ফুলকৌড়ি পর্ব-৫৬+৫৭

0
3

#ফুলকৌড়ি
(৫৬)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

নিভানের পিতৃস্থানীয় বাড়িটায় সময়টা বেশ আনন্দে ফূর্তিতে কাটলো সবার।আর আতিথিয়েতা তো মাশাআল্লাহ,খুব আমায়িক।সকাল হতেই খাওয়া দাওয়া সেরে বিদায় নিয়ে বের হলো নিভানরা।রওনা দিলো বাড়ির পথে।আবিদা জাহানের মনেহলো,ছেলেমেয়েগুলোকে এবাড়িতে আঁটকে রাখতে।একদিনের হৈ-হুল্লোড়ে বাড়িটা কেমন প্রান ফিরে পেয়েছিলো।ছেলেমেয়েগুলো চলে যেতেই বাড়িটা কেমন খা খা করছে।পুনরায় শান্ত নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে।ছটফটে ইতুটারও কেমন মন খারাপ বসে আছে।ওরা চলে যেতেই কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে!তবে নিভান উনাকে কথা দিয়ে গেছে সপ্তাহে একদিন হলেও সে এবাড়িতে আসবে।উনার সাথে দেখা করে যাবে।এবাড়ির মানুষগুলোর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে।এতেই তিনি খুশি,সন্তুষ্ট।ছেলেটাকে একেবারে ধরে রাখার অধিকার তিনি অনেক আগেই হারিয়েছেন বিধায় যুক্তি দেখিয়ে, হক খাঁটিয়ে, সম্পর্কের জোর চাপিয়ে ধরেবেধে রাখতে চাননা।নিভানকে রাখা সম্ভবও নয়।তবে যেটুকু আপনে থেকেই পাচ্ছেন তাতেই শুকরিয়া।বাড়ির সামনের লন এরিয়া থেকে গাড়ি দুটো চোখের আড়াল হতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।উনার বাহু চেপে রাখা আশহার সাহেবকে বললেন–আমাকে ঘরে নিয়ে চলো ছোটোখোকা।

মায়ের মন খারাপ বুঝে উনাকে ঘরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললেন–আপনি কিন্তু দুশ্চিন্তা করবেননা আম্মা।নিভান কিন্তু বলে গিয়েছে, সে সপ্তাহে একবার হলেও বউমাকে নিয়ে ঘুরে যাবে।

‘তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরোনা ছোটোখোকা।আমি ঠিক আছি।তবে আমার আওসাফ বেঁচে থাকলে মনেহয় আমার গুছানো সংসারটাও ঠিক থাকতো।

বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।মায়ের সাথে সাথে আশহার সাহেবও একটা শ্বাস ছাড়লেন।বড় সন্তানের প্রতি বাবা মায়েদের একটা অন্যরকম টান থাকে।প্রথম সন্তান বলে কথা!মা হোক বা বাবা, ডাকটাও তো তার মুখেই প্রথম শোনা হয়।পিতামাতৃত্বের স্বাদ অনুভূতিাটও তো সেই প্রথম সন্তান দ্বারা উপলব্ধিত হয়।সন্তানের প্রতি সকল অনুভূতি অনুভব প্রথম সন্তান দ্বারাই হয়ে থাকে,বিধায় তাদের প্রতি মায়া টান,ভালোবাসাটাও একটু বেশী হয়।গভীর হয়।আশহার সাহেবেরও তো সেই টান আছেন।ইতু নিতুকে তিনি সমান ভালোবাসলেও,নিতুর প্রতি মায়াটা উনার একটু বেশি।সেই হিসাবে বড় ভাইয়ের প্রতিও উনার মায়ের টান,স্নেহ,ভালোবাসা একটু গভীরে।আর সেই সন্তানের সন্তান,এবাড়ির প্রথম নাতী হলো নিভান।তারপ্রতি সেই টান ভালোবাসা থাকবেনা!তা কিকরে হয়?প্রচলিত প্রচলন,লোকে বলে–আসলের চেয়ে নাকি সুদের মায়া বেশি।আসলেইতো তাই!আর সেই সুদের মায়া যদি হয়,সেই প্রথম মাতৃস্বাদ প্রাপ্ত সন্তানের সন্তান।তাহলে তো কথাই নেই!দূরে থাকলেও নিভানের প্রতি আশহার সাহেবের যে,মায়ের মতো একই টান ভালোবাসা নেই।তা নয়।ছেলেটাকে তিনিও তো ভালোবাসেন।বড়ো ভাইয়ের বড় দরদের অমুল্য আমানত হিসাবে নিজের কাছে রাখতেও চান।তবে না সেদিন চেয়েও পেরেছিলেন আদরের ভাইপো-কে কাছে রাখতে,আর না আজ চেয়েও পারবেন। এসব ভেবে একপর্যায়ে মা’কে সান্তনা দিতে দিতে ভিতরের দিকে অগ্রসর হলেন তিনি।

বাড়ি ছেলেমেয়েগুলো বাড়িতে আসতেই বাড়ির প্রানটা যেনো ফিরে এলো।বিয়েতে আসা আত্মীয় স্বজন এই দুদিনের মধ্যে কমে গিয়েছে।বললে চলে নেই।শুধুমাত্র নিভানের নানুমা ছাড়া আপতত আত্মীয়- স্বজন বলতে বাড়ি ফাঁকা।ওবাড়ি থেকে এসে,ওবাড়িতে ঘুরেফিরে বেড়ানো,অতিথি আপ্যায়নের গল্পে মুগ্ধ মশগুল সবাই।নীহারিকা বেগমতো কৌড়িকে আলাদা ডেকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে গিয়ে বসলেন।কেমন অশান্ত গলায় শুধালেন–নিভানের দাদুমা,নিভানকে ওবাড়িতে থেকে যাওয়ার কথা কিছু বলেননি কৌড়ি?

কেমন উৎকন্ঠা, অশান্ত,অস্থির হয়ে শব্দগুলো প্রয়োগ করলেন তিনি।যেনো কোনো কিছু নিয়ে আশংঙ্কায় ছিলেন।কৌড়ির কেমন মায়া হলো।বুঝতে পারলো, ছেলে দূরে সরে যাওয়ার নীরব ভয় সংশয় থেকে এমন উৎকন্ঠিত বাক্য,প্রশ্ন।হয়তো আজ দু’দিনে তিনি এই ভয়ে সংশয়ে কাটিয়েছেন।বুঝদার ছেলেকে নিয়েও উনার এতো ভয়?এতো সংশয়?সন্তান দূরে যাওয়ার ভয়,তাকে হারানোর অনিশ্চয়তা বুঝি বুঝদারপনা আর বয়স মানেনা?বাবা মায়ের মন তা হয়তো কোনো ঘটনাক্রমে সংশয়িত হয়েই থাকে।তবে নীহারিকা বেগমের সংশয়,দুশ্চিন্তা দূর করতে কৌড়ি উত্তর দিলো—দাদুমা তো তেমন কোনো আবদার করেননি।তবে মাঝেমধ্যে উনাকে একটু দেখে আসার আবদার জানিয়েছেন।তোমাকেও যেতে বলেছেন, বড়মা।

‘আবার বড়মা।শুধু মা বলবি।

কৌড়ি দেখলো একটু আগের সংশয় ভিতু কন্ঠ মূহুর্তেই
উচ্ছ্বাসে পরিনিত হয়েছে।চোখমুখে যে উৎকন্ঠার আধার ছিলো,তা মূহুর্তেই কেটে গিয়ে দুপুরের রোদের ন্যায় ঝলমলে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।নীহারিকা বেগম সবিনয়ে বলতে থাকলেন—আমার নিভান আমাকে শুধু মা বলে ডাকে জানিস!ওর ডাকে আমার কলিজা জুড়িয়ে যায়।কতো দুশ্চিন্তা,অপারগতা,যন্ত্রণা,সব যেনো সেই ডাকেই সহস ধুয়েমুছে ভিতরটা সচ্চ হয়ে যায়।মনেহয়,আমার জীবন, আমার মাতৃত্ব স্বার্থক আমি এমন সন্তান জন্ম দিতে পেরেছি বলে।আমার বাচ্চা। আমি ওকে খুব ভালোবসি জানিস কৌড়ি।কিন্তু ওরই তো মা,ওকে ঠিকঠাক বোঝাতে পারিনা।বোঝাতে পারিনা,আমি তোর বাবার থেকে একচুল কম ভালোবাসিনা নিভান!আমি তোর বাবার মতোই তোকে খুব ভালোবাসী।

ফের উদাস কন্ঠে বললেন–ওকে কষ্ট দিসনা কৌড়ি।ভালো রাখিস।ওর আমার প্রতি অনেক অভিমান অভিযোগ আছে,যা ও কখনো প্রকাশ করেনা।হয়তো করতেও চায়-না। তুই উত্তম সঙ্গী হয়ে ওর চাপা দুঃখ কষ্টগুলো বের করে নিস।সেটা আমার নামে অভিযোগ হলেও,কষ্টগুলো ওর মনে থেকে দূরীভূত করার চেষ্টা করিস।এটা আমার তোর কাছে দাবী।আমি জানি তুই পারবি ওর জমা কষ্টগুলো,দুঃখগুলো ভুলিয়ে দিতে, ওকে ভালো রাখতে।একজন স্ত্রীর স্বামীর দুঃখ দুর্দশা হতাশা, কষ্ট ভুলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা থাকে,এজন্য মা হয়ে সন্তানের সুখ কামনায় কথাগুলো তোকে বলা।

‘উনি তোমাকে খুব ভালোবাসেন বড়মা।স্যরি মা।

হেসে ফেললেন নীহারিকা বেগম।বললেন –আমি জানি সেটা।আচ্ছা ওসব রাখ।ওবাড়ির গল্প করতো শুনি।আশহারের বউকে আমি দেখিনি।কেমন?ওর মেয়ে দুটো কেমন?

বউ শ্বাশুড়ি গল্পে মেতে উঠলো।কতোশত প্রশ্ন!কতশত পুরানো মধুময় স্মৃতি উগলে দেওয়া!ওবাড়ির প্রতি টান মায়া সব যেনো কন্ঠে ঝুরে পড়লো নীহারিকা বেগমের।
কৌড়ি প্রশ্নের উত্তর দিলো।শ্বাশুড়ির ওবাড়ির প্রতি টান মায়ার গল্প শুনলো।উনার সন্তুষ্টচিত্তে বলার ভঙ্গিমা মুগ্ধ হয়ে দেখলোও।আর এটাও বুঝলো,তার শ্বশুর নামক কবরে শায়িত মানুষটা তার শ্বাশুড়িকে খুব ভালোবাসতেন।যা তিনি আরেক সংসারের বেড়াজালে পড়েও এখনো ভুলতে পারেননি।যেমন নিভান ভুলতে পারিনি তার বাবাকেও।

‘হাতের বালাজোড়া কে দিয়েছেন? দাদুমা?

কথার একপর্যায়ে কৌড়ির হাতের দিকে নজর যেতেই শুধালেন নীহারিকা বেগম।সেদিকে একপলক তাকিয়ে মৃদু হেসে মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দিলে কৌড়ি।মুখ বললো–হুমম।দাদুমা দিয়েছেন।

নীহারিকা বেগম বালাজোড়া আলতো হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলেন।এই বালাজোড়া শ্বাশুড়িমার খুব যত্নের।বিয়ের পর শ্বশুরবাবা নাকি নিজ শখে গড়িয়ে দিয়েছিলেন শ্বাশুড়িমাকে।স্বামীর শখের বালাজোড়া তাই নিজ যত্নে যক্ষের ধনের মতো গুছিয়ে রাখতেন।আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ঘুরতে গেলে তখনই এই বালাজোড়া উনাকে পরতে দেখা যেতো।তাছাড়া আলমারীর লকারে সযত্নে তা আগলে রাখতেন।সেই বালাজোড়া আজ নিভানের বউকে দিয়ে দিলেন তিনি!তবে নিভান তার কতো যত্নের।হয়তো পারেননি সেই যত্ন সযত্নে আগলে রাখতে।তবে ভালোবাসা যত্ন ঠিকই মনের কুঠোরে রয়ে গেছে।

শ্বাশুড়ির কাছ থেকে ছাড় পেতেই কৌড়ি রুমে এলো।রুমে ঢুকতেই মুখে আপনাআপনি মৃদু হাসি ফুটল তার।চারপাশটা নিষ্পলক চোখ চেয়ে দেখলো কিছুক্ষণ।সঙ্গে বদ্ধ রুমের মধ্যে ভেসে বেড়ানো সেই মানুষটার শরীরের নিজস্ব সুগন্ধ রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করতে লাগলো।যা মানুষটার অনুপস্থিতিতেও,রুমের মধ্যে চারিদিকে তীব্র সুবাস ছড়িয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে।সময় নিয়ে কৌড়ি ভিতরে ঢুকলো।বাসায় পরিধিয় সালোয়ার কামিজ নিয়ে মূহুর্তেই আবার ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।ফ্রেশ হয়ে গায়ের গহনা সব খুলে শাড়ী ছেড়ে সেলোয়ার-কামিজ পরতেই মনে হলো শান্তি।একে শাড়ী, তাতে একগাদা গহনা পরে থাকাতে কি যে অস্বস্তি লাগছিলো!উফফ!এবার যেনো শান্তি।পরম শান্তি।আগের পরিহিত জামাকাপড়গুলো ধুয়ে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো কৌড়ি।বেলকনিতে তা মেলে দিয়ে এসে ধপ করে বেডের আড়াআড়ি শুয়ে পড়লো সে।নরম বিছনায় শরীর মেলে দিতেই,ঘরময় ঘুরে বেড়ানো সুগন্ধটা যেনো নাকে কড়া হয়ে ধরা দিলো।ঘাড় কাত করে পাশে ফিরলো সে।জীবনের প্রথম স্বামী নামক পুরুষটার সঙ্গে কাটানো প্রথম রাতের মূহুর্তগুলো দুনয়নে ভেসে উঠলো।পরপর ভেসে উঠলো,ওবাড়িতে থাকা প্রতিটি রাতের সুন্দর সুন্দর মূহুর্ত।এমনকি কালকে রাতের ওই বেসামাল মূহুর্তগুলোও।ভাবতেই লজ্জায় চোখ বুঁজে নিলো কৌড়ি।ঠোঁটে ফুটলো বিস্তর হাসি।পাশ থেকে খামচে একটা বালিশ উঠিয়ে নিয়ে বুকে চেপে ধরতেই সেই ঘরময় ছুটে বেড়ানো সুগন্ধটা যেনো আর-ও প্রকট হলো।সেই অনুভূতিতে কৌড়ি বালিশটা যেনো আরও শক্তভাবে বুকে চেপে নিলো।মানুষটা কাছে নেই অথচ মনেহচ্ছ,খুবকাছে আছে মানুষটা।যেমনটা তাকে বুকে আগলে ঘুমায় তেমনটা।ওবাড়ি থেকে বের হয়ে মাঝরাস্তা থেকে অফিসে চলে গিয়েছে মানুষটা।তারা চলে এসেছে বাড়িতে।অথচ না থেকেও মানুষটার উপস্থিতি যেনো ঘরময়।

‘ওভাবে শুয়ে আছিস কেনো?বালিশ মাথায় না দিয়ে বুকে?ব্যাপার কি?

মান্যতার গলা শুনে চমকে বুকের থেকে বালিশ সরিয়ে ফেললো কৌড়ি।ততক্ষণে মান্যতা এসে বসে পড়লো কৌড়ির পাশে।কৌড়ির উত্তরের অপেক্ষা না করে ফের বললো —

‘জানিস, আগে এঘরে আসতে কেমন একটা দ্বিধা ভয় কাজ করতো।ভয় অবশ্যই না।দাদাভাইয়ের সম্মুখে পড়ার অস্বস্তি।যদিও দাদাভাই যেখানে থাকে, ছোটোদাদাভাই বাদে সেখানে আমাদের কাওকে পাওয়া যায়না।সত্যি বলতে দাদাভাইয়ের সম্মুখে বসা চলা,কথা বলা সাহসে কুলাইনি কখনো।দাদাভাইয়ের ওই গম্ভীর মুখ,ভারী কন্ঠ, শান্ত চাহুনী।সবসময় আতঙ্কিত করে রাখাত আমাদের।আর রাখেও। অথচ দাদাভাই কিন্তু অকারণে বকাঝকা রাগারাগি অযথা চিল্লাপাল্লা এসব করতোনা।এখনো করেনা।তবুও কেমন একটা তারপ্রতি ভয়সয় কাজ করে।তবে তুই দাদাভাইয়ের বউ হওয়ার পর সেই দ্বিধা আতঙ্ক ভয়সয় যেনো কিছুটা কেটে গেছে।তবুও দাদাভাইয়ের সম্মুখে পড়তে যেনো কেমন একটা অনুভব হয়।এখন এই রুমে ঢুকতে গিয়ে কেমন মনে হচ্ছিলো!যদিও জানি দাদাভাই রাতের আগে ফিরবেনা।তবুও…

‘ফিরলেও কি!কিচ্ছু বলবেন না উনি।তুমি বসে না থেকে শুয়ে পড়োতো।

মান্যতা কৌড়ির পাশাপাশি শুয়ে পড়লো।কিছুটা প্রহসন করে বললো–একেই বলে বউকা পাওয়ার।অথচ দুদিন আগে কিন্তু কেঁদেকেটে ভেসে যাচ্ছিলো আমাদের কৌড়ি।

হাসলো কৌড়ি।নজর তার ছন্দতুলে ঘুরতে থাকা বৈদ্যুতিক ফ্যানটার।সেদিকে তাকিয়ে সহসা মান্যতা শুধানোর মতো করে বললো—এসি না চালিয়ে ফ্যান ছেড়েছিস!যা গরম পড়ছে!উফ!জান যায়যায় অবস্থা!

এসির রিমোটটা হাত বাড়িয়ে বেডটেবিলটার পাশ থেকে নিয়ে মান্যতার কাছে দিল কৌড়ি।সহসা শুধালো–দীবা আপুকে দেখলাম না-তো?উনি বাড়িতে নেই আপু?তোমাদের সাথেও ওবাড়িতে গেলেন না?

‘তােদের বিয়ের দিন রাতে সিয়াম ভাইয়ার সাথে ঘুরতে বেরিয়ে নাকি,সিয়াম ভাইয়াদের বাড়িতেই চলে গেছেন।
সকালেই তো তোরা গাজীপুর চলে গেলি,এজন্য হয়তো জানিস না।

‘উনাদের সব মিটমাট হয়ে গেছে?

‘তা জানিনা।তারপর তো আর এবাড়িতে আসলেন না।আমারও আপুর সাথে কথা হয়নি।উনি সিয়াম ভাইয়াদের বাড়িতে আছেন,এটুকু শুধু আম্মুর কাছ থেকে শুনেছি।তাছাড়া সেভাবে কিছু জানিনা।তবে মিটমাট হয়ে গেলেই ভালো।আপুর মন খারাপ আমারও ভালো লাগেনা।আপু খারাপ নয় জানিস।শুধু বিয়ের পর কেমন জানি একটা হয়ে গেছেন।আমি বুঝিনা আপুতো জেনে-বুঝে সিয়াম ভাইয়াকে বিয়ে করেছিলেন। তবে উনাকে নিয়ে এতো সমস্যা কিসের।ভাইয়াকেও কিন্তু আমার একেবারে খারাপ মনেহয় না।আপুকে কিন্তু প্রচন্ড ভালোবাসেন।তবুও এতো ঝামেলা কিসের আমি বুঝিনা।

‘আমার উপরে দীবা আপুর খুব রাগ তাই না আপু?

মান্যতা সহসা পাশ ফিরে কৌড়ির দিকে তাকালো।ফের বললো।

‘তা কেনো হবে!থোড়াই না তুই তার ভালোবাসার মানুষ আর না ভালোবাসার সংসার কেড়ে নিয়েছিস!যা সে হারিয়ে আফসোস করছে,সংসার ছেড়ে এলোমেলো জীবনযাপন করছে!তা তার ডিসিশনে,এবং নিজের ইচ্ছেতে!সেখানে তোর উপরে কেনো কারও উপরে আপুর রাগ করা উচিত নয়।নিজ থেকে খুইয়ে দিলে সে জিনিস কি আর সহজে পাওয়া যায়?যায় না!শুধু তা হারনোর বেদনায় আফসোস করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা!

আফসোস!দীবা আপুর মতো তাকেও কি করতে হবে? সহসা মনে প্রশ্নটা আসতেই ভিতরে ভিতরে কেমন থমকে গেলো মান্যতা।সেদিনের পর আর তৃনয়ের সাথে তার কথা হয়নি।আর না দেখা হয়েছে।সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে লোকটাকে এখনো নিজের ডিসিশন জানানো হয় নি।আর না লোকটাও তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে।আচ্ছা,দাদাভাইকে নিজইচ্ছেতে হারিয়ে দীবা আপু যেমন সিয়াম ভাইয়ার সাথে ভালো নেই।তার ডিসিশনও যদি দীবা আপুর মতো হয়!তৃনয়কে বিয়ে না করে সে যদি অন্য কাওকে বিয়ে করে!আর সুখি না হয়?তখন কি দীবাআপুর মতো অবস্থা হবে তার!কাওকে অভিযোগ করার থাকবেনা।শুধু ভিতরে ভিতরে পুড়ে শেষ হতে হবে?আফসোস করতে হবে?সাথে উত্তম জীবনসঙ্গিনী হারানোর বেদনায় ছটফটিয়ে মরতে হবে?এমনটা কি তারসাথেও হবে?দীবা আপুর এবাড়িতে পড়ে থাকার সত্যিটা তো সেও জানে,তবে কৌড়ির সামনে খোলাখুলি প্রকাশ করেনি। পাছে মেয়েটার না আবার মন খারাপ হয়ে যায় তাই!দীবা আপু সম্পর্কে আগে যেটুকু শুনেছে জেনেছে,এখনতো দাদাভাই কৌড়ির স্বামী।অন্য মেয়ে দাদাভাইকে ভালোবাসে,তাকে পাগলের মতো চায়!নিজের স্বামী, সংসারধর্ম ছেড়ে বসে আছে দাদাভাইকে পাওয়ার জন্য।এটা কোনো স্ত্রী সহ্য করতে পারে? মানতে পারে? মান্যতার মনেহয় কখনোই পারেনা। সে যতোই ধৈর্য্যশীল সহনশীল মেয়ে হোক না কেনো,স্বামীর বেলায় তারা পারেনা এসব মানতে!যদিও কৌড়ি বুদ্ধিমান মেয়ে বুঝতে পারে সবকিছু। তবে চুপ হয়ে থাকে।বুদ্ধিমান মানুষেরা যে কথা বলে কম।আচ্ছা সেই বুদ্ধিমান মেয়েটার কাছ থেকে নিজের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের পরামর্শ নেবে?নেওয়াই যায়।সহসা চুপচাপ থাকা কৌড়িকে ডাক দিলো সে।

‘কৌড়ি।

‘হুমম।বলো আপু।

‘আমাকেও কি দীবা আপুর মতো কোনো একটা সময় গিয়ে আফসোস করতে হবে?

প্রশ্নটা কৌড়ি বুঝলোনা।ভাবান্তর কপালে মৃদু ভাজ ফেলিয়ে পাশে তাকাল।মান্যতা উপরের দিকে তাকিয়ে আছে।স্থির দৃষ্টিটা তার বৈদ্যুতিক ঘুরতে থাকা ঝা চকচকে পাখাটার দিকে।এসি ছাড়লেও,আলসেমিতে কেউ উঠে পাখাটা বন্ধ করেনি।কৌড়ি বুঝলো না মান্যতার প্রশ্ন!আপু ভবিষ্যতে কি নিয়ে আফসোস করার কথা বলছে?কৌড়িকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে দেখে হয়তো মান্যতাও বিষয়টা বুঝলো।তাই পুনরায় বললো—তৃনয় ভাইয়াকে বিয়ে করার বিষয়টা নিয়ে বলছি।সবাই বলে উনি ছেলে ভালো।দ্বিতীয়ত দাদাভাইয়ের বন্ধু।সত্যি বলতে এমনিতেই উনি ছেলে ভালো।তবে…

তবে বলে থেমে গেলো মান্যতা।আর একটা শব্দ মুখ থেকে আর করলোনা।কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে চুপচাপ রইলো কৌড়ি।হয়তো সেই তবের পরে রয়েছে মান্যতার ব্যাক্তিগত কোনো বিষয়।যা সে বলতে চায়না।কৌড়িও আর খুঁচিয়ে শুনলো-না।খুঁচিয়ে শোনা তার স্বভাব, পছন্দ কোনোটাই নয়।তাই চুপচাপ মুখ ফিরিয়ে সে-ও মান্যতার মতো উপরের দিকে তাকালো।মান্যতার প্রশ্নের উত্তর কি দেওয়া উচিত এটাও ভেবে পেলোনা।যেখানে প্রশ্ন উত্তর সবই আপুর কাছে রয়েছে। সেখানে আলাদা কি সদুত্তর দেবে!বুঝে আসলোনা।তবুও তাকে বিশেষ কেউ ভেবে যখন প্রশ্ন শুধিয়েছে উত্তর দেওয়াটা কৌড়ির মনেহলো অনিবার্য।

‘ তৃনয় ভাইয়া সত্যিই খুব ভালো ছেলে আপু।আমার সাথে যে কয়বার দেখা হয়েছে কখনো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন নি।নিজের দৃষ্টি সংযত রেখে সবসময় কথা বলেছেন। বিষয়টা আমার ভিষন ভালো লেগেছে। আর ব্যবহার!তন্ময়ী আপুর যেমন অমায়িক, অসাধারণ, উনারও।সেখানে আমার থেকে তো তুমি উনাকে বেশি ভালো জানো।আর সবদিক থেকেই তো ভাইয়া দারুন গুনের অধিকারী।সেখানে একটা মেয়ের আর কি চাই বলো-তো!ওমন ছেলেই তো মেয়েরা জীবন সঙ্গিনী হিসাবে চায়।আমিও চেয়েছিলাম।পেয়েছি।আর দ্বিতীয়ত উনি তোমার দাদাভাইয়ের বন্ধু।শুনেছি অনেক বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।সেখানে তোমার দাদাভাইয়ের মতো স্বামী পাওয়া ভাগ্য। যেকোনো নারীর সৌভাগ্য।সেখানে তাঁর বন্ধু নিশ্চয় তার মতো।তা-না হলে এতোবছর বন্ধুত্ব টিকতো-না। থাকতো না।আর তার স্ত্রী হলে তুমি কি সৌভাগ্যবতী হবেনা?যেমনটা আমি হয়েছি।বাদবাকি ভাগ্যের উপর।সৃষ্টিকর্তা যা লিখেছেন ভাগ্যে,তাই তো হবে নাকি!আর ত্রুটি তো মানুষের মধ্যেই থাকে তাইনা?ভুল, অন্যায়,ত্রুটি, অপরাধ তাদের দ্বারাই হয়।এসব তো তাদের জন্যই সৃষ্টি!আর এসব নিয়েই সংসার!বেহেশত ছাড়া আমার মনেহয় নিখাঁদ সংসার পৃথিবীতে নেই।সুতরাং ভাগ্যকে সংবরণ করা থোড়াই না আমাদের হাতে!তারমধ্যে নিজের ভালো কোনটাতে হতে পারে,হবে,ভেবেবুঝে নিতে হয়।জ্ঞানী বুদ্ধিমান নারীরা কখনো তারজন্য ভালো কিছু পেলে,তা কখনোই জেনে-বুঝে হাত ছাড়া করেনা।

মান্যতা অবাক হয়ে কৌড়িকে দেখতে থাকলো।একটা বাচ্চা মেয়ে! অথচ এতো বুঝজ্ঞান তারমধ্য!হয়তো পরিস্থিতি তাকে সময়ের আগে এতো বুঝতে জানতে বাধ্য করেছে!চুপচাপ থাকা সল্পভাষী মেয়েটা এতো কথাও মনেহয় এই প্রথম শুনলো মান্যতা। মান্যতা তার পানে চেয়ে আছে বুঝে পাশ ফিরে তারদিকে তাকালো কৌড়ি। মৃদু হেসে বললো –তোমার জীবন সঙ্গীনি হিসাবে তৃনয় ভাইয়া বেস্ট হবে।তবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত একান্ত তোমার।তুমি যেটা ভালো মনে করবে সেটাই হবে।

মান্যতা মাথা সোজা করে চোখ বুঁজে নিলো।কি ভেবে নিজের হাতের পাশের কৌড়ির হাতটা ধরে নিয়ে বুকে চেপে নিলো।মৃদুস্বরে বললো—দাদাভাইকে খুব ভালো রাখিস বউমনি।খুউব।

ওই মানুষটার জন্য সবার যেনো একটাই অনুরোধ,একটাই আর্তনাদ!কেনোযে,কৌড় কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা!শুধু এটুকু বোঝে,এই মানুষগুলো ওই মানুষটাকে খুব ভালোবাসে।খুউব।কৌড়ি একটু সরে এসে মান্যতা গা ঘেঁষে শুলো।ফের মান্যতার বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখা হাতটার উপর অন্য হাতটা রেখে আশ্বাস দিলো।তা বুঝে এবার শক্তপোক্ত বাঁধনে কৌড়ির দু-হাত চেপে ধরলো মান্যতা।তবে চোখ খুললো না।ওভাবে চুপচাপ শুয়ে রইলো দুজনে কতক্ষণ!

সারদিন গিয়ে রাত এগোরোটার দিকে বাড়িতে এলো নিভান।ড্রয়িংরুম পার করতেই জমজমাট ডাইনিং রুমের দিকে একপলক তাকালো।রাতের খাবারে ব্যস্ত সবাই সেখানে।সেই একপলকেই বুঝে নিতে পারলো তার বউয়ের অস্তিত্ব ওখানে নেই।সারাদিনে মেয়েটার সঙ্গে কথা হয়নি।খুব ব্যস্ত ছিলো নিভান।মায়ের সঙ্গে অবশ্যই কয়েকবার কথা হয়েছে। কখন আসছে সে?তন্মধ্যে রাতে সবাইকে ডাইনিংয়ে খেতে দেওয়ার আগেও মা ফোন দিয়েছিলেন।কখন আসছে সে?নিভান বলেছিল, জ্যামে আঁটকে আছে সে।আসতে দেরী হবে।সেই ভাবনা মতোই হয়তো মা সবাইকে খেতে দিয়েছেন।ভাবনার একপর্যায়ে রুমে ঢুকলো নিভান।ঝকঝকা লাইটের আলোয় কোথাও কারও অস্তিত্বের গন্ধ পেলোনা সে। বুঝতে পারলো বউটা তার রুমে নেই।তবে গেলো কোথায়? গায়ের ব্লেজার গলিয়ে শার্টটা খুলতে খুলতে চারপাশে আরও একবার নজর ফেললো।নজর পুনরায় হতাশ হলো।শার্ট ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো সে।সময় নিয়ে গোসল সেরে বের হলো।তখনো রুমটা ফাঁকা। কারও আসার কোনো সাড়াশব্দও পেলো-না।নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে মাথা মোছায় মনোযোগ দিলো।মাথা মুছে পুনরায় গায়ে টিশার্ট জড়ালো।মাথার চুলগুলো কোনোরকম হাত দিয়ে ঠিকঠাক করে নিচে নেমে গেল।ততক্ষণে ডাইনিংয়ে সবার খাওয়া শেষ। যে যার রুমে চলে গেছে।তবুও নজর একবার চারপাশ থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসলো নিভান।কোথাও কেউ নেই।শুধু মা রান্নাঘরে কিছু করছেন।

‘ নিভান এসেছিস?আচ্ছা বোস,খাবার দিচ্ছি।

হঠাৎ নিভান শুধালো—সবাই খেয়েছে মা?

নিভানের প্রশ্নের কারণ ধরতে না পারলেও,নিজ গতিতে হাতের কাজ সারতে সারতে উত্তর দিলেন নীহারিকা বেগম–হ্যা, সবাই খেয়েছে।শুধু কৌড়ি খায়নি।ওর নাকি ভালো লাগছেনা খেতে।তোর নানুমাকে খাবার দিতে গিয়ে ডাকলাম,কিছুতেই খেতে আসলো-না।বকাবকিও করলাম তবুও শুনলোনা।

নিভান বুঝলো বউটা তার কোথায় আছে।দ্বিতীয়ত আর মায়ের কথায় প্রতিত্তোর করলোনা সে।নীহারিকা বেগম ছেলের জন্য রান্নাঘরে খাবার গুছিয়ে রাখছিলেন, ইতিমধ্যে নিভানকে আসতে দেখেই খাবারগুলো এনে তার সম্মুখে দিলেন।খাবার সম্মুখে আসতেই,খাবারে মনোযোগ দিলো।মা’কে পুনরায় রান্নাঘরে দিকে যেতে দেখে ডাক দিলো নিভান।।–‘মা।

নীহারিকা বেগম পিছু ফিরলেন।বললেন—কি হয়েছে? কিছু লাগবে?

‘না।তুমি খেয়েছো?

নিভান না খেলে তিনি কখনো খেয়েছেন কি-না মনে নেই।নিভান বাড়ির বাহিরে থাকলে হয়তো দৈবিসই খেয়েছেন।তবে নিভান বাড়ির বাহিরে থাকলেও,তিনি ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছেন,ছেলে খেয়েছে কি-না?তার হ্যা না উত্তরে তারপর মুখে খাবার তুলেছেন।তবুও ছেলে জিজ্ঞেস করতেই বরাবরই খাবেন,খেয়েছেন এরকমটা বলে এড়িয়ে যান।আজও অন্যথা হলোনা।এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতেই বললেন–রাত কতো হয়েছে দেখেছিস?সাড়ে এগারোটা বাজতে চললো।তোদের তো কাজের শেষ হয়না তাই বলে এতোরাত করে এখনো কেউ না খেয়ে বসে থাকে।

‘আমার সঙ্গে অল্প খাবে, মা?তোমাকে হাতে মাখাতে হবেনা, আমি খাইয়ে দেবো নাহয়।

অনেকদিন পর এরকম আবদার!ফেলতে পারলেন না ছেলের আবদার।হয়তো নিভান বরাবরের মতোই বুঝে গিয়েছে তিনি খাননি।মাতৃহৃদয় আবেগাপ্লুত হলো।অথচ পা নড়তে চাইলোনা।

‘এসে বসো।

নীহারিকা বেগম নিজের আবেগ ঢাকতে বাহানা ছুড়লেন–‘রান্নাঘরে কাজ আছে তো!

‘সকালে রানীসাহেবা করে নেবে।

যেখানে মন চাইছে দ্বিতীয়ত আর বাহানা জুড়লেন না।
নীহারিকা বেগম গোটা গোটা পায়ে নিভানের পাশাপাশি চেয়ারে এসে বসলেন।বললেন–তুই খা।আমি তোরসঙ্গে
আবার খেয়ে নিচ্ছি।

‘চেয়ারটা ঘুরে নিয়ে বসো।আমিই খাইয়ে দিচ্ছি।

নিভানের অনড় সিদ্ধান্তে চেয়ারটা ঘুরে নিয়ে বসলেন নীহারিকা বেগম।নিজেকে ক্ষনিকের জন্য মনেহলো ছোটোবাচ্চা।হ্যা, নিভানের আদেশে মন থেকে তেমনটা অনুভব করলেন তিনি।ক্ষনিকের জন্য সত্যিই বনে যেতে ইচ্ছে করলো,সামনের ছেলেটার সন্তানতুল্য হয়ে যেতে।
অথচ সেই সন্তানের জন্ম দেওয়ার প্রায় ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। চুলে পাক ধরেছে উনার।চেহারার জৌলুশতা কমে গিয়ে সারাঅঙ্গে বাতব্যাথা জেগেছে।সেই ছেলে বিয়ে দিয়ে নাতী-নাতনী হওয়ার সময়ও চলে এলো।অথচ মন সাজতে চাইছে নাদান বাচ্চা!মনেমনে নিজের প্রতি হাসলেন নীহারিকা বেগম।

‘মা, খাবার নাও।

মৃদু চমকে নিভানের মুখের দিকে তাকালেন তিনি।চৌকস শ্যামবর্ণের স্বাভাবিক কি সুন্দর মায়াময় একটা মুখ।নিভান জন্মের পর অনেকেই কানাঘুঁষা করে বলতেন–নীহারিকার পাশে যেমন তার বরকে মানায় না তেমন ছেলেটাও হয়েছ বাবার মতো।নীহারিকার কোলে মানায় না।সাধারণ রঙের কারনেই এসব বলতো সবাই এটা উনি জানতেন। অথচ উনি চেয়ে চেয়ে দেখতেন।আর উনার মাতৃমন,মনতাময়ী সত্তা বলতেন–না।ছেলেটা যেনো একটু বেশিই উনার কোলে মানায়।খুব মানায়।

‘খাবে-না?

হুঁশ ফিরলো যেনো!তড়িৎ হা করলেন তিনি।নিভান সযত্নে গালে লোকমা তুলে দিলো।অথচ উনি চাবালেও গিলতে পারলেন না।মনেহলো,গলায় কিছু একটা দলাপাকিয়ে আছে।যা খাবার গিলতে বাধাসৃষ্টি করছে।
নিভানও মায়ের মুখে খাবার দেবার পরপরই নিজের মুখে একলোকমা তুলে নিলো।তা চেয়ে চেয়ে দেখলেন নীহারিকা বেগম।কি নির্বিকার আচারণ।সত্যিই যেনো সন্তানকে গালে তুলে খাওয়াচ্ছে আর নিজে সেই একই এঁটো খাবার থেকে খাচ্ছে!যা তিনিও নিভানের ছোটোবেলায় করেছেন।অথচ তফাৎ আজ সময়ের, ব্যাক্তির।সেই ব্যাক্তির এই কাজটা করতে না আছে দ্বিধা সংকোচ, না আছে অযত্ন অবহেলা।কোনোমতে খাবারটা গলা থেকে নামিয়ে পেটে চালান করলেন নীহারিকা বেগম।অনেকদিনের মনের মধ্যে জমে থাকা একটা প্রশ্ন অ,তিনি শুধাতে সাহস পেতেননা।পাছেই কি না কি উত্তর শুনতে হয়।আজ তা সাহস করে শুধালেন।

‘আমার উপরে তোর খুব অভিমান,অভিযোগ তাই-না নিভান?মা তোকে ঠিকঠাক আদর ভালোবাসা দিতে পারিনি। সময় দিতে পারিনি।তোর শখ ইচ্ছের গুলোর গুরুত্ব দিতে পারিনি।বিনিময়ে শুধু দিয়ে গেছে অবহেলা আর অযত্ন!

খাবার মাখানো আঙুলগুলো হঠাৎই ক্ষনিকের জন্য থেমে গেলো নিভানের।পরমূহর্তেই তা আবার সচল হয়ে খাবার মাখাতে থাকলো।লোকমা বানিযে সম্মুখে ধরে চোখ দিয়ে ইশারা করলো নিভান নিতে।নীহারিকা বেগম বাধ্য মেয়ের মতো নিলেনও।তবে অপেক্ষা করলেন নিভানের উত্তর। নিভান উত্তর দিলো রয়েসয়ে। মায়ের মুখে খাবার তুলে দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত সচ্চ এক বাচ্চাদের মতো ভুবন ভুলানো চমৎকার একটা হাসি দিলো।ফের বললো–

‘অভিমান অভিযোগ ছিলোতো!খুব অভিযোগ ছিলো!তারসাথে যোগ হয়েছিলো অভিমানেরাও।কেনো আমার মায়ের আবার বিয়ে হবে!সবাই বলেছিলো তো,আমার মায়ের আবার বিয়ে হলে আমার মা আর আমার থাকবেনা।বাবাতো নেই মা থেকেও থাকবেন না।
সত্যিই তো থাকিনি!কেউ কেউ এসবও বলেছিলো, আমার মায়ের বিয়ের পর নতুন সংসার হবে,সেই সংসারে মা ব্যস্ত থাকবেন।আমাকে ভুলে যাবেন।অযত্ন অবহেলা ছাড়া তখন আর আমার কিছু জুটবেনা।সত্যিই তো অবহেলা অযত্নরা আমার সঙ্গী হয়ে গেলো!
আমার মায়ের থেকে পাওনা ভালোবাসা যত্নরা গেলো বাবার মতো হারিয়ে!আচ্ছা সেই বাবা হারানো ছেলেটার কি মায়ের উপরে তখন অভিযোগী অভিমানী হওয়া উচিত ছিলো না?ছিলো কি জানিনা।তবে সেই ছোট্টো অবুঝ মনে একটু একটু করে অভিযোগ বাসা বেধেছিলো,সঙ্গে জন্মেছিলো একরাশ অভিমানেরা।

একটু থামলো নিভান।মায়ের ফাঁকা গালে পুনরায় আরেক লোকমা খাবার গুঁজে দিয়ে ফের বলতে শুরু করলো–তবে সেই অবুঝ ছেলেটা তখন বুঝিনি তাকে ফেলে তার মা দ্বিতীয় আর কারও ঘরোনি হতে চায়নি।বিয়ে করতে চাইনি অন্য কাওকে।অবুঝ ছিলো কি-না ছেলেটা!ছেলেটা এটাও বুঝিনি সেই অবলা অসহায় নারী,তার পরিবারে কাছে, তার সমাজের কাছে,তার বয়সের কাছে নিরুপায় ছিলো!বাধ্য হয়েছিলো তার আদরের সন্তানকে রেখে অন্যত্র বিয়ে বসতে!জোর করা হয়েছিলো তাকে।অথচ হতভাগ্য সন্তান আমি, আমার নিরুপায় মা’কে বোঝার ক্ষমতা, বয়স তখন আমার হয়নি।তারপর আমার মা যখন পুনরায় সংসারী হলেন,সেই সংসারে ভাগ্যবশত আমারও ঠাই হলো।যদিও ঠাইটা করে নিয়েছিলেন আমার মা,তার সুখের বিনিময়ে!শর্ত জুড়েছিলেন,আমার দ্বিতীয় বাবাকে।পুনরায় দ্বিতীয় সংসারে উনার আদরের সন্তানকে ছাড়া কিছুতেই তিনি বিয়ে বসবেন না তিনি। সন্তুষ্ট চিত্তে রাজী হয়েছিলেন আমার পিতৃতুল্য মানুষটা।আমি বাবাহারা সন্তান বাবার পরে মায়ের মমতালোভী ছিলাম তো!মায়ের প্রতি অভিযোগ অভিমান জমলেও মায়ের সঙ্গ ছাড়তে পারলাম না।অথচ মায়ের সংসারে ঠাই হলেও, সবার সঙ্গেসঙ্গে মায়ের আদর ভালোবাসাও নুইয়ে এলো।তবে মায়ের সঙ্গে থাকতে পারছি তো!এই পরম ভাগ্য!নতুন সংসারে মায়ের বেখেয়াল অযত্ন,তাকে কাছে না পাওয়া,মায়ের প্রতি আমার অভিমান অভিযোগ বাড়িয়ে দিলো।অথচ দুর্ভাগা অবুঝ সন্তান আমি তখনো বোঝার ক্ষমতা হয়নি ,আমার মায়ের নতুন সংসার হয়েছে!তিনি তখন আমার মা বাদেও কারও বউ কারও ভাবী কারও বউমা,কারও মামি চাচি হয়েছেন।উনার দায়িত্ব খেয়াল তখন আর শুধু আমাতে আঁটকে নেই!তিনি আর তখন শুধু আমার মা-তে আঁটকে ছিলেন না!উনার দায়িত্ব বেড়ে গেছে।শত চেয়েও তিনি আর পারেননা,তার বাবাহারা সন্তানটাকে একটু বেশি খেয়ালে রাখতে!একটু বেশি বেশি আদর যত্ন ভালোবাসা দিতে!কাছে রাখতে!আমার মতো ভাবতেন হয়তো,সন্তান কাছে আছে এই ঢেড়!তবে যখন বুঝতে শিখলাম,জানলাম তখন অনুভব করলাম আমার মায়ের প্রতি আমার অভিমান অভিযোগেরা মাত্রই নিছক।আমার চোখের আড়াল তিনিও সন্তানকে কাছে না পাওয়ার কষ্টে কাঁদেন। ছেলেকে খাবার খোঁটা দিলে তিনিও খান না।ছেলের অযত্ন অবহেলায় তিনিও ব্যাকুল হন।মূর্ছা পড়েন।ছেলের শখ আহ্লাদ ইচ্ছেগুলো হারিয়ে যাওয়ায় তিনিও ব্যথিত হন। আত্মগ্লানিতে ভোগেন!অথচ তিনিতো সেই নারীজাতি যে,নারী শত কষ্ট,বাধাবিপত্তি,নিজের মৃতুসঙ্গ নিয়ে সন্তান পেটে লালিতপালিত করেও,আহ শব্দ মুখ থেকে বের করেন না।তিনি নিজের কষ্ট ব্যথাগুলো কি করে সন্তানকে বলবেন?জানতে দেবেন?কিন্তু আমি সন্তান আমারওতো দ্বায় থাকে বাবা মা’কে বোঝার।তাই আমার মতো করে আমিও বুঝে নিয়েছি।আমার মায়ের বিরুদ্ধে নিছকই মনে গাঁথা অভিমান অভিযোগগুলো ধুইয়ে মুছে নিয়েছি।

কথা শেষ করে নিভান আবারও একটা স্বতঃস্ফূর্ত হাসি দিলো।সচ্ছ পরিচ্ছন্ন মৃদু হাসি।যে হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত হলো অথচ দন্তের দেখা মিললো-না।ফের চড়ুইয়ের মতো হা করে নিজ মুখে ভাত তুলে নিলো।ছেলের মায়ামাখা হাসি,খাবার তুলে নেওয়া চেয়ে চেয়ে হতবিহ্বল চোখ দেখলেন নীহারিকা বেগম।নিভানের তো উনার সম্পর্কে ভিতরের এতো কিছু জানার কথা নয়!তবে জানলো কি-করে?সপ্রশ্নের সাথে সাথে উত্তরও যেনো নিজেই দিলেন।হয়তো নিভানের নানুমা নয়তো জাহিদ সাহেব জানিয়েছেন।এই দুজন মানুষ ছাড়া তো এসব কথা কেউ জানেনা।সেদিকে আর ভাবতে গেলেন না তিনি।তবে অবাক হয়ে বুঝদার,ধৈর্য্যশীল ছেলেকে দেখতে থাকলেন।যদিও ছেলের ধৈর্য্য সহ্য সম্পর্কে উনার ধারনা আছে।তাই বলে ওই বাচ্চা নিভান ভিতরে ভিতরে এতো অভিযোগ অভিমান জমা করে রেখেছিলো!আজ হয়তো ওর মনে অভিমান অভিযোগ নেই।কিন্তু একটা সময় উনার বিরুদ্ধে এতো এতো অভিযোগ জমেছিলো!যা ছেলেটা কখনো মুখের কথা দ্বারা হোক বা নিজের ব্যবহার দ্বারা,কখনো বহিঃপ্রকাশ করেনি। সব চেপে রেখেছিলো নিজের বুকের ভিতর হৃদয় গহীনে!

‘তুই বিশ্বাস করিস,আমি তোর বাবার থেকে তোকে একচুলও কম ভালোবাসিনা?

মুখ তুলে চাইলো নিভান।মায়ের ভারী কন্ঠস্বর!চোখের কিনারা ঘেঁষে জল থৈথৈ!একটু-ও ভালো লাগলো-না। এমনিতেই মা’কে ব্যাথা দিয়ে কথা বলার আগেই তার গলা রোধ হয়ে যায়।বিবেক বাঁধা সৃষ্টি করে!বুকে কাঁপন তোলে।যার কারনে শত অভিযোগ অভিমান পুষলেও মায়ের বিরুদ্ধাচারণ করে একটা কথাও ঠোঁটের আগায় আনিনি কখনো নিভান।আনতে পারিওনি!সেই মায়ের চোখে জল!ডানহাত এঁটো থাকায় বাম হাত বাড়িয়ে দিয়ে মায়ের চোখের জল মুছে দিলো নিভান।অমায়িক দৃঢ় কন্ঠে বললো।

‘এতো বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে কেনো!মা তুমি আমার।তুমি ভালোবাসলেও আমার মা,না বাসলেও আমার মা।একটু কমবেশি ভালোবাসলে কি তুমি মা, আমার মা থাকবেনা? বাতিল হয়ে যাবে?না-তো!আমার মা তো আমারই থাকবে।সেখানে এতো বিশ্বাস অবিশ্বাস দিয়ে কি হবে।তবে তোমাকে কিন্তু আমি বাবার থেকে একটু কম ভালোবাসি।এই বিশ্বাসটা নিশ্চয় পুষে আছে মনে?

‘থাকবেনা কেনো!সত্যিই তো তুই আমার থেকে তোর বাবাকে বেশি ভালোবাসিস।

মায়ের বিশ্বাসভরা দৃঢ়কন্ঠের বাচ্চামোতে নিভান আবারও হাসলো।এবার ঝলমলে দন্তের কিছুটা অংশ দেখা গেলো।সহসা খাবার রেখে হঠাৎ দু-হাত দু’দিকে প্রসারিত করলো নিভান।নীহারিকা বেগমের সেই কাছে ডাকার আহ্বান একটু বুঝতে সময় লাগলো। আর বুঝে উঠতেই হুড়মুড়িয়ে পড়লেন ছেলের বুকে।এবং মৃদু শব্দ করে কেঁদেই ফেললেন।নিভান কতো যত্নের আহ্লাদের ছেলে ছিলো আওসাফের।আর সেই ছেলেকে তিনি কতো অযত্নে অবহেলায় মানুষ করলেন!নিভান মায়ের মাথা হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।ফের বললো–তুমি যেমন আমাকে বাবার থেকে একচুল কম ভালোবাসোনা।আমিও তোমাকে বাবার থেকে একতিলও কম ভালোবাসিনা।অভিমান অভিযোগ যাই থাকুক না কেনো মনে,খুব ভালোবাসি মা।

নীহারিকা বেগম নিভানের সেকথায় বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।বরং নিজের মনের মধ্যে চলা আকুলতা প্রকাশ করে বললেন।

‘পরকালে আমি তোর বাবার সম্মুখে গিয়ে কি করে দাড়াবো নিভান?তার এতো আদরের ছেলেকে আমি যে নিজের সুখের জন্য বড্ড অবহেলায় মানুষ করেছি,তার কি জাবাব দেবো?এবার তোর বাবার কবর যিয়ারত করতে গেলে,তারকাছে আমার হয়ে একটু ক্ষমা চেয়ে নিস বাবু।নাহলে যে আমাকে তার সামনে গিয়ে কঠিন অপরাধী হয়ে দাড়াতে হবে!

‘আর তোমার নামে সালিশ নিয়ে গেলে বুঝি বাবা আমাকে ছাড়বেন!বাবা কি তোমাকে কম ভালোবাসতেন!নিশ্চয় তিনি তোমার পরিস্থিতি বুঝবেন।আর পরকালে যদি আমাদের একসাথে থাকা হয়।তিনি কখনো তোমাকে দোষী ঠাওরাবেন না।আমি দোষী ঠাওরাতে দেবোনা মা।বাবাকে খুব ভালোবাসী তাই বলে তোমাকে কম নয়।এইযে তুমি কাঁদছো না,বাবা এটাতে আরও আমার উপর অসন্তুষ্ট হবেন।কেনো আমি তোমার চোখে জল আসতে দিলাম!

বলতে বলতে নিভানের গলার স্বরও কেমন রুদ্ধ হয়ে এলো।মা ছেলের এই আবেগঘন দৃশ্য আরও একজন দেখলো।সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে ইভান নিষ্পলক চোখে দেখে গেলো।সামন্য বিষয়েও সে মা বাবাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। আঙুল তুলে অভিযোগও করেছে।অথচ তার চাওয়া পাওয়া কখনো কি অপূরনীয় রেখেছেন বাবা মা?রাখেন নি!বরং চাওয়ার আগেই সবকিছু পেয়ে গিয়েছে সে।অথচ দাদাভাই পেয়েছে কি!
হয়তো এখন সাফল্য তার নাকের ডগায়।তাকে চেনে সবাই একনামে।তবে সাফল্য তো সবকিছু নয়।সাফল্যর বাহিরে একটা পরিবার থেকে যে আদর ভালোবাসা তার পাওয়ার কথা ছিলো,তা তো সে পায়নি।বরং বিনিময়ে কতোকিছু সহ্য করেও মুখ থেকে কখনো একটা কটুবাক্যও বের করেনি।মায়ের প্রতি তীব্র অভিমান অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও,তা কখনো প্রকাশ করেনি।বাবা মায়ের বিরুদ্ধাচারণ করিনি।চুপচাপ সব সয়ে গেছে!সেই ওইটুকু বয়স থেকে এতোকিছু!সইলো কিভাবে !সে পারতো?কখনোই না!কেনো সে দাদাভাইয়ের মতো হতে পারিনি!আসলে কি সবাই নিভান হতে পারে?পারেনা!নিভান হয় হাজারে একজন।একশো পার্সেন্টেজে দশজন।সেই দশজনের একজন তার মায়ের ছেলে আর তার দাদাভাই নিভান।তার দেখা শ্রেষ্ঠ ভাই।

মা’কে এতো এতো স্বান্তনা বানি আওড়িয়ে চুপ করিয়ে, খাইয়ে,নিজে খেয়ে তারপর এবার বউয়ের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো নিভান।সে বাড়িতে এসেছে মেয়েটা শোনেনি?
না-হলে তার দেখা নেই কেনো?নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে?
ঘুমিয়ে পড়লে তো মুশকিল! তবে নানুমার সম্মুখ দিয়ে কিভাবে নিয়ে আসবে মেয়েটাকে?আর ইদানীং ওই মেয়েটাকে ছাড়া নিভানের দিন-রাত!উফফ!নানুমার রুমের দরজা মৃদু খোলা।ভিতরে ফকফকা লাইট জ্বলছে।সেই মৃদু ফাঁক থেকেই দেখা গেলো,নানুমা পায়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে বেড হেলান দিয়ে বসে আছেন।আর তারপাশে কৌড়ি ঘুম।ঘুম নাকি চুপচাপ চোখ বুঁজে শুয়ে আছে নিভান বুঝতে পারলোনা।দরজায় মৃদু শব্দ করে অনুমতি চাইলো নিভান।

‘নানুমা আসবো?

বৃদ্ধা চোখ তুলে তাকালেন।হঠাৎ মুখে মৃদু হাসি ফুটলো উনার।বললেন—এসো এসো।

নিভান ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো–খবর কি?শরীর ঠিকঠাক আছে তো আপনার?

ভদ্রমহিলা একটু রসিকতা করে বললেন –আমার খবর নিতে এসেছো নাকি বউকে?

‘দুটোই।এবার বলুন শরীর ঠিক আছে আপনার?

‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কি খবর?

‘আলহামদুলিল্লাহ।

নিভান এরমধ্যে কৌড়িকে দেখলো।মেয়েটা ঘুমে বিভোর।আজ চারদিনে নিভান খুব ভালো করে বুঝে গিয়েছে, তার বউটা ভিষণ ঘুমকাতুরে।ঘুম পেলে সে জায়গা দেখেনা, ঘুমিয়ে পড়ে।কাল কি সুন্দর শান্ত বাচ্চাদের মতো তার বুকের উপর ঘুমিয়ে থাকলো। যতক্ষণ না নিভান নিজ থেকে নাড়ালো ততক্ষণ মেয়েটা নড়েনি।চুপচাপ তাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থেকেছে।আজ চারদিনে বুকের ভিতরের সাথে সাথে বাহিরটাও জুড়ে নিয়েছে মেয়েটা।মেয়েটার স্পর্শ না পেলে যেনো প্রশান্তি পাওয়া যায়না।

‘রাত তো অনেক হয়েছে, এখনো জেগে আছেন?শরীর খারাপ করবে তো!ঘুমিয়ে পড়ুন।

নিভান উঠে দাড়ালো।নানুমার সম্মুখ দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।লজ্জা এমনটা নয়।তবে সমীহ বলে একটা কথা তো থেকে যায়।সম্পর্ক যতোই কাছের থাকুক না কেনো,সমীহের দেয়াল কখনো কোনো সম্পর্কে ভঙ্গ করেনি নিভান।সব সম্পর্কে সম্মান,স্নেহ শ্রদ্ধাবোধের সাথে সাথে সমীহটা বজায় চেষ্টা করেছে।আজ নাহয় না ঘুমালো সে!কথা বলতে নানুমার পাশে এসে বসেছিলো নিভান।সেখান থেকে উঠে কথাগুলো নানুমাকে উদ্দেশ্য করে বলে দরজার দিকে পা বাড়াতেই বৃদ্ধা ফের রসিকতা করে বললেন–‘বউ নিতে এসেছো। না নিয়েই চলে যাচ্ছো যে?

থেমে গেলো নিভান।মনটা উল্টো গান গাইলেও,পিছে ফিরে কৌড়ির দিকে তাকিয়ে বললো—ঘুমিয়ে আছে তো!নিয়ে যাবো কিকরে?

‘তবে এতো লম্বা চওড়া রিষ্টপুষ্ট শরীরখানা কিসের জন্য শুনি? একটা ফিনফিনে পাতলা মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যেতে পারবেনা!’তা তাকে এখান রেখে ঘুম হবে তো তোমার?

নানুমার রসিকতায় এবার মৃদু হাসলো নিভান।বললো —
‘চেষ্টা করে দেখি।

‘চেষ্টা করতে হবেনা বাপু।তোমার বউ তুমি নিয়ে যাও।আমিও স্বস্তিতে থাকি তুমিও শান্তিতে ঘুমাও।

নিভান ঘুরে এগিয়ে এলো।যেখানে নানুমা নিজেই বলছেন সেখানে সমীহ দেখানোর আর প্রয়োজন পড়ে না।বেডের কাছ এসে কৌড়ির দিকে তাকিয়ে বললো—আমার বউটা তো শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে,সে আপনাকে অস্বস্তি দিলো কিকরে?

ভদ্রমহিলা হাসলেন।বললেন–এইযে তােমার বউয়ের বরটা যখন তখন এসে আমার রুমে হানা দিতে পারে,তারজন্য পাহারাদার হয়ে বসে আছি।এটা আমার স্বস্তি হরণ নয় বলছো?আর দ্বিতীয়ত আমার নাতি তার বউটাকে ছাড়া শান্তিতে থাকবেনা জেনে আমি কিকরে স্বস্তিতে থাকি মশাই?

‘তাই তো!আমার বউয়ের বরটার হয়ে এতো কিছু চিন্তা ভাবনা করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ভালোবাসা নানুমা।

নিভান মৃদু হাসলো।মাথা নিচু করে ধপ করে পাতলা শরীরটাকে কোলে তুলে নিলো সে।ভদ্রমহিলা এবার রসিকতা ছেড়ে বেশ অমায়িক নম্রসূলভ কন্ঠে বললেন–ও-কে খাইয়ে দিয়েছি আমি।খেতে চাইছিলো না,তবুও জোর করে কয়েক লোকমা খাবার খাইয়ে দিয়েছে।রাতের ঔষধটা খাওয়া হয়নি তবুও ওর ঘুমটা ভেঙো না।কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছে।হয়তো শরীরটা ভালো লাগছিলো না তাই। ঘুমটা প্রয়োজন।

নিভান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে নানুমার রুম থেকে বের হলো।রুমের বাহিরে পা রাখতেই কৌড়িকে বুকের সাথে শক্তবাধনে চেপে ধরলো।এতোক্ষনে মনেহয় শান্তি পেলো ভিতর বাহিরটাজুড়ে।খোলা বারান্দার করিডোরের আলোতে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো,মেয়েটা তখনও ঘুমে বিভোর!শুধু ক্ষনে ক্ষনে ঘনো নিঃশ্বাস ছাড়া তার আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।কিছু ছোটো খাটো এলোমেলো চুল চোখমুখ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।আনমনেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো নিভানের।মাথা নিচু করে পরপর নরম স্পর্শে চুমু খেলো বউয়ের কপাল,গালে।ফের কাব্যিক স্বরে আওড়ালো।

সুখের আড়ালে যাতনা ছিলো মন-পাড়াতে,
সেই যাতনা ভুললো মোর হৃদয়,তোমার আগমনে।
যাতনা ভুলিয়ে ডানা মেলে সুখ সুখ নিয়ে এলে তুমি।
সৌভাগ্যের পদচারণ হয়ে আমার জীবনে।

চলবে…..

#ফুলকৌড়ি
(৫৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সারাদিনের অবসাদ ক্লান্তি এক নিমিষেই যেনো দূরীভূত হয়ে গেলো মেয়েটার সান্নিধ্যে পেয়ে।সামন্য স্পর্শের এতো শক্তি যে,একজন সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমী ব্যক্তিকে নিমিষেই সেই স্ত্রী স্পর্শদ্বারা শান্তি দিতে পারে!
ক্লেশে ভরা মনমস্তিস্ককে মূহুর্তেই প্রশান্তিতে ভরে তুলতে পারে!এতো মহাত্ম গুন দিয়ে সৃষ্টিকর্তা সৃজন করেছেন তাদের!তবে এজন্য কি প্রতিটি পুরুষের সঙ্গীনি করে একজন হালাল স্ত্রী নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রভু?আর তাদের মধ্যেই স্বামীজাতিদের শান্তি, সুখ, সমৃদ্ধি নির্গত করেছেন!যা সেই হালাল স্ত্রী মধ্যে খুঁজে নিতে বলেছেন অন্যত্র হারাম স্ত্রীর মধ্যে নয়!পুরুষের শারীরিক মানসিক শান্তি প্রশান্তির উত্তম সঙ্গীনি হওয়ায় কারনেই কি তবে সে অর্ধাঙ্গিনী?হ্যা তাই!নাহলে নিভানের অবসাদে ভরা ক্লান্ত শরীরটা কিকরে মহূর্তেই অবসাদ কেটে গিয়ে সতেজ স্নিগ্ধ হয়ে উঠলো!ক্লেশে ডুবে থাকা মস্তিষ্কটা হঠাৎই কিকরে পরম শান্তি শান্তি অনুভব করলো!আলগোছে হাসলো নিভান।হাতের বাঁধন দৃঢ় করে মেয়েটাকে আরও একটু কাছে টেনে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে জড়িয়ে নিলো।কৌড়িও একটু নড়েচড়ে আবার চুপ হয়ে গেলো।মাথার নিচে আরও একটা বালিশ এঁটে মাথা উচু করে সেই চুপচাপ ঘুমন্ত মেয়েটাকে দেখলো কিছুক্ষণ।এক টুকরো ঝলমলে চাঁদ যেনো তার বুকটাজুড়ে চুপচাপ শুয়ে আছে।আর তার কিরণে ঝলমলিয়ে উঠছে আশপাশটা!নিজের বুকের উপর রাখা কৌড়ির ফর্সা হাতটা নরম স্পর্শে নিজের হাতের মধ্যে নিলো নিভান।স্থির মুগ্ধ চোখে তা দেখলো কিছুপল।ফর্সা হাতে মেহেদী রঙটা মিলিয়ে এসেছে প্রায়!মেহেদীর রঙটা মিলিয়ে এলেও হাতের সৌন্দর্যতা মোটেও নষ্ট হয়নি।ফর্সা চিকনচাকন হাতটা বেশ আকর্ষণীয়।পুনরায় হাতটা বুকে চেপে ধরলো নিভান।মেয়েটা গভীরঘুমে বিভোর।তার ঘনো উষ্ণ শ্বাসগুলো বুকের সর্বত্র ছেয়ে যাচ্ছে।আপনমমেই চোখ বুঁজে নিলো নিভান।হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠলো তার।হোয়াটসঅ্যাপে কেউ কল দিয়েছে।এতো রাতে আবার কে?চোখ খুলে,বেডটেবিলটা থেকে ফোনটা নিলো নিভান। কলদাতার নাম দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটলো তার।পুনরায় হাত বাড়িয়ে বেডটেবিলটার উপরে থাকা ল্যাম্পস্যাডটা জ্বালিয়ে দিলো।ফের ভিডিও কলটা রিসিভ করতেই ওপাশের হাস্যজ্বল এক রমীনিকে দেখা গেলো।তিনি কথা বলার আগেই নিভান তাকে সালাম জানালো।সে উত্তর দিতেই নিভান বললো–আমার কথা মনে পড়লো তবে তোমার?

‘মনে পড়লো মানে?বিয়ের দিনও তো কথা বললাম।আজ দু’দিন তুই ব্যস্ত এজন্য কথা বলতে পারিনি।ঈশির কাছে শুনলাম,ওবাড়িতে গেছিস।তাই আর বিরক্ত করি নি।এখন তোর সাথে কথা বলার আগে ফুপির কাছে ফোন দিয়েছিলাম।শুনলাম বাড়িতে এসেছিস,তাই কল দিলাম।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।স্যরি।আর এতো এতো কৈফিয়ত দিতে হবেনা।

‘স্যরি কি!তুই আমাকে মনে করে ফোন দিস কখনো?বরং আমিই তোকে ফোন দিয়ে খোঁজ নেই।দু’দিন ফোন দিয়ে খোঁজ নিলাম না ওমনি অভিযোগ?

নিভান হাসলো।তার বড়োমামার দুই মেয়ে।ছোটোজন ঈশিতা।আর ইনি বড়।নাম নিশিতা।এই দুই বোনের ভুমিকা তার জীবনে অস্বীকার্য।তাদের জীবনে তারা
তাকে এতো প্রায়োরিটি,এতো আদর যত্ন ভালোবাসা দিয়েছে।যা কখনো ভুলবার নয়।নিভান কখনো ভুলতে পারবেনা।নিশিতার অভিযোগে নিভান নরম গলায় বললো–আচ্ছা আবার ‘স্যরি।ওকে।

ইট’স নট ওকে।বিকজ আমি তোর বউকে এখনো দেখিনি।দেখিনি বললে ভুল।মান্যতা, ঈশি ওরা পিক পাঠিয়েছিলো।বাট আমার আদরের ভাইয়ের বউটাকে ছবিতে দেখে কি আর মন ভরে?সরাসরি এখনো দেখতে পায়নি।দেখার জন্য মনটা কেমন ছটফট করছে, তুই জানিস।বুঝতে পারছি এখন বাংলাদেশে অনেক রাত।তবুও তাকে দেখার উদ্বেগে এতো রাতে আমাকে ফোন দিতেই হলো।বিশ্বাস কর তোর বিয়েতে যাবার জন্য মনটা যে কি ছটফট করেছে,কি বলবো তোকে।পারলাম না।যাই হোক,ওসব বাদ দে।তা কৈ সে?দেখা আমাকে।

নিভান একটু অপ্রস্তুত হলো।বুকে শয়নরত রমনীকে একপলক দেখে নিয়েই পুনরায় ফোনে নজর দিলো।নজর ফোনে থাকলেও অনুভব করতে পারলো,কৌড়ি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।একহাতে তাকে কাছ থেকে সরানো সম্ভব নয়!নিভানও চাইছেওনা,কাছ
থেকে মেয়েটাকে সরিয়ে দিতে।তাই প্রসঙ্গ এড়াতে বললো—আপু,উদয় উচ্ছ্বাস কোথায়?আর ভাইয়া?কেমন আছে সবাই।

লন্ডনে তখন সন্ধ্যা ছয়টা।ড্রয়িংরুমের দিকে একপলক তাকালো নিশিতা।ফের বললো–ওরা সবাই ড্রয়িংরুমে।আমি ওদের জন্য নাস্তা রেডি করছি আর তোর সাথে কথা বলছি।যাই হোক ওদের কথা বাদ দে।
আরেহ দেখা ওকে।

চুলের আঁচে বসানো ফ্রাইপ্যানে কি যেনো ভাঁজছে নিশিতা।তা দেখতে পেলোনা নিভান।তবে বোনের সুশ্রী চেহারার কর্মব্যস্ততা অনুভব করতে পারলো বেশ।সময় নিয়ে বললো–ফোনের ভিডিও কলে দেখা আর পিকে দেখা, সেই সমান কথাই তো হলো।তা না করে তুমি একেবারে সামনাসামনি দেখো না-হয়।

‘সমান কথা নয়।বিয়ের সাজগোজে দেখা আর সাধারণভাবে দেখা সমান কথা নয়।আমারও কবে বাংলাদেশে আসা হবে তারও ঠিক নেই।ততদিন পর্যন্ত তাকে সামনাসামনি দেখার জন্য কি আমি বসে থাকবো?দ্বিতীয়ত বিয়ের সাজগোজের যে পিকগুলো আমি দেখেছি,তা দেখে আমার মন তৃপ্ত হয়নি।ঈশিতা আম্মা, সবাই তোর বউয়ের প্রশংসায় এতো পঞ্চমুখ!আমার তাকে দেখার তৃষ্ণা, তারসাথে কথা বলার ইচ্ছে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।আজ দুদিন তুই ব্যস্ত ছিলি,তাই চেয়েও কল দিয়ে ডিস্টার্ব করতে পারিনি।তৃতীয়ত আমার গোমড়ামুখো ভাইটা কোন চাঁদমাখা মুখখানা দেখে এতো পাগল হয়ে দু’দিনের মধ্যে বিয়ে করে নিলো,সেই চাঁদ মুখখানা আমিও একটু দেখি।

শেষের কথাগুলো একটু ফাজলামো করে মজার ছলেই বললো নিশিতা।বিনিময়ে নিভান মৃদু হাসলো।পুনরায় বাহানা দিয়ে বললো– ‘ও ঘুমিয়ে গেছে আপু।

‘তো।ঘুমালে নতুন বউকে দেখা নিষেধ নাকি।সত্যি বলতে সবার প্রশংসায় ওকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ভাই।আরেহ দেখা না?আমি বুঝলাম না ওকে দেখাতে তোর সমস্যা কোথায়?

নিশিতার নাছোড়বান্দামীতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নিভান।আসলেই তো তাকে দেখাতে সমস্যা কোথায়?যাই হোক দেখাতে সমস্যা কোথায় এটা যদি আপুকে সে বোঝাতে বা বলতে পারতো।আবারও একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে,
ফোন ঘুরিয়ে ঘুমন্ত কৌড়িকে দেখালো নিভান।এলোমেলো অবিন্যস্ত চুল ।সুন্দর একটা গোলগাল মুখ।ল্যাম্পস্যাডের কমলাভাব আলোতে সৌন্দর্যের উজ্জ্বলতা যেনো ঠিহরে পড়ছে।কি নিস্পাপ বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা!

‘মাশাআল্লাহ।নজর না লাগুক কারুর।সবাই যে প্রশংসা করেছে আলহামদুলিল্লাহ তারচেয়ে খুবই সুন্দর।ভাই, ও নাকি খুব শান্তসূলভ?

বউয়ের প্রশংসায় হাসি মুখটা আরও একটু প্রসারিত হলো নিভানের।ফের নিশিতা প্রশ্ন করতেই হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো।সেটা দেখে নিশিতা বললো–আমার ভাইয়ের ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে পছন্দও মার্জিত,রুচিশীল মনাতেই হবে।তবে তুই কিন্তু আমাদের সেই ভদ্র-সদ্র নিভান আর নেই।বেশ নির্লজ্জ হয়ে গেছিস!

এতোসময় ফোনের স্কিনে নজর রেখে কৌড়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও,মেয়েটা কোথা শুয়ে আছে নজর পড়তেই চোখ সরিয়ে শেষের কথাগুলো বললো নিশিতা।সেটা বুঝে নিভান কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নিশিতার পিছন থেকে পুরুষালী গলায় কেউ
বললো–ওর আর দোষ কোথায়?দোষ তো তোমারই।রাত চৌদ্দটার সময় নব বিবাহিত দম্পত্তিরদের ফোন দিয়ে এমনিতেই বিরক্ত করলে,তারউপর নাছোড়বান্দার মতো বউ না দেখে ছাড়বে-না।বান্দা এতো বাহানা দিচ্ছে তুমি তো শুনলেই না।বউ না দেখে ছাড়লেই না।এখন দোষ ওর উপর চাপাচ্ছো? ওকে দিচ্ছো?

‘এই তোমাকে উপদেশ দিতে এখানে ডাকা হয়েছে?তুমি আমার কথায় নাক ঢুকাতে আসলে কেনো?

‘যাক বাবাহ,সত্যি কথার কোনো ভাতই নেই।

‘জানো যখন তোমাকে উপদেশ দিতে ডেকেছে কে?আর নির্লজ্জামীগুলো তোমরা বোন জামাইরাই শিখাচ্ছো পড়াচ্ছো,আমাদের ভাইগুলোকে।আমি ঈশির থেকে শুনেছি,নিভান বিয়ের ঘোষণা দিতেই সজীব (ঈশিতার বর)ওকে আবোলতাবোল বলে শিখিয়ে লজ্জা ভাঙিয়েছে।তোমাদের মুখে তো সারাক্ষন নির্লজ্জ কথা লেগেই থাকে।সারাদিন কানে সেসব বাণি ঢুকতে থাকলে আমার ভাইয়ের আর কি দোষ!

‘তোমার ভাই নিরিহ!দোষ এখন সব আমাদের!আশ্চর্য!

দু’জনের ঝগড়া দেখে নিভান আশ্চর্য!যেকোনো টপিকে এরা এরকম ঝগড়া করে এটা সে জানে।তবুও এখন?ফোনের ক্যামেরা সে ঘুরিয়ে নিয়েছে অনেক আগেই।আশ্চর্য হয়ে দু’জনের ঝগড়া দেখতে থাকলো।একপর্যায়ে নিশিতার হাত থেকে ফোন নিয়ে ওর বর নিভানক উদ্দেশ্য করে বললো–

‘আশ্চর্য শালাবাবু তুমি তোমার আপুকে কিছু বলছো না কেনো?তুমি বলতে পারলে না, বিয়ের পর পাড়ার অতি ভদ্র সভ্য ছেলেটাও নির্লজ্জ হয়ে যায়।তাকে নির্লজ্জতা সেখানো লাগেনা।আর দ্বিতীয়ত যারা বউকে একটু বেশি ভালোবাসে তারা পারিবারিক সমাজে নির্লজ্জ বলেই আখ্যায়িত হয়।সুতরাং বিবাহিত পরবর্তী জীবনে কেউ নির্লজ্জ বললে কথা কানেই তুলবে না।ওকে।

নিভান প্রাণবন্ত হাসলো।ফের বললো–‘ওকে ভাইজান।

পাশ থেকে নিশিতা বললো–ইন্ধন জুগিয়ে আর তোমাদের মতো বানিওনা।

দুজনের কেউ কথা কানে তুললো না।তারা তাদের মতো কথা চালিয়ে গেলো–তা তোমার মিসেসের শরীর এখন ভালো আছে?আমাদের এখানে কবে আসছো শালাবাবু?

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনাদের ওখানে তাড়াতাড়ি যাওয়া হবেনা ভাইয়া।সামনে ওর এডমিশন আছে।আপতত তারও প্রস্তুতি নিতে হবে।আর আমার ঝামেলাটা তো জানেনই।তবে ওর এডমিশন পরিক্ষাটা হয়ে গেলে,দেখি কোথায় কি হয়।তারপর আসার চেষ্টা করবো।

‘চেষ্টা নয়।আসতেই হবে।আর আসার টিকিট কিন্তু আমার।তোমার আপু তোমাদের জন্য গিফট অলরেডি পাঠিয়ে দিয়েছে।আমার পক্ষ থেকে এখানে আসার টিকিটটা উপহারসরূপ তোলা রইলো।না বলতে পারবেনা।আর না বললেও আমি শুনছি না।ওকে।

‘আচ্ছা সে নাহয় দেখা যাবে।

‘দেখা যাবে কি তোমার বাচ্চা বউটার এডমিশন পরিক্ষাটা হয়ে যাক, তারপর আমিই দেখছি।

প্রতিত্তোর করলোনা নিভান।
মানুষটা অমায়িক চরিত্রের।বোনের থেকে কম স্নেহ যত্ন পায়নি নিভান,এই মানুষটার কাছে।মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান এমনিতেই চলে আসে।যতোই সফলতায় ডুবে থাকুক,এসব মানুষের মুখের উপর যেকোনো বিষয়ে না বলে তাদের যত্নগুলোকে ছোটো করতে বা খোয়াতে রাজি নয় নিভান।সফল ব্যাক্তি হয়েও নিজকে বড় দেখাতে পারে না সে।আরও কিছুক্ষণ কথা চললো দুজনের মধ্যে।একটা সময় দু’জনের আলাপ শেষ হতেই ফোনটা ফের নিশিতা নিলো।নিভানকে বললো–ভাই ওকে আবার একবার দেখা।

‘তুমি আমাকে আবার নির্লজ্জ বলবে।

‘বলবো না। দেখা না!একটা কাজ বাকি আছে।

নিশিতার বাহানা দেখে ওঁর স্বামী ভদ্রলোক চলে গেলেন।নিভান এবার বিনা সংকোচে ফোনটা ঘুরিয়ে কৌড়ির দিকে ধরলো।ফোনের স্কিনে ঘুমান্ত সুন্দর মুখটা ভেসে উঠতেই মুখ এগিয়ে ফোনের স্কিনে কৌড়ির কপালে চুমু দিলো নিশিতা।ফের বললো–এই আদরটুকু ওর পাওনা ছিলো।হয়ে গেছে।এবার রাখ।আর কাল ওরসাথে আমাকে অবশ্যই কথা বলিয়ে দিস।পার্সেল রিসিভ করে জানাস,কেমন হয়েছে।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।

‘রাখছি তবে।আল্লাহ হাফেজ।

ফোন কাটতে যাবার আগেই নিভান তাকে ডেকে উঠলো–আপু।

‘কি হয়েছে?কিছু বলবি?

‘স্যরি।

‘কেনো?তখন নির্লজ্জ বললাম তাই?আরেহ ওটাতো আমি এমনিতেই বলেছি।তবে এমনিতেই বললেই কি, আজ যেভাবে মেয়েটাকে আগলে রেখেছিস,সারাজীবন ওভাবেই আগলে রাখিস বাবু।

‘সেটার জন্য না।

‘তবে?

‘তোমাদের আসার অপেক্ষা না করে বিয়ে করে নিলাম। যেখানে তুমি বা তোমরা আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।অথচ গুরুত্ব দিলাম না।

‘ইটস ওকে বাবু।আমি কিচ্ছু মনে করিনি।বরং খুব খুশি হয়েছি,তুই নিজ থেকে কাউকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইছিস!বিয়ে করেছিস।আলহামদুলিল্লাহ।

থ্যাঙ্কিউ এন্ড লাভ ইউ,আপু।

‘লাভ টুহ্ বাচ্চাসোনা।খবরদার কাল মনে করে ওরসাথে আমাকে কথা বলিয়ে দিস।কেমন?

নিভান মৃদু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।পুনরায় আল্লাহ হাফেজ জানিয়ে কথার পরিসমাপ্তি ঘটালো দুজনে।

ফোনটা রেখে কৌড়ির দিকে তাকালো নিভান।মেয়েটা কেমন গুটিয়ে এসে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে।কথা বলার মধ্যেও অনুভব করেছে,মেয়েটার বারবার কুঁকড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরা।কেনো?ঠান্ডা লাগছে নাকি?সহসা হাত বাড়িয়ে কৌড়ির গাল,গলা এবং খোলা হাতের অংশ ছুলো নিভান।বেশ ঠান্ডা।তড়িৎ এসির দিকে তাকালো 18c দেওয়া।তাও আবার কুল মুডে।তখন বাহির থেকে এসে অতিরিক্ত গরম লাগায়,এতো কমে তাপমাত্রায় দিয়ে রেখেছিলো নিভান।তারপর আর কমানো বাড়ানো হয়নি।তারকাছে তাপমাত্রা স্বাভাবিক লাগলেও হয়তো কৌড়ির জন্য স্বাভাবিক নয়।বেড টেবিল থেকে এসির রিমোটটা নিয়ে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিলো নিভান।তবুও কৌড়ির ঠান্ডাভাব কমলো-না।সেটা বুঝে পায়ের কাছ থেকে চাদরটা পা দিয়ে টেনে নিয়ে জড়িয়ে দিলো।উষ্ণতা পেতেই,তাকে ছেড়ে দিয়ে চাদটা জড়িয়ে নিয়ে সেরে যেতে চাইলো কৌড়ি,তা কেমন অদ্ভুত চোখে অবলোকন করলো নিভান।তবে কাছ থেকে কৌড়িকে সরতে দিলোনা।বরং গায়ের থেকে চাদরটা সরিয়ে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা আবার তার কাছ ঘেঁষে উষ্ণতা খুঁজলো।নিভানের বুকের কাছের টিশার্ট খামচে ধরে তার শরীরে মিশে যেতে চাইলো।পায়ের ফাঁকে পা গলিয়ে দিলো।মুখ গুঁজে দিলো তার গলার ভাঁজে।অতঃপর সব বুঝেও নিভান চুপচাপ কিছুক্ষণ বউয়ের ঘুমের ঘোরের কর্মকাণ্ড শান্ত চোখে দেখলো।মেয়েটা অদ্ভুত ঘুমকাতুরে আজ কয়েকদিনে তা বেশ উপলব্ধি করেছে নিভান।তাই বলে এতো গাঢ়!এইযে একটা মানুষ তাকে অন্য রুম থেকে তুলে আনলো।আরেকটা বেডে শুইয়ে দিলো।এতোসময় ধরে ফোনে কথা বললো।অথচ বউটা তার জাগলোই না? এতো ঘুৃম কাতুরে যে,কিচ্ছু অনুভব করতে পারলো-না?আশ্চর্য!

নিভান হাসলো।উষ্ণতা খুঁজে ফেরা শরীরটাকে মূহুর্তেই নিজের শরীরের উপর তুলে নিলো।হাতের কাছে টেনে রাখা চাদরটা কৌড়ির পিঠের ওপর দিয়ে দুজনকে জড়িয়ে নিলো।কৌড়ি একটু নড়েচড়ে ফের শান্ত হয়ে গেলো।সেটা খেয়ালি চোখে দেখে,কৌড়ির মুখের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিলো নিভান।নিটোল ছোট্টো ফর্সা কপালটা উন্মুক্ত হতেই সেখানে প্রগাঢ় একটা চুমুও বসালো সে।ফের ডান হাতটা কৌড়ির পিঠের ওপর দিয়ে তাকে নিজের সাথে আগলে রেখে বাম হাতটা নিজের মাথার নিচে রাখলো নিভান।সুগভীর শান্ত চোখজোড়া তার কৌড়ির সুশ্রী মুখে।এখান থেকে কয়েকদিন আগেও সে একা ঘুমাতো।মেয়ে মানুষের সান্নিধ্যে পছন্দ না থাকায় তখনো অনুভব হয়নি,এরকম এতো কাছে কাওকে আদর যত্নে বুকে আগলে রাখাতেও চরম সুখ।অনাবিল প্রশান্তির।স্বর্গসুখ কেমন জানা নেই নিভানের।তবে মেয়েটাকে কাছ পাওয়ার পর যে প্রশান্তি, সুখ সে শরীর মনে অনুভব করে,তা পুরুষ হিসাবে উপলব্ধি করা দুনিয়ায় স্বর্গসুখই বলা যায়।

এখন মনে হচ্ছে তার জীবনে কৌড়ির আগমনটা আরও কিছুদিন আগে আসা উচিত ছিলো!না না,হয়তো কিছু মাস আগে!সময়টা কিছু বছর আগে আসলেও হয়তো মন্দ হতোনা!বরং সব থাকতেও যে নিঃসঙ্গ জীবনের এক একটা একাকিত্ব দিন নিভান পার করেছে,সেই জীবনের সারাদিনের ক্লান্তি অবসাদে ঢাকা শরীর মনের একজন সুখকর সঙ্গী হতো।চাপা স্বভাবের নিভান,সেই সঙ্গীনির কাছে নিজের দুঃখটা ভাগ করতে না পারলেও,এই যে মেয়েটাকে কাছে পাওয়াতে যে সুখ, প্রশান্তি সে, শরীর মনে শান্ত নদীর ধারার মতো বয়ে চলার অনুভূতি অনুভব করছে।অন্তত সেই সুখটুকু পেতো!এরকম টুকরো টুকরো সুখ,টুকরো টুকরো শান্তিই তো চাওয়া পাওয়া ছিলো নিভানের।খুব বেশি চাওয়া পাওয়া তো তার কখনোই ছিলো-না।তবে দেরীতে হলেও ভাগ্য তার সহায় হয়েছে।নাহলে বাবা মারা যাওয়ার পর পরিস্থিতির অনুকূলে পড়ে সবসময়ের ভাবনা অনুযায়ী নিজের জীবনের প্রতি অভিমান অভিযোগী হয়ে নিভান নিজেকে নিন্দা করে গিয়েছে–জীবনে কি আছে তার?সব থাকতেও কি তার বলে এই পৃথিবীতে আদৌও কিছু আছে?জীবনে সাচ্ছন্দ্য জীবিকার অভাব না থাকলেও, সেই জীবনে ভালোবাসা,খেয়াল, আদর যত্নের তো নিদারুণ অভাব ছিলো।যা ভাগ্যক্রমে ঘুচেছে এমন সময় এসে,যে সময়ে এসে আদর যত্নের আর বিশেষ প্রয়োজন পড়েনা।গুরুত্ব রাখেনা।তবে সেই আদর ভালোবাসার খামতি পূরনের জন্য হয়তো ভাগ্যের লিখন তাকে সময়ে এসে বিশেষ উপহার হিসাবে কৌড়িকে দিয়েছে।এখন নিভানের মনে হয়,তার একটা আস্ত সুখকর পৃথিবী আছে।সেখানে পেঁজাতুলোর মতো শুভ্র কোমল একটা বউ আছে।যাকে বুকে জড়ালে সারাদিনের ক্লান্তি,অবসাদ মূহুর্তেই দূরীভূত হয়ে গিয়ে আকাশসম প্রশান্তিতে মনটা ডুবে যায়।যার ছোয়ায় দুঃখগুলো ডুবে গিয়ে সুখ ধরা দেয়।কি অদ্ভুত জীবন।

ঘড়ির ঢং শব্দ ভাবনা কাটলো নিভানের।কৌড়ির মুখ থেকে নজর সরিয়ে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাতেই দেখলো একটা বাজে।ভাবনায় এতো মশগুল ছিলো টেবিল লাইটটাও অফ করতে খেয়ালে নেই।মাথার নিচ থেকে হাতটা বের করে লাইটটা অফ করে দিলো নিভান।পুনরায় হাতটা এনে রাখলো মাথার নিচে।রাত অনেক হয়েছে অথচ ঘুম ধরা দিচ্ছে না চোখে।অথচ তার বুকে শয়নরত নারীটা গভীর ঘুমে বেহুশ।আনমনে হাসলো নিভান।ঘুম চোখে ধরা না দিলেও,এবার চোখ বুঁজে নিলো সে।

ঘুম ভাঙতেই নড়েচড়ে উঠলো কৌড়ি।অনুভব করতে পারলো,কারোর খুব কাছে শুয়ে আছে সে।গায়ের সুগন্ধটা বলে দিচ্ছে মানুষটা কে!নিজের কোমল শরীর,হাত পায়ের অবস্থানও কোথায় কোথায় সেটাও ঘুম কেটে যাওয়া সচল ব্রেনে সহজেই বুঝে নিলো।মানুষটার একটা হাতের উপর শুয়ে আছে সে।অন্যহাতটা তাকে পরম ভালোবাসায় মানুষটার সাথে জড়িয়ে রেখেছে।কৌড়ির মুখ গুঁজে আছে সেই পরম আদরে আগলে রাখা মানুষটার বুকে।সদ্য ঘুম ভাঙা কৌড়ির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটলো।অনুভব করলো মানুষটার সাড়াশব্দহীন শরীরটা বলছে মানুষটা গভীর ঘুমে।সেই সুযোগ নিয়ে কৌড়ি আরও একটু ঘনিষ্ঠ হলো বরের সাথে।ঘুম ভেঙে গেলেও বুঝতে দিলো-না মানুষটাকে।অথচ তার ধারনা ভুল প্রমানিত করে দিয়ে তাকে জড়িয়ে রাখা মানুষটা বলে উঠলো।

‘নামাজ পড়তে হবেনা?

চমকে চোখ খুলে ফেললো কৌড়ি।তারমানে মানুষটা ঘুমিয়ে ছিলো-না?ছিঃ!একটু আগে নিজের করা কর্মে ভিষন লজ্জিত হলো সে।মুখে বলি না ফুটতে চাইলেও কোনোরকম বললো।

‘হুমম।উঠুন।

‘উঠবো কিকরে?

ততক্ষণাত নিজের অবস্থানের কথা মনে পড়তেই হাত পায়ের অবস্থান সরিয়ে নিতে চাইলো কৌড়ি।তবে হতে দিলো নিভান।বরং নিজের হাত পা দিয়ে নিবিড় বাধনে জড়িয়ে নিলো কৌড়িকে।সদ্য ঘুম ভাঙা ঘনো স্বরে বললো—বললাম আর সরে যেতেই হবে?একদম না।তোমার উচিত ছিলো আর-ও কাছে আাসা।বরকে একটু ভালোবাসা।তুমি না ভালোবাসলেও তাকে একটু সুযোগ করে দেওয়া।

লজ্জা পেলো কৌড়ি।মুখ ডুবিয়ে রাখলো, লজ্জা দেওয়া মানুষটার বুকে।সারারাতে ঘুম ভাঙিনি কৌড়ির।কাল রাতে কোথায় শুয়েছিলো আর এখন কোথায় শুয়ে আছে?এখানে কে নিয়ে আসলো তাকে?কিভাবে আসলো?এসব মাথাতে না আনলেও,সকাল সকাল বরের ভালোবাসায় সিক্ত হলো।সে জানে এখানে তাকে কে নিয়ে আসতে পারে! নিভানের দুষ্টমিষ্টি অভিযোগী বার্তার পরিবর্তে নিচু গলায় বললো–নামাজের সময়টা পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।

বুকে নিবিড়বন্ধনে জড়িয়ে রাখা মেয়েটাকে আরও শক্ত করে বুকে চেপে নিলো নিভান।কৌড়িকে আগলে রাখা হাতটা,তার মাথার খোলা চুলের ভাঁজে চলে গেলো।পরম আহ্লাদে মাথার মধ্যে আগুল বোলাতে বোলাতে গলার ঘনো স্বরটা বজায় রেখেই বললো–সকাল সকাল ব্ল্যাকমেইল?ইট’স ভেরী ব্যাড!

বিনিময়ে কৌড়ি হাসলো। যা নিভান দেখতে পেলো-না।তবে অনুভব করতে পারলো।ততক্ষণাত কৌড়ির মাথায় রাখা হাতটা দিয়ে মেয়েটার মুখটা তার বুক থেকে আলগা করে ধরলো নিভান।সকাল সকাল বউয়ের মায়াবিনী মুখের মিষ্টি হাসিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো নিভান।যা রুমের আবাছা নীল আলোটায় বেশ মুগ্ধকর লাগলো। যেদিন থেকে মেয়েটার প্রতি দূর্বলতা অনুভব করেছে,সেদিন থেকেই মেয়েটাকে নিজের নিজস্বতা রূপে চেয়ে এসে নিভান।তবে সে আশা পূর্ণ হবে,মেয়েটাকে এতো কাছে পাবে!এটা কখনো ভাবিনি সে।যদি কখনো কৌড়ি,নিভানের না হওয়ার অস্বীকৃতি জানাতো।তবে হয়তো মেয়েটাকে আর এতো কাছে পাওয়া হতোনা কখনো নিভানের।এভাবে বুকে জড়িয়ে যে শান্তি সুখ মেলে তাও হয়তো আর হতোনা।ভালোবাসাও হতো-না।

কথাগুলো ভাবতেই কেমন যেনো মনটা হাসফাস করে উঠলো নিভানের।কৌড়ির আগলা করে ধরে রাখা মাথাটা পুনরায় হাত দিয়ে চেপে এনে ধরলো নিজের ঠোঁটের ভাঁজে।শুষ্ক ঠোঁটের দীর্ঘ গাঢ় ছোঁয়া বসালো কৌড়ির মৃসণ কপালে।সেখান থেকে সরে এসে কৌড়ির বুঁজে থাকা দুচোখের পাতায় পরম আহ্লাদে নিজের ঠোঁটের আদর ছোয়ালো।এই চোখ দুটো তাকে খুব টানে।মেয়েটাকে খুব খুব ভালোবাসতে বাধ্য করে।এতো মায়াভরা দু’টো চোখ!ওই চোখ দু’টো ভারাক্রান্ত থাকলে, অশ্রু ঝরলে নিভানের কলিজায় গিয়ে বিঁধে।আর এই চোখ দুটো প্রানউচ্ছল থাকলে নিভানের হৃদয় মন সবকিছু শান্তিতে থাকে।ঠোঁটের উষ্ণতা ছুঁইয়ে দিয়ে সরলো নিভান।কৌড়ির মুখের দিকে কোমল নজর ফেলে সময় নিয়ে বললো– আচ্ছা উঠে নামাজ পড়ে নাও।

কৌড়িও ঘুম ঘুম চোখে ঘনোঘনো পলকে বরকে দেখলো কিছুক্ষণ।নব্য বউ হিসাবে সকাল সকাল বরের ভালোবাসায় লজ্জায় মূর্ছা যাওয়ার কথা থাকলেও,মূর্ছা গেলো-না সে।বরং সেই মানুষটার নরম নরম ভালোবাসা কেমন বিগলিত মনে উপভোগ করলো!মানুষটা ছোঁয়া,আদর যত্নগুলো ভিষণ অন্যরকম।ভিষণ আদূরে ছোয়া।খুব দরদী কোমলতা ভরা সেসব স্পর্শে।যেনো নিজেকে কেউ বিন্দু আঘাত না দিয়ে পরম আদরে স্পর্শে ভালোবেসে ছুঁচ্ছে।সব ছোঁয়ায় ভালোবাসা যত্নগুলো যেনো চুইয়ে চুইয়ে পড়ে।কৌড়ির মনেমনে পুরুষ নিয়ে যে ভয়টা ছিলো।তা কেমন ধীরে ধীরে মানুষটার আচারনে কেটে যাচ্ছে।কেটে যাচ্ছে কি, কেটে গিয়েছে।কৌড়িকে চেয়ে থাকতে দেখে নিভান নম্র আদূরি গলায় শুধালো।—উঠবেনা?

কৌড়ির যেনো হুঁশ ফিরলো।নড়েচড়ে উঠতে গিয়েই ওড়নায় টান পড়লো।তা দেখে নিভান মৃদু হেসে হাতটা আগলা করতেই গায়ের ওড়না ঠিক করে কৌড়ি উঠে বসলো।মাথার চুলগুলো আজও খোলা।অথচ স্পষ্ট মনে আছে শোয়ার আগে চুলগুলো বেনী করে শুয়েছিলো।পরপর আজ কয়েকদিন সে বেনীকরে রাখা চুলগুলো সকাল হলেই খোলা পাচ্ছে।কারণটা না জানলেও,চুল খুলে ফেলা ব্যক্তিটা কে?হয়তো সে জানে।তবে চুল খোলার রহস্য কি এটা সে জানতে চেয়ে এই সকাল সকাল প্রশ্নের উত্তরে বিব্রত হতে চাইলোনা।তাই নিঃশব্দে চুলগুলো খোঁপা করে আলস্য ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। ফের ধীর পায়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।পিছনে ফিরে দেখলো না দুটো মুগ্ধ চোখ তার প্রতিটি মুভমেন্ট কিভাবে অবলোকন করে চলেছে!সেই মুগ্ধ চোখের মানুষটার,চোখের সাথে-সাথে মনের মধ্যে-ও মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো।মন প্রার্থনায় গেয়ে
উঠলো।–প্রতিটি সকালের আগমনী বার্তা তার এভাবেই হোক।এই নারীকে ভালোবাসা মধ্যে দিয়েই প্রতিটি ভোর এভাবেই মুগ্ধতায় কেটে সকালের সূর্য উঠুক।তারপর সেই মুগ্ধতার রেশ ধরে সকাল পেরিয়ে দুপুর কাটুক,আর দুপুর পেরিয়ে রাত।আর সেই রাত পেরিয়ে একই মুগ্ধতায় আরও একটা সকাল আসুক তাদের জীবনে।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে