ফুলকৌড়ি পর্ব-৫০+৫১

0
10

#ফুলকৌড়ি
(৫০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ওবাড়ি আর ঠিক দাদু-মা বলতে বুঝতে কৌড়ির একটু সময় লাগলো।তবে ততক্ষণাত সে প্রশ্ন করলো-না।নিজে থেকে বুঝতে চেষ্টা করলো,নিভানের কথার অর্থ।আর কাকেই বা দাদু-মা বলছে আর ওবাড়ি বলতে কোথায় যেতে চাইছে মনুষটা!তবে বুঝে উঠার আগেই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ।কৌড়িকে ছেড়ে দাঁড়ালো নিভান।ছাড়া পেতেই গায়ে মাথায় ওড়নাটা ঠিকঠাক করে জড়িয়ে নিলো সে।নিভান গিয়ে দরজা খুললো।ওপাশে মা-কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ভিতরে ভিতরে একটু অপ্রস্তুত হলো।তার রুমের দরজা কখনো আটকানো থাকে-না।দরজায় লাগানো ভারী পর্দাগুলো,দরজা আটকানোর কাজ সেরে দেয়।যদিও নক বিহীন রুমে কেউ ঢোকেনা।যার কারণে রাতে ছাড়া দরজা আটকানোর প্রয়োজনও পড়েনা। অথচ আজ আটকাতেই হলো।আর বিষয়টা তাকে একটু অস্বস্তি দিলো।যাতে ভিতরে ভিতরে একটু অপ্রস্তুতবোধও করলো।তবে নীহারিকা বেগম সেসবে বিশেষ ভ্রুক্ষেপ করলেন না।কেমন চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন–কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?কৌড়িকে নিয়ে যাবি নাকি ওবাড়িতে?

‘ভিতরে এসো মা।

দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো নিভান।নীহারিকা বেগম চিন্তিত মুখেই ঘরে ঢুকলেন।ফের বললেন–বয়স্ক মানুষটা অসুস্থ।ক’দিন বাঁচে কবে মরে তার ঠিক নেই।অসুস্থ মানুষটা যখন একবার আবদার করেছেন।কৌড়িকে নিয়ে তোকে কিন্তু একবার যাওয়া দরকার।বংশের বড় ছেলে তুই।বিয়ে করেছিস। তিনি আসতে পারলেন না।তাই বলে-কি নাতবউ দেখার ইচ্ছাপোষণ করবেন না!যা একবার ঘুরে আয়।তোর ছোটো চাচ্চু কতো করে বলে গেলেন কাল।সকাল হতে না হতেই আবারও ফোনকোলে ব্যস্ত করে তুলেছেন।যাচ্ছিস কি-না তোরা।রিসিপশন যখন হচ্ছে না,তখন আজই একবার যেতে তড়া দিচ্ছেন নাকি তোর দাদুমা।নাতবউকে দেখার জন্য নাকি অস্থির করে তুলছেন।

‘আমাকেও ফোন দিয়েছিলেন।কথা হয়েছে দাদুমার সঙ্গে।।দাদুমা উতলা হয়েছেন,আজ একবার কৌড়িকে ওবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।তাকে দেখার জন্য।চাচ্চুও বললেন,তিনি বেশ অসুস্থ।বারবার বলছেন নাকি দেরী হলে তিনি যদি আর কৌড়িকে না দেখতে পান।তাই চাচ্চু-ও বারবার রিকুয়েষ্ট করলেন,একবার যেতে।

‘কি করবি?যাবি?এখন নাকি বিকালে যেতে চাইছিস?কাল বিয়ে হলো, বাড়ি ভর্তি মেহমান।কৌড়ির ছোটোচাচাও তো আছেন। ভদ্রলোক সকাল সকাল চলে যাবার কথা বলছিলেন।বাড়িতে নাকি উনার স্ত্রীও অসুস্থ।বড় ছেলেটা তো কাল রাতেই ফিরে গিয়েছে হোস্টেলে।পরিক্ষা আছে নাকি তার।ছোটো ছেলেটা আর উনি আছেন।আছেন বলতে তোর বাবাই আটকে রেখেছেন।

‘কৌড়িকে তো রেডি হয়ে নিতে বললাম।এখনই যাবো ভাবছি।অফিসেও একটা কাজের ঝালেমা হয়েছে,যদিও না গেলেও চলতো।তবে বের হচ্ছি যখন সেটা মিটিয়ে তারপর ওকে নিয়ে ওখান থেকেই চলে যাবো ভাবছি।

‘আচ্ছা তাই কর।ওকে নিয়ে একেবার বের হ।

কথাটা বলেই তিনি কৌড়ির দিকে এগোলেন।কৌড়ি এতোসময়ে বুঝতে পারলো ওবাড়িতে আর দাদুমার কাছে বলতে কোথায় যেতে চাইছেন মানুষটা।কাল আলাপপরিচিতির সময়ে,ছোটো চাচাশ্বশুর বলে একজনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বড়মা।পরিচিত হয়ে কৌড়ি সালাম দিতেই ভদ্রলোক মিষ্টি হেসে সালামের উত্তর দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে তো দোয়াও করে দিয়েছিলেন।তারপর একটা নামীদামী গিফ্টবক্সও তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।তাতে কি ছিলো তা কৌড়ির এখনো দেখা হয়নি।ওরকম অনেক গিফ্টবক্স উপহারসরূপ পেয়েছে সে।যা এখনো খুলে দেখা হয়নি।বিয়ের এতো তালঝামেলায় ভদ্রলোকের কথাতো কৌড়ির মাথা থেকে বেরই হয়ে গিয়েছে।তবে সেখানেই যাওয়ার কথা বলছে।আপন শ্বশুরালয়!মাথায় হাত পড়তেই ভাবনা কাটলো তার।

‘যা ঘুরে আয়।বৃদ্ধা মানুষটা দেখতে চাইছেন।আর ওটাও তো তোর আরেকটা শ্বশুরবাড়ী,হক আছে তোর যাওয়ার।দেখে আয় আপন শ্বশুরালয়।ঘুরে আয়,ভালো লাগবে।

কৌড়ি মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ালো।নীহারিকা বেগম আর কথা না বাড়িয়ে ওদেরকে রেডি হয়ে নিতে বলে চলে গেলেন।মা চলে যেতেই নিভান কৌড়ি দিকে এগোলো।বললো–যাও।রেডি হয়ে নাও

কৌড়ি আশেপাশে একবার তাকালো।এরুমের কোথায় কি, কিচ্ছু তার জানা নেই।তবুও সমস্যা নেই।নিজের বলতে ড্রেস,শাড়ী গহনাপত্র সবকিছু দুটো ট্রলিতে ভর্তি গোছানো আছে তার।ট্রলি দুটো এঘরেই আছে।তবে জিনিসগুলো এখনো গুছিয়ে কবিনেটে তোলা হয়নি। এখন কথা হলো,কোন পোশাকে সে রেডি হবে!নতুন অপরিচিত জায়গায় কোন পোশাকে গেলেই বা তাকে মানাবে?হুট করে বুঝে উঠলো-না।হঠাৎ বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলো সে।

‘শ্বশুরবাড়িতে কিভাবে যেতে হয়?

বউয়ের বোকা প্রশ্ন বুঝতে সময় লাগলো নিভানের।কৌড়ির চিন্তিত চোখমুখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে সে-ও বোকাবোকা উত্তর দিলো— সেজেগুজে যেতে হয়।

তড়িৎ কৌড়ি সংশোধনী গলায় বললো–‘আমি তা বলিনি।মূলত কি পরে রেডি হবো আমি সেটাই বলছি।

হাসলো নিভান।তবে কৌড়ির চিন্তিত মুখ দেখে তাকে আর জটিলতায় ফেলতে চাইলো-না।যদিও মন চাইছিল একটু দুষ্টিমী করতে!তবে করলোনা।শুধু আরও একটু কাছে গিয়ে, কৌড়ির গালে নরম স্পর্শে হাত রেখে বললো –যেটাতে তুমি কমফোর্টেবল ফিল করো,সেটাই পরো।সেটা শাড়ী হোক বা ড্রেস।হুমম?

কৌড়ি মাথা নাড়ালো।নিভান ফের বললো –এরুমের প্রত্যেকটা জিনিসে তোমার হক।ওবাড়ি থেকে এসে যেখানে যে জায়গাটা প্রয়োজন হয়,নিজের মতো করে তোমার সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে।কোনোকিছু ছুতে বা কোথাও কিছু রাখতে কোনোরূপ দ্বিধা করবে-না।কেমন?

কৌড়ি ফের উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে মুখে মৃদুস্বরে বললো —হুমম।

নিভান ফের নরম স্বরে শুধালো–‘দ্বিতীয়বার আমাকে আর বলতে হবে না-তো?

কৌড়ি এবার মাথা এদিকওদিক নাড়িয়ে না সম্মতি জানিয়ে ফের আগের ন্যায় মৃদুস্বরে বললো–না।

নিভান সহসা কৌড়ির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো–এই তো লক্ষ্মীসোনা বউ আমার।

আচমকা গালে হাত রাখা,কপালে ঠোঁট ছোঁয়া কৌড়ির ভিতরটায় কেমন ঝড় বয়ে চললো। অথচ বাহিরে সে সাবলীল দাঁড়িয়ে। নিভান সরে দাঁড়ালো। ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো।–কেবিনেট খোলো।দেখো, ওখানে তোমার সবকিছু রাখা আছে।তোমার ভালোমন্দ যেটা ইচ্ছে হয় পরো।

নিভান ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দিতেই কৌড়ি জোরেশোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।সময় নিয়ে কেবিনেটের দিকে এগোলো।বিশাল বড় তিনপাল্লার ওয়াল কেবিনেটায় হাত রাখতেই সমস্ত শরীরটা কেমন শিরশির করে উঠলো।কেমন যেনো নতুন নতুন অজানা অচেনা অনুভূতি।কেবিনেট খুলতেই চোখ বড়বড় হয়ে গেলো কৌড়ির।পুরো শাড়ীর বাজারটা মনেহয় এখানে তুলে এনে রেখেছে।বিভিন্ন ডিজাইনের ভিন্ন ভিন্ন নামকরা শাাড়ী।আশ্চর্য!শাড়িগুলো আবার নিজের মতো করে থরেথরে গুছিয়েও রেখেছে।তবে কৌড়ি ড্রেস খুঁজলো।আজ কয়েকদিন শাড়ী পরে বুঝেছে শাড়ী সামলানোর ঝামেলা আর জ্বালা।তবে ড্রেস কৈ?ড্রেস-তো নেই।কৌড়ি কৌতুহলবশত কেবিনের আরেকটা দ্বার খুলতেই,সেখানে দেখা গেলো ড্রেসের সমাহার।এ-কি অবস্থা!হঠাৎ একটা জিনিস কৌড়ির নজরে পড়লো।কেবিনেটের পাশাপাশি তাঁ’কে একটা পরিচিতি ড্রেস ভাজকরা,তারসাথে ছেলেদের একটা কালো ফর্মাল প্যান্ট আর একটা সাদা শার্ট।একই সাথে রাখা।কৌড়ি ছুলো জিনিসগুলো।ফের পরপর একের পর একটা ভাজ করে রাখা সবগুলো কাপড় একসাথে হাতে নিলো।ভাজকৃত কাপড়ের প্রথমে সাদা শার্টটা রাখা।সেটা সরিয়ে ফেলতেই বিস্ময়ে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো কৌড়ির।নেভিব্লুর সাথে সাদা মিশ্রনের ফ্রকজাতীয়
সেই ড্রেসটা।সাথে ওড়না চুড়িদারসহ।যেটা পরা অবস্থায় সেদিন অফিসে বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছিলো সে।পরিবর্তন করার পরে ড্রেসটার কথাতো আর মাথাই ছিলো-না কৌড়ির। খেয়ালই হয়নি।সেটা এখানে?কিকরে?হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ তড়িৎ পিছে মুড়লো সে।গোসল সেরে খালি গায়ে মাথা মুছতে মুছতে নিভান বেরিয়েছে।সেদিকে বিশেষ খেয়ালি হলোনা কৌড়ি।তবে সহসা বিস্ময়কর গলায় প্রশ্ন ছুড়লো।

‘এগুলো এখানে কি করে?

আকস্মিক প্রশ্নে মুখ তুললো নিভান।কৌড়ির হাতের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হেসে স্বাভাবিক গলায় বললো–ওগুলো যেখানে পেয়েছো,সেখানেই তো থাকার কথা।নয় কি?আমার বউয়ের জিনিস আমার কাছে গচ্ছিত থাকবে না তো কোথায় থাকবে! কার কাছে থাকবে!

ভিতরে ভিতরে অনুভূতির ভরা জোয়ার বয়ে চলেছে।তবুও সহসা ফের প্রশ্ন কৌড়ির।–‘আপনার কাছে এলো কি করে?

শান্তশিষ্ট মেয়েটার প্রশ্নবানে নিভানের হাসি চওড়া হলো।মাথা মুছতেমুছতে মুখে হাসি রেখেই উত্তর দিলো-
লন্ড্রিতে দেওয়ার পর পার্সেল করে ওগুলো আমার কাছে পাঠানো হয়েছিলো।

‘আপনি পাঠাতে বলেছিলেন?

নিভান এবার মাথা মোছা বাদ দিয়ে কৌড়ির দিকে এগোলো।ততক্ষণাত কৌড়ির খেয়াল হলো,সামনের মানুষটার ট্রাউজার পরা উন্মুক্ত প্রশস্ত পেটানো বুক, পিঠ।বর্ষায় ডোবা কাশফুলের ন্যায় বুকের আস্তরনে নুইয়ে আছে ঘনো লোশমগুলো।যা আগে কখনো দেখা হয়নি কৌড়ির।লজ্জায় ঝিমঝিমেয়ে উঠলো ভিতরটা।উষ্ণ অনুভূতিতে হাসফাস করে উঠলো মন।সেই লজ্জা, হাসফাস দ্বিগুণ করে দিয়ে নিভান এসে দাঁড়ালো তার সন্নিকটে।তার বলিষ্ঠ বুকটা এসে থেমে গেলো কৌড়ির চোখ বরাবর। মূহুর্তেই চোখমুখ শক্ত করে নিয়ে নজর নিম্নমুখী করে ফেললো কৌড়ি।তা দেখে ঠোঁটের দুষ্ট হাসিটা আরও বিস্তৃত হলো। মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে কেমন ধীমেধীমে বললো।

‘হুমম।আমি বলেছিলাম ড্রেসটা লন্ড্রি করে আমার কাছে পার্সেল করতে।তোমার প্রতি হয়তো তখনো সেভাবে গাঢ়করে কোনো অনুভূতি জন্মাইনি আমার,তবুও মনমস্তাত্ত্বিকের দোলাচলে কোথাও যেনো তোমাকে আমার আমার অনুভব হতে থাকলো।সেই আমার আমার অনুভব থেকেে তোমার পরিধিয় জিনিসগুলো সেদিন আমি নষ্ট বা ফেলে দিতে বলতে পারিনি।কেনো পারিনি!সেটাতো একটু একটু করে পরে অনুভব করলাম।তবে জানো,একটা সময় এই জিনিসগুলো আমাকে ভরসা দিয়েছে বিশ্বাস জুগিয়েছে।সবচেয়ে কঠিন আশ্বাস জুগিয়েছে যে, এই জিনিসগুলো আমার কাছে মানে ওর মালিকও আমার হয়ে আমার কাছে ঠিকই আসবে একদিন।

কৌড়ি মুখ তুলে চাইলো।ঘনপল্লবি আঁখিদুটো মেলে কেমন অদ্ভুত চোখে দেখতে থাকলো তারদিকে ঝুঁকে থাকা মানুষটাকে।যার গা থেকে ভেসে আসছে সদ্য স্নানকরা বডিওয়াশের তীব্র সুবাস এবং কড়া শ্যাম্পুর সুগন্ধ।মোহিত হলো কৌড়ি।ডগর ডগর হরিনী চোখে কেমন অবাক করা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েই রইলো।পাগল নাকি মানুষটা!ফের মন গেয়ে উঠলো,কারজন্য পাগল?শুধু তোরজন্য!কৌড়ি মোহনীয়তা আরও প্রগাঢ়ত্ব রূপ নিলো।ঘনপল্লব ফেললো-না।ফ্রেশ ভেজা স্নিগ্ধ একটা শ্যামারঙা মোহনীয় মুখাবয়ব।ভেজা চুল।সেই ভেজা চুল থেকে ভেসে আসছে কড়া সুগন্ধ।কেমন শান্তনদীর মতো নিটোল চোখে চেয়ে আছে মানুষটা।সেভাবেই চেয়ে থেকে মিষ্টি হাসলো নিভান।হাতের তোয়ালেটা কৌড়ির কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে,তার হাত থেকে ভাজকৃত কাপড়গুলো নিতে নিতে বললো।

‘দেরী হয়ে যাচ্ছে।যাও রেডি হয়ে নাও।পারলে গোসল সেরে রেডি হয়ে নিও।ফিরতে দেরী হবে তো,এজন্য বলছি।

কৌড়ির সম্বিৎ ফিরলো।তড়িৎ মুখ নিচু করে নিলো।সহসা সরে দাঁড়ালো সে।তারমধ্য আবারও দরজায় নক পড়তেই,নিভান হাতের কাপড়গুলো কেবিনেটে রাখতে উদ্যোক্ত হলো।তন্মধ্যে ওপাশ থেকে মান্যতা
বললো–কৌড়ির জন্য আম্মু শাড়ী পাঠিয়েছেন।আসব?

‘এসো।

মান্যতা সহসা ভিতরে ঢুকলো।হাতে তার কালো একটা স্লিক বেনারসি শাড়ী।সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ পেটিকোট।
কৌড়ির সামনে সেটা ধরে বললো–ওবাড়িতে যাচ্ছিস বলে আম্মু পাঠালেন।বললেন,নতুন বউ যাচ্ছিস।শাড়ী পরে গেলে ভালো দেখাবে।আর এগুলো আম্মু স্পেশালি তোরজন্য কিনেছিলেন।দেওয়া হয়নি।আম্মু নিচে ব্যস্ত, তাই আমাকে দিয়ে পাঠালেন।

নিভান ননদ ভাবীর কথা ঢুকলো-না।নিজের কাজে মনোযোগী হলো সে।কৌড়ি শাড়ীটা হাতে নিলো।শাড়ী পরার ইচ্ছে ছিলোনা।সেই শাড়ী পড়তেই হবে!তবে শাশুড়ীর মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে মান্যতার হাত থেকে শাড়ীটা নিলো।মান্যতাও আর দেরী করলো না।নিভানের অগোচরে কৌড়ির ডানগালটা আলতো করে টেনে দিয়ে তড়িৎ চলে গেলো সে।

‘শাড়ী পরতে অসুবিধা হলে,ড্রেস নাও।মা’কে বললে মা অবশ্যই বুঝবেন।

আয়নার সামনে দাড়িয়ে শার্টের বাটুন লাগাতে লাগাতে কথাটা বললো নিভান।সেদিকে একপলক তাকাতেই মূহুর্তেই সম্মোহনী হয়ে পড়লো নজর।তবে তড়িৎ নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিলো সে–সমস্যা নেই।ড্রেসের থেকে শাড়ী পরাটা উচিত হবে।

দাড়ালো না কৌড়ি।ওয়াশরুমে চলে গেলো।রঙে শ্যামবর্ণ হলে কি হবে,উচু লম্বা মানুষটা সবদিক থেকে আকর্ষনীয়।নজর তার দিকে গেলে,কেমন অদৃশ্য ফেভিকলের আঠার মতো আঁটকে থাকতে চায়।যা নির্লজ্জতা।নজরের বেহায়াপনা।আপতত এই বেহায়াপনা করতে গিয়ে লজ্জায় পড়তে চায়না কৌড়ি।
তাই সহসা পা বাড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো সে।
বিশালকার ওয়াশরুমটা পরিচ্ছন্ন পরিপাটি এবং আভিজাত্যের কোনো কমতি সেখানে নেই।কাপড় রাখার স্টিলের হোল্ডিংয়ে হাতের কাপড়গুলো রেখে দিয়ে,নিভানের কথামতো গোসলটা সেরে নিলো।সময় নিয়ে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করে,শরীর মোছার জন্য তোয়ালেটা মুখের কাছে নিতেই,আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে এলো।ভিজে শরীরেও কেমন উষ্ণ উষ্ণ অনুভূতি অনুভব হলো।প্রতিটা জিনিসে মানুষটার ছোয়া,তার নির্দিষ্ট সুগন্ধ।উফফ,উথাল-পাতাল করে দিচ্ছে কৌড়িকে!হাসলো কৌড়ি।যে মানুষটা তাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে,তার সুগন্ধে-তো ডুবতেই হবে তাকে।ডুবতে বাধ্য কৌড়ি।বাধ্য নয় কি?অবশ্যই বাধ্য!

শাড়ীটা ভিজে যাওয়ার ভয় থাকলেও ওয়াশেরুমেই শাড়ীটা পরে নিলো কৌড়ি।কেননা রুমে গিয়ে ওই মানুষটার সম্মুখে শাড়ী পরা কখনো হয়ে উঠবে-না।বিষয়টা তার জন্য মোটেই সহজ এবং স্বাভাবিকও নয়।যাই হোক,বেনারসি হলেও শাড়ীটা খুব ভারী নয়।মোটামুটি।সাথে বেনারসি স্লিক হওয়াশ দারুন সফট।সহজেই পরে নিতে পারলো কৌড়ি।তবে গুছিয়ে নয়।তবুও চলার মতো।নিজের জামাকাপড়ের সাথে অন্য আরেকজনেরটাও ধুয়ে নিয়ে বের হলো ওয়াশরুম থেকে।সবকিছুতে কেমন নতুন নতুন অন্যরকম ভালা লাগা আবার কিছুটা নাজুক লজ্জা অনুভূতি।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো নিভান রুমে নেই।স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে,রুমের লাগোয়া বেলকনিতে চলে গেলো সে।সেখানে লম্বা করে স্টিলের স্ট্যান্ড টানানো।জামাকাপড়গুলো সেখানে শুকাতে দিয়ে রুমে এসে তাড়াতাড়ি শাড়ীটা ভালোভাবে পরে নিলো।ভেজাচুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই,আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের পিছনে নজর থমকে গেলো তার।মানুষটা দরজায় এসে কখন দাড়িয়েছে!হৃদস্পন্দন দ্রুত হলো।সহসা মনে প্রশ্ন জাগলাে, তাকে কি শাড়ী ঠিকঠাক করে দেখে নিয়েছে মানুষটা?প্রশ্ন যেনো সেখানেই থেমে গেলো তার,পিছনের মানুষটাকে তারদিকে এগোতে দেখে।শীতের সকাল সকাল গোসল।সেই ঠান্ডা হাত পায়ে যেনো আরও শীতলতা ছড়িয়ে কম্পন বইলো।দুরুদুরু মনটার উষ্ণ উষ্ণ অনুভূতি যেনো রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।আর সকল অনুভূতির পারদ ছাড়িয়ে পড়লো,যখন পিছনের মানুষটা কেমন অদ্ভুত সম্মোহনী চাহুনী নিয়ে তার পিঠ ঘেঁষে পিছনে এসে দাড়ালো।কিছু সময় অপলক আয়নায় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে ঘনো গলায় বললো।

‘লুক অ্যাট দ্যা মিরোর!

গলার ঘনো স্বরটায়, মূহুর্তেই পাথরের মূর্তি বনে যাওয়া মেয়েটা কেমন মোহাবিষ্ট হলো।সত্যি সত্যিই নজর তুলে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো।ফর্সা দুধে সাদা শরীরে কালো শাড়ীটা, তপ্ত মধ্যদুপুরের সূর্যের কিরণের ন্যায় দ্যুতি ছড়াচ্ছে।নিজেও কেমন নিজের রূপে ক্ষনিকের জন্য বিমোহিত হয়ে পড়ল কৌড়ি।অথচ শক্ত দুটো হাত সেই কখন তার কোমর পেচিয়ে নিয়ে ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে খেয়াল নেই তার।হাতের বাঁধন শক্ত হতেই হুঁশ ফিরলো তার।তড়িৎ নিজেকে ভুলে আয়নায়,নিজের পিছনে দাড়ানো সুদীর্ঘ লম্বা চওড়া মানুষটার দিকে ফিরলো সে।অথচ সেই মানুষটা কি আর কৌড়ির তাকানোর অপেক্ষা আছে?সে তার নিজের কাজে ব্যস্ত।পুরুষালী শক্ত নাকটা,ফর্সা নিটোল গলার বাঁকে বিঁধতেই চোখ মুদে এলো কৌড়ির।সেকেন্ডে চঞ্চল হয়ে উঠলো ভিতরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভূতিগুলো।তা টের পেয়েও নিভান কেমন জড়ানো গলায় বলে গেলো।

‘দেখেছো নিজেকে?কোনো সাধুপুরুষও কি পারবে,এই আকর্ষণীয়তা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে!তাও আবার নিজের একান্ত নারীটা থেকে!উফফ!আমি যতোই নিজেকে ধরেবেধে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি,তুমিই ততোই চম্বুকের ন্যায় টেনে যাচ্ছো আমাকে।টুটাচ্ছো আমার অহামিকা, আমার নিজস্বতা।এইযে কালো শাড়ীটা পরেছো,নজর কাটার বদলে নজর-তো আরও ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আকর্ষিত হচ্ছে।আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখে নিয়েছো নিশ্চয়!কিভাবে রাখবো তোমার থেকে নিজেকে দূরে!তোমাকে না ছুঁয়ে!টেল মি কৌড়ি?উফফ,এতো আকর্ষনীয় কেনো তুমি।এতো টানছো কেনো আমাকে?তুমি অসুস্থ!এটা কি করে মাথায় রাখবো…

‘প্লিজ।

কথা থেমে যাওয়ার আকুতি নাকি নিজেকে ছাড়া পাওয়ার আকুলতায় শব্দটা মুখ ফুটে বের করল কৌড়ি, সে নিজেও জানেনা।মেয়েলি মায়বাী শরীরের মিষ্টি সুগন্ধে মাতোয়ারা মানুষটা শুনলো কি শুনলোনা,কৌড়িকে আরও শক্তবাধনে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো।পুরুষালী হাতের শক্ত বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা কৌড়ির মনেহলো,সে লোহার খাঁচায় বন্দিনী।আর সেই লোহার বেড়ি তাঁর নরম শরীটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে রেখেছে নিজের বাঁধনে।তবে সেই স্পর্শে অস্বস্তি নেই,দ্বিধা নেই,ব্যথা নেই।আছে কিছু দমবন্ধকর অনুভুতি।কৌড়ির শ্বাসটা যেনো সেই দমবন্ধকর অনুভূতিতে মাঝেমধ্যে নিঃসাড় হয়ে আসছে।কথা বলার পরিস্থিতিতে সে নেই,ঘনোঘনো শক্ত নাক আর পুরো ঠোঁটের বিচরণ চলছে তার গলার সর্বত্রজুড়ে।তবুও কোনরকম ছাড়াছাড়া জড়ানো গলায় বললো সে।

‘দেরী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু. …

হাতের বাঁধন যেনো আরও ঘনো আরও দৃঢ় হলো।সাথে গলার স্বর—তো?

এই সামন্য তো শব্দে কৌড়ি যেনো মূর্ছা যাওয়ার মতো নুইয়ে পড়লো।শক্ত হাতের বাধনের উপর নিজের কোমল হাতটা রাখলো।মূহুর্তেই শক্তহাতজোড়া আলগা হয়ে কোমল হাতজোড়া নিজের হাতের বাঁধনে নিয়ে,নিজের সাথে চেপে ধরার আগেই সুযোগ নিলো কৌড়ি। উল্টোমুখো হয়ে নিভানকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো।মুখে তার ঘনো নিঃশ্বাস।বিচক্ষণ সৈনিকের ন্যায়
যুদ্ধে জয়ী হওয়া স্ত্রীর সফলতায় হেসে ফেললো নিভান।
নরম পাতলা শরীরটা নিজের সাথে শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে বললো–দিস ইজ নট ফেয়ার!

কৌড়ি টুঁশব্দও মুখে উচ্চারণ করলো-না।উচ্চারণ করার পরিস্থিতিতে থাকলেই না মুখে কথা বের হবে!এতোসময়ের সুখ সুখ মরমর অনুভূতির রেশ সামলাতেই বিচলিত সে।যে মানুষটা তাকে বিচলিত করে তুললো আবার সেই মানুষটারই বলিষ্ঠ বুকে আশ্রিত হয়ে ঘনোঘনো নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় মগ্ন হলো।উফফ,কখনো কি ভেবেছিলো তার ইহকালের চিরন্তন সুখের জায়গা হবে এই মানুষটার বুকে?এটাও কি কখনো ভেবেছিলো,এই মানুষটা কখনো তারই হবে?শুধু তার?আজ হয়েছে!কাল দুপুরের পর থেকে মানুষটা একান্ত তার হয়ে গেছে।আর সেখান থেকে বিগত উনিশটা বছর কাটানো জীবনের পরিবর্তন এসেছে।পরিবর্তিত হয়েছে তার জীবন।এইযে,কাল এই সময়টাও পর্যন্ত মানুষটা তাকে ছুয়ে দেখেনি অথচ তিন কবুলের কি শক্তি,কি মাধুর্যতা।দুটো নরনারীকে কাছে আনে।একটা অজানা অচেনা মানুষকেও আপন করে নিতে বাধ্য করে মন।সেই অচেনা অজানা পুরুষটার নিরবিচ্ছিন্নভাবে ছুয়ে দিলেও তাতে কেনো জানি বিবাহবহির্ভূত পুরুষের ছোঁয়ার মতো ঘেন্না থাকে-না। অস্বস্তি থাকে-না।থাকে একরাশ লজ্জা, আর অসংখ্য অদ্ভুত টুকরো টুকরো ভালো লাগার অনুভূতি।যে অনুভূতিতে এখন ডুবে আছে কৌড়ি।অথচ কালকের এই সময়টাও পর্যন্ত সে নিজেও চায়নি এই মানুষটা তাকে কোনোরূপ ছুঁক।আর সেই মানুষটা তাকে এমন উতালপাতাল ঝড়ো হাওয়ার মতো ছুঁয়ে দিলে,নিজেকে কিকরে ঠিক রাখা যায়!

কৌড়ির ভাবনার মাঝেই নিভানের ডানহাতটা এলোমেলো চললো তার ভেজা চুলে।হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়লো।আগের দিন রাতের পরে মেয়েটার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানা হয়নি।কাল এতশত ব্যবস্থার মধ্যেও খোঁজ রাখা হয়নি।ভেজা চুলের ভাঁজে হাত থামিয়ে শুধালো নিভান।

‘শরীর এখন কেমন তোমার?মেডিসিন নেওয়ার পর ঠিকঠাক লাগছে?

খোলামেলা নয় খুবই সুক্ষভাবে প্রশ্ন! বুঝতেও একটু সময় লাগলো কৌড়ির।তবুও লজ্জাজনক বিষয়।যা এখন মানুষটার কাছে পুরোপুরি খোলামেলা।যারকারনে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়।তাই মৃদুস্বরে ছোটো করে উত্তর দিলো কৌড়ি।–হুমম।

‘নামাজ পড়েছিলে সকালে মনেহয়?

মনেহয়?হয়তো তাকে নামাজ পড়তে দেখেছে নয়তো নিশ্চয় কোনোকিছু খেয়াল করেছে মানুষটা।নাহলে এমন প্রশ্ন?প্রশ্নটায় কেমন একটু গুটিয়ে গেলো কৌড়ি।হাতের মুঠোয় আঁটোসাটো নিভানের পিঠের কাছের শার্টের অংশটা আরও দৃঢ় মুঠোয় চেপে ধরলো।ছোট্টো মুখটা আরও চেপে নিলো,সেই বলিষ্ঠ বুকটায়।তারপর মৃদুভাবে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি সরূপ হ্যা জানিয়ে মুখে আওড়ালো।–হুমম।

দু’হাতের বন্ধনীতে কোমল শরীরটার আড়ষ্টতা বুঝে নিভান সে প্রসঙ্গে আর কথা বাড়াতে চাইলো-না।তবে একটা কথা না বললেই নয়,তাই গলার দৃঢ়তা বজায় রেখে বললো–আজকের পর থেকে তোমার যেকোনো অসুস্থতা,প্রয়োজন অপ্রয়োজনীয়তা,ভালোমন্দ তুমি আমার কাছে বলবে।নির্দ্বিধায় নিজ থেকে সবকিছু জানাবে আমাকে।আমি চাইনা তোমার সামান্য কোনোকিছুও দ্বিধাজাল হয়ে গোপনীয় থাক আমার কাছে।জানাবে তো?

কৌড়ির আড়ষ্টতা যেনো বাড়লো বৈ কমলো না।কি উত্তর দেবে সে?কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে কি সম্মতি জানিয়ে দেবে?

‘কি হলো?

দৃঢ়কণ্ঠটা কর্ণপাত হতেই কৌড়ি কথা না বলে মাথা মৃদু উপর নিচ নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।তবে স্বামী নামক মানুষটা তাতে মনেহয় মোটেই সন্তুষ্ট হলোনা।বললো–

‘কথা বলো।মুখে বলো।

পেলব শরীরটা যেনো নির্দেশ পেতেই পুরুষালী শরীরে আরও মিশে গেলো।তবে অপর মানুষটা উত্তর না পাওয়া অব্দি তাকে ছাড়বে-না,অনঢ় থাকবে বুঝতে পেরে মৃদুশব্দে বললো।

‘জানানোর কি দরকার। আপনি তো এমনিতেই জেনে যান।

সহসা মুখে হাসি ফুটলো নিভানের।স্ত্রীর জবাবে সন্তুষ্ট নাহলে-ও,খুনসুটি করার একটা প্রত্যয় তৈরি করে দিয়েছে।তাই জবাব পেতেই বললো সে।

‘তারমানে তুমি,আমকেই তোমার সবকিছু জেনে নিতে বলছো?আমার স্ত্রীর অসুবিধা তবে আমাকেই জেনে নিতে হবে!ওকেহ্!

গলার স্বরে স্পষ্ট দুষ্টমী ভঙ্গিমা,কৌতুক।কৌড়ি যেনো আরও মুর্ছা গেলো।কোনোরকম হাসফাস গলায় বললো— দেরী হয়ে যাচ্ছে না?

মৃদু শব্দ হলো হাসির।স্ত্রীর কথা ঘুরানোর বুদ্ধিমত্তায়, তাকে নিজের সাথে আরও শক্তপোক্ত বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে,সেই হাসিহাসি গলায় নিভান
বললো–যাচ্ছে তো!

ফের কৌড়ি ভেজা চুলে সুদীর্ঘ একটা চুম্বন একে বললো–আচ্ছা রেডি হয়ে নাও।আর ডিস্টার্ব করবোনা।

সময় পার হলো অথচ কৌড়িকে ছাড়লোনা নিভান।এই মেয়েটাকে একটু এরকম বুকে জড়িয়ে কাছে পাওয়ার কতো তৃষ্ণা ছিলো তার।কালকের দুপুরের পর পবিত্রতা পেয়েছে সেই তৃষ্ণার।অথচ তাকে কাছে পেতেই তৃষ্ণা কমার বলদে আরও বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ।কালরাতে মেয়েটাকে কাছে নিয়ে ঘুমানোর পর সেই তৃষ্ণার মাত্রাটা আরও প্রগাঢ় রূপ নিয়েছে। সর্বক্ষণ যেনো তার সঙ্গ পেতে চাইছে।তার পেলব শরীরটাকে এভাবে বুকে জড়িয়ে সারাক্ষণ তাকে কাছে রাখতে চাইছে শরীর, মন।

কাল বিয়ে হতে না হতেই আজ স্যার অফিসে আসবেন?বিষয়টা বস নামখ্যাত নিভান আওসাফ আহমেদ নামক মানবের জন্য আশ্চর্যের বিষয় নাহলে-ও,নতুন দম্পত্য জীবন শুরু হওয়া মানবের বিষয়ে খুবই আশ্চর্যজনক।অফিসের পিয়নের কাছে বসের আগমনী বার্তা শুনেই,সেই আশ্চর্যতা থেকে অফিসের সমস্ত স্টাফগন কৌতুহলী নজর নিয়ে ক্ষনে ক্ষনে চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে অফিস রুমের মেইন ঘোলাটে কাচের দরজা থেকে।অথচ অপেক্ষার অবসান হচ্ছেই-না।সেখান থেকে প্রায় মিনিট দশেক যেতেই সবার কৌতূহলী নজরের অপেক্ষার অবসান ঘটলো।আর সবার কৌতুহলী নজর উবে গিয়ে মুগ্ধ স্থবির নজর সেদিকে আটকে রইলো।

চারমাস কি সাড়ে চারমাস আগে এরকম একটা দৃশ্যে অফিসের সবাইকে খনিকের জন্য আশ্চর্য হতে বাধ্য করেছিলো।অফিসের বসকে একটা বাচ্চা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে হেটে আসতে দেখে,তারপ্রতি কোমল আচারন দেখে মনে আচমকা কৌতুলহ হয়েছিলো।আজ আবারও সেইম দৃশ্য।তবে আজ যেনো সবার নজরে কৌতুহল নয় কেমন মুগ্ধতা বিরাজ করছে।নিত্যদিনের সাজ।ফর্মাল ড্রেসআপ। তবে আজ কালো শার্টের উপরে কালো স্যুট।উচুলম্বা শ্যামবর্ণ পেটানো শরীরে বেশ অন্যরকম লাগছে।লোকে বলে, বিয়ে হলে নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।অন্যরকম মুগ্ধতা ছড়িয়ে বেড়ায় সেই নারীঅঙ্গে।আচ্ছা ছেলেদের-ও কি সেরকম কোনো সৌন্দর্যের উপমা ছড়ায় বিয়ের পর?তা নাহলে বিভিন্ন ফর্মাল ড্রেসআপে রোজকার দেখা একই বেশের মানুষটাকে আজ কেনো অন্যরকম লাগছে?একটু মাত্রারিক্ত বেশিই হ্যান্ডসাম।গম্ভীর্যবান পুরুষটা বরাবরই যেমন একটা আত্মপ্রত্যয়ী মুভমেন্ট নিয়ে অফিসে প্রবেশ করে,আজও তেমনটা।তার সেই আত্মপ্রত্যয়ী দৃঢ় চোয়ালে আজও সবাই ফিদা।তবে অন্যদিনের গম্ভীর্য চেহারায় এতোটা জৌলুশতা মুগ্ধতা অনুভব করিনি কেউ।শ্যামবর্ণ গম্ভীর্য মুখের অবয়বে সবসময় একটা কাঠিন্যভাব লেগে থাকতো।কোথাও যেনো মনেহচ্ছে সেই কাঠিন্য ভাবটা আজ কোমল,নরমতায় রূপায়িত হয়েছে।ঠোঁটে হাসি না থাকা সত্ত্বেও শ্যামবর্ণ মুখটা কেমন স্বতঃস্ফূর্ত।নাকি নজর ভঙ্গি আজ অন্যরকম দেখতে চাইছে,তাই!হয়তো বা আবার হয়তো বা না।তবে সেই হান্ডস্যাম চৌকস পুরুষটার পাশাপাশি হেঁটে আসা ম্যাচিং ড্রেসআপে অনন্যময়ী সেই নারীটা যেনো,মেড ফর ইচ আদার।বাচ্চা পুতুল একটা মেয়ে!

সেদিন যখন সম্পূর্ণ একটা অচেনা অজানা মেয়ের প্রতি স্যারের দৃঢ় চিন্তিত মুখ, কুঞ্চিত কপালে রেখা দেখেছিলো রাইসা,সঙ্গে ওভার পজেসিভ কিছু কান্ড।
সেদিন কেনো জানি মনে হয়েছিলো কিছু একটা কানেকশন তো দুজনের মধ্যে আছেই।আজ সেই কানেকশন,ওই গম্ভীর্য আত্মপ্রত্যয়ী মানুষটার পরিপূর্না রূপ নিয়েছে ।অফিস মেইন ডোর পেরিয়ে স্টাফরুমের মধ্যে ঢুকতেই নিজের নজর সংযাত করে নিয়ে নিজের অবস্থানে গিয়ে বসে পড়লো রাইসা।মনেমনে যেনো একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়লো।

‘উফ,একেই বলে বুঝি ভাগ্য। না না শুধু ভাগ্য নয়, রাজভাগ্য।ওরকম একটা মানুষকে স্বামীরূপে পাওয়ার সৌভাগ্য।

‘আর ইউ ওকে?

হঠাৎ প্রশ্ন করায় মুখ তুলে তাকালো কৌড়ি।পাশে চলতি মানুষটার দৃঢ় মুখাবয়ব সম্মুখে,অফিসের বিভিন্ন কর্মকর্তারা বসকে সালাম বা মর্নিং উইশেস জানিয়ে চলেছে,তাদের প্রেক্ষিতে মৃদুশব্দে হোক বা মাথা নাড়িয়ে প্রতিত্তোর করে চলেছে মানুষটা।তারমধ্যে তারদিকে নজর না ফেলেও ঠিকই তাকে সুক্ষনজরে খেয়াল রেখে চলেছে।এই আত্নবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী মানুষটার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে গেলেও তাকে কিছুটা তেমন হতে হবে।সেই ভাবনা থেকে নিজের ভিতরের দূর্বলতাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলতি পথেও মৃদু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো যে,সে ঠিক আছে।

কিন্তু পাশাপাশি চলতে থাকা মানুষটার যেনো হ্যা সম্মতিসূচক বার্তা ঠিক মনে হলোনা।কেননা,তার নজর যেখানেই থাকুক না কেনো,লক্ষ্য পাশে থাকা অর্ধাঙ্গিনীর গতিবিধির উপর।মেয়েটা গাড়ী থেকে নামার পরই কেমন যেনো মুখের স্বতঃস্ফূর্ত মিষ্টি চেহারার বদল ঘটেছে।হঠাৎ আকস্মিক এমন পরিবর্তনের কারণ?মেয়েটা কি কোনো কারনে ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি ফিল করছে না অন্যকিছু?

‘কোনো কারণে তুমি কি আনকমফোর্টেবল ফিল করছো?

কৌড়ি কিছুটা চমকে তাকালো।ফের মুখে জোরপূর্বক মৃদু হাসি টেনে নমনীয় গলায় বললো–আসলে তেমনটা নয়।

অথচ ঠিক তেমনটাই!অফিসে এতো এতো মানুষের উপস্থিতি!তাদের সম্মুখ দিয়ে এই মানুষটার পাশাপাশি হেঁটে চলা,কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে জেঁকে ছিলো মনে!মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো এলেবেলে সব ভাবনা।যার পূর্ব অভিজ্ঞতাও তার রয়েছে।এই অচচ্ছন্দতা সে আগেই অনুভব করেছে।তারউপর আবার অফিসের মেইন দরজা পেরিয়ে সম্মুখে তাকাতেই কতকত কৌতুহলী নজর তাদের দিকে তাক হতেই ভিতর থেকে যেনো আরও অদ্ভুত, দুর্বল এক অনুভূতিতে হানা দিয়ে আঘাত হানলো অদৃশ্য হাতে কোনোরূপ ধরেবেঁধে রাখা মানসিকতায়।যা ভিতরে ভিতরে দাবিয়ে রাখতে চাইছিলো সে।মুখের অবয়বে বহিঃপ্রকাশ করতে চায়নি কোনোক্রমে।অথচ পাশে যে একজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন চতুর মানুষ সঙ্গী হয়ে কদমে কদমে পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছে তারসাথে,সে খেয়াল যেনো তার ছিলোনা!ছিলো তো।তবে দৃঢ় চোয়াল সম্মুখে রেখেও তাকে এতো পরিচ্ছন্নভাবে খেয়াল করে চলেছে,এই আন্দাজটা ছিলোনা।কৌড়ির পাশে হেঁটে চলা মানুষটা কৌড়ির উত্তরে অমায়িক হেসে দিলো।সচ্চ নরম হাসি।পাশে থাকা স্ত্রীকে স্বস্তি আর প্রশ্রয় দেওয়ার হাসি।যা কৌড়িসহ অফিস কর্মকর্তা, যাদের নজরে পড়লো আশ্চর্য হয়ে দেখলো।সেদিকে আত্মপ্রত্যয়ী মানুষটার বিশেষ বিন্দু খেয়াল নেই।সে আছে নিজ স্ত্রীধ্যানে।পাশে চলা রমনীর দিকে একপলক তাকিয়ে কেমন দৃঢ়কণ্ঠে বললো– তুমি আমার সাথে আছো।তোমার লিগ্যাল হাসবেন্ডের সাথে।তারপরও আনকমফোর্টেবল ফিল করছো?আমি পাশে আছিতো ম্যাডাম।

ভাসাভাসা মায়াময় চোখজোড়া কি সুন্দর পলক ফেলে তাকে আস্বস্ত করলো।কৌড়ি আস্বস্ত হলেও,মনেমনে বললো–আপনার মতো আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ পাশে আছে বলেই তো আমি আনকমফোর্টেবল ফিল করছি।নিজেকে কেমন আপনার পাশে মানাচ্ছে-না মানেচ্ছ-না মনেহচ্ছে।

একপর্যায়ে সকালের নজরের আড়াল হয়ে নিজস্ব কেবিনে ঢুকে পড়লো নিভান।কৌড়ি পিঠে আলতো স্পর্শে হাত রেখে নিজের সাথে সাথে তাকেও ঢুকিয়ে নিলো কেবিনে,যা অফিস স্টাফদের অনেকের নজর গোচর হয়েছে।গম্ভীর, দৃঢ়প্রত্যয়ী বস নামধারী মানুষটা আসলেই নিজের একান্ত,নিজস্ব মানুষটার ক্ষেত্রে বিশেষ,একদম আলাদা।বুঝতে অসুবিধা হলোনা কারও।বসধারী গম্ভীর মুখ করে রাখা কাঠিন্য মানুষটা যে নয়।তিনি যেনো নিজের একান্ত নিজস্ব নারীর বিষয়ে ভিষণ কোমল,নরম।একই মানুষের স্থান ভেদে দুরকম ভাবমূর্তি,তা আজ অনেকেরই নজরে পড়েছে, খেয়াল করেছে।অনুভবও করেছে সবাই।যা আগে কখনো অন্যকারও ক্ষেত্রেবিশেষে নজর পড়েনি কারও।সবসময় নিজের কাঠিন্য গম্ভীর্য ব্যক্তিত্ব নিয়ে থাকা মানুষটাকে নিয়ে এবিষয়ে উনার অগোচরে ট্রলও কম হয়নি।সবাই কমবেশি এটা নিয়ে ট্রল করতো,স্যারের সবকিছু পারফেক্টলি থাকলেও এতো জলদগম্ভীর আর সল্পভাষী মানুষটার কখনো বউ টিকবে-না।অথচ তার উপরেই আবার ফিদা ছিলো অফিস ফিমেল স্টাফ-রা।
মুখে ট্রল করলেও মনেমনে স্যারের সেই গম্ভীর্য স্বভাবে, সল্পভাষীতে এবং আত্মপ্রত্যয়ী ব্যক্তিত্বে মোটামুটি সবাই ডুবুডুবু।

কেবিনে ঢুকতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় বসলো কৌড়ি।বিশাল বড় শীততাপনিয়ন্ত্রক কেবিনটা পরিপাটি টিপটপ সাজানো গোছানো।একজন মানুষের জন্য একটা অফিসকক্ষ কি এতো বড় প্রয়োজন?একপাশে ওয়াল আর তিনপাশে ঘোলাটে কাঁচের বেষ্টনে বেষ্টিত অফিরুমটার মাঝবরাবর অফিসিয়াল বড়সড় কাচের টেবিল,সেখানে অফিস কক্ষের মালিকের বিশেষ নেইম-প্লেটসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি রয়েছে।তবে গুচ্ছ আর্টিফিশিয়াল ফুলের ফুলদানিতটা বেশ নজর কাড়ছে।সবকিছু পারফেক্ট পরিপাটি করে গুছানো।টেবিলের ওপাশে আরামদায়ক বড়সড় কেদারা, অপরপাশেও দুটো রয়েছে।তবে অফিস মালিকের স্পেশাল কেদারার তুলনায় ছোটো।টেবিলের কিছুটা দুরত্ব মেইনটেইন রেখে তিনসিটের একটা বড়সড় সোফা।সেখানেই বসেছে কৌড়ি।আগেও একবার আসা হয়েছিলো, তবে বিশেষ খেয়াল করা হয়নি।নিভান গায়ের ব্লেজারটা খুলে নিজের বসার চেয়রটার উপর রাখতে রাখতে কৌড়িকে বললো–অফিসে ঘন্টাখানেক সময় থাকতে হবে,সমস্যা হবে না-তো?

কৌড়ি মুখ তুলে চাইলো।তবে উত্তর দেওয়ার আগেই নিভান ফের প্রশ্ন করলো—কি,সমস্যা হবে?

কৌড়ি মৃদু হেসে মাথা নাড়ালো।কিন্তু মন বলছে,প্রচুর সমস্যা হবে।কোথাও যেনো মনেমনে একটা অস্বস্তি কাজ করছে।কৌড়িকে খেয়াল করে নিভান তার পাশে এসে বসলো।একটু দুরত্বে,তবে কৌড়ির মুখোমুখি হয়ে আড়াআড়ি বসলো।নির্দ্বিধায় কৌড়ির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে খুব কোমল গলায় শুধালো–কি কারনে এতো নার্ভাস ফিল করছো,জানতে পারি? কি হয়েছে কৌড়ি?সকালে কিন্তু কথা হয়েছিলো,তোমার ভালোমন্দ সবকিছু জেনে নেওয়ার দায়িত্বটা আমার।
দায়িত্বটা,পরোক্ষভাবে হোক বা প্রত্যক্ষভাবে তুমিই দিয়েছো।এখন বলো এতোটা আনকমফোর্ট ফিল কি কারণে?

কৌড়ি মাথা নিচু করে নিলো।কথা গুছাতে থাকলো কি বলবে।নাকি বলবে, কিছুইনা।তবে এই সামন্য কিছুইনা বলে কি এই চতুর মানুষটার থেকে পার পাওয়া যাবে?কৌড়ির মনেহয়, যাবেনা।তাই বাহানা করার চেষ্টা করলোনা।মাথা উচু করে কেমন অসহায় নজর ফেলে মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে কিছুটা দ্বিধান্বিত গলায় বললো–আমার কেনো জানি মনেহয়, আপনার পাশে আমাকে ঠিকঠাক লাগে-না।সবদিক থেকেই কেমন…

কথা শেষ করতে দিলোনা নিভান।কৌড়ির দিকে সামন্য ঝুঁকে কেমন অদ্ভুত দৃঢ় স্বরে বললো–‘এই পাগল তুমি!তুমি জনাো,তুমি কি বলছো?এই,এই সংশয়টা তুমি রপ্ত করা শুরু করলে কবে থেকে?আমি আমার জীবনের পরিপূর্ণ রূপ দিতে আমার অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে শুধু তোমাকেই চেয়েছি।দ্বিতীয় আর কিছু নয়।এমনকি তুমি বাদে আর কাওকেই নয়।সেখানে দ্বিতীয়ত কোনো কারণ,কিন্তু,যোগ্য অযোগ্যতা বিচার বিবেচনা করার সামন্য চিন্তাভাবনা ভুলেও আমার মনমস্তিষ্কের কোথাও সংশয় সৃষ্টি করতে দেইনি।যা আমার তা যেমনই হোক,তাতে সংশয় কিসের!।আর তুমি বলছো কি!তোমার অন্তত আমার যোগ্য অর্ধাঙ্গিনীর উপর এরূপ সংশয়টা রপ্ত করা একদম উচিত হয়নি।একদমই না।

সামনের মানুষটা থেকে এমন জবাবটা জায়েজ জেনেও
আবেগাপ্লুত হলো কৌড়ি।চোখে জ্বলজ্বল করছে মৃদু নোনাস্রোত।সেসব উপেক্ষা করে হেসে ফেললো সে।তখনো নিভান দৃঢ় চোয়ালে তারপানে তাকিয়ে,কৌড়ির হাসিতে সে ভোলেনি।শান্ত চাহুনী তার সামনে বসা মায়াবী রমনীর জ্বলজ্বল করা ডগরডগর চোখে।কৌড়ি সেই চাহুনী লক্ষ্য করে মনেমনে কুন্ঠিত হয়েও নিভানের দিকে একটু এগিয়ে বসলো।শক্তহাতের মুঠোয় তখনো নিজের কোমল হাতটা আবদ্ধ।সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে, নিজেই এবার রুক্ষ হাতটা চেপে নিলো নিজের হাতের মুঠোয়।মিষ্টি গলায় নরম সুরে বললো– আপনার কিন্তু একদম রেগে যাওয়া উচিত নয়।আমি শুধু আমার সংশয়টা প্রকাশ করেছি মাত্র ,আপনার অর্ধাঙ্গিনীর উপর সংশয়টা প্রগাঢ় রপ্ত করেনি।তবে সংশয়টা মনে প্রশ্রয় দিয়ে যদি আপনার অর্ধাঙ্গিনীকে ছোটো করা হয়ে থাকি,খুব স্যরি।

স্যরি শব্দটা এতো নম্র আর মিষ্টি শোনালো এবার নিভানের মুখের আদল যেনো বদল হলো।নিজের অবস্থানে অটল বসেই,কৌড়ির হাত ধরে টেনে তাকে আরও একটু কাছে আনলো।শক্ত দু’হাতে তার মুখটা আজলে নিয়ে,নিজের মুখটা কৌড়ির মুখের কাছাকাছি আনলো।তারপর নিজের খাঁড়া নাকটা দিয়ে কৌড়ির কোমল নাকে শক্তকরে একটু ঘষা দিলো।একবার নয় কয়েকবার দিলো।যেনো ভুলকরে বলে ফেলা কথার শাস্তি।কৌড়ি শাস্তি উপভোগ করতেই চোখ বুঁজে নিলো। মনে চললো চঞ্চল অনুভূতিদের দোলাচল।ফের নাকে, পুরো ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই চোখ খুলে ফেললো সে।অনিমেষ চেয়ে রইলো আদর দেওয়া মানুষটার দিকে।নাক থেকে ঠোঁট সরিয়ে, কালো হিজাবে বাঁধা কপালের অল্প ফাঁকা অংশে দীর্ঘ ঠোঁট ছুঁইয়ে নিভান বললো–‘পাগল মেয়ে।আর কখনো এমন সংশয়কে মনে প্রশ্রয় দেবেনা।কেমন?

কৌড়ি ওভাবেই মাথা নাড়ালো।বউয়ের কপালে সুদীর্ঘ আরও একটা চুম্বন শেষে নিভান ফের বললো—হিজাব খুলে ফেলো,ভালো লাগবে।অনেকটা সময় থাকতে হবে-তো,যাবার আগে আবার বেঁধে নিও।

দীঘল চুলগুলো হেয়ারড্রায়ার দিয়ে সম্পূর্ণ শুকাতে পারিনি কৌড়ি,সময়ের অভাবে।আর মাথার চুল ভিজে থাকলে,মাইগ্রেনের ব্যথাটা যত্রতত্র শুরু হতে সময় লাগবেনা।তাই সামনের মানুষটার নির্দেশ যথাযথ মনে করে হিজাবের পিনে হাত দিতেই,হঠাৎই আবার নির্দেশ এলো–ওয়েট,ওয়ান-মিনিট।

কৌড়ি হাত থেমে গেলো।মনে তৈরী হলো প্রশ্ন। তবে কিছু সেকেন্ডের মাথায় সেই প্রশ্ন দূরীভূত হলো কারও দরজার নকে এবং ভারিক্কি গলার স্বরে।

‘স্যার, আসবো।

নিভান উঠে দাঁড়ালো।আজ আর অফিসের পিয়ন অহিদ সাহেবকে ভিতরে আসার অনুমতি দিলোনা।বরং নিজই এগিয়ে গেলো।পিয়ন আসবে,এটা সে জানতো।নিভান অফিসে ঢুকতেই মিনিট পাচেকের মাথায়,কফির মগ নিয়ে অহিদ সাহেবের আগমন রোজকার।আজ মিনিট পাচেকের জায়গায় আরও একটু দেরী হলো।তবে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে দরজার সম্মুখে গিয়ে দাড়াল সে।দরজা নিজ হাতে আগলা করতেই অহিদ সাহেব যেনো একটু অপ্রস্তুত হলেন।সম্মতি নিয়ে উনি যাওয়ার বদৌলে স্বয়ং এমডি স্যার দরজা খুললেন।বিষয়টা উনাকে অপ্রস্তুত করে দিলো।

‘স্যার আপনার কফি।

ট্রেতে দুমগ কফি দেখে কপালে ভাজ পড়লো নিভানের।মূহুর্তেই তা আবার মিলিয়ে গেলো।অহিদ সাহেব সেটা লক্ষ্য করে তড়িঘড়ি করে বললেন—ম্যাডামও তো এসেছেন এজন্য দুটো দিলাম।

‘ইট’স ওকে।থ্যাঙ্কিউ।

হাতে ট্রেটা নিতে নিতে গম্ভীর স্বরেই উত্তর দিলো নিভান।অহিদ সাহেব সবাভজাত উত্তর দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।কিছু একটা ভেবে উনাকে ডাকলো নিভান।বললো —মিটিং রুমের সবকিছু রেডি হলে,মৃদুলকে দরজায় এসে নক না করে,আমাকে ফোনকল অথবা মেসেজ করতে বলবেন।

‘ওকে স্যার।

সম্মতি জানিয়ে অহিদ সাহেব চলে যেতেই নিভান দরজা ছেড়ে ভিতরের দিকে এগোলো।সোফার দিকে এগোতে এগোতে বললো।—এবার খুলতে পারো।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কৌড়ি হিজাব খুলে ফেললো।কাঁটায় আবদ্ধ চুলের খোপাটা খুলে দিতেই,সাদা ঝকঝকে টাইলসকৃত ফ্লোরটা ছুঁয়ে গেলো।চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে নাড়িয়ে দিতেই কড়া মিষ্টি শ্যাম্পুর সুঘ্রাণটা যেনো মৃদুতরভাবে আশপাশটা ছড়িয়ে পড়লো।যেটা নিভানের নাকে গিয়েও ঠিকলো।তবে সে আপতত অফিস টেবিলটায় পিঠ ঠেকিয়ে বউয়ের সৌন্দর্য অবলোকনে ব্যস্ত, মগ্ন।

কালো স্লিক বেনারসিটা বেশ দক্ষ হাতে পরিপাটি করে পরা।সাথে গায়ের ম্যাচিং কালো ব্লাউজটা যেনো তার নিটোল ফর্সা শরীরে ঝকঝক করছে।বিভিন্ন অঙ্গে গহনায় ছাওয়া।কানে ঝুমকো।গলায় বেশ বড়সড় একটা মালাহার সাথে নানুমার আশীর্বাদসরূপ বিছাচেইনটাসহ কালরাতে তার দেওয়া নীলাপাথের চেইনটা-ও পরা।নানুমার দেওয়া চেইনটা সেই খুলতে নিষেধ করেছিলো,বলেছিলো উনি চলে যাওয়ার পর খুলতে।মুরুব্বি মানুষ ভালোবেসে নিজের গলার হার খুলে দিয়েছেন,তাই হয়তো খুলিনি মেয়েটা।তারউপর মা মনেহয়,ওবাড়িতে যাওয়া উপলক্ষে বিভিন্ন গহনার সাথে আরও একখানা মালাহার চাপিয়ে দিয়েছেন। মেয়েটা এতোটা শান্ত এবং চাপা স্বভাবের কাওকে নিজের অস্বস্তি বা অনিচ্ছার কথা বলতেই পারেনা।এইযে এতো গহনা পরিয়েছে নিশ্চয় ইচ্ছে করেনি পরতে। তবুও বাধ্য হয়ে অপরপক্ষের ইচ্ছের গুরুত্ব দিয়েছে।মনেমনে হাসলো নিভান।প্রচলিত আছে,য্যাসেকি সাথ ত্যাসিই মিলে।

ডানহাত ভর্তি চিকন চিকন একগাছি স্বর্নালি চুড়ি সাথে মধ্যেবর্তি চিকন চুড়িগুলোর এপাশ ওপাশ মোটামোটা দুটো চুড়।বামহাতে একটা মেল ওয়াচ্।মুখে প্রসাধনী বলতে নিত্যদিনের সাধারণ ফেসক্রিম হয়তো-বা।আর ঠোঁটে গাঢ় মেরুন কালেরর লিপস্টিক।এরপর দীঘল কালো চুলগুলো ছেড়ে সোফায় বসে আছে,এক এলোকেশী অপরূপা,অনন্যা।তিনদিন আগের সেই বাচ্চা বাচ্চা চেহারাট যেনো নেই।এ-যেনো স্বয়ং সম্পূর্ণা একজন অনন্যাময়ী নারী।সেই রমনীর মনে নাকি সংশয় রপ্ত হয়েছে,এই শ্যামবর্ণ মানবের পাশে নাকি ওই অনন্যাময়ী নারীকে মানায় না?ঢেড় মানায়।নিভানের মনেহয়, তারপাশে মেয়েটাকে একটু বেশিই যেনো মানায়।অবশ্যই মানাক আর না মানাক,মন যেকোনো রূপেই তাকে চায়।

সোফায় বসা অপরূপা মানবী যেনো চম্বুকের ন্যায় টানলো নিভানকে তবে ভুলেও এই অসময়ে অঘাটন ঘটাতে চাইলো-না সে।তাই নিজের চোখের দ্বারা তৃপ্ত হতে চাইলো।কৌড়ি বুঝতে পারলো।তবে ভুলেও সেই নেশালু দৃষ্টিতে খেয়ালি হতে চাইলো না।তবে বুকের ভিতরে কাঁপন চললো ক্ষয়ে ক্ষয়ে।হঠাৎ তরল পদার্থের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজে মাথা উঁচু করে সামনে তাকালো সে।দুটো মগ দু’হাতে।একটা মগের ঘনো তরল অন্যমগে ঢেলে নিচ্ছে।কেনো?অহিদ সাহেবের কথা সে শুনেছে।কফি দুজনের জন্য।যদিও কফি খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। তুবও কি করতে চাইছে মানুষটা?

‘তোমার ক্যাফেইন জাতীয় খাবার তথা কফি খাওয়া একদম নিষিদ্ধ।তোমার প্রেসক্রিপশনের খাবারের চার্টে সেটা জ্বলজ্বল অক্ষরে লেখা,একদম নিষিদ্ধ।আর সেদিন ডক্টরও আমাকে নিজেই সাজেশন দিয়েছিলেন,ক্যাফেইন জাতীয় খাবার একদম নয়।সুতরাং….

কথা শেষ না করে থামলো নিভান।ঠোঁটের কোণে তার জ্বলজ্বল করছে তার দুষ্টোমাখা হাসি।কৌড়ি সেটা না বুঝে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিভানের মুখে।এতসব কিছুর মধ্যে এই সামন্য কথাও মনে রেখেছেন মানুষটা!

‘সুতরাং কফি থেকে দূরে।তবে জে এইচ জে গ্রুপ এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের এমডির স্পেশাল গেস্ট তুমি।মিষ্টি মুখ করানোতো প্রযোজ্য।প্রথমবার আপ্যায়ন করার সুযোগ হয়নি,দ্বিতীয়বার আপ্যায়নে ত্রুটি করা ঘোর অন্যায়। এখন তুমি এমন একজন গেস্ট স্বয়ং অফিসের এমডি সাহেব নিজেই তোমাতে আপ্যায়িত।এখন কফি খাওয়াতো নিষেধ,মিষ্টিমুখ করা-ও জরুরি।এবার তুমি আপ্যায়ন কিভাবে পেতে চাইছো মিসেস নিভান?তবে বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দিলে কথা ভিন্ন।তোমার কফিটা যখন আমাকেই পান করতে হবে,সেখানে বিশেষভাবে আপ্যায়নের অতিরিক্ত যত্নটা-ও আমার উপর বর্তায়।

সাবলীল ধীর কন্ঠে একের পর এক বলে যাওয়া বাক্যে
মুগ্ধতা কাটিয়ে দিয়ে মূহুর্তেই ভীড় করলো লজ্জারা।ফর্সা গোলগাল মুখটা আরক্ত হলো মৃদু রক্তিম আভায়।নিভানের কথার প্রতিটি শব্দ উষ্ণ অনুভূতিতে ছেয়ে গেলো নারীসর্বাঙ্গের প্রতিটি রক্তকণিকায়।মাথা নিচু করে হাসফাস করলো কৌড়ি।তবে মুখে তার লাজুক মিষ্টি হাসি।একটা মানুষ এতো অবলীলায় কিকরে এসব নির্লজ্জ কথাবার্তা বলে যেতে পারে!তবুও আবার সেই মানুষটা।অবিশ্বাস্য!

‘নাও।

তড়িৎ মুখ তুলে চাইলো কৌড়ি।কফির মগটা চোখের সামনে দেখতেই নিভানের মুখের দিকে তাকালো।ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি নয় এবার মিষ্টি হাসিরা জড়ো হয়েছে।সোফায় ফের আগের অবস্থানে বসতে বসতে নিভান বললো।

‘একটু খেলে কিচ্ছু হবে-না।নাও।তবে তুমি চাইলে কিন্তু কফির বদলে মিষ্টিমুখটা অন্যভাবে ক…

তড়িৎ কফির মগটা নিভানের হাত থেকে নিয়ে ঠোঁটে বসিয়ে নিলো কৌড়ি।সময় নিয়ে ঠোঁট সরালো।যেনো মুখের সমস্ত লজ্জায় আরক্ত হওয়া পেশিগুলো কফির মগের আড়ালে ঢেকে ফেলতে চাইলো।সেটা দেখে নিভানের মুখের হাসি চওড়া হলেও আর লজ্জায় ফেলতে চাইলেনা মেয়েটাকে।অনেক হয়েছে।এবার সাধারণ টুকটাক কথায় ফিরলো দুজন।কথা বেশিদূর এগোলোনা,ফোনের মেসেজ নোটিফিকেশন টোন বেজে উঠলো।সেদিকেও মস্তিষ্ক সজাগ রেখেছিলো নিভান।ফোন চোক করতেই দেখলো মৃদুল মেসেজ করেছে।
মেসেজ পড়ে ফোনটা রেখে দিলো নিভান।কৌড়িকে উদ্দেশ্য বললো—জাস্ট আধাঘন্টা, পারবে-না একাকি কাটাতে? নাহলে ওপাশের রুমে গিয়ে বেডরেস্ট নিতে পারো?

অফিস রুমের সাথে লাগায়ো রুমটার দিকে তাকালো কৌড়ি।এই অফিসরুমটায় স্পেশাল কিছু স্মৃতি রয়েছে তার।ওই রুমটাও তার রোমন্থন।

‘কি হলো,খুব অসুবিধা হবে এই আধাঘন্টা একাকী থাকতে?

‘না।আপনি যান।আমার অসুবিধা হবে-না।

নিভান উঠে দাঁড়ালো।কপি মগের দিকে তাকাতেই দেখলো,কফির কিছু অংশ তরল এখনো মগে আছে।কিছু একটা ভেবে তড়িৎ কৌড়ির কফিমগে নিজের খাওয়া এঁটো তরল পদার্থটা ঢেলে দিলো।কৌড়ি অবাক হয়ে সেটা দেখলো।কফি ঢালা শেষে নিভান চমৎকার হেসে বললো–বরের প্রতি তো তোমার ভালোবাসা কম।যদি এই এঁটো তরল পদার্থের বিনিময়ে তা একটু বৃদ্ধি পায়।তবে খাওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়।তোমার ইচ্ছে অনিচ্ছা যথার্থ সেখানে।

কথা শেষ করে কৌড়ির দুপাশের চোয়ালে নরম হাত রাখলো নিভান।মিষ্টি হাসি তখনো ঠোঁটে ঝুলছে তার।কৌড়ির অবাক করা ডগরডগর চোখের দিকে তাকিয়ে চোখের পলক ফেলে ফের আশ্বস্ত করলো সে।মৃদুস্বরে বললো –আমার এঁটো না খাওয়ার অপশন আছে কিন্তু।না খেলে সমস্যা নেই।

ফের কৌড়ির খোলা চুলের সিঁথির মাথায় একটা দীর্ঘ চুমু দিয়ে বললো–একাকী থাকতে অসুধিধা হলে আমাকে নির্দ্বিধায় ফোন অথবা মেসেজ কোরো।আমি কাওকে পাঠিয়ে দেবো।কেমন?

নরম নরম ভালোবাসাগুলো যেনো কৌড়িকে ভিতর থেকে বেশ আবেগী করে তুললো।আর সব থেকে মায়া লাগলো,কলিজায় গিয়ে সপাৎ করাঘাত করলো, নিভানের একটা কথায়,বরের প্রতি তো তোমার ভালোবাসা কম,যদি এই এটাে তরলপদার্থের বিনিময়ে তা একটু বৃদ্ধি পায়।কৌড়ির মনেহলো মানুষটাকে সপাটে জড়িয়ে ধরে তার কপালেও দীর্ঘ একটা আদর ছোঁয়াতে। তবে এই গণ্ডি কখনো পার করতে পারবে কি না জানা নেই তার।আজ তো পারলোনা।তবে নিভানের কথার বিনিময়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বললো —ঠিক আছে।জানাবো।

নিভান সরে দাড়ালো।বাহিরের পানে আগ্রসর হতেই,
দরজার দোরগোড়ায় গিয়ে পিছু ফিরে তাকাতেই মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো তার।কফিটা সাবলীলভাবে নির্দ্বিধায় পান করে চলেছে কৌড়ি।এলোকেশী অপরূপা নারীর নজর বিশাল বড়োসড়ো কাচের জানালার ওপারে।নিভান দরজা চেপে দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো।নিভান বেরিয়ে যেতেই উঠে দাঁড়ালো কৌড়ি।এতোসময় কোলের মধ্যে পড়ে থাকা হিজাবটা নিয়ে রেখে দিলো নিভানের ব্লেজারের উপর।হাতের পিনগুলো রাখলো অফিস টেবিলের উপর।আবারও পরতে হবে যখন তাই আর হ্যান্ডব্যাগে রাখলো না।ফের কফির মগটা নিয়ে শান্ত পদক্ষেপ বাড়ালো,কাঁচেঘেরা জানালার পাশে।

বাহিরে ঝলমলে কড়া রোদ।নিত্যদিনের ভিন্ন ভিন্ন ব্যস্ত কর্মমুখর মানুষের বিপুল আনাগোনা চওড়া রাস্তাটায়।বিভিন্ন চাকার যানবাহনের অবাধ চলাচলও সেখানে।কফির মগে একটু একটু করে চুমুক দিলো আর বাহিরের সবকিছু কেমন মনোযোগ দিয়ে তীক্ষ্ণ খেয়ালি নজরে অবলোকন করতে থাকলো কৌড়ি।এবারের কফির স্বাদটা ভিন্ন।তার কফির মগে মিষ্টান্নের আভাস থাকলেও এটার স্বাদ কেমন হালকা কশ বা তিক্ত।হয়তো অন্য মগের কফিটা তিক্তই ছিলো।তবে তার মিষ্টান্ন কফির সাথে মেশানোর পর সেটা হালকা,সাবলীলতায় রূপ নিয়েছে।মিষ্টি করে হাসলো কৌড়ি।তবে দুইয়ের মিশ্রণে জিনিসটার স্বাদ মন্দ হয়নি।বেশ দারুন একটা কম্বিনেশন হয়েছে।উপভোগ্য বেশ স্বাদ দিচ্ছে।

সকাল থেকেই উদ্বিগ্ন মান্যতা।তৃনয় বিয়ের প্রস্তাব রেখেছে মানে,যখন তখন একটা কিছু হয়ে যেতে পারে।ইদানীং তাদের ভাইবোন ভাগ্যে হুটহাট বিয়ে হওয়ার প্রবণতা সঙ্কা পেয়েছে।সেই সঙ্কায় এবার নিজেও আতঙ্কিত সে।তৃনয় ছেলে খারাপ নয়।যদি তার প্রস্তাবে বাড়ির সবাই রাজি হয়ে হুটকরে বিয়ে নামক সম্পর্কে বাঁধা পড়ে যেতে হয়।তখন?বিষয়টা ঠিক কেমন দাড়াবে।ওই মানুষটার সম্মুখীন হতে তো তার ভীষণ সংকোচ,লজ্জা।সারাটা জীবন সেই মানুষটার সাথে কাটাতে হবে।কি করে?উফফ!ওই মানুষটাও সব জেনেশুনে কেনো তাকে এরকম পরিস্থিতিতে ফেললো?কতবার ফোনটা হাতে নিয়েছে কল করার জন্য, অথচ বারবার ডায়ালে গিয়েই ফিরে আসছে!যে মানুষটাকে একটা কল করার দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারছেনা,সেই মানুষটার সাথে আমৃত্যুকাল পর্যন্ত সংসার!ধপাৎ করে বসে পড়লো মান্যতা। ফের গা এলিয়ে দিলো নিজের আরামদায়ক বিছানাটায়।

সম্পর্ক ছিলো,সেটা তৃনয় জেনেছিলো বিষয়টা মান্যতার কাছে নরমাল ছিলো।বাট ওই জানোয়ার ছেলেটা তাকে অসভ্য অসভ্য প্রস্তাব দিয়েছিলো।সেই বিষয়গুলো তৃনয় জানে, এটা তারকাছে ভিষন লজ্জার।এমন একটা খারাপ ছেলের সাথে একসময় হুটকরে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলো,এটাই মান্যতাকে হীনমন্যতায় ভোগায়।ভিতরটা আর লজ্জায় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।তৃনয় ছাড়া এই বিষয়ে সেভাবে আর কেউ জানেনা।দাদাভাই, ছেলেটা সম্পর্কে জানলেও এতো গভীরে জানেনা।এটা সে দাদাভাইয়ের কথাকাজে আগেই বুঝেছে।বিধায় লজ্জাটাও একমাত্র সেখানেই।অথচ বিষয়টা লোকটার কাছে যেনো কিছুই নয়।বিছানায় শুয়ে আরও কিছুটা সময় ছটফটালো মান্যতা।ফের আবারও ফোনটা হাতে নিয়ে অন করে ডায়ালে চলে গেলো।নম্বরের দিকে তাকিয়ে ফের ভাবতে বসলো ফোন দেবে নাকি মেসেজ করবে?মেসেজ দেখার সময় আছে লোকটার?যা ব্যস্ত মানুষটা।কাল রাতেও পর্যন্ত এবাড়িতে থাকার সময় হলো-না তার!আন্টির মুখেও তো গল্প শুনেছে,ছেলেটা সারাদিনে এত ব্যস্ত থাকে,নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখার সময় হয়না।আরও কত কি!এমনিতেই মান্যতা সরাসরি এবং দ্রুত কথা বলতে চায় তৃনয়ের সাথে ।আরও কিছুসময় দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে কলটা করেই বসলো মান্যতা।বুকের মধ্যে চললো উথাল-পাতাল ঢেউ।সেই ঢেউয়ের ঘনত্ব বাড়িয়ে দিয়ে ওপাশ থেকে চমৎকার পুরুষালী কন্ঠে বার্তা এলো।

‘সূর্য বুঝি আজ পশ্চিমে উদিত হলো?

যদিও লোকটা সামনে নেই তবুও তার বার্তায় চোখমুখ শক্তকরে চেপে বুঁজে নিলো মান্যতা। ওই মানুষটার মান্যতার প্রতি দূর্বল অনুভূতি অনেক আগেই টের পেয়েছে মান্যতা।তবে দূর্বলতাটা যদি,ওই জানোয়ার ছেলেটার সাথে সম্পর্কে যাওয়ার আগে টের পেতো মান্যতা।তবে কখনোই ওই জানোয়ার ছেলেটার উপরে উপরে মন ভোলানো প্রস্তাবে রাজী হতোনা।ভাইয়ের বন্ধুর মতো এবাড়িতে আসা যাওয়া করতো,এবং তাদের সাথে খুবই কমই কথা বলতো তৃনয়।বিধায় সেভাবে স্পেস রেখে তারাও চলতো।তবে তারপ্রতি তৃনয়ের দূর্বলতা টের পেলো,ওই ছেলেটার সাথে সম্পর্ক ছেদ হওয়ার পর।তবে ততোদিনে তৃনয়ের সামনে যাওয়া তারজন্য লজ্জাজনক হয়ে দাড়িয়েছিলো।অথচ একই অনুভূতিতে অটল সেই মানুষটা।যার নজরে নজর রেখে কথা বলার সাহস, দৃঢ়তা মান্যতার নেই।

‘চুপ থাকার জন্য এই নিজ থেকে কল দেওয়ার মতো অঘটনটা নিশ্চয় তুমি করোনি?

‘আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই?

কোনোরকম সহজ গলায় মান্যতা কথাটা বললেও, তার প্রেক্ষিতে তৃনয় মিছেমিছি বিস্ময় দেখিয়ে বলো–তোমার ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখোতো,সত্যি সত্যিই আজ সূর্য পশ্চিমে উদিত হলো কি-না?

‘তৃনয় ভাইয়া প্লিজ।কথা বলাটা জরুরি।

জরুরি কি জরুরি না তৃনয় খুব ভালো করে জানে।নিভান বা জাহিদ সাহেব বললে বিয়েতে হয়তো মান্যতা অমত পোষন করবেনা।তবে দুটো নরনারী একটা পবিত্র বন্ধনে আঁটকে পড়ার আগে নিশ্চয় তাদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ? আর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা তৃনয় মোটেও এড়াতে চায়না।তাতে অপরপক্ষের মতামত না বা হ্যা যাই হোকনা কেনো।তবে মান্যতার মতামত তারজন্য না হওয়ার কারণ সে জানে।সেই হীনমন্যতা ভাঙার জন্য হলেও মেয়েটার সাথে একান্ত কথা বলা জরুরি।মেয়েটা যখন নিজ থেকে কথা বলতে চাইছে,বিষয়টাতো আরও জরুরি।তৃনয় আর ফাজলামোতে গেলোনা।বললো–

‘আমি আসবো নাকি তুমি আসবে?

চলবে…..

#ফুলকৌড়ি
(৫১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত যানযট,কোলাহল,মানুষের আনাগোনা, ব্যস্ত পায়ে তাদের এদিক ওদিক দূরন্ত বা সতর্ক পায়ে চলাচল,দূর থেকে কেমন দেখতে বেশ ভালোই লাগলো কৌড়ির।অবিচল নজরে সেদিকে তাকিয়ে সময়টা পার করতে থাকলো সে।অথচ খেয়াল করলোনা,অফিসের একদল নারী স্টাফদের তাকে ঘিরে কৌতুহলী নজর!স্যারের বউকে কাছ থেকে দেখার কথা বলার প্রবল আকাঙ্ক্ষা।নিভান অফিসকক্ষ ছেড়ে চলে যেতেই রাইসার নেতৃত্বে মেয়ে স্টাফেরা এসে হাজির হয়েছে এমডি স্যারের অফিসকক্ষের দোরগোড়ায়।রাইসা বাদে অন্যরা এমডি স্যারের অফিসকক্ষে ঢুকতে বেশ আতঙ্কিত। দ্বিধা সংকোচ করছে।স্যার জানলে রক্ষে থাকবেনা।এমডি স্যারের অনুমতিবিহীন প্রয়োজন ছাড়া উনার রুমের আশপাশ ঘুরঘুর বা অফিসকক্ষে প্রবেশ একদম নিষিদ্ধ।সেখানে এভাবে অযাচিত ঢুকে পড়া অশোভন।দৃষ্টিকটু। নিয়মবহির্ভূত।সবার সিনিয়র শীলা মাহমুদা এসব বিষয়ে বেশ সতর্ক থাকেন।তিনি বেশ নিন্ম অথচ দৃঢ় গলায় বললেন।

‘রাইসা,স্যার জানলে কিন্তু বিষয়টা ভালো দেখাবে-না।তিনি কিন্তু নিয়মভঙ্গ মোটেও পছন্দ করেন-না। শেষে কিন্তু আমাদেরই লজ্জায় পড়তে হবে।এভাবে অযাচিত প্রবেশ, বিষয়টা কিন্তু আমার ঠিক লাগছেনা।

কতো সাহস যুগিয়ে বিষয়টাতে উদ্যোগ নিয়েছে সে।এই ভদ্রমহিলা কেনো সেটা টুটিয়ে দিচ্ছে!কাশফিয়া নামক মেয়েটার প্রতি তার ভিষন কৌতুহল।অতটুকু একটা মেয়ে নাকি ওই জাদরেল গম্ভীর এমডি স্যারের অর্ধাঙ্গীনি!যদিও গতবার মেয়েটার জন্য স্যারের অদ্ভুত সব স্বভাববিরুদ্ধ কান্ড দেখেছে।মেয়েটার প্রতি আলাদা মায়া,টান খেয়াল করেছে।তবুও কিকরে এতোটুকু একটা মেয়ে ওই গম্ভীর মানুষটাকে সামলে চলে!যার একজন খুবই শান্তশিষ্ট তো অন্যজন দৃঢ় গম্ভীর স্বভাবের।দীর্ঘ সময় ধরে দেখে আসা প্রেম- সম্পর্কিত সম্পর্কে পুরো রিফ্রেশ থাকা স্যার হঠাৎ এরকম একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করলেন।বয়স,স্বভাবে দু’রকম মানুষ দুটোর কম্বিনেশন ঠিক কেমন!কৌতুহলী মনের প্রশ্ন থেকেই মেয়েটাকে কাছ থেকে দেখার এবং তারসাথে কথার বলার তীব্র বাসনা জেগেছে রাইসার মনে।মনটাও কেমন আকুপাকু করছে মেয়েটার চালচলনে সেসব কৌতুহলী উত্তর পাওয়ার জন্য।যা না করা পর্যন্ত রাইসার চঞ্চল মন কিছুতেই শান্ত হবেনা।সে হিসহিসিয়ে বললো।

‘শীলা আপু,আপনি একটু বেশি হাইপার হয়ে যাচ্ছেন।আরেহ, কুল। আমরা কি স্যারের বউ তুলে নিয়ে যাচ্ছি নাকি?নাকি তুলে নিয়ে যাওয়ার প্লান করছি?আমরা জাস্ট উনার সাথে কথা বলার,দেখা করার একটু আগ্রহ প্রকাশ করছি।আর উনার রুমে অনুমতি বিহীন প্রবেশ করছি কোথায়?উনার ওয়াইফের অনুমতি নিয়েই তবে তো ঢুকবো।আর স্যারের ওয়াইফ মেয়েটা!মেয়েটার অনুমতিও যথেষ্ট প্রযোজ্য এরুমে প্রবেশ করার জন্য।
আর মেয়েটাকে আমি আগেও কাছ থেকে দেখেছি।খুব শান্তশিষ্ট অমায়িক মানসিকতার।অহংকার দাম্ভিকতা তারমধ্যে লক্ষ্য করিনি।

শীলা মাহমুদা কেমন দ্বিধান্বিত হয়ে বললো—‘তবুও?

শীলার কথা কানে না তুলে তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে রাইসা দরজায় নক করলো।আতঙ্কিত হলো সবাই। ঘনোঘনো পিছে ফিরে দেখলো।তাদের মনে শঙ্কা তৈরী হলো,এই বুঝি স্যার এসে জদলগম্ভীর স্বরে শুধালেন–এখানে কেনো আপনার?

রাইসা দরজায় নক করে থামিনি।বরং দরজা ঠেলে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে ভিতরের মানুষটাকে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো।তবে প্রবেশের অনুমতি চাওয়ার আগেই চোখ আঁটকে গেলো তার,কালো শাড়ী পরিহিতা দীঘল এলোকেশী কালোচুলের অপরূপা নারীতে।হঠাৎ করাঘাতে কৌড়িও একটু অপ্রস্তুত হলো।নিভান বলে গেলো আধাঘন্টা সময় লাগবে তার মিটিং সারতে।তবে কে এলো?কাঁচের জানালা থেকে নজর সরিয়ে দরজার দিকে নজর ফেলতেই এবার সে সত্যিই অপ্রস্তুত হলো,নিজের খোলা চুলের এলোমেলো পরিস্থিতি উপলব্ধি করে।তবে মনেহলো মেয়েটাকে সে চেনে।চেহারার আদলে বলে দিচ্ছে এর আগেও মেয়েটাকে সে দেখেছে।এবং এই অফিসেই দেখেছে।আগেরবার অফিসে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ায়, তাকে বেশ সাহায্য করেছিলো মেয়েটা।

‘আসবো?

অনুমতি!মন দোলাচালে ভুগলো।কি বলবে সে?আর এই রুমে প্রবেশ করার জন্য সেই বা অনুমতি দেওয়ার কে? তবে কিছু একটা ভেবে মুখে সৌজন্যে হাসি ফুটিয়ে বললো—আসুন।

হুড়মুড় করে চারপাঁচজন ঢুকে পড়লো কক্ষে।কৌড়ি মনেমনে দ্বিধান্বিত হলো খুব।এনারা!এনাদের তার কাছে কি?এনাদের এমডি স্যার অফিস-রুমে নেই,এটা এনার জানেনা?তবে রাইসাকে সহসা তার সামনে এসে দাঁড়াতে দেখেই মনেমনে অপ্রস্তুত কৌড়ি,উপরে নিজের স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো —ভালো আছেন আপু?

তাকে মনে রেখেছে মেয়েটা?রাইসা বাদেও অন্যরা মুগ্ধ হলো যেনো তার আলাপে,ব্যবহারে।আর তারচেয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলো,কালো শাড়ী পরা,হাটু ছাড়িয়ে পরা এলোকেশী অনন্যাময়ীকে।কি অপরূপা দেখতে!এযেনো প্রভুর নিজহাতে নিখুঁতরূূপে গড়া জীবন্ত মূর্তি।
সবাই ভাবনার মধ্যে রাইসা বেশ আপ্লূত কন্ঠে বললো।

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তুম….আপনি

রাইসার দ্বিধা কাটিয়ে দিলো কৌড়ি।স্বভাবজাত নমনীয় কন্ঠে বললো –‘আমি সেদিনও বলেছিলাম আমি আপনার ছোটো।আপনি আমার সাথে তুমি সম্বোধন করেই কথা বলুন।

খুশি হলো রাইসা।সহসা শুধালো–তুমি কেমন আছো?

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

কৌড়ির সহজ ব্যবহারে সবাই যেনো একটু আশ্বস্ত হলো।তবে মন আতঙ্কিত সবার।সেই আতঙ্কিত মন বারবার নজরকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিয়ে আসছে ঘোলাটে বিশাল বড়ো কাঁচের দরজা থেকে।তবে রাইসার আচারণ স্বাভাবিক। সে টপাটপ সবাইকে কৌড়ির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।অফিসের কোন সেকশনে তারা কি কাজ করে,তাদের নাম।ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড অপ্রস্তুতবোধ করলেও কৌড়ি সবার সাথে সহজ আচারণ করে আলাপ বিনিময় সারলো।

‘বসুন সবাই।

শীলা মাহমুদা অফিস সিনিয়র।শান্তশিষ্ট গম্ভীর এমডি স্যারকে অকারণে তিনি ভয় পান।ভয় পান বলতে সমীহ করে চলেন।এমডি প্রদত্ত অফিসের কড়াকড়ি সকল নিয়মগুলো দৃঢ়তার সাথে মেনে চলতে তিনি সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।এই রুমে স্যারের অবর্তমানে প্রবেশ করে মনটা উনার সেই থেকে ঢিপঢিপ করে চলেছে।এটা এরুমের সামনে এলে।কারনে অকারণে হয়ে থাকে।সবসময় সঙ্কায় থাকেন,এই বুঝি কোনো ত্রুটির কারনে কড়া গলায় স্যার কিছু শুনিয়ে দিলেন।আজ সেই স্যারের অনুমতিবিহীন উনারই রুমে প্রবেশ করায় সঙ্কটা যেনো সরীসৃপের মতো তিড়তিড় করে সারাগায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।যদিও বউয়ের অনুমতি দেওয়া নিয়ে হয়তো রা করবেন না স্যার।তবুও এ-ই রুমে এসে তাদেরকে দেখলে,বিষয়টা স্যারের চেয়েও তাদেরকে বেশি অস্বস্তি অপ্রস্তুত করে তুলবে।এখন এখানে বসা মানে, সেই অপ্রস্তুততাকে নিজে নিমন্ত্রণ করে আনা।তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি অফিসকক্ষ থেকে বের হতে চাইলেন।তবে সামনে দাঁড়ানো অপরূপাকে নারীর সাথে কথা বলতে বা কিছুসময় সঙ্গ পেতেও মন চাইলো উনার।দেখতে অপরূপা এবং স্বভাবে বেশ মিষ্টি একটা মেয়ে।তাই বকবক করে চলা রাইসাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘ম্যাডামকে নিয়ে আমাদের ডেস্কে চলোনা রাইসা।ওখানে গিয়েই না-হয় চা কফির সাথে কথা বা আড্ডা দেওয়া যাবে।

‘বিষয়টা মন্দ নয়।

তার থেকে দ্বিগুণ বয়সী শীলা মাহমুদার মুখে ম্যাডাম ডাকটা শুনতেই কৌড়ির মনেমনে অপ্রস্তুততা বাড়লো।সেটা আরও দ্বিগুণ করে দিলো রাইসার উৎসাহিত কন্ঠে—চলো না,স্যারের মিটিং সেরে আসতে তো প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগতে পারে।সেটুকু সময় নাহয় আমাদের বকবক শুনে কাটালে।যদিও বিরক্ত লাগবে, তবুও সময় তো কেটে যাবে।

কৌড়ি কি বলতে তড়িৎ ভেবে পেলো-না।আদৌও কি তার যাওয়া উচিত?সময়টা একাকি পার করলেও, তার মোটামুটি তো খারাপ লাগছিলো-না।রাইসাকে সে অল্প চেনে,আর এতো অপরিচিত মানুষের সাথে আড্ডা দেওয়া গল্প করা তার যে হয়ে উঠেনা!ভিষণ কেমন কেমন লাগে।এমনিতেই সে ইন্ট্রোভার্ট টাইপের মেয়ে।বেশি মানুষের মধ্যে থাকলে হাসফাস লাগে,সহজে তাদের সাথে সহজ হতে পারেনা,মিশতে পারেনা।তবে এবাড়িতে আসার পর অনেকেটাই ঘরকুনো স্বভাবে পরিবর্তন এসেছে তার।আর রাইসা মেয়েটা যেভাবে বলছে,কিকরেই বা না বলবে!

‘আরেহ চলো-না।এতো চিন্তা ভাবনা করার কি আছে, দূর তো কোথাও যাচ্ছো না। স্যার এসে ঠিকই খুঁজে নেবেন।

গলায় স্পষ্ট দুষ্টমী।কৌড়ি বিষয়টা বুঝেও সহজ গলায় বলার চেষ্টা করলো–বিষয়টা আসলে, উনাকে নিয়ে ফ্যাক্ট নয়।

আরও
কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো সে।মুখে সৌজন্যে হাসি বজায় রেখে ফের বললো–আচ্ছা চলুন।

হাতের কফির মগটা এতোক্ষণে টেবিলের উপর রাখলো কৌড়ি।ফের চুলগুলো মূহুর্তেই হাত খোঁপা করে নিয়ে কাটা আটকালো তাতে।চেয়ারে হেডে রাখা নিভানের ব্লেজারের উপর থেকে কালো হিজাবটা তুলে নিয়ে মূহুর্তেই সেটা অভ্যস্ত হাতে মাথায় এঁটে নিলো।রাইসা পিনআপ করতে সাহায্য করলো।তারপর টেবিলের উপর রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে সবার সাথে বেরিয়ে গেলো সে।অফিসকক্ষ থেকে বের হতেই শীলা মাহমুদাসহ,অন্যরা যেনো হাফ ছেড়ে বাচলেন।সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

নির্দিষ্ট আধাঘন্টা বাদেই কেবিনে ঢুকলো নিভান।নিস্তব্ধ নিঃশব্দ,নীরব শুনশান কেবিন।কেবিনে ঢুকতেই কপালে মৃদু ভাজ পড়ল তার।কোথাও কোনো প্রানির নিঃশ্বাসের শব্দ,বা তার আনাগোনার কোনো চিহ্নমাত্র নেই।মূহুর্তেই গোটা রুমটা সহ পাশের স্পেশাল কেবিনটায়ও পলকে নজর ঘুরিয়ে আনলো নিভান।কৌড়ি কোথায়?কেবিনে নেই কেনো মেয়েটা?কৌড়িতো এমন হুটহাট কোথায় যাওয়ার মতো মেয়ে নয়!তাও আবার না বলে।আর অফিসের বাহিরের যাওয়ার প্রশ্নই তো উঠে-না।তবে?
অফিসের বাহিরে যাওয়ার প্রশ্নই উঠেনা,বিষয়টা ভাবতেই একটু স্বস্তি পেলো নিভান।তাহলে মেয়েটা গেলো কোথায়?হঠাৎ তীক্ষ্ণ ব্রেইন কিছু একটা ভাবলো,সময় নিয়ে মুখে মৃদুমন্দ হাসি ফুটে উঠলো তার।স্বস্তির হাসি।ধীরপায়ে নিজের আরামদায়ক চেয়ারটায় গিয়ে বসলো সে।টেবিলে রাখা ল্যাপটপটা টেনে কাছে নিয়ে দক্ষ হাতের আঙুলগুলো ফটাফট চালালো তাতে।

অফিসের সিসিফুটেজ নিয়ন্ত্রণ বা দেখার জন্য আলাদা অফিস স্টাফ আছেন।অফিস চলাকালীন তিনি সর্বদা নিজের কাজে অব্যাহত থাকেন।তবুও প্রয়োজন অপ্রয়োজনীতায়,গোটা অফিস-রুমের সিসি ফুটেজের কানেকশন নিভানের আওতাধীন রয়েছে।দক্ষ হাতে কয়েকসেকেন্ডের মধ্যে গোটা অফিসটাকে নিজের ল্যাপটপের স্কিনে হাজির করে ফেললো নিভান।মূহুর্তেই ভাবনা অনুযায়ী সুগভীর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুুটো চলে গেলো অফিসকক্ষের ফিমেল ডেস্কে। মুখের হাসি চওড়া হলো তার।যা ভেবেছিলো তাই।নিশ্চয় তার অবর্তমানে সাহসিকতা দেখিয়ে তার বউটাকে নিয়ে গেছেন ম্যাডামেরা।আর স্বভাবসুলভ কারও মুখের উপর না বলতে পারা মেয়েটা হয়তো বাধ্য হয়েই উনাদের সাথেই গেছে।কিন্তু কৌড়ির হাস্যজ্বল মুখ দেখে তো বাধ্য হয়ে গেছে মেয়েটা মনে হচ্ছে না।সিসিফুটেজটা বড়ো করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো নিভান।নিষ্পলক, শান্ত নজরটা তার সিসিফুটেজের একটা গোলগাল মায়াবিনী মুখেই আঁটকে আছে।যে নারীটা তার সহধর্মিণীনি।
ফিমেল স্টাফদের মধ্যেমনি হয়েই বসে আছে মেয়েটা।হাসিখুশি গোলগাল মিষ্টি একটা মুখ।মাঝেমধ্যে সবার কথার খেই ধরে হাত নেড়েচেড়ে নিজেও কিছু বলে চলেছে।কথার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত মায়ামায়া হাসি।হাতের মধ্যে কিছু একটা খাবার,মাঝেমধ্যে টুকটুক করে খেয়ে চলেছে তা।আশ্চর্য! এতো খোলামেলা বাহিরের মানুষের সাথে কখনো কৌড়িকে সহজ হয়ে মিশতে দেখেছে নিভান?এমন কি এতো হাস্যজ্বল বদনে বাড়ির কারও সাথেও তো সেভাবে হেসে খেলে কথা বলত দেখেনি নিভান।দেখেনি বলতে ভুল।টুকটাক মান্যতার সাথে দেখেছে,তবে স্বতঃস্ফূর্ত নয়।হয়তো করেছে। সারাদিন বাড়িতে না থাকার দরুন নজরে পড়েনি তার।তবে কৌড়ির এই হাস্যজ্বল রূপ একদম আলাদা।অন্যরকম মায়াময়।ওই স্বতঃস্ফূর্ত হাস্যজ্বল বদন নিভানকে যেনো অন্যরকম শান্তি অনুভব করালো।সময় অতিবাহিত হলো তবুও নজর সরালোনা সেই হাসিহাসি মিষ্টি মুখটা থেকে।সুগভীর নজর নিষ্পলক দেখে গেলো মেয়েটাকে।

সময় অতিবাহিত হলো।ফোনের আওয়াজে মগ্নতা ভগ্ন হলো নিভানের।ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো, মা কল করেছেন।কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে নীহারিকা বেগমের কন্ঠ ভেসে এলো।

‘অফিস থেকে বেরিয়েছিস?

‘না।এই বের হবো।

‘অফিসের ঝামেলাটা আজ না নিলে হতোনা?মৃদুল অথবা তোর ছোটচাচ্চুকে দিয়ে ঝামেলাটা তো কাটানো যেতো!কোথাও যেতে চাইলে মনস্থিরটা সেই গন্তব্যেই রাখতে হয়।নাহলে…

‘মা,রিলাক্স।আধাঘন্টার কাজ।ব্যাপারটা মিটেও গেছে।এবার বের হবো।এতো হাইপার হচ্ছো কেনো?

কিজানি এতো হাইপার হচ্ছেন কেনো তিনি।মনেমনে তিনিও যেনো একটু চেয়েছিলেন পুরোনো সংসার থেকে ঘুরে আসার।এই বয়সে এসে কি এরকম আবেগপ্রবনতা মানায়? হয়তো মানায় না।তবে কেনো যেনো মন এতসব নিয়মের ধারাবাহিকতা মানতে চায়না।হয়তো সেই আবেগ থেকে নিভানকে এতোকিছু বলে ফেললেন।দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিভানকে কিছু বলতে যাবেন তারআগেই নিভান বললো।

‘কি নেয়ে টেনশন করছো?

নীহারিকা বেগম যেনো একটু থতমত খেলেন।তবুও বললেন–‘কি নিয়ে টেনশন করবো।এই তোরা গেছিস কি-না সেটা জানতে ফোন দিলাম।

‘বাড়িতে মেহমান না থাকলে আমি তোমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম মা।তাতে যে যেমনই মন্তব্য করতো-না কেনো,আর যেমনই দৃষ্টিতে দেখতো-না কেনো, তোমার ছেলে কাওকে পরোয়া করতোনা।কোনো কিছুতে কান দিতো না।তবে বাড়িতে মেহমান কমে যাক,তোমাকে নিয়ে এবাড়ি থেকে আমি ঘুরিয়ে নিয়ে যাবো।নিয়ে আসবো।বিচলিত হয়োনা,প্রেশার বেড়ে যাবে।

আবেগপ্লুত হলেন নীহারিকা বেগম।এই ছেলের কাছ থেকে ভালো মন্দ কোনো অনুভূতি লুকোনো যায়-না। পেরেছেন কি কখনো লুকাতে?পারেননি।আগে নিভান উনার আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে অবগত হলেও এরকম ভাবে মুখে কখনো প্রকাশ করে স্বান্তনা দিতোনা।তবে অবশ্যই সেটা যেভাবে হোক পূর্ণ করে বুঝিয়ে দিতো,মা তুমি আমার থেকে তোমার ভালো মন্দ ইচ্ছে,চাওয়াগুলো লুকিয়ে গেলেও তোমার ছেলে ঠিকই বুঝতে পারে।এমন একটা ছেলেকে গর্ভে ধারণ করতে পেরে তিনি গর্বিত।পৃথিবী না জানুক তিনি জানেন,তিনি রত্নগর্ভা।যদিও পৃথিবী জানতে বাকি নেই তিনি রত্নগর্ভা।

‘মা।

‘ওবাড়ি পৌঁছিয়ে আমাকে জানাস।আর সাবধানে গাড়ি চালাবি।রাখছি।আল্লাহ হাফেজ।

‘আল্লাহ হাফেজ।

নিভানের প্রস্তাবে মা যে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন।বেশ বুঝতে পারলো নিভান।তাই আর কথা না বাড়িয়ে মায়ের বিদায় বার্তা মেনে নিয়ে নিজেও মৃদুস্বরে বিদায় বার্তা জানিয়ে দিলো।

মায়ের ফোনটা কাটাতেই নিভানের ছোটোচাচা ফোন দিলেন। জানতে চাইলেন কতদূর এসেছে তারা?আসতে
আর কতক্ষণ বা লাগবে?

বিচিলিত যেনো সবাই!ছোটো চাচার সাথে কথা সেরে ফোন রাখল নিভান।স্থির নজর তখনো তার ল্যাপটপের স্কিনে।কৌড়ির হ্যান্ডব্যাগটা তার টেবিলের উপর, তার নিজস্ব ফোনটাও ছিলো ব্যাগের ভিতরে।নিভানের তাই মনে হয়েছিলো, কৌড়ি ফোন নিয়ে যায়নি।অথচ মায়ের সাথে কথার বলার মধ্যেও নিভান খেয়াল করেছে ডেস্কের উপর থেকে ফোন নিয়ে দুবার চেক করে নিয়ে রেখে দিয়েছে কৌড়ি।হয়তো কার-ও ফোনের অপেক্ষা।মৃদু হাসিতে পুনরায় ছেয়ে গেলো ঠোঁট। মেয়েটার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফোন দিলো নিভান।কয়েক সেকেন্ড পার হতেই রিনরিনে মেয়েলি মিষ্টি স্বর ভেসে এলো।

‘আমি রাইসা আপুদের এখানে।আপনি এসেছেন?

ওপাশের সব রমণী যেনো তথাস্তু,চুপচাপ।শুধু একজন চঞ্চল।নিভান সেসবে পাত্তা না দিয়ে প্রিয় নারীটার কথার পরিবর্তে উত্তর জানাতে ব্যস্ত হলো।তবে কন্ঠে তার অতি ব্যস্ততা নেই।বরাবরের মতোই শান্ত,ঘনোস্বরে বললো।

‘হুমম,এসেছি তো।আমিতো আমার দিয়ে যাওয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চলে এসেছি অথচ ম্যাডামের খোঁজও নেই,দেখাও নেই।আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ম্যাডাম?

উত্তর কি দেবে কৌড় যেনো খুঁজে পেলোনা।তন্মধ্যে আশেপাশে তাকিয়ে আরও একটু দ্বিধায় পড়ে গেলো।সবটা দেখলো নিভান।ওই মিষ্টি মুখটার অপ্রস্তুতা যেনো মোটেই ভালো লাগলোনা তার।সেখানে মিষ্টি লজ্জা আর উচ্ছলতার প্রভাব যেনো নিদারুন মানায়।নিভান সেই অপ্রস্তুততা দূরীভূত করতে শান্ত, চমৎকার কন্ঠে বললো।

‘চলে এসো।যেতে হবে তো আমাদের।

রিনরিনে মেয়েলি মিষ্টি আওয়াজটা আবার ভেসে এলো—আসছি।একটু অপেক্ষা করুন।

ফোন কেটে দিলো নিভান।সবাইকে বলে কৌড়ি উঠে দাঁড়াতেই ফুটেজ কানেকশন অফ করে দিলো নিভান।গভীর দৃঢ়পন নজরটা তার এবার অফিসকক্ষের ঘোটালে কাঁচের দরজায়।সেখানে একটা ছায়া এসে হাজির হতেই মুখে মৃদু হাসিটা ফিরে এলো তার।কৌড়ি মুখ বাড়িয়ে অনুমতি চাওয়ার আগেই নিভান
বললো–দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে রাখি কি বলো?

নিভানের দুষ্টমী কথার ভঙ্গিমা বুঝে অমায়িক হেসে কৌড়ি ভিতরে ঢুকে পড়লো।কৈফিয়তের স্বরে বললো–
আপনাকে না বলে যাওয়া হয়তো উচিত হয়নি তবে উনাদেরকেও না বলতে পারিনি।ভেবেছিলাম অফিসের মধ্যে তো আছি,খুঁজে নেবেন আমাকে।তাই আর ফোন দিয়ে…..

‘খুজে নিয়েছি তো।কৈফিয়তের কোনো প্রয়োজন নেই।

উঠে দাঁড়ালো নিভান।কৌড়ির কাছাকাছি সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকে বললো–তবে সামন্য একটু বিচলিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে,আমার এতো সাধ্যসাধন করে পাওয়া শান্তশিষ্ট বউটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো কোথায়?

নিভানের বলার ভঙ্গিমায় লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।সেই লজ্জা কাটিয়ে দিলো প্রগাঢ় এক চুমুতে নিভান।কৌড়ির মুখটা শক্তকরে দু’হাতে আঁজলে নিয়ে কপালে সঁপে দিলো নিজের ঠোঁটে।চেপে রাখলো কিছুক্ষণ। ফের সরে এসে কৌড়ির নাকের সাথে নিজের নাকটা ঘষা দিয়ে বললো–এভাবে কখনো আর সামন্য হলেও আমাকে বিচলিত করে দেবে-না।একটু হলেও নিজের অবস্থানটা কোথায় রাখছো জানাবে,সে যেখানেই থাকোনা কেনো আর যেখানেই যাওনা কেনো তুমি।কেমন?

কৌড়ি বাধ্য স্ত্রীর মতো উপর নিচ সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ালো।সেটা দেখে মৃদু হেসে পুনরায় টুপ করে কৌড়ির দুঠোঁটের মেলবন্ধনে একটা চুমু একে দিলো।কৌড়িকে লজ্জা পাওয়ার সময় না দিয়ে বললো–চলো।এরপর দেরি হয়ে যাবে যেতে।সবাই ফোন দিয়ে আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।

কৌড়িও যেনো মূহুর্তেই ভুলে গেলো স্বামী নামক পুরুষটার সদ্য রাঙিয়ে দেওয়া ভালোবাসা।টেবিলের উপর থেকে নিজের হ্যান্ডব্যাগটা নিলো।তারপর ছড়িয়ে থাকা শাড়ীর আঁচলটা পিঠের উপর দিয়ে উঠিয়ে ডানহাতের ফাঁক গলিয়ে অন্যহাতে চেপে নিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বের হওয়ার জন্য অগ্রসর হলো।দু’জনেই একসাথে বের হলো অফিস রুম থেকে।নিভানের অগ্রগতি বরাবরের মতোই আত্ম দৃঢ় স্বভাবের।কৌড়িও তার নমনীয় ধারা অটল রেখে পায়ে পা মিলিয়ে চললো।স্টাফরুম পার হওয়ার আগেই ধীমে গেলো তার চলন।নিভান এগোতেই পাশকেটে দুকদম ডানে গিয়ে আলাদা ওম্যান ডেস্কের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিতেই দেখলো,তাঁরাও উঁকি দিয়ে দেখছে কিছু।কৌড়ির সাথে তাদের নজর বন্দি হতেই হাত নাড়িয়ে তাদেরকে বিদায় জানালো কৌড়ি।তারাও মিষ্টি হেসে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো।সামনে এগোনো নিভান যেনো বউয়ের কান্ড স্পষ্ট উপলক্ষে করলো।মুখে মৃদু হাসি ফুটতেই মূহুর্তেই তা মিলিয়ে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলো।কিছু মূহুর্ত পর অনুভব করলো,তার প্রিয়তমা স্ত্রী পুনরায় সঙ্গ নিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছে তার।

শহর থেকে নিভানের আসল পিতৃগৃহটা বেশ ভিতরে।
বেশ ভিতরে বলতে ঢাকার জ্যাম পেরিয়ে প্রায় তিন ঘন্টার কাছাকাছি লেগেছে এই এবাড়িতে আসতে।এখানের আশপাশটা কেমন গ্রামীন পরিবেশের ছোঁয়া।অথচ চারপাশের বড়বড় আধুনিক কায়দায় বিল্ডিং, রাস্তাঘাট,পরিবেশ সব শহুরে ছোঁয়ায় আচ্ছাদিত।তবে বিশাল বিশাল এরিয়া নিয়ে করা বাড়িগুলো গ্রামীণ পরিবেশেকে বেশ উপলব্ধি করাচ্ছে।পুরানো বিশাল বড় দুতলা বাড়িটার বড়সড় লোহার গেটটা পেরিয়ে লন এরিয়ায় গিয়ে গাড়ীটা থামাতেই গাছপালা ভরা চারপাশটাকে দেখতেই,নিজের বেড়ে উঠা মাতৃস্থানীয়ার কথা মনে পড়ে গেলো মূহুর্তেই কৌড়ির।গাড়ী থেকে বের হতেই সেটা আরও দৃঢ়রূপে অনুভব করতে থাকলো সে।

রঙচটা বিশাল বড়ো দোতলা বাড়ি, দৈত্যের ন্যায় বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে।অনেক আগের বাড়ি।যেটা তার কারুকাজ,গঠন,দেখেই বোঝা গেলো।এটা সদ্যপ্রাপ্ত হওয়া বড়োলোকিদের বাড়ি নয়।বাড়ির সামনে এরিয়ায় বিভিন্ন রকমের অবাধ গাছপালায় ভর্তি।ওবাড়ির লন এরিয়ার মতো নিদিষ্ট করে সাজানো গোছানোরূপে কোনো গাছ লাগানো নেই।অথচ তাতে মুগ্ধতা বা সৌন্দর্যের খামতি নেই।কেমন মায়ামায়া শান্তশান্ত নিরিবিলি পরিবেশ।

চারপাশটা বিশেষভাবে খেয়াল করার আগেই,গাড়ীর শব্দ পেয়ে হয়তো বড় বাড়িটা থেকেই বেরিয়ে এলেন বিয়ের দিনে পরিচিত হওয়া সেই চাচাশ্বশুর নামক মধ্যেবয়সী পুরুষটা।অমায়িক হেসে কুশলাদি বিনিময় করে, তাদেরকে নিয়েই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন তিনি।ভিতরে প্রবেশ করতেই বাহিরের থেকে আরও শান্ত আরও নিরিবিলি পরিবেশ অনুভব করলো কৌড়ি।তারা বসার ঘরে প্রবেশ করতেই কোথা থেকে ছুটে এলেন সুদর্শনা এক নারী।চেহারার জৌলুশতায় তাকে নিতান্ত অল্প বয়সী লাগছে। বয়স ধারনা করতে পারলো না কৌড়ি। তিনি এসে প্রথমে নিভানের সাথে আলাপ বিনিময় সারলেন।ফের কৌড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়ে অমায়িক মিষ্টি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললেন—এই বুঝি আমাদের বড় বউমা?মাশাআল্লাহ।

ফের নিজেই নিজের পরিচিত জানান দিলেন—আমি তোমার ছোটো চাচিশ্বাশুড়ি হই।কেমন আছো মা?

ভদ্রমহিলার অমায়িক ব্যবহারে কৌড়ি নিজেও সহজ আচারণ করলো।যদিও ভিতরে ভিতরে আড়ষ্টতায় ঘিরে আছে।তবুও মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে স্বভাবসুলভ নরম কন্ঠে বললো—আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।আপনি ভালো আছেন?

‘আলহামদুলিল্লাহ।ওবাড়ির সবাই ভালো আছেন?আর বড়ভাবি,উনি কেমন আছেন?

‘আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছেন।

‘তোমাদের বিয়েতে খুবকরে যেতে চেয়েছিলাম।কিন্তু যাওয়া হয়নি।মেয়েদের পরিক্ষা ছিলো সাথে তোমাদের দাদুমাও অসুস্থ ছিলেন।

‘ঝুমুর, এসব কথা পরে গল্প করো।দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে,ময়নার মা’কে টেবিল গোছাতে বলো।
ওদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো।আমি নিভানকে মায়ের সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে আসছি।

ভদ্রমহিলার সম্বিৎ ফিরলো যেনো।কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বললেন–ও হ্যা হ্যা, সবকিছু গোছগাছ করাই আছে।চলো,ওদেরকে আগে মায়ের সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে আসি।তারপর ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেবে।চলো বউমা।

‘গাড়ি থেকে ফল আর মিষ্টির প্যাকেটগুলোতো নামানো হয়নি।

নিভান কথাটা বলতেই নিভানের ছোটো চাচা বললেন–ওগুলো পরে আমি নামিয়ে নেবো।আগে চল,দাদুমা সাথে দেখা করবি। সেই সকাল থেকে ছটফট করছেন তোদের জন্য।অপেক্ষা করে বসে আছেন।ঘুমাচ্ছেনা, খাচ্ছেন না।

নিভান আর দ্বিরদ করলোনা।ভদ্রলোক অগ্রসর হওয়ার আগেই নিভান অগ্রসর হলো।এবাড়িতে দাদুমার রুমটা কোথায় তার জানা আছে।সেই বাড়ি ছাড়ার পর না চাওয়া সত্ত্বেও আরও দু’বার এবাড়িতে পা পড়েছে।তাই দাদুমার থাকার রুমটাসহ মা বাবার থাকার রুমটাও তার জানা।নিভান আর তার ছোটো চাচার পিছুপিছু কৌড়ি আর উনার ওয়াইফও অগ্রসর হলেন।ভদ্রমহিলা কথা বলেই চলেছেন। কৌড়ি কানে সেসব ঢুকলেও একটু আশ্চর্য হলো সে।এতোবড় বাড়িতে মাত্র এই কয়েকটা মানুষ থাকে।আর কেউ নেই।তবে চাচিশ্বাশুড়ি নামক মানুষটা যে বলেন উনার দুটো মেয়ে আছে তারা কোথায়?

কতোগুলো বছর আগের নতুন সেই বরবধুর চিত্র মানসপটে ভেসে উঠলেন আবেদা জাহানের,তবে পিছে ফেলে আসা নির্দিষ্ট দিনের সময়টা ঠিক মনে করতে পারলেন না।শোক আর রোগ উনাকে আগের সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছে।ইদানীং অনেককিছু ভুলিয়ে রেখেছে।অথচ এমন একটা যুগল তিনি অনেকদিন পর আবারও দেখলেন।সেই একই জুটি যেনো উনার সম্মুখে বসা।
বাবা ছেলের মধ্যে সবকিছুতে এতো মিল!ছেলেটার চেহারায়, স্বভাবে,ব্যবহারে,বউভাগ্যে সবকিছুতে যেনো অদ্ভুত মিল।হঠাৎ জীর্ণশীর্ণ বৃদ্ধা মনটা আঁতকে উঠলো উনার।মূহর্তই মেনেমনে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া আর্জি করলেন, প্রভু সবকিছুতে মিল রাখলেও ছেলেটার ভাগ্য যেনো তার বাবা-র মতো নাহয়।এটুকুতে তুমি মিল রেখোনা।এই অসুস্থ দাসীর প্রার্থনাটা তুমি কবুল কোরো প্রভু।

নাতী এবং নাতবউয়ের সাথ আলাপপরিচয় শেষে ভালোমন্দ অনেক কথাই বললেন আবিদা জাহান।পাশে বসা নিভানকে কাছে পেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে কাছে ডেকে কপালে চুমুও খেলেন।কৌড়িকেও বাদ রাখলেন না।বৃদ্ধা যখন কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন, কৌড়ির তখন মনেহলো একটা মানুষের বদৌলে কতো মানুষের আদর ভালোবাসা সে পাচ্ছে।অথচ তার আদর ভালোবাসার পৃথিবী ছিলো খুবই সীমিত।আজ একটা মানুষ তাকে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে,সেখানে নিজেতো তাকে ভালোবাসা আদর যত্নে ডুবিয়ে রেখেছে।নিজের বদৌলে অন্যদেরকেও তার ভাগের আদর যত্ন ভালোবাসা থেকে ভাগ দিয়ে কৌড়িকেও মুড়িয়ে রাখতে বাধ্য করেছে।আবেগপ্রবণ হলো মন।এই মানুষটাকে কৌড়ি খুব ভাালোবাসবে।খুব খুব।

‘ছোটো বউমা,যাও।দাদুভাইয়ের ঘরটা দেখিয়ে দাও। অনেকটা পথ এসেছে ওরা,ফ্রেশ হয়ে নিক।দুপুরের খাবারের সময়টাও তো পেরিয়ে যাচ্ছে,ওরা ফ্রেশ হতেই খেতে দাও।

‘এবার আপনার খাবারটা দেই আম্মা?

‘রুমে দিওনা।খাবার টেবিলেই আমার খাবারটা দাও।আজ ওদের সাথেই খাই।আশহার নাহয় আমাকে উঠিয়ে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেবে।

ছোটো ছেলেকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলতেই ছেলেও সম্মতি জানালো।ঝুমুরও আর দ্বিরুক্তি করলেন না।বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটা অসুস্থতায় হঠাৎ চলাফেরায় অচল হয়ে পড়েছেন।চলাচল করতে পারেননা এমনটা নয়।তবে ধরে চলাফেরা করাতে হয়।অসুস্থতা মানুষটাকে টানাহেঁচড়া না করে উনার সমস্ত কাজ ঘরের মধ্যেই সম্পূর্ণ করা হয়।নিভানকে সাথে নিয়ে আশহার সাহেব বের হতেই,ঝুমুরও কৌড়িকে নিয়ে বের হওয়ার জন্য উদ্যোক্ত হতেই বৃদ্ধা মানুষটার হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়াই তড়িৎ বললেন।

‘ছোটো বউমা দাঁড়াও।

দাড়িয়ে পড়লেন ঝুমুর।সাথে দাঁড়িয়ে পড়লো কৌড়িও।
আবিদা জাহান ফের বললেন। –আমার আলমারিটা খোলো দেখি।তারপর ভিতরের লকারটা খুলে গহনার বাক্সটা আমার কাছে দাও।দাদুমনি আর একটু আমার কাছে এসে বসোতো।

শেষের কথাটা কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললেন।শ্বাশুড়ির আদেশ পেতেই ঝুমুর সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করলো।আলমারি খুলে গহনার বাক্সটা এনে দিতেই,বৃদ্ধ ভদ্রমহিলা বাক্স থেকে অনেক আগের পুরোনো ডিজাইনের ভারী একজোড়া বালা বের করলেন।তারপর তা পরিয়ে দওলেন কৌড়ির দু’হাতে। চুড়ির মেলায় যেনো হাত ভারী হয়ে পড়লো কৌড়ির।তবে ভালোবাসায় কাওকে মাঝ সমুদ্রে ডুবিয়ে দিলেও বলার কিছু থাকেনা।বলতে নেই।কৌড়িও বললোনা।চুপচাপ ভালোবাসা উপলব্ধি করলো।চুড়ি পরানো শেষে ভদ্রমহিলা কৌড়ির গালে হাত রেখে দোয়া করলেন।

‘তোমাদের পথচলা দীর্ঘায়ু হোক।খুব সুন্দর হোক।সুখি হও।

ফের মনেমনে দোয়া করলেন–তোমার স্বামীভাগ্যও যেনো সুদীর্ঘতম হয়।তোমার মৃত্যুক্ষন পর্যন্তও যেনো তুমি তোমার স্বামীর ভালোবাসা পাও,সংস্পর্শ পাও।

ফের মুখে বললেন–
‘যাও দাদুমনি,অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছো হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।যাও।দুপুরটাও গাড়িয়ে যাচ্ছে ,খেতে হবে তো।যাও…

ভিতরটা যেনো আবেগে টইটম্বুর।এই ধরনের ভালােবাসাগুলোর প্রতিদান কিকরে আর কোণ ভাষায় চোকাতে হয় কৌড়ির জানা নেই।তাই নিজের ভিতরের আবেগ অনুভুতি বহিঃপ্রকাশ না করতে পেরে বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো।ঝুমুর ততক্ষণে পুনরায় গহনার বাক্সটা গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত। তাই কৌড়িকেও দাঁড়িয়ে থাকতে হলো।ততক্ষণে আবিদা জাহান নাতনীদের খবর নিতে থাকলেন।কৌড়ি তখন বুঝলো এবাড়ি আরও দু’জন মানুষ তবে আছে।

‘বড় দাদুমনির জ্বরের কি খবর?জ্বর ছেড়েছে ছোটো বউমা?

‘না আম্মা।কাল ওই অসুস্থ অবস্থায় পরিক্ষা দিতে গিয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।বেহুঁশের মতো ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। তাইতো নিভান আর বউমারা এসেছে জেনেও বাহিরে আসতে পারলো-না।

‘আর ছোটো দাদুমনি কোথায়?

‘ইতু!ওকে তো জানেন,একটু লাজুক স্বভাবের মেয়ে।এত বললাম তবুও ঘর থেকে বের হলো-না।নিতুর পাশে শুয়ে আছে।যাই হোক একটু সময় যেতে দিন আপনার নাতবৌয়ের মাথাটা ওই নষ্ট করে দেবে।

হাসলেন ঝুমুর।হাসলেন বৃদ্ধাও।কৌড়ি এলোমেলো কথার অর্থ বুঝলোনা।তবে দাড়িয়ে চুপচাপ শুনল সব।


আসরের আযানের পরপরই এবাড়িতে এসে হাজির হলো তৃনয়।মা,এখনো জামাইয়ের বাড়ি থেকে বিদায় নেননি।তাই মায়ের সাথে বোনের সাথে দেখা করে,কিছু সময় বাক্যবিনিময় করে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে গন্তব্যে পা বাড়ালো।এ-সময় মান্যতার ছাঁদে থাকার কথা।তৃনয় গিয়ে পেলোও তাকে ছাঁদে।ছাঁদের দরজায় পা রাখতেই দেখলো,ছাদের উত্তর পাশের পানিরট্যাঙ্ক রাখার জন্য আলাদা ছাঁদ করা।আর সেই ছোটো ছাঁদের সিঁড়িতে বসে একমনে হাতের নখ খুঁটে চলেছে মেয়েটা।এই জড়তা কিসের তৃনয়ের জানা।দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই দুশ্চিন্তিত রমনীর দিকে অগ্রসর হলো সে।তাকে সর্বদা এড়িয়ে চলা নারীটা আজ নিজইচ্ছেতে তাকে ডেকেছে,সময় এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে ক্ষয় করা উচিত নয়।

‘কি খবর?কেমন আছো বাধ্যতা?হঠাৎ আমার তলব?

নিজের ভাবনা বিভোর হওয়া মেয়েটা তৃনয়ের নিঃশব্দের পদচারণ খেয়াল করেনি।মশকরা করে ডাকা পুরোনো ডাকটা কানে আসতে চমকে মাথা উচু করে তাকালো সে।তৃনয়কে সামনে দেখেই ভিতরে ভিতরে আড়ষ্টতায় ডুব দিলো মন।তবে সহজ আচারন করলো সে।বললো–কেনো আপনার তলব?আপনি জানেন না?

‘কি জানার কথা বলছো?আমি আবার কি অপরাধ করলাম?

জানা সত্ত্বেও গলায় স্পষ্ট ফাজলামো স্বর।মান্যতা এবার কিছুটা শক্তগলায় বললো–এটা কিন্তু ফাজলামো করার বিষয় নয় তৃনয় ভাইয়া।আপনার কি উচিত হয়েছে আমাকে না জানিয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার?

এবার সিরিয়াস হলো তৃনয়।বিয়ে উপলক্ষে নাকি সবসময় পাতানো থাকে জানেনা,ছাঁদে একটা গোলটেবিলের সাথে কিছু চেয়ার পাতা ছিলো।সেখান থেকে একটা চেয়ার উঠিয়ে নিয়ে কিছুটা দুরত্ব মেইনটেইন করে মান্যতার মুখোমুখি বসলো তৃনয়।
মান্যতার দিকে তাকাতেই নজর সরিয়ে ফেললো সে।বুঝতে পারলো একটু আগে বলা কথাগুলোর মধ্যে কিছুটা ভুল আছে।আর সেই ভুলটা পুনরায় উত্থান করে তৃনয় বললো।–তোমাকে কতোবার ফোন দিয়েছি, মেসেজ দিয়েছি দেখেছো নিশ্চয়?তারপরও এই ব্লেমটা করা তোমার সাঝে?

‘তাই বলে আপনি এরকম একটা সিদ্ধান্ত একাএকা নিয়ে নিবেন?এখানে আমার সিদ্ধান্তের কোনো গুরুত্ব নেই?

‘গুরুত্ব আছে বলেই তো,নিভান অথবা আঙ্কেলের কাছে প্রস্তাব রাখার আগে তোমার সিদ্ধান্ত জানার জন্য তোমার কাছে ফোন দিয়েছিলাম।তুমি ধরোনি?আমার ইগো হার্ট করে আমি বারংবার তোমাকে ফোনকল, মেসেজ দিয়ে গেছি।অথচ তুমি সাড়া দাওনি।কেনো?পারবে এন্সার দিতে?সেই ফালতু একটা ঘটনার পরে তুমি আমাকে তোমার শত্রু বানিয়ে নিলে।অথচ আমি বরাবরই তোমার মিত্রই থাকতে চেয়েছিলাম।ওই ফালতু ছেলেটার সঙ্গে সম্পর্কে যাওয়ার অনেক আগে থেকে তোমার প্রতি আমার ফিলিংস্ ছিলো।যা আমি প্রকাশ করতে পারিনি।যদিও সেটা আমার চরম ব্যর্থতা।তুমি সম্পর্কে জড়িয়েছিলে সেই অভিযোগও তোমার প্রতি আমার কখনো ছিলো না।যা অভিযোগ ব্যর্থতা ছিলো, শুধু নিজের প্রতি।কিন্তু আমার হৃদয়ের রানীকে কেউ বাজে উদ্দেশ্যে ইউজড্ করবে!সম্পর্কের নামে তাকে বাজেভাবে ধোঁকা দিবে! তাকে না ভালোবেসে তার শরীরকে নোংরা উদ্দেশ্য ছুঁতে চাইবে!এসব জানার পর তুমি বলো,আমার কাছ থেকে ঠিক কিরূপ ব্যবহার আশা করছিলে?আমি ওই নোংরা ছেলেটার উদ্দেশ্য জানার পরও তোমার হুশ ফিরবে কখন সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করবো?চুপচাপ থাকবো?তুমি যদি সেরকমটা আশা করে থাকতে আমার কাছ থেকে,আমি খুবই খুবই দুঃখিত। আমার দ্বারা চুপচাপ থাকা সম্ভব ছিলোনা।আমি নিভানকে জানিয়েছিলাম,ওই ছেলেটা খারাপ!
তোমাকে নিয়ে তার চিন্তাভাবনা এন্ড উদ্দেশ্যও খারাপ!
তো বেশ করেছিলাম।তুমি আমাকে যেমনই ভেবেছিলে আর আগামীতে যেমনই ভাবোনা কেনো,আমার মনেহয় কোনো আমি ভুল করিনি।বরং ভুল এটা ছিলো,ওই জানোয়ারটাকে যোগ্য শাস্তি না দিতে পারা।শুধু মার খাওয়াটা ওর প্রাপ্য ছিলোনা।আমার তো ইচ্ছে করেছিলো,ওকে মেরে পুঁতে ফেলতে। কিন্তু আমার এখন যেটুকু ক্ষমতা হয়েছে, তখনতো ছিলো-না।থাকলে হয়তো ওর চিহ্নও রাখতাম না আমি। আর যেটুকু ছিলো,সেটুকু প্রয়োগ আমি করেছিলাম।আর সেটুকু প্রয়োগ করেই তো আমি তোমার কাছে খারাপ হয়ে গেলাম,লোভী হয়ে গেলাম।আর তোমার ওই দুশ্চরিত্র প্রেমিকের গায়ে হাত তুলে পাপিষ্ঠও হয়ে গেলাম, তাই না?

স্পষ্ট ভৎসনা!রাগ ক্ষোভ যেনো ঠিহরে পড়ছে পুরুষালী স্বরে।সেদিন তো রাগে-ক্ষোভে লোভী আর আবোলতাবোল কথাগুলো বলে ফেলেছিলো মান্যতা।কারণটা তো ছেলেটাকে মারার উদ্দেশ্য নয়,তার চুপিচুপি সম্পর্কটা দাদাভাইয়ের সম্মুখে উন্মোচন করার ক্ষোভে, রাগে।তৃনয় যখন ছেলেটা আর ছেলেটার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জেনেছিলো, তখন তারকাছে প্রকাশ না করে দাদাভাইয়ের কাছে কেনো জানালো?যার বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি এবং দাদাভাইয়ের কতো ভারী ভারী কথা শুনতে হয়েছিলো তাকে।সেসব রাগ ক্ষোভইতো ঝেড়েছিল সে তৃনয়কে। পরে তো বুঝতে পেরেছিলো নিজের ভুল।গভীরভাবে ভেবেছিলো,আদৌও কি সে তখন তৃনয়ের বলা কথাগুলোকে বিশ্বাস করতো?ছেলেটাকে তো সৎ চরিত্রবান ভেবেছিলো বলেই তো সে সম্পর্কে জড়িয়েছিলো।কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিলো লোভ, নোংরামো।এটাতো তখন জানতো না মান্যতা।তাই তৃনয়ের কথাগুলো বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজনবোধও ছিলোনা।এসব ভেবে বেচারা মনেমনে ভিষণ অনুতপ্ত হয়েছিলো।তবে তৃনয়কে উল্টো পাল্টা ব্লেম করে যে ভুলটা করেছিলো সেদিন,তার ভুলের স্বীকারোক্তি দেওয়া হয়নি।যা আজ অনন্য রাগক্ষোভের সাথেও প্রকাশ করে চলেছে তৃনয়।তবে যে সম্পর্কের লজ্জায় মানুষটার সম্মুখে সে দাঁড়াতে পারেনা,মুলত দাঁড়াতে চায়না।সেই সম্পর্কটা নিয়ে পুনরায় আলোচনা,সর্বাঙ্গে অস্বস্তি ধরালো মান্যতাকে।ভিতরে ভিতরে লজ্জায় আড়ষ্ট করে তুললো।তবে কথাতো উঠতোই!

‘ওসব পুরানো কথা ঘেঁটে লাভ আছে?যেটার জন্য আপনাকে ডাকা সেটা নিয়ে কথা বলাই ভালো।আমরা সেটা…

‘লাভ নেই মানে?অবশ্যই লাভ আছে।তুমি কি কারণে আমার সাথে কথা বলোনা?কেনো আমার সম্মুখীন হও না?কারন তো ওই একটাই।নাহলে আগে তো একটা সহজ সরল সম্পর্ক ছিলো আমাদের।কথা কম হলেও, দেখা হলে এড়িয়েতো যেতে না।অন্তত সৌজন্যেবোধ রক্ষার্থে ভালোমন্দ আলাপন তো হতো আমাদের।তবে সেদিনের ঘটনার পর তা কেনো হয়না,মান্যতা?

তৃনয়ের কথাগুলো তো অক্ষরে অক্ষরে সত্য।বিধায় মান্যতা জবাব দিতে পারলো-না।প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললো- আমি আপতত বিয়ে করতে চাইছি না।

‘বিয়েটা করতে চাইছোনা নাকি আমাকেই বিয়ে করতে চাইছোনা?

‘যেটা আপনার মনেহয়?

‘কেনো মান্যতা? আমি জানি আমি তোমার যোগ্য নই..

‘আপনার ধারনা ভুল!বরং আপনার মতো ছেলের যোগ্য আমি নই।

‘এটা তোমারও ভুল ধারনা।

‘কেনো বুঝতে চাইছেন না আপনি?

‘কি বুঝবো?বলো?যে ঘটনাটা ঘটে গেছে সেখানে তোমার হাত ছিলো-না।আর থাকলেও ছেলেটার খারাপ মানসিকতায় তো তুমি সঙ্গ দাওনি।তবে সমস্যা কোথায়?সেই দুদিনের সম্পর্কতো চুকেবুকে গেছে।সেটা মনে রেখে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো চলবেনা।সেখানে তুমি দাঁড়িয়ে থাকলেও আমি দাঁড়িয়ে নেই।আর না সেসব নিয়ে আমার সমস্যা আছে।সমস্যা নেই বলতে ভুল।সমস্যা ছিলো।তুমি যে হীনমন্যতায় ভুগছো!তার শতগুণ হীনমন্যতায়, অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছি আমি।বর্ণনা না করাই শ্রেয়।তবে একটা কথা কি জানো,আমরা যাকে মন থেকে চাই।পছন্দ করি।তাদের করা হাজার ভুল,অন্যায়গুলো কেমন ভুল অন্যায় বলে মনে হলেও,মনকে মানাতে পারিনা।মস্তিষ্ক চোখে আঙুল দিয়ে বারবার সেই ভুল অন্যায়গুলো উল্লেখ্য করলেও,
মন মানতে চায়-না সেসব ভুল অন্যায়।মনমস্তিস্কের টানাপোড়েন যেভাবে হোক মন জিততে চায়।মন হাজার যুক্ত দেখিয়ে মস্তিষ্ককে হার মানাতে চায়।সেই মানুষটার দোষ, ত্রুটি, না জেনে করা ভুল, অন্যায়গুলো সবকিছু ক্ষমা করে দিতে চায়।বেহায়া মন তবুও তাকেই পেতে চায়।আমার মনেহয় কি জানো?কারও গভীর প্রেমে পড়লে বা কাওকে মন থেকে পাগলের মতো চাইলে, ভালোবাসলে।সেই প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে একটা বিশেষ গুন থাকা অবশ্যই দরকার।আমার মনেহয় থাকতেই হয়।আর তা নিজেকে বেহায়া বা লজ্জাহীনতা করা।সেখানে হয়তো নিজের আত্মসম্মানবোধ বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা।তবুও সই, সেই বেহায়া নির্লজ্জ মন বারংবার তাকেই পেতে চায়।

মান্যতা কাঠ পুতুলের মতো স্থির হয়ে কথাগুলো গিলে চলেছে।কথাগুলো কেমন যেনো দোদুল্যমান মনে ঝড় তুলে দিয়েছে।তৃনয় যেনো এতোদিনের সবকিছুর রাগ ক্ষোভ কথার উপর কথায় উগরে চলেছে।সাথে নিজের অনুভূতিগুলো অকপটে স্বীকার করে চলেছে।যা এতোদিন নিজে ভিতরে চেপে রেখেছিলো।বহিঃপ্রকাশ করতে পারিনি।একটু থেমে নিজেকে শান্ত করলো তৃনয়।বলতে বলতে বেশিই বলে ফেলেছে হয়তো।এতোকিছু বলা উচিত হয়নি।কিন্তু কি করবে সে।
নিজের অনুভূতি প্রকাশে অক্ষর তৃনয়,হারাতে হারাতে নিজের প্রেয়সীকে ফের ফিরে পাওয়া।নিজের প্রতি এবং মেয়েটার প্রতি চাপা ক্ষোভ, রাগ থেকে কথাগুলো বেরিয়ে এসেছে।যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়োও পারিনি সে।বলেছে বেশ করেছে তাতে যা হয় হবে।একটু সময় নিয়ে শান্ত কন্ঠে ফের বললো–

‘আর যে হারে বিয়ের প্রস্তাব আসছে তোমার,আজ না-হয় কাল বা পৌরশু। বিয়ের জন্য মতামত তোমাকে দিতেই হবে।সেখানে পিছনের সবকিছু ভুলে তুমি যদি অন্য কাউকে মেনে নিতে পারো,তবে সেই অন্যকেউ আমি নই কেনো?আর আমি হলেই বা সমস্যা কোথায়?

আপনি বলেই তো সমস্যা।যাকে দেখলে প্রতিনিয়ত মনেহবে,এই মানুষটা তার এক বাজে অতীত সম্পর্কে জানে।অতীতে খারাপ একটা ছেলের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো,সেই ছেলেটা তারসাথে কি করতে চেয়েছিলো সেসব জানে।প্রতিটি মূহুর্ত এসব আড়ষ্টতা,খারাপ লাগা,লজ্জা নিয়ে এই মানুষটার সাথে অমৃত্যু পর্যন্ত সংসার করে যাবে কিকরে মান্যতা?একজন অপরিচিত মানুষ হলে তো,নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করলেও তার সামনে অন্তত আড়ষ্টতা থাকতে হবেনা।মনেমনে কথাগুলো আওড়ে গেলেও মুখে কথাগুলো বলতে পারলোনা মান্যতা।আর না তৃনয়ের কথাগুলোর উত্তর দিতে পারলো।ঠিক কি উত্তর দেওয়া উচিত?এটাই সে ভেবে পেলোনা।

‘কি হলো?উত্তর দেবেনা,সেই অন্য কেউ আমি নই কেনো?নাকি সত্যিই আমাকে তোমার যোগ্য বলে মনে হয়ন…

‘আমার সময় চাই!

তৃনয়ের মুখের কথা কেড়ে নিলো মান্যতা।তোমার যোগ্য নই,এই একটা কথার জন্যই বারবার দূর্বল হতে হচ্ছে তাকে।চিন্তা ভাবনা সব থামিয়ে দিতে হচ্ছে সেখানে!আর সেই কথাটারই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে যেনো বারবার তৃনয়।

‘ঠিক আছে।তবে তুমি যে বিষয়টা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছো,সেটা ছাড়া অন্যকিছু ভাবার জন্য যতো সময় চাই,সময় নাও। তবে উল্টোপাল্টা ভেবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগো না।সময় চাইছো,সময় নাও।কেউ তোমাকে প্রেশার দেবেনা।তাঁরপর তোমার সিদ্ধান্ত হ্যা না যেটাই হোক, আমি মেনে নেবো।যদিও আঙ্কেলের কাছে আমি তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব রেখে ফেলেছি।নিভানকেও জানিয়েছি ব্যাপারটা।তবুও তারা যদি তাদের নির্ধারিত সিদ্ধান্তটস তোমার উপর বর্তায়, তবে তা মানিয়ে নিতে বাধ্য হতে হতে হবেনা।আমি বিষয়টা
বুঝে বলবো না-হয়।তারপরও সময় যখন নিচ্ছো আরেকটাবার ভেবে দেখো।

একটু সময় নিয়ে চুপ থেকে তৃনয় ফের বললো–আমার মনেহয় আমাদের কথা শেষ হয়ে গেছে।উঠছি।

উঠে দাঁড়ালো তৃনয়।মাথা নিচু করে তখনো মান্যতা হাত কচলে চলেছে।তবে তৃনয়ের কথা পরিবর্তে মুখে টুঁশব্দ উচ্চারণ করলো-না।বিকালের নরম আলোয় হালকা গোলাপি রঙের সেলোয়ার-কামিজটা মেয়েটার গায়ের রঙের সাথে মিলেমিশে একাকার।গোলাপি ওড়নাটা মাথায় সুন্দর করে চাপানো।মনের ভিতরের টানাপোড়েনের যন্ত্রনায় এককভাবে হাত কচলে যাচ্ছে।সেটা খেয়াল করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৃনয়। সামনের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলো সে।কেমন শ্রান্ত গলায় বাললো–তোমার সিদ্ধান্ত যদি না হয়, আজকের পর আর তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলবো না।আর না কখনো তোমার সম্মুখীন হয়ে তোমাকে লজ্জা,বিড়ম্বনায় ফেলবো।আসছি বাধ্যতা।

“বাধ্যতা” আবারও সেই নাম।যো নামটা একসময় মশকরা করে ডাকতো তৃনয়,তা আজ কেমন আবেগে পরিপূর্ণ।এবার গলায় সেই মশকরা বা ফাজলামোর কোনো রেশ নেই।সেখানে ওই ডাকটা জানান দিচ্ছে একগুচ্ছ আবেগ,অনুভূতি।ভিতর থেকে কিছু একটা ঠেলে গিয়ে গলায় দলাপাকিয়ে গেলো মান্যতার।মন কেমন কেমন করে উঠলো।তবুও মুখ উচু করে সেই পুরুষটার চলে যাওয়া দেখলোনা সে।দোটানায় মনটা তখনো ছটফটিয়ে চলেছে।এখন কি করবে সে?

ঘড়ির কাঁটাটা সময়টা রাত সাড়ে দশটার কাঁটায়।চারপাশটা কেমন মনেহচ্ছে গভীর রাত।শহরে এই সাড়ে দশটা যেনো সন্ধ্যা। অথচ সন্ধ্যা নামতেই এবাড়ির আশপাশটা কেমন ঘনো,গাঢ় অন্ধকারত্বে ডুবে গিয়েছে।কৃত্রিম আলোও যেনো সেই গাঢ় অন্ধকারের ঘনত্ব কাটাতে পারছে-না।গাছপালায় আচ্ছাদিত মধ্যমনি হয়ে থাকা বাড়িটা যেনো কেমন ভুতড়ে বাড়ি বলে মনে হলো কৌড়ির।তাতে বাড়িটায় মানুষজন এতো কম,সাথে সেই কমসংখ্যক মানুষগুলোও কেমন শান্তশিষ্ট,চুপচাপ। সেজন্য বাড়িটা আরও নিরিবিলি ঠেকছে।যে ঘরটাতে তাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে, সেই ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালো কৌড়ি।পুরানো বাড়িটায় থাকার রুমগুলো বেশ বড়বড়।সাথে খোলা বারান্দা, বাথরুম। সবকিছুই যেনো বিশালকার।বাড়িটা পুরনো আমলের তৈরী।সামনে যেমন বিভিন্ন গাছপালার বাগান, পিছনেও বিশাল আকারের শানবাধানো একটা পুকুর রয়েছে। যার চারপাশেও বড় বড় আমগাছ,আরও বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো।পুকুরের ওপারেও বিশাল বাঁশঝাড় আর কাঠবাগান।কৌড়ি আশ্চর্য হয়েছে শহরের মধ্যেও পুকুরওয়ালা বাড়ি হয়!বিকালে বাড়িটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে তাকে ছোটো চাচাশ্বশুরের মেয়ে ইতু।মেয়েটা ভারী মিষ্টি। একটু চঞ্চল স্বভাবের, কথাও বলে প্রচুর।তবে ভিষন মিশুকে।ছোটো চাচাশ্বশুরের দুই মেয়ে।একজন দেখে হঠাৎ যেনো মান্যতা কথা মনে হলো তো আরেকজন যেনো মৌনতা।চাচাশ্বশুড়ীর দৌলতে সাক্ষাতের পর কৌড়ির দুজনকে দেখে অন্তত তাই মনে হয়েছে।বয়সেও যেমন।পড়ালেখায়ও তারা যেনো মান্যতা আর মৌনতার সমবয়সী।বড়মেয়েটা অসুস্থ থাকায় ভালোমন্দ আলাপন ছাড়া সেভাবে তারসাথে কথা হয়নি।তবে ছোটোটার সাথে দীর্ঘসময় কাটানো হয়েছে।

ভাবনার একপর্যায়ে নিজের দিকে তাকালো কৌড়ি।নিজের সাজ থেকে কিছুটা আড়ষ্টতা অনুভব করলো।তন্মধ্যে গম্ভীর স্বরের ডাক পড়লো।

‘কৌড়ি,আমি এখানে।এসো।

পুনরায় নিজের দিকে একবার লক্ষ্য করলো কৌড়ি।নতুন পাটভাঙা গাঢ় লাল একটা জামদানি শাড়ী পরা।ছোটো চাচিশ্বশুড়ী ভিষন মিষ্টি ভাষী এবং সোজাসাপটা দিলখোলা মানুষ।মেয়েদের সাথেও বন্ধুসুলভ আচারণ উনার।সেই আচারণ কৌড়ির উপরও প্রভাব ফেলেছে। দুপুর হতে এটুকু সময়ের মধ্যে নিজের, নিজের বাপের বাড়ির,এবাড়ির অনেক কিছুই মনখুলে গল্প করেছেন তিনি।তার আচারণে কৌড়ির মনে হয়নি,সে প্রথপ্রথম এবাড়িতে এসেছে এবং এই মানুষটাকে এই প্রথম দেখেছে।বরং এরকমটা মনে হয়েছে তিনি যেনো তার কতোদিনের চেনাজেনা।সেই মানুষটা রাতের খাবার পর,কৌড়িকে ডেকে নিয়ে তার পরিহিত শাড়ীটা পাল্টে দিয়ে সেখানে নতুন এই জামদানী শাড়ীটা আটপৌড়ে করে তাকে পরিয়ে দিয়েছেন।আর গহনাতো কৌড়ির পরাই ছিলো।এক্সট্রা মাথায় একটা টিকলি ঝুলিয়ে দিয়েছেন।তারপর তাকে দেখে হাজারও প্রশংসার বার্তা ছুঁড়ে দুষ্টমিষ্টি গলায় আরও বলেছেন–বিয়ে হলে নতুন নতুন সবসময় একটু সেজেগুজে থাকতে হয়।

চাচীশ্বাশুড়ীর এরকম দিলখোলা কথায় কি-যে লজ্জায় পড়েছিলো কৌড়ি।উফফ!এখন মনেহচ্ছে রুমে আসার থেকে উনার ওখানে থাকা উচিত ছিলো।

‘কি হলো,এসো।

ফের ডাকে সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো কৌড়ি।ধীর কদমে পা বাড়ালো কাঙ্ক্ষিত মানুষটার ডাকে।
বিশাল খোলা বারান্দায় সটান দাঁড়িয়ে আছে নিভান।এই বারান্দায় দাঁড়ালে না সামনে দেখা যায় না পিছন।রুমটা বাড়িটার হয়তো সাইডে।কৌড়ি নজর ঘুরিয়ে ফিরেয়ে দেখলো,হ্যা রুমটা বাড়টিটার দক্ষিন পাশে।

‘দাঁড়িয়ে পড়লে কেনো?কাছে এসো।

কাছে এসো কথাটায় ভিতরটা কেমন যেনো উথলপাথল করে উঠলো।তবুও কৌড়ি এগিয়ে গেলো।তাকে পাশাপাশি দাঁড়ানোর সুযোগ না দিয়ে নিভান। কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো।একদম শক্তপোক্ত বাঁধনে।পরপর ঘনো চুম্বনে ছুঁয়ে দিলো কৌড়ির মাথার সিঁথি আর কপাল।ফের বললো।

‘আমার কাছে একটুও আসতে ইচ্ছে করেনা,তাই না?

উত্তর দেওয়ার পর্যায়ে নেই কৌড়ি।তবে সকল লজ্জা কাটিয়ে নিবিড়ভাবে মাথা চেপে দিলো অভিযোগ করা মানুষটার বুকে।নীরবে দু’হাতের মুঠোয় খামচে ধরলো সেই মানুষটার গায়ের পিঠের অংশের শার্ট।ফের ভিতরের আড়ষ্টতা কাটিয়ে নিজেও একটু নিবিড় হলো সেই পুরুষসলী শরীরের সাথে মিশে গিয়ে।কৌড়ির মনেহলো মানুষটা যেনো কতমূহর্ত ধরে তাকে কাছে পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলো।আর সেই অপেক্ষাটা মৃদু অভিযোগের শব্দ হয়ে ঝরেছে।যার উত্তরও কৌড়ি মুখে নাহলেও,নিজের কর্ম দ্বারা দিয়ে দিয়েছে।হয়তো সেই মানুষটাও সেটা উপলব্ধি করে আর কথা বাড়াইনি।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে