ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ০৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
পরদিন ভোরের ট্রেনে শুভ নুহাকে নিয়ে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। দুপুর নাগাদ নরসিংদী এসে পৌঁছে ওরা। নরসিংদী থেকে রুহুলের ফ্রেন্ডকে সাথে করে নিয়ে শুভ রওয়ানা দেয় গাজীপুরের উদ্দেশ্যে। যেহেতু শুভ ছোট্ট নুহাকে ভরসা করতে পারছিল না। পথিমধ্যে শুভ নুহাকে প্রশ্ন করে —
‘ আচ্ছা, তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়?’
জবাব আসে, গাজীপুরের শ্রীপুর।
তুমি কি জানো গাজীপুরের একজন কীর্তি সন্তান ছিল? যিনি তার কর্মগুনে আজো স্মরনীয় হয়ে আছেন?
শুভর এমন প্রশ্নে নুহার জটপট জবাব ছিল, তাজউদ্দীন আহমেদ।
আচ্ছা, শ্রীপুর অর্থ কি জানো?
এবারো নির্লিপ্ত কন্ঠে নুহার জবাব, এককভাবে শ্রীপুরের কোন অর্থ আমার জানা নেই। তবে আমার মতানুসারে যদি বলি তাহলে বলবো শ্রী অর্থ সুন্দর আর পুর অর্থ পরিপূর্ণ। অর্থাৎ শ্রীপুর অর্থ সুন্দরে পরিপূর্ণ।
এমন তাৎক্ষণিক জবাবে মুগ্ধ শুভ তাকিয়ে আছে নুহার দিকে। ভাবা যায় এরকম একটা পিচ্চি মেয়ে একাধারে এতগুলো গুনের অধিকারি? ঘোর লেগে যায় শুভর। এক মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই সে জড়িয়ে যাচ্ছে আরো মুগ্ধতার আবেশে। মুগ্ধতার এ রেশ কবে, কখন কাটবে সেটা শুভ নিজেও জানে না।
যায় হোক। যে কথাটি বলছিলাম। বিকেল ৩টা নাগাদ শুভ নুহাদের গ্রামে পৌঁছে। বাসার পাশে এসে নুহাকে নামিয়ে দেয়া হয়। তারপর গাড়ি উল্টো দিকে মোড় নেয়। যদিও শুভর ইচ্ছে ছিল নুহাকে বাসায় অবধি পৌঁছে দিয়ে আসা। কিন্তু রুহুলের বন্ধু আতিকের জন্য সামনে আগাতে আর সাহস পায়নি শুভ। আতিকের ভাষ্যমতে,
‘ শুভ ভাই আর সামনে যাবেন না। শুনেছি এ এলাকার মানুষ ভালো না। অনর্থক ফাসিয়ে দিবে আপনাকে। তাই সেধে সেধে এভাবে বিপদ ডেকে আনার কোন মানেই হয় না। চলুন। যাওয়া যাক।’
আতিকের কথা শুনে আর সামনে এগিয়ে যায়নি শুভ। কোন কথা না বাড়িয়ে আতিকের গাড়িতে গিয়ে বসে। গাড়ি স্টার্ট দেয় আতিক। স্তব্ধ নুহা রাস্তার পাশে তেতুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু একটু করে চোখের আড়াল হয়ে যায় গাড়িটি। বুকের ভেতর ধুরমুশ পেটাতে শুরু করে নুহার। সাহস পাচ্ছে না বাসার দিকে এগুনোর। কোন মুখে এগুবে আর কিবা বলবে সেটা ভেবেই কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে নুহার।
এদিকে কেউ একজন নুহাকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাসায় গিয়ে খবর দেয়। খবর পেয়ে ছুটে আসে নুহার আশপড়শি চাচি জ্যাঠিমাসহ আপন দাদীমা। ছুটে আসে একমাত্র প্রাণের ভাই নিলয়। নুহার দাদীর চিল্লানো শুনে ছুটে আসে পাড়া প্রতিবেশী।
নুহার দাদীর একটাই প্রশ্ন ছিল। আর সেটা হলো – “সম্মান সব ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়ে এখন এখানে এসে দাঁড়িয়েছিস কোন মুখে?” এছাড়াও নুহাকে সম্মুখীন হতে হয়েছে পাড়া প্রতিবেশীদের অপ্রিয় কিছু প্রশ্নের। বুকে সাহস সঞ্চয় করে ভিষণ ধৈর্য্য সহকারে নুহা তুলে ধরে গত ২দিনে ওর সাথে ঘটে যাওয়া নানা অপ্রীতিকর ঘটনার কথা। তুলে ধরেনি শুধু বিয়ের কথাটা। পুরো ২দিনের ঘটনার মধ্যে একই রুমে রাত্রি যাপন আর বিয়ের কথাটা নুহা গোপন রাখে সবার থেকে। তারপরও নুহাকে শুনতে হয়েছে ভিষন অপ্রিয় কিছু কথা। যে কথা গুলো শুনে নুহা রাগে ফেটে পরছিল। কিন্তু পরমুহূর্তে মাটির দিকে তাকিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করে। আল্লাহ, আল্লাহ করতে করতে সে স্থান ত্যাগ করে বাসায় চলে যায় নুহা।
মাগরিবের নামাজ পড়ে অনেকটা অপরাধীর ন্যায় মাথানিচু করে চুপচাপ রুমে বসেছিল নুহা। তখনি ভিতরে ঢুকে ২জন পড়শি। খুটিয়ে খুটিয়ে নুহার পা থেকে মাথা পর্যন্ত বাকা দৃষ্টিতে দেখে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে। নুহা মহিলা দুজনের সবগুলো প্রশ্ন পরম ধৈর্য্য সহকারে দেয়। নুহার সুন্দর গুছানো জবাবে ওরা সন্তুষ্ট নয়। আর তাই কথার প্যাঁচে ফেলার জন্য বিভিন্ন এঙ্গেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে বাচ্চা মেয়েটাকে। ছোট্ট নুহা সুন্দর গুছানো জবাব দ্বারা প্রতিবারই পরম ধৈর্য্যের পরিচয় দেয়। সবশেষে ব্যর্থ হয়ে কানাঘুষা করতে করতে মহিলা দুটো চলে যায়।
পরদিন স্কুলে গেলে নুহাকে সম্মুখীন হতে হয় শিক্ষকদের নানান প্রশ্নের। মুখোমুখী হতে হয় ক্লাসমেটসহ বড় আপুদের টিপ্পনীমূলক বাক্যের। সেই সাথে হতে হয় সবার উপহাসের পাত্রী। দুর থেকে বান্ধবীরা ওকে দেখে হাসাহাসি করত। হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর ঢলে পড়ত। ওকে নিয়ে কানাঘুষা করত। নুহা সেসব দেখেও না দেখার ভান করত। তবে ভিতরে ভিতরে ও খুব কষ্ট পেতো। কারণ ওর সকল বন্ধুরা একটু একটু করে ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। কাছের যে তিনজন বান্ধবী ছিল তাদের মধ্যে ২জনই নুহাকে নিয়ে খেয়ে ছেড়ে দিয়েছে টাইপের মন্তব্য করেছে। খুব কাছের মানুষের দেয়া আঘাত সহ্য করার মত ক্ষমতা কারো নেই। নুহাও পারেনি। একটু একটু করে ও সকলের থেকে আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে গেছে বললে ভুল হবে ওকে আলাদা করে দেয়া হয়। মুখে না বললেও ওর ক্লাসমেটরা ওকে ইশারাতে বুঝিয়ে দিত, যে মেয়ে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে টানা তিনদিন দু’রাত বাহির দেশে পরপুরুষের সাথে কাটাতে পারে সে আর যায় হোক আমাদের ফ্রেন্ড হওয়ার যোগ্য নয়। নুহাও ওদের ইশারা বুঝে গিয়েছিল। আর তাইতো স্কুলে গেলেও কারো সাথে তেমন মিশত না। সবসময় ক্লাসমেটদের থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ দূরত্ব বজায় রেখে চুপটি করে বসে থাকত। মন খারাপের অনেকগুলো টিফিনের মুহূর্ত নুহা কাটিয়েছে কমনরুমের কর্নারের জানালার পাশের বেঞ্চটিতে বসে বাহির পানে তাকিয়ে।
নুহার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী একমাত্র শুভাকাঙ্খী জান্নাত জানিয়েছে, “আমি আমার বান্ধবীকে একবছরের মধ্যে হাতে গুনা তিন চার দিন ছাড়া বাকি সময়গুলো আনমনে জানালার পাশে বসে ডায়েরী লিখে সময় কাটাতে দেখেছি। হাসিখুশি প্রাণ চঞ্চল মেয়ে যার কাজই ছিল ছোট বড় সবাইকে পাঁকা পাঁকা কথা দ্বারা উপদেশ দেয়া। যে সবসময় চারপাশটা মাতিয়ে রাখত। মানুষের মন মুহূর্তেই ভালো করে দেয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে যে মেয়েটি জন্মেছিল। যাকে স্কুলে অনেকেই মন খারাপের ঔষধ বলে ডাকত। যার কাজই ছিল হাসাহাসি করা। নিজে হাসবে সেই সাথে অন্যকে হাসাবে। সেই মেয়েটাকে আমি দেখেছি। আমি দেখেছি সেই মেয়েটা কিভাবে একটু একটু করে বিষণ্নতাকে বরণ করে নিয়েছে। নুহার ঠোঁটের কোণের হাসিটা একেবারে ম্লান হয়ে যেতে দেখেও আমি চুপ করে ছিলাম। কিন্তু যেদিন আমাদের জেসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল সেদিন আমি স্কুল থেকে ওদের বাসার পিছন দিয়ে যাচ্ছিলাম। নুহা পুরো গাজীপুরের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। সেটা নুহাকে জানানোর জন্য আমি ওদের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়। নাম ধরে ডাক দেবো তখনি শুনতে পেলাম ওর আপন দাদী ওকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেছে। আর নুহা সেটা সইতে না পেরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সেদিনই মনে হলো সময় হয়েছে এবার ওর জন্য কিছু করার। আর সেই মতেই আমি নুহার ছোট ভাই নীলয়ের থেকে আবির আঙ্কেলের নাম্বারটা যোগার করি।”
হু, যা শুনতেছিলেন। জান্নাত উপস্থিত বুদ্ধির জোরে আবিরের নাম্বারটা সংগ্রহ করে ঐ নাম্বারে একটা মিসড কল দেয়। সেদিন বিকেলেই আবির কল করে। ইতস্তত জান্নাত প্রথমেই সুন্দর করে নিজের পরিচয় দেয়। অতঃপর সকল প্রকার লজ্জা ভয়কে দুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বুকে সাহস সঞ্চয় করে। নির্লিপ্ত কন্ঠে আবিরকে জানায় নুহার সাথে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার কথা। আরো জানায় বিগত একটা বছর নুহা কিরকম মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছে।
একমাত্র মেয়ের কাছের বান্ধবী জান্নাতের থেকে এমন ধরনের অপ্রিয় সব কথা শুনে আবির যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে আবির ওর বিশস্ত এক বন্ধুকে ওর এলাকায় ডেকে পাঠায়। আবিরের কথামত ওর ঐ বন্ধুটি শ্রীপুর আসে। বিয়ের জন্য পাত্রী হিসেবে নুহা মেয়েটা কিরকম এটা আবিরের বন্ধু আশপড়শি মহিলাদের জিজ্ঞেস করলে গ্রামের মহিলারা নুহা প্রসঙ্গে ভিষণ বাজে কথা শুনিয়ে দেয়। আবিরের বন্ধুটি ফিরে যায়। কল করে আবিরকে পুরো বিষয়টা জানায়।
চিন্তিত আবির সেদিন রাত্রে কল করে হিয়াকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করে হিয়া ওর কলেজ শিক্ষক আবিরকে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দেয়। জানতে চায় বান্ধবীর বর্তমান অবস্থার কথা। হিয়ার কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবির পাল্টা প্রশ্ন করে ওকে। ” ভিষণ বিপদে পড়ে তোমার শরণাপণ্ন হওয়া। তুমি কি আমায় হেল্প করবে?”
লজ্জা পেয়ে যায় হিয়া। ছি! ছি স্যার! এভাবে কেন বলছেন? আপনি আমার গুরুজন। আর গুরুজনের জন্য কিছু করতে পারা তো পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। স্যার, আপনি শুধু আদেশ করেন কি করতে হবে। আমি প্রাণ দিয়ে হলেও সে কাজটা করার চেষ্টা করব।
আবির হিয়াকে পুরো ঘটনা জানায়। আবির আরো জানায়, নুহাকে সে ঢাকায় নিরাপদে হিয়ার বাসায় রাখতে চাচ্ছে।
প্রথমে নুহার সাথে করা অন্যায়গুলোর জন্য মন খারাপ হলেও পরে যখন জানতে পারে নুহা ওর মেয়ের সাথে ওর বাসায় থাকবে তখন আনন্দে চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে হিয়ার।
স্যারকে আশস্ত করে হিয়া পরদিন ভোরে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায় গ্রাম থেকে নুহাকে আনতে। আবিরের কথা মতো নুহা স্কুল থেকে সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র এনে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রাখে। প্রাণের আন্টি হিয়াকে দেখা মাত্র’ই দুতলা বাসার নিচে নেমে আসে। নিচে নেমে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে হিয়ার সাথে কুশল বিনিময় করে। ‘ওরে আমার মা’টা তো দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছে’ কথাটা বলেই একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে হিয়া বুকে জড়িয়ে নেয় নুহাকে।
নীলিমার শাশুড়ি ওরফে নুহার দাদীমার থেকে বিদায় নিয়ে হিয়া তারই কলিজার টুকরা জুনিয়র নীলিমাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। বিকেল ৫টা নাগাদ নুহাকে সাথে করে নিয়ে ঢাকায় নিজ বাসায় এসে পৌঁছে হিয়া। নুহা গাড়ি থেকে নামলে একটা মিষ্টি হাসি দেয় হিয়া। বাসায় এসে গেছি মা। চলো, চলো। নিশ্চুপ নুহা নিঃশব্দে হিয়াকে অনুসরন করে দোতলা বাসার উপরে উঠে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপে হিয়া। পরপর কয়েকবার কলিং বেল চাপার পর দরজা খুলে কাজের মহিলা শিরি। নুহাকে দেখেই একটা হাসি দেয় মহিলাটা। ওহ, নতুন সতীন এসে গেছে আমার? হেসে দেয় হিয়া। স্মিতহাস্যে নুহার দিকে তাকিয়ে বলে, নুহা মা! ইনি তোমার দাদীমা হয়। জিজ্ঞেস করো কেমন আছে?
সালাম দিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে নুহা কুশল বিনিময় করে মহিলাটির সাথে।
হঠাৎ করেই পাশের রুম থেকে বাচ্চার কান্নার স্বর ভেসে আসে। ড্রেস চেঞ্জ করতে করতে হিয়া ডাকতে থাকে। শুভ, শুভ কইরে তুই? আদনান তো পুরো বাসা মাথায় তুলে নিয়েছে কান্না করে। একবার দেখা দিয়ে যা। প্রতিউত্তরে ওয়াশরুম থেকে ভেসে আছে- ‘আমি গোসল করতেছি ফুপ্পি। দাদীমাকে বলো একটু কোলে নিতে।’
ক্ষাণিক বাদে শরীরে কোন রকম তোয়ালে প্যাঁচিয়ে হাত দিয়ে চুল থেকে পানি ফেলতে ফেলতে রুমে ঢুকে শুভ। কোথায় আমার বাবাটা? বাসা নাকি মাথায় তুলে ফেলেছ? কথাটা বলে সামনে তাকাতেই ভূত দেখার ন্যায় চমকে যায় শুভ।
চলবে…..