#ফুলকৌড়ি
(৫৮)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
অফিশিয়াল কিছু কাজের জন্য সকাল সকাল জাহিদ সাহেবের শরণাপন্ন হতে হলো নিভানকে।যদি-ও রোজ সকালে অফিসে বের হওয়ার আগে উনার সাথে একবার দেখা করে তারপর অফিস যায় নিভান।রাতে অফিস থেকে ফিরেও একবার দেখা করার চেষ্টা করে ,যদিনা তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।জাহিদ সাহেবের রুমে ঢুকে উনার শরীরের খবরাখবর নিয়ে অফিশিয়াল কাজের কথায় মত্ত হলো দু’জনে।কথাবার্তা শেষ হতেই জাহিদ সাহেব একটু সময় নিলেন।ফের বললেন– তৃনর আর মান্যতার বিষয়টা নিয়ে কি ভাবলে?তৃনয় প্রস্তাব রেখেছে বিষয়টা খুবই ভালো লেগেছে কিন্তু প্রস্তাবটা বেয়ান সাহেবা রাখলে বিষয়টা আরও ভালো হতো-না?
‘আন্টিই প্রস্তাব রাখতে চেয়েছিলেন।তৃনয় মানা করেছে।
একটু আশ্চর্য হলেন জাহিদ সাহেব। শুধালেন–কেনো?
‘বিয়ের মতো একটা বন্ধনে ছেলে মেয়ে দুজনেকেই সংসারের জালে আঁটকে পড়তে হয়।সেখানে শুধু তৃনয় মতামত বা প্রস্তাব রাখলে-তো হবে-না।মান্যতার মতামতও গুরুত্বপূর্ণ।প্রয়োজনীয়।যদিও আমি মান্যতার সাথে তৃনয়ের বিষয়ে কথা বলেছি।সিদ্ধান্ত নিতে মতামত জানাতে সময় চেয়েছে সে।সেটা আমি তৃনয়কে জানিয়েছি।তাই আপতত আন্টিকে মানা করে রেখেছে তৃনয়।যদিও মান্যতার সময় চাওয়ার বিষয়টা আন্টি জানে না।তৃনয়,আন্টিকে বলেছে পরপর ওবাড়িতে দুটো বিয়ে হলো।আপতত আমরা সময় নিয়ে বিয়ের প্রস্তাবটা রাখি।সেটা মেনেছেন আন্টি।তবে মান্যতা ভালোমন্দ মতামত প্রকাশ করলেই আন্টিকে পাঠানো হবে প্রস্তাব নিয়ে।
মেয়ের বিষয়টা তিনি এতো গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখেন নি।কারন মান্যতা বাবা,ভাইয়ের সিদ্ধান্তের বাহিরে যাবার মতো মেয়ে নয়।সেজন্য মান্যতাকে নিয়ে এতোটা তৎপর ভেবে দেখা হয়নি। এজন্য নিভানের সকল সিদ্ধান্ত তিনি চোখ বুঁজে মেনে নেন।ছেলেটার সবদিকে খেয়াল থাকে।কারও অধিকার থেকে এক সুতা পরিমাণ হক যেনো নষ্ট নাহয়,ছেলেটার নিদারুণ খেয়াল সবসময় সেদিকে তৎপর থাকে। কন্ঠে সন্তুষ্টতা বজায় রেখে তিনি বললেন।
‘বেশ ভালো।তবে ওদিকে চৌধুরী সাহেব তো মনেহয় আমাদের উপর বেশ মনোক্ষুণ্ণ হয়েছেন!তোমার বিয়ের নিমন্ত্রণে তো আসলেনই না,গতকাল কথা হলো।কথার ভঙ্গিমায় বুঝলাম তিনি প্রস্তাব নাচকে বেশ অসন্তুষ্ট।তবে আরও একবার বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখতে বললেন।
‘আপনি কি বললেন?
‘বলেছি কাওকে কথা দিয়ে ফেলেছি। সেজন্য আপনার প্রস্তাব রাখতে পারছিনা।
নিভানের ঠোঁট সুক্ষ প্রসারিত হলো।সেটা খেয়াল করলেন জাহিদ সাহেব।তুখোড় বিজনেসম্যান হওয়ায় হঠাৎই একটা কথা মাথায় এলো।সেই অনুযায়ী শুধিয়ে ফেললেন সামনে বসা ছেলেটাকে–এই কারণে যদি ব্যবসায়ী সম্পর্ক নষ্ট করতে চান?
‘করবেন।সমস্যা কোথায়?
জাহিদ সাহেব জানেন উনার সামনে বসা ছেলেটাও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন একজন বিজনেসম্যান।তাকে জেনেশুনে প্রশ্নটা করা অযাচিত।তবুও কৌতুহল বসত করলেন।যার সদুত্তর যেমনটা আশা করেছিলেন ঠিক তেমনটাই পেলেন।তবে নিভানের উত্তরে মনের ভিতর আরও একটা প্রশ্ন হানা দিলো উনার।
‘উনার প্রস্তাব নাকচ করার কারণ মান্যতার উপযুক্ত পাত্র শুধু তৃনয়কে বলে মনে করো,কেনো জানি এটা আমার মনে হয়না।কারণতো একটা আছে!আমাকে কি বলা যায়, উনার প্রস্তাব নাকচ করার তৃনয় বাদে-ও দ্বিতীয় কারণটা কি?
‘উনার ছেলে এই বিয়েতে রাজি নন।উনি শুধু বিজনেস আর উনার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ঠিক রাখতে ছেলের উপর উনার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন।ছেলের পছন্দ অন্য কাওকে।সেখানে আমি জেনেশুনে আমার বোনকে বলি দেই কিকরে!দ্বিতীয়ত আমি চাই-না,আমার বোন শুধু আরাম-আয়েশে থাকার জন্য ওরকম ধরাবাঁধা সম্পর্কে বাঁধা পড়ুক।আমি চাই আমার বোন আরাম-আয়েশ বাদেও সুখে-শান্তিতে থাকুক।চৌধুরীবাড়ির মতো খুব আরাম-আয়েশ না দিতে পাারলেও আমার বোনকে তৃনয় অনন্ত সুখে-শান্তিতে রাখবে।এটা আমার বিশ্বাস।আমি মনে করে তৃনয়ের প্রতি আমার বিশ্বাসে আপনিও বিশ্বাসী?
জাহিদ সাহেব মুখে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে নিভানের কথায় সায় জানালেন।বিনিময়ে নিভানও মৃদু হাসলো।ততক্ষণাত কিছু একটা ভেবে জাহিদ সাহেব ফের
বললেন–আচ্ছা ওসব বাদ দাও।সেই যখন সিদ্ধান্তঃ নেওয়া হয়ে গেছে চৌধুরী সাহেবের ভাবনা বাদ দেওয়াই ভালো।
কথাটা বলে তিনি একটু চুপ হলেন।যেটা তিনি বলতে চেয়েছিলেন, ছেলেকে সেটা কিভাবে বলবেন ভিতরে ভিতরে আড়ষ্ট কাজ করলো উনার।
‘কিছু বলবেন।
বলছিলাম,সেই যখন কক্সবাজার যাচ্ছো।মেয়েটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। একবারে ঘুরিয়ে নিয়ে এসো নাহয়।এরপর ওর কোচিং শুরু হবে।সামনে এডমিশন পরিক্ষা।রেজাল্টের পরে আবার ভর্তির কার্যক্রম আছে।এটাওটাতেই কেটে যাবে সময়। তাড়াতাড়ি তো আর সময় হবেনা।এখন যখন সুযোগ আছে,এই সুযোগে ওকেও নাহয় তোমার সাথে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসলে।
জাহিদ সাহেব যে হানিমুনের কথাটা ঘুরতে যাবার নাম দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছেন,সেটা বেশ বুঝলো নিভান।বাবার এমন প্রস্তাবে ভিতরে ভিতরে নিজেও একটু আড়ষ্টতায় ডুবলো।তবে বাহিরে নিজেকে সহজ রেখে মন জাহিদ সাহেবের প্রস্তাব মানতে চাইলেও মুখে বললো –ও আমার সাথে গিয়ে কি করবে।ওখানে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হবে।ওরদিকটা খেয়াল রাখার সময় হবেনা।বরং পরিক্ষার পরে নাহয় দেখা যাবে।
‘যে দুদিন অফিশিয়াল কাজে যাচ্ছো।সেই দুদিন নাহয় ব্যস্ত থাকলে।তারপর আর-ও এক্সট্রা দুদিন নিয়ে না-হয় ঘুরেফিরে আসলে।
বিষয়টা নিয়ে জাহিদ সাহেবের সাথে বাকবিতন্ডায় যেতে চাইলোনা নিভান।মুরুব্বি মানুষটার সাথে এটা নিয়ে আলোচনা করা কেমন একটা অস্বস্তির বিষয়।তাই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো–আচ্ছা দেখছি কি করা যায়।
‘কি করা যায় কি!দুই ভাই আমার দুই বউমাকে নিয়ে ঘুরে এসো।ওদের ভালো লাগবে।নিজেদের ভালো লাগা মন্দ লাগা বাদ দিয়ে মাঝেমধ্যে ওদের ভালো লাগা মন্দ লাগাটাও একটু চিন্তাভাবনা করতে হয়।করা ভালো।তাতে সংসার জীবন সুখে শান্তির হয়।যদিও তুমি বুঝদার ছেলে।তোমাকে এগুলো বলে বোঝাতে হবেনা।তবে তোমার ভাইকে বোঝানো একটু দরকার।তিনিতো থাকেন তাহার মতিগতি নিয়ে।
‘ইভান যথেষ্ঠ বুঝদার ছেলে।যেখানে ও নিজের জীবন নিয়ে যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে তা আমার কাছে অযথা বলে মনে হয় না।আর যদি কখনো অযথা প্রমানিত হয়।আমরা তো আছি।
হাসলেন জাহিদ সাহেব।নিভানের সামনে ইভানকে নিয়ে কথা বলা অনর্থক।তার কোনো কাজে মন্দ খুঁজে পায়না যে ছেলে,সেই ছেলের সামনে তার নিন্দা করে লাভ আছে!যদিও নিভান ঠিক।কেননা,ইভানকে ছায়ার মতো আগলে রাখলেও ইভানের অন্যায়গুলো কখনো নিভান প্রশ্রয় দেয়না।
‘আসছি।আপনি বিশ্রাম নিন।
নীহারিকা বেগম তখনই রুমে ঢুকলেন।হাতে উনার জাহিদ সাহেবের সকালের খাবার ট্রে।নিভান বেডটেবিলের পাশে দাঁড়িয়েছিলো,মা’কে খাবার নিয়ে আসতে দেখেই সরে দাঁড়ালো। নীহারিকা বেগম বললেন– এখনো কথাবার্তা শেষ হয়নি।এবার তো না খেয়েই অফিসে দৌড়াবি।তোদের নিয়ে আর পারা যায়না।কথা শেষ এবার ডাইনিংয়ে যা।খেয়ে নে।
নিভান সম্মতি জানিয়ে চলে যাচ্ছিলো।জাহিদ সাহেব তাকে আবারও ডাকলেন–নিভান।দাঁড়াও।
নিভান পুনরায় দাঁড়িয়ে পড়লো।জাহিদ সাহেব এবার নীহারিকা বেগমে উদ্দেশ্য করে বললেন–নীহারিকা সেই ফাইলটা কোথায় রেখেছিলে।নিয়ে এসো।
‘কোন ফাইলটা?
প্রশ্ন করেই যেনো উনার হুশ ফিরলো।দ্রুত পায়ে গিয়ে আলমারি খুলে ফাইলটা এনে জাহিদ সাহেবের কাছে দিলো।জাহিদ সাহেব সেটা নিভানের দিকে এগিয়ে দিতেই কপালে সুক্ষ ভাজ পড়লো নিভানের।ফাইলটা খুবই পরিচিত তার।একদিন নিজেই এটা বহন করে এনে জাহিদ সাহেবের হাতে হস্তান্তর করেছিলো সে।
‘এটা এখন আর আমার দায়িত্ব নয়।এর দায়িত্বের মালিক এখন তুমি।তাই এই আমানত তোমার কাছেই রেখে দাও।
ফাইলটা হাতে নিলো নিভান।কৌড়ির বাবার উইল করে যাওয়া নিজের সম্পত্তির কিছু কাগজপত্র, ব্যাংক একাউন্ট কাগজপত্র এবং চেইক।সাথে কৌড়ির বিষয় কাগজপত্র ও সার্টিফিকেট নিয়ে এই ফাইল।নিভান ফাইলটা খুললো।কৌড়ির স্কুল কলেজের এবং বার্থ সাটিফিকেট এই ধরনে কাগজপত্রগুলো বের করে নিয়ে পুনরায় ফাইলটা জাহিদ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলো সে।বললো–আমার দায়িত্ব আমি নিয়ে নিয়েছি।এবং তা যথাযথ পালন করার চেষ্টা করবো।বাকী কাগজপত্র গুলো আমার দায়িত্ব নয়,আপনি রাখুন।আর আপনি না রাখতে পারলে,কৌড়ির দাদিআপার কাছে ফাইলটা দিয়ে দিয়েন।এগুলো আমার প্রয়োজন নেই।
‘আমার মনেহয় ঘুরেফিরে ফাইলটা তোমার দায়িত্ব আসবে।আমি তোমাদের বিয়ের দিন রাতে কৌড়ির দাদািআপাকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম উনি নেননি।
‘আপনি আমাকে জানেন এবং চিনেন।এই দায়িত্ব আমি কখনোই নেবোনা।আমার স্ত্রীর সকল ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা আল্লাহর রহমতে আমার আছে।সুতরাং সেই সক্ষমতা থাকা বা না থাকা সত্ত্বেও এগুলো আমার প্রয়োজন নেই।আপনার কাছেই রেখে দিন।পরে বুঝিয়ে উনাকে ফাইলটা নাহয় দিয়ে দিবেন।
নিভান আর দাঁড়াতে চাইলোনা।বললো–অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে। আপনি খেয়ে নিন।আমি আসছি।
নিভান আর দাঁড়ালো না।চলে এলো।সেদিকে তাকিয়ে রইলেন জাহিদ সাহেব।লোভ, হিংসা,অহংকার এই মন্দ জিনিসগুলো সহজে সংবরণ করা যায়না।যদি মানুষ নিজে সংবরণ না করতে চায়।তার উৎকৃষ্ট ভালোমন্দ উদহারন দুটোই উনার বাড়িতে ছিলো।একদল সেই নিকৃষ্ট রূপটা দেখিয়ে চলে গেছে।আরেকজন উত্তম রূপটা দেখিয়ে নিজের শখ স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে রয়ে গেছে। এজন্য ছেলেটাকে তিনি এতো ভালোবাসেন।হ্যা নিজের রক্তের চেয়েও তিনি খুব বেশি ভালোবাসেন।
★
সকালের সময়টা তাড়াহুড়ো লেগে যায় সবার।আর তার চেয়েও তাড়াহুড়োয় থাকতে হয় বাড়ির গিন্নীদের।
কারণটা বাড়ির ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজ ভিন্ন সময়ে সঙ্গে পুরুষদের অফিসও।খাবার রেডি করা থেকে ছেলেমেয়েদের সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠিয়ে,গুছিয়ে খাবার খাইয়ে স্কুল কলেজে পাঠানো,যেনো একটা যুদ্ধ জয়।আপতত যুদ্ধ জয় করে ছেলেমেয়ো সব স্কুল কলেজে চলে গিয়েছে।বাড়িটা এখন ফাঁকা।শাহেদ সাহেবও কেবল খেয়ে উঠে চলে গেলেন।আপতত রেডি হয়ে অফিস বের হবেন।তাই স্বান্তনা রহমানকেও ছুটতে হলো স্বামীর পিছে পিছে।ডাইনিংয়ে কেবল খাবার খেতে বসলো ইভান।টেবিল পরিস্কার।পানির জগ গ্লাস আর ফ্রুটসের ঝুড়িটা ছাড়া আপতত বিলাশ বড় টেবিলটা ফাঁকা। ফ্রুটসের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল তুলে নিলো ইভান।তাতে একটা কামড় বসিয়ে আশেপাশে নজর দিলো।তবে কিচেনে রানীসাহাবাকে ছাড়া আর কাওকে নিচে দেখতে পেলোনা।তার বউটা কোথায়?রুমেও তো দেখলো না।তবে?
‘রানীসাহেবা আমার জন্য সকালের বিল কি মওকুফ হয়ে গেছে?টেবিলে দেখছি কিচ্ছু নেই।ব্যাপার স্যাপার কি?
এবাড়িতে সবার শেষে ঘুম থেকে উঠে ইভান।এজন্য খাবারটাও তার সবার শেষে হয়।তা নিয়ে মায়ের কতো কথা।সেরকমই একটা কথা সে বলে দিলো।সেটা শুনে রানী হেসে বললো–খাবার থাকবেনা কেনো!অবশ্যই খাবার আছে।সবার প্রায় খাওয়া শেষ তো, তাই টেবিল পরিস্কার করে নিলাম।একটু বসো।আমি দিচ্ছি।
‘তুমি একহাতে আর কতো কাজ করবে।তোমার ছোটো বউমা কোথায়?বাড়িতে দু’দুটো বউ এনে লাভ কি হলো।সেই যদি সবদিকে খেয়াল তোমাকেই রাখতে হয়।
ইভান যেমন মজার ছলে কথাগুলো বললো।তেমন সিরিয়াস হয়ে উত্তর দিলো রানী–‘বউমাদের দোষ খুজবেনা একদম।বউমা-রা আমার খুব ভালো।বড় বউমাকে নিভান বাবা ডেকেছে তাই গেছে।আর ছোটো বউমা-তো এখানেই ছিলো।টেবিলের সবকিছুতো সেই গুছিয়ে রেখে গেলো।
‘রানী সাহেবা,তোমাদের মনে হয়না তোমাদের নিভান বাবা একটু বেশি বউ পাগল?
ইভান যে মজা করছে এটা বুঝে চওড়া হাসলো রানী।বললো–তা বউ পাগল হলে দোষ কোথায়?বউ পাগল হওয়া ভালো।সে তো শুধু বউপাগল তা তো নয়।সে তো মা পাগল,ভাই পাগল,বোন পাগল,পর বলতেও পাগল।সম্পর্ক বলতে সে পাগল।
রানী কিচেন থেকে খাবার এনে ইভানের সম্মুখে টেবিলে রাখতে রাখতে কথাগুলো বললো।সেটা শুনেে ইভান বললো–তা অবশ্যই।তবে আমার আবিস্কার বলছে, ভবিষ্যতে তোমাদের নিভান বাবা সব সম্পর্কের থেকে একটু বেশিই বউপাগল হবে।আমি কিন্তু তোমাদের নিভান বাবার মতো অতশত বউ পাগল নই।আমি ভাই খাঁটি মাটির মানুষ।ওসব পাগল টাগল নই।
‘সে আমি জানি,তুমি কেমন খাঁটি মাটির মানুষ।বউ পাগল নও বলে তার বিয়েটা ভেস্তে দিয়ে নিজেই বিয়েটা করে নিয়েছো।তিনি আবার বউ পাগল নয়!
এই রানীসাহেবা,’তুমি এই সিক্রেট জানলে কিকরে?
আশেপাশে একপলক তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো ইভান।তেমন ফিসফিসেয়ে উত্তর দিল রানী।বললো — তোমাকে বলবো কেনো!এখন বলো বউপাগল আমাদের নিভান বাবা নাকি তুমি?
‘অবশ্যই তোমাদের নিভান বাবা।
রানী হাসলো।ফিরতে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিভান চেয়ার টেনেন বসতে বসতে বললো—‘আমাাকে নিয়ে আবার কি হলো?
কন্ঠ পেয়ে ইভান নড়েচড়ে বসলো।রানীও একটু সরে দাঁড়ালো।নিভান বসেই বললো–কি হলো?
‘রানীসাহেবা বলছিলো,তুমি নাকি মা পাগল ছেলে, ভাই-বোন পাগল ভাই,এবং বউ পাগল বর।তাই আর কি!আমিও রানীসাহেবার কথায় সম্মতি জানাচ্ছিলাম।
নিভান কেমন শান্ত নজরে ইভানের অপ্রস্তুত হাস্যজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।পিছনে না তাকিয়ে বুঝতে পারলো,রানীসাহেবা কেমন অসহায় মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ইভানের মুখের এই উল্টো পাল্টা কথাগুলো যে সম্পূর্ণ রানীসাহেবার মুখের নয়,সেটা অজানা নয় তার।তাই রানিকে সহজ করতে বললো–রানীসাহেবা আমাকে এককাপ কফি দিন তো।
রানী দ্রুত কিচেনে চলে গেলো।ইভান বললো–তুমি এখনো বাড়িতে?ব্যাপার কি?
ইভানের মুখের দুষ্ট হাসি বলে দিচ্ছে, সে এখন অতি ফাজলামো মুডে আছে।নিভান বললো-প্রয়োজন ছিলো তাই।
‘তারমানে আমার আবিস্কার ঠিক।সত্যি তুমি বউপাগল হয়ে যাচ্ছো।এটা রানি সাহেবা মনেমনে মানলে-ও মুখে মানতে চাইছে-না।তোমার বিষয়ে সবার ধারণা একঘেয়েমী,একটু এদিক ওদিক হলেও কেউ মানতে চায়না।তেমনটা আমারও,আমি সত্যি বললেও সবাই ভাবে আমি ফাজলামো করছি।
সত্যিটা মুখ দিয়ে বের হয়ে যাওয়ায় অপ্রস্তুত হাসলো ইভান।নিভান গুরুত্ব দিলোনা।সে জানতো কথাগুলো ইভানের।তাই বললো–তো এগুলো বাচ্চামো,ফাজলামো ছাড়া কি!যাই হোক আমার তোর সাথে কথা আছে।
নিভানের কথা কানেই তুললো না ইভান।কন্ঠে দুষ্টমীর সুর তুলে বললো–তাহলে আমি গিয়ে ফুলকৌড়িকে বলি তার বর তাকে একটুও ভালোবাসে না।
‘ইভান!
ইভান গাল ভরে হেসে দিলো।খাবারের জন্য শব্দ করতে পারলো না।নিভান বিরক্ত হলো।যা বলতে এসেছিলো, সেটা বলতে শুরু করলো।–আমি কাল কক্সবাজার যাচ্ছি।
‘হানিমুনে!
গলার স্বরে আর ঠোঁটের মিটিমিটি হাসিতে স্পষ্ট মজা।নিভানের মনেহলো ইভানের আজকের শিকারী সে।তাই ইভানকে কাটিয়ে উঠতে বললো–ইভান,আমার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে।ফাজলামোটা অন্তত এখন রাখ।
‘আচ্ছা বলো।
‘অফিশিয়াল কাজে যেতে হচ্ছে। বাবা বললেন যাচ্ছি যখন তোদের তিনজনকেও নিতে।কৌড়ি,তন্ময়ী আর তুই।বিষয়টা তিনি ভুল বলেননি।তন্ময়ীকে নিয়ে কোথাও তোর ঘুরে আসা উচিত ছিলো।সেটা হয়নি যখন, প্রস্তুতি নিয়ে রাখ।সকালেই আমরা বের হবো।
‘আমি যেতে চাইনা ভাইয়া।
তন্ময়ী কথাটা বলতেই নিভান ইভান দুজনেই তাকলো।মেয়েটা মূহুর্তেই অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো।ইভান এমনিতেই না বলতো।সামনে তার বিবিএস পরিক্ষা।বিগত দিনগুলোতে একটার পর একটা ঝামেলার কারণে পড়াশোনার গতি একদম লো।সামনে যে দিনগুলো আছে, পড়াশোনাটা ঠিকঠাক করতে চায়।প্রিপ্রারেশন প্রপার নিতে চায়। নাহলে স্বপ্ন তার স্বপ্নই থেকে যাবে।তবে ইদানীং তন্ময়ীর আচারণ তার ঠিকঠাক লাগছে-না।মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে।আচারণ কথাবার্তা তার অদ্ভুত। যা তাকে বলছেনা।এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি?বারবার শুধিয়েও তো উত্তর মিলছেনা।এখন ঘুরতে যাওয়ার বিষয়টা নিয়ে উত্তরেও কেমন তড়িঘড়ি করলো।কেমন অস্বাভাবিক। অথচ মেয়েদের ঘুরতে যাওয়ার কথা বললেই দুকদম আগে চলে তারা।সেখানে তন্ময়ীও আলাদা নয়।তবে কি হলো মেয়েটার।নিভান শুধালো।
‘কেনো?
তন্ময়ী কি বাহানা দেবে খুঁজে পেলোনা।হঠাৎ করে মনে পড়লো ইভান যে বিসিএস পরীক্ষার প্রিপ্রারেশন নিচ্ছে বাহানা সরূপ সেটাও মন্দ হয়না।সামনে তারও ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষা। তাই বললো–আসলে সামনে আমার ইয়ার ফাইনাল এক্সাম। ওরও বিসিএস প্রিপ্রারেশন। আমরা নাহয় পরে যাবো।আপনি কৌড়িকে নিয়ে ঘুরে আসুন।
নিভান কেমন রয়েসয়ে বললো–
‘কয়েকদিনের জন্য।আমার মনেহয় খুব একটা সমস্যা হতো না।
তন্ময়ী ততক্ষণাত উত্তর দিতে পারলোনা।মুখে মুখে উত্তর দেওয়া তার স্বভাব নয়।আর যাকে সে সম্মান শ্রদ্ধার নজরে দেখে,তার কথা টলানো,ফেলানো কেমন মন খারাপ করে দেয় তাকে।তবে উপায় নেই।ইভান খাওয়া বাদ দিয়ে এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিলো মেয়েটাকে।এবার তন্ময়ীর হয়ে সে বললো–দাদাভাই ওর শরীরটা ভালো না।তাই যেতে চাইছে না। তুমি বরং বউমনিকে নিয়ে ঘুরে এসো।
মেয়েটার শরীর ভালো না!ওবাড়িতে বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়লো।কাল রাস্তায় আসতে গিয়েও বমি করলো।হয়তো সে কারণেই বলছে।তাই বিশেষ কথা বাড়ালোনা আর নিভান।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।মুখে ইভানকে বললো– অ্যাজ ইয়োর,স উইশ।
ততক্ষণে রানী কফি আনলো।নিভান কোনোমতে সেটা খেয়ে বের হলো।সকালের খাবারটা সে আগেই খেয়ে নিয়েছে।ইভান আর খাবারে মনোযোগ দিতে পারল না। মাথা ঘুরিয়ে কিচেনের দিকে তাকিয়ে রইলো।তন্ময়ী রানীসাহেবার সাথে কথা বলছে।হঠাৎ ভাবনা মাথায় পোকা হয়ে নড়তে লাগলো-মেয়েটার হোলোটা কি?তার কেনো মনে হচ্ছে তন্ময়ী তার কাছ থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছে!কিন্তু কি?
★
কৌড়ির কাল থেকে মন খারাপ।অথচ কাওকে বুঝতে দেয়নি সে। কাল ওবাড়ি থেকে ফেরার পথে কানন নেমে গিয়ে ভার্সিটিতে চলে গিয়েছে।বাড়িতে ফিরতেই দুপুরের পরে বিথী আর দাদীআপাকে নিয়ে ছোটোকাকুও চলে গিয়েছেন।দাদীআপাকে যেতে দিতে চাইনি কৌড়ি।তবে দাদীআপার যুক্তির কাছ হার মেনে যেতে দিতে বাধ্য হয়েছে সে।উনাকে আঁটকে রাখার যুক্তিতর্কে তিনি যখন বললেন–‘তুই যেমন আমার বংশের রক্ত। ওও তেমন।ওর মন্দ খবরে কি কইরা আমি এখানে বইসা থাকি বল!তবে তুই বিশ্বাস না করিস,ও আর আগের সেই নাহিদ আর নাইরে আপা।আগে ওরজন্য মন আমার না কাদলেও এখন কাঁদে।
তখন আর কৌড়ির বিবেক কিছুতেই উনাকে আটকে রাখার যুক্তিতর্কে যেতে চায়নি।নাহিদের জন্য দাদিআপাকে আগে এতো ছটফট করতে কখনো দেখেনি কৌড়ি।অথচ এবার তার খারাপ সংবাদ শুনে ছটফট করেছেন তিনি।
ভাবনার একপর্যায়ে ফোনটা হাতে নিলো কৌড়ি।সারাদিনে একবার দাদিআপার সাথে একবার অন্তত কথা বলার অভ্যাস। অথচ কালকে চলে যাওয়ার পর, অভিমানে কথা বলা হয়নি কৌড়ির।উনারা বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছেন এই খবরটা ছোটো কাকুই দিয়েছেন। কৌড়ি কাল সারাদিন অভিমান পুষে রাখলেও আজ সারাদিন ছটফট করেছে কথা বলার জন্য।অথচ বারবার হাতে ফোনটা নিয়েও কল দেওয়া হয়নি তার।ফোন দিলো কৌড়ি।একবার কল হয়ে কেটে গেলো।পুনরায় ফোন দিলো কৌড়ি।এবার কলটা রিসিভ হলো।অথচ দাদীআপা নয়।ধরলো অন্যকেউ।তার নমনীয় কন্ঠ শুনতেই চোখমুখ কঠিন হয়ে গেলো তার।কেনো জানি এই লোকটার ব্যাপারে সে কখনো নমনীয় হতে পারে-না।
‘কেমন আছিস ফুল?
ফোনে কেটে দিতে ইচ্ছে করলো।তবে কাটলোনা কৌড়ি।কেমন শক্তগলায় উত্তর দিলো–আপনি ঠিকই জানেন আমি কেমন আছি।
‘আলহামদুলিল্লাহ।আমি দোয়া করি তুমি সবসময় ভালো থাক।
আমার মনেহয় আপনার দোয়া ছাড়াও আমি খুব ভালো থাকবো,কথাটা ঠোঁটের আগায় এনেও নিজেকে সংযম করে নিলো কৌড়ি।কেনো জানি বললো না।বললো–
-দাদিআপাকে ফোনটা দিন।
‘উনি আম্মার সাথে খাচ্ছেন।ফোনটা আমার এখানে ফেলে রেখে গিয়েছিলো।কলটা রিসিভ করতে চাইনি, তবে দ্বিতীয়বার কলের লোভটা সামলাতেও পারি-নি।
ধপ করে ফোনটা কেটে দিলো কৌড়ি।মূহুর্তেই রাগে ক্ষোভে চোখ দিয়ে জল গড়ালো তার।তারজন্য কেউ খারাপ থাকুক এটা সে চায়নি কখনো।নাহিদের খারাপ থাকার দ্বায়ও তার নয়।অথচ কেউ আঙুল তুলে দ্বায়ী না করলেও দ্বায়ী যেনো সে।এমনটা বুঝাচ্ছে।দাদীআপা কাল থেকে এখানো অব্দি একটা ফোন দিলো-না।সে অভিমান করেছে যেনেও একবার কল দিয়ে কথা বলতে চাইলো-না।তিনিও কি নিভৃতে বুঝাতে চাইছেন, তার নাতীর খারাপ থাকার দ্বায় কৌড়ির?তবে কি ওবাড়িতে তারজন্য আপন বলতে আর কেউ রইলোনা। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকালো কৌড়ি।সে কাঁদবে না।কারজন্য কাদবে?কিজন্য কাঁদবে? সে নামক ঝামেলা ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলেছে ওবাড়ির মানুষগুলো এটাই তো অনেক! নিজের মনের অযাচিত আবোলতাবোল ভাবনায় এবার কেঁদেই ফেললো কৌড়ি।কান্নার শব্দ যেনো ঠোঁট ভেঙে না বের হয়,তারজন্য দাঁত দিয়ে এবার ঠোঁট এমন জোরে কামড়ে রাখলো।নিচের নরম ঠোঁটটা কেটে যেতে বাধ্য হলো।লবনাক্ত তরল পদার্থ টের পেয়েও অনড় থাকলো নিজের কাজে।একসময় রাগে ক্ষোভে ফোনটা বেডে ছুঁড়ে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে।দরজা চাপিয়ে কাঁদলো কিছুক্ষণ।একটা সময় মাইগ্রেনের ব্যাথাটা শুরু হয়ে গেলো।চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বাহিরে বের হয়ে বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লো সে।নরম বালিশে মাথা পড়তেই অশ্রুরা যেনো আপনমনে গড়িয়ে পড়তে থাকলো।সেদিকে বিশেষ খেয়ালধ্যান দিলো-না কৌড়ি।চোখ বন্ধ করেই পড়ে রইলো।
★
আজকেও বাড়িতে এসে বউকে ঘুমে পেলো নিভান।তবে নিজের রুমে দেখে স্বস্তি পেলো।দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে রুমে ঢুকে অফিসিয়াল ব্যাগটা সোফার সামনে টেবিলে রাখলো সে।সাথে ব্লেজারটাও।টাইটা নাটটা ঢিলে করতে করতে কৌড়িরপানে চেয়ে রইলো সে।আজ মেয়েটার চুলগুলো ছাড়া।সেই লম্বা এলোমেলো চুলে মুখটা ঢেকে আছে।টাইয়ের নাটটা ঢিলে করে খুলে রেখে কৌড়ির কাছে এগোলো নিভান।মুখ গলায় জড়ানো এলোমেলো চুলগুলো মুলত সরিয়ে দেওয়ার জন্য। অথচ পাশে বসে চুলগুলো সরাতেই আশ্চর্য হলো সে।চোখের কোণে পানি জমে আছে মেয়েটার।সাদা মৃসন ফর্সা গালটা লালচে আভায় ছড়িয়ে।কেনো?কি হয়েছে মেয়েটার?
কৌড়িকে ডাকতে গিয়েও ডাকলো-না নিভান।বরং মাথাটা ঠিকঠাক করে বালিশে শোয়াতে গিয়ে দেখলো শুষ্ক হয়ে থাকা লাল ঠোঁট জোড়ার নিচের অংশটার মধ্যবর্তী জায়গাটা কিছু অংশ কেটে আছে।আশ্চর্য!
সন্ধ্যার পরেও তো কথা হলো মেয়েটার সাথে।কন্ঠতো ঠিকঠাকই ছিলো।কাল কক্সবাজার যাচ্ছে সেটাতো সকালে জানালো।বিকালে ফোন করেও বললো, সবকিছু গোছগাছ করে নিতে।সন্ধ্যার পরও কথা হোলো।তবে হোলোটা কি?এই অবস্থা কেনো মেয়েটার?এবার আর না ডেকে পারলোনা নিভান।
‘কৌড়ি?
মেয়েটার ঘুম গাঢ় জানতো নিভান।তবে তিনবার ডাক দিতেই চোখ মেলে তাকালো কৌড়ি।নিভানকে খুব কাছে দেখতেই সজাগ হলো ব্রেইন।মূহুর্তেই কি হোলো তার।এগিয়ে এসে নিভানকে জড়িয়ে ধরলো।উপুড় হয়ে থাকা নিভানও খেই হারিয়ে বেডে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।আগলে নিলো মেয়েটাকে।অনুভব করতে পারলো মেয়েটা কাঁদছে।
‘কি হয়েছে? মন খারাপ কেনো?
নিভানের পিঠের শার্ট খামচে কৌড়ি আরও শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো তাকে।বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে দিয়ে মাথা নাড়িয়ে জানালো তার কিচ্ছু হয়নি।অথচ তার কর্মকান্ড বলছে হয়েছে অনেককিছু।নিভান দু’হাতে তাকে বুকে জড়িয়ে রেখে মাথায় দীর্ঘ চুমু খেয়ে বললো।
‘আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবেনা।তবে এ কেমন পাগলামি কৌড়ি।নিজেকে কেউ এভাবে কষ্ট দেয়!আমার কৌড়িতো বুঝদার।এরকম অবুঝপনাতো তাকে মানায় না! আমি তার কাছে আশা করিনি যেকোনো কারণেই হোক নিজেকে এভাবে সে কষ্ট দেবে!তবে কেনো এই পাগলামী?
নিভানের নম্র আহ্লাদিত কন্ঠের অভিযোগের বানীতে কৌড়ির কান্না যেনো এবার বাঁধ ভেঙে এলো।ফুপিয়ে উঠলো সে।সেই ফোঁপানোর স্বরেই বললো-‘আমার জন্য কারোর খারাপ কিছু হোক,কেউ খারাপ থাকুক। এটা আমি কখনো চাইনি। চাইনা কখনো।সে খারাপ ছিলো তাই ভাগ্য তাকে খারাপ রাখছে।তবে কেনো তার দ্বায় আমার হবে?কেনো দাদীআপা সেটা বুঝবেন না!অথচ যারজন্য আমার জীবন এলোমেলো হলো,আমার থেকে দাদিআপার কাছে সেই আপন হয়ে গেলো!আমার কথা না ভেবে তার কাছেই ছুলে চলে গেলেন!তারতো সবাই আছে?আমার কে আছে,এটা বুঝতে চাইলেন না?আর চলে গেলেন তো ভালো কথা,তাই বলে আমাকে ভুলে গেলেন। একবার খোঁজ নিলেন না?আমি আগে না-হয় বোঝা ছিলাম তাই বলে অন্যের হাতে তুলে না দিতেই পর করে দিলেন আমাকে?আমার সব সম্পর্ক, সবকিছু বিনষ্ট করে দিয়েছে ওই লোকটা।তবুও সে ভালো।আর তার খারাপ থাকার দ্বায় আমার!কেনো?কেনো আমার এরকম অলক্ষুণে জীবন হোলো।কেনো আপন মানুষ গুলো স্থায়ী থাকেনা আমার জীবনে?
‘কৌড়ি!এসব কি কথাবার্তা?রিলাক্স!কিচ্ছু হয়নি।উহুম আর একটা শব্দও নয়।
নিভান চাইছিলো যে কারণে মন খারাপ মেয়েটার,মন থেকে তা বের দিক।তাই চুপচাপ কৌড়ির অভিযোগনামা শুনে যাচ্ছিলো।তাই আবোলতাবোল বলে যাবে মেয়েটা?আশ্চর্য!কৌড়িকে নিজের থেকে আলগা করতে চাইলো নিভান।কৌড়ি হতে চাইলোনা।তাই নিভানও আর জোর করলোনা।মেয়েটা চুপ হয়ে গিয়েছে। তবে ফুঁপানো এখনো বন্ধ হয়নি।সেই ফুঁপানো আওয়াজে এবার শেষ অভিযোগ জানালো–কেউ আমাকে ভালোবাসে না।কেউ না।
‘আমিও না?
কৌড়ি উত্তর দিলোনা।নিভান যতোটা আহ্লাদিত গলায় প্রশ্নটা শুধালো তারচেয়ে আহ্লাদিত গলায়
বললো–সবাইকে কেনো ভালোবাসতে হবে তোমাকে!
আমি ভালোবাসি তোমাকে।আমৃত্যুকাল আমি ভালোবাসবো তোমাকে।
কৌড়ি এবার মুখ তুলে চাইলো।এই মানুষটা তাকে ভালোবাসে এটা সে জানে।যা মুখে কখনো স্বীকার করিনি ।যদিও সেই স্বীকারোক্তিতো তার যায় আসেনা। তবুও আজ কথার ছলে হলেও সেই স্বীকারোক্তি যেনো কৌড়ির মনটাকে শীতল করে দিলো।কৌড়িকে মুখ তুলে চাইতে দেখে নিভানও তাকলো ওরদিকে।সুন্দর মুখটাকে কেঁদেকেটে বিবর্ণ করে ফেলেছে মেয়েটা।নিভান হাত বাড়িয়ে ঠোঁটের কাটা জায়গাটা ছুলো।চোখ বুঁজে নিলো কৌড়ি।শক্ত আঙুলের ঘনো আলতো স্পর্শে শিহরণ বয়ে গেলো সর্বাঙ্গে।খাচমে রাখা পিঠের শার্টের অংশ আরও শক্ত হাতে খামচে ধরলো সে।নিভান টের পেলো তবে প্রতিক্রিয়া দেখালোনা।কেমন শীতল গলায় বললো–
‘কাকে ব্যাথা দিয়েছো জানো?যাই হোক ব্যাথা যখন দিয়ে ফেলেছো আর জানতে হবে-না।তবে দ্বিতীয় কোনো দিন যেনো তোমাকে এই অবস্থায় আর না দেখতে হয় আমাকে।,কখনো না দেখতে হয়।সেদিন কিন্তু আমি প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হবো কৌড়ি।প্রচুর বকবো তোমাকে।
কথাগুলো বলতে বলতে নিভানের ওষ্ঠ ছুঁয়ে গেলো স্ত্রীর রাগের স্বীকার হওয়া তারই ওষ্টজোড়ায়।একটু আগে যতোটা ব্যাথায় জর্জরিত করা হলো সেই রক্তিম ওষ্ঠদ্বয়কে,নিভান তারচেয়ে পরম আহ্লাদে আদরে ছুঁয়ে দিলো সেখানে।একটা সময় গিয়ে সেই ছোঁয়া আর নিতে পারলোনা কৌড়ি।আচমকা সরে গিয়ে নিভানকে পুনরায় জড়িয়ে ধরলো।নিভানও তাকে আগলে নিলো বুকে।কৌড়ির মাথার ভাজে গাল ছুঁয়ে মোহনীয় কন্ঠে বললো–আমার ভালোবাসা যথেষ্ঠ নয় তোমার জন্য?
‘যথেষ্ঠ।তবে মায়ের ভালোবাসাও চাই আমার।যা জন্মের পর থেকে দাদীআপা আমাকে দিয়ে এসেছেন।স্বামিত্ব আর মাতৃত্বের ভালোবাসা এক নয়।সেই দুজনের আলাদা আলাদা অনুভূতির ভালোবাসা,যত্নগুলো একজনের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব কি?বলুন না?
নিভান এবার মৃদু হাসলো।আসলেই তো তাই।সে-ও তো একটা সময় কৌড়ির জায়গাটা ফেস করে এসেছে। প্রিয়জন হারানো মানুষগুলো,প্রিয়জন হারিয়ে যাওয়ার পর অনুভব করে আসলে তারা কি হারিয়েছে।সেইসব মানুষের ভালোবাসা আদর যত্নগুলো আসলে কি অন্য মানুষ দ্বারা পূর্ণ হয়?নিভানের তো মনেহয়, হয় না।বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর,জাহিদ সাহেবের মতো মানুষ পেয়েও বাবার ভালোবাসা যত্নগুলো ভুলতে পেরেছে সে?মামাদের থেকেও তো কম আদর ভালোবাসা পায়নি নিভান।তবে উনারা কি কখনো নিতে পেরেছেন বাবার সেই নির্দিষ্ট জায়গাটা?পারিনি।পারেনা কেউ।ঈশিতা নিশিতাও মায়ের মতো ভালোবাসা দিয়ে পারিনি মায়ের জায়গাটা নিতে।বিনিময়ে কষ্টে থাকা বেছে নিয়েছিলো নিভান।তবুও মায়ের সংস্পর্শ ছাড়েনি।কেউ পারেনা কারও জায়গাটা নিতে।সকল সম্পর্কের ভালোবাসা আদর যত্নের জায়গাগুলো আলাদা আলাদা হয়।সেই জায়গা থেকে আলাদা আলাদা অনুভূতির ভালোবাসা,যা একজন নির্দিষ্ট ব্যাক্তির ভালোবাসা দ্বারা সম্ভব নয়।সম্ভব হলেও পূরণ হয়না সেই ভালোবাসা। হওয়ার নয়।আর প্রিয়জন হারা মানুষগুলো সেইসব মানুষের ভালোবাসা পেতেই মুলত কাঙাল।
চলবে…..
#ফুলকৌড়ি
(৫৯)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
সুন্দর হাস্যজ্বল একটা দিন।ঝলমলে দুপুর।বিস্তৃত নীল আকাশ।সেই নীল আকাশপানে সচ্চ কাঁচের ন্যায় টুকরো টুকরো সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে।নীল সাদার মিশ্রণে আকাশটা যেনো অদ্ভুত সুন্দরে পরিনত হয়েছে।একদল নাম না জানা পাখির ডানা ঝাপটিয়ে এদিক ওদিক পানে ছুটে চলাকে সেই নীল সাদা আকাশের সৌন্দর্যতা যেনো অপরূপ কোনো রূপকথা!
একটু আগেই কৌড়ি আর নিভান এসে পৌঁছেছে কক্সবাজার। লাক্সারিয়াস ফাইভস্টার একটা হোটেলের আটতলায় উঠেছে তারা।আভিজাত্যের পূর্ণ ছোঁয়া লেগে আছে পুরো হোটেলসহ আটতলা ভবনের এই সুবিশাল রুমটায়।কৌড়ির ক্ষনিকের জন্য মনে হলো,নিভানের বেডরুমটা এখানে তুলে আনা হয়েছে।যদিও আসবাবপত্র সেই রুমের তুলনামূলক এই রুমটায় কম।চারপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে হোটেলরুমের বিশাল বড় কাচের জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো কৌড়ি।সমুদ্রের খুব কাছে হোটেলটা।চারপাশটা তার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে ভরপুর!আভিজাত্যের ছোঁয়ায় পরিপূর্ণ রূপ দিতে কি নেই!আর যে উদ্দেশ্য হোটেলটা গড়ে উঠা,সেই সমুদ্রের উচ্ছল ঢেউ!তর্জন গর্জনের শব্দ!উফফ আল্লাহর অপার নিখাঁদ নিখুঁত সৌন্দর্যতার বিবরণ যেনো দেখতে পাচ্ছে কৌড়ি।জীবনের এই প্রথম কাছ থেকে সমুদ্র দেখছে সে।অদ্ভুত ভালো লাগা আর প্রশান্তি কাজ করছে হৃদয়গহ্বরে।যা বর্ননাহীন।নিটোল চোখে কৌড়ি অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের মোহে তাকিয়ে রইলো বিস্তৃত সমুদ্রেরপানে।
‘কি এখনো মন খারাপ?
হঠাৎ দৃঢ় পুরুষালী হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো সে।বলিষ্ঠ ঠান্ডা হাত দুটো তাকে পিছন থেকে আঁকড়ে ধরেছে।সদ্য গোসল সেরে আসা ঠান্ডা হাত দুটো তার নরম হাতের উপর দিয়ে কোমর জড়িয়ে তাকে সেই মানুষটার সাথে বাহুবন্ধনীতে বেঁধে নিয়েছে।নিজস্ব ম্যান পারফিউমের সুঘ্রাণটা ছাড়িয়ে সদ্য নেওয়া বডিওয়াশের গন্ধটা মূহুর্তেই কৌড়ির নিউরনে নিউরনে পৌঁছে গেলো।স্পর্শে হোক বা ঘ্রাণে।চোখ বুঁজে এলো কৌড়ির।নিভান কি জিজ্ঞেস করেছে ভুলেই বসেছে সে।
নিভানের ভেজা চুলের ফোঁটা ফোঁটা পানি তখনও ঝরে চলেছে।যা কৌড়ির গলায় বর্ষন হচ্ছে।সেই বর্ষণ গড়িয়ে ভিজে যাচ্ছে তার বক্ষপট।কৌড়ি আরও আবেশিত হলো।মিশে গেলো জড়িয়ে রাখা পুরুষটার উন্মুক্ত চওড়া বুকের সাথে।পেলব শরীরটা আপোষ মেনে পায়রার মতো পোষ মানতেই হাসলো নিভান।মাথা নিচু করে নরম স্পর্শে তার গালে নিজের গালটা ছোয়ালো।খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শে খিঁচে এলো কৌড়ি।তা পরোয়া করলোনা নিভান।গাল সরিয়ে এবার ওষ্ঠ ছোঁয়ালো সেখানে।ঘনো স্পর্শের অত্যাচার চললো নরম তুলতুলে গালটাতে কিছুক্ষণ।তারমধ্য কেমন মোহনীয় গলায় নিভান ফের জিজ্ঞেস করলো।
‘কি হলো?বলো?মন খারাপ এখনো?
অনুভূতিতে ভরাডুবি কৌড়ি।জবাবে মাথা
নাড়ালো শুরু।বলতে পারলোনা কিছু।নিভান মানলো না।বললো–মুখে বলো।কথা বলো।
অনুভূতির দোলাচলে চাপা পড়া কৌড়ি এবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো।চোখ খুললো।মূহুর্তেই উন্মোচন হলো হোটেল এরিয়ার চারপাশের অপার সৌন্দর্যতা।তারসাথে বিস্তৃত সমুদ্রের তেজস্বী ঢেউ। সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে নিভানের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো সে।সম্পূর্ণ পারলোনা।তখনো পেছনের মানুষটা তাকে শক্তপোক্ত করে জড়িয়ে।তবে কৌড়িকে ঘাড় ঘুরাতে দেখে সে-ও তারদিকে তাকালো। ঠোঁটে মৃদু হাসি টানলো কৌড়ি।যা চিকন ওষ্ঠদ্বয়ের সৌন্দর্যতা বাড়ালো।নিভান মুগ্ধ হয়ে সেই ওষ্ঠ পানে তাকিয়ে রইলো।কৌড়ির খুশি ঝলমলে চোখদুটো সেই মুগ্ধ চোখে গিয়ে স্থবির হলো।তারপর মৃদু মুগ্ধ স্বরে বললো।
‘কেউ আমার সাথে সাথে আমার ভালোমন্দের দায়িত্বটাও নিয়ে নিয়েছে।সে আমার মন খারাপ থাকতে দেয় কোথায়!তবে বলুন আমার কি মন খারাপ থাকতে পারে!নাকি সে মন খারাপ করে থাকতে দেবে আমাকে?
নিভান হাসলো।ফের তড়িৎ কৌড়কে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো।আচমকা বউয়ের ওষ্ঠদ্বয়ে নিজের ওষ্ঠদ্বয় নিবেদিত করলো।সেকেন্ডে সেকেন্ডে সময় চললো তবে নিবেদিত ওষ্টদ্বয় থামলোনা।একটা সময় উন্মুক্ত পিঠে বউয়ের নখের ডোবা আঁচড়ে তার হুঁশ ফিরলো। ছেড়ে দিলো কৌড়িকে।নিঃশ্বাস আঁটকে আসা কৌড়ি যেনো বেঁচে ফিরলো।নিভানের উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে শ্বাস নিতে ব্যস্ত হলো সে।তা দেখে নিভান মৃদু শব্দ করে হাসলো।সেই মৃদু শব্দে কৌড়ির লজ্জারা হুড়মুড় করে হানা দিলো।ইচ্ছে করলো,লোকটার পিঠে দুই একটা কিল-চড় বসাতে।কিন্তু তা কি কখনো হওয়ার!তবে মনোবাসনা পূর্ণ করতে উন্মুক্ত পিঠে খামচি বসাতে ভুললোনা সে।বউয়ের এরকম মৃদুমন্দ আঁচড়ে যদিও নিভানের কোনো ব্যাপার স্যাপার মনেহয়না।বরং তাতে আরও বউয়ের প্রতি ভালোবাসার সীমাটা বাড়ায়।
তবুও কৌড়ির সাথে মজা করতে বললো।
‘ছেড়ে দিয়েছি তারপরও ব্যথা দিচ্ছো?তবে কিন্তু আমিও ছেড়ে দেবোনা।ব্যথার পরিবর্তে দ্বিগুণ ব্যথা কার্যক্রম চলবে কিন্তু!সুতারাং রাজী থাকলে তুমি যেরূপ ইচ্ছে ব্যথা দিতে পারো আমাকে!আমি কিছু মনে করবো না।
লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে কৌড়ি এবার আরও জোরে খামচি দিলো।খামচি অনুভব করেই কৌড়িকে এবার নিজের সাথে আরও জোরে চেপে নিলো নিভান।শব্দ করে হাসলোও।সময়টা যেনো অদ্ভুত সুন্দর মনে হোলো তার।থমকে দিতে পারলে হয়তো ভালোই হতো।যদিও প্রভু তাকে থমকে দেওয়ার মতো ক্ষমতা প্রদান করলে অবশ্যই সে এই সময়টা থমকে দিতো।দু’হাতের বন্ধুনীতে জড়ানো নারীটাকে আর চারপাশের সুন্দর পরিবেশের মুগ্ধতা কিছুক্ষন অনুভব করলো নিভান।ফের একটু সময় নিয়ে বললো–জার্নি করে এসেছো।ফ্রেশ হয়ে নাও, ভালো লাগবে।
জার্নিটা আর হয়েছে কোথায়!ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ফ্লাইটে এসেছে তারা।আর সেখান থেকে প্রাইভেট গাড়ীতে।তবুও নিভান এসেই গোসল সেরে নিয়েছে।মানুষটা কেমন একটু শুচিবায়ু টাইপের।সবসময় ফিটফাট।নিয়ম মেনে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা থাকা চাই।
এটুকু কৌড়ি এই কয়দিনে বেশ বুঝে গেছে।
★
কৌড়ি গোসল সেরে বের হতেই দেখলো নিভান রেডি হয়ে বসে আছে।ফোনে মনোযোগ।কৌড়ি জানে,তারা শুধু এখানে মধুচন্দ্রিমায় অথবা ঘুরতে আসিনি।নিভান এখানে অফিসিয়াল কাজে-ও এসেছে।আপতত দুদিন সে অফিসিয়াল কাজে ব্যস্ত থাকবে,এটা-ও তার জানা।তার উপস্থিতিতে নিভান তারদিকে তাকাতেই চোখ সরিয়ে চুল মোছায় ব্যস্ত হলো সে।লম্বা চুলের এই এক দশা।ভিজালেই মুছতে, শুকাতে সমস্যা।যদিও ওয়াশরুমে হেয়ারড্রাইয়ার ছিলো।তবে এবাড়িতে আসার আগে সে কখনো ওটা ব্যবহার করেনি।বিধায় ওটা ব্যবহারে তার দ্বিধা,সংকোচ আছে।যদিও ওটার ব্যবহার সে জানে।তবুও কেনো জানি ভালো লাগে-না।
‘চুল দিয়ে তো পানি পড়ছে!পিছনের জামার অংশতো ভিজে যাচ্ছে!এতোচুল টাওয়ালে শুকানো তো মুশকিল।হেয়ারড্রাইয়ারটা ইউজড করতে!
‘এমনিতেই শুকিয়ে যাবে।
কৌড়ি নিজের কাজে ব্যস্ত রইলো।নিভান সেটা দেখে উঠে দাড়ালো।হেয়ার ড্রাইয়ারটা এনে,কৌড়িকে দাঁড় করালো নিজের সামনে।কৌড়ির হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে রেখে দিয়ে,বউয়ের চুল শুকাতে ব্যস্ত হলো।কৌড়ি মুখ উঁচিয়ে কেমন নিস্পাপ চোখে তা দেখতে থাকলো। সেটা দেখে নিভান মিষ্টি হাসলো।ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো-কি হয়েছে?কৌড়ি উত্তর দিলোনা।নিভান নিজ থেকে যেনো বউয়ের চেয়ে থাকার মানে বুঝে উত্তরটা দিয়ে দিলো।
‘সকালে সেভাবে খেলে-না।এখন তো এই চুলের কারণে দুপুর পার করে তোমাকে রাতে গিয়ে খেতে হবে দেখছি!আর বউতো আমার খুবই লক্মী,নিজ থেকে নিজের ভালোমন্দ বা ক্ষুধার কথাতো জানাবেই-না।
কৌড়ি,নিভানের অন্য কথায় মনোযোগ দিলো-না।চুল প্রসঙ্গে বললো-‘চুল কিছুটা কেটে ফেলা উচিত?তাইনা? দাদিআপাকে কতো বলেছি,অথচ তিনি কখনোই চুল একছটা কাঁটার পক্ষপাতিত্ব ছিলেন না।
‘আমিও পক্ষপাতিত্ব নই!চুল শুকাতে সমস্যা হলে আমি আছিতো!সঙ্গে এই হেয়ারড্রাইয়ার।
বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে কথাটা বলতে বলতে হাতের হেয়ারড্রাইয়ারটাও দেখালো নিভান।কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই মনেহলো সদ্য গোসল করে আসা বউটাকে একটু অন্যরকম লাবন্যময় দেখাচ্ছে।চুল শুকানো বাদ দিয়ে হুটকরে কোমড় জড়িয়ে ধরে কৌড়িকে কাছে টানলো সে।আচমকা কাছে টানায় কৌড়িও মুখ উঁচু করে তাকালো।সদ্য গোসল নেওয়া স্নিগ্ধ মায়াময় মুখটা মুগ্ধ নজরে দেখলো কিছুক্ষণ নিভান।ফের কৌড়ির চোখে চোখ রেখে মোহনীয় কন্ঠে বললো —
-চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ছেড়ে যে নাবিক হয়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি আমি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, এতোদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নিভানের বনলতা।
কবিতার লাইন শেষ হতেই চমৎকার হাসলো নিভান।কৌড়ির নাকে আলতো করে নিজের নাকটা ঘষা দিয়ে কেমন ঘনোস্বরে ফের বললো–আমার বনলতা!
নরম আদুরে স্পর্শ পেয়েও আজ আর কৌড়ি চোখ বুজলো-না।বরং নিভান নাকে স্পর্শ করে সরে যেতেই মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখতে থাকলো।এই মানুষটা তাকে এতো সুন্দরভাবে উপলব্ধি করে।মানুষটার নরম নরম আদূরে ভালোবাসাময় স্পর্শ,কৌড়ির প্রতি শখের বস্তুর মতো আহ্লাদী আচারণ।যা কৌড়িকে মুগ্ধ করে। মানুষটার প্রতি টান ভালোবাসা সম্মান বাড়ায়।হঠাৎই কৌড়ির চোখ ভরে উঠলো।অশ্রুদের আটকাতে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরতেই নিভান তার ঠোঁটের নিচে দাঁড়ি চেপে ধরে আঁটকে দিলো।অসন্তুষ্ট গলায় বললো–একদম না।কাল ব্যথা দিয়েছো কিচ্ছু বলিনি।আজ কিন্তু ছাড়া পাবে-না মিসেস নিভান।
সর্তক বানীতে কৌড়ি ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে মিষ্টি হাসলো।অথচ চোখে তার থৈথৈ ভরপুর জল।সেই জল লুকাতে সামনের মানুষটার বুকে আশ্রয় নিলো।অনুভব করলো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসাময় নিরাপদ স্থান।যেখানে নিরাপত্তার সাথে সাথে কৌড়ির সুখ শান্তি সব আছে।নিভান আগলে নিলো বউকে।চুমু খেলো মাথায়। সময় নিয়ে বললো–কারণে অকারণে এভাবেই নিজের জায়গাটা করে নেবে।দুঃখ হোক বা সুখবিলাসে, নিভানের এই চওড়া বুক নামক স্থানটা তোমার জন্য সদাসর্বদা উন্মুক্ত।শুরু তোমার জন্য।
আবেগপ্রবণ হলো কৌড়ি।আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো নিভানকে।সদাসর্বদা মানুষটা তাকে ভালো রাখার প্রচেষ্টায় লেগে থাকে।কালও তো,আবেগপ্রবণ হয়ে দাদীআপার জন্য একটু কাদলো কি!কতো ভালোমন্দ কথা বলে বুঝ জ্ঞান দিলো,সাথে আহ্লাদ দিলো ভালোবাসা যত্ন দিলো।আর তারচেয়ে না চাইতে যেটা দিলো,সেটা কৌড়ির কাছ পরম পাওয়া হয়ে রইলো।কালরাতে যখন কৌড়ি কান্নাকাটি সেরে চুপ হলো।সেখান থেকে কিছুক্ষণ বাদেই দাদিআপা তাকে ফোন দিলো।কৌড়ির অভিমানী মনটা ফোন ধরতে নারাজ ছিলো।তবুও আরেকমন তো দাদীআপার সঙ্গে কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলো।সেটা হয়তো তার পাশে থাকা দায়িত্ববান মানুষটা বুঝে গিয়েছিলো। তাই তার সেই ব্যাকুল মনটাকে ইন্ধন দিয়ে ফোনটা ধরিয়ে কানে ধরলো।সঙ্গে তাকে বুকে জড়িয়ে দাদীআপার সঙ্গে কথা বলতে মানলো।কৌড়ি ফোন ধরলো।তারপর অভিমানে অভিযোগে দাদিআপার সঙ্গে কথা বলতেই বুঝতে পারলো,এদিক থেকে কেউ একজন তার মনখারাপের কথা জানিয়েছে।সঙ্গে দাদীআপাকে নিয়ে অভিমান অভিযোগও।বিধায় দাদীআপাও আদর আহ্লাদ দিয়ে নিজের সমস্যার কথা জানিয়ে তাকে মানানোর চেষ্টা করলেন।একজন ভালোবাসার মানুষ তাকে পরম আদরে বুকে চেপে রাখলো,আরোকজন ভালোবাসার মানুষ তাকে আদর দিয়ে নরম সুরে কতোকিছু বলে মাননানোর প্রচেষ্টা করতে লাগলো।কৌড়ি অভিমান অভিযোগেরা কি আর অটল থাকতে পারে?পারলেও,কৌড়ি দু’জন মানুষের আহ্লাদিত ভালোবাসায় তা আর পুষে রাখতে পারলো-না।মুলত রাখতে চাইলো না।
★
দুপুরের খাবারটা সেরে কৌড়ি এসে হোটেলের আরামদায়ক বিছানাটায় শরীরটা এলিয়ে দিল।জার্নির কঠিন প্রভাব শরীরে না পড়লেও,ঔষধের একটা ঘুম ঘুম প্রভাব তার উপর সেই ঔষধ খাওয়ার শুরু থেকেই কাজ করে চলেছে।যদিও প্রয়োজনের তুলনায় ঘুম তার একটু বেশি।গভীর।আর কাল রাতেও দেরীতে ঘুমিয়েছে।আবার সকাল সকাল উঠতে হয়েছে।জার্নিতেও ঘুম ঘুম ভাবটা লেগে ছিলো।যা পূর্ন হয়নি।এখন চোখ বুঁজে আসছে তার।নিভান বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে।অফিসিয়াল কথাবার্তা। কৌড়ি তাতে বিশেষ মন দিলোনা।চোখ বুঁজে নিলো সে।ঘুমঘুম ভাবটা চোখে লেপ্টে আসতেই কেউ মাথায় হাত রাখলো তার।মোটামোটা আঙুলের হাতটা কপাল আর মাথার অংশজুড়ে পড়তেই চোখ মেললো সে।খুব কাছে দেখতে পেলো নিভানকে।
-আমাকে বের হতে হবে ইমার্জেন্সি।যদিও আমি হোটেলের মধ্যেই থাকবো।তবুও তুমি কি একা থাকতে পারবে?
চোখে ঘুম।পলক পড়ছে ঘনোঘনো।তবুও কৌড়ি মাথা সামন্য ঝাকিয়ে বললো–হুমম।
নিভান মাথা নিচু করে কৌড়ির কপালে চুমু খেলো।মৃদু হেসে বললো–গুডগার্ল।
ফের বললো–দুটো দিন তোমাকে একটু কিছুসময় কষ্টকরে একা-একা থাকতে হবে তারপর সর্বক্ষণ আমি তোমার সঙ্গী হবো।কেমন?
কৌড়ি ফের মৃদু উপর নিচ মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি দিলো।সেটা দেখে নিভান পুনরায় জিজ্ঞেস করলো।–পারবে তো একা থাকতে?
চোখ ঘুম ডুবে এলো কৌড়ির।চোখ বুজেই মৃদু হাসলো সে।ঘুমঘুম চোখে ঘনো স্বরে বললো–আমি বাচ্চা নই।আপনি অযথা আমাকে নিয়ে…
কথা শেষ করতে দিলোনা নিভান।বুঁজে থাকা চোখ।মায়াবী একটা মুখ।আর মৃদু প্রসারিত হওয়া ওষ্ঠদ্বয়।তাকে বড়োই টানলো।নিভান আবারও মাথা নিচু করে কৌড়ির সেই সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া ফুলের মতো মেলে থাকা ওষ্ঠদ্বয়ে চুম্বন দিলো।কৌড়ির বুঁজে থাকা চোখ আরও খিঁচে এলো।সময় নিলোনা নিভান।আলতো স্পর্শে সরে এলো।তবে সরে এসে কৌড়ির বুঁজে থাকা চোখের খুব কাছে নিজের অবস্থান রেখে কেমন মোহনীয় স্বরে বললো– তুমি বাচ্চা নও,এটা আমি জানি।তবে মন আমার তোমাতে অন্যকিছু অনুভব করে।মন বলে তুমি আমার কাছে একটা আদূরে পুতুল।একটা অমূল্য যত্নের রত্ন।তুমি জানোনা,সেই আদূরে পুতুলটাতে আমি নিভান কি অনুভব করি।সেই মূল্যবান রত্নটা কিভাবে যত্নে ভালোবাসায় আগলে রাখতে ইচ্ছে করে আমার।নিভানের ভালোবাসা তুমি।তুমি জানানো কিভাবে নিজের কাছে তোমাকে রাখতে ইচ্ছে করে।
ঘুমে তলিয়ে আসা চোখজোড়া কিছুতেই পল্লব মেলতে চাইলোনা।তবুও নিভানের মোহনীয় স্বরের প্রেমময় বাক্যে কৌড়ি চোখ মেলে তাকালো।তবে ঘুমে ডুবো চোখজোড়া তার নিভু নিভু হয়ে রইলো।সেটা দেখে নিভান মিষ্টি হাসলো।কৌড়ির চুলের মধ্য আঙুল ডুবিয়ে বুলিয়ে দিয়ে মুখটা আরও একটু নিচু করে বললো–যাই হোক,তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
কৌড়ি সত্যিই চোখ বুঁজে নিলো।সেটা দেখলো নিভান।হঠাৎ কিছু একটা ভেবে কৌড়িকে ফের ডাকলো নিভান।তবে কৌড়ি এবার আর চোখ খুললো-না।মুলত ঘুমে নিভে আসা চোখটা সে মেলে তাকাতে পারলোনা।তবে ডাক শুনলো–হুমম।
বউয়ের আহ্লাদী আচারনে নিভানের ঠোঁট প্রসারিত হলো।ইচ্ছে করলোনা দুপুরবেলা বউটাকে এভাবে একা রুমে ফেলে যেতে।বরং ইচ্ছে করলো,মেয়েটাকে কাছে নিয়ে জড়িয়ে রাখতে।আদূরে স্পর্শে তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।তবে যেতে হবে তাকে।তাই কৌড়ি সাড়া দিতেই সে বললো–যদি একা রুমে থাকতে খারাপ লাগে অথবা ভয় হয়।তুমি ততক্ষণাত আমাকে কল করবে।আমি যতোই ব্যস্ত থাকিনা কেনো,চলে আসবো।তুমি আমাকে বিরক্ত করবেনা মনে করে কল দিতে কিছুতেই দ্বিধা করবেনা।কেমন?
‘আপনি ব্যস্ত হবেন না।আমি থাকতে পারবো।
কোনেমতে কৌড়ি বাক্যদ্বয় উচ্চারণ করতেই নিভান বলে উঠলো–তবুও।
‘হুমম।শব্দটা উচ্চারণ করেই কৌড়ি যেনো কেমন ঘুমে তলিয়ে গেলো।তার হঠাৎই গাঢ় শ্বাসপ্রশ্বাসটা বলছে,সে ঘুমিয়ে গিয়েছে।ঘুমটা গভীরে না গেলেই, ঘুমিয়ে তলিয়েছে সে।নিস্পাপ মুখটা দেখলো কিছুক্ষণ নিভান।তারপর তার ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিলো কৌড়ির সমগ্র মুখ।কপাল,চোখের পাতা,নাক,ঠোঁট, গাল,কোথাও বাদ থাকলো-না।বউকে একধাপ ভালোবাসা দিয়ে তারপর বাহিরে যাওয়ার জন্য নিজের কাজে ব্যস্ত হোলো সে।
★
‘হেই মিঃ নিভান।কেমন আছেন?
হোটেলের লবি এরিয়াতে আসতেই হঠাৎ কারও সম্বোধনে মুড়লো নিভান।যদিও কন্ঠস্বর তার পরিচিত।এবং সে যেনো জানতো বাবার ব্যবসায়ে উদাসীন ছেলেটা কক্সবাজারের এই বিজনেস কনফারেন্সে নিজে একজন বিজনেসম্যান হিসাবে অবশ্যই সামিল হবে।বিহানের এখানে আসার কারণটা হয়তো নিভানের জানা।তবুও খুব স্বাভাবিক হয়ে মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে তার সম্বোধনের সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উত্তর দিলো সে।
‘হ্যালো মিঃ বিহান।আই অলওয়েজ ট্রাই টু বি গুড।আপনার কি খবর?
‘থাকারই কথা।
কথাটা বিহান মিনমিনিয়ে বললেও নিভানের কান এড়ালোনা।তবে ভালোমন্দ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো-না সে। বিহান যেনো নিজেকে,সামনের মানুষটার মতো ধৈর্য্যশীল পরিচয় দিতে পারলোনা।নিভানের কেমন আছেন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কেমন যেনো ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন শুধালো–শুনলাম ওয়াইফকে নিয়ে এসেছেন!কনফারেন্সের সাথে সাথে মধুচন্দ্রিমায়-ও!নট ব্যাড!তা তিনি কৈ?
নিভানের ইচ্ছে করলো বিহানের নাকটা এক চটকান দিয়ে ফাটিয়ে দিতে।নেহাৎ ছেলেটা ভদ্রভাবে কথা বলছে বিধায় কাজটা করতে পারলো-না সে।একজন বিজনেস পার্টনার আরেকজন বিজনেস পার্টনাটকে সালিনতা বজায় রেখে ভদ্রভাবে প্রশ্ন করতেই পারে।যদি উদ্দেশ্য প্রবন না হতো তবে নিভান-ও উত্তর দিতে কার্পন্য করতোনা।তবে কার্পন্য অবশ্যই করতে হচ্ছে তাকে।মুখে ভদ্রতার হাসি বজায় রেখে কেমন অদ্ভুত গলায় বললো।
‘ আমাদের ব্যাক্তিগত খোঁজখবরও রাখছেন দেখছি?মন্দ নয়!বাট বিজনেস পার্টনার হয়ে এতো গভীরে খোঁজখবর রাখবেন, আশা রাখিনি।ধন্যবাদ।
স্পষ্ট উপহাস।বিহানকে ইতস্তত দেখালো।তবুও কেমন মিনমিনে স্বরে উত্তরে বললো সে–‘রাখতেই হয়।
উত্তরটা বিষবাক্য হয়ে কানে ধরা দিলো নিভানের।তবুও যতসম্ভব ধৈর্যশীলের পরিচয় দিয়ে নিজেকে শান্ত রেখে বললো-
‘অন্যের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে খোঁজখবর রেখে লাভ কি বলুন?আমার মনেহয় অন্যের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে হোক বা অন্যের লাইফলাইনের বিষয়ে খোঁজখবর রেখে লস্, আফসোস ছাড়া কোনো লাভ আছে!তারচেয়ে বরং বিয়ে করে নিজের একটা পার্সোনাল লাইফলাইন বানিয়ে ফেলুন।নিয়মিত সেই লাইফলাইনের স্পেশালি ভালোমন্দ খোজখবর রাখুন।তাকে দেখুন হালাল নজরে।আমার মনেহয় তাতে ভরপুর শান্তি। হালাল প্রজেক্টে বলে কথা! লাভ ছাড়া লসেস্ নেই।যদিও আমার মনেহয় আপনি আবেগপ্রবণ কাঁচা ব্যবসায়ী।বুদ্ধিমান পাকা ব্যবসায়ী হলে লস্ প্রজেক্টের পিছনে অন্ততঃ পড়ে থাকতেন বলে মনে হয় না।
বিহানের বিবর্ন হয়ে আসা মুখাবয়ব দেখে থেমে গেলো নিভান।থেমে গেলো না বরং থেমে গিয়ে কথার রহস্য রাখতে বেশ মজা পেলো।ঠোঁটের কৃত্রিম হাসিটা আরও একটু প্রসারিত করে ফের বললো-যাই হোক।কনফারেন্সে দেখা হচ্ছে।আসছি।
নিভানের,তাকে এড়িয়ে চলে যাওয়া দেখে বিহানের খুব করে গলাবাজি করে বলতে ইচ্ছে করলো—মেয়েটা যদি কৌড়ি হতো তবে হালাল কাজটা আপনি না বললেও খুব শীঘ্রি সেরে ফেলতাম আমি।তবে আপনি সিংহ হয়ে নিজের শিকারিকে পরিবেষ্টন করে রাখবেন।অন্যকে তা ছোঁয়াতো দূর নজরস্পর্শ করতে দেবেননা।এটা ভাবিনি।নাহলে,কৌড়িকে দেখে যেদিন মনে দূর্বলতা অনুভব হয়েছিলো,সব উপেক্ষা করে হলেও মেয়েটাকে নিজের করে নিতাম।যেভাবেই হোক নিতাম।
মনেমনে আত্নচিৎকার দিয়ে কথাগুলো বললেও তা ভুলেও মুখে উচ্চারণ করার দুঃসাহসিকতা দেখালো না।নিভান সম্পর্কে সে জানে।সঙ্গে তার বিজনেস পাওয়ার সম্পর্কেও।সৎ নিষ্ঠাবান বিজনেসম্যান ছেলেটা সম্পর্কের বেলায় আরও দায়িত্ব এবং আরও নিষ্ঠাবান।সেখানে সামন্য এদিকওদিক হলে কাওকে ছেড়ে কথা বলেনা।বিন্দুমাত্র ছাড় দিয়েও কথা বলেনা।যদিও বিহানের মানসিকতা সীমা ছাড়াতে চায়।তবে ছাড়িয়ে লাভ কি!আদৌও কি কৌড়িকে কখনো সে পাবে?নাকি পাওয়া সম্ভব?
★
ঘুম ভাঙলো কৌড়ির।অলস্য ভঙ্গিতে মৃদু চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলো,রুমের মধ্যে কৃত্রিম জিরো বাল্বের হলুদ সবুজ কম্বিনেশনের মৃদু আলোটা জ্বলছে।হঠাৎ ঘুম ভেঙে কোথায় আছে,বুঝতে সামন্য সময় নিলো।ফের বুঝে উঠতেই মনেহলো,সেই তো দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়েছিলো।আর সবে উঠলো।রুমে কৃত্রিম আলো জ্বলছে, তারমানে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে রাত গড়িয়েছে।তবে লাইট জ্বালালো কে?সহসা আশেপাশে তাকালো সে।রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় লম্বা একটা অবয়ব দেখতে পেলো।অবয়বটা দেখেই ধাতস্থ হলো সে।সময় নিয়ে উঠে বসলো।বেডের সোজাসুজি সামনের দেয়ালে ঘড়িটা তখন জানান দিলো রাত দশটা বাজে।এতোক্ষণ ঘুমিয়েছে সে।যদিও এরচেয়ে দীর্ঘ সময়ে ঘুমানোর নজির আছে তার।
গায়ের চাদরটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।ফের বারান্দার দিকে একপলক তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।সে ওয়াশরুমে ঢুকতেই বারান্দায় দাড়ানো মানুষটাও পিছে ফিরে একপলক দেখে পুনরায় হোটেল এরিয়ার রাতের ঝলমলে সৌন্দর্যে নজর রাখলো।মুলত নজরটা তার গভীর সমুদ্রের নোনাজলে।যা দুপুরের সময়ে উত্তাল থাকলেও এখন শান্ত, নীরব।উচ্ছাস,উত্তালহীন।রাতের নীরব সৌন্দর্যে পাড়হীন সেই সুবিশাল সমুদ্রের থৈথৈ পানি যেনো অপরূপ এক অন্যরকম সৌন্দর্য!অপরূপ সেই সৌন্দর্যের মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিয়েছে,হোটেল সম্মুখীন কতৃপক্ষের নিজস্ব বিচ এরিয়ার কফিবিচ নামে খ্যাত বে- লাউঞ্জ শপটা।দিনের বেলায় তার সৌন্দর্য কাঠের তৈরি ছনের একটা ঘরমাত্র হলে-ও, রাতের বেলায় তার সৌন্দর্য কোনো রুপকথার নগরীর থেকে কম নয়।সন্ধ্যার পর থেকে লাল নীল,বিভিন্ন লাইটিংয়ে তার সৌন্দর্য হয়ে উঠে নজর ধাঁধানো।আশেপাশে নৌকাশেইপ সহ বিভন্ন বসার স্থানগুলোও বেশ নজর আকর্ষণীয়।যেখানে বসে বিচে ঘুরতে আসা মানুষগুলো নীরব সময় কাটায়।বিকাল চারটের পর থেকে বে- লাউঞ্জ এরিয়াটা ওপেন করা হয়।সেখান থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত বে- লাউঞ্জ খোলা থাকে।সন্ধ্যার পর থেকে লাউঞ্জ এরিয়াটায় মানুষের মেলা বসতে শুরু করে।সমুদ্র উপভোগ করা,একান্তে সময় কাটানো,খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সব চলে এখানে।রাত একটু গভীর হতে শুরু হলেই,লাইভ গানের শো-ও চলে সেখানে।কেউ কেউ সরাসরি সেই গানের লাইনগুলো উপভোগ করলেও,কেউ কেউ আবার সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে গানের শব্দগুলো অনুভব করে।নিভানের কক্সবাজার এলেই এই হোটেলে থাকা হয়।ব্যবসায়ী সুত্রে এনাদের সাথে দৃঢ় একটা সম্পর্ক আছে কি না তার।
হঠাৎই পাশে কারও অস্তিত্ব টের পেতেই ভাবনা কাটলো নিভানের।ঘার ঘুরিয়ে পাশে ফিরলো।মিষ্টি হেসে বললো—ঘুম কাটলো তবে?আমার তো মনেহলো আজ রাতে আর ঘুম কাটবেনা তোমার!
‘মনেহচ্ছে কোনো ঔষধের প্রভাবে ঘুমটা একটু বেশিই হচ্ছে।
‘শুধু ঔষধের প্রভাব?
কৌড়ি হেসে দিলো।আসলেই যে শুধু ঔষধের প্রভাব তা তো নয়।বিষয়টা মানুষটা বুঝতে পেরেছে।পারারই কথা!একসপ্তাহ হতে চললো,থাকছে মানুষটার সঙ্গে ।তাও আবার মানুষটার খুব কাছে। নিঃশ্বাসের সাথে মিশে।হঠাৎই নিভানের দিকে তাকিয়ে কেমন উচ্ছসিত গলায় সে জানালো–জানেন, দাদিআপারও আমার ঘুম নিয়ে অভিযোগ ছিলো।এতো সময় কিকরে ঘুমিয়ে থাকতে পারি?সময় নেই অসময়ে কিকরে ঘুমিয়ে যাই?এতো ঘুম ভালো নয়?আরও কতশত অভিযোগ।
‘ আমার কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই।
হঠাৎই নিভান দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেললো। কৌড়ির কোমর পেচিয়ে কাছে টেনে নিলো তাকে।হঠাৎ আক্রমণে কৌড়ি চোখ বুজে নিলো।বলিষ্ঠ বুকে মিশে গেলো তার পিঠ।খামচে ধরলো কোমরে জড়িয়ে ধরা নিভানের হাত।সঙ্গে সঙ্গে সেই হাতজোড়া চলে গেলো শক্ত হাতের বাঁধনে।কোমরে শক্ত হাতের স্পর্শ দৃঢ় হতেই চোখ মেলে তাকানোর আর সাহস হলোনা তার।বরং মুখের কাছে নিভানের শ্বাসপ্রশ্বাসের ঘনত্ব টের পেতেই আর-ও শক্তপোক্ত ভাবে খিঁচে নিলো আঁখি। নিভান তা দেখলো।একটু আগে যখন মেয়েটা হাসলো।সদ্য ঘুম থেকে উঠা লুচির মতো ফোলাফোলা গালে কি মোহনীয় দেখালো সে হাসি!নিভান, কৌড়ির খিঁচে থাকা চোখমুখের দিকে তাকিয়ে কেমন ঘনোস্বরে বললো–
‘এইযে আমাকে ছাড়া দীর্ঘ সময় একাএকা ঘুমিয়ে পার করছো তবুও আমার অভিযোগ নেই কেনো জিজ্ঞেস করবে-না?
কখনো না।উত্তর লজ্জাজনক আসবে এটা কৌড়ি জানে।তাই ভুলেও নিভানের শুধানো বাক্যের প্রতিক্রিয়া দেখালো না।নিভানও অপেক্ষা করলোনা বউয়ের প্রতিক্রিয়ার।মেয়েটাকে কাছে পেলেই তার যে কি হয়!শুধু আদর ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করে।নিজের মাথা নিচু করে কৌড়ির গালে ঠোঁট ডুবালো।শিহরে উঠলো কৌড়ির সর্বাঙ্গ। নিভান সেটা অনুভব করেই আরও শক্ত বাঁধনে নিজের সাথে চেপে ধরলো তাকে।ফের কেমন নেশাময় স্বরে বললো–কারণটা হলো,আমার বউটা ঘুমিয়ে থাকলে তাকে ইচ্ছেমতো আদর ভালোবাসা যায়।মনমতো ভালোবাসতেও আমার খুব সুবিধা হয়।
নিঃশ্বাস আঁটকে এলো কৌড়ির।কি অসভ্য লোক!আশ্চর্য!এসব কথা কেউ মুখে বলে!উফফ!কৌড়ি যেন লজ্জায় হাসফাস করে উঠলো।শক্ত বাঁধনে নড়া দুঃসাধ্য হলো।তবে তার নরম গালে খোঁচাখোঁচা দাঁড়ির স্পর্শ অসহনীয় করে তুললো তাকে।উপায় হিসাবে অস্পষ্ট স্বরে নিভানকে ডাকলো সে।কাজে তো দিলো না।বরং স্পর্শের দৃঢ়তা আর ঘনো হলো।সত্যিই এবার কৌড়ির শ্বাস আঁটকে এলো।আর সেই শ্বাস আঁটকে আসা স্বরে কোনোমতে বললো।
‘নিভান প্লিজ।
নিভান হাসলো।মৃদু শব্দও হলো।তবও সে সরলোনা।বরং বললো-আমি সেই সন্ধ্যা থেকে তোমার ঘুম ভাঙার
অপেক্ষা করছি।
মানেটা কি!সে নিঃশ্বাস আঁটকে মরে যাওয়ার উপক্রম আর লোকটা হাসছে।আরও কিসব বলে চলেছে!হঠাৎ কৌড়ির মনেহলো হাতের বাঁধন ঢিলা হয়েছে।সঙ্গে সঙ্গে পিছনে মুড়ে নিভানকে জড়িয়ে ধরলো সে।শ্বাস নিলো ঘনোঘনো।তার সঙ্গে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলো।–আপনি খুব অসভ্য।
নিভান, বউয়ের অসহনীয় অবস্থা টের পেয়েই হাতের বাঁধন ইচ্ছেকৃত ঢিলা করেছে।বউয়ের থেকে অসভ্য আখ্যা পেতেই শব্দহীন হাসলো সে।মুখটা কৌড়ির কানের কাছে নিয়ে দুষ্টমিষ্টি গলায় বললো–এর চেয়েও অসভ্য হলে তখন কি আখ্যা দেবে কাশফিয়া আহসান কৌড়ি?
কৌড়ি মুখে কিছু বললোনা।শুধু জোরসে খামচে ধরলো নিভানের পিঠ।যা শার্ট ভেদ করে চামড়ায় আচড় কাটলো।আঘাত পেয়েও নিভানের দুষ্ট হাসি প্রসারিত হোলো।বিনিময়ে বউটাকে আরও শক্ত বাঁধনে বুকে চেপে নিলো নিভান।এরপর একটু একটু করে সময় কাটতে থাকলো।দুজনেই দুজনের অবস্থানে নীরব।উপভোগ করলো সময়টা।উপভোগ করলো,খোলা সমুদ্র থেকে তেড়ে আসা শীতল বাতাস।বে- লাউঞ্জ নয়,দূর কোথা থেকে দারুন কন্ঠে ভেসে আসা কিছু গানের বাক্য।
Dil main hoo tum,akho main tum.
Pahle najar,sae yaara.
Yaa isqaka sajas hain dua mila hum dubara.
★
রাতের আকাশটা মৃদুমন্দ মেঘাচ্ছন্ন।তবুও তারাদের আনাগোনা সেখানে স্পষ্ট।চাঁদটাও যেনো রূপোর গোল থালা হয়ে ধরা দিয়েছে আকাশে।সেই থালার মতো চাঁদটায় ক্ষনে ক্ষনে একেক দলা কালো মেঘ এসে ছুঁয়ে দিয়ে প্রকৃতিতে কিরণ দেওয়া থেকে আবাছা করে দিচ্ছে।আবার যখন মেঘের দলাগুলো সরে যাচ্ছে, রূপালি চাঁদটা ঝলমলে হয়ে ধরা দিচ্ছে।সমুদ্রের পাড়ে বে- লাউঞ্জ এরিয়ার দোলনায় বসেবসে চাঁদের এই রূপ পাল্টে যাওয়া দেখছে কৌড়ি।নিভান একটু দূরে ফোনে কথা বলছে।রাতে ডিনার সেরে কৌড়িকে নিয়ে বের হয়েছে নিভান।কৌড়ির ঘুম আসছিলো।বলতেই নিভান তাকে নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে চলে এসেছে।বে- লাউঞ্জে মানুষে ভরপুর।লাইভ গানের শোও চলছে সেখানে।তাই নিভান আর তাঁকে নিয়ে সেখানে যায়নি।এই নিরিবিলি জায়গাটা বেছে নিয়েছে।এখানে মানুষের আনাগোনা কম।কৌড়িরও জায়গাটা বিশেষ ভালো লেগেছে। যদিও লাউঞ্জের পাশাপাশি জায়গাটা।মৃদুমন্দ দোল খাওয়া দোলনাটায় হঠাৎ জোরে দোল পড়তেই পিছে ফিরলো কৌড়ি।তবে নিভানকে দেখে কিছু বললো-না। একবার দোল দিয়ে পুনরায় দোলনাটা ধরলো নিভান।বললো–চলো,হাঁটি।
কৌড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো।সঙ্গে সঙ্গে কৌড়ির চিকন আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুল গলিয়ে হাতটা ধরলো নিভান।বালুময় চরে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকলো দুজনে।মৃদুমন্দ কথাও চললো।তবে হোটেল থেকে বের হওয়া অব্দি নিভানের মনেহচ্ছে,কেউ তাদেরকে ফলো করছে।গাঢ় নজরে দেখছে।মানুষটা কে হতে পারে, নিভানের মনেহচ্ছে জানা।তবে বিশেষ পাত্তা দিলো-না নিভান।মনোযোগ দিলো পাশের নারীটিতে।বিস্তৃত সমুদ্র নীরব,পাশে থাকা নারীটি নীরব!আশেপাশে মানুষের মুখরিত পরিবেশ তবুও অতিরিক্ত হৈচৈ নেই।কেমন শান্ত শান্ত।সমুদ্রের দূরপ্রান্ত থেকে ভেসে মন জুড়ানো হিমেল বাতাস।চারপাশটা কেনন যেনো অদ্ভুত মনোরম পরিবেশ।কিছুসময় হাঁটতেই নিবান শুধালো।
‘পানিতে পা ভেজাবে?
‘ ভেজাবো?
‘তুমি চাইছো না?
কৌড়ি ততক্ষণাত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।অর্থাৎ সে পা ভেজাতে চায়।সেটা দেখে নিভান বললো–তবে জুতা খুলে ফেলো।
মূহুর্তেই পায়ের স্লিপারজোড়া খুলে ফেললো কৌড়ি।ততক্ষণে নিভান, নিজের জিন্স গুটিয়ে পায়ের জুতা খুলে হাতে নিয়েছে।কৌড়ি জুতা খুলতেই সেটাও হাতে নিলো।ততক্ষণাত কৌড়ি বলে উঠলো–আমি নিতে পারবো।আপনি কেনো আমার জুতা হাতে নিচ্ছেন। আমার কাছে দিন।আপনারটাও দিন।
‘আমিও পারবো।চলো।
কৌড়িকে দ্বিতীয়ত কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পুনরায় তার হাতটা ধরলো এবং দুকদম এগিয়ে সমুদ্রের নোনাজলে পা ডুবালো তারা।কৌড়ি চেয়েও আর কিছু বলতে পারলোনা।নিভান সেই সুযোগ দিলোইনা।পায়ের গোড়ালি সমান পানিতে পা ডুবিয়ে গন্তব্যহীন হেঁটে চললো তারা।কিছুদূর যেতেই হঠাৎ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামলো।বৃষ্টি গায়ে লাগতেই থেমে গেলো দু’জন।নিভান আকাশেরপানে চাইলো।রাতের আকাশের মেঘাচ্ছন্ন ঠিক পরিমাপ করা গেলো-না।ভাদ্রমাস!মেঘ পরিমাপ করার আগেই হঠাৎ করেই ঝুপঝাপ বৃষ্টি নামলো।নিভান খালি পায়ে কৌড়ির হাতটা ধরে দৌড় দিলো।কৌড়িকেও বাধ্য হয়ে দৌড়াতে হলো।দৌড়ালো আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেকেই।আবার কিছু মানুষ বৃষ্টিবিলাশে মুখরিত।
দৌড়ে এসে কফিবিচ খ্যাত বে- লাউঞ্জে ঢুকে পড়লো দুজনেই। ততক্ষণেই অর্ধভেজা হয়ে গেছে দু’জনে।মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে কৌড়ির দিকে লক্ষ্য করলো নিভান।কৌড়ির একটা ঢিলাঢালা থ্রিপিস পরা ছিলো।বৃষ্টিতে ভিজে তা গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে।যদিও গায়ে মাথায় সুন্দর করে ওড়না দেওয়া।তবুও গোলাপি রঙ হওয়ায়, ভিজে ওড়নার ওপাশের লম্বা বেনুনিটা সাদৃশ্য।
সঙ্গে নারী অবয়ব।ফর্সা মুখটা বৃষ্টির ছিটাফোঁটা পানিতে রূপার মতো জ্বলজ্বল করছে।লাউঞ্জ এরিয়ার রঙবেরঙের লাইটের আলোতে এনারী যেনো অন্যরকম অপরূপা।হঠাৎ আশেপাশে তাকালো নিভান।লাউঞ্জে তখন মানুষের সমাগমে ভরপুর।কৌড়িকে নিয়ে ওই অবস্থায় সেখানে থাকতে চাইলোনা নিভান।নারীটা তার একান্ত।ভেজা অবস্থায় তাকে দেখার অধিকার কারও নয়।অধিকার থাকলে শুধু তার।মুগ্ধ হওয়ার থাকলে শুধু সে মুগ্ধ হবে,অন্য কেউ নয়।অথচ অনেকের নজর কৌড়িকে ঘুরে-ফিরে।নিভান খপ করে কৌড়ির হাত ধরল।ততক্ষণে বৃষ্টির তোপ বেড়েছে।কৌড়ি প্রশ্নবোধক নজরে তাকাতেই নিভান বললো।
‘চলো।বৃষ্টি থামবে বলে মনেহয়না।হোটেলে গিয়ে নাহয় একেবারে চেঞ্জ করে নেবে।
খুব স্বাভাবিক গলা।অথচ কৌড়ির কাছে শব্দগুলো নয় গলাটা কেমন অস্বাভাবিক ঠিকলো।সেই আকাশ ভাঙা ঝুপঝাপ বৃষ্টির তোপে হোটেলে ফিরলো তারা।ততক্ষণে কাকভেজা দু’জনে।হোটেল রুমে ঢুকতেই আশেপাশে বিবেচনা না করে,গায়ের ভেজা ওড়ানাটা টেনে গা থেকে ছাড়িয়ে ফেললো কৌড়ি।অসময়ে ভেজা কাপড়গুলো গায়ে প্রচন্ড অস্বস্তি দিচ্ছে।রুমের অন্যত্র দাড়িয়ে থাকা নিভান তখন নিস্পলক চোখে বউয়ের পানে চেয়ে।আজ বৃষ্টিতে ভেজা কৌড়ি অন্যরকম আকর্ষিত করছে তাকে।কি সুন্দর দিনের পর দিন নিজের স্বামীনামক পুরুষ সত্ত্বাকে নিয়ন্ত্রিন করে যাওয়া নিভানকে অস্বাভাবিক করে তুলছে।এই নারীটিকে কাছে নিয়ে নিভানের বুকে চেপে ঘুমানো হয়।স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার তুলনায় তাকে হয়তো একটু কম ভালোবাসা হয়।তবে তার নারী সত্ত্বাকে প্রবলভাবে অনুভব করা হয়।যা নিভানকে নিয়ন্ত্রন হারাতে বাধ্য করে এবং নারীটাকে একান্তভাবে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে।তবুও মেয়েটার কথা ভেবে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে নিভান। তবে আজ তা কাজে দিচ্ছে কোথায়!
প্রচন্ড এলোমেলো মনেহচ্ছে নিজেকে।কৌড়িই বা তাকে স্বাভাবিকই বা থাকতে দিচ্ছে কোথায়!এরকম বোকামো কেউ করে!তার পুরুষ সত্ত্বাাটা যেনো আজ অন্য কথা বলছে।অন্য কিছু চাইছে।
হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজার শব্দে ঘোর কাটলো নিভানের।কৌড়ি ওয়াশরুমে ঢুকেছে।এতো সময়ের রুদ্ধ করে রাখা শ্বাস এবার হাসফাস করে উঠলো।চঞ্চল হয়ে উঠলো মন।ব্যাকুল হয়ে উঠলো পুরুষ সর্বাঙ্গ।উফফ!নিজেকে স্বাভাবিক করে নিতে চাইলো কিন্তু কিছুতেই পারলো-না নিভান।আশপাশে ফিরে লম্বা লম্বা শ্বাস ছাড়লো তবুও কাজ হলো বলে মনেহলোনা নিভানের।বড়বড় কদম ফেলে হোটেলের খোলা বারান্দায় চলে গেলো সে।প্রকৃতিতে তখন বর্ষনের ঘোর তুফান বইছে।বৃষ্টির ছটা এসে ভিজে দিচ্ছে বারান্দা।সেই বর্ষন মুখর বারান্দায় দাঁড়াতেই কাকভেজা নিভান এবার ভিজে একাকার হলো।রাতের প্রকৃতিতে তখন ধূসর রঙ ছড়িয়েছে।নিভান, নিজে আর প্রকৃতির মাঝে কোনো তফাৎ খুঁজে পেলোনা।সবই তো ঠিক ছিলো!হঠাৎ কেনো বারিধারা নেমে সবকিছু এলোমেলো করে দিলো!তুফান ছড়িয়ে দিলো মনমস্তিস্কে!
‘ভিজছেন কেনো?ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
বলিষ্ঠ দেহের সটান দাঁড়িয়ে থাকা নিভান আজ বউয়ের কন্ঠে যেনো মৃদু কেঁপে উঠলো।উফফ!কেনো এলো এখানে কৌড়ি!ঘুমিয়ে পড়তে পারতোনা!চোখ বুঁজে নিলো নিভান।আজ কি কৌড়িকে চাইলে, সে বারণ করবে?তাকে কি রোজকার তুলনায় আজ একটু বেশি ভালোবাসতে দেবে-না কৌড়ি?নিভানের ভাবনার মধ্যে কৌড়ি পাশে এসো দাঁড়ালো।সদ্য শুকনা শাড়ী পড়া মেয়েটা আবারও ভিজে যেতে থাকলো।তবুও পরোয়া করলোনা।তার কেনো জানি,তখন থেকে মনে হচ্ছে মানুষটা স্বাভাবিক নেই।কি একটা কারণে হঠাৎই অস্বাভাবিক আচারভ করছেন!কিন্তু কেনো?হঠাৎ কি হয়েছে?কৌড়ি কেমন মায়ামায়া গলায় শুধালো।
‘কি হয়েছে?এভাবে কেনো ভিজছেন?শরীর খারাপ করবে তো!
নিভান চোখ খুললো।সত্যকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারেনা।তার মতোন ছেলের এড়িয়ে যাওয়ার মানায় না।তেমন মানে-ও হয় না।মনেমনে কথাগুলো বললেও,পাশে দাঁড়ানো নারীটার দিকে তাকানোর সাহস হলো-না তার।তাকালেই আজ আর সে কিছুতেই এই নারী থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবেনা।তবুও নিভান যতোসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পাশে তাকালো।কৌড়িকে শাড়ী পরা দেখেই ভিতরের বৈরীভাবটা দ্বিগুণ চড়া দিয়ে উঠলো।তবে সদ্য শুকনো কাপড় জড়ানো মেয়েটা ভিজে যাচ্ছে দেখে কোনোরকম ঠোঁটে হাসি টেনে বলল-কি হবে।কিচ্ছু হয়নি তো।তুমি আবার এখানে আসতে গেলে কেনো?বৃষ্টিতে ভিজে যাবে তো!
ভিজে যাবে কি!ভিজে গেছে।নিভান কৌড়ির হাত ধরলো।কোমল হাতটা ছুতে কখনো দ্বিধা হয়নি নিভানের।আজ হলো।সঙ্গে মৃদু কম্পনও।কৌড়িকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বললো–আবার ভিজে গেছো তো।মুছে না-ও।
বলেই কেমন ওয়াশরুমে পালিয়ে যাওয়ার মতো চলে গেলো নিভান।কৌড়ির দিকে ঠিকঠাক ভাবে তাকালোও না।চরম আশ্চর্য হলো কৌড়ি।নিভানের কথাকাজের অস্বাভাবিকতা ঢেড় টের পেলো।তবে কারণটা কি বুঝতে পারলোনা।বেড বসলো কৌড়ি।শাড়ীর সামনের দিকে মুছতে মুছতে খেয়াল হলো।তখন তাড়াহুড়ায় ট্রলির প্রথমে যা পেয়েছে তাই নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেছে।ভেবেছিলো, রুমে এসে চেঞ্জ করে নেবে।কিন্তু রুমে এসে নিভানকে ওভাবে বারান্দায় বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,শাড়ী চেঞ্জ করার কথা আর খেয়ালেই ছিলোনা।চলে গিয়েছিলো বারান্দায়।এখন কি চেঞ্জ করবে?ধ্যাত।বারবার এই চেঞ্জের ঝামেলা ভালো লাগছে-না। ভেবে, কৌড়ি আর চেঞ্জ করলোনা।বরং নিভানের ভাবনায় বিভোর হলো।হঠাৎ মানুষটার হলোটা কি? সেটাই ভেবে পাচ্ছেনা।অনেকটা সময় পার হওয়ার পরও যখন নিভান বের হচ্ছেনা।কৌড়ি ডাকবে কি ডাকবে না।ভেবে না পেয়ে শুয়ে পড়লো।হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব লাগায় পায়েট কাছ থেকে চাদরটা জড়িয়ে চোখ বুঁজে নিলো,তবে ঘুমালো না।মুলত হঠাৎ নিভানের হোলোটা কি,কেনো এতো বিচলিত দেখাচ্ছে তাকে?সেই ভাবনায় বুদ হয়ে রইলো সে।
★
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নিভান দেখালো কৌড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে।নিষ্পলক চোখে মায়াবীর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।ফের নিজের কাজে ব্যস্ত হলো সে।প্রকৃতিতে তখনও বৈরীভাব চলছে।সঙ্গে তুমুল বর্ষন।ওয়াশরুম থেকে টওয়াল পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসা নিভান,ট্রাউজার আর টিশার্টে নিজেকে চেঞ্জ করে নিলো।মাথার চুলগুলো মুছতে মুছতে রুমের বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে,হালকা আলোর বাতিটা জ্বালিয়ে দিলো।ফের ল্যাপটপ নিয়ে বসলো,হোটেল রুমে বরাদ্দকৃত একসিটের সোফায়।সামনের কাচের টি-টেবিলটা টেনে নিয়ে পা সটান রাখলো সেখানে।ল্যাপটপটা কোলের মধ্যে রেখে ওপেন করে মন বসালো স্কিনে।অথচ মন কিছুতেই সেখানে বসতে চাইলো-না।মন যেতে চাইলো চাদর জড়িয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটার কাছে।গিয়ে তার শান্তির ঘুমটা ভেঙে দিয়ে তাকে ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখতে।নিভান,সোফার হেডে মাথা এলিয়ে দিলো।চোখ বুঁজে পড়ে রইলো সেভাবে কিছুক্ষণ।ফের মনমস্তিস্কের দন্ডে মনকে প্রশ্রয় দিয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে, সামনের টি-টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো সে।ওই মেয়েটাকে সামন্য উপেক্ষা করা তার সাধ্যি নয়।নয়ই।
বিছানায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসলো নিভান।প্রকৃতিতে তখনও মুশলধারায় বর্ষন চলছে।রুম আর বারান্দার সাথে লাগোয়া কাঁচের দরজটায় বৃষ্টির তোপে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে এসেছে।সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পাশে শুয়ে থাকা রমনীর পানে চাইলো নিভান।তার নিদ্রা হারাম করে দিয়ে শান্ত বাচ্চার মতো কি সুন্দর আরামে ঘুমাচ্ছে। নিষ্পলক চোখে সেই রমনীর পানে চেয়ে কিছুটা সময় আবারও ক্ষয় করলো।তারপর শব্দহীন ধীরেসুস্থে তারপাশে শুলো নিভান।কৌড়ির গায়ে জড়ানো অবশিষ্ট চাদরটা নিয়ে নিজের গায়ে জড়ানোর আগেই কৌড়ি এসে গুটিশুটি মেরে বুকের মধ্যে ঢুকে পড়লো।অশান্ত নিভান তা দেখে কিছুটা সময় নিশ্চুপ থেকে মেয়েটাকে আগলে নিলো দু’হাতে।দীর্ঘ একটা চুমু খেলো বউয়ের মাথায়।ভাবলো,ঘুমের ঘোরে হয়তো কাছে এসেছে।কিন্তু অবাক হলো।যখন কৌড়ি খুব স্বাভাবিক গলায় শুধালো—কি হয়েছে আপনার?
সেই প্রশ্নে যেনো বিমুঢ় চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ নিভান।উত্তর না দিয়ে,নিজেও প্রশ্ন শুধালো–তুমি ঘুমাও নি এখনো?
কৌড়ি মুখ উচু করে তাকালো।নিভান কেমন শান্ত চোখে চেয়ে আছে।সে চোখে চোখ রেখে তারপর কেমন মায়ামায়া গলায় শুধালো–বলুন না আমাকে আপনার কি হয়েছে?
অশান্ত নিভান,বউয়ের কাছে আসায়,মায়ামায়া স্বরের কথায় আরও ভিতরে ভিতরে আরও বিচলিত হয়ে উঠলো।হঠাৎই কৌড়িকে বুকের উপর থেকে সরিয়ে বালিশে শুইয়ে দিলো সে।কৌড়ির প্রশ্নবোধক চোখের পানে চেয়ে কেনন অদ্ভুত গলায় বললো–জানতে চাও আমার কি হয়েছে?
শান্ত হলেও কেমন অস্বাভাবিক চহুনি।যা অস্থির!আর তারচেয়েও অস্বাভাবিক অস্থির লাগলো নিভানের গলার স্বর।তার শুধানো প্রশ্ন।কৌড়ির মস্তিষ্ক যেনো তড়িৎ কাজ করলো। মূহুর্তেই বুঝে নিলো কিছু।তৎপর সমস্ত ইন্দ্রীয়ের বহমান রক্তকনিকা যেনো ছলকে উঠলো।লজ্জায় অসঢ় হয়ে এলো সর্বাঙ্গ।রুমের মৃদু আলোতে নিভানের ওই কেমন অস্বাভাবিক শান্ত চাহুনীতে নজর রাখা সম্ভব হলোনা আর তার।সহসা চোখ বুঁজে নিলো সে।নিভান বুঝে ফেললো,বুদ্ধিমান বউটা তার কথার ইঙ্গিতে বুঝে নিয়েছে সব।নিভানের কি হয়েছে,আর কি চাই?কৌড়ির বুঁজে নেওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে নিভান আরও নেশাময় হয়ে উঠলো।
ভারী অশান্ত হয়ে পড়লো ভিতরের অনুভূতিতে জর্জরিত বৈরী ভাবটা।মুখ নিচু করে বউয়ের কানের কাছে মুখ ডুবালো সে।ছটফটিয়ে উঠে বিছানার চাদর শক্তমুঠোয় খামচে নিলো কৌড়ি।নিভান তা বুঝে আরও উতলা হলো।আবেদনময়ী স্বরে ডাকলো।
‘কৌড়ি।
এ ডাক সর্বনাশা!এ ডাক যেনো কারও অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আহ্বান।কেমন নেশাময় স্বর!শক্ত শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে।কৌড়ি ডাকের উত্তর দেওয়ার অবস্থায় নেই।সারা শরীরে তার ভয়াবহ লজ্জার কম্পন।কি হতে চলেছে এখন?কি হতে চলেছে আজকের রাতটা?ভেবেই শিরশিরিয়ে উঠলো শরীর সঙ্গে ভিতরের মনটাও।নিভান-ও আশা করলো-না বউ তার ডাকের সাড়া দেবে। উত্তর দেবে।বরং বউকে একান্ত কাছে পাওয়ার উদ্দেশ্যে আবেদনময়ী গলার স্বর আরও ঘনো হয়ে এলো তার।সেই স্বরেই অভিযোগ আবদার দুটোই জানালো।
‘এখন কেনো ডাক শুনছো-না?জানতে চাওনা আমার কি হয়েছে?এই কৌড়ি,আজ কি তোমাকে একটু বেশি ভালোবাসালে খুব ক্ষতি?
কৌড়ি পাথর বনে রইলো।হৃদস্পন্দন তার ছটফট করছে।কখন নাজানি চামড়ার বুকটা ভেদ করে বেরিয়ে আসে।সমস্ত ইন্দ্রিয় কেমন অসহনীয় অনুভূতিতে চঞ্চল হয়ে আছে।নিভান আবদার জানালেও,থেমে নেই।বউকে ভালোবাসতে ব্যাকুল সে।স্পর্শের অসংলগ্নতা চললো বউয়ের গলামুখে।যেনো চম্বুকের আকার্ষনের মতো মেয়েটা টানছে।নিয়ে যেতে চাইছে সম্পর্কের অতল গভীরে।নারী শরীরের আলাদা সুগন্ধটা যেনো তাকে ভালোবাসার চরম পর্যায়ে ঠেলেঠুলে এগিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করছে।নিভান পরম আবেশে সেই বাধ্যতার বশিভূত স্বীকার করলো।যেনো নিজেকে অনুভব কোনো যাদূর বশবর্তী মানব।যা তাকে যাদূর বলে টানছে আর এগিয়ে যাচ্ছে।তারমধ্যেও বললো–বলোনা,কৌড়ি।খুব কি অসুবিধা হবে?খুব কি ক্ষতি?
বরের ভালোবাসায় কৌড়ি তখন অনুভূতির জোয়ারে ভেসে চলেছে।মুখ দিয়ে রা শব্দটা বের করার জো নেই।যেনো সে নিজেও চাইছে,নিভান তাকে ভালোবাসুক।একজন স্বামী তার স্ত্রীকে যেভাবে ভালোবাসে,নিভান ঠিক সেভাবে তাকে ভালোবাসুক।অনুভূতিতে এলোথেলো কৌড়ি,নিভানের আকুল আবদনে এতোসময় বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরা হাতদুটো আলগা করলো।নিজের ইচ্ছেতে আঁকড়ে ধরলো নিভানকে।নরম,কোমল হাতের ছোঁয়া পিঠে পড়তেই নিভান যেনো মূহুর্তেই সম্মতি পেয়ে গেলো।স্পর্শ আরও ঘনিষ্ঠ হলো।ঘনো জড়ানো গলায় ফের শুধালো–সত্যিই তোমার কোনো অসুবিধা নেই তো?
অনুভূতিতে জুবুথুবু কৌড়ি স্বামীর ভালোবাসায় কেমন যেনো বশ্যতা স্বীকার হয়ে গেলো।নিভানের শুধনো প্রশ্নে উত্তর দেওয়া যেনো অত্যাবশ্যক মনে করে মাথা নাড়িয়ে না জানালো।অর্থাৎ স্বামীর অস্তিত্বে নিজেকে বিলিন করে দিতে তার কোনো অসুবিধা নেই।নিভান যেনো আকাশ ছোঁয়া আশকারা পেলো।আর সেই আশকারা পেতেই এতো দিনে নিয়ন্ত্রণ রাখা নিজের পুরুষ সত্ত্বাকে অবাধ মুক্ত করে দিলো।জমানো ভালোবাসা উগলে দিতে থাকলো একান্ত নারীটিতে। চললো নিভানের পাগল করা উথাল-পাথাল ভালোবাসা।বাহিরের মুশলধারা বর্ষনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে যেনো নিভানের ভালোবাসা।কৌড়িও যেনো স্বামী নামক মানুষটার কাছে নিজেকে অবাধ ছেড়ে দিলো।সেটা উপলব্ধি করে নিভানও আজ প্রথম নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করলো।খুব ঘনিষ্ঠ মূহুর্তে স্ত্রীর কানে মুখ ডুবিয়ে বললো–নিভান তোমাকে খুব ভালোবাসে,
আমার ভালোবাসা।নিভান তোমাকে তার চেয়ে-ও খুব খুব যত্নে রাখবে।খুব খুব ভালোবাসবে।দেখো!
চলবে….