ফুলকৌড়ি পর্ব-৪৪+৪৫

0
10

#ফুলকৌড়ি
পর্ব(৪৪)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বাড়ির বাহিরের নজরকাঁড়া অতি সাজসজ্জায় যতোটা না অবাক,বিস্মিত হলো,বাড়ির ভিতরে গিয়ে ততোটাই হতবাক হলো কৌড়ি।বাড়িতে যেনো পরিচিত অপরিচিত আত্মীয় স্বজনের মেলা বইছে।যাদেরকে ইভান ভাইয়ার বিয়েতে দেখেছিলো সে।সবাই যেনো উপস্থিত।সবাই!আর-ও কিছু অপরিচিত মুখ আছে।যাদেরকে কৌড়ি চেনেনা।হতবাক নজর ড্রয়িংরুমে,চা নাস্তায় ডুবে থাকা মানুষগুলোর পানে স্থির রেখে মেইন দরজায় দাঁড়িয়ে পড়লো।বাহিরের লন এরিয়ায় ফুলে সজ্জিত স্টেজ, ফুলের বাগানসহ বিভিন্ন গাছগুলোতে মরিচবাতির ঝলকানি,চারপাশ পরিপাটি সাজসাজ রব।এতো আত্মীয় স্বজনের ভীড়!কারণটা বুঝেই হঠাৎই কৌড়ির অস্বস্তি বাড়লো।লজ্জায় ভিতরে ভিতরে নুইয়ে পড়লো।এতোকিছু এতো অল্প সময়ের মধ্যে ম্যানেজ করলো কিকরে মানুষটা!যদিও মানুষটা কখন কি করে বুঝে উঠা মুশকিল!তবে তিনি তাকে বিয়ে করতে চাইলেন আর সবাই নির্দ্বিধায় তা মেনে নিলো!জাহিদ আঙ্কেল মেনে নিলেন?তারচেয়ে বড়কথা,কাল প্রস্তাব রাখলো মানুষটা,সেই রাতটা পার করে আজ দিনটা গড়িয়ে কেবল সন্ধ্যা!তারমধ্যে আত্মীয় স্বজনের ভীড়।বাহিরের সাজসজ্জা, সবকিছু এতো সহজে হয়ে গেলো!কিকরে?মানুষের তো মেয়ে দেখতে, ফ্যামিলি নির্বাচন করে সিদ্ধান্ত জানাতে সময় লেগে যায় মাসের উপরে। সেখানে একটা রাত আর গোটা দিনের মধ্যে সর্বসম্মতি নিয়ে আয়োজন কমপ্লিট!

মানুষটার মুখে বলা, দু’দিন বাদে আমাদের বিয়ে।কথাটা সিরিয়াসলি নেয়নি কৌড়ি।সত্যিই নেয়নি।তখন মনে হয়েছিলো,মানুষটার কথা না মানায় তারউপর রাগান্বিত হয়ে কথাটা বলেছে।আজ যখন ডক্টরের চেম্বারে দৃঢ়তার সহিত ডক্টরকে জানালো,দু’দিন পরে আপনিও কিন্তু নিমন্ত্রণ পাচ্ছেন।তখনও কথাটা সিরিয়াসি মনে হয়নি কৌড়ির।ভেবেছে,কথার কথা বলেছে।তবে বিয়ে যে তাদের হবে,মানুষটা তাকে জীবনেও ছাড়বেনা,এটা কৌড়ি জানে।সে তারমধ্যে যতোই ত্রুটি থাকুক, তাকে ছাড়বেনা।এটা সে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে।তাই বলে,নিজের কথার সত্যায়িততা বাজায় রাখতে এতো দ্রুত পদক্ষেপ।গা ঝাড়া দিয়ে,সমস্ত শরীরে ঝিমঝিমানি দিয়ে কম্পন বয়ে গেলো কৌড়ির।ক্লান্ত শরীরে তা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারলো।হৃদযন্ত্রটা বেড়ে গিয়ে একটু একটু করে অস্বাভাবিক হতে লাগলো।আর সেই অস্বাভাবিকতা বাড়িয়ে দিলো ড্রয়িংরুমে বসা কিছু পরিচিত মুখ।

কৌড়িকে দেখতেই যেনো মৌমাছির মতো তারা হামলে এসে পড়লো।চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে, কতো উল্টো পাল্টা বলে ফাজলামো করতে লাগল।তারমধ্যে মান্যতা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো-সারপ্রাইজ!এন্ড কংগ্রাচুলেশনস আমােদর বাড়ির বড়ো বউ।শাদী মোবারক হে।

হতবাক কৌড়ি তখন মান্যতা মৌনতা,ঈশিতা তন্ময়ীর বেড়াজালে আবদ্ধ।আরও কিছু মুখচেনা মেয়ে,যারা নিভান নামক মানুষটার মামাতো বোন,আত্মীয়।সকলের মধ্যমনি হয়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।
বিস্ময় কাটাতে পাশে তাকালো।কৈ মানুষটা তো নেই!
তারসাথেই ছিলো তো!তবে গেলো কোথায়?মুখ উচুকরে সামনে তাকাতেই সিঁড়িপথ ধরে উপরে উঠতে থাকা নিভানকে নজরে পড়লো।উচুলম্বা মানুষটা মেরুদণ্ড কাঁটার মতো সোজা রেখে,সিড়ির ধাপে ধাপে পা রেখে উপরে উঠে চলেছে।হাতে তার,ডাক্তারের কাছ থেকে প্রাপ্ত কৌড়িট একগাদা রিপোর্ট! সাথে কৌড়ির ফোনটাও।কৌড়ি হতবিহ্বল চোখে,তার উপরে উঠা দেখতে থাকলো।হঠাৎই একে একে সিঁড়ি ধাপ পেরিয়ে উপরে উঠা মানুষটা থমকে দাঁড়ালো।যেনো সে, কৌড়ি তাকিয়েছে এটা কোনো যন্ত্র দ্বারা অনুভব করতে পারলো।পিছে ফিরে কৌড়ির হতবাক, বিস্মিত নজরের দিকে তাকিয়ে,মানুষটা চমৎকার হাসলো।সেই হাসিতে যেনো স্পষ্ট জানান দিলো–আমাকে তুমি ভুল চিনেছো।আমি এমনি এমনি কখনোই কিছু বলিনা।

চমৎকার সেই হাসিতে কৌড়ি আরও বিস্মিত হলো।আর্কষিতও হলো বটে।বিস্মিত নিষ্পলক নজর এবার মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ওই শ্যামবর্ণ হাস্যজ্বল মুখে।কি মায়াভরা আদল!পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চেহারার ব্যক্তি বলে মনেহলো।কৌড়ির মনের খবর বুঝলো কি বুঝলোনা সিড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা,হাসি যেনো তার উপচে পড়তে লাগলো।হুঁশ ফিরলো কৌড়ির।নজর সরিয়ে নিয়ে সম্মুখে তাকালো।মূহুর্তেই মৌনতার খুশি খুশি হাস্যজ্বল মুখটা নজরে পড়লো তার।ততক্ষণাত উৎফুল্ল কন্ঠে মৌনতা বললো।–জানো,যেদিন তুমি এবাড়িতে এলে।আমি মনে করেছিলাম দাদাভাই বউ নিয়ে এসেছে।পরে যখন শুনলাম,তুমি দাদাভাইয়ের বউ নও।খুব মন খারাপ হয়েছিলো।এবার সত্যিই তুমি দাদভাইয়ের বউ হচ্ছো।আমি এত্তো এত্তো খুশি।

হাত প্রসারিত করে বাচ্চামো স্বরে কথাগুলো বলতেই মিষ্টি করে হেসে দিলো কৌড়ি।সাথে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো।একেএকে সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে যার যার,তাকে নিয়ে ভালোলাগা ভালোবাসা অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করতে লাগলো।ঈশিতাও বাদ গেলো না।কেমন মায়াভরা কন্ঠে বললো–ঈশশ, আমাদের নিভানের বাচ্চা বউ।

নিভান মানুষটা,তার গোটা বংশের আপন আত্মীয় স্বজনের কাছে কতোটা প্রিয় একজন মানুষ।কৌড়ি এই চারমাসে দেখেছে,বুঝেছে,জেনেছে।প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যমনি যেনো সে।নিভান বলতে তাদের কাছে যেনো চাঁদের টুকরো।তার কাছের মানুষগুলোর কাছে,তিনি যেনো আলাদা এক মায়া,টান,ভালোবাসা।আর তার বউ হবে কৌড়ি।সেই মানুষটার ভাগের ভালোবাসা পাবেনা,এটা হয়?সবার মধ্যমনি হয়ে ভাবনারত কৌড়ির হাতটা সন্তপর্ণে ধরলেন নিভানের নানুমা।ভীড় সরিয়ে দরজা থেকে ধীরস্থির পদক্ষেপে তাকে নিয়ে বসালেন সোফায়।কৌড়ির মায়াভরা মুখটায় আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিয়ে নিজের গলায় হাত রাখলেন।কুঁচকে আসা ফর্সা গলায় জ্বলজ্বল করতে থাকা,অনেক দিনের পুরানো বিছা চেনটা খুলে আনলেন।কৌড়ির মাথার ওড়নাটা সরিয়ে পরিয়ে দিলেন গলায়।ফের কৌড়ির মুখটা দুহাতে আজলে নিয়ে গভীরভাবে চুমু খেলেন তার কপালে।কৌড়ির হতবিহ্বল নজরের পলক তখনো পড়েনি।অসাড় হয়ে রয়েছে।বৃদ্ধা প্রগাঢ় চুমু একে মুখটা সরাতেই কৌড়ির চোখের পলক পড়লো।সেই চোখে চোখ রেখে কোমল গলায় তিনি বললেন–

‘আমার নিভানকে ভালো রাখিস নানু।খুব খুব ভালো রাখিস।আর খুব ভালোবাসিস।ওর না পাওয়া ব্যথা গুলো তোর ভালোবাসায় ভুলিয়ে দিস।জানিস,ওর এই এতো বছর বয়সে নিজের আপনজন, কারও কাছে জোরকরে কখনো কিছু আবদার করেনি,চায়নি।নিজের বলে কোনো আকাঙ্ক্ষা জাহির করেনি।বরং আপনজনদের খাতিরে নিজের শখ, ইচ্ছে, ভালোলাগুলো বিসর্জন দিয়েছে।সেই ছেলেটা,আজ তোকে পাওয়ার জাহির করছে।আবদার রেখেছে, তোকে পাওয়ার।

মন কেঁদে উঠলো।চোখ পানি জমলো কৌড়ির।মানুষটা কিকরে তাকে এতো ভালোবাসতে পারে!কিকরে?কি আছে তারমধ্য যে,মানুষটা তারজন্য এতোটা পাগল হলেন!ভদ্রমহিলা নম্র চোখ তাকিয়ে রইলেন কৌড়ির দিকে। নিভান বিয়ে করবে।হঠাৎ এই সিদ্ধান্তে যেমন উনার পরিবারের সবাই অবাক হয়েছিলেন।মেয়েটা কে জানার পর,তিনি বাদে উনার ছেলে-ছেলেবউরা যেনো একটু বেশিই আশ্চর্য হয়েছিলেন।মেয়েটার বাহ্যিক সৌন্দর্যে,আর শান্তশিষ্ট নম্র আচারনে,শালিন চলাফেরায়,বউমারা তেমন আপত্তি না জানালেও ছেলেরা আপত্তি জানালেন।নিভান বিয়ে করবে উচ্চবংশ,নামাদামী বিত্তশালী পরিবারের কোনো এক রূপবতীকে।তা না একটা এতিম মেয়ে!মেয়েটাকে উনারা দেখেছেন,খুবই ভালো মেয়ে।সবদিক থেকে ঠিকঠাক থাকলেও,গার্ডিয়ান নেই এতিম মেয়ে বিয়ে করবে নিভান!গাইগুই করে নিভানের সিদ্ধান্তে অমত পোষন করলেন।ভদ্রমহিলা ছেলেদেরকে বোঝালেন।খুব সুন্দর করে বোঝালেন।একপর্যায়ে গিয়ে মানলেন,তবে নিভানের প্রতি মনেহয় একটু অসন্তুষ্টই রয়েই গেলেন।খুব ভালোবাসে যে ছেলেটাকে,হয়তো আশাটাও তেমন করেছিলো।সেজন্য এই অসন্তুষ্টতা।

‘এই, ও অসুস্থ!তাতে আবার বাহিরে থেকে এসেছে।তোরা এরকম ওকে চেপেচুপে বসিয়ে রেখেছিস কেনো?বিশ্রাম নিতে দে।রাতে আবার হলুদের অনুষ্ঠান। এই অসুস্থ শরীরে আবার এক ধকল যাবে।ছেলেটাকে এতো করে বললাম, বুঝালাম শুনলোইনা।বিয়ে মানে বিয়ে।

নীহারিকা বেগম কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে এসে সবার মধ্যে থেকে কৌড়িকে তুলে দাড় করালেন।মিষ্টি হেসে বললেন—আপতত বিশ্রাম নে যা।রাতে হলুদের অনুষ্ঠান।তোকে না জানিয়ে এতো তাড়াহুড়ো করে সবটা করছে বকে,আমার ছেলেটার উপর অসন্তুষ্ট হোস না।নিজের ইচ্ছেগুলো হারিয়ে যেতে দেখতে দেখতে হয়তো তোর বেলায় আর ঝুঁকি নিতে চাইছেনা।

নীহারিকা বেগম কৌড়ির হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলেন। ফের কোমল কন্ঠে শুধালেন—নিভানের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট তুই?

এতো মানুষের ভালোবাসা যার দরুন পাচ্ছে তার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হবে কৌড়ি!না।তবে এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে। এটা কেমন যেনো লাগছে তার।নীহারিকা বেগমের কথায় মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো সে।সেটা দেখে নীহারিকা বেগম মিষ্টি করে হাসলেন।কৌড়ির গালে আলতো স্পর্শে হাত রেখে বললেন–লক্ষী মেয়ে।

পাশ থেকে মান্যতা মৃদু চেচিয়ে বললো-লক্ষী মেয়ে নয়।বলো লক্ষী বউমা।

কৌড়ি লজ্জা পেলো।নীহারিকা বেগম সংশোধনী গলায় বললেন –হ্যাঁ লক্ষী বউমা আমার।

কেমন করে যেনো উঠলো কৌড়ির মন।অদ্ভুত ডাক!প্রসঙ্গ এড়াতে তড়িৎ বলল–দাদীআপা কোথায় বড়মা?

‘বড়মা নয়,নিভানের মতো মা বলে ডাকা শুরু কর।একদিনে যখন ডাকটা হওয়ার নয়,আজ থেকেই শুরু কর।দেখেছিস তন্ময়ীর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।এখন আর আন্টি বলে ডাকেনা।

সোফায় বসা তন্ময়ী লাজুক হাসলো।কৌড়ি আরও লজ্জা পেয়ে কেমন করে নীহারিকা বেগমের দিকে অসহায় নজরে তাকালো।সেটা দেখে নীহারিকা বেগম হাসলেন।বুঝলেন কৌড়ির অস্বস্তি, লজ্জা।তাই এসব পর্ব রেখে বললেন–চাচিমাকে একটু আগে চা দিয়ে আসলাম,তোর দাদুমার রুমে।হয়তো এখনো ওখানেই।তিনি ঠিক আছেন। তুই রুমে যা।বাহিরের জামা কাপড় ছেড়ে আপতত বিশ্রাম নে।

কৌড়ি সম্মতি জানিয়ে আশেপাশে আরেকবার নজর দিলো।বাড়িতে মানুষ ভর্তি। তবে সময়টা মাগরিবের নামাজের পর,এজন্য হয়তো সবাই এখানো যে যার রুমে অবস্থান করছেন।ড্রয়িংরুমের মানুষগুলো সবাই তার পরিচিত।অথচ সবাইকে নজর পড়লেও একটা মানুষকে নজরে পড়ছেনা।দীবাআপু।সকাল থেকে বাড়ি থাকা অব্দি তাকে দেখেনি।এখনও এতো মানুষের ভীড়েও তাকে দেখা যাচ্ছেনা।দীর্ঘশ্বাস ফেললো কৌড়ি। উপরতলার কাঙ্ক্ষিত রুমটার দিকে একবার তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।সাথে মৌনতা, মান্যতা পিছু নিতে ছাড়লো-না।

নিজের রুমের বেডের হেডে মাথা এলিয়ে পায়ের উপর পা জড়িয়ে চোখ বুঁজে বসে কৌড়ি।সব ঠিকঠাক থাকলেও কোথায় যেনো একটা সুর কেটে বসে আছে।কোথায়?দাদিআপার আচারণে?হুমম!বাহিরে মানুষের হইহট্টগোল শোনা যাচ্ছে।তাঁকে সাজাবে বলে মান্যতা মৌনতা একটু পরপর আসছে আর তাকে একের পর সাজের বহর শোনাচ্ছে।পার্লারের লোকদের ভাড়া করা হয়েছে।তারা আসলো বলে।এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা হচ্ছে।শপিংটাও ঠিকঠাক নাকি করতে পারিনি।অথচ বড়ো ভাইয়ের বিয়ে!কতো আহ্লাদিত গলায় অভিযোগ জানালো দুজনে।তবে আজসকালে কৌড়িরা বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তারাও নাকি শপিংয়ে বের হয়েছিলো।হলুদের শপিংটা আপতত গুছিয়ে সেরে এসেছে।কাল মেহেন্দি,বিয়ের জন্য অনলাইনেও চলছে তাদের শপিং।কৌড়িকে দেখালো।তবে তার হলুদের বিশেষ শপিং নাকি করেছে ওই মানুষ।কখন?কৌড়ি জানা নেই।কাল থেকে তো এই অব্দি মানুষটা তারসাথে তবে শপিং করলো কখন?ঈশিতা আপু কেনাকাটার সময় কৌড়ির হলুদের শপিংয়ের জন্য নাকি নিভানের কাছে ফোন দিয়েছিলো, তাকে কিছুক্ষণ শপিংয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।তখন নাকি মানুষটা জানিয়েছে,কৌড়ির জন্য কেনাকাটা লাগবেনা তারা নিজদের ইচ্ছে মতো শপিং করে বাড়িতে ফিরুক।কৌড়ির জন্য নাকি সে ব্যবস্থা করে রেখেছে।তাই আর আলাদাভাবে কৌড়ির জন্য তারা কিছু কিনিনি।তবে মান্যতা ধারনা সরূপ এটাও বললো, অনলাইনে হবে হয়তো।নাহলে সারাদিন কৌড়ির সাথে থেকে আবার তারজন্য শপিং করলো কখন?আসলেই কখন?সব শুনে কৌড়ির ভাবনায় একটা কথা এলো,মানুষটা যখন নিভান।তার ব্রেইনে কি চলছে সেটা শুধু তার মস্তিষ্ক আর মস্তিষ্কের মালিক আল্লাহ জানে।হঠাৎ কারও ধীর পায়ের শব্দে ভাবনা কাটলো কৌড়ির।চোখ খুললো সে।সোজা হয়ে বসলো।মাজেদা খাতুন এসেই কৌড়ির পাশে বসলেন।নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।

‘শরীরডা এখন তোর ঠিকঠাক লাগছে তো আপা?

সময় নিয়ে উত্তর দিলো কৌড়ি –‘হুমম ঠিক আছে।

ছোটো করে উত্তর দিয়ে চুপ রইলো কৌড়ি।মাজেদা খাতুনও চুপ থেকে কৌড়িকে দেখে গেলেন।সেই ছোট্টো কৌড়িটার দু’দিন বাদে বিয়ে।পেট থেকেই টেনে তিনিই তো বের করেছিলেন।তারপর মায়ের অকুলনে,মাতৃত্ব স্নেহ ভালোবাসায় কোলেপিঠে করে তিনিই তো মানুষ করলেন।এইতো সেদিনের কথা।অথচ আজ মেয়েটা বিয়ের উপযুক্ত।দু’দিন বাদেই তার বিয়ে!কি আশ্চর্য!
সময় কতো তাড়াতাড়ি পার হয়ে যায়।ছেলে আর ছেলের বউটা বেঁচে থাকলে,এই দিনটাতে কতোটাই না খুশি হতো তারা।অথচ মেয়েকে বিয়ে সাজে দেখার মতো সুখানুভূতি,নিজের কাছ থেকে বিদায় দিয়ে পর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার মতো দুঃখবিলাস!কোনোটাই কপালে জুটলোনা তাদের।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

‘তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট তাইনা দাদিআপা?

একটু অবাক হলেন তিনি।চকিতে বললেন — অসন্তুষ্ট কেনো হইবো?

‘বিয়ের এই সিদ্ধান্তে মত প্রকাশ করার জন্য।আমি হ্যা মত প্রকাশ করি এটা তুমি চাওনি তাইনা?

ভদ্রমহিলা একটু অপ্রস্তুত হলেন।নাহিদের বিষয়ে যে মনোভাব তিনি মনেমনে পুষেছিলেন সেটাতো তিনি কৌড়িকে সরাসরি প্রকাশ করেননি।তবে কেনো একথা বলছে মেয়েটা।তবে কি মেয়েটা উনার আচারণে কিছু আন্দাজ করে নিয়েছে!হবে হয়তো!কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেও কিছু বলতে পারলেন-না তিনি।

‘তবে আমি তোমার উপর অসন্তুষ্ট!

ভদ্রমহিলা এবার বুঝতে পারলেন,মেয়েটা উনার মনোভাব বুঝে নিয়েছে সব।তাই তিনিও মায়ামায়া কন্ঠে বললেন–আমি তোকে নিজের কাছে রাখার লোভ করেছিলাম।

‘কিন্তু বাবা বেঁচে থাকলে,ও যদি ফেরেস্তা রূপও ধারন করতো তবুও ওরহাতে নিজের মেয়েকে তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা কখনো ভুলেও করতেন*না।তুমি তো বাবার,মা।বাবাকে তো খুব ভালো বুঝতে,চিনতে।তুমি বলো না,বাবা এরকম চিন্তা ভাবনা কখনো পোষণ করতেন কি না?অথচ যে ছেলের জন্য নিজের সন্তানের মৃত্যুর শোকটা ঠিকঠাক ভাবে পালন করতে পারলে না।তার থেকে বাঁচাতে আমাকে রক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে এতো দুরে পাঠিয়ে দিলে।সেই আমাকেই আবার সেই ছেলেটার হাতে তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা।আমাকে অসন্তুষ্টতা করেছে।

ভদ্রমহিলা কৈফিয়ত দিলেন না।নিজের বংশের রক্ততো।খারাপ ছিলো যখন খারাপ নজরে দেখেছেন।মন পুড়েছে তবুও খারাপকে খারাপ বলেছেন।ব্যবহারও করেছেন তেমন।কিন্তু ছেলেটা যখন ভালো পথে ফিরলো,তার কথাবার্তা আচারণে মুগ্ধ হতে বাধ্য হলেন তিনি।দূর্বলতা তো রয়েছেই,নিজের বংশপ্রদীপ।নিজের সন্তানের রক্ত।যারসাথে নিজের রক্তও মিশে আছে।সুপথে ফেরার পর ছেলেটা যখন উনার খোঁজখবর নিতো,কৌড়ির ঘরটায় এসে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতো।ছুঁয়ে ছুয়ে কৌড়ির বইখাতাগুলো দেখতো।উনার যেনো ভিতরে ভিতরে মায়া কাজ করতো।মনে হতো,ছেলেটা আর যতো খারাপ কাজ পিছে করে এসেছে।কৌড়িকে শুধু নিজের রাগজেদের ফল হিসাবে চায়নি।চেয়েছিলো সে খাঁটি মনে।নাহলে কৌড়ির অবর্তমানে, তার সবকিছুতে এতো মায়া,ভালোবাসা দেখায় কেনো ছেলেটা।সেই দূর্বলতা থেকে আর ছেলের বউয়ের ইন্ধনে মনেমনে ইচ্ছেটা পোষন করেছিলেন।চেয়েছিলেন পরিক্ষা শেষ কৌড়িকে বুঝিয়ে বলবেন।কিন্তু তার আগে উনার চাওয়া মনের মধ্যেই চাপা পড়ে গেলো।মেয়েটার ভাগ্যে যাকে লেখা ছিল,সেই এসে মেয়েটাকে চেয়ে নিলো।তবে কৌড়ির একথা সত্য, তিনি নাহিদকে নিয়ে মনেমনে যে চিন্তা ভাবনা পোষন করেছিলেন,নিজের ছেলে তার ফুলের মতো মেয়েটাকে নিয়ে এমন চিন্তা ভাবনা পোষণ করতো-না।

পরিবেশ নীরব গুমোটভাব!সেই নীরবতা কাটলো,দরজায় নক করার মৃদু শব্দে।কৌড়ি আগেই নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসেছিলো।দরজায় শব্দ পড়তেই মাথা উচু করলো।কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে নজরে পড়তেই,ভিতরটা কেমন এলোমেলো অনুভব হলো।মাজেদা খাতুনও পিছু তাকালেন।তিনি তাকাতেই নিভান নমনীয় স্বরে শুধালো।—ভিতরে আসতে পারি,দাদীআপা?

‘অনুমতি লাগে?আইসো,আইসো।

ছেলেটার আচারণে তিনি বরাবরই মুগ্ধ হন।এবাড়িতে এক মাসের অধিক সময় থেকে গেছেন।ছেলেটা স্বভাব গুনে সবদিক থেকে ভালো। তবে তিনি আশা করেননি, একদিন কৌড়িকে সেই ছেলে উনার কাছে চেয়ে বসবে।উঠে দাঁড়ালেন তিনি।ততক্ষণে নিভান ভিতরে ঢুকে গিয়েছে।

‘তোমরা কথা কও।আমি আসতাছি।

‘,আপনি বসুন।আমি ওর সাথে কথা বলতে আসিনি।আপনার সাথে কথা ছিলো।

কথাটা বলে কৌড়ির ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে টুলটা টেনে সেটাতে বসে পড়লো নিভান।কৌড়িকে একপলক দেখে নিলো।মাথা নিচু রেখে নিজের হাত কচলে যাচ্ছে।ভদ্রমহিলা বসে পড়তেই,নিভান সময় নিয়ে শুধালো।

‘আপনি নাতজামাই হিসাবে আমাকে অপছন্দ?নীতনি আমাকে দিতে চাইছেন না,এমনটা কি?

কৌড়ির হাতের কচলানো যেনো বাড়লো।নিভান মাজেদা খাতুনের দিকে অটল নজর রেখে সেটা বুঝতে পারলো।ভদ্রমহিলা আঁতকে উঠার মতো করে বললেন।

‘অপছন্দ ক্যান হইবো,এসব কি কও তুমি?

‘তাহলে আপনার নাতনী পাওয়ার অযোগ্য বলে মনে করছেন?

দ্বিগুণ আঁতকে উঠা কন্ঠে তিনি ফের বললেন–ও মাবুদ, তুমি অযোগ্য হইবা কেনো।এইটা আমি মনেই করিনা।

মনেমনে হাসলো নিভান।ভদ্রমহিলাকে বিভ্রান্ত করার জন্য অকারণে এই প্রশ্নগুলো করা তার।ভদ্রমহিলার সাথে বিয়ের আগে একবার খোলাখুলি কথা বলা উচিত মনে করেছে সে।কৌড়ির প্রচন্ড একটা দূর্বলতার জায়গা এই দাদীআপা।হওয়ারই কথা।আর ভদ্রমহিলার সিদ্ধান্ত খোলাখুলি না হওয়া পর্যন্ত মেয়েটা নিজেও দ্বিধায় ভুগছে।হয়তো মনেমনে ভাবছে দাদিআপার অমতে গিয়ে বিয়েতে সম্মতি দেওয়াটা কি ঠিক হয়েছে তার?তার সম্মতিতে কি দাদিআপা সত্যিই অসন্তুষ্ট?ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী এখন মেয়েটাকে স্ট্রেস নেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ।মনেমনে যদি এই দ্বিধাগুলো পুষে থাকে!সেই স্ট্রেস দূরিভুত করার একটা চেষ্টা মাত্র করতে এসেছে নিভান।

‘তাহলে আমার কেনো মনেহচ্ছে,আমার দেওয়া বিয়ের প্রস্তাবে আপনি খুশি নন।অসন্তুষ্ট!

‘তুমি যা ভাবতেছো তেমনটা নয়।তয় আমি কৌড়িকে আমার কাছে রাইখা দিতে চাইছিলাম এইটা সত্য।

অস্বস্তি নিয়ে কথাটা বললেন মাজেদা খাতুন।কথার অর্থ নিভানের কাছে পরিস্কার।তবে উনি যেমন রাখঢাক রেখে কথাগুলো বললেন।উত্তরও নিভান তেমন দিলো–আপনি কিন্তু আপনার নাতনীর কাছে থাকতে পারেন আজীবন।যেমনটা আপনি মনেমনে পোষন করেছিলেন।

কথার ভার বলে দিচ্ছে, যে বিষয়টা দাদিআপা না বলতেও সে টের পেয়েছে।মানুষটাও টের পেয়ে গেছে। হাতের কচলানো বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই।কৌড়ি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে,সামন্য দূরত্ব বজার রেখে বসা মানুষটার পানে।আশ্চর্য মানুষ!সবদিকে তার এতো তীক্ষ্ণ খেয়াল কেনো?

‘চাইলেই কি সব হয়!নাতিন হোক বা মাইয়া।জামাই বাড়িতে থাকা শোভনীয় দেখায় না।সে যাই বলো-না ক্যান তুমি।যাই হোক তোমার কথা কও,আমি যাই।

উঠে দাঁড়িয়ে কিছুদুর এগোতেই পিছে ফিরলেন তিনি।সচ্চ হেসে জানালেন—তোমারে আমার অপছন্দ নয়।আমার ছেলের পরে আমার নাতিনের দায়িত্ব চোখ বুইজা তোমার উপর ছাইড়া দেওয়া যায়।সেই ছেলেডা আমার নাতিনের অযোগ্য কখনো হইতে পারে?নাকি আমার অপছন্দ হইতে পারে?

প্রশ্ন চিহ্ন ঝুলিয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন।নিভান সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কৌড়ির পানে তাকালো।কৌড়ি তখন-ও অবাক চোখে তাকিয়ে দরজার পানে।

‘দাদিআপা তো মনখুলে সম্মতি জানিয়ে গেলেম,নাতনির কি খবর?তিনি কি ভাবছেন,আজ হলুদের অনুষ্ঠান বাদে বিয়ে কি দুদিন বাদে হবে?নাকি মন অন্য কিছু বলছে?

চকিতে কৌড়ি মুখ ফিরিয়ে নিভানের দিকে তাকালো।ফের মুখটা ছোটো করে দূর্বল গলায় জানালো-সবকিছু এতো দ্রুত কেনো?

বরাবরের মতোই কৌড়ির পানে সুগভীর শান্ত নজরে তাকালো নিভান।কৌড়ি কথাগুলো বলতেই শ্বাস ফেলে ঠান্ডার গলায় শুধালো–দ্রুত হলে সমস্যা কোথায়?তুমি কি আমার হতে চাইছোনা?

তড়িৎ মাথা উপর নিচ নাচিয়ে সম্মতি জানালো কৌড়ি।অর্থাৎ সে হতে চায়।সে শুধু এই মানুষটারই একান্ত নারী হতে চায়।

সুক্ষ হাসলো নিভান।সেই হাসি লক্ষ্য করে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।নিভান বললো—তাহলে সমস্যা কোথায়।দুদিন আগে হোক বা দু’দিন পরে।আমারই যখন হতে হবে,তাড়াতাড়ি হলে বা সমস্যা কোথায়?আর দেরী করেও বা লাভটা কি?

তাকাতে বাধ্য হলো কৌড়ি।অসহায় কন্ঠে বলল-আমার কেমন যেনো লাগছে!

নিজের মনের ভিতরের চাপা কথা বা অনুভূতি সহজে প্রকাশ করেনা মেয়েটা।আজ করছে।কেমন যেনো একটু দুষ্টমি করতে চাইলো মন।নিভান কেমন দুষ্টমী গলায় যেনো শুধালো–কেমন লাগছে?

অচেনা কন্ঠ।এমন গলায় তো কখনো কথা বলিনি মানুষটা!অথচ মানুষটা নিজের জায়গায় অবিচল বসা।বরাবরের মতোই শান্ত নজর,নিশ্চল ভঙ্গিমা।তবে ঠোঁটে খেলা করছে লুকোচুরি দুষ্ট হাসি।নজর এলোমেলো হলো কৌড়ির।চোখ সরিয়ে কোলের মধ্যে রাখা হাতের দিকে নজর দিলো।ফের ছাড়াছাড়া গলায় বললো।

‘আপনি চলে যান,আমার কাজ আছে?

দুষ্ট লুকোচুরি হাসিটা প্রসারিত হলো নিভানের ঠোঁটে।মনটা আরও দুষ্টমিতে মেতে উঠতে চাইলো।আজ একটু প্রশ্রয় দিলো মনটাকে।কেমন মোহনীয় গলায় সামনের মেয়েটাকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে বলে উঠলো।

‘আজ যেতে বলছো।কাল হয়তো একই সিদ্ধান্তে অটল থাকবে।পৌরশুদিন কি করবে?সেদিনতো তুমি আমাকে নিজেই থাকতে বলবে।তখন?

লজ্জায় অস্বস্তিতে বুদ হয়ে থাকা কৌড়িকে বাঁচালো ঈশিতা আর তারসাথে কিছু মেয়ে দলবল।যারা নিভানের পরিচিত কাজিন এবং আশেপাশে ফ্লাটের সুপরিচিত মেয়েরা।তাদেরকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো নিভান।অসময়ে কৌড়ির রুমে সে,দেখে পিঞ্চ করতেও ছাড়লোনা।বরাবরের মতোই নির্বিকার, কথা বাড়ায়নি নিভান।শুধু যাবার আগে ঈশিতাকে বলে গেলো।

‘এক্সট্রা গাদাগাদা রঙচঙ মাখিয়ে ভুতের মতো সাজাবেনা ওকে।ও যেমনই আছে তেমনই পারফেক্ট আছে।ওর ন্যাচারাল চেহারা যেনো রঙচঙের ভিড়ে না হারায়।

গায়ে লাগলো কথাটা এমন স্বরে প্রতিবাদ জানলো ঈশিতা।গলা উঁচিয়ে বলল–এই এই আর তোর বউ যদি সাজতে চায়?

থামলোনা নিভান।যেতে যেতে বললো–ও চাইবেনা।আমি ওকে জানি।নিভান এমনি এমনি তো আর দূর্বল হয়নি ওর উপর।

আরও একগাদা কথার অস্বস্তি দিয়ে চলে গেলো নিভান।কৌড়ি আরও লজ্জা পেলো।সেই লজ্জা বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েগুলো তারসাথে মশকারা করলো কিছুক্ষণ।ঈশিতা তাদেরকে ধমক দিয়ে চুপ করালো।তারপর মান্যতা আর তন্ময়ী হাতভরে হলুদের সাজসজ্জার সরঞ্জাম নিয়ে আসতেই সাজগোছ নিয়ে পড়লো সবাই।হলুদের শাড়ী আর ফুলের গহনা দেখেই কেমন যেনো হৃদপিণ্ড ঢিপঢিপ তাল হারিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠলো তার।

চলবে…

#ফুলকৌড়ি
(৪৫)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

নিজের রুমে রেডি হচ্ছে নিভান।গায়ে কালো ছাইরঙা চেইক শার্ট।ছেলেটাকে আগে ফর্মাল ড্রেসআপে দেখা যেতো বেশি।ভার্সিটি লাইফ চুকানোর পর খুব কমই তাকে এধরনের রঙিন শার্টে দেখা গেছে।তবে ইদানীং আবারও তাকে দেখা যাচ্ছে বেশ।হয়তো প্রেমে পড়ার কেরামতি।তবে একটু পরে হলুদের অনুষ্ঠান।অনুষ্ঠানের পোশাক বাদে এরকম সাধারণ ড্রেসআপে রেডি হচ্ছে কেনো সে?নিভানের এখানে আসা থেকে চুপচাপ তৃনয়।অথচ এরকম চুপচাপ তাকে সাঝেনা।চুপচাপ থাকেও না সে।কিন্তু কি করার।নিভানকে কিভাবে বোঝাবে সে!নিভান যে ধারণা তারসম্পর্কে করছে তা সম্পূর্ণ ভুল।
অনেক্ক্ষণ ধরে চুপ থাকলেও এবার পেটের মধ্যে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার কাচুমাচুটা শুরু হলো। আর চুপ থাকতে পারলোনা তৃনয়।কাছের বন্ধুটার সাথে আজ যেনো কথা বলতেও কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। যদিও তার যৌক্তিক কারণ আছে।তবুও।কেমন অস্বস্তি নিয়ে জড়ানো গলায় বললো।

‘আমার সম্পর্কে তুই যে ধারনা করছিস সম্পূর্ণ ভুল।তুই আমাকে চিনিস নিভান।তুই যে অ্যালিগেশনগুলো আমার উপর অপর্ন করেছিস তা যথাযথ নয়।সম্পূর্ন ভুূল ধারনা তোর।আমি কখনো নিজের সফলতাকে অহংকার রূপে দেখিনি বা ভবিষ্যতে দেখবোওনা। আমার মনে কখনো একরকম ধারনার জন্ম নিতে দেব না যে,আমি সফলতার চুড়ায় উঠলে মান্যতাকে আমি ভুলে গিয়ে অন্য কাওকে নিজের জীবনে জড়াবো।বা সফলতার চুড়ায় পৌঁছাতে পারলে ওরকম মান্যতা আমার জীবনে বহু আসবে!আমি আর যাকে হোক,ওই মেয়েটাকে এতো ছোটো করে দেখিনা কখনো।দেখিওনি কখনো।ইভান যখন তন্ময়ীকে বিয়ে করলো,আমার মনে হয়েছিলো বিয়েটা না-হোক।শুধু বোনের ননদকে পাওয়ার আশংঙ্কা ক্ষীন হয়ে যাবে তাই।তারপর মনে হলো স্বার্থপরী করছি।যা হবে পরে দেখা যাবে,আগের বোনের সুখ।সেই আমাকে তুই এমন দোষারোপে ডুবিয়ে দিয়ে ভুল বুঝতে পারিসনা।

থামলো তৃনয়।নিভান নির্বিকার তার কাজ করে যাচ্ছে। যেনো তৃনয়ের কথাগুলো তার জানা,মুখস্থ।তাই বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালোনা।তৃনয় সেটা বুঝেও ফের বলতে শুরু করলো।

‘কতবার আমি তোকে বলতে চেয়েছি মান্যতার কথা, জানিস?বন্ধুত্ব নষ্ট হবে,তোরসাথে সম্পর্ক খারাপ হবে বলে বলিনি।তারপর মান্যতারও আমার উপর ওই ফালতু ছেলেটাকে মারা নিয়ে,কবেকার রাগ মনে পুষে রেখে রেগে আছে।সেই থেকে তো আমার সাথে ঠিকঠাক কথাও বলে-না।দেখা হলেই এড়িয়ে যায়।এমনকি এবাড়ির সাথে একটা নতুন সম্পর্ক তৈরী হলো,সেখানে যতোবার দেখা হয়েছে আমাকে এড়িয়ে গেছে।কথা বলিনি।সেখানে ওর মতামতটা না জেনে আমি আঙ্কেলের কাছে প্রস্তাব রাখলে,সেই প্রস্তাবে যদি ও অসম্মতি জানায়!আমার সম্মান পরে,মায়ের অসম্মান হোক আমি চাইনি।তাই তুই যখন সেদিন ওরকম কথাগুলো বললি।আমি বুঝে গিয়েছিলাম,তোর কাছে নিজেকে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে গিয়েছে মাত্র।আমার মনে মান্যতাকে নিয়ে অনুভূতি জন্মানো থেকে তুই আগাগোড়া সবটাই জানিস।যা বুঝতে দিসনি কখনো।চতুর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন বিজনেসম্যান নিভানের কাছে তার কাছের বন্ধুর অনুভূতি লুকানো আসলেই গাধামী?এটা আমারও মাথায় ছিলো-না।যাই হোক সেদিন তোর কথায় বুঝতে পেরেছিলাম তুই চায়ছিস,আমি মান্যতা জন্য তার গার্ডিয়ানের কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখি।বিশ্বাস কর,আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম।ভেবেও নিয়েছিলাম পরের দিন মা’কে নিয়ে এবাড়িতে আসবো।হঠাৎ মান্যতার কথা মনে পড়লো।ভাবলাম,ও যদি আমার প্রস্তাবে সম্মত না হয়।তবে?
সেদিন সারারাত ঘুমাইনি কিভাবে মান্যতাকে মানাবো সেই চিন্তায়।রাতেই ওরসাথে যোগাযোগ করার ট্রাই করলাম।ফোন ধরেনি।হোয়াটসঅ্যাপে নক দিলাম, ফাযিল মেয়েটা আমার রিপ্লাইই দেয়নি।

‘সাবধানে ওয়ার্ড ইউজ কর।কার সম্পর্কে কথা বলছিস ভুলে যাসনা।

নিভানের হুমকিমুলক বার্তায় পাত্তা দিলোনা তৃনয়।বরং
একই টোনে বললোো–আর তোর বোন যেটা করছে, সেটা ঠিক?ও আমাকে বুঝেও অবুঝ হয়ে রয়েছে!বল এখন আমার কি করনীয়?ও এখনো সেই ঘটনা নিয়ে পড়ে আছে।ছেলেটা খারাপ ছিলো, এটা ওর ধ্যানে নেই।তুই ছেলেটাকে মেরেছিলি।ওর ধারণা আমি তোকে উসকিয়ে ছিলাম,এবং ছেলেটার সাথে ও রিলেশনে জড়িয়েছে সেটা তোকেই আমিই জানিয়েছিলাম।

‘ওর ধারনাতো ভুল নয়।তুইই-তো জানিয়েছিলি।

‘নিভান।

হাসলো নিভান।কাল কথার ছলে রেগে গিয়ে কি না কি বলেছে,তাই নিয়ে পড়েছে ছেলেটা।

‘তুই ভালোভাবে জানিস,আমি কি বলেছিলাম আর কি করেছিলাম!ওর খারাপ কখনো চাইনি আমি।ছেলেটার উদ্দেশ্য খারাপ ছিলো ওকে নিয়ে,যেটা আমি জানতে পেরেছিলাম আর তোকে জানাতে-ও বাধ্য হয়েছিলাম।আমার অনুভূতির অন্ধ মোহে পড়ে কোনো কিছু করিনি আমি।

‘তবে আর কি!মান্য যখন তোকে অপছন্দ করে।তোর প্রস্তাবে রাজী হবেনা ভাবছিস।তাহলে আর কি করার!আমি বরং মিঃ চৌধুরীর প্রস্তাবে আগ্রহী হতে বলি।এবং আসার নিমন্ত্রণ জানাই।কি বলিস?

‘নিভান।

অসহায় কন্ঠ তৃনয়ের।ডাক শুনে ঠোঁট থেকে মুছে যাওয়া হাসিটা ফিরে এলো নিভানের।অকপটে বললো-‘আরেহ মহা মুশকিল!’তো কি করতে বলছিস?বোন আমি তোর বাড়িতে গিয়ে উঠিয়ে দিয়ে আসবো।যে আমার একটাই মাত্র বোন বেশি হয়ে গিয়েছে,পাত্রস্থ করতে পারছিনা।তাই বন্ধুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেলাম।

‘তা কখন বললাম!আমি জানি তুই বললে মান্যতা একবাক্যে বিয়েতে রাজি হবে।কিন্তু মন থেকে তো নয়।আমার প্রতি যে বিরূপ দৃষ্টি ওর মনে আগলে রেখেছে।সেখানে সবটা ঠিকঠাক কিকরে হবে?সেই ভাবনা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে, আর তুই আছিস মজায়?

‘এই ভাবনাগুলো ওর প্রতি দূর্বল হওয়ার আগে ভাবা উচিত ছিলো-না।

‘সবকিছু কি ভেবেচিন্তে হয়।আর ওর প্রতি দূর্বলতা,ওই ঘটনার আগে থেকে জন্মেছিলো।এটা তুইও জানিস…

‘কৌড়িও কিন্তু রাজী ছিলো-না।তাকে মানাতে হয়েছে আমাকে।তারপর এই দিনটা এসেছে আমার জীবনে।

‘তোর বোন, মানানোর সুযোগ দিচ্ছে আমাকে?যেদিন তুই প্রস্তাব রাখার ইঙ্গিত দিলি সেদিন থেকে উল্টোপাল্টা চিন্তায় ভাবনায় মাথার মধ্যে আমার আওলাঝাওলা হয়ে আছে।সেখান থেকেই তোর বোনের সাথে কথা বলার,তাকে বোঝানোর সুযোগের চেষ্টা করছি।এর আগে ওকে বোঝানোর জন্য কথা বলার কতো চেষ্টা করেছি।সুযোগ দিয়েছে আমাকে?বিকালে তুই আবার তোর বোনের মতো বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কথা বলে আসলি।অথচ আমার দিকটা কেউ ভেবেও দেখলিনা।কি যন্ত্রণায় আছি আমি!

কানে শুনলেও, তৃনয়ের কথায় বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালো না নিভান।গায়ে পারফিউমের সুগন্ধটা ছড়িয়ে নিয়ে,টেবিল থেকে নিজের ফোনটা নিতে গিয়ে কৌড়িরটাও নজরে পড়লো।সেটাও পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে গাড়ির চাবিটা হাতে নিলো।তৃনয়কে তাড়া দিয়ে বললো—উঠ।বাহিরে যাবো।সাথে তুইও যাচ্ছিস।

‘নিভান।

ডাকের অর্থ নিভানের জানা।সেই প্রেক্ষিতে মজার ছলে বললো–তোর বিয়ে নিয়ে পরে দিনরাত একত্র করে ভাবতে বসিস। আপতত আমার বিয়েটা এনজয় কর।

‘নিভান।

‘বাচ্চাদের মতো এরকম আম্মা আম্মা করছিস কেনো?সুদর্শন যুবক,একটা মেয়ের মন জয় করতে পারিস-না।
এরচেয়ে চরম ব্যর্থতা একজন সুদর্শন পুরুষের জীবনে আর আছে!উঠ।

‘তোর বোন বাদে কতো মেয়ে পটে আছে জানিস?কথাটা বলতে গিয়েও বললোনা তৃনয়।একথা মুখ থেকে কোনোক্রমে বের হয়ে গেলে,বোনের আহ্লাদে ভাই তাকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলতেও ছাড়বেনা।তাই প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো।

‘একটু পরে হলুদের অনুষ্ঠান।তুই এখন কোথায় বের হবি?

‘প্রয়োজন আছে।গেলেই তো দেখতে পাবি।চল।

তৃনয় উঠে দাঁড়াতেই নিভান এসে তারসামনে দাঁড়ালো। তৃনয়ের গায়ে জড়ানো ফ্যাকাশে কালেরর হলুদ রঙা পাঞ্জাবি।উপরের দুটো বোতাম খোলা।সেখানে দ্বিধাহীন হাত রাখলো নিভান।বোতাম দুটো লাগিয়ে দিতে দিতে খুব শান্ত মসৃণ কন্ঠে বললো।

‘মান্যতা রাজী হবে।আর ও তোর সম্পর্কে যে ধরণাই মনে পুষে রাখুক না কেনো এটা জানে এবং মানে, তুই ভালো ছেলে।খুব ভালো ছেলে।বাবার কাছে প্রস্তাব রাখ।আমার জানামতে,তিনি তোর প্রস্তাবে অমত পোষন করবেননা।আর তিনি প্রস্তাবে সম্মতি প্রকাশ করা মানে মান্যর সম্মতি।তারপরও আমি মান্যর সাথে কথা বলে নেবো।বিয়েটা হলে হতে দে।সেই ছেলেটার পরে মান্যতা আর কোনো রিলেশনশিপে জড়াইনি।তাহলে এতো কেনো টেনশন নিচ্ছিস!ওকে মানাতে চাস বোঝাতে চাস, ভালো কথা।ও যখন সুযোগ দিচ্ছে না,বিয়েটা করেনে।তারপর মানানোর বোঝানোর সময়টা কাছ থেকে পাবি।দেখবি মানানোসহ সম্পর্কটা আর-ও সহজ হয়ে গেছে।আর বিবাহিত সম্পর্কে সৃষ্টিকর্তার আলাদা একটা রহমত থাকে।সেই পবিত্র সম্পর্কে দুটো আলাদা অচেনা নর-নারীর মধ্যেও তিনি অঢেল,মায়া,ভালোবাসা টান সৃষ্টি করে দেন।সুতারাং বিয়েটা করে নে।সমাধান এমনিতেই মিলে যাবে।

আবেগে আপ্লূত হলো তৃনয়।পুরুষ চোখে সহজে নোনাজল না জমলেও,ভিতর থেকে একটা আবেগের ঢেউ খেলে গেলো।এরকম বন্ধু থাকলে,আর কি চাই!জীবন সহজ।আবেগে আপ্লূত হয়ে কথা যেনো হারিয়ে গিয়েছে তার।নিভানের হাত সরিয়ে যেই ওকে জড়িয়ে ধরতে যাবে,নিভান ওর বুকে হাত দিয়ে বাধা দিয়ে বললো–আবেগে পরে ভাসিস ডুবিস।আপতত চল।

তৃনয় শুনলো না।নিভানের হাতটা জোরকরে সরিয়ে দিয়ে তাকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো।তবে আবেগপ্রবণ হয়ে মুখে বলতে পারলো না কিছু।নিভান সেটা বুঝে নিজেও শক্তকরে ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।পিঠে বারবার হাত বুলিয়ে ঠাট্টা করে বললো–তুই এরকম মেয়েদের মতো আবেগী হয়ে গেলি কবে থেকে।

‘যেদিন থেকে নিভান নামে আমার একটা সুবন্ধু হয়েছে সেদিন থেকেই।

হেসে উঠলো দুজনে।ফের একে-অপরকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো।তৃনয় গিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে।নিজেকে একপল দেখে নিয়ে নিভানের পিছু নিলো।দু’জনে দরজা অব্দি পৌঁছানোর আগেই সম্মুখে এসে হাজির হলো ঈশিতা।হাতে তার তার নামী শপিংমলের একটা শপিং ব্যাগ।নিভানেকে সাধারণ বেশে রেডি হয়ে কোথাও যেতে দেখেই কপাল কুঁচকে গেলো তার।সহসা শুধালো।

‘তুই কোথাও যাচ্ছিস?

‘আমার একটু কাজ আছে।বাহিরে যেতে হবে।আপতত সেই উদ্দেশ্যে বের হচ্ছি।কেনো,কোনো প্রয়োজন?

‘মানেটা কি!একটু পরে হলুদের অনুষ্ঠান!এখন তুই বের হবি?

‘হলুদের অনুষ্ঠানে আমার কি কাজ?তোমরা কি আমাকেও হলুদ মাখানোর চিন্তা ভাবনা করছো নাকি?

কপালে ভাজ ফেলিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে কথাটা বলতেই, পাশে দাঁড়ানো তৃনয় হেসে দিলো।শব্দ শুনেও কর্ণপাত করলো না নিভান।ঈশিতার মুখের দিকে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে রইলো।সেই তাকানো উপেক্ষা করে ঈশিতা বললো —

‘হলুদের অনুষ্ঠানে তোর কি কাজ মানে?বিয়ে কি একা কৌড়ির হচ্ছে?ওর যে কারণে হলুদ ছোঁয়ানো হবে তোরও একই কারণেই ছোঁয়ানো হবে।আর তোকে হলুদ মাখানোর চিন্তাভাবনা মানে?বিয়ের বর কনে দুজনকে হলুদ ছোঁয়ানো নিয়ম।

‘নিয়ম না মানলে কি হবে?

‘কিচ্ছু হবে-না।তবে এটা বিয়ের একটা আনুষ্ঠানিকতা। এছাড়া কিছু না।

‘তাহলে মানা না মানাতে সমস্যা কোথায়? আর আমার এখন বাহিরে যাওয়াটা খুব প্রয়োজন।

শপিংব্যাগটা নিভানের হাতে ধরিয়ে দিলো ঈশিতা।ফের বললো–এতো কথা শুনতে চাইনা।রেডি হয়ে নিচে আসবি,এটাই জানি।

‘এটাতে কি?

‘তোর হলুদের পোশাক।

‘মানেটা কি?তুমি জানোনা আমার হলুদ রঙ নিজের গায়ে জড়ানো একদম পছন্দ নয়।

‘সেজন্য পুরোপুরি হলুদ পোশাক নেয়নি।তুই দেখে নে।
তবে রেডি হয়ে নিচে আসবি,দ্বিতীয়ত আর কোনো কথা শুনতে চাইনা।

ঈশিতা আর সেকেন্ড সময় ব্যায় না করে চলে গেলো।সেদিকে তাকিয়ে নিভান কিছু ভাবলো।বাহিরে যাওয়াটা তার খুব প্রয়োজন।তারপর আবারও কিছু ভেবে রেডি হতে চলে গেলো।তা নিয়ে তৃনয়ও মজা লুটলো।এটা বলতেও ছাড়লোনা।–

‘তোমার পুরুষ স্বাধীনতার অবক্ষয় হতে শুরু হয়ে গেছে বন্ধুু।

সময়টা রাত আটটার এদিক ওদিক।অথচ দিনের আলোর মতো ফকফকা পরিস্কার,চারপাশটা।ফুল দিয়ে আচ্ছাদিত চমৎকার চোখে ধাঁধানো সজ্জার স্টেজে এনে বসানো হয়েছে কৌড়িকে।পরনে তার,ভারী কাতান মোলায়েম হলুদ শাড়ী।দুধে আলতা গায়ের বর্ণে নিদারুণ মানিয়েছে হলুদ রঙটা।কৃত্রিম নয় অকৃত্রিম সতেজ টাটকা ফুলে সাজানো হয়েছে তাকে।রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুলের সংমিশ্রণে গহনা বানিয়ে তার বিভিন্ন অঙ্গ জড়ানো হয়েছে।তাতে গোলগাল মায়াবী চেহারার জৌলুষ যেনো চৌগুন বেড়ে গিয়েছে।হরিণী চোখজোড়া আজ মাশকারার ছোঁয়ায় অন্যরকম লাগছে।কেমন?আকর্ষণীয়,আরও মায়াময়।চিকন ঠোঁটজোড়া সেজে উঠেছে,কৃষ্ণচূড়ার লালাভ আভায়।নিভানের কথামতো কি, কৌড়ির ইচ্ছায়।অতিরঞ্জিত মেকওভারে সাজানো হয়নি তাকে।খুব সাধারণ সাজেই সাজানো হয়েছে।অথচ মোহমায়া রূপ যেনো উপচে পড়ছে।অসাধারণ অপরূপা এক রূপ।পছন্দের নারীটিকে আজ প্রথমবার শাড়িতে এবং সাজে দেখলো নিভান।সেই মোহমায়া অপরূপা রূপে যেনো নজর থমকে রইলো।থমকে রইলো হৃদস্পন্দনও।সচ্চ সুগভীর নিষ্পলক চোখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলো নিভান।

‘ওয়াও,আজ ফুলকৌড়িকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে!

নিভানের হাতের বাধন ছাড়িয়ে নাফিম সামনে ছুটতেই হুঁশ ফিরলো তার।মূহুর্তেই তাকে দেখে হৈহৈ করে উঠল সবাই।সেটা খেয়াল হতেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার চেষ্টা করে নিলো,কিন্তু বাহিরটাকে স্বাভাবিক দেখাতে পারলেও ভিতরটাকে কিছুতেই স্বাভাবিকতায় দমাতে পারলো নিভান।ভিতরের নতুন নড়েচড়ে উঠা কম্পিত অনুভূতিগুলো যেনো চঞ্চল উচ্ছ্বসিত পায়ে বুকের ভিতর নৃত্য করে চলেছে।হৃদয়ের সেই চঞ্চলা অনুভূতি নিয়েই ধীর পায়ে কৌড়ির পানে এগোলো নিভান।তার সামনে এগোনো একেক কদমে স্টেজে বসা মেয়েটার বুকের ভিতর-ও কম্পন ধরালো।লজ্জিত হয়ে শিরশির করে উঠলো গায়ের প্রতিটি লোমকূপ।মাথা নিচু করে নিয়ে সেই লজ্জা নিবারিত করতে চাইলো।পারলো কি?কে পারলো!তা যেনো এগোনো মানুষটার প্রতিটি পদক্ষেপের ন্যায় বেড়ে চললো।চারপাশটা উচ্ছ্বসিত,মুখরিত।নিভানের আগমন,এবং কৌড়িরপানে এগোনো পদক্ষেপ যেনো বাড়িয়ে দিলো,সেই উচ্ছসিত পরিবেশ।নিভান এসে কৌড়ির পাশাপাশি নয় সামনে দুহাটু সঁপে বসলো।দু’জনের মধ্যেখানে, হলুদের ডালা আর বিভিন্ন মিষ্টান্ন দিয়ে সাজানো টেবিলটা শুধু বাঁধা হয়ে রইলো।নিভান সেটা পরোয়া করলোনা।নির্দ্বিধায় মুখ বাড়িয়ে নিয়ে মুগ্ধ কন্ঠে বললো।

‘মাশাআল্লাহ।

আবারও হৈহৈ করে উঠলো সবাই।কৌড়ির হাত জড়িয়ে বসা নাফিমও নিভানকে অনুসরণ করে বলে উঠলো– ‘মাশাআল্লাহ।ফুলকৌড়িকে সত্যিই পরীদের মতো সুন্দর লাগছে,তাইনা বলো দাদাভাই?

নিভান কিছু বললোনা।অথচ তার হাস্যজ্বল নজর দুটো বলে দিলো অনেককিছু।দূর থেকে ইভান উচ্ছ্বসিত গলায় মজা লুটতে থাকলো।কান দিলোনা নিভান।তবে লজ্জায় আড়ষ্ট হলো কৌড়ি।সেই আড়ষ্টতা বাড়িয়ে দিয়ে নিভান হাত ছোঁয়ালো হলুদের বাটিতে।তর্জনী আর মধ্যমা আঙুলে মাখিয়ে নিলো হুলুদের গাঢ় প্রলেপ।চারপাশ থেকে মেয়েদের গুঞ্জন উঠলো।তন্মধ্যে মান্যতার গলার স্বর স্পষ্ট হয়ে ভেসে এলো।

‘হলুদ হাতে লাগিও-না দাদাভাই। বাটির পাশে দেখো গোলাপের পাতা আছে,সেটাতে লাগিয়ে নাও।

শুনলো কি মানুষটা!না!কৌড়ি স্পষ্ট দেখলো,হলুদের গাঢ় প্রলেপ লাগিয়ে নিয়েছে ডানহাতের দু আঙুলে।তারপর সেই আঙুলজোড়া দ্বিধাহীন ছুঁয়ে দিলো তার নরম গাল।হলুদের ঠান্ডা প্রলেপে নাকি কারও নমনীয় স্পর্শে!জানা নেই কৌড়ির!শিরশির করে উঠলো শরীর।
শীতল স্রোত বয়ে গেলো সর্বাঙ্গে।অতি লজ্জায় নুইয়ে পড়ার বদলে মুখ উঁচু করে তাকালো সে।তাঁকে ছুঁয়ে দেওয়া আঙুলজোড়ায় লেগে থাকা বাকি প্রলেপ ছুয়ে নিলো,নিভান নিজের গালে।সমস্ত শরীরে এবার তরঙ্গোচ্ছ্বাসের শীতল ঢেউ বয়ে চলল।গতিনিয়ন্ত্রন ছাড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে থাকলো হৃদপিণ্ড।চারপাশটা তখন নিভানের কর্মে উচ্ছসিত।সেই উচ্ছ্বসিত কন্ঠগুলোকে উপেক্ষা করে সামনের হলুদে আচ্ছাদিত অপরূপা বেশে, হৃদয়ে ঝড় তোলা নারীটিকে উদ্দেশ্য করে বললো নিভান।

‘তোমার হলুদের সালামী নেবে না!

বাকরুদ্ধ কৌড়ি তখন অপলক চোখে চেয়ে।সাদা পাজামা পাঞ্জাবিতে মানুষটা।পাঞ্জাবির উপরের কটিটা শুধু হলুদের।তাও খুবই হালকা রঙের।অথচ শুভ্র সেই সাধারণে পোশাকে,কি মায়াময় আর হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে সেই শ্যামলাটে পুরুষটাকে।

‘কি হলো,নেবেনা?

কানে কথা গেলে-ও কিছু বললোনা কৌড়ি।শুরু বোবা মানুষের মতো অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।কি মুগ্ধকর সেই দৃষ্টি। যদি নারীটি তারজন্য হালাল হতো,অনুষ্ঠানের সমস্ত মানুষকে উপেক্ষা করে ওই মায়াময় চোখে আদর ছুঁয়ে দিতো নিভান।আপতত তা সংবরন করলো।মিষ্টি কন্ঠে বললো।

‘শুনেছি হলুদের অনুষ্ঠানিকতার নিয়ম হচ্ছে, কনেকে হলুদ ছুয়ে তাকে সালামী দেওয়া।আমি তো হলুদ ছুঁয়ে দিলাম।সালামিতো এবার প্রযোজ্য।দিতেই হবে।নেবে না?

চমৎকার হেসে কথাটা জিজ্ঞেস করলো।কৌড়ির জবাবের অপেক্ষা না করে তার কোমল বাম হাতটা তুলে নিলো নিজের হাতের মুঠোয়।ফের ডান হাতটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে চমৎকার একটা জুয়েলারী বক্স বের করলো।ডান হাতের আঙুল দ্বারা সেটা খুলতেই,সাদা পাথরটা তার সৌন্দর্য ছড়িয়ে জ্বলজ্বল করে উঠলো।মুখর হলো পরিবেশ।দেরী করলোনা ইভান,বিভিন্ন এ্যঙ্গেলে ছবি উঠিয়ে নিলো কয়েকগাছি।বক্স থেকে রিংটা উঠিয়ে নিলো নিভান।আলতো স্পর্শে তা পরিয়ে দিলো কৌড়ির অনামিকায়।কৌড়ি বিস্মিত নজর একপলক সেটা দেখে আবার নজর স্থির করলো, সামনের মানুষটার শ্যমবর্ন মুখে।আবেগে কান্না ঠিহরে বের হতো চাইলো।দাঁতে দাত চেপে তা সংবরণ করলো।রিং পরানো শেষে মুখ তুলে চাইলো নিভান।চমৎকার সেই হাসিটা তখনো ঠোঁটে ঝুলে।

‘কান্নাদের আটকাচ্ছো কেনো?তাদেরকে আসতে দাও।ঠোঁট থেকে দাঁত সরাও।আমি তোমার চোখে সুখের কান্না দেখতে চাই,তবে তারসাথে ঠোটের চমৎকার হাসিটাও।

ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে হাসলো কৌড়ি।মায়াবী হরিণী চোখে তখন জ্বলে টইটম্বুর।সেই কান্না হাসিতে মোহগ্রস্ত হলো নিভান।অমায়িক কন্ঠে বললো–আমাকে রিং পরাবে না?

এবার লজ্জায় আড়ষ্ট হলো কৌড়ি।কিভাবে সম্ভব!এই এতো এতো আভিজাত্যপূর্ন আয়োজন সব শুধুমাত্র তারজন্য করেছে মানুষটা।অথচ সেই মানুষটার জন্য তার পক্ষ থেকে করার কেউ নেই।কিচ্ছু নেই।বাবা মা বেচে থাকলে,জীবনটা স্বাভাবিক হলে এমন দিনটা কি কখনো দেখতে হতো?তার বাবার অর্থ ঐতিহ্য কম থাকলেও এই মানুষটাকে একটা কিছু উপহার দেওয়ার মতো অর্থ সমর্থ্য তো ছিলো।কৌড়ির ভাবনার মাঝেই চোখ ইশারা করে কিছু দেখালো নিভান।ঈশারা লক্ষ্য করে তাকাতেই এবার আর বিস্মিত নয়,মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কৌড়ি।নিভান স্পষ্ট খেয়াল করলো।নিজে রিংটা কৌড়ির হাতে তুলে দিলো।ফের পরাতে ইশারা করলো।আশেপাশে ছোটো বড় নানা মানুষের উৎসুক নজরের ঢল।নজর ফিরিয়ে রিংটা পরিয়ে দিলো নিভানের বাড়িয়ে দেওয়া ডানহাতে।ফের হৈচৈ শুরু হলো।সেসব হৈচৈ উপেক্ষা করে নিভান নুইয়ে কৌড়ির কানের কাছাকাছি হলো।চমৎকার কন্ঠে বললো।

‘আমার ফুলকৌড়ির আত্মসম্মানে আঘাত আনুক এমন কাজ কখনো করবেনা নিভান।চিন্তা করোনা,আমার শ্বশুরের প্রাপ্য সম্পদ থেকে এই রিংয়ের অর্থ আমি ঠিক সময়মতো নিয়ে নেবো।আপতত আমার ফুলকৌড়ির সম্মান যেনো হীন না-হয় সেই দায়িত্বটা নিলাম।

এবার কেঁদে ফেললো কৌড়ি।তবে মুখে তার মায়াবী হাসি।পাশ থেকে ভেসে এলো সফট ভলিউমের গানের কিছু কলি।

হাওয়া কেনো আজ হয়েছে মাতাল,কানে কানে বলে।
আছে যতো সুখ ভরে দেবো আজ তোরই আচলে…

ভেসে আসা সুরের সাথে মৃদুস্বরে মানুষটাও যেনো তাল মেলালো।কি ভয়ংকর সে কন্ঠে।ঝর তুলে দিলো কৌড়ির হৃদয়ে।হঠাৎ সুর থামিয়ে মিষ্টি কন্ঠে শুধালো নিভান।

‘এখনো মন খারাপ?

মাথা নাড়িয়ে না জানালো কৌড়ি।মায়ামায়া কন্ঠে বললো –থ্যাঙ্কিউ।

‘অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে।অসম্ভব!

নিজের কথার পরিবর্তে এই উত্তর আশা করেনি কৌড়ি।লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।হঠাৎ মনেহলো পাশে নাফিম ছিলো যে!এতো-সময়?পাশে তাকালো কৌড়ি।নেই ছেলেটা।ওইযে দুরে দাঁড়িয়ে ইভানের সাথে দুষ্টুমিতে মেতেছে।স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো কৌড়ি।

‘কৌড়ি।

তড়িৎ মুখ ফিরিয়ে সামনের মানুষটার দিকে তাকালো কৌড়ি। নিভান সুন্দর শান্ত কন্ঠে বললো-আমাকে একটু বাহিরে যেতে হবে।আর্জেন্ট।কোনোরূপ মন খারাপ করবে-না।হলুদের অনুষ্ঠান মন দিয়ে এনজয় করবে।আমি না থাকায় হোক বা কারও কোনো উল্টো পাল্টা কথায়।কোনোরূপ মন খারাপ করবেনা।এই সময়গুলো আর কখনো ফিরে আসবেনা,সেভাবেই তোমার কাছের মানুষগুলোর সাথে এনজয় করবে।আমি যেখানেই থাকিনা কেনো,নজর আমার তোমাতেই থাকবে।তাই ভুলেও যেনো দেখিনা,আমার ফুলকৌড়ির ঠোঁটের হাসি সরেছে।কেমন?

মোহগ্রস্তের মতো মাথা নাড়ালো কৌড়ি।উঠে দাঁড়ালো নিভান।তৃনয়কে দেখলো ইভানের সাথে কথা বলতে।
অথচ নজর তার ক্ষনে ক্নে মান্যতাতে গিয়ে ঠিকছে।মেয়েটার সাথে কথা বলা প্রয়োজন।তবে এখন নয়।তৃনয়ের দিকে এগোলো নিভান।মূহুর্তেই মেয়েদল এসে ভীড় করল কৌড়ির পাশে।হলুদ মাখার হৈচৈ পড়ে গেলো।তবে মুরুব্বিপাটি না আসা পর্যন্ত কেউ কৌড়িকে হলুদ ছোঁয়ালো-না।নিষেধ আছে।তারা আসবে তারপর হলুদ ছোঁয়ানো শুরু হবে।তবে নিভানের বিষয় আলাদা ছিলো বলে কেউ কোনো দ্বিরুক্তি করেনি।

তৃনয়কে সাথে নিয়ে নিভান বের হলো।যাওয়ার আগে বার্তা ছুঁড়ে গেলো।—দ্বিতীয় কোনো পুরুষ যেনো ওকে হলুদ না ছোঁয়ায়।না মানে না।

বার্তা শিরোধার্য।সেই বিষয়ে যুক্তিতর্ক হওয়ার আগেই নিভান বড়োবড়ো কদম ফেলে চলে গেলো।কারও দ্বিরুক্তি শুনলো না।নিভান চলে যেতেই সেখানে হাজির হতে শুরু হলো বাড়ির সিনিয়র পাটিরা।সাথে দীবাকেও দেখা গেলো।গম্ভীর মুখ।ফর্সা চোখমুখ লালাভ আভায় ছেয়ে আছে।চোখগুলো ফুলোফুলো ভাব।চোখমুখের হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে প্রচুর কেঁদেছে।কৌড়িকে আশ্চর্য করে দিয়ে তার পাশে এসেই বসলো সে।মিষ্টি করে হাসলোও।অথচ মেয়েটা কখনো তাকে দেখে হাসেনা।কেমন মুখটা গম্ভীর করে রাখে।আর এই চারমাসে তারসাথে কথা কতোবার বলেছে গুনে বলতে পারবে কৌড়ি।কৌড়িকে আরও আশ্চর্য করে দিয়ে মেয়েটা সুমিষ্ট কন্ঠে শুধালো——-শরীর এখন কেমন তোমার? ঠিক আছো?হলুদ কে মাখিয়ে দিয়েছে?নিভান?

নিভান নামটা নিতে গিয়ে গলা কপলো কি তার!কৌড়ি তো টের পেলো কাঁপা! কিজানি হয়তো!তবে এতো প্রশ্ন একসাথে!আশ্চর্য তো হলো সাথে উত্তর দিতে ভুললোনা কৌড়ি।–আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছি আপু।

তবে শেষের কথার উত্তর দিলোনা।তারআগেই গাড়ীর হর্নের শব্দে চোখ গেলো বাড়ির মুল গেটে।নিভানের গাড়িটা বের হচ্ছে।গাড়িটা বের হওয়ার আগেই আরও একটা গাড়ি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো।যা দেখে ছলাৎ করে উঠলো দীবার কলিজা।সিয়ামদের ইনভাইটেশন করলো কে?বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা তো আপতত বাড়ির লোকদের আর কিছু কাছের মানুষদের নিয়ে হচ্ছে।তবে উনারা এখানে কেনো এসেছে নাকি অন্যকিছু। তবে ওদের আসার নিমন্ত্রন জানালো কে?
নিভান নাকি মামা!দীবার কতশত ভাবনার মাঝে,
গাড়ি এসে থামলো পার্কিং এরিয়ায়।গাড়ী থেকে প্রথমে নামলো সুদর্শন এক যুবুক।বাহিরের সৌন্দর্য্যে পারফেক্ট যাকে বলে।আভিজাত্যপূর্ন হলুদ পোশাকে আচ্ছাদিত সে।সময় নিয়ে ফ্রন্ট সিট থেকে নামলেন এক ভদ্রমহিলা।উনার পোশাক-আশাকেও আভিজাত্যের ছোঁয়া।দু’জনকে দেখেই শক্ত হয়ে গেলো দীবার শরীর।পাংশুটে হলো মুখাবয়ব।যেটা পাশে বসা কৌড়ি সুক্ষ নজরে খেয়াল করলো।কৌড়ির অপরিচিত মানুষ দুজন কাছে আসতেই বাড়ির মুরুব্বিরা বিনয়ী হয়ে আলাপপরিচয় সারলেন।ডালিয়া বেগম যেনো একটু বেশিই বিনয়ী হয়ে কথা বললেন।তাতেই কৌড়ি বুঝে গেলো মানুষ দুজন কে?ততক্ষণে কৌড়ির হলুদ ছোঁয়ানো কাজ শুরু হয়ে গেছে।নিভানের মামিদের দিয়েই শুরু হলো হলুদ ছোঁয়া।নিভান চলে যাওয়ায় ঈশিতাসহ বাড়ির মুরুব্বিরা তাকে বকতে বকতে হলুদ ছোঁয়ানো শুরু করলেন।তারমধ্যেই আগমন ঘটলো দীবার হাসবেন্ড আর তার শ্বাশুড়ির।সিয়ামকে ছেলেদের ভীড়ে চলে যেতে দেখলেও ভদ্রমহিলা এসেই বসলেন দীবার পাশে।খুব নমনীয় কন্ঠে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন।গম্ভীর স্বরে হলেও দীবাও উত্তর দিল।
যেটা পাশে থাকায় কৌড়ি শুনতে পেলো।তারপর ভালো মন্দ কিছু কথা হওয়ার পর ভদ্রমহিলা কৌড়িকে হলুদ ছোঁয়ালেন।ফের আমায়িক কন্ঠে বললেন।

‘ওরে বাবাহ এতো দেখি অনিন্দ্য সুন্দরী।এই পরী কোথা থেকে খুঁজে আনলো নিভান!

আরও কত প্রশংসা করলেন।ভদ্রমিলাকে যথেষ্ঠ ভালো মনের এবং অমায়িক ব্যবহারের বলেই মনে হলো কৌড়ির।তারপরও দীবা আপু সংসার করতে চাইছেনা। কেনো?শুধু কি ওই মানুষটার জন্য?কেমন যেনো শক্ত হয়ে এলো কৌড়ির শরীর। ভাবনাটা কেমন হঠাৎই অস্থির করে তুললো তাকে।

হলুদের ছোঁয়ায় মুখরিত হলো পরিবেশ।সফট ভলিউমে মিউজিক চলছে।যেটা ইয়াং ছেলেমেয়েরা মানতে চাইছেনা।তবে বাড়ির সিনিয়রপাটি এবং নিভানের বিশেষ নিষেধাজ্ঞা থাকায় সবকটাকে শান্ত করে রেখেছে ইভান।লনের বাগান সাইডে ঘাটি পেতেছে জাহিদ সাহেবসহ উনার বয়স্ক শালাবাবুরা সাথে শাহেদ সাহেবসহ আরও কিছু পরিচিত মানুষ।চা কফির বিশাল নাস্তারপানির সাথে তাদের বিভিন্ন আলোচনা চলছে।গানের লাউড ভলিউম কানে গেলে,নিভানের বড়মামার বাজখাঁই গলার একখান ধমক আসতে সময় লাগবেনা।তখন বন্ধ হয়ে যাবে সকল সাউন্ড।যদিও আজ কিছু বলবে বলে মনেহয়না ইভানের।তবুও নিভানের কথা মতো,সালিনতা বজায় রেখে উশৃংখলের মতো নয় সুশৃঙ্খলের মতো হলুদের অনুষ্ঠানটা সারতে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।যাতে কোনো মানুষের কোনোরকম অসুবিধা নাহয়।হলুদ মাখানোর একপর্যায়ে কোথা থেকে সিয়াম আসলো।দ্বিধাহীন হলুদের বাটি থেকে গোলাপের পাতায় হলুদ মাখিয়ে কৌড়ির গালে ছোঁয়াতে গেল,তারআগেই মাথা পিছেয়ে নিলো কৌড়ি।চোখ বড়োবড়ো করে তাকিয়ে রইলো সামনে।মান্যতা পাশ থেকে মৃদু চিৎকার দিয়ে বললো।

‘ভাইয়া, ছেলেদের কৌড়িকে হলুদ ছোঁয়ানো নিষেধ আছে।দাদাভাই নিষেধ করে গেছেন।

সিয়াম হাসলো।পাতাটা রেখে দিলো বাটিতে।ফের বললো–নিভানের ওয়াইফ যখন এরকম বাধ্যতামূলক নিয়ম থাকতেই পারে।

কাকে খোঁচা দিয়ে কথাটা বললো?দীবাকে?কথার টোন, ইঙ্গিততো সেরকমই শোনালো।সেদিকে একপলক তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে নিজের খেয়ালে মন দিলো।তবে বিড়বিড় করে এরা বলতে ভুললোনা।চরিত্রহীন।সুন্দরী মেয়ে দেখলেই ছোঁয়ার জন্য হাত নিসপিস করে,তা বলবেনা।শুধু অন্যের দিকে আঙুল তুলতে জানে ঠিকই।

মাথার খোঁপাটা খুলে যাওয়ার বাড়ির ভিতরে ঢুকলো তন্ময়ী।সেটা খেয়াল করল ইভান।তার খেয়ালি নজরটা প্রথম থেকেই হলুদ সাজে তন্ময়ীর উপর ছিলো।কি সুন্দর লাগছে আজ মেয়েটাকে।চোখে চশমা না থাকায় চেহারাটা আজ প্রস্ফুটিত।চেহারার উজ্জ্বলতা,স্পষ্ট।অথচ তাকে কাছ থেকে দেখার একটু সুযোগই পাচ্ছেনা ইভান।মেয়েটাও কেমন যেনো তার থেকে দূরে দূরে থাকছে।যেনো লুকোচুরি খেলতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।সুযোগ পেতেই তন্ময়ীর পিছু নিলো সে।বাড়ির ভিতরে ঢুকেতেই মা,মামিদের নজরে পড়লো সাথে ফুপিমনিসহ দীবাআপুর শাশুড়ী এবং নিজের শ্বাশুড়িকেও নজরে পড়লো।নীহারিকা বেগম জিজ্ঞেস করলেন—কিছু লাগবে কি-না।

অপ্রস্তুত হেসে না জানিয়ে তড়িৎ উপরে চলে গেলো সে।নিজের রুমে ঢুকতেই আয়নার সামনে তন্ময়ীকে দেখতে পেলো।দরজায় ঠেস দিয়ে মোহগ্রস্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো কতক্ষণ। তন্ময়ীর মনোযোগ চুল বাধাতে।বেশি সময় নিজেকে সামলিয়ে রাখতে পারলো না ইভান।শান্ত কদমে পা বাড়িয়ে তন্ময়ীর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো সে।ভুত দেখার মতো চমকে উঠে তার গয়ের সাথে লেগে গেলো তন্ময়ী।সুযোগ পেতেই দুহাতে পিছন থেকে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরলো ইভান।

‘এরকম ভুতের মতো নিঃশব্দে কেউ রুমে আসে ইভান!একটু হলে তো আমার জানটাই বের হয়ে যেতো!কি যে করো-না তুমি।উফফ।

তীক্ষ্ণ গলায় বাক্যগুলো ছুড়লো তন্ময়ী।অথচ বাক্যগুলো কানেই তুললোনা ইভান।নজর বেপরোয়া হলো তন্ময়ীর হলুদ ছোঁয়ানো গালে,কাজলকালো চোখে,গাঢ় লাল লিপস্টিক ছোঁয়ানো ঠোঁটে।মুক্তোর দানার ন্যায় জ্বলজ্বল করতে থাকা উন্মুক্ত গলায়।চুম্বনের ন্যায় টানলো হলুদরঙা সেই উজ্জ্বল গলা।বেসামাল হয়ে গলায় মুখ ডুবালো ইভান।হঠাৎ স্পর্শে চমকে গেলো তন্ময়ী।কুঁকড়ে ইভানের বুকের সাথে আরও মিশে গেল।খামচে ধরলো নিজের পেটে জড়িয়ে রাখা ইভানের হাত।চোখ বুঁজে এলো ইভানের স্পর্শে।
বেপরোয়া হয়ে উঠলো ইভানের ঠোঁট,সাথে যবানও।

‘আজ তো তুম গায়া।

‘ইভান।

ডাকার অর্থ-ছেড়ে দাও।অথচ ইভান উল্টে জড়ানো গলায় বললো–‘ওভাবে ডেকো-না প্লিজ।আমি আর-ও বেসামাল হয়ে যাবো।

গলা ছাড়লো ইভান।তন্ময়ীর হলুদ ছোঁয়ানো মুখে ঠোঁট ডুবালো।চোখমুখ আর-ও খিঁচে ডুবে গেলো তন্ময়ীর।এই স্পর্শ পুরানো হয়ে গেছে।অথচ ইভান যতবার তাকে ছুয়ে দেয় ততোবার সর্বাঙ্গে যেনো উথাল-পাতাল ঝড় বয়ে যায়।অনুভূতিতে জুবুথুবু হয়ে থাকা তন্ময়ীর হঠাৎই মনে দরজা খোলা।কথা বলতে গিয়ে গলায় জড়িয়ে এলো তবুও জড়ানো গলায় বললো।

‘ইভান দরজা খোলা,যেকোনো সময় কেউ এসে যেতে পারে?

একই জড়ানো গলায় ইভানও উত্তর দিলো।

‘এরুমে একজোড়া স্বামী স্ত্রীর বসাবস।এটা সবাই জানে।সেই রুমে নক ছাড়া ঢোকা শোভনীয় নয় এটাও সবাই জানে।

বেশ কিছুটা সময় চললো ইভানের বেপরোয়া ভালোবাসা।সুযোগ পেতেই তন্ময়ী উল্টো ঘুরে ইভানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।হেসে ফেললো ইভান।বললো।–এটা কিন্তু ভারী অন্যায়।

শক্তহাতে খামচে ধরলো ইভানের পাঞ্জাবির অংশ।পাঞ্জাবি ভেদ করে খামচি ধরা আচরটা পিঠেও লাগল।
ইভানের কথা পুরো দস্তুর উপেক্ষা করে তন্ময়ী অভিযোগী গলায় বললো

‘ইভান তুমি কিন্তু দিনকে দিন মাত্রাধিক অসভ্য হয়ে যাচ্ছো।সীমা ছাড়াচ্ছো।

ইভানের হাসি চওড়া হলো।ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে সে।শক্তহাতে নিজেও জড়িয়ে নিয়েছে তন্ময়ীকে।মেয়েটার কথার উত্তর সরূপ দুষ্ট গলায় বললো।

‘তারজন্য দ্বায়ী কে?

লজ্জায় লাল হলো তন্ময়ীর মুখ।যেটা ইভান দেখতে না পেলেও তন্ময়ীর কুঁকড়ে আসা শরীরের ছোঁয়ায় অনুভব করতে পারলো।তবু্ও তন্ময়ী শক্তগলায় উত্তর দিলো।

‘দ্বায়ী তুমি।

মৃদুস্বরে এবার ইভানের হাসির শব্দ শোনা গেলো।ফের দুষ্টমিষ্টি কন্ঠে বললো।

‘তাহলে দ্বায়ী যখন আমি,অসভ্যতামীর সীমাতো ছাড়াতেই হয়।কি বলো?

সীমা ছাড়ালো ইভান।তন্ময়ীকে আর কথা বলতে না দিয়ে নিজের বুক থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার লালাভ ঠোঁটজোড়ায় দখল বসিয়ে নিলো।তন্ময়ীর প্রথম ছাড়ানোর চেষ্টা করে গেলো,পরবর্তীতে নিজেই কেমন শান্ত হয়ে গেলো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে