ফুলকৌড়ি পর্ব-৮+৯

0
8

#ফুলকৌড়ি
পর্ব(৮)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

নীহারিকা বেগমের দ্বিতীয় স্বামী হলেন জাহিদ সাহেব।একই শহরের একই গলির বাসিন্দা হওয়ায় চেনা পরিচিত ছিলেন উনারা।দু’জনেই বাবারা আদিসূত্রে বাসিন্দা,এই শহরের।চালচলনের শালীনতা আর স্বভাবে শান্ত থাকায়।নীহারিকাকে বেশ পছন্দ করতেন।শুধু যে স্বভাব, চালচলনে ভালো লাগতো এমনটাও নয়।নীহারিকা সেই কিশোরী বয়সে ছিলো,অনিন্দ্য সুন্দরী। তার সৌন্দর্যতাও মুগ্ধ করতো জাহিদ সাহেবকে।তবে কালভেদে নিজের অনুভূতিরগুলো কখনো, না নিজের পরিবারের কাছে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন আর না নীহারিকাকে জানাতে পেরেছিলেন।যদিও তিনি চেয়েছিলেন পড়াশোনা শেষ করে,নীহারিকার পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখবেন।কিন্তু ভাগ্য সু-সম্পূর্ন ছিলো-না উনার।পড়াশোনার খাতিরে বাড়ির থেকে দূরে থাকায় হঠাৎ একদিন জানতে পারলেন,নীহারিকার বিয়ে হয়ে গেছে।ভালো সুশিক্ষিত উচ্চবংশীয় পাত্র পাওয়ায় অল্প বয়সে মেয়েকে পাত্রস্থ করেছেন নীহারিকার বাবা।জীবনের প্রথম ভালোলাগা মেয়েটা অন্যের জীবনসঙ্গিনী হয়ে গেছে জানতে পেরে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন সেদিন।ব্যথিত হয়েছিলো নিজের মন।পরবর্তীতে ভাগ্য হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।তবে উনার চাওয়ায় হয়তো পবিত্রতা ছিল।
তাই ভাগ্যক্রমে নীহারিকা আবারও উনার কাছে ফিরে এলো।দ্বিতীয়বার সুযোগ পেলেন নীহারিকাকে নিজের করে নেওয়ার।আর সেই সুযোগটা বিভিন্ন সংঘাতের মধ্যেও কোনোমতেও হাতছাড়া করেননি তিনি।

নীহারিকার বিয়ের সাতবছর পর হঠাৎই তার প্রথম স্বামী এক্সিডেন্টে মারা যান।সংসারের বিভিন্ন সংঘাত আর ঝামেলার কারনে,ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরতে হয় তাকে।বিষয়টা জানার পর জাহিদ সাহেব আর দেরী করেননি।চার ভাইয়ের মধ্যে, তিনি সবার বড় হওয়া সত্ত্বেও তখনও বিয়ে করেননি।যদিও অন্যন্য ভাইরা বিয়ে করে নিয়েছিলো।তিনি যখন ছেলেসহ- নীহারিকা বিয়ে করতে চাইলেন,বাড়ির কেউই প্রস্তাবে রাজী হলেন না।বিশেষভাবে উনার মা।সুদর্শন ছেলে উনার,কোনো দিক থেকে কম নয়।বাবার বিরাট ব্যবসাও একহাতে সামলে চলেছে।সেই ছেলের জন্য বাচ্চাসহ বিধবা বউ।তিনি মানতে নারাজ ছিলেন।তবে এক সময় ছেলের জেদের কাছে হার মেনে নীহারিকাকে মানতে রাজী হলেও,তার ছেলেকে মানতে নারাজ। কিছুতেই রাজী হলেন না।তবে জাহিদ সাহেব বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে মা’কে মানান।তবুও মায়ের নজরভঙ্গি না নীহারিকার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলো আর না নিভানের প্রতি।পরে আস্তে আস্তে সবটা ঠিক হয়েছে।তবে কতোটা ঠিক হয়েছে এটা বিশেষ জানা নেই জাহিদ সাহেবের।হয়তো আছে,তবে প্রকাশ করতে চান-না।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।

নীহারিকাও,উনাকে এক কথায় বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলেন এমনটাও নয়।তাকেও বিভিন্নভাবে মানাতে হয়েছিলো।শেষমেশ বাবা ভাইদের কথায় বাধ্য হয়ে জাহিদ সাহেবকে বিয়ে করতে রাজী হয়।তবে বাধ্য হয়ে বিয়ে করলেও,পরবর্তীতে নিজেকে মানিয়ে নেয়।মেনে নিতে শুরু করেন নিজের নতুন সংসার।নীহারিকার সাথে বিয়ের বছরের মাথায় নীহারিকা অন্তঃসত্ত্বা হয়।তারপর ইভানের জন্ম।নিভান শান্ত, গম্ভীর ধরনের ছেলে বরাবর।তবে ইভানের জন্মের পর,ভাই অন্ত প্রান ছিলো তার।সময়ের সাথে সাথে সেই অন্তরঙ্গ ভাইভাই সম্পর্কটায় হঠাৎই দুরত্ব তৈরী হলো।ইভানের ক্লাস সিক্স সেভেন উঠা পর্যন্ত দু’ভাইয়ের সম্পর্ক মোটামুটি ঠিকই ছিলো।তারপর যে কি হলো,দু’ভাই হঠাৎ দু’জনের থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরী করে চলতে শুরু করলো।নিভান চুপচাপ থাকলেও, ইভানের কথা ছিলো।নিভানকে বাবা মা সবকাজে সবসময় প্রায়োরিটি বেশি দেয়।তাকে বেশি ভালোবাসে।শত চেয়েও, বুঝিয়েও আর সেই দুরত্ব ঘুচানো গেলোনা।তবে আগে ইভানের অভিযোগের মাত্রা সীমাহীন থাকলেও,এখন আর তাকে অভিযোগ করতে দেখা যায়না।তবু-ও, দুভাইয়ের মধ্যে সম্পর্কটায় আর উন্নতি হলো না।

‘বাবা ডেকেছিলে আমায়? আসবো?

ইভানকে ডাকতে পাঠিয়ে অতীতের ভাবনায় ডুব দিয়েছিলেন জাহিদ সাহেব।ইভানের ডাকে সেই ঘোর কাটতেই বললেন।–এসো।

‘ইভান এসে বেডের পাশে রাখা টুলটা টেনে বসলো।বাবার দিকে শান্ত দৃষ্টি বুলিয়ে বললো–শরীর কেমন যাচ্ছে তোমার?পরিক্ষার চাপে এ-কদিন খোঁজ নেওয়া হয়নি।

‘আলহামদুলিল্লাহ, এই যাচ্ছে ভালো।

কিছুসময় দু’দিকেই নীরবতা চললো।ইভানের নীরবতা বুঝে জাহিদ সাহেব মুখ খুললেন– পড়াশোনা তো আপতত শেষ।এখন কি করতে চাইছো?এবার অফিসে বসার চিন্তা ভাবনা করলে ভালো হয়-না?

জানা ছিলো ইভানের।বাবা এমনই বিষয় নিয়ে কথা বলবেন বলে,তাকে জরুরী তলবটা করেছেন।ইভানের শান্ত নজরটা এবার দৃঢ় নজরে পরিনত হলো।নির্বিকার গলায় বললো।

‘যাকে দায়িত্বটা দিয়েছো তাকেই সেই দায়িত্বটা সামলিয়ে নিতে দাও।আমি মনে করি অফিসে বিশেষ প্রয়োজন নেই আমার।প্রয়োজন যার,সে-তো সবটা সামলিয়ে আসছে,সামলিয়ে চলছে তো।নিচ্ছে-ও।তবে সেখানে আমার বিশেষ প্রয়োজনটা কোথায়?দেখছি না-তো আমি!

ইভানের কথাগুলো খারাপ নয়।তবে যাকে নিয়ে ইভান বাক্যগুলো ব্যবহার করলো,সেই সম্বোধনহীন বাক্যগুলো ঠিক মেনে নিতে পারলেন না জাহিদ সাহেব। কিছুটা কঠিন গলায় বললেন।

‘ছেলেটাতে,তোমার সমস্যা কোথায় ইভান?কেনো তার বিষয় এলে সবসময় এহেন কথাবার্তা বলে চলো?দু’ভাই তোমরা,অথচ বড় ভাইয়ের বিষয়ে আচারন কথাবার্তায় এ-কি বিরূপ ভঙ্গিমা ইভান!আমি তো ভেবেছিলাম সেই বয়সে বুদ্ধি বিবেক বিবেচনায় অপরিপক্বতা ছিলে বলে অবুঝপনা করেছো।তবে আশা রেখেছিলাম, বয়সের সাথে সাথে ম্যাচুরিটি বাড়বে,সেই অপরিপক্ক বুদ্ধি বিবেচনার পরিপক্কতা আসবে।কিন্তু তুমি-তো সবকিছু দেখেও,তোমার বিবেক বিবেচনার দুয়ার নিজ ইচ্ছেতেই বন্ধ করে রাখলে।কেনো ইভান?

‘কারনটা তো তোমাদের জানা,তোমাদের প্রায়োরিটির প্রথমে সবসময় সে।আর ভালোও বাসো বেশি তোমরা তাকে।মা হওয়ার প্রথম অনুভূতিটা নাহয় তার মধ্যেমে অনুভব করেছিলো,মা। মাকে না-হয় মা সেই প্রথম ডেকেছিলো তাই মায়ের তাকে প্রায়োরিটি দেওয়া, বেশি ভালোবাসার কারন রয়েছে।কিন্তু তোমাকে তো বাবা বলে প্রথম ডেকেছিলাম আমি। তবে কেনো মায়ের মতো তুমিও দাদাভাইকে বেশি প্রায়োরিটি দাও,বেশি ভালোবাসো।আমাকেও দাদাভাইয়ের মতো ভালোবাসাে না,কেনো?

‘এটা তোমার অত্যন্ত খুব-বাজে ভুল ধারনা ইভান।যা আমি মনে করেছিলাম,বয়স বাড়ার সাথে সাথে শুধরে যাবে।কিন্তু তুমি সেই বাজে ধারণাই মনে পুষে রেখেছো।তবে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি।তোমাদের যদি তাই মনেহয়,যে আমি নিভানকে তোমাদের সবার চেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দেই,বেশি ভালোবাসী।তবে হ্যা তাই।প্রথম কারনটা,সে আমাকে বাবা না ডাকলেও,আমার প্রথম সন্তান।আর দ্বিতীয় কারনটা চোখে দেখা এবং জানা সত্বে-ও যদি বাবার মুখ থেকে শোনার ইচ্ছে হয় তোমার, তবে শোনো।

‘তোমার দাদি চাচাদের আর ফুফুর ভস্যমতে আমি আমার স্ত্রীর প্রথম ঘরের সন্তানকে নিয়ে বেশি মাতামাতি করি।আর আমার সন্তানদের দাবি হলো, তাদের বড়ভাইকে আমি সবসময় প্রায়োরিটি বেশি দেই।বেশি ভালোবাসি।কেনো?অর্ধাঙ্গিনীর সন্তানকে যদি নিজের ভাবা,যদি মাতামাতি হয়।তবে সেটা মাতামাতি।এই কথাগুলো কখনো আমি আমলে নেইনি।গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনি,তাই তা নিয়ে অযথা তর্কবিতর্কে জড়াইনি।কিন্তু নিভান,ওর দোষটা কোথায় বলো-তো? বাচ্চা বয়সে বাবা হারা হয়ে যাওয়া?নাকি তার স্বভাব ব্যববহারে,তার প্রতি টান ভালোবাসা অনুভব করা?নিভান যখন এবাড়িতে এলো,তুমি ছিলেনা তখন।তবে শুনে দেখোতো,ওর কোনোপ্রকার অসংগতি আচার ব্যবহার কারও নজরে কখনো পড়েছে কি-না?ওইটুকু ছেলে কখনো এবাড়ির কারও কাছে কোনো জিনিসের আবদার,অযথা বাহানা করেছে কি-না?এমনকি আমার কাছেও না,আর না তোমার মায়ের কাছে।তোমার মা বরাবরই তার প্রয়োজন বুঝতে পেরে তবে তাকে প্রয়োজনীয় জিনিস দিতেন।সেই ছেলেটাকে ভালো না বেসে থাকতে বলছো।তোমার মা’কে বিয়ে করার পর,নিভানকে কিন্তু তোমার নানুমনিরা নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন।তার মাথার উপর ছাঁদের কিন্তু অভাব ছিলো-না।কিন্তু আমি চাইনি,ওরকম একটা শান্ত নিস্পাপ বাচ্চা মা ছাড়া থাকুক।মা ছাড়া বেড়ে উঠুক।মা থেকে দুরে থাকুক।তাতে যদি তোমাদেরকে আমার তোমাদের প্রাপ্য ভালোবাসা না দেওয়ার অপরাধী মনেহয়,আমি তবে অপরাধী!শাস্তি দিয়ো বাবাকে, বাবা মাথা পেতে নিবে।কি করারা আছে।

‘আর তাকে প্রায়োরিটি দেওয়ার কথা বলছো!আমি যখন সুস্থ ছিলাম,সবাই আমাকে গ্রাহ্য করতো,মানতো।কিন্তু যেই আমি এক্সিডেন্টে অসুস্থ হয়ে পড়লাম।আমার ব্যবসা ধসে পড়তে শুধু করলো।তোমার চাচারা নিজেদের তল্পি তল্পা গুছিয়ে নিয়ে কেটে পড়লেন।পিছে ফিরে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করলেন-না,আমি তাদের রক্তের সম্পর্কিত ভাই বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি!অথচ বাবা মারা যাওয়া ভাইবোনদের নিজ শরীরকে যত্ন নেওয়ার মতো লালিত পালিত করেছি।যদিও সেটা আমার তাদের প্রতি হক ছিলো,কথাগুলো বলা উচিত নয়।তবে আমিও একজন রক্তে-মাংসে মানুষ!তাদের গুছিয়ে নেওয়া সম্পদ সব আমার পরিশ্রমের ছিলো।যদিও পিতার সম্পত্তির অধিকার সবার সমান,তবুও সেখানের কঠিন হাড়ভাঙা শ্রমটা ছিলো আমার।কোনো কিছু থেকে তাদেরতো আমি চুল পরিমাণ বঞ্চিত করিনি।তবে তারা কি করলো বিবেকহীন আর মনুষ্যত্বহীনের পরিচয় দিলো।আমি অসুস্থ দেখেও,স্বার্থপরের মতো নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হলো।রক্তের টানটা পর্যন্ত দেখালো না।সেই ধসে পড়া ব্যবসাটা,নিজের ক্যারিয়ারের কথা বাদ দিয়ে হাল ধরলো কে?তোমার বাবার ছেলে নয় শুধু তোমার ওই মায়ের ছেলেটা।তোমাদের চিন্তা ধারায় যে তোমাদের সৎভাই।আর তাকেই প্রায়োরিটির লিস্টে প্রথম রাখা আমার অন্যায় বলছো?

‘বাবা।

ছোটোবেলায় অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে আবেগপ্রবন হয়ে যে বিবেকহীন কথাগুলো বলেছে বলেছে।যতো বড় হতে শুরু করলো,নজর খুললোা।বিবেক পাল্টাতে শুরু করলো।ইভান বুঝতে পারলো,সে এতোদিন কার বিরুদ্ধে অহেতুক অভিযোগ নামা করে এসেছে।তবে তখন দু-ভাইয়ের সম্পর্কে এতো দূরত্ব চলে এসেছিলো।ইগোর কারনে,সেই দুরত্বটা আর ঘুচিয়ে উঠা হয়নি।তাই বলে,বাবার মুখে উচ্চারিত সৎভাই নামক সম্পর্কটার নাম দিয়ে দাদাভাইকে কখনো ভাবিনি,দেখিনি সে।এতো নিচু মানসিকতা তার আগে-ও ছিলোনা,আর এখন….।মাথা নিচু করে নিলো ইভান।ফের বললো।

‘আমি কিন্তু কখনো দাদাভাইকে সেই নজরে দেখিনি বাবা।আমার বরাবর অভিযোগ ছিলো,তোমাদের দাদাভাইকে বেশি ভালোবাসা নিয়ে।প্রায়োরিটি দেওয়া নিয়ে।তাই বলে এরকম কথা বলতে পারো তুমি।

‘তুমি বলোনি।কিন্তু তোমার আগের আচার ব্যবহার আর এখনের বলা কথাবার্তা গুলোতো সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে।তা না হলে একটা বিবেকবান সুশিক্ষিত ছেলে হয়ে এখনো ওসব উল্টো পাল্টা কথাবার্তা বলো কিকরে?চোখে দেখেশুনেও ভাবনাতে আসে কিকরে তোমার?তার আচারনে কখনো মনে হয়েছে,যে তোমারা তার আপন ভাইবোন নও।এবাড়ির কেউ তার রক্তের সম্পর্কিত কেউ নয়।সেই ধসে পড়া ব্যবসাটা পুনরায় দাঁড় করাতে কি পরিমান ধৈর্য্য কষ্টসাধ্য করা লেগেছে, তুমি জানো?ব্যবসায় ঢুকে দেখো,এখন সাজানো গোছানো সব।তবুও বুঝতে পারবে,কতো নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে যে সম্মান পরিচিয়ের সাথে চলতে ফিরতে পারছো তা কতো কষ্টে অর্জিত করতে হয়।আর সেখানে নিজের পরিশ্রমটা কি পরিমান ঢালতে হয়।তা নাহলে নিজের ছোটো চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করে দেখো,কেনো সে নিভানের সিদ্ধান্তের উপরে একটা কথা-ও বাড়ায় না।কেনো আমাদের প্রায়োরিটিতে সে প্রথম থাকে।কেনো তার সিদ্ধান্তকে বিনাবাক্যবয়ে মেনে নেওয়া হয়।

কথা শেষ করতেই বেডের হেডে মাথা এলিয়ে দিলেন জাহিদ সাহেব।ছেলেমেয়েদের সাথে কখনো জোর গলায় বা উত্তেজিত হয়ে কথা বলেননা তিনি।বরাবরই শান্তভাবে বুঝিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন।তবে আজ পারলেন না।কারনটা হয়তো নিজের অসুস্থতা।সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করলেন।ফের ধীরকন্ঠে বললেন।

‘আমার ছেলে হয়ে,তোমাকে এই কথাগুলো কখনো বোঝাতে হবে এটা তোমার থেকে আশা করেনি ইভান।আমি ভেবেছিলাম,সব ঠিক হয়ে যাবে।তবে কি বলতো আমার সন্তান হলে কিহবে,গুনটা হয়তো চাচাদের মতো….

কথা শেষ করতে চাইলেন না জাহিদ সাহেব। চোখ বুঁজে নিলেন।ইভানও এবার আশ্চর্য হয়ে বাবার মুখের দিকে চাইলো।তাকে নিয়ে বাবার ধারণা এতোটাও নিন্মে চলে গেছে।কথা বাড়ালোনা ইভান।রাগ হলো,ক্ষোভ হলো।তবে কার প্রতি তার জানা নেই।উঠে দাড়ালো সে।দরজা মুখো হতে গিয়ে দেখলো,অসহায় নজরে একজন মা দাঁড়িয়ে আছে।হয়তো তাদের বাবা ছেলের আলাপনটা শুনেছে।ভালোমন্দ কথা বলতে চেয়েও হয়তো পক্ষ নেওয়ার ভয়ে কথা বলেনি।সেই পক্ষপাতে বড় ছেলে অভিযোগ না জানালেও,ছোটো ছেলে অভিযোগ জানাতে ভুলবেনা।নজর সরিয়ে ফের বাবার বন্ধ হয়ে চোখমুখের দুই তাকালো ইভান।দৃঢ় গলায় বললো।

‘আমি ভালো ছেলে হতে চাই- না।তাই আমার পক্ষে-ও অফিসে বসা সম্ভব নয়।আর মনে হয়না সেই দক্ষতা আছে আমার,দক্ষতা অর্জন করতে চাই-ও না আমি।তাতে যদি আমাকে সেখানের সকল অর্থের অধিকার ভোগ বিলাশ থেকে বঞ্চিত হতে হয়,অসুবিধা নেই আমার।যাদের সাথে মানসিকতার তুলনা করলে এতটা নিচু মানসিকতাও আমার নয়,যদিও আমি ভালো ছেলে নয়,তবুও।বাবার রক্ত আলাদা হলেও,একই মায়ের পেট থেকে আমাদের জন্ম।দুজন মানুষ আলাদা হতেই পারি।তবে মানসিকতার শিক্ষাটা দুজনেই মায়ের থেকে পাওয়া।আর আমার মায়ের মানসিকতার শিক্ষা কখনো নিচু নয়।হতে পারেনা।

চুপ হলো ইভান।ফের বললো—আমি সামনে বি-সি-এস এর জন্য প্রিপ্রারেশন নিচ্ছি।আমি জব করতে চাই।আর তুমি আমাকে যাই বলো,আমি কখনো অফিসে বসবোনা।সেখানের কোনো লেনাদেনা বা সিদ্ধান্তে আমি কখনো নিজেকে জাহির করতে চাইনা।করবোও না।

নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে চলে গেলো ইভান।দরজা মাড়ানোর আগে মায়ের শান্ত মুখের দিকে একবার তাকিয়ে যেতে ভুললো-না।বাবার বুঁজে নেওয়া নজর,আর মায়ের শান্ত চাহুনি বুকের ভিতরে তীব্র ব্যথায় ছড়িয়ে দিয়েছে।সেটা মনের মধ্যে সংবরন করেই বড়বড় পা ফেলে চলে গেলো সে।


সুন্দর একটা ঝলমলে বিকাল।অথচ ইভানের মনটা সেই সুন্দর বিকালটার মতো ঝলমলে নেই,সেখানে হয়ে আছে আমাবস্যার রাতের মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার।বাবা এখনো এরূপ আচারনে এরআগে কখনো তারসাথে কথা বলেনি।কিন্তু আজে! মন খারাপ নিয়ে ছাঁদ উঠলো ইভান।আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘনোঘনো দীর্ঘশ্বাসই ফেললো সে।মন যেটা চায় মুখ কেনো সেটা প্রকাশে অক্ষম জানায়। এ কেমন স্বভাবে পুরুষ জাতিকে সৃষ্টি করেছেন প্রভু।অতি খুশিতে খিলখিলিয়ে হাসতে নেই।অতি দুঃখ কষ্ট শোকেতাপেও কাঁদতে নেই।পকেটে দু’হাত গুজে স্থির নজরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম নিভান।পাশে এসে কাওকে দাঁড়াতেই সেদিকে একনজর তাকিয়ে মৃদু হাসলো।বুঝলো,ছেলেটাকে কে পাঠিয়েছে।হঠাৎ মন চঞ্চল হয়ে উঠলো।

‘ছোটো দাদাভাই তোমার মন খুব খারাপ?

নাফিমের উত্তর না দিয়ে, ঘুরে দাঁড়িয়ে হঠাৎই ওয়ালে উঠে বসলো ইভান।সেটা দেখে চোখ মোটামোটা করে নাফিম বললো—এই কি করছো,দাদাভাই? পড়ে যাবে তো!আর বড়ো দাদাভাই দেখলে কিন্তু খুব বকে দেবে।

‘তোর বড়ো দাদাভাইকে আমি ভয় পাই নাকি।তোকে এখানে কে পাঠিয়েছে বল-তো?তোর বড় দাদাভাই নয় তো?

কি উত্তর দেবে?তাকে যে পাঠিয়েছে সে তো বারবার করে তার নামটা বলতে নিষেধ করে দিয়ছে।আর তার নিষেধ তো মানতেই হবে। তবে কি বলবে এখন?নাফিম কে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বারবার ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস সরূপ ইশারা করলো ইভান।সেটা দেখে আমতা আমতা করলো নাফিম।তা দেখে হেসে দিয়ে ইভান বললো।

‘যা তো পিচ্চু,আমার গিটারটা নিয়ে আয়তো।একটু গান গাই।তোর প্রশ্ন মতে সত্যিই আমার মনটা একটু একটু খারাপ,তাই মনটা একটু ভালো করি।যা নিয়ে আয়।

ছোটো দাদাভাইয়ের গলা দুর্দান্ত।ছুট লাগালো নাফিম।মিনিট পার হলোনা,গিটার এনে হাজির হলো সে।গিটার হাতে পেতেই ধপ করে নিচে নামলো ইভান।পশ্চিম আকাশে তাকালো।সূর্যের তীর্যক রশ্মিটা কমে গিয়ে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে।তার নিভে আসা রূপটা প্রকৃতিকে অপরূপ সৌন্দর্য্যে মনোহারিত করেছে।গিটারে টুংটাং শব্দ তুললো ইভান।ফের চোখ বন্ধ করে গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করলো।

‘এক মুঠো স্বপ্ন এসে ছুঁয়ে যায় সারাক্ষণ, চেয়ে থাকি আমি তার আশায়’
একমুঠো ইচ্ছে লুকিয়ে রাখি অন্তরে,হয়না সাজানো ভালোবাসায়।
কখনো মন হয় রোদেলা কখনো হয় মেঘলা যায় না তারে ভোলা।
কাটেনা যে বেলা একাকি একেলা, ভালোবাসার একি জ্বালা…।।

ও-হো,,, আধো আলো আধু ছায়া।বুঝিনা এ কেমন মায়া।।
কখনো মন রোদেলা কখনো হয় মেঘলা।যায় না তারে ভোলা।
কাটেনা যে বেলা একাকি একেলা ভালোবাসার এ-কি জ্বালা…।।

গানের মধ্যও,চোখবুঁজে ইভান অনুভব করতে পারলো। নাফিম বাদেও তার অন্যপাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।
হাতে কফির মগ।কফির গন্ধে ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হলো। মুখের হাসিটা আর-ও একটু চওড়া করে গলার স্বরটা এবার আরও উগরে দিলো।

খুঁজে ফিরি তারি ছবি অন্ধ মোহে ভাসি ডুবি….।।

গানের কলিটা শুরু করতেই, আপনাআপনি চোখ বন্ধ হয়ে গেলো নিভানের।বদ্ধ চোখে ভেসে উঠলো সেই ক্রন্দনরত মায়াবী আঁখি জোড়া। ভুলতে চেয়েও আরও জেনো জেঁকে ধরেছে এই চোখজোড়া তাঁকে।চোখ বন্ধ করলেই জেনো,ক্রন্দনরত চোখজোড়া তাকে ভর্ৎসনা কর বলছে,যতো যাই করো আমার থেকে তোমার ছুটকারা নেই,নেই নিস্তার।নেই মানেই কোনোমতেও নেই।চোখ খুললো নিভান।ইভানের মুখের দিকে তাকালো।ছেলেটা এখনো চোখ বন্ধ করে গেয়ে চলেছে।কি দুর্দান্ত তার গলার স্বর।চোখ ঘুরিয়ে ওয়ালের উপরে রাখা কফিটার উপর নজর ফেললো সে।কফিটা ঠান্ডা হতে বসেছে,খাবে না না-কি?আর ঠান্ডা হলেও কি,বাসি হলেও ইভান ঠিকই খেয়ে নেবে।

এক মুঠু সপ্ন এসে ছুয়ে যায় সারাক্ষণ,চেয়ে থাকি আমি তার আশায়
এক মুঠো ইচ্ছে লুকিয়ে রাখি হৃদয়ে,হয়না সাজানো ভালোবাসা।
কখনো মন রোদেলা কখনো হয় মেঘলা, যায় না তারে ভোলা।
কাটেনা যে বেলা, একাকি একেলা ভালোবাসার এ কি জ্বালা…!!

গান শেষ করেও,চোখ খুললো না ইভান।তারপাশে দাঁড়ানো মানুষটার সাথে গলায়গলায় ভাব না থাকলেও, মন খুলে কথা না বললেও,মানুষটা পাশে এসে দাঁড়ালে অদ্ভুত মনোশান্তি অনুভব হয়।অনুভব হয়,বাবার পরে তার আরও আরেকটা ছায়া দেওয়ার জন্য বটবৃক্ষ আছে।যতোই তারসাথে আড়ষ্টতার সম্পর্ক থাকুক না কেনো,সেই মানুষটা সবসময় তার ছায়া হয়ে রয়েছে, থাকবেও।চোখ খুললো ইভান।তবে ভুলেও আশেপাশে তাকালো না।ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফির মগটা হাতে নিয়েই এক চুমুকে সেটা শেষ করে ফেললো।কপাল কুঁচকে সেটা দেখে আবার সামনের দিকে নজর দিলো নিভান।কন্ঠে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বললো।

‘লাইফটা তোমার।বয়সের ম্যাচুরিটিটা-ও হয়তো এসে গেছে,তাই তোমার লাইফের বিশেষ বিশেষ সিদ্ধান্তঃগুলোও তোমার নেওয়া যথার্থ।বাবা মা কখনো তার সন্তানদের জন্য ভুল ডিসিশন নিতে পারেন না,হয়তো সময়ের চক্রে কিছুসময় সেই ডিসিশন ভুল হয়ে যায়।এটা আমার একান্ত ধারনা।তবে তোমার নেওয়া ডিসিশন যে ভুল,এটাও আমি বলছি-না।শুধু বলতে চাইছি তাদের দিকটাও একবার ভেবে দেখা উচিত।আমি তোমার স্বপ্নপূরণ বা ইচ্ছের সাথে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে বলছিনা।তবে তাদেরকে শান্তভাবে বুঝিয়েও সবকিছুর ডিসিশন নেওয়া, তোমার ডিসিশন এর মতোই যথার্থ উচিত।

সামনের দিকে নিটোল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইভান।তবে তার কান সজাগ বড় দাদাভাইয়ের উপদেশ মুলক বানীতে।সেদিকে একপলক তাকিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য পিছে মুড়ালো নিভান। দুকদম সামনে এগিয়ে ফের দাড়ালো সে।এবার দৃঢ় নজর ফেললো ইভানের স্বশরীরে।তখনও ইভানের নজর সামনে স্থির ।নিভান সেটা খেয়াল করে বললো।

‘আর নিজের লাইফের অর্ধাঙ্গিনী পছন্দ করাও একান্তে তোমার ডিসিশন। তাই বলে যেকোনো মেয়ে আর
যেন-তেন মেয়ে নয়।যে মেয়েটার সাথে সম্পর্কে আছো, সে মেয়েটা ভালো,মেয়ে নয়।তার একাধিক বয়ফ্রেন্ড আছে।বড়াে দাদাভাই হিসাবে সতর্ক করলাম, সিদ্ধান্ত এখন একান্ত তোমার।

তড়িৎ গতিতে পিছে ফিরলো ইভান।ততক্ষণে পা চালিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে নিভান।ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো ইভানের।গলা চড়িয়ে নিভানকে উদ্দেশ্য করে বললো—আই হেইট ইউ দাদাভাই।

‘আই হেইট ইউ টুহ্।

ছাঁদের দরজা পানে যেতেই ইভানের বলা বাক্যগুলো কানে পৌঁছালো নিভানের।তবু-ও পিছে মুড়লোনা সে।তবে উত্তর সরূপ একই বাক্যগুলো ইভানের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে যেতে মোটেও কার্পণ্য করলো’না সে।

.

মেয়েটার সাথে লোক দেখানো সম্পর্কে জড়িয়েছিলো ইভান।কারন যেটা ছিলো,সেটাতে সাকসেসফুল হয়েছে সে।মুখের হাসি চওড়া হলো তার।সেই খুশিতে হঠাৎই ছাঁদের কোণায় লুকিয়ে থাকা মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘গান শুনবে ফুলকৌড়ি।

চমকে উঠলো কৌড়ি।নাফিমকে ছাঁদের দিকে আসতে দেখে সে ছাঁদে এসেছিলো।এসে দেখে ইভানও আছে।তাই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিলো।হঠাৎই সেই ভয়ংকর গলার মানুষটার ছায়া,ছাঁদের দরজায় পড়তে দেখেই ছেলেমানুষী করে ফেলেছে সে।উনাকে পাশ কাটিয়ে ভদ্র মেয়ের মতো চলে যাওয়া যেতো।কেননা কোনো কারন ছাড়াতেো আর কিছু বলতেন না তিনি।তবে পা বাড়িয়েও,মনের শঙ্কায় যেতে পারিনি সে।গা কেমন কাটা দিয়ে উঠেছিলো তার।তাই ছাঁদের অন্য পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলো।দরজা মুখো হয়ে মানুষটা ছাদের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকার কারনে পরবর্তীতেও যেতে পারিনি।তবে সেই মানুষটার নজরে পড়লোনা, এই মানুষটার নজরে পড়ে গেলো স।লোকটা তো সাংঘাতিক।কৌড়ির ভাবনার মাঝেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো ইভান।ফের উচ্ছল কন্ঠে বললো।

‘আমার মনটা আজ খুব খুব ভালো।চলো তোমাকে আরেকটা গান শোনাই।

কৌড়ি কিছু বলতে যাবে।তার আগেই ছাঁদের অন্য প্রান্ত থেকে নাফিম দৌড়ে এসে ইভানকে উদ্দেশ্যে বললো।

‘একটু আগে তুমি-না বললে তোমার মন খারাপ। এখন বলছো মনটা খুব খুব ভালো?

‘একটু আগে খারাপ ছিলো।কিন্তু এখন মনটা ওই ঝকঝকা আকাশের মতো রিফ্রেশ হয়ে গেছেরে পিচ্চু।

একটা মানুষ তাকে তার গার্লফ্রেন্ড থেকে ব্রেকাপের নিমন্ত্রণ দিয়ে গেলো।অথচ সেই মানুষটা বলছে তার মন ভিষণ ভালো এখন।একটু আগে দু-ভাই যে শব্দগুলো একে অপরের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলো।তারপরও ছেলেটা বলছে তার মন ভিষণ ভালো।কি অদ্ভুত ছেলেরে বাবাহ।দুভাই একে অপরের থেকে কেউ কম না।দু’টোই অদ্ভুত!কৌড়ির ফের ভাবনার মাঝে নাফিম বললো।

‘বড়ো দাদাভাই তোমাকে কতোগুলো বকা দেওয়া কথা শুনিয়ে গেলো তারপরও তোমার মন ভালো হয়ে গেছে বলছো?

‘তারপর তো মনটা ভালো হয়ে গেলো রে পিচ্চু।ও তুই বুঝবিনা।

সত্যিই নাফিম বুঝলো না।তবে ইভানের কঠিন কঠিন কথার মধ্যে আর যেতে চাইলোনা।তাই কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো–এই ফুলকৌড়ি তুমি কখন ছাঁদে এলে?চলো বাগানের ওদিকে যাই।

সুযোগটা চাইছিলো কৌড়ি।ইতিমধ্যে নাফিম কৌড়ির হাত ধরেছে।নাফিমের সাথে যেতে উদ্যোক্ত হতেই ইভান বললো।

‘কি ব্যাপার বলোতো ফুলকৌড়ি।তুমি দাদাভাইকে দেখে এরকম পালাই পালাই খেলছো কেনো?সকালেও দেখলাম দাদাভাইকে দেখে পালাতে,এখনো।ভয়ে নাকি সামথিং সামথিং,কোনটা?

শেষের কথাগুলো ঘনোঘনো ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল ইভান।কৌড়ি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো ইভানের মুখের দিকে।এই ছেলে কিকরে বুঝলো,সে ওই লোকটা কে দেখে পালাই পালাই করছে।আর তার গতিবিধি-ও লক্ষ্য করছে ছেলেটা?তবে ভয় তো অবশ্যই।কিন্তু সামথিং সামথিং মানেটা কি?অচেনা একটা ছেলের সাথে তর্কবিতর্ক করা ঠিক মনে হলোনা বলে,পাল্টা প্রশ্ন করতে পারলোনা কৌড়ি।ইভান ফের ভ্রু নাচাতেই বললো।

‘তুমিও দাদাভাইকে ভয় পেতে শুরু করলে?

নাফিমের কথায় অসহায় নজরে তারপানে চাইলো কৌড়ি।সেটা দেখে নাফিম একগাল হেসে দিয়ে বললো- এটা কোনো ব্যাপার না।সবাই দাদাভাইকে একটু আধটু ভয় পায়।তাতে তোমার ভয় পাওয়াটা মোটেই দোষের নয়।চলো….

কৌড়ির হাত ধরে চলে নিয়ে গেল নাফিম।ইভানও আর কথা বাড়াতে চাইলো-না বলে।তবে কৌড়ির যাবার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনেমনে বললো- মাকে একটা সুপরামর্শ দেওয়া উচিত।

সময়টা সকালবেলা।বাড়ির ছেলেমেয়েগুলো খেয়েদেয়ে যে যার সময় মতো স্কুলে চলে গেছে।আজকে জাহিদ সাহেবের সপ্তাহে চেকাপ করার দিন তাই নীহারিকা বেগম উনাকে নিয়ে হসপিটালে গেছেন।ফাতেমা বেগম খাবারটা আজ রুমে খেয়েছেন।স্বান্তনা রহমানের শরীরটা খারাপ থাকায়,এখনো শুয়ে আছেন। বাড়িটা আপতত নিরিবিলি।ডায়নিং টেবিলের মধ্যেবর্তী একটা চেয়ারে বসে চুপচাপ খাবার খাচ্ছে কৌড়ি।সে আর রানীসাহেবা ছাড়া আপতত নিচে কেউ নেই।সে ডাইনিংয়ে খাচ্ছে আর রানীসাহেবা রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করে চলেছে।খাবার মধ্যে কৌড়ির হঠাৎই মনে হলো তার অপর পাশের সামনের চেয়াটায় এসে কেউ বসেছে।একটা কড়া মিষ্টি সুবাস নাকে এসে ঠেকতেই,কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারলো মানুষটা কে।হঠাৎই খাবার গলায় আঁটকে গেলো কৌড়ির।ভুলেও মুখ উঁচু করে তাকালো না সে।তবে গলায় আটকে থাকা খাবারটা বিষমে পরনিত হলো সামনে বসা মানুষটার গম্ভীর গলার স্বরে।

‘রানীসাহেবা আমাকে এককাপ কফি দিয়েন তো।

ব্যাস।সামন্য এক লাইনের স্বাভাবিক কথা।কৌড়ির বিষম লাগার কারন নাহলেও,ভয়ে হোক বা সংকোচে বিষম লেগে গেলো তার।তবু্ও মাথা উঁচু করলোনা,মাথা নিচু রেখেই কেশে গেলো।আশ্চর্য হয়ে মাথানিচু করে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো নিভান।ড্রয়িংরুম থেকে ডায়নিং টেবিল ফাঁকা দেখে সে ডায়নিংয়ের দিকে এসেছিলো।তখন কৌড়িকে খেয়াল না করলেও কাছে আসতেই বুঝতে পেরেছিলো।চুপচাপ নিঃশব্দে একটা মেয়ে ডায়নিংয়ে বসে খাচ্ছে।সেটা দেখে চলে যেতে চেয়েছিলো,তবে বিষয়টা কেমন দেখায় তাই আর চলে যায়নি।নিঃশব্দে এসে ডায়নিংয়ে বসেছে।আর মেয়েটাও তো স্বাভাবিক ভাবে খাচ্ছিলো।তবে হঠাৎ কি এমন হলো,যে বিষম খেতে হলো?খাওয়ার ধরনও তো তাড়াহুড়ো নয়।আস্তেআস্তে।তবে বিষম খাওয়ার কারন কি?

‘রানিসাহেবা।জলদি এদিকে আসুন।

কৌড়ির বিষম কানে যেতেই ডায়নিংয়ে আসছিলো রানী।শুধু ভীমের ফ্যানাতে ভরা হাতটা ধুতে যেটুকু সময় লেগেছে।তার আগেই নিভানের ডাকে ছুটে এলো সে।রানী কাছে আসতেই, পানি ভর্তি গ্লাসটা তার দিকে এগিয়ে দিলো নিভান।ফের বললো।—পানি খেতে দিন তাকে।

আগের দিনের মতো হয়নি।অল্পতে বিষম ছেড়ে গেলো কৌড়ির।তবে বিষম লাগায় গলাবুক জ্বলে যাওয়ার সাথে সাথে চোখ দিয়ে অনর্গল পানিও বের হয়ে গেলো তার।মুখ উচু করে পানি খেতে গিয়ে সেই নজরে একবার নজর পড়লো নিভানের।সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।পানি খেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।সঙ্গে মনেমনে নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত হলো।কারও গলার স্বর গম্ভীর হতেই পারে,তারজন্য বিষম খাওয়ার কোনো মানে হয়!গম্ভীর গলার স্বরতো তো তার বাবারও ছিলো,তবে এতোটাও ভয়ংকর নয়।কৌড়ির বিষম ছেড়ে দিতেই রানীসাহেবা ফের রান্নাঘরে যেতে উদ্যোগী হলেন।

‘নিভান বাবা,আমি চুলোয় দুধ বসিয়ে দিয়ে এসেছি।এক মিনিট দেরী করো,তোমার কফি দিচ্ছি।

হঠাৎই কফি খাওয়ার মুডটা জেনো নষ্ট হয়ে গেলো নিভানের।বললো–আপতত লাগবে না।আপনি কি জেন করছিলেন,সেটাই মনোযোগ দিন।

কৌড়ি মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছো।সেদিকে একপলক শান্ত নজর ফেলে চলে গেল নিভান।সেদিকে আঁড়চোখে একবার তাকিয়ে এতোক্ষণের চেপে রাখা শ্বাস,বুকে হাত দিয়ে জোরে-শোরে ছেড়ে দিলো কৌড়ি।
খেতে আর ইচ্ছে করলোনা।হঠাৎ করে ডায়নিংয়ে উদয় হলো ইভান।সে এতো সময় সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে ডায়নিংয়ের চিত্র দেখেছে।তাই বসতে বসতে বললো।

‘আজ বিষম-ও উঠে গেলো দাদাভাইকে দেখে!লক্ষ্মণ কিন্তু মোটেও ভালো বলছে না ফুলকৌড়ি।আমার কালকের প্রশ্নের উত্তর দিলে না তো।এইযে দাদাভাইকে দেখে তোমার পালাই পাালই,বিষম উঠে যাওয়া।ভয়ে নাকি সামথিং সামথিং।

এই লোকটা তার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করছে?এ কি অদ্ভুত ঝামেলায় ফেঁসে গেলো সে।কালকের মতো ইভানকে ভ্রুু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করতে দেখে মিনমিন স্বরে মুখ খুললো কৌড়ি।

‘উনার গলার স্বর শুনলেই আমার কলিজা কেঁপে যায়।কেমন অদ্ভুত মানুষ উনি।তাই….

কথা শেষ করলোনা কৌড়ি।তবে কৌড়ির না বলা কথার অংবিশেষ বুঝে নিতে পারল ইভান।আর কৌড়ি অদ্ভুত মানুষ উনি বলতে কি বোঝালো।সেটাতে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে,নিজের দু-হাতের কনুই সঁপে দিলো টেবিলে।ফের দুগালে দুহাত রেখে বিজ্ঞ ব্যাক্তির মতো করে বললো।

‘দেখো,আবার ওই অদ্ভুত মানুষটার প্রেমে পড়ে যেওনা জেনো।উনার আশেপাশের মেয়েরা কিন্তু ওই অদ্ভুত মানুষটাতেই পিছলে যায়।এই দেখো আমার গায়ের রঙ কতো ফর্সা অথচ ওই শ্যামবর্ণ অদ্ভুত ছেলেটাতেই সবাই মুগ্ধ হয়।ভালোবেসে ফেলে।তুমি আবার ভয় পেতে গিয়ে ডুব দিও-না জেনো,সেই অদ্ভুত মানুষটার প্রেমে।সাবধান ফুলকৌড়ি!

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
পর্ব(৯)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বাবার মৃত্যুর আজ পনেরো দিন পার হয়ে গেলো। কৌড়ি-ও এবাড়িতে এসেছে আজ প্রায় পনেরো দিনের মতো।নারী মানুষের জীবন কেমন অদ্ভুতময় হয়,তাই না?নির্দিষ্ট কোনো স্থানে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাদের জীবনটা স্থায়ীত্ব হয়-না।জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নির্দিষ্ট বয়সের কিছু বছর বাবার সংসারে কাটাতে হয়।তারপর ভাগ্যের পালাক্রমে শুরু হয় স্বামীর সংসার।সেই
পর-মহলটা আপন করতে করতে,সময় এসে যায় নিজের সংসারটা ছেড়ে দেওয়ার।তারপর বৃদ্ধ বয়সে কিছুদিন এই ছেলের সংসারে তো কিছুদিন ওই ছেলের সংসারে।তবে মেয়ে মানুষের জীবনটাও একটা সময় গিয়ে একটা নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীত্ব হয়,সেই স্থায়ীত্বটা কবরে গিয়েই।হয়তো সবার স্থায়ী বা শেষ ঠিকনা কবর। তবে মেয়ে মানুষেরটা বিশেষ।

সেই মেয়ে মানুষ হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে কৌড়ি।তার জীবনটা অন্য মেয়ে মানুষের থেকে আলাদা হয় কি করে!তবে মেয়ে মানুষের বিয়ের পর বাবার সংসার ছাড়তে হয়,কিন্তু তার তো সেই সময়টা আসার আগেই বাবা-র আশ্রয়টা ছাড়তে হলো।কি অদ্ভুত ভাগ্য।আর সেই ভাগ্য মেনে নেওয়া ছাড়া তার উপায়-ও নেই।নিতে হচ্ছে তাঁকে।এই পনেরো দিনে এবাড়িটার প্রতিটি মানুষের সাথে মিশে যেতে শুরু করেছে সে।মানুষগুলাও তেমন,ভিন্ন চরিত্র ভিন্ন স্বভাবের হলেও খুবই অমায়িক ব্যবহার।আর ভালো তো বটেই।হয়তো সে কারনেই বাবা হারিয়ে যাওয়ার শোকটা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সে।

তবে কৌড়ির আজ ভীষন মন খারাপ।এবাড়ির ছেলেমেয়ে গুলোকে রোজ স্কুল কলেজে যেতে দেখলেই তার ভীষন মন খারাপ হয়ে যায়।সে-ও তো বাড়িতে থাকলে,কলেজে যেতো।কলেজ অনিয়মিত করা,পড়াশোনায় হেলা করা।কৌড়ির বাবার মোটেও পছন্দ ছিলোনা।আর সেই হিসাবে কৌড়ি নিজেও কলেজ অনিয়মিত বা পড়াশোনায় হেলা করতো না।কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ করতে হচ্ছে।এইস এস সি
পরিক্ষার তিনমাস বাকী থেকে, আর-ও পনেরোটা দিন কেটে গেলো।বাকী আছে মাত্র আড়াইটা মাস।অথচ সে পড়ালেখা থেকে দূরে।আদৌও তার আর পরিক্ষাটা দেওয়া হবে কি-না কে জানে!তবে বাবার সাথে সাথে তার ও যে স্বপ্ন ছিলো, সে ডাক্তার হবে।তবে?মন খারাপটা আর-ও তীব্র রূপ নিলো।সারাদিন সেই মন খারাপেই কেটে গেলো তার।মৌনতা আর মান্যতা সেটা বুঝতে বিভিন্ন প্রশ্ন করেও উত্তর মেলেনি।কৌড়ির মুখ থেকে মন খারাপের কথাটা কিছুতেই বের করতে পারি নি।না পেরে মান্যতা,মাকে গিয়ে কৌড়ির কথা বিবরণ দিয়ে ডেকে আনলো।নীহারিকা বেগম এসে ভালোমন্দ কথা বলতে থাকলেন।কৌড়ির ভিতরে কি চলছে সেটা জানার জন্য তাকে সহজ করতে লাগলেন।মা বাবা মরা মেয়ে,ভালোমন্দ বলতে,উনারাইতো এখন সব।তাছাড়া কৌড়িকে দেখে তিনি প্রথমদিনই বুঝতে পেরেছিলেন,মেয়েটা চাপা স্বভাবের।অতি প্রয়োজন ছাড়া কখনো নিজের সুবিধা অসুবিধার কথা কাওকে জানাবে না।

‘কৌড়ি,আমার মনেহচ্ছে তোমার মন খারাপ।কি হয়েছে মা?

নীহারিকা বেগমের অমায়িক আচারনে কৌড়ি নিজের ভিতরের কথাগুলো আর চাপিয়ে রাখতে পারলো না।
চাপা স্বভাবটা সরে গিয়ে,মন গলে গেলো।আবেগপ্রবণ হয়ে বলে ফেললো।

‘আন্টি, আমি পরিক্ষা দিতে চাই।

আশ্চর্য হয়ে নীহারিকা বেগম বললেন।–দেবে।এটাতে বাঁধা কে দিচ্ছে।আর অবশ্যই তুমি পরিক্ষা দেবে।এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

‘আমার পরিক্ষার আর কিছুদিন বাকি আছে আন্টি।কলেজে যাওয়া দরকার।আর কলেজ না গেলেও পড়টা তো খুবই দরকার।কিন্তু আমার তো বইখাতা বলতে আপাতত কিছুই নেই।কিভাবে পড়বো আমি?

বইখাতা কিছুই নেই,এই কথাগুলো বলতে হবে বিধায় লজ্জা পাচ্ছিলো কৌড়ি।মান্যতা মৌনতাকেও বলতে পারিনি ।এবাড়ির মানুষগুলো তাকে খেতে পরতে দিচ্ছে এটাই তো অনেক।তার উপর নিজের জন্য নিজ থেকে কিছু চাওয়া সত্যিই কৌড়ির জন্য লজ্জাকর।তাই-তো বিষয়টা নিয়ে গুমরে মরলেও কাওকে বলতে পারছিলো না।তবে নীহারিকা বেগমের কোমল আচারনের জন্য বলতে হলো তাকে।আর না বলেও উপায়!পড়াশোনাটা ছাড়া জীবনে আর কি হারাতে বাকী আছে তার।সেই পড়াশোনাটার জন্য নাহয় একটু চেষ্টা করল।নীহারিকা বেগম নিস্প্রভ নজরে কিছুসময় কৌড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে তার সংকোচটা বুঝতে চেষ্টা করলেন।হঠাৎ নিভানের এবাড়িতে কাটানো ছোটো-বেলার কথা মনে পড়ে গেলো।উনার নিভানটাও এমন ছিলো।প্রয়োজনেও জিনিস চাইতোনা।বুঝতে পারতো সংসারটা মায়ের হলেও,সেই সংসারের আপনজন সে নয়।এতো বুঝদার ছিলো ছেলেটা।কখনো তাকে নিয়ে অহেতুক কটু কথা শুনতে হয়নি,পড়তে হয়নি কখনো কোনো দ্বিধা লজ্জায়।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীহারিকা বেগম।এই মেয়েটাও সেই একই স্বভাবের বলে মনে হলো উনার।মৃদু হাসলেন।কৌড়ির মাথায় গালে নরম স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন।

‘এজন্য মন খারাপ?এটা কোনো বিষয় হলো,মন খারাপ করার জন্য?পাগল মেয়ে। আজতো আর সময় হবেনা, কাল কাওকে দিয়ে তোমার বই আনিয়ে নেবো।আর কলেজে যাওয়ার ব্যবস্থাটা দেখি কি করা যায়।এবিষয়ে তোমার আঙ্কেল ভালো বুঝবেন।আমি উনার সাথে জরুরি কথা বলছি।আর মন খারাপ করে থেকো-না, ঠিক আছে?

কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেলো কৌড়ির।নীহারিকা বেগমের কথায় মুখে কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেললো।ফের মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।

‘এরকম ছোটো খাটো বিষয়ে কখনো মন খারাপ করবে না।মনে প্রবল আস্থা রাখবে,মন খারাপ করে সেই আস্থা নষ্ট করে ফেলবেনা।তাহলে শত চেষ্টা সব বিফলে যাবে।

মাথা উঁচু করে নিলো কৌড়ি।কৃতজ্ঞতায় ভরা জ্বলজ্বলে চোখদুটো নীহারিকা বেগমের মুখের দিকে নিষ্পলক দিয়ে বললো।–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আন্টি।

‘ধন্যবাদ দেওয়ার মতো কিচ্ছু করিনি।আর না এটা ধন্যবাদ দেওয়ার মতো বিষয়।এটা তোমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়,তোমার প্রাপ্য।যেটা আমাদের গুরুজন হিসাবে গুছিয়ে দেওয়া দায়িত্ব।আর মা হিসাবে সেই দায়িত্বটা পালন করছি বা করতে চাইছি আমি।

আচমকা নীহারিকা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো কৌড়ি।মায়ের আদর তার কখনো ভাগ্যে জুটিনি।তিন তিনজন চাচী থাকতেও সেই অভাবটা থেকে গেছে তার।তবে মেজো চাচী কিছুটা মমতা দেখাতে চাইলেও,উনার ওই কুকুর ছেলেটার জন্য কাছে টানতে পারতেন না।বলতেন, –তোর চাচা মানুষ না।আর তার মতো হয়েছে আমার পেটের ছেলে।দেখিসনা,কি অমানুষ হয়েছে।সারাদিন মদ গাঁজা নিয়ে পড়ে আছে।মন মেজাজ হয়ে থাকে কুকুরের মতো।আর সেরকমই ব্যবহার করে মা বোনের সাথে।আর তাতে আবার তোকে বউ বানানোর জন্য উৎ পেতে বসে আছে।তুই আমার কাছে আসলে সুযোগ পাবে বেশি।তাই আমার কাছে আসবিনা।এবাড়িতে ঢুকবিনা সহজে।আমি চাইনা আমার মতো তোর কপালটা পুড়ুক।নিজের সন্তান হয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি,ওই জানোয়রটা ভুলেও তোর মতো ফুলকে কখনো না ছুঁতে পারুক।তাই এটা তোর চাচীর পক্ষথেকে দূরে থেকেও আগলে রাখা।চাচীযে মা মরা তোকে খুব আদর দিতে চায়,ভালোবাসতে চায়।তবে পারেনা।তাই চাচীর জন্য কখনো মনে দোষ পুষে রাখিস না।অন্য চাচিদের মতো মনে করে ভুল বুঝে থাকিস না।

তবে সত্যি বলতে দূরে থেকেও এটুকু আগলে রেখেছিল চাচি তাকে।তবে সেই ছোট্টোটা থেকে মায়ের অপূর্ণ মমতা ভালোবাসাটা পেয়েছিলো,দাদির কাছথেকে।বৃদ্ধা মানুষ নিজের যথাসাধ্য দিয়ে চেষ্টা করে যেতেন, তার মায়ের অভাবটা পূর্ণ করার।আজ সেই দাদিআপা থেকেও দূরে।নীহারিকা বেগমের মমতা সেই মৃতু মা’কে মনে করিয়ে দিলো।কেমন হতো সেই মমমতাময়ী মায়ের স্পর্শ ভালোবাসা,শাসন-বারন জানা নেই কৌড়ির।তবে যে দাদিআপার থেকে কিছুটা হলেও অনুভব করেছিলো সেই মমতা ভালোবাসা।তা নীহারিকা বেগমের কথায় ব্যবহার নিজের জন্য অনুভাবিত হতেই,প্রকাশ পেতেই আবেগপ্রবণ হলো কৌড়ি।নীহারিকা বেগমও তিন সন্তানের মা। সন্তানের দরদ তিনি বোঝেন।তাই পরম মমতায় কৌড়িকে আগলে নিলেন নিজের বুকে।মাথায় চুমু দিয়ে বললেন।

‘নিজেকে সহজ কর মা।অন্য কাওকে বলতে না পারিস, নিজের প্রয়োজনীয়তা অপ্রয়োজনীতা যা মন চাই এই বড়মাকে অন্তত বলার চেষ্টা করিস,বলিস।মান্যতা আমার নিজের পেটের মেয়ে হলেও,মৌনতাকে আমি মান্যতার থেকে তিল পরিমান কম ভালোবাসিনা।তুইও আমার মান্যতা মৌনতার মতো আরেক মেয়ে।ওদের মতোই মায়ের কাছে আবদার করিস।মা যথাসাধ্য চেষ্টা করবে তোদের আবদার পূরণ করতে, ভালো রাখতে।শুনছিস আমি কি বলছি।বলবি তো?

নিঃশব্দে কেঁদে চললো কৌড়ি। মুখে কিছু বললো-না। শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো।সেটা বুঝে মৃদু হেসে কৌড়ির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে নীহারিকা বেগম ফের বললেন—আর আজ থেকে ওসব আন্টি সান্টি বলবি না।হয়তো মান্যতার মতো মা বলে ডাকবি নয়তো মৌনতার মতো বড়মা বলে।কেমন?ডাকবি তো?

একটু সময় নিয়ে ফের মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো কৌড়ি।সেটা বুঝে আর কথা বাড়ালেন না নীহারিকা বেগম।মেয়েটা এখন তো সম্মতি জানিয়েছে ঠিকই তবে নিজের অপ্রয়োজনীয় তো দূর,প্রয়োজনীয়টা পর্যন্ত বলবে কি উনার সন্ধান। এরকম স্বভাবের একজনকে যে পেলেপুষে বড়ো করেছেন তিনি।তাই এসব স্বভাবের মানুষ সম্পর্কে বেশ আবগত উনি।

এবাড়িতে সবার সাথে মোটামুটি কৌড়ির সখ্যতা গড়ে উঠলেও,সখ্যতা সেভাবে গড়ে উঠেনি দীবার সাথে।মেয়েটার হাবভাব বুঝে পায়না কৌড়ি।এবাড়িতে আসা এই পর্যন্ত কখনো তারসাথে সেভাবে কথা বলেনি।বলিনি বললেই চলে।অথচ কি অদ্ভুত নজরে মাঝেমধ্যে তারদিকে তাকিয়ে থাকে।নিজেরই কেমন এলেবেলে লাগে কৌড়ির।মনেহয়,গ্রামের অদ্ভুত মেয়ে সে।তাদের মতো স্মার্ট চালচলন নয় বলে কি এভাবে তাকিয়ে থাকে?নাকি অন্যকিছু?সেদিন কাশফুল বাগানে ঘুরতে গেলো,সারাটা সময় একসাথে কাটালো অথচ একটা শব্দও তার হয়ে ব্যয় করলোনা।তবে সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে ভুল করেনি।তাকে ওই অদ্ভুত দৃষ্টিতে কি দেখে বুঝে আসেনা কৌড়ির।কি যে অস্বস্তি অনুভব হয় তখন।কি করে বোঝাই ওই মেয়েটাকে।এইযে খাওয়া বাদ দিয়ে তারদিকে সেই তীক্ষ্ণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,যারজন্য ঠিকঠাক ভাবে খেতে পারছেনা কৌড়ি।কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকলে খাওয়া যায়।তবে সকালের এই সময়টাতে তো মেয়েটা খেতে আসেনা।আজ পনেরো দিনেও বেশি,কখনো দেখিনি কৌড়ি।তবে আজ কেনো?

‘কিরে খাবার সামনে রেখে এভাবে বসে আছিস কেনো?
খেয়ে নে?

নীহারিকা বেগমের কথায় খাবারে মনোযোগ দিলো দীবা।তবে খাবার গলা দিয়ে নামতে চাইলো-না তার।কি এক যন্ত্রণার মধ্যে আছে সে।সেই যন্ত্রণার সাথে সাথে দ্বিধায়ও আছে।যন্ত্রনাটা হলো,অসুস্থ একটা বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছেন না সে।আর দ্বিধা হলো সেই সম্পর্ক থেকে নিজেকে মুক্ত করার পর,যাকে সে মনে-প্রাণে চাইছে তাকে সে পাবে তো?হয়তো বা।যারজন্য সিয়ামের সাথে সম্পর্কটায় তার ইতি টানতে হবে তাড়াতাড়ি না-হলে বিয়ে হয়েছে অথচ শ্বশুর বাড়িতে না থেকে বাপের বাড়িতে পড়ে আছে।আশেপাশে পরিচিত কতো মানুষের কতো কথা শুনতে হচ্ছে রোজ তাকে।তাদেরকে তো আর খুলে বলা যায়না সে কি পরিস্থিতির মধ্যে আছে।যারা অন্যের পরিবার সংসার নিয়ে সমোলচনা করে তারা-তো আর জানেনা,সেই পরিবারের সেই সংসারের ভিতরের খবর।তারা শুধু জানে মেয়েটার একটা ভালো বিত্তশালী ফ্যামিলিতে বিয়ে হয়েছিল,ছেলেটাও তো দেখতেশুনতে ভালো। তবে মেয়েটা কেনো বাপের সারক্ষন বাড়িতে পড়ে থাকে?

‘মা কবে আসবে বলেছে নাকি?সেদিন আমার সাথে একবার কথা হলো,সেভাবে তো কিছুই বললো না।

নীহারিকা বেগমের প্রশ্ন মুখ তুলে চাইলো দীবা।বললো- দুই একদিনের মধ্যে আসবে বললো।

‘বাড়িটা একটু শান্ত পরিবেশে আছে সেটা বুঝি ভালো লাগছেনা তোমার?ডেকে ডেকে ঝড় তুফান নিয়ে আসছো কেনো?

মা’কে উদ্দেশ্যে কথাটা বলেই কৌড়ির পাশাপাশি চেয়ারটায় বসে পড়লো ইভান।মায়ের চোখ রাঙানোকে সম্পূর্ণ ইগ্নোর করে বললো।-তোমার বেকার ছেলেটাকে একমুঠো খাবার দাও।

‘তুই কাকাে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললি?নিশ্চয় মা-কে?

দীবা কথাটা বলতেই চমৎকার হেসে দিলো ইভান।মুখে হাসি রেখেই পুরো ৩৬০ডিগ্রী এঙ্গেলো কথা ঘুরিয়ে বললো।—বাবা আর চাচ্চু,তোমাকে ড্রয়িংরুমে ডাকছেন।আামকে বললেন তোমার খাওয়া হলে ডেকে দিতে।ওবাড়ি থেকে সিয়াম ভাইয়ার বাবা মা নাকি ফোন দিয়েছেন।

দীবার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।একপলক উপস্থিত সবার মুখের থেকে চোখ ঘুরিয়ে এনে, উঠে পড়ল সে।আপতত তার খাওয়া আর গলা দিয়ে নামবেনা।হাত ধুয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ালো সে।সেদিকে তাকিয়ে নীহারিকা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বিরক্ত হয়ে বললেন।—কথাটা মেয়েটার খাওয়া শেষ হলে বলা যেতোনা।এতোবড় ছেলে হয়ে গেছিস,এখনো বুঝে শুনে কথা বলতে শিখলি না।মেয়েটা অর্ধেক খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলো।

‘বুঝেশুনেই তো বললাম।আর যার মেয়ের এই অবস্থা, তিনি মেয়ের চিন্তা না করে জমিজায়গার হিসাব নিয়ে সেই না সংসার করা শ্বশুর বাড়িতে পড়ে আছেন।আর তুমি মরে যাচ্ছো,তার মেয়ের চিন্তায়।

ছেলের সাথে তর্কে গেলেন না নীহারিকা বেগম।এই ছেলের সাথে যতো তর্ক যাবেন।উল্টোপাল্টা কথা ছাড়া এই ছেলের মুখ থেকে একটা কথাও বের হবেনা।মা চুপ হয়ে যাওয়ায় ইভানও আর কথা বাড়ালোনা।তবে সে যে চুপচাপ থাকার ছেলে নয়।পাশে থাকা কৌড়ির দিকে নজর দিলো।মেয়েটা সংকোচ নিয়ে বসে প্লেটের খাবার নেড়ে যাচ্ছে শুধু।গালে তুলছে কম। কি কারনে বুঝতে অসুবিধা হলো না ইভানের।তড়িৎ উঠে কৌড়ির অপর পাশের সামনাসামনি চেয়ারে গিয়ে বসলো সে।ফের কালকের মতো টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে দু’হাত দুগালে চেপে কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘কি ব্যাপার ফুলকৌড়ি আশেপাশে তো কোথাও দাদাভাইকে দেখছিনা,তবে কেনোএতো ভয়ে ভয়ে সংকোচে খাবার খাচ্ছো? তবে তুমি মোটেও চিন্তা করো না,দাদাভাই নিচে নামলো বলে কথা ।তাই বলছি বিষম লাগার আগেই খাবারটা খেয়ে নাও।নাহলে আজকের বিষম লাগাটা কিন্তু তুমি কিছুতেই হজম করতে পারবে না।

বাবা সহজে নিজের অসুস্থতার কারনে রুমের বাহিরে খুব একটা আসেন না।প্রয়োজন ছাড়া।তবে আজ এসেছে।ইভান,ড্রয়িংরুমে দেখে এসেছে বাবা আর চাচ্চু কি বিষয় নিয়ে আলাপআলোচনা করছে।সেখানে ইতিমধ্যে স্বয়ং ঝামেলাকে-ও পাঠিয়ে দিয়েছে ইভান।এখন দাদাভাই নিচে নামবে।আর বাবা সেই ঝামেলার সমাধান সরূপ দাদাভাইয়ের কাছে পরামর্শ চাইবে।আর দাদাভাই তার ওই জলদগম্ভীর গলা দিয়ে পরামর্শ সরূপ কি বানী ছাড়তে পারে,এটা এখানে বসে মুখস্থ বলে দিতে পারে ইভান।আর সামনে বসা এই ভীতু মেয়ে যদি সেই গলার স্বরের কথাগুলো শোনে।তাহলে বিষম কনফার্ম হতে সময় লাগবেনা।কৌড়ির বোকা চাহুনীর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে খাবারের প্লেটের দিকে ইশারা করলো ইভান।ফের মুখে বললো।

‘বসে আছো কেনো,জলদি খেয়ে নাও।

অসহায় নজরটা প্লেটে দিকে দিলো কৌড়ি।আজ পনেরো দিনে এই ছেলেটাকে সে খুব ভালোকরে চিনে ফেলেছে।কারও একটা দূর্বল পয়েন্ট পেলেই হয়,সেটা নিয়ে তাকে সামনে পেলেই শুরু হয়ে যাবে তাকে ক্ষপানো।এরজন্য এতো বড় ছেলে বড়মার কাছে বকা কম খায়না।তবুও ইতোড়ের মতো পিছনে লেগে থাকবে।এমন একটা ভাব,কে কি বললো বা বলছে এরা থোড়াই না তার যায় আসে।তবে ইভানের কথা সত্যিয়িত করে ড্রয়িং রুম থেকে গম্ভীর গলার স্বরটা আসতেই খাওয়া থেমে গেলো কৌড়ির।ইভানের মুখের দিকে চকিতে তাকাতেই দেখলো,মনোযোগ দিয়ে ভদ্রসভ্য ছেলের মতো খাচ্ছে।অথচ কৌড়ির তাকানোটা মাথা নিচু রেখেই বেশ বুঝতে পারলো ইভান।উপহাসের স্বরে বললো।

‘বলেছিলাম শোনোনি,এখন বিষম লাগার ভয়ে না খেয়ে বসে থাকো।

সকালে অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়েই নজরে পড়লো সোফায় বসা জাহিদ সাহেবকে।পাশাপাশি সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন, শাহেদ সাহেব।বিগত পনেরো দিনের বিজনেস ট্যুর সেরে গতকাল রাতে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।আর তাদের মধ্যেমনি হয়ে মাথা নিচুকরে বসে আছে দীবা।নিভানের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক আর বুদ্ধিদীপ্ত নজর মূহুর্তেই বুঝে নিতে পারলো,এখানে কি আলাপআলোচনা চলছে।সেদিকে মোটেই গুরুত্ব দিলো না নিভান।ধাপেধাপে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো সে।বড়বড় পা ফেলে ড্রয়িংরুম পার হতেই জাহিদ সাহেব ডাকলেন তাকে।

‘নিভান।তোমার সাথে জরুরি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার ছিলো।

জরুরি বিষয়টা কি?জানা সত্ত্বেও ডাক উপেক্ষা করলো না নিভান।পিছে ফিরে সরাসরি জাহিদ সাহেবের মুখের দিকে তাকালো।বুঝতে পারা সত্ত্বেও গম্ভীর কন্ঠে বললো।

‘বলুন।

জাহিদ সাহেব এবং শাহেদ সাহেব দু’জনের মুখ গম্ভীর। তবে দীবার আশাবাদী মুখটা উৎসাহিত হয়ে আছে,নিভানের মুখপানে চেয়ে।সেদিকে নিজের নজর ভুলেও ফেললোনা নিভান।নিজের দৃঢ় নজর শুধু স্থির রাখলো জাহিদ সাহেবের মুখপানে। জাহিদ সাহেব বললেন।

‘সিয়ামের বাবা মা ফোন দিয়েছিলেন,উনারা দীবাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন।কিন্তু আমার মনে-হচ্ছে, এতো কিছু হওয়ার পর সেখানে মেয়েটার না যাওয়াই উচিত।আর দীবাও চাইছেনা,সিয়ামের সাথে সম্পর্ক রাখতে। ওদিকে উনারাও অনুনয়বিনয় করছেন।ছেলে মানুষ ভুল করে ফেলেছে,তাই বলে সম্পর্কচ্ছেদ করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।বিভিন্ন কথা অনুনয়-বিনয় করে বলছেন।উনাদের অনুনয়-বিনয় শুনে তোমার ছোটো চাচ্চুও বলছিলেন সবাই মিলে একজায়গায় বসে উভয়পক্ষের কথা দ্বারা একটা সিদ্ধান্ত নিতে, সমাধান বের করতে।কি করা যায় বলো তো?

‘এখানে আমি কি বলতে পারি?আমি মনে করছিনা,ওর বিষয়ে আমার সিদ্ধান্ত জানানোটা যথাযথ।সেটা আমি আগেও মনে করেনি,এখনো-ও মনে করছি-না।আর দ্বিতীয়ত ও একটা অ্যাডাল্ট মেয়ে।বিয়ের মতামতটা ও নিজেই নিয়েছিলো,আপনারা সেই মতামতের গুরুত্ব দিয়েছিলেন।এখন সেই সম্পর্কে ও সুখে নেই,ভালো নেই বা সেই সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেনা।সেটারও যথাযথ কারন দিয়ে ওকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন।ও যথেষ্ঠ বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে এবং অ্যাডাল্ট পারসন।তাই ওর সিদ্ধান্তটা আপতত ওকেই নিতে দিন।তবে বুঝে এবং অন্যের দোষ ত্রুটিগুলোর সাথে সাথে নিজের দোষত্রুটি গুলোও খুঁজে।সেখানে ও থাকতে চায় নাকি না।আর
এখানে আমার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করার মতো প্রয়োজন বা গুরুত্ব কোনোটাই আমি দেখছিনা।

দৃঢ়কণ্ঠে কথাগুলো বলে একটু থামলো নিভান।তবে নজরের নড়চড় হলোনা।জাহিদ সাহেবের ভাবান্তর মুখের দিকে চেয়ে ফের বললো–আর একান্ত আপনারা ওর গার্ডিয়ান হয়ে যদি ভালোমন্দ মতামত গ্রহন করতে চান,তবে ওর কাছে জিজ্ঞেস করে নিন।সেই সিদ্ধান্ত ও খুশি মনে মেনে নেবে কি-না?যদি নেয়,তবে ছোটো চাচ্চুর পরামর্শ অনুযায়ী দুই পরিবার একসাথে হয়ে,দুজনের ভালোমন্দ কথা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিন।এখানে আমার সিদ্ধান্তের একান্ত প্রয়োজনীতা নেই।জীবন-টা ওদের তাই সামনের পথটাও ওদেরকেই বেছে নিতে বলুন।

বড়বড় পা ফেলে চলে গেলো নিভান।সেদিকে ভারাক্রান্ত নজরে তাকিয়ে রইলো দীবা।নিভান এতোটা অবজ্ঞা করে তাকে।অথচ আগেও তারসাথে কম কথা হলেও এতোটা অবজ্ঞা করে কথা বলতোনা সে।নিভান বরাবরই প্রয়োজন ছাড়া কম কথা বলে,তাই বলে এতো রুক্ষ ভাষা!কতো সাবলীলভাবে কথাগুলো বলে গেলো সে।তারদিকে একবারও ফিরে চেয়ে দেখারও প্রয়োজন মনে করলোনা।তবে কি সত্যিই নিভানের ফেলে দেওয়া থুথু হয়ে গেলো।যার দিকে দ্বিতীয়বার চর ফিরে তাকাতে চায়না নিভান।অথচ সেই নিভানকে নিয়েই তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্য ঝগড়ার উৎপত্তি শুরু হয়।যদিও দোষ নিভানের নয়,তার জাগ্রত হওয়া ভুল সময়ের অনুভূতির।

একটা বিজনেস কন্ট্রাক্ট সাইন করার জন্য জাহিদ সাহেবের সিগনেচার দরকার।কারন জে এইস জে এর চেয়ারম্যান এখনো উনি।যদি-ও কোম্পানির নির্দেশনায় পরিচালনায় নিভানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়।তবুও যেকোনো কোম্পানির সাথে কন্ট্রাক্ট সাইন করার আগে ডিলকৃত কোম্পানি সম্পর্কে উনাকে বিস্তারিত জানানো এবং কন্ট্রাক্ট সাইন করার জন্য অনুমতি নেওয়া প্রযোজ্য মনেহয় নিভানের।এবারও তাই করা হলো।তবে ডিল-কৃত কোম্পানি জাহিদ সাহেবের পুরানো।উনারা জাহিদ সাহেবের সাথে আগেও ব্যবসায় লেনাদেনা করেছেন।তখন জাহিদ সাহেবের ব্যবসার নীতি,উনার সদাচরণ বেশ ভালো লেগেছিলো।উনি অসুস্থ শুনে তাই সরাসরি উনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান।এবং কথাও বলতে চান।বিকালের সময়টাতে উনাদের,বাড়িতে আসার ইনভাইটেশন দিলো নিভান।সেটা বাড়িতে জানিয়েও দিলো।বিকাল গড়াতেই হাজির হলেন উনারা।

উনাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হলো বাড়ির অন্দরে নয়,বিভিন্ন ফুলে আচ্ছাদিত সাজোনো গার্ডেন এরিয়াতে।গোল চেয়ার টেবিলে বসার আয়োজন হলো।চা নাস্তা সহ বিভিন্ন খাবারে টেবিল ভরে উঠলো।মুখোমুখি বসে দু’পক্ষ কথাতে মশগুল।কোম্পানির বিভিন্ন কার্যক্রম এবং নিজদের ব্যাক্তিগত কথাও চললো সেখানে।তবে চারজন ব্যাক্তির মধ্যে, একজনের মুগ্ধ নজর গার্ডেন এরিয়ার অপরপাশে।যেখানে দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।তারমধ্য কালো সাধারণ একটা প্লাজু পরা সাথে কালো মিশালে সাধারণ চেইকের জামার সঙ্গে সুন্দর করে গায়ে মাথায় কালো উড়না জড়ানো মেয়েটার সৌন্দর্যে বিভোর হলো সে।বিকালের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য জেনো ফিকে পড়েছে মেয়েটার ওই সৌন্দর্যে।কালো ড্রেসআপে গোলগাল ফর্সা মুখটা নজর কেড়েছে বেশি।সাথে মেয়েটার মাথার ওড়না ভেদ করে কোমর ছাড়া হাঁটু ছুঁইছুঁই চুলগুলো।এই অধুনিক শহরের মেয়েদের কৃত্রিম সজ্জা চেহারা দেখতে দেখতে হঠাৎই এরকম সাদামাটা সৌন্দর্য দেখে নজর মুগ্ধ হতে বাধ্য হলো ছেলেটা।

তীক্ষ্ণ নজরে নিজের মুখোমুখি বসা ছেলেটাকে লক্ষ্য করলো নিভান।ছেলেটার মুগ্ধ নিষ্পলক নজরও তার এড়ালোনা।ছেলেটা,তাদের কোম্পানির সাথে ডিলকৃত কোম্পানির কর্ণধার নওশাদ চৌধুরীর ছেলে বিহান চৌধুরী।তবে ছেলেটা তার পিছনে এরকম নিস্পলক নজরে তাকিয়ে কি দেখছে?ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরতেই, নিজেও কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে পুনরায় সোজা নজর ফেললো বিহানের সুদর্শন মুখের দিকে।গলা জোরেশোরে ঝাড়লো নিভান।গলার স্বরের তীক্ষ্ণতায় হুঁশ ফিরলো বিহানের।মনেমনে লজ্জিত হয়ে নড়েচড়ে বসলো সে।তবে চেহারায় সেটা প্রকাশ পেতে দিলোনা।তবে নিভানের তীক্ষ্ণ নজর সেটা ঠিকই অনুধাবন করলো।পায়ের উপর পা তুলে,চেয়ারে গা ছেড়ে দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বসার ভঙ্গিমা চেঞ্জ করে সামনে বসা মানুষটার দিকে ঝুঁকে বসলো সে।গম্ভীর কন্ঠের তীক্ষ্ণতা বজায় রেখেই বললো।

‘ব্যাবসার নীতি কি জানেন?সততা।আর সততার নীতি কি জানেন?চরিত্র।আর চরিত্রের নীতি হলো ব্যক্তিত্ব।আর একজন পুরুষ মানুষের ব্যক্তিত্ব ঠিক না থাকলে তাকে সুপুরুষ বলা যায়না।আর একজন ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ না ব্যবসায়ের কর্ণধার হতে পারে।আর না সেই পুরুষটা কোনো স্পেশাল নারীর কাম্য।

লজ্জায় কান মাথা গরম হয়ে উঠলো বিহানের।মুখের বহির্ভাগ ধারন করলো রক্তিম। সামনে বসা অতি চতুর লোকটা যে তাঁকে বেশ লক্ষ্য করেছে বুঝতে পারলো বিহান।যদিও অল্প বয়সে নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা আর চতুরতা দিয়ে বাবার ব্যবসায় বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে লোকটা,এটা জানা সত্ত্বেও তারই সামনে বসে লজ্জাজনক কাজটা করে ফেললো কিকরে বুঝতে পারলোনা বিহান।তবে সত্যি বলতে মেয়েটার সাদামাটা সৌন্দর্য তাকে বিমোহিত করেছে।বিধায় কার সামনে বসে আছে অনুধাবনে ছিলোনা।ফের নিভানের তীক্ষ্ণ বাক্যে, বিহানের মুখাবয়ব কঠিন হয়ে এলো।

‘আমার বাড়ির প্রতিটি নারীই স্পেশাল।আমরা আশা রাখি,এবাড়িতে যত অপরিচিত ব্যক্তি প্রবেশ করবে আমাদের বাড়ির নারীদের নজরে পড়তেই তারা নজর নিচু করে নেবে।আমরা বরাবরই এমনই মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরী করি,করে আসছি।ব্যবসায়ী ক্ষেত্রেও এই নীতি শিরোধার্য মানা হয়।সো বি কেয়ারফুল মিস্টার বিহান।যেদিকে ভুলে নজর দিয়ে ফেলেছেন, সেদিকে জেনো আর ভুলে-ও নজর না যায়।মনের ভুলে-ও না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে