ফুলকৌড়ি পর্ব-৬০+৬১

0
9

#ফুলকৌড়ি
(৬০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সারারাত মুশলধারায় বর্ষনের পর ভোরের দিকে বর্ষার তোপ কমেছে।প্রকৃতি এখন নিস্তব্ধ, শান্ত।কিছুটা ঠান্ডাভাবও নেমেছে।তারমধ্যে শীততাপনিয়ন্ত্রক রুমটা বেশ আরামদায়ক।কৌড়ি বিভোরে ঘুমাচ্ছে।সামন্য নড়চড় নেই।যেনো রূপকথার রানী,তার শ্রান্ত শরীরটা ঘুমের দেশে বিলিন করে দিয়েছে।গায়ের চাদরটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো।ঘুমের ঘোরে একপেশে হয়ে শোয়ার কারণে শুভ্র পিঠের কাঁধের অংশটা ঝলমলে রোদ্দুরর মতো উঁকি দিচ্ছে।শুভ্র গলার অংশটাও ।যেখানে এখনো স্পষ্ট হয়ে আছে,নিভানের উন্মাদিত হয়ে বউকে ভালোবাসার চিহ্ন।মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিছনায়।মায়াবিনী মুখটাও ঢেকে আছে।সেখান থেকে মৃদুমন্দ উঁকি দিচ্ছে ফর্সা গাল।
নিভান গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে খেয়ালি নজরে দেখলো বউকে।মুলত হাতে কাজ চললেও,সুগভীর,শান্ত মুগ্ধ চোখজোড়া তার বউতে আঁটকে।সারারাত তাকে কাছে পাওয়ার পরও মেয়েটা যেনো এখনো তাকে টানছে।অথচ ঘন্টাখানেক পর তার কনফারেন্স শুরু।সেখানে এ্যাটেণ্ড থাকতে হবে আরও আধাঘন্টা আগে থেকে।বিধায় অনুভূতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে বাধ্য হয়ে মেয়েটাকে ছেড়ে উঠতেই হলো নিভানকে।

মৃদু নড়েচড়ে উঠলো কৌড়ি।মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিলো।নড়াচড়ায় ফর্সা কাধটা আরও একটু উন্মুক্ত হলো।জানালার কাচ ভেদ করে পর্দার ফাঁকফোকড় দিয়ে সূর্যের রশ্মিটা সেই কাঁধে পড়তেই পূর্নিমা চাঁদের মতো দ্যুতি ছড়ালো। আকর্ষিত করলো।নিভান সেদিকে চেয়ে শার্টের বাটুন লাগাতে লাগাতে পূবদিকের বিশাল বড় কাঁচের জানালাটার কাছে চলে গেলো।পর্দাটা বেশ আঁটোসাঁটো করে টেনে দিতেই, সকাল নয়টায়ও রুমটা কেমন সাঝবেলা মনেহলো।নিভান পুনরায় নিজের স্থানে ফিরে এসে নিজেকে প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হলো।
অথচ ঘুরেফিরে নজর তার কৌড়িতে।নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে কৌড়ির পাশে বিছানায় গিয়ে বসলো নিভান।কৌড়ির চোখেমুখে ঢেকে থাকা এলোমেলো চুলগুলো নরম স্পর্শে সরিয়ে দিলো।উন্মুক্ত হলো আদূরে মায়াময় মুখটা।সেই ঘুমান্ত মুখটা অদ্ভুত শান্ত মুগ্ধ নজরে চেয়ে চেয়ে দেখলো কিছুক্ষণ।কালরাতে নিজের অনুভূতি, নিজের পুরুষ চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি এই মায়ামায়া মুখটার আকর্ষণের কবলে পড়ে।এমনিতেই মেয়েটাকে নিভানের কারণে অকারণে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।যার সর্বোচ্চ সীমাটা ছাড়িয়েছে সে কালরাতে।আপনমনেই ঠোঁটে হাসি ফুটলো নিভানের।হাত বাড়িয়ে ছুলো,কৌড়ির ফর্সা কাঁধের মৃদুমন্দ রক্তজমাট জায়গাটায়।ফের মাথা নিচু করে ঠোঁটের গভীর স্পর্শ বসালো সেখানে।কৌড়ি ঘুমের ঘোরেও কেপে উঠলো।নিভান টের পেলো।ঠোঁটের হাসিটা তার চওড়া হলো।কালরাতে তার প্রতিটি স্পর্শে মেয়েটা এভাবে কেঁপে কেঁপে উঠেছে।

নিভানের ঠোঁটের স্পর্শ স্ত্রীর কাঁধ ছুলো গলা ছুলো,নরম গালটা ছুলো।ফের গভীর স্পর্শটা ছুলো কৌড়ির কপাল।এতো আদূরে মেয়েটা!নিভানের ভালোবাসা আদরে যেনো বউটার কোনো বাধানিষেধ নেই।নিভান নিবেদিত করলেই,সে যেনো সেই আদর ভালোবাসাগুলো কুড়িয়ে নিতে ব্যস্ত সযত্নে।কৌড়ি সম্পর্কে কিছু ধারণা তার কালরাতের পর পাল্টে গিয়েছে।নিভান মিষ্টি হাসলো।কৌড়ির গায়ের চাদরটা ঠিক করে দিয়ে ফের আলতো করে তার কপালে আরও একটা চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আর দেরী করা যাবে-না। সময় হয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ কিছু একটা ভেবে কৌড়ির ফোনটা হাতে নিলো।
ফোনে সল্প চার্জ আছে দেখে,চার্জে বসিয়ে দিলো ফোনটা।একবার চেইক করে-ও নিলো,কল করলেই যেনো কৌড়িকে পাওয়া যায়।ফোনটা সাইলেন্ট নয় নরমাল মুডে আছপ।দেখেই রেখে দিলো ফোনটা।হঠাৎ দরজায় নক পড়তেই সেদিকে এগলো।দরজা খুলে দেখলো,হোটেল সার্ভিস-বয়।সকালে উঠতেই খাবার অর্ডার করে ওয়াশরুমে গিয়েছিলো নিভান।যা নিয়ে এসেছে ছেলেটা।খাবারগুলো গুছিয়ে রেখে,নিভান পুনরায় আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।গায়ে ব্লেজার জড়িয়ে অফিশিয়াল ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে চলে যেতে উদ্যোক্ত হতে-ও,বিছনার কাছে এসে দাঁড়ালো।পুনরায় বিছনায় বসলো।গভীর নিদ্রায় ডুবে থাকা বউটাকে একপলক দেখে কলম আর কাগজ বের করে কিছু লিখলো।সেটা টেবিলের উপর কৌড়ির হেয়ারক্লিপটা দিয়ে চাপা রেখে ফের উঠে দাঁড়ালো।কৌড়ির গায়ের চাদরটা আবারও সরে গিয়েছে। সেটা ঠিক করে দিয়ে বউয়ের গালে নরম স্পর্শে ওষ্ঠ ছুঁয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে গেলো।

নিভান বেরিয়ে যেতেই ঠোঁটে হাসি ফুটলো কৌড়ির।ঘুম চোখে সে হাসি সাঝ সকালে ঝিলে ফোঁটা চমৎকার পদ্মফুলের মতো দেখালো।গভীর ঘুমটা কৌড়ির এখনো কাটেনি তবে নিভান কাছে আসায় পারফিউমের তীব্র সুঘ্রাণে ঘুমটা হালকা হয়ে গিয়েছে তার।তবে লজ্জায় দ্বিধায় ভুলেও চোখ খুলতে পারি নি।তার এখানো অনুভব হচ্ছে, মানুষটা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লেপ্টে আছে।সকাল হতে না হতেই কি-করেই বা সেই মানুষটার চোখে চোখ মেলাতো সে!কাল রাতটা মনে করে লজ্জায় গায়ের চাদরটা আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল কৌড়ি।না দেখেও হাত বাড়িয়ে বেডটেবিলটা থেকে একটু আগে নিভানের লিখে যাওয়া চিরকুটটা হাতের মুঠোয় নিলো।মুদে থাকা চোখজোড়া পিটপিট করে চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

নিভানের বনলতা,
ঘুম ভেঙে নিজেকে একা রুমে পেয়ে ভয় পাবে-না কিন্তু একদম।আমি হোটেলের ছয়তলার কনফারেন্স রুমে আছি।তোমার কাছাকাছিই আছি।দ্বিতীয়ত,উঠে ফ্রেশ হবে,খেয়ে নেবে।আর অবশ্যই অবশ্যই ঔষধ খাওয়ার কথা মনে থাকে যেনো!আমি কিন্তু এসে ঔষধ চেইক করবো।সুতরাং ভুলেও যেনো ঔষধ খাওয়াটা মিস না হয়ে যায়।তৃতীয়ত,কোনো অসুবিধা মনে করলে অবশ্যই ফোন করবে লক্ষ্মীটি।

ইতি
তোমার অসভ্য মানুষটা।

আদূরে আদূরে সম্বোধনে কৌড়ির ভিতরটা পুলকিত হলো।মুগ্ধতায় ভরে উঠলো মন।ভালোবাসা প্রগাঢ় হলো সেই মানুষটার প্রতি যে,তাকে তার মনের মতো করে ভালোবাসছে।ওই মানুষকে তার মতো খুব কাছ থেকে না দেখলে, না জানলে কেউ বুঝতে পারবেনা,আসলে মানুষটা ঠিক কেমন?কতোটদ সুন্দর, কতোটা যত্নশীল!কতোটা মুগ্ধকর তার আচরণ!সম্পর্কের প্রতি সে কতোটা বিনয়ী শ্রদ্ধাশীল আর কতোটা অমায়িক!নিজের একান্ত নারীকে গভীরভাবে ভালোবাসতে পুরুষ ঠিক কতোটা বিনয়ী আচারণ করে কৌড়ির জানা নেই। তবে তার পুরুষটা অদ্ভুত অন্যরকম, আলাদা।কালকের রাতটার পর সেই পুরুষটার প্রতি কৌড়ির মায়া,টান ভালোবাসা দ্বিগুণ হয়েছে।দ্বিগুণ নয় গুণহীন হয়েছে।সে ওই মানুষটাকে চায় তার জীবনআয়ু যতদিন চলবে ততোদিন পর্যন্ত।এমনকি মরণের পরবর্তী জীবনে-ও।কৌড়ি আনমনে হাসলো।চিরকুটটা রাখতে গিয়ে দেখলো অপর পৃষ্ঠায়-ও কিছু লেখা আছে।কৌড়ি পৃষ্ঠা উল্টে চোখের সামনে ধরলো।

পাখির নীড়ের মতো সেই মোহমায়া দুটো আঁখি!
যারা কেঁড়ে নিয়েছিলো আমার নৈশর নিদ্রা।
যে আঁখি ভুলতে চেয়ে হৃদগহীন আমার দ্বন্দ্বে জড়ালো।
যার মায়ায় আমার দিন ডুবলো,সন্ধ্যা নামলো।
তবুও না সে আখির মায়া না আমায় ছাড়লো
বরং আমার নিজস্বতা ভুলিয়ে,আমার মধ্যে তাকে বরণ করলো।
গন্তব্য আমার থমকে গিয়েছিল,সেই শোভিত মুখশ্রীতে।
যার কারুকার্যতার মনোমুগ্ধতা ডুবিয়েছে আমাকে, অতল মায়ার কোনো যাদুর বনশ্রীতে।
আমি ছিলাম অন্যমনা,
তবে সেই আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম তার চলাবলা আর বানীতে।
আজ আমার অস্তিত্ব অস্তমিত হলো সেই মায়াবীনিতে।

নিভানের বনলতা,নিভান নিজেকে বারংবার তোমাতেই হারিয়ে ফেলতে চাই।তোমাতেই নিজের অস্তিত্ব অস্তমিত করতে চায়,আমার ভালোবাসা।

কাব্য শেষে লেখাটুকু পড়ে কৌড়ি আবেগপ্রবণ হলো।
সবসময় ওই কঠিন গম্ভীর মুখ করে থাকা মানুষটাকে দেখলে,কেউ কল্পনাও করতে পারবেনা,মানুষটা তার স্ত্রীর কাছে ঠিক কতোটা আবেগী।কতোটা উন্মুক্তমনা।
কৌড়ি সেই মানুষটার স্ত্রী!বড়োই আশ্চর্য লাগে তার।কখনো ভাবেনি ওই মানুষটার সম্মুখীন দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারবে অথচ সেই মানুষটার শরীরজুড়ে থাকে সে।তার বলিষ্ঠ বুকের মধ্যে আর দু’হাতের বাহুবন্ধনীতে আজ সে আগলে রাখা মুকুল।নিজেকেও মাখিয়েছে মানুষটাজুড়ে।চিরকুটটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বুকে জড়ালো কৌড়ি।যেনো নিভানের হাতের লেখা নয়,নিভানের হাতটাকে নিয়েই বুকে জড়ালো সে।সেভাবেই পরম আবেশে চোখ বুঁজে নিলো।বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়িয়ে আওড়ালো–কৌড়িতো আপনাতেই হারিয়ে গেছে,আপনাতেই অস্তমিত হয়েছে।সেই হারানোর গভীরতা যে বড়োই সুদূরপ্রসারী।আর অস্তমিত!এই অস্তমিত সূর্যের আলোকরশ্মির মতো নয়,একটা নির্দিষ্ট সময়ে সে উঠলো আবার একটা নির্দিষ্ট সময় গড়িয়ে সে ডুবে গেলো।এই অস্তমিত বহমান নদীর মতো নিজেকে তারমাঝে বিলিন করে দেওয়া।যেখানে সে নিজেকে ডুবালেও,অস্তিত্ব হারায়না।বরং উল্টে শান্তি আর সুখের প্রবাহমান স্রোত খুঁজে পায়।

দুপুরের রান্নার বন্দোবস্ত করছিলেন নীহারিকা বেগম।যদিও সরঞ্জাম সব গোছগাছ করা।উনার কাজ হলো, শুধু চুলার তাপে বসিয়ে পাকানো।তন্মধ্যে তারমধ্য দুটো তরকারি শেষ করে মাংসকষার খুন্তিটা স্বান্তনা রহমানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নীহারিকা বেগম ছুটে চললেন জাহিদ সাহেবের গোসল সারতে।উনার গোসলের সময় হয়ে গেছে,দেরী করলে অস্বস্তিতে ভোগেন।তাই স্বামীর সেবায় ছোটো জায়ের হাতে কাজ ফেলে ছুটলেন তিনি।কিচেনের সিংয়ে ধোয়াপোঁছার কাজ করছে রানী।নীহারিকা বেগম ছুটতেই,স্বান্তনা রহমান আর রানী টুকিটাকি কথা বলতে বলতে দুজনে নিজেদের কাজে মগ্ন রইলেন।তন্মধ্যে ফাতেমা খাতুন নিজের ঘর থেকে হাঁক ছাড়লেন।

‘ছোটোবউমা,রাণীকে একবার আমার রুমে পাঠাওতো।

দু’বার হাক ছেড়ে কথাগুলো বলতেই স্বান্তনা রহমান পিছে ফিরলেন।রানি কেবল ধোয়াপোঁছার কাজে হাত দিয়েছে।সিংয়ে অনেক থালাবাসন।মুখ ফিরিয়ে কন্ঠ উচু করে শ্বাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন–আম্মা খুব দরকার। আমিই আসবো?

‘না,তোমার আসতে হবেনা।আমার একটু কাজ ছিলো রাণীকে দিয়ে।যাই হোক,ও কাজে থাকলে পরে পাঠিও।

রানীর হাত ততক্ষণে থেমে গেছে।সেটা দেখে স্আান্তনা রহমান বললেন –রানী আপা,যা-ও দেখো আম্মা কি বলছেন।

রানী হাত ধুয়ে কিচেন ছাড়ার আগেই স্বান্তনা রহমান কিছু একটা মনে করে ফের ডাকলেন তাকে–আপা।তন্ময়ী বাড়িতে নেই?ও কি ভার্সিটিতে গিয়েছে?ওকে দেখছি না তো?

‘ছোটো বউমাতো নিজের রুমে। বেশ কয়েকদিন ধরে দেখছি চোখমুখের অবস্থা ভালো-না,শরীরটা মন্দমন্দ ভাব।জিজ্ঞেস করলেই।বলে,তেমন কিছুনা।এমনিতেই শরীর খারাপ।বড়ভাবী তো সকালেও শুধালেন।

শুধিয়েছেন তো তিনিও।রানীর বক্তব্যের মতো একই উত্তর পেয়েছেন।কিন্তু ইদানীং মেয়েটার হাবভাব ভালো ঠেকছেনা উনার।তন্ময়ীর এই হঠাৎ শরীর খারাপের ভাব,চোখমুখের ক্লান্ততা উনাকে অন্যকিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে।তবে তাই যদিই হয়ে থাকে,তবে বিষয়টা জানাতে দ্বিধা কিসের?নাকি লজ্জায় জানাতে পারছেনা মেয়েটা?নাকি তিনিই ভুলভাল ভাবছেন?প্রাপ্তবয়স্ক দুজন ছেলেমেয়ে এতো তাড়াতাড়ি কি ফ্যামিলি প্লানিংয়ে যাবে?তাই যদি হবে,তবে মেয়েটার হোলোটা কি?ইদানীং খাওয়া দাওয়াও তো ঠিকঠাকভাবে করছেনা তন্ময়ী।খাবার দেখলেই যেনো দূরেদূরে থাকছে।বিষয়টা লক্ষ্য করেছেন তিনি।

‘ভাবী আমি আম্মার কাছে গেলাম।

হুঁশে ফিরলেন এমনভাবে রানীর দিকে তাকালেন তিনি।ফের বললেন–আচ্ছা যাও।যাবার আগে তন্ময়ীকে একবার ডেকে দিয়ে যেওতো।

‘আচ্ছা ছোটোভাবী।

রানী চলে গেলো।স্বান্তনা রহমান নিজের কাজে মন দিলেন। তন্ময়ীর সঙ্গে সঙ্গে উনার আরও একটা ভাবনা মাথায় এলো।ইদানীং শাহেদ সাহেবের আচারণ কেমন অস্বাভাবিক ঠেকছে।বাড়িতে থাকলে,কেউ ফোন দিলেই দূরে গিয়ে কথা বলছেন।শান্তশিষ্ট মানুষটার আচারণ কখনো গম্ভীর ছিলোনা।তবে ইদানীং কেমন গম্ভীর গম্ভীর ভাব।যা তিনি শুধিয়েও উত্তর পাচ্ছেন না।

‘কিছু করতে হবে ছোটোমা?

ভাবনা কাটলো উনার।হলদেটে উজ্জ্বল মুখটা কেমন শুকিয়ে ছোটো হয়ে আছে।চশমার আড়ালের চোখদুটোতেও কেমন যেনো ক্লান্তি ভরপুর।আচ্ছা, ইভানের সাথে মেয়েটার সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?স্বান্তনা রহমানের ভাবনার মাঝে,তন্ময়ী সিংয়ভরা বাসনকোসন দেখে সেদিকে এগোলো সে।শ্বশুর বাড়ীতে তাকে মেয়ের মর্যাদায় পুতুল করে রেখেছে বললে চলে।তবুও মেয়ে হলেও তো হাত পা নেড়ে খেতে হয়।একটু আধটু কাজ না করলে কি হয়!মায়ের বানী অনুযায়ী তন্ময়ী কাজ না করলেও শ্বাশুড়ি, চাচাশাশুড়ির সাথে সাথে থাকার চেষ্টা করে। ইদানীং তাও পারছেনা।মনে হচ্ছে এই বুঝি তার হাবভাব টের পেয়ে তারা ধরে ফেললো।আর জেনে ফেললো নতুন অতিথি আসার আগমন। যদিও এটা চেপে রাখার বিষয় নয়।তন্ময়ী চেপে রাখাটা যুক্তিযুক্তও মনে করেনা।তবুও মনেমনে ইভানকে নিয়ে একটা সংশয় কাজ করছে!সেই সংশয় কাটিয়ে সুখসংবাদটা ইভানকে দিতে চেয়েও পারছেনা সে।বাসনে হাত দেওয়ার আগেই স্বান্তনা রহমান তন্ময়ীর হাত চেপে ধরলেন। বললেন-

‘আমি তোমাকে এখানে কাজ করানোর জন্য ডাকেনি।
আর ওগুলোতে তোমাকে হাত লাগাতে কে বলেছে!রানী এসে করে নেবে।তোমাকে ডেকেছি অন্যকারণে।সত্যি করে বলো-তো তোমার কি হয়েছে?ইভানের সঙ্গে কিছু হয়েছে কি?

হঠাৎ প্রশ্নবানে হকচকিয়ে গেলো তন্ময়ী।কিছুটা আমতা আমতা করে বললো–আমার কি হবে।আর ইভানের সঙ্গে কিচ্ছু হয়নি আমার।সবকিছু ঠিক আছে ছোটো-মা।

স্বান্তনা রহমান কেমন তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ফের প্রশ্ন করলেন–‘কিচ্ছু হয়নি?সব ঠিক আছে?

তন্ময়ী জবাব দিতে পারলো না।সত্যি বলতে শ্বাশুড়ি আর চাচীশ্বাশুড়ী দুজনেই অমায়িক মনের মানুষ।ছেলে মেয়েদের ভালোমন্দে তারা বেশ নজরদারি এবং খবরদারি।তাদের চোখ এড়ানো সহজ নয়।তন্ময়ীও চায় না, সেই নজরদারি খবরদারি চোখ তার বেলায় ফাঁকি যাক।তবে..

‘আমি মান্যতা, মৌনতা,তোকে,কৌড়িকে কখনো আলাদা ভাবিনা।দেখিনা।ভাবতে চাইওনা।দেখতে চাইও না।আমি ভাবি তোরা সবাই আমার নিজের।সেখানে আমি একজন মা।আমার নজর বলছে,তোর কিছু একটা তো হয়েছে।হয়তো ইভানের সঙ্গে কিছু।নয়তো…

‘বিলিভ মি,আমার ইভানের সঙ্গে কিচ্ছু হয়নি ছোটমা।

‘তবে কি তুই প্রেগন্যান্ট?

সহসা মুখের উপর প্রশ্ন পড়তেই তন্ময়ী জবাব দিতে পারলোনা।মাতৃত্ব ব্যাপারটা ঢাকাচাপার জিনিস নয়, তবে কোনো একটা কারণের সংশয়ে পড়ে সে কাওকে নিজের প্রেগন্যান্সির কথা জানাতে পারছিলোনা।বাড়ির সবাই হয়তো সুসংবাদটা শুনে খুব খুশি হবে।বাট ইভান!সে কি খুশি হবে?যে এখনো নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে ব্যস্ত।সে কি আদৌও এতো তাড়াতাড়ি নতুন কারও আগমনটা মেনে নেবে?নিতে পারবে?দোষ কি তন্ময়ীকে দেবে না যে,তুমি একটু সতর্ক থাকতে পারলেনা?নাকি সহজভাবে মেনে নেবে।আজ কয়েকদিন ধরে এসব ভেবে চলেছে তন্ময়ী।কয়েকবার ভেবেছে,ইভানকে সে বলে দেবে।যা হয় হবে!স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসায় একটা নতুন প্রানের আগমন ঘটতেই পার।এটা দোষের বা কি? আর এতো ভাবাভাবির ও বা কি?তবুও বলতে পারিনি।বরং তার কি হয়েছে জানতে চেয়ে ইভানকেই উল্টো কাল আবোলতাবোল বলেছে।ইদানীং ঘনোঘনো মুডসুয়িং হচ্ছে।এই ভালো তো এই খারাপ।কি যে হচ্ছে! উফফ!এতো সিদ্ধান্তহীনতা তাকে আরও অসুস্থতাবোধ করাচ্ছে।

‘তন্ময়ী।কি হয়েছে?কি ভাবছিস এতো? আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোক?তুই প্রেগন্যান্ট?

তন্ময়ী এবার অসহায় মুখ করে স্বান্তনা রহমানের দিকে তাকালেন।তাতে উনি বোঝার বুঝে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটে হাসি ফুটলো উনার।উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন-এত ভালো একটা খবর, তুই আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছিস পাগল মেয়ে!নিশ্চয় লজ্জায় বলতে পারিসনি?ইভান জানে?

শেষের বাক্যের উত্তর সরূপ তন্ময়ী মাথা নেড়ে না জানালো।তা দেখে স্বান্তনা রহমানের হাসি চওড়া হলো। মেয়েটা লজ্জা পেয়ে কাওকে জানাইনি।তন্ময়ীকে কাছে টানলেন তিনি।বুকে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললেন–ওরে বোকা মেয়ে,এতো সুন্দর সুসংবাদ তুই ওকেও জানাসনি!আল্লাহ.

আজ কয়েকদিন বাদে তন্ময়ীর মুখে হাসি ফুটলো।এবার যেনো অনুভব হলো,সত্যিই সে মা হতে চলেছে।লোকে ঠিকই বলে,খুশি ভাগ করে নিলে খুশি দ্বিগুন হয়।সেই খুশির মর্মতাও খুব সুগভীর আর আনন্দদায়ক হয়।আচ্ছা, নতুন প্রানের আগমনে ছোটোমা যতোটা খুশি তারচেয়ে তো দ্বিগুণ খুশি ইভানের হওয়ার কথা। সে কি খুশি হবে?তন্ময়ীর ভাবনার মাঝে উচু গলায় স্বান্তনা রহমান হাঁক ছাড়লেন।–ও বুবুনি!তুমি কোথায়?তাড়াতাড়ি এদিকে এসো।

কানে স্বান্তনা রহমানের হাঁক যেতেই নীহারিকা বেগম কেমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন।গায়ের এ্যাশ কালারের কালো পাড়ের শাড়ীটা অর্ধভেজা।জাহিদ সাহেবকে গোসল করাতে গিয়ে রোজ এরকমটা অর্ধভেজা হয়ে যান তিনি।জাহিদ সাহেবকে গোসল করিয়ে পোশাকটা কোনোমতে গায়ে জড়াতেই স্বান্তনা রহমানের হাক শুনতেই দৌড় দিলেন তিনি।নাজানি কি না কি হয়েছে?কিন্তু কিচেনে আসতেই চিত্র অন্য রকম দেখে পায়ের গতি কমালেন।ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, কি হয়েছে তার ঠিক নেই?কিছু হয়নি দেখে স্বস্তির শ্বাস নিলেন।নীহারিকা বেগমকে দেখতেই স্বান্তনা রহমান কেমন উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন–বুবুনি,তুমি এসেছো?তোমার ছোটো বউমা তো কান্ড ঘটিয়ে বসেছে!

তন্ময়ী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।স্বান্তনা রহমান বলেই চললেন–তোমার ছোটো বউমা মা হতে চলেছে।আর তোমার ছোটো ছেলে বাবা!

ওহ আল্লাহ, বলিস কি?আমি দাদি হবো!

বিস্ময়ে মুখে হাত চেপে ধরলেন তিনি।তন্মধ্যে স্বান্তনা রহমান উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন-আরেহ তুমি একা দাদি হবে কেনো।আমরা দাদি হবো।

‘ওই তাই।আমরা দাদি হবো।এতো মহা সুসংবাদ!

নীহারিকা বেগম আনন্দে বাকহারা হলেন।তন্ময়ীর কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে নিলেন বুকে।কপালে চুমু খেলেন,মাথায় চুমু খেলেন।বিস্ময় হয়ে থাকা মন ভাবতে বসলেন,তার দুষ্টু ছেলেটা বাবা হবে!ঈশশ,সেই চঞ্চল, দুষ্ট,প্রানবন্ত ছেলেটা তার বাবা হবে!বাবা!ততক্ষণে স্বান্তনা রহমানের হাঁকে কিচেনে একটা জটলা বসে গেলো।বাড়িতে যে ক’জন মানুষ ছিলেন সবাই হাজির হলেন।সুসংবাদটা সবার কানে যেতেই খুশির হাট বসলো যেনো।হৈচৈ পড়ে গেলো পুরো বাড়িতে।

‘আরেহ হাফিজ কোথায়!হাফিজকে ডেকে মিষ্টি আনতে পাঠা-ও বড়বউমা।আমি বুড়মো হতে চলেছি! কতোদিন পরে বাড়িতে একটা নতুন বাচ্চা আসতে চলেছে!আমার ইভান দাদুভাই বাবা হবে!সুখবর জানাও সবাইকে।জাহিদকে খবরটা দিয়ে এসো,বলো সে দাদু হতে চলেছে।

শ্বাশুড়ির খুশির বার্তায় জাহিদ সাহেবের কথা মনে পড়লো নীহারিকা বেগমের। তখন তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছে,মানুষটাও হয়তো অস্থির হয়ে আছে বাহিরে কি হলো?এই ভেবে।হুইলচেয়ারে বসা থাকলে নিজেই আসতে পারতো।কিন্তু বিছনায় বসা মানুষটার ছটফট করা ছাড়া উপায় নেই।দীর্ঘশ্বাস ফেলে তন্ময়ীকে বুক থেকে ছাড়লেন তিনি।মায়াময় দৃষ্টি ফেললেন মেয়েটার লাজুক মলিন মুখের দিকে।উজ্জ্বল হলুদ মুখটা মলিন হওয়ার কারণ,তবে এটা!তন্ময়ী কোনো একটা অসুস্থতায় ভুগছে এটা তিনি বেশ বুঝতে পেরেছিলেন।যার উত্তর, বারবার শুধিয়েও মেলেনি।হয়তো মেয়েটার লজ্জায় বলতে পারিনি।কিন্তু কারনটা এটা হতে পারে এটা তিনিও আশা করেন-নি।অমায়িক হাসলেন নীহারিকা বেগম।তন্ময়ীর মাথায় মমতার হাত ছোঁয়ালেন।সেই হাত নেমে এলো মেয়েটার গালে।অতঃপর সেই হাত নিজের ঠোঁটে এনে স্পর্শ করে নীহারিকা বেগম বললেন –আমার আয়ু কেটে নিয়ে হলেও আল্লাহ তোমাদের দীর্ঘজীবী করুক।সুস্থ থাকো।সুখে থাকো।

বলে তিনি আর দাড়ালেন না।তন্ময়ীর চোখের টলমল পানিটুকু মুছে দেওয়ার সময়ওকরলেনা,ছুটলেন জাহিদ সাহেবের কাছে।ছটফট করা মানুষটাকে তিনি কিছুতেই অপেক্ষা করাতে পারেননা।সঙ্গে এতো সুন্দর একটা সুসংবাদ উনাকে না জানিয়ে অপেক্ষায় রাখার মানেও হয় না! নীহারিকা বেগম চলে যেতেই ফাতেমা বেগম তন্ময়ীর কাছে গেলেন।তন্ময়ীর চোখে টলমলানো জল দেখে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন–এতো খুশির একটা মুহূর্তে কেউ মন খারাপ করে!পাগল মেয়ে!

ইভান উনার বড় যত্নের নাতি।বংশের বড়নাতী নাহলেও বড় ছেলের প্রথম বাচ্চা হিসাবে,ছোটোবেলা থেকে তাকে অন্য নজরে দেখে এসেছেন ফাতেমা বেগম।ছেলেটাও ছিলো,নিভানের পরপর উনার ঘেষা।কিন্তু কিছু ঘটনার কারণে দাদী নাতীর সম্পর্কে দূরত্ব এসেছে।যা উনাকে মর্মাহত করে।সেসব ঘটনায় হয়তো উনার-ও দোষ ছিলো।যার অনুশোচনা উনাকে মনেমনে এখন বড্ড পোড়ায়।সেই নাতীর ঘর আলো করে এই বংশে নতুন বংশপ্রদীপ আসতে চলেছে।উনি খুব খুশি।খুশি উনার আচারণে প্রস্ফুটিত হলো।কন্ঠে সেই খুশি দ্বিগুণ ঢেলে ছেলের বউয়ের উদ্দেশ্য বললেন–ছোটো বউমা, নাতবউয়ের বাড়ীতে খবর পাঠাও।আসতে বলো তাদের।বলো,তাদের মেয়ে মা হতে চলেছে।

‘কি বলছো দাদুমা!ছোটো দাদাভাই বাবা হবে!আমি ফুপিমা হবো?আল্লাহ!

মান্যতার চমকিত কন্ঠে সবাই সেদিকে ফিরলো।সবার আগে রানীই বললো–হ মান্য মা।আমাদের বাড়িতে নতুন মেহমান আসতে চলেছে।ছোটো বউমা মা হতে চলেছে।আল্লাহ!কতোবার যে আলহামদুলিল্লাহ বলেছি।

চোখমুখে খুশি ঝরিয়ে কথাগুলো বললেও,ভদ্রমহিলার চোখে পানি।এই একটা কারণে উনার সংসার হয়নি।বন্ধ্যা নারী তিনি।যার এই একটা কারণে সংসার হলো না।কদর করলো-না স্বামী নামক লোকটা।ছেড়ে দিয়েছে তাকে।স্বাম্তনা রহমান যেনো খুশির মাঝেও রানীর চোখের জলের কারণ বুঝলেন।রানীর পাশে এসে কাঁধে হাত রাখলেন।বিনয়ী কন্ঠে বললেন– মন খারাপ কেনো করছো আপা?তোমাকে কতবার নিষেধ করেছি মনখারাপ করবেনা।মানুষের মাঝে অপূর্ণতা,সেগুলো তাদের নিজহাতের কামাই না।প্রভু চেয়েছেন বলেই কিছু অপূর্ণতা দিয়েই তাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।তোমার আপন রক্ত নেই,তাই বলে কি তুমি সন্তানহারা?এবাড়িতে তোমার কতোগুলো সন্তান!তারা সবাই তোমাকে কতো ভালোবাসে!তুমি জানাোনা?
আর-ও একজন আসতে চলেছে।মন খারাপ কোরোনা।

রানী মুহূর্তেই চোখের পানি মুছে ফেললো। হ্যা তার নিজ সন্তান না থাকলেও,এবাড়ির ছেলেমেয়ে গুলো উনাকে মা সমতুল্য ভালোবাসে।একথা অস্বীকার করার নয়।আর তাদের খুশির মুহূর্তে সে চোখের পানি ফেলে দুঃখ করতে পারে না।ততক্ষণে তন্ময়ীকে নিয়ে ফাতেমা বেগম সোফায় বসলেন।মান্যতা-ও ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানালো।এটা-ওটা বলে খুনসুটিতে মাতলো।হঠাৎ একটা প্রশ্ন এলো তার মস্তিষ্ক।তন্ময়ীকে মশকারা করে শুধিয়েও বসলো সে।–ছোটোদাদাভাই জানে, দুষ্টমশাই বাবাা হতে চলেছেন?

ইভানের কিছু বইয়ের দরকার ছিলো।তাই সকাল সকাল খেয়েদেয়ে বাইক নিয়ে ছুটে এসেছিলো বইয়ের সমগ্র নীলক্ষেতে।বই কিনে ফিরতে পথেই দুজন বন্ধুর সাথে দেখা হলো।তাদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে বেলা গড়ালো।বুঝতেই পারলোনা।কফিশপ থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের বিদায় দিয়ে বাইকে উঠতে যাচ্ছিলো, এমনই সময় ফোনটা বেজে উঠলো তার।প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে মান্যতার নামটা দেখতেই কপাল কুঁচকে এলো।এই মেয়ে প্রয়োজন ছাড়া তাকে ফোন দেয়না।নিশ্চয় ভার্সিটি থেকে নিয়ে যেতেই তাকে ফোন করেছে।এখন ইভান কিছুতেই উল্টো রাস্তায় যাবেনা।ফোনটা রিসিভ করে মানা করে দেওয়ার আগেই ওপাশ থেকে মান্যতার উচ্ছাসিত গলা ভেসে এলো।—দাদাভাই কোথায় তুই?তাড়াতাড়ি বাড়িত আয়। আর অবশ্যই মিষ্টির দোকানটা বাড়িতে ধরে নিয়ে আসিস।আজ বাড়িতে মহা খুশির দিন।

ইতিমধ্যে মান্যতা জানতে পেরেছে,ইভান জানেনা তার বাবা হওয়ার কথা।তন্ময়ীও বারবার নিষেধ করছে,
তাাকে এখন না জানাতে।তাই আর সরাসরি মান্যতা, ইভানকে জানালোনা না।তবে ইভানের মনেহলো,বাড়িতে নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে।এদের তো আবার কারণের অভাব লাগেনা।যেকোনো একটা কারণ হলেই পার্টিসার্টি, খাওয়া দাওয়া।মেয়েলোকের তো খুশিরদিবসের শেষ নেই।তাই মান্যতা যতোটা উচ্ছ্বসিত গলায় বার্তা জানালো ইভান ততোটা নিরাশিত গলায় বললো।

‘আমি সকালে লন্ডনে এসেছি।ওমা!এটা বাড়ির কেউ তোকে জানাইনি?আর মিষ্টির দোকন কি তোর শ্বশুরের! যে উঠিয়ে তার বউমার জন্য বাড়িতে নিয়ে আসবো আর দোকনদার আমাকে কিছু বলবেনা।গাধী একটা!মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে,ফ্রিজ থেকে বের করে খা।সকালেও আমি ফ্রিজ খুলতেই দেখেছি,কয়েকরকম মিষ্টিতে নর্মাল ভরা।

খুশির একটা বার্তা দেওয়ার জন্য ফেন করলো অথচ বরাবরের মতোই কতো আবোলতাবোল কথা শুনিয়ে দিলো!তাই অসন্তুষ্ট গলায় বললো মান্যতা–‘দাদাভাই, তুই খুব খারাপ।

‘তা আমি জানি।এই পদবী নতুন নয়।তা কি মহাখুশির সুসংবাদ শুনি?নিশ্চয়,তৃনয় ভাইয়া আমাদের বাড়ির ঝামেলাবানুকে তাড়াতাড়ি তাদের বাড়িতে ট্রান্সফার করার ডেট ফিক্সড করতে এসেছে ?সেই খুশিতে আমাদের বাড়ির ঝামেলাবানু মিষ্টি খেতে চাইছে!তাই কি?

‘দাদাভাই! তুই মিষ্টি নিয়ে বাড়িতে আসবি কি আসবি না সেটা তোর ব্যাপার। পরে যেনো আফসোস না করিস!বলে দিলাম!আর আমাদের বাড়িতে মহাখুশিতে তোর মিষ্টি না আনলেও আমাদের মিষ্টি খাওয়ার অভাব পড়বেনা।বুঝেছিস?

‘ইভান নিজের টাকা বাঁচানোতে কখনো আফসোস করে না।

‘করবি করবি।

ইভানকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো মান্যতা।ধপাত করে বসে পড়লো তন্ময়ীর পাশে।ফের বললো–তোমার বরটা খুব খারাপ।

তন্ময়ী হাসলো।ফের বললো–কিন্তু আমি ভরসা বিশ্বাস দিয়ে বলতে পারি,আমার ভাইটা কিন্তু খুব ভালো।তুমি ঠকবেনা।তোমাকে ভিষণ যত্নে রাখবে সে।

মান্যতা অপ্রস্তুত হলো।এই কারণে সে একই বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও তন্ময়ীর আশেপাশে খুব একটা ঘেঁষে না।মান্যতার সিদ্ধান্তহীনতার কারণে নিজের ভাইয়ের প্রস্তাব আঁটকে আছে।ভাই ভালো হওয়া সত্ত্বেও,সেটা কোন বোন মেনে নিতে পারেনা।মান্যতা সেটা খুব ভালো বোঝে।কিন্তু তন্ময়ী তো জানেনা,মান্যতা কিসের জন্য সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।তবে সিদ্ধান্ত সে স্থির করেছে।শুধু দাদভাই আসার অপেক্ষা।তবে পরিস্থিতি সহজ করতে বললো—আমার ভাইও ভালো।ওটা আমি এমনি এমনি বলেছি।

তন্ময়ী মিষ্টি হাসলো।মান্যতার ফর্সা কোমল হাতটা নিজের নরম হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো—সেটা আমি জানি।তবে আমার ভাইও খারাপ না।আম্মুও না।তুমি আমার ভাই,আমার মায়ের কাছে ভালো থাকবে মান্য।যেমনটা আমি তোমাদের বাড়িতে আছি।এতোদিনে আম্মু যতো মেয়ে দেখিয়েছে ভাইয়াকে।ভাইয়া,না বলেছে।মেয়ে দেখা তো দূর,শুধু বলেছে এখন সে বিয়ে করতে চায়না।আম্মু অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছে।আমি ভাবতাম,সত্যি ভাইয়া বুঝি এখন বিয়ে করতে চায়না।আসলে বিষয়টা তা ছিলোনা এখন বুঝছি!ও তোমাকে পছন্দ করে!তোমাতে দূর্বল!সেটা আমার বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে লক্ষ্য করছি।যা এখন বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।ওর বোন হিসাবে তোমার কাছে অনুরোধ।ওকে ফিরিয়ে দিওনা।
সত্যি আমার ভাইটা খুব ভালো।ও তোমাকে আভিজাত্যপূর্ণ জীবন না দিতে পারলেও,সুখে শান্তিতে রাখার চেষ্টা করবে।ভালোবেসে আদর যত্নে আগলে রাখার চেষ্টা করবে মান্য।

ইভান বাড়িতে এলো ঘন্টাখানেক পরে।মান্যতাকে ইচ্ছেমতো পচালেও মিষ্টি সে নিয়ে এসেছে।মান্যতার বিশেষ পছন্দ রসমঞ্জুরী আর আরও দুইপ্রকার মিষ্টি।
বাড়িতে ঢুকতেই ড্রয়িংরুমে একটা শান্তশিষ্ট উচ্ছসমূখর পরিবেশ পেলো।হইহট্টগোল না থাকলেও সবাই বেশ হাসিখুশী। আর সবার মধ্যেমনি হয়ে বসে আছে তন্ময়ী।মাথা তার নমনীয়।চোখেমুখে লাজুকলতা ভাব।কেনো?হঠাৎ কি এমন ঘটলো লজ্জায় লাল হয়ে আছে মেয়েটা?তারসাথে তো বাঘিনীর সম্পর্ক।কিছু বলতে পারেনা,ইভানকে সে গিলে খায়।কাল রাতেও তো ঝগড়া হলো দু’জনের।একটা প্রশ্নে কতো কথা শোনালো তাকে!অথচ বউয়ের ভালো ভেবেই তো প্রশ্ন শুধিয়েছিল!কিন্তু উত্তর মিললো কি!সব কথা কি না জানলে নয়?বউ বলে আমার সবকিছু কি তোমাকে জানতেই হবে?আর কতো কথা!কালরাতের কথা মনে পড়তেই নিজেকে কেমন গম্ভীর করে নিলো ইভান।হঠাৎ তাকে দেখে মান্যতা লাফিয়ে উঠলো।উচ্ছ্বসিত গলায় এগিয়ে এসে বললো–মিষ্টি এনেছিস?

হাতের দিকে লক্ষ্য করে ইভানকে কিছু বলতে না দিয়ে মিষ্টির ভারী প্যাকেটটা হাত থেকে নিয়ে নিজের পছন্দের মিষ্টি দেখে মান্যতা দ্বিগুণ খুশি হয়ে
বললো– মিষ্টি যখন এনেছিস,সুসংবাদটা তোকে দেওয়াই যায়। নাহলে তো আমি কাওকে বলতে দেবেনা ভাবছিলাম।আর আমার পছন্দের মিষ্টি এনেছিস যখন তবে শোন।আমি ফুপিমা হতে চলেছি।আর তুই বাবা!

বাবা!

মান্যতার উচ্ছ্বসিত বাক্যলাপে এতো সময় বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে থাকা ইভানের কপালের ভাজ টনটন হয়ে গেলো।বিস্ময়ে নয়নে মান্যতার মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলো।মস্তিষ্কে ধারণ করার চেষ্টা করলো মান্যতা ঠিক কি বললো?মান্যতা ফুপিমা হতে চলেছে আর সে বাবা!বাবা!বাবা শব্দের মর্মার্থটা মস্তিষ্ক ধারণ করতেই, কয়েকজোড়া খুশিতে ভরপুর চোখ আর এক একটা হাস্যজ্বল মুখ উপেক্ষা করে তন্ময়ীর পানে তাকালো সে।মেয়েটা যেনো আগের তুলনায় মাথাটা আরও ঝুঁকে নিয়েছে।ইভানের বিস্ময় নজর হঠাৎ শীতল হলো।সেই শীতল নজরে স্থির তন্ময়ীরপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সবাইকে উপেক্ষা করে বড়বড় কদম ফেলে সিড়ি বেয়ে চলে গেলো উপরে।নিজের রুমে।

‘এই দাদাভাই!এরকম পালিয়ে গেলে চলবেনা।আর শুধু এই মিষ্টিতেও চিঁড়ে ভিজবেনা।আমাদের ট্রিট চাই। মৌনতা বাড়িতে আসুক তোকে ধরছি, অপেক্ষা কর।

স্বান্তনা রহমান বললেন-আরেহ বেচারা লজ্জা পেয়েছে।

‘লজ্জা আর ছোটোদাদাভাই!বরং বলো, লজ্জা আরও ছোটো দাদাভাইকে দেখে পালাই পালাই করে।উল্টে সে আরও ছোটোদাভাইকে দেখে নিজে সরমায়।তাই বলো।

স্বান্তনা রহমান হাসলেন। সঙ্গে পাশে বসা সবাই।অথচ কারও হাসির মৃদু ঝলকানিও তন্ময়ীর কানে গেলো-না। কর্ণগোচর হলো শুধু ইভানের সিড়ি বেয়ে উপরে যাওয়া, পায়ের শব্দ।সেই শব্দে অকারণে কলিজামোচড় দিয়ে উঠলো তন্ময়ীর।মারাত্মক একটা খবর! অথচ ইভান কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নীরবে চলে গেলো? ইভানের স্বভাবের সঙ্গে এমন নীরবতার মানায়?মান্যতা তো ঠিকই বলেছে।লজ্জা পাওয়ার মতো ছেলে ইভান নয়।তবে?সত্যি কি বাবা হওয়ার সুসংবাদে সে খুশি নয়?নাকি তার ভাবনায় সঠিক,এতো তাড়াতাড়ি কেউ তাদের জীবনে আসুক,এটা চায়নি ইভান?নাকি কালকে রাতের ঝগড়া?নাকি এতোবড় একটা নিউজ তারথেকে চুপিয়ে রাখার জন্য এই নীরবতা?ইভানকে সে ভয় পায়না।কোনোক্রমেই না।অথচ আজ কেনো জানি মনেমনে ভয় ধরেছে তাকে নিয়ে।সংশয় হচ্ছে, তার সামনে কিকরে দাঁড়াবে? ইভানকে বকবে তাকে?প্রচুর রাগ করবে?করলেও কি,ইভানের রাগে কি সে ভয় পায়?পায় নাতো?তবুও কেনো এতো সংশয় মনে।যা এই কয়দিন পুষে পুষে বিস্তর হয়েছে।ফ্যানের বাতাসেও কেমন ঘেমেনেয়ে গেলো সে।

আধাঘন্টার বিরতিতে কনফারেন্স রুম থেকে বের হয়ে লিফট ধরলো নিভান।গন্তব্য নিজেদের বরাদ্দকৃত হোটেলরুম।রুমের মধ্যে এসে দেখলো কৌড়ি তখনও ঘুমে।কাছে আসতেই বুঝলো,বউটা তার উঠেছিলো।গোসল সেরেছে, খেয়েছে আবার ঘুমিয়েছে।নিভান ডাকলেোও দু’বার। তবে মেয়েটা গভীর ঘুমে।একটু পরে নিভানকে আবার বের হতে হবে।শহরের নামকরা বড়বড় বিজনেসম্যানদের নিয়ে এই কনফারেন্স।নিভানকে সারদিন ব্যস্ত থাকতে হবে।কৌড়িকে আজ সারাদিনে সময় দেওয়া হয়ে উঠবেনা। বিধায় কৌড়ির ঘুমটা আর ভাঙলোনা।বরং ঘুমিয়ে কাটুক।একাকিত্ব আর অনুভব হবেনা।কৌড়ির গায়ের চাদরটা ঠিকঠাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো নিভান।তারআগে বউকে একধাপ ভালোবাসতে ভুললোনা ।উঠে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ভেবে কৌড়ির খাবারটা অর্ডার করলো সে।অপেক্ষা করতে লাগলো খাবার আসার।হঠাৎই ফোনটা ভাইব্রেট হলো।কনফারেন্স রুমে ঢোকার আগে ভাইব্রেট করে রেখেছিলো নিভান। ফোনটা বের করে দেখলো ইভান ফোন দিয়েছে।ফোনটা রিসিভ করলো সে।ওপাশে তখন বুকের মধ্যে অজানা অনুভূতিতে তোলপাড় চলছে ইভানের।তখন তন্ময়ীর উপরে রাগ হলেও রুমে এসে কেমন বুক ধড়পড় অনুভব হতে লাগলো ইভানের।জীবনে কখনো এরকম অনুভব হয়নি তার।ভালোমন্দ সব বিষয় সবসময় কেমন সে হাসিমজার মধ্যে দিয়ে সল্ভ করেছে।কিন্তু আজকের বিষয়টা কেমন স্পর্শকাতর।যখনই মান্যতার বলা কথাটা কানে বেজে বেজে উঠছে।সে বাবা হতে চলেছে!বাবা!ততবারই ক্ষনে ক্ষনে কলিজা ছটফট করে চলেছে। উত্তেজনায় হৃদপিণ্ড বারংবার কেঁপে কেঁপে উঠছে তার।নিজের এই অনুভূতি যেনো নতুন।সেই নতুন অনুভূতি কিছুতেই তাকে স্থির শান্ত থাকতে দিচ্ছে না।না পারছে তন্ময়ীকে ডেকে শেয়ার করতে।তন্ময়ীর উপরে তার ভিষন রাগ।ভিষন!!

‘ইভান কথা বলিস না কেনো?

‘দাদাভাই!

কন্ঠ কেমন এলোমেলো! ডাকটাও স্বাভাবিক লাগলোনা নিভানের।কপাল চিন্তায় কুঞ্চিত হলো তার।কৌড়ির থেকে সরে গিয়ে রুমের খোলা বারান্দায় চলে গেলো সে।ভিতরে এসি চলছে।বারান্দায় গিয়ে দরজাটা আঁটকে দিলো।তড়িৎ শুধালো-কি হয়েছে ইভান?বাড়িতে সবাই ঠিক আছেতো?সকালেও তো মার সঙ্গে কথা হলো।বললেন,বাড়িতে সবাই ঠিক আছে।

‘বাড়িতে সবাই ঠিক আছে।

‘তবে কি হয়েছে? এমনভাবে কথা….

‘দাদাভাই!তুমি বড়চাচ্চু হতে যাচ্ছো।আর আমি বাবা।

কন্ঠটা কেমন দূর্বল শোনালো!সেই সঙ্গে কথাটা বুঝতেও সময় লাগলো নিভানের।কথাটা ব্রেণে গেঁথে যেতেই কিছুটা বিস্ময় নিয়ে সহসা শুধালো সে–‘কি বলছিস!এতো তাড়াতাড়ি?

‘হয়ে গেছে দাদাভাই।

হাসলো নিভান।মৃদুতর হলেও সেই হাসির শব্দ ইভানের কান পর্যন্ত চলে গেলো।সে-ও হেসে দিলো।কেমন অবুঝ বাচ্চাদের মতো শুধালো–তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে,তাই না দাদাভাই?তবে আমার বাবা ডাকটা শুনতে একটুও অসুবিধা নেই।সে আসুক।আমার প্রাণটা নিয়ে হলেও পৃথিবীতে আসুক।

‘পাগল বাচ্চা আমার।

আদূরে ডাকটাতে ইভান কেমন আরও বাচ্চা হয়ে গেলো।ধপাৎ করে বেডে শুয়ে পড়লো।শুধালো–‘তুমি খুশি হওনি দাদাভাই?

‘আরেহ,খুশি না হওয়ার মতো কথা নাকি!আশ্চর্য! আমাদের বাড়িতে কতোদিন পরে বাচ্চা আসবে।আমার বাচ্চাটার বাচ্চা!আর আমি খুশি হবোনা!আমি খুব খুশি বাচ্চা।এই তোকে তো অভিবাদন জানানো হয়নি! কংগ্রাচুলেশনস ভাই।

‘লাভ ইউ, দাদাভাই।

থ্যাঙ্কিউ এর বদৌলে লাভ ইউ।চোখ বুঁজে নিলো নিভান।ছোটো বেলার কিছু স্মৃতি মুহূর্তেই মানসপটে ভেসে উঠলো।সে যেটাই বলতো ইভানের থেকে ফিরতে উত্তর আসতো, লাভ ইউ দাদাভাই।তখন নিভানও নিজের ভালোবাসা খুব যত্নের সাথে দ্বিগুণ বহিঃপ্রকাশ করতো।ইদানীং তা আর হয়না।দু-ভাইয়ের মধ্যে আরও কিছুক্ষণ বাক্যলাপ হলো।শেষে নিভান বললো-তন্ময়ীর দিকে খেয়াল রাখিস।

তন্ময়ীর দিকে খেয়াল রাখিস,কথাটা বলতেই ইভানের হাসিখুশি মুখটা নিভে গেলো।সে তো খেয়াল রাখতে চায়।তবে হয়তো মেয়েটা তার খেয়াল নিতে চায়-না।
সমোঝোতার সম্পর্কে হয়তো বাধ্য মেয়েটা মায়ের বানী মেনে স্বামীর সঙ্গে সমোঝোতায়ই করে নিয়েছে।ইভানকে ভালোবেসে নয়।তবে ইভান মানে দোষ তার!

কৌড়ির ঘুম ভাঙলো ফোনের রিংটোনে।চোখ খুলতে প্রচন্ড আলসেমি হলো তার তবুও কোনোরকম চোখ খুলে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো মান্যতা ফোন দিয়েছে।ফোনটা ধরলো সে।ঘুমুঘুমু গলায় শুধালো।

‘আপু,কেমন আছো?

‘আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভালো। তুই ঘুমাচ্ছিলি?

‘হুম।

‘তাহলে তো তোকে ডিস্টার্ব করলাম?

‘একদম না।তুমি বলো?

‘এই বউমনি,তুইতো বড়মাম্মা হতে চলেছিস!

কৌড়ি আশ্চর্য হয়ে উঠে বসলো।সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো তার।অতিরিক্ত ঘুমানোর ফল হয়তো।তবুও মাথা চেপে ধরে কৌতুহলী গলায় শুধালো–‘মানে?

‘আরেহ ছোটো দাদাভাই বাবা হবে।ছোটো বউমনি মা।

কৌড়ি সহসা বললো –‘বলো কি?

‘হুম।

‘আলহামদুলিল্লাহ। ইয়া আল্লাহ,আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আপু।তন্ময়ী আপু কোথায়?

মান্যতা উত্তর দেওয়ার আগেই নাফিম তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললো—তুমি ছোটো বউমনির সঙ্গে পরে কথা বলবে,আগে আমার সঙ্গে কথা বলো।ও বড়বউমনি তুমি কবে আসবে?আই মিসড্ ইউ।আমার তোমাকে খুব বেশি বেশি মনে পড়ছে।

পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটলো মৌনতা–বউমনিকে না বউমনির ফোনটাকে মনে পড়ছে সেটা বল?

নাফিম প্রতিবাদ জানিয়ে বললো–‘একদম ফালতু কথা বলবিনা।সত্যি আমার বউমনিকে খুব মনে পড়ছে।

প্রথমে তেজীকন্ঠে কথাগুলো বললেও,পরে কথাগুলো বলতে গিয়ে স্বর নিভে এলো নাফিমের।সেটা বুঝে কৌড়ি মায়ামায়া কন্ঠে বললো–‘আহারে,আই মিসড্ টুহ নাফিমসোনা।আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো।মন খারাপ করেনা।কেমন?

‘ওকে বউমনি।তবে তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু?

‘আচ্ছা।

কৌড়ি আচ্ছা বলতেই নাফিমের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো মৌনতা।ফোনটা কানে নিয়ে
বললো– বউমনি ভিডিও কলে এসো।তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে।

কৌড়ি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ভিডিও কল করলো।কৌড়ি বাড়ি থেকে যাবার পরপর কি কি হয়েছে, কি কি ঘটেছে সব উগলে দিতে থাকলো মৌনতা।মান্যতা তন্ময়ীকে ডাকতে গিয়েছিলো।ওদের কথার মাঝেই এসে পড়লো দুজনে।দুই জা দুই ননদে বেশ ঘন্টাখানেক বকবক করলো বিভিন্ন আলাপে।কৌড়ি বাড়িতে ফিরলে কিকরে একসাথে সবাই ইভানকে চেপে ধরে রেস্টুরেন্টের বিল বাড়াবে,সেটাও পরিকল্পনা করে নিলো।শুধু রেস্টুরেন্টের বিল বাড়ানো নয়,ঘুরতেও নিয়ে যেতে হবে সেই পরিকল্পনাও কষে ফেললো।কথা শেষ করে আবারও চোখ বুঁজে কিছুক্ষন ঝিম মেরে বসে রইলো কৌড়ি।তারউপর মাথাটা ঝিমঝিমানো থেকে একটু একটু করে ব্যথার উপসর্গে গড়াচ্ছে ।চোখ বুঁজে বসে থাকা কৌড়ি সময়-জ্ঞান উপেক্ষা করে আবারও নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।

নিস্তব্ধ শীতল পরিবেশ।রুমের মধ্যে সল্প আলোর বাল্বটা জ্বলছে।কৌড়ি মৃদু চোখ খুলে আবার বুঁজে নিলো।বুঝতে পারলো,ধরণীতে রাত নেমেছে।আরও একটা রাত এসেছে তার জীবনে।মুহূর্তেই কাল রাতের সময়টা মানসপটে ভেসে উঠলো।স্ত্রী হিসাবে ভালোবেসে নিজেকে নিবেদিত করেছিলো স্বামীরূপে সেই পুরুষটার বাহুডোরে।অস্তিত্বে।আর সেই মানুষটা তাকে মনপ্রাণ উজাড় করে সযত্নে ভালোবাসেছে।সেই ভালোবাসায় উগ্রতা ছিলেনা,উশৃংখলতা ছিলো-না।ছিলো নমনীয়তা, কোমলভাব।যা মানুষটার প্রতি সম্মানবোধ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা বাড়িয়ে দিয়েছে কৌড়ির।আনমনেই হাসলো কৌড়ি।স্পষ্ট টের পেলো,মানুষটা রুমের মধ্যে আছে।তার গায়ের তীব্র সুঘ্রাণে চারপাশটা সুবাসিত হয়ে আছে।এরকম তীব্র সুঘ্রাণ তখনই পাওয়া যায়,যখন সে স্বয়ং রুমে উপস্থিত থাকে।নাহলে সে বেরিয়ে যেতেই তীক্ষ্ণ ঘ্রানটা কেমন ম্লান হয়ে যায়।

জেগে গিয়েও কৌড়ি কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়ে রইলো।
আজ সারাটাদিন ঘুমে পার হলো তার।এরকম রেকর্ডকরা ঘুম এটুকু জীবনে তার বহু আছে।তবে আজকের ঘুমটা কেমন যেনো চোখ থেকে সরছেই-না।
চোখ যেনো গভীর নিদ্রায় ডুবিয়ে রাখতে চাইছে।তবে ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন।আর তার থেকেও প্রয়োজন কাল রাতের পর যে মানুষটাকে দেখা হয়নি তাকে দেখা।তবে মানুষটা কি করছে?শব্দ নেই কেনো? মানুষটার সম্মুখীন হওয়া আজ যেনো লজ্জার।কৌড়ি গায়ের চাদরটা সরিয়ে মুখটা ডানপাশে ঘুরিয়ে নিলো।মুহূর্তেই আবাছা আলোয় নজরে পড়লো সোফায় বসা মানুষটাকে।সোফায় হেডে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ।এক পা আরেক পা আঁকড়ে পাজোড়া ছড়িয়ে রাখা সোফায় সম্মুখে কাচের টেবিলটার উপরে।পায়ের পাশে রাখা খোলা ল্যাপটপটা।হাতজোড়া কোলের মধ্যে রাখা।মানুষটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?কখন এসেছে?এসে তাকে ডেকেছিলো কি?

কৌড়ি নিঃশব্দে উঠে বসলো।আগে ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন।সেই অনুপাতে ওয়াশরুমে চলে গেলো।সেখান থেকে ফিরে দেখলো মানুষটা সেভাবেই শুয়ে আছে।তবে কি ঘুমিয়ে পড়লো?পায়ের চলন নমনীয় রেখে ধীর কদমে নিভানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে।সারাদিন মানুষটা খেয়েছে কি-না? কি করেছে?এগুলো খোঁজ রাখা তার দ্বায়িত্ব ছিলোনা?অথচ সে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলো পুরোদিন।ভিতরে ভিতরে অপরাধ বোধ হলো সঙ্গে মন খারাপ হলো কৌড়ি।নিভানকে ডাকবে কি ডাকবেনা,দোটানায় পড়লো সে।তবে অপেক্ষা করতে হলোনা তাকে।চোখ বুঁজে রেখেই তার হাতটা টেনে ধরলো নিভান।কোলের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে
দু’হাতে জড়িয়ে নিলো নিজের বলিষ্ঠ চওড়া বুকে।ফের মৃদুস্বরে বললো–ঘুম ভাঙলো তবে!

কৌড়ি উত্তর দিলোনা।বরং নিজকেও মিশিয়ে নিলো মানুষটার বুকে।দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো নিভানের কোমর।নিভান ফের বললো–‘এতো ঘুম!

কৌড়ি এবার হাসলো।নড়েচড়ে আবারও সেই বলিষ্ঠ বুকে শান্ত হলো।নিভান মাথা উঁচু করে সেই বুকে জড়ানো নারীটাকে একবার দেখলো।চুমু খেলো তার মাথার চুলের ভাজে।ফের বললো –এসে কতবার ডাকলাম উঠলেনা।দুপুরে খাওনি কেনো?

মানুষটা ডেকেছিলো!নিজের প্রতি হতাশ হলো কৌড়ি।
তবে উত্তর দিতে দ্বিধা করলোনা। বললো–‘ইচ্ছে করেনি।খেতে একটুও মন চায়নি।আপনি খেয়েছিলেন?

‘হুম।কনফারেন্সে লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিলো।আমাকে খেতেই হয়েছিলো।

নিভান সোজা হয়ে বসলো।কৌড়িকেও সোজা করে বসালো।বললো–‘চলো খেয়ে নেবে।

ক্ষুধা কৌড়িরও লেগেছে তাই আর দ্বিমত করলো-না।
নিভান আগেই খাবার অর্ডার দিয়ে রেখেছিলো।রুমের লাইট জ্বালিয়ে কৌড়ি খেতে গিয়ে দেখলো সব ভারী খাবার। কৌড়ির ওসব কিছুই খেতে মন চাইলো না।বউয়ের মুখ দেখে নিভান যেনো তা বুঝে গেলো।শুধালো–কি খাবে?

‘সাদাভাত আর কোনো নর্মাল আইটেম।ভর্তাভাত হলেও চলবে।আমার একটুও এগুলো খেতে ইচ্ছে করছেনা।

নিভানের শুধানোর ভঙ্গিতে কৌড়ি যেনো কেমন সংকোচহীন বলে দিলো।নিভান কৌড়ির বলার মধ্যে হোটেল ম্যানেজমেন্টে ফোন দিয়ে আর্ডারও করে ফেললো।খাবার আসলে কৌড়িকে নিজে হাতে খেতে দিলো না নিভান।নিজে সযত্নে খাইয়ে দিলো।কৌড়ি দ্বিমতও করলো।শুধু মানুষটাকে দেখে গেলো।খুব ক্যাজুয়াল তার ভাবভঙ্গি।যেনো কৌড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তার যুগযুগান্তরের।সে কাছ থেকে যতো মানুষটাকে বুঝছে দেখছে,ততোটাই বিমোহিত হচ্ছে।এতো নিখাঁদ ভালোবাসা পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।কৌড়ি সত্যি সৌভাগ্যবতী।ভাবনার একপর্যায়ে ভিতরে ভিতরে ভিষণ আবেগপ্রবণ হলো কৌড়ি।নিভানের ভাত মাখানো হাত সরিয়ে দিয়ে হঠাৎই তাকে জড়িয়ে ধরলো সে।নিভান একটু অবাক হলো।একহাতে প্লেট, অন্য হাতে খাবার মাখানো।চেয়েও কৌড়ির পিঠে হাত রাখতে পারলো না।তবে কোমল গলায় শুধাল–কি হয়েছে?

‘কিচ্ছু না।আমি আর খাবো না।আপনি খেয়ে নিন।

‘দুপুরে খাওনি।এখন এতোটুকুতেই শেষ।

কৌড়ি সামন্য মুখ উঁচু করলো।বললো–‘সত্যি আর খেতে ইচ্ছে করছে না।

নিভানও আর জোর করলো না।কৌড়ির মসৃণ কপালে চুমু খেতেই মুখটা সরিয়ে নিয়ে পুনরায় বুকে রাখলো সে।নিভান হাতে ধরা খাবারের প্লেটটা ধরাসহ কৌড়ির পিঠ আঁকড়ে ধরলো।সেভাবেই খাবার খেলো সে।কৌড়ি সরে যেতে চাইলেও তাকে সরে যেতে দিলোনা।

রাতে খাবার খেয়ে নিভান ভেবেছিলো, কালকে রাতের মতো কৌড়িকে নিয়ে একটু বের হবে।তবে সন্ধ্যা হতেই মাথার মধ্যে কেমন ঝিমধরা হয়ে রয়েছে তার।তা যেনো ক্রমশই বেড়ে চলেছে।তাই ইচ্ছে সত্ত্বেও বের হওয়া হলো-না।কৌড়িকে বেডে বসিয়ে,তার কোলে মাথা রেখে কৌড়ির হাতটা ডুবিয়ে দিলো মাথার ভাজে। চুলের মধ্যে।মুখে বললো না কিছু।কৌড়িরও নীরবে হাত চললো।নরম হাতের স্পর্শে আরামবোধ করলো নিভান।চোখ বুঁজে নিলো সে।কিছুটা সময় পার হওয়ার পর কৌড়ি অনুভব করলো,নিভানের ডানপাশের কপালের সোজাসুজি মাথার মধ্যে একটা ডোরাকাটা শক্ত কিছু। দাগ হয়তোবা!যা বারবার হাতে বিঁধছে। হঠাৎই মনে পড়লো, এইতো কিছুদিন আগে মানুষটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছিলো।কপালসহ মাথায় ব্যান্ডেজে জড়ালো ছিলো অথচ কৌড়ি নিভানের কপালে কখনো দাগই দেখেনি।তাহলে কি আঘাতটা মাথায় লেগেছিলো?তড়িৎ মুখনিচু করে ঘনো চুলগুলো সরালো সে।মুহূর্তই উন্মুক্ত হলো লম্বা ছয়টা সেলাইযুক্ত কাটা দাগটা!কৌড়ি যেনো শিহরে উঠলো!আঘাতটা তো ছোটোখাটো নয়!তখনই কেমন শান্ত গলায় নিভান বললো–

‘ওই জায়গাটায় তোমার ছোয়ার হক নেই।ভালোবাসা দেখানো মানা।

কৌড়ি যেনো নিষেধাজ্ঞার কারণটা খুব ভালো করে জানে।তবুও বললো–কেনো?

‘কারন তুমি আমাকে দেখতে যাওনি।

কৌড়ি ক্ষীনস্বরে বললো –‘আমি যেতে চেয়েছিলাম।

নিভান শান্ত অথচ অভিযোগী গলায় বললো–‘আমিও অপেক্ষায় ছিলাম কিন্তু তুমি যাওনি।

‘স্যরি।

‘গ্রহনযোগ্য নহে।

কৌড়ি খুব ইচ্ছে করলো জায়গাটায় একটু ভালোবাসা ছুয়ে দিতে কিন্তু নিভানের কথায় নয়,লজ্জায় পারলোনা।শুধু বললো–‘ওকে।

নিভান তড়িৎ চোখ খুললো।কেমন বিস্মিত গলায় শুধালো—ওকে্!

কৌড়ি হেসে দিলো বললো–তাহলে এই অপরাধী আর কি বলবে বলুন?

নিভান সহসা কৌড়ির কোল থেকে মাথা সরিয়ে তাকে টেনে নিয়ে নিজের বুকের নিচে এনে শুইয়ে দিলো।একপল কৌড়ির খিঁচে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে,মুখ ডুবালো কৌড়ির গলার ভাঁজে।যেখানে চকচক করছে স্বর্নের চিকন চেনটা।যা বড়োই আকর্ষণীয়।কৌড়ি আকস্মিক ঘটনায় স্থির হয়ে গেল।নিভান গলায় মুখ ডুবাতেই শক্তকরে চোখবুঁজে নিলো।নিভান আপন অনুভূতিতে ডুবে থেকেই বললো–ইট’স নট ওকে্ আমার অপরাধী।তুমি জানো,আমি মানতেই পারিনা তুমি আমাকে দেখতে যাওনি।আমি যদি সত্যি মরে যেত….।

তড়িৎ চোখ খুলে নিলো কৌড়ি।হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো নিভানের।সহসা নিভানের বলা ঠোঁট ডুবে গেল কৌড়ির গলার খাঁজে। নিভানের কথা বন্ধ হয়ে গেলো।যা কৌড়ি করতে চেয়েছিলো। চুপ হয়ে গেলো নিভান।কৌড়ি কেমন অসন্তুষ্ট অভিমানর গলায় বললো–‘আপনি তো নাফিম নন।তবে এ কেমন ছেলেমানুষী কথা!মৃত্যু চিরন্তন সত্যি।তাই বলে বারবার বলতে আছে!আপনি তো আমার কাছে আছেন,তবুও কেনো মৃত্যুর কথা!

‘আমি মানতেই পারিনা তুমি আমাকে দেখতে যাওনি।

‘স্যরি।

‘কৌড়ির কন্ঠ এবার অসহায় দূর্বলদের মতো শোনালো।নিভানও আর প্রসঙ্গ বাড়ালোনা।চুপ করে কৌড়িকে জড়িয়ে শুয়ে রইলো।মাথার মধ্যে ব্যাথার ঝিমঝিমানিটা এখনো কাটিনি তার।নিভানকে চুপ হতে দেখে কৌড়ি মাথায় রাখা হাতটা আগের ন্যায় চুলের মধ্যে ডুবিয়ে দিলো।ধীরেধীরে নরম আঙুলগুলো নড়তে লাগলো সেখানে।দুপক্ষের কেউ আর কোনো শব্দ করলোনা।

গভীর রাত।শীততাপনিয়ন্ত্রক রুমটা একদম চুপচাপ।
শুধু ঘনো নিঃশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো শব্দ নেই।নিভান ঘুমালেও কৌড়ির চোখে ঘুম নেই।সারাদিন ঘুমানোর ফলে নাকি অপরাধবোধে,জানা নেই কৌড়ির।নিভানের কোমর জড়িয়ে রাখা হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো সে।নিস্প্রভ চোখে,আবাছা আলোয় নিভানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।ফের নিভানের গায়ের চাদরটা ঠিক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।নিঃশব্দে পা ফেলে হোটেলের খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র থেকে ভেসে আসা একদল শীতল হাওয়া ছুঁয়ে দিলো তাকে।গায়ের ওড়নাটা শক্ত হাতে জড়িয়ে নিলো কৌড়ি।বাহিরে কালকের মতো তুমুল বর্ষন নাহলেও মৃদুমন্দ বর্ষন হচ্ছে। যার একটুআধটু ছিটেফোঁটা গায়ে এসে লাগলো কৌড়ির।হোটেল এরিয়ার সমুদ্রের পাড়ে
বে-লাউঞ্জখ্যাত শপটা এখনো খোলা।প্রতিরাতের ন্যায় ঝলমলে তার রূপ।হালকাপাতলা গানের আওয়াজ ভেসে আসছে সেখান থেকে।কৌড়ির মনোযোগ সেই ভেসে আসা সুরে নেই।তার মনমস্তিস্ক জুড়ে নিভানের মাথার কাটা জায়গার চিত্রটা ভেসে বেড়াচ্ছে।সত্যিই কি সেদিন চাইলে সে যেতে পারতোনা মানুষটাকে দেখতে?হয়তো পারতো।তবে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও, না ইচ্ছে থাকাটাকে জোর দেওয়াতে তার আর যাওয়া হয়ে উঠেনি।মুলত সে ইচ্ছের গুরুত্ব দেয়নি।না-হলে যাবার উপায় ঠিকই বের হতো।মানুষটা তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেও তার না যাওয়াটা এখনো স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি।ভুলতে পারিনি।কৌড়ির ভিষণ মন খারাপ বাড়লো।নিভান যখন এককথা বারবার আওড়ে যাচ্ছিলো-তুমি আমাকে দেখতে যাওনি এটা আমি এখনো মানতে পারিনা।কথাটায় কেমন যেনো নিভানের কন্ঠে অনুযোগের সাথে সাথে ভারী শোনালো।যা ভার কৌড়িকে ভিতরে শান্ত থাকতে দিচ্ছে না।তখন খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো,জায়গাটাকে আদূরে স্পর্শে ছুয়ে দিয়ে নিভানের অনুযোগ মেটাতে।কিন্তু পারেনি।আচ্ছা এখন তো মানুষটা ঘুমিয়ে আছে।তার অভিযোগ মানাতে না পারলেও মনের শান্তির জন্য জায়গাটা একটু ভালোবেসে ছুঁয়ে দিয়ে খায়েশ তো মেটাতে পারবে?ভাবনাটা মাথায় আসতেই কৌড়ি আর দাড়ালোনা।ওই মানুষটা তার ভুল,দোষ,ত্রুটি,মন্দ নিয়েই যদি তাকে এত ভালোবাসতে পারে!সে কেনো পারবেনা!যেখানে মানুষটা তারকাছে ত্রুটিহীন।অসাধারণ।

কৌড়ি রুমে ঢুকে,বারান্দার দরজাআবৃত কাচটা টেনে দিলো।গিয়ে বসলো নিভানের পাশে।আলতো হাতে স্পর্শ করলো,সেই কাটা জায়গাটা।আবাছা আলোয় মাথা নিচু করে খুব কাছে গিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ।ফের
নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলোনা।মুখ নিচু করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো সেই জায়গাটায়।গভীর চুমু খেলো সেখানে।ফের ক্ষীনস্বরে বললো–স্যরি।

‘ক্ষমা গ্রহনযোগ্য হবে তবে শর্ত প্রযোজ্য।

ঘুম জড়ানো কন্ঠস্বরের বার্তা কানে আসতেই চমকে উঠলো কৌড়ি।তবে সরলো-না।বরং নিজেকে দৃঢ় রেখে মুখটা আরও নিচু করে নিভানের গালে ছোয়ালো।ক্ষীন স্বরে বললো

‘যেকোনো শর্ত গ্রহনযোগ্য।মাঞ্জুর।

শর্ত জানালো না নিভান।তার বদলে কৌড়িকে টেনে নিলো গায়ে জড়ানোর চাদরের নিচে।শর্ত মুখে না বলে নিজের আচারণ দিয়ে বোঝালো নিভান।কৌড়িও যেনো সেই অজানা শর্তে নিজেকে সপে দিলো দ্বিধাহীন।শর্ত যদি হয় বরের ভালোবাসা! তবে সে শর্ত দ্বিধাহীন মানা যায় বৈকি?তাতে যদি সম্পর্ক দৃঢ় হয়,অনুযোগ অভিযোগ দূর হয়।তবে সে শর্তে বারবার কৌড়ি দ্বিধাহীন রাজী।মানুষটার অস্তিত্বে নিজের অস্তিত্ব বারংবার বিলিন করতে রাজী।

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(৬১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

তন্ময়ী অন্তঃসত্ত্বা!সুসংবাদটা পাওয়ার সাথে সাথেই মিষ্টিমিঠাই,ফলফলাদি নিয়ে ততক্ষণাত মেয়ের বাড়িতে চলে এসেছিলেন তাহমিনা বেগম।দুপুরের পরপর এসে বিকালে চলে যেতে চেয়েছিলেন তবে এবাড়ির মানুষগুলো উনাকে যেতে দেননি।তিনিও আর না করেন নি।যদিও তন্ময়ীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেপোষন করেছিলেন।তবে নীহারিকা বেগম বলেছিলেন–আপা, এসেছেন যখন রাতটা থেকে কালকে নাহয় তন্ময়ীকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন।জামাই বাড়িতে এসেছেন বলা কথা! বাড়ির মানরক্ষার্থে অন্তত একটা রাত সেখানে থাকুন।

আত্মীয়তা রক্ষার্থে এমন সম্মানীয় আবদারে তিনি আর দ্বিমত করেননি।তৃনয়-ও সঙ্গে এসেছিলো তবে এবাড়ির সবার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় সেরে বোনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সে চলে গিয়েছে।রাতে তন্ময়ীর সাথে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি।মেয়েটা কেমন ছটফট করেছে সারারাত।তিনিও বারবার জিজ্ঞেস করেছেন-শরীর খারাপ লাগছে কিনা?তবে মেয়েটা না বলেছে।এমনিতেই চাপা স্বভাবের মেয়ে তন্ময়ী।ভালো মন্দলাগা সহজে প্রকাশ করতে চায়না।যদিও উনারও মনে হয়েছে মেয়ে শরীর খারাপের জন্য নয়,অন্য কারণে ছটফট করেছে। কিন্তু কারণটা কি বুঝতে পারলেন না!এবাড়ির সবাই যথেষ্ঠ পরিমান ভালোবাসে এবং খেয়াল রাখে তন্ময়ীকে।তা শুধু উপরে উপরে তা নয়।এ বাড়ির মানুষগুলো সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা আছে উনার।আর তার থেকেও বড়কথা,মানুষের কথার ধরণ আর ব্যবহারের আন্তরিকতা দেখলে বোঝা যায়।তারা ঠিক কেমন মানসিকতার মানুষ। সেখানে তিনি যেমনটা চেয়েছিলেন মেয়ে উনার তেননটা রাজরানী হয়ে আছে। তবে সমস্যা কোথায়?ইভানের সঙ্গে সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?থাকারইতো কথা।ছেলেটা একটু চঞ্চল হলেও উনার মেয়ের প্রতি খেয়ালী এবং দায়িত্বশীল।সেটা তিনি তন্ময়ীর বিয়ের পর,ইভানের ওবাড়িতে থাকা আসায় খেয়াল করেছেন। তবে কালকে এবাড়িতে আসার পর ইভানকে সেভাবে তিনি দেখেননি।এসে একবার সাক্ষাৎ হলো,কুশলাদি বিনিময় হলো তারপর আর তিনি দেখেননি।দেখেননি ভুল,রাতে খাবার টেবিলে একবার দেখেছিলেন।কিন্তু মেয়ে আর জামাইয়ের মধ্যে সেই বসব বিনিময়ে সাক্ষাৎ যেনো উনার নজরে পড়েনি।চঞ্চল ছেলেটাকে এবার যেনো একটু গম্ভীর মনেহলো উনার।এদের মধ্যে সব ঠিকঠাক চলছে তো?

ব্যাগে নিজের জিনিসপত্র গুছানো তন্ময়ীকে এবার তিনি বেশ গাঢ় নজরো খেয়াল করলেন।মেয়েটার হাত দুটোতে নেওয়া জিনিস যেনো ব্যাগে ঢুকাতে ভিষণ দ্বিধা।ব্যাগে ঢুকাতে গিয়েও পুনরায় বাহিরে রাখছে।ভিতরে কি নিয়েছে তা বারবার চেক করছে।ঘুরেফিরে চঞ্চল নজরদুটো তার দরজার পানে অথচ তিনি এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন সে খেয়াল নেই মেয়েটার।কি আশ্চর্য! এতো বিচলিত কি কারণে মেয়েটা?আর একটু কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি।মেয়ের অস্থির হাতদুটো ধরে তার অস্থিরপনা আঁটকে দিয়ে বললেন।

‘কি হয়েছে তনু?সব ঠিকঠাক আছে তো?কাল থেকে এসে দেখছি, তুই কেমন অস্থির হয়ে আছিস!কি হয়েছে তন্ময়ী?

মেয়েটাকে যেনো একটু অপ্রস্তুত দেখালো।সেরকমই অপ্রস্তুত গলায় বললো–কি হবে আম্মু!সব ঠিক আছে।
তুমি জানোতো,এবাড়ির মানুষ সবাই আমাকে কতো ভালোবাসে তারপর আর কি হব….

‘ইভানের সঙ্গে সবকিছু ঠিক আছে তো?

মেয়ের অপ্রস্তুত গলায় হড়বড়িয়ে বলে যাওয়ায় কথায় আরও সন্দেহ বাড়লো তাহমিনা বেগমের।তাই তন্ময়ীর মুখের কথা শেষ করতে না দিয়ে তিনি মনে চলা দ্বিধান্বিত প্রশ্নটা শুধিয়েই ফেললেন।কিন্তু উনি প্রশ্নটা শুধাতেই তন্ময়ীর যেনো ভিষন কান্না পেলো।কালকে খবরটা পাওয়ার পর থেকে ইভানের সঙ্গে দেখা হলেও একান্তে সাক্ষাৎ হয়নি তাদের। নিশ্চয় ইভান খুশি নয়।তা-না হলে কিকরে এতোবড় একটা নিউজ শোনার পর তার থেকে দূরে থাকতে পারে!একবারও তার সঙ্গে কথা বললোনা!কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলো না!ইভান কিকরে এমনটা করতে পারে?পারে না!তবে মায়ের প্রশ্নে সচেতন হলো তন্ময়ী।ভিতরের উগলে আসা কান্নাটা আঁটকে বললো–ইভানের সাথে কেনো সবকিছু ঠিকঠাক থাকবেনা আম্মু! সবকিছু ঠিকঠাক আছে। শরীরটা খারাপ তো এজন্য এরকম অস্থির দেখাচ্ছে।

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তাহমিনা বেগম।তন্ময়ী সহজে মিথ্যা বলেনা।আর বললে তা উনি ধরতে পারেন।আজও উনার যেনো পারলেন।উনার দিকে না তাকিয়ে নজর এদিকে ওদিকে চঞ্চল রেখে কথা বলাতে তিনি বেশ বুঝলেন।তবে মেয়ে যখন জামাইকে আড়াল করার চেষ্টা করছে।নিশ্চয় নিজেদের মধ্যে রাখতে চাইছে ব্যাপারটা।তাই তিনি আর ওবিষয়ে ঘাটলেন না। তবে তন্ময়ীর হাতদুটো চেপে ধরে বসালেন।ফের বললেন–সেদিন আমি নিরুপায় ছিলাম।আমি মা,বিয়ে ভেঙে যাওয়া বদনামী মেয়ের ভবিষ্যতটা যেনো দুর্নাম আর কটাক্ষের মুখে দেখতে পাচ্ছিলাম।মা হচ্ছিস না, সন্তান জন্ম দে।তারপর বুঝবি,এই মায়েদের কথা জ্বালা কতো দুশ্চিন্তা।সেখানে ইভানের প্রস্তাব দেওয়াকে আমি তোর জন্য সৌভাগ্যের দ্বার খুলে যাওয়া মনে করেছিলাম।তবে এটা ভুলেও ভাবিসনা,তোর মা অর্থসম্পদের মোহে পড়েছিলো।তা নয়।কারণটা ছিলো, নিভানের ভাই ইভান।ওদেরকে তো আমি আগে থেকেই চিনতাম।আমার মনে হয়েছিলো,ওর থেকে ভালো ছেলে আর তোরজন্য হয়না।তবে তখনও আমি জানতাম না,ওই তোর বিয়ে ভেঙে ছিলো।যখন নিভান আমাকে বিষয়টা ক্লিয়ার করলো,আমি না করেছিলাম।কিন্তু ইভান,ছেলেটা নিজের অপরাধ স্বীকার করার সঙ্গেসঙ্গে তোকে পাওয়ার জন্য আকুলতা প্রকাশ করলো।সেদিন ও কেঁদেছিলোও।আমি পারিনি নিজেকে কঠিন সিদ্ধান্তে আঁটকে রাখতে।আমি মেনে নিয়েছিলাম ওর আকুলতা।ওর চাওয়া।সেখানে তুই যদি বলিস,নিজের মেয়ে কথা না ভেবে তুমি অন্যের ছেলের কথা।কেনো ভাববে?আমি বলবো ভাবনা ভুল,তোর কথা ভেবেই আমি ওর চাওয়ায় সম্মতি দিয়েছিলাম।

একটু থেমে ফের বললেন তাহমিনা বেগম–তোর হয়তো মায়ের উপর অভিযোগ থাকতেই পারে।তোর বিয়ে ভাঙা সত্ত্বেও কেনো আমি সেই তার সঙ্গে তোর বিয়ে দিলাম! এবং সেই ইভানের সঙ্গেই মানিয়ে নিতে বললাম!ও অপরাধ করেছিলো,কিন্তু ছেলে হিসাবে ওকে কখনো আমার খারাপ ছেলে মনে হয়নি তনু।দ্বিতীয়ত যে ছেলে আমার মেয়েকে পাওয়ার জন্য এতো আকুলতা প্রকাশ করতে পারে!যার সমস্ত কোয়ালিটি এবং বাপের এতো অর্থসম্পদ প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও একজন ভিক্ষুকের ন্যায় আমার কাছে আমার মেয়েকে চায়!আমার মনে হয়েছিলো,আমার মেয়ে সেই ছেলের কাছেই ভালো থাকবে।আমি সেদিন ওর অন্যায় ভুলতে বাধ্য হয়েছিলাম।হয়তো আমি তোরকাছে অপরাধী।সেদিন তোর মনের কথা না ভেবে,তোর ভালো কিসে হয় সেকথা ভেবেছি।তবে আমি জানিনা, সত্যিই সেদিন ঠিক ভেবেছিলাম কি-না? হয়তো ন…

‘তুমি ঠিকই ভোবেছিলে আম্মু।

মায়ের আশাভঙ্গজনিত কথাটা মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো তন্ময়ী।ফের নমনীয় কন্ঠে বললো তন্ময়ী।একবার নয় কয়েকবার আওড়ালো।ফের চিন্তিত মা’কে দুশ্চিন্তামুক্ত করতে বললো–ইভান আমাকে খুব ভালো রেখেছে, মা।সেদিন তুমি ইভানের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কথা বলাতে,আমি সাময়িক অসন্তুষ্ট হলেও এখন আর অসন্তুষ্ট নেই।ও সত্যিই আমাকে খুব ভালো রেখেছে আম্মু।ওর সঙ্গে আমার সামন্য একটু ঝগড়া হয়েছে তাই মন খারাপ।তবে বিশ্বাস করো,তাতেও ওর কোনো দোষ নেই।আমিই খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছিলাম এজন্য এখন খারাপ লাগছে।

তাহমিনা বেগম বুঝলেন, দুজনের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে। তাই নিয়ে মেয়ে এতো অস্থির। সেখানে বিষয়টা মেয়ে বলতে চাইছেনা।সেখানে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে উনার খোঁচাখোঁচি করার কোনো মানে হয়না।তাতে ঝামেলা বাড়ে।সামন্য ঝামেলা,প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন। নিজেরাই ঠিক করে নেবে।তাই আর ওবিষয়ে কথা বাড়ালেন না।শুধু বললেন–স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝামেলা হলে বিষয়টা দীর্ঘ করতে নেই।তাতে শয়তানের ইন্ধন থাকে।তাতে খারাপ ছাড়া ভালো হয়না।যেটা হয়েছে মিটিয়ে নাও।আমি কি ইভানকে আমাদের সঙ্গে যাবার কথা বলবো।যদিও বলেছি,রাজি হয়নি।

‘থাক মা।ও এখন পড়াশোনায় ব্যস্ত।সামনে বি-সি এস পরিক্ষা। আমি যাই,ও নাহয় পরে আমাকে গিয়ে নিয়ে আসবে।

‘আচ্ছা। তবে রেডি হয়ে নাও।আমি বেয়াইনদের ওখানে যাই।

মেয়ের গালে আদূরে হাত রেখে চলে গেলেন তিনি।উনার যাবার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তন্ময়ী।হয়তো কারও আসার অপেক্ষাও করছিলো।কিন্তু না।অপেক্ষা যেনো দীর্ঘ হচ্ছে কিন্তু ইভানের আসার কোনো নামগন্ধ নাই। হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে ব্যাগ গুছানোতে ব্যস্ত হলো তন্ময়ী।ব্যাগ গোছানোর শেষ পর্যায়ে এসে হঠাৎ কারও পায়ের আওয়াজে কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো তার।হৃদবেগ বাড়লো।এরকম তো হওয়ার কথা নয়!কিন্তু হচ্ছে কেনো?ইভান রুমে এলো।তবে ভুলেও আশপাশ তাকালোনা। গায়ের টিশার্টটা চেঞ্জ করে একটা শার্ট জড়ালো।ফের ফোনটা নিয়ে রুমে বাহিরে যাওয়ার আগে তন্ময়ী বিস্মিত গলায় তাকে ডাকলো।

‘ইভান।

কেমন যেনো অভিমানী ডাক।ইভানের চওড়া বুকের ছাতি যেনো মৃদু কেঁপে উঠলো।মূহুর্তেই থেমে গেলো পা। তবুও তীব্র অভিমানে পিছে ফিরলোনা সে।শক্ত হয়ে কেমন দাড়িয়েই রইলো।সেটা দেখে তন্ময়ী নিজেই উঠে দাড়ালো।দরজার সম্মুখে গিয়ে প্রথমে দরজা আটকালো।ফের দরজায় পিঠ লাগিয়ে ইভানের কঠিন করে রাখা মুখের দিকে দৃষ্টি ফেললো।মূহুর্তেই ভিতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো তার।ইভান এমন নয়!ইভান হাসিখুশি হাস্যজ্বল চঞ্চল ছেলে।তাকে এরকম কঠিনতা মানায় না!একদম না!

‘তোমার এভাবে চুপ থাকা মানায় না।

ইভান সবসময় অধৈর্য্যবান ব্যাক্তি।তার ধৈর্য্যশক্তি কম।অল্পতে অধৈর্য্য হয়ে যায়।তন্ময়ীর সামান্য কথাতে অধৈর্য্যশীলতার পরিচয় দিয়ে কঠিন গলায় বললো-তো কি বলতে চাইছো।তোমার সাথে ঝগড়া কথা উচিত? কিন্তু তুমিতো চাও,আমি তোমাকে অযথা প্রশ্ন না করি! প্রশ্ন করে বিরক্ত না করে তুলি!

‘এটা অযথা বিষয় নয়?

ইভান ধপাধপ পা ফেলে তন্ময়ীর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। মুখ নিচু করে কঠিন গলায় শুধালো–তো কিসের বিষয়?হ্যা বলো?কিসের বিষয়?আজ তিনদিন ধরে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি,তন্ময়ী কি হয়েছে? আমি তোমার হাসবেন্ড। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করতে পারিনা?না!জিজ্ঞেস করলেই,আমি অযথা প্রশ্ন করি!স্বামী বলে স্ত্রীর সবকিছু আমাকে কেনো জানতে হবে!স্ত্রীর সব বিষয় না জানলে কি নয়!তবে কি করতে বলছো?বলো?

‘তাই বলে তুমি বিষয়টা জানার পরও চুপ থাকবে?

তন্ময়ী করুনকন্ঠে শুধালো।সে বাচ্চাটাকে নিয়ে ইভানের প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়,জানতে চায়।অথচ ইভানের প্রতিক্রিয়া বলছে,সে সত্যিই বাচ্চাটাকে এতো তাড়াতাড়ি চায়নি।ইভানের রাগ বাড়লো।আগেপিছে না ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে বললো–থাকবো না বলছো?তুমি আমাকে ভালোবাসাে না,এটা আমি জানি।তাই বলে তুমি আমাকে তোমার ভালোমন্দ জানাবে না?আমি ভালোবাসী তোমাকে। আমার জানতে ইচ্ছে হয়!স্বামী না মানো।মানুষ নই আমি?বলা যায় না আমাকে?বলবে কিকরে! ভালো না বাসলে তাকে শরীর দেওয়া যায়।কিন্তু মন দেওয়া যায় কি?তুমি শরীর দিয়েছো,মন দিতে পারোন…

‘ইভান!তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারোনা?

ইভান তাচ্ছিল্যেময় একটা হাসি ছুড়লো।আর হাসি বলে দিলো,তন্ময়ীর উপরে তার প্রগাঢ় অভিমান,অভিযোগ। বললোও তেমনটা।মুখ নিচু করে তন্ময়ীর চোখে চোখ রেখে বললো–বলতে পারিনা,তাই না?আমিও বলতে চাইনা,জানো!কিন্তু আমি কেনো জানিনা,তোমার বা দাদাভাইয়ের মতো ভিতরে সবকিছু চেপে রাখতে পারি না।ইদানীং খুবকরে চাইছি,কিন্তু পারছিই না।তবুও রাখছি।কিকি চেপে রেখেছি শুনবে?ওইদিন তুমি যখন বললেনা,তুমি আমাদের সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাও?বিশ্বাস ভরসা করো আমাকে!তুমি মিথ্যা বলেছিলে তন্ময়ী।

তন্ময়ী চোখ বুঁজে নিলো।বিষয়টা ইভান ধরে ফেলেছিলো। যা তাকে বুঝতে দেয়নি!ইভান সেই বন্ধ চোখের দিকে নিস্প্রভ তাকিয়ে বললো–ওদিন তোমাকে যখন প্রথম গভীর স্পর্শ করলাম।আমি বুঝেছিলাম,তুমি মুখে বললেও আদৌও তোমার সায় নেই।সায় নেই আমাদের সম্পর্কে।তবে আমার স্ত্রী তার ভরসা বিশ্বাস অটুট করতে আমাকে আহবান জানিয়েছে,আমি তাকে ফিরাই কিকরে?দ্বিতীয়ত আমি পুরুষ। আমি দূর্বল ছিলাম সেই নারীতে।ভেবেছিলাম, কত সম্পর্ক তৈরী হয় একঅপরকে না জেনে না বুঝে।সেসব সম্পর্কে যদি প্রগাঢ় ভালোবাসা তৈরী হতে পারে।আমাদের সম্পর্কেও নয় কেনো?আমাদের সম্পর্কেও ভালোবাসা টান তৈরী হবে।একটা সময় সব ঠিক হয়ে যাবে।আমার সম্পর্ক তোমার ভুলবোঝা দূর হয়ে যাবে।তোমার সঙ্গে হওয়া অন্যায় ক্ষমা করে দিয়ে আমাকে একটু হলেও ভালোবাসবে তুমি।স্বামী স্ত্রীর মায়ার বাঁধনে পড়বে তুমি।কিন্তু কঠিন সত্য হলো, তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি তন্ময়ী।তুমি শুধু আন্টির কথাতে মানিয়ে নিয়েছো আমাকে।মানতে বাধ্য হয়েছো।নাহলে আমার বাবা হওয়ার খবর অন্যের কাছ থেকে শুনতে হয় আমাকে?

‘তোমার অভিযোগ সবটা ঠিক নয় ইভান।সেটা তুমিও জানো।

তন্ময়ীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ালো।কেমন নিস্প্রভ গলায় কথাটা বললো।সেই নাড়ানো শুষ্ক ঠোঁটের দিকে চেয়ে রইলো ইভান।তন্ময়ী কি বলেছে সেটা যেনো কানেই ঢুকালো-না।তার প্রেক্ষিতে বরং কেমন অদ্ভুত গলায় শুধালো–আচ্ছা সত্যি করে বলোতো,তুমি ওকে চেয়েছিলে?যারজন্য আমি বারবার জানতে চাওয়া সত্ত্বেও তুমি বলতে চাওনি..

তন্ময়ী তড়িৎ চোখ খুলে ফেললো। কন্ঠ উঁচু করে কেমন কঠিন গলায় বললো–‘ইভান!এবার বাড়াবাড়ি বলছো কিন্তু।

‘তবে আমাকে বলতে অসুবিধা কোথায় ছিলো?

কিছুটা নম্র গলায় শুধালো ইভান।কন্ঠে নিদারুণ অসহায়বোধ।এই অবস্থায় তন্ময়ীকে সে এতো কথা শোনাতে চাইনি।উত্তেজিত করতে চাইনি।চেয়েছিলো,তন্ময়ীর উপরে হওয়া রাগটা কিছুটা কমলে তারপর কথা বলবে দুজনে।কিন্তু তার আগেই কেমন অধৈর্য্য হয়ে রাগটা উগলে দিলো।যা সত্যিই সে চায়নি।তন্ময়ীর পাতলা পেটের দিকে তাকালো ইভান।মনটা যেনো তার আরও খারাপ হয়ে গেলো।যে বাচ্চাটা আসার সুসংবাদে তারা খুশিতে মশগুল থাকবে!তা না করে ঝগড়া করছে!ইভানের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে তন্ময়ী কেমন অপরাধী কন্ঠে বললো –আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম।পারিনি এজন্য,বাচ্চাটা এতো তাড়াতাড়ি আসা তুমি ঠিক ভাবে নেবে কি-না এইভাবে।

ইভান কেমন অদ্ভুত শান্ত নজরে চাইলো তন্ময়ীর পানে।সেই নজরে নজর রাখলোনা তন্ময়ী।চোখ বুজে নিলো সে।ইভানের শান্ত নজর বলছে,তার ধারণা ভুল।সে একটু বেশিই ভেবে ফেলেছে।সেই বুঁজে থাকা নজরের পানে চেয়ে কেমন বিস্ময়ভরা অদ্ভুতকন্ঠে বললো– ও আমার।ও যখনই আসুক,আর যেই পরিস্থিতিতেই আসুক।আমি মানবোনা তাকে,এই ধারণা তোমার হলো কি করে তন্ময়ী?তুমি আমাকে এতোটা নিচু মানসিকতার মনে করো?আমার সম্পর্কে সত্যিই তোমার ধারণা এতোটা বাজে!

‘তুমি আমাকে ভুল বুঝছো ইভান।তোমার সম্পর্কে এমন ধারনা আমি পোষন করিনা।

ইভানের যেনো তন্ময়ীর কথা কানে গেলোনা।কেমন অভিমানী গলায় বললো–পোষণ করোনা?কিন্তু তোমার কথাকার্যকলাপ তো সেটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।আমার এখন কি মনেহয় জানো?সেদিন জেদ করে জোর করে তোমাকে আমার কাছে ধরে রাখার জন্য বিয়ে করা একদম উচিত হয়নি?আসলে জোর করে সবকিছু পেতে নেই।বিশেষ করে তুমি ভালোবাসো এমন জিনিস তো নয়। আমার মনেহয় তা জোর কোরে নিজের কাছে রাখার থেকে মুক্তমনে তার মতো তাকে ছেড়ে দেওয়া উচিত।নিজের কাছে যদি ভালোবাসার জিনিস ভালো না থাকে তার মতো অসুখী মানুষ আর মনেহয় পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কেউ হয়না।ভালোবাসাকে ভালো না রাখার অপরাধবোধ সত্যিই ভিষণ যন্ত্রণাদায়ক।তাকে আমি ভালো রাখতে পারছিনা!আহা কি ব্যর্থতা!সেই যন্ত্রণা ভোগ করার থেকে সেই ভালোবাসা যদি অন্যের কাছে ভালো থাকে সেটাই তো শ্রেয়।নয় কি?আমার তো মনে হয় পুরুষ মানুষ হয়ে সেই ব্যর্থতা উপলব্ধি করার থেকে সেটাই শ্রেয়!সত্যিই আমার সেদিন তোমাকে পাওয়ার লোভে তোমার বিয়ে ভাঙা উচিত হয়নি।তোমাকে তোমার ইচ্ছেতে ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিলো।তবে বিশ্বাস করো,তোমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সেদিন আমি সংবরণ করতে পারি-
নি

কথা শেষ করে ইভান দাঁড়ালো না।কোনো রকম দরজার নব মুড়িয়ে পায়ে শব্দতুলে চলে গেলো।তন্ময়ী ডাকতে চেয়েও ডাকলোনা।কেমন যেনো সবকিছু অসহ্য লাগছে! নিস্তেজ! স্বাদহীন!প্রচন্ড বিস্বাদ!হ্যা সে ইভানকে ভালোবাসে না।তবে ইভানের সম্পর্কে যে ধারণা তার ছিলো তা পাল্টে গেছে।ইভান খারাপ ছেলে নয়।তাই বলে ইভান যেগুলো বলে গেলো সবটাও ঠিক নয়।ইভানকে ভালো না বাসলেও,ইভানের প্রতি তার দূর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে।সেটা একটু অধটু নয়।ইভানকে ছাড়া জীবনে দ্বিতীয় পুরুষ সে চায়না।

হঠাৎ ধপাধপ্ পায়ের আওয়াজে ভাবনা কাটলো তন্ময়ীর।মুখ উচু করে তাকানোর আগেই ইভানের গলার ছেলেমানুষী আওয়াাজ এলো–আমার সাথে যেটা ইচ্ছে করো তবে ভুলেও আমার বাচ্চাটাকে সামন্য কষ্ট দেওয়ার চেষ্টাও করোনা তন্ময়ী।আমি কিন্তু সহ্য করবো-না।একদম না!

‘তুমি তার মা’কে কষ্ট দিচ্ছো!আবোলতাবোল বলছো!তাতে সে কষ্ট পাচ্ছে না?তুমিই তো কষ্ট দিচ্ছো তাকে!
আমাকে না বলছো?

ইভান কেমন চোখ বুঁজে ঘনোশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ালো। তন্ময়ী যেনো ইভানের দূর্বলতা টের পেয়ে বললো–তুমি একবারও তাঁকে ছুঁয়ে দেখলে না ইভান?

ইভান রয়েসয়ে চোখ খুললো।তারপর কেমন শীতল, স্থির নজরে তন্ময়ীরপানে চাইলো।ফের দূরত্ব ঘুচিয়ে তন্ময়ীর খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।খুব শান্ত গলায় বললো–তুমি কখনো আমার স্পর্শ সেভাবে অনুভব করেছো?করলে নিশ্চয় বুঝতে পারতে,আমি তাকে ছুঁয়েছি কি-না!তুমি বরং তোমার গর্ভের ভিতরে সদ্য জমাটবাধা আমার অংশের কাছে জিজ্ঞেস কোরো,তোর বাবা তোকে ছুয়েছিলো?ও বলে দেবে।

বড়ো তাচ্ছিল্যের স্বরে শেষের বাক্যদ্বয় জানালো ইভান।নিজের ব্যর্থ অনুভূতিতে চোখ বুঁজে নিলো তন্ময়ী।তবে কর্নণদ্বয় ইভানের চলে যাওয়া টের পেলো।বুঁজে থাকা চোখের কর্ণবেয়ে নোনাজল গড়াতেই তা মুছে নিয়ে চোখ খুললো তন্ময়ী।মাথা নিচু করে পেটের দিকে চাইলো।ইভান ওকে ছুয়েছিলো?কখন?সে টের পায়নি! আশ্চর্য!খেয়াল হলো কাল রাতেও বেশ কয়েকবার বমি হয়েছে। ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো খেয়াল নেই।হয়তো তারপর! হয়তোবা?চোখে অশ্রু অথচ ঠোঁটে হাসি ফুটলো তন্ময়ীর।সত্যি তার এই মূহুর্তে ওবাড়িতে যাওয়া প্রয়োজন।

আজ কয়েকদিন এই ভালো তো এই কালো মেঘে আকাশটা ছেয়ে গিয়ে ঝুপঝাপ বৃষ্টি নামছে।কাল রাতের পর আবহাওয়াটা যেনো বেশি খারাপ।সকাল থেকে ঘুমোট ভাব।মনে হচ্ছে,এ-ই ভরা কার্তিক মাসে কালবৈশাখী ঝড় উঠবে।ভয়ংকর ঝড়।তন্ময়ী ধীরপায়ে রুমের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

প্রকৃতিতে বৈরীভাব।আকাশটা ঘনোকালো মেঘপুঞ্জে ঢাকা।ঝড়োমেঘ সঙ্গে তুমুল বর্ষন চলছে।সময়টা দুপুর বারোটার সময় হলেও,নিকষকালো সন্ধ্যাবেলা মনে হচ্ছে।আজ-ও নিভান অফিসিয়াল কাজে ব্যস্ত।ঘুম থেকে উঠে তাকে আজ-ও দেখেনি কৌড়ি।তবে দেখিনি ভালোই হয়েছে।তা নাহলে সকাল সকাল এতো লজ্জা নিয়ে তার সম্মুখীন হতো কি-করে কৌড়ি।যদিও মানুষটা কাছে এলে,তার সমস্ত লজ্জারা যেনো মূহুর্তেই নাম জানা কোনো এক সুদূরপ্রসারে পালিয়ে বেড়ায়।বেডে হেলান দিয়ে বসা কৌড়ির ঠোঁটে প্রসারিত হাসি।সাফেদ দন্তের দেখা না মিললেও,বিলে ফোটা শাপলার মতো সৌন্দর্য নিয়ে এলিয়ে আছে দুটো ঠোঁট। আচমকা চোখ বুঁজে নিলো সে।বদ্ধদ্বারের অন্তঃপটে ভেসে উঠলো কিছু মধুময় চিত্র। কেউ একজনকে দেখতে না যাওয়ার অপরাধে তাকে সাজাপ্রাপ্ত হতে হয়েছে।অপরাধীর শাস্তি ছিলো,সাজা দেওয়া ব্যক্তির থেকে পর্যাপ্ত ভালোবাসা পাওয়া।যার স্নিগ্ধতা, মুগ্ধতা কৌড়ির সর্বাঙ্গে ছেয়ে আছে।যার অনুভব তখনের ন্যায় এখনো সতেজ।তবে কৌড়ির মনে সুখ ছেয়ে যায় তখন,যখন নিভান ছোট্টো বাচ্চাটার মতো তাকে বুকে আগলে নিয়ে ঘুমায়।যার শক্তপোক্ত হাত দুটো দরদভরা কোমলস্পর্শে কৌড়িকে তার বলিষ্ঠ বুকে জড়িয়ে নেয়।যখন ঠোঁটের নরম নরম স্পর্শে ছুঁয়ে দেয় কৌড়ির কপাল।চুলের মধ্যে আঙুল নাড়িয়ে, আলতো হাতে পিঠ চাপড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে কৌড়িকে।কৌড়ি সেই সময়টা অবাক হয়ে উপলব্ধি করে।ভাবে,এমন করে কি প্রত্যেকটা পুরুষ তার স্ত্রীকে ভালোবাসে!এতো সুন্দর করে!যে স্পর্শে এতো মুগ্ধতা, এতো কোমলতা,এতো স্নিগ্ধতা উপলব্ধি হয়!

কাঁচের দরজা ভেদ করে বজ্রপাতের ঝলকানিতে চোখমুখে অনুভব করতেই চোখ খুলে ফেললো কৌড়ি। বাহিরের প্রবল ঝড়বৃষ্টির শব্দ ভিতরে না এলেও, বিদ্যুতের মৃদু আলোর ঝলকানি ঠিকই অনুভাবিত হচ্ছে।কৌড়ি গায়ের চাদরটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বারান্দার কাঁচের জানালাটার কাছে গিয়ে সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলো,প্রবল বর্ষনে পুরো শহর ভিজে একাকার।সাগর উত্তাল।বৃষ্টির তোপে ধুসর রঙে ছেয়ে গেছে দূরদূরান্ত।কৌড়ি কিছুসময় সেখানে দাঁড়িয়ে বর্ষনের তোপে প্রকৃতিকে হারিয়ে যাওয়া রঙ বদলটা দেখলো।তারপর পুনরায় বজ্রপাত হতেই,বিদ্যুতের আলোটা যেনো খুব কাছ থেকে অনুভব করলো সে।সঙ্গে সঙ্গে কানে হাত চেপে ধরে, রুমের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দার কাঁচের দরজাটা থেকে সরে এলো সে।টেনে দিলো ভারী পর্দাগুলো।মুহূর্তেই রুমটা যেনো দিনেদুপুরেও,কোনো বন্দীশালায়ের অন্ধকার রুমে পরিনত হলো।বজ্রপাতে তার ভীষণ ভয়।ঠিক ভয় নয়।এযেনো কেমন একটা অনুভূতি।সে জানে রুমে থাকাকালীন, আল্লাহ চাইলে সে বজ্রপাতের অনিষ্ট থেকে বেঁচে যাবে।তবুও ভিতুময় কেমন কেমন অনুভূতি।দ্রুত গিয়ে রুমের মৃদু আলোর বাল্বটা জ্বালিয়ে দিলো সে।রুমে অকারণে অতিরিক্ত আলো ভালো লাগেনা তার।পুনরায় বেডে এসে বসতেই ফোনটা বেজে উঠলো।জ্বলজ্বল অক্ষরে ইংলিশ বর্ণে স্কিনে ভেসে উঠলো Nivan নামটা।কৌড়ির মুখে ফের হাসি ফুটলো।কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে তুলতেই ওপাশ থেকে এলো চিন্তিত কন্ঠস্বর।

‘উঠেছো?ভয় পাচ্ছো?আমি আসবো?

কন্ঠে যেনো মায়া ঢালা।কৌড়ি আনমনে হাসলো।কাল কনফারেন্স শেষ করতে কতো সময় লেগেছে।আর আজ মানুষটা তারজন্য ব্যস্ত।কাজে মন দিতে পারছে-না!কাজ ফেলে আসতে চাইছে!চিন্তিত কন্ঠেস্বরের মালিককে নিশ্চিন্ত করতে কৌড়ি বললো–‘আমি ঠিক আছি।আপনি টেনশন করবেন-না।অস্থির হবেন না।

‘শিওর?ভয় পাবে না তো?

‘ভয় পেলে অবশ্যই আপনাকে চলে আসতে বলবো।

কন্ঠ যেনো স্বাভাবিক হলো নিভানের।সহসা
শুধালো—খেয়েছো?

‘হুমম।

‘আর মেডিসিন?নিয়েছো?

‘হুমম।

‘গুডগার্ল।এইতো লক্ষীসোনা আমার।

কন্ঠ যেনো বেশ চাপা এলো।কৌড়ি বুঝলো আশেপাশে মানুষ আছে।দুই একজনের মৃদু কন্ঠস্বরের আওয়াজও ভেসে আসছে।তবে নিভানের সম্বোধনে মন পুলকিত হলো কৌড়ির,যেনো সে আহ্লাদীত কোনো বাচ্চা!আর খুব খুব আদূরে!কৌড়ি,বাবা মায়ের শেষ বয়সের সন্তান ছিলো।তাও একমাত্র সন্তান।তবুও মনেহয় এতোটা আহ্লাদীত ছিলোনা,যতোটা আহ্লাদী বিগত দিনগুলোতে মানুষটা তাকে করে তুলেছে।রোজ রোজ মানুষটার কথাকাজে ব্যবহারে তাকে অনুভব করাচ্ছে।কৌড়ি আনমনে হাসলো।তার ক্ষেত্রে ওই মানুষটার আচারণ বার্তা এতো স্পর্শকাতর, কৌড়ির তো মনেহয় পৃথিবীর সব আহ্লাদ জড়ো করে ওই মানুষটা তারপানে এনে ঢেলে দেবে।দেবে কি! দিচ্ছেই তো!

শীতল আবহাওয়া। ঠান্ডা ভাব।নিদ্রায় ডুবে থাকার আরামদায়ক সময়।অথচ আজ আর কিছুতেই চোখে ঘুম ধরা দিলো-না।বিছনায় পা মেলে দিয়ে কৌড়ি কিছুসময় ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করলো।এটাওটা দেখলো।হঠাৎই একটা মডেলের গাঢ় লালরঙের আটপৌড়ে বেনারসি পরে নিদারুণ সাজের কিছু পিক নজরে আসলো।মেয়েটার চেহারা চমৎকার।আটপৌড়ে পরা শাড়ীর সঙ্গে সাজটাও বেশ রুচিশীল।কৌড়ি পিকগুলো দেখলো।মূহুর্তেই নিজের বিয়ের আগেপিছের দিনের কথাগুলো মনে পড়ে গেলো তার।মডেলের পিক দেখা বাদ দিয়ে নিজের গ্যালারিতে ঢুকলো সে।ফোন থাকলেও হুটহাট তার ছবি তোলা হয়না।তার গ্যালারির অধিকাংশ পিক মৌনতা আর মান্যতার সুবাধে তোলা।এবং কিছু পিক মান্যতার ফোন থেকে নেওয়া।গ্যালারিতে অনেকের পিক আছে।কৌড়ি নিজেরসহ সবার পিকগুলো দেখলো।দেখতে দেখতে নিভান আর তার একটা পিক সামনে এলো।পুরো গ্যালারিজুড়ে হাতেগোনা এই একটাই পিক দু’জনের।আশ্চর্যের বিষয় হলেও দুজনের একসঙ্গে আর কোনো পিক নেই।বিয়ের দিনের পিক।শুভ্র রঙের উপর সোনালী কারুকার্যের ভারী শেরওয়ানিতে লম্বা চওড়া শ্যামবর্ণ মানুষটাকে অসম্ভব সুদর্শন এবং ব্যক্তিত্ববান লাগছে।মুগ্ধকর।কৌড়ি ছবিটা জুম করলো।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিভানের খাড়া নাক,ভাসাভাসা চোখ,পুরো ঠোঁট,চওড়া কপাল,ছোটো করে কাটা চুল,পুরুষালী স্বরউচু গলার বহিরাঅংশ দেখলো।দেখলো মানুষটা উচ্চতায় তার থেকে কতখানি লম্বা।আনমনে ঠোঁটে হাসি ফুটলো কৌড়ির। নিভানের কাঁধ সমান উঁচ্চতা তার।অথচ পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা সে।তাহলে মানুষটার উচ্চতা ঠিক কতোটুকু?

দু’জনের পাশাপাশি বসা ছবিটা বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছুক্ষণ প্রসন্ন চিত্তে দেখলো কৌড়ি।নিজের শাড়ী পরা আরও কিছু ছবিও দেখলো।ফের চঞ্চল নজরে বাহিরের মুশলধারা বৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করলো।ঘনোবর্ষন হলেও এখন আর মেঘের চমকিত সেই ডাক নেই।আকাশ ভেঙে শুধু কেমন অঝোরধারায় জল নামছে।এমন বর্ষা হলে বাহিরের উঠানে,পুকুরের শানবাঁধানো জায়গাটায় দাঁড়িয়ে কতো ভিজেছে কৌড়ি।মন চঞ্চল হলো।পিছনের কথা মনে পড়তেই বৃষ্টিতে ভিজতে মন চাইলো।ফের ফোনের দিকে তাকাতেই আরও একটা ইচ্ছে জাগলো তার। হঠাৎই এই বর্ষণমুখর দিনে তার শাড়ী পরে ভিজতে মন চাইলো।কৌড়ি আগেপিছে ভাবলোনা।উঠে দাঁড়ালো।তার আগে নিজের পছন্দের একটা গান প্লে করে দিলো।ফোনে সুর উঠলো,আর সে ছুটলো হোটেল রুমের কর্ণারে রাখা ট্রলিটার পানে।

মন মোর মেঘের ও সঙ্গী
উড়ে চলে দ্বিগদিগন্তেরও পানে।
নিঃস্বমো সন্ধ্যে শ্রাবন বর্ষনো সঙ্গীতে..

এই রবীন্দ্র সংঙ্গীতে কেমন একটা একাকিত্ব, মনখারাপ, নিঃসঙ্গ ভাব। সুর।তবুও কৌড়ির ভালো লাগে।ট্রলিটা খুলতেই নজরে পড়লো খয়েরী পাড়ের গাঢ় সবুজ কাতান স্লিক শাড়ীটা।শাড়ীটা ভারী।এই শাড়ীটাও ওই মানুষটার পছন্দ।একদম নতুন। ভাজভাঙা হয়নি।কৌড়ি ঘুরতে আসাতে শাড়ী নিতে চায়নি।কিন্তু মান্যতা তা জানতেই নিজের পছন্দে শাড়ী বেছে কয়েকটা শাড়ী গুছিয়ে দিয়েছিলো আর দুষ্টীমি করে
বলেছিলো।–মধুচন্দ্রিমায় যাচ্ছিস।বাঙালি নারী, শাড়ী নাহলে চলে!দেখবি কখন আবার মন পরতে চাইবে!আবার তোর মন পরতে না চাইলেও দাদাভাইয়ের তো চাইতেই পারে।তাই না?আর পুরুষ মানুষ তার একান্ত নারীকে একান্ত শাড়ীতেই দেখতে পছন্দ করে।

মধ্যদুপুরেও চারপাশটা কেমন সন্ধে সন্ধে মনেহলো।
রুমের সেই মৃদু আলোতে কৌড়ি গায়ে শাড়ী জড়ালো।ফোনের সেই মেয়েটার মতো আটপৌড়ে করেই শাড়ী পরলো।ঘরের আবাছা আলোতে আয়নায় তবুও নিজের সেই শাড়ীনারী নারী রূপটা স্পষ্ট। শাড়ী গায়ে জড়ালেই যেনো নারী অন্যরকম।যতোই বয়সে অপরিণত হোক, নারী যেনো শাড়ীতেই পরিপূর্ণা।অনন্যা।আলাদা মাধুর্যময়ী।নিজেকে দেখতে দেখতে,কৌড়ি দু’হাতে কাঁচের সবুজ খয়েরী চুড়ি পরলো।এগুলোর কৃতিত্বও মান্যতার।তার শাড়ীর সঙ্গে ম্যাচিং চুড়ি ছিলোনা।সেটা শুনে মান্যতা নিজের কাছে থাকা চুড়ি গুলো এনে দিয়েছিলো। কৌড়ি বারবার মানা করেছিলো।শোনেনি মেয়েটা।তখন মনে হয়েছিলো, কি কাজে লাগবে।অথচ মনের পাগলামো পূর্ণ করতে কাজে লাগলোই।কৌড়ি হাসলো।খয়েরী আর সবুজের মিশেলে চুড়িতে ফর্সা হাতের সৌন্দর্য যেনো বেশ আকর্ষনীয় দেখালো।সেই আকার্ষরিনীয় হস্তে রিনিঝিনি শব্দতুলে কৌড়ি মাথার মধ্যমনিতে সিঁথি তুললো।জাদুর ছড়ির মতো ঘুরিয়ে কিভাবে কিকরে যেনো দু’হাতের আঁটোসাঁটো খোঁপা বাঁধলো।মায়াবী মুখটা যেনো আরও স্পষ্ট হলো।সেই মুখে মৃদুমন্দ প্রসাধনী ছোঁয়ালো।মুখে হালকা ফেইসক্রিম আর ঠোঁটে গাঢ় খয়েরী লিপস্টিক লাগালো।ক্ষনিকেই মুখের লাবন্যতা যেনো অন্যরকম সৌন্দর্যময়ী রূপ ধারণ করলো।কৌড়ি নিষ্পলক চোখে তা চেয়ে চেয়ে নিজেকে দেখলো কিছুক্ষণ।নিজের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলো যেনো তার চোখজোড়া।কানে একজোড়া ছোট্ট দুল ছিলো।সেটা খুলে সেখানে কানটানা একজোড়া ঝুমকোজোড়া পরলো।ফর্সা গলায় চিকন স্বর্নের চেইনটা যেনো বেশ মানানসই।তাই আপতত আর গলাতে কিছু পরলো-না।সাজের সাথেও যেনো মানিয়েছে বেশ।পুনরায় আয়নায় তাকাতেই নিজেকে কেমন সাধারণের তুলনায় একটু অন্যরকম দেখালো।কৌড়ি সময় ব্যায় করলোনা।কেমন দুরন্ত পায়ে ছুটে গেলো বারান্দার দোরগোড়ায়।তখন ফোনে গান বদলে গিয়ে নতুন আরও একটি বর্ষামুখর গান চললো,

পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে,
পাগল আমার মন জেগে উঠে।
চেনাশোনার কোন বাইরে,যেখানে পথ নাই নাইরে
সেখানে অকারণে যায় ছুটে।

অফিশিয়াল কাজ আপতত কমপ্লিট।মিটিং সেরে বাহিরে সময় ব্যায় না করে,নিজেদের বরাদ্দকৃত হোটেল রুমে ফিরলো নিভান।কার্ড প্রেস করে রুমের দরজাটা খুলতেই মৃদুস্বরে গানের আওয়াজ ভেসে এলো…

-এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকেনা তো মন,
কাছে যাবো কবে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।

কৌড়ি গান শুনছে!রুমে ভিতরে ঢুকতেই আচমকা নজর চলে গেলো বারান্দায়। যেখানে বারান্দার অর্ধগ্রিল ঘেঁষে শাড়ী পরিহিতা এক রমনী চোখবুঁজে আকাশপানে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।বৃষ্টির অঝোরে ঝরা বর্ষন পুরোটা তাকে না ছুঁতে পারলেও,মৃদুমন্দ ছিটেফোঁটা তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।মুক্তোর দানার ন্যায় সেই ফোঁটাফোঁটা পানি দানা বেধেছে তার রাঙানো লালওষ্টে, বুঁজে থাকা চোখে,নাকে,গালে,গলায়।মেয়েটার ঠোঁটে প্রসারিত হাসি।বাহিরের ধূসরে ছেয়ে যাওয়া ঝমঝমে বৃষ্টি আর একান্ত নারীর স্বর্গরূপা সাজ!এযেনো অপার্থিব দৃশ্য!নিভান কেমন পলকহীন,দৃঢ়,গভীর নয়নে সেই নারীকে অবলোকন করতে করতে, তারইপানে এগোলো।যতোই এগোলো মেয়েলী একটা মিষ্টি গন্ধে মোহাবিষ্ট হতে লাগলো তার নাসাপথ।আর তা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে।সঙ্গে মুগ্ধ হতে থাকলো নিভানের দুটো বুদ্ধিদীপ্ত গম্ভীর চোখ।ফর্সা শরীরে গাঢ় সবুজ শাড়ীটা যেনো পাহাড়ী নজরকাঁড়া কোনো মায়ারণ্য রূপ।সঙ্গে কানের টানা ঝুমকোজোড়া!গলায় চিকচিক করা স্বর্নের চেইনটা!দু’হাতে ভরা খয়েরী সবুজ কাঁচের চুড়ি!আর মৃদুমন্দ বৃষ্টিতে ভেজা সে নারী!নিভান বারান্দার দোরগোড়ায় গিয়ে ঘনোঘনো পলক ফেললো কয়েকটা।এই নারীর এই রূপ-লাবণ্যেতা উপেক্ষা করা কঠিন সাধুপুরুষেরও কাম্য নয়।নিভান ঠায় দাঁড়িয়ে বিমুগ্ধ নজরে সেই রূপ-লাবণ্যে উপভোগ করতে লাগলো।তবে কৌড়ি যেনো টের পেলো নিভানের এসে দাঁড়ানোটা।মূহুর্তেই চোখ খুললো সে।বললো–আপনি এসেছেন?আজ এতো তাড়াতাড়ি?

ঝর্নায় ন্যায় উচ্ছল যেনো সে কন্ঠস্বর!যার উচ্ছলতার টের আগে কখনো পায়নি এই নারী কন্ঠে নিভান।সেই কন্ঠের উচ্ছলতার রেশ যেনো ছড়িয়ে পড়েছে নারীটার চোখেমুখে।সেই ডগরডগর হরিনী চোখ হাসছে।যে চোখ দুটো এতোটা ঝলমলে খুশি নয় বরং ভারাক্রান্ত মায়াবী শান্ত নয়নে ধরা দিয়েছে নিভানের নয়নে।আজ তার উচ্ছ্বসিত রূপ!হাসছে সেই ওষ্ঠদ্বয়।যে ওষ্ঠদ্বয়ে নিভান এর আগেও বহুবার হাসি দেখেছে।তবে এতো মাধুর্যপূর্ন নয়।এযেনো পদ্মের ফুটন্ত রূপ!হাসছে যেনো সেই মায়াবী পুরো মুখাবয়ব!নিভান, এই কৌড়িকে চেনেনা!এতো উচ্ছলতা নিয়ে কখনো কৌড়িকে বলতে শোনেনি সে!তবে এই অচেনা উচ্ছল কৌড়িই যেনো অমায়িক অসাধারণ লাবন্যময়ী লাগলো তার। মনেহলো,বাহিরে ধূসরে ছেয়ে যাওয়া বৃষ্টির চিত্ত আর এই উচ্ছলতায় ভরা স্বর্গরূপা নারীর হাস্যজ্বল রূপের দৃশ্যপট! তার পৃথিবী এখানেই থমকে যাক!অন্তত যুগ ধরে এই দৃশ্যই অবলোকন করুক তার চক্ষুযুগল।নিভান যেনো ঘোরে ডুবলো।কৌড়ি কি জিজ্ঞেস করেছিলো ভুলে বসলো।
তার প্রেক্ষিতে জিজ্ঞেস করলো–হঠাৎ আমাকে ভুলে বৃষ্টির সঙ্গে সখ্যতা? তাও আবার এতো অপরূপা সাজে?

কৌড়ির হাসিতে এবার সাফেদ দন্তের দেখা মিললো। নিভানের প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে খুব স্বাভাবিকতর দাড়িয়ে থাকা।সহজ কন্ঠস্বর!তাকে লজ্জার বিভ্রান্তে ফেললোনা।বরং নিভানের মতোই খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে সেও বললো– হঠাৎ ইচ্ছে জেগেছে তাই।

নিভান একটু অবাক হলো!এ কি সেই কৌড়ি বলছে যে, নিজেকে কখনো কারও সম্মুখে ঠিকঠাকভাবে মেলে ধরতে চায়না!তার সম্মুখেওনা!তবে সেসব ভাবনা ভুলে
নিভান যেনো সেই মুক্তোঝরানো হাসিমুখের মুগ্ধতার গভীরে ডুবলো।কৌড়ি সেই মুগ্ধতার মোহজাল বাড়িয়ে দিয়ে বলতেই নিভান কদম বাড়িয়ে দূরত্ব ঘুচালো।বললো—আমারও যে হঠাৎ কিছু ইচ্ছে মনে জেগেছে!

নিভানের ইঙ্গিত হঠাৎই ধরতে পারলোনা কৌড়ি।আগের ন্যায় উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো-আমি আমার ইচ্ছে অপূর্ণ রাখিনি।

কথাটা বলেই ঘুরে দাঁড়ালো কৌড়ি।হাতদুটো মেলে দিলো দু’দিকে।সেই মেলে রাখার হাতের উপরে নিভান নিজের হাতদুটো রাখলো।কৌড়ি এবার চমকে উঠলো।পিছে ফিরে তাকানোর আগেই নিভান তার কানের কাছে মুখ এনে বললো–তবে তুমি কি আমার ইচ্ছেও অপূর্ন রাখতে না করছো?

কৌড়ি এবার বুঝলো সে কি বলে ফেলেছে।যার দরূন উত্তর দিতে পারলো-না।বরং বরের স্পর্শে অনুভূতিতে নারী কোমল শরীর হিম অনুভব হলো।মূহুর্তেই লজ্জারা এসে ভীড় করলো সর্বাঙ্গে।হঠাৎ নিজের সাজপোশাকের কথা মনেহলো।এবার যেনো লজ্জায় গলে এলো শরীর।সেই গলে আসা শরীরটা বড়োযত্নে নিভান নিজের বলিষ্ঠ বুকে ঠাই দিলো।আগলে নিলো শক্তপোক্ত বাহুবন্ধনীতে।কোমল হাতের উপরে শক্ত হাতের চাপ লাগতেই পরপর কয়েকটা চুড়ি খুলে পড়ে গেলো।টাইলসকৃত ফ্লোরে তা ঝনঝন আওয়াজে বেজে উঠলো।কৌড়ি আঁতকে উঠে,কেমন মুখ ফসকে নিভানকে মৃদুশব্দে ডেকে উঠলো।–নিভান!

কৌড়ির আতঙ্কিত ডাকের বিপরীতে নিভান মৃদু হেসে বললো-ভেঙে যাক।যতো ইচ্ছে কিনে নিও।আমি দেবো।

ভেঙে যাওয়ার জন্য তো বলেনি কৌড়ি।বলেছে আতঙ্কিত হয়ে।কৌড়ি ফের কিছু বলতে যাবে তারআগে কন্ঠস্বর নিভে এলো তার।বউয়ের ফর্সা গলার ভাঁজে গভীর চম্বুনে নিবিষ্ট করলো নিভান নিজের ওষ্ঠদ্বয়।যা কৌড়িকে দেখলেই তাকে বড়োই আকর্ষণীয় বস্তুর ন্যায় টানে।গভীর উষ্ণ স্পর্শে কৌড়ির পাতলা শরীরটা খিঁচে নিভানের বলিষ্ঠ বুকের সঙ্গে আরও মিশে গেলো।শ্বাস রুদ্ধ হওয়ার জোগাড়।সেই রুদ্ধশ্বাস এবার আঁটকে এলো এবার নিভানের জড়ানো স্বরের ডাকে।

কৌড়ি।

এ ডাকের অর্থ কৌড়ির জানা।তবে এ ডাকটার উত্তর দিতে চায়না কখনো কৌড়ি।তবে অসময়ে ডাকটা শুনে লজ্জায় বিমুঢ় হয়ে গেলো সে।মন মস্তিষ্কে তোলপাড় শুরু হলো।চোখ খিঁচে অনবরত শুধু মাথা নাড়ালো।মুখে কাঁপা স্বরে আওড়ালো–উহুম।অর্থাৎ না।

‘হুমম।অর্থাৎ না নয় হ্যা।

নিভান হেসে দিলো। সে হাসির শব্দ মোহগ্রস্তের ন্যায় কৌড়িকে দূর্বল করে দিলো।আর তারচেয়ে দূর্বল করে দিলো নিভানের গলার হুমম শব্দটা। যার বিপরীতে কৌড়ি আর একটা শব্দও প্রয়োগ করতে পারলো-না।আর না সে ডাকের আহ্বান উপেক্ষা করে ফিরিয়ে দিতে পারলো।নিভানও কেমন মধ্যেদুপুরটাকে মধ্যেরাত বানিয়ে নিলো।আর অসময়টাকে কেমন সময়।

সময়টা বর্ষনমূখর বিকেলবেলা।সিয়াম বাহিরে যেতে চেয়েও যেতে পারলো-না।বাহিরে বর্ষার তোড় কেমন সেটা সদর দরজা খুলে দেখে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পড়লো সে।এতো বর্ষায় বাহিরে যাওয়া যায়!সোফায় বসতেই নজর পড়লো কিচেনে।দীবা কিছু একটা করছে।সুশ্রী মুখখানা তার আষাঢ়ে মেঘের মতো গম্ভীর।সেদিন রাতে মেয়েটা শান্ত হয়ে ঘুমালেও সকালে উঠে ওবাড়িতে যাওয়ার জন্য বেশ গলাবাজি করে তারসঙ্গে ঝগড়া করেছিলো।সিয়াম না পেরে শান্তস্বরে বলেছিলো—আচ্ছা তুমি যদি ওবাড়িতে ভালো থাকো,তবে ওবাড়িতেই রেখে আসবো তোমাকে।
আপতত শান্ত হও।তবে ওবাড়িতে যাবার আগে আরও একবার ভেবে দেখো।আমি খারাপ মানুষ আমার সঙ্গে ভালো থাকবে না সেটা নাহয় বাট ওবাড়িতে ভালো থাকবে তো?

সিয়ামের কথায় দীবা আর দ্বিতীয়ত কথা বাড়াইনি।চুপ হয়ে গিয়েছিলো।কথা বলেনি আজও। তবে তার কথা ভেবে হোক বা অন্যকিছু, মেয়েটা আর ওবাড়িতে যাওয়ার জেদ করেনি।এমনকি প্রসঙ্গ টানেনি।সিয়ামও সেখানেই চুপ।তবে নিভানের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সিয়ামের মায়ের সঙ্গে তার শ্বাশুড়ির এবাড়িতে চলে আসায় দীবার এবাড়িতে থাকাটা আর-ও সহজ হয়েছে। তবে দীবা তার সঙ্গে কথা না বললেও,সিয়ামের বাবা মায়ের সঙ্গে আগের ন্যায় আচারণ করছে।কথাবার্তায় গম্ভীরভাব হলেও বলছে।হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় ভাবনা কাটলো তার।এক বন্ধু কল করেছে। তারসঙ্গে মিট করা কথা ছিলো। সেইই ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করে কথা বললো সিয়াম।এ অবস্থায় কোনোরূপ বাহিরে যাবেনা সে।জানিয়ে দিলো।আরও টুকিটাকি কথাবার্তা বলে ফোন রাখলো।হঠাৎ কিছু একটা মনে করে শুভাকাঙ্ক্ষী একজনের নম্বরে ডায়াল করলো।যাকে সে এতোদিন প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতো সঙ্গে নিজের অপছন্দের ব্যাক্তি।ওপাশ থেকে দৃঢ় কন্ঠস্বরের আওয়াজ ভেসে আসতেই সালাম দিলো সিয়াম।নিভান সালামের উত্তর দিতেই সিয়ামের দৃষ্টি চলে গেলো কিচেনে।যেখানে দীবা এখনো একমনে কিছু করে চলেছে।জীবনে সে অনেক ছেলেমানুষী করেছে। তবে এই মেয়েটার বেলায় এসে দিল কিকরে আঁটকে গেলো বুঝে আসেনা সিয়ামের।আর এই মেয়ের জন্য কতো কিছু বাধ্য হয়ে ছেড়েছে।কতোকিছু ছাড়তে হয়েছে। নিজের স্বভাব আচারনের বদলও করতে হয়েছে।যা বাপের এক রাজপুত্র হিসাবে,যখন যেটা যা ইচ্ছে করা সিয়ামের জন্য সহজ ছিলো-না।তবুও কেমন মেয়েটাকে পাওয়ার আশায় সেই নিত্যনতুন আকাঙ্ক্ষার জীবন
ত্যাগ করতে হয়েছে।তবে এটাতে সিয়ামের ভালো ছাড়া মন্দ হয়নি।যার অনুভব ধীরেধীরে অনুভাবিত হয়েছে সিয়ামের।সিয়াম আনমনেই বললো–‘থ্যাঙ্কিউ নিভান। দীবাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।

এটা ভুল ধারণা আপনার।আমি ফিরিয়ে দেই-নি।যেটা কখনো আমি আমার ভাবিনা তার দিকে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকাইনা।যা আমার নয় তা অন্যকে দেওয়া নেওয়ার হকও আমার নয়।সুতরাং আপনার জিনিস আপনি হাসিল করেছেন।

‘সুপরামর্শ তো আপনার ছিলো।নাহলে দীবাকে আমার কাছে ফিরানো সহজ ছিলো কি?ছিলো না।

‘ছিলো কি ছিলো,তা আমি জানিনা।তবে থ্যাঙ্কিউয়ের থেকে আমি যেটা আপনার থেকে আশা করছি তা হলো,দীবাকে ভালো রাখা।ও আমার রক্তের সম্পর্কের কিছু না হলেও,ও আমারই একজন ফ্যামিলি মেম্বার্স।আর আমি কখনো চাইনা,আমার ফ্যামিলি মেম্বার্সের কেউ একজনও দুঃখী থাকুক।অশান্তি, অসুখে থাকুক।তারজন্য আপনাকে সুপরামর্শ দেওয়া।

‘যেটার জন্য হোক তবুও ধন্যবাদ আপনাকে।

সিয়াম এতোটা বিনয়ী কখনো ছিলোনা।আর নিভানের ক্ষেত্রে তো নয়ই।ওবাড়ির জামাই আর দীবাকে পাওয়ার গর্বে সবসময় নিভানের সম্মুখে একটা অন্যরকম ভাবভঙ্গিতে থেকেছে।যা নিভানও কখনো পরোয়া করেনি।সেই সেই না পরোয়া, সিয়ামকে আরও নিভানের বিপক্ষে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে।সেই দ্বন্দ্ব আগে ভঙ্গ হলেও,সম্পূর্ণ ভঙ্গ হয়েছে নিভানের বিয়ের আগের রাতে।যখন নিভান তাকে ফোন দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে তার বিয়েতে আমন্ত্রণ করলো।এবং নিজের থেকে দীবাকে মানানোর একটা প্রচেষ্টা করতে বললো।মানুষের জীবনে ভুলভ্রান্তি অন্যায় থাকতে।পারে।সেগুলো সে কোন পরিস্থিতি করেছে বুঝিয়ে শুনিয়ে সিয়ামকে একটা সুযোগ দিয়ে মানাতে।আরও নানাবিধ সুপরামর্শ।
সিয়াম ভিষন আশ্চর্য হয়েছিলো সেদিন।বিয়ের আগ থেকে দীবার মুখে নিভানের ভালো গুনগান শুনতে শুনতে একটা অদ্ভুত আক্রোশ তৈরী হয়েছিলো। শত্রুতা না করে কেমন শত্রু মনোভাব পোষন করতো।নিভানের প্রতি দীবার দূর্বলতা সেই শত্রুতা মনোভাব যেনো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলো।আর সেই শত্রুতা মনোভাব থেকে রাগ-ক্ষোভে কিনা কি বলেছে লোকটাকে।আর সেই লোকটা তার সংসার জোড়ার সুপরামর্শ দিচ্ছে!

‘সিয়াম।আমি আরও একটা কথা বলতে চাই?

দৃঢ়কণ্ঠের বার্তায় ভাবনা কাটলো সিয়ামের।নড়েচড়ে বসলো সে।তবে তখনো নজর তার দীবাতে।সেখানে নজর রেখেই বললো—বলুন।

‘দ্বিতীয়ত দীবা যদি কখনো আপনাকে অভিযুক্ত করে এবাড়িতে পা রাখে।আপনি কিন্তু দ্বিতীয়বার সুযোগ বা সুপরামর্শ আর পাবেন না। এবং তাকেও না।জাহিদ সাহেব, শাহেদ সাহেব তাদের আদরের ভাগ্নীর ব্যাপারে চুপ আছেন কিন্তু আমার পরামর্শে।দ্বিতীয়বার কিন্তু আমি আপনাদের বিষয়ে মস্তিষ্ক ঘামাবো-না।আমার কথাগুলো ভালো না লাগলে, আমি দুঃখিত।বাট আমার মনেহয় একজন মানুষকে বারবার সুযোগ দেওয়া অনুচিত।

নিভানের এই কার্টছাট কথায় সিয়ামের ব্যক্তিত্বে আঘাত হানলো।নজর সরে এলো তার দীবা থেকে।গম্ভীর হয়ে গেলো সুদর্শন মুখাবয়ব। দোষ কি তার একার ছিলো?ওদের বাড়ির মেয়ের দোষ ছিলোনা?তবে কেনো বিচার সর্ব পর্যায়ে তার বিপক্ষে যাবে?সে যা করার বিয়ের আগে করেছে কিন্তু দীবা!আঘাত হানা মনটাকে সামালে নিলো সিয়াম।সে বাবা মায়ের আদূরের দুলাল হলেও বখে যাওয়া ছেলে নয়।আর দ্বিতীয়ত জোড়া না লাগা সম্পর্কটাকে সে জোড়া লাগাতে চায়।বিভক্তি করতে চায়-না।মুলত দীবা যেমনই থাকুক সে দীবাকেই চায়।দীবা তার জীবনে আসার পর থেকে অন্য নারীতে তার মন বসেনি।তার আর অন্য কোনো নারী চাইনা।সুতরাং
কিছু কথা ব্যাক্তিত্বে আঘাত হানলেও না চাইতেও তা হজম করতে হবে।যেখানে নিজের দোষটাও খুব ছোটো খাটো বিষয় ছিলোনা।কমও ছিলেনা।এটা ভেবে নিজের পুরুষ জেদ, ইগো সরিয়ে বিনয়ী গলায় উত্তর দিলো।

‘সেই সুযোগ আমি যতোসম্ভব না দেওয়ার চেষ্টা করবো
নিভান।তবে দীবা আমাকে বুঝলে হয়।ওর চাওয়াতো এক মানুষের আঁটকে আছে।

‘আর সেই মানুষটা মনেপ্রাণে শুধুমাত্র তার স্ত্রীকে চায়।শুধুমাত্র তারই স্ত্রীকেই।এটা আপনার বউকে বুঝিয়ে নিজের ভালোবাসায় আঁটকে রাখর চেষ্টা করুন।আঁটকে রাখুন।ভালোবাসায় বন্যপ্রাণীও আঁটকে থাকতে বাধ্য হয়।

‘হুমম।

ফোনে কেটে দিলো নিভান।সিয়াম সেই ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ফের পাশ ফিরতেই দেখলো ডালিয়া বেগম শূন্য দৃষ্টি ফেলে তারদিকে ফিরে দাঁড়ানো।সিয়াম ফোন কাটতেই তিনি বললেন-নিভানের সঙ্গে কথা বলছিলে?

‘জ্বি আম্মা।

‘নিভান তোমাকে পরামর্শ দিয়েছিল দীবাকে মানানোর চেষ্টা করতে ?

সিয়াম মৃদু মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো।ফের মুখ বললো–হ্যা আম্মা

চলবে…

বাকি অংশ পরবর্তীতে যোগ করা হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে