ফুলকৌড়ি পর্ব-৫২+৫৩

0
3

#ফুলকৌড়ি
(৫২)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

চারপাশটা ঘনো অন্ধকার।নিঃশব্দ নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ ।ঝিঁঝি পোকার মৃদু আলোড়ন ছাড়া তেমন কোনো শব্দ নেই।নেই আজকের আকাশে চাদের দেখাও।তবে কিছু সংখ্যক নক্ষত্র আকাশের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিটিমিটি জোনাকি পোকার ন্যায় জ্বলজ্বলে আলো ছড়াচ্ছে।চমৎকার দৃশ্যাবলী।কৌড়িকে বুকে জড়িয়ে নিতেই আচমকা বুকে কিছু একটা বিধলো নিভানের।বুঝতে পারলো জিনিসটা কি?
তবে পেলব শরীরটাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে না নিতে পারলে কেমন শান্তি পাওয়া যায়না।মেয়েটাকে কাছে পাওয়ার যে বাসনা,সেই বাসনা তৃপ্ত হয়না।সহসা সন্তপর্ণে কৌড়ির গলায় হাত রাখলো নিভান।পুরুষলী রুক্ষ হাতের দৃঢ় স্পর্শ পেতেই মূহুর্তেই শিহরণ দিয়ে মৃদু কেপে উঠলো নরম ফিনফিনে শরীরটা।অনুভব করলো নিভান।তবে হাত থামালো না।রুম থেকে আসা মৃদু আলোতে কিভাবে কিকরে যেনো অভিজ্ঞ হাতে কৌড়ির গলার মালাহারটা খুলে ফেললো।খুলে ফেলতেই সেটা হাতে এনে নিজের ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো।মেয়েটাকে এবার নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে শুধালো।

‘সাজিয়ে দিলো কে?

কৌড়ি কেমন যেনো সাহস দেখিয়ে নিভানের বুক থেকে মাথা তুললো।মাথাটা হালকা পিছে সরিয়ে নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো—ছোটোচাচী।

জানালার ফাঁক গলিয়ে রুমের মৃদু আলো এসেছে পড়েছে কৌড়ির মুখে।সেই লুকোচুরি আলোতে সাজবিহীন একটা স্বর্ণের টিকলিতে মেয়েটাকে অপূর্ব লাগছে।নিটোল ফর্সা কপালে ওই আকাশের নক্ষত্রের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে টিকলিটা।এই মেয়েটাকে যে সাজপোশাকেই আর যেমন রূপেই দেখুক না কেনো, নজর মুগ্ধ হতে বাধ্য হয় নিভানের।নিভান গভীর নিস্প্রভ নজরে কিছুক্ষণ একহারা দেখলো মেয়েটাকে।এই নারীটাকে ঘিরে তার চাহিদা ভালোবাসাগুলো ভিষন নরম,কোমল।তাকে একটু ছোঁয়া,একটু ভালোবাসার,একটু কাছে পাওয়ার তীব্রতা খুব গাঢ় হলেও,তারপ্রতি ভালোবাসাগুলো খুব আলতো,তাকে ছুঁয়ে দেওয়ার বাসনাগুলো খুব নরম।একদম খাঁটি মন থেকে বেরিয়ে আসা স্নিগ্ধ মনোবাঞ্ছা।অথচ পুরুষ চাহিদাটা যখন মেয়েটাকে ঘিরে নিজের ভিতরটাকে তোলপাড় শুরু করে দেয়, তখন নিজেকে সংযাত রাখা, সংযম করা কঠিন দ্বায় হয়ে পড়ে।এই দ্বায়টা কালথেকে উৎপাত করা শুরু করে দিয়েছে।অথচ মস্তিষ্ক, বিবেক প্রতিমূহর্তে সেই চাহিদার বিপক্ষে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলছে,মেয়েটা অসুস্থ।তাকে সময় দেওয়া অতি অবশ্যই প্রয়োজন।যেখানে মেয়েটা আমৃত্যু পর্যন্ত তোর।সেখানে এতো অসংযত, অসংযম কেনো!এতো তাড়াহুড়োই বা কেনো!কর-না নিজের পৌরুষ আকাঙ্ক্ষাকে একটু সংযম, সংযাত।তবেই না তুই নিয়ন্ত্রাধীন পুরুষ!যার কামনা বাসনাগুলো একান্ত স্বস্ত্রীর জন্য হলেও, প্রয়োজনে সে সংযমী।

নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে আলগোছে কৌড়ির কপালের টিকলির নিচে দু-ভ্রুর মাঝে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে সময় নিলো নিভান।নিজ পুরুষ চাহিদাকে সংযাত করার প্রচেষ্টা করলো হয়তো!স্পর্শ পেতেই চোখ বুঁজে নিলো কৌড়ি।নিভান শুধু কৌড়ির কপালেই থেমে থাকলো না, গড়ীরভাবে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো প্রিয়তমা স্ত্রীর নাকের উপরের অংশভাগকেও।ফের চোখবুঁজে থাকা কৌড়ির দিকে একপল তাকিয়ে নিজের ওষ্ঠ নিয়ে রাখলো সেই একান্ত নারীর গোলাপের পাপড়ির ন্যায় নরম ওষ্ঠে।আচমকা গভীর স্পর্শে কৌড়ি চোখমুখ আরও খিঁচে বন্ধ করে নিলো।শক্তহাতে খামচে নিলো,নিজস্ব পুরুষটার পিঠের শার্টের অংশবিশেষ।তারপর পুরুষালী ওষ্ঠের স্পর্শ যখন সয়ে এলো,সময় পেরুতেই ধীরেধীরে নিজেকে সহজ করে নিলো স্বামীর স্পর্শে।এরপর সময়ের কাঁটাটা এক দুই করে এগোতেই থাকলো।একটা সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকলো।অথচ স্ত্রীকে ছাড়ার লক্ষ্মণই পরিলক্ষিত হলো-না সেই মানবের মধ্যে।হাতে মুঠোয় শার্টের অংবিশেষ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকলো কৌড়ির।শার্ট ভেদ করে সেই মুঠো বলিষ্ঠ পিঠেও আঁচড় কাটলো বৈকি।তবুও ভ্রুক্ষেপহীনভাবে তার ওষ্ঠজোড়া গভীর আশ্লেষে ছুয়ে যেতে থাকলো সেই পুরুষ ওষ্ঠজোড়া।একটা সময় শ্বাসের অকুলনে ছটফটিয়ে উঠলো কৌড়ি।আর ঠিক তখনই ছেড়ে দিলো নিভান তাকে।আলাদা হলো দুজোড়া ওষ্ঠ।কৌড়ি নিভানের বুকে মাথা রাখলো।থেমে থেমে দূর্বল নিঃশ্বাস ফেলে আরও জড়োসড়ো হলো সেই ভরসাপূর্ন আশ্রয়ে।নিভান দু’হাতে তাকে আগলে নিয়ে আলগোছে হাসলো। ফের দুষ্টমিষ্টি গলায় বললো।

‘এইযে তোমাকে বারবার এরকম অপরূপা অনন্য সাজে সাজিয়ে আমার সম্মুখে উপস্থাপন কোরে,আমার সংযমের পরিক্ষা নিচ্ছে সবাই!নিচ্ছো তুমিও!এটা কি ঠিক?একবার নাহয় ঠিক।বারবার কিকরে তা ঠিক হয়?
ঠিকযে নয়,তার অপ্রাপ্য শাস্তি এটা।

অপ্রাপ্য শাস্তি!যে ছোঁয়ার স্পর্শ উপরিভাগ হলেও কলিজা ছেদ করে যায় তা সাধারণ বা অপ্রাপ্য হয় কি করে!কথার সারাংশ বেশ বুঝলো কৌড়ি। উত্তর দিলো-না।নিজের শ্বাস স্বাভাবিক করতে ব্যস্ত সে।সেদিকে খেয়াল দিলো-না নিভান।তবে মেয়েটাকে আরও সতর্কস্পর্শে আগলে নিলো নিজের সাথে।ফের নজর রাখলো সামনের নিকেষ কালো অন্ধকারে।সময় অতিবাহিত হলো।কিয়ৎক্ষন দু’জনের মুখে শব্দরা ভিড়লোনা।বেশ অনেকটা সময় পর নিভান শুধালো।

‘ঘুম পাচ্ছে?

অনেকক্ষণ পর নিজেও স্বাভাবিক হলো কৌড়ি।নিভান প্রশ্ন শুধাতেই নমনীয় গলায় উত্তর দিলো সে।–ঘুম পেলেও বারান্দায় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে।

এভাবে দাড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে!কথার মর্মার্থটা অনুভব করেই মেয়েটাকে আরও নিবিড় স্পর্শে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো নিভান।দক্ষিণের মৃদুমন্দ হাওয়া বয়ে চলেছে ঝিরিঝিরি।দুজনকে ছুয়ে দিচ্ছে তা ক্ষনে ক্ষনে।সময়টা বেশ উপভোগ্যময়।তবুও কৌড়ির কথা প্রেক্ষিতে নিভান বললো–সেই অসুস্থ হওয়ার পর ঘুমটা প্রয়োজন ছিলো তোমার।অথচ তারপর একটা রাতও ঠিকঠাকভাবে ঘুমাতে পারলে না।অসুস্থতা তো বাড়বে!শরীর আরও খারাপ করবে তো!

‘একটা রাত আর কিচ্ছু হবে-না।জেগে থাকলেও রাতগুলো তো আমার দুশ্চিন্তায় আর কষ্ট ক্লেশে কেটে যাচ্ছে না!বেশ শান্তিপূর্ণ আর আরামেই যাচ্ছে। আর এমনিতেই আমি যথেষ্ঠ সুস্থ আছি।

নিভান আর কথা বাড়ালো-না।দক্ষিণা হাওয়ার ঝাঁপটাটা এবারে একটু তীব্র রূপে বইলো।দুজনের শরীরটা ছুঁয়ে যেতেই চোখ দুটো বুঁজে নিয়ে কেমন স্বস্তি শান্তির ঘনো নিঃশ্বাস নিলো নিভান।কৌড়ি সেটা বুঝতে পেরে মাথা উচু করে আবারও তাকালো নিভানের মুখের পানে।তখনো নিভান চোখ বুঁজে।তবে চোখবুঁজেও কৌড়ির গতিবিধি অনুভব করতে পারলো।কেমন অদ্ভুত গলায় বলতে থাকলো।

‘মায়ের সাথে এবাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর আরও দু’বার এবাড়িতে এসেছি।এই ভূতুড়ে বাড়িটা আমাকে অদ্ভুত শান্তি দেয়,স্বস্তি দেয়,জানো!এখানের আলো বাতাস,খোলা আকাশ,এই ভূতুড়ে বাড়িটা,সবকিছু কেমন আমার আমার মনেহয়।একান্ত, নিজস্ব মনেহয়।আপন আপন মনেহয়।অথচ এই স্বস্তি এই শান্তি এই আপনতা,এই নিজস্বতা আমার ওই বাড়িতে কখনো অনুভব হয়না।এবাড়িতে সামন্য শিশুকাল ছাড়া আমার কিচ্ছুটি নেই।এই শিশুকালও ধোঁয়াশার মতো শুধু একদলা আবাছা স্মৃতি।তা সত্ত্বেও এবাড়িটা কেমন যেনো আমাকে টানে।অথচ ওবাড়িটায় আমার শৈশব কৈশোর বেড়েওঠা,কতো কতো-স্মৃতি, ভালোমন্দ সবকিছু,থাকা সত্ত্বেও ওবাড়িটাতে আমি সেই আপনতা, নিজস্বতা খুঁজে পাইনা।নিয়মকরে স্বস্তি শান্তির শ্বাস প্রশ্বাস তো ছেড়ে যাই,তবে প্রানখুলে স্বস্তি শান্তি পাইনা। সবসময় মনেহয় ওবাড়িতে আমার বলে কিচ্ছুটি নেই। কিচ্ছু না।

কৌড়ি অবাক।অদ্ভুত শোনালো নিভানের গলার প্রতিটি বাক্য।অথচ সেই অদ্ভুত গলার স্বরটা পড়ার ক্ষমতা হলো না তার।পুরুষালি স্বরের সেই শব্দগুলোয় অনুরাগ অভিযোগ, নাকি অভিমান মিশানো ছিলো বুঝলোনা কৌড়ি।কেমন আশ্চর্য গলায় বললো।

‘ওবাড়ির সবাই কিন্তু আপনাকে খুব ভালোবাসেন।বড়মার কথা বাদ আঙ্কেল কিন্তু আপনাকে প্রচন্ড স্নেহ করেন, ভালোবাসেন।ইভান ভাইয়া,মান্যতা আপু,এমনকি নাফিম,মৌনতাও কিন্তু আপনাকে যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসেন।

তুমি যে সুন্দর চিত্তটা ওবাড়িতে এসে দেখেছো কৌড়ি।এমন চিত্তটা আগে ছিলোনা ওবাড়ির।আর নিভানকে ভালোবাসার মানুষও তখন ওবাড়িতে সীমিত ছিলো কৌড়ি।খুবই কম।হয়তো সংখ্যায় মা বাদে ওই একজনই ছিলেন।যার পিতৃস্নেহ কখনো তাকে ওই বাড়িটা পরিত্যাগ করতে দেয়নি।বারবার তার এগোনো পা-কে আরও দুকদম করে পিছিয়ে দিয়েছে।আটকিয়ে রেখেছে নিজ মায়াজালে।তবে সেই মানুষটাও কি জানতো,ওই বাড়িটায় সারাটাক্ষন ওই ছোট্টো নিভান কি কি সহ্য করতো?কতো ছোটো বড় কটুবাক্য শুনতে হয়েছে তাকে?নিজের বলে কিছু নেই,পরের ছেলে পরের ছেলে বলে কতো লাঞ্চনা,অবাঞ্ছিত কথা শুনতে হয়েছে?কোনো কিছু ধরার,কোনো কিছু ছোয়ার একছত্র অধিকার ছিলো না সেই ছেলেটার!সম্পর্কের সুত্র অনুযায়ী নিভানের ডাকগুলোও তাদের পছন্দ হতো না। যার ছিলো সব অথচ ধরা,ছোঁয়ার অধিকার ছিলোনা কিচ্ছু।সে যে পর রক্ত ছিলো!ছিলো আগাছাও!সবকিছু সেই ছোট্টটা থেকে এই নিভান কতোকিছু ভেবেই না গিলে হজম করে এসেছে কৌড়ি!সেই নিচুবাক্যগুলো,অবলেহা অপমানগুলো যদি তুমি শুনতে,জানতে,নিজচোখে দেখতে কৌড়ি!সেই অবহেলা!উফফ!এইযে তুমি এবাড়িতে এসে নাটক সিনেমার মতো সুন্দর সাজানো গোছানো একান্নবর্তী পরিবারের দৃশ্যগুলো দেখছো।পরিবারের পরিবেশটাও এরকম ছিলোনা।সেখানে নিচু মানসিকতার আরও কিছু লোক ছিলো।যারা পরিবারের অসময়ে নিজেদের রঙ দেখিয়ে নিজ পরিবার ছেড়েছে, সংসার ছেড়েছে।আর এই নাটক সিনেমার দৃশ্যের মতো সাজানো গোছানো সংসারটা হয়েছে তাদের বিদায়ের পর।যদিও সাজানো গোছানো সংসারটা গড়তে বেশ সময় লেগেছে।আর সেখানে আজীবন অবহেলা অবজ্ঞা সহ্য করেও দুটো মানুষের মুখ চেয়ে নিজের ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করে,কঠিন অবদানের মধ্যে নিভান তারপ্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান আর ভালোবাসার জায়গাগুলো নিজগুণে অর্জিত করে নিয়েছে।এসব শ্রদ্ধা সম্মান ভালোবাসা তোমার নিভান এমনি এমনি সহজে পাইনি কৌড়ি। বিনিময় দিয়ে পেতে হয়েছে।চাইলেই কি সেসব ক্ষতবিক্ষত কাটাছেঁড়ার দাগ সহজেই মন থেকে মুছে ফেলা যায়?নিভানতো চেয়েছিলো মুছে ফেলাতে অথচ দাগ কিছুতেই উঠেনি।এতো এতো ভালোবাসা পাওয়ার পরও ডলে ঘেঁষে-মেজেও তা উঠে নি।যদিও ভাগ্য, প্রভু প্রদত্ত ছাড়া খান্ডানো সম্ভব নয়।নিভান নিজের ভাগ্য মেনে নিয়ে সামনে এগিয়েছে।সেখানে কাওকে বুঝতে দেয়-না নিজের ভিতরের ক্ষত। ব্যথা,বেদনা।নিজমনে কৌড়িকে আলাপনে রেখে হাজার কথা আওড়ালেও, আজ তাকেও জানতে দিলেনা, বুঝতো দিলো-না নিজের গোপনীয় ব্যথা।বুকে জমে থাকা শতশত কথাগুলো।ভিতরের দগ্ধ হয়ে থাকা ক্ষত চিহ্নের গল্পগুলো।অথচ মেয়েটা নির্বাক চহুনিতে তাকিয়ে আছে তার কথার কিছু একটা প্রতিত্তোর পাওয়ার জন্য ।অনেকটা সময় পর নিভান মুখ খুললো।

‘সেজন্য তো দাদুমার বারবার এবাড়িতে ফেরার অনুরোধ,আমি ফিরিয়ে দিয়ে ওবাড়িতে থেকে গেছি। মায়ের জন্য থেকে গেছি।আঙ্কেলর পিতৃস্নেহে, ভাইবোনদের ভালোবাসায় থেকে গেছি।

কোথাও যেনো একটা সুর কাটা!ঠিক মিলছে-না গানের শব্দগুলো কথাগুলো,সাথে সুরটাও কেমন ছাড়া ছাড়া অগোছালো ভাব!কৌড়ি নিষ্পলক,নির্বাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলো,তাকে জড়িয়ে রাখা মানুষটাকে।অথচ বিয়ের একটাদিন কেটেছে মাত্র।তারমধ্যে লজ্জা লাজুকলতা ভুলে গিয়ে মানুষটাকে একটু বোঝার জন্য কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।সবসময়ের মতো সাবলীল মুখভঙ্গি মানুষটার।অথচ মুখে উচ্চারিত শব্দগুলো,গলার স্বর ঠিক লাগলো-না কৌড়ির।তবে কাওকে খুঁচিয়ে তার ভিতরের কথাগুলো কখনো জানার শোনার অভ্যাস নেই কৌড়ির।সেই অনাড়ী অভ্যাসের জন্য,মন কতো কিছু জানতে চাইলেও প্রশ্ন করা হয়ে উঠলো-না তার।তবে মুখোভঙ্গিমায় জানা বোঝার চেষ্টা করলো,তাকে ভালো রাখার প্রয়াসে থাকা মানুষটার ভিতরে ঠিক কি চলছে।সক্ষম হলোনা তার চেষ্টা। তবুও চেয়ে রইলো সে।মেয়েটাকে অনুভব করে নিভান এবার চোখ খুললো।মিষ্টি হেসে মাথা নিচু করে কৌড়ির মুখের কাছাকাছি হয়ে জিজ্ঞেস করলো।

‘কি হয়েছে?কি দেখছো?

শান্ত,অদ্ভুত মায়াময় গলার স্বর।কৌড়িও ঘোরে পড়ে গেলো।উত্তর দিলো–‘বোঝার চেষ্টা করছি।

হাতের বাঁধন শক্ত হলো নিভানের।কৌড়ি মুখ উচু করতেই যেটুকু বাঁধন আগলা হয়েছিলো,পুনরায় তা দৃঢ় করে নিলো নিভান।মূহুর্তেই দুজনের শ্বাসপ্রশ্বাস মিশে একাকার হয়ে মিলিয়ে গেলো।নিভান ফের অদ্ভুত গলায় শুধালো —বুঝতে পেরেছো কি?

ওই দৃঢ় চহুনী।গলার স্বর।শ্বাসপ্রশ্বাসের ঘনত্ব বেশিক্ষণ নিতে পারলোনা কৌড়ি।কাল থেকে তার একটা নির্ভরতম জায়গা হয়েছে।জায়গাটা খুব আরামদায়ক, খুব প্রশান্তির।সেখানে মাথা রাখলো সে।হঠাৎ বিয়ের আগের বলা নিভানের নানুমার কথাগুলো মনে পড়লো তার।তিনি মানুষটার শৈশব কৈশোরের বিভিন্ন অসুখকর গল্প শুনিয়ে বলেছিলেন—এই মানুষটার জীবনের এমন একজন জীবন সঙ্গীনি আসে,সেই সঙ্গীনি যেনো এই মানুষটাকে খুব করে বোঝে।তাকে খুব ভালোবাসে।যত্ন নেয়।আজ সেই জীবনসঙ্গীনি কৌড়ি নিজেই।অথচ এই মানুষটাকে তিল পরিমান বোঝার ক্ষমতাজ্ঞান তার নেই।তবে সে এই মানুষটাকে খুব ভালোবাসবে,যত্ন নেবে,আগলে রাখবে।তাতে মানুষটাকে বুঝুক আর না বুঝুক।তবে প্রশ্নকৃত মানুষটার উত্তরসরূপ সে বললো।

‘নাহ।তবে ঠিকই একদিন বুঝে যাবো।সেদিন হয়তো আমার থেকে-ও আপনি আপনাকে-ও বুঝতে পারবেন না।

ঠোট প্রসস্থ হলো নিভানের।যেটা কৌড়ির নজর গোচর হলো-না।দু’হাতের বন্ধনী আরও শক্ত করে নিভান বললো—আই উইশ,সেই সময়টা খুবই দ্রুত আসুক।

প্রতিত্তোর করলোনা কৌড়ি।
সময়টা আর-ও কিছুক্ষণ পার হলো।দুজনেই চুপচাপ।শান্ত কৌড়ির আজ যেনো চুপ থাকতে ইচ্ছে হলো-না। মানুষটার সাথে কথা বাড়াতে,তার কথার বিপরীতে মানুষটার কথাও শুনতে ইচ্ছে হলো।তাই প্রাসঙ্গিক কথা বাড়াতে বললো—এবাড়িটা কেমন শান্ত নিরিবিলি।তবে বাড়ির চারপাশটায় কেমন পুরানো জমিদার বাড়ির ভাব রয়েছে।জানেন,আমি একবার বাবার সাথে জমিদার বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম।বাড়িটা কিছুটা এরকম গঠনাভাব ছিলো।যাই হোক,তবে এবাড়ির সবকিছুর থেকে সুন্দর হচ্ছে পুকুরঘাট দুটো।আপনি দেখেছেন,বাড়ির পিছনের বিলাশ বড়ো পুকুটার দুটো শানবাঁধানো ঘাট?বাড়ির ভিতরের দিকের ঘাটটা বেশি সুন্দর।ঘাটের পাশের কামেনি ফুল গাছটা কতো বড়!ফুল ফুটে গাছ ভরে গেছে।পুকুর তো পুরো সাদা হয়ে গেছে কামেনি ফুলের পাপড়িতে।ওপাড়ের বাশবাগনটাও ভিষন সুন্দর।বাগানের মধ্যেও গাছগুলো এতো বড়বড়, মনেহচ্ছে আমরা পিঁপড়ে হাঁটছি।

এযেনো নানা বাড়ির গল্প মায়ের সাথে।নিভান মনোযোগ দিয়ে শুনলো।সচারাচর কৌড়ি এতো কথা বলেনা।কথার বলার কারনটাও হয়তো ধরতে পারলো সে।কৌড়ির কথার বিপরীতে বাহির থেকে নজরটা হাঁটিয়ে এনে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে থাকা রমনীর দিকে ফিরলো।তখনও কৌড়ি অনর্গল বলে যাচ্ছে। একটা সময় থামতেই নিভান বললো।

‘এবাড়িটা পছন্দ হয়েছে খুব?

‘পছন্দ হওয়ার মতোই তো বাড়ি।কতো সুন্দর পরিবেশ।

‘তবে থেকে যাবে নাকি?

কৌড়ি মাথা উচু করে ফের তাকালো।কেমন অবাক করা সেই চাহুনী।হয়তো নিভানকে সে বুঝে উঠতে পারছেনা।আজ মানুষটার হলোটা কি?হুটহাট কেমন কেমন অসংলগ্ন কথা বলছে!তবে নিভানকে গাঢ় চোখে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে যত্রতত্র চোখ নামিয়ে নিয়ে বললো–পছন্দ হলেই যে, সব জায়গায় বা সেই জায়গায় থেকে যেতে হবে এমনটা নয়।বড়জোর সেই ভালোলাগার টানে সেই জায়গায় বারবার যাওয়া আসা যায়,তবে নিজেদের আপনজন ছেড়ে,ভালোবাসার মানুষগুলো ছেড়ে একেবারে থেকে যাওয়া যায়না।

সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নিভান।নজরটা আবার নিকেষ কালো অন্ধকারাচ্ছন্নে ডুবিয়ে বললো—তা যা বলেছো।তবে তুমি চাইলে যাওয়া আসার বদলে থেকে যেতে পারো।এবাড়িতে সারাজীবন থেকে যাওয়ার অধিকার রয়েছে তোমার।

নিভান দীর্ঘশ্বাস সংগোপনে ছাড়লেও বুকে মাথা রাখা রমনীটি বুঝি তা অনুভব করতে পারলো।আবারও মুখ তুলে চাইলো সে।কি চলছে মানুষটার মনে?কেনোই বা মানুষটা বারংবার এমন অদ্ভুত সব কথা বলে চলছে?কেমন অবুঝ চাহুনিতে চেয়ে থেকে তারচেয়েও অবুঝ গলায় কৌড়ি বললো–ওবাড়ির মানুষগুলোও আমাদের খুব ভালোবাসে।

চোখ বুঁজে নিলো নিভান।সময় নিলো নিজেকে ধাতস্থ করতে।ফের চোখ খুলে মুখে মিষ্টি হাসি টানলো।কৌড়ির মনেহলো,ওই হাসি তারজন্য জোরপূর্বক।কৌড়ির অবুঝ চেয়ে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে সেই হাসি প্রসস্থ করলো নিভান।অনেকটা সময় পর দীর্ঘ একটা চুমু খেলো কৌড়ির কপালে।ফের কৌড়ির মাথার পিছে হাত রেখে নিজের বুকে চপে ধরে বললো–হুমম।সবাই আমাদের খুব ভালোবাসে।

সহজ শব্দের কিছু বাক্য। একটু আগে কৌড়িও উচ্চারণ করলো অথচ এতোটা বিষাদ অস্বাভাবি কি লেগেছিলো নিজের কানে?নাতো!তবে খুব শান্ত সহজ গলায় বলা মানুষটার কথাগুলো এতো অস্বাভাবিক শোনালো কেনো?কি চলছে মানুষটার মনে?তার কি কোনো কারণে মন খারাপ?নাকি কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায়?কৈ একটু আগে তো সবকিছু ঠিকই ছিলো।তবে হঠাৎ কি হলো?

‘আমার কেনো মনে হচ্ছে আপনি ঠিক নেই!

পুরানো স্মৃতিগুলো মনে পড়তেই কেমন যেনো বিষাদে ছেয়ে গিয়েছিলো ভিতরটা।হয়তো তার আচ কথার মধ্য প্রভাব ফেলেছে।আর তার শান্তশিষ্ট বুদ্ধিমান বউটা ঠিকই সেটা অনুভব করতে পেরেছে।কৌড়িকে নিবিড়-বন্ধনে জড়িয়ে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার সময় নিলো নিভান।ঘনো ঘনো শ্বাস ফেললো।ফের কিছুটা প্রানবন্ত গলায় বললো।

‘বাহ,আমার বউটা বলতে বলতে আমাকে বুঝতেও শিখে গেছে।নট ব্যাড।

সিরিয়াস প্রশ্নের প্রাণবন্ত উত্তর কৌড়ি আশা করেনি।বিধায় উত্তরে একটু লজ্জা পেলো।তাই প্রসঙ্গ ঘুরাতে মাথার মধ্যে চলা কৌতুহল থেকে প্রশ্ন শুধালো–এ-বাড়িটা-তো বিশাল বড়ো।বাড়ি বাদেও আশেপাশে জায়গাও তো অনেক।তবে এবাড়ি ছেড়ে বাবাকে ওখানে কেনো সমাধিস্থ করা হয়েছে?

‘এবাড়ি থেকে তো কবরস্থান বেশি দূরে নয়।দূরে নয় বললে আবার ভুল,পনেরো বিশ মিনিটের রাস্তা।মেইন রোডের পাশে ওই কবরস্থান জায়গাটার সম্পত্তি তালুকদার বংশীয়।আমাদের বংশীয় নাম।ওটা অনেক আগের পুরানো কবরস্থান।তালুকদার বংশীয় পারিবারিক কবরস্থান।ওখানে কোনো বাহিরের মানুষ নয়,এই তালুকদার বাড়িরই মৃত্যু ব্যক্তিদেরই শুধু সমাধিত করা হয়।বাবার,বাবা, দাদু এবং তাদের দাদুদের আরও পিঁড়িও নাকি ওখানে সমাধিত করা।পাশে যে মসজিদটা দেখেছো,ওটা অনেক আগের স্থাপিত।এখন নতুনত্ব করা হয়েছে।

পনেরো,বিশ মিনিটের পথ!তবে আজ এবাড়িতে আসতে এতোসময় লাগলো!কালরাতে যখন নিভান তাকে নিয়ে বাবার কবরস্থানে আসলো তখনতো এতো সময় লাগিনি?ততক্ষণাত প্রশ্ন শুধালো সে।

‘কালরাতে তো কবরস্থানে আসতে এতোসময় লাগিনি তবে আজ এবাড়িতে আসতে এতো সময় লাগলো কেনো?

‘রাতে রাস্তায় জ্যাম ছিলোনা।তাই ফাঁকা রাস্তায় সময় লাগিনি আসতে।জ্যাম থাকলে অবশ্যই আজকের মতো এতোসময় লাগত আসতে।

এই সহজ কথাটা কৌড়ির মাথায় ছিলো না!তবে কাল এবাড়ির এতো কাছাকাছি থেকে ঘুরে গেলো তারা!হঠাৎ নিভানের বললো–আমি মারা গেলেও,মা’কে বলে রেখেছি ওই কবরস্থানে বাবার পাশেই যেনো আমাকে সমাধিত করা হয়।

চড়াৎ করে কৌড়ি নিভানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে কেমন করে তার মুখের দিকে তাকালো কৌড়ি।সত্য,সহজ বাক্য।অথচ কাল বিয়ের রাতটা গিয়ে আজ আরেকটা রাত এলো কেবল।তারমধ্যে এরূপ বাক্য!
বাক্যগুলো যেনো কোনোরূপে আশাই করেনি সে।তবে নিভান যতোটা সহজভাবে সাবলীল গলায় কথাগুলো বললো,কৌড়ির পরানটা যেনো তার চেয়ে চৌগুন অস্বাভাবিকভাবে ছটফটিয়ে উঠলো।ঠোঁট দুটোও সেই তালে তাল মিলিয়ে সহসা বলে উঠলো।

‘এ কেমন অশোভনীয় কথা?

নিভানের যেনো হুশ ফিরলো।হুটকরে মৃত্যু নামক বাস্তবতাটা,তার গলায় এতো সাবলীল ভাষায় নিতে পারিনি কৌড়ি,তাই এমন প্রতিক্রিয়া।এরকম একটা মূহুর্তে তারও হয়তো বলাও উচিত হয়নি।তবে স্ত্রীকে বিচলিত হতে দেখে অদ্ভুত এক শান্তি পেলো নিভান।স্বান্তনা সরূপ নরম গলায় বললো—অশোভনীয় কথা কেনো হবে?মৃত্যু সত্য।তুমি আমি কেউ এই কঠিন সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে এড়িয়ে যেতে পারবো-না।সেখানে কার কখন প্রভুর ডাকে সাড়া দিতে হয়,তারআগে নিজের ইচ্ছেটা প্রকাশ করে যাওয়া ভালো।বাবার পাশে থাকার ইচ্ছেটা আমার সেই বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে।ওই ছোট্টো মনটা যখন বাবাকে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো।মায়ের কাছে শেষ জেদ করেছিলাম,বাবার পাশে বাবার সাথে ঘুমানোর। তখন মারা যাওয়া কি,বুঝতাম না।মা আমার শেষ জেদটা পুরুন না করলেও, ইচ্ছেটা আমার নষ্ট হয়ে যায়নি। ক্ষীন হয়নি।তুমি আমার জীবনে আসার আগে প্রায়সই যখন বাবা-র সাথে কবরস্থানে দেখা করতে আসতাম।শুধু বলতাম,বাবা তোমার কাছে কবে চলে আসবো।কবে তোমার পাশে তোমার মতো করে শান্তিতে ঘুমাবো।তারপর তুমি এলে।বাবার কাছে তাড়াতাড়ি যাওয়ার ইচ্ছেটা আমার ক্ষীন হতে শুরু করলো,তবে নষ্ট হয়ে যায়নি।একদিন যখন যেতেই হবে,জায়গাটা নির্ধারণ করে রাখলাম।

নিভানের পিঠের শার্টের অংশবিশেষে খামচে রাখা
কোমল দু’হাতের মুঠোর আঙুলগুলো আরও দৃঢ় হলো অথচ মুখে শব্দরা ভিড়লোনা কৌড়ির।সামনের মানুষটার সাবলীল বলে যাওয়া শব্দতে আপতত বাক্যহারা সে।ডগর ডগর হরিনী চোখদুটো দিয়ে শুধু নির্বাক চহুনীতে দেখে গেলো সামনের শ্যামপুরুষটাকে।
হঠাৎ নিভানকে যেনো অচেনা ঠিকলো তার।গম্ভীর হলেও যে পুরুষটাকে সে জানতো,সে পুরুষ টাও যেনো এই পুরুষটা নয়।যদিও কথার প্রসঙ্গে কথা উঠেছে তাই বলে কাল বিয়ে হতে না হতে আজ মৃত্যুর কথা!সেই অচেনাত্ব বাড়িয়ে দিয়ে কিছু একটা মনে পড়তেই নিভান শুধালো।—সেদিন ওই এক্সিডেন্টে যদি আমি না ফিরতাম?মরে যেতাম?তুমি অন্য কারও নিবিড় ভালোবাসায় এভাবে তাকে জড়িয়ে থাকতে কৌড়ি?

এবার কৌড়ির বিচলতা বাড়লো।সেই না হওয়া ভবিষ্যতে সে কি করতো,কি না করতো তার জানা নেই। জানেনা সে। তবে এই মানুষটার সাথে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর একটায় অনুভব অনুভূত হয়েছে।সেটা, এই ব্যাক্তি ছাড়া দ্বিতীয়ত তার জীবনে আর কেউ এলাউড্ নয়।সে, জীবনে যাই হয়ে যাক।সেই মানুষটার মুখে এমন অদ্ভুত কথা!কেমন আহত গলায় নিচুস্বরে কৌড়ি শুধালো।–‘কি হয়েছে আপনার?এসব কথা কেনো?

‘আমাকে তো সেদিন দেখতে যাওনি।সত্যিই যদি আমি মরে যেতাম কৌড়ি?

এ কেমন অবুঝপনা।এই মানুষটার সাথে কি এরকম অবুঝপনা কথাবার্তা মানায়?তবুও বললো—আমি সেদিন আপনাকে দেখতে যেতে চেয়েছিলাম।আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন বা না করুন, এটাই সত্য।তবে আমার ভিতরটা কি চেয়েছিলো,সেটা আমি কাওকে বহিঃপ্রকাশ করতে পারিনি।যার দ্বায়ভার দোষী সাব্যস্ত হতে হয়েছে আমাকে।

কৌড়ি সহজে আবেগপ্রবণ হয়না।হঠাৎ হঠাৎ কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনায়ও সে কেঁদেকেটে ভাষায় না।তবে আপনজন হারানোর বেদনা,সে জানে।
কাল বিয়ে হতে না হতে,এই মানুষটার এমন সব কথা!আপনজন হারানো মনটাকে টলিয়ে দিলো।দূর্বল করে তুললো।তাই নিভানকে কৈফিয়ত দেওয়ার সময় ডগরডগর চোখে জল ছলছল, থৈথৈ না করলেও, গলা কাঁপলো তার।সেটা অনুধাবন করে নিভান এবার সত্যিি নিজের প্রতি বিরক্ত হলো।এতো আবেগ,এতো অনুভূতি বহিঃপ্রকাশ তো সে কখনো করেনা।তবে আজ কি হলো!আর করলোই যখন এমন একটা সময়ে,একটু হিসাব করে রয়েসয়ে কথা বললে কি হতো!এতো আবেগপ্রবণ হয়ে মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়ার খুব দরকার ছিলো কি?যেখানে তারা সদ্য বিবাহিত দম্পতি। মেয়েটার মনে কি প্রভাব পড়তে পারে,জেনেও বোকামি করতে কেনো চাইলো মন!উফফ!

‘আপনি আমার উপর এতো অসন্তুষ্ট?

কৌড়ির পিঠ থেকে হাত সরে এসে গলার পিছে এসে থামলো নিভানের হাতজোড়া।গলা ছুয়ে সেই হাতজোড়া থামলো কৌড়ির মসৃণ তুলোর মতো দু-গালে।ছোট্রো মুখটা দু’হাতে আজলে নিয়ে নিভান নরম, আদূরে স্বরে বললো।-কে বলেছে আমি তোমার অসন্তুষ্ট?আমি তোমার উপর অসন্তুষ্ট নই।

‘তবে এসব কথা কেনো?পুনরায় সেই অভিযোগ। আর মৃত্যু!আমরা জানি মৃত্যু অবধারিত।তাই বলে আজকের দিনে এসব বলবেন আপনি।

নিভান এবার স্বতঃস্ফূর্ত হাসলো।তবে মৃদু হাসি।লাজলজ্জা ভুলে সেই চমৎকার হাসি মাখানো ঠোঁটের দিকে চেয়ে রইলো কৌড়ি।ততক্ষণাত সেই হাসিমাখা ঠোঁট নড়ে উঠলো।কেমন মায়ামায়া স্বরে প্রকাশ করলো– স্যরি,মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য।তবে তোমার যদি আমাকে নিয়ে এতো সঙ্কা,এতো ভয় হয়,তবে প্রভুর কাছে তোমার প্রার্থনায় সবসময় রেখো আমায়।

কৌড়ি চোখ বুঁজে নিলো।মনেমনে বললো–সে রাখতেই হবে।তবে ততক্ষণাত চোখ খুলে ফেললো সে।মুখের খুব কাছে গোচর হলো,সেই মায়ামায়া শ্যামবর্ণ মুখ অবয়ব। খুব সাহসিকতা দেখিয়ে কালরাতে একটা লাজলজ্জাহীন কাজ করেছিলো কৌড়ি।সেটাতে পরক্ষনে লজ্জা ও পেয়েছিলো খুব।তবে কালকের সেসব ভুলে বিয়ের দ্বিতীয় দিন গিয়ে রাতে কৌড়ি আরও একটা নির্লজ্জতামী কাজ করলো।বাম হাতটা নিভানের পিঠের শার্ট খামচে রেখে ডান হাতটা নিভানের মাথায় এনে রাখলো।ছোটো ছোটো করে কাটা চুলগুলোয় হাত রাখতেই সর্বাঙ্গ শিহরে উঠলো তার।ভিতরে অনুভূতিরা তখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছটফটালো।তবে সেসবে পাত্তা না দিয়ে,হাত দিয়ে নিভানের মাথাটা নিচু করে নিলো।ফের মুখ উঁচিয়ে নিজের নরম ঠোঁটটা ছুঁইয়ে দিলো,সেই চওড়া কপালের মাঝে।হাত পায়ের তীব্র কম্পন টের পেয়েও ঠোঁট সরালোনা কৌড়ি।আজ সকালেও ভেবেছিলো,এই দুঃসাধ্য কাজটা কখনো তার দ্বারা করা হবেনা অথচ দিন পেরিয়ে রাত গড়ানোর আগেই সেই দুঃসাধ্য কাজটা সে করে ফেললো।শ্যামবর্ণ মায়াময় মুখটা আজ তার লাজলজ্জা ভুলিয়ে দুঃসাধ্য কাজটা করিয়ে নিলো।নিভান বিস্মিত হলো বউয়ের কাজে।তবে হাতের বাঁধন দৃঢ় করার সাথে সাথে শান্ত হয়ে উপভোগ করলো বউয়ের ভালোবাসা।

চলবে…

#ফুলকৌড়ি
(৫৩)প্রথমাংশ
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কাল বিকালেই চলে যেতো নিভান আর কৌড়ি।তবে আবিদা জাহানের অনুরোধে যেতে পারিনি।নিভানেরও এবাড়ির প্রতি বিশেষ দূর্বলতা থাকায়,একবার অনুরোধে কেমন সে-ও থেকে গিয়েছে।সকালে যখন নিভান পুনরায় যাবার কথা বললো।বৃদ্ধা মুখটা অসহায় দেখালো।নিভান বুঝলো সেই অসহায়ত্ব।তবে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালো-না।তবে বৃদ্ধা মানুষটা নাতীর কাছে আবারও অনুরোধ করে বসলেন —আর একটা দিন কি থেকে যাওয়া যায়-না দাদুভাই?বিশ্বাস করো,তোমাদের এবাড়ি থেকে একদম যেতে দিতেই ইচ্ছে করছেনা। তবে তা স্বার্থপরতা হয়ে যায়।তাই আর-ও একটা দিন যদি থেকে যেতে তোমরা।এই বৃদ্ধা মানুষটার মনটা খুব শান্তি পেতো,সন্তুষ্ট হতো।

নিভান তড়িৎ কিছু বললো-না।তবে নিজের মনও কি চাইছে-না বৃদ্ধা মানুষটার অনুরোধ পুনরায় সায় দিতে? চাইছে তো।তবে কি করবে সে?দাদিমার অনুরোধ, ইচ্ছেকে বারবার প্রশ্রয় দিলে এবাড়ির প্রতি মায়া বাড়বে তার।তখন ওবাড়ির প্রতি সব মোহমায়া ত্যাগ করে এবাড়িতে থাকতে চাইবে মন।যেটা দাদুমা সবসময় চেয়ে এসেছেন,চেয়ে এসেছে তার মনও।তবে মনকে কখনোই প্রাধান্য দেয়নি সে।নাহলে শত গঞ্জনা,অপমান সহ্য করে ওবাড়িতে থেকে যাওয়ার কোনো মানেই ছিলো-না।সবকিছু ছেড়েছুড়ে এবাড়িতে এসে থাকতে পারতো সে।নিজের ভাগ্যের নির্ধারিত সুখ, সাচ্ছন্দ্য, আরাম আয়েস,পাওনা আদর, ভালোবাসা সবকিছু ছাড়তে পারলেও পারিনি, নিজের মায়ের স্নেহ মমতা ছাড়তে।ত্যাগ করতে।তাই মায়ের স্নেহ মমতা আর ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা হয়ে ওবাড়িতে রয়ে যেতে হয়েছে তাকে।এখনো থাকতে হচ্ছে। এখন অবশ্যই মায়ের প্রসঙ্গ বাদেও বিষয়টা আলাদা।এখন যে শুধু মায়ের স্নেহ মমতার বন্ধনে আটকা পড়ে আছে এমনটা নয়।এখন সময়ের চিত্ত বদলেছে।বদলেছে অনেকের মন-মানসিকতাও।আজ ওবাড়ির প্রতিটি মানুষের স্নেহ মমতার বন্ধনে আটকা সে।এমনকি যে দাদুমা পর্যন্ত তাকে হেয় নজরে দেখতো,তিনিও আজ নিভান চোখের আড়াল হলে বারবার খোঁজখবর নিতে থাকেন।এইযে কয়েকঘন্টার জন্য বাড়ি থেকে এসেছে,তারমধ্যে কতোবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,তারা বাড়িতে ফিরছে কখন? শুধু যে দাদুমা ফোন দিয়েছেন,এমনটা নয়।সবাই ফোন দিয়ে বিরক্ত করে দিচ্ছে,তাকে।কিকরে সেসব মায়া,টান ত্যাগ করে এবাড়িতে রয়ে যাবে সে?অথচ স্বস্তি শান্তি তার এবাড়িতে,আর ভালোবাসার মানুষগুলো তার ওবাড়িতে।কি এক দোটানা!

‘দাদুমা,আমি আবার আসবো তো।সময় পেলেই আপনার নাতবৌকে নিয়ে আপনার এখান থেকে ঘুরে যাবো।

‘আর সেবার এসে যদি আমাকে মৃত দেখতে হয় তোমাকে?আফসোস হবেনা আর একটিবার এই অসুস্থ বুড়িটার অনুরোধ রাখতে না পারার জন্য?

নিভান ভিতরে ভিতরে ভিষন অসহায়বোধ করলো।অথচ বাহিরে নিভান,শক্তকঠিন দৃঢ় হয়ে বসে থাকলো।কৌড়িও চুপচাপ তার পাশে বসে আছে। কিছু কথা তারও বলতে ইচ্ছে করছে,তবে সম্পর্কের নতুনত্ব ভেঙে নিজের ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে জিহ্বা কিছুতেই নাড়াতে ইচ্ছে করছেনা।মন সায় দিচ্ছে না।তন্মধ্যে
সেখানে উপস্থিত নিভানের ছোটো চাচী ঝুমুর বললেন।

‘নিভান থেকে যাওনা।দাদুমা এতো করে যখন বলছেন, অসুস্থ মানুষটার অনুরোধটা আরেকটাবার রাখো।কাল সকালে অব্দি না-হয় আজ বিকাল পর্যন্ত থেকে যাও।

নিভান সময় নিয়ে সায় জানালো।মূহুর্তেই বৃদ্ধা মানুষটার চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।আবেগ প্রবন হয়ে তিনি বলেই বসলেন—এই বুড়ির অনুরোধটা রেখেছো,আমি খুব খুশি হয়েছি দাদুভাই।খুব খুশি হয়েছি।

নিভান সৌজন্যে হাসলো।তবে মনেমনে আরেকটা দিন এবাড়িতে কাটানোর সুযোগে সে-ও খুশি হলো।খুশিটা সর্বসম্মুখে বহিঃপ্রকাশ না করলেও পাশে থাকা মেয়েটা হয়তো বুঝে ফেললো।কৌড়ি নিভানের দিকে একপলক তাকাতেই,নিভান নিজেকে আড়াল করতে উঠে দাঁড়ালো।দাদুমাকে বিশ্রাম নিতে বলে,এবাড়িতে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমটার দিকে চলে গেলো।সেদিকে তাকিয়ে মনেমনে হাসলো কৌড়ি।নিজের গম্ভীর,দৃঢ় মনোবল খোলাসা থেকে সহজে বের হতে চায়না মানুষটা।দীর্ঘ সাড়ে চারমাসের পরিচিতিতে কৌড়ি, নিজের ব্যাতিত অন্তত কারও সামনে ওই মানুষটাকে নিজের গম্ভীর স্বভাব, দৃঢ় মনোবলের খোলাসা ছাড়তে দেখিনি।বাহিরের মানুষের সাথে খুব কম এবং ব্যাক্তিত্বের সাথেই কথা বলে।সেখানে মানুষটাকে ভিতর থেকে তো দূর বাহির থেকেও বোঝা দ্বায় হয়ে যায়।সেই হিসাবে নিঃসন্দেহে কৌড়ি সৌভাগ্যবতী।ওই মানুষটা তার ভিতর বাহিরটা সানন্দে সপে দিয়েছে তাকে।

‘ছোটো বউমা,আশহারকে বলো লোক ডাকিয়ে পুকুর থেকে মাছ তুলতে।আর আজ সব বাড়ির শাকসবজি মাছ,মাংস রান্না করবে।সব টাটকা।আমার আওসাফ বাড়ির শাকসবজি, পুকুরের সদ্য ধরা মাছ,বাড়ির পালা হাস মুরগির গোশত খেতে খুব ভালোবাসতো।নিশ্চয় নিভান দাদুভাইও বাবার মতো ধারা পেয়েছে।যদিও দেখলাম তো তার খাবার পরিমাণ সীমিত।বাবার মতো খাদ্যরসিক নয় সে।আবার জিজ্ঞেস তো করা হলোনা তার খাবারের পছন্দ অপছন্দতা।তবুও বাড়ির টাটকা শাকসবজি মাছ-মাংসতে মনেহয়না তার অপছন্দ হবে।তুমি ময়নার মাকে নিয়ে রান্না গোছানোর ব্যবস্থা শুরু করে দাও।

বয়স্ক মানুষটা একাধারে এত কথা বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলেন।শারিরীক অসুস্থতার তোড়ে ঘনো শ্বাস ফেলাতেই সেটা বোঝা গেলো।তা দেখে তড়িৎ নিভানের ছোটো চাচী ঝুমুর বললেন –আম্মা, আপনি ব্যস্ত হবেন না।অসুস্থ হয়ে পড়বেন তো!আপনি না বললেও,নিভান থাকার কথা বললেই আমি আপনার চিন্তাভাবনার মতোই ব্যবস্থা করবো ভেবে নিয়েছিলাম।আর আপনার ছেলে তো মাছ ধরার জন্য লোক ডাকতে গেছেন।আপনি নিভানকে না মানাতে পারলেও কি,আজ তিনি নিভানকে আর বৌমাকে কিছুতেই যেতে দিতেন না।

ছেলের বউয়ের আচারণে খুশি হলেন আবিদা জাহান।যদিও শুধু আজ নয়,ঝুমুর এবাড়িতে বিয়ে হয়ে আসা থেকে এ-অব্দি তিনি তার উপর খুশী,সন্তুষ্ট।ঝুমুর সহজ সরল মেয়েমানুষ। সংসারের মারপ্যাঁচ বুঝলে-ও,সহজে সেসব ঝামেলায় জড়াতে চায়না।হিংসা অহংকার জিনিসটা তারমধ্যে ক্ষীন।হুটহাট সবার সাথে যেমন মিশতে পারে,তেমন সবাইকে আপন করে নিতেও তার সময় লাগে-না।মিষ্টি চেহারার সাথে সাথে মিষ্টিভাষী, কোমল স্বভাবী সে।এইযে একটা অসুস্থ মানুষকে পালাসহ, সংসারটা কি সুন্দর নিপুনহাতে না সামলে চলেছে।

‘আম্মা আপনি বিশ্রাম নিন।দুশ্চিন্তা করবেন না।আমি আপনার ভাবনা অনুযায়ী সবকিছুর ব্যবস্থা করছি।যাই দেখি,ময়নার মা’কে মশলাপাতি গোছানো,বাটাবাটি করতে বলি।চলো কৌড়ি।

এতোসময়ে নিরবদর্শক কৌড়ি এবার নড়েচড়ে বসলো।উঠার প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই আবিদা জাহান বললেন—দাদুমনি আমার এখানে কিছুক্ষণ সময় থাক।তুমি বরং নিতু ইতু দাদুমনিকে এখানে ডেকে দাও।

‘আচ্ছা।

ঝুমুর বেরিয়ে গেলেন।কৌড়ির সাথে টুকটাক কথা শুরু করলেন আবিদা জাহান।মেয়েটা বেশ শান্তশিষ্ট,কোমল স্বভাবের।বেশ পছন্দ হয়েছে উনার।কৌড়ির বাপের বাড়িতে কে কে আছে,তার নানু দাদু আছেন কি-না?টুকিটাকি খোশগল্পে মত্ত হলেন তিনি।অল্প প্রশ্নত্তোরে কৌড়িকে ছেড়ে দিয়ে নিজের ছেলেবেলা,সংসারী জীবন,স্বামী সন্তান এসব নিয়ে গল্পে ডুবলেন। তারমধ্য ইতু নিতুও এসে হাজির হলো।ছোটো চাচার দুই মেয়ের মধ্যে নিতু বড়।স্বভাবে মেয়েটা মৃদুভাষী শান্ত,চুপচাপ স্বভাবের।আর ছোটো, ইতু।বড়টার বিপরীত স্বভাবের সে।সারাক্ষণ যেনো তার মুখে খই ফুটছে।কারও নিষেধ বারণে তার মুখ বন্ধ নেই।মুখের সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবেও চঞ্চল সে।তবে লাজুকে।যারসামনে সে নিজের মনের কথা গাইতে পারেনা,চঞ্চল স্বভাব প্রকাশ করতে পারেনা।তারসাথে সে সহজে মিশেনা। কৌড়ি স্বভাবে শান্তশিষ্ট হলেও কৌড়ির সাথে তার দারূন পটে গেছে।ভাব হয়েছে। অথচ একবার কোনোমতে নিভানের সাথে আলাপ সেরে তার সামনে আর সহজে যায়নি সে।দুবোন দাদুমার ঘরে পা রাখতেই,দৌড়ে এসে কৌড়ির হাত জড়িয়ে কৌড়ির পাশে বসে পড়লো ইতু।বিনিময়ে কৌড়ি মিষ্টি করে হাসলো।তন্মধ্যে নিতু বললো।

‘সবজায়গায় এতো দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি কিসের?
ঘাসফড়িংয়ের মতো সারাদিন ছটফটিয়ে যাচ্ছে!তুই যেভাবে উনার হাতটা টেনে ধরলি,পড়ে যেতেন তো উনি।

বয়সে বড় অথচ কাল সাক্ষাতের পর থেকেই মেয়েটা, আপনি সম্বোধনে তারসাথে কথা বলে চলেছে।কৌড়ির বিষয়টা বেশ অস্বস্তি দিচ্ছে। তবুও মেয়েটা মানতে নারাজ।কাল না পেরে একবার আপনি বলতে নিষেধও করেছে।তবুও নিতু সেই থেকে তাকে আপনি করে বলে চলেছে।কৌড়ি নিষেধ করায় তখন এটাও বলেছে—আপনি আমার বসয়ের বড় নাহলেও সম্পর্কে আমার অনেকটা বড়।ভাইয়া এবাড়ি বড়ছেলে,তার বউকে তুমি সম্বোধন করে কথা বললে আম্মু তো রাগ করবেনই।আমারও কেমন যেনো ভালো লাগবেনা।

কৌড়ি আর কিছু বলেনি।ইতুকে বকতে দেখে কৌড়ি নরম গলায় বললো—থাক আপু,ওকে বকবেন না।ওর বয়সটা চঞ্চলতার।আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।আর ঠিক না হলেও কি!বাড়িতে দুএকজন এরকম না থাকলে বাড়িটা কেমন যেনো বাড়িই মনে হয়না।

ইতু মুখটা ভার রেখে ততক্ষণাত গম্ভীর গলায় কৌড়ির কথার প্রেক্ষিতে বললো-এটা আম্মু আর আপু বুঝলেতো!আমি উনাদের মতো ওরকম চুপচাপ শান্ত হয়ে সবসময় থাকতে পারিনি।

নিতু ইতুর কথার উত্তর না দিয়ে কৌড়ির কথার দিলো–

‘বাহ,আপনি দেখি বাবা আর দাদুমার মতো কথা বললেন।বাবা আর দাদুমার লাই পেয়ে পেয়ে দিন দিন ওর চঞ্চলতা, লাফানো ঝাঁপানো আরও বাড়ছে।দল যতো ভারী হচ্ছে ততো স্বভাব ঘাসফড়িং হচ্ছে।আর মুখ চললেই তো থামতেই চায়না।

এবার আবিদা জাহান মুখ খুললেন–থাক না দাদুমনি।সবে ক্লাস সিক্সে উঠেছে।ওরকম বয়সে সবাই একটু-আধটু ওরকম থাকে।বয়সের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।ঠিক হয়ে যাবে কি,ঠিক হয়ে যায়।ওরকম বয়সে আমিও ইতু দাদুমনির মতো চঞ্চল সাথে উড়নচণ্ডী স্বভাবের ছিলাম।আমার ছেলেবেলার ছায়াটা আমি ইতু দাদুমনির মধ্যে দেখতে পাই।উপলব্ধি করি।আর সেই বয়সেই তো আমার বিয়ে হয়ে গেলো।তারপর তো সেই ছটফটে স্বভাব, অর্নগল কথা বলা সবতো ছুটে গেলো।আমি হয়ে গেলাম সংসারের দোলাচলে পাক্কা সুগৃহিনী।তারপর মা হলাম।ভরা সংসার হলো আমার।স্বামী পরাপর হলো,সুস্থসবল সন্তান হারালাম।এতো নাতীনাতনিদের ভিড়ে কৈ আছে আমার সেই ঘাসফড়িংয়ের মতো লাফিয়ে চলা,আর বেশিবেশি কথা বলার স্বভাব। সেতো সেই কবেই চুকেবুকে গেছে।ছোটো দাদুমনিরও এরকম চুকেবুকে যাবে।তাই তাকে বকোনা, নিষেধ করোনা।তুমি বরং কাছে এসো দেখি জ্বরটা কমেছে কিনা?

নিতু আর একটা শব্দও উচ্চারণ করলেনা।ইতুকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে।তবে তার ছটফটে স্বভাবে মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে দুই একটা কথা বলে,বকাবকি করে।তবে মা আর সে যখনই ইতুকে বকে তখনই দাদুমা আর বাবা তার ঢাল হয়ে এরকম ইমোশনাল কথাবার্তা শুনিয়ে তাদেরকে চুপ করিয়ে দেয়।দাদুমার কাছে গিয়ে বসলো নিতু।যদিও জ্বরটা কমেছে তবে দাদুমার হাতের শীতল মায়ামাখা ছোঁয়া, আদুরে স্পর্শ তার ভালো লাগে।কাছে গিয়ে বসতেই নিতুর কপালে হাত রেখে জ্বর পরিমাপ করলেন আবিদা জাহান।কালকের একশো চারের ঘরের তাপমাত্রাটা কমে গেছে। তবে পুরোপুরি গায়ের তপ্ততা কমেনি।নিতু জ্বর পরিমাণ মাপতে মাপতে ইতুর দিকেও খেয়াল করলপন তিনি।আপুর বকাতে ইতু মনখারাপ করে চুপচাপ বসে আছে।যা মেয়েটার স্বভাবের সাথে বড়ােই বেমানান।উনার নজরেও ভালো লাগেনা।তা দেখে আবিদা জাহান,ইতুর রাগ ভাঙাতে বললেন–ছোটো দাদুমনি,আমার রসূনের আচারের বৈয়মটা এনে তোমার ভাবিমনিকে খেতে দাও দেখি।

ইতুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।বছরে বড়বড় দুই বৈয়ম রসুনের আচার বানানো হয়।দাদুমার পছন্দনীয় বলে বানানোটা জরুরি।মুলত দাদুমাই বানান।শুধু যে দাদুমার পছন্দ এমনটা নয়,দাদুমার মতো তারও পছন্দ।আর দাদুমার হাতের আচার মানেই উফফ!মারাত্মক লোভনীয় স্বাদ। কিন্তু রান্নাঘরে যে রসুনের আচারের বৈয়মটা রাখা হয়,ওটাতে সহজে হাত দেয়না ইতু।মায়ের বকুনির সাথে সাথে কয়েকটা মারও ফ্রি।সাথে বাবার কাছে হাজারটা নালিশ।তবে মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলে অবশ্যই ছাড়েও না ইতু।একবাটি আচার অনায়সে খেয়ে নেয় ইতু।তবে দাুমার ঘরের আচারের বৈয়মগুলো তারজন্য ফ্রী।তবুও মা দেখতে পেলে ফ্রী-টা লাভ, সুদবুদসহ বকাবকি রাগারাগি করে উশুল করে নেন।তবে দাদিমা যদি বলেন–তিনি খেতে বলেছেন,বিষয়টা আলাদা।তখন মা একটুআধটু বকলেও রাগারাগি আর করেননা।বাবাকে নালিশও জানান না।দাদিমার আদেশ পেতেই,ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট্টো রুমটার দিকে ছুট লাগালো ইতু।তা দেখে নিতু আর আবিদা জাহান হাসলেন।নড়বড়ে স্বরে ফের বললেন।

‘নারকেল নাড়ুর বৈয়মটাও নিয়ে এসো দাদুমনি।

ইতু শুধু বৈয়ম আনলোনা।সাথে বাটি চামচও আনলো।
বৈয়মের মুখ খুলে একবাটি কৌড়িকে দিয়ে নিজেই আরেক বাটিতে নিয়ে খেতে বসলো।দ্বিতীয়ত আর কারও কথা ভাবলো-না।তাতে কেউ কিছু বললোওনা।কৌড়ি আচার খাওয়ার আগে দাদুমা তাকে আর নিতুকে নাড়ু বের করে দিলেন।নিতু নিলো।কৌড়িও সেটাই খেলো আগে।নারকেল নাড়ু সে আগেও খেয়েছে তবে এটার স্বাদ আলাদা, অসাধারণ।আচারটা খেতেই বুঝতে পারলো,পরিপক্ব হাতের বানানো এগুলো।বাটা রসুনের আচার নয়, সরিষার তেলে ডুবানো বিভিন্ন মশলার উপকরণে আস্ত কোয়া ছাড়ানো রসুনের আচার।রসুনের আচারটা এই প্রথম খেলো কৌড়ি।সত্যিই অসাধারণ স্বাদগন্ধ।আচার খাওয়ার ফাকে ফাকে রসুনের আচার বানানোসহ বিভিন্ন আচার বানানোর গল্প শুনলো দাদুমার মুখ থেকে।এরমধ্যে বিরতিহীন ইতুর আচার খাওয়া নিয়ে মজা-ও করলো নিতু।সেটা নিয়ে ক্ষেপলােনা ইতু।নাতবৌ নাতনিদের নিয়ে গল্পগুজবের সময়টা যেনো আবিদা জাহানের কাছে সুখ সুখ,শান্তি শান্তি একটা অনুভূতি অনুভব হতে লাগলো।তিন ছেলে উনার।একজনকে তো কবেই হারিয়ে বসলেন।দ্বিতীয়জন,নিজের স্বার্থ, সুখসাচ্ছন্দ্যে বিলাসবহুল জীবনযাপন গড়তে মা’কে ছেড়ে নিজ ইচ্ছায় সুখের দেশে পাড়ি জমিয়েছে।সেখানে কেমন সুখে তার দিন পার হচ্ছে, আবিদা জাহান জানেননা।তবে আল্লাহর কাছে সর্বদা কামবা করেন, তাকে সুখে রাখুক।আর তৃতীয়জন তার বৃদ্ধবয়সের অবলম্বন হয়ে রয়ে গেছেন।বিশাল বড় বাড়িটাতে সামন্য এই কয়জন মানুষের পদচারণ নগন্য।সারাক্ষন নীরব নিস্তব্ধ থাকা বাড়িটাতে দু’জন মানুষ বাড়তেই কেমন একটা হৈচৈপূ্র্ন ঝলমলে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।কেমন তৃপ্ত অনুভব হলো উনার নজর,তৃপ্ত হলো উনার বৃদ্ধা মন।সেই মনে আরেকটা আকাঙ্ক্ষা চেপে বসলো,এই ছেলেমেয়ে দুটোকে যদি তিনি এবাড়িতে বরাবরের জন্য রেখে দিতে পারতেন।

সকাল পেরিয়ে এগোরাটা বাজতে না বাজতে তালুকদার ভিলাতে হঠাৎ গাড়ীর শব্দ।এই অসময়ে কে বা কারা এলো?দৌড়ি গিয়ে ছাদের কোণ ঘেঁষে দাঁড়ালো ইতু।মুখ নিচু করে সামনের লন এরিয়ায় দেখার চেষ্টা করলো,অসময়ে কে বা কারা এসেছে?কৌড়ি তখন নিতু আর ইতুর সাথে ছাঁদটা ঘুরে-ঘুরে দেখার সাথে সাথে আশেপাশের সবুজ সমাহারের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ডুবে ছিলো।নিভানের দাদুবাড়ি জায়গাটা গাজীপুরেরশ্রীপুর উপজেলার রাজবাড়ী এলাকায়।আশেপাশের প্রতিটি বাড়ি,সবুজের সমাহারে ছেয়ে আছে।শহরের পরিবেশের মতো শুধু বহুতল উঁচু উঁচু রঞ্জিত বিল্ডিংয়ে একের পর এক সীমানাভেদ করা বাড়ি করা নয়।বালু সিমেন্ট রড কংক্রিট দিয়ে তৈরী করা গাছপালাহীন ফাঁকা বাড়িও কম।প্রতিটি বাড়িতে,ফল-ফুল ছাড়াও বিভিন্ন গাছের আগানবাগান।উঁচু নিচু প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সামনে পিছনের লন,ছাঁদবারান্দা,এমনকি ছাঁদেও সবুজ সমাহারে ছাওয়া।শহরের ছোঁয়ায় সমৃদ্ধি, বোনা,আলাদা এই সবুজ সমাহারের পরিবেশটা কৌড়িকে বিমুগ্ধ করেছে।তাই মুগ্ধ হয়ে আশপাশটা দেখছিলো।হঠাৎ জোরেশোরে গাড়ির হর্ন বাজতেই ইতু পিছেপিছে নিতুও কৌতুহলী নজর নিয়ে ছাদে কিনারায় এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো।মূহুর্তেই কপাল কুঞ্চিত করে বললো–

‘এতো ছেলেমেয়ে!এনারা কারা?

দু’জনের দেখাদেখি কৌড়িও এগিয়ে গেলো।নজর নিচমুখো করতেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার।আচমকা ঠোঁট ফুটলো হাসি।ততক্ষণাত নিচে বিনা আমন্ত্রণে আগত মেহমানদের কাছে পৌঁছে গেলেন,এবাড়ির ছোটো ছেলে অর্থাৎ নিভানের ছোটো চাচা আশহার সাহেব।তিনি বাড়ির পিছনের পুকুরে মাছ মারার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।হঠাৎ অসময়ে বাড়িতে গাড়ির হর্ন বাজার শব্দ শুনে,সদরে চলে এলেন।এসেই গাড়ী ভর্তি মানুষ দেখে চমকে গেলেন।ইভানকে ড্রাইভিং সিট থেকে নামতে দেখেই অমায়িক হেসে দিলেন।ইভান সালাম দিলো।ফের স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বললোো—বিনা নিমন্ত্রণে চলে এলাম চাচাজান।শুধু বাড়ির ছেলেটাকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াবেন,তা তো হতে দেওয়া যায়না।

‘আরেহ কি বলো,নিভান কেনো একা এবাড়ির ছেলে হতে যাবে।তুমি নাফিম,তোমরা সবাই আমাদের আপনজন।চলে এসেছো ভালো করেছো।চলো চলো, ভিতরে চলো।আম্মা দেখলে খুব খুশি হবেন।

‘আপনজন হলে শুধু দাদাভাইকে নিমন্ত্রণ দিয়ে নিয়ে আসলেন কেনো?আমাদের কেনো নিমন্ত্রণ দিলেন না।

‘তোমাদেরকেও আসার কথা বলেছিলাম।কিন্তু ভাবি-তো না করলেন।বললেন, বিয়ে বাড়িতে মানুষ ভরপুর। বাড়ির ছেলেমেয়ে সব চলে গেলে বিষয়টা কেমন দেখায়।তাই তো আর জোরাজোরি করতে পারলাম।

ততক্ষণে গাড়ী থেকে মান্যতা মৌনতা নাফিম, তন্ময়ী,
নেমে পড়েছে। এমনকি বিথী আর কাননকেও নিয়ে আসতে ভুলিনি ইভান।আশহার সাহেবের সাথে দুষ্টমিষ্টি তর্কবিতর্ক করতে করতেই বাড়ির ভিতরে পা রাখলো ইভান।সঙ্গে সবাই।ভিতরে ঢুকতেই আশহার সাহেব নিজের স্ত্রীকে ডাক দিলেন।যদিও তিনিও গাড়ীর শব্দ পেয়েছেন তবে রান্নাঘর ছেড়ে বাহিরের দিকে উঁকি দেওয়ার সময়টুকু পাননি।তিনি আসতেই আলাপ পরিচয় সারলো সবাই।আলাপ পরিচয় সেরে সবাইকে বসতে বলে তিনি নাস্তা পানির ব্যবস্থায় ব্যস্ত হলেন।

‘দাদুমার ঘরটা কোথায়?চলুন উনার সাথে দেখা করে আলাপ পরিচয় সেরে আসি।

ততক্ষণে ছাঁদ থেকে নেমে এসেছে কৌড়ি।নাফিমের চোখ গেলো সেদিকে।দৌড়ে গিয়ে কৌড়িকে জাপ্টে ধরে বললো–আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি ফুলকৌড়ি।স্যরি স্যরি বড়বউমনি।

নাফিমের বাচ্চামোতে কৌড়ি হেসে ফেললো।সঙ্গে সঙ্গে
স্নেহময় হাতে আগলে নিলো তাকে।ফের নিজেও বললো–আই মিসড্ ইউ টুহ্ ছোটোসাহেব।

ইভান আর কানন বাদে সবাই কৌড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।একদিন সে ওবাড়িতে না থাকায় সবাই তাকে কতোখানি মিস করেছে,মিষ্টি অভিযোগে সেসব বর্ননা দিতে থাকলো।আর বাড়ির নতুন বউ বাড়িতে না থাকলে সে বাড়িতে কি হৈচৈ ভালো লাগে?কোনোকিছু মজা লাগে?এসব মিষ্টি মিষ্টি অভিযোগ নিয়ে টুকিটাকি একের পর এক কথা হতেই থাকলো।তারমধ্যে নিতু ইতুর সাথে পরিচয় হলো সবার।

বিশাল বড়ো পুকুরটার এপার ওপার,ওপাড়েই শানবাঁধানো ঘাট।এপাড়ের ঘাটের একপাশের শানবাঁধানো বসার জায়গায় বসে আছে নিভান।পুকুরে জাল ফেলে এক নামেমাত্র জেলে মাছ ধরছে।তিনি প্রফেশনাল না হলেও জাল ফেলার হাত সুনিপুণ।এটাও যেনো একটা অভিজ্ঞতার বিষয়।নাহলে সবাই পারে-না কেনো?কি সুন্দর নিপুনহাতে তিনি জাল ফেলছেন পুকুরে,আর তা গোল চাদরের মতো বিছিয়ে সর্বত্রে ছড়িয়ে কেমন একটা ছন্দময় আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে!দুইবার জাল ফেলাতেই বেশ বড়সড় কয়েকটা রুই কাতলা পড়েছে জালে।জেলে মাছ ধরলেও, মাছগুলো এতোসময় সংরক্ষণ করছিলেন আশহার সাহেব। গাড়ীর হর্ণের শব্দ শুনতেই তিনি বাড়ির সদরে চলে গেছেন।যাবার আগে এবাড়ির সারাক্ষণ কর্মরত বুয়াকে ডেকে মাছ কাটার তাগিদ দিয়ে গেলেন।বাড়ির পিছনের উঠান অর্থাৎ পুকুরপাড় সাইডের কিছুটা দূরত্বে বসে মাছ কাটছেন বুয়া ময়নার মা।আর তার সামন্য দূরত্বে চেয়ারে বসে তা পর্যবেক্ষণ করছেন নিভানের দাদুমা।জেলের মাছধরা থেকে নজর সরিয়ে সেটা একপলক দেখে পুনরায় মুগ্ধ নজর ফেললো জেলের হাতের জালে।

‘হ্যালো দাদুমা,কেমন আছেন?

চঞ্চল, উচ্ছসিত কন্ঠে আবিদা জাহান উনার থেকে কিছুটা দূরত্বে বাড়ির পিছনের সদর দরজায় তাকালেন।ইভানকে চিনতে বেশকিছুসময় সময় লাগলো উনার।নিভানকে দেখতে গিয়ে হাসপাতালে দেখেছিলো ইভানকে।পরিচিতও হয়েছিলো।তবে বয়স হয়েছে,সাথে অসুস্থা খেয়ালে রাখতে দেয়না কোনোকিছু।হঠাৎ খেয়াল হতেই অমায়িক হেসে দিলেন তিনি।কিছু বলার আগেই ইভান ফের বললো—বিনা আমন্ত্রণে চলে এলাম দাদুমা।দাদাভাইকে একা আদর যত্নে ডুবিয়ে রাখবেন তা তো মানা যায় না।তাই তার আদর যত্নে ভাগ বসাতে চলে এলাম।

ছেলেটা এরকমই উচ্ছল।সেদিনও লক্ষ্য করেছিলেন তিনি।তাই অমায়িক কন্ঠে বললেন–খুব ভালো করেছো দাদুভাই।তা কেমন আছো তুমি?

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনার শরীর এখন কেমন?

‘আলহামদুলিল্লাহ আছে মোটামুটি।

ইভানের সাথে কানন ছিলো। আবিদা জাহানের সাথে তাকেও পরিচয় করিয়ে দিলো ইভান।ময়নার মা মাছকাটা বাদ দিয়ে বাড়ির ভিতটে গিয়ে তড়িৎ দুটো চেয়ার এনে দিয়ে ফের মাছ কাটতে বসলেন।চেয়ারে আরাম করে আবিদা জাহানের মুখামুখি বসে খোশগল্পে মেতে উঠলো ইভান।ভুলেও নিভানের তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টিতে আঁখি মেলালোনা সে।ওই চোখে তাকালেই তার দূরদর্শী চতুর বুদ্ধিসম্পন্ন দাদাভাই ধরে ফেলবে,দলবল নিয়ে কেনো এবাড়িতে হাজির হয়েছে ইভান।কানন স্বভাবে কিছুটা ইভানের মতো।তাই ইভান আর আবিদা জাহানের খোশগল্পের মধ্যে তার অবদানও একবারে চুটিয়ে।নিভান সেসব তীক্ষ্ণ চোখে কিছুসময় অবলোকন করে,মনেমনে ইভানের খামখেয়ালি ছেলেমানুষীর কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুকুরের দিকে নজর ফেললো।লোকটা পুকুরের পূর্ব দিক থেকে জাল ফেলা শুরু করেছিলো।এখন উত্তরের কোনাকোনি সাইডে চলে গেছে।জাল ফেলে, বড়বড় মাছগুলো একাএকা সংরক্ষণ করতে প্রায় হিমশিম খাচ্ছে।তবে এজীবনে নিভানের পুকুরে জাল ফেলা তো দুর,জাল ফেলে বাস্তবে এই মাছ ধরা মনেহয় প্রথম দেখলো।সেখানে মাছ সংরক্ষণ করে ব্যাগে রাখা তার পক্ষে ওই অভিজ্ঞ লোকটার থেকেও হিমশিমের ব্যাপার।তাই উনাকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজেকে লজ্জায় ফেলা সত্যিই লজ্জাজনক। তাই উঠতে চেয়েও আর উঠলোনা নিভান।তবে একটু সময় নিয়ে আশহার সাহেব চলে এলেন।তড়িঘড়ি করে লোকটার কাছে চলে গেলেন।
তন্মধ্যে বাড়ির মধ্যে থেকে মেয়েলি কন্ঠের শোরগোল কিছুটা কানে এলো নিভানের।তারমধ্যে উচ্চধ্বনি হলো মৌনতার কন্ঠ।নিভান বুঝতে পারলো,শুধু কানন আর ইভান আসিনি। পুরো দলবল নিয়েই হাজির হয়েছে ইভান।কেনো? বুঝতে অসুবিধা হয়নি।তবে এই বয়সে এসে ইভানের এখনো সেই ছেলেমানুষী ভয়টা রয়ে গেছে।মনে-মনে হাসলো নিভান।একটা তৃপ্তময় হাসি।একটা সময় ঘনিষ্ঠতা ছাড়িয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে ছাড়াছাড়া সম্পর্ক ছিলো।তখনোও ইভান একই ভয়ে এই ছেলেমানুষীটা করেছে।নিভানের সাথে রাগ করেছে,জেদ দেখিয়েছে।বিনিময়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে।তবুও দিনশেষে নিভানকে চোখে আড়াল হতে দেখলেই,বাবা মা বোন কাওকে না কাওকে দিয়ে খোঁজ নিয়ে বারবার জেনেছে,দাদাভাই বাড়ি আসবে কখন?সে বাড়ি আসছেতো?সে বাড়ি বাদে অন্য কোথাও গিয়ে থাকছে-না তো?থাকবে না তো?এই ছেলেটার জন্য নিভান কোথাও গিয়ে রাত পার করলে,তাকে একটু স্বস্তি একটু শান্তিতে থাকতে দেইনি ছেলেটা।যেনো দূরে গিয়েও কাছে থাকার আহ্বান।আজ-ও ছেলেটা কি সেই ভয়ে এখানে ছুটে এসেছে!এখনো নিভানের স্নেহবন্ধন থেকে যাবার ভয় পায় ইভান?কেনো?ছেলেটা তো অনেক বড় হয়েছে, সেই অপ্রাপ্ত বয়স্ক ইভান আর নেই।তার বিয়ে হয়েছে, মিষ্টি একটা বউ হয়েছে।তারপরও ইভান এখনো তার দূরত্বতে, তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় পায়!একেই কি তবে বলে ভ্রাতৃত্বের স্নেহময় বন্ধন!তার প্রতি ইভানের সেই অটুট অবুঝ ভালোবাসা।যা অপ্রাপ্ত অবুঝপনা ছেলেটার জেদ রাগের মধ্যেও অটুট ছিলো!আর এখনো প্রাপ্ত বুঝদার ছেলেটার মধ্যে অটুট আছে!হঠাৎ ইভানের ছেলেবেলার একটা কথা মনে পড়ে গেলো নিভানের।তখন হয়তো নাফিমের বয়সী ছিলো ইভান।কোনোকারণে রেগে গিয়ে টেবিলের একডজন গ্লাস ভেঙে ফেলেছিলো ছেলেটা।শেষে টেবিলে আলাদা করে যে গ্লাসটা পড়ে ছিলো, সেটা ছুড়ে ফেলতে গিয়ে নিভানের গায়ে লেগেছিলো।মা ততক্ষণে অগ্নিশিখা।ইভানকে মারতে আসায়,নিভান তাকে আগলে নিয়েছিলো।মায়ের সম্মুখ থেকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিয়ে নিজের ঘরে এনে দরজা আঁটকে দিয়েছিলো।ততক্ষণে ইভান শান্ত হয়েছে।নিভান তাকে কিছু বলার আগেই ইভান তাকে জড়িয়ে কেঁদে দিয়ে বলেছিলো।

‘তুমি খুব ব্যাথা পেয়েছো, তাই-না দাদাভাই?আমি তোমাকে ইচ্ছে করে মারিনি?আমি দেখিনি তোমাকে দাদাভাই? স্যরি দাদাভাই।

‘ইট’স ওকে সোনা।আমি জানিতো আমার ইভান সোনাটা আমাকে কখনো ইচ্ছেকৃত ব্যথা দিতে পারেনা।

নিভানকে আঘাত করার দরূন ইভান তখনোও ঠান্ডা হয়নি।নিভানের স্বান্তনা বানি কাজে দেয়নি।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছিলো আর অবুঝ গলায় বলছিলো–‘দাদাভাই আমি তোমাকে ব্যথা দিলে তুমি কখনো আমাকে বকোনা,মেরোনা, তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিও-না।শুধু ভালোবেসো দাদাভাই।বেশিবেশি ভালোবেসো দাদাভাই।মা বাবা যতযত তোমাকে ভালোবাসে।তুমি ততোততো তারচেয়ে বেশি আমাকে ভালোবেসো দাদাভাই।ভালোবাসবে না দাদাভাই? বলো?

‘দাদাভাইতো তোকে খুব ভালোবাসে।আর সবসময় খুব ভালোবাসবে সোনা।তুই শত ব্যথা দিলে-ও ভালোবেসে যাবে।চুপ।আর কাঁদে না।তাহলে কিন্তু এবার দাদাভাই সত্যিই বকবে।

নিভান তার কথা রাখতে পেরেছে কি-না,সে জানেনা।হয়তো ভ্রাতৃত্বের সেই স্নেহময় ভালোবাসার সার্টিফিকেট শুধু একমাত্র ইভানই দিতে পারবে।ইভানের দিকে ফের নজর দিলো নিভান।মিষ্টির বাটি হাতে তার।টপাটপ খেয়ে চলেছে।ছোটো চাচী একটু আগে এসে ভিতরে নাস্তা করার জন্য ডেকে গেলেন।বান্দা খোশগল্পে এতো মত্ত,ভিতরে যায়নি বলে পুনরায় চাচি মিষ্টির বাটিটা দিয়ে গেলেন।এক্সট্রা আরেকটা চেয়ারে উপরে আরও কি কি যেনো রেখে দিয়ে গেছেন।তবে নিভান তা দেখতে না পেলেও বাটি হাতে নিয়ে ইভানকে কাঁটাচামচে একটার পর একটা করে মিষ্টি তুলতে আর সদানন্দে মুখ পুরতে দেখছে সে।।সেখানে খাওয়া আর গল্প বাদে পৃথিবীর আর কে কোথায় আছে আপতত সেসবে তার খেয়াল, ধ্যান নেই।মাত্রাধিক সুদর্শন ছেলেটার হাসিখুশি মুখটা যেনো তার চেহারার জৌলুশতা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।

নীরবতায় ডুবে থাকা বাড়িটায় হঠাৎ শোরগোল। বেশ ভালো লাগল আবিদা জাহানের।ওবাড়ির প্রতিটি বাচ্চা মিশুকে এবং স্বভাবে অমায়িক।অল্প সময়ের মধ্যে নিতু ইতুও কেমন ওদের সাথে মিশে গিয়েছে। মনেহচ্ছে কতোদিনে আত্মীয়তা,পরিচিত সবার।অথচ আজই সবার প্রথম দেখা,প্রথম পরিচয়।মেয়েগুলো বসে নেই, কাজ না পারলেও যে যেটুকু জানে হাতেহাতে টুকটাক ঝুমুরকে সাহায্য করে দিয়েছে।ঝুমুর বারবার নিষেধ করায় এখন একজায়গায় বসে গল্পে মেতেছে।অন্যদিন এই সময়টা আবিদা জাহানের চুপচাপ একাকি নিজ ঘরেতেই কেটে যায়।আজ তা আর হলোনা।আজ এরা আর তাকে ঘরে শুয়ে-বসে থাকতে দিলোনা।বসার ঘরের সোফার মধ্যেমনি করে উনাকে বসিয়ে গল্পে মেতেছে।মাঝেমধ্যে গল্পের উপস্থাপনা উনাকেও করতে হচ্ছে। বিষয়টা মন্দ নয়।মনটার সাথে সাথে অসুস্থ দূর্বল শরীরটাও কেমন যেনো হঠাৎ ফুরফুরে অনুভব হচ্ছে।
শরীরে যেনো কোথায় কোন অসুখে ভুগেছিলেন তা যেনো মূহুর্তেই ভুলে বসলেন।ক্ষনে ক্ষনে শ্বাসকষ্টের যে সমস্যাটা দেখা দেয়,তা যেনো কোন দূরপ্রান্তে উড়াল দিয়েছে।আসলে উনার অসুখটা শরীরের থেকে মানসিক বেশি।আর সেই মানসিক পীড়া শরীরের অসুখকে দিনকে দিন ভারী করে তুলছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের চতুর্পাশের হাসিখুশি মুখগুলো মুগ্ধ নজরে দেখতে থাকলেন।হ্যা,বৃদ্ধা বয়সে এসে এরকমই একটা পাওনা তো তিনিও আশা করেছিলেন।সবসময় নাতিনাতনিদের হৈ-হুল্লোড় কোলাহল, হাসিখুশিতে ভরপুর থাকবে বাড়িটা এরকমই তো চেয়েছিলেন।অথচ ভাগ্য এমন এমন গলিতে গিয়ে মোড় নিলো,নাতীনাতনী থাকা সত্ত্বেও এত বড়ো বাড়টি সবসময় নীরবই পড়ে থাকে।নিতু আর ইতু বাড়িতে না থাকালে,বিশেষ করে ইতু বাড়িতে না থাকলে ক্ষনে ক্ষনে তো মৃতুপুরীর মতো নিস্তব্ধ, শুনশান হয়ে পড়ে বাড়িটা।

সবাই খোশগল্পে মজে থাকলেও কৌড়ি দাঁড়িয়ে আছে রানাঘরে ঝুমুরের পাশে।সবার সাথে গল্প করার মধ্যে হঠাৎ তার মনেহলো,ছোটোচাচীকে সাহায্য না করা হোক তবুও তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে,কথা বললে ব্যস্ত কর্মরত উনারও ভালো লাগবে।সত্যিই কৌড়িকে রানাঘরে দেখতেই ভদ্রমহিলা অমায়িক হেসে দিয়ে বললেন–তুমি আবার উঠে আসলে কেনো?কিছু লাগবে কি?

‘না।এমনিতেই আসলাম।আপনি একা একা কতোশত কাজ করছেন,আমাদের কাওকে রান্নাঘরে ঢুকতে দিচ্ছেন না।বিষয়টা ভালো দেখায়?আমারতো ভালো লাগছে না।

‘ওরে আল্লাহ।সত্যিই তো শ্বাশুড়ি কাজ করবে আর তার বাচ্চা বউমা চুপচাপ দেখে যাবে বিষয়টাতো সত্যিই কেমন দেখায়।এসো তবে কাজে হাত লাগাও।

প্রথম কথাগুলো মজার ছলে বললেও,শেষের কথাটা বলতে বলতে কৌড়ির দিকে বড়সড় একটা মাছের পাত্র ধরিয়ে দিলেন।তাতে বড়বড় কাতল মাছের পিছ করে রাখা।সুন্দরকরে ধোয়া পরিস্কার করা।কৌড়ির হাতে সেটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন–আপতত বউমা কে কাজের চাপে রাখতে,শ্বাশুড়ির আর এটুকু কাজ বাকি আছে।বউমা যখন নিজেই শ্বাশুড়ির সাহায্য করতে চাইছে তবে মাছগুলোতে একটু কষ্ট করে লবন হলুদ মাখিয়ে দাও।তবে খবরদার মরিচের গুঁড়ো নেবে-না।ওটা আমি মাছভাজার সময় নিজে লাগিয়ে নেবো।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।

সানন্দে কাজে হাত দিলো কৌড়ি।সকালে এবাড়িতে নিভান থাকার কথা বলতেই,শাড়ী ছেড়ে নিতুর একটা নতুন থ্রিপিস পরেছে সে।নিতু নিজেই অফার করেছিল।কৌড়ি না বললেও শোনেনি।নিতু তার থেকে স্বাস্থ্যে ভালো তাই থ্রিপিসটা গায়ে একটু ঢিলাঢলা হয়েছে।তবে ফর্সা গায়ে কাঁঠালি রঙটা বেশ চড়াও হয়েছে।মেয়েটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে ঝুমুরের।মিষ্টি মেয়েটার সাথে কথা বলেও আলাদা শান্তি।বয়স অল্প হলেও বেশ বুঝদার।

‘বাটাবাটি, কাটাকাটি সব কাজ-তো ময়নার মা’ই গুছিয়ে দিয়েছে।আমি শুধু রান্না করছি।তবে তোমাকে কিন্তু এখানে মাছগুলোতে লবন হলুদ লাগানোর জন্য আটকায়নি,গল্প করার জন্য আটকিয়েছি।এখন বলো তো,এই বাড়িটা তোমার কেমন লাগলো?মাঝেমধ্যে এই শ্বশুরবাড়ীতে আসা যাবে তো?যদিও থেকে গেলে আমার একজন দারুন সঙ্গী হয়।তবে তোমার শ্বাশুড়ির হক তো চেয়ে নেওয়াও অন্যায়।তাই থেকে যাওয়ার কথা বলতে পারছিনা।

‘এবাড়িটা আমার খুব ভালো লেগেছে ছোটোচাচী।আমি আসবো মাঝেমধ্যে।

‘আর এবাড়ির মানুষগুলো বুঝি পছন্দ হয়নি?

ঝুমরের কথায় কৌড়ি বিচলিত হলোনা বরং অমায়িক হাসলো।ফের বললো–যেবাড়ির মানুষগুলো ভালো নয়, সেটা রাজপ্রাসাদ হলেও সেখানে যেতে বা থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে-না।বাড়ি ভালো হয় বাড়ির মানুষগুলোর গুনে,বাড়ির অবকাঠামো আর রঙচঙের সৌন্দর্যের গুনে নয়।এটা বাবা বলতেন।আমিও মানি।

মেয়েটা গুন স্বভাব আচার-আচরণ বলে মেয়েটা বাবা, মায়ের কাছ থেকে বেশ ভালোই শিক্ষা পেয়েছে।ঝুমুর কৌড়ির কথার প্রশংসা করলেন।এরকম টুকটাক কথা হতে থাকলো তাদের মধ্যে।

বড় পুকুরটায় প্রায় ঘন্টাখানেক আগে জাল ফেলে মাছধরার ঘোলাপানির কোনো চিহ্ন নেই।মাছধরার সময় পানিটা হালকা ঘোলাটে হয়ে গেলেও,তা পুনারায় সচ্চ,টলটলে।দুপাশে বসার স্থান করে শানবাঁধানো ঘাটটার একপাশে নিভান আর অন্যপাশটায় ইভান বসে আছে।সেই কখন এসেছে এবাড়িতে আর মাত্রই দু’ভাইয়ের সম্মুখীন সাক্ষাৎ হলো।অনেকটা সময় পর নিভান মুখ খুললো।খুব সহজ সাবলীল গলায় শুধালো।

‘হঠাৎ দলবল নিয়ে হাজির?কেনো?

‘দাদুমা একেক দিন আবদার জুড়ছে আর তুমি তাতে সায় জানিয়ে থেকে যাচ্ছো।কেনো?তাহলে তো আমার আর আসা লাগতো-না।

ইভানেরও সহজ সরল স্বীকারোক্তি।অদ্ভুত শান্ত চোখে তারদিকে তাকিয়ে রইলো নিভান।ফের বললো–তো প্রবলেমটা কোথায়?উনি অসুস্থ মানুষ।আবদার জুড়লে পিতৃসুত্রে তা রাখার দ্বায় আছে আমার।যাই হয়ে যাক রক্তের দ্বায়টা তো এড়াতে পারিনা আমি।বাবার জন্য হলেও সেটা রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ।

‘যেমনটা মায়ের জন্য রক্ষা করে যাচ্ছো!তাই না?

সত্য হলেও ইভানের মুখে কথাটা মানতে পারলো না নিভান।কপাল কুঁচকে কিছুটা ক্ষিপ্র গলায়
বললো—হোয়াট রাবিশ!এসব কি ধরনের অবুঝপনা ছেলেমানুষী কথাবার্তা!তুই কি এখনো ছোটো আছিস ইভান?এখনো এসব কথাবার্তা তোর মাথায় ঘুরেফিরে চলে!আর আমি এখানে থেকে গেলে, তুই কি পারবি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে?কেউ পারবে?এসব বোকামো,পাগলামো নয়?

‘তারমানে দাদুমা বললে তুমি এবাড়িতে থেকে যাবে?

‘তা কেনো থাকবো!থাকার হলে বহুবছর আগেই এসে আমি থাকতাম।

‘মায়ের জন্য পারো-নি তাই না?

‘সমস্যাটা কি তোর ইভান?

সবসময় কথা প্যাচানো, কথা বাড়ানো ইভান।আজ কথা বাড়াতে চাইলো-না।রক্তের সম্পর্কের প্রতি কার কতোটা দূর্বলতা আছে ইভানের জানা নেই।তবে নিভান আওসাফ আহমেদের আছে।কঠিন দূর্বলতা।যে ছেলেটা অবুঝ বয়স থেকে-ও কখনো বাবার নামের টাইটেল নিজের নাম থেকে মুছতে দেয়নি।এতোবড় নামীদামী ব্যাবসায়ীর চেয়ারে বসে যখন নিজের পিতার নাম জাহিদ হাসান না বলে দ্বিধাহীন আওসাফ আহমেদ বলে পরিচয় দেয়।সেই ছেলেটার রক্তের টান সম্পর্কে ইভানের ঢেড় জানা আছে।ওবাড়ির সামন্য অর্থ,আরাম-আয়েশ সুখসাচ্ছন্দ্য দাদাভাইকে টানেনা।সেসবের প্রতি দাদাভাইয়ের বিন্দু লোভ, টান নেই।এটাও ইভান জানে।আর সহধর্মিণীও পেয়েছে তেমন।যদি বলে তারসাথে রাস্তায় জীবনযাপন করতে।মেয়েটা চোখবুঁজে সেই রাস্তায় থাকতে রাজি হয়ে যাবে।সেখানে এবাড়িতে থেকে যাওয়াটা কোনো বাঁধাই না।ইভান জানে ইভান নিজের মনের সংশয়,ভয় থেকে ছেলেমানুষী করছে।নিভান যদি এবাড়িতে থাকতে চায় ইভান তাকে কখনো আটকে রাখতে পারবে-না।তবে রক্তের টানের থেকে আত্মার টানের বন্ধন দৃঢ় হয়।সেখানে একই মায়ের সন্তান তারা।আর দাদাভাইয়ের আলাদা একটা টান ভালোবাসা তারপ্রতি রয়েছে,সেখানে দাদাভাই কখনো তার চাওয়া পাওয়া, ভালোবাসা, মায়া অগ্রাহ্য করতে পারবে-না।তারদিক থেকে সহজে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবেনা।সেখানে সবগুলো ভাইবোনের ভালোবাসা টান মায়া সে কিকরে উপেক্ষা করবে?তাই ভুলেও যদি দাদাভাই থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করে,এবাড়িতে কিছুতেই একেবারে থাকতে দেবেনা ইভসন।তাই দলবল নিয়ে হাজির।যদিও এটা দলবলেরা জানেনা।জানে শুধু ইভানের ভিতরটা।

নিভানের কথার উত্তর দিলোনা ইভান।গায়ের টিশার্টটা একটানে খুলে ফেললো।প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেট আর ফোনটা বের করে শানের উপর রেখে ঝপাৎ করে পুকুরের পানিতে লাফ দিয়ে পড়লো।ইভান সুইমিং জানে,তাই বিচলিত হতে গিয়েও হলো-না নিভান।স্থির হয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে সেভাবে বসে থেকে ইভানের সাঁতরানো দেখতে থাকলো।অদ্ভুত ছেলেটার কখন কি মনেহয় কে জানে!এবোবড় হয়েছে তবুও ছেলেটার ছেলেমানুষী গেলো না!সময় নিয়ে নিভান বললো।

‘তুইযে এই লাফিয়ে ঝাপিয়ে গোসল করে চলেছিস।গোসল সেরে পরবি কি?

সাঁতরানোর মধ্যেও ইভান মুখ উঁচু করে হাসলো।ফের বললো—তুমি আছো কিসের জন্য।

‘আমি এবাড়িতে থাকার জন্য আসিনি ইভান।ক্ষনিকের জন্য এসেছি।সেটা ভেবে না সঙ্গে করে এক্সট্রা কিছু নিয়ে এসেছি,আর না এখানে আমার কিছু আছে।

‘ভেরী গুড।তবে তুমিযে কাল স্যুট পরে আসলে।এখন গায়ের এই টিশার্ট,পরনের এই ট্রাউজার কোথায় পেলে?

‘এটা এক্সট্রা গাড়িতে থাকে আমার।

‘অর্ডার দিলে তো হয়ে যেতো।

‘কাল এখানে থেকে যাবো ভাবিনি।মনে হয়েছিলো, যত রাত হোক বাড়িতেই চলে যাবো।কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠেনি।তবে সকালেই বাড়ি যাওয়া হবে বলে রাতে-ও আর অর্ডার করা হয়নি।এখন মনেহচ্ছে করলে ভালো হতো।

‘এখন অর্ডার দিয়ে দাও।

‘আসতে সময় লাগবে। তারমধ্যে কি করবি?

‘আরেহ চাচাজান আছেননা?উনার লুঙ্গিসুঙ্গি পরে নেব।

ইভান পরবে লুঙ্গি!হেসে ফেললো নিভান।নিভানের বড়মাম বাংলাদেশ ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা ছিলেন।তিনি অফিস টাইম বাদে বরাবরই লুঙ্গিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।ইভান তখন ছোটো।একেবারে ছোটো নয়।তখন হয়তো ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ে।বড়মামাকে দেখে ইভানের লুঙ্গি পরার শখ জাগলো।যেন-তেন শখ নয়,ভিষন শখ।লুঙ্গি কিনবেই কিনবে এবং পরবেই পরবে।বাধ্য হয়ে মা তাকে ছোটো লুঙ্গি কিনে দিলেন।ইভান খুশিমনে তা পরলো।কিন্তু বেচারা সামলাতে পারলোনা।শত চেষ্টা করেও সামলিয়ে উঠতে পারলোই না।বরংবার তা খুলেখুলে পড়ে যেতে লাগলো।তবুও শখ বলে কথা,ইভান চেষ্টায় সচল থেকে গেলো।কিন্তু সেই চেষ্টা যখন সর্বসম্মুখে ইজ্জতের দফারফ করে দিলো।তখন গিয়ে ছেলেটা ক্ষান্ত হলো।বস্ত্রহীন ইভান,লজ্জায় কেঁদেকেটে লুঙ্গি ছিঁড়ে ফেললো।এবং কঠিন শপথ করলো,পোশাক না থাকলে না পরে থাকবে তবুও লুঙ্গি সে আর কখনো পরবেনা।জীবনে পরবেনা।সেই থেকে আজও পর্যন্ত ইভান কখনো লুঙ্গি পরেনি।নিভান অন্তত পরতে দেখেনি।

‘হাসছো কেনো?তখন ছোটো ছিলাম বলে সামলাতে পারতাম না। তবে এখন নিশ্চয় সামলাতে পারবো।

নিভান কিছু বলতে যাচ্ছিলো।তন্মধ্যে আযানের ধ্বনি ভেসে আসায় চুপ হয়ে গেলো।ততক্ষণে ইভান সারাপুকুর সাঁতরিয়ে চলেছে।নিভান তা চেয়ে চেয়ে দেখলো।

‘আরেহ ইভান ওয়াশেরুমে গোসল করতে।

আশহার সাহেবের কন্ঠে ইভান গলা চড়াও করে উত্তর দিলো–সমস্যা নেই আঙ্কেল।পুকুরে গোসল করতে বেশ ভালোই লাগছে।আপনি শুধু একটা তোয়ালের ব্যবস্থা করে দিন।গামছা হলে-ও চলবে।

নিভানকেও ভিতরে গোসল করার তাগাদা দিয়ে আশহার সাহেব বাড়ির মধ্য চলে গেলেন।নিভান ভিতরে গেলোনা।গায়ের টিশার্টটা খুলে ইভানের দেখাদেখি সেও পুকুরে নেমে পড়লো।সুইমিং জানা থাকলেও ইভানের মতো পরিপক্ব নয় সে।তাই আর বিশাল বড় পুকুরটার টলটলে সচ্চ পানিতে সাঁতরানো হলো-না তার।ছয় সাতটা সিঁড়ি বেয়ে কোমর সমান পানিতে গিয়ে বসলো সে।শানের উপর আগের থেকেই একটা গোসলের মগ ছিলো।সেটা হাতে নিয়েই নেমেছিলো।আর তা দিয়েই পানি কাটিয়ে গোসল করার চিন্তা ভাবনা করলো।

বাড়ির পিছনের বাগানটা দেখবে বলে নিতু ইতুকে সাথে মেয়েরা সব বেরিয়েছিলো।পুকুরঘাটে নিভান আর ইভানকে গোসল করতে দেখে,ডানপাশ ঘুরে তারা বাগানে চলে গেলো।তবে কৌড়ি যেতে পারল না।নাফিম জেদ ধরেছে,বাহানা করছে।সেও পুকুরে ডুবিয়ে দাদাভাইদের মতো গোসল করবে।কিন্তু নিভান থাকায় জেদটা জোরালো করতে পারছে-না।আর না দৌড়ে গিয়ে নামতে পারছে।তাই কৌড়িকে ধরেছে উকিল।কৌড়ি পড়েছে মহাজ্বালায়।একে নাফিম সাঁতার জানে-না।তাতে আবার অচেনা পানি-তে ওর ঠান্ডা লাগার ধাত আছে।কিছুতেই নিভান রাজি হবেনা তাকে পানিতে নামতে দিতে। এখন কি করবে সে?

‘বউমনি,আমিও পুকুর গোসল করবো।তুমিও চলোনা, তবে দাদাভাই বকবেনা।

বাহানা জারি রইলো বিরতিহীন। পুকুরের ঘাটে বসে গোসল করতে থাকা মানুষটা মনেহয় সেই অব্যহত জারী শুনতে পেল।পিছন ফিরে মুখ উঁচিয়ে বললো–কি বলছে ও?

কৌড়ি জানে উত্তর পেতেই গম্ভীর মুখে মানুষটা বলবে– না,পুকুরে গোসল দেওয়া যাবেনা।ওকে ভিতরে নিয়ে গোসল করিয়ে দাও।আর এই গম্ভীর বার্তা শুনতেই বাচ্চা ছেলেটার মন খারাপ হয়ে যাবে।সুন্দর মুখখানা গুমোট হয়ে থাকবে।এমনিতেই মানুষটার গলার আওয়াজ শুনতেই চুপ হয়ে গেছে ছেলেটা

‘কৌড়ি।

‘ও-ও আপনাদের সাথে পুকুরে গোসল করতে চাইছে।

নিভান কিছুসময় চুপ থেকে বললো—আচ্ছা পাঠিয়ে দাও।

কাচুমাচু হয়ে দাড়ানো নাফিম লাফিয়ে উঠলো।তড়িৎ কৌড়ির ওড়নার আচল ধরে টান দিয়ে বললো—চলো।

‘এই আমি কোথায় যাবো?দাদাভাই হ্যা বলেছে যখন তুমি যাও।আমি ঘাটে দাড়িয়ে থাকছি। যাও।

কৌড়িকে ছাড়া যাবে-না নাফিম।ছোটো দাদাভাইয়ের সাথে দুষ্ট মিষ্টি যেমনই হোক,তার দারুন সখ্যতা হলেও বড়দাদাভাইয়ের সাথে একদম নয়!অগ্যতা নাফিমের বাহানায় কৌড়িকে যেতে হলো।তবে সিঁড়িতে পা রাখতেই উদোম গায়ে নিভানকে গোসল করতে দেখে কেমন অস্বস্তি হলো।নাফিম পানিতে নামার আগে নিভান বললো।–‘ও গোসল করে পরবে কি!ওকে চেঞ্জ করে গামছা জাতীয় কিছু পরিয়ে দাও।

অগ্যতা গামছা এনে নাফিমকে চেঞ্জ করে দিল।ছেলেটা লজ্জা পাচ্ছিলো তবে পুকুরের গোসলের আনন্দে তা ক্ষীন হলো।নাফিমের প্যান্ট শার্ট আর চশমা হাত নিয়ে উপরে চলে গেলো কৌড়ি। নাফিম পুকুরে নামতেই তাকে কোলের মধ্যে সিঁড়িতে বসিয়ে নিজের হাতের মগটা ধরিয়ে দিলো নিভান।বললো–পুকুরে নামা যাবে না।ডুবে যাবে।এখানে বসে গোসল করে নাও।

‘নাফিম আমার কাছে আসবি?

ইভান ডাকতেই নাফিম কোথায় বসে আছে মূহুর্তেই যেনো ভুলে গেলো।উচ্ছসিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠতেই,নিভান তাকে হাত ধরে বসিয়ে দিলো।নিজের একটা হাত দিয়ে ওর পেট চেপে ধরে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বললো–ও সাঁতার জানেনা ইভান।ওকে নিয়ে একদম ফাজলামো নয়।

গম্ভীর গলাা শুনতেই নাফিম দমে গেলো।চুপচাপ দাদাভাইয়ের কোলের মধ্যে বসে পড়লো।পুকুরে নামতে দিয়েছে এই ঢেড়।এখন বাড়াবাড়ি করলে,দাদাভাই সোজা উপরে উঠিয়ে দেবে।ওর থেকে চুপচাপ গোসল করাই ভালো।আর কোলের মধ্যে বসে আছে এটাওতো ভসবতে হবে! তবে ইভান তাকে উস্কানো বন্ধ করলো-না।তাতে কান মন দিলে-ও, সায় দিতে পারলো-না নাফিম।কানন এসে দাঁড়ালো সবে।ও ওয়াশরুমে গিয়েছিলো।ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ঝুমুর জানালো সবাই বাড়ির পিছনের বাগানে। তাই ওও চলে এসেছে।কৌড়ির পাশাপাশি এসে দাঁড়াতেই ইভান এবার নাফিমকে ছেড়ে ওর পিছু নিলো।বললো–কানন সাঁতার জানো?

‘গ্রামের ছেলে সাঁতার জানবোনা।হ্যা ভাইয়া।

‘তবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?নেমে পড়ো।

‘গোসল করে পরবোটা কি ভাইয়া?ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিওনা টাইপ মাথায় কাজ করবে তখন।হুদাই গামছা পরে বসে থাকতে হবে।

‘আরেহ অতশত ভাবলে কি আর হয়।নেমে পড়ো তো।

কানন সত্যিই ভাবলোনা।গা থেকে শার্ট গলানোর আগে নিচু গলায় কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো—ফুলবানু ব্যাডনিউজ আছে।

কাননের স্বভাব সম্পর্কে জানে কৌড়ি।সত্যি যদি ব্যাড নিউজ হতো,কন্ঠে এতো রসিকতা এনে বলতো-না।মুখেও চিন্তাভাবনার প্রলেপ থাকতো।তাই বিচলিত না হয়ে সহজ গলায় জিজ্ঞেস করলো—কি ব্যাড-নিউজ?

‘আমাদের নাহিদ আরশাদ সাহেব নাকি আবার-ও পুরানো ক্যারেক্টারে ফিরে গিয়েছেন।সাথে মাতলামো, পাগলামো শুরু করছেন।আগের দিন নাকি হাত-ফাত কেটে নাজেহাল অবস্থা করে ফেলেছেন। হসপিটালে ভর্তি করা লাগছে নাকি উনাকে।আহারে বেচারাকে দেখতে যেতে আমার খুব ইচ্ছে করছে।দাদিআপা আর আব্বুতো আজ সকালেই চলে যেতো।তুই যেতে চাইলে বল,ভাইয়াকে বলি?

চলবে…..

#ফুলকৌড়ি
(৫৩)শেষাংশ
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ফাজলামো করে ঘনোঘনো ভ্রু নাচালো কানন।অর্থাৎ কৌড়ি যাবে কি-না? কিন্তু বিষয়টা কাননের কথাবার্তায় যে ধারায় ফাজলামো ঝরে পড়লো, কৌড়ির কাছে তা একটুও ফাজলামো মনে হলোনা।শত্রু হলেও নিজের জন্য কারও অমঙ্গল কখনো চাইনি আর চায়ও-না সে।নাহিদকে একেবারে পছন্দ করেনা কৌড়ি তাইবলে তার মন্দটা হোক এটা চায়না কখনো।

‘ও যা আমাকে বকে ধমকিয়ে জ্বালিয়েছে না!চল-না নিভান ভাইয়ার বউ ইন্ট্রডিউস করিয়ে তোকে দেখিয়ে এবার একটু শোধবোধ নিয়ে আসি।

‘তুই পুকুরে নামবি নাকি আমি ঠেলা মেরে ফেলে দেবো তোকে!কুকুর কামড়িয়েছিল তাই শোধ নিতে এখন তুইও যাবি কুকুরকে কামড়ে দিতে!অসভ্য, পুকুরে নাম গোসল কর, যা।

কানন মৃদু হেসে গায়ের শার্ট গলিয়ে ঝপাৎ করে পুকুরে নেমে পড়লো।তারপর শুরু হলো ইভান আর তার সারা পুকুরময় দাপানো।প্রতিযোগিতাও হলো দুজনের মধ্যে,ওপাড়ের ঘাট থেকে ওপাড়ের ঘাট।একটা সময় ক্ষান্ত দিয়ে সিড়িঘাটে এসে বসলো দুজনে।নিভান এতোসময় ধৈর্য্য নিয়ে দুই প্রাপ্তবয়স্ক বাঁদরের বাদরামি দেখলো।একজন সম্পর্কে শালাবাবু আরেকজন কলিজার ভাই।কি বলা যায় তাদের?নিভানের পাশে এসে ইভান বসতেই নাফিমের দিকে নজর দিলো।নাফিমের পরনের গামছার ফাঁক দিয়ে তার ফর্সা পা দেখা যাচ্ছে। সেটা লক্ষ্য করে চোখ দিয়ে ইশারা করলো ইভান।নাফিম কি বুঝে সেদিকে তাকালো।তবে উরুর অংশ বেরিয়ে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি ঢেকে ফেললো।
তবে তার মনে হচ্ছে, ছোটো দাদাভাই আরও কিছু দেখে ফেলেছে।যদিও ইভান দেখেনি।তবে নাফিমের আতঙ্কিত নজর খেয়াল করে মিছেমিছি নাফিমকে ক্ষেপাতে বললো–আরেহ ঢেকে কি লাভ দেখেই তো ফেলেছি।

নাফিম কেঁদে দেবো যেনো।এতো মানুষের সামনে বেইজ্জতি।এতোসময় নিভানের সান্নিধ্যে থেকে তার কাছে কিছুটা সহজ হয়ে যাওয়ায় মুখ উচু করে কন্ঠে খাদ মিশিয়ে ডাকলো—দাদাভাই।

নিভান কিছু বলার আগেই ইভান ফের বললো–আরেহ দাদাভাই কি!দু’বছর আগে যখন তোর ইয়ে কেটেছিলো,তুই কাঁদছিলি আমি ধরেছিলাম তোকে।তখন তোর লজ্জা কোথায় ছিলো?

‘উফফ,ইভান!

পাশে বসা কানন খিলখিলিয়ে হাসলো।ইভান ভাইয়া যেমন মিশুকে ছেলে তেমন জোশ।নিভান এবার সত্যি বিরক্ত হলো।ইভানকে থামিয়ে দিয়েও কাজ হলোনা।সে কি কারও কথা শোনে!সে আছে খোঁচাতে। না পেরে নিভান এবার কৌড়িকে ডাক দিলো।কৌড়ি ছিলো নিজের খেয়ালে।একবার নয় দুবার ডাক দেওয়া লাগল তাকে।

‘এই কৌড়ি।শুনছো।এই নাাফিমকে নিয়ে যাওতো।চেঞ্জ করিয়ে দাও।

কৌড়ি এলো।নাফিমকে কোল থেকে উঠিয়ে দেওয়ার সময় ফের নাফিমের গামছা ধরে টান দিলো ইভান।নিভান হাত চেপে ধরে আটকালো।মিছেমিছি রাগ দেখালোও।তাতে থোড়াই না ইভানের গেলো এলো।নাফিমকে নিয়ে উপরে উঠে চেঞ্জ করিয়ে দিলো কৌড়ি।ওদের গোসলের মধ্যে আশহার সাহেব এসে বডিওয়াশ শ্যাম্পু রেখে গিয়েছিলেন।সারা পুকুরের শেওলা গায়ে জড়িয়ে এবার এবার বডিওয়াশ, শ্যাম্পু নিতে ব্যস্ত হলো ইভান।নিভানের হয়ে গেছে।কয়েক সিঁড়ি উপরে উঠে কৌড়ির কাছে তোয়ালে চাইলো সে।সেটা দেখে ইভান এবার কৌড়ির পিছে লাগলো।

‘কি বলেছিলাম ফুলকৌড়ি?বলেছিলাম না,ওই মানুষটা থেকে দূরে থেকো।নাহলে কিন্তু তার প্রেমে পড়ে যাবে।সব মেয়েরা কিন্তু ওই একই ভুল করে।মানলেনা আমার কথা।তুমিও সেই ভুল করলে।দেখেছো,শেষমেশ বিয়েই
করে নিতে হলো।এখন আবার খেদমতও করতে হচ্ছে।
এজন্য লোকে বলে,গরীবের কথা বাসি হলে ফলে।তখন শুনলে-না আমার কথা এখন খেদমত করে যাও।

নিভান থোড়াই না কানে তুললো ইভানের কথা।তবে কৌড়ি তাজ্জব বনে গেলো।তখনও হা হয়ে ইভানের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে।এমন কথা কখনো বলেনি ইভান বরং তার দাদাভাইয়ের গুনোকীর্তন গেয়ে দিনের পর দিন উসকিয়ে গেছে তাকে।ফাযিল লোকটা এখন পাল্টি খাচ্ছে। উল্টো গান গাইছে।

‘কি ফুলকৌড়ি ফলে গেলো তো আমার কথা?

এবার নিভান বললো–ফুলকৌড়ি কি?

ইভান হেসে বললো—ফুলকৌড়ি ইজ ফুলকৌড়ি।তুমি কি বলতে চাইছো,ফুলকৌড়িকে আমি বউমনি বলবো।নেভার এ্যাভার।অতটুকু একটা মেয়েকে বউমনি বলা যায়!যদি পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের একটা বুড়িছুড়ি হতে তবে ভেবে নাহয় দেখা যেতো।ভেবে দেখা যেতো কি!বড় ভাইয়ের বউ হিসাবে বউমনি বলে ডাকতেই হতো।কিন্তু এমন একটা বাচ্চা মেয়েকে বউমনি ডাকা যায়?

কৌড়ি এবার আর ইভানের দিকে নয় নিভানের দিকে ছোটো মুখ করে তাকালো।উন্মুক্ত শরীর।একটানা মাথা মুছে চলেছে মানুষটা।কৌড়িকে তাকাতে দেখেই মিষ্টি হেসে দিলো নিভান।নিভানের হাসি দেখে কৌড়িও মৃদু হেসে মাথা নিচু করে নিলো।সে তো জানে ইভান কেমন?তবে কেনো বোকামো করে ওমন ছোটো মুখ করে তাকালো!নিজের বোকামোতে যেনো নিজেই লজ্জা পেলো কৌড়ি।ইভানকে থামাতে নিভান ফের বললো —‘তবুও আর ফুলকৌড়ি নয়।ও তোর মেয়ের বয়সী হলেও ওকে বউমনি বলেই ডাকবি।

‘আরেহ ফুলকৌড়ি আমাদের ফুলকৌড়ি।ও তোমার বউ হওয়ার আগে আমাদের ফুলকৌড়ি ছিলো। ছিলো নাা নাফিম?

পুকুরপাড়ের শানবাঁধানো ঘাটের একপাশে বিশাল বড়ো একটা কামেনিফুল গাছ অপরপাশে ঝাঁপানো একটা করমচা গাছ।সেখানে সুবজের মিশলে লাল করমচাঁতে গাছ হেলে পড়েছে।সেখান থেকে করমচাঁ তুলছিলো নাফিম।ইভান তাকে উদ্দেশ্য করে বলতেই
নাফিম নাকমুখ কোঁচকালো।অর্থাৎ তাকে একটু আগে চরম বেইজ্জতি করার কারণে ইভানের কথায় উত্তর দেবে-না সে।ইভান সেটা দেখে এবার কৌড়িকে ছেড়ে নাফিমের পিছু লাগলো।নিভান বিরক্তির সাথে সাথে ইভানের কাজে এবার অধৈর্য্য হয়ে পড়লো।বুঝতে পারলো,ইভানের আজকের টার্গেট নাফিম এন্ড কৌড়ি।
এরা সামনে থেকে না সরা পর্যন্ত এই ইতোড় ছেলেটা কিছুতেই থামবে-না।নিভান কোনোরকম চেঞ্জ করে নাফিম আর কৌড়ি ডেকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।ততক্ষণ পর্যন্ত বিরতী চললো ইভানের ইতুড়েপনা।ওরা চলে যেতেই কানন হাসি থামিয়ে বললো।

‘আপনি পারেন-ও বটে ভাইয়া।

বিনিময়ে একগাল হাসলো ইভান।ইদানীং তার সবচেয়ে জ্বালাতে ভালো লাগে তন্ময়ীকে।আজ তাকে জ্বালানোর সুযোগ পায়নি ইভান।তাই সুযোগটা ব্যবহার করলো নাফিম আর কৌড়ির উপর দিয়ে।সারাদিনে একবার কারও পিছু না লাগলে মনেহয় দিনটা কেমন যেনো রুচিহীন খাবারের পানসে গেছে তার।

ডায়নিংটেবিল ভর্তি খাবার সাজানো।চিংড়ি মাছ দিয়ে মোচাঘণ্ট,নারকেলের দুধ দিয়ে লাউ চিংড়ি, রুইমাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট,চিংড়ি মাছের মালাইকারি,রুইয়ের দই মাছ,কাতলা মাছের মাখোমাখো ভুনা এবং সর্ষে ইলিশ সাথে দুধ পোলাও,দেশি মুরগির রোস্ট, রাজহাঁসের মাংশ ভুনা এবং হাঁসের ডিমের কোরমা।মিষ্টান্নতে রয়েছে পায়েশসহ, গাজরের হালুয়া,এবং দই।সঙ্গে দুই তিন পদের আচার।টেবিলভর্তি টায়টায় খাবার।আর খাবার সুগন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশটা।টেবিল ভর্তি খাবার দেখেই ইভান হায় হায় করে উঠলো।ঝুমুরকে উদ্দেশ্য করে বললো–কি করেছেন কি আন্টি!এতো আপনি পুরো বিয়ে বাড়ির আয়োজন করে ফেলেছেন।

বিনিময়ে ঠোঁটে মাতৃসূলভ স্নেহময় হাসি ফুটিয়ে ঝুমুর বললো –এ-তো বাড়িরই সবকিছু।আলাদা আয়োজনের আর সময় পেলাম কোথায়?তোমার আসবে জানলে আলাদা আয়োজন করা যেতো।

‘যা করেছেন আর আলাদা আয়োজনের দরকার নেই।এই খেয়ে সবাই শেষ করতে পারলে হলো!

সবাই চেয়ার টেনে বসে পড়লো।ঝুমুরকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে ইভানও চেয়ারে টেনে বসে পড়লো।সঙ্গে সঙ্গে পাশের চেয়ারে বসা নিভান চাপাস্বরে
বললো।–সাবধান খেতে গিয়ে আবার লুঙ্গি না খুলে যায়!এটা কিন্তু সেই ছেলেবেলা নয় সর্বসম্মুখে বেইজ্জতি হলো,কেঁদেকেটে লুঙ্গী বর্জন করে ফেললাম!আর সবাই সেই ইজ্জত হারানোর বিবস্ত্র দৃশ্যটা ভুলে গেলো!সুতারাং খাবার চেয়ে মনোযোগ লুঙ্গিতে!এই বয়সে ইজ্জত হারালে কি হবে নিশ্চয় বুঝতে পারছিস?

সবার পিছু পড়ে থাকা ছেলেটা আতঙ্কগ্রস্থ হলো।গোলগাল নজরে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা নিভানের দিকে তাকিয়ে রইলো।শেষে কি-না দাদাভাইও!এবার নিজের পরনের লুঙ্গির দিকে একবার অসহায় নজর দিলো।গোসল শেষে যখন আশহার সাহেবের লুঙ্গি পরলো ইভান।তন্ময়ী আর মৌনতাতো খিলখিলয়ে হেসে দিলো।সাথে নাফিম মান্যতাও বাদ যায়নি।নাফিম তো বলেই বসলো–ছোটো দাদাভাই তোমাকে কেমন পাগল পাগল বোকাবোকা লাগছে।

আসলে লুঙ্গি পরায় পাগল পাগল লাগিনি।লুঙ্গি পরার ধরনে অদ্ভুত পাগল পাগল বোকাসোকা দেখাচ্ছিলো।পরে যখন আশহার সাহেব ঠিকঠাক করে পরিয়ে দিলেন,তারপর যা একটু সামলে চলতে পারছে ইভান।নাহলে নিজে যখন পরেছিলো,শুধু পায়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছিলো।খুলে যাওয়ার সম্ভবনায় কোমরের গিটের ওখানে সর্বক্ষণ চেপে ধরে রাখা লাগছিল।তখন বুঝেছে না বুঝেশুনে পুকুরে গোসল করতে নামার ঠিকঠাক শাস্তি!ততক্ষণে উপায়হীন!আর সেই উপায়হীন অসহায় মানুষটাকে,তার ভালো দাদাভাইটাও সুযোগ নিয়ে খোঁটা দিচ্ছে।

‘ইভান,কি ভাবছো?খাবার শুরু করো।

আশহার সাহেবের কথায় ইভান জোরপূর্বক সৌজন্য হাসি মুখে ফুটিয়ে বললো–এইতো শুরু করছি আঙ্কেল।

অথচ তখনও তার মন আতঙ্কগ্রস্থ।এরকমই খাবার টেবিলে তার বেইজ্জতিটা হয়েছিলো।লুঙ্গি পরে খাবার খেতে বসেছিলো।খাবার খেতে খেতে লুঙ্গির কথা আর মনে ছিলোনা।খাবার শেষে চেয়ার ছেড়ে যখন উঠে দাঁড়ালো। তখন মনেহলো তার পরনের লুঙ্গি গায়েব।নিচে পড়ে গেছে।সবাই তখন তারদিকে চেয়ে!ছিঃ ছিঃ সেকি বেইজ্জতি!এখনো মনে উঠলে ইভানের কান-মাথা গরম হয়ে যায়।সেই কান্ড যদি আজও ঘটে!ওরে আল্লাহ, ইজ্জত হারানোর লজ্জায় তার বুড়িগঙ্গার ওই পচা বর্জ্য নোংরা পানিতে ডুবে মরা ছাড়া আর উপায় থাকবেনা।ইভান অসহায় মুখ করে নিভানের দিকে তাকালো।দাদাভাই সেই বিদঘুটে পুরানো স্মৃতিটা ঠিক খাবার সময় মনে করিয়ে দিয়ে,তার খাওয়া আঁটকে রেখে নিজে কি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খেয়ে চলেছে।খাবারের গন্ধে চারপাশটা ম-ম করছে,সবাই খাচ্ছে অথচ সে খেতে পারছেনা।নিজের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইভান কন্ঠ নিচু করে নিভানকে বললো–দাদাভাই এখন আমি কি করবো?

‘এত খাবার সামনে রেখে জিজ্ঞেস করছিস, কি করবো!

‘দাদাভাই প্লিজ। হেল্প মি।আমার চেঞ্জ করা দরকার। নাহলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে আমাকে দেশান্তরি হতে হবে।এটা নিশ্চয় তুমি চাওনা?

‘সেটা আমি চাইনা।তবে এখানে আমি কি হেল্প করতে পারি!না আছে এখানে আমার কোনো পোশাক-আশাক, আর না আছে তোর আমার সমবয়সী কেউ।তবে?দ্বিতীয়ত অর্ডায় দিয়েছি তো, আসতে সময় লাগবে।সেটুকু সময় তো ধৈর্য্য ধরতেই হবে।

নিচুগলায় নিভানের নির্লিপ্ত উত্তর ইভানকে আরও অসহায় করে তুললো। সে আবারও রিকুয়েষ্ট করলো — দাদাভাই প্লিজ।আমি বেইজ্জতি হলে তুমিও তো লজ্জা পাবে তাই-না?

‘আমি কেনো লজ্জা পাবো?

‘পাবেনা বলছো?

নিভানের হাসি পেলো।তবে ভুলেও সে হাসলো না।বরং নির্লিপ্ত গলায় বললো–‘উল্টোপাল্টা না ভেবে খেয়ে নে।কাননকে দেখ,ও লুঙ্গির গিটে হাত চেপে কি সুন্দর খেয়ে চলেছে।বুদ্ধি খাটা আর ওকে অনুসরণ কর।আর এতো দুশ্চিন্তা করারও বা কি আছে,খাবার শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠার আগে লুঙ্গি ঠিকঠাক আছে কি-না দেখেশুনে উঠলেই তো হলো।

শেষের বাক্যদ্বয় বলতেই হেসে ফেললো নিভান।পুরনো স্মৃতি মনে পড়েছে কিনা!মূহুর্তেই হাসিটা আবার মিলিয়ে নিলো ঠোঁটের ভাঁজে।ইভান কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সেই চাপাহাসি ছড়ানো মুখটার দিকে।দাদাভাই নিশ্চয় পুরানো সেই বিদঘুটে স্মৃতি মনে করে হাসছে?ইভানের চোখের সামনেও যেনো মূহুর্তেই সচল হলো সেই স্মৃতি।কান-মাথা যেনো হঠাৎ গরম হয়ে এলো।তবে দাদাভাইয়ের পরামর্শ একেবারে মন্দ নয়।যাই হয়ে যাক, খাবার শেষে উঠার আগে লুঙ্গি ঠিকঠাক আছে কি-না চেক করে নিলেই তো হলো।

‘ইভান,এখনো প্লেট ফাঁকা তোমার। কি ব্যাপার?খাবার পছন্দ হচ্ছে না?

‘না না।খাবার কেনো অপছন্দ হবে।এইতো খাচ্ছি।

তাড়াহুড়ো করে নিজের প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো ইভান।তবে বারবার লুঙ্গি রিচেক দিতে দিতে খাবারটা ঠিকঠাকমতো স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারলোনা সে।কোনোমতে খাবার শেষে অবশ্যই লুঙ্গি ঠিকঠাক আছে কি-না দেখেই তারপর উঠলো।বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে পড়লো আরেক মুশকিলে।একহাতে লুঙ্গির গিট ধরা অন্যহাতে এঁটো। এখন গিট ছাড়লে যদি খুলে যায়?এমনিতেই আশহার সাহেব যেভাবে শক্তকরে বেঁধে দিয়েছিলেন লুঙ্গিটা সেই শক্তপোক্ত অবস্থানে নেই।কেমন যেনো নড়বড়ে মনে হচ্ছে। এখন যদি খুলে যায়?ওরে আল্লাহ সব শেষ।তন্ময়ীকে বেসিনের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখেই বললো–আমার লুঙ্গির গিটটা একটু ধরে রাখোনা,আমি একটু হাতটা ধুয়ে নেই।

‘সব জায়গায় তোমার ফাজলানো।এখানে কতো মানুষ, আমি তোমার লুঙ্গির গিট ধরে দাঁড়াবো!আশ্চর্য!

ইভানের অবস্থা হয়েছে রাখালের গল্পের বালকের মতো,সে মিথ্যা বলে মজা পেত।আর ইভান ফাজলামো করে।বালকের যখন মহাবিপদ এলো তখন আর তার কথা বিশ্বাস করে কেউ তাকে সাহায্য করতে গেলোনা।এখন ইভানের হয়েছে তাই।সবসময় ফাজলামোর ফল,
,এখন ইভানের বিষয়টাকেও ফাজলামো মনে করে তন্ময়ীও আর তাকে সাহায্য করতে চাইছেনা।এজন্য বলে,সব কাজে মাত্রাধিক বাড়াবাড়ি করতে নেই।মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইভান।ফের নরম স্বরে অনুনয় করে বললো–সিরিয়াসলি তন্ময়ী,আমার হেল্প প্রয়োজন।হয় হাত ধুইয়ে দাও নয়তো লুঙ্গীর গিট ধরো।প্লিজ তনু।সোনা বউ আমার, লক্ষী বউ আমার।বিশ্বাস করো,আমি তোমার সাথে ফাজলামো করছিনা।

ইভানের মুখের অসহায় নাজেহাল অবস্থা দেখে তন্ময়ীর পেট ফেটে হাসি পেলো।তবে আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিলো।ইভানের লুঙ্গির গিট ধরা নয়, ইভানের হাত ধুইয়ে দিলো সে।ইভান যেনো হাফ ছেড়ে বাচলো।হাত ধুয়ে তড়িৎ গিয়ে সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসলো সে।

‘কি ভাই চাপে আছেন মনে হচ্ছে!

কাননের কথায় ইভান বললো–
‘তুমি বিশ্বাস করো আমি আর আমার সজ্ঞানে জীবনেও লুঙ্গি পরবোনা।এটা যেমন সহজ সরল দেখতে এ সামলে চলা ততোটা কঠিন।একদম ভােলোভালা সহজ সরল নয়।দারূন চাপের জিনিস।এই চাপ আর কখনো ভুলেও নিচ্ছি না আমি।যদিও লুঙ্গি জিনিসটা বেশ আরামদায়ক।তবুও না।

কানন হেসে ফেললো। বললো — আমি গ্রামের ছেলে।তবে লুঙ্গিতে অভ্যস্ত নই।লুঙ্গিটা ঠিকঠাক পরতে পারিনা।আপনার মতো আমারও একই অবস্থা হয়।

দু’জনে গল্পে মেতে উঠলো।একেএকে ড্রয়িংরুমে হাজির হলো নিভান, আশহার সাহেব,নাফিম।ছেলেদের খাওয়া হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে মেয়েদের ডেকে খেতে বসালেন ঝুমুর।আবিদা জাহানও তাদের সাথে বসলেন।সবাই চুপচাপ খেলেও,তন্ময়ী খেতে পারলোনা।হুটকরে কাল পেটব্যথা শুরু হলো,তারপর বমি।সেই রেশ এখনো কাটিনি।সেখান থেকেই কিচ্ছুটি খেতে ভালো লাগছে না সাথে কিছুর গন্ধ নিতেও যেনো ভালো লাগছে না তার।খাবার সামনে দেখলেই যেনো পেটের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠছে। অসহ্য অসহ্য লাগছে।তবুও মানুষের বাড়িতে এসে তো আর বাহানা দেওয়া যায়না।তাই নীরবে প্লেটে সাদা ভাত তুলে নিয়ে মোচা চিংড়ির ঘন্টটা একটু নিলো।দুগাল খেতেই বেশ ভালো লাগলো।একটু একটু করে কয়েকটা পদ খেয়ে যেই মাছের পদ ধরলো, ওমনি গা গুলিয়ে উঠলো তার।কোনো মতে দাঁতে দাঁত চেপে তা আটকালো।পাশে বসা বিথী তা লক্ষ্য করে কন্ঠ নিচু রেখে বললো—আপু,ঠিক আছেন আপনি?

তন্ময়ী মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়েও কেমন করে বিথীর দিকে তাকালো। ফের বললো—মাছ খেতে পারছিনা বিথী।এতোবড় মাছের পিছটা নিয়েই ঝুটা প্লেটে ফেলে দেওয়া কেমন দেখা যায়?এখন কি করবো?

বিথী মাছ খেতে তেমন পছন্দ করে-না।বিশেষ করে এই রুই কাতলা জাতীয় কাটামাছ।তবে তন্ময়ীর সিচুয়েশন বুঝে সে বললো–সমস্যা নেই,আমাকে দিন।

‘এটা এঁটো হয়ে গেছে বিথী।কিভাবে তোমাকে দেই?

‘কালও তো আপনার প্লেট থেকে মৌনতা আর আমাকে খাইয়ে দিলেন।তখন ঝুটা খেতে পারলে এখন কেনো খেতে পারবোনা।দ্বিতীয়ত আমি তো দেখলাম আপনি সেভাবে হাতই লাগাননি।

তন্ময়ী কৃতজ্ঞতাপূর্ন চোখে বিথীর দিকে তাকলো।ফের মাছের পিছটা তার প্লেটে চুপিসারে উঠিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো।–থ্যাঙ্কিউ বিথী।

বিনিময়ে মিষ্টি হাসলো বিথী।তবে মাছ উঠিয়ে দিয়েও রক্ষা হলোনা তন্ময়ীর।তার প্লেট খালি দেখে ঝুমুর একপিচ ইলিশ মাছ তুলে দিলেন।না চাইতেও বাধ্য হয়ে যেই মুখে তুললো,ওমনি পেটের ভিতর নাড়িভুড়ি সব উল্টে আসার জোগাড় হলো।আর বসে থাকতে পারলোনা তন্ময়ী।ড্রয়িংরুমে নিভানরা বসে আছে দেখে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে শিংয়ে চলে গেলো সে।ফের হড়হড় করে বমি করে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে ঝুমুর দৌড় দিলেন।কৌড়িও চলে গেলো।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সবাই।আবিদা জাহান বললেন–তোমরা বসো। খেয়ে নাও।বউমা গেছে,নাতবৌমা গেছে সামলে নেবে।

আবিদা জাহান আগেও খেয়াল করেছেন,সবাইকে কিছু খেতে দিলেই মেয়েটা খাচ্ছেনা।কেমন খাবার থেকে দুরে দুরে থাকছে।মাছমাংসের গন্ধ যেনো সইতে পারছে-না। তখন বিশেষ গুরুত্ব দেননি,মনে করেছিলেন মেয়েটা হয়তো কাঁচা মাছ-মাংসের গন্ধ সহ্য করতে পারে-না।কাটাপোছাটা হয়তো অভ্যাস নেই।কিন্তু এখনতো মনে হচ্ছে,ব্যাপারটা আলাদা।উনার অভিজ্ঞ নজর বলছে ভিন্ন কথা।তবে সেরকম কোনো আভাসও তো শুনলেন না।এসব বিষয় তো চেপে থাকেনা।থাকার কথা নয়ও।

‘এখন ঠিক লাগছে?

মেয়েটার চোখমুখে মাথায় ঘনোঘনো পানি ঝাপটা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ঝুমুর।তন্ময়ী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি সূচক উত্তর দিলো। -হ্যা ঠিক লাগছে।

যা খেয়েছিলো মোটামুটি সব বের হয়ে গেছে,স্বস্তি তো লাগারই কথা।ঝুমুর ফের জিজ্ঞেস করলেন—খাবার অসুবিধা লেগেছে তোমার কাছে?

‘কি বলেন আন্টি।খাবার খুবই সুস্বাদু এবং ভালো হয়েছে।অসুবিধাটা আমার বাড়ি থেকেই লাগছিল।যার জন্য খেতে ভালো লাগছিলো না।মাছমাংস দেখলে অসহ্য অসহ্য লাগ…

কথাটা শেষ করতে গিয়েই নিজের মনেও কেমন একটা দ্বিধা তৈরী হলো।হঠাৎ করে বিগত দুদিন থেকে কেমন কেমন যেনো লাগছে তার।অস্থির অস্থির অনুভব হচ্ছে ।উফফ!কিযে হচ্ছে, কে জানে! নিজের ভিতরটা অস্থির অস্থির লাগছে তাতে অন্যকেও অস্থির করে তুলছে।এই অনুশোচনায় চুপ হয়ে গেলো। কথা শেষ না করে দমে গেলো সে।বলতেও কেমন সংকোচ হলো।

‘সেটা তুমি আমাকে বলবেনা,তবে আমি তোমার জন্য মাছমাংস বাদে আলাদা কিছুর ব্যবস্থা করতাম।

‘আলাদা আর কি ব্যবস্থা করবেন।আমারতো এমনিতেই কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছেনা।

তন্ময়ীর এবারের কন্ঠ মিনমিনে।ঝুমুর কিছু একটা আন্দাজ করলেন।তবে খোলাখুলি বিষয়টা জিজ্ঞেস করতে পারলেননা।সদ্য মেয়েটার সাথে পরিচয়।সে নিজ থেকে না বললে তার ব্যাক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা একদম উচিত নয়।কৌড়ি এতোসময় চুপচাপ দাড়িয়ে দুজনের কথপোকথন শুনছিলো।তন্ময়ীর দূর্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে কেমন মায়া হলো তার।এমনিতেই মায়াবী একটা সুন্দর মুখ।একটু ক্লান্ত,দূর্বলতার ছাপ পড়লেই মুখটা যেনো আরও মায়ময় হয়ে উঠে।তন্ময়ীর হাতটা চেপে ধরে বললো–আপনি গিয়ে রুমে রেস্ট নিন আপু।এরকম শরীর খারাপ নিয়ে আপনার আসা উচিত হয়নি। চলুন।

তন্ময়ী কথা বাড়ালোনা।বাড়ি থেকে শরীর খারাপ লাগলেও এতোটা খারাপ অনুভব হয়নি।যতো সময় যাচ্ছে ততো যেনো শরীর খারাপটা ভিতর থেকে জেঁকে বসছে।তন্ময়ীর আর খাওয়া হলোনা।নিচের একটা রুমে তাকে রেস্ট নিতে রেখে আসলো ঝুমুর।ড্রয়িংরুমে বসে থাকায় ইভান সেটা লক্ষ্য করলো।

রুমটা পরিপাটি গুছানো।এসি নেই তবুও বেশ ঠান্ডা। তারমধ্যে বিরতিহীন মৃদু খটখট শব্দে বৈদ্যুতিক পাখাটা চলছে।চোখের উপর হাত রেখে তন্ময়ী চুপচাপ শুয়ে আছে।নিয়মিত ব্যবহারের চশমাটা পড়ে আছে,তার শয়নরত বালিশের পাশে।ইভান নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে বসলো তার পাশে।হঠাৎ মেয়েটা শরীর খারাপ হওয়ার কারণ কি?কালও বমি করেছে। তবে ফুডপয়েজেনিং বলে এড়িয়ে গিয়েছিলো।ইভানও তাই ভেবে আর কথা বাড়াইনি।তবে পেটে সমস্যা কি এখনো যায়নি?নাহলে হঠাৎ আবার বমি!

‘তনু।

কপাল থেকে হাত সরালো তন্ময়ী।সবসময় ইভানের চোখমুখে যে চঞ্চলতা আর দুষ্টিমীরা ঘুরেফিরে বেড়ায় তা এখন নেই,সেখানে চিন্তারা রেখাবেষ্টিত।

‘শরীর বেশি খারাপ?ডাক্তারের কাছ যাবে?শরীর বেশি খারাপ লাগলেতো ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে,আমিও না।এখনই যাবে?

চঞ্চলতা, ভারী দুষ্টমী একপাশে ফেলে দায়িত্ববান হাসবেন্ডের মতো চিন্তা ভাবনা, কথা।অদ্ভুত এক চরিত্র ছেলেটার।ছেলেটার বাহিরের অতিরিক্ত চঞ্চলতা আর অহেতুক দুষ্টমী কেউ পছন্দ না করলেও,তার ভিতরটা কেউ একবার বুঝতে পারলে অবশ্যই ইভানের প্রতি যেকেউ আকার্ষিত হবে।তাকে স্নেহ করবে ভালোবাসবে, তারপ্রতি টান তৈরী হবে।তন্ময়ী হাসলো।ইভানের এসব আচারণের কারণেই হয়তো খুব তাড়াতাড়ি পিছে ফেলে আসা খারাপ সময়টা ভুলতে পেরেছে তন্ময়ী।ভুলতে পেরেছে ছেলেটার করা অন্যায় কর্মকান্ডটাও।ছেলেটা এই চঞ্চল তো, পরিস্থিতি বদলে এই দায়িত্ববান।ভাবনা ছেড়ে কেমন দূর্বল গলায় আবদার জানালো তন্ময়ী।

‘ইভান শোবে আমার পাশে,আমি একটু তোমার কাছে ঘুমাই।

তন্ময়ী জুড়ছে এমন আবদার!ইভান যেনো বিস্মিত হলো।কপালে ভাজ ফেলে স্থির চোখে কিছুসময় তন্ময়ীকে দেখে ধপাৎ করে তার পাশে শুয়ে পড়লো।আজ তন্ময়ীকে কাছে টানা লাগলোনা।নিজেই ইভানের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে চোখ বুঁজে নিলো।তার মনেহচ্ছে কোথাও একটা গড়মিল হচ্ছে।আর গড়মিলটা মনেহয় একটু একটু করে পরিস্কার হচ্ছে তারকাছে।তাই যদি সত্যি হয়,তবে তা কিকরে জানাবে সে ইভানকে!বিষয়টাও বা ইভান কিকরে নেবে?

‘মুলত কি কারণে শরীর খারাপ লাগছে তোমার?বলবে আমাকে?সত্যিই কি ফুডপয়েজিনিং হয়েছে নাকি অন্যকিছু?

‘আমার কথা বলতে ভালো লাগছেনা ইভান।গলা ব্যথা করছে প্রচুর।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।চুপচাপ থাকো।

তন্ময়ীর চুলের ভাঁজে আঙুল চালিয়ে নড়াচড়া করতে থাকলো ইভান।মেয়েটা যেনো আরাম পেলো।খুব ধীরেধীরে তার দূর্বল নিঃশ্বাস ছাড়া আর কোনো শব্দ পাওয়া গেলোনা।নড়াচড়া তো একদম নয়।

বিকালের দিকে তন্ময়ীর শরীর আবারও চনমনে হয়ে উঠলো।তন্ময়ীকে সুস্থ দেখে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো নক্ষত্রবাড়ী রিসোর্টে যাবে।মুলত নিতু ইতুই অফরটা করেছে।সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েদলেরা ঘুরতে যাওয়ার জন্য লাফিয়ে উঠলো। এবাড়ি থেকে পনেরো বিশ মিনিটের রাস্তা। গাড়িতে গেলে এতোসময়ও লাগবে-না।আবিদা জাহান আর আশহার সাহেব মেয়েদের সিদ্ধান্তে আশকারা দিতেই সবাই তৎপর হলো রেডি হতে।নিজের রুমে রেডি হচ্ছে কৌড়ি।আবারও শাড়ী পরতে হয়েছে তাকে।গরমে একটুও পুনরায় গায়ে শাড়ী জড়াতে ইচ্ছে করছিলোনা তবুও বাধ্য হয়ে জড়াতে হলো।কেননা এবাড়িতে আসার সময় এক্সট্রা পোশাক আনিনি। তাই ঘুরতে যাওয়ার জন্য পুনরায় শাড়ী অঙ্গে জড়াতে হলো তাকে।শাড়ী ছাড়া উপায় নেই।কি সুন্দর নিতুর একটা ড্রেস পরে আরামে ঘুরছিলো সে!আরাম শেষ!

কালকে যে শাড়ীটা পরে এবাড়িতে এসেছিলো,সেটাই পরলো কৌড়ি।চুলটা খোঁপা করে,মুখে হালকা প্রসাধনীর প্রলেপ লাগালো।এর বেশি সাজ সে কখনো সাজেনা,দুই একসময় অতিরিক্ত ঠোঁটে লিপস্টিকটা লাগানো ছাড়া।মেয়েদের না-কি চোখে কাজল পরলে দারুন মায়াবী দেখায়।চোখের সৌন্দর্যতা বৃদ্ধি পায়।চেহারার লাবন্য বাড়ে?অথচ কাজলটাও লাগানো হয়না কখনো কৌড়ির।এসব ভাবতে ভাবতে হিজাবটা গুছিয়ে মাথায় জড়ালো সে।মাথায় পিনআপ করে কাঁধে পিনআপ করতে গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি।ভাবনায় বিভোর অন্যমনস্ক কৌড়ির হিজাব শাড়ী ব্লাউজ ভেদ করে সুচালো পিন গিয়ে ফুটলো নরম কাঁধে।মূহুর্তেই মৃদু আওয়াজ তুলে”আহ”শব্দটা মুখ থেকে বেরিয়ে এলো।জ্বালাময় ব্যথা পেলেও পুনরায় ঠোঁট চেপে ব্যথা নিবারণ করে নেওয়ার চেষ্টা করলো।ততক্ষণে রুমের উপস্থিত ব্যক্তিটি চলে এলো তারকাছে।আয়নায় কৌড়ির বন্ধ চোখমুখ দেখেই সহসা শুধালো।

‘কি হয়েছে?

প্রশ্ন শুধালেও নিভান চুপচাপ নেই।এতোসময় তার লক্ষ্য ছিলো কৌড়িকে ঘিরে।বিধায় কি হয়েছে সেটুকুও লক্ষ্য করেছে সে।প্রথমে কৌড়ির হাত থেকে পিনটা নিয়ে কপালে ভাজ ফেলিয়ে লক্ষ্য করে দেখেই তীর্যক বাক্য ছুড়লো।

‘এটার মধ্যে আর সুচের মধ্যে পার্থক্য কোথায়!আর এই তুমি সমস্ত গায়ে মাথায় বিঁধাচ্ছো?

কথা শেষ করার আগেই কৌড়ি মাথায় যে দুটো পিনআপ করেছিল সে দুটোও খুলে নিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।কৌড়ি ব্যথা ভুলে তাজ্জব চোখে হা হয়ে তা দেখলো।ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে আলপিনের যে কৌটাটা ছিলো।তড়িৎ সেটা নিয়েও ফেলে দিলো নিভান।কৌড়ি বিস্ময় যেনো বাড়লো।মানুষটা পাগল হলো নাকি?

‘ওসব আলতু ফালতু জিনিস যেনো গায়েমাথায় বিঁধতে না দেখি!

মুখে কথা চললেও হাত চললো তার কৌড়ির হিজাবে।হিজাবটা এমনিতেই মাথা থেকে সরে গলায় ঝুলছিলো। সেটা গলা থেকে সরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো নিভান।কৌড়ির গায়ের ব্লাউজটার গলা বেশ ছোটো।বললে চলে ব্লাউজটা গলার সাথে মিশে আছে।সামনের গলাটা একটু বড় হলেও পিছনের গলাটা কাঁধের সাথে মিশে আছে।ব্লাউজটা খোলাফেলার হুকগুলোও কোনো কারনে পিছনে।হাঁফ ছাড়লো নিভান।নাহলে এই ভরা বিকালবেলা বিবাহিত বউয়ের সাথে একটা কেলেঙ্কারির হয়ে যেত।কৌড়ির দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল না দিয়ে টপাটপ ব্লাউজের তিনটি হুক খুলে ফেললো সে।বিস্ময়, ধ্যান কাটলো যেনো কৌড়ির।সাথে খোলা কাঁধের কাছে পুরুষালী হাতের রুক্ষ স্পর্শ পেয়ে সর্বাঙ্গ যেনো খিঁচে এলো তার।রন্ধ্রে রন্ধ্রে চঞ্চল হলো কিছুু এলোমেলো অনুভূতি।সেই অনুভূতির শিহরনে দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।তবে মানুষটার থেকে সরে আসতে যেনো বিবেকে বাঁধা দিলো।ততক্ষণে কৌড়ির ব্লাউজের কভার সরিয়ে ফর্সা মসৃণ কাঁধটা উম্মুক্ত করে ফেলেছে নিভান।ইনারের ফিতাটায় হাত দিতেই কৌড়ি হাত চেপে ধরলো।শব্দগুলো গলায় জড়িয়ে গেলো।কি বলবে সে?নিষেধও তো করা উচিত নয়।হক আছে মানুষটার!তবে?

কৌড়ির হাতটা সরিয়ে দিয়ে নিজের বুকে রাখলো নিভান।কিছুটা গম্ভীর গলায় আদেশের স্বরে বললো–হাত যেনো এখান থেকে না নড়ে।

আদেশ মোতাবেক কৌড়ি হাত সরালো না। তবে নিভান যখন পুনরায় ইনারের ফিতাটায় হাত দিলো,চোখমুখ খিঁচে বুঁজে নিলো কৌড়ি।নিঃশ্বাস যেনো এবার তার আঁটকেই আসবে!কেনো বুঝছেনা মানুষটা।অস্পষ্টস্বরে নিভানকে সে ডেকেই বসলো।

‘নিভান প্লিজ।

ব্যাস কিছু মূহুর্তের জন্য হাত থমকে গেলো।তবে দূর্বল হলে চলবেনা!ভিতরটা সে পথরকঠিন রাখার চেষ্টা করছে।নাহলে এতোক্ষণে কতো উল্টো পাল্টা কিছু হয়ে যেতো!হাত সচল হলো নিভানের।খুব স্বাভাবিক গলায় বললো—বলো,শুনছি আমি।

মানুষটা কি তার ভিতরের দমবন্ধকর আর্তনাদের ব্যাপারটা তার শব্দচয়ন দ্বারা বুঝলো না?না-কি বুঝে- শুনেই এড়িয়ে গেলো?তা নাহলে এতো স্বাভাবিক উত্তর কিকরে দিতে পারে?নিভান শুনতে চাইলেও কৌড়ি আর বলতে পারলোনা কিছু।চেয়েও শব্দ গুছিয়ে আনতে পারলোনা,কিছু বলার জন্য।কারন ততক্ষণে তার শব্দ প্রয়োগ করা কন্ঠস্বরের দ্বার চাপিয়ে ইনারের ফিতাটা সরিয়ে ফেলেছে নিভান।এবং নিজ কর্মে ব্যস্ত সে।ফিতাটা সরাতেই উন্মুক্ত হলো পিন ফুটে যাওয়া জায়গাটা।মোটা একফোঁটা রক্ত এসে হাজির হলো যেন মূহুর্তেই জায়গাটার মুখে।পিনটা যে ভিতরে অনেকটা বিঁধে গিয়েছিলো,সেটা দুধে ফর্সা কাঁধে কালচে একটা লম্বা দাগের চিহ্নতে বেশ বোঝা যাচ্ছে।নিভান রক্তের ফোঁটাটা আঙুলের মাথায় মুছে নিলো।ফের সেখানে আলতো চাপে আরও একটু রক্ত বের করে দিতেই কৌড়ি যেনো এবার ছটফটিয়ে উঠলো।তবে ব্যথায় নাকি অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে? তা নিভান বুঝেও বুঝলো না।

কৌড়ির আঙুলগুলো আরও শক্ত স্পর্শে খামচে ধরলো নিভানের বুকের কাছের শার্টের অংশ।কৌড়ির স্পষ্ট টের পেলো তার নখের আঁচড়গুলো বসে যাচ্ছে মানুষটার বুকে।তার স্পর্শে হয়তো ব্যথাও পাচ্ছে মানুষটা! তবে সামনের মানুষটা নির্বিকার। যেনো কিছুই হচ্ছেনা।কৌড়ি এবার না পেরে বললো–ওটা সামন্য।ওটুকুতে কিচ্ছু হবেনা।প্লিজ ছেড়ে দিন।

প্লিজ ছেড়ে দিন’ নিজের মুখের বাক্যদ্বয় যেনো নিজেরই কানেই অদ্ভুত শোনালো।কেমন অহেতুক কঠিন,কিছুটা বাজে হয়তো।কৌড়ি যেনো নিজেই অবাক হয়ে গেলো নিজের আচরণে।স্পর্শতো বাজে নয়,তবে কেনো এমন শব্দ প্রয়োগ করলো।স্ত্রী ব্যথা পেলে অবশ্যই স্বামীর খেয়াল রাখার হক আছে।ব্যথাযুক্ত জায়গা দেখার,স্পর্শ করার হকও আছে।সেখানে মানুষটা সম্পর্কে সে জানা সত্ত্বেও এমন কেনো বিহেভ করলো!নিজের বলা বাক্যদ্বয় যদি নিজের কাছে এতো রুষ্ট লাগে তবে মানুষটার কেমন লেগেছে? কি ভাবছে মানুষটা?নিভানের হাত সরে যেতেই মূহুর্তেই চোখ খুলে ফেললো সে।নিভানের মুখোভঙ্গিমা বোঝার আগেই ঘর ছেড়ে বাহিরে চলে গেলো সে।আবার কৌড়িকে কিছু ভাবতে দেওয়ার আগেই তার সম্মুখে এসে হাজির হলো সে।হাতে অ্যান্টিসেপটিক্।খুব স্বাভাবিক তার মুখোভঙ্গিমা।তুলোর সাহায্যে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে নিয়ে,পিন বিঁধে যাওয়া জায়গাটায় চেপে চেপে কয়োকবার মুছিয়ে দিলো নিভান।না নড়াচড়া আর না একটা শব্দ ব্যবহার করলো কৌড়ি।কেমন মায়ামায়া চোখে পলকহীন নিভানকে দেখতে থাকলো সে।যে ব্যক্তি স্ত্রীর অসুস্থতার কথা ভেবে নিজের কামনা বাসনা নিয়ন্ত্রণে রাখে।সুযোগ পেয়েও নিজের অনুভূতিতে প্রলুব্ধ হয়না,সেই ব্যক্তির সাথে কি এমন রূঢ় আচারণ মানায়?মন বলছে নিজের অজান্তেই অহেতুক একটা ভুল করে ফেলেছে কৌড়ি।যা তার মোটেও করা উচিত হয়নি।নিভান দায়িত্ব এবং যত্নশীলতার সহিত অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে দিয়ে পুনরায় সযত্নে কৌড়ির ব্লাউজের হুকগুলো লাগিয়ে দিলো।কৌড়ির মনেহলো দু’হাতে মানুষটাকে আগলে নিতে।জাপ্টে ধরতে।তারপর নিজের অনুসূচনা ব্যাখা করে স্যরি বলতে। তা না হলে,তার কেনো জানি মনে হচ্ছে এই মানুষটা আর নিজ থেকে তাকে কাছে টানবে-না।ভালোবাসবে না।
কিন্তু নিজের ভিতরের চাওয়াটা ভিতরেই রয়ে গেলো।কেনো জানি তা প্রকাশ করতে পারলো না।নিভান সরে দাঁড়ালো। খুব সাবলীল গলায় বললো—তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে এসো।আমি নিচে যাচ্ছি।

কৌড়ি পিছু ডাকতে চেয়েও যেনো ডাকতে পারলো-না আর।গলা যেনো নিজের ভুলে রোধ হয়ে এলো।ঈষৎ কাঁপলোও।যারজন্য শব্দ বের হলো-না।শুধু স্থির চোখে নিভানের চলা যাওয়া দেখলো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে