ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব-০৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
ব্রেকফাস্টের জন্য রুটি বানিয়েছিল নীলিমা। রুটি আর ডাল। এটা দেখেও কিছুক্ষণ ঘেনর ঘেনর করল ওর শাশুড়ি। একটা রুটি একটু পুড়ে গিয়েছিল, ব্যাস! সেটা নিয়েই শুরু হলো। তারপর বাপজন্মে এমন ডাল দিয়ে রুটি খায়নি, এই সেই, আরো কত কি!
বিকেলে আবির ওর বোন-দুলাভাইয়ার সাথে লুডু খেলছিল আর হাসাহাসি করছিল ড্রয়িংরুমে বসে। নীলিমা উপর থেকে সেটা থেকে থমকে দাঁড়ালো।আবিরের হাসিমুখটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কারণ, এ বাড়িতে আসার পর এই প্রথম নীলিমা আবিরের হাসিমুখ দেখেছে। মানুষটার চেহারার মত হাসিটাও খুব সুন্দর…..
হাসি দেখে ঘোর লেগে যায় নীলিমার। ঘোর কাটে ননাস আদিবার ডাকে। কি হলো? ঐখানে দাঁড়িয়ে কেন তুমি? আসো, নিচে আসো। ননাসের ডাকে সাড়া দিয়ে নিচে নামে নীলিমা।
ঐ মেয়ে! ঐখানে বসছ কেন? এদিকে আসো, আবিরের পাশে বসো। কথাটা বলেই ননাসের হাজবেন্ড জায়গা দিয়ে ওনি আদিবা আপুর পাশে চলে যায়। বসবে না বসবে না করেও কাঁপা কাঁপা দৃষ্টি নিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে নীলিমা ওর পাশে বসে। পাশে বসার পর নীলিমা লক্ষ্য করেছে আবির কেন যেন একটু পর পর ওর দিকে তাকাচ্ছে। ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায় ওর। মাকে চা দিতে হবে, আমি উঠি। মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াতেই, তার জন্য কাজের মেয়ে আছে কথাটা বলে নীলিমার ননাস নীলিমাকে আবারো বসায়।
খেলা শুরু হলো।
আবির-দুলাভাই বনাম নীলিমা-আপু।
গুটি চালাচালির সময় আবিরের হাতের সাথে নীলিমার হাত লেগেছে অনেকবার। তারই সূত্র ধরে দু’জনের মধ্যে চোখাচোখিও হয়েছে। তারপর আবার খেলা। খেলায় নীলিমাদের জয় হয়েছে। এ প্রথম লুডু খেলায় আবিরের হার হয়েছে তাও নীলিমার কাছে। খেলা শেষে শাশুড়ির ডাকে দৌঁড়ে যায় নীলিমা। তার সাথে আবিরও উঠে দাঁড়াচ্ছিল, বোন আদিবার কথায় আবারো বসে।
— কিছু বলবা?
বলব না, শুনব। গত পরশুদিন রাত্রে কি, কি হয়েছে তোদের রুমে সেটাই শুনতে চাই।
–আপু, এসব কি বলছ? তুমি না আমার ব….(….)…..???
হুম, বড় বোন হই। তবে সেটা নামেই, কাজে নয়। কাজে হলে ঠিক বাবা বোনের কথা মেনে নিতে।
–কি বলতে চাচ্ছো তুমি?
আমি যা বলতে চাচ্ছি, আশা করি তুই তা বুঝে গেছিস।
—আপু, প্লিজ! এভাবে কথা না ঘুরিয়ে সোজাসাবটা বলো কি বলতে চাচ্ছ তুমি?
আবির! মা অন্যরকম হলেও তোকে আমরা ঠিক ভালো মানুষ ভাবতাম। ভাবতাম, মা না বুঝলেও তুই ঠিক বুঝবি।
কিন্তু আমরা ভুল ভাবছিলাম। যে মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে পারে না, তার থেকে আর যায় হোক ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যায় না।
উপস্থিত হয় আবিরের বাবা। মেয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বলে, যে ছেলে শত শত মানুষকে শিক্ষা দেয় মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, সেই ছেলে কি না এরকম মনের অধিকারী? আমার ভাবতে অবাক লাগছে, এই আবিরকে নিয়ে আমি গর্ভ করতাম!
— গর্জে উঠে আবির! চুপ করো তোমরা। আমি আর নিতে পারছি না।
কেন চুপ করবে ওরা? তুমি বলো মেয়েটার কি অপরাধ? কেন ওর সাথে এরকম ব্যবহার করছ? ও কালো এই জন্য নয়তো??? পাশ থেকে আবিরের দুলাভাই বলে উঠে।
—আবির দাঁতে দাঁত চেপে বলে, আমার কাছে সব মানুষ’ই সমান দুলাভাই।
তাহলে কেন এরকম করছিস?
—- এরকম করছি কারন আমি এধরনের মানুষকে ঘৃনা করি আপু।
হা, হা, হা! এই বললি সবাই সমান। এখনি আবার ঘৃণা? ভালো তো!
— বাবা! হাসার কোনো কথা বলিনি এখানে। তুমি হয়তো জানো না, আমি মনে প্রাণে সব সময় একটা জিনিসই চাইতাম, আর সেটা হলো জীবনসঙ্গীনি হিসেবে পাশের মানুষটা যেরকমই দেখতে হোক না কেন তাকে হতে হবে প্রতিবাদী, শক্তিশালী মননের অধিকারী। কালো হোক, দলা হোক যেরকম’ই হোক আমি শুধু চাইতাম, আমার বউটা শিক্ষিত এবং মার্জিত রুচিবোধ সম্পূর্ণ ব্যক্তি হোক। কিন্তু তোমরা এটা কি করলে?
ওহ! তোর তাহলে প্রবলেম এই জায়গায়…..
— কোন জায়গায়?
এই যে নীলিমা অশিক্ষিত…..
— প্রবলেমটা এই জায়গায় নয় আপু। প্রবলেমটা হলো ওর মন মানসিকতা বড্ড সেকেলে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কোনো ক্ষমতায় ওর নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা ওর সাথে আমার যায় না। বিশেষ করে বয়সের ক্ষেত্রে। কোথায় ১৫বছরের এক কিশোরী আর কোথায় ২৭বছরের যুবক। বয়সের ক্ষেত্রে ওর সাথে আমার অনেক ব্যবধান।
ওকেও তুই যোগ্য করে তৈরি করতে পারিস। গড়ে তুলতে পারিস তোর মনের মত, এর জন্য শুধু মনের একটু জোর দরকার। জানিস, নীলিমা স্কুলের ফাস্ট গার্ল….(…)…???
—- আপু, প্লিজ! আমি আর শুনতে চাচ্ছি না। ক্ষমা করো।
আবির কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে চলে যায়। পুরো রাত ভর আবির চিন্তা করল। সব শেষে আদিবা আপুর কথা মনে হলো। বার বার কানের মধ্যে প্রতিধ্বণিত হতে লাগল ওনার বলা শেষ কথা- “ওকেও তুই তোর মনের মতো করে গড়ে তুলতে পারিস।” সত্যি’ই কি এটা সম্ভব? আমি ওকে আমার মত করে গড়ে তুলতে পারব? নীলিমা স্কুলের ফাস্ট গার্ল ছিল? শুয়া থেকে উঠে বসে আবির। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় আবির ঘুমন্ত নীলিমার মুখের দিকে তাকিয়ে আচমকা একটা রহস্যজনক হাসি দেয়।
সকাল ১১টা_
শাশুড়ির জন্য চা তৈরি করে দৌঁড়ে নীলিমা শাশুড়ির রুমের দিকে এগুতে থাকে। নীলিমাকে এভাবে দৌঁড়াতে দেখে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় আবির। নীলিমা সামনের দিকে এগুচ্ছে, নিশ্চুপ আবিরও ধীর পায়ে নীলিমাকে অনুসরন করছে। পৌঁছে যায় শাশুড়ির রুমে।
” মা! চা…..”
একটা হাসি দিয়ে চলে যাচ্ছিল আবির, হঠাৎ ভিতর থেকে মায়ের চিল্লানোর স্বর ভেসে আসে।
আবির ফিরে তাকায় রুমের দিকে। ওর মা নীলিমাকে হাত থেকে পরে কাপ ভাঙার অপরাধে যাচ্ছে তাই কথা শুনাচ্ছে। অলক্ষ্মী, অপয়া বলে গালি দিচ্ছে। গালি দিচ্ছে বাপ তুলে। কথা ধরে নীলিমা। অনেক সহ্য করেছে, আজ ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। কথায় কথায় বাবা মা তুলে গালিগালাজ, আজ মৃত বাবাকে নিয়ে কথা বলছে। না, আর মেনে নেয়া যায় না।
” ক্ষমা করো মা” আমাকে আজ মুখ খুলতেই হচ্ছে, কথাটা মনে মনে বলে, বলতে শুরু করে নীলিমা-
মা, আপনার কাছে হাতজোড় করছি! দয়া করে, কথায় কথায় বাপ মা তুলে গালি দেয়া এবার বন্ধ করুন। অনেক সহ্য করেছি, আর পারছি না মা।
তুই আমাকে ধমক দিচ্ছিস? কেন? কি করবি? আমি তোর ঐ শয়তান বাপের নাম নিলে কি করবি তুই? আমার নামে নালিশ করবি শ্বশুরের কাছে? আমায় বাড়ি ছাড়া করবি? কালকের মেয়ে হয়ে তুই আমায়, এতটুকু বলে থেমে যায় নীলিমার শাশুড়ি।
কি ব্যাপার? ওনি এদিকে কি দেখছেন বলেই পিছনে ফিরে তাকায় নীলিমা। আবিরকে এভাবে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নীলিমার কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। এদিকে নীলিমার শাশুড়ির মনেও ছোট খাটো ঝড় বয়ে যাচ্ছে, সেটা ওনার মুখ দেখেই বুঝা গেছে।
শাশুড়ি বুঝতে পারছে আবিরের প্রশ্ন থেকে আজ আর নিস্তার নেই। কারণ, ওনি ওনার ছেলেকে খুব ভালো করেই চেনেন। শান্ত এবং গম্ভীর প্রকৃতির আবির সবসময় রাগে না। তবে যখন রাগে তখন কুরুক্ষেত্র বয়ে যায়। ভয়ে আবিরের মা হায় আল্লাহ, হায় আফসোস করছে।
আবির ওর মাকে অবাক করে দিয়ে, নীলিমাকে ফ্লোর থেকে টেনে তুলে। নীলিমা তখন ভাঙা কাপের টুকরো জড়ো করছিল। আর ওর কিছু বুঝে উঠার আগেই আবির ওকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে যায়।
নিশ্চয় ওনি মায়ের সাথে তর্কে করার সময় তা শুনে নিয়েছেন। হে আল্লাহ! এখন আমার কি হবে? কেন আমি মায়ের কথা মতো চুপ করে থাকতে পারলাম না। এখন যদি ওনি আমায় তাড়িয়ে দেয়? কি হবে আমার? মা বোন ওরা’ই বা সমাজে মুখ দেখাবে কি করে?
আবির আলমারি খুলে ভিতর থেকে নীলিমাকে থ্রি-পিছ বের করে দেয়। সেটা দেখে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে নীলিমা। আর মনে মনে বিলাপ করতে থাকে, আজ আর সব গেল। মায়ের কথা না শুনাতে আজ আমার সব শেষ হয়ে গেল। আবির রুম থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়, ঢাকায় যাব। এসে যাতে রেডি দেখি।
আবির রুম থেকে বের হয়ে সরাসরি মায়ের রুমে যায়। মা তখন কপালে হাত দিয়ে চিন্তিত মনে টিভির সামনে বসে ছিলেন। আবিরকে দেখেও না দেখার ভান করে টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। রিমোর্ট দিয়ে টিভির শব্দটা অফ করে মায়ের দিকে তাকায় আবির। জোর করে মুখে হাসির রেখা টেনে প্রশ্ন করে ওর মা, কিরে কিছু বলবি?
হ্যাঁ_
আবিরে মা:- বস এখানে।
.
আবির:- বসতে আসিনি। ঢাকায় চলে যাচ্ছি, সেটাই বলতে আসলাম।
.
আবিরের মা:- কিন্তু তোর না ৭দিনের ছুটি দিয়েছে?
.
আবির:- দিয়েছিল। একটা জরুরী কাজের কথা মনে পড়েছে, তাই এখন চলে যেতে হচ্ছে। ছুটি’টা ওখানেই কাটাবো।
.
আবিরের মা:- ওহ! কখন রওয়ানা দিবি?
.
আবির:- এখন, আসি। ভালো থেকো।
মায়ের কথা উপেক্ষা করে আবির চলে যাচ্ছিল, কি মনে করে যেন দরজার সামনে থেকে ফিরে আসল। টিভির দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল- আর একটা কথা! এই স্টার জলসা, জি বাংলার খল নায়িকাদের চরিত্র না ফলো করে, বিটিভি দেখো। বিটিভির সাবানা, কবরী, ববিতা ওদেরকে ফলো করো। আদর্শ মা গঠনে কাজে দিবে এটা।
আর কিছু বলতে পারেনি আবির। গত ৩দিন ধরে আবির নিরবে সব লক্ষ্য করে গেছে কিন্তু বুঝতে দেয়নি মাকে। আজ মেজাজ চরম পর্যায়ের খারাপ হয়ে গেছে। তাই কথাগুলো না বলে পারেনি।এখানে থাকলে হয়তো মাকে উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আবির রাগের বশে কোনো ভুল করতে চাচ্ছে না। কারণ, শত খারাপ’ই হোক, মা’তো মা’য়।
আবির রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
এদিকে নীলিমা?!!!
আবির রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর হু, হু করে কেঁদে দেয়। মনে মনে বলছে, তার মানে আমার ধারনায় ঠিক। ওনি আমাকে বিদায় করে দিবে চিরতরে এ বাড়ি থেকে। ঢাকায় গিয়ে হয়তো আমায় ছেড়ে দিবে। হে আল্লাহ! এখন আমার কি হবে?
খাটে বসে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে নীলিমা। ঠিক তখনি রুমে প্রবেশ করে আবির। আবিরের রক্তলাল চোখ দেখে থরথর করে কাঁপতে থাকে নীলিমা। কাঁপতে কাঁপতেই খাট থেকে উঠে দাঁড়ায়।
— কি হলো? এভাবে ছাগলের মত ভ্যাঁ, ভ্যাঁ করছ কেন?
কান্না থামিয়ে মাথা নিচু করে আছে নীলিমা। ঝাঁঝালো কন্ঠে আবির বলে, কথা কি কানে যাচ্ছে না? শাঁড়ি চেঞ্জ করে থ্রি-পিছ পরতে বলছি।
আমি এ বাড়িতেই থাকব। কোথাও যাব না। তাই আমি চেঞ্জও করব না, কান্নাভেঁজা কন্ঠে নীলিমার জবাব।
তোমাকে চেঞ্জ করতে হবে না। আমি’ই করিয়ে দিচ্ছি। দাঁতে দাঁত চেপে নীলিমার শাঁড়ির আঁচল ধরে টান মারে আবির।
না, প্লিজ….. আমি করতে পারব। প্লিজ, আপনি এরকম করবেন না। আমি পরব শাঁড়ি। চোখ দুটো বন্ধ করে নীলিমার জবাব।
ঠিক আছে। ১০মিনিট। ১০মিনিটের ভিতর আমি রেডি চায়। কথাটা বলেই দরজা আটকে দিয়ে বাইরে চলে যায় আবির।
১০মিনিট পর___
থ্রি-পিছ পরে মাথা নিচু খাটের একপাশে বসে আছে মায়া। আর ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে অশ্রু পরছে।
চলো…
হঠাৎ’ই নীলিমা আবিরের পা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে দাঁড়ায় আবির। কিছু বলতে যাবে তার আগেই নীলিমার বিলাপ- হাত জোর করছি আমায় মাফ করে দিন। আমার ভুল হয়ে গেছে, দয়া করে আমায় মাফ করে দিন। আমি আর কখনো মায়ের মুখে মুখে কথা বলব না, আমার বাবার নামে শপথ করে বলছি। আমায় মাফ করুন, দয়া করুন আমায়। দয়া করে আমাকে তালাক দিবেন না।
শেষ কথাটা শুনে মাথা গরম হয়ে যায় আবিরের। পা থেকে উঠিয়ে ঠাস করে নীলিমার গালে কষে একটা থাপ্পর মারে সাথে সাথে। নীলিমা চুপসে গিয়ে আবিরের চোখের দিকে তাকালো।
দ্বিতীয় বার কখনো যদি এরকম ফালতু কথা বলতে শুনি না, তাহলে এক থাপ্পরে মুখের সব কয়টা দাঁত ফেলে দিব।
পা চালাও….
এবার আর জোর করতে হয়নি। আবির সামনের দিকে চলছে, আর নীলিমা কোনো কথা ছাড়া’ই আবিরের পিছন পিছন দৌঁড়াচ্ছে।
চলবে….