ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ১৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
” বাপ তুই নাম।
আমি কিছুক্ষণ হাইসা লই।”
কথাটা বলে হু, হু করে হেসে উঠে আদিত্যর বাবা। তার সাথে সাথে হেসে উঠে আদিত্যর দাদা-দাদী, হেসে উঠে আদিত্যর ছোট কাকা ও তার স্ত্রী। মোটামুটি সবার মুখেই হাসি, শুধু হাসি নেই আদিবার মুখে। ভাই আবির যে এমন কান্ড করবে সেটা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। অথচ তাই হয়ে গেল, শেষমেষ বউ চুরি করে নিয়ে গেল। লজ্জায় কুঁকড়ে যায় আদিবা কিন্তু হেরে যেতে রাজি নন। দৌঁড়ে বাড়ির পিছনে জাম গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ান। ততক্ষণে আবির নীলিমাকে কোলে নিয়ে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কাছে চলে গেছে। আদিবা একদৌঁড়ে গাড়ির কাছে যায়। আবির ততক্ষণে গাড়ির ভিতরে বসিয়ে দিয়েছে নীলিমাকে।
” ঐ বদমাইশ! তুই বউরে নিয়া কই যাস? নীলিমা বেরিয়ে আসো।”
গাড়ির ভিতরে হাত দিয়ে আবিরের বোন আদিবা নীলিমাকে টানছে কিন্তু নীলিমার কোনো সাড়া নেই। সাড়া দিবে কিভাবে? পিছন থেকে হঠাৎ মুখ বেধে ফেলা, তারপর আচমকা পিছনে তাকিয়ে আবিরের গায়ের সাদা গেঞ্জিতে কঙ্কাল এবং তার সাথে লাল জিহ্বার ছাপ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল নীলিমা। যদিও ভূত-প্রেতে ওর বিশ্বাস নেই কিন্তু গত পরশুদিন দুপুরে পুকুরপাড়ে ঘুরতে গিয়ে এক অচেনা যুবকের ঝুলন্ত ভয়ানক লাশ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আজ তাই মুখ বাধার পর আবিরের গেঞ্জির কঙ্কাল এবং লাল জিহ্বার ছাপ দেখে ভয় পেয়ে জ্ঞান হারায়। আদিবা যখন নীলিমাকে ধরে টানাটানি করছিল, তখন পিছন থেকে আদিত্যর বাবা এসে স্ত্রীকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে শ্যালক আবিরের উদ্দেশ্যে বলে-
” ওরে গাধা! তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দে।”
আবির গাড়িতে উঠে তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দেয়। বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে বেশ ক্ষাণিকটা দুরে গিয়ে গাড়ি থামায়। বোতল থেকে পানি নিয়ে নীলিমার চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয়। জ্ঞান ফিরে নীলিমার। আবিরের দিকে একবার তাকিয়ে গেঞ্জির দিকে তাকায় সে। তারপর’ই কেমন ঢোক গিলে। মূল কাহিনী বুঝতে পারে আবির। শরীর থেকে গেঞ্জিটা খুলে ফেলে আবির। গাড়ি পুনরায় স্টার্ট দিবে আবির, তখনি একটান দিয়ে মুখ থেকে বাধনটা খুলে ফেলে নীলিমা। এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারে এখনো তেমন রাত হয়নি। গ্রামের বাজারে টং দোকানে তখনো মানুষজন বসে চা খাচ্ছিল। তারমানে আমি এখন চিৎকার দিলে মানুষ আসবে!
আবিরের দিকে একবার তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে নীলিমা,
কেউ আছেন….!!!
পানি খাচ্ছিল আবির। মুখ থেকে পানি ছিটকে পরে যায়। মুখ চেপে ধরে নীলিমার-
” চুপ! একদম চুপ!”
বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে নীলিমা। আবির তখনো মুখটা চেপে ধরে আছে। নীলিমা কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। হাতটা সরিয়ে নেয় আবির। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে নীলিমা। গাড়ি স্টার্ট দেয় আবির। গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। কিছুক্ষণ পর মুখ খুলে নীলিমা-
” আমায় নামিয়ে দেন নতুবা আমি লোক ডাকব।”
গাড়ি থামায় আবির,
নীলিমাকে অবাক করে দিয়ে চেঁচাতে থাকে আবির-
” বাঁচান! বাঁচান! হেল্প! হেল্প! এক বদমাইশ আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্লিজ, হেল্প মি।”
চোখ বড় বড় করে তাকায় নীলিমা।
একটা শয়তান মার্কা হাসি দিয়ে বলে,
কি হলো? লোক ডাকো। আমি তো শুরু করে দিলাম….. রাগে দুঃখে দাঁতে দাঁত চেপে অন্য দিকে মুখ করে তাকায় নীলিমা। জয়ের হাসি হেসে গাড়ি চালাতে শুরু করে আবির। মাঝ রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ’রা আবিরের গাড়ি থামায়। সামনে আরো অনেক গাড়ি, সিরিয়ালের সবচেয়ে শেষে আবিরের গাড়িটা। ঘন্টা দু’য়েক যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে সেটা আবির বেশ বুঝতে পারছে। এদিকে চারিদিকে যেন বরফ পরছে। গাড়ির কাঁচ ভেঙে মনে হচ্ছে সেগুলো ভেতরে চলে আসবে। নীলিমার গায়ে শীতের চাদর ছিল বিধায় দিব্যি বসে আছে কিন্তু বেচারা আবির? শীতে ওর যায় যায় অবস্থা….
শীতে দু’হাত একসাথে করে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। প্রচন্ড শীতে কুকড়ে যাচ্ছে আবির। একবার হাতে হাত ঘষাচ্ছে তো আরেকবার পাশে রাখা ঐ হাতাকাটা গেঞ্জি দিয়ে শরীর ঢাকার চেষ্টা করছে। পাশ থেকে অফার করে নীলিমা।
” এটা নিন।”
ফিরে তাকায় আবির। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে-
” চাদর তো একটা। এটা নিয়ে নিলে তুমি কি গায়ে দিবে?”
মাথা নিচু করে জবাব দেয় নীলিমা, আমার আসলে তেমন শীত করছে না এখন। আপনি গায়ে দিন।
জবাব দেয় আবির-
” চাদরটা নিতে পারি এক শর্তে…”
জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকায় নীলিমা। ক্ষাণিক মাথা চুলকিয়ে আবির বলে- না মানে তুমি যদি আমার সাথে চাদরের নিচে আসো,
তবেই আমি তোমার চাদর নিব।
” Impossible….!”
কথাটা বলেই অন্যদিকে মুখ করে বাইরে তাকায় নীলিমা। আবিরও আর কিছু বলেনি। শুধু জড়োসড়ো বসে আছে। কেটে যায় মিনিট দশেক। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে নীলিমা। এদিকে রাত যত বাড়ছে শীতের প্রকোপটাও ততই বাড়ছে। শীতের দাপটে দাঁতে দাঁত লেগে আসে আবির।
প্রচন্ড শীতের যন্ত্রনায় “উহ” করে উঠে আবির। পাশ থেকে একটু একটু করে এগিয়ে আসে নীলিমা। আসতে আসতে আবিরের একদম কাছে চলে আসছে। সেটা দেখেও আবির না দেখার ভান করে বিপরীতমুখী তাকিয়ে আছে। গায়ের চাঁদর’টা নিজহাতে আবিরের শরীরে জড়িয়ে দিয়ে তার ভিতরে গিয়ে চুপটি করে বসে। নড়ে বসে আবির। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠে। জাপটে ধরে নীলিমাকে। আবিরের ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় শিহরিত হয়ে উঠে নীলিমা। কিন্তু মুখে কোনো রাগ দেখায়নি। কারন, রাগ দেখালে আবির যদি চাঁদরের নিচ থেকে বেরিয়ে যায় তাই। এদিকে আবির?!
এক হাতে নীলিমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে নীলিমার মুখের উপর সরিয়ে ছিটিয়ে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুজে দেয়। তারপর মুখটা নীলিমার ঘাড়ের কাছে নিয়ে যায়। নাক ডুবিয়ে দেয় নীলিমার ঘাড়ে। কেঁপে উঠে নীলিমা কিন্তু সরে যায় নি। আবির যেন সেই সুযোগের’ই সদ্ব্যবহার করছে। ঘাড় থেকে মুখটা সরিয়ে নেয় আবির। একটানে নীলিমাকে ওর দিকে ফিরিয়ে নেয়। নীলিমার গালের পাশে আবির ওর আঙুল দ্বারা ভালোবাসার রেখা টেনে দিচ্ছে, শিহরিত নীলিমা পরম সুখে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। নীলিমাকে কাছে টানে আবির। কপালে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। চোখ খুলে আবিরের দিকে তাকায় নীলিমা। একটা হাসি দিয়ে বুকে টেনে নেয়।
গাড়িতে জোরে জোরে টোকা দেয়া হচ্ছিল বাহির থেকে। ঘোর কাটে নীলিমার। আবিরের থেকে ক্ষাণিকটা দুরে সরে মাথা নিচু করে রাখে। চেঁচিয়ে উঠে গাড়ি থেকে মাথা বের করে আবির-
” ও ভাই! কি শুরু করছেন? শান্তি মতো একটু রোমাঞ্চও করতে দিবেন না নাকি?”
কথাটা বলে পুলিশের দিকে তাকাতেই চমকে যায় আবির, আরে সজিব? তুই?
আবিরও মতো বন্ধু সজিবও চমকে উঠে প্রশ্ন করে-
” আরে আবির না? কেমন আছিস? আর তুই এত রাত্রে এখানে?”
পুরো ঘটনা সংক্ষেপে সজিবকে জানায় আবির। নীলিমার সাথে কথা বলার জন্য গাড়ির ভিতরে তাকায় সজিব_
” আরে ভাবি?! কি করছেন? ঠোঁটে কি চুইংগাম লাগছে নাকি? এভাবে ঘষাচ্ছেন কেন?”
প্রচন্ড রাগে আবিরের দিকে তাকিয়ে কেঁদে দেয় নীলিমা। সজিব ঘটনা কি বুঝার জন্য আবিরের দিকে তাকায়। আবির ইঙ্গিতে ওর ঠোঁটে হাত দিয়ে চোখ টিপ মারে সজিবকে। বিষম খায় সজিব। হাসি আটকিয়ে বলে- আসলে খবর পেয়েছি এ এলাকা থেকে মাদকদ্রব্য চালান হয়। তাই এভাবে জেরা করা আর কি….
আচ্ছা তুই ভিতরে গিয়ে বস। আমি ওদের গিয়ে বলছি তোকে তাড়াতাড়ি দেখে ছেড়ে দেয়ার জন্য।
সমস্ত ঝামেলা কাটিয়ে রাত্রি আড়াইটার দিকে বাসায় গিয়ে পৌঁছে আবির।
আহ! ফ্রেস হয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয় নীলিমা। এদিকে আবির?
ওর দুলাভাইকে ফোন করে বাসায় আসার কথা জানিয়ে রুমে প্রবেশ করে। রুমে এসে নীলিমাকে না দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। স্টাডিরুমে কেবল শুয়েছিল নীলিমা। দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে একটানে নীলিমাকে উঠিয়ে দেয়। চোখ বড় বড় করে তাকায় নীলিমা। কোনো কথা না বলে টানতে টানতে আবির নীলিমাকে ওর রুমে নিয়ে যায়। হাতটা ছাড়িয়ে ‘আমি ঘুমাবো’ এটা বলে চলে যাচ্ছিল নীলিমা। পিছন থেকে ওড়নায় টান দিয়ে ধরে আবির। একহাতে গলার কাছে চলে আসা ওড়নার মাথায় ধরে বিপরীতমুখী হয়েই প্রশ্ন করে নীলিমা-
” কি করছেন এসব?”
উত্তর আসে, করিনি তবে করব।
ঢোক গিলে নিচু গলায় নীলিমা বলে, ছাড়ুন! আমি ঘুমাবো…..
অনেক ঘুমিয়েছ আর নয়, আবির নীলিমার ওড়না ধরে টানতে টানতে কাছে নিয়ে আসে। কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে নীলিমা, কেন এমন করছেন? কেন এভাবে আমায় জ্বালাচ্ছেন?
জবাব আসে,
অন্যের বাচ্চা নিয়ে আর যাতে তারা গুনতে না হয় সেই জন্য এমন করছি। তোমায় জ্বালানোর জন্য আরো একজন সদস্য আনার প্রয়োজন বোধ করছি আমি।
আবিরের কথা শুনে দৌঁড় দিচ্ছিল নীলিমা, ধরে ফেলে আবির। একটানে কোলে তোলে নেয়। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে নীলিমা। দুষ্টু হেসে আবিরের প্রশ্ন, পালাবে কোথায়?
চলবে….