ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ২৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
কুটকুট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আবিরের। কি হলো? আলমারির কাছে কি শব্দ হচ্ছে? ইঁদুর নয়তো? হুট করে লাইটটা জ্বালিয়ে দেয় আবির। আলমারির দিকে তাকিয়ে ‘থ’ হয়ে যায় আবির। আলমারির পাশেই ছোট্ট সোফায় বসে কলার খোসা ছাড়িয়ে আপনমনে কলা খাচ্ছে নীলিমা।
হেসে দেয় আবির, তুমি? ভড়কে যায় নীলিমা। তাড়াতাড়ি ফলের কার্টুনটা পিছনে লুকিয়ে ফেলে।
আবির হাঁটতে হাঁটতে নীলিমার কাছে চলে যায়। ‘কি ব্যাপার? অন্ধকারে বসে আছো যে?’ মুহূর্তেই বলে উঠে নীলিমা, আমি কিছু খাইনি। হা, হা করে অট্টোহাসিতে মেতে উঠে আবির। এ যেন সেই পুরনো প্রবাদ, ‘ঠাকুর ঘরে কে’রে, আমি তো কলা খাইনি’ কথাটার মতই। কথাটা বলে থতমত খেয়ে যায় নীলিমা। আবিরের হাসি শুনে টের পায় কত বড় বোকামীর পরিচয় দিয়েছে। বোকামীর জন্য আনমনে নীলিমা নিজে নিজেকেই গালি দিচ্ছে।
হাসি থামালো আবির। নীলিমার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পরল। মৃদু হেসে প্রশ্ন করল- ‘খিদে পেয়েছে, খাবে। এজন্য এত ভয় পাওয়ার কি আছে?’
লাইট’টা জ্বালিয়ে ধীরে সুস্থে বসে খেলেই তো হতো। অত্যন্ত নীচু গলায় নীলিমার জবাব, না মানে আপনি ঘুমুচ্ছিলেন তো তাই ঘুমের ডিস্টার্ব হবে ভেবে লাইটটা জ্বালাইনি।
ওকে, ফাইন। হয়েছে তো। এবার তো কার্টুনটা সামনে আনো…..!!!
নীলিমা কার্টুন’টা সামনে এনে আপনমনে খাওয়া শুরু করছে, আবির চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে নীলিমার খাওয়া দেখছে। একটা সময় তৃপ্তির ঢেকুর তুলে উঠে দাঁড়ায়। বসা থেকে উঠে নীলিমার একটা হাত ধরে আবির। ধীর পায়ে নীলিমা বিছানার দিকে এগুচ্ছে।
বিছানায় শুইয়ে দেয় আবির নীলিমাকে। তারপর লাইটটা অফ করে নিজেও গিয়ে শুয়ে পড়ে নীলিমার পাশে। অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে আছে আবির। মিনিট ত্রিশেক এভাবে শুয়ে থেকে ঘুরে শুয়ার জন্য নীলিমার দিকে ফিরে তাকাতেই চমকে যায়। ড্রিমলাইটের মৃদু আলোয় আবির দেখতে পায় নীলিমা কেমন ঢ্যাবঢ্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে। ‘ঘুমাওনি এখনো?’
মাথাটা আংশিক তুলে প্রশ্ন করে আবির।
‘উহু, ঘুম আসছে না উত্তর দেয় নীলিমা।’
মৃদু হেসে আবির এগিয়ে যায় নীলিমার দিকে। স্পর্শ করে নীলিমার গাল, এলোমেলো চুলগুলো গুজে দেয় কানের পাশে। কপালে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দিয়ে টেনে নেয় বুকে, ভালোবাসার সাথে মাথায় হাত বুলাতে থাকে। ঘুমিয়ে পড়ে নীলিমা, ওর ভারী হয়ে গরম নিশ্বাসগুলো তার’ই ইঙ্গিত দিচ্ছে। একহাতে আবির ওর পাশে রাখা চাদরটা নীলিমার গায়ে জড়িয়ে দেয়। মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে আবির নীলিমার কপালে আবারো ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। মুখে মৃদু হাসির রেখা নিয়েই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে আবিরও।
নীলিমার গর্ভের সময়কাল ৭মাস__
হাত পা গুলো অসম্ভব রকমের ফুলে যায় ওর। পা’গুলো ফুলে তো তালগাছের মতই হয়ে গিয়েছিল। নড়াচড়া করতে খুব কষ্ট হতো বিধায় কিচেনে কোনো রকম রান্না বসিয়ে দিয়ে বেশীর ভাগ সময় রুমে এসে বসে থাকত। কখনো কখনো লুকিয়ে লুকিয়ে আবিরের কিনে আনা ফলমূল, দুধ কখনো বা মায়ের পাঠানো গম+ডাল+চাল+চিনি মিশ্রিত গুড়ো খেতো। নজর এড়ায় না শাশুড়ির। এ নিয়ে অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দেয় নীলিমাকে। ওনার এক কথা, মা ওনিও হয়েছেন। এভাবে খাই, খাই করেননি কখনো। একবেলা খেয়ে আরেকবেলা না খেয়ে থেকেছেন। নীলিমার ভাষ্যমতে, খাওয়া নিয়ে আমার শাশুড়ি আমাকে যতগুলো কথা শুনিয়েছেন ততগুলো কথা বোধ হয় আমি কালো হয়ে জন্ম নেওয়া’তেও শুনিনি।”
সেদিন নীলিমার শরীরটা প্রচন্ড খারাপ লাগছিল। এই সময় বাসার কাজের লোক তাড়িয়ে দেয়ার জন্য মনে মনে বাসার সকলকে বকে এক করে ফেলে আবির। চাল, ডাল, গম, চিনির যৌথ মিশ্রণে তৈরি পুষ্টিকর খাবার নীলিমাকে খাইয়ে দিয়ে, প্লেটে কিছু ফল ধুয়ে নীলিমাকে খেতে বলে, সকালের ব্রেকফাস্ট তৈরি করার জন্য দ্রুত কিচেনের দিকে পা বাড়ায় আবির। দ্রুত বাবা মায়ের পছন্দের খাবার তৈরি করে নীলিমার জন্য ভাত বসিয়ে দেয়। নীলিমার আবার ভাত হলে কিচ্ছু লাগে না। বড্ড খেতে চায় মেয়েটা। কিন্তু খাবার সামনে নিলে একমুঠো ভাতের বেশী খেতে পারে না। যাও খায় সেটা আবিরের জুড়াজুড়িতে। ভাত বসিয়ে দিয়ে দ্রুত তরকারী কুটছিল আবির। পিছন থেকে কিচেনে ঢুকে ওর মা। আবির তরকারী কুটে চুলোয় তরকারী বসিয়ে দিয়েছে। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে মা, ছেলের পাক্কা রাধুনীর মত রান্না করার দৃশ্য দেখে নিঃশব্দেই আবার কিচেন থেকে প্রস্থান করেন। কিচেন থেকে বেরিয়ে উগ্র মেজাজ নিয়ে সোজা আবিরের রুমে ঢুকেন। নীলিমা তখন খাটে হেলান দিয়ে বসে এক একটা করে আঙুর মুখে দিচ্ছিল। হঠাৎ’ই পায়ের শব্দ পেয়ে দরজার দিকে তাকায়। আচমকা শাশুড়িকে থেকে থতমত খেয়ে যায় নীলিমা। হাত থেকে ফলটা পরে যায়। কাছে আসেন আবিরের মা। তাচ্ছিল্যের হাসি এসে বলেন, কালে কালে আরো কত কি দেখতে হবে! বউ নবাবজাদির মত পালংকে শুয়ে থাকবে আর জামাই গিয়ে রান্না করবে….!!!
হায়রে, একটা বাচ্চা পেটে ধরে মনে হচ্ছে বিশ্বজয় করে ফেলেছে। ভয়ে ঢোক গিলে নীলিমার জবাব, মা! শরীর’টা খুব দুর্বল দুর্বল লাগছিল তাই……
হাত উঁচু করে নীলিমার শাশুড়ি ওরফে আবিরের মা। তারপর মুখ বাঁকিয়ে বলে,
” এ্যা, দুর্বল লাগে…!
সারাদিন শুয়ে বসে থেকে বলে দুর্বল লাগে। ওরে, পেটে আমিও বাচ্চা ধরেছিলাম। তোমার মত এত পায়ে পা তুলে শুয়ে থাকিনি। ৭মাসের বাচ্চা পেটে রেখেও রান্না করছি, কুয়া থেকে পানি তুলে আনছি, ঢেকিতে ধান বানছি। অথচ কোনো নিচু বংশ থেকে আসিনি আমি। নামকরা পুরনো ধনী ছিলেন আমার দাদা। তার’ই সন্তান আমার বাবা। মঠখোলাতে বিরাট বড় কাপড়ের দোকান ছিল ওনার। বছর শেষেও ঢুলি ভরা ধান, গম থাকত’ই। এত বড় খানদানি বংশের মেয়ে হয়েও শ্বশুর বাড়িতে দিন কাটিয়েছি খেয়ে না খেয়ে। আর ওনি খাবারের নিচে ডুবেই থাকেন সব সময়। কাজের বেলায় যত অজুহাত।”
অনেকগুলো তিক্ত কথা শুনান আবিরের মা নীলিমাকে। কারো পায়ের আওয়াজ শুনে দ্রুত বের হয়ে যান রুম থেকে। খাটে মাথা রেখে দু’চোখের নোনাজল ছেড়ে দেয় নীলিমা। রুমে প্রবেশ করে আবির। আবিরের আসার শব্দ পেয়ে দ্রুত চোখের জল মুছে নেয় নীলিমা।
“কি ব্যাপার? এভাবে শুয়ে আছ কেন?”
বলেই কাছে আসে আবির। ফলের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলেন, কি হলো? এগুলো খাওনি যে? ভেঁজা গলায় নীলিমার জবাব- খেয়েছি, আর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। একটু পরে খাই? মুখে হাসির রেখা ফুঁটিয়ে তুলে আবির, ঠিক আছে। এখন একটু রেস্ট নাও। একটু পর ভাত খাইবা। তারপর ভরা পেটে ফলগুলো খেয়ে নিও। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় নীলিমা। ‘আচ্ছা, আমি মা বাবাকে বলে আসি ব্রেকফাস্ট করে নিতে।’
চলে যাচ্ছিল আবির, ফিরে আসে।
‘ আচ্ছা! মাকে দেখলাম এদিকে থেকে যেতে।” মা কি রুমে আসছিল নাকি? মাথা নাড়ে নীলিমা, ‘জ্বি, আসছিলেন।’
উতলা কন্ঠে প্রশ্ন করেন আবির-
“মা, আজকেও তোমাকে প্রাচীনকালের কাহিনী বলে চড়া কথা শুনিয়েছে?”
হেসে দেই নীলিমা,
” কি যে বলো না! ওনি কেন কথা শুনাবেন? ওনি তো আসছিলেন বলতে এভাবে শুয়ে বসে না থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করতে। এতে আমার ভালো হবে।”
মুখ থেকে চিন্তার ছাপ সরে যায় আবিরের। কারণ- ও জানে ওর নীলিমা কখনো ওকে মিথ্যে বলবে না, বলতে পারেই না। মুখে মৃদু হাসির রেখা নিয়ে নীলিমার কপালে একটা আলতো করে চুমুর পরশ এঁকে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় আবির।
আবির চলে যাওয়ার পর প্রত্যেক বারের পর আজও নীলিমা বলে উঠে,
” ক্ষমা করো আমায়। এ নিয়ে শতেক বার মিথ্যে কথা বললাম তোমায়। কিন্তু কি করব বলো? আমার যে এর ছাড়া কোনো তোমায় নেই। এসব কথার জের ধরে সংসারে ভাঙোক ধরোক এটা আমি কোনো কালেই চাইতে পারব না। হাজার হোক শাশুড়ি তো। শাশুড়ি তো মায়ের’ই সমান। মা সন্তানকে কতকিছুই তো বলতে পারে, সেগুলো মনে ধরলে চলবে কিভাবে? আর তাছাড়া ওনি বুড়ো হয়ে গেছেন। বয়স হয়েছে। এখন একটু আধটু এসব বলবে। এসব মনে নিয়ে বসে থাকলে যে হয় না। কারণ, আমরা মেয়েজাত…”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় নীলিমা। ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে দেয়, দুর অজানায়…..
ক্ষাণিক বাদে’ই মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠে নীলিমার। টেবিলের উপর ঢেকে রাখা দুধের গ্লাসটা হাতে নিয়ে একচুমুকে সবটুকু দুধ খেয়ে ফেলে।
“আর যায় হোক!
এম.বি.বি.এস নীলিমার সন্তান কখনো অপুষ্টিতে ভুগতেই পারে না…..”
কথাটা বলে একটা রহস্যজনক হাসি দেয় নীলিমা…..
চলবে…..