ফুলকৌড়ি পর্ব-৪৬+৪৭

0
10

#ফুলকৌড়ি
(৪৬)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সময়টা বসন্ত ঋতু হলেও শীতের আভাস এখনো পুরোপুরি কাটিনি।দিনের বেলায় যেমন তেমন সন্ধ্যার পর থেকে তার প্রকোপের বিশেষ আগাগোনা দেখা যায়।রাত যতো বাড়ে ততোই যেনো তার প্রকোপ তীব্র হয়।ছাঁদের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে দীবা।রাতের দক্ষিণা হিমেল হাওয়াটা ছুঁয়ে দিচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে।মসৃন চামড়ায় সেই হাওয়াটা লাগার সাথে সাথে গায়ের লোমকূপ শিরশির করে কাটা দিয়ে উঠছে।তবুও লোহার ইস্পাতের মতো কঠিন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।শান্ত নজরটা তার ঝলমলে ব্যস্ত নগরীতে।এই নগরীর প্রতিটি বিলাসবহুল নিবাস জানান দেয়,তারা বিত্তশালী।তারা উচ্চ আকাঙ্ক্ষী।আচ্ছা এখানের সবার মন মানসিকতা কি,এই রঞ্জিত নিবাসগুলোর মতো শুধু রঞ্জিত জীবন কাটানো!প্রতিটি মানুষের মনে কি শুধু উচ্চ বিলাসিতা আর উচ্চ আকাঙ্ক্ষা!এই এতো এতো প্রাচুর্যের ভীড়ে কেউ কি তারমতো একটু সুখে, একটু শান্তিতে দিন কাটাতে চায়না?নিভানের মতো মানুষের সাথে কি একটু ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষা নেই তাদেরও!আছেতো।এখানের অনেকের সাথে পরিচিতি দীবার।এতো বিলাসবহুল জীবনযাপন করেও তারা দীবার মতো অসুখী।তাদের অনেকের মনে উচ্চবিলাসবহুল নয় ছোটোখাটো মনমতো স্বাভাবিক কিছু আকাঙ্ক্ষা।সৎ চরিত্রবান একজন পুরুষের সাথে একটু সুখে থাকার,একটু শান্তিতে থাকার আকাঙ্ক্ষা।সেই সৎ চরিত্রবান পুরুষটার সাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একটু বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা।স্বামী নামক পছন্দের পুরুষটার কাছ থেকে পাওয়া একটু প্রাপ্য সম্মান,একটু মর্যাদার আকাঙ্ক্ষা।যা কৌড়িকে প্রতিনিয়ত দিয়ে চলেছে নিভান।সবার মুখেমুখে,মেয়েটা সত্যিই সৌভাগ্যবতী।আসলেই তো সৌভাগ্যবতী।নিভানের মতো একটা ছেলেকে স্বামীরূপে পাওয়া মানে তো সৌভাগ্য বটেই।সেই সৌভাগ্যকে পেয়েও দূরে ঠেলে দিয়েছিলো সে।এখন আফসোস করে কেঁদেকেটে লাভ আছে কি!নেই।নিভান আর কখনো তার হওয়ার নয়।বুঝে-ও এ আফসোস যেনো তাকে সারাটা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।আওড়ে যেতে হবে।

‘এখনো নিভানের আশায় অপেক্ষা করে থাকবে?ও তোমার কখনোই হওয়ার ছিলো-না।এটা কেনো বুঝতে তোমার এতো অসুবিধা?

গলার স্বরটা শুনেই পুরো শরীর যেনো আরও শক্ত হয়ে উঠলো দীবার।কাঠকাঠ গলায় জানালো।

‘আমি কারও আশায় বা অপেক্ষায় পড়ে নেই।আমি মুলত তোমার সাথেই সংসার করতে চাইছি-না।

“আমি কারও আশায় বা অপেক্ষায় পড়ে নেই” কথাটা চরম মিথ্যা!বলতে বুক কাপলেও জেদী গলায় জানালো দীবা।কেনো যেনো নিভানকে না পাওয়ার একটা দোষ বা ত্রুটি হিসাবে সিয়ামকেই দ্বায়ী মনে হয় তার।নিজেকেও কম মনে হয়না। তবে নিজ দোষের থেকে পরের দোষটা যে আমরা একটু জোরালো চোখেই দেখি।তাই হয়তো জোর করে হলে-ও নিজের ভাগের দোষটা অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিলেই নিজের দোষ দুর্বোধ্য।

‘দোষ কি আমার একার ছিলো?দোষী তুমি ছিলে-না?

চোখ বুঁজে নিলো দীবা।এখন আপতত কোনো সওয়াল-জবাব তার ভালো লাগছেনা।কন্ঠ কঠিন রেখেই বলল–

‘আমি কারও দোষ বিচার করার জন্য বসে নেই।তুমি বড়দের নিমন্ত্রণে এবাড়িতে এসেছো,নিমন্ত্রণ রক্ষা করেই চলে যাও।আর তোমার যাইচ্ছে গিয়ে তাই করো।নিভানের বিয়েটা মিটে গেলে আমাদের ডিভোর্সের ঝামেলাটা আমি মিটিয়ে নেবো।

এ মেয়ে কখনো তাকে ভালোবেসেছিলো?নাহলে এতো নির্দ্বিধায় কিকরে বলতে পারলো ডিভোর্সের কথা!গলা তো কাপলোনা বলতে,বুকটা কি কাপলোনা তার?শান্ত পদক্ষেপে দীবার পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়ালো সিয়াম।কেমন যেনো খুব স্বাভাবিক গলায় বললো–নিমন্ত্রন!সে তো আমি তোমার দৌলতে জামাই হিসাবে পেয়েছি।
তাই আসতে বাধ্য হয়েছি।আর যা ইচ্ছে তাই করতে বলছো?তোমার জনামতে তো আমি একটা প্লেবয় তবে কেনো পারছিনা যা ইচ্ছে তাই করতে?রাগে জেদে তুমি চলে আসার পর হয়তো কিছু ভুল করেছি।কিন্তু সেটাও যেনো নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছে,তোমাকে পাওয়ার আশায়।সব জায়গায় তুমি বাঁধা হয়ে আছো।আর ডিভোর্স!সে আমি চাইনা।প্লিজ ট্রায় টু আন্ডারস্ট্যান্ড দীবা।

‘নাটক করোনা সিয়াম।আমি ছাড়া তুমি স্ত্রীসঙ্গ কাটাচ্ছ না, এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছো?

‘হ্যা,বিশ্বাস করতে বলছি।তোমাকে বিয়ের পর দ্বিতীয়ত কোনো নারীসঙ্গে যায়নি আমি।

হাসলো দীবা।তাচ্ছিল্যপূর্ন সে হাসি।বিদ্রুপের গলায় বললো—–বিয়ের আগে তো কাটিয়েছো,তাই নয়-কি?

‘সেটার জন্য আমি তোমার কাছে অনুতপ্ত হয়েছি।তবে সেই অনুতপ্ততায় হয়তো তোমার কিছু যায় আসছে-না। কিন্তু তুমি কি একই অপরাধ করো-নি।স্বামীর ত্রুটি উহ্য করে বারবার অন্য পুরুষের উদাহরণ দিয়ে তাকে নিচু দেখাও নি?তোমার মনে কি নিভান ছিলোনা?

‘উহ্য কখন করেছি।যখন তোমার মধ্যে ত্রুটি পেয়েছি তখন!যখন তোমার কাজিন ফ্রেন্ডস্-রা মজার ছলে বললো,আমার আগে-ও তোমার একাধিক সুন্দর সুন্দর গার্লফ্রেন্ড ছিলো,যা চুটকিতে তাদের ছুঁড়ে ফেলেছো তুমি!এ্যাফেয়ার ছিলো কতশত! তখন!

‘এসব শুনে আমাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন আনার আগে কি নিভান তোমার মনের মধ্যে কোথাও আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ছিলো-না?হ্যা আমার দোষের জন্য তুমি আমার চরিত্রে আঙুল তুলতে পারতে,সেটা নিয়ে রাগ ক্ষোভ দেখাতে,জেদ করতে।আমাদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হতো, স্বাভাবিক।তুমি অন্য নিষ্ঠাবান পুরুষের সমকক্ষ করে উদাহরণ দিতে পারতে আমাকে!কিন্তু না!তুমি বারবার একজন নির্দিষ্ট পুরুষকে নিয়েই উদাহরণ দিয়ে আমার মন মস্তিষ্ককে বিগড়ে দিতে বাধ্য করেছো।তবে ভেবে বলো,তোমার মনে কি কোথাও তখনো নিভান ছিলো-না?আমি নাহয় খারাপ ছেলে।অভিযোগ করেছো, হ্যা মানছি।তোমার মনে কি স্বামী ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষ ছিলো-না?সেটা কি ঠিক ছিলো!নাকি স্বামী হয়ে সেটা মানা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো?ছিলো?তুমি মানতে চাইছোনা আমার বিয়ের আগের নড়বড়ে রিলেশনগুলো।আমি কিকরে মানি?কোনো স্বামী মানে?

‘আমি তোমাকে মানতে বলিনি!

নিজের দোষ যেনো অকপটে স্বীকার করে নিলো দীবা।সিয়ামও যেনো নিজেকে জেতাতে চাইলো।বললো-তবে দোষ কেনো আমার একার ঘাড়ে চাপাচ্ছো?

নজর তখনো ঝলমলে শহরের কৃত্রিম সজ্জায়।নিষ্পলক নজর সেখানে রেখে ফের স্পষ্ট স্বরে উত্তর দিলো–ওকে,ফাইন।মামাকে,আমিই বলে দেবো আমি তোমার সাথে সংসার করতে চাইছি-না।এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।

আর কত চলবে যুদ্ধ!মেয়েটা কি সত্যিই চাইছেনা আর তারসাথে সংসার করতে?এটা কি দীবার মন থেকে ছলেবলে নিভান-কে সরিয়ে দেওয়ার উচিত কর্মফল? নয় কি?দীবার মনে নিভান ছিলো,এটাতো সে জানতো।মেয়েটার হাবভাবে, কথা কাজে তা প্রকাশ পেতো।আর জেনেই তো সে না জানার ভান করে দীবাকে প্রপোজ করেছিলো।নিজের করে তাকে চেয়েছিলো।এবং ভালোবাসার দাবিদার জানিয়েছিলো।দীবার আগে অন্যসব সম্পর্কগুলোতে সে সিরিয়াস না থাকলেও দীবাকে দেখার পর এবং তারসাথে কথাবার্তা হওয়ার পর সে এই সম্পর্কটাতে সিরিয়াস হতে চেয়েছিলো।আর সিরিয়াস হয়েছিলো বলেই তো,দীবার মন থেকে নিভানকে জোর করে সরিয়ে ফেলানোর মনোবাসনা করেছিলো।তখন ক্ষনিকের জন্য সফল হতে পারলেও, দীর্ঘস্থায়ী সমাধান তো বাজে পরিস্থিতি, অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করলো।তবে সে দীবাকে ভালোবেসেছিলো।এবং এখনো বাসে।সেটা মেয়েটা স্বীকার করুক বা না করুক।আজ এখানে আসার একটাই কারন,মেয়েটাকে মানানো।শ্বাশুড়ির অনুরোধও বটে।আচ্ছা মপয়েটাকে যখন সে ভালোবাসে তবে কি শেষবারের মতো নিজের ইগো ছেড়ে আর একবার কি ট্রায় করে দেখবে, মেয়েটাকে মানানো যায় কি-না!

চোখ বুঁজে নিজেকে ধাতস্থ করলো সিয়াম।সত্যিই সে মন থেকে দীবার সাথে সংসার করতে চায়।প্রথম যেদিন দীবাকে দেখেছিলো,সত্যি বলতে রূপের মোহে পড়েছিলো।তারপর আস্তে আস্তে মেয়েটার প্রেমে।তারপর কিকরে কিভাবে যেনো মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেললো।মন তাকেই স্ত্রীরূপে পাওয়ার বাসনা জাগলো। এরআগে সম্পর্কে জড়ানো কখনো কোনো নারীকে নিয়ে মন এমন বাসনা করেনি।তারপর কত ছলাকলা করে দীবাকে বিয়ে করলো।সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিয়েছিলো শ্বাশুড়িমা।আজ পরিনিতি ভাঙনের পর্যায়ে!ভিতরে ভিতরে নিজের ইগো দুমড়ে মুচড়ে ভাঙার চেষ্টা করলো সিয়াম।দীাবকে ডিভোর্স দিয়ে ঘরে সুন্দরী স্মার্ট বউ আনতে তার সময় লাগবো-না।তবে রাগী জেদি হলেও দীবাকে তো পাবেনা।যে মেয়েটা আর উড়ন্ত মনে বাসা বেঁধে গতি থামিয়ে দিয়েছিলো।দীবা চলে আসার পর রাগে জেদে বিয়ের আগের লাইফস্টাইলে চলে গিয়েছিলো সে।পেরেছিলো কি শান্তিতে একদন্ড কোথাও মনটাকে টিকাইতে?মনে হয়েছিলো,দীবাতেই সুখ তার দীবাতেই শান্তি।তাই মেয়েটাকে একদণ্ড স্থির থাকতে দেয়নি।ফোন দিয়ে হোক বা তাকে নজরে রেখে, যেভাবেই হোক জ্বালিয়ে গেছে সারাক্ষণ।হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই ক্ষীন হাসলো সিয়াম।

নিভানের কথা মনে পড়লো তার।আজকে এখানে একান্তভাবে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়েছে নিভান নিজেই।যে মানুষটার সাথে বিগত দিনগুলোতে তার সম্পর্ক ছিলো কাটাতারের মতো।যা কেউ কখনো ছুটোনোর চেষ্টা করেনি।দীবা সম্পর্কিত সিয়াম শ্বশুরবাড়িতে এলে শুধু হ্যান্ডশেক আর দুকথার আলাপ বিনিময় ছাড়া সেভাবে দুজনের সাথে কথা হয়নি।সেই হিসাবে ইভানের সাথে শালা-বোনজামাইয়ের সম্পর্ক বেশ মধুর।সেই কঠিন মানুষটা নিজের দিক থেকে কাটাতারের বেড়া ছুটিয়ে তাকে নিজে নিমন্ত্রণ করেছে।এবং বউকে যেভাবেই হোক মানানোর একটা অফার জানিয়েছে।সবাই যখন তাদের সম্পর্ক বাঁচানোর একটা একটা করে সুযোগ করে দিচ্ছে, তবে সে-ও নাহয় একটা শেষ চেষ্টা করে দেখুক।সামনে থেকে নজর সরিয়ে দীবার দিকে ফিরলো সিয়াম। হঠাৎই তার সামনে হাটুগেড়ে বসলো।চমকে উঠলো দীবা।সেই চমক বাড়িয়ে দিয়ে তার দু-হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় চেপে নিলো সিয়াম।দীবার ফুলোফুলো প্রশ্নবিদ্ধ চোখদুটোতে কাতর পথিকের ন্যায় তাকালো।এযেনো চেনাপরিচিত সেই স্বামীর চাওয়া নয়।এযেনো নতুন সিয়াম।যার সাথে কেবলই পরিচয়।এমনই অবাক হলো দীবা।

‘তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম তারপর তার দ্বিতীয় কোনো নারীর রূপ লাবন্য আমাকে টানো-নি।আল্লাহ কসম টানেনি।সেই তোমাকেই শুধু আমি আমার স্ত্রীরূপে চেয়েছিলাম।যা বিয়ের আগের রিলেশনশিপে আর কাওকে আমি চাইনি।হ্যাঁ বিয়ের আগে আমার রিলেশন ছিলো।একটা নয় দুটো নয় অনেকগুলো মেয়েট সাথে…

কথাটা বলতে গিয়ে গলায় বিঁধে বিঁধে কথা বের হলো।
নিভানকে সরিয়ে দীবার মনে তো ঠিকই নিজের জন্য জায়গা করে নিতে পেরেছিলো সে।শুধু এই একটা কারনে জন্য আজ তাদের পরিনতি এই ছাড়োছাড়ো অবস্থা।দীবার বিস্মিত মুখাবয়বও বিস্ময় ছাড়িয়ে গিয়ে কঠিন হয়ে এলো।ফলসরূপ সিয়ামের হাতের মুঠো থেকে হাত সরাতে চাইলো।সিয়াম সেটা হতে দিলো-না।আরও শক্তকরে চেপে ধরলো তার হাত।এই হাত ছাড়তে চায় না সে।এটা কেনো কিছুতেই এই মেয়েটাকে বোঝাতে পারছেনা।তবে যাই হোক এতোদিন রাগে জেদে পড়ে অন্যভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছো।এবার নাহয় শেষ চেষ্টা হিসাবে ঠান্ডা মাথায় ঠান্ডা কথায় বোঝাবে।দেখা যাক সফল হয় কি-না।যদিও সে কঠিন অপরাধী।তবুও ক্ষমা পায় কি-না?ফের বলতে শুরু করলো সিয়াম।

‘আমি সত্যি বলছি,সেসব সম্পর্কে আমি কখনোই সিরিয়াস ছিলাম না।এরপর যখন তুমি এলে আমার লাইফে,আমি আর দ্বিতীয় কোনো নারীতে আসক্ত হই নি।মন আসক্ত হতে চাইনি।কেমন জানি তোমাতেই আসক্ত হয়ে পড়লাম।আর শুধু তোমাকেই চাইতে শুরু করলাম।চেয়ে গেছি।আজও চাইছি।প্লিজ দীবা আমি আমাদের ছাড়াছাড়িটা চাইনা।চাইছি-না।আমি তোমার সাথেই সংসার করতে চাই।একটু বুঝতে চেষ্টা করো।প্লিজ দীবা।আর রাগ জেদ করে থেকো-না।চলো না আমার সাথে।সংসার করি দুজনে।প্লিজ।

বিয়ে উপলক্ষে নীল মরিচবাতি দিয়ে ছাদটা সাজানো হয়েছে খুব সুন্দর করে।সেই ঝলমলে আলোতে সিয়ামের ফর্সা সুদর্শন মুখটা স্পষ্ট। আর তার থেকেও স্পষ্ট তার চোখের ভাষা।চোখ দুটো বলছে ছেলেটা যাই করে থাকুক, এই ক্ষনে বলা কথাগুলো মিথ্যা বলছে-না।কৌড়িকে নিয়ে নিভান যতোটা আগ্রহী, পজেসিভ।তার সামন্য একাংশ যদি দীবাকে নিয়ে থাকতো নিভান।তবে কখনোই দোটানায় পড়ে সিয়ামের মিষ্টি মিষ্টি ভালোবাসার বানীতে ভুলতো না দীবা।মামি প্রস্তাব রাখলেও নিভানের গাছাড়া ভাবে একটা সময় সিয়ামের প্রতি দূর্বল হয়ে মায়ের বিভিন্ন কান ভাঙানি কথাতে সিয়ামের সাথে বিয়েতে রাজী হয়ে যায় সে।বিয়ের পর যখন সিয়ামের কাজিন বন্ধুমহল থেকে জানলো,তার অনেকগুলো রিলেশনশিপের কথা।পুনরায় নিভানকে মনে পড়তে লাগলো তার।মায়ের কথায় আর সিয়ামের বাহিরের চাকচিক্য দেখে সিয়ামকে বিয়ে করা ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে হলো তার।এরপর একটার পর একটা ঝামেলা।রোজ রোজ অশান্তি।সিয়াম তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে,মানাতে চেয়েছে।তবুও মন মানেনি দীবার।শুধু নিভানের চরিত্র সকল গুনাগুন মনে পড়েছে আর রাগে ক্ষোভে সেসব ইঙ্গিত করে ঝগড়াঝামেলা বেড়েছে। দিনকে দিন সেসব অশান্তি বাড়ার বৈ কমেনি।আর সেই পরিনতি আজ ছাড়াছাড়ির পর্যায়ে এসে থেমেছে।যা দীবা মনেমনে হোক স্পষ্টে, চেয়েছিলো।আশাও করেছিলো ভিন্ন কিছু।যা আজ রাত পেরিয়ে কালকের পরের দিন,গহীন সমুদ্রে ভাসিয়ে দোওয়ার মতো বিসর্জন দিতে হবে তাকে।বুক কেঁপে উঠলো।নিশ্চল সিয়ামের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে-ও সেখানে ভেসে উঠলো অন্য মুখ।

‘প্লিজ দীবা।

নড়েচড়ে দাড়ালো দীবা।কিছু মনে পড়তেই শক্তকন্ঠে বললো।–আর তুষি যেটা বলেছিলো সেটাও কি মিথ্যে? তুমি রুমডেট করোনি কোনো মেয়ের সাথে?শুধু কি তাদের সাথে রিলেশন ছিলো?এসব জানার পরও স্বামী হিসাবে তোমাকে মেনে নিতে,মানিয়ে নিতে বলছো?তুমি হলে মানতে আমাকে?

তুষি,সিয়ামের চাচাতো বোন।একরত্তি ইঁচড়েপাকা মেয়েটার বয়স কতো হবে?এই কয়েকমাস আগেইতো আঠারো বছর পূর্ন হলো।পিচ্চি মেয়েটা অনেক আগে থেকেই তাকে মনেমনে পছন্দ করে।যা তার হাবভাবে প্রকাশ পেলেও সিয়াম পাত্তা দেয়নি।মেয়েটা যে বেশ ইনিয়েবিনিয়ে রসিয়ে তার বউয়ের কান ভাঙিয়েছে এটা আগেই টের পেয়েছিলো সিয়াম।শাস্তিস্বরূপ কষিয়ে দুটো দিতেও দ্বিধা করেনি।তা নিয়ে হাঙ্গামাও বাড়িতে কম হয়নি।এই মূহুর্তে অসভ্য মেয়েটাকে আরও কষিয়ে কয়েকটা চড় মারতে ইচ্ছে করলো।সামনে থাকলে হয়তো থাপ্পড় দুটো দিতে দ্বিধা করতো-না।তবে ভাগ্য ভালো মেয়েটার সামনে নেই।আশেপাশেও নেই।

চুপ থাকা সম্মতির লক্ষ্মণ।তাই বেশি সময় চুপ থাকলো না সিয়াম।তড়িৎ বললো–আল্লাহ কসম,আমি কোনো মেয়ের সাথে রুমডেট করিনি।বিলিভ মি,আমি আল্লাহর নামে মিথ্যা বলছিনা।ওই ফাযিল মেয়েটা আমাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে,তাই তোমার কাছে আমার নামে উল্টো পাল্টা বলে বুঝিয়েছে।যদিও পুরোপুরি নির্দোষ আমি নই।তবুও ও বাড়িয়ে বলেছে।

রুমডেট না করলেও প্রত্যেকটা রিলেশনশিপে কিসমিস চলেছে বহুত।এখন যদি এবিষয়ে দীবা জানে।এই মূহুর্তে ডিভোর্স হয়ে যাবে তাদের।নিভান বলেছে যে করে হোক দীবাকে মানাতে।আর সে চাায়ও মানাতে।তাই যেটা প্রশ্ন করেছে দীবা,সহজ ভাষায় সেটারই সত্যি উত্তর দিয়েছে শুধু সে।অথচ দীবার কেমন কেমন তীক্ষ্ণ নজর বলছে, সে সিয়ামকে বিশ্বাস করেনি।

‘তবুও আমি তোমার সাথে থাকতে চাইনা।তুমি একটু আগে বললে না,আমার মনে অন্য কেউ বাস করে।সত্যি তো তাই।তাই মনে কাওকে রেখে আমার তোমার সাথে সংসার হবেনা।

‘কাল বাদে নিভানের বিয়ে তবুও তুমি একথা বলবে।

‘ও কখনোই আমার প্রতি দূর্বল ছিলোনা।দূর্বলতা ছিলো আমার পক্ষ থেকে।তাই যা কিছু শুধু আমার পক্ষ থেকে।

‘আমি এখনো তোমার হাসবেন্ড।তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলতে পারো-না।

‘এজন্য তো সেপারেশন হতে চাইছি।

‘প্লিজ দীবা।একটু বুঝতে চেষ্টা করো।তুমি যেভাবে দেখতে চাইছো,জীবনটা ততোটা সহজ নয়।তুমি এখানে ভালো নেই এটা আমি জানি।চলো না আমার সঙ্গে দীবা।

সত্যিই বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েদের বাপের বাড়িতে পড়ে থাকা জীবনটা আসলেই সহজ নয়।যে সাচ্ছন্দ্যবোধে,সুখে বিয়ের আগের দীর্ঘদিনগুলো সে বাপের বাড়িতে কাটিয়ে যায়,বিয়ের পর সেই একই সাচ্ছন্দ্যে সুখে বাপের বাড়িতে দিন পার করা মোটেও সহজ বিষয় নয়।কথাও নয়।আত্মীয় স্বজন আশেপাশে মানুষের তীর্যক দৃষ্টি,ইনিয়েবিনিয়ে বলা কটু বাক্য।মাথা বুক ভারী করে তোলে।জীবনে বেঁচে থাকা অতিষ্ঠ হয়ে যায়।যেখানে নিজের মায়ের কথা শুনতে হয়,সেখানে অন্য মানুষের তীর্যক ব্যাঙ্গ দৃষ্টি, কটু কথা আর বড় কি!সিয়ামের মন ভোলানো কথায় কান্না পেলো ভীষন।চোখে জলও জমে গেলো।তবে সিয়ামকে কেনো জানি সহ্য করতে পারলোনা।হাত ছাড়িয়ে নিলো দীবা।সিয়ামের কথার উত্তর না দিয়ে বড়বড় কদম ফেলে চলে গেলো নিচে।সেদিকে কিছুক্ষণ নির্বিকার তাকিয়ে মাথা নুইয়ে নিলো সিয়াম।মাথা ভিতরটা ফাঁকা হয়ে এলো তার।নিজের ইগো ছেড়ে দোষ স্বীকার করার পরও মেয়েটাকে বোঝাতে সক্ষম হলো-না সে!ভাবনায় আর আনতে পারলো না,কি হতে চলছে তাদের আগামী দিনের পরিনতি!

রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি সময়।কৌড়ি গোসল সেরে শুয়েছে।শুয়েছে কি!ঘুমিয়েই পড়েছে।মান্যতা ওয়াশরুম থেকে এসে দেখলো মেয়েটা ঘুমে।পাশে মৌনতাও ঘুমে বিভোর।একটা হাত তার কৌড়ির কোমর জড়িয়ে রাখা।আজ এরুমে আর কাওকে নেইনি সে।দাদাভাইয়ের বিশেষ নির্দেশ আছে।নজর সরিয়ে মাথার তোয়ালে খুলে চুল মোছায় মন দিলো।চুল মোছা শেষে শুতে গিয়ে পানির তৃষ্ণা পেলো।আপনাআপনি বেডটেবিলের উপর নজর যেতেই দেখলো জগ-ওয়াটার পট,কোনোটাতেই পানি নেই।কিন্তু পানি না খেলে যে তার ঘুম আসবেনা।পুরোনো অভ্যাস। শুতে গেলেই পানির তৃষ্ণা লাগবেই।আর না খাওয়া অব্দি ঘুম আসবে না।আলসেমি হলো প্রচুর।তবুও উঠে জগ হাতে নিয়ে পানি আনতে চলে গেলো।কয়েক সেকেন্ড পরেই শব্দ করে ফোনটা বেজে উঠলো তার।মাথার কাছে টেবিলে ফোনটা বেজে উঠায় ঘুম হালকা হয়ে গেলো কৌড়ির।ফোন কেটে গিয়ে পুনরায় বেজে উঠায় চোখ মেলে তাকালো সে।মান্যতার ফোন বাজছে অথচ আপু ফোন তুলছেনা।কেনো?ক্লান্তি আর শরীরের দূর্বলতায় ডুবে আসছে চোখ।তবুও চোখ মেলে ল্যাম্পস্যাডের মৃদু আলোয় চোখ বুলিয়ে নিলো সারাঘর।মান্যতাকে কোথায় না দেখে ফোনটা হাতে নিলো সে।ফোনের স্কিনে লেখা নামটা দেখে ফের চোখ বুঁজে নিলো।ঘুম চোখেই মুখে ফুটলো মৃদু হাসি।আবারও তাকিয়ে ফোনটা রিসিভ করে চোখ বুঁজে নিলো সে।

‘বাড়িতে এসেছেন?

ভারী ঘুমঘুম আওয়াজ।কি আদুরে মিষ্টি গলা।সেই ভারী
কন্ঠ কানে ভেসে আসতেই গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিলো নিভান।চোখ বুঁজে নিলো আপনমনে।কন্ঠের মালিককে চিনতে সময় নিলো না।উত্তর দিলো।

‘না।এখনো বাড়িতে ফেরা হয়নি।তুমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলে মনেহচ্ছে?

‘হুমম।

এমনিতেই মেয়েটা অসুস্থ তারউপর সারাদিনের ঘোরাঘুরি ক্লান্তি,হলুদের অনুষ্ঠানের বাড়তি একটা ক্লেশ ঘুমতো আসবেই।নাহলে মিনিট দশেক আগে মান্যতাকে ফোন দিয়ে জানলো,মেয়েটা গোসল সারছে।তারমধ্যে ঘুমিয়েও পড়লো।কিছু একটা মনে পড়তেই শুধালো নিভান।

‘রাতে খেয়েছো তুমি?

‘হুমম।

হুমম মানে হলুদের অনুষ্ঠানের বিভিন্ন মিষ্টি মিঠাই পায়েশ অন্যন্য খাবার খাওয়ার পর আর আলাদা করে রাতের খাবারের চাহিদা হয়নি।তবুও খেয়েছে-তো।না বলার প্রশ্নই উঠেনা।আর না বললে উপাই আছে!নেই!তবে পরের প্রশ্নে ধরা খেয়ে গেলো সে।।

‘আর ঔষধ ?খেয়েছো?

এবার সরাসরি মিথ্যা বলতে পারলোনা কৌড়ি।চোখ মুখ খিঁচে চুপ করে রইলো।নিশ্চুপতায় ধরা পড়ে গেলো।
শব্দ করে শ্বাস ফেললো নিভান।

‘কৌড়ি।

মূহুর্তেই গলার স্বর পরিবর্তন। ডাক সুবিধার লাগলোনা।নিভানকে কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে কৌড়ি তড়িৎ কৈফিয়তের স্বরে বললো।

‘আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছিলো।আমি পারছিলাম না চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে।মনে হচ্ছিলো পৃথিবী গোল্লায় যাক আগে আমার ঘুম প্রয়োজন।তাই ঔষধের কথা তখন খেয়ালে ছিলো।

নিভান হাসলো কৌড়ির ছেলেমানুষী চঞ্চল কথায়।মেয়েটা মন খুলে তাকে জানাচ্ছে তার ভালোমন্দটা।কথা বাড়ানোর আর উপায় পেলোনা নিভান।তাই আর কথা বাড়ালোও না।বকলোনা।কালকের একটা দিনই-তো।পরের দিন থেকেতো ওই মেয়েটাসহ তার ভালো-মন্দ সবকিছু তার।তখন নিজেই নাহয় পালন করবে মেয়েটার অবহেলিত দায়িত্বগুলো।শ্বাস ফেললো নিভান।বললো।

‘ইট’স ওকে।তবে সকাল থেকে মেডিসিন নিতে যেনো অনিয়ম নাহয়।হুমম?

সহজে মেনে নিলো!একটু একটু করে যেনো নিজের প্রতি মানুষটার দূর্বলতা টের পেতে থাকলো কৌড়ি।হাত উচু করে বামহাতের অনামিকায় নজর দিলো সে।সমস্ত শরীর যেনো সুখানুভূতিতে আলোড়ন দিয়ে উঠলো।
ঠান্ডার মধ্যেও উষ্ণ আর্দ্র এক অনুভূতি টের পেল।ফের চোখবুঁজে নিয়ে উত্তর দিলো।–‘হুমম?

‘কৌড়ি।

‘বলুন।

‘তোমার ফোনটা তো আমার কাছে।দিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছিলাম।তাই বাধ্য হয়ে মান্যতার ফোনে ফোন দিতে হলো।একটা পারমিশন নেওয়ার ছিলো।

পারমিশন!তারকাছ থেকে?আপনাআপনিই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো–কি?

‘তোমার সবকিছু অর্থাৎ বিয়ের প্রয়োজনীয় সমস্ত শপিং যদি আমি আমার পছন্দ অনুযায়ী কিনি তোমার অসুবিধা আছে?তুমি অমত,অপছন্দ করবে?

আশ্চর্য!কৌড়ি যেনো বলতে ভুলে গেলো।ভাবতে ভুলে গেলো।কৌড়িকে চুপ থাকতে দেখে নিভান ফের বললো–সময় কম আর তুমিও অসুস্থ।এজন্য বলছিলাম কথাটা। আমি চাইছিনা,তোমাকে নিয়ে কেনাকাটায় অযথা টানাহেঁচড়ার করা হোক।যাতে তুমি অারও অসুস্থ হয়ে যাও।তবে তুমি যদি চাও,সমস্যা নেই।আমি আমার পছন্দ অনুযায়ী কিনবোনা।কালকের দিনটা তো এখনো সময় আছে।তুমি মান্যতা আর ঈশিতা আপুদের সাথে পরামর্শ করে নিজের পছন্দ অনুযায়ী নাহয় অনলাইনে শপিং করে নিও।

‘আপনার পছন্দে-তো আমার সমস্যা নেই।বরং সেটা আমার…

সহসা কথাগুলো বলে থেমে গেলো কৌড়ি।নিভান পাল্টা জিজ্ঞেস করলো–সেটা কি?

‘আমার সৌভাগ্যতা।

ঠোঁট বিস্তৃত হলো নিভানের।মনের প্রশান্তি থেকে হাসি ফুটলো ঠোঁটে। কৌড়ি দেখতে পেলোনা আর না বুঝতে পারলো।হঠাৎই নিভান শুধালো।

‘কৌড়ি।এইযে বিয়েটাসহ সকল কার্যক্রম আমার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হচ্ছে।সেখানে তোমার সিদ্ধান্ত আমি শুনতে চাইছিনা, জানতে চাইছিনা।গ্রহণযোগ্যতা দিচ্ছিনা। তুমি আমার প্রতি অখুশি, অসন্তুষ্ট?বাধ্য হয়ে মেনে নিচ্ছো সব।তাই না?

সময় নিলো কৌড়ি।মানুষটার সাথে একটা সময় সম্পর্ক ছিলো লুকোচুরির!এড়িয়ে চলার!ভীতির! আজ সেই মানুষটার সাথে এতো সোজাসাপ্টা সহজ সম্পর্ক সত্যিই কি কখনো আশা করেছিলো সে!এটাও কি আশা করেছিলো,আজ রাত বাদে কাল দিন পেরিয়ে ওই মানুষটা শুধু তার হবে!আর সে শুধু ওই মানুষটার!ভাবিনি।আর এটাও ভাবিনি কখনো এতো সহজ সুন্দর সাবলীলভাবে মানুষটার সাথে মনখুলে কখনো কথা বলতে পারবে।নিজের চাপা স্বভাবটা এড়িয়ে মানুষটাকে নিজের মনের কথা গুলো জানাতে পারবে।
অথচ ওই মানুষটা তাকে সুন্দর সহজ একটা পথ করে দিয়েছে।যে পথের রাস্তা আর গন্তব্য শুধু একান্ত তাকে জানিয়ে দেওয়া।তাকে চিনিয়ে দেওয়া।সেই রাস্তায় দিয়ে নিভানের কাছে পৌছানো অগ্রাধিকার শুধু তার। অন্য কেউ সেই পথে আলাউড্ নয়।ওই মানুষটা তাকে ছাড়া মানুষটার জীবনে সেই পথ ধরে অন্য কাওকে আলাউড্ করেনি।সন্তুষ্টচিত্তে হাসলো কৌড়ি।ফের স্বভাবসুলভ কোমল মায়াময় কন্ঠে প্রশ্নকৃত উত্তরের অপেক্ষারত মানুষটাকে উদ্দেশ্যে বললো।

‘প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা বটবৃক্ষ নামক ছায়া খুব প্রয়োজন জানেন।বিশেষ করে নারী জাতির জীবনে।আমার অন্তত তাই মনে হয়।সেই ছায়াটা না থাকলে তারা জানে জীবন কি!জীবনের মানেটা কি!
হয়তো বাবা,নয়তো ভাই,নয়তো স্বামী,নয়তো সন্তান, এসব প্রিয় মানুষদের ছায়া তাদের খুব প্রয়োজন হয়।খুবব!তারা উপলব্ধি করে নীরবে বলতে পারেনা মুখফুটে।কেনো জানি তাদের মুখ ফুটে বলা কোথাও একটা বারণ!নিষেধ আছে‌!আমিও সেই বারনটা মনেপ্রাণে এতোদিন মেনে এসেছি।বাবা চলে যাওয়ার পর সেই বারণের তৃষ্ণটা এতো উপলব্ধি করেছি,আজ মুখ ফুটে বলতেই হচ্ছে। চাইছি আমি বলতে।জীবনে একা চলা যায়না,সঙ্গ নিতেই হয়।সেটা ভাগ্যে ভালো থাকলে সৌভাগ্য না থাকলে মন্দ।তবুও প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা বটবৃক্ষ নামক সঙ্গী বলে ছায়া দরকার হয়।আমার ছায়া বাবা ছিলেন।তিনি আজ নেই।তিনি চলে যাওয়ার পর উপলব্ধি করলাম,আমার জীবনে কি হারিয়ে ফেলেছি আমি।সেই উপলব্ধি পুরোপুরি ক্ষান্ত নাহলেও কিছুটা ক্ষান্ত হলো হঠাৎই একজনের ছায়া আমার মাথার উপর এসে পড়তেই।বাবার পরে আমাকে নিজের মতো করে বোঝার ভরসাটা কেনো জানি তারমধ্যে অনুভব করলাম।নিজেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম সেই ছায়ার উপর।সেই ছায়া আপনি।সেই ছায়া যদি বলে আমি তোমাকে রোদের তাপ ছুতে দেবোনা,ঝড়বর্ষার প্রলেপ লাগতে দেবোনা,কাঁটার আঘাত পেতো দেবোনা,কোনো বিপদ ছুঁতে দেবো-না।সেখানে অখুশী অসন্তুষ্ট হওয়ার কি আছে।অখুশী অসন্তুষ্ট হয় কেউ?যেখানে নিজের সিদ্ধান্ত আপনিই বর্তায়।সেখানে আলাদা একান্ত বলে নিজের সিদ্ধান্ত কিসের?যে সিদ্ধান্তে আমার ইচ্ছেরাও সামিল সেখানে নিশ্চুপ থেকে সবকিছু মেনে নেওয়া আমি বাঞ্ছনীয় মনে করি।তাই চুপ।জোরকরে,বাধ্য হয়ে নয়।

একটু থামলো কৌড়ি।ওপাশের মানুষটার শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর একটা শব্দ নেই।কেমন নিঃশব্দতা।সেই নিঃশব্দতা পেরিয়ে কৌড়ি ফের নমনীয় মায়াময় কন্ঠে বললো।–আমি অসন্তুষ্ট অখুশি নই।আমি আপনাতে এবং আপনার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট, খুশী।

কথা শেষ করে শ্বাস ফেললো কৌড়ি।এতো কথা বলে ফেললো।সর্বাঙ্গ কেমন শরীর করছে লজ্জায়।এতো কথা তো সে বলেনা!অথচ বলেই ফেললো।ওপাশের মানুষটার নিশ্চুপতা দেখে ভিতরটা কেমন অদ্ভুত অনুভূতিতে আরও নিশপিশ করে উঠল।তড়িৎ ফোনটা সামনে নিয়ে সময় দেখলো।তখনো নিভান নিশ্চুপ।কৌড়ি সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রসঙ্গ এড়াতে ফের বললো–রাত অনেক হয়েছে তো। এখনো বাহিরে কি করছেন?কাল অর্ধেক রাত প্রায় জার্নি করেছেন, আজ সারাদিনও প্রায় ছুটোছুটি। এখন রাত বারোটা বাজতে চললো,এখনো বাহিরে।আপনার ক্লান্ত লাগে-না?আমার তো একটু ক্লান্তিতেই শরীর খারাপ লাগে। ঘুম এসে যায়।আপনার ঘুম পায় না?

অধিকারবোধ!মেয়েটা যেনো তার জীবনে আলৌকিক একটা শান্তি।শুধু যে শান্তি তা নয়,প্রশান্তি আর সুখ-ও বটেই।যা হঠাৎই এসে জুড়ে নিয়েছে তার হৃদয়কুল,মন মস্তিষ্ক।পুরুষ মন প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো নিভানের।মেয়েটা যেনো তার নিশ্চুপতার খোলশ থেকে একটু একটু বের হচ্ছে।বিষয়টা মন্দ নয়।এটাই তো চায় সে,শুধু কৌড়ি তারউপর এরকম অধিকার দেখাক।শুধু কৌড়ি।

‘ক্লান্ত লাগে তো।তবে আমাকে খুঁটিয়ে খোঁজ নেওয়ার মানুষ কম ছিলোতো,এজন্য শরীরটা সহজে ক্লান্ত হতে চাইতো-না।তবে এখন যখন খোঁজ নেওয়ার মানুষ হয়েছে তখন মনেহয় শরীরটা প্রত্যহ ক্লান্তিতে ডুববে।আর ঘুম।দুটো দিন নাহয় বিসর্জন গেলো,তারপর থেকে প্রশান্তিতে ঘুমাবো।

কথার ইঙ্গিতে দারুণ লজ্জায় ডুবলো কৌড়ি।পরবর্তী কথার খেই হারিয়ে ফেললো।মনেমনে চমকালোও বটে।কালরাত বাদে দিনরাতটা কি সত্যিই অন্যরকম হতে চলেছে !তার জীবনটাও কি পরিবর্তন হতে চলেছে!এমনিতেই ওই মানুষটার আগমনে হটাৎই জীবনটা তার পরিবর্তন হয়ে গেছে।দিনগুলো সব অন্যরকম যাচ্ছে। অদ্ভুত শান্তি।সুখ সুখ।

‘কৌড়ি।

কথা আর বাড়াতে চাইলোনা কৌড়ি।ডাক পড়তেই সহসা বললো।–কাজ সেরে তাড়াতাড়ি চলে আসুন।রাখছি।

হাসলো নিভান।বুদ্ধিমান মেয়েটা তার ডাকের অর্থ বুঝে নিয়েছে। তাই কথা আর না-বাড়িয়ে সে-ও ছোটো করে উত্তর দিলো।–হুমম।ঠিক আছে।

‘আল্লাহ হাফেজ।

নিভানও মৃদুমন্দ মিষ্টি গলায় জানালো–‘আল্লাহ হাফেজ।

নিভান ফোনটা কান থেকে সরিয়ে বুকে চেপে ধরে চোখ বুজে নিলো।পাশের সিটে বসা তৃনয় সেটা খেয়াল করে কান থেকে হেডফোনটা সরালো।কিছুক্ষণ অপলক চোখে নিভানকে দেখে নিজেও সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বললো–মেয়েটাকে এতো ভালোবাসিস?

‘প্রচন্ড।

হাসলো তৃনয়।পছন্দ, চাওয়া,ভালোলাগা,ভালোবাসা আসলেই অদ্ভুত। পৃথিবীতে তো সুন্দর জিনিসের অভাব নেই।অথচ সব সৌন্দর্য মানুষের মনটাকে আটকাতে পারে না।আটকায় না,ভালো লাগেনা।পছন্দ হয়না।ভালোবাসা তাৈরী হয়না।বিশেষ কারও ক্ষেত্রে গিয়েই সেই পছন্দ, ভালোলাগা, ভালোবাসায় আঁটকে যায়। মন,নজর,চাওয়া পাওয়া যেনো সেই মানুষটার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হয়ে যায়।আর সেই মানুষটাকে চাওয়া পাওয়ায় তীব্রতায় মনটাকে এমন পাগল করে তোলে।মনেহয় সে ছাড়া পৃথিবী সৌন্দর্যহীন!জীবন অর্থহীন!বাঁচা মুশকিল!তার ক্ষেত্রেও তাই।বিয়ের জন্য মা কম সুন্দরী পাত্রী দেখাচ্ছেন না।অথচ মন পড় আছে সেই অবাধ্য মেয়েটায়।ভাবনা ক্ষান্ত রেখে ঘাড় ফিরিয়ে নিভানের দিকে চেয়ে বললো।

‘বসে থাকবি।বউয়ের জন্য স্পেশাল শপিং করতে এসেছিস।চল।রাত অনেক হয়েছে এবার-তো উনারাও আমাদের অপেক্ষায় বিরক্ত হয়ে যাবেন।

‘উনার জানেন নিভান আওসাফ আসছে,তার বউয়ের জন্য স্পেশালি শপিং করতে।আমি সারারাত বললে সারারাত অপেক্ষা করতে বাধ্য উনারা।বরং মুখিয়ে আছেন আমি যাবার জন্য।কন্ট্রাক্ট করেই এসেছি।
এমনিতেই অর্ডার দিলে সবকিছু বাড়িতে পৌঁছে যেতো।কিন্তু আমি চাইছি ওরজন্য নিজে হাতে সবকিছু কিনতে।

‘মাঝেমধ্যে তোকে আমার চেনাজানা নিভান ভাবতে খুব দ্বিধা হয়।অবাক লাগে জানিস!

নিভান হাসলো।প্রতিত্তোরে করলো-না।বরং চোখ বুঁজে রইলো কতক্ষণ। ফের মৃদুকন্ঠে বলো–Everything is fair in love and war,or does’t? সেখানে আমি নিভান কি আর কেমন ছিলাম শুধুমাত্র ওই মেয়েটার ক্ষেত্রবিশেষ ভুলে গেছি।ভুল যেতে চাইছি।আমার মধ্যে কতোটা পরবর্তীত এসেছে, জানিনা।তবে আমি নিভান ওই ফুলকৌড়িতে কি অনুভব করি সেটা যদি তোকে বোঝাতে পারতাম!সত্যিই কাওকে বোঝাতে পারতাম!

চলবে…

#ফুলকৌড়ি
(৪৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বসন্তের মিষ্টি পড়ন্ত বিকেল।তপ্তহীন সূর্যের ঝলমলে আভায় প্রকৃতিতে কেমন স্নিগ্ধতার বড়ত্বতা ছড়িয়ে পড়েছে।যেনো প্রকৃতি নয় একোনো মায়াবন!প্রভুর আকা শ্রেষ্ঠতম অমোঘ শিল্প!সেই শিল্পত্বে দক্ষিণা হিমেল হাওয়ায় ক্ষনেক্ষনে ছুঁয়ে যাওয়ায়,প্রভুর কৃতত্ব, শৈল্পিকতার শ্রেষ্ঠত্বের মনোরমা মুগ্ধতার গুনাগুন যেনো চারপাশটা ভারী করে তুলেছে।কি অপরূপা সাজে সাজিয়েছে প্রভু বিকেলটা!অতুলনীয়!কালকের হলুদের স্টেজে আবারও হৈচৈ পরিপূর্ণ।চারপাশটা পরিপাটি সাজসাজ রব।সবকিছুতে যেনো একটা নিখুঁত সুন্দর পরিচ্ছন্ন সাজনি।রকমারী ডালা সাজিয়ে মেহেন্দি হাজির করা হয়েছে স্টেজের উপর।তার-ও একটা আভিজাত্যপূর্ন সাাজানো গোছানো সুন্দর সৌন্দর্যবর্ধন রূপ।পুরো লনএরিয়াসহ বাড়িটার একটা আলাদ রূপ হয়েছে।আর তাসাথে প্রত্যেকটা মানুষের সাজপোশাকও।আশপাশটা মুগ্ধ চোখে একবার দেখে নিয়ে নিজের দিকে তাকালো কৌড়ি।নিখুঁত বুননির গাঢ় একরঙা সবুজ একটা জামদানী পরোনো হয়েছে তাকে।ধবধবে দুধে আলতা ফর্সা গায়ে ম্যাচিং ব্লাউজের সাথে সবুজ শাড়ীটা যেনো,তপ্ত দুপুরের রোদের ন্যায় ঝলেমলে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।পাতলা ফর্সা শরীরে শাড়ীটা ফুটেছে ভিষণ।আজও কৃত্রিম নয় অকৃত্রিম সবুজ গোলাপ আর শুভ্র সতেজ সাদা বেলিফুলের সংমিশ্রনে গহনা বানিয়ে বিভিন্ন অঙ্গে সাজানো হয়েছে তাকে।সবুজ গোলাপ সহজে দেখা যায়-না।এবাড়িতে আসার আগে সবুজ রঙের গোলাপ হতে পারে, সেই সম্পর্কে বিশেষ ধারনা ছিলোনা কৌড়ির।তবে এবাড়িতে আসার পর ছাঁদে লাগানো একটা টবে দেখেছিলো।মাত্র দুটো ফুল ফুটেছিলো গাছটাতে।তবে তার খোঁপা দিয়ে,কানে, মাথায়, গলায়, হাতে অনেক সবুজ গোলাপ জড়িয়ে গহনা পরা।সবুজ বুননি করে বানানো গহনার ফুলগুলাে নজরকাঁড়া, চোখধাঁধানো।এই আকর্ষণীয় ফুলগুলো ঠিক কোথা থেকে সংগ্রহ করে তাকে সাজানো হয়েছে কৌড়ির বিশেষ জানা নেই।আর চেয়ে-ও কারও কাছে জানতে পারিনি, প্রশ্ন করতে পারিনি সে।লজ্জা পেয়েছিলো খুব।কারণ তার সাজকৃত সকল কিছু নাকি সেই মানুষটার দেওয়া পছন্দনীয় জিনিস।এমনকি এই ফুলের গহনাগুলোও।তবে তাকে সাজানোর সময় দুষ্টমি করে মান্যতার মুখে শুধু দু-একবার বলতে শুনেছিলো–দাদাভাইয়ের পুতুল বউয়ের জন্য দাদাভাইয়ের স্পেশাল শপিং।একেবারে মুগ্ধতায় ছড়ানো সাজপোশাক।

তবে নিজেকে দেখে মান্যতা আপুর মতো কৌড়ির বলতেই হচ্ছে মানুষটার পছন্দ,রুচিশীলতা অসাধারণ।দারুন।একপলকে যে কার-ও পছন্দ হয়ে যাবে।যেতে বাধ্য।এক কথায় কি অমায়িক রুচিবর্ধক।

‘কি অপরূপা লাগছে তোকে!আমার তো চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছেরে কৌড়ি।হায় আল্লাহ,নজর না লেগে যায় আমার!

পরিচিত গলার স্বর পেতেই নজর তড়িৎ উচু করলো কৌড়ি।কিছু বলার আগেই দুর থেকে মৌনতা দৌড়িয়ে এসে বিথীকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত গলায় বললো।–কেমন আছো বিথী আপু?তুমি আসা হলো তবে?

কৌড়িদের বাড়িতে দু’দিন থাকার সুবাধে বিথীর সাথে বেশ একটা ভাব জমিয়ে ফেলেছিলো মিশুকে মৌনতা।বিথীও প্রচন্ডে মিশুকে।তাই সহজে ভাব হয়ে গিয়েছিলো তাদের।একসাথে কৌড়িদের পুকুরে গোসল করা।গাছ থেকে বরই পেড়ে মেখে খাওয়া।নিজের বাড়িসহ তাদের গ্রামের আশপাশটা ঘুরে বেড়ানো।সেই সুবাধে ভালোই খাতির জমে বন্ধুত্ব হয়েছে দু’জনের মধ্যে।

‘খুব ভালো আছি।তুমি কেমন আছো মৌনি?

এই মিষ্টি ডাকটার জন্য মনেহয় দুদিনে বিথীর সাথে মিশুকে ভাবটা আরও গাঢ়ভাবে জমেছিলো মৌনতার।মিষ্টি হেসে বিথীর কথার জবাব দিয়ে সরে দাঁড়ালো মৌনতা।ততক্ষণে কৌড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে।এই কাছের মানুষটাকে তার এই শুভক্ষণে কাছে পাবে আশা করেনি কৌড়ি।আশা করেনি ভুল।আশা তো করেছিলো খুব।তবে মেয়েটাকে এতোদুরে কেউ নিয়ে আসার সংকটে আশা চূর্ণ করতে হয়েছিলো তাকে।কালও তো কথা হলো।বললো–তার আসা হবে না।কতো আফসোস কতো দুঃখ বিমিময় হলো তা নিয়ে।কৌড়িরও ভিষন মন খারাপ হলো।অথচ ভাগ্য সহায় হয়ে কাছের বন্ধুটাকে তার এই শুভক্ষণে নিয়ে আসলো!

কথা বিনিময় ছাড়াই কৌড়ি জড়িয়ে ধরলো বিথীকে।
সময় নিয়ে বললো–বললি যে আসা হবে-না।এসেছিস তবে।

কান্নার আওয়াজ নেই।অথচ মন নোনাজলের অস্তিত্ব টের পেলো নিজের কাঁধে। নিজেও আবেগপ্রবণ হলো বিথী।কৌড়িকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বললো—মন খারাপ কেনো করছিস?এসেছি তো।তুই মন খারাপ করলে হয়?

‘আমার কেনো সবাই নেই, বল-না বিথী?কেনো আমার বলতে সবাই নেই।সব সুতো বাঁধন নেই।কেনো মা নেই,বাবা নেই।আপনজন বলতে কেউ নেই।কেনো নেই?আমার এই শুভক্ষণে কেনো তারা নেই?কেনো কেউ নেই?কেনো আমার প্রতি সবাই এতো নির্দয়া?আমার ভাগ্য কেনো এমন?তুই আসবিনা শুনে,কত মন খারাপ হয়েছিলো জানিস?

কৌড়ির দাঁতে দাঁত চেপে কান্নার এবার যেনো মৃদু শব্দ হলো।প্রানপ্রিয় বন্ধুটাকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো বিথী।আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো নিজেও।তবে নিজেকে ঠিক রাখার প্রয়াস করে স্বান্তনা সরূপ মোলায়েম কন্ঠে বিথী বললো—কে বললো তোর কেউ নেই।বাবা মা কি চিরকাল সবার থাকে?আর না সেই না থাকার জন্য সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ সাঝে?তুইতো বুঝদার মেয়ে,তোর কাছ থেকেই তো সবকিছু শেখা,জানা।তুই এরকম বললে সাঝে?এই যে এতো সুন্দর একটা ফ্যামিলি পেয়েছিস।
মানুষগুলো কত অমায়িক,ভালো।ভাইয়ার মতো একটা অসাধারণ মানুষ তোর।শুধু তোর।তারপরও বলবি আপনজন বলতে তোর কেউ নেই!মা বলেন,স্বামীই নারীর পরমআত্নীয়।মেয়েরা বাবার সংসারে লালিত- পালিত হয় ষোলো বছর,আঠারো বছর? বড়জোর কতো?অথচ স্বামীর বাড়ীতে থাকতে হয়,মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। জীবনের চারভাগের তিনভাগ সময়টা স্বামীর সংসারে কাটাতে হয়।সেখানে পৃথিবীতে মেয়েদের আর ভাগ্য ভালো নাহলেও, স্বামীভাগ্য ভালো হওয়া,সুখকর হওয়া,শান্তিময় হওয়া উচিত।ভাইয়াকে দেখার পর, জানার পর,আমার মনে হয়ছে সেই সুখকর,শান্তিময় ভাগ্য নিয়ে তুই জন্মেছিস।সেই পরমআত্মীয়টা তুই পেয়েছিস।সেই তুই কিভাবে বলছিস তোর কেউ নেই।সবাই নেই।আমারই তো মনেহয় এক নিভানই তো তোর সব।ওরকম মানুষকে জীবনসঙ্গী পাওয়া সৌভাগ্য।আর কখনো এমন কথা বলবিনা।

শ্বাস ফেলে বিথী একটু চুপ হলো।ফের বললি–আমার জানটার বিয়েতে আমি থাকতে পারবোনা,আমারও ভিষন মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। আমি তোর বিয়েতে থাকতে পারবো না,ঈশশ কি অফসোস!তবে ভাগ্য সহায় হলো।সকালে ছোটো কাকু গিয়ে বাবাকে বললেন,আমাকে নিয়ে তোর এখানে আসার কথা।বাবা দ্বিমত করলেন না।আসতে দিলেন।

কৌড়ির কান্না আগেই কমে এসেছিলো।ছোটো কাকু নামটা শুনতেই বিথীকে ছেড়ে,তার সম্মুখে সোজা দাড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে বললো–ছোটো কাকু এসেছেন?

বিথী হাসলো।কৌড়ির চোখের পানি আলতো স্পর্শে মুছে দিয়ে বললো—শুধু ছোটো কাকু নয়।কানন আর কিয়ান ভাইয়া-ও এসেছে।

কিয়ান ভাইয়া ঢাকাতেই থাকে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট সে।আর কানন,সেও ভালো স্টুডেন্ট। এবছর এডমিশন নিয়েছে।পড়ালেখার বিষয়ে বরাবর কিয়ান ভাইয়ের পরামর্শ নিয়ে তাকে অনুসরণ করে,সে-ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তির্ন হয়েছে।কিন্তু ছোটো কাকু চেয়েছিলেন ভিন্ন কিছু।যাই হোক,চাচাতো
ভাইবোন হিসাবে সম্পর্ক খুব একটা মিঠা না থাকলেও, ভালোমন্দ আলাপন চলতো।ছোটো চাচা আর তাদের বাড়িটা মুখোমুখি। বিধায় অন্য চাচাতো ভাইবোনদের থেকে এদের দু’জনের সাথে সম্পৃক্ততা ছিলো মোটামুটি।তবে কিয়ান ভাইয়া ঢাকায় পড়তে আসার পর,বাড়িতে গেলে দেখাসাক্ষাৎ হলে ভালোমন্দ আলাপনেই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো কথাবার্তা। তবে বয়স সীমায় কানন তার বছর খানেকের বড় হওয়ায় কথাবার্তা মোটামুটি হতো।

‘কেমন আছিস মা?

ছোটো কাকুর এতো বড় দুটো ছেলে আছে তাকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেনা।উনার চেহারায় বিশ্বাসযোগ্যতা পায়না।মনেহয় ছেলেদুটোর বড় ভাই তিনি।কৌড়ির বাবার পৌরুষ সুদর্শন আদল,তিনিও পেয়েছেন।চাচাদের মধ্যে ভাইদের চেহারায় বেশ একটা মিল আছে।সেই মানুষটাকে দেখেই কেমন কৌড়ি আবেগপ্রবণ হলো।মা ডাকটায় যেনো ভিতর থেকে গলে পড়লো।অথচ মনের কোথায় অনুরাগের ছোঁয়ায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।মানুষটা তাকে আদর যত্ন কম করতো এমনটা নয়।মা-ছাড়া ভাইয়ের মেয়ে হিসাবে ভালোও বাসতো ঠিকই।তবে কেমন ভালোবাসা ছিলো!যা তাকে পরের আশ্রিতা বানিয়ে দিলো।তবুও মায়া মমতা দেখিয়ে নিজেদের মেয়ে হয়েও তাদের কাছে তাকে আঁটকে রাখতে পারলোনা।একটা ছেলের উশৃংখলপনা থেকে নিজের বাড়ির মেয়েকে না বাচিয়ে অন্যের আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিতেও বিবেকবোধে আটকালো-না।চারজন চাচা,কতোগুলো চাচাতো ভাইবোন সত্যিই কি তাকে আগলে রাখার মতো কউ ছিলোনা?

‘কাকুর উপরে এখনোও এতো অভিমান জমিয়ে রেখেছিস?

বাবার মতো হয়েছে মেয়েটা।আত্নকেন্দ্রীক! আত্মমর্যাদাসম্পন্ন!এবার বাড়িতে গিয়েও তাকে দেখা দেয়নি।বাড়ি থেকে বের হয়নি।সেদিন রাতে যখন অসুস্থ হয়ে পড়লো।কতোবার তার অসুস্থতার কথা নিয়ে এটাওটা জিজ্ঞেস করলো।অভিমানে মেয়েটা চোখ বুঁজে দাতে দাতত ব্যথা সহ্য করেছে।তবুও নিজের ব্যথা যন্ত্রণা উনাকে জানাইনি।আগে থেকে যে অপরাধবোধ উনাকে কুঁড়ে কুড়ে খাচ্ছিলেন।সেদিনের পর তা যেনো দ্বিগুন হলো।

সাজানো লন এরিয়াজুড়ে তখন মানুষ।স্টেজে কৌড়ির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক কেমন অসহায়ত্ব নজরে কৌড়ির মিষ্টি মুখের দিকে তাকিয়ে।পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো মান্যতা মৌনতা,বিথী আরও অনেকেই।উনাদের কে একটু আলাদা কথা বলতে দেওয়া দরকার। কথাটা ভেবে স্টেজের বাহিরে চেয়ার পাতানো ছিলো।সেখান থেকে দুোটা চেয়ার এনে দিলো মান্যতা।ভদ্রলোককে বসতে বলে,অন্যদের স্টেজ ছাড়তে ঈশারা করলো।
বিথী মৌনতাকে নিয়ে নিজেও স্টেজ ছাড়লো।স্টেজ ছাড়তেই মৌনতা,বিথীকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো।উদ্দেশ্য বিথীকে সাজানো।বিথী নিষেধ করলো শুনলো না।একপ্রকার বাধ্য হয়ে নিজেও মৌনতার সাথে পা বাড়াবো।ওদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আশপাশটা নজর দিলো মান্যতা।দূরে দেখতে পেলো,কৌড়ির চাচার সাথে আসা ছেলেদুটো ইভানের সাথে কথা বলছে।

‘সেদিন আমি তোর এখানে আসাটাকে আটকাতে পারতাম।অধিকারবোধে আটকিয়ে রাখিনি এজন্য হয়তো আমি অপরাধী।তবে আমি চেয়েছিলাম আটকাতে।মা’কে বলেছিলাম,কেনো ওকে অন্যের কাছে পাঠাতে হচ্ছেে?আমরা আছিতো।

মা সেদিন বলেছিলেন-কে আছিস ওরজন্য?আমিতো জানি কে কেমনভাবে ওকে আগলে রাখার জন্য আছিস!এতোদিনে কি করতে পেরেছিস?পেরেছিস ওই উশৃংখল ছেলেটাকে সুশৃঙ্খল বানাতে!ওর থেকে নিজেদের প্রাপ্য সাম্মান যেখানে আদায় করতে পারিসনি।সেখানে ওই মেয়েটাকে কি করে আগলে রাখবি।যদি নাহিদ ওর ওই সঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসে জোরজবরদস্তি করে কৌড়িকে বিয়ে করে নেয়।পারবি নাহিদকে আটকাতে?তোর মেজো ভাইকে আটকাতে?তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে?তোর ভাইয়ের মতো কৌড়িকে আগলে রাখতে?

‘আমি কেমন মানুষ যেমন মা জানেন তেমন তুইও জানিস।সেদিন মায়ের কথায় সত্যি মন থেকে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।সত্যি ও যদি ভাইয়ের অবর্তমানে নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে তোকে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে করে নেয়।যেখানে মেজোভাই বরাবরই ইন্ধন জুগিয়েছে,জুগিয়ে আসছে ছেলেকে।সেখানে তাদেরকে উপেক্ষা করে সত্যিই কি আমি পারবো তোর মতো ফুলকে রক্ষা করতে?বড়ভাইয়ের অবর্তমানে মেজোভাইকে দমানো কি সহজ কথা ছিলো?আমিতো কখনো তাদের সাথে দ্বন্ডে জড়াইনি, যায়নি।যেতে ভয় পেয়েছি সবসময়।সেই আমিকি পারবো,তোকে তোর বাবার মতো করে আগলে রাখতে?প্রশ্ন আমাার কাছেই রশে গেলো।না পারলাম তার যথাযথ উত্তর মেলাতে।আর না পারলাম তোকে আঁটকে নিজের কাছে রাখতে।

ছোটো কাকু।সহজ-সরল মানুষ। বরাবরই এরকমটাই দেখে এসেছে কৌড়ি।সহজে কাওর সাথে ঝামেলায় জড়ানো,দ্বন্দ্বে যাওয়া।এগুলো উনার স্বভাবজাত নয়।তিনি সবসময় ঝামেলা মুক্ত থাকতে চান।থেকে এসেছেনও।চাচি তার বিপরীত।চতুর চালাক।তবে উনারও একটা গুন,ঝামেলা দ্বন্দ্বে না জড়ানো।তবুও প্রশ্নতো রয়ে যায়!ভদ্রলোকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা কৌড়ির প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলো–যদি সে ছোটো কাকুর নিজের মেয়ে হতো, কি করতেন তিনি?তাকে কিভাবে প্রটেক্ট করতেন?প্রটেক্ট করতেন না নাকি?নাকি এভাবে তাকেও নিজের আশ্রয় ছাড়িয়ে অন্যের আশ্রয়ে আশ্রিত করতেন?

হঠাৎ মাথায় হাত পড়তেই ভাবনা কেটে গিয়ে চমকে উঠলো কৌড়ি।পলকহীন নজর নিবিষ্ট করলো,সামনে বসা মানুষটার অসহায়ত্ব মুখে।সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা মানুষটার মুখে যদি ভারী কাঁচাপাকা চাপদাড়িরতে ভর্তি থাকতো।কৌড়ি এতোক্ষণে তার বুকে মাথা লাগিয়ে দিয়ে দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরতো।বাবাকে ছেড়ে বিয়ে হয়ে পর বাড়িতে যাওয়ায়,দু এক ফোঁটা অশ্রুও বিসর্জন দিতো।বাবা কতো মন ভোলানো কথা বলে স্বান্তনা যোগাতেন।হঠাৎই কৌড়ির মনেহলো,
এযেনো ছোটো কাকু নয়।বাবা তার সামনে অসহায়ত্ব নজরে তাকিয়ে আছেন।সহসা কলিজা কেপে উঠলো কৌড়ির।তন্মধ্যে ভদ্রলোক বললেন–

‘জানিনা,নিজের মেয়ে হলে কি করতাম।তবে আমার উপর অভিমান যতো আছে পুষে রাখতে চাইছিস তো?রাখ।অধিকার আছে তোর।চাচা হিসাবে অপারগ মানুষটার বিরুদ্ধে অভিমান কেনো,রাগ, ক্ষোভ, অভিযোগ পুষে রাখাও জায়েজ তোর।তবে ছোটো কাকুকে অমানবিক অমানুষ মনে করিসনা।করিস না।

আঁতকে উঠল কৌড়ি।তড়িৎ বলো–এগুলো কি বলছেন ছোটো কাকু!আমার অভিমান আপনাদের উপর। তাই বলে অপরাধী ভাবি-না।এসব কেমন কথা!বাবা সামনে থাকলে আমার উপরে অসন্তুষ্ট হতেন।এখন নেই,তাই বলে কি তার সন্তুষ্টতা অসন্তুষ্টার খেয়াল আমার নেই!এমনভাবে বলবেন না।

‘কেমন আছিস মা?শরীর কেমন আছে তোর?

কৌড়ি কথা বলবেই আবেগপ্রবণ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।কৌড়িও কেমন যেনো টান ছাড়তে পারলোনা।মৃদু হেসে বললো– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।শরীরও ভালো আছে।আপনার শরীর কেমন আছে।বাড়িতে সবাই কেমন আছেন?

‘বাড়িতে সবাই ভালো আছে।আর আমি!আমি ভালো আছি।তবে মন তাকে ভালো রাখতে পারছি কই!তবুও দিন যাচ্ছে ভালো।

একটু থেমে ফের কেমন করুন গলায় বললেন।–তোর থেকেও বড় অপরাধী আমি তোর বাবার কাছে।সে যেনো আমার বিবেককে ধাক্কা দিয়ে বারবার বলে,পারলি না তোরা কেউ আমার মেয়েটাকে একটু আগলে রাখতে!পারলিনাতো!’বড়ভাইয়ের কবরের পাশে গিয়ে দু-বেলা মাফ চাই।তার যত্নের মেয়েটাকে আগলে রাখতে পারলাম না!আহ।ক্ষমা পাইনা জানিস!
রোজ সেই একইভাবে বিবেক ধাক্কা দিয়ে আমাকে কথা শোনায়।তোকে দেখার জন্য শহরে এসেছিলাম দুবার।দেখেছিলাম।তবে তোর সম্মুখীন হওয়ার সাহস হয়নি।লজ্জায়,কুন্ঠায়!কিয়ান-কে বলেছিলাম খোঁজ রাখতে।
ওই মাঝেমধ্যে খোঁজ দিতো আমাকে।আর মা-তো ছিলোই।তুই যখনই মায়ের সাথে কথা বলতিস,আমি সামনে থেকেছি প্রায়।

একের পর এক কথা হতে থাকলো দুজনের।কৌড়ি সহসজ সরল মানুষটার স্বীকারোক্তি শুনলো।মানুষটা এরকমই মনে কিছু চেপে রাখতে পারে-না।মনেমনে নিজেও দীর্ঘশ্বাস ফেললো।রক্তের সংযোজন তো!যতোই রাগ অভিমান অভিযোগ থাকুক।টান,মায়া এসেই যায়।কথা বলতেই মনটা আরও কিছু জানার জন্য খুদমুদ করে উঠলো কৌড়ির।সহসা জিজ্ঞেস করলো।—সেজো কাকু আর বড়োছোটো কাকু আসতে চাইলেন না?আপনি একা এসেছেন?আর ছোটো চাচী?

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক। বললেন–সবাই তো একই অপরাধে অপরাধী হয়ে আছে।মেয়েটার বিপদে পাশে থাকতে পারিনি,তার শুভক্ষণে তার পাশে থাকা লজ্জাজনক।সেই লজ্জা।আবার এবাড়ি থেকে বিয়ের নিমন্ত্রণ পেতেই,তোর সেজো কাকু বড়ছোটোকাকু বললেন-মেয়ে আমাদের বাড়ি থেকে বিয়ে হয়ে বিদায় হওয়ার কথা।সেখানে ছেলের বাড়ি থেকে নিমন্ত্রিত হচ্ছি। নিমন্ত্রণ পাচ্ছি। এরথেকে লজ্জাজনক আমাদের জন্য আর কি হতে পারে।সেখানে যাওয়া নিজেদের জন্যই অসম্মানের।লজ্জার।তাই আসলেন না।আর উনারা না আসলে,ছেলেমেয়েগুলো কি করে আসবে।
যেখানে পরিস্থিতিও অদ্ভুত।তবে রাজশাহী থেকে মুবিন বলেছে বিয়ের দিন আসবে।আর তোর ছোটোচাচী। সে অসুস্থ।পুকুরঘাটে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলো,তুই অসুস্থ হয়ে পড়লি সেদিন।পায়ের ভিষণ খারাপ অবস্থা। নাহলে আসতে চেয়েছিলো।

দুজনের মধ্যে আরও কিছুসময় কথা চললো।সেখান থেকে কিছুক্ষণ বাদে কিয়ান আর কানন-ও আসলো।বোনের সাথে আলাপ পরিচয় সেরে,কিয়ান চলে গেল।সাথে কৌড়ির ছোটো চাচাও। কানন বসে পড়লো তার পাশে।কৌড়িকে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখে বললো–এক পুঁচকে মেয়ে,শাড়ী পড়েছিস তো তোকে কতো বড় দেখাচ্ছে!তুই ঘটি থেকে এই চারমাসে কলসের মতো বড় হয়ে গেলি কিকরে?

আশ্চর্য! উদাহরণের কি শ্রী!তবে কাননের সাথে কথা কম হলেও সম্পর্কে ছিলো,তাদের ঠোকামোকির।সেই সম্পর্কগুলো যেনো ভুলে বসেছিলো কৌড়ি।তারজন্য এই ছেলেটাও নাহিদের কাছে হুমকিধমকিও তো কম খায়নি।

‘কি হলো?কথা বলিস না ক্যান?আর যারউপরে অভিমান রাগ করিসনা কেনো,আমার উপর অন্ততঃ অভিমান, রাগ,অভিযোগ করতে পারবিনা।আমি বলেছিলাম,চল কৌড়ি নাহিদ ভাইয়াকে টপকে তুই আর আমি পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি।আমার কথা কানেই তুললিনা।শুনলিই না।তাহলে তোকে তো আর অন্ততঃ বাড়ি ছেড়ে আসতে হতো না।

‘তবে পরের দিন ঠিকই বিধবা হতে হতো।আর তোর বুকের পাটার সাহস কতো!তা তো আমার জানা আছে।ওই অসভ্যটা বাড়ির দরজায় পা রাখলে,রাস্তা থেকে হাক ছাড়লে যাকে ঘরের দরজা খুলতে দেখা যেতোনা।তিনি আসছেন,বানী শোনাতে।

ফিসফিসিয়ে কথাটা বলতেই দাঁত বের হাসলো কানন।
বোকা হাসি।কাকুর মতো ছেলেটাও সহজ সরল।একটা সময় কৌড়ি তাকে গাধা বলে ডাকতো।তার নানাবিধ কারনও ছিলো।ছেলেটা ফের বললো—তা এই অসাধ্য নিভান ভাইয়া সাধন করলো কিকরে?টোপসহ নাহিদ সাহেবের কাছ থেকে একবারে বরশি ছিনিয়ে নিলো। আর নাহিদ সাহেব কিচ্ছু বললেন-না।এক্কেবারে ভালো বাধ্য ছেলেদের মতো বরশি দিয়ে দিলো! মেনে নিলো! আবার শুনলাম আমার মেজো চাচার অভদ্র নেশাখোর ছেলেটা নাকি মানুষ হয়ে গেছে।ব্যাপারটা তো শুনেই বুকব্যথা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লাম।নাহিদ সাহেব ভালো হয়ে গেছেন!মেনেই নিতে চাইছেনারে মন!আর তোর বিয়ে, শুনেও তিনি চুপচাপ!সব হজম করতে ভিষণ কষ্ট হচ্ছেরে ফুলবানু।

বাবা তাকে ফুল বলে ডাকতো।আর তার পিছে বানু খাটিয়ে দিয়ে কানন তাকে ফুলবানু বলে ডাকতো।যেটা নিয়ে ক্ষিপ্ত হতো ভীষন কৌড়ি।আজ ক্ষিপ্ত হলোনা।কেমন বাবার কথা বলে পড়ে গেলো।মূহর্তেই কলিজা মোচড় দিয়ে চোখের কোণে জমলো নোনাজল।

‘বানু?

কৌড়ির ভিতরটা যেনো আরও ভেঙে এলো।মাথা নিচু করে নিয়ে চোখের নোনাজল সংবরন করার চেষ্টা করলো।পারলো না।পরপর গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা নোনাজল।সেটা দেখে অপরাধী গলায় কানন বললো।

‘বড়কাকুর কথা মনে পড়ছে?

কৌড়ি মুখে কিছু বললো-না।তবে কান্নার দমক চোপে রাখার প্রচেষ্টায় কেঁপে উঠলো তার শরীর।

‘তোর কান্না কিন্তু তিনি সহ্য করতে পারতেন না।তাই তুই কাদলে কিন্তু তিনি যেখানেই থাকুক কষ্ট পাবেন।’মন খারাপ করিস না।আমরা আছি তো…

কথাটা বলতেই কেমন বিবেকে নাড়া দিলো।তারা কি সত্যিই মেয়েটার আপনজন বলে ছিলো?কৈ ছিলো!না হলে একটা মেয়েকে প্রটেক্ট করার ক্ষমতা,সাহস কি ভাইবোন বা চাচা কারও ছিলোনা?নাকি চাইনি কেউ।সেই অপরাধ থেকে সহসা ফের কাননন বললো—

‘চাচাদের দায়িত্ব কর্তব্য দোষগুন কি ছিলো কি আছে, উল্লেখ করতে চাইনা আমি।তবে বড়ভাই হিসাবে হয়তো তোর ভালোমন্দের যে খেয়াল রাখা উচিত ছিলো,এটা
পারি-নি।ভিতু ছিলাম, তাই হয়তো পেরে উঠিনি।কেনো জানিনা, এই শহরে এসে তোর ভাইটা তোরমতো বড় হয়ে গেছে।তুই যেমন ছোট্রো ঘটিটা থেকে কলস হয়ে গেছিস।আমিও তেমন তোর গাধা ভিতু ভাইটা থেকে একটু সাহসী হয়েছি।কথা দিচ্ছি বানু,ভাই হিসাবে এবার সবসময় তোর খোঁজ রাখবো।খেয়াল রাখবো।যদিও জীবনে এমন একজনকে পেতে চলেছিস,হয়তো আমাদের আর প্রয়োজন হবেনা। নিভান ভাইয়া থাকতে হয়তো আর খেয়াল খোঁজ না রাখলেও চলবে।তবুও তোর এই ভাইটা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আছে খেয়াল খোঁজখবর রাখবে।মন খারাপ করিস না।লক্ষীসোনা বোন আমার।কাকু কষ্ট পাবে।

কৌড়ি মুখ তুলে চাইলো।সাংঘাতিক আকারের ভিতু ছেলেটা তাকে এসব বলছে!কেমন যেনো অদ্ভুত নজরে কাননকে দেখলো সে।

‘চোখ মোছ। কি সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে।সবতো নষ্ট হয়ে যাবে।ঈশশ, আমার সাহস যদি নিভান ভাইয়ার মতো একটু সাহস থাকত,তবে নাহিদ ভাইয়ার হাতের বরশিটা নিভান ভাইয়াকে ছিনিয়ে নেওয়ার আগে আমিই ছিনিয়ে নিতামরে ফুলবানু।

কথার মধ্যে ঠিকঠাক কথা কম ফাজলামো বেশি।এই ছেলের সহজ সরল চঞ্চল স্বভাব।কৌড়ি হাসলো।দু’হাতে চোখ মুছে নিলো নরম স্পর্শে।সামনে তাকালো।লন এরিয়ার অপজিট সাইডের বাগানের খোলা জায়গায় চেয়ার টেবিলের আসন পাতা।ছোটো কাকু আর কিয়ান ভাইয়া সেখানে বসে নিভান নামক মানুষটার সাথে আলাপে মেতেছে।সঙ্গে উনার মামারাও আছেন।জাহিদ আঙ্কেলও।

‘ওইযে নিভান সাহেবকে দেখা যাচ্ছে।যা তো,বরশিটা তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আয়।কেমন সাহস দেখি কানন আশরাফের?

‘তুই আমাকে গাধা ভাবলেও আমি এতোটাও গাধা নই।যে বান্দা নাহিদের মতো উগ্র, উশৃংখল,হিংস্র আচরণের ছেলের সামনে থেকে খুব সহজে তার টোপেগাথা বরশিটা নিয়ে নিতে পারে।সে বান্দাকে যতোই শান্ত আর সরল দেখাক না কেনো!আমি বুঝে গিয়েছি তিনি কেমন! ঘুমান্ত,শান্ত টাইগার।উনার লক্ষ্যচুত যে সাংঘাতিক তীক্ষ্ণ। সেটা তার ওই বুঁজেথাকা চোখের পাতার দিকে তাকলেও বোঝা যায়।তার ওই বুদ্ধিদিপ্ত খোলা চোখের মনির দিকে না তাকালে-ও জানা যায়। আর তার হাত থেকে বরশি ছিনিয়ে নিতে বলছিস?আমি চির কুমার থাকতে চাই। তবুও মাফ চাই।এতোসময় মজা করছিলামরে ফুলবানু।

চারিদিকে মেহেদি মাখার হৈ-হুল্লোড়। মেহেদী আর্টিস্টদের ইনভাইটেশন করা হয়েছে।আপতত কনেসহ,বাড়ির মেয়েদের মেহেদী মাখাতে ব্যস্ত তারা।
কৌড়িসহ মেহেদী আর্টিস্ট মেয়েদের মধ্যে একজন স্টেজে বসা।আর সবাই লন এরিয়ার বিভিন্ন জায়গায়জুড়ে আলাদা আলাদা দল হয়ে গোলাকার ভাবে বসে মেহেদী মাখছে।গল্প হাসি মজায় চলছে তাদের মেহেদী উৎসব।স্টেজ থেকে কিছুটা দূরে মিউজিক সিস্টেম মৃদুমন্দ আওয়াজে গান বাজছে।সেখানে চলছে ছেলেদের বিশেষ আড্ডা।আড্ডার মুখ্যমনি ইভান,তৃনয়, সিয়াম এবং তাদের পরিচিত বন্ধু, কাজিনমহল।সেখানে অবাধ আড্ডা চলছে।বিকালে মেহেদী পর্ব শেষ করে সন্ধ্যার পর মেহেদী উৎসব উপলক্ষে নাচ গানের মৃদুমন্দ আসর বসবে।এটাই লক্ষ্য আর পরিকল্পনা তাঁদের।মাঝেমধ্যে ফাজলামোর সাথে সেসব আলোচনা ভেসে আসছে কৌড়ির কানে।কৌড়ির ডানহাতটা নিয়ে সবে মেহেদীর ঠান্ডা প্রলেপ বসিয়েছে আর্টিস্ট মেয়েটা।তারমধ্যে কানে এলো ভারী গলার শান্ত আওয়াজ।

‘এক্সকিউজ মি।আই উইল ট্রাই টু ডু ইট!

গলার স্বর পরিচিত।মুখ উচু করে তাকালো কৌড়ি।তারমধ্যে আর্টিস্ট মেয়েটা সম্বোধন পেতেই নিভানের মুখের দিকে তাকাতেই তড়িঘড়ি করে সরে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো–ইয়েস ইয়েস।,সিওর স্যার।

মেয়েটা উঠে গিয়ে জায়গা করে দিলো।সেখানে গিয়ে রয়েসয়ে বসলো নিভান।শ্যাম গায়ে জড়ানো কৌড়ির মতোই গাঢ় সবুজরঙা পাঞ্জাবি।সেটা কেমন সবুজ নয় পিত্তিরঙা দেখাচ্ছে।একই রঙের সুতোর কারুকাজ হওয়ায়,গলা এবং বুকের নিখুঁত কারুকার্যখচিত ডিজাইনটা ঠিকঠাক হঠাৎ বোঝা যাচ্ছে না।ঘনোকালো পরিপাটি চুল।যেটা শ্যামবর্ণ মুখের জৌলুশ সৌন্দর্যতার পরিস্ফুটতা বাড়িয়ে দিয়েছে।সেখানে খাঁড়া নাক,সুগভীর শান্ত ভাসাভাসা চোখ,আকানো পুরো ঠোঁট স্পষ্ট।ভারী গম্ভীর অথচ মায়ামায়া চেহারা।আর সেই মায়ামায়া চেহারার সৌন্দর্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে,গাঢ় সবুজ পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামাতে।বেশ লাগছে উঁচু লম্বাটে মানুষটাকে।কৌড়ির ভাবনার মাঝেই নিভানকে স্টেজে দেখে হৈহৈ পড়ে গেলো।সবার নজর পড়ে গেল।স্টেজে বসা দুজন স্পেশাল ব্যাক্তির উপর।ইভান-তো গানের সাউন্ড বাড়িয়ে দিলো।ফের ছটফটিয়ে এসে মজা নিতে নিতে কয়েকডজন ছবি তুলে নিলো।সেদিকে বিশেষ পাত্তা দিলোনা নিভান।নিজের কাজে মনোযোগী হয়ে সামনে বসা অপরূপা রমনীকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘হাত দিতে ভয় পাচ্ছো নাকি?পাছে তোমার হাতটা নষ্ট না হয়ে যায়?

নিজের দিকে তাকালো কৌড়ি।দু’জনেই একরঙের পোশাক জড়ানো।কেমন উষ্ণ উষ্ণ শিহরণ বয়ে যেতে লাগলো শরীরের আগাগোড়া।নিভান প্রশ্ন ছুড়তেই সেই শিহরণে মৃদুকম্পন দিয়ে দোলা দিলো সর্বাঙ্গে।সামনের মানুষটার শরীর থেকে ভেসে আসা কড়া পারফিউমের সুগন্ধ প্রজাপতি মতো ডানা মেলে ভেসে বেড়াতে লাগলো তার চারপাশ। মোহিত হলো মন,মনোযোগ।নিঃশব্দে হাতটা বাড়িয়ে দিলো নিভানের পানে।হাত ধরলোনা নিভান।শুধু নজর ইশারা করে দেখিয়ে দিলো হাতটা রাখবে কোথায়।মানুষটার আসনেবসা কোলের মধ্যে! মোহিত নজর সংকোচিত হলো।সেটা বুঝে বাড়ানো হাতটা সন্তর্পণে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কোলের মধ্যে রাখলো নিভান।কোলের মধ্যে অবশ্য নয়, নিজের মুড়োনো পায়ের উপর রাখলো।কম্পন দিয়ে উঠলো হাত।সাথে শরীীটাও।সেটা বুঝে কৌড়িকে সহজ করতে নিভান বললো।

‘একটা সময় মনে হয়েছিলো,তুমি যাদুময়ী,যাদুকারিনি।যে মোহিনী,কোনো মন্ত্রতন্ত্র জাদুবল ছাড়াই যে-কোনো পুরুষকে মোহিত করতে পারে!যেমনটা তার শান্তশিষ্ট আচারনে,ধীরস্থির কন্ঠে,মোলায়েম স্বভাবে,মায়ামায়া চাহুনিতে আমিও আঁটকে গিয়েছিলাম।আমার আগে আঁটকে গিয়েছিলো আরও অনেকেই।সেই মোহিনী আমার জেনেও এখনো আঁটকে যাচ্ছে আরও অনেকেই।আজ মনেহচ্ছে, তুমি ভুবনমোহিনী মোহমায়া রূপের বাসিনীও।এক দেখায় যার রূপেতে আঁটকে গেছে অনেকের নজর।আমি পারছি-না, সেই নজরগুলোকে চেয়েও আটকাতে।আবার না পারছি সেই চোখগুলো উপড়ে দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করতে!শুধু সবকিছু গিলে ফেলে নিজেকেই ঠিক রাখার প্রয়াস করে যেতে হচ্ছে।তা যে কতোটা কঠিন,উফফ!তোমাকে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে কৌড়ি।এমন কোথাও লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে সেখানে এইরূপে আর কেউ নয় আমিই দেখবো তোমাকে। শুধু আমার নজর ওরকম মুগ্ধ হয়ে দেখবে তোমাকে।এই জনসম্মুখে তোমাকে এভাবে প্রেজেন্ট করাটা কিছুতেই ঠিক হয়নি!ঠিক হয়নি আমার!তোমাকে চুপিচুপি বিয়ে করে নেওয়াই উচিত ছিলো।

বান্দা এখানে এসেছে শুধু তাকে মেহেদী লাগানোর জন্য, এমনটা নয়!এটা নিভানের শান্তস্বরের সর্তক বার্তায় বেশ অনুভব করলো কৌড়ি।বান্দার নজর যে তাকে ঘিরে চারিদিকে ঘুরছে!এটাও টের পেলো কৌড়ি।তবে একটা কথা মনে খচখচ করতে লাগলো।সহসা প্রশ্নও করলো সে।

‘আপনিও কি তবে সেই রূপে মোহিত হয়েই…

হাসলো নিভান।চমৎকার সে হাসি মুগ্ধ নজরে অবলোকন করলো কৌড়ি।এতোসময় মেহদীর টিউব নিয়ে খোঁচাখোঁচি করছিলো নিভান।কিভাবে মেহেদী লাগাবে বুঝতে পারছিলো-না।পর্ব অভিজ্ঞতা নেই তার।কাননের মুগ্ধ নজর।কৌড়িকে হাসোনোর চেষ্টা। তার সাথে হেসে হেসে কথা বলা।সেই বাগানে বসেই খেয়াল করেছে নিভান।আরও কিছু মানুষের নজর খেয়াল করেছে।কেমন ক্ষনে ক্ষনে মুগ্ধ নজরে কৌড়িকে দেখছে তারা।বিষয়টা মোটেও ভালো লাগিনি নিভানের।যদিও মেয়েটার এমন মোহমায়া রূপে নিজেও মুগ্ধ। তবে সে যে শুধু কৌড়ির রূপে মুগ্ধ, তা তো নয়।কৌড়ির রূপতো তাকে আগে মোহিত করেনি!করছিলো ভিন্ন কিছু।মুখ উচিয়ে সেই কাজল কালো হরিনী চোখে নজর ফেললো নিভান।এই মায়াবিনী চোখদুটো তাকে আকৃষ্ট করেছিলো আগে।স্বচ্ছ হরিনী চোখদুটো ছিলো নোনাজলে ভরপুর।আজ সেই চোখে গাঢ় কাজলের প্রলেপ।এই কাজলকালো চোখদুটোতেই তো নিভান প্রথম দূর্বল অনুভব করেছিলো।তারপর একটু একটু করে ওই মেয়েটাতে।সেই চোখে চোখ রেখে নিভান অকপটে স্বীকার করলো।

‘নাহ।তবে একেবারে না নয়,তাও যে নয়।তা নয়।এই শক্তপোক্ত হৃদয়ের আমাকে তোমার প্রতি দূর্বল করেছিলো,তোমার এই চোখ।তবে এই কাজলকালো সচ্চ,সুন্দর চোখজোড়া নয়।তোমার সেই ক্রন্দনরত নোনাজলে টইটম্বুর চোখজোড়া।ওই চোখজোড়া আমায় ডেকেছিলো,তার গহ্বর থেকে ফোঁটায় ফোটায় গড়িয়ে পড়া নোনাজলগুলো আমার আদূরে স্পর্শ মুছে নিতে।অথচ আমি না বুঝে যখন তাকে পাত্তা দিলাম না।সেও আমাকে একটা রাত স্থির হয়ে শান্তিতে ঘুমাতে দিলো-না।দিনের ক্লান্তিতে আমার দুচোখ একত্র করতে দিলো-না।সহসা আর বদ্ধ দুয়ারে,কঠিন হৃদয়ে তার হানা প্রবেশ শুরু হলো।আমি অনুভব করলাম,ওই চোখজোড়া তার মালিকের দখলদারী আমার মনে বসিয়ে ফেলেছে।আমি রোজ তাকে দেখছি,মুগ্ধ হচ্ছি আর একটু একটু করে তার দখলদারত্বের বশিভুত হচ্ছি।অনুভব করলাম,তবে তা থেকে বেরিয়ে আসার বদলে তাতে আরও ডুবে যেতে প্রশান্তি বোধ করলাম।
সুখ অনুভব করলাম।বুঝলাম আমার শান্তি আমার প্রশান্তিটা ঠিক কোথায়!সেই চোখজোড়া থেকে তুমি।তারপর তোমার সর্বত্র কিছু।আমি আমার একান্ত বলেই ভেবে নিলাম।যার মালিকানা শুধু আমার।

কৌড়ির নজর স্থির।মৃতুব্যক্তির ন্যায় স্থির।ঘনপল্লবিত লেশগুলোর পলক নেই।কালোমনিটার নড়নচড়ন নেই।শান্ত।নিজেকেও কেমন কঠিন পাথর মনেহলো।শরীরটদ কেমন বরফঠান্ডা শীতলের মতো অনুভব হলো।হৃদযন্ত্র অসাড়।একেমন অভিব্যক্তি, অনুভূতি।কৌড়ির এই অচল অনুভূতি নিভান ঠিকে পেলো কিনা।সেভাবে জানা নেই।তবে কৌড়ির সেই স্থির চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন আত্মবিশ্বাসী, ভরসাপূর্ন গলায় বললো–এতোটা মোহমায়ারূপী নাহলেও আমি তোমাকেই চাইতাম।বিশ্বাস করাটা একান্ত তোমার ইচ্ছে।তবে আমি তোমাকেই চাইতাম,কৌড়ি।

কৌড়ির অভিব্যক্ত সেরকমই নিশ্চল।হাতের মধ্যেখানে ঠান্ডা মেহেদীর প্রলেপ পড়তেই সচকিত হলো সে।তড়িৎ মুখ নিচুকরে হাতের দিকে তাকালো।নিজের হাতের মধ্যে নজরে পড়ার আগেই,লোশমে ভরা শক্তপোক্ত আকর্ষনীয় একটা পুরুষালী হাত নজরে পড়লো।পাঞ্জাবির হাতাটা কনুই পর্যন্ত গোটানোতে,হাতটা স্পষ্ট।হাতটা দেখে কেমন শিরশির করে উঠলো ভিতরটা।মানুষটা রঙে শ্যামবর্ণ হলে কি হবে,তিনি বড্ড আকর্ষনীয়।দুজনের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়ে হঠাৎই কৌড়ির ফোনটা বোজে উঠলো।পাশেই ছিলো ফোনটা।দুজনেই সেদিকে তাকালো।নিভান একপলক তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। অথচ কৌড়ির নজর ফোনে স্কিনে স্থির।নামধাম নেই।শুধু নম্বর।অথচ নম্বরের মালিকটা কে? সে জানে।তড়িৎ নিভানের মুখের দিকে তাকালো সে।বরাবরের মতোই নিস্পৃহ, নির্বিকার একটা মুখ।দ্বিধাদন্ডে ভুগলো কৌড়ি।ফোনটা ধরবে কি ধরবেনা!যদিও মন একদম অটল,ফোনটা ধরার কোনো কারন নেই।তবুও সামনের মানুষটাকে বিবেচনা করে মস্তিষ্ক বলছে ফোনটা ধরতে।এমন একটা সম্পর্কে তারা জড়াতে চলেছে,যেখানে জড়তা-সংকোচ রাখা উচিত নয়। ফোনটা কাছে নিয়ে আরও একবার নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে ফোনটা ধরলো কৌড়ি।লাউডস্পিকারও দিলো।মূহুর্তেই ওপাশ থেকে হড়বড়িয়ে কেউ ভারাক্রান্ত গলায় বলে উঠলো।

‘ফোনটা ধরেছিস ফুল!আমি কৃতজ্ঞ।এই ফুল,আমি নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু আর পারছিনা।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে,নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।ভিষণ জ্বালাপোড়া করছে বুকটা।কেনো এমন হচ্ছে বলতো?আমি তো মনে করেছিলাম, তোকে ছাড়াই যখন তোকে ভালোবেসে যেতে পারছি।তবে তোকে ছাড়াও থাকতে পারবো।তবে কেনো পারছিনা,তোর বিয়ে এটা মানতে!জানিস,সেদিন যখন হসপিটালে নিভান ভাইয়া তোকে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখলো।মনেহলো,আমার হৃদপিণ্ডে কেউ তীব্র আঘাতে হৃদপিণ্ডটা ছিনিয়ে নিতে চাইলো।আমি সেই আঘাত নিয়েও চুপচাপ সবটা দেখতে শুনতে বাধ্য হলাম।মনকে বোঝালাম,যাকে পেতে আমি এতটা উতলা,অসভ্য।সে আমার নয়।আমি তাকে আর জোরজবরদস্তি করে তার ঘৃনার শহরে হারিয়ে যেতে চাই না।মনকে সেখান থেকেই একটার পর একটা বুজ দিয়ে চলেছি।অথচ কিছুতেই মানতে রাজি নয় সে।
মানছেনা না।তীব্র ব্যথায় ছটফটিয়ে একটাই করছে সে, পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময় শুধু তোকে পেতে চাইছে।নাহলে আবার ডুবে যেতে চাইছে সেই অন্ধকার গলিতে।আমি পারছিনা আর তাকে সামলে রাখতে।আমার পাপের শাস্তিস্বরূপ একেমন যন্ত্রণায় নিপতিত করেছিস তুই!এই ফুল,আমি তো ভালো হয়ে গেছি তাইনা?আমি আরও ভালো হয়ে যাবো।খুব ভালো। যেমনটা বড়কাকু চাইতেন তেমনটা।সেখানে তুই যা চাইবি,আমার সাধ্যবলে পৃথিবীর সবকিছু তোর পায়ে এনে দেবো।আমার কাছে চলে আয়-না ফুল।তোকে ছাড়া আমি যে মরে যাবো।

নিভান আঁকাআকির চেষ্টা করলোনা। তার দ্বারা হবেনা।তাই কৌড়ির ডান হাতের মধ্যে নিজের নামটা ইংলিশ ওয়ার্ডে খুব সুন্দর করে লিখতে মনোযোগী হলো।মনে হচ্ছে দুনিয়ায় সব মনোযোগ তার সেই লেখাতে। আশে পাশে কি হচ্ছে সেসবে তার বিন্দু মনোযোগ নেই।অথচ নাহিদের মাঝেমাঝে কিছু কথার প্রতিফলনে হাতটা মৃদু কেঁপে উঠছে।সেটা যেনো স্পষ্টই টের পেলো কৌড়ি।
তবে মানুষটা ভুলেও লেখা খারাপ হতে দিলোনা।এমন দৃঢ় মনোভাব রাখার চেষ্টা সেখানে।কৌড়ি কান দিয়ে একজনের ভারাক্রান্ত হৃদয়বিদারক কথাগুলো শুনলো।
আর নজর দিয়ে আরেকজনের মনোযোগী হয়ে লেখাটা বেশ খেয়াল করে দেখলো পলকহীন।তারচেয়ে খেয়াল করে দেখলো,সামনের মানুষটার গম্ভীর নির্বিকার মুখটা।আশ্চর্য যে মানুষ একটু আগে তাকে নাকি মুগ্ধ নজরে গিলছে সবাই বলে কতো কি অভিব্যক্তি জানালো।সেই মানুষটা নাহিদের এতো আবোলতাবোল পাগলামি কথা শুনেও এতো নির্বিকার।শান্ত।

‘এই ফুল।

‘বলেছি না,এই নামে ডাকবেন না আমাকে।আর নিজেকে সামলান।নিজেকে আবার খারাপ পথে নিয়ে যাবেন নাকি ভালো পথে অনড় রাখবেন,সেটা আপনার একান্ত মর্জি।সেখানে আপনি ভালো থাকলেন নাকি মন্দ। আমার দেখার জানার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছিনা।আর আমাকে কেউ ধরেবেধে বিয়ে দিচ্ছে না।আমার নিজের একান্ত মর্জিতেই আমার বিয়ে হচ্ছে।সেখানে আপনার অনুভূতি অভিব্যক্তি আমার কাছে, জাস্ট ম্যাটার করে-না।সুতরাং দ্বিতীয়বার ফোন দিয়ে আপনি আমাকে বিরক্ত করবেন না,সেটাতে বরং আমিই প্রচন্ড বিরক্ত হবো।রাখছি….

ফোন কেটে দেওয়ার আগেই নিভান কেমন মুগ্ধময় স্বরে মুখ এগিয়ে নিয়ে বললো–মেহেদীর রঙে রাঙিত করে,আমার নামের স্টাম্প লাগিয়ে দিলাম।আজ না-হয় শুধু মেহেদীর রঙে আমার নামে তোমার হাত রাঙালাম ফুলকৌড়ি।কাল পুরো আমিময় রঙে নাহয় রাঙিয়ে দেবো তোমার সর্বত্র।

কান ঝাঝা করে উঠলো কৌড়ির।লজ্জায় চোখ নুইয়ে পড়ার বদলে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।এরকম লজ্জাজনক কথাতো এই মানুষটা কখনো বলে না। তবে?হঠাৎ ফোনের আলো জ্বলে উঠতেই হুশ রইলো কৌড়ির।নাহিদ ফোন কেটে দিয়েছে।তবে কি?

‘কবুলটা এখন পড়ে রাখলে কেমন হয় কৌড়ি?বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নাহয় কাল হলো।

লজ্জা ভুলে কৌড়ি বিস্ময় নিয়ে ফের তাকালো নিভানের নির্জীব নির্বকার শ্যামল মুখে।কোথাও বিন্দু পরিমাণ উতলা হওয়ার চিহ্ন নেই।তবে এমন কথা কেনো?বিস্ময় নিয়ে শুধালো সে।

‘আপনি কি আমাকে নিয়ে কোনোরকম ইনসিকিউরড্ ফিল করছেন?

‘না।আমি জানি আমাকে না বিয়ে করলেও তুমি নাহিদ কে অন্তত কখনোই বিয়ে করবেনা।করতে চাইবেওনা।

‘তবে একথা কেনো?বিয়ে এখন না-হোক, কাল হোক।অসুবিধা কি?

‘এমনিতেই বলছিলাম।

কথাটা বলেই অমায়িক হাসলো নিভান।সে হাসি কৌড়ির কাছে বড্ড বোকা বোকা মনে হলো।অথচ এই মানুষটার কাছে বোকা হাসি হোক বা আচারন।কল্পনাও করে-না কৌড়ি।কখনোই না।তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন অতি চতুর মানুষটার কাছ থেকে বোকা আচারন কল্পনাও মূখর্তা।নিজের অজ্ঞতা।সেই অজ্ঞতা নিজের মস্তিষ্কে উপলব্ধি করতেই নির্মিশেষে নিভানের মুখের দিকে কেমন অদ্ভুত নজর তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।মানুষটা হঠাৎ এমন আচরণের কারণ কি?কারণটা কি সে!সত্যি কি তাকে নিয়ে ইনসিকিউরড ফিল করছে মানুষটা?যা মানুষটা মুখফুটে বলতে চাইছেনা বা চায়না!

‘এক্সকিউজ মি ম্যাম। আমার কাজ শেষ।আপনি এসে ওকে মেহেদী লাগিয়ে দিন।

কৌড়ির ভাবনা কাটলো।স্টেজের সামনে চেয়ার আসনে বসে ছিলেন মেয়েটা।আজ্ঞা পেতেই স্টেজের দিকে এগোলেন।নিভান উঠে দাঁড়ালো।মেয়েটা আসার আগেই নিভান কেমন অদ্ভুত গলায় বললো।

‘আমার প্রিয় নারীটাকে অন্য কেউ পাগলের মতো চাইছে!সহ্য হয়?তাকে অন্যরা মুগ্ধ নজরে দেখছে!ধৈর্য্য ধরা যায়?আর তাকে হারানোর ভয়,যদি আমার অনিশ্চয়তা ভাবনা হয়।তবে ঠিকই ভেবেছো।তোমার পরিচিত মানুষগুলো আমাকে অনিশ্চয়তায় ডুবাচ্ছে কৌড়ি।তবে তুমি কিছুতেই আমাকে ডুবতে দিও-না।হাতটা শক্ত করে ধরে রেখো।খুব শক্ত করে ধরে রেখো।

কথা শেষ করেই পা চালিয়ে স্টেজ থেকে নামতে ব্যস্ত হলো নিভান।ইনসিকিউরড্!হ্যা সে অনিশ্চয়তায় ভুগছে।সে জানে কৌড়ি তেমন মেয়ে নয়।তবে তাকে চাওয়া পাওয়া লোকের অভাব নেই।নাহিদ তো মরিয়া হয়ে আছে।সাথে কানন নয় কিয়ানকে সে মুগ্ধ নজরে পলকহীন কৌড়িকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে।সেই মুগ্ধ নজর কি চাইছে বা চাইতে পারে!নিভানের জানতে বাকি নেই।বাকি থাকার কথাও নয়।ভুক্তভোগী তো সেও ছিলো।আচ্ছা পৃথিবীতে কি একটাই কৌড়ি!নয় তো!তবে কেনো তাকে নিয়ে এতো মুগ্ধতা!এতো পাগলামো!বিহান চৌধুরীতো এখনো মুখিয়ে আছে।কাৌড়িকে পাওয়ার প্রয়াস তো সেও কম করেনি।মেয়েটার বাবা মা নেই।পরের বাড়ির আশ্রিতা বলে নিজ বাবা বিরোধিতা করেছেন।তবুও কি ছেলেটা শান্ত ছিলো?শুনেছে বাবার কথা?না!কৌড়িকে পাওয়ার আকুলতায় বাবার বিরুদ্ধাচারণ করেও মেয়েটার কলেজের সম্মুখে গিয়েও ধর্না দিয়েছে।বিহান চৌধুরী কৃতিত্ব সব খবর আছে নিভানের কাছে।

সেদিন ঝড়বরষার দিনের পর মেয়েটা আর একাকি কলেজে যায়নি কোনোদিন।হয়তো বাড়ির গাড়িতে গিয়েছে আর নাহলে কারও সাথে কারও সাথে যাতায়াত করতো বলে বিহান কথা বলার সুযোগ পেতোনা।পায়নি।তবুও চেষ্টা কি কম চালিয়ে গিয়েছে?ভাগ্য সহায় হয়নি আর নিভানের সুক্ষ চালে ছেলেটা বারবার কৌড়ির সাথে কথা বলা থেকে ব্যর্থ হয়েছে।এরমধ্যে কৌড়ির পরিক্ষার সময় এলো।আর কথা বলার সুযোগও হয়ে উঠলোনা।তবুও কি ছেলেটা পিছু ছেড়েছিলো কৌড়ির?না।বরং মরিয়া হয়ে উঠেছিলো কৌড়ির সাথে কথা বলার জন্য।আর সেই মরিয়া আচারণ তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো কৌড়ির পরিক্ষা কেন্দ্র অব্দি।কিছুই নিভানের বুদ্ধিদীপ্ত চোখ এড়ায়নি। আর এড়ানোর মতো পাহারাদার রেখেছে কি সে!বিধায় নিভানও কৌড়ির পিছু ছাড়েনি।ছেলেটাকে যদি কৌড়িকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়।ছেলেটা বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও ছুটবে।এবং কোনো বাকবিতন্ডায় ছাড়া সদা কৌড়িকে বিয়ে করতে প্রস্তুত সে।এমন ব্যকুলতা সে বিহানের আচারনে নজরে টের পেয়েছে নিভান।নাহিদ, বিহান,কিয়ান আনাফ।সব কেমন ওতপেতে বসে আছে।আর সবকিছু জেনেশুনেও এদের মধ্যেও কেমনে,কিকরে নিশ্চয়তায় থাকবে সে!

ফর্সা হাতদুটোতে মেহেদীর রঙে সাজাতে ব্যস্ত আর্টিস্ট মেয়েটা।দীবা গাঢ় খেয়ালী নজরে দেখছে সেই সুক্ষতর, নিখুঁত হাতের কাজ।মূহুর্তেই মধ্যেই কতো সুন্দর করে তারা ফুটে তুলে মেহেদীর কারুকাজ।হাত ঘুরালেই যেনো নজর ধাঁধানো তাদের কারুকার্যতা।

ম্যাডাম, হাতে কারও নাম লিখতে চান?লিখবো কোনো নাম?

হঠাৎ স্টেজের দিকে চোখ দিলো দীবা।সেখানে এখন নিভান নেই।তড়িৎ নজর ফিরিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগে ভারী দুষ্ট গলায় কেউ একজন বলে উঠলো।

‘লিখুন।সিয়াম মাহমুদ।

মেয়েটা একপলক সিয়ামের দিকে তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিলো।সিয়ামের কন্ঠস্বর পেতেই দীবা মুখ উচু করে কড়া চোখে চাইলো। চোখের চাহুনী বলে দিলো, দাঁড়াও লেখাচ্ছি তোমার নাম!ততক্ষণে সিয়াম এসে দাড়িয়েছে তাদের পাশে। দীবা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মেয়েটাকে কিছু বলতে যাবে তারআগেই হাতের দিকে নজর পড়লো।স্পষ্ট ইংরেজি গোটাগোটা অক্ষরে সিয়ামের নামটা হাতের মধ্যে দেখতেই রাগে জ্বলে উঠলো ডে।দাঁতে দাত পিষে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললো।—ও বললো আর ওর নামটা লিখে ফেললেন!আশ্চর্য!আমার হাতে লিখছেন,অথচ আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ মনে করলেন না।

মেয়েটা হতবাক।লজ্জিতও।ছোটো মুখ করে অসহায় নজরে দীবার পানে চেয়ে রইলো।দীবার খারাপ লাগল।দাঁতে দাত পিষে একবার সিয়ামের দিকে নজর দিলো।সিয়াম,যেনো ব্যাপারটা কিছুই না এমন নিরুদ্বেগ মুখ করে তাকিয়ে রইলো।মুখে তার দুষ্ট মিষ্টি হাসি।সেটা দেখে আরও জ্বলে উঠলো দীবা।বাম হাত দিয়ে ডান হাতের মধ্যে লেখাগুলো লেপ্টে মুছে দেওয়ার আগেই সিয়াম কেমন উচ্ছল গলায় বলে উঠলো– মুছে ফেলতে চাইছো!ফেলো।তবে মুছে ফেললে কি চিহ্ন যাবে?লেখা মুছে যাবে তবে চিহ্ন যাবেনা।বরং বারবার ওই লেপ্টানো জায়গায় নজর যাবে,আর মনে হবে ওখানে কার নাম লেখা আছো।তা না করে দারুন একটা এ্যাডভাইস দেই?

দীবার প্রতিত্তোরের অপেক্ষা করলোনা সিয়াম।অপেক্ষা করলে হয়তো ভয়ংকর কোনো গালি বা মন্দ কথা শুনতে হবে।তাই আগের ন্যায় কন্ঠের উচ্ছলতা বজায় রেখে সহসা বলে গেলো –বরং তোমার হাতের নিখুঁত ডিজাইনের ভিড়ে নামটাকে হারিয়ে যেতে দাও।মুছে ফেললে হাতের ডিজাইন, নষ্টের সাথে সাথে এই খারাপ বরটাকেও মনে পড়বে ঘনোঘনো।যাকে তুমি মনেই করতে চাওনা।দারুণ এ্যাডভাইস না?

‘দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।তুমি বরাবরই এরকম।সাজানো গোছানো সবকিছু খারাপ, এলোমেলো করে দিতে অভ্যস্ত!

সিয়াম চলো গেলোনা।বরং রাগ ক্ষোভ নিয়ে দীবা উঠেই চলে গেলো।সেদিকে নির্বিকার তাকিয়ে রইলো সিয়াম।দীবার কথায় বুকের কোথাও সুক্ষ একটা ব্যাথার টের পেলো।হয়তো সেটা তার প্রাপ্য ব্যথা।তবে মনেমনে সে একটা পরিকল্পনা সাজিয়েছে।নিভানের বিয়েটা মিটে গেলে পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করবে।ততক্ষণে বউয়ের পিছুনে একটু লেগে থাকুক!আর্টিস্ট মেয়েটা বুঝলো,দু’জন স্বামী স্ত্রী।তবে বনিবনা নেই দু’জনের মধ্যে।এজন্য ভাবভালোবাসাও নেই।

নাফিমও মেহেদী লাগাবে বলে বায়না ধরলো।ওকে নিয়ে মশকারা শুরু করলো মৌনতা।বললো–এই তুই শরীফ তো!নাহলে মেয়েদের মতো এরকম মেহেদী লাগাবি বলে বায়না ধরেছিস কেনো?ছেলেদের রঙ মাখতে নেই জানিস না।

পাশে বসা মান্যতা মূহুর্তেই ধমকে উঠলো। —এসব কি ধরনের কথা মৌন।ও বাচ্চা। ও এসব বোঝে?আর এ কেমন উদাহরণের শ্রী!দিনদিন বেশী পাকনামো হচ্ছে। কোথায় কাকে কি বলতে হয়,বুঝজ্ঞান হচ্ছে না দেখছি!

‘থাক।ও-ও তো বাচ্চা।বকো-না।কথার ছলে বলে ফেলেছে।

তন্ময়ী কথাটা বলে নাফিমকে কাছে ডাকলো।–নাফিম আমার কাছে এসো।আমি মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছি।

নাফিম সহসা প্রশ্ন করলো—ছোটো বউমনি ছেলেদের মেহেদী লাগাতে নেই ?

‘না,ছেলেদের রঙচঙ মাখা ঠিক নয় ।তবে তুমি ছোটোতো, তুমি লাগালে কিছু হবেনা।এসো লাগিয়ে দেই।

‘না। থাক তবে।আমি মাখতে চাইনা।দেখি গিয়ে ফুলকৌড়ির হাতে কি আঁকছে।কেমন দেখাচ্ছে তার হাতদুটো।

ছেলেটা সবার হাতের নিখুত ডিজাইনে মেহেদী দেওয়া দেখে,নিজেও মাখতে উৎসুক হয়েছে।তবে মৌনতাকে বকা খেতে দেখে মন কেমন মিইয়ে গেলো।সাথে ছেলেদের রঙ মাখা ঠিক নয়,ব্যাপারটা কেমন তার ছোট্ট পুরুষ মনে সহজেই মেনে নিতে বাধ্য হলো।উঠে চলে গেলো নাফিম।সাথে মান্যতাও।তখনো মুখ ভার করে বসে আছে মৌনতা।বিথী আগে থেকেই কৌড়ির ওখানে বসা।সবাই চলে যেতেই তন্ময়ী,মৌনতাকে একপেশে জড়িয়ে ধরেই বললো–মন খারাপ করেনা,ছোটো ননদিনী।ওরকম বড়রা একটু আধটু বকেই থাকে।তাতে মন খারাপ করলে চলে?চলে না!চলো,আমাদের নতুন বউয়ের হাতে কি আঁকানো হলো দেখে আসি।

মৌনতা উচ্ছল হেসে উঠে দাঁড়ালো।তন্ময়ী উঠে দাঁড়াতেই সেখানে এসে হাজির হলো ইভান।ইভানকে দেখেই দুজনেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো।তাদের রিয়াকশন দেখে ইভান বললোো–আমি চোর না ডাকাত?আমাকে দেখে ওরকম চোখমুখ ছোটো হয়ে গেলো কেনো তোমাদের?

দু’জনেই পরিহাসের স্বরে একসাথে বল উঠলো–তুমি খুব ভালো মানুষ তাই!

মূহুর্তেই ইভান হেলে গিয়ে তন্ময়ীর কানের পাশে মুখ নিয়ে বললো—নয় বলছো?

শিরশির করে উঠলো তন্ময়ীর শরীর।চোখমুখের কুঁচকানো আকার যেনো মূহুর্তেই পাল্টে গেলো।সেটা খেয়াল করে মৃদু হেসে ইভান মৌনতাকে উদ্দেশ্য করে বললো –দেখি তো আছাড়েবিবি, কি ঘোড়ার ডিম এঁকেছিস হাতে!

‘দাদাভাই!!বাড়িতে কতো মানুষ,আর তুমি সেখানেও আমাকে উল্টো পাল্টা নামে ডাকছো!তুমি আমাকে উল্টো পাল্টা নামে ডাকবেনা,বলে দিলাম।আমার কিন্তু খুব রাগ হয়।

‘আমাদের আছাড়েবিবির দেখি প্রেস্টিজ হয়েছে!ভাবার বিষয়!ভাবলাম,মেয়ে বড় হয়ে গেছে।বিয়ে দিতে হবে।চিন্তা ভাবনা করিসনা,তোর বড়আপুর আগে তোকে বিয়ে দেওয়া হবে।

‘দাদাভাই!

দাঁতে দাঁত চেপে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে ডাক দিলো মৌনতা।রাগে দুঃখে কি বলবে,খুজে না পেয়ে চলে গেলো সে।মৌনতা চলে যেতেই তন্ময়ী অধৈর্য্য গলায় বললো–তুমি ফালতু কথা জানো!উফফ!প্রতিটা মানুষ তোমার কার্যকলাপে অতিষ্ঠ!

‘তুমিও?

আবারও সেই একই ভঙ্গিতে প্রশ্ন। এবার যেনো আরও কাছাকাছি ইভানের মুখ।হৃদযন্ত্র ছটফটিয়ে উঠলো তন্ময়ীর।ইভানের বলার ভঙ্গিমায় গায়ের লোমগুলোও কেমন লজ্জায় নুইয়ে না পড়ে,তটস্থ হলো।কি একটা অবস্থা! নিজেকে ঠিক দেখাতে,মিছেমিছি রাগ দেখিয়ে তন্ময় বললো।

‘তুমি সাংঘাতিক অসভ্য!

‘এটা আর নতুন কি?তবে তুমি যদি চাও,আমি সেই অসভ্যতামীগুলো তোমার সাথে না করে অন্য কার-ও সাথে করতে পারি।কি বলো?

ভ্রু নাচিয়ে শেষে কি বলো বলতেই, কড়া চোখে তাকালো তন্ময়ী।মানে,চোখ দিয়ে শাসানো যাকে বলে।ইভান বেশ উপভোগ করলো। ফের তন্ময়ীকে আরও একটু ক্ষেপিয়ে তুলতে বললো।–যাক বাবাহ।তুমি তোমার সাথেও অসভ্যতামী করতে দেবে-না।আবার অন্য কারও সাথেও না।তাহলে আমি পুরুষ যাবো কোথায়?

‘যেখানে খুশি যাও।তবে আগামী একসপ্তাহ যাবৎ যেনো তোমাকে আমার ধারে-পাশে না দেখি।

‘দেখলে কি করবে?আদর নাকি অন্যকিছু চলবে?সে যাই হোক কিছু একটা চললেই এই ইভানেরও চলবে।তবে কাল রাতের দৃশ্যময়গুলো স্মরণ করো!আমি একসপ্তাহ অনায়সে এমনিতেই পার করে দিতে পারব।

তপ্ত রোদ গায়ে লাগার মতো ইভানের কথাগুলো শুনে কানমাথা ঝাঝা করে উঠলো তন্ময়ীর।তীব্র লজ্জায় চোখমুখের দৃশ্য পাল্টে গেলো।মৃদু লাল আভায় ছেয়ে গেলো ফুলোফুলো দুটো গাল।লজ্জা নিবারণে শক্তহাতে ইভানকে তারথেকে সরিয়ে দিয়ে মিছেমিছি শাসানো গলায় বললো–তুমি আসলেই দিনকে দিন মাত্রাধিক অসভ্য হয়ে যাচ্ছো। আগামী একসপ্তাহ নয় একমাসও যেনো তোমাকে আমার আশেপাশে না দেখি।

ইভানকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো তন্ময়ী।মানসপটে সত্যিই ভেসে উঠলো কালকে রাতের দৃশ্যময়।সামনে কেউ না থাকা সত্ত্বেও লজ্জায় যেনো বুূদ হলো ভিতরটা। হাসফাস করে উঠলো নিজেই।ইভান ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে তন্ময়ীর যাওয়া দেখলো।কাল হলুদের বেশের থেকেও আজ মেহেদীর সাজে সবুজ শাড়ী গহনাতে মেয়েটাকে আরও সুন্দর আরও মায়াবী লাগছে।সবুজ শাড়ীতে সৌন্দর্য যেনো তার হেসেখেলে লুটোপুটি খেয়ে বেড়াচ্ছে। কাল নিজেকে শতচেষ্টা করেও তন্ময়ীর থেকে দূরে রাখতে পারিনি।আজ রাখবে কিকরে!সেখানে বিবি আবার তাকে আদেশ জারী করে গিয়েছে,একসপ্তাহ নয় একমাসেও যেনো তার আশেপাশে ঘেষতে না দেখা যায় তাকে।ইভান দুষ্ট হাসলো।বিবি আদেশ জারী করলেই হলো নাকি!ইভানকে তো সে এখনো পুরোপুরি চিনে উঠেনি!এবার অবশ্যই চিনে যাবে।ইভানের অসভ্যতামীর পারদ ঠিক কতো হাই লেবেলের।বুঝেও যাবে!

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে