ফুলকৌড়ি পর্ব-৫৪+৫৫

0
2

#ফুলকৌড়ি
(৫৪)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সবুজ সমাহারে দৃষ্টিনন্দিত পরিবেশ।শিল্পীদম্পতি তৌকির আহমেদ এবং বিপাশা হায়াত গড়ে তুলেছেন এই নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট।বিশাল আয়তকার জায়গাজুড়ে চারপাশটা শুধু সবুজঘেরা।বিশাল আয়তকার বলতে প্রায় ২৫ বিঘার জায়গাজুড়ে তৈরি এই অবসর যাপনকেন্দ্রে আছে দিঘি, কৃত্রিম ঝরনা,কনফারেন্স হল, সুইমিংপুল,রেস্টুরেন্ট,একটি আবাসিক ভবন।নক্ষত্রবাড়ী প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসুদের কাছেও অতি জনপ্রিয় নাম। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, পুকুরের পানির ওপর কাঠ-বাঁশ ও ছনের সমন্বয়ে নির্মিত শীততাপনিয়ন্ত্রিত কটেজগুলো।যার বারান্দায় বসে চারপাশের বৈচিত্র্যময় সবুজেঘেরা প্রকৃতি উপভোগ্য বেশ মাধুর্যপূর্ন।রাতের জোছনা বা পূর্ণিমা বিলাসে এর জুড়ি কৃতিত্বপূর্ণ ।প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার আরেক মুগ্ধতা নক্ষত্রবাড়ী।

ভিতরে ঢুকতেই চারপাশটা নজর ঘুরিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলো কৌড়ি।আশেপাশে সবাই উচ্ছসিত।ভিতরে ঢুকেই যেনো ছড়িয়ে পড়লো তারা। গাজীপুর জায়গাটা বিশেষকরে নক্ষত্রবাড়ী রিসোর্ট নিভানের মুখস্থ। মাসে দুই-তিনবার অন্তত এখানে আসা যাওয়া হয় অফিসিয়াল কাজকর্মের জন্য। মুলত বাহিরের ক্লায়েন্টরা যখন তাদের ভ্যারাইটিস ফুডের ফ্যাক্টরিটা পর্যবেক্ষণের পরিদর্শনে আসেন এবং পরিদর্শন শেষে সবকিছু পর্যালোচনার জন্য মিটিং সারতে এই জায়গাটা বেছে নেয় নিভান।মাঝেমধ্যে ক্লায়েন্টরাও নিরিবিলি প্রাকৃতিক কোথাও ঘুরতে চান।তখনও গাজীপুর হিসাবে এই জায়গাটা নিভানের বেশ মনেহয়।সেই সুবাধে ক্লায়েন্টদের মিটিং আওয়ার,প্রকৃতিতে ঘুরেফিরে বেড়ানো,মনপুত খাওয়া দাওয়া,একটু নিরবিচ্ছিন্ন কাটানো,মাসের মধ্যে দুই একবার এই রিসোর্টে হয়ে থাকে।তাই নিভান আর ঘুরলোনা,গিয়ে বসলো আবাসিক ভবনের নিচতলায় ক্যান্টিনে।যেখানে ঘুরতে আসা ভ্রমণকারীদের আলাদা নিরিবিলি বসার সুব্যবস্থা রয়েছে।মুখোমুখি গদিওয়ালা চারসিটের একটা টেবিলে গিয়ে বসল নিভান।বিকালের কমলাভাব সূর্যের রশ্মিটা এসে মৃদুমন্দ লুকোচুরি খেলছে সেখানে।
জানালাহীন খোলামেলা জায়গাটা থেকে বাহিরের পরিবেশটা সাদৃশ্য।নিভান কফি অর্ডায় দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বাহিরের প্রকৃতিতে নজর দিলো।বাহিরের প্রকৃতিতে তো নয়,নিজের জন্য স্পেশাল করে গড়া তুলতুলে পুতুল এক কন্যার প্রকৃতিতে মুলত নির্দিষ্ট তার নজর।সুইমিংপুলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কৌড়ি।সাথে নাফিম।নাফিম উচ্ছসিত হয়ে হাত দিয়ে এটাওটা দেখাচ্ছে হয়তোবা, নয়তোবা কিছু জিজ্ঞেস করছে।দূর সেটা থেকে সেটা অনুধাবন করতে পারলোনা নিভান।তবে এটা অনুভব করতে পারলো, নাফিমের বড়বউমনির মন খারাপ। সে একটু পরপর আশেপাশে,পিছনে নজর ফেলে কাউকে খুঁজছে।ফের হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ বাদে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রকৃতিতে নজর দিচ্ছে।নিভান অনেকটা সময় ধরে শান্ত স্থির নজরে বউয়ের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলো। দেখলো।মেয়েটা, গাড়িতে উঠে সেই যে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসলো।তারপর আর না আশেপাশে চোখ তুলে তাকিয়েছে,আর না গাড়ীর মধ্যে থাকা অন্য কারোর কথায়,হাসি,মজায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, জানিয়েছে।নিভান কিছুক্ষণ পরপর সামনে থেকে নজর সরিয়ে বউয়ের নিশ্চুপতা দেখেছে অথচ সেই খেয়ালও বোধকরি মেয়েটা করিনি।দৃঢ় স্থির নজর ছিলো তার ফর্সা দু’হাতের মুঠোবন্ধনিতে।নিভানও কেনো জানি সেই নিশ্চুপতা ভাঙিনি।মেয়েটাকে চুপচাপ থাকতে দিয়েছে।সম্পর্কে কিছুকিছু সময় হয়তো অন্য মানুষটাকে একটু নিজের মতো করে থাকতে দেওয়া উচিত। খেয়ালী হয়েও, একটু বেখেয়ালি আচারণ করা উচিত।একটু অন্যমনস্কতাও হয়তো মাঝেমধ্যে হওয়া উচিত।তাহলে হয়তো সম্পর্কে একে অপরের প্রতি শারীরিক আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা বাদেও কে কার প্রতি কতোটা যত্নবান,কতোটা গুরুত্বপূর্ন,দু’জনের মর্মস্পর্শীতা,কে কার প্রতি কতোটা বিশ্বাসযোগ্য,ভরসাপূর্ন ঠিকভাবে বোঝা যায়।সর্বপরি ভালোবাসার যত্নশীলতার কার প্রতি কতোটা গাঢ়ত্ব ঠিকঠাক হয়তোবা অনুভাবিত হয়। যেমনটা নিভান অনুভব করে কৌড়ির প্রতি।

কফি চলে আসায় গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে কফিতে মনোযোগ দিলো নিভান।কফি হাতে আবারও শান্ত,স্থির নজর ফেললো সেই মায়াবী রমনীরপানে।মন এমন একটা জিনিস যেখানে নিজের শক্তপোক্ত ব্যাক্তিত্বও যেনো কিছুকিছু মূহুর্তে হেলিয়ে দেয়!মাঝেমধ্যে হয়তো সূর্যের মতো হেলতে হেলতে একটা নির্দষ্ট সময়ের কক্ষে গিয়ে ডুবিয়েও দেয়।সেখানে যেনো আর নিজের অস্তিত্ব কাজ করেনা।অন্যের ভূগর্ভে সমর্পিত হয়ে তাহাতে বিলিন হয়ে যায়।তখন নিজের শক্তপোক্ত ব্যাক্তিত্ব হোক বা কঠিন মন। সমস্ত অনুভূতিরা কেমন নিস্পৃহ কাজ করে।ওই মেয়েটার মায়ায়, ভালোবাসায় নিজের মনটাকে এমন একটা অস্থির বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে নিভান।চাইলেও মেয়েটার সাথে কোনোকারণে অভিমানী অভিযোগী হয়ে দূরত্বটা মনেহয় কখনো গড়া হয়ে উঠবেনা তার।হয়তো মনটা মনোক্ষুণ্ণ হবে,সাময়িক অসন্তুষ্ট হবে তবুও বিপরীতে ওই মেয়েটার মনখারাপ সহ্য হবেনা।নিজের আত্মসম্মানে আঘাত পাওয়ার পর-ও যে মন মানতেই চায়না।,মেয়েটা ভুল করেছে!উল্টে মন নিজেকেই বোঝাতে চায়, মেয়েটা অবুঝ।হয়তো কোনোকারনে অবুঝপনা করে ফেলেছে!তাই বলে তুই অভিযোগী হবি!এ কেমন বুঝদারপনা তোর?এতো ধৈর্য্য এতো সহ্য,ওই মেয়েটার বেলায় এসে কেনো এতো দ্রুত বিচ্যুত হবে!নিস্পৃহ হয়ে পড়বে!কেনো?তার ছোট্টো আদূরে মায়াবী মুখে কালো মেঘদুরের আনাগোনা দেখেও কি বুঝতে পারছিস না,মেয়েটা অনিচ্ছাকৃত ব্যবহার করে ফেলেছে!যা সে নিজেও চাই নি।

‘স্যার অন্যকিছু লাগবে?

ওয়েটার প্রশ্ন করতেই নিভান নজর সরিয়ে ওয়াটারের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো–নো,থ্যাঙ্ক’স।

ওয়েটার চলে যেতেই নিভান পুনরায় নির্দিষ্ট স্থানে নজর দিলো।তবে আর চুপচাপ বসা হলো-না তার।আর না ক্ষনিকের জন্য বেখেয়ালি হওয়া হলো।হাত থেকে কফিমগটা রেখে তড়িৎ উঠে পড়লো সে।কাঠের সেতু তৈরী করা।সেখানে সেতুর মাথায় কাঠের রেলিঙ চেপে দাড়িয়ে আছে কৌড়ি।আর তার পায়ের কাছে বসে উবু হয়ে মান্যতা শাড়ী উঁচিয়ে তার পা দেখছে।নিশ্চয় বেখেয়ালিতে হাঁটতে গিয়ে মোচড় লেগেছে।উফফ!কি যে করে!নিভান দ্রুত হেঁটে চলে গেলো কৌড়ির কাছে।গিয়েই সহসা জিজ্ঞেস করলো—কি হয়েছে?

উত্তর দিলো মান্যতা–পায়ে মোচড় লেগেছে মনেহয়!আমি একটু সামনে ছিলাম।দেখিনি।নাফিমের গলার শব্দ শুনে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি ও ব্যথায় দাড়িয়ে পড়েছে।

নাফিম বললো–হ্যা। বউমনি হাঁটতে গিয়ে পায়ে মোচড় লেগেছে।

তড়িৎ হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো নিভান।সেটা দেখে মান্যতা উঠে দাঁড়ালো।শাড়ী উঁচিয়ে কৌড়ির পায়ে হাত রাখার আগেই কৌড়ি পা টেনে নিলো।নিভান মুখ উচু করে শান্ত স্থির চোখে তাকালো।কৌড়ি কি দেখল সেই চোখে, মূহুর্তেই পা বাড়িয়ে দিলো।নরম,কোমল পায়ে রুক্ষ হাতের নম্র স্পর্শ পেতেই শিরশির করে উঠলো শরীর।
জুতোটা খুব বেশী উঁচু নয়।মিডিয়াম লেবেলের।পায়ে মোচড় খাওয়ার মতো নয়।তবু্ও কিকরে মোচড় লাগলো বুঝতেই সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।পা-টা হালকা চেপে মৃদু ঘুরিয়ে ফিরেয়ে দেখলো।কৌড়ির মৃদু ঘনোঘনো কেপে উঠা টের পেতেই তার মুখের দিকে তাকালো নিভান।শুধালো।

‘ব্যথা পাচ্ছো?

গলায় কারা যেনো সেই কখন থেকে জটপাকিয়ে বসে আছে।স্বর বের হতেই চাইছেনা।নাফিম কখন থেকে তার সাথে বকবক করে চলেছে অথচ এখনো অব্দি একটা কথাও বলিনি ছেলেটার সাথে সে।শুরু থেকে তাকে সঙ্গ দেওয়া বাচ্চা ছেলেটার উচ্ছসিত কথার পরিবর্তে জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে প্রতিটা মুগ্ধকর বাক্যে মাথা দুলিয়ে হ্যা না স্বীকারোক্তি জানিয়েছে।পা মোচড় খেয়ে যখন পড়ে যেতে নিলো, ছেলেটা হাত ধরে আটকালো।সঙ্গে সঙ্গে সামনে থাকা মান্যতাকে মৃদু চিৎকারে ডাকালো।মান্যতা এসেও অনর্গল প্রশ্ন শুধালেও এখনো অব্দি মুখ খোলেনি কৌড়ি।মান্যতা প্রশ্ন শুধিয়েছে আর সে হ্যা না বাক্যে শুধু মাথা দুলিয়ে উত্তর দিয়ে গেছে।আর এখন এমন একটা মানুষ প্রশ্ন শুধিয়েছে,যার উত্তর দেওয়ার জন্য ঠোঁটের আগায় কথা এসেও কান্নারা আটকিয়ে দিচ্ছে।অভিমানী মন বলতে চাইছে,এই বিপত্তিটা তো আপনার জন্যই হলো।
তবে বিপত্তি হয়েছে এবং সে ব্যথা পেয়েছে বেশ হয়েছে!
এটা হয়তো তার শাস্তি!সে আরও ব্যথা পাক,তবুও মানুষটাকে বলবেনা কতোখানি ব্যথা পেয়েছে সে।মানুষটা কতোটা খারাপ হলে মানায়,তার চোখের আড়াল হলেও তাকে চোখের আড়াল করেনি। কেমন সে ব্যথা পেতেই দৌড়ে চলে এলো।নিশ্চয় তাকে নজরের মধ্যে রেখেছিলে।অথচ হাজার খুঁজে ফিরেও তাকে চোখের নাগালে পায়নি কৌড়ি।বলবে না সে কিচ্ছু!হাজার ব্যথা পেলেও বলবে না সে।তখন হুটকরে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ পাওয়ায় ওরকম রূঢ়ভাবে কথাগুলো হয়ে গেছে।যা তার নিজেরও ভালো লাগেনি।তাই বলে তাঁকে একটু বুঝবেনা মানুষটা!কেনো বুঝবেনা!কেনো?কেনো তার চোখের আড়াল হবে!কেনো তার থেকে দূরে দূরে থাকবে মানুষটা!কেনো?

চোখজোড়া টলমলিয়ে উঠলো কৌড়ির।কাছের মানুষ থেকে আদর, ভালোবাসা, আহ্লাদ পেতে পেতে হঠাৎ তাতে ভাঁটা পড়লে,ব্যথা ছাড়া শরীরও মনে হয় ব্যথার যন্ত্রণায় ছটফটায়!মনটা কাতর হয়ে পড়ে!অসহ্য যন্ত্রণায় বুকের ভিতরটা টনটন করে।সেখানে সে-তো ব্যথা পেয়েছে।ব্যথা পেয়েছে শরীরে, ব্যথা পেয়েছে মনেও।আর তারচেয়েও ব্যথার যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে কাওকে ব্যথা দিয়ে।আবার তার ব্যথায় সেই মানুষটাকে ব্যথিত হতে দেখে আরও মন খারাপ হচ্ছে তার।সবকিছু নীরব সহ্য করেও এতো কেনো ভালোবাসে মানুষটা তাকে?কেনো ভালোবাসবে?যার মর্যাদা সে রাখতে পারছেনা,পারিনি!একমন তার হয়ে গাইছে তো অরেকমন ব্যাথা মানুষটাকে নিয়ে গাইছে!মনের দোলাচালে কৌড়ির ভিতরটা ঝড়, তুফান, ঘনোবর্ষার একসাথে আগমনের মতোই নাজেহাল অবস্থা।টলমলা চোখের কিনারা ভেদ করে এবার নোনাজলের স্রোত ভেসে আসতে চাইলো।

‘খুব ব্যথা পেয়েছিস?কাঁদছিস কেনো সোনা?ব্যথা হচ্ছে খুব?

প্রশ্ন শুধিয়ে মাথা নিচু করে কৌড়ির পায়ে খেয়ালি হয়েছিলো নিভান।মান্যতার আহ্লাদিত গলার বাক্যদ্বয় শুনতেই তড়িৎ মুখ উচু করে তাকালো সে।স্বপ্নে দেখা সেই অভিমানী ক্রন্দনরত ঘনোপাপড়ি ভেজা বড়বড় হিরণটানা চোখ!রাজহংসীদের চরে বেড়ানোর মতো দিঘী টলমল পানি সেই হ্রদে।সাথে তীব্র অনুশোচনা ।হৃদস্পন্দন থমকে গেলো নিভানের।কলিজাটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।এই হরিণটানা আঁখির টলমল জ্বল,পায়ের মোচড় লাগার ব্যথার নয়!এতো তাকে না বোঝার অভিমানী অভিযোগী বর্ষন।এই ক্রন্দনরত চোখজোড়া তো তার খুবই পরিচিত।খুব চেনা।নিভান মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো,পুনরায় তা আবার ঠোঁটের ভাজে মিলিয়ে নিলো।সেই হরিনী চোখে অভিমানী জল টলমলালেও ভুলেও তা কিনারা ভেদ করছেনা!মায়াবিনীর অভিমান কি আরও একটু দৃঢ় করবে নিভান?করলে ক্ষতি কি!প্রিয়তমার অভিমান ভাঙানো তো তার মিলি সেকেন্ডের ব্যাপার!কেমন দুষ্ট হেসে মাথা নিচু করেই নিভান বললো।

‘ব্যথা বেশি করছে?

অনেক্ক্ষণ পর অভিমানি রিনরিনে ভারী মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এলো–‘আমার পায়ে তেমন ব্যথা লাগেনি।সামন্য ব্যথা পেয়েছি।ঠিক আছি।

নিভানের হাসি মৃদু থেকে প্রসারিত হলো।কৌড়ির পা-টা তার জুতার উপর আলতোভাবে রেখে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো। –‘এই জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটতে পারবে?গাড়ীতে নর্মাল স্লিপার আছে এনে দেবো?

‘লাগবে-না।আমি ঠিক আছি।

নিভানের হাসিটা আরও একটু প্রস্ফুট হলো।তা পুনরায় ঠোঁটের ভাঁজে মিলিয়ে নিয়ে উঠে দাড়ালো।অভিমান অভিযোগ করার কথা তার!অথচ যে ব্যথা দিলো সেই ব্যথিত হয়ে উল্টো অভিমান করে বসে আছে?এই অদ্ভুত কর্মের সমাধান কি!সমাধান নিভানের তুড়ির ব্যাপার। তবে পাবলিকপ্লেসে তা প্রয়োগ করা মোটে-ও যথাযথ নয়।তাই মুখটা স্বাভাবিক রেখেই বললো।

‘আর ইউ সিওর?হাঁটতে পারবে তুমি?

কৌড়ি উত্তর দেওয়ার আগেই মান্যতা বললো—ব্যাথায় চোখে পানি এসে গেছে!আর তুই বলছিস হাঁটতে পারবি?

‘আমি তেমন ব্যাথা পায়নি আপু।হঠাৎ আঘাত লাগায় ব্যথায় চোখে পানি এসে গেছে।

কথাটা বলেই কেমন চমকে উঠলো কৌড়ি।চকিতে নিভানের দিকে তাকাতেই মনটা কেমন ছলাৎ করে উঠলো।নিজের অভিমান অযথা ঠিকলো।শ্যামবর্ণ মায়াময় শান্ত মুখটা দেখে আবারও তীব্র অনুশোচনায় ডুবলো মন।তন্মধ্যে মান্যতা সন্দিহান গলায় শুধালো।

‘সিওর?তুই ব্যাথা পাসনি?হাঁটতে পারবি?

চোখ নিচু রেখে মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দিলো–‘হুমম।

নিভান অদ্ভুত শান্ত নজরে মেয়েটাকে দেখলো।কিছু একটা বলবে তারমধ্যে এতোসময়ে চুপ থাকা নাফিম বলে উঠল–বউমনি তাহলে চলো-না,ওইযে রাজারবাড়ি ওটা দেখে আসি।ছোটো দাদাভাইরা ওদিকে গেছে আমি দেখেছি।চলো না ওদিকেই যাই।রাজারবাড়ির পুকুরঘাটটা কি সুন্দর দেখো?চলোান বউমনি?

নাফিম হাতের আঙুলটা পুনরায় কৌড়ির আঙুলের মধ্যে ডুবিয়ে সামনে এগোলো।বাধ্যতামূলক কৌড়িকেও এগিয়ে যেতে হলো।সঙ্গে সঙ্গে পায়ের মোচড় লাগা জায়গাটায় মৃদু ব্যাথা অনুভব করলো।যা আরও দুকদম সামনে বাড়াতেই সয়ে গেলো।নিভান সেই এগোনো পদক্ষেপে তাকিয়ে রইলো।মান্যতাও তাদের পিছনে এগোলো।তবে পিছু ফিরে আরও একবার নির্বিকার নিভানকে দেখে নিলো।তার খুবকরে মনেহচ্ছে দু’জনের মধ্যে মান-অভিমান কিছু একটা তো হয়েছে।নাহলে দুজনেরই আচারণ তার কাছে এমন অস্বাভাবিক অদ্ভুত ঠিকলো কেনো!

বাড়িটা জমিদার রাজার বাড়ির মতো তৈরী করা হলেও মুলত রাজার বাড়ি নয়।আগেরকার আমলের জমিদার বা রাজাবংশীয়দের নিয়ে সিনেমা তৈরী করার জন্য,রাজার বাড়ির মতো এই বাড়িটা বানানো হয়েছে। মুলত সেটা পুরানো আমলের জমিদার বাড়ির প্রতিফলিত একটা শুটিং স্পট নির্মাণ করা।বাড়ির সম্মুখে বড়সড়ো ধাপে ধাপে সিঁড়ির একটা ঘাট বাঁধানো রয়েছে।আশেপাশে ঘুরেফিরে সেখানে গিয়ে বসলো সবাই।এমনিতেই কৌড়ি শান্ত মেয়ে তাকে আরও শান্ত দেখে তন্ময়ী জিজ্ঞেস করলো–মনখারাপ কৌড়ি?

কৌড়ি জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি ফুটালো।ফের বললো-না আপু।মনখারাপ কেনো হবে?

ইভান ফাজলামো শুরু করলো –কিন্তু ‘আমার তো মনে হচ্ছে তোমার খুব মন খারাপ! দাদাভাই সঙ্গ দিচ্ছে না তাই?

কৌড়ি দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিলো—‘মোটেই না!

ইভান তারচেয়েও দৃঢ় গলায় বললো—মোটেই হ্যাঁ।

ফের দুষ্টমী স্বরে ইভান বললো—তবে দাদাভাইয়ের
এখানে নিত্য আসাযাওয়া,এজন্য হয়তো এতোএতো ঘুরতে ভালো লাগছেনা।তবে তুমি বললে কিন্তু নিশ্চয় আসতো?একমাত্র বাচ্চা বউ বলে কথা।

তন্মধ্যে তন্ময়ী বললো—তা আমি তোমার একমাত্র বউ বলছি,এই পুকুর একটু ঝাপ দাওতো।দেখি একমাত্র বউয়ের কথা কেমন শোনো।

ইভান ধপ করে তন্ময়ীর পাশে বসে পড়লো।বললো–যদি ইজ্জত রক্ষা করার একটা ভালোমতো উপায় থাকতো তবে অবশ্যই আমি আমার একমাত্র বউয়ের কথা শুনতাম।বাট উপায় নেই এজন্য শুনতে পারছিনা।আমি দ্বিতীয়বার আর লুঙ্গির ওই সাদাসিধা প্যচালে পড়তে চাই-না।

সবাই হাসলো।হাসলো তন্ময়ীও।তবে সবার অগাচরে তন্ময়ীর কানের কাছে মুখটা নিয়ে ইভান বললো–তবে দুপুরের মতো যদি রাতেও আহ্বান করে ওভাবে কাছে ডাকো।সঙ্গে আদর ভালোবাসাটা যদি একটু অন্যরকম হয়,তবে ইভান তোমার জন্য পুকুরে ঝাপ দিতে নয়, জীবন উৎসর্গ করে দিতেও রাজি হয়েযাবে।এবার বলো রাজি হে?

তপ্ত আগুন যেনো কানের ভিতরটা পর্যন্ত ছুঁয়ে গেলো।তার আভাও যেনো কানের সাথেসাথে চোখেমুখেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো।এমনটা অনুভব করলো তন্ময়ী।কতোবড় অসভ্য ছেলেটা!আশেপাশে কতো মানুষ অথচ কিসব নির্লজ্জের মতো কথাবার্তা বলে যাচ্ছে!তড়িৎ মুখ উচু করে আশেপাশে তাকালো তন্ময়ী।না।কারোর তাদের দিকে খেয়াল নেই।হাফ ছেড়ে বাচলো যেনো মেয়েটা। ফের পাশে বসা ইভানের দিকে কড়া চোখে তাকালো।ইভান থোড়াই না তাতে পরোয়া করলো।আর-ও কিছু বলবে বলে মুখ খুলছিলো,তার আগেই তন্ময়ী তাকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিলো।তবে ইভানকে একচুল নাড়াতে পারলোনা।তাই হুমকিস্বরূপ শক্তকন্ঠে বললো—আর একটাও উল্টো পাল্টা শব্দ যদি তুমি প্রয়োগ করেছো না!তোমার খবর আছে বলে দিলাম!

‘খবরটা যদি,তোমার আদর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়,কোনো ব্যাপার না।আমি খবর কেনো,খবরের হেডলাইন ডেডলাইন সব হতে রাজী।

এই ছেলেকে দমানো তার কর্ম নয়।বিরক্ত এবং ধৈয্যচুত হয়ে তন্ময়ী নিজেই উঠে দাঁড়ালো। নাফিম,ইতু আর কৌড়ি, পুকুরের পানির কাছে সিঁড়িতে। নাফিম নিচু হয়ে পানি ছুড়ছে এদিক ওদিক,তাকে সঙ্গ দিচ্ছে ইতু। আর কৌড়ি চুপচাপ আশপাশটা দেখছে।তন্ময়ী ধপাধপ্ সিড়ি বেয়ে ওদের কাছে গেলো।আশেপাশে সবাই তখন ছবি তোলায় ব্যস্ত। দুরপ্রান্তে বসা এক মানবের শান্ত,স্থির চোখজোড়া তখনও তার প্রিয়তমা স্ত্রীরপানে নিবন্ধিত।দুরে থেকেও বুঝতে পারলো। মেয়েটার মন খারাপ!তবে একান্ত সময় না পেলে কিভাবে সমোঝোতা করবে?আর কিভাবেই বা কাটাবে সেই নারীর মন খারাপ?সবার সাথে ঘুরতে নিয়ে এসে নিজের কাছ বসিয়ে রাখাও তো উচিত-না!তবে সঙ্গ দেওয়া মনেহয় অবশ্যই উচিত।সঙ্গ দেওয়ার ভাবনাটা তার কেবলই মনমস্তিস্কে উদয় হয়েছে এমনটা নয়।বরং সঙ্গ ছেড়ে মেয়েটাকে কিছু সময় একা ছাড়তে চেয়েছিলো নিভান।যা হিতে বিপরীত হয়ে গেলো।মেয়েটার ওই ক্রন্দনরত চোখজোড়া! উফফ,জ্বালা ধরিয়ে দেয় তার বুকে।কোনোপ্রকার স্বস্তিতে,শান্তিতে থাকতে দেয়না।কিছুতেই দেয়না।নিজের জন্য হলেও সে দেখতে চায়, ওই মায়াবীনি মুখের উচ্ছ্বসিত উজ্জ্বল হাসি।

বউটাকে সঙ্গ দিতেই উঠে দাঁড়ালো নিভান।তন্মধ্যে এসে হাজির হলো ইভান।সঙ্গে কানন। পিছনে নিতু আর মান্যতাকেও দেখা গেলো।নিভান পুনরায় পুকুরঘাটের দিকে তাকালো। সেখানে কেউ নেই।শূন্যঘাট।তারমানে বাকিরাও পিছনে আসছে।নিভান সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বসে পড়লো।ওয়েটারকে ডেকে,যে যার পছন্দের মেন্যু অনুযায়ী খাবার অর্ডার দিতে বললো।আস্তে আস্তে সবাই এসে হাজির হলো।মূহুর্তেই চারসিটের তিনটে টেবিল বুক হয়ে গেলো।শেষ টেবিলে গিয়ে বসলো নাফিম, কৌড়ি আর বিথী।মাঝখানের টেবিল থেকে মূহুর্তেই উঠে এলো ইতুও।হাতে তার নিতুর ফোন।পিক উঠিয়েছে তাই উচ্ছ্বসিত হয়ে দেখাচ্ছে।

‘দেখো তোমাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে!হাসলে আর-ও সুন্দর দেখাতো।

ইতুর কথাতে নয় বিথীও খেয়াল করেছে কৌড়ি আজ বেশিই চুপচাপ। কৌড়িকে কয়েকটা পিক দেখিয়ে ইতু আর নাফিম পিক দেখায় ব্যস্ত হলো। সেদিকে একপলক তাকিয়ে বিথী বললো।–কি হয়েছে তোর?

“কিছু না তো! কি হবে?

‘আমিতো তোকে অনেক আগে থেকেই দেখছি মুডঅফ।ভাইয়াও কেমন চুপচাপ। অথচ দুজনের একসাথে ঘোরার কথা।

‘ইভান ভাইয়ার কথা শুনলিনা!ভাইয়া বললেন তো, উনিতো এখানে সবসময় আসেন।এজন্য আলাদা করে ঘোরাঘুরি করেননি।আর আমিতো সবার সাথে ঘুরছিই।

‘কৌড়ি।

বিথীর ডাকটায় কেমন করে তাকালো কৌড়ি। তবুও মুখ দিয়ে শব্দ বের করলো না। সেটা দেখে বিথী পুনরায় বললো।

‘এই কয়েকমাসের দুরত্বে তুই এতোটাও পাল্টে যাসনি যে আমি তোকে বুঝতে ভুল করবো।আর আমাদের বন্ধুত্বটা এতোটাও ঠুনকো হয়ে যায়নি যে, তুই আমার কাছ থেকে কথা গোপন করবি।তবে তোদের একান্ত কথা হলে সেটা আলাদা।আমি তা জানতে চাইনা। তবে আমি নিশ্চিত তোর কোনো কারণে মন খারাপ।

‘উনি আমাকে ব্যাডলি ছুইনি কারনবশত ছুঁয়েছে।সেটা নিয়ে আমি উনার সাথে খারাপ রিয়াকশন করে ফেলেছি।

ইতস্তত হয়ে কথাটা বলতেই,বিথী বিস্ময় নিয়ে বললো।
‘তুই!

বিথীর রিয়াকশনে কৌড়ি মুখটা আরও ছোটো হয়ে গেল।বিথী বললো-তুই ভাইয়াকে চিনিস না?তারপরও?

‘আমি ইচ্ছেকৃত করেনি। অনিচ্ছাকৃত হয়ে গেছে!

‘এটা নিয়ে ভাইয়া রাগ করেছেন,অসন্তুষ্ট হয়েছেন?

‘নাহ।

‘তবে তা নিয়ে মন খারাপ কেনো করছিস?

‘আমি যেটুকু জানি উনাকে।উনি মনেমনে অসন্তুষ্ট হলেও তা বহিঃপ্রকাশ করবেননা কখনো।নিজের মনে চেপে রাখবেন।তবুও অসন্তুষ্টতা প্রকাশ করবেন না।

বিথী মজার ছলে বললো–দুদিনে এতোটা জেনে গেছিস?

বিথীর কথার টোন বুঝে কৌড়ি উত্তর দিলো-না।বরং মুখটা সেভাবেই ছোটো করে বসে রইলো।সেটা দেখে বিথী একপেশে তাকে জড়িয়ে ধরলো।নিচুস্বরে বললো –আচ্ছা মনখারাপ করিস-না।ভাইয়া তোকে অসম্ভব ভালোবাসেন।একদম অসম্ভব।বিশ্বাস কর,এরকম করে সবদিক দিয়ে খেয়াল ধ্যান রেখে একটা মেয়েকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে ছেলেমানুষ আমি কমই দেখেছি।সেখানে তিনি তোর প্রতি অসন্তুষ্টতা পুষে রাখবেন?কখনোই-না।তখন সুযোগ বুঝে তুইও নাহয় উনাকে স্যরি বলে দিস।হয়ে যাবে!

বিথীর বুঝদারপনা কথায় মৃদু হেসে সম্মতি জানালো কৌড়ি।তবে মন সেই অস্থির, বিচলিতই রইলো।ওয়েটার খাবার এনে টেবিলে রাখতেই ধ্যান সেদিকে দিলেও,মন পড়ে রইলো সেই শ্যামবর্ণ মায়ামায়া মুখে।শান্ত, স্থির সুগভীর দু’টো চোখে।কৌড়ি তখন ওমন রূঢ় আচারণ করার পর কেমন আরও শান্ত থমথমে হয়ে গিয়েছিলো সেই নজর,মুখ।অথচ চেহারার নির্বিকারত্ব দেখে বোঝার উপায় ছিলোনা,মানুষটা তার ব্যবহারে ঠিক কতোটা অসন্তুষ্টতা হয়েছেন!বারবার সেই চোখমুখ মনোসপটে ভেসে উঠছে আর অনুশোচনায় অপরাধবোধে বুকের ভেতরটা দগ্ধ হচ্ছে।মাথাটা কেমন ভারী করে তুলছে।পিছন ফিরে মানুষটাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করলো।অথচ দেখা হলো-না তার।সামনে টেবিলে রাখা কোল্ড কফি মগটায় আনমনে হাত দিতেই ওয়েটার সতর্কতা করে বললেন– ম্যাম আপনার জন্য কফি না।ফাস্ট টেবিলের স্যার নিষেধ করলেন বলে আপনাকে কফি দেওয়া হয়নি।উনি বললেন আপনার নাকি ক্যাফেইন জাতীয় খাবার নিষিদ্ধ। তাই আপনি জুস নিন।অ্যারেঞ্জ ফ্লেভার অথবা ম্যাংগো,দুটো রাখলাম যেকোনো একটা নিতে পারেন।চাইলে অন্যন্য তা আছে।দেবো?

‘লাগবে না।

কৌড়ি দেখলো,জুস কফিসহ টেবিলে বিভিন্ন খাবার সাজানো।পিৎজা,চিকেন বার্গার,পাস্তা,মেয়োনিজ,ফ্রেঞ্চ ফ্রাই,চিকেন স্যান্ডউইচ,পটেটো ওয়েজেজ।ওয়েটারের বার্তা অনুযায়ী এগুলো থেকেও টেষ্ট করতে পারেন। আর মিষ্টিতে স্ট্রবেরি কেক এবং ভ্যানিলা কাপ।এগুলোও ট্রায় করা যেতে পারে।

ওয়েটার বার্তা জানিয়ে চলে গেলো।কৌড়ি কেমন অদ্ভুত চোখে তার যাওয়া দেখলো।ভিতরে অনুশোচনায় ডোবা মনটা যেনো চনমনিয়ে উঠলো।সর্বদা সর্বক্ষণ মানুষটার ধ্যান থাকে কৌড়ির খেয়ালে।আর সেই কৌড়ি ব্যাথা দিল মানুষটাকে।খাবারের রুচি এমনিতেই নেই।এবার যেনো তা নিঃশেষ হয়ে এলো।ভিতরটা উগলে এলো কান্নায়।পাশ থেকে বিথী বললো–দেখেছিস,তুই যতো দূরে থাকিসনা কেনো ভাইয়া ঠিকই তোর খেয়াল রাখে।আর রাখবেও।সেখানে তোর প্রতি অসন্তুষ্ট হলেও বেশিক্ষণ মনে পুষে রাখতে পারবেন না।

অসন্তুষ্ট বহিঃপ্রকাশ করবেনা, পুষে রাখবে-না,এটা সেও জানে।সেজন্য তো গ্লানিটা তার বেশি।মানুষটাকে বুঝেশুনেও অকারণে তারসাথে রূঢ় আচারণ তাকে শান্তিতে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।মন ওই মানুষটার সঙ্গে চাইছে,সাথে তার দু’হাতের শক্তপোক্ত বন্ধনীর স্পর্শ চাইছে!খুবকরে চাইছে!

আড্ডা মজাতে ইভানের জুড়ি মেলা ভার।সাথে তারই ভার্সন কানন যুক্ত হয়েছে।জমজমে হয়ে উঠেছে টেবিল।
তবে হাসি গল্পে টেবিল ক্রস করছেনা কেউ।ইভানের দুষ্ট ফাজলামো কথাগুলো কানে আসলেও,মধ্যে টেবিলে বসা তন্ময়ীরা তা কানে তুলছেনা।তারা নিজেদের মতো গল্প করছে।মাঝেমধ্যে পিছুনের টেবিলে বসা কৌড়িদের খোঁজখবর নিচ্ছে।যদিও ইতু কৌড়দের সাথে গিয়ে যোগ হয়েছে মৌনতা।ইতু, মৌনতা আর বিথী।তিন বকবকানি খোশগল্পে মাতিয়ে তুলেছে টেবিল।

গোধূলী সন্ধ্যা।সূর্যটা অস্তমিত হয়েছে সেই কখন!এই মাগরিবের আযান পড়লো বলে।নাস্তা সেরে সবাই, পুকুরের পানির উপরে নির্মিত কাঠ বাশ ছন দিয়ে করা কটেজগুলো ঘুরেঘুরে দেখলো।এবার নিভান বউয়ের পাশেপাশে হেঁটে তাকে সঙ্গ দিলো তবে কথা হলোনা দু’জনের মধ্যে আর না দৃষ্টি বিনিময় হলো।কৌড়িও অনুভব করলো তার পাশের মানুষটাকে।তবে গ্লানিভরা মন কেমন যেনো পাশে তাকিয়ে মানুষটার দিকে নজর ফেলতে পারলোনা।স্বাভাবিকভাবেই বাঁশ কাঠের নির্মিত রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখে এলো কটেজগুলো তারা ।সূর্য হারিয়ে গিয়ে পশ্চিম আকাশে উদয় হয়েছে সিঁদুররঙা লাল আর গাঢ় নীল আলো।সেই লাল নীল গোধুলেলগ্নের আলোয় সবুজ সমাহারে ঘেরা ঘনো এই প্রকৃতিকে কি-যে মোহনীয় লাগছে।অবর্ননীয় রূপ।সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মাধুর্যতা যেনো উপচে উপচে পড়ছে। পাশে তাকালো নিভান।প্রকৃতির মাধুর্যতার লীলাভূমিতে তার বউটাও কোনো অংশে কম কিসে!সে যে গোলাপের আবরণীর ন্যায় স্নিগ্ধময়ী অনন্য।গোধুলির উদিত হওয়া সিঁদুররঙা লাল নীল মোহমায়া রূপের ন্যায় অপরূপা।

আযানের আগেই তারা রিসোর্ট থেকে বের হলো।রিসোর্ট থেকে বের হতেই ইভান বললো।-অনেকদিন পর যখন সবাই একসাথে বের হয়েছি।চলো-না একটু লং ড্রাইভে যাই দাদাভাই।মন খুলে ঘোরাঘুরি করি।আবার কবে কখন এরকম একসাথে হতে পারবো তার ঠিক নেই।

বড়রা বাদে বাচ্চারা যেনো নেচে উঠলো।অগ্যতা বাচ্চাদের উচ্ছ্বসিত মুখের দিকে তাকিয়ে নিভান আর না বলতে পারলো-না।কৌড়ির সাথে একান্ত সময় কাটাতে বাচ্চাদেরকে নিজের গাড়ীতে নিলো নিভান।নাফিম ইতু মৌনতা আর বিথী।সঙ্গে বউটা নিয়ে নিভান গাড়ীতে উঠলো।গাড়ীতে উঠতেই উদাস মনে মেয়েটা জানালার বাহিরে তাকালো।নিভান কিছু বলতে গিয়েও যেনো বলতে পারলোনা।পথিমধ্যে আযান হতেই,একটা মসজিদ দেখে গাড়িটা পার্ক করে নামাজ পড়ে নিলো।নামাজের অভ্যস্তটা হয়েছে তার,বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে।বাবা মারা যাওয়ার পরে ছোট্টো নিভান যখন বাবার কাছে যাবার জন্য খুব বাহানা করে কাদছিলো।তার সাথে ঘুমানোর জন্য জেদ করছিলো।কোনোমতেও সেই বায়না যখন কেউ থামাতে পারছিলো।নিভান ছটফট করছিলো।তখন কোনো এক বয়স্ক লম্বা দাড়িওয়ালা মুরুব্বি তাকে কাছে নিয়ে কি সুন্দর নমনীয় মিষ্টি গলায় বলেছিলেন–বাবার সাথে থাকতে চাও?

ছোট্টো অবুঝ নিভান মাথা নাড়িয়ে ক্রন্দনরত কন্ঠে বলেছিলো—হ্যা।আমি বাবার সাথেই থাকতে চাই।

‘তাহলে যে তোমাকে সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে।নামাজ পড়তে হবে,আর নামাজ শেষে প্রার্থনা করে আল্লাহর কাছে বলতে হবে আমি বাবার সাথে থাকতে চাই।

নিভান তখন অবুঝ হলেও নামাজ সম্পর্কে দৃঢ় ধারনা ছিলো তার।বাবার সাথে প্রতি ওয়াক্তে নাহলেও বাবা বাড়িতে থাকলে প্রায় ওয়াক্ত নামাজে সে বাবার সাথে মসজিদে যেতো।আর সেজেগুজে জুমার নামাজ তো কখনো মিস করতো-না।বাবা নামাজী ছিলেন।নামাজী হওয়ার গুনটা বংশ পরম্পরায় পেয়েছিলেন।তাই মুরুব্বির কথা তার অবুঝ মন নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিল।ততক্ষণে বাবার দাফন শেষ।তবুও বাবাকে কাছে পাওয়ার আশায় নিজে নিজে নামাজ পড়েছিলো।তখন কোনো ওয়াক্ত ছিলোনা তবুও নামাজ পড়েছিলো নিভান।এবং কেঁদেছিলো আর দোয়া করেছিলো,সে বাবার কাছে যেতে চায়,বাবার সাথে থাকতে চায়।তারপর ছোট্টো নিভান রোজ মায়ের সাথে নামাজ পড়তো।আর দু-হাত তুলে অবুঝমনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতো– আমি বাবা-র সাথে থাকতে চাই।

বাবাকে না পেয়ে ছটফট করতো নিভান।ঘনোঘনো জ্বর অসুখে ভুগেছেও সে।তবে বাবার কাছে থাকার যে তীব্র রাগ জেদ বাহানা ছিলো।সেই রাগ জেদ বাহানা আস্তে আস্তে কমে গিয়েছিলো।হয়তো তার ছোট্টো হৃদয়টা নামাজে মধ্যেমে আল্লাহর রহম, নেয়ামত অর্জন করতে পেরেছিলো।সেই করুনায় রাগ জেদ কমে গিয়ে সেখানে ভর করেছিলো গম্ভীর্যতা,ধৈর্য্যশীলতা,সহনশীলতা।তবে সেই মুরুব্বির কথার অর্থ”‘আমি বাবার সাথে থাকতে চাই'” বাক্যের অর্থদ্বয় নিভান যতো বড় হয়েছে ততোই গভীরভাবে তার মর্মার্থ অনুধাবন করেছে।ভদ্রলোক তাকে বাবার সাথে থাকার জন্য নিজের আয়ু নিস্ক্রিয় করতে প্রভুর কাছে কামনা করতে বলেনি।বলেছিল,শুধু নিজের ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে।যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে সে বাবার সাথেই জান্নাতে থাকতে পারে।আনমনে হাসলো নিভান।মায়ের চেয়ে বাবাকে খুব ভালোবাসতো সে।সর্বদা বাবার সঙ্গ পাওয়ার জন্য কত জেদ,কতো অবুঝপনা করেছে নিভান!বাবা মারা যাওয়ার পরে তা সময়ের সাথে সাথে সয়ে গেছে।তবুও অবুঝ ইচ্ছেটা তার রয়ে গেছে।অবশ্যই সে জান্নাতে বাবার সাথে থাকতে চায়।পাশে তাকালো নিভান।সেখানে নিজের সঙ্গিনী হিসাবে এই মেয়েটাকেও চায় সে।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো নিভানের।ব্লুটুথটা কানে গুঁজে নিতেই সংযোগ স্থাপন হলো।ওপাশ থেকে ইভান বললো—কোথায় তোমরা?দেরী হচ্ছে কেনো আসতে?আমার শ্রীপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর সাফারি পার্কের সামনে গাড়ী থামিয়েছি কেবল। এসো।

‘সন্ধ্যার সময় ওখানে কেনো?

‘নিতু বলছিলো গাজীপুরে জায়গাটা ঘোরার জন্য বেস্ট।তাই এলাম।

‘গাজীপুর হিসাবে জায়গা ঘোরার জন্য বেস্ট হলেও,
এখন বনজঙ্গল দেখার সময় না!ওখানে খোলামেলা জীবজন্তুর মেলা।যা রাতে উপভগ্য করার সময় নয়।আর বাচ্চাদের নিয়ে রাতে ওখানে ঘোরাফেরাও ঠিক হবে-না।চাইলে তোরা ঘুরে আয়।আমি ওদের নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর দিকে যাচ্ছি।

‘নিতু বলছিলো নন্দন পার্ক বলে আরেকটা জায়গা আছে।তবে ওখানে এসো।

‘ওখানেও রাতের বেলা খুব একটা উপভোগ্য নয়।চাইলে তোরা যা।আমি ওদের নিয়ে শীতলক্ষ্যার দিকে যাচ্ছি। তোর ঘুরে আয়।

ইভান দ্বিরুক্তি করলোনা।সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতেই নিভান গাড়ী চালানোতে মনোযোগ দিলো।পাশে একপলক তাকাতেই দেখলো,কৌড়ি গাড়ীর জানালায় হাত রেখে তার উপর মুখটা সপে বাহিরে তাকিয়ে আছে।রাতের রাস্তায় গাড়ী চালানোতে বরাবর এক্সট্রা সতর্ক অবলম্বন করে নিভান।বিধায় কৌড়ির পানে বিশেষভাবে খেয়াল দিতে চেয়েও পারলোনা।গাড়ীতে অন্যরা না থাকলে কোথাও গাড়ী থামিয়ে দুজনের অমীমাংসিত ঝামেলাটার চুটকিতেই সমাধান করে ফেলতো।তা এখন হওয়ার নয়।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো সে।

ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে শীতলক্ষ্যা নদীর উৎপত্তি।শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে বর্মী খেয়াঘাট।কাছাকাছিই চারশো বছরের পুরানো বর্মী বাজার।সেখান থেকে কিছুটা দূরেই গাড়ী থামালো নিভান।কিছুটা দূরে বলতে বরমা সিংহস্রী ব্রিজের কাছেই গাড়ীটা পার্ক করলো।গাড়ী থেকে নামতেই হৈচৈ করে বাচ্চার ব্রিজে উঠে গেলো।অন্যন্য ব্রিজের মতো এই ব্রিজের রেলিঙের পাশ ঘেষে একের পর এক সোডিয়ামের কোনো আলো নেই। তবে ব্রিজের উপর দিয়ে চলা একের পর এক গাড়ির আলোতে ঝলমলে উজ্জ্বল চারপাশটা।নদীর নাম যেনো সার্থক।কচুরিপানায় ভরা শান্ত শীতল পানি।তার বহমানে নেই কোনো তরঙ্গ উচ্ছাস।ছলছল কলকলভাবের তাপ-উত্তাপ।চুপচাপ শান্ত শীতল বয়ে চলেছে সে।রেলিঙ ঘেঁষে উপর থেকে সুগভীর শীতলপানির বহমান দেখতে থাকলো সবাই।দিনের বেলা হলে এই নদীতে নৌকা চড়া যেতো।রাতে বেলা ভুলেও বাচ্চাদের নিয়ে সেই রিক্স নেওয়া যাবেনা।একটাও সাঁতার জানেনা সেভাবে।
নাফিম দেখতে দেখতে হঠাৎ উবু হওয়ায়,পাশে দাড়ানো কৌড়ি আতঙ্কিত হয়ে তাকে চেপে ধরে সোজা করে দাড় করিয়ে দিলো।বললো–সোজা হয়ে দেখো নাফিম।নিচু হয়ে দেখোনা,পড়ে যাবা।

‘সোজা হয়ে তো সামনে দেখা যায়।নিচে কি দেখা যায়?আমিতো নিচে দেখতে চাই।একটু বউমনি।

নাফিমের আদূরে কন্ঠের অনুরোধ ফেলতে পারলোনা কৌড়ি।তাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো।আর নাফিম হালকা মাথা নিচু করে নদীর একান্ত ছন্দেছন্দে চলা বহমান পানি দেখতে থাকলো।সাথে কৌড়িও।অন্ধকারে তার আসল বৈচিত্র্য অনুভব না করতে পারলে-ও,শান্ত নদীতে চলা বাহারি নৌকাগুলোর ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বয়ে যাওয়া উপভোগ করতে থাকলো।নিভান গাড়ীর গায়ে হেলান দিয়ে সুগভীর চোখে শীতলক্ষ্যার অনুরূপ শান্ত, নিজের বউটাকে দেখতে থাকলো।মেয়েটার চোখে তীব্র অনুশোচনা অথচ তার ঠোঁট নিরুপায়, নিস্তব্ধ।এরকম মানুষেরা ভিতরে ভিতরে পুড়ে ছাই হয়ে যায়,দগ্ধ হয়।অথচ নিজেকে কারও কাছে খোলামেলা উপস্থাপন করতে পারে-না।নিজের ভালোমন্দ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করতে পারেনা।নিভান সোজা হয়ে দাঁড়াল।পা বাড়ালো প্রিয়তমা অভিমানির পানে।তন্মধ্যে আরও একটা গাড়ি এসে থামলো তার গাড়ির পাশে।

ইভানরা হয়তো পার্কে সময় কাটায়নি।সোজা চলে এসেছে এখানে।নাহলে এতো তাড়াতাড়ি আসার কথা নয়।গাড়ি থামতেই নেমে পড়লো সবাই।কোলাহলহীন নির্মল পরিবেশ। সবাই যেনো জায়গাটা উপলব্ধির সাথে সাথে উপভোগও করলো।নিভানের আর বউয়ের কাছে যাওয়া হলোনা।সবাই ব্রিজের এপাশ ওপাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখতে থাকলো।গল্প কথার মধ্যে বিভিন্ন রকম মতামত প্রকাশ হলো।তন্মধ্যে দিনের বেলা হলে জায়গাটা বেশ উপভোগ করা যেতো।আশেপাশে ঘুরেও দেখা যেতো।সর্বোপরি এই শান্ত শীতলক্ষ্যায় নৌকা চড়ে হৈহৈ করে কিছুক্ষণ বেড়ানোও যেতো।সবাই যার যার মতো ঘুরেফিরে সময়টা উপভোগ করতে লাগলো সাথে ব্যক্ত করতে থাকলো নিজেদের অনুভূতি।হঠাৎ নাফিম বললো।

‘বউমনি চলোনা ব্রিজের ও-মাথা থেকে ঘুরে আসি?

আঙুল দিয়ে দেখালো নাফিম।মানুষজন যা সব ব্রিজের এমাথায় আর মধ্যেখানে।ওমাথায়ও আছে তবে সংখ্যায় দু-একজন। কৌড়ি সম্মতি জানালো।নাফিম বরাবরের মতো কৌড়ির আঙুল নিজের আঙুলের মধ্যে পেচিয়ে নিয়ে সামনে আগ্রসর হলো।কিছুদূর যেতেই নিজের পাশে বটবৃক্ষের মতো বলিষ্ঠ দেহের ছায়া অনুভব করলো।তারসাথে নিজের কোমল অন্যহাতের তালুতে সেই মানুষটার শক্তহাতের স্পর্শ পেলো।সঙ্গে সঙ্গে শরীর শিহরে উঠলো তার।পা থামাতে গিয়েও নাফিমের হেঁটে চলা গতিতে স্থির দাঁড়াতে পারলো-না।ততক্ষণে তার নরম আঙুলের ভাঁজে গেঁথে গিয়েছে কারও শক্তপোক্ত বড়বড় আঙুলের ভাজ।তার হাতটা দখল হয়ে গিয়েছে কারও ভরসা বিশ্বাসযোগ্য হাতের মুঠোয়।অথচ নিজের ভিতরের ভরপুর আত্মগ্লানিতে পাশে ফিরে মানুষটাকে একবার মুগ্ধ চোখে দেখা হলো-না তার।শুধু হাতে হাত রেখে হাটা হলো!আর তাকে অনুভব করা হলো!

বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ওখান থেকে বের হয়ে কাপাসিয়া ব্রিজ ঘুরে রওনা হলো বাড়ির পথে।কাপাসিয়া ব্রিজেও বেশ কিছুক্ষণ সময় ঘোরাঘুরি করে পার করলো।রাতও অল্প হয়নি!এতো রাত করে বাচ্চাদের নিয়ে এভাবে বাহিরে থাকাও ঠিক নয়।তবে তাদের আনন্দিত উচ্ছ্বসিত মুখগুলো,নিভানকে দৃঢ় হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেয়নি।

পুরানো আমলের করা বড়সড় রুমটা দক্ষিণা পাশে হওয়ায় রুমে সর্বক্ষণ এলোমেলো হাওয়া বইতে থাকে।কৃত্রিম বাতাসের প্রয়োজন তেমন একটা হয়না।তবুও বাহির থেকে এসে ফ্যানটা ছেড়ে দিলো নিভান।রুমের মধ্যে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের কোনো কমতি নেই।তন্মধ্যে রুমের মধ্যে দুই সিটের একটা ডাবল সোফায়ও আছে।সেখানে গিয়ে বসলো নিভান।গা এলিয়ে দেওয়ার আগেই মনেহলো,একবারে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলে ভালো হয়!উঠে দাঁড়াতেই দরজার পানে নজর দিলো।ফাঁকা দরজা।কারও পায়ের ধ্বনিও শোনা যাচ্ছে না।তারমানে কৌড়ি এখনো নিচে।তার সঙ্গ দেওয়াতে মেয়েটার ক্ষনিকের অভিমান কাটালেও, মন খারাপ কাটেনি!দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকলো নিভান।ফ্রেশ হয়ে এসে পোশাক চেঞ্জ করে নিলো সে।দুপুরে ইমার্জেন্সি যে পোশাকগুলো অর্ডার করেছিলো,তা সন্ধ্যার একটু আগে এসে পৌঁছেছে।বাড়িতে ঢুকতেই ছোটোচাচী বিনয়ের সাথে পার্সেলটা হাতে ধরিয়ে দিলেন।ইভানকে দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রুমে নিয়ে এসেছে নিভান।এখানে তার কিছু নেই।যা আছে কৌড়ির প্রয়োজনীয় জিনিস।ভারী শাড়ী পরে মেয়েটা কাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি শুধু উশখুশ করেছে।অথচ ঘুমকাতুরে মেয়েটা ঘুমানোর জন্য ছটফট করেছে।নিভানেরও ঘুম হয়নি।নিজের বেড ছাড়া হঠাৎ অন্য কোথাও তার ঘুম হয়-না।

পা দুটো সামনে এলিয়ে দিয়ে গা-ছাড়া ভাব নিয়ে সোফায় বসলো নিভান।কিছুক্ষণ পর মাথাটাও এলিয়ে দিলো সোফার হেডে।পিছনের জানালা ভেদ করে নির্মল ঠান্ডা বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে।অকৃত্রিম সেই বাতাসের কাছে যেনো ফ্যানের এই কৃত্রিম হাওয়া কিচ্ছু নয়।চোখ বুঁজে নিলো নিভান।মূহুর্তেই কৌড়ির মেঘমেদুরে ডুবে থাকা মুখ,আর অসহায়ত্ব নিয়ে চাওয়া হরিনী ডাগরডাগর চোখজোড়া ভেসে উঠলো বদ্ধ নয়নে।উফ!মেয়েটার থেকে সামন্য নিজেকে দূরে রাখা তো দূর, অভিমানী অসন্তুষ্ট নিয়েও থাকার কায়দা বুঝি তার আর ইহকালে হবেনা।মন কাঁদবে, বুক কাঁপবে, মস্তিষ্কও তাতে সায় জানিয়ে বলবে ও অবুঝ,ও ছোটো,কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলেছে তাই ধরে তুই অভিমানী হয়ে বসে থাকবি?সম্পর্কে একজন অবুঝ হলে আরেকজন বুঝদার হতে হয়।মায়াময়, স্নেহশীল, দায়িত্ববান,যত্নশীল হতে হয়।নাহলে সেই সম্পর্ক অযত্নে হারিয়ে যায়।নষ্ট হয়ে যায়।আর তুই তো তা হতে দিতে পারিস-না।

কারও মৃদু পায়ের শব্দে অস্পষ্ট হাসলো নিভান।এই নিঃশব্দে চলা পায়ের শব্দও তার চেনা। চোখ খুললো নিভান।সোজা হয়ে বসলো।কৌড়ি সেটা খেয়াল করেনি।নিভানকে চুপচাপ চোখে বুঁজে শুয়ে থাকতে দেখে নিঃশব্দে ভিতরে ঢুলো।তারপর শব্দহীন হাতে
হিজাব খুলতে ব্যস্ত হলো সে।তখন পিনগুলো মানুষটা ফেলে দেওয়ায় হিজাব বাঁধবে কি দিয়ে,ভাবতে গিয়ে মনেহলো, স্টোনের বড়বড় কয়েকটা সেফটিপিন তো আছে তারকাছে।মুলত সেটা দিয়েই কোনোরকম হিজাব বেঁধে চলে গিয়ছিলো সে।বিধস্ত মন লজ্জায় চাইনি ঘুরতে যেতে,তবুও সবার কথা ভেবে যেতে হয়েছিলো।।তবে লজ্জায় মানুষটার দিকে একবারও ফিরতে পারিনি সে।

‘কৌড়ি।

হঠাৎ ডাকটা কর্ণগোচর হতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো কৌড়ির।কান্না পেলো ভিষন।দাঁতে দাত চেপে তা আটকালো।সারাটা বিকেল আত্মগ্লানিতে ভুগেছে সে।আত্মগ্লানি যেনো দ্বিগুণ হয়েছে,সে ওমন ব্যবহার করার পরও মানুষটার তারপ্রতি খেয়াল ধ্যানে,যত্নে।তাকে সঙ্গ দেওয়ায়।সেই সঙ্গসর্স্পে নিজের অযথা ক্ষনিকের অভিমান মুছে গেলেও,আত্মগ্লানি মুছেনি।
ওই মানুষটার সাথে ওমন ব্যবহার করার পর মানুষটা কতোট কষ্ট পেয়েছে সে জানেনা,তবে সে ভিতরে ভিতরে জ্বলেপুড়ে মরছে।অসহ্য এক অনুশোচনা তাকে যন্ত্রণায়,ব্যথায় পাগল করে তুলছে।এমনকি মাইগ্রেনের ব্যথাটাও যোগ হয়েছে সাথে। মানুষটার ডাকটায় তা যেনো প্রকট হলো।ব্যথায় ঝিমঝিম করে উঠলো মাথার শিরা উপশিরাগুলো।ঠোঁটজোড়া ভেঙে ফুপিয়ে আসতে চাইলো সেই নরম ডাকে।তা কাদলো-না।তবে ডাক শুনতেই চড়াৎ করে মুখ ঘুরিয়ে পিছে ফিরলো সে।সরাসরি তাকালো নিভানের চোখে।কেমন শিশুসুলভ অবুঝ সে চাহুনি।ওই মেঘজমা মুখটা,জ্বলজ্বলে চোখজোড়া,শুষ্ক ঠোঁটদুটো বেশ কিছুসময় দেখলো নিভান।তারপর কি ভেবে মৃদু হেসে ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো কৌড়ির দিকে। আহ্বান জানালো।

‘কাছে এসো।

চিলছো মারার মতো মনটা যেনো দৌড়ে চলে গেলো সেই মানুষটার আহ্বানে।অথচ কৌড়ি পারলোনা যেতে।আত্মগ্লানি অনুশোচনা যেনো তার পা দুটো বেঁধে রাখলো অদৃশ্য এক বন্ধনীতে।তবে সেই আদুরে আহ্বানে স্থির হয়ে দাড়িয়েও থাকতে পারলোনা।ছোটো ছোটো কদম ফেলে এগোলো।চেয়েছিলো নিভানের পাশে গিয়ে বসবে।অথচ সেই মানুষটা তা হতে দিলোনা।নিভানের বাড়ানো হাতটা কৌড়িকে নাগালে পেতেই,তার কোলের মধ্যে বসিয়ে দিলো তাকে।এবার আর নিজের শান্ত রাখলোনা কৌড়ি।মূহুর্তেই শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরলো নিভানের গলা।ঠোঁট ভেঙে এলো নীরব কান্নায়।দাঁতে দাঁত চেপে তা আটকাতে চেষ্টা করলেও,আঁখি দ্বয়কে মানানো গেলোনা।তবে এতক্ষণে বুঝি তার বুকের ভিতরে বয়ে চলা দহনক্রিয়া কমলো।স্বস্তি পেলো,শান্তি পেলো।সুখ অনুভব করলো মানুষটার শরীরের পুরুষ স্পর্শে, গন্ধে।অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর অপরাধীস্বরে বললো–।আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি!

নিভান জানা সত্ত্বেও খোঁচালো–কিসের জন্য?

‘আপনাকে অকারণে অসন্তুষ্ট করেছি এজন্য।

নিভান হাসলো।সোফার হেডে মাথা এলিয়ে পুনরায় চোখ বুজে নিলো।খুব সাবলীল গলায় বললো—সামন্য বিষয় নিয়ে মন খারাপ করে কেউ?এটা নিয়ে মন খারাপ করার কি আছে!আমি তোমাকে বিয়ে করেছি, আর তুমি আমার জন্য হালাল হয়ে গিয়েছো তারমানে এই নয়, আমার যখন তখন তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমাকে ছোঁয়ার দলিল হয়েছে!অধিকার হয়েছে! তোমার ভালোমন্দ না বুঝে তোমাকে ছোঁয়ার গ্যারান্টি পেয়ে গেছি!হক পেয়ে গেছি!আমাদের সম্পর্কে স্পর্শ হোক বা অন্যন্য চাহিদা অনুভূতি। আমিও যেমন চাইবো,তোমাকেও তেমন চাইতে হবে।তবেই না আমরা একজন অপরজনের।তবে তুমি না চাইলেও আমার চাওয়ায় আচারণে, স্পর্শে, বার্তায় যদি অহেতুক উগ্রতা, অস্বাভাবিকত্বতা না-থেকে থাকে,নিশ্চয় আমি তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধাচারণ করতে পারি?পারি কি,আমার মনেহয় অবশ্যই পারি!সেটার জন্য আমার মনে হয়না আমি আমার স্ত্রীর হক নষ্টকারী অপরাধী!তাকে ছুঁয়ে কঠিন কোনো অপরাধ করে ফেলেছি।যেখানে আমার স্ত্রীর প্রতি আমার দায়িত্বশীলতা, যত্নশীলতা,কর্তব্য তার হক।সে না চাইলেও সেসব হক তারজন্য থেমে থাকবেনা।After-all i love her.so i want to keep her well.

‘চলবে..

#ফুলকৌড়ি
(৫৫)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সোজাসাপ্টা সাবলীল স্বীকারোক্তি “সর্বোপরি আমি তাকে ভালোবাসী তাই ভালো রাখতে চাই।একটা মানুষ নিখুঁতভাবে সবদিকে খেয়ালধ্যান রেখে কি করে এতোটা ভালোবাসতে পারে?না পারলে এই মানুষটাকে তাকে এতো ভালোবাসে কিকরে!আর সেই ভালোবাসা, নিজের এলোমেলো অনুভূতির দাবানলে পড়ে কৌড়ি হেয় করে বসলো?মানুষটাকে ব্যথা দিলো!ভাবতেই নিবিড়বাঁধনে আরও শক্তপোক্ত হাতে নিভানকে জড়িয়ে ধরলো সে।ঠোঁট নাক-মুখ গভীরভাবে সপে দিলো নিভানের উন্মুক্ত গলার ভাঁজে।যেখানে পুরুষালী নিজস্ব গায়ের গন্ধ আর টিশার্ট থেকে ভেসে আসা সুগন্ধ, একত্রে একাকার হয়ে নেশালো অদ্ভুত এক মনোমুগ্ধকর সুগন্ধ ছাড়াচ্ছে।সেই নেশালো সৌরভে কৌড়ি মোহিত হলো।মোহাবিষ্ট হয়ে আরও নিবিড় ঘনিষ্ঠ বন্ধনে মিশে গেলো নিজের একান্ত পুরুষটার শরীরে।শ্বাস ঘনো হলো।কথা বের হতে চাইলোনা স্বর ভেদ করে মুখ থেকে।তবুও জড়ানো গলায় নিভানের কথার প্রেক্ষিতে ধীমে ধীমে বললো–

‘আমি কিচ্ছু জানিনা,জানতে চাইওনা।আমি শুধু জেনে রাখতে চাই,যাই হয়ে যাক এই মানুষটা শুধু আমারই।আমার সমস্ত অপরাধ, ভুলত্রুটি,অন্যায় যতোই সীমা ছাড়াক না কেনো, সে কখনো আমাকে তারকাছ থেকে দূরে সরাবেনা।আমার প্রতি তার রাগ অভিমান অভিযোগ যাই হোকনা কেনো, সে তার দু’হাতের শক্তপোক্ত বন্ধনি থেকে কখনো আমাকে আলাদা করবেনা।সর্বদা এভাবেই তারকাছে আামকে আগলে রাখবে।পরিস্থিতি আর জীবনের গতিবিধি যেখানে গিয়েই ঠেকুকনা কেনো সে আমার থেকে কখনো দূরে যাবেনা।যাবার চেষ্টাও করবেনা।

কোমল নারীস্পর্শটা নিবিড়রূপে পেতেই নিভানের পুরুষালী সত্ত্বাটা যেনো সংযম হারাতে চাইলো।যতোই নিজেকে সংযাত রাখার চেষ্টা করুক না কেনো।দিনশেষে এই একান্ত হালাল নারীটার পুরুষ সে!স্বামী সে!যাকে মনের ব্যাকুলতায় শরীরও একান্তভাবে পেতে চায়। আর সেই স্ত্রীর এরকম নিবিড়স্পর্শ পেলে কোন স্বামী তা উপেক্ষা করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়!নাকি রাখতে পারে?কোনো মহাপুরুষ ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ রাখতে পারে কি-না নিভানের জানা নেই।তবে নিভান কোনো মহাপুরুষ নয়।তবু-ও আজ তাকে মহাপুরুষের গুন ধারন করে ধৈর্য্য ধরতে হবে।শুধু আজ নয় হয়তো আরও কিছুটাদিন।বিকালের ঘটনাটার পর কৌড়ির অনুশোচনা হয়তো তাদের গভীর সান্নিধ্যে বাধা হয়ে দাড়াবেনা।তবে নিভানের বিবেক বলছে,তিনদিন আগে মেয়েটা কঠিন শারীরিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেয়েছে।তাও পুরোপুরি সুস্থ নয়,ঔষধ চলছে মেয়েটার।স্বাভাবিক পিরিয়ড জনিত অসুস্থতা হলে হয়তো বিষয়টা সাধারণভাবে নেওয়া যেতো।কিন্তু ডাক্তারের মুখের বর্ননা অনুযায়ী প্রায় মাসের অর্ধেকের অধিক সময় অনিয়মিত পিরিয়ড সার্কেলে ভুগেছে মেয়েটা।
শুধু গত মাসে নয়, পিছনের মাসগুলোতে নাকি এরকম অনিয়মিত পিরিয়ড চলে এসেছে তার।সেই বিবেচনায় হলেও হয়তো তার আরও একটু ধৈর্য্য ধরা দরকার।বউটা তো তারই।কঠিন হলেও নিজেকে একটু সংযাত করলে তো ক্ষতি নেই।বরং তার মনেহয় ভালো।কোনো এক বিজ্ঞ ব্যাক্তি বলেছিলেন,মেয়েদের নাকি যেটা দেওয়া হয় সেটা নাকি তারা দ্বিগুণ রূপে ফেরত দেয়।সেটা ভালোবাসা, যত্ন, অযত্ন, যন্ত্রণা, কষ্ট যাই দেওয়া হয় না কেনো!নিভান নাহয় ভালোবাসা যত্ন দিক,দেখা যাক তা দ্বিগুণ রূপে ফেরত পাওয়া যায় কি-না!নিজের একান্ত ভাবনার মধ্যে কৌড়ির বলা কথাগুলো তাকে প্রশান্তি দিলো।ভিতরের নীরব নিবিড় অভিমান অভিযোগগুলো ধুয়েমুছে যেতে থাকলো।শক্ত হাতের বাঁধুনি আরও জোরালো হলো।কৌড়ির কথার প্রেক্ষিতে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে জবাবের বদলে বললো–

‘যদি বলি, আমার এখনি তোমাকে চাই।এবং খুব কাছে চাই।

এমনিতেই নাকমুখ ডুবিয়ে বসে আছে কৌড়ি।হঠাৎ এমন আবদারে সর্বাঙ্গ মৃদু কাঁপন দিয়ে বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠলো তার।নিঃশ্বাসও কেমন আঁটকে গেলো।তবে দ্বিতীয়বার আর নিজের অনুভূতির অসহ্যকর দাবানলে পড়ে ভুল করবেনা সে।মানুষটাকে চেনে জানে।ইদানীং বুঝতেও শুরু করেছে সে।উত্তর দিতে সময় নিলো।তবুও বললো–‘আমি জানি আপনি অবিবেচক, বিবেকহীন নন।

নিভানের ঠোঁটের কোণের হাসি চওড়া হলো।সোফার হেডে শক্তকরে সঁপে রাখা মাথা আরও শক্তকরে সপে দিলো।প্রশ্ন ছুড়লো।–জেনেশুনেও এতো অভরসা, অবিশ্বাস কেনো?

কৌড়ি ততক্ষণাত উত্তর দিলো–অভরসা,অবিশ্বাস নয়।

‘তবে?

উত্তর দিতে লজ্জা, অস্বস্তি হলো।তবুও বললো–আমার কেমন জানি হয়েছিলো।

এবার নিভানের হাসির মৃদু শব্দ হলো।লজ্জা বাড়লো কৌড়ির।সাথে সাথে নাকমুখ আরও ডুবিয়ে দিলো নিভানের গলার ভাঁজে।সেই লজ্জা আরও বাড়িয়ে দিয়ে নিভান দুষ্ট স্বরে শুধালো–কেমন?

নিভানের দুষ্ট গলার স্বর বুঝে তার পিঠ খামচে ধরলো কৌড়ি।ফের অতি নিচুস্বরে বললো—জানিনা।

নিভানের হাসি প্রস্ফুট হলেও,বউটাকে আর লজ্জায় ডুবালোনা।তবে উত্তর পেয়েও পুনরায় বললো –সত্যিই অভরসা অবিশ্বাস নেই তো?

সময় নিলো না কৌড়ি।মূহুর্তেই উত্তর দিলো—না।

নিভান এবার চোখ খুলে মাথা উচু করে বসলো।অভরসা অবিশ্বাস নেই যখন তখন বউটাকে একবার পরিক্ষা করে নেওয়া যাক।বিকালের ন্যায় অনুমতিবিহীন কৌড়ির ব্লাউজের হুকে হাত বসালো।পরপর তিনটে হুক খুলে বিকেলের পিন ফুটে যাওয়াটা আলগা করলো।সুচ ফোঁটার মৃদু চিহ্ন থাকলেও লম্বা দাগটা মিলিয়ে গিয়েছে।লাল ফোলা ফোলা ভাবটাও নেই।নিভান কোমল স্পর্শে জায়গাটা ছুলো।এতোসময় কৌড়ি চুপচাপ গাঁট হয়ে বসে থাকলেও এবার আর পারলোনা।তবে বিকেলের মতো ভুলও করলো না।
পুরুষালী রুক্ষ হাতের কোমল স্পর্শ শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঝড় তুলে দিলেও,ঢাল হিসাবে সেই মানুষটাকেই ক্ষত করলো কিন্তু মানুষটাকে ছাড়লোনা।বরং গলায় ডুবে থাকা মুখ এবার গলার ভাজ ছেড়ে নিভানের কানের পাশের নরম জায়গায় এনে শক্তকরে গুঁজে নিয়ে নিভানের পিঠের টিশার্টের অংশ দু’হাতের বলিষ্ঠ মুঠোয় চেপে ধরলো।শক্ত মুঠো টি-শার্টের অংশ ভেদ করে পিঠে আঁচড় কাটলো।তবুও নিভান নির্লিপ্ত। বরং কৌড়ির নখের আঁচড় আর ফর্সা কাঁধ তাকে নোশালো বস্তুর মতো টানলো।নিভান আগেপিছে ভাবলোনা।মাথা নিচু করে ঠোঁট বসালো বউয়ের কাঁধে। ইচ্ছে ছিলো পিনফোটা জায়গাটায় একটা আলতো চুম্বন দেওয়া।অথচ নিভানের সেই নেশালো আকর্ষণ চম্বুকের ন্যায় টেনে ধরে রাখলো কাঙ্ক্ষিত রমণীর ফর্সা মসৃন নরম কাঁধে।পুরুষালী সত্ত্বাটাকে সংযম হারিয়ে করে দিলো এলোমেলো।আলতো স্পর্শ হয়ে উঠলো,ঘনো।সেই ঘনো স্পর্শ আর কাঁধে রইলো-না।তীব্র অনুভূতির তাড়নায় কাঁধ থেকে সরে এলো নারী নরম গলার ভাজে,কন্ঠিতে।এমনকি কন্ঠি থেকে ফর্সা উন্মুক্ত গলার নিচে।অসংযত অনুভূতি স্পর্শকাতর জায়গা অনুভব হতেই মূহুর্তেই সচেতন হয়ে উঠলো নিভান।এ-র বেশি এগোলে আজ আর নিজেকে,এই নারী থেকে গভীর সান্নিধ্যে দূরে রাখা যাবেনা!একটু আগের ভাবনাগুলো সব বিফলে যাবে।ততক্ষণাত সরে এলো নিভান।তবে ভুলেও কৌড়িকে ছাড়লোনা।বরং দু’হাতে মেয়েটাকে চেপে নিলো বুকের ভিতর।সোফার হেডে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে,অনুভূতিতে এলোমেলো নিজের উথাল-পাতাল ভিতরটাকে সংযাত করে নেওয়ার চেষ্টা করলো।সঙ্গে অনুভব করলো বুকের মধ্যে থাকা পাতলা দেহটার প্রবল কাঁপুনি। তার ঘনো শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠানামা।আনমনেই হাসলো নিভান।এই মেয়ে সাংঘাতিক আদূরে।অথচ সামন্য আদর পেলেই নিজেকে ঠিক রাখতে মেয়েটা হিমশিম!এতো নাজুক মেয়েটাকে নিয়ে সামনের দিনগুলো ঠিক কেমন হতে চলেছে তার,কে জানে!বহুক্ষণ দুজনে চুপচাপ থাকলো।অনেক্ক্ষণ পর যখন অনুভব হলো,বুকের সাথে মিশে থাকা মেয়েটা স্বাভাবিক।তখন গিয়ে মুখ খুললো নিভান।

‘পায়ের ব্যাথার কি অবস্থা?ব্যাথা বেশি নাকি কম?

কৌড়ির ভিতরে তখনো ঝড়ো হাওয়ার মতো বয়ে চলছে অনুভূতির এলোমেলো তান্ডব।উপারে শান্ত দেখা গেলেও ভিতরটা এখনো লজ্জায় অশান্ত।গলার স্বরতো নিরোধন হয়ে গেছে সেই কখন!জীবনের প্রথম এতো ঘনিষ্ঠ পুরুষ স্পর্শ। তাও স্বামী নামক একান্ত পুরুষটার!মানুষটা তাকে কাছে টানলেও,আজ দুদিনে কখনো এতো গভীর, নিবিড়ভাবে ছুঁইনি।উফফ,কি নাজেহাল দমবন্ধকর অনুভূতি!নিভান প্রশ্ন করলেও উত্তর দিতে পারলোনা কৌড়ি।শুধু মাথা নাড়িয়ে না জানালো।তাতে বিশেষ কি বোঝালো সে নিজেও বুঝলোনা।নিভান তা বুঝে হাসলো।তবে নীরবে।বললো।

‘কথা বলো।

সময় নিয়ে কেমন অস্পষ্ট স্বরে কৌড়ি বললো–পায়ে তো সেভাবে ব্যাথা লাগিনি।ঠিক আছে।

‘তখন তো দেখলাম, নাফিম হাত ধরে সামনে এগোতেই তুমি কেমন ব্যাথা অনুভব করে চোখমুখ বন্ধকরে নিলে!

এটাও খেয়াল করেছে মানুষটা!লজ্জা যেনো কিছুটা কেটে গেলো কথার ছলে। বললো–হালকা মোচড় লেগেছিল।তাই হঠাৎ পা ফেলতেই একটু ব্যাথা অনুভব হয়েছিলো।তবে হাটাহাটিতে তা ঠিক হয়ে গেছে।

‘একটুও ব্যাথা নেই তো?

‘না!

আবারও কিছুক্ষণ চুপচাপ দু’পক্ষ।সময়টা নীরবতায় উপভোগ করলো।ফের নিভান বললো–কাল শাড়ী পরে ঘুম হয়নি, তাই-না?

এটাও খেয়াল করেছে মানুষটা!কৌড়ি আশ্চর্য হতে গিয়েও,নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো।ঠোঁটের কোণে ফুটলো নীরব মিষ্টি হাসি।মানুষটা নিজ থেকে তাকে বোঝে,তার আর কি চাই!নিভানের প্রশ্নের উত্তর সরূপ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।ফের মুখে ছোট্টো করে বললোো—হুমম।

চোখ খুলে কৌড়ির মাথার সিঁথির ভাঁজে চুমু খেলো নিভান।ফের বললো–‘আচ্ছা,উঠে পড়ো তাহলে।কাল ঘুমাওনি,ঘুমানো প্রয়োজন।বেডের উপর দেখো তোমার পোশাক আনিয়েছি।ফ্রেশ হয়ে ওটা পরে নাও।

কৌড়ি উঠতে যাচ্ছিলো অথচ শক্ত হাতের বাঁধন তখনো মুক্ত হয়নি।আঁটোসাটো বাধনেই তাকে আঁটকে রেখেছে।কৌড়ি নিভানের মুখের দিকে চাইলো।সেটা দেখে নিভান দুষ্টমিষ্টি গলায় বললো–এতো তাড়াহুড়ো কেনো!বলছি বলেই সঙ্গে সঙ্গে উঠতে হবে?শুধু আমার থেকে দূরেদূরে থাকার সুযোগ খোঁজা তাইনা?

সুযোগ খুঁজে দূরে দূরে আর যাবে কোথায়?আর দূরে গিয়ে থাকবেই বা কোথায়?কৌড়ি তার প্রশান্তি,সুখের ঠিকানা তো পেয়ে গেছে।পালিয়ে গিয়ে হোক বা দূরেদূরে অথবা ঘুরিফিরে, একটু শান্তিতে থাকার জন্য যে তার এই মানুষটার কাছেই আসা লাগবে।তার বুকেই আশ্রয় নিতে হবে।যার বুকে সে নিজের নিরাপত্তা খুঁজে পেয়েছে,সুখ খুজে পেয়েছে।সেই জায়গাটা ছেড়ে কি পালিয়ে বেড়ানো যায়!নাকি সেই মানুষটা থেকে দূরেদূরে থাকা যায়!কতশত ভাবলেও কৌড়ি মুখে কিছু বললোনা।নীরবে সেই ভারসাপূর্ন আশ্রয়ে মাথা রাখলো।কোমল শরীরটা ছেড়ে দিলো সেই শক্তপোক্ত হাতের বাঁধুনিতে।দু’হাতে আবারও আঁকড়ে ধরলো সেই বলিষ্ঠ পিঠ।কথা না বললেও নীরব স্পর্শে বুঝিয়ে দিলো-আমি আপনার থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাইনা।আর না দূরেদূরে থাকার প্রয়াস করছি।

নীরবে আরও কতকমূহর্ত পার হয়ে গেলো।কেউ আর কোনো কথা বাড়ালোনা।শুধু রাতের একদল বুনো হাওয়া জানালা ভেদ করে ক্ষনে ক্ষনে ছুয়ে গেল তাদের।

ওয়াশরুমে ঢুকে গায়ের থেকে শাড়ী নামাতেই যেনো স্বস্তি পেল কৌড়ি।মনেহলো,গায়ের থেকে ভারী কোনো বস্তু নেমে গেছে।হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিভানের দেওয়া প্যাকেটা খুলতেই দেখতে পেল তাতে একজোড়া লেডিস্ নাইট স্যুট।এটা পরে ওই মানুষটার সম্মুখে যেতে হবে এখন!বাড়িতে অলটাইম সালোয়ার কামিজ পরতো কৌড়ি।ওবাড়িতে আসার পর রাতে কম্ফোর্টেবল পোশাক পরে ঘুমানোর জন্য মান্যতা, তাকে লেডিস্ টিশার্ট আর প্লাজু কিনে দিয়েছিলো।তা শুধু সে রাতেই ব্যবহার করতো।নাইট স্যুটটা কিছুটা ওরকম হলেও কমফোর্টেবল হতো।যদিও স্যুটজোড়া কিছুটা তেমনই।তবে লেডিস্ টিশার্ট আর প্লাজুর মতো ততোটাও ঢিলাঢালা নয়।ক্লান্তিতে অতশত বেশি আর ভাবলোনা কৌড়ি।পরে নিলো।পাজামাটা ঠিকঠাক মনে হলেও,নাইট স্যুটের শার্টটা লেডিস্ টিশার্টের তুলনায় শর্ট।স্যুট জোড়া গায়ে জড়িয়ে নিজেকে একবার কেমন অদ্ভুত চোখে দেখে নিলো কৌড়ি।মোটেও খারাপ দেখাচ্ছে না।আর না পোশকটা অশালীন।পোশাকটা গায়ে স্বস্তি দিচ্ছে, তবে মন ভুগছে অস্বস্তিতে।এই পোশাকে ওই মানুষটার সামনে!উফফ!!দুপুরে গোসল সেরে নিতুর সেলোয়ার-কামিজ পরেছিলো।বিকালে বাহিরে যাওয়ার সময় তা রুমে খুলে রেখে গিয়েছিলো।সেটা পরলে-ও তো হতো।খেয়ালেই ছিলোনা।

কিছুক্ষণ দ্বিধা দন্ডে ভুগে যখন বুঝতে পারলো,এই পোশাকেই বের হতে হবে তাকে।আর ওই মানুষটারই সাথেই থাকতে হবে!নিজেকে ধাতস্থ করলো।আপতত ওড়না পরতে পারলে এতো অস্বস্তিও লাগতো না।হঠাৎ অনুভব করলো,রুমের মধ্যে নীরব।লাইটের আলোটাও তীক্ষ্ণ নয়,মৃদু।ওয়াশরুমের দরজাটা হালকা খুলে উঁকি দিলো কৌড়ি।সত্যি তাই!নিভান লাইট অফ করে,সবুজ বাতির মৃদু আলোটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়েছে।এবার কিছুটা স্বস্তি পেলো সে।খোলা পোশাকগুলো হাতে নিয়ে বের হলো।সেগুলো আপতত সোফার উপরে রেখে,ওড়নাটা খোজ করলো।মৃদু আলোতে তা খুঁজে পেতে সময় লাগলো।বিকালে ঘুরতে যাবার আগে পোশাক পাল্টিয়েছিলো ওয়াশরুমে।আর পোশাকগুলো পাল্টে রেখে এসেছিলো বারান্দায়।মনে পড়তেই, সেখান থেকে ওড়নাটা নিয়ে গায়ে দিলো।রাত অনেকে হয়েছে।তারা বাড়িতে ঢুকেছে প্রায় এগোরোটার দিকে।বাহির থেকে খেয়ে এসেছিলো বলে খাবারের ঝামেলা আর করতে হয়নি।ক্লান্তিতে যে যার রুমে চলে গিয়েছে।কৌড়িরও প্রচুর ক্লান্তিতে ধরেছে।ঘুমে চোখ জুবুথুবু অবস্থা।অথচ হঠাৎ আবার কোথা থেকে একদল কুন্ঠা,দ্বিধা ঘিরে ধরছে তাকে।মনটা যেনো বেডে গিয়ে ধপাৎ করে এলিয়ে দিয়েছে,অথচ পা টনটন!বেডের দিকে এগোতে কেমন দ্বিধা করছে!যদিও মানুষটা কাছে টানলে কিন্তু সেসব দ্বিধা,অস্বস্তি, কুন্ঠা লজ্জা মূহুর্তেই সব গায়েব হয়ে যায়।তবে মানুষটার কাছে পৌছানো অব্দি তা প্রকট থেকে যায়।কেমন অদ্ভুত সব অনুভূতির বেড়াজালে আটকে গিয়েছে কৌড়ি।যার কোনো তাল- ঠিক নেই।বলা নেই কওয়া নেই লজ্জা, কুন্ঠা, অস্বস্তিরা, হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়,আবার হুটহাট মিলিয়ে যায়!একটু আগের কথাগুলো মনে পড়লে যেনো এসব অনুভূতিগুলো আরও দৃঢ় হচ্ছে।ভাবতে ভাবতে কখন যে বেডের পাশ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে বুঝতে পারলো-না কৌড়ি।বুঝতে পারলো যখন তার কোমল হাতে টান পড়লো।মূহুর্তেই বেডে পড়ে গেলো সে।এবং চকিতেই ঢুকে গেলো কারও কাত হয়ে শুয়ে থাকা বলিষ্ঠ বক্ষতলায়।নিঃশ্বাস আঁটকে এলো।কোমল হাতজোড়ার অবস্থান আপনাআপনিই চলে গেলো উন্মুক্ত চওড়া পিঠে।সহসা সর্বাঙ্গ ছমছম করে শিহরে উঠলো।চোখমুখ ডুবে গেলো লোশমভরা বুকে।যেখান থেকে তীক্ষ্ণ জেন্স পারফিউমের সুগন্ধ সরাসরি নাকের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে মাতোয়ারা করে তুলছে নারী কোমল মনটাকে।কৌড়ি মূহুর্তেই মোহাবিষ্ট হলো।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলেও কোনো উশখুশ করলো-না। বরং শান্ত থাকলো।কিন্তু তাকে শান্ত থাকতে দিলো-না স্বামী নামক নির্লজ্জ পুরুষটা।মেয়েটাকে আঁটোসাটো বাঁধনে বেঁধে নিয়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো কৌড়ির গলার ভাঁজে কানের পাশে।অসংযত স্পর্শ চললো সেখানে।তারসাথে চললো ঘনো স্বরের অসংলগ্ন বার্তা।

‘তুমি আমাকে যতোটা ধৈয্যশীল,সহনশীল পুরুষ ভাবো।আমি ততোটা একদম নই।বিশেষ করে তোমার ক্ষেত্রে।তোমাকে কাছে পাওয়ার তাড়না সম্পর্কে সামন্যও জ্ঞাত নও তুমি!শুধু অসুস্থ বলে ছাড় পেয়ে যাচ্ছো।তবে তোমার সময়সীমা একসপ্তাহ।সেই সময়টা পিছানো ছাড়া এগোবে-না এক সেকেন্ডও।সুতরাং অবিশ্বাস অভরসা যখন নেই সর্বক্ষণ,বি রেডি!কারন তোমার দেওয়া সময়সীমাটা ফুরিয়ে আসছে,একসপ্তাহ থেকে অলরেডি তিনটা দিন চলে গিয়েছে।আর আজকের পর ভেবোনা সময়টা একসপ্তাহ পর্যন্তও গড়াবে!যদি-ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কোনো মানা বারণ নেই।তবে মানাটা আমার ক্ষেত্রে নিজথেকে প্রযোজ্য মনে করেছি আমি।তবে তাই বলে আমার হালাল স্ত্রীর থেকে রোজ রোজ উপবাস!নো ওয়ে!

উপবাস!কি নির্লজ্জ কথাবার্তা!মুখের লাগামে যেনো সামন্য কুন্ঠাও নেই!এতোসময়ের পাথর বনে যাওয়া মেয়েটা এবার নড়েচড়ে উঠলো।যদিও দীর্ঘকার শরীরের মধ্যে তা খুবই মৃদুতর হলো।তবুও আশ্চর্য হয়ে খিঁচে রাখা চোখমুখ খুলে ফেললো সে।বিস্ময়ে অস্পষ্ট স্বরে মুখ দিয়ে বের হয়েই গেলো–ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী মানে?এসবও জিজ্ঞেস করতে হলো ডক্টরের কাছে!

নিভান হাসলো।একদম স্বতঃস্ফূর্ত।সেই হাসিতে লজ্জা পেয়ে পুনরায় চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো কৌড়ি।
বুঝতে পারলো,নির্লজ্জ পুরুষটার থেকেও নির্লজ্জ প্রশ্ন শুধিয়ে ফেলেছে সে।লজ্জায় গুটিয়ে যেতে চাইলো অঙ্গ।তা হতে দিলোনা নিভান।নিজের সাথে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে মেয়েটা নড়তেও পারলো না।গুটিয়ে যাওয়া তো দূর!নিভান সেই লজ্জা টের পেতেই গলা থেকে মুখ উচু করে কৌড়ির পানে তাকালো।হালকা সবুজ আলোয় ফর্সা গোলগাল মুখটা লোভনীয় স্বরে আহবান জানাচ্ছে তাকে।সেকেন্ড সময় ব্যায় করলোনা নিভান,আহ্বানে সাড়া দিতে।কৌড়ির গালে ঠোঁট ডুবিয়ে জড়ানো গলায় উত্তর দিলো—কৌড়ি বলতে নিভান প্রচন্ড নির্লজ্জ,বেহায়া,অসভ্য!তা হয়তো তুমি এখনো বুঝে উঠতে পারোনি!তুমি যে অসুস্থতা কাওকে না জানিয়ে পুষেছো!তা ক্ষনিকের নয়।আবার দীর্ঘস্থায়ী না হলেও একেবারে সারারও নয়।সেখানে এমন একটা বন্ধনে আমরা জড়িয়েছি,জানতেই হতো আমাকে।জানাটা গুরুত্বপূর্ণ-ও মনে করেছি আমি।তাই জেনে নিয়েছি।বিষয়টা নরমাল!

বিষয়টা নরমাল?তাহলে কৌড়ির ভিতরটাতে এমন ঝড় তুফান বয়ে যাচ্ছে কেনো!হ্দপিন্ডটার গতিবেগ এ্তো খারাপ পর্যায়ে!কখন না জানি যন্ত্রটা বুকের চামড়া ভেদ করে ছিটকে বেরিয়ে আসে!বাহিরে কৌড়ি অসাড় হয়ে চুপচাপ পড়ে থাকলেও,ভিতরের সত্ত্বাটা ঝড় তুফানের মতো এলোমেলো।কৌড়ির ঠোঁট ভেদ করে আর একটা শব্দ বের করার চেষ্টা করলোনা।যেখানে নিঃশ্বাস ফেলা দুষ্কর সেখানে গলার শব্দরা এমনিতেই বিলিন।শব্দ বেরোনোর মতো পরিস্থিতি এমনিও নেই।পুরুষালী ঠোঁটজোড়ার এলোমেলো বিচরণ চলছে তার সমগ্র মুখজুড়ে।অনুভূতিতে শিথিল সে।কথা বলবে কিকরে!যেখানে শরীরের সাড় নেই!হঠাৎ নিভান থেমে গেলো।মুখ উচু করে কৌড়ির বুঁজে থাকা চোখমুখের দিকে কিছুক্ষণ শান্ত,স্থির চোখে তাকিয়ে তাকে ডাকলো।

‘কৌড়ি।

ডাকটা কেমন যেনো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনালো।অনুভূতিতে জুবুথুবু হয়ে চোখ বুঁজে থাকা,কৌড়ি তবুও সহসা ডাক শুনলো–হুমম।

‘আর ইউ শিউর,আমার প্রতি তোমার পূর্ন আস্থা, বিশ্বাস ভরসা আছে?অভরসা, অবিশ্বাস নেই?

কৌড়ি ততক্ষণাত উত্তর দিলো–শিওর।

উত্তর পেয়েও নিভান মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ কৌড়িরপানে চেয়ে রইলো।সত্যি বলতে,তার এই হঠাৎ স্বামী জাতীয় অসংলগ্ন আচারণ নীরবে কৌড়ির মেনে নেওয়া হুটকরে মনে হুল হয়ে প্রশ্ন তুললো-মেয়েটা কি বিকালের ঘটনার পর নীরবে মেনে নিতে চাইছে সব?নাকি স্বামীর আদর ভালোবাসা পেতে তারও সায় আছে।যদি-ও কৌড়ির নারীগত আচারণ বলছে সায় আছে।তবুও মনের খচখচানি থেকে প্রশ্নটা তৃতীয়বারের মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধালো নিভান।এবং উত্তর পেতেই মনটা ঠান্ডা হলো।ঠোঁট ফুটলো মিষ্টি হাসি।ছোট্টো বউটাকে আদর দিতে মনটা আবারও অসংলগ্ন হয়ে উঠলো।তবে এবার আর বেপরোয়া হয়ে উঠলোনা নিভান।আজ বেপরোয়া হলে চলবেনা!মাথা নিচুকরে চুমু খেলো কৌড়ির মসৃন কপালে,ডাগরডোগর বদ্ধ দুচোখ,খাঁড়া নাকে,তুলোর মতো ফর্সা দুগালে।ফের নরম ওষ্ঠে।

জায়গাগুলোই চুম্বনের স্পর্শ দীর্ঘ হলেও,ঠোঁটের চুম্বনটা একটু বেশিই দীর্ঘ হলো।কৌড়ি তখনো চোখ বুঁজে শান্ত মেয়েটার মতো বরের আদরে ডুবে আছে।উম্মুক্ত পিঠে হাতের বাঁধনটা পরপর শক্ত হতেই থাকলো।চুম্বন শেষে নিভান কৌড়ির হাতের বাঁধন মুক্ত করে ধপাৎ করে তার পাশে শুয়ে পড়লো।সেকেন্ড সময় ব্যায় না করে কৌড়ির পাতলা শরীরটা তুলে নিলো নিজের বলিষ্ঠ শরীরের উপর।গা থেকে ওড়নাটা সরিয়ে,ওর মাথার চুলের বেনুনিতে হাত দিলো।বেনীটা ওয়াশরুমে দাঁড়িয়েই করেছিলো কৌড়ি।পরপর মোটা আঙুলের ভাজে বেনী খুলে ফেললো নিভান।নিজের মাথার নিচে আরও একটা বালিশ দিয়ে মাথাটা উচু করে, কৌড়ির চুলের ভাজে আঙুল চালালো।কপাল মুখ থেকে এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে, মুখ উচু করে ফের সিথির সম্মুখে কপালে চুমু খেলো।একহাতে কৌড়িকে জড়িয়ে রেখে, অন্যহাতটা কৌড়ির মাথার চুলের ভাঁজে গলিয়ে দিয়ে বললো—ঘুমিয়ে পড়ো।

কৌড়ি শব্দ করলো-না।স্বামীর আদর ভালোবাসার মোহ এখনো কাটিনি তার।গত দুদিনে মানুষটা কাছাকাছি থাকলেও,তার স্পর্শ পেলেও এতোটা গভীরে অনুভব হয়নি।যা আজ হলো।স্বামীর আদর ভালোবাসা ঠিক কি!আর কতোদূর সেই ভালোবাসা গড়ায় এটা কৌড়ি জানে।তবে সেই স্পর্শের অনুভূতি এতোটা প্রবল হয়,নিজেকে এতোটা এলোমেলো করে দেয়, কৌড়ির জানা ছিলোনা।নিজেকে সামলাতে হিমশিম কৌড়ি,শান্ত হয়ে চুপচাপ রইলো নিভানের উন্মুক্ত বুকে।তবে অনুভব করলো,উন্মুক্ত বুকটা তারকাছে বিছনার চেয়ে আরাম আর শান্তির।যা তার ক্লান্ত শরীরটাকে আর বেসামাল মনটাকে দ্রুত নিস্তেজ করে দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে দিলো।বেশ কিছুসময় পর কৌড়ির ঘনো শ্বাস বুকে পড়তেই নিভান মুখ সামন্য উচু করে চাইলো।মেয়েটা ঘুমে বিভোর।ঘুমন্ত কৌড়ি আরও মোহনীয় আরও আকর্ষনীয়, আরও মুগ্ধময়,আরও সুন্দর।যা চম্বুকের ন্যায় টানলো নিভানকে।কিন্তু ঘুমান্ত মেয়েটাকে একটুও বিরক্ত করতে ইচ্ছে করলোনা তার।তাই মাথাটা বালিশে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে নিলো সে।হাতের বাঁধন দৃঢ় করে অস্পষ্ট স্বরে কেমন দূর্বল মায়ামায়া গলায় বললো।

‘আমার বলতে কিচ্ছু না থাকলে-ও,তুমি অমৃত্যুকাল আমার হয়ে থেকো কৌড়ি।আমাকে বাহিরে শক্তপোক্ত মানুষ হিসাবে সবাই জানলেও,আমি ভিতর থেকে ভিষন দূর্বল কৌড়ি।সেটা তুমি জানোনা!তুমি কেনো।কেউই জানে-না কৌড়ি!আমার সবলতা বাবা ছিলেন।অদ্ভুত এক সবলতা।হয়তো প্রতিটা সন্তান তার নিজ নিজ বাবার মধ্যে সেই সবলতা অনুভব করে।কিন্তু বাবাকে ঘিরে আমার সব অনুভূতি ছিলো অদ্ভুত ধরনের।উনাকে জড়িয়ে ধরলে অদ্ভুত এক শক্তি,শান্তি, নিরাপত্তা অনুভব করতাম।মনে হতো-তিনি আমার বলরেখা।যা টপকে কখনো কোনো খারাপ কিছু আমাকে ছুঁতে পারবেনা।তিনি ছুঁতে দেবেননা।অথচ বাবা হারিয়ে যেতেই,সেই সবলতা হারিয়ে ভিতরের আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম।মনে হতে থাকলো,বাবা হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনের সবলতা,সুখ,শান্তি,নিজ আশ্রয়,আপনমানুষ সব হারিয়ে যেতে শুরু করলো!হারিয়ে গেলেও তাই!আমার গোছানো সুন্দর জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।
তবুও আমি খুঁটির মতো শক্ত থাকার চেষ্টা করলাম।যদিও জীবনের একটা একটা ধাক্কায় আমি খুঁটির মতো শক্ত হতে বাধ্য হলাম।অথচ ভিতরের মনটা আমার ভিষন দূর্বল হয়ে পড়লো।বাহিরের শক্তপোক্ত আমি ভিতরের দূর্বলতায় নিজেকে আর গুছিয়ে নিতে চেয়েও কিছুতেই গুছিয়ে নিতে পারলাম না।বাহিরের নিভান সফলতায় আকাশচুম্বী হলেও ভিতরের নিভান কতো ব্যর্থ তুমি জানোনা কৌড়ি।আর সেই পুরানো সবলতা, অদ্ভুত এক শক্তি,শান্তি আমি তোমাতে অনুভব করেছি।বাবাকে জড়িয়ে ধরলে যেমন একটা সুখ সুখ অনুভব হতো।তোমাকে বুকে জড়িয়ে নিলে তেমন অদ্ভুত এক সুখ সুখ আমাকে ঘিরে ধরে।ভিতরের দূর্বলতা কেটে গিয়ে সেখানে প্রশান্তি অনুভব করে।মন বলে-আমারও একজন আপন মানুষ আছে।আামর বাবার মতো আপন মানুষ।

আপনমনে কথা বলতে বলতে একটু থামলো নিভান।পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই অথচ বাবাকে মনে পড়লে তার চোখে অশ্রু না ঝরলেও মন কাঁদে।ভিষণ কাঁদে।নিভান চোখ বুঁজে নিলো।মূহুর্তেই কার্ণিশ বেয়ে অযত্নে নোনাজল গড়ালো।কেনো বাবা চলে গেলেন, তবে তার আরও একজন আপনমানুষ থাকতো।কৌড়িকে জড়িয়ে রাখা হাতের বাঁধন দৃঢ় হলো তার।চোখ বুঁজে রেখেই অস্পষ্ট স্বরে ফের বললো—বাবা অসময়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেলেও,তুমি যেওনা কৌড়ি।অন্তত আমার মৃত্যুর আগ অব্দি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেওনা।আমার মৃত্যুর অপেক্ষা করো আমার ফুলকৌড়ি।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে