ফুলকৌড়ি পর্ব-৪৮+৪৯

0
9

#ফুলকৌড়ি
(৪৮)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বিয়ে বাড়ি মানেই আমেজ উল্লাস।সাজগোছ। হৈহুল্লোড়।আনন্দ খুশির উৎসব।সকাল হতেই পুরো বাড়িটা যেনো সেরকম আমোজে ছেয়ে আছে।বাড়ির গৃহিণীদের হাতে গত দুদিন রান্নার আয়োজন না থাকলেও,নাস্তাপানির আয়োজনে হুলুস্থুল ব্যস্ত তারা।বিশেষ করে নীহারিকা বেগমের যেনো একদন্ড কোথাও বসার বা জিরোনার ফুরসত নেই।সমানতালে মেহমানদের আবদার অনাবদারের ঝুড়িঝুড়ি আহ্লাদ মিটিয়ে চলেছেন,স্বান্তনা রহমান আর রানিসাহেবাও।সাথে নিভানের মামিরাও হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দেওয়ার প্রয়াস করছেন।তবে কোনো গল্পের আসরে ভাগ্যবশত মজে গেলে আর দেখা নেই তাদের।তা নিয়ে মাথাব্যথা বা কোনো ক্ষোভ নেই,বাড়ির সুগৃহীনিদের।যেখানে বাড়ির মানুষেরাই মেহমান সেজে বসে আছে,সেখানে বাড়ির মেহমানরা টুকিটাকিও কাজে হাত লাগাক,চান না নীহারিকা বেগম নিজেই।ব্যাথা-বেদনায় শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা থাকলেও তিনি কাজে তৎপর।বাড়ির বড়ো গিন্নি।আবার নিজের ছেলের বিয়ে বলে কথা।

বাড়ির পুরুষেরা,বাহিরে ক্যাটারিংয়ের লোকরা রান্নাবান্নাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত, সেখানের দেখাশোনায় মনস্থ।তৎপর।সেখানেও অবাধ নাস্তাপানির ব্যবস্থায় নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে।আর বাড়ির বড়ো গিন্নি হিসাবে সবদিকে খেয়াল রাখার দ্বায় বলেও উনি মনে করেন।কাজের একফাঁকে নিভানের ঘরে উঁকি দিলেন তিনি।ঘর আপতত ফাঁকা,রুমে কেউ নেই।রুমে ঢুকলেন তিনি।শান্ত নীরব ঘরটা একপলক অবলোকন করলেন।
শৌখিনতা ছোঁয়ায় সবসময় পরিপাটি থাকা ঘরটা,আজ এলোমেলো অবস্থা।নিভান থাকাকালীন এ অবস্থা হওয়ার কথা নয়।তবে কাল রাতে তৃনয়সহ নিভানের কয়েকজন বন্ধু থাকায় রুমের এহেন এলোমেলো দশা।বুঝলেন নীহারিকা বেগম। ত্রস্ত হাতে গুছিয়ে দিলেন ঘরটা।ফের একপলক দেখলেন। দুপুরের পর এঘরে বউ আসবে উনার।এআশা কতো দিনের!সে আশা পূর্ণ হতে চলেছে।নিভান পূরণ করতে চলেছে।মনেমনে আনন্দ উপভোগ করলেন।ঘরটা গুছিয়ে যখন চলে যাবেন,বেলকনি থেকে নিভানের গলার আওয়াজ এলো।

‘মা,কিছু বলতে এসেছিলে?

চমকে বেলকনির দিকে চোখ গেলো নীহারিকা বেগমের।সহসা বললেন–তুই ওখানে।আমি এতোসময় তোর রুমে,দেখলি না?

দেখিনি নিভান।বেলকনিতে দাঁড়িয়ে লন এরিয়ায় নজর ছিলো তার।সেখানে হলুদ মেহেন্দি বিগত দুইদিনের আনুষ্ঠানিকতার সকল সাজসজ্জ নষ্ট করে,বিয়ে উপলক্ষে কাল রাত থেকে পুনরায় ইভেন্টের লোকজন সজ্জিত করেছে।কাজ সকাল সকাল কমপ্লিট হয়ে গেলেও তারা বিশেষ তদারকীতে তৎপর হয়ে আছে ।কোথাও কোনো কিছুর খামতি থেকে গেছে কি-না!বা ঘাটতি আছে কি-না।সৌন্দর্যবর্ধনে ঠিকঠাক লাগছে কি-না।নিভানও যেনো খেয়ালি নজরে সেটাই দেখছিলো।যদিও ওখানে খেয়াল রাখার বিশেষ দায়িত্বে মামারা আছেন।তবুও কিসব মনে করে দেখছিলো সে।
হঠাৎ রুমের মধ্যে শব্দ পাওয়ায়,মনেহলো রুমে কেউ এসেছে।মা’কে রুম থেকে বেট হতে দেখেই ততক্ষণাত প্রশ্নটা শুধালো সে।

‘আমি খেয়াল করিনি তুমি কখন এসেছো।

কথাগুলো বলতে বলতে রুমে ঢুকলো নিভান।মা’কে টেনে নিয়ে বসালে বেডে।ফের মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।মায়ের হাতটা নিয়ে রাখলো মাথায়।নীহারিকা বেগম তৎপর হলেন ছেলের ঘন চুলে আঙুল চালাতে।সময় নিয়ে বললেন।

‘আজ কয়েকদিন তো বেশ ঘুমের ঘাটতি যাচ্ছে।মাথা ধরেছে নিশ্চয়?

‘ওই একটু।

কিছুসময় নীরবে কেটে গেলো।নিরবতা কেটে নিভান শুধালো।-বললে নাতো,কিছু বলবে বলে কি এসেছিলে?

‘না।তেমন কিছু না।তুই কি করছিস।তাই দেখতে এলাম।সকালের খাবারটাও তো এখনো খেলিনা।তাই আর কি।

আবারও কিছু সময় নীরবতা চললো দু’পাশে। এবার নীহারিকা বেগম কথা পাড়লেন।বললেন–তোর দাদুমাকে তোর বিয়ের কথা জানাবি-না?তুই কিন্তু ওই বংশের বড়ছেলে এবং উনার বড় নাতী।যাই হয়ে যাক,সেই নাতীর বিয়েতে কিন্তু উনার থাকা উচিত।

‘ইনভাইটেশন কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছি তো।সাথে দাদুমা আর ছোটো চাচ্চুর সাথেও কথা হয়েছে।দাদুমা অসুস্থ, ব্যথা বেদনায় বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছেন-না নাকি।ছোটো চাচ্চুও উনাকে ছেড়ে কাল আসতে পারেন-নি।আর এমনিতেই সবকিছুতো কেমন হঠাৎই হচ্ছে।তবে দাদুমা না আসলেও চাচ্চু বলেছেন,আজ বিয়েতে অবশ্যই আসবেন তিনি।

নীহারিকা বেগম ছেলের দায়িত্ববোধ দেখে খুশি হলেন।খুশিতে আপ্লুত হয়ে ছেলের কপালে চুমু-ও বসালেন।ফের আবেগে বলে বসলেন–তুই আমার খুব ভালো ছেলে।আমার গর্ভ সার্থক।আমি সত্যিই রত্নগর্ভা মা।

চোখ মেলে মায়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকালো নিভান।খুশিতে ঝলমলে মুখটা দেখলো কিছুক্ষণ। ফের মায়ের মাথাটা হাত দিয়ে নিচু করে নিয়ে কপালে গাঢ় চুমু খেলো।মৃদুহেসে কেমন আদূরে কন্ঠে সে-ও জানালো।

‘তুমিও আমার সেই শান্তিময়ী মা।যার গর্ভে জন্ম নিয়ে আমিও সন্তান স্বার্থক।

নীহারিকা বেগম আবেগপ্রবণ হলেন।সেই আবেগের ঝরঝর বর্ষন ছেলের কপালে দীর্ঘ সময় ঠোঁট ছুয়ে ঝড়লেন তিনি।নিভানও চোখ বুঁজে কেমন নিশ্চুপ রইল সেই আদরে।

সকাল কেটে গিয়ে যখন দুপুর হতে লাগলো।সাজসাজ রবে চারিদকে হৈচৈ পড়ে গেলো।সকাল দশটা বাজতেই পাল্লারের কিছু মেয়েরা এসে হাজির বাড়িতে।সবকিছু ওই মানুষটার সিদ্ধান্ত মতো বাড়িতেই হচ্ছে।সময় যতো এগোতে লাগলো ভিতরের আবেগ অনুভূতির উৎকন্ঠা যেনো ততোই তীব্রহারে বাড়তে থাকলো।বুকের ভিতরের স্বাভাবিক থাকা সকল যন্ত্র আজ অনিয়ন্ত্রিত।সবকিছুর অস্বাভাবিকতা,উৎকন্ঠা সেকেন্ডে সেকেন্ডে টের পাচ্ছে কৌড়ি।সমুদ্রের উত্তাল ঝড় বয়ে চলেছে যেনো ভিতরে।সকাল থেকেই আজ বিয়ের দিন কথাটা যতবার শুনছে,ততোবার সেই ঝড়ের প্রখরতা যেনো ভিতরে ভিতরে বেড়েই চলেছে।সেই অস্বাভাবিক প্রখরতা চৌগুন হারে গিয়ে টের পেল, যখন পার্লার থেকে আগত দুজন মেয়ে তাকে সাজাতে বসালো।মান্যতার রুমে দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে এ-সি ছেড়ে মেয়েদুটো আধাঘন্টা আগেই তাকে সাজাতে বসেছে।রুমে পার্লারের দুটো মেয়ে আর সে বাদে আপতত কেউ নেই।সাধারণ সাজ দিতে বলা হয়েছে।অতিরঞ্জিত কোনো কিছু নয়।সেভাবেই সাজানো হচ্ছে।

গাঢ় লাল রঙের শাড়ীটাতে সোনালী জরির কাজ।এতো ভারী কাজ,শাড়ীর লাল অংশবিশেষগুলো খুব কম নজরে পড়ছে। বোঝা যাচ্ছে।মনেহচ্ছে লাল নয়,সোনার সুতোয় গাঁথা কারুকার্যের বুননে শাড়ীটা।সাথে কনুই পর্যন্ত একই বুননে ডিজাইনার ম্যাচিং ব্লাউজ। হয়তো দামী শাড়ীর সাথে এরূপ ম্যাচিং ব্লাউজ থাকাটা শোভনীয়।সেই ভারী শাড়ীটা সুনিপুণ সুদক্ষ হাতে পাল্লারের সুন্দরী এক রমীনি তাকে পরিয়ে দিয়েছে।ব্লাউজ পেটিকোট আগেই পরা ছিলো।শাড়ীটা পরিয়ে মেয়েটা যেনো হাফ ছাড়লো।কৌড়িরও মনেহলো সুদক্ষ হাত হলেও শাড়িটা পরাতে মেয়েটাকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।তবে শাড়ী পরানো শেষে মেয়েটা কৌড়ির দিকে তাকিয়ে কেমন মুগ্ধ গলায় বললো।–মাশা-আল্লাহ।যে আপনাকে পছন্দ করে স্যারের সাথে বিয়ে দিচ্ছেন, তার পছন্দও যেমন অতুলনীয়।যে এই শাড়ীটা পছন্দ করে কিনেছে।মাশাআল্লাহ।উনার পছন্দ এবং রুচিশীলতা প্রসংশাযোগ্য।

পাশে এসিস্ট করা মেয়েটাও কেমন হাস্যজ্বল মুগ্ধ বদনে সেকথার সায় জানালো।সামনে আয়না।মেয়েটার কথার জৌলুশে আপ্লুত হয়ে,একরাশ লজ্জা সীমাহীন উৎকন্ঠা নিয়েও দেখলো নিজেকে।আজ তিনদিন ভিন্ন রঙায় একটানা শাড়ী পড়ছে সে।আগের দুদিনও নিজেকে দেখে কেমন অন্যরকম মনে হয়েছিলো। একটা আলাদা মানুষ।আলাদা রূপ সৌন্দর্য।আজও তাই।কেমন যেনো অন্যরকম। নিজেকে চেনা দ্বায়।অথচ এখনো মেকাপের প্রলেপে সাজানো হয়নি তাকে।গহনার বড়বড় বক্সগুলো ড্রেসিং টেবিলের উপরে থাকেথাকে রাখা।সবকিছু ওই মানুষটার পছন্দে কেনা।সে-ও তো ওই মানুষটার একান্ত পছন্দ।শিহরণ দিয়ে উঠলো শরীর।একেএকে ছুঁয়ে যাবে, ওই মানুষটার পছন্দনীয় সবকিছু তাকে।রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেমন শীতল স্রোতের প্রবাহ ছুটে চললো।সেই শীতলতায় কাটা দিয়ে উঠলো হাত পায়ের প্রত্যকটা লোমকূপ। হঠাৎ নজর গেলো টেবিলের উপরে রাখা নিজের ফোনটায়।কালকের বিকালের পর মানুষটা কেমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। না মানুষটার দেখা পেয়েছে আর না কথা হয়েছে তাদের।কাল মানুষটার কথাবার্তাগুলোও কেমন যেনো অদ্ভুত অদ্ভুত লেগেছে কৌড়ির কাছে,সাথে মানুষটাকেও।কি হয়েছে যানেনা কৌড়ি।কৌতূহল হলো জানার।তবে তার থেকেও বেশি মন আনচান করলো,ইচ্ছে জাগলো ওই মানুষটার সাথে একটু কথা বলার।কেনো জানেনা খুব ইচ্ছে জাগলো।ফোনটা হাতে নিলো কৌড়ি।আশেপাশে কে আছে,আর কাকে সে ফোন দিচ্ছে, এই সংকোচবোধ করলোনা। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই কল দিলো কাঙ্ক্ষিত নম্বরে।খুব বেশি সময় নিলোনা ওপাশ থেকে কলটা তুলতে।দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোনটা তুললো সে।চমৎকার মিষ্টি গলায় শুধালো।

‘কি হয়েছে কৌড়ি?এ্যানি প্রবলেম?

খুব স্বাভাবিক গলা।তবুও ধকধক করে বাড়লো হৃদযন্ত্রের গতিবেগ।ভিতরে তার তান্ডব চলতে থাকলেও উত্তর দিতে ভুললোনা কৌড়ি।সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো–উহুম।

নীরবতা চললো দু’পাশে। নিভান কি বুঝলো না বুঝলো সেই ছোটো উত্তরে।তবে আর প্রশ্ন করলো-না।অমায়িক মিষ্টি কন্ঠে জানালো—আমিও তো তোমার মতো রেডি হচ্ছি।তবে নো প্রবলেম,আমি লাইনে আছি।তুমি কানে ইয়ারফোন গুঁজে নিয়ে লাইনে থেকেই রেডি হও।হুমম?

‘হুমম।থ্যাঙ্কিউ।

কি আদুরে মিষ্টি সেই শব্দগুলোর স্বর।নিভান বিগলিত হলো।কন্ঠের ভাজে আরও নমনীয়তা ঢেলে ফের শুধালো–‘হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল দেই?

‘নাহ।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।রেডি হও তবে।আমি লাইনে আছি।

কৌড়ির কথা বলাতে পার্লারের মেয়েদুটোকে বিশেষ একটা আগ্রহবোধ হতে দেখালোনা।হবু বরের সাথে কথা বলা এযেনো এখন প্রচলন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাতে আবার বড়বড় ঐতিহ্যবাহী বিত্তশালী পরিবারের বিষশগুলোতো আলাদাই।কৌড়িকে কথা বলতে দেখে তন্মধ্যে পার্লারের মেয়েটা তাকে চেয়ারে বসতে ঈশারা করলো।ফের কথা কানটিনিউ করে যেতে বললো।কৌড়িও তাই করলো।ইয়ারফোন খুঁজে কানে লাগিয়ে বসেও পড়লো।অদ্ভুত টান তৈরী হতে শুরু করেছে মানুষটার উপর তার।সেখানে দ্বিধা সংকোচ রাখছেনা মন।লজ্জাগুলোও কেমন ভুলিয়ে দিচ্ছে।পুরো দু’ঘন্টা ধরে সাজালো পার্লারের মেয়েটা।দীঘল কালো চুলগুলো বাঁধতে গিয়ে তার সময় লেগেছে বেশি।শাড়ী পরানোর থেকেও তাকে ঝামেলা পোহাতে হয়েছে চুলে।তবে শাড়ী পরা থেকে শুরু করে প্রত্যহ সাজে, চুল বাধায়,গহনা পরায়, মেয়েটা প্রশংসা করে গেছে তার।আর ওপাশের মানুষটাও সেই প্রশংসা শুনেছে নিশ্চুপে।এই দু’ঘন্টায় ভুলেও ফোন কাটেননি তিনি।তবে বিশেষ কথাও হয়েছে তাদের, তেমনটাও নয়।তবে কেমন যেনো ফোন কাটতে ইচ্ছে হয়নি কৌড়ির।এমন পাগলামো কখনও করবে সে,আশা করেনি।তবে পাগলামোতে তীব্র প্রশ্রয় পেয়ে,নিজেও কেমন অটল ছিলো।নিভান নামক সুতোর টানটা যে তাকে বেশ মায়াময় টানে আঁকড়প নিয়েছে,এটাও বেশ উপলব্ধি করে ফেলেছে।

আজ শুক্রবার।বিয়ে বাদেও জুমা’র দিন হওয়ায়,সব ছেলেগুলো সকাল সকাল রেডি হয়ে নিয়েছে।জুমা’র নামাজ বাদেই বিয়ে পড়ানো হবে।গোসল সেরে নিজ নিজ সাজে প্রস্তুত সবাই।নিভানের রুমে এতোসময় সে একা একা রেডি হলেও এবার সেখানে হাজির হলো তৃনয় আর ইভান।সাদার উপরে গোল্ডেন কারুকার্য শোভিত শেরওয়ানি আর পাজামাতে সত্যিই বর বর লাগছে তাকে।শ্যামগায়ে মানিয়েছেও মাশাআল্লাহ।সবসময়ের মতো চুলগুলো জেন্টেলম্যানস লুকের মতো পরিপাটি।বিয়ে উপলক্ষে চুলে কাট দেওয়া হয়েছে।তাই আজ যেনো আরও পরিপাটি দেখাচ্ছে।খুব সাধারণ লুক।তবুও অসাধারণ সুদর্শন দেখাচ্ছে। ভাইকে দেখেই ইভান কেমন উচ্ছল গলায় বলে উঠলো—মাশা আল্লাহ।নজর না লাগযায়ে আমার ভ্রাতাশ্রীকে।

নিভান বিশেষ পাত্তা দিলো-না ইভানের কথায়।ইভান এসে দাঁড়ালো নিভানের সামনে।বললো– শেরওয়ানির সাথে সৌন্দর্যবর্ধনের গলার সেই হারটা, পরেছো কই?
আর শেরওয়ানিতে জড়ানো ওড়ানটাওতো গলায় জড়ালে না।

নিভান তখন আয়নার সামনে,নিজেকে ঠিকঠাক লাগছে কি-না দেখে নিতে ব্যস্ত। ইভান কথাটা বলতেই, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো–এই,আমি পুরুষ!মেয়েলোক নই যে, গলায় ভারী হার ঝুলাবো।ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে গায়ে ওড়নাও জড়াবো।ওসব চলবে-না।আমি এভাবেই কমফোর্টেবল।দ্যাটস এনাফ।

‘ওটা শুধু বিয়ে উপলক্ষ সৌন্দর্যবোধনে পরা হয়। সবসময় পরছো এমনতো নয়।তবে একটাদিনে সমস্যা কোথায়?

‘একদিন হোক বা রোজ।সমস্যা আমার রুচিতে।আমার সৌন্দর্যবর্ধনের দরকার নেই।আমি এভাবেই ঠিক আছি।

‘ওকে।বলে ইভান অলস ভঙ্গিতে বসে পড়লো বেডে।এবার ইভানের সুরে সুর মিলিয়ে তৃনয় বললো—সব নাহয় ঠিক আছে।তবে মাথায় পাগড়িটা পর।নাহলে বর আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য থাকলো কোথায়?কেমন একই রকম দেখতে সাজপোশাক লাগছে না!

‘তাতে আামাকে আমার বাউয়ের চিনে নিতে বিন্দুমাত্র আসুবিধা হবেনা,চল।আর নামাজটা তো আর পাগড়ি মাথায় দিয়ে হবে-না।টুপিতেই নামাজ সারতে হবে।সুতারং বিয়েটাও টুপিতেই সেরে নেবো।চল,চল।

তাড়া দিলো নিভান।এই ছেলেকে নিয়ে আর পারা গেলো না!বিড়বিড় করে বকে তৃনয়ও অলস ভঙ্গিতে বসে পড়লো ইভানের পাশে।ইভান এবার শুয়ে পড়লো।
অদ্ভুত নজরে দেখছে সে নিভানকে।দামী একসেট পাঞ্জাবি পাজামা।যদিও চুলের কাটসার্ট দিয়ে আজও মানুষটাকে হ্যান্ডসাম লাগছে।তবুও সেই জাঁকজমকপূর্ণ বর বর লাগছেনা।তবুও এভাবেই নাকি বিয়ে করতে যাবে!ধ্যাত।মানুষটা যে কি!ইভান তৃনয়কে লক্ষ্য করে নিভান বললো—আরেহ শুয়ে পড়লি কেনো ইভান?
নামাজের সময় চলে যাবেতো,চল।আলরেডি ১২.৪৫ অভার হয়ে গেছে।তৃনয়,তুই আবার বসলি কেনো?

তৃনয় কিছু বললোনা।ইভান বললো–ভাবছি।

নিভান এবার বিরক্ত হলো।বিরক্ত নিয়ে শুধালো।–কি ভাবছিস?

‘তোমার বিয়ে নাকি মুখভাতের অনুষ্ঠান।

নিভানের আরও বিরক্ত হওয়ার কথা।সেখানে ইভানের কথায় অমায়িক হাসলো সে।ফের নিজেকে আরও একবার দেখে নিয়ে পিছে মুড়ে ইভান আর তৃনয় দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললো–‘মুখে ভাতের অনুষ্ঠান ।তোরাও খেতে চাইলে আয়।আমি যাচ্ছি।

চলে গেলো নিভান।ইভান ডাকলো তবুও পিছে ফিরলো না।তৃনয় ডাকলো তবুও ফিরলোনা।হতাশ হলো দুজনে।ফের একই শব্দে বিড়বিড়ালো দুজনে–এ কেমন বর!যার লোকশরম,লাজলজ্জা কিচ্ছু নেই।যেখানে ভাইবন্ধুরা হাত ধরে তাকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাবে,আর সে লজ্জায় ঠিহরে মাথা নিচু করে ভাইবন্ধুর হাত চেপে ধরে থাকবে।তা না,ভাইবন্ধু রেখেই একা একা বিয়ে করতে চলে গেলো।আশ্চর্য ছেলে!


বাড়ির পাশেই জামেমসজিদ।বাড়ির ছোটো বড় সকল পুরুষ নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে মসজিদে আগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নিলো।সবাই একইসাথে যাবে।নিজের ঘর থেকে বের হয়ে নিভান সোজাা মায়ের ঘরে ঢুকলো।সেখানে নীহারিকা বেগম জাহিদ সাহেবকে প্রস্তুতি করাচ্ছিলেন।সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরিয়ে তাকে হুইলচেয়ার বসিয়ে গায়ে আতর লাগিয়ে দিচ্ছিলেন।
এমন সময় দরজায় টোকা পড়তেই জাহিদ সাহেব থেকে নিজেকে সরিয়ে আসার অনুমতি দিলেন।অনুমতি পেতেই নিভান ভিতরে ঢুকলো।মুগ্ধ নজরে নীহারিকা বেগম ছেলেকে দেখে গেলেন।তবে মুখে কিছু বললেননা।জাহিদ সাহেব কথা বাড়ালেন।

‘তুমি আসতে গেলে কেনো?আমিই তো আসছিলাম।

নিভান মৃদু হাসলো।সহসা উনার দিকে এগিয়ে একহাঁটু গেড়ে উনার সম্মুখে বসলো।উনার কোলের মধ্যে রাখা হাতটা উপর নিজের হাতটা কোমল স্পর্শে রাখলো।সেই স্পর্শে জাহিদ সাহেবের পুরুষ চওড়া হাতটা মৃদু কেপে উঠলো।এই স্পর্শের মালিকের প্রতি উনার ভিষণ মায়া, স্নেহ,দরদ,আবেগ।পোষা পাখি যে!লোকে বলে পোষা জিনিসের প্রতি আপন জিনিসের থেকে মায়া বেশি,দরদ বেশি।জাহিদ সাহেবের ভাবনার মধ্যে নিভান নম্র কন্ঠে শুধালো।

‘আপনি আমার এহেন সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট নন-তো?যদিও আজ বিয়ের দিন এমন প্রশ্ন বেমানান।

অবাক হলেন জাহিদ সাহেব।গলার স্বরেও তেমন অবাকতা ঢেলে শুধালেন–অসন্তুষ্ট কেনো হবো?

‘আপনি সবসময় আমার সকল সিদ্ধান্তকে প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছেন।আমার জীবনে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আপনার সিদ্ধান্ত জানতে চাইলাম না এজন্য?

অমায়িক হাসলেন জাহিদ।বয়স বাড়লেও সুদর্শন চেহারার জৌলুশতা এখনো কমেনি।বরং কাঁচাপাকা চাপদাড়িতে বেশ দেখায়।সেই মুখে হাসিটা যেনো আরও মুক্তোঝরায়।বাবার মুখের হাসিটাও তাকে বেশ আনন্দ দিতো।এরকম ঝলমলে ছিলো।নিভান সে মুখের দিকে চেয়ে রইলো নিষ্পলক। জাহিদ সাহেব নিজের হাতটা নিভানের হাতের নিচ থেকে টেনে নিয়ে, সেটা আবার ভারসাপূর্ন স্পর্শ নিভানের হাতের উপর রাখল।ফের অমায়িকতা কন্ঠে বললেন।

‘তুমিতো নিজের সিদ্ধান্ত জারী করার আগেই কৌড়িকে আমার কাছে চেয়েছিলে।তবে অসন্তুষ্ট হবো কেনো?আমি তখনই ভিষন খুশি হয়েছিলাম,যখন তুমি কৌড়িকে নিজের জন্য এবাড়িতে রাখতে চাইলে।ওই মেয়েটার বাবার কাছে আমি ঋনী।অসময়ের দূর্লভ বন্ধু আমার সে।আমি সেই মানুষটার কৃতজ্ঞতা, ঋন কখনো চোকাতে পারবো-না।তাই চেয়েছিলাম মেয়েটা যখন আমার ঋন শোধ করার কিছুটা সুযোগ দিয়েছে।তবে কৌড়ির সুখসমৃদ্ধি নিজ হাতে গুছিয়ে দেবো।তুমি আমার দায়িত্ববান বাচ্চা।আর সেই দায়িত্ববান সন্তানের অধিনে ওকে নিজের কাছে যখন রাখতে পারছি।এরচেয়ে ভালো সুখসমৃদ্ধি ওরজন্য আর কি হয়।আর দ্বিতীয়ত আমি কখনোই তোমার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হই-না।সিদ্ধান্ত ঠিকঠাক মনে না-হলেও,প্রশ্ন থাকে অন্তরে।তবে তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট কখনো হই-না।তুমি আমার প্রথম সন্তান।সেটা তুমি মানো আর না মানো।আমি মানি।মেনে এসেছি বরাবর। আর এটাও মনেপ্রাণে মানি, তুমি আমার দায়িত্ববান খুব ভালো বাচ্চা।বুঝদার বাচ্চা।তাই তুমি কখনো উল্টো পাল্টা সিদ্ধান্ত নেবে বা নিতে পারো বা ভুলভাল কাজ করবে?এটা আমি মানিনা।আমার মন মানেনা।আর সেই সিদ্ধান্তে আমি অসন্তুষ্ট হবো!এমন দিন কখনো না আসুক।এমন দিনটা আল্লাহ যেনো আমাকে না দেখান।তার আগেই মৃত্যু যেনো আমার দুয়ারে…

নিভান কথা শেষ করতে দিলো-না।তার আগেই হাত চেপে ধরলো উনার।সেই হাতটা নিজের মাথায় রেখে বললো—আপনি যেমন বাবা হয়ে আপনার সন্তানের অমঙ্গল কখনো আশংঙ্কা করেননা, চান-না।তেমন সেই সন্তানটাও তার বাবার মুখে এমন অমঙ্গলের কথা শুনতে চায়না।আশংঙ্কাও করেনা।মৃত্যু অপ্রিয় সত্যি।প্রতিটি প্রানীকে মৃত্যুর সম্মুখীন হতেই হবে।তবুও,আশংঙ্কা করেনা, শুনতে চায়না।আপনার কাছে একটাই চাওয়া পাওয়া আমার সবসময়।আপনার বড়ো সন্তান হিসাবে,আপনার দেওয়া দায়িত্ব কর্তব্যগুলো যেনো আমি নিষ্ঠার সাথে সর্বদাই পালন করে যেতে পারি।রবের কাছে আমার জন্য সবসময় সেই প্রার্থনাই করবেন।করে যাবেন।

‘আমার সকল প্রার্থনায় আমার সন্তানেরা।তোমরা।তোমাদের ভালোমন্দ প্রার্থনায় তো,বাবা হিসাবে আমার সর্বদা কাম্য।আমি সেই প্রার্থনাই সর্বদা উতালা হয়ে থাকি।আলাদা করে আমার সন্তানদের চাইতে হবেনা, এই বাবার দোয়া।আর তুমি।তুমি বাচ্চাটা আমার জীবনে কি?সেটা তুমি বুঝবে না নিভান।তবে বাবা হও, কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারবে।নিজের প্রথম সন্তান।সেটা রক্তের সম্পর্কিত হোক বা আত্মার।আর যেমনই হোক।তার প্রতি বাবা মায়ের ভালোবাসা, মায়া, টান, ঠিক কেমন হয়।সেটা বাবা না হওয়া অব্দি বুঝবে-না।উপলব্ধি করতে পারবে না।

শক্তপোক্ত মানুষটা হঠাৎই কেমন আবেগপ্রবণ হলেন।নিভানের গালে হাত ছোঁয়ালেন। ফের বললেন–আমি জানি, তুমি তোমার বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসতে।সেই বাবার ভালোবাসা ছাপিয়ে,তাকে হারিয়ে দ্বিতীয় আর কাওকে বাবা বলা তোমার ছোটো মন সায় দেয়নি।তবুও তোমার বাবা না ডাকটা আমাকে ক্ষুন্ন করে,কষ্ট দেয়।ব্যর্থতা জানান দেয়।মনেহয় আমি তোমার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারিনি।সত্যিই তো পারিনি।স্বার্থান্বেষীদের মতো তোমার ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা বিসর্জিত করে,আমার দায়িত্ব কর্তব্য সব তোমার উপর চাপিয়ে দিয়েছি।পারি-নি সন্তানের যথাযথ হক দিতে।সেখান থেকে ভাবলে মনেহয়,তুমি বাবা ডাকো-না।ভালোই করেছো।নাহলে এই ডাকটার ঋন তো থেকেই যেতো আমার।ডাকটার যথাযথ মূল্যায়ন না দিতে পারায় অপরাধবোধ নিয়েই বাঁচতে মরতে হতো আমাকে।

নিভান নিশ্চুপ শুনলো কথা।একটাও শব্দও উচ্চারণ করল না।যেনো উনার ভিতরে জমা নিজস্ব কথা নিজস্ব ব্যথাগুলো বের করে আনতে চাইলো।তাতে যদি মনে শান্তি মেলে।নীহারিকা বেগম তখন বাবা ছেলে থেকে অদুরে দাড়িয়ে দাঁতে দাত চেপে কান্না আঁটকে চলেছেন।নিভান,হুইলচেয়ারটা টেনে আরও ঘনিষ্ঠ হলো উনার সাথে।নিজের গালে ছোঁয়ানো হাতটা নিয়ে বুকে চেপে ধরলো।ফের নিজের শক্তপোক্ত খোলাসাটা ছেড়ে কেমন বাচ্চামো অবুঝ স্বরে বলতে থাকলো।

‘বাবাকে আমি খুব ভালোবাসতাম।এতো ভালোবাসতাম অতোটুকু বয়সে বাবাকে হারিয়ে বুঝতে পারলাম,আমার আর বাবার মতো ভালোবাসার মানুষ রইলো-না।মা’কে জিজ্ঞেস করুন,বাবা আমাকে মায়ের চেয়ে ভালোবাসতেন কিনা?সেই বাবার জায়গায় কিছুতেই মন থেকে অন্য কাওকে মেনে নিতে পারিনি।আমার বাচ্চা মন মেনে নেয়নি।বাবা ছাড়া বাবা ডাকটাও কাওকে ডাকা আমার ওই ছোট্টো মনটাও কেনো জানি সায় দেয়নি।দিতে চাইনি।আর যখন মনে সায় দিলো,তখন নিজের মধ্যে দ্বিধা কাজ করলো।বাবার মতো আদর যত্ন পাওয়া মানুষটাকে কিছুতেই আমার আর বাবা ডাকা হয়ে উঠলো-না।মন চাইলো অথচ মস্তিষ্কের বশিভূত আমি হতে পারলাম না।তবে
আপনাকে-ও আমি ভিষন ভালোবাসি।হয়তো বাবা ডাকটা ডেকে সেই ভালোবাসাটা জাহির করা হয়নি কখনো।তবুও প্রচন্ড ভালোবাসি।আমার জন্য আপনার অপরাধবোধ,ব্যথিত ধারনা ভুল।আপনি স্বার্থান্বেষী মানুষ নন।আর স্বার্থান্বেষী বাবাতো কখনো নন।আপনি খুব ভালো একজন বাবা।যে তার সন্তানদের বরাবর সমান প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছে।তাদের হক সমানভাবে যথাযথ পালন করার চেষ্টা করেছে।আর কে বলেছে,আপনি বাবা হিসাবে আমার যথাযথ দায়িত্ব পালন করেননি?করতে পারেননি?করেছেন।একজন বাবা হিসাবে যতোট দরকার ততোটাই করেছেন।বড়ো সন্তান হিসাবে আমার প্রতি হয়তো একটু বেশিই করেছেন।ইভান ভুল বলে-না।আপনার,মায়ের মনথেকে নজরে লাগা ভালোবাসাটতো আমিও অনুভব করি।

হাসলা নিভান।ফের বলতে থাকলো–আর আমার স্বপ্ন ইচ্ছে বিসর্জন দিয়ে, আপনার দায়িত্ব কর্তব্য কাঁধে নেওয়ার ব্যাপারটাকে আপনি আপনার স্বার্থপরতা ভেবে ব্যথিত হচ্ছেন?কেনো?সেই দায়িত্ব কর্তব্য তো পালন করতেই হতো আমাকে।বাবার অসুস্থতার অবর্তমানে বাড়ির বড় সন্তানের কাঁধে এসে,বাবার বর্তিত দায়িত্ব কর্তব্য তো পড়বেই।আর বাবা মা,ভাই বোনদের প্রতি সেই দায়িত্ব কর্তব্য পালনে কখনোই আমার অনিহা ছিলোনা।সেখানে স্বপ্ন ইচ্ছেতো বিসর্জন দিতেই হতো।তাওতো আপনি চেষ্টা কম করেননি,সেই স্বপ্নের পথে আমাকে এগিয়ে দিতে।আমি দায়িত্ব ছেড়ে এগোতে চায়নি।এখানে আপনার দোষ কোথায়?আপনার দোষ নেই তো।দোষী যদি হতে হয়,দু’জনেই।

এবার গাল ভরে হাসলো নিভান।ফের চমৎকার কন্ঠে বললো—-দোষী তো আমরাই দুজনে তাইনা?

হাসলেন জাহিদ সাহেবও।ভিতরটা যেনো নিভানের কথার যুক্তিতর্কে জুড়িয়ে গেলো উনার।নিভানের বুক থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দুহাতের কুটুরিতে তার মুখটা চেপে ধরলেন।পিতৃমন শিহরন দিয়ে উঠলো।ফের মুখটা টেনে নিয়ে স্নেহপূর্ণ চুমু বসালেন নিভানের চওড়া কপালে।নীহারিকা বেগম আর দূরে দাড়িয়ে থাকতে পারলেন না।দুজনের পাশে এসে দাড়ালেন।একটু মুড়ে নিজেও নিভানের মাথায় আদর ছুঁয়ে দিলেন।ফের সরে গিয়ে চুপ করে দাঁড়ালেন।জাহিদ সাহেব কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে নিভানের মুখের দিকে মায়াময় নজরে তাকিয়ে কন্ঠে মাধুর্যতা ঢেলে বললেন—খুব সুখি হও।

বিনিময় নিভান শুধু অমায়িক হাসলো।জাহিদ সাহেব কিছু একটা ভেবে নিভানকে ডেকে উঠলেন–নিভান।

‘বলুন।

‘আমি জানি কৌড়িকে তুমি খুব ভালো রাখবে।সেই ভরসা বিশ্বাস অগাধ তোমার প্রতি আমার।তবু-ও ওর বাবার হয়ে দায়িত্ব পালনের খাতিরে বলছি ,মেয়েটাকে ভালো রেখো নিভান।তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা রেখো, মেয়েটাকে খুব ভালো রাখতে।

মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে সম্মতি জানালো নিভান।ফের জাহিদ সাহেবের মাথায় টুপি পরিয়ে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে মসজিদে নামাজ অগ্রসর হলো।নিচে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেছে নমাজে যাবার। সবার গলার স্বর ছাড়িয়ে নাফিম আর ঈশিতা আপুর ছেলের অধৈর্য্যেময় কন্ঠের বার্তা শোনা গেল।–কখন যাবো আমরা নামাযে, আর কখন হবে বিয়ে!

বিশাল বড় লন এরিয়ারটা ইভেন্টের কর্মীরা সাজিয়েছে বেশ চমৎকার আভিজাত্যপূর্ন নজর ধাঁধানোরূপে।সম্পূর্ণ ফুলদিয়ে চমৎকার প্রদর্শনীর স্টেজটা বেশ নজর কাড়ছে।আর্টিফিশিয়াল দুধেসাধা আর গাঢ় লালফুলের কম্বিনেশনে সাজানো হয়েছে পুরো স্টেজের চারপাশটা।রঙিন কাপড় দিয়ে স্টেজের ছাঁদের সৌন্দর্যবর্ধনে,ফুলের বিশাল বিশাল ঝাড়বাতি বানিয়ে ঝুলানো হয়েছে।সামনের পুরো এরিয়াজুড়ে সৌখিনতার ছোঁয়ায় সাজানো গুছানো চেয়ার টেবিল।সেখানে আমন্ত্রণিত মানুষের ঢল।আপতত সবাই এখন স্টেজে নিশ্চুপ কাজীর মুখে পাঠকরা বানিগুলো শুনে যাচ্ছে।

স্টেজের প্রস্থ মাঝ বরাবর সটান বেলিফুলের শতশত মালার ঝুলানো গাঁথুনি দিয়ে পর্দা তৈরি করা হয়েছে।ফুলের ঘনত্ব এতো বেশি যে,এপাশ ওপাশের মানুষগুলোকে অনুভব করা ছাড়া কাউকে দেখা যাচ্ছেনা।যার একপাশে বসে আছে ছেলেরা অন্যপাশে মেয়েরা।নিস্তব্ধ, নীরব পরিবেশ।শুধু কাজীর মুখের নিটোল,সচ্চবানিগুলো ছাড়া কোথাও কোনো টু-শব্দটি নেই।অথচ কৌড়ি স্পষ্ট টের পাচ্ছ,তার ধকধক করে তড়পানো হৃদস্পন্দনের গতিবেগ।তার মনে হচ্ছে আশেপাশে মানুষগুলোও এই শব্দের স্পষ্টতা শুনতে পাচ্ছে।এই শব্দের সুচনাতো অনেক আগেই শুরু হয়েছে।তবে একধারে চলছে,তাকে স্টেজে আনার আগমুহূর্ত থেকে।রাজকীয় ভাবে তাকে স্টেজে আনা হয়েছে।কি হৈ-হুল্লোড়ের।মিষ্টি সম্মোধন,অভ্যর্থনা জানিয়ে তাকে স্টেজ পর্যন্ত আনা হলো।অদ্ভুত ফিল হয়েছে তার।আর এখন আর-ও অদ্ভুত অনুভব হচ্ছে।হাত পায়ের হীমভাবটা যেনো প্রকট হচ্ছে।শ্বাসপ্রশ্বাসের তাল হারিয়ে যাচ্ছে।ভাবনাগুলো কেমন খেই হারাচ্ছে।
আর এলোমেলো অনুভূতি আর ভাবনার মাঝে যখন স্পষ্ট পরিচিত কন্ঠের কবুল বার্তা শুনলো।সব অনুভূতির দুয়ার ঢ়েনো খিঁচে বন্ধ হয়ে গেলো।মুখ উঁচু করে তার সামনাসামনি বসা মানুষটার দিকে চেয়ে পড়লো।অথচ মানুষটাকে নয় নজরে পড়লো বেলিফুলের আচ্ছাদিত দেয়ালটা।অথচ নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইলো কৌরি।ফের কাজীর প্রতিটা বার্তা সমর্থন করে যখন আরও দুবার কবুল বললো।কৌড়ির তো হুঁশই উড়ে গেলো।হাত পায়ে হিম-ভাবের সাথেসাথে মৃদু কম্পনও শুরু হলো।সেই মৃদু কম্পন তীব্র হলো যখন একত্রে ওপাশের সবাই আলহামদুলিল্লাহ বাক্য বারবার আওড়াতে থাকলো।

কাজীসাহেব সময় নিয়ে ফের আবারও একই বানী আওড়াতে থাকলেন।মুখস্থ বানিগুলো একের এক শব্দ তুলে চঞ্চল স্বরে আওড়ে চললেন।তবে কি এবার তার পালা?হুঁশ ফিরলো কৌড়ির।তবে হাতে পায়ের শীতলভাব,কাঁপুনি বিন্দুমাত্রও কমলো-না।বরং বেড়েই গেলো।দুপাশে বসা ঈশিতা মান্যতা স্পষ্ট টের পেলো।তড়িৎ কৌড়ির হাতটা চেপে ধরে হাতের মুঠোয় নিলো ঈশিতা।মৃদু হেসে চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো।অপরপাশ থেকে মান্যতা আলতো স্পর্শে জড়িয়ে নিলো তাকে।তাতে কি কমলো তীব্রবেগে চলা হৃদযন্ত্রের উর্ধ্ব গতিবেগের শব্দ?কমলো কি হাতে পায়ের কাঁপুনি?শিরদাঁড়া বেয়ে চলা হিমশৈল ভাব?নাহ আরও তারা অস্থির করে তুললো কৌড়িকে।সেই অস্থিরভাব বাড়িয়ে দিয়ে ওপাশ থেকে কাজীসাহেব তার বানী শেষ করে মুখ্য শব্দে এসে থামলো।

‘বলুন মা,কুবল।

কৌড়ির সব আবেগ অনুভূতি এবার যেনো নিস্তব্ধ,শান্ত, নির্বাক হয়ে পড়লো।মূহুর্তেই গলা শুকিয়ে এলো।এবার অদ্ভুত অনুভতিতে বুকে খিল ধরে গেলো।কিসব হচ্ছে এসব!উফফ!স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে-ও যেনো বুকে বিঁধে এলো।তিনটে বর্নের একটা বাক্য আওড়াতে তাকে এমন অস্বাভাবিক করে কেনো তুলছে!অথচ ওপাশে একটা মানুষ ঠায় মাথা নিচু করে অপেক্ষা করে আছে, প্রিয় রমণীর মুখ থেকে কাঙ্ক্ষিত বর্নগুলো শোনার।কি অধীর অবর্ননীয় অপেক্ষা!তবে সে অপেক্ষায় তাড়াহুড়ো নেই।তার মনে হচ্ছে, যতো দেরী হয় হোক।যতো সময় নেয় নিক কৌড়ি,তবুও তিনবর্নের ওই শব্দটা বলা চাই।নিভানের হওয়া চাই তাকে।তবে নিভানের মতো ধৈর্য্য নিয়ে কাজী সাহেব বসে থাকতে পারলেন না।তিনি ফের মেলায়েম কন্ঠে বার্তা জানালেন।–বলুন মা,কবুল।

এবার ঈশিতা কৌড়ির হাত মৃদু ঝাঁকুনি দিলো।যার অর্থ কবুল বলে দাও।চোখ দিয়েও ঈশারা করলো।মান্যতাও অন্যপাশ দিয়ে মৃদুস্বরে বললো–কবুল বলে দাও কৌড়ি।

কাছাকাছি বসা বিথীসহ একেএকে ফিসফিসিয়ে সবাই বলতে থাকলো একই কথা।অথচ কৌড়ির শ্বাস কেমন রুদ্ধ হয়ে আসছে।সেই রুদ্ধশ্বাস গলায় আশেপাশে একবার তাকিয়ে মাথানিচু করে মৃদুস্বরে বলে দিলে কাঙ্ক্ষিত শব্দটা–কবুল।

কাজীসাহেব ফের বলতে বললেন।বলুন,আলহামদুলিল্লাহ তাকে আমি কবুল করিলাম।

আবারও রুদ্ধশ্বাস নিয়ে ফের কাজী সাহেবের বলা একই বানী দু’বার আওড়ালো।হয়ে গেলো সে একান্ত ওই মানুষটার।ওপাশ এপাশ সব পাশ থেকেই আলহামদুলিল্লাহ বার্তায় মুখোরিত হলো পরিবেশ।একপাল্লা হৈচৈ পড়লো।কৌড়ির তখন চোখ ফেটে কান্না এলো।কি কারনে কান্না এতো পেলো,জানা নেই তার।তবে ঠোঁট ভেঙে সত্যিই খুব কান্নারা উপচে আসতে চাইলো।যা কৌড়ি দাত চেপে আঁটকাতে চাইলো।তবুও দুফোটা টপটপ করে ঝরলো।সেটা খেয়াল করে মান্যতা তাকে জড়িয়ে ধরলো।মিষ্টি গলায় বললো–আমার বাচ্চা বউমনিটা।একদম না।

পরপর সবাই জড়িয়ে ধরলো।আদর করলো,দোয়া করলো।ওপাশ থেকেও, ওই মানুষটাকে জানানো কিছু অভ্যর্থনাও কানে এলো কৌড়ির।ফের সময় নিয়ে কাবিন নামায় সাক্ষর হলো দুজনের।এরপর কাজীসাহেব মোনাজাত ধরলেন মোনাজাতে মনযোগী হলো সবাই।নতুন নবদম্পতির অদূর ভবিষ্যত, তাদের সুখের সংসার জীবন,প্রজন্ম নিয়ে বেশ কিছুসময় মোনাজাত রাখলেন কাজী সাহেব।ফের খেজুর বিতরণ করা হলো।সাথে মিষ্টিমুখ।দু’পাশে সবাই তখন মিষ্টিমুখ করতে ব্যস্ত। নিভান ফুলের সমাহারে পর্দাটা একটু গোটালো।মুহূর্তেই বধুবেসে পা মুড়িয়ে বসে থাকা চমৎকার একটা মায়াময় মুখ অবলোকন করলো।যাকে চেনা দ্বায়।সোনালী কারুকার্যময় ভারী লাল বেনারসি গায়ে জড়ানো।সাথে গা ভর্তি বড়বড় গহনা।গালায় জড়ানো স্বর্নের জড়োয়া সেট।আলাদা করে একটা জুয়েলারি হারও।কানে বড়ো বড়ো ঝুমকো।নাকে নাকছাবি। ভারী ভারী চুড়িতে দুহাত পূর্ন।মেহেদীরঙা হাতে যা দারুণ আকর্ষনীয়।মাথায় সিঁথি ঢেকে এসে কপালে পড়ে আছে জড়োয়া সেটের ডিজাইনের সেই টায়রাটা।মাথার চুল থেকে শুরু করে আজ মেয়েটার প্রতিটা অঙ্গ আকর্ষনীয় রূপে সেজেছে।কি মায়াময় সেই চন্দ্রপ্রদীপ রূপ।মুগ্ধতায় ডুবে গেলো নয়ন। এই মেয়েটার আজ থেকে শুধুই তার।অন্তরিক্ষের অনুভূতিগুলো কেমন সুখ সুখ প্রজাপতি হয়ে ডানা উড়তে লাগলো।এই ক্ষনটার কতো অপেক্ষা ছিল তার।
কাল এসময়টাতোও তো এক্ষনটার অপেক্ষায় অস্থির ছিলো।অপেক্ষারত সেই ক্ষনটা কেটে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত রমনীটি হয়ে গেলো তার।মেয়েটা খেজুর খাচ্ছে। কি লোভনীয় চিত্র। তড়িৎ পকেট থেকে ফোন বের করে একটা পিক তুলে নিলো।ওমনিই নজর গেলো সবার সেদিকে।কৌড়িও তাকিয়ে পড়লো।নিভান চমৎকার হেসে মায়ামায়া কন্ঠে বললো।

‘কংগ্রাচুলেশনস মাই ডিয়ার লাইফলাইন।

লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।হৃদযন্ত্রের ধকধকানি পুনরায় নিজের অবস্থানে ফিরে এলো।ঈশিতা মিছেমিছি বকে উঠলো।এখনো বিয়ের কোনো আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়নি তুই বউয়ের মুখ দেখলি কেনো?ঈশিতার বকা বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলোনা নিভান।হাত বাড়িয়ে কৌড়ির আধা খাওয়া খেজুরটা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে গালে ঢুকিয়ে দিয়ে পর্দার আড়ালে সরে গেলো।গম্ভীর্য ছেলেটার এমন উচ্ছল কান্ড সবাই এতোসময় হা হয়ে দেখছিলো।নিভান সরে যেতেই হেসে দিলো সবাই।মান্যতা বিথী এটা নিয়ে কৌড়ির সাথে মজা লুটতোও ভুললোনা।

বিয়ে পড়ানো শেষে ঈশিতা প্রদত্ত বাড়ির সমবয়সী ছেলেমেয়েরা মিলে বিয়ের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালন করলো।তন্মধ্যে, বর বউয়ের হাতে হাত রেখে প্রথম স্পর্শ করে সালাম প্রদর্শন।নব বরবধু দু’জনের মুখ আয়নাতে দেখা।দুধে-আলতা পানিতে আঙটি ফেলে খোজা।দু’জনে একে অপরকে মিষ্টি মুখ করানো।সমস্ত আনুষ্ঠানিকসহ ক্ষনে ক্ষনে নব বরবধূর ফটোশুট হলো।নিভান চলে যেতেই তন্মধ্যে সেখানে দাঁড়ানো নাফিম কোতুহলী মনে জিজ্ঞেস করলো।–আজ থেকে ফুলকৌড়িকে আমি কি বলে ডাকবো?

মান্যতা তার গোলুমোলু গালটা টিপে দিয়ে বললো–বড় বউমনি।

‘কিন্তু কৌড়িতো ছোটোমনিরও ছোটো।তবে কেনো তাকে বড়ো বউমনি বলে ডাকবো?

ঈশিতা আদুরে কন্ঠে বললো–কারণ ফুলকাৌড়ি এখন তোমাদের বড়দাদাভইয়ের বউ তাই।

নাফিম বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো–তুমি তবে দাদাভাইয়ের বউ হয়েই গেছো ?

গোল ফ্রেমের চশমাটা নাকের কাছে এসে ঠেকেছে নাফিমের।সেটা আলতো হাতে সেটা দিয়ে ঠেলে ঠিক করে দিয়ে বললো–

‘এইযে একটু আগে কাগজে কলমে লিখিত পড়িতভাবে তোমার দাদাভাই তাকে বউ করে নিয়েছে।এটাই বিয়ে।আর আজ দাদাভাই আর ফুলকৌড়ির বিয়ে ছিলোনা?

‘হুমম।

ঈশিতা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো—তবে?

‘ফুলকৌড়ি আমার বড়োবউমনি।

সবাই হেসে দিলো নাফিমের বাচ্চামো কথাশ।ঈশিতা হেসে দিয়ে নরম স্পর্শে নাফিমের গাল চেপে দিয়ে বললো –এইতো নাফিম বুদ্ধিমান ছেলে।

নাফিম কৌড়ির সামনে গিয়ে তার গালক হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো–সত্যি তুমি আমার বড়ো বউমনি, ফুলকৌড়ি?

কৌড়ি ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয় উপর নিচ মাথা নাড়ালো।
ফের নাফিমকে কাছে টেনে নিজের সাথো জড়িয়ে নিয়ে বললো — সত্যি।

অতি আনন্দে নাফিম চিল্লায়ে নিজেও কৌড়িকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো।সেই আনন্দে সবাই সামিল হলো।ফুলকৌড়ি পাগল নাফিমকে সবাই দুষ্ট মির ছলে খোঁচালো,হাসলো,মজা করলো।তবে আনুষ্ঠানিকতা শেষে নিভানকে আর আশেপাশে দেখা গেলো না।তারপর পুরো দুপুরটা কেটে গেলো আমন্ত্রিত মেহমানদের মেহমানদারীতে,সেখানেই দেখা গেলো ব্যস্ত নিভানকে।মেহমানদারী আর নিজেদের খাবার শেষে পুনরায় হই হুল্লোড় দুষ্টমি মজায় কেটে গেলো পুরো বিকাল।

ও আম্মু,দাদাভাইয়ের থেকে আমরা বিয়ের কোনো এনামি পায়নি।ঘর সাজানোর জন্য যে এনামিটা নেবো।দরজায় দাড়াবে কে?সেই ভয়ে তো দরজার সামনে দাড়াতেও পারছিনা।ঈশু আপু বড়োবোন বলে সম্মানের খাতিরে দাড়াতে চাইছেনা।উনি ছাড়া আর কার সাহস আছে দাদাভাইয়ের সামনে দাড়ানোর।উনি যখন চাইছেন না, তুমি একটু দাদাভাইকে বলে আমাদের এনামির একটা ব্যবস্থা করে দাওনা।

বাড়িতে মেহমান যারা রয়েছেন। সবাই আপতত বিশ্রামে।রান্নাঘরে ব্যস্ত হাতে কাজ করছিলেন নীহারিকা বেগম।সাথে রানীসাহেবাও।এতোসময় দল বেঁধে কিভাবে দাদাভাইয়ের কাছ থেকে বিয়ের এনামি পাওয়া যায়,সেই পরিকল্পনা করছিলো।নিজেরা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াবে!সেটা কখনো হওয়ার নয়।তাই অনেকেই কে বুঝিয়েছে কাজ হয়নি।নিরাশ মুখে মা’কে ফাকা পেয়ে এবার দলবেধে এসেছে মা’কে দিয়ে কিছু হয় কিনা,তাই মানাতে। মান্যতার কথা শুনেই চকিতে তার মুখের দিকে তাকালেন নীহারিকা বেগম।আশ্চর্য গলায় বললেন।

‘মানে কি?এখন আমি ছেলের ফুলসজ্জার গেট ধরবো!
ছিঃ ছিঃ ছিঃ।তার কাছে এনামি চাইবো?এই মেয়ে, জ্ঞানবুদ্ধি কি সব লোভ পেয়েছে তোর?মা ওর আমি!আমি নাকি ছেলের ফুলসজ্জার এনামি চাইবো ছেলের কাছে!ও আল্লাহ এ-কেমন মেয়ে আমার!এই নির্বোধ মেয়েকে কোন বাড়িতে পাঠাবো আমি!

মায়ের আহাজারিতে আরও নিরাশায় ডুবে গেলো মান্যতার মুখ।সাথে পাশে দাড়িয়ে থাকা মৌনতা,বিথী তন্ময়ী সকলের মুখ চুপসে গেলো।বেশী চুপসে গেলো তন্ময়ীর মুখটা।এহেন আবদার সত্যিই ঠিক হয়নি।
মান্যতা ফের বললো–ছেলেতো কি হয়েছে।তুমি বলে দিলেই তো কাজটা হয়ে যাচ্ছে।

‘মান্য, আমার এখান থেকে যা।কি কান্ডজ্ঞানহীন মেয়ে।বলে কি-না ছেলেতো কি হয়েছে!এখন তোদের কাজ উদ্ধার করার জন্য আমি ছেলের কাছে নির্লজ্জ সাজব!
বেহায়া হবো!ও মাবুদ এমেয়ের বেশি বেশি বোধবুদ্ধি জ্ঞান দান করো।

মায়ের দ্বারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা হবেনা,এটা বুঝে মান্যতা আর কথা বাড়ালো-না।সবাই মাথা নিচু করে নিরাশ মুখে ডায়নিংটেবিলে গিয়ে বসলো।সেখানে বসে ইভান চা খাচ্ছিলো।ওদের দেখেই ইভান পরিহাসের সুরে বললো –কলিজা ছিদ্র যখন,এসব কাজের খেয়াল মনে নিয়ে আসতে হয় কেনো?হুহ,এনামি চাই।ফকির হয়েছে সবকটা।

সবাই বেজার মুখে একবার তাকালো ইভানের দিকে।
তবে তন্ময়ী তাকালো চোখমুখ শক্তকরে।মান্যতা কিছুটা রাগান্বিত গলায় বললো — এখানে ফকিরের কি দেখলি তুই?এটা জাস্ট মজা করে পেতে চাইছি আমরা।

তন্ময়ীর চোখমুখ শক্তকরে রাখা দেখে ইভান দুষ্ট হাসলো।ফের বললো–আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।তবে শর্ত আছে।

তন্ময়ী বাদে উচ্ছাসিত কয়েক জোড়া স্বর একত্রে বলে উঠলো–কি শর্ত।

ইভানের মুখের দুষ্ট হাসি আরও চওড়া হলো।সেটা দেখে মনেমনে আশংঙ্কাগ্রস্ত হলো তন্ময়ী।তবে চোখমুখের হাবভাবে সেটা ফুটতে দিলো-না।তবে ফাজিল ছেলেটা যে তাকে নিয়েই মনেমনে কিছু একটা প্লান করে চলেছে এটা স্পষ্ট তার মুখের দুষ্টমিষ্টি হাসির ঝলকানিতে বুঝলো।সত্যি সেটাই হলো।ইভান বললো -‘শর্ত শুধু তোর ছোটোবউমনি মানলেই চলবে।আর কাওকে মানতে হবেনা।

কারন না শুনতে চেয়ে সবাই তন্ময়ীকে চেপে ধরলো ইভানের শর্ত মানতে।যেখানে তন্ময়ী ইভানের বউ,সেখানে নিশ্চয় কঠিন কোনো শর্ত ইভান তাকে দেবেনা। এমন যুক্তিতর্কে তন্ময়ীকে বোঝাতে থাকলো তারা।তন্ময়ী পড়লো চিপায়। হতভম্ব চোখে একবার আশা নিয়ে তাকে বুঝানো মেয়েগুলোকে দেখলো,তো একবার ঠোঁটে দুষ্ট হাসি লেপটে রাখা ইভানকে দেখতে থাকলো।কি করবে এখন সে?তন্ময়ীর পরিস্থিতি বুঝে ইভানের দুষ্ট হাসি মাখা মুখটা যেনো আরও ঝলমলে হয়ে উঠলো।কালরাতে সত্যিই মেয়েটা তার কথা রাখতে তার কাছে ঘুমাইনি।ইভান শতচেষ্টা করেও মেয়েটার নাগাল পায়নি।তবে আজ কি করবে?হঠাৎ তন্ময়ী বলে উঠলো।–দরকার পড়লে কাল নিভান ভইয়ার কাছে থেকে এনামি আমি চেয়ে দেবো তোমাদের।তবুও কোনো বদ মতলবী মানুষের শর্ত মানতে রাজি নই।

‘ছোটো দাদাভাই বদ মতলবী?মান্যতা কথাটা জিজ্ঞেস করলো।তন্ময়ী উত্তর দেওয়ার আগেই মৌনতা চটপটে গলায় বললো–‘তুমি পারবে তো?

ইভানের দুষ্ট হাসিরা তখনো তার ঠোঁটজুড়ে মাখামাখি। নিশ্চিত অন্য কোনো ছক কষছে।তবুও তন্ময়ী শক্ত গলায় জবাব দিলো–‘দরকার পড়লে দাদাভাইকে দিয়ে পারিয়ে নেবো।

‘তাই তো। তৃনয় ভাইয়া আছে,সেটাতো মাথায় ছিলো-না আপু।তৃনয় ভাইয়াকে ধরলে তো এতোসময় সমাধান হয়ে যেতো সবকিছুর।

মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলতেই ধ্বক করে উঠলো মেয়েটার বুক।লোকটাকে সে সবসময় এড়িয়ে চলতে চায় অথচ ঘুরেফিরে তারই নাম নেবে সবাই।আবার ঘুরেফিরে তারই সামনেই পড়তে হয়।লোকটার কথাতো তারও মনে ছিলো।তবে উনার থেকে সাহায্য কখনোই নিতে চায়না বলে স্মরন করেনি মান্যতা।অথচ সেই নামেই গিয়ে গড়ালো বিষয়টা।

‘আপু চল।তৃনয় ভাইয়ারা ছাঁদে আড্ডা দিচ্ছেন।উনাকে গিয়ে ধরি।

কথাটা বলেই মান্যতার হাত টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মৌনতা।সাথে বিথী এবং অন্যন্য মেয়েগুলো উঠে দাড়ালো। না বলতে গিয়েও সবার দিকে তাকিয়ে না বলতে পারলোনা সে।তন্ময়ী উঠতে গেলেই হাত চেপে ধরলো ইভান।কাছে এসে বললো–আজ রাতে যেখানেই থাকোনা কেনো,ঘুম থেকে জেগে দেখবে তুমি ইভানের বুকের তলায়।

কথাটা বলেই আশেপাশে একবার নজর বুলিয়েই তড়িৎ তন্ময়ীর গালে চুমু বসালো সে।মূহুর্তেই সরে গিয়ে গুনগুন করতে করতে ছাঁদের দিকে অগ্রসর হলো।তন্ময়ী তখনো কাঠ পুতুলের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে।

সারাদিনের হৈ-হুল্লোড়,দৌড়ঝাঁপ থেমে গিয়ে নিশুতিরাতের আগমন ঘটলো।ক্লান্তিতে বাড়িটা তখন নিস্তব্ধতায় ছাওয়া।কৌড়ি তখন একাকী বসে নিভানের ঘরের ওয়ালসেট ড্রেসিংটেবিলের টুলে।শান্ত নীরব, চারপাশে শীতলভাব রুমটাতে যখন তাকে ঢুকানো হয়েছিলো,অদ্ভুত অনুভূতিতে সর্বাঙ্গ কেমন শিরশির করে কেঁপে উঠেছিলো।কাল কোথায় ছিলো আর আজ কোথায় থাকতে হবে!এটা ভেবে শিরশিরানিটা যেনো ক্ষনে ক্ষনে তীব্ররূপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বশরীরে।আশেপাশে আবারও নজর খেয়ালি হয়ে উঠলো তার।শৌখিনতা আর আভিজাত্যের পরিপূর্ণ ছোঁয়ায় পরিপাটি করে রাখা ঘরটাকে,বড়বড় ক্যান্ডেললাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে। হীমশীতল ঘরটার কোণায় কোণায় বড়বড় মোমগুলো নরম আলোয় শোভা পাচ্ছে।ধীমেধীমে আলোয় জ্বলছে তারা।শুধু যে ঘরের কোণায় কোণায় শোভা পেয়েছে তারা, এমনটা নয়।বেডের পাশের ল্যাম্পস্যাড টেবিলটার চারপাশজুড়ে।বেডের পায়ের কাছের ডিভানটারজুড়ে।,বেডের অন্যপাশের ইনডোর প্লান্টের চারপাশটাজুড়ে।দরজার পাশের বড়সড় ফুলদানিটা ঘিরে সাজানো গোছানো রূপে রূপায়িত হয়েছে তারা।রুমের নীলচে-সবুজ বাতির ধিমে জ্বলা আলোতে মুগ্ধ নজরে চারপাশটা দেখতে দেখতে বেডে এসে নজর থমকে গেলো কৌড়ির।বড়সড় শৌখিন বেডটার সাদা কাভারের বিছানাজুড়ে লাল গোলাগের পাপড়িতে সাজানো।সেখানে নবদম্পতির নামটাও লেখা উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে।হার্টবিট তালে তালে বেড়ে গেলো কৌড়ির।মূহুর্তেই নজর সরিয়ে ঘুরে বসলো সে।

আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের প্রতি নজর পড়তেই দৃষ্টি নিজের প্রতি মুগ্ধ হলো।বিয়ের সাজ পাল্টে তাকে পুনারায় সাজানো হয়েছে। বিয়ের ভারী সাজ পাল্টে আর ইচ্ছে করেনি তার একটুও সাজতে।তবে মুখফুটে নিজের ক্লান্তি আর অস্বস্তির কথা কাওকে না বলতে পারায়,পুনরায় আবার সাজতে হয়েছে তাকে।তবে বিয়ের সাজের মতো অতোটাও ভারী সাজ নয়।গাঢ় খয়েরী রঙের সবুজ একটা সাউথ বেনারসী সিল্ক শাড়ী পরানো হয়েছে।ভিতরে তার ছোটো ছোটো ফুলের স্বর্নালি কাজ।গলায় নতুনকরে ভারী জড়োয়ার সেটের গহনা পরানো হয়েছে।কানে বড়বড় ঝুমকো। হাতে গাদাগাদা চুড়ি।চুল উল্টিয়ে সিথীবিহীন সটান করে বড়করে খোঁপা বাঁধা হয়েছে।আর খোঁপায় শোভা পেয়েছে কতোকগাছি গাঢ় খয়েরী গোলাপ।ম্যাচিং ডিজাইনে টায়রা ঝুলানো মাথায়।হলকা মেকাপ হলেও ঘনপল্লবিত চোখে গাঢ় কাজলের প্রলেপটা বেশ চাকচিক্য ছড়াচ্ছে।আর তার থেকেও ঠোটের গাঢ় খয়েরী রঙা লিপস্টিকের প্রলেপনটা যেনো পুরো মুখের গৌরবর্ণের সৌন্দর্যতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।সবকিছু নিটোল চোখে একবার নয় কয়েকবার দেখেছে কৌড়ি।সবকিছু ওই মানুষটার পছন্দসই।যেনো পোশাক গহনা নয় মানুষটাই লেপ্টে আছে সমগ্র শরীরজুড়ে।আবারও শিরশির দিয়ে উঠলো শরীর।কি অদ্ভুত এক অনুভূতি।
এই রুমে প্রবেশ করার পর, রুমের চারপাশটা যেনো ওই মানুষটার গায়ের কড়া পারফিউমের গন্ধে থৈ-থৈ করে নেচে-গেয়ে করে ভেসে বেড়াচ্চছে।অথচ মানুষটা নেই।হঠাৎ দরজা খোলার”‘খট” শব্দে পিছে মুড়ে উঠে দাঁড়ালো কৌড়ি।কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখতেই সমগ্র শরীরে লজ্জরা ভিড় করলো।উষ্ণ অনুভূতিতে শিরদাঁড়া কেঁপে উঠলো।হঠাৎ মনেহলো মাথায় কাপড় নেই।তড়িৎ মাথায় কাপড় টেনে দিলো।আটপৌড়ে পরা শাড়ী গহনার সাথে এটাই বুঝি বেমানান ছিলো।মাথায় কাপড় উঠাতেই পরিপূর্ণা নারী। হুশ ফিরলো নিভানের।মিষ্টি হেসে চমৎকার কন্ঠে সালাম জানালো।

‘আসসালামু আলাইকুম,রব্বাতুল বাইত।

লজ্জায় ডুবে থাকা কৌড়ির কথা বলতে গিয়ে হঠাৎই টের পেলো, কাটা বেঁধে যাওয়ার মতো তার গলায়ও কথারা বেঁধে জড়িয়ে পড়েছে।তবুও জড়ানো গলায় সালামের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলো।উত্তর পেতেই অনুমতি প্রার্থনা চাইলো,স্বামী নামক পুরুষটি।

‘ভিতরে আসবো?

ভিষণ লজ্জা পেলো কৌড়ি।নিজের ঘরে ঢুকতে তার কাছে অনুমতি চাইছে!বিষয়টা ভিতরে ভিতরে অস্থির করে তুললো তাকে।অবাধ্য অনুভূতিরা তাতে যেনো তাল মিলিয়ে পাল্লা দিয়ে তাকে জর্জরিত করে তুললো।
তবে ভুুলেও কথা বললোনা।মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে শুধু সম্মতি জানালো।সম্মতি পেতেই নিভান নৈঃশব্দ্য দরজা চেপে ধীরেধীরে এগোলো কৌড়ির পানে।এতোদিন শুনে এসেছে বউ একহাত ঘোমটা টেনে বরের অপেক্ষায় বেডে বসে থাকে।অথচ তার বউটা ওখানে টুলে বসে কি করছে ?ভাবনাটা গাঢ় রূপ নিতে পারলো না,তার সম্মোহনী দৃষ্টির জন্য।যে দৃষ্টি তার বউয়ের মোহমায়া রূপে সম্মোহিত হয়ে আঁটকে গেছে।কি বর্ননাহীন অপরূপা লাগছে মেয়েটাকে!নিভান যতো কাছে আগাতে লাগল,কৌড়ির অবস্থা ততোই নজেহাল হতে শুরু করলো।দুপুরের শেরওয়ানি পাল্টে সাধারণ একটা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা তার।এলোমেলো অবিন্যস্ত চুল।ক্লান্ত মুখ।অথচ মুখে চমৎকার হাসি।কৌড়ি মোহিত হলো।

‘আমাদের একসাথে পথ চলার অভিনন্দন আমার অর্ধাঙ্গিনী।

কি মোহিত কন্ঠস্বর!নিজের থেকে দুআঙুল দুরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে অপলক নজরে দেখলো কৌড়ি।সামনের মানুষটার অভিনন্দন অভ্যর্থনা যেনো কানে ঢুকেও ঢুকলোনা।সেটা বুঝে সামনের মানুষটা সুযোগ নিলো।মাথা নুইয়ে সদ্য হওয়া অর্ধাঙ্গিনীর কপালে নিজের কপাল ঠেকাল।শিহরে উঠলো কৌড়ি।যেনো বিদ্যৎ ভ্রষ্ট হলো।তবে নড়তে ভুলে গেলো।যেনো চম্বুক হয়ে টেনে রেখেছে মানুষটা অথচ কপালে কপাল রাখা ছাড়া তাকে মানুষটা কোনোরূপ ছুঁই নি।

‘প্রভু বুঝি নিজ হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে, আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য তোমাকে গড়েছিলেন।কি অপরূপা গড়েছেন তোমাকে,জানো তুমি?আমার শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য,সম্পত্তি,সুখ শান্তি বানিয়ে তোমায় উপহার দিয়েছেন আমাকে।জাজাকাল্লাহ।

কৌড়ি চোখ বুঁজে নিলো।উষ্ণতার জোয়ার বয়ে বেড়ালো রন্ধ্রে রন্ধ্রে।সেই বুঁজে থাকা চোখে গভীর ভালোবাসা ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করলো নিভানের।আর সেই গভীর ভালোবাসা তো ওই নির্দিষ্ট চোখে থেমে থাকবে না।তবে একটা কাজ না সেরে আপতত নিজের অনুভূতির উষ্ণতায় ডুবাতে চাইছেনা মেয়েটাকে।তবে গভীর নজরে অপলক মেয়েটাকে দেখতে থাকলো সে।একটা সময় মনেহলো,নাহ বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে নিজেকে আর ঠিক রাখা যাবেনা।তখন ধীরেসুস্থে মুখ খুললো সে।বললো–ফ্রেশ হয়ে আসছি।ফের কথা বলছি।কেমন?

চোখ বুঁজেই কৌড়ি তড়িঘড়ি মাথা মৃদু উপর নিচ নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।নিভান সরে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতেই কৌড়ি বুকে হাত দিতে ঘনোঘনো শ্বাস ফেললো। কি রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি।সময় নিয়ে বের হলো নিভান।গোসল সেরে বের হয়েছে।একটু আগের ক্লান্তি তার চোখমুখে দেখা যাচ্ছে না।সেখানে ভর করেছে সতেজতা,স্নিগ্ধতা।মাথার চুলগুলো মুছতে মুছতে বের হয়েছে সে।ওয়াশরুমে ঢোকার আগে আরেক সেট সাদা পাজামা পাঞ্জাবি নিয়ে ঢুকেছিলো।আর সেটা পরেই বের হয়েছে।কৌড়ি বুঝলোনা,একরঙ মানুষের বারবার পরতে ভালো লাগে?অথচ মানুষটাকে সবসময় সাদা জিনিসই পরতে দেখে কৌড়ি।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে কৌড়িকে বেডের এককোনে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখে নিভান বললো।

‘আমার এশারের নামাজটা এখনো আদায় করা হয়নি।নামাজটা আদায় করে নেই।আর নানুমা বললেন,আজ উপলক্ষে দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করতে।

কথা শেষ করতেই হঠাৎ কিছু মাথায় এলো।কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে শুধালো—তোমার পিরিয়ড বন্ধ হয়েছে?

লজ্জায় খিঁচে এলো ভিতরটা।মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।ঔষধের প্রভাবে আজ সকাল থেকে পিরিয়ড বন্ধ। তবুও সংশয় আছে।তবে কি এসব বলা যায়?আর কিওবা বলবে সে।মাথা নিচু রেখে কোনোমতে মাথা এদিকে ওদিকে নাড়িয়ে না জানালো।সেটা খেয়াল করে নিভান বললো।

‘সমস্যা নেই।আজ আমি একা পড়ি।যেদিন তুমি সুস্থ হবে,সেদিন নাহয় দু’জনে একসাথে আবার পড়ে নেবো।

কৌড়ি তড়িৎ মাথা উচু করলো।নিভান অমায়িক হেসে চোখ দিয়ে আশ্বাস জনালো।ফের কৌড়ির কোলের মধ্যে মাথা মুছতে থাকা তোয়ালিটা আলতো হাতে ছুঁড়ে দিয়ে বললো।

‘আমি নামাজ সেরে নেই।তারমধ্য তুমি ফ্রেশ হ’য়ে কমফোর্টেবল কিছু পরে নাও।তোমার সবকিছু এরুমে আছে।সব তোমার।সালোয়ার কামিজও পরতে পারো।আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে,এই বেশে তোমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবেনা।

প্রশ্ন জাগলো মনে।তবে প্রশ্ন করলোনা কৌড়ি।নিভানকে সম্মতি জানিয়ে উঠে দাড়ালো সে।নিভানও সরে গিয়ে নামাজে দাঁড়ালো।ওয়াশরুমে ঢোকার আগে প্রথমে গহনাগুলো খুলে নিলো কৌড়ি।এরুমের কোথায় তার কি রাখা আছে, সে জানােনা।কিছু খুজতে-ও গেলোনা সে।মান্যতারা যখন এরুমে তাকে রেখে গিয়েছিল, তখন সাথে করে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটা ট্রলিসমেত রেখে গিয়েছিলো।সেখান থেকে সুতি একটা থ্রিপিছ বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।সবকিছু পরিস্কার করে বের হতে তার বেশ সময় লাগলো।তবে চুলগুলো কিছুতেই একা খুলতে পারলোনা।ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো,নিভান এখনো নামাজের বিছনায় বসে।কৌড়ি কেমন অসহায় নজরে তারদিকে তাকালো। সেটা খেয়াল করে উঠে দাঁড়ালো নিভান।কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো— কি হয়েছে?

‘খোপাটা খুলতে পারছিনা না।

নিভানের বুঝতে সময় লাগলো।তবে কৌড়ি আঙুল উচু করে দেখাতেই,বুঝলো সে।কৌড়ির হাতটা ধরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড় করিয়ে,সমস্ত মনোযোগ ফুলে এঁটে থাকা খোঁপায় দিয়ে ফুলগুলো খুলতে থাকলো সে।
একটা খোঁপা করতে আর তাতে ফুল দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধনে কতো ক্লিপ যে এঁটেছে,বলা মুশকিল।নিভান ধৈর্য্য নিয়ে তা খুলতে চেষ্টা করলো।আর আয়নায় কৌড়ি দেখে গেলো তাকে।বেশ সময় লাগলো খোপাটা খুলতে।সময় নিয়ে একসময় সফল হলো।
চমৎকার হেসে বললো–হয়ে গেছে।

নিভান সরে গিয়ে নামাজের বিছানা উঠাতে ব্যস্ত হলো।কৌড়ি তারমধ্যে চুলগুলো আঁচড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করলো।তবে দীঘল চুলগুলোর যে অবস্থা!দুইপাচ মিনিটে আঁচড়ানোর কাজ সেরে নিতে পারবে বলে মনে হলোনা তার।আর কেমন হাত পা সহজভাবে নাড়াতেও তার অস্বস্তি হচ্ছে। তাই উপর উপর কোনোমতে আঁচড়িয়ে ওড়না মাথায় দিয়ে নিলো।তারমধ্যে নিভান রেডি হয়ে নিয়ে বললো—তোমার হয়েছে?

কৌড়ি তড়িৎ উত্তর দিলো–হয়েছে।

নিভান তাকে একপল দেখলো।ফের নিজের ঘরের কেবিনেটের দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছু একটা বের করে কৌড়ির সামনে এসে দাড়ালো।মাথার ওড়নাটা সরিয়ে দিয়ে বড়সড় সুন্দর একটা হিজাবে তাকে মুড়িয়ে দিলো।ফের ঠিকঠাক করে দিয়ে তারদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ স্বরে বললো—মাশাআল্লাহ। তোমার জন্য শপিং করতে গিয়ে এটা দেখে পছন্দ হলো তাই নিয়ে নিয়েছিলাম।অসুবিধা আছে পরতে।

অদ্ভুত অনুভূতিতে জর্জরিত কৌড়ি মাথা নাড়িয়ে না জানালো।নিভান সম্মতি পেয়ে মৃদু হাসলো।নিজেকে একপল আয়নায় দেখে নিয়ে বললো–চলো।

মেইন রাস্তার পাশে বিস্তৃত জায়গা নিয়ে কবরস্থান। তিনপাশ উঁচু পাঁচিলে ঘেরা থাকলেও,রাস্তার সাইডে রেলিঙ করা।সেখান থেকেই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মৃতব্যক্তির,ইট সিমেন্ট বালু দিয়ে পাকা আধাপাকা নেইমপ্লেট জড়ানো কবরস্থান।হঠাৎ মনেহলো,আজকের দিনে মানুষটা তাকে এখানে নিয়ে এলো কেনো?

‘ভয় পাচ্ছো?

মেইন রোড।রাস্তার ঝলমলে আলো।তা বাদেও কবরস্থানের পাশ ঘেঁষে মসজিদ। সেখানে অতিরিক্ত লাইটের ব্যব্স্থা।ভয় পাবার কোনো অবকাশ নেই। কৌড়ি নিঃসঙ্কোচে বললো—না।

‘ওই যে বাবার কবরস্থান।

আঙুল উঁচিয়ে দেখালো নিভান।ততক্ষণাত কৌড়ির প্রশ্নের উত্তর মিলালো।কৌড়ি খেয়ালি নজরে দেখলোও সেখানে পাকা কবরস্থানের গায়ে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা– মরহুম মোহাম্মদ আওসাফ আহমেদ।আর কিছু লেখা।নামের তুলনায় অন্য লেখাগুলো ছোটো হওয়ায়, দুর থেকে কৌড়ি পড়তে পারলোনা।

‘বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন জানো।খুব ভালোবাসতেন।তার কাজের ফাঁকে যেটুকু সময় পেতেন তিনি আমার পিছনে ব্যয় করতেন।আমাকে খাইয়ে দেওয়া,গোসল করিয়ে দেওয়া,স্কুলে নিয়ে যাওয়া,বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়ানো।সহজে মা’কে করতো হতো-না।তিনিই করতেন।বাবা থাকাকালীন এসব আদর যত্ন আমি মায়ের থেকে কম পেয়েছি।কম পেয়েছি বলতে, বাবাই মা’কে সুযোগ দিতেন না।হয়তো তিনি বুঝে গিয়েছিলেন,আমার কাছে তাকে আর বেশিদিন থাকা হবেনা।তাই হয়তো উনার সারাজীবনের আদর যত্নগুলো বেশি বেশি করে দিয়ে গিয়েছিলেন।তিনি প্রচন্ড আদর করতেন আমাকে,কৌড়ি।আমার এখনো মনেহয়,আমার গালে, আমার কপালে, উনার ছুঁয়ে দেওয়া আদরগুলো এখনো লেপ্টে আছে।আমি প্রায় স্নপ্ন দেখি,তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন।এইতো আমাকে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছেন। আমি খেতে চাইছিনা বলে,কতোশত গল্প শুনিয়ে আমাকে খাওয়াচ্ছেন।বাবাকে কেনো জানি আমি কিছুতেই ভুলতেই পারি-না।কেনো জানি পারিইনা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা যেনো কেঁপে কেঁপে উঠছিলো মানুষটার।কৌড়ি কেমন অসহায় নজরে সেটা দেখে যাচ্ছিলো।ওই কষ্টের অভিজ্ঞতা তো তারও আছে।ক্ষনেক্ষনে সেই কষ্ট, ব্যথাগুলোর অভিজ্ঞতা গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।আজ দু’দিন ধরেও তো সেই ব্যথাগুলো ক্ষনেক্ষনে চাড়া দিয়ে উঠছে মনে।কৌড়ি নিভানের পাশে গিয়ে তার হাতটা নিজের কোমল হাতের মুঠোয় নিয়ে নিঃসঙ্কোচে আশ্বস্ত জানলো।

‘এতোরাতে তোমাকে এখানে নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিলোনা।আজ দুদিন ধরে সুযোগ খুঁজছি,কিন্তু ব্যস্ততায় খাতিরে এখানে আসা হয়ে উঠেছেনা।আজ এখন এসময়ে হয়তো তোমাকে এখানে নিয়ে আসা ঠিক হয়নি।কিন্তু আমি চাইছিলাম,আমাদের নতুন জীবন শুরু হওয়ার আগে বাবার কাছে একবার তোমাকে নিয়ে আসতে।উনার আদরের ছেলের জীবনসঙ্গীনিকে একটু দেখিয়ে নিয়ে যেতে।

কৌড়ির হাতের মধ্যে থাকা শক্তপোক্ত হাতটা কৌড়ি আরও শক্তকরে চেপে ধরলো।যেনো নীরব আশ্বস্ততা।নিভান সময় নিয়ে বললো–আমি সামনে এগিয়ে গেলে তুমি ভয় পাবে?কবরস্থানে তো মেয়েদের যেতে নেই,তাই বললাম।

রাস্তায় ক্ষনে ক্ষনে বিভিন্ন পাল্লার যানবাহন চলছে।সাথে অল্পসল্প মানুষজন।কৌড়ি আশেপাশে খেয়াল করে বললো–আপনি কবর যিয়ারত করে আসুন।আমি ভয় পাবো-না।

কৌড়ি হাত ছেড়ে দিলো।নিভান একপলক তাকে দেখে সামনে এগিয়ে কবর যিয়ারত করলো।রাত হওয়ায় কবরস্থানের ভিতরে আর ঢুকলো-না।পাছে কৌড়ি-ও ববার ভয়না পায়।সেই বিবেচনাও করলো।সময় নিয়ে কবর যিয়ারত করলো নিভান।যিয়ারত শেষে কৌড়িকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো।তবে গন্তব্য যে বাড়ির পথে নয়,এটা বেশ বুঝতে পারলো কৌড়ি।কেননা গাড়ি যে পথে এসেছিলো,তার অন্যপথ ধরলো নিভান।

‘তোমার খুবকরে মনে হয়, তুমি আমার থেকেও বেটার কাওকে ডিজার্ভ করো।তাই না?

কৌড়ি অবাক হয়ে নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে রয় কিছুক্ষণ।হঠাৎ সংকোচ দ্বিধা কাটিয় সময় নিয়ে কিছুটা অবাক কন্ঠে শুধায়–আপনার থেকেও ভালো কেউ?

‘হুমম।

নিস্তব্ধ গভীর রাত,জনমানবহীন শূন্য রাস্তা।বাতাসের মৃদু শা শা শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই।নিভান কোথায় নিয়ে এসেছে,জায়গাটার নাম কৌড়ির বিশেষ জানা নেই।তবে একটা সুদীর্ঘ ব্রীজের রেলিঙ ঘেঁষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তারা।নিভান হুম বলতেই,সেই পাশাপাশি দাঁড়ানো দূরত্বটা ঘুচিয়ে ফেললো কৌড়ি।নিভানের সামনে এসে দাঁড়ালো।উচ্চতায় মানুষটা বুক সমান সে।তাই পায়ের সিম্পল স্যান্ডেলজোড়া খুলে নির্দ্বিধায় নিভানের পায়ের উপর পা রাখলো।নিভান শান্ত নজরে সেটা দেখলো।কৌড়িকে নিজের পায়ের উপর পা রাখতে দেখেই,ঝুঁকে তার কোমরটা জড়িয়ে নিজের কাছাকাছি টেনে নিলো।তাতে সুবিধাই হলো কৌড়ির। নিভান ঝুঁকে আসতেই আদূরে স্পর্শে তার মুখটা নিজের কোমল দু’হাতের তালুতে আজলে নিলো।
নিভানের শান্ত বাদামী বর্ণ নজরজোড়ায়,নিজের মায়াবী ডগরডগর নজরজোড়া স্থির রাখলো।ব্রিজের সোডিয়ামের লাল নীল আলোতে নিভানের শ্যামবর্ব চোখ মুখ স্পষ্ট।সেই মুখাবয়বে কিয়াদক্ষন চেয়ে থেকে
আবেদনময়ী কন্ঠে বললো

‘এই চোখ, এই নাক,এই ঠোঁট, এই শ্যামবর্ণ মুখাবয়বের থেকে-ও যদি কোনো আকর্ষণীয় মুখ অবয়ব থেকে থাকে,আমার মন,আমার মস্তিষ্ক, আমার হৃদয়, আমার নজর তবুও এই শ্যামবর্ণ মুখাবয়বেই আঁটকে থাকবে।
শত শত সৌন্দর্যের মধ্যে এই শ্যামবর্ণ পুরুষটাতেই আকর্ষিত হই আমি,মুগ্ধ হয় আমার নয়ন।মায়া মোহ টান সবকিছু ঘিরে এই শ্যামবর্ণ পুরুষটাতেই অনুভব করি আমি।আর সেই পুরুষটার থেকেও যদি আকর্ষণীয়, বেটার কোনো পুরুষ থেকে থাকে।তবু্-ও সেই পুরুষটা কখনো আমায় চাইনা।আমি এই শ্যামবর্ণ পুরুষটাতেই মুগ্ধ।আর আমার দেখা সুন্দর ব্যাক্তিত্বের সৌন্দর্যময় পুরুষ ”শুধুই আপনি” নিভান আওসাফ আহমেদ।

কৌড়ির আবেদনময়ী গলার প্রসংশাতে মন প্রশান্ত হলো নিভানের।সে এমনই একটা উত্তর আশা করেছিল কৌড়ির থেকে।কৌড়ি যেনো সেই উত্তরটা আরও দ্বিগুণ মুগ্ধকর ভাষায় প্রকাশিত করেছে।দু’হাতের বন্ধনী আপনাআপনি দৃঢ় হলো নিভানের।কৌড়ি আরও কাছে চলে এলো তার।কেঁপে উঠলো কৌড়ি,সমস্ত শরীরে বয়ে গেলো শীতল স্রোতের মৃদু কম্পন।বিয়ের পর এই প্রথম এতো কাছাকাছি আসা।যদিও নিজেথেকে এসেছিলো সে।তবে তখন অতোটা ভেবে কাছে আসে-নি।আবেগপ্রবণ হয়ে এসেছিলো।কেনো জানি তখন কোনো দ্বিধা সংকোচ কাজ করেনি।কিন্তু এখন!কৌড়ির মুখটা কাছাকাছি আসতেই,তার দিকে নিগাঢ় চোখে চেয়ে থাকলো নিভান।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো তাকে।হিজাবে জড়ানো গোলগাল সুন্দর মায়াময় পরিচ্ছন্ন একটা মুখ।যা কোমলতায় আর স্নিগ্ধতায় ভরা।মোহবিষ্ট হলো নিভান।কৌড়ির কোমরে রাখা হাতটা আরও শক্তবাধনে আকড়ে নিলো।সহজে কৌড়ির মুখটা আরও কাছাকাছি আসতেই, তার কোমল ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন আঁকলো নিভান।অনুভূতিতে আবেশিত হয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো দু’পক্ষই।জীবনের প্রথম গভীর নারীস্পর্শ।নাহ,বিয়ের আগেও তার ঠোঁটজোড়া তো ছুয়েছিলো এই একান্ত নারীর কপাল।তবে জ্বরের প্রকোপে হুশ না থাকাই এই নারীটার জানা নেই সেই স্পর্শের কথা।

সময় অতিবাহিত হলো,তবে ঠিক কতোটা সময় অতিবাহিত হলো এটা কৌড়ি নিভান কারও জানা নেই।একটা সময় গিয়ে শেষ হলো সেই চুম্বন।ততসময়ে নিভানকে শক্তকরে আকড়ে ধরেছে কৌড়ি।সেটা বুঝে কৌড়িরর কোমর ছেড়ে দিয়ে তার গোলগাল মুখটা,নিজের রুক্ষ দু’হাতের তালুতে আজলে নিয়ে বেশ নিষ্পলক কিছু সময় দেখলো নিভান।ফের নিজের মুখের অতিসন্নিকটে কৌড়ির মুখটা টেনে নিয়ে মুগ্ধ কন্ঠে বললো।

‘আমার ফুলকৌড়ি।

#ফুলকৌড়ি
(৪৯)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সময়টা গভীর রাত।ছাঁদের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দীবা।ঠান্ডা বাতাসগুলো ক্ষনে ক্ষনে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে, তবু্-ও কেমন অনড় দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটা।গায়ে কোনো শীতবস্ত্র নেই অথচ শরীর কাটা দেওয়ার মতো শীতলতা।

‘এতো রাতে,এই ঠান্ডার মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো?

পরিচিত কন্ঠের বার্তা পেয়েও ভাবান্তর হলোনা দীবার।
সারাটা দিন যেনো তার কেমন কেমন গিয়েছে।আসলেই কেমন?চারদিকে আনন্দ উল্লাসে ভরপুর অথচ নিজের বলে কোনো আনন্দ নেই,খুশি নেই।শুধু ভারী ভারী নিঃশ্বাস আর শ্বাস আঁটকে আসা অসহনীয় বুকব্যথা।সকাল থেকে চারপাশটা যত সাজসাজ রবে সেজ উঠছিলো বাড়িটা, হৈচৈ পরিপূর্ণ হচ্ছিলো চারিদিক।ততোই যেনো মনে হচ্ছিলো এবাড়িটাতে কেমন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।তার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার নির্ভরশীলযোগ্য বাড়ি এটা নয়।চারপাশের ভালোমন্দ সবকিছু কেমন অসহনশীল হয়ে উঠছিলো।খুবকরে মনে হচ্চিলো,একটু সহজভাবে নিঃশ্বাস ফেলার জন্য তার দুরে কোথায় চলে যাওয়া দরকার।খুব দূরে।নয়তো গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়া দরকার।সেই ঘুম যেনো না ভাঙে।চিরনিদ্রায়িত হলেও সমস্যা নেই।কিন্তু তার না দূরে যাওয়া হয়ে উঠলো আর না গভীর পড়া হলো।সকাল থেকে সিয়াম কেমন তার পিছুপিছু ঘুরেছে।যার জন্য ছেলেটাকে কতো বাজে কথা শোনালো। তবুও ছেলেটা পিছু ছাড়েনি।কেমন,যেখানে সে ঘুরেফিরেই যেনো ছেলেটা সেখানে।আচ্ছা, সিয়াম কি কোনোভাবে তার আচারনে বুঝে গিয়েছিলো তার মনে কথা?হবে হয়তো।সিয়ামের কন্ঠ পেয়েও কথা বললো-না দীবা।সিয়াম পাশে এসে দাড়ালো তার।ফের আপনমনে বলে উঠলো–আমারও কেনো জানি ঘুম আসছেনা,তাই ছাঁদে চলে এলাম।লং-ড্রাইবে যাবে দীবা?চলো-না কোথাও থেকে একটু স্বস্তি একটু শান্তি নিয়ে আসি।যাবে?

তৃষ্ণার্থ মন,খেইহারা মাঝির মতো দরিয়ার তীর খুঁজে পেলো যেনো।যদিও সময় নিয়ে উত্তর এলো।–চলো।

দীবা একবাক্যে সিয়ামের রাখা প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে,এটা আশা করেনি সিয়াম।কিছুসময় বিস্ময় নজরে রাগী জেদি মেয়েটার দিকে কয়েক- সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সময় নষ্ট না করে বললো–এসো।আমি নিচে গিয়ে গাড়ি বের করছি।

বিনাবাক্যয়ে সিয়ামের সাথেই নিচে নামলো দীবা।শান্ত মেয়ের মতো চুপচাপ সিয়ামকে অনুসরন করে, গাড়িতে গিয়েও বসে পড়লো।গাড়িতে বসার আগে নিস্প্রভ নজরে লন এরিয়ার ফুলেফুলে সজ্জিত স্টেজটার দিকে একপলক তাকিয়ে নিঃশব্দে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ফের অজানা গন্তব্যে সিয়ামের সাথে বেরিয়ে পড়লো।রাস্তা এগোলো,এগোলো অজানা অচেনা রাজপথ।
সিয়ামের গাড়িটা কোথায় না কোথায় বাক নিলো।অথচ থামলোনা কোথাও। বিরামহীন গাড়িটা চলতে থাকলো।না গাড়ী থামলো আর না দু’জনের মধ্যে কোনো কথা হলো।কিছুদূর গিয়ে গিয়ে একেকটা চা-পানের স্টল দেখ গেলো।মধ্যে রাতে বিভিন্ন স্ট্যান্ডগুলোতে বিশেষত এগুলো খোলা দেখা যায়।এরকম কয়েকটা স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে যেতেই সিয়াম জিজ্ঞেস করলো।

‘কোথাও থামবো?কিছু খাবে?

দীবা তখন গাড়ীর জানালায় হাত সঁপে, তাতে মুখ রেখে অপলক নির্বাক নজরে নিস্তব্ধ,নীরব শহরটাকে দেখে চলেছে।বিধস্ত মনটা,আর এলোমেলো শব্দ বোনা মস্তিষ্কটা খোলা বাতাস পেয়ে কিছুটা হলে-ও শান্ত হয়েছে।সিয়াম প্রশ্ন শুধাতেই কেমন অনুভূতিশূন্য গলায় বললো–না।

সিয়াম কেমন শান্ত নজরে একবার তাকে দেখে ফের গাড়ী চালানোয় মনোযোগ দিলো।যে পরিকল্পনা সে কাল করবে ভেবেছিলো, তা এক্ষনি করার কথা ভাবল।ফলশ্রুতি যা হয় হবে।নিজের বাড়ির দিকে গাড়ি মোড় নিলো সিয়াম।গাড়ীটা কোথায় কিভাবে মোড় নিচ্ছে দীবা বিশেষ মনোযোগী নয়।মুলত তারই সুযোগ নিলো সিয়াম।প্রায় ঘন্টাখানেকর মতো সময় পার করে যখন বাড়ির সামনে এসে গাড়ীটা দাঁড় করালো সিয়াম,দীবার হুঁশ ফিরলো।গাড়ীর জানালা দিয়ে বিশাল লোহার গেইটটা পেরিয়ে,রাস্তার সোডিয়ামের বড়বড় আলোয় ঝকঝকা আলিশান বাড়িটা নজরে পড়তেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো মেয়েটার।এবাড়ির একমাত্র বউ সে।বেশ কিছুদিন সংসার হয়েছিলো তার এবাড়িতে।বাড়ি চিনতে তার ভুল হওয়ার নয়।সিয়াম কেনো তাকে নিয়ে আসলো এখানে?মূহুর্তেই চেচিয়ে উঠলো সে।-তুমি এখানে কেনো নিয়ে আসলে আমাকে?হোয়াই সিয়াম?

দাঁতে দাঁত পিষলো শেষ কথায়।সিয়ামের মধ্যে বিশেষ হেলদোল দেখালো না।সে কাকে যেনো পোন করতে ব্যস্ত।ওপাশের মানুষটা ফোন না ধরায় বিরক্ত হয়ে বারবার কল দিচ্ছে সে।তৃতীয় ব্যাক্তিটি ফোন ধরতেই শান্ত গলায় বললো–বাড়ির মেইন গেটটা খুলে রাখুন খালা। আমরা আসছি।

আশ্চর্য!আমরা আসছি মানে!দীবা দ্বিগুণ স্বরে ফের চেচিয়ে বললো–আমরা আসছি মানেটা কি?তুমি আমার অনুমতি ছাড়া এবাড়িতে কেনো নিয়ে আসলে আমাকে?বলো?

‘তুমি এবাড়ির বউ তাই।

‘আমি এবাড়ির কেউ না।আমাকে ওবাড়িতে দিয়ে এসো সিয়াম।বাড়িবাড়ি করো-না।

ক্ষিপ্র হলো সিয়াম।রাগে টনটন হলো মাথার শিরা-উপশিরা।গলা চড়িয়ে বললো–কেনো যাবে ওবাড়িতে?মরতে?এই আমি তোমাকে এতো ভালোবাসী তোমার চোখে পড়েনা?অন্যায় করেছিলাম,তোমাকে পাওয়ার পর শুধরে নিয়েছি।কেনো বিশ্বাস করছো না আমাকে?কেনো?স্বামী থাকতেও কেনো পরপুরুষের জন্য এতো পাগলামি!বিয়ের আগে একাধিক বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া যদি ভ্রষ্টতা হয়,বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী মতো হলাল সম্পর্কে থাকার পর অন্য পরপুরুষের কথা ভাবা কি সেই একই ভ্রষ্টতা নয়?তুমি তখন আমার জীবনে না থেকেও,আমার অন্যায় মানতে পারছো না।আমি কি করে মানি?তবুও মানতে হচ্ছে!কেনো ভেবে দেখেছো কখনো?ভাববে কিকরে! তুমিতো নিভানকে ছাড়া কাওকেই ভাবতে পারো-না।

বলতে বলতে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, নিভান নামটা আসতেই খেয়াল হলো সিয়ামের।সে-তো এসব বলে ফের নিজেদের মধ্যে জটিলতা আনতে চাইনি।অথচ রাগে পড়ে জিহ্বা সংবরণ করা গেলো-না।নিজেকে শান্ত করার অভিপ্রায়শ চালিয়ে কিছুসময় চুপ থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে,দীবার জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন দূর্বল গলায় বললো—ওবাড়িতে তুমি ভালো নেই,তারপর-ও, যে তোমাকে চাইছেনা তার সংস্পর্শে থাকতে সেখানেই যেতে চাইছো।অথচ স্বামী হয়ে আমার অন্যায় গুলো মার্জনা করে এবাড়িতে আমার কাছে থাকতে চাইছোনা কোনো দীবা?কেনো?

‘আমাকে ওবাড়িতে দিয়ে এসো সিয়াম।

সেই একরোখা জেদ!সিয়াম মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গাড়ীর ডোর খুলতে ব্যস্ত হলো।তাতে যেনো দীবার রাগটা চড়ে গেলো।সিয়ামের হাত চেপে ধরে তেজস্বী গলায় বললো–সিয়াম,বাড়াবাড়ি ক….

সিয়াম কথা বলতে দিলোনা দীবাকে।পিছে মুড়ে মেয়েটাকে টেনে কাছে এনে দুগাল চেপে ধরলো।ফের তার কথার তেজস্ক্রিয় থামিয়ে দিলো নিজের ঠোঁটের সিক্ততায়।দীবা ছটফট করলো।ছাড়লো না সিয়াম।এতোদিন মেয়েটাকে ইচ্ছেমতো বিরক্ত করলেও,কখনো কোনোবিষয়ে জোর করেনি।জোট খাটায়নি তারউপর।তবে মনে হচ্ছে,এবার থেকে একটুআধটু খাটাতেই হবে।এই ট্রেনিং সে নিভানের থেকে পেয়েছে।ইচ্ছেমতো চড় কিল চললো সিয়ামের বুকে কাঁধে।তবুও ছাড়লোনা সে।একটা সময় গিয়ে নিজেকে ছাড়াতে না পেরে নিশ্চুপ হয়ে গেলো দীবা।সুযোগ লুফে নিলো সিয়াম।সময় সুদীর্ঘ হলো।সেই সুদীর্ঘ সময়টা পার হওয়ার পর সিয়ামের মনোহলো দীবার শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে ছেড়ে আসছে। ততক্ষণাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে বুকে আগলে নিলো সে।

‘স্যরি লক্ষ্মীটি!আমি জোর করতে চায়নি তোমাকে।ট্রাস্ট মি,আমি জোর করতে চায়নি তোমাকে।এই সংসারটা তোমার।সবকিছু ভুলে গিয়ে চলো-না দু’জনে মন দিয়ে সংসারটদ করি।প্লিজ দীবা।

‘আই হেইট ইউ সিয়াম।আই হেইট….

আর বলতে পারলোনা দীবা।সারাদিনের মানসিক টানাপোড়েনে আর নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারল না।সিয়ামের বুকের টিশার্টটা খামচে কেমন নিস্তেজ হয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো তারই বুকে।সিয়াম সময় নিলো।দীবার কথা বিশেষ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়ী থেকে বের হলো।গেটের দরোয়ান যেনো এই সময়টার অপেক্ষায় তথাস্তু ছিলো।বাড়ির সামনে ছোটো সাহেবের গাড়ী দেখে সে আগেই দরজা খুলে বসে ছিলো।কিন্তু গাড়ি থেকে যখন কেউ নামছেনা,ভিতরে ঝগড়াঝাটির মৃদু শব্দ ভেসে আসছিল কানে।তিনি মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিলেন।বড়লোকদের ব্যাপার স্যাপারই অন্যরকম,এতে মনকান না দেওয়াই শ্রেয়।দীবাকে কোলে নিয়ে বাড়ির দরজায় পৌঁছাতেই দেখলো,দরজা খোলা।বাড়ি দেখাশানার মহিলাটি সোফায় বসে আছে।মা বাবা বাড়িতে নেই,আপতত ওবাড়িতে।সিয়ামকে দেখতেই অর্ধবয়স্ক মহিলাটা তড়িৎ উঠে দাঁড়ালেন।সিয়ামের কোলে দীবাকে ওরকম নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে সহসা জিজ্ঞেস করলেন।

‘বউমার কি হইছে?

‘এমনিতেই একটু অসুস্থ,এছাড়া কিছু নয়।আপনি ব্যস্ত হবেন না।আর দরজা লাগানোর দরকার নেই,আমি গাড়ি পার্ক করে দরজা লাগিয়ে দেবো।আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।

আর কথা না বাড়িয়ে সিয়াম নিজেদের ঘরের দিকে চলে গেলো।ভদ্রমহিলা কেমন নিস্পাপ চোখে দেখলেন সেটা।স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়ে আলাদা থাকছিলো দু’জনে।মিটে গেলো সব!মিটে গেলেই ভালো।আরও কিছু ভাবতে ভাবতে তিনি চলে গেলেন।

বিশাল বড়ো বাড়িটার সর্বত্র আলো জলছে।আশেপাশে থেকে ভেসে আসা মৃদু আলোতে দীবাকে নিয়ে রুমে ঢুকলো সিয়াম।মেয়েটাকে যেনো আরও নিস্তেজ মনেহলো।কোনো সাড়াশব্দ নেই।একদম কাদামাটি।
দীবাকে বেডে শুইয়ে দিয়ে গায়ে ভারী কম্বল জড়িয়ে দিলো সিয়াম।মেয়েটা কোনো উফতাক শব্দ করলোনা।আর না সিয়াম ডাকলো।যদি ঘুমিয়ে থাকে ঘুমাক।আর যদি জেগে থেকে-ও, নীরব থাকতে চায়।তবে থাকুক।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের নরম আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে, দরজা টেনে বাহিরে চলে গেলো সিয়াম।গাড়িটা পার্ক করতে হবে।সিয়াম চলে যেতেই চোখ খুললো দীবা।মূহুর্তেই বালিশ জড়িয়ে নিঃশব্দে কেঁদে দিলো।কিছুক্ষণ বাদে সিয়াম এসে দেখলো,দীবা ঘুমিয়ে পড়েছে।চোখের কোণে নোনাঅশ্রু।কিছুসময় চেয়ে চেয়ে দেখলো সেই জ্বলজ্বলে অশ্রু।তারপর নরমস্পর্শে তা মুছে দিলো।আলতো স্পর্শে ঠোঁট ছোঁয়ালো দীবার কপালে।রাগী জেদী মেয়েটা হয়তো শরীরের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে এইমূহর্তে তার সবকিছু মেনে নিয়েছে,কাল কি হবে এর পরিনিতি?জানা নেই সিয়ামের।জানা নেই বলতে ভুল।জানা আছে,তবে যা হয় কাল দেখা যাবে।আপতত এই নিয়ে ভেবে এখন মনস্তাত্ত্বিকে পীড়া দিয়ে লাভ নেই।দীবার কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে,ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো সে।

সময়টা বসন্তের মধ্যে প্রহরের দিনগুলো চলছে।শীতের হিমহিমভাব আমেজ পুরোপুরি কাটেনি তখনো।যদিও বসন্তেও তার প্রভাব হালকা পাতলা চলে। তবে এবার
বসন্তে তার প্রতাপ বেশ ভারী প্রকট।কুয়াশাচ্ছন্ন হিমশীতল এক ভোর।ঘুম ভেঙে গেল কৌড়ির।নড়াচড়া করতে গিয়েই বুঝতে পারলো, কারও শক্তপোক্ত একটা হাতের বাঁধনে জড়িয়ে আছে তার হালকা পাতলা ছোট্রো শরীরটা।নিদ্রায়মাণ সকল ইন্দ্রিয় যেনো মূহুর্তেই সজাগ হলো।সহসা চোখ খুললো সে।টের পেলো,গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে তার পিছনে নিদ্রায়িত এক দীর্ঘাকার পুরুষ।যার ভারী নিঃশ্বাসের ধোঁয়াগুলো তীব্রভাবে ছুয়ে যাচ্ছে তার গলা, ঘাড়, কাঁধ, পিঠজুড়ে।যার বলিষ্ঠ পুরুষালী শক্তপোক্ত বুকের পাটায় মিশে আছে তার পেলব দেহ।আর সেই মানুষটার একটা হাতের পোক্ত বাহুতে এলিয়ে আছে তার মাথা।আর অন্য হতটা জড়িয়ে রয়েছে তার কোমর ছড়িয়ে পেটে।সেই লোমভরা আকর্ষণীয় হাতটার উপর তার হাতটা রাখা।অতঃপর দু’জনের অর্ধ শরীর পর্যন্ত শীতবস্ত্রে ঢাকা।

নিজের অবস্থান ঠিক কোথায় লেপ্টে আছে?বুঝে উঠতেই সকল ইন্দ্রিয় কেমন তড়িঘড়ি নিয়ে সচল হলো।আর তারচেয়ে দ্বিগুন ব্যস্ততা নিয়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইতে শুরু করলো অনুভূতির উষ্ণ প্রবাহিতা।নড়তে চাওয়া হাত পা মূহর্তেই অসাড় বনে গেলো।কাল বেশ রাতে ফিরেছে তারা।সারাদিনের সাজপোশাকে শরীর কেমন ম্যাজম্যাজ করছিলো।রুমে ঢুকেই তাই আগে গোসল করে নিয়েছিলো কৌড়ি।নিভান আগেই ফ্রেশ হয়ে বিছানা পরিপাটি করতে ব্যস্ত ছিল।ফুলেফুলে সাজানো বেডটা মুলত পরিস্কার করছিলো।কৌড়ি গোসল সেরে বের হতেই,দায়িত্ববান ব্যক্তির ন্যায় তাকে জিজ্ঞেস করলো–একসাথে ঘুমাতে কোনো অসুবিধা নেইতো?

সেই নিজথেকে কাছে যাওয়া। প্রগাঢ় চম্বুন।তারপর কি করে বলে,আমার অসুবিধা আছে।যদিও কৌড়ির অসুবিধা ছিলাে-না।ছিলো একরাশ লজ্জা।যা সমগ্র শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছিলো তখন।আর চেনা মানুষটার সাথে একসাথে কাছাকাছি থাকার সংকুচিততা।রন্ধ্রে রন্ধন সেই সংকুচিততা তখন ঘুরেফিরে চলছিলো।কি উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে,নিরাশিত ভঙ্গিতে কেমন কেমন করে চেয়েছিলো মানুষটার দিকে।মানুষটা বরাবরের মতো কি বুঝেছিলো কৌড়ির জানা নেই।তবে
কাছে এসে কোমল স্বরে বলেছিলো–একটু একটু করে, তুমি এক-পা আমি-পা এগিয়ে সহজ করে নেই আমরা আমাদের সম্পর্কটা?তুমিও তো এগিয়েছো,আমি-ও এগিয়েছি।এবার দু’জনে একসাথে এগোই?

সেই প্রগাঢ় চুম্বনের কথা মনে পড়তেই অনুভূতিতে জুবুথুবু হওয়া কৌড়ি কোনো কথাই বলতে পারিনি।শুধু মাথা নিচু করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।তবে মৃদুতর মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে হ্যা সম্মতি প্রকাশ করতেও ভুলেনি।কারণ মানুষটা যে তার সম্মতির দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলো।সেই মানুষটাকে উপেক্ষা করা যে অমর্যাদা।

‘তবে এসো ঘুমাবে।

বার্তা জানিয়ে মানুষটা সরে যেতেই লজ্জায় বুদ হয়ে থাকা কৌড়ি নড়েচড়ে দাড়ালো।মুখ উঁচু করে বেডের দিকে তাকাতেই ভিতরটা কেমন কম্পিত হলো।মানুষটার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে হবে!শুধু আজ নয়,এরপর থেকে রাত থাকতে হবে।স্বাভাবিক। তবুও কদম ফেলে সেদিকে যাওয়ার জন্য পা উঠতে চাইলো না তার।হঠাৎ নিভানকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখেই তারদিকে ফিরলো।অমায়িক হাসলো নিভান।হাতে মোটাসোটা একটা খাম তার।সেটা কৌড়ির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো—তোমার মোহরানা।স্বামী প্রদত্ত প্রাপ্য দেনমোহর। নাও।

কৌড়ির কয়েক পলক নিভানের দিকে আর হাতের খামটার দিকে তাকিয়ে নমনীয় কন্ঠে বললো–আপনার কাছে রেখে দিন।আমি কি করবো।

‘আমার কাছে কেনো রেখো দেবো?এটা একান্ত তোমার প্রাপ্য। এটা দিয়ে তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারো।এই অর্থ আমার উপার্জন হলেও এটাতে আমার হক নেই যে, আমার কাছে রেখে দেবো।আর হক থাকলেও কি!এখন থেকে এঘরসহ এঘরের মালিকের দায়িত্ব তোমার।তার সবকিছুর হক তোমার।তাই স্ত্রী হিসাবে তার ভালোমন্দের সবকিছুর দায়িত্ব,হক তোমাকেই পালন করতে হবে।আমার সবকিছুর দায়িত্ব পালন করতে চাওনা? নেবেনা তুমি?

শ্বাস রূদ্ধ হওয়ার মতো প্রশ্নাবলী!যার উত্তর কৌড়ি মুখ ফুটে দিতে পারিনি।অথচ ভিতরে ভিতরে মন ঠিকই উত্তর দিয়েছিলো।-হ্যা আমি স্ত্রী হিসাবে আপনার সকল দায়দায়িত্ব আমৃত্যুকাল নিখুঁতভাবে পালন করে যেতে চাই।তবে মুখ কথাগুলো বলতে না পারলেও,আচারনে ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছিলো।নীরবে মানুষটা বাড়িয়ে রাখা খামটা নিজের দু’হাতে তুলে নিয়েছিলো।তারপর ফুলসজ্জার রাত উপলক্ষে মানুষটা তাঁকে আরও একটা বিশেষ উপহার দিয়েছিলো।একটা দামী নীলাপথরের চেইন।সেটা নিজ হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বলেছিলো– এটা ছিড়েখুঁড়ে না যাওয়া পর্যন্ত কখনো গলা থেকে খুলবে-না।আমার নজর সবসময় তোমার গলায় ওটা জ্বলজ্বল আভা ছড়িয়ে পড়তে দেখে যেনো তৃপ্ত হয়।কখনো খুলবে না। কেমন?

অদ্ভুত মোহনীয় আবদার।মোহিত হয়েছিলো কৌড়ি।নিভানের কথার মায়ায় ডুবে সম্মতি-ও জানিয়েছিলো।
আর শুধু চেয়ে চেয়ে নিষ্পলক চোখে দেখেছিলো শ্যামবর্ণ মানুষটাকে।যেদিন থেকে মানুষটা নিজের বলে তাকে দাবী করলো।তারপর থেকে একটু একটু করে পৃথিবীর সমগ্র সুখ যেনো তার আঁচলে নিঙড়ে দিতে শুরু করলো।যাকে কৌড়ি কিছুই দিতে পারছে-না।আর সামনে কি দিতে পারবে,জানা নেই।

তারপর কৌড়ির হাত থেকে খামটা নিয়ে সোফার উপর রেখে দিয়ে মানুষটা খুব মায়াময় কন্ঠে বলেছিলো-চলো ঘুমাবে।আজ তিনদিনে অনেক ক্লান্তি গিয়েছে।তারউপর তুমি অসুস্থ।

কি সাবলীল বানী।মনেহয়,কতোদিনের সহধর্মিণী সে।তাকে নিয়ে গিয়ে বেডে শুইয়ে দিয়ে,খুব আদূরে একটা চুম্বন দিলো তার কপালে।তারপর নিজে গিয়েও শুয়ে পড়লো তার পাশে।দুজনের গায়ে ভারী কম্বল জড়ালো।সেদিনের সেই কম্বলটা।যে কম্বলটা নাফিম আর তার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলো মানুষটা।যাতে এখনো মানুষটা গায়ের পারফিউমের তীব সুগন্ধে সুগন্ধিত হয়ে আছে।পুরো ঘরটাজুড়ে মানুষটার সুগন্ধে যেনো সুগন্ধিত।সেই ঘরের মালিক আস্ত পাশে তার,নাকে সুগন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর লাগতেই সারাদিনের ক্লান্তি অবসাদে ডুবে এলো আঁখি। ঘুম এসে গিয়েছিলো মূহুর্তেই।তারপর আর কৌড়ির কিছু জানা নেই।একদম কিছু জানা নেই।এমনিতেই ঘুম কাতুরে মেয়ে সে।তারপর আজ কয়েকদিন ঔষধের প্রভাবে ঘুমালে যেনো চোখ মেলাতেই পারছে-না।আর গতকাল এতো ক্লান্ত ছিলো শরীর।ঘুমের মধ্যে কিচ্ছু টের পায়নি সে।তবে ঘুমাবার সময়তো এতো কাছাকাছি ঘুমাইনি তারা।তবে?

তবে?ভেবেই যেনো মুখে অস্পষ্ট হাসি ফুটলো কৌড়ির।এই হাসির কারণ কি,তার জানা নেই?তবে কালতো মৌনতা তাকে এভাবে জড়িয়ে শুয়েছিলো,কৈ এরকম অনুভব তো হয়নি!সময় নিয়ে নিজের অনুভুতিগুলোকে ধাতস্থ করলো কৌড়ি।তারপর আলতো হাতে গায়ের ভারী শীতবস্ত্রটা সরিয়ে ফেললো।নিজের পেটের উপর শক্তপোক্ত হাতটায় হাত রাখতেই ভিতরটা কেমন ছমছম করে উঠলো।তবু্ও নরম স্পর্শে সেই হাতটা ধরে সরিয়ে নিভানের গায়ে জড়ানো ভারী কম্বটার উপর রেখে তড়িৎ উঠে বসলো।মূহুর্তেই নড়েচড়ে উঠলো পিছনের মানুষটা,ফের শান্ত।কৌড়ি পিছে মুড়লো।

নীল সবুজের ধিমে আসা মিঠে আলোতে শ্যামবর্ণ মুখটা স্পষ্ট।নিদ্রাত বুজে থাকা চোখ,গাঢ় শ্বাসপ্রশ্বাস বলে দিচ্ছে মানুষটা এখনো গভীর ঘুমে।সেই ঘুম ভাঙার চেষ্টাও করলোনা কৌড়ি।সামনে ফিরে শব্দহীন নেমে পড়লো বেড থেকে।অপরিচিত রুমটায় আশেপাশে খেয়ালি নজরে তাকালো।সবকিছু নতুন,অপরিচিত। যেখানে আগে আসা হয়নি কখনো,কালকে রাতেই প্রথমে আসা এই রুমে।রুমের জানালা দরজা সব বন্ধ। প্রতিটি জানালা দরজায় ভারী ভারী পর্দায় শোভায়িত।রুমটা নীরব,শান্ত।রাতের মধ্যে আলোহীন।শুরু কৃত্রিম আলোটা ছাড়া বাহিরের পরিবেশ বোঝা দুঃসাধ্য।কয়টা বাজে?ঘুরেফিরে বামপাশের দেয়ালের দিকে ফিরতেই বড়সড় একটা দেয়ালঘড়ি নজর পড়লো।সেখানে সময়ের কাটাগুলো স্পষ্ট জানান দিচ,৫ঃ১৫।অর্থাৎ ফজরের আযান শেষে এখন ভোর।কৌড়ি বেডের দিকে আরও একবার তাকিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।হঠাৎ মনেহলো গায়ে ওড়না নেই।চমকে তড়িৎ আবার ফিরে এলো।মানেটা কি?গায়ের ওড়না গেলো কোথায়?নিজের শোয়ার জায়গাাটা অনুসন্ধান করে না পেয়ে,আস্তেধীরে নিভানের গায়ের কম্বলটা উচু করলো।মানুষটার শরীর দিয়ে পিঠের নিচে জড়িয়ে আছে ওড়নাটা।ভুলেও চেষ্টা করলোনা ওড়না ছাড়ানোর।কম্বলটা ঠিকঠাক করে দিয়ে,আশেপাশে নজর দিলো।কালকে নিভানের জড়িয়ে দেওয়া হিজাবটা সোফার উপর দেখে তড়িৎ গিয়ে সেটা উঠিয়ে নিজের গায়ে মাথায় জড়িয়ে নিলো।অদ্ভুত ভঙ্গিতে বুকে হাত চেপে শ্বাস নিয়ে আরও একবার বেডের দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।সময় নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নামাজ পড়ে নিলো।কাল পিরিয়ড নিয়ে সন্দেহ থাকলেও,রাতে গোসলের পর সন্দেহটা কেটে গিয়েছে।রাতে গোসলটা সে ঋতুশ্রাব থেকে সুস্থ হওয়ার বদলে ফরজ গোসলের নিয়তেই করেছিল। বিধায় সন্দেহের প্রবনতা যেমন নেই,নামাজ পড়তেও অসুবিধা নেই।নিজে নামাজ পড়ার পর,গভীরঘুমে শয়নরত মানুষটাকেও ডেকে উঠিয়ে নমাজ পড়াতে মন চাইলো।তবে কোনো এক দ্বিধায় পড়ে মানুষটাকে আর ডেকে উঠানো হলো-না।নামাজের বিছানায় বসে নিজের অতিত বর্তমান নিয়ে বেশ ভাবলো।কতো দ্রুত নিজের জীবনের গতিবিধি পাল্টে গেলো।কাল এসময় কোথায় ছিলো,কি করছিলো!আর আজ কোথায়?

জায়নামাজ থেকেও ওই মানুষের শরীরের পারফিউমের সুগন্ধ।আশ্চর্য!মানুষটা ঘরের প্রতিটি জিনিসে সুগন্ধটা কি নিজ ইচ্ছাকৃত ছড়িয়েছে?নাকি তার স্বীয় সুগন্ধে সিক্ত হয়েছে এঘরের প্রতিটি জিনিস।হঠাৎ নিজের শরীর থেকেও একই সুগন্ধ অনুভব করলো কৌড়ি।শিহরিত হলো শরীর।তার গায়ে তো ইচ্ছেকৃত পারফিউমের ছিটেফোঁটা লাগানো হয়নি।এমনকি মানুষটা লাগিয়েও দেয়নি।তবে কি?তার খুব কাছাকাছি ঘুমানোর ফলশ্রুতি!তাই হয়তো।এঘরের সবকিছুর মতো স্বীয় সুগন্ধে সিক্ত করেছে তাকেও।আপন মর্জিতে ঠোঁট প্রসারিত হয়ে এলো কৌড়ির।নামাজের বিছানাটা গুছিয়ে আবারও বেডের দিকে নজর দিলো।লম্বাচওড়া মানুষটা কেমন কম্বলটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিস্পাপ বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে।নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ দেখে,নিঃশব্দে রুম থেকে বের হলো কৌড়ি।

আজ যেনো রুমের বাহিরে পা ফেলতে কিছুটা অস্বস্তি কাজ করলো কৌড়ির। কিছুক্ষণ দরজার মুখে দাঁড়িয়ে এদিকে ওদিকে তাকালো।বাড়িটা নিঃশব্দ।হয়তো সবাই এখনো ঘুমে।এবার ধীরে ধীরে পা এগোলো কৌড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ এলো কানে।এসময়ে রানীসাহেবা থাকে কিচেনে।কোথায় যাবে ভেবে না পেয়ে সেদিকে এগোলো সে।সত্যি রানিসাহেবা কিচেনে।চুলার উপর চায়ের প্যান বসানো।তাতে অর্ধ প্যান পানি।পানি এখনো শিথিল।হয়তো কেবল পানি বসিয়েছে।পানি বসিয়ে তিনি সকালের নাস্তা বানানোর সরঞ্জাম রেডি করছেন।তাকে কিচেনে দেখেই সহসা তিনি কেমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন।

‘আরেহ নতুন বউ তুমি এতো সকালে এখানে কেনো?

কৌড়ি যেনো লজ্জায় পড়লো।”নতুন বউ” রানিসাহেবার মুখে হঠাৎ এমন সম্বোধন তাকে কেমন লজ্জার আড়ষ্টতায় ফেলে দিলো।ভেতরটা অদ্ভুত অনুভূতিতে হাসফাস করে উঠলো।তবুও বাহিরে নিজেকে ঠিক রাখার প্রচেষ্টা করে অপ্রস্তুত হেসে বললো–আমি-তো রোজ এরকম সকালেই উঠি।আপনি তো জানেনই।

‘তবে আজ।

কথাটা বলে নিজেও যেনো কেমন থতমত খেলেন।যেটা তার মুখভঙ্গিমায় প্রকাশ পেলো।কৌড়ি যেনো আরও অপ্রস্তুত হলো।তবে পরিস্থিতিতি সামলাতে
বললো–আজও ঘুম ভেঙে গেলো, তাই উঠে পড়লাম।
ঝুড়ির মরিচগুলো আপনার বাগানের না?

রানাঘরের কেবিনেটের পাশে বড়সড় একটা ঝুড়িতে গাছসহ মরিচগুলো রাখা।সেগুলো দেখেই মুলত বললো কৌড়ি।সেটা খেয়াল করে রানী বললো — হ্যা। শীতের আগে লাগিয়েছিলাম।বিয়ে উপলক্ষে বাড়ির চারপাশটা পরিস্কার করায়,সব গাছগুলো কেটে ফেলানো হয়েছে।

‘মরিচগুলোতো এখনো সেভাবে বড় হয়নি।আরও বড়বড় হতো তো।গাছগুলো কাটলো কেনো?আপনার লাউশাক শাছ,পুঁই মাচা সবকিছু কেটে দিয়েছে।

রানী হাসলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো –হ্যা। পিছনের আগানবাগান সব পরিস্কার করে ফেলেছে তো।

কৌড়ির মন খারাপ হলোা।রানীসাহেবা কতো শখ করে গাছগুলো লাগিয়েছিলেন।এক বিয়েতে সব নষ্ট হয়ে গেলো।বাড়ির ভিতরের কাজকাম গুছিয়ে,প্রায়শই তিনি সেখানেই সময় দিতেন।সেই সময়টা বৃথা গেলো।ইশশ।
সদ্য বিবাহিত রমনীর জৌলুশ মুখটা মূর্ছা যেতে দেখেই রানি বললো–মন খারাপ লাগছে? মন খারাপ করোনা কৌড়িমনি।আল্লাহ বাচিয়ে রাখলে,সামনের বছর আবার লাগাবো সবকিছু।এবারের সবজিবাগানের কৃষাণী আমার সাথে নাহয় তুমিও হলে।কি হবে না?

মূহুর্তেই মেঘ কেএে গিয়ে যেনো ঝলমলে রৌদ্দুর ভর করলো কৌড়ির মুখে।কন্ঠেও সেই ঝলমলতা বজায় রেখে কৌড়ি বললোো–ঠিক আছে রানীসাহেবা।এবারের সবজি বাগান করতে,অবশ্যই আমি আপনার সঙ্গী হবো।

রান্নাঘরের ছোটো টুলটা টেনে বসে পড়লো কৌড়ি।মরিচের ঝুড়িটা টেনে নিতেই রানী বললো–আরেহ কি করছো?

‘মরিচগুলো বেছে রাখি।আমিতো সেভাবে কাজ জানিনা যে আপনাকে সাহায্য করবো।আর দাদিআপার থেকে যেটুকু শিখাছিলাম,তাতো এবাড়িতে এসে ভুলেই গেছি।

‘তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে-না।আর ওগুলো বাছতে গেলে হাত জ্বলবে-তো।সদ্য মেহেদী মাখা সুন্দর হাতদুটো জ্বলনে ব্যবহার করলে,নিভান বাবাতো বাড়ি মাথায় তুলবে।তোমার প্রতি যা যত্নবান ছেলেটা!অবশ্যই সবার প্রতি খেয়ালি,যত্নবান ছেলেটা।

‘উনি কিচ্ছু বলবেন না।

কথার ফাঁকেই কৌড়ি মরিচগুলো বাছা শুরু করে দিলো।রানী তার মেহেদীরঙা হাতদুটোর দিকে চেয়ে রইলো।গাঢ় খয়েরী মেহেদীরঙা ফর্সা হাতদুটো নজর কাড়ছে প্রচন্ড।সেই হাতদুটো নড়েচড়ে কাজ।কি অদ্ভুত সুন্দর যে দেখাচ্ছে।

‘রানিসাহেবা,ঝুড়ির মধ্যে তো দেখছি মরিচ বাদেও টমেটো বেগুন শিম মিশ্রিত।ঝুড়ি দিন আমি আলাদা আলাদা করে গুছিয়ে দিচ্ছি।

‘বললাম তো তোমার কিছু করা লাগবেনা,কৌড়িমনি।

‘দিন না আপনি।

রানি বাধ্য হলো দিতে।কৌড়িও ঝটপট হাতে একে একে আলাদা আলাদা গুছিয়ে দিতে থাকলো সবকিছু।রানী নাস্তা বানানোর কাজে মন দিলো,চায়ের দিকেও খেয়াল করলো।দুদিকেই নজর তার।তারমধ্য কৌড়ির সাথে টুকিটাকি গল্পে মেতে থাকলো।

‘রানিসাহেবা,তুমি একা একা কারসাথে এতো কথা বলছো?

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গিয়েছে মান্যতার।নিজের একান্ত বেডটায় একা একা ঘুমাতে ঘুমাতে অভ্যাস হয়ে গেছে।কৌড়ি আর মৌনতা থাকলে বা দুই একজন থাকলে ততোটা ঘুমের অসুবিধা হয়না।কালরাতে বেশ কয়েকজন একসাথে ঘুমানোর ফলে,রাতে ঘুমে-তো ব্যাঘাত ঘটেছেই।সাথে সকালে আর ঘুমিয়ে থাকতেই পারলো-না।এতো সকালে কাকে গিয়ে বিরক্ত করবে,তাই বাগানের দিকে যাচ্ছিলো।ড্রয়িংরুম পার হতেই রানীসাহেবাকে কথা বলতে দেখেই কৌতুহলবশত কিচেনের দিকে এগোলো।কিচেনে রানিসাহেবাকে একা কথা বলতে দেখে কৌতুহল যেনো তার দ্বিগুন হলো।তাই সহসা প্রশ্নটা করলো।কৌড়ি নিচে টুল পেতে বসে থাকায় কেবিনেটের আড়ালে তাকে দেখা যাচ্ছিলো না।

‘আমি একা কই?নতুন বউমাও তো আছে।

‘নতুন বউমা?

হাসলো রানী।বললো–‘কৌড়িমনি।

কৌড়ি!সহসা বড়বড় পা ফেলে রান্নাঘরে ঢুকলো মান্যতা। তাকে দেখে অমায়িক হাসলো কৌড়ি।সহসা মান্যতা প্রশ্ন করলো –তুই সাতসকালে সকালে এখানে?

পুনরায় একই প্রশ্নে লজ্জা পেলো কৌড়ি।মান্যতাও প্রশ্ন করে কেমন যেনো বিব্রত হলো।রানীসাহেবার দিকে একপলক তাকিয়ে দেখলো,তিনি নিজের কাজে ব্যস্ত। কৌড়ির উত্তরের অপেক্ষা নাকরে বললো–চল।বাগান থেকে ঘুরে আসি।

ততক্ষণে কৌড়ির গোছানো প্রায় শেষের দিকে।তাই বললো–আর একটু আছে। এটুকু করে নেই।

‘রানীসাহেবা,তুমি একটু করে নিতে পারবে-না?ওকে নিয়ে যাই?

রানী ততক্ষণাত বললেন–আচ্ছা যাও।কৌড়িমনি তুমি উঠো,ওটুকু আমিই করে নেবো।এতবার নিষেধ করলাম শুনলে তো না।যাও হাত ধুয়ে বড়মায়ের সাথে যাও।

কৌড়ি বাধ্য মেয়ের মতো হাত ধুতে সিংয়ের সামনে দাড়ালো। মান্যতা দুষ্টমী গলায় ততক্ষণাত বললো–রানী সাহেবা,কৌড়িমনি থেকে’তোমার নতুন বউমা ডাকটা কিন্তু দারুন ছিলো।

ফের আমায়িল হাসলো রানী।বললো—আচ্ছা এবার থেকে তবে তাই বলে ডাকবো।

মান্যতার দুষ্টমি বুঝে কৌড়ি রাণীকে উদ্দেশ্য করে বললো–‘আপনার কৌড়িমনি ডাকটা আমার কাছে আরও আদূরে লাগে।

রানি সহসা উত্তর দিলো–‘আচ্ছা মাঝেমধ্যে নাহয় কৌড়িমনি বলেও ডাকবো।

মান্যতা মিছেমিছি বিরোধিতা করে বললো—তুই নতুন বউ তোকে কেনো কৌড়িমনি বলে ডাকবে।আগে এই বাড়ির মেয়ে মনে করে রানীসাহেবা নাহয় আদর করে ডাকতেন।এখন তার নিভান বাবার বউ তুই।এখন আর আদূরে নাম টাম না।বউ ইজ বউ।সো নতুন বউ বলে ডাকবে রানীসাহেবা।

কৌড়ি এসে মান্যতার হাত পেচিয়ে ধরলো।মিষ্টি অভিমান দেখিয়ে অভিযোগ করলো–পর করে দিতে চাইছো?

‘রায়বাঘিনী ননদিনী আমি তোর।নাম রক্ষা করতে হবে না!

কৌড়ি এবার মান্যতা জড়িয়ে ধরলো।আহ্লাদিত কন্ঠে বললো—তুমি আমার ভালো আপু।

‘আর তুই আমার দাদাভাইয়ের বউ।তুই জানিস?দাদাভাই আমাদের কাছে কি?আর তুই তার বউ!পুতুল বাচ্চা বউ!সবার আদূরে।এবাড়ি সংক্রান্ত আগে যে ভালোবাসা পেয়েছিস,তা আমাদের সম।অথচ ওই মানুষটার সবার কাছে আলাদা,সবার কলিজার একটুকরো আদর। ভালোবাসা।এবার সবার কাছে ভালোবাসা পাবি দাদাভাই স্পেশাল,আদর ভালোবাসা।সে সবার মধ্যেমনি মানে তার বউও।সেখানে কারও হিংসা বিদ্বেষও,সেই আদর ভালোবাসা একতিল কমার নয়।কমবেও না।তাই না রানীসাহেবা?

রানী সেকেন্ড সময় ব্যয় না করে উত্তর দিলো–একদম তাই।

তা কি আর কৌড়ি জানেনা!হাসলো তিনজন।ফের মান্যতা তাড়া দিয়ে বলো।–চল।

‘তুই যে ভাবী।ননদ হয়ে একটু মজা করবো।পারছি-না।বড় দাদাভাইয়ের বউ বলে কথা।মজা করতে কলিজায় মোচড় দিচ্ছে।

মান্যতার বলার ভঙ্গিমা দেখে হেসে দিলো কৌড়ি।বললো –কলিজায় মোচড় দিচ্ছে যখন,তখন আর মজা করে লাভ নেই।

হঠাৎ নীরব হলো দুপাশ।দুজনে হেঁটে চললো লন এরিয়া ছাড়িয়ে বাগানের দিকে।লন এরিয়ার অন্যপাশে তখনো বিয়ের স্টেজটা সাজানো গোছানো মোড়ানোয়।এপাশে সারিবদ্ধ করে বিভিন্ন ফুলের বাগান।বিয়ে উপলক্ষে গাছগুলো সুন্দর করে ছেটেছুটে পরিচ্ছন্ন করে সাজানো হয়েছে।মুল গেটের থেকে গাড়ি পার্কিং- এরিয়া পর্যন্ত সারিবদ্ধ দুটি ঝাউগাছের ফাঁকে ফাঁকে একটা করে বেলীফুলের ঝাড়।তাতে থোকা থোকা ফুল ফুটেছে।ঝাঁপানো গাছের নিচেও ফুল ঝরে পড়েছে। সকালের কুয়াশাচ্ছন্ন শিশিরভেজা ঘাসের উপরে পড়া শুভ্র ফুলগুলো এতো সতেজ স্নিগ্ধ। দুহাতে কিছু ফুল কুড়িয়ে নিলো কৌড়ি।তা দেখে মান্যতা ও কুড়ালো কয়েকগাছি।হঠাৎ কৌড়ি শুধালো।

‘তৃনয় ভাইয়া,তোমাকে পছন্দ করে আপু?

বিস্ময় নিয়ে কৌড়ির মুখের দিলো তাকালো মান্যতা। কৌড়ি বুঝলো কি-করে?এ ব্যাপারে সেভাবে তো কেউ জানেনা।তবে কৌড়ি জানলো কিকরে?ভিতরটা কেমন হাসফাস লাগলেও বাহিরটাতে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো সে।সময় নিয়ে কেমন এড়ানো স্বরে বললো–

‘উনি কেনো আমাকে পছন্দ করবেন!যাই হোক, চল ওদিকে যাই।কি সুন্দর গোলাপ ফুটেছে দেখ।আমাদের ডাকছে যেনো।

কৌড়ি দ্বিতীয়ত প্রশ্ন করার সুযোগ পেলোনা।তার আগেই তার হাতটা ধরে গোলাপের সারিবদ্ধ বাগানের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো মান্যতা।আগে খেয়াল না করলেও আজ তিনদিন ধরে খেয়াল করছে,মান্যতা আপুর দিকে অদ্ভুত নজরে তৃনয় ভাইয়ার চেয়ে থাকা।মান্যতা আপুর একটু কাছে ঘেঁষতে চাওয়া,থেকে থেকে কথা বলার উদ্বিগ্নতা। অথচ মান্যতা আপু তাকে যেনো চেনেই না।কেনো এমন আচারন?তার নজরে যদি তৃনয় ভাইয়ার ভালো লাগাটা প্রকাশ পেয়ে থাকে,তবে কি মান্যতা আপুর নজর সেই ভালো লাগাটা।তার প্রতি ছেলেটার দূর্বলতা নজরে পড়েনি?সত্যিই কি পড়েনি?

‘হিজাবটা কিন্তু দারুন।তোকে বেশ মানিয়েছে।দারুন দেখাচ্ছে। দাদাভাই দিয়েছে?

হিজাব পরা তো অনেক আগেই দেখেছে!প্রশ্ন এখন?প্রসঙ্গ এড়াতে চাইছে আপু?হয়তো-বা।তাই কৌড়ি-ও আর সেসবে কৌতূহল দেখালোনা।শুধু মান্যতার প্রশ্নে ছোটো করে উত্তর দিলো–হুমম।

দু’জন প্রসঙ্গ পাল্টে মজে গেলো কথায়।কথার ফাঁকে দুষ্টমি হলো।মজা হলো।শিশিরভেজা ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা হলো।তার ভেজা মাতাল গন্ধ নেওয়া হলো।কিছু স্নিগ্ধ ফুল তুলে কানে গোঁজাও হলো।এভাবেই চলতে থাকলো তাদের ভোরের বাগান বিলাশ।

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিবিড়চোখে সদ্য বিবাহিত বউয়ের আর বোনের সকাল সকাল উচ্ছ্বসিত হওয়া পাগলামো গুলো দেখতে থাকলো নিভান।কাল মেয়েটা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে সুক্ষ স্পর্শে কাছে টেনে নিয়েছিলো সে।কিকরে পারতো,মেয়েটাকে পাশাপাশি রেখে কাছে না টেনে ঘুমাতে!এই মেয়েটাকে একটু কাছে পাওয়ার জন্য কতো উতলা হয়েছে মন!বরংবার তা সংবরণ করে গিয়েছে।কাল সেই সংবরণটা আর মানতে চাইনি। ধৈর্যহারা হয়ে ঘুমন্ত মেয়েটাকে নীরবে কাছে টানতে শরীর মন দুটোই বাধ্য করেছিলো।শরীরকে পাত্তা দেয়নি সে।মনটাকে পাত্তা দিয়ে মেয়েটাকে নিজের সাথে নিবিড়বন্ধনে জড়িয়ে নিয়েছিলো শুধু। কি স্নিগ্ধ শান্তিময় সে অনুভূতি।সেসব অনুভূতি ছাড়িয়ে আরও একটা অনুভূতি জেগেছিলো।তা হলো নিজের পৌরুষ অনুভূতি। যেটাকে সংবরণ করার ক্ষমতা নিভানের ছিলো।সংবরণ করেও ছিলো সে।অথচ মেয়েটাকে কাছে পাওয়ার স্পর্শে ঘুমাতে পারিনি প্রায় অর্ধ রাতের বেশিসময়।তারপর কখন কিভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলো নিজেও জানেনা।সেই বউ সকাল সকাল তার নিবিড়বন্ধন ছেড়ে পাখির মতো উড়াল দিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বেড়াচ্ছে।আজ পাখি বাঁধন ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।রোজ রোজ কি আর তা হবে!হতে দেবে-না নিভান।ওই নরম শরীরটা চুপচাপ বুকে পড়ে থাকার অনুভূতি! অবর্ননীয়!অস্পষ্ট হাসি ফুটলো নিভানের ঠোঁটে।হাসিটা ভিতরের।সুখের, প্রশান্তির।

হঠাৎ মান্যতার দিকে নজর পড়ায় ভাবনা কাটলো নিভানের।কিছু একটা ভেবে লন এরিয়ার আসার জন্য অগ্রসর হলো সে।লন এরিয়ায় পা রাখতেই দেখলো, কালকের পাতা চেয়ার টেবিলে বসে ননদ- ভাবী চুটিয়ে গল্প করছে।সাথে হাসি মজাও।তাকে দেখতেই দু-জনে চুপ হয়ে গেলো। দুজনের চোখমুখেরই দুধরনের আড়ষ্টতা।দুজনের এই আড়ষ্টতার কারণ নিভানের জানা।তাই বিশেষ গুরুত্ব দিলোনা।নিভানকে কাছে এসে দাঁড়াতেই উঠে দাঁড়ালো মান্যতা।ভাই ভাবীকে স্পেস দিতে তড়িৎ বললো—আমি আসছি।তোমারা কথা বলো।

মান্যতা কদম সামনে এগোনোর আগেই নিভান বললো—তোমার সাথে আমার কথা আছে মান্যতা।

বুক ধড়ফড় করে উঠলো মেয়েটার।কি কথা?ততক্ষনে কৌড়ি উঠে দাঁড়িয়েছে।এবার সে বললো–তোমরা কথা বলো।আমি একটু ভিতর থেকে আসছি।

নিভান ততক্ষণে বসে পড়েছে। সে কিছু বলার আগেই মান্যতা কৌড়ির হাত চেপে ধরলো।কেমন করে তাকালো তার দিকে।দাদাভাই মানেই আতঙ্ক।আর কথা আছে মানেই, ভয়ংকর কিছু।কিছুতেই কৌড়িকে ছাড়া যাবেনা।এমূহর্তে দাদাভাইয়ের সামনে সহজভাবে থাকার সাহস সে।মান্যতার পরিস্থিতি বুঝে নিজের আড়ষ্টতা কাটিয়ে নিভানের পাশের চেয়ারে বসে পড়ল কৌড়ি।তাকে দেখে বসে পড়লো মান্যতাও।নিভান সময় নিয়ে রয়েসয়ে বললো।

‘কাল তৃনয় বাবার কাছে তোমাকে চেয়ে বিয়ের প্রস্তাব রেখেছে।

শ্বাস যেনো বুকেই বিঁধে গেলো মান্যতার।তা আর বুক ভেদ করে নিঃশ্বাস হয়ে নাক দিয়ে বের হতে ভুলেই গেলো।যে ভয়টা পাচ্ছিলো,সেটাই হলো।লোকটাকে হাতের নাগালে পেলে,নিশ্চিত সে গলা চেপে ধরত।তার মতো নিঃশ্বাস না আঁটকে আসা পর্যন্ত ছেড়ে দিতোনা সে।অসভ্য লোক একটা!

‘ও বাবার আগে আমার কাছেই প্রস্তাব রেখেছিলো।বাবা এবং আমার একই কথা,তোমার সিদ্ধান্ত ইম্পর্ট্যান্ট।

বড়ো ভাইয়ের সামনে এমনিতেই সংকোচ,দ্বিধা কাজ করে।তারউপর এমন একটা বিষয়।মান্যতা আর-ও সংকুচিত হলো।কৌড়ি নীরব দর্শক।গলার কাছে বিঁধে থাকা নিঃশ্বাসটা কেমন হাসফাস করে উঠলো মান্যতার।তারসাথে মস্তিষ্কে ঘোরা একটা প্রশ্ন।মান্যতা শ্বাস ছাড়লো।দ্বিধা আড়ষ্টতা নিয়েও মস্তিষ্কে হাসফাস করা প্রশ্নটা করেই ফেললো।

‘তোমাদের সিদ্ধান্ত কি?

নিভান সহসা বললো–‘তৃনয়ের মতো ছেলেকে নাকচ করার মতো ত্রুটি বা যুক্তি তো আমি দেখছি-না।তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সুদীর্ঘ সময় কেটেছে আমার।আমার জীবনের বিভিন্ন সিচুয়েশনে আমি তাকে বন্ধুর চেয়েও ভাইয়ের মতো কাছে পেয়েছি বেশি।সেই থেকে বন্ধু কম ভাইয়ের নজরে দেখে এসেছি তাকে।আমি ওরমধ্যে আর ইভানের মধ্যে কখনো পার্থক্য করে দেখিনি। দেখিনা।এটা তুমিও জানো।আর এটাও জানো,আমি তাকে আমার ফ্যামিলির বাহিরের কেউ বলে কখনো ভাবিনি।ভাবিওনা।সেখানে আমার সিদ্ধান্ত কি হতে পারে,নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছো।তবে এখানে আমার আর বাবার সিদ্ধান্তের চেয়েও তোমার সিদ্ধান্তটা ইম্পর্ট্যান্ট। তুমি কি চাইছো?ওকে খুব কাছ থেকে দেখেছি বলে, আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে শুধু যাচাই করছি।তোমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তোমার ভাবনা আলাদা হতেই পারে।তারসাথে সংসার করবে তুমি।সেখানে তুমি তাকে কেমন নজরে দেখছো,তোমার সিদ্ধান্ত কি সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

মান্যতা কি বলবে ভেবে পেলোনা।নিঃসন্দেহে তৃনয় ভাইয়া ভালো ছেলে।তবে সমস্যা তার।সে কিভাবে সেই সমস্যাটা খোলামেলা উপস্থাপন করবে বাবা,ভাইয়ের সামনে!এমনকি সবার সামনে!প্রস্তাব যখন রেখেছে, সবার সামনে বিষয়টা প্রকাশ পেতে সময় লাগবে-না।আর ওই ভালো ছেলেকে রিজেক্ট করার কারণতো তাকে দেখানোই লাগবে।তখন কি বলবে সে?কিভাবে বলবে নিজের সমস্যাটা!তবে একটা উপায় আছে,ওই মানুষটার মুখোমুখি হওয়া।তারসাথে কথা বলা।ব্যাপারটা তো,সেই সেইম।যে লজ্জিত কারণগুলোর জন্য মানুষটাকে এড়িয়ে চলা।সেসব কারনের জন্য আবার তার মুখোমুখি। উফফ!কি যে ঝামেলায় পড়লো সে!এমন একটা সিচুয়েশনে দাড় করানোর জন্য মনেহচ্ছে, লোকটাকে হাতের কাছে পেলে সে খু’ন করে ফেলাতো।নিশ্চিত।

‘সময় নাও।তারপর হ্যা না সিদ্ধান্ত জানিও।তবে তৃনয়ের মতো ছেলের হাতে তোমাকে তুলে দেওয়া মানে,ভাই হিসাবে আমি নিশ্চিন্ত।আমরা কলিজাকে সর্বত্র দিয়ে আগলে রাখার উত্তম ভরসাযোগ্য একটা ছেলে,তৃনয়।

নিভান উঠে দাঁড়ালো।মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে মান্যতার মাথায় হাত রাখলো।ভরসাযোগ্য ছোঁয়া। ফের কোমল কন্ঠে বললো —তবে তুমি হ্যা না যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই সিদ্ধান্ত বলে মানা হবে।

নিভান চলে গেলো।কৌড়ি সেদিকে একপলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে চুপ হয়ে বসে থাকা মান্যতার দিকে তাকালো।আজ চারমাসের অধিক সময় মান্যতা আপু নামক মেয়েটাকে দেখছে সে।তার ফোন নিয়ে মৌনতা, নাফিম,সে অবাধ ঘাটাঘাটি করে।কখনো প্রেম সম্পর্কিত কোনো কিছু-তো নজরে পড়েনি।এমনকি কখনো সেভাবে কারও সাথে কথা বলতেও দেখি-নি।তবে তৃনয় ভাইয়ার মতো ছেলেকে স্বীকার করতে আপুর এতো দ্বিধা কেনো?কেনো এই নীরবতা।

‘তৃনয় ভাইয়া তো খুব ভালো ছেলে আপু।তবে কেনো এতো দ্বিধা করছো?

মান্যতা কেমন দূর্বল নজরে কৌড়ির পানে তাকালো।কি করে বলবে সে,একটা বাজে ছেলের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো।যদিও কয়েকমাসের মধ্যে সম্পর্কটা ভেঙে গিয়েছিল। আর পুরো ক্রেডিটও ওই মানুষটার।
সেই ছেলের সাথে হাতে হাত ধরে হাঁটা!এই রেস্টুরেন্ট, সেই কফিশপ ঘুরতে দেখেছে, ওই লোকটা।তার সাথে রুমডেট করতে চাওয়া,কিসিংমিচিং করার জন্য জোরাজোরি করা।সব তথ্য ওই মানুষটার জানা।সে বর্ননা সে পেয়েছে।আর সেসব ভুলে সেই লোকটার সাথে নির্দ্বিধায় নির্লজ্জের মতো সংসার করবে কি করে সে?যেখানে মানুষটার সামনাসামনি হতেই স্মৃতিমন্থর হতে থাকে বিষয়গুলো।লজ্জায় মাতা উঁচু করে মানুষটার মুখের দিকে তাকানো হয়ে উঠেনা।তারসাথে আজীবনের সংসার!কিভাবে কিকরে সম্ভব?মান্যতার চাহুনি দেখে কৌড়ি আর প্রশ্ন করলো-না।আর না প্রশ্ন করা প্রশ্নের উত্তর পেতে চাইলো।শুধু মান্যতা বসে থাকা চেয়ারটার পিছনে গিয়ে তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ভরসা দিলো।

মান্যতার সাথে সময় কাটিয়ে সেখানে থেকে বেশ ঘন্টাখানেক পরে রুমে ঢুকলো কৌড়ি।সে রুমে ঢোকার অপেক্ষায় ছিলো যেনো একজন।রুমের দরজা ফাঁক হতেই তাকে যেনো চিলেরছোঁ মেরে টেনে এনে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো অপেক্ষায় তৃষ্ণার্থ মানুষটা।তার পাতলা দেহটা এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে,যেনো বুকে নয় নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নিতে চাইছে মানুষটা।আশ্চর্য হয়ে হঠাৎ ঘটে যাওয়া কান্ডে বিমুঢ় হয়ে রইলো কৌড়ি।তাতে ক্লান্ত কি মানুষটা?না!গায়ের হিজাবটা টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে বেডে ছুঁড়ে দিতেই,কৌড়ি এবার নিজেই নিজেকে শক্তকরে সঁপে দিলো সেই বুকে।মুঠোহাতে জড়িয়ে ধরলো মানুষটার বলিষ্ঠ পিঠ।

‘করছেন কি?আমার গায়ে ওড়না নেই।

বলেই যেনো বিব্রত হলো সে।অথচ সেই মানুষটা তার কথাগুলোকে পুরো আগ্রহ্য করে বললো—এটা শাস্তি।সকাল সকাল আমাকে রুমে ফেলে,উড়ন্ত প্রজাতির মতো আগানেবাগানে ঘুরে বেড়ানোর জন্য।

কৌড়ি চুপ।উত্তর করলো-না।যদিও উত্তর দেওয়ার পর্যায়ে নেই সে।চুলের আস্তরণে ঠোঁটের ছোঁয়া পেতেই হাতদুটোর বন্ধনি যেনো আরও দৃঢ় হলো।জড়িয়ে ধরা মানুষটা ফের বলতে শুরু করলো—সেদিন ওই বর্ষার দিনে যখন তোমাকে পাওয়া যাচ্ছিলো-না।পাচ্ছিলাম না তোমাকে।সেদিন কঠিনভাবে অনুভব করেছিলাম তোমার প্রতি আমার দূর্বলতা।আমার স্বাভাবিক নিঃশ্বাসের অকুলনতা।তারপর তোমাকে যখন পেয়ে গিয়েছিলাম।এভাবেই নিজের সাথে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করেছিলো।বর্ষার পানিতে ভেজা ওই ক্রন্দনরত মুখটায় আদর ছুঁয়ে দিতে মন চেয়েছিলো খুব।আমি তৃষ্ণার্ত পথিক, অনাহারী হলে-ও বিবেক ছুতে দিলোনা আমার আহার।তারপর সেদিন হসপিটালে যখন তোমাকে ওভাবে নির্জীব ঘুমিয়ে থাকতে দেখলাম।তোমাকে ঠিক এভাবেই বুকে জড়িয়ে নেওয়ার তৃষ্ণাটা আমার চৌগুন হলো।অথচ আমি অসহায় পথিক,আমি বিবেকের বশিভূত।পারলাম না তোমাকে ছুঁতে।নিজের সংবরণ করলাম।তবে নিজেকে সহনশীল ব্যক্তি হিসাবে অমোঘ রাখতে পারলাম-না।আর একটাদিন দেরি নয়,তোমাকে আমার হালাল রূপে পাওয়ার তৃষ্ণায় পেলো।হালাল করে নিলাম।সেই তৃষ্ণার্থ পথিককে তুমি সকাল সকাল একা ফেলে প্রজাপতির মতো রঙিন পাখনা মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছো!সেই পথিক কি-করে মেনে নেবে?

কৌড়ি শান্ত মেয়ে।তাকে যেনো আর-ও শান্ত অনুভব করলো নিভান।হঠাৎ তাকে ছোঁয়ার অনুযোগ নেই,অভিযোগ নেই।কেমন যেনো শান্ত মেয়ের মতো লেপ্টে আছে তার বুকে।হাতে থাকা ওড়নাটা মেয়েটার গায়ে জড়িয়ে দিলো নিভান।কৌড়ি এবার তড়িৎ মুখ উচু করে চাইলো।তা দেখে নিভান মৃদু হেসে দুষ্টমিষ্টি কন্ঠে বললো-বরটাকে খুব খারাপ মনে হয়েছে তাই-না?
বিয়ে হতে না হতেই…

নিভানের কথা শেষ করতে দিলোনা।তার আগেই মাথা ঘনোঘনো এদিকে ওদিকে নাড়িয়ে না সম্মতি জানিয়ে মুখে বললো–উহুম।আপনি একটুও খারাপ নন।একটুও না।

শেষের কথাগুলো নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারলোনা।তাই সইচ্ছায় আবারও মাথা রাখতে হলো তার বুকে।লজ্জার আড়ষ্টতায় কথাগুলো বলে চুপচাপ রইলো।নিভানের হাসি চওড়া হলো।সেই অমায়িক হাসি কন্ঠেও রেশ পেলো।কৌড়ির পিঠে রাখা হাতটা,আলতো স্পর্শে বোলাতে বোলাতে
বললো–আমার বুঝদার লক্ষ্মীসোনা বউটা।আচ্ছা রেডি হয়ে নাও।আমাদের ওবাড়িতে দাদুমার কাছে যেতে হবে?

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে