ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ০৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
ছোট্ট একটা হাত আবির ওর চোখের সামনে দেখতে পায়। আনমনেই মুখে হাসি ফুঁটে উঠে ওর। হাতটা ধরেই আবির বিছানায় উঠে, শুয়ে পরে। পাশাপাশি বালিশে দুজন শুয়ে আছে। নিশ্চুপ আবির পিচ্চি নীলিমার হাসি দেখছে। যখন থেকে পরে গেছে সে, তখন থেকেই হাসার শুরু। একটু একটু করে হাসি বাড়তেই আছে। একপর্যায়ে শুয়া থেকে উঠে বসে হাসতে থাকতে। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেছিল বোধ হয়, তাই ওমাগো করে পেটে হাত দিয়ে মাঝখানে বিরতি নিয়েছিল। এখন আবার হাসার শুরু করছে। হাসতে হাসতে পাশে রাখা কোলবালিশ জড়িয়ে ধরছে আর বলছে- ওমাগো! এতবড় হয়েও পরে যায়….!!!
চুপ করো! ভদ্রতার রেশ মাত্র নেই ভেতরে। কারো বিপদ থেকে মানুষ হাসে??? অনেকটা ধমকের স্বরেই কথাটা বলে আবির। চুপ হয়ে যায় নীলিমা।
অভিমানে নাক, গালটা ফুলে গেছে নীলিমার। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে বিছানা থেকে উঠে চলে যায় সে। প্রথমে আবির ভাবছে হয়তো ওয়াশরুমে গেছে কিন্তু ২৫ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন নীলিমা ফিরেনি তখন শুয়া থেকে উঠে, কি করছে নীলিমা এটা দেখার জন্য ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াই। নিশ্চুপ নীলিমাকে ওয়াশরুমের ঠিক পাশেই মাথা নিচু অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়। কাছে যায় আবির। ঠোঁট বাকিয়ে বালিকা নিঃশব্দে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে নীলিমা, সাথে নখ দিয়ে নখও কাটছে। মৃদু হেসে কাছে যায় আবির। অনেক দিন হলো পিচ্চিদের কান্না দেখে না, আজ সেই কান্না দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে পিচ্চির ঠোঁট বাকানো কান্না দেখতে। আর তাইতো আদর করে কাছে টানার পরিবর্তে ধমক দেয় আবির- কত করে বলছি নখ দিয়ে নখ কাটবে না, তারপরও এরকম করছ।আমার কথা কি কানে যায় না? কেঁপে উঠে নীলিমা। ছোট বাচ্চাদের মতই মাথা উঁচু অবস্থায় থেকে’ই চোখটা ঘুরিয়ে আবিরের দিকে নেয়। আবিরের রাগান্বিত দৃষ্টি দেখে আবার নখ কাটায় ব্যস্ত হয়ে পরে নীলিমা, সেই সাথে ঠোঁট বাকিয়ে নিঃশব্দে কান্না। এক টানে বুকে নিয়ে আসে আবির নীলিমাকে। পিঠে, মাথায় হাত বুলাতে থাকে। আদর পেয়ে থামার পরিবর্তে আহ্লাদী আরো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
দিনগুলো এভাবেই কাটছিল হাসি আনন্দে, দুষ্টু-মিষ্টি খুনসুটিতে।
সেদিন ছিল বুধবার_
নীলিমার মনটা প্রচন্ড খারাপ। কারণ, পরদিনই ওর স্কুলের শেষ দিন। অথচ ও যেতে পারছে না। নীলিমাদের ব্যাচের বিদায়ী অনুষ্ঠান। যেহেতু বিদায় অনুষ্ঠানটা ফেব্রুয়ারির ২১তারিখ স্থির হয়েছে, তাই সব মেয়েরা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল সবাই মিলে একই রঙের শাঁড়ি, চুড়ি আর চুলগুলো খোঁপা করে তার সাথে বেলীর মালা পরে স্কুলে সমবেত হবে। নীলিমার মন খারাপ কারন একদিকে ও ঢাকায় আছে, অন্যদিকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ও যেতে পারবে না। কারণ, আবিরের কলেজে নাকি কি পরীক্ষা চলছে। আর না যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ, ও শাঁড়ি পরতে পারে না। ও বাড়িতে আবিরের বোন আদিবা পরিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু এখানে তো তেমন কেউ নেই। মন খারাপ করে নীলিমা যখন সোফায় বসে তখন তার পাশে এসে আবির বসল।
মন খারাপ???
মাথা নাড়ে নীলিমা। প্রশ্ন করে আবির, মন খারাপের কারণটা কি জানা যাবে? নীলিমা জানায়, কালকে বিদায় অনুষ্ঠান হবে আমাদের স্কুলে অথচ আমি যেতে পারব না। প্রশ্ন করে আবির, যেতে পারবে না মানে? স্কুলের শেষ দিন আর তুমি যাবে না?! কেন???
জবাব আসে, আপনার স্কুলে পরীক্ষা। কালতো ১১টার সময় অনুষ্ঠান শুরু হবে।
পরীক্ষা শেষ। মন খারাপের কিছু নেই, গাড়ি আছে তো! তো আর সমস্যা কী? সকাল সকাল আমরা রওয়ানা দিয়ে দিব।
—তারপরও যেতে পারব না।(নীলিমা)
—- কেন?(আবির)
—– ওরা সবাই লাল সবুজের শাঁড়ি, লাল চুড়ি, খোপায় বেলীর মালা পরে আসবে।আমার তো আর ওদের মত এতকিছু নেই।(নীলিমা)
বোকা মেয়ে! এই জন্য কেউ মন খারাপ করে? আবির বসে থেকেই ফোন করে ফোন করে ওর বন্ধুর কাছে। বন্ধুকে নীলিমার শাঁড়ি, চুড়ি আর বেলী ফুলের মালার কথা বলে ফোনটা রেখে নীলিমার দিকে তাকায়। নীলিমা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে।
ব্যস! বন্ধুকে বলে দিয়েছি। ও নিয়ে আসবে। যেহেতু ও তোমাকে দেখেছে তাই ঠিকঠাক মাপেই সবকিছু কিনবে, কোনো সমস্যা হবে না। এখন চলো তো! খিদে পেয়েছে খুব!
আবির-নীলিমা খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে বসে থেকে, আসর নামাজটাও আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু বন্ধুর ফেরার কোনো নাম নেই। আবির ফোন করে বন্ধুকে। জিজ্ঞেস করে, কিরে! শাঁড়ি কি তৈরি করে আনছিস নাকি? এত দেরী কেন হচ্ছে? উত্তর দেয় জোবায়ের, ঠিক’ই ধরেছিস। তৈরি’ই করছি, তাই লেইট হচ্ছে। তবে সেটা শাঁড়ি নয় ব্লাউজ। মেচিং করে কাপড় কিনে বানিয়ে তবেই ফিরছি।
“এইরে! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। বলেই জিহ্বায় কামড় দেয় আবির।”
সন্ধ্যা ৭টায় জোবায়ের শাঁড়ি, চুঁড়ি, বেলির মালা, সেফ্টিপিন আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস আবিরের বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়।
রাত্রি ১০টার দিকে খাওয়া দাওয়া করে একটু শুয়েছিল আবির। তখন’ই ডাক দেয় নীলিমা। শুনছেন…..!!!
আবির ফিরে তাকায় নীলিমার দিকে। কিছু বলবে? নীলিমা মাথা নিচু করে জবাব দেয়, আমি শাঁড়ি পরতে পারি না। বিছানায় উঠে বসে আবির, পরতে পারো না মানে? আমাদের বাসায় কিভাবে পরেছিলা? মন খারাপ করে জবাব দেয়, ঐটাতো আমি এমনিই পরেছি। পরে দেখলেন না পরে গিয়েছিলাম? তারপর আদিবা আপু পরিয়ে দিয়েছিল……
কিন্তু এখন তো ওরা নেই!(আবির)
—- এজন্য’ই বলছিলাম দরকার নেই যাওয়ার। আমি না হয় পরে ১দিন গিয়ে এডমিট কার্ডটা নিয়ে আসব।(মন খারাপ করে নীলিমার জবাব)
ধমক দেয় আবির!
আবিরের ধমকে কেঁপে উঠে নীলিমা।
—যাও শাঁড়ি নিয়ে আসো।
কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি আলমারি থেকে শাঁড়ি বের করে আবিরের দিকে এগিয়ে দেয়।
—– শুধু শাঁড়ি কেন? শাঁড়ির সাথে কি আর কিছু পরতে হয় না নাকি?
এবারো নীলিমা তাড়াতাড়ি কাপড় বের করে এনে আবিরের সামনে দাঁড়ায়। আবির মুখে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে বলে, ওগুলোও কি আমি পরিয়ে দিব নাকি? এভাবে এগুলো আমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছ যে? লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে নীলিমা। মুখটা কেমন লাল হয়ে গেছে। নীলিমার লজ্জা পাওয়া দেখে আবির রসিকতার স্বরে বলে, ওহ! ম্যাডাম তাহলে চাচ্ছে আমি এগুলো পরিয়ে দেই! ওকে, দাও। আবির মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে হাত বাড়াতেই আবিরের হাত থেকে শাঁড়ি নিয়ে দৌঁড় দেয় নীলিমা। আবির হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মিনিট দশেক পর চেঞ্জ করে পরণে কোনো রকম শাঁড়িটা প্যাঁচিয়ে রুমে আসে নীলিমা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক ট্রাই করেও নীলিমা পারেনি ঠিক করে কুঁচি দিতে। না পেরে আয়নার দিকে রাগে চিরুনি ছুঁড়ে মারে। আড়চোখে সবটা দেখছিল আবির। স্মিতহাস্যে এবার বিছানা থেকে নেমে নীলিমার কাছে যায়। আয়নার ভিতর দিয়ে আবিরকে দেখতে পেয়ে মলিন মুখে ঘুরে তাকায় নীলিমা।
আমাকে দাও, আমি পরিয়ে দিচ্ছি। হাসি আটকিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আবির কথাটা বলে।
আহারে! মেয়েটা ঠিক আমার মতই,
সহজ সরল বোকা সোকা। তাইতো দুষ্টু আবিরের এক কথায়’ই রাজি হয়ে যায়। এগিয়ে যায় আবিরের দিকে। সুন্দর করে কুঁচি তুলে নীলিমার দিকে তাকায়।
বোকা নীলিমা কিছু না বলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্ন করে আবির, গুজে দেই???
নীলিমা মাথা নেড়ে “হ্যাঁ” সূচক সম্মতি জানায়। আবিরের চোখে মুখে রাজ্য জয়ের হাসি। কোনো কথা না বলেই কুঁচিগুলো গুজে দিতে দিতে আবির নীলিমার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়। কেঁপে উঠে নীলিমা, তারপরও আবিরের দিকে তাকিয়ে আবিরের সাথে তালমিলিয়ে হাসি দেয়। প্রশ্ন করে নীলিমা, হয়েছে? আবির লক্ষ করেছে লজ্জায় নীলিমার চোখ মুখ কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে। বিষয়টা আবির এনজয় করছে। আর তাইতো নীলিমার প্রশ্নের উত্তরে বলেনি, হয়নি! সবেতো প্রস্তুতি ম্যাচ। আবির আবারো শাড়ি নিজ ইচ্ছাতে এলোমেলো করে শাঁড়িতে কুচি তুলতে থাকে। যতবার আবির কুচি গুজে দিচ্ছিল, ততবার’ই শিউরে উঠছিল নীলিমা। পরক্ষণে আবিরের সাথে তালমিলিয়ে অকারণেই হেসে উঠছিল সেও।
এখনো হয়নি? অনেকটা হাফিয়ে উঠে কথাটা বলে নীলিমা। উত্তর দেয়, হ্যাঁ! এদিকটা হয়ে গেছে। এবার উপরে ঠিক করতে হবে। আঁচলটা দাও তো!
নীলিমা আমতা আমতা করে বলে, মামামানে…..?!!!
উত্তর দেয় আবির, সুন্দর করে ভাঁজ করে সেফ্টিপিনে আটকাতে হবে তো। না হলে তোমার বান্ধবীরা হাসাহাসি করবে না তোমাকে নিয়ে? দাও, দাও! দেখি, কিভাবে পরাবো সকালে। নীলিমা কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির নীলিমার শাঁড়ির আঁচল ভাঁজ করছে আর মুখটিপে হাসছে। আঁচলটা সেফ্টিপিন দিয়ে আটকানোর সময় আবিরের হাত নীলিমার ঘাড় স্পর্শ করলে নীলিমা কেঁপে উঠে। নজর এড়ায় না আবিরের। নীলিমাকে ছেড়ে দিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অনেকটা হিরোর ভাব নিয়ে প্রশ্ন করে, সত্যি করে বলো তো এই যে কুচি তুলে গুজে দিলাম, আঁচল ঠিক করে দিলাম, এতে তোমার কেমন ফিল হয়েছে? মানে তোমার অনুভূতিটা জানতে চাইছি। নীলিমা মাথা তুলে আবিরের দিকে তাকায়। আবির উৎসুক দৃষ্টিতে নীলিমার দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁপা কাঁপা গলায় নীলিমার উত্তর, আআআপনি……
আবির খুশি হয়ে বলে, হ্যাঁ আমি…..
আপনি আআমায়…..
হ্যাঁ, বলো আমি তোমায়…….
—- কাতুকুতু কেন দিছেন?(নীলিমা)
ওরে, আমারে কেউ মাইরালা…!!!
কথাটা বলেই ধপাস করে বিছানায় পরে যায় আবির…
চলবে…..