#ফুলকৌড়ি
(৪২)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
সময়টা মধ্যহ্ণ।শহুরে পিচঢালা রাস্তা।নিভানের গাড়ী চলেছে শাশা শব্দ তুলে তার গন্তব্যে।গাড়ির গতিবেগ খুব অস্বাভাবিক নাহলেও স্বাভাবিক নয়।অথচ ছেলেটা সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করে নিয়মমাফিক গাড়ি চালাতে পছন্দ করে, অভস্ত্য।অনার্স লেবেলে গিয়ে নিভান যখন গাড়ি চালানো শিখলো,অল্প সময়ের মধ্যে দক্ষ হয়ে উঠলো।তারপর থেকে তার গাড়ীতে যতবার নীহারিকা বেগম চড়েছেন,নিপুণহাতে ছেলেটার দক্ষভাবে গাড়ী চালানো উপলব্ধি করেছেন।কোলাহল রাস্তায় বরাবর ছেলেটা নর্মাল গতিবেগে কি সুন্দর দক্ষতার সহিত নিপুণহাতে গাড়ী চালায়,তার গাড়িতে চড়লে আল্লাহর ভরসা করে তিনি নিশ্চিন্তে থাকেন।শান্তি পান,তৃপ্তি অনুভব করেন।সেই ছেলেটা প্রথম এক্সিডেন্ট করলো সেদিন।তবে নিজ দোষে নয়।বেখেয়ালিতে চলতে গিয়ে একজন মায়ের সঙ্গে তার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলো।তবে আজ!নিভানের হাত কেনো অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে!গাড়ির গতিবেগ কেনো স্বাভাবিকের তুলনায় অস্বাভাবিক চলছে।কেনো ছেলেটার নির্বিকার চাহুনি উনার কাছে এলোমেলো ঠিকছে!নিভান ক্লান্ত বলে!কতোটা পথ জার্নি করে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই আবার জার্নি।সেই ক্লান্ততায়?নাকি অন্যকিছু?আচ্ছা কৌড়ির অসুস্থতার সংবাদ নয়তো!হ্যা আজ নিজ চোখে ছেলের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন নীহারিকা বেগম।যখন নিভানকে জানালেন কৌড়ির অসুস্থতার খবর।হঠাৎই ছেলেটার স্বাভাবিক মুখের শান্ত আদল পাল্টে গেলো।কুঞ্চিত কপাল মূহুর্তেই মিলিয়ে গিয়ে, চোখের আকার হলো স্থির,ঠান্ডা।যেনো ভয়ংকর কোনো দুঃসংবাদ শোনানো হয়েছে তাকে।অদ্ভুত চোখে চেয়ে চেয়ে ছেলের পরিবর্তিত রূপ দেখলেন তিনি।তখনও খেয়ালে ছিলোনা,কৌড়ির প্রতি নিভানের আলাদা নজরভঙ্গি।কিছুসময় নীরবতায় কেটে গেলেও,যখন নিভান খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,চলো।তখন যেনো উনার হুঁশ ফিরলো।তারপর থেকে নিভানকে সুক্ষ নজরে থেকেথেকে দেখছেন তিনি।আর অনুভব করছেন ছেলের অস্বাভাবিক পরিবর্তন!কৌড়ির প্রতি তার দূর্বলতা!এটাতো নিশ্চয় একদিনে হয়নি!তবে এতোটা দূর্বল কৌড়ির প্রতি উনার ছেলে হলো কবে থেকে? কখন?যা উনার নজর এড়িয়ে গেছে!নজরে পড়েনি!আশ্চর্য!গাড়ির গতিবেগ আগের চেয়েও আরও অস্বাভাবিক হতেই,নীহারিকা বেগমের ভাবনার ছেদ ঘটলো।তড়িৎ বললেন।
‘নিভান,গাড়ি থামা।
মায়ের মৃদু আতঙ্কিত গলার শব্দে হুশে ফিরলো এমন ভাবে মায়ের দিকে তাকালো সে।ফের অমায়িক হাসল।
সে হাসি এলোমেলো ঠেকলো,নীহারিকা বেগমের কাছে।আরেকধাপ আশ্চর্য হলেন তিনি।নিভান এমনটা করছে?এই ছেলে উনার!ততক্ষণে নিভান নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বললো
‘ভয় পাচ্ছো কেনো,মা।আমাদের একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিত,তাই গতিবেগ একটু বাড়িয়ে দিয়েছি।ভয় পেও না।
আশ্বাস!আজ কেনো যেনো,নিভানের কথার আশ্বাসে ভরসা পেলেন না তিনি।নিভানের হাতের দিকে তাকালেন তিনি।স্ট্রিংয়ের রাখা শক্তপোক্ত হাতদুটো সাবলীল নয়।কেমন অ-সাবলীল কাজ করছে।এর আগেও তো নিভানকে গাড়ি চালাতে দেখেছেন তিনি।অদ্ভুত চোখে চেয়ে চেয়ে ছেলের অস্বাভাবিক কান্ড দেখলেন আর বিস্মিত হলেন।কৌড়ির অসুস্থতায় সংবাদে এতো অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে ছেলেটা।যার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চাইছেনা কিন্তু ভিতরের অস্বাভাবিকতায় বহিঃপ্রকাশ ঘটে যাচ্ছে ছেলেটার।কি আশ্চর্য!গলায়ও আশ্চর্যতা ঢেলে তিনি ফের বললেন।
‘নিভান গাড়ি থামা।
কেমন যেনো ক্লান্ত মনেহলো নিজেকে।অনেকটা সময় যুদ্ধ চালিয়ে বিরতি নেওয়ার পালা এমনভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের কথা মানলো নিভান।ফাঁকা দেখে রাস্তার সাইডে গাড়ি দাঁড় করালো।মূহুর্তেই মাথা এলিয়ে দিলো সিটে।গতকাল তার আগের দিন পরিক্ষা শেষ হওয়ার পর মেয়েটার সাথে কথা হয়েছে। তারপর আর কথা হয়নি।প্রচুর ব্যস্ত ছিলো নিভান।আর তার থেকেও ব্যস্ত ছিলো মন।কখন কাজ কমপ্লিট করে বাড়িতে ফিরবে সে।জাহিদ সাহেব তো আগে থেকেই কৌড়ির সম্পর্কে জানেন।এবার মা’কে জানিয়ে,সবাইকে নিয়ে কৌড়ির কাছে যাবে সেই তাড়ায়!অথচ তাড়া নিয়ে যাচ্ছে সে।কিন্তু কিভাবে! নিজেকে এলোমেলো করে নিয়ে।কৌড়ি এতো অসুস্থ জানায়নি কোনো তাকে?
‘পিছনে গিয়ে বোস।
ততক্ষণে গাড়ির পিছন সিট থেকে নেমে এসেছে তন্ময়ী আর ইভান।ভাইয়ের অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ইভান অবাক নাহলেও তন্ময়ী হয়েছে।একটু নয় বেশ অবাক হয়েছে। কেননা নিভান-নামক শ্রদ্ধাভাজন মানুষটাকে তার জানা আছে।তাই সহসা প্রশ্নও করলো সে, ইভানকে।
‘নিভান ভাইয়াকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে না?
‘ভাসুরের নাম ধরতে নেই।তওবা পড়ো।
সিরিয়াস বিষয়েও কেমন ফাজলামো।কপাল কুঁচকে অদ্ভুত নজরে ইভানের দিকে তাকালো তন্ময়ী।সেটা দেখে একগাল হেসে দিলো ইভান।চমৎকার সে হাসি।তবুও সে হাসিতে মোটেই গললোনা তন্ময়ী।সেভাবেই চেয়ে রইলো।সেটা দেখে তড়িৎ ইভান বললো।
‘তোমার ভাসুরকে শুধু এখনো অস্বাভাবিক লাগছে এটাই শুকরিয়া করো প্রভুর কাছে।কৌড়ি বলতে সে যে অন্ধ,মেয়েটা অসুস্থ তাতে আবার হসপিটালাইজড্
এটা শুনে তোমার ভাসুর এখনো উদভ্রান্ত পাগল হয়নি।এখনো সুস্থ মানুষের মতো আচারণ করছে।প্রভুর শুকরিয়া করো।
প্রহসন করে বলা ইভানের কথাগুলো হঠাৎ বিশ্বাস করতে পারলোনা তন্ময়ী।কৌড়ি আর নিভান ভাইয়া!যদি তাই হয়ে থাকে,তবু্ও নিভান ভাইয়ার ব্যক্তিত্ব এমন উতলা উদভ্রান্ত কখনো সে ভাবতে পারেনা।তবে মন থেকে হওয়া,টান মায়ার সম্পর্কগুলো আসলেই অদ্ভুত অন্যরকম হয়।তাতে নিজের স্বভাব, ব্যক্তিত্ব সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।এলোমেলো করে দেয় মন।এটা সে ইভানকে দিয়ে হাড়েহাড়ে অনুভব করছে।যে মানুষটার কর্মকান্ডে রাগ,ক্ষোভ,ঘৃণা জন্মেছিলো মনে।আজ মন তারই বশে।তার ছোঁয়ায়,তার ভালোবাসায় পার হচ্ছে নিজের দিনগুলো।সামনে সিটে গা ছাড়িয়ে বসা মানুষটাকে দেখে,কেমন যেনো তাকে নিয়ে অবিশ্বাস্য ভাবনাগুলো বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো।ফের বোকা নজর ঘুরিয়ে ইভানের মুখের দিকে আনতেই,হেসে মাথা ঝাকলো ইভান।বুঝালো তুমি যেটা ভাবছো,সেটাই।ফের সময় নিয়ে ফিসফিসিয়ে মৃদুস্বরে বললো
‘মনে হচ্ছে গাড়ি আমাকে চাালাতে হবে।
ততক্ষণে মায়ের আদেশ মেনে নেমে পড়লো নিভান।নেমে পড়লেন নীহারিকা বেগমও।তিনি নামতেই ইভানকে উদ্দেশ্য করে বললেন–তন্ময়ীকে নিয়ে সামনে গিয়ে বোস।দাদাভাই ক্লান্ত।গাড়ি তুই চালা।
মায়ের আদেশ মেনে তন্ময়ীকে নিয়ে সামনে বসলো ইভান।জায়গা পরিবর্তন করে নিভান-ও গিয়ে বসলো পিছনের সিটে।সহসা চোখ বুঁজে গা এলিয়ে দিলো সিটে।খুলে ফেললো শার্টের উপরের পরপট কয়েকটা বোতাম।যেনো গায়ে জ্বালা ধরে গিয়েছে তার।অথচ ঠান্ডার মধ্যও এসি চলছে নির্বিকার ভঙ্গিতে।নীহারিকা বেগম সুক্ষ খেয়ালি নজরে সবটা খেয়াল করলেন।ধীরেসুস্থে গিয়ে বসলেন ছেলের পাশে।ফের ইভানকে গাড়ি ছাড়তে বললেেন।সময় গড়ালো।গাড়ী চলছে স্বাভাবিক গতিতে।আর সেই স্বাভাবিকতা বজায় রেখে গাড়ির মধ্যে চলছে পিনপিন নীরবতা।হঠাৎই সেই নিঃশব্দতা ছাড়িয়ে নিভানের শান্ত গলার স্বর শোনা গেলো।ছেলেটা তখনও চোখ বুঁজে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে বসে আছে।নীহারিকা বেগম স্থির নজরে সেদিকে তাকিয়ে। আর সেটা বুঝে মনেহয় নিভান কথা পাড়লো।
‘মা,আমি কৌড়িকে বিয়ে করতে চাই।
নীহারিকা বেগম শুনলেন।কিন্তু কিছু বললেন না।সবটা বুঝেও কেনো যেনো নিভান আর তার কর্মকাণ্ডগুলো বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না।সত্যিই ছেলের পরিবর্তন নজরে পড়ার মতো।অথচ এরআগে উনার নজরে পড়লো না।কিকরে?
‘মা।
নীরবতা ভেঙে এবার কথা বললেন নীহারিকা বেগম।গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন। —শুনেছি তো।
মায়ের প্রসন্ন স্বর শুনে নিভান কেনো যেনো আর কথা বাড়ালো-না।তখনও ছেলের শ্যাম শান্ত মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে নীহারিকা বেগম।কি নির্বিকার শান্ত আদল।অথচ তার বিচলিত কর্মকাণ্ড বলে দিচ্ছে,ভিতরে ভিতরে কতোটা অশান্ত সে।সহসা হাত বাড়িয়ে নিভানের শক্ত-পোক্ত রুক্ষ হাতের উপর নিজের কোমল হাতটা রাখলেন।এ স্পর্শ যেনো নীরব আশ্বাস।মাতৃস্পর্শ পেতেই নড়েচড়ে উঠলো নিভান।তবে চোখ খুললো-না।সেভাবে চোখ বুঁজে রেখে মায়ের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বুকে চেপে ধরলো।যেনো ভিতরে বয়ে চলা অস্বাভাবিকতার ঝড়টা ঠান্ডা করতে চাইলো।ছেলের বলিষ্ঠ বুকে হাত পড়তেই মূহুর্তেই চমকে উঠলেন নীহারিকা বেগম।ছেলের হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা টের পেলেন নিগাঢ়ভাবে।বুকের খাঁচার ভিতরের হৃদযন্ত্রটা যেনো ঢিপঢিপ তালে নয় উগ্রবেগে উথাল-পাতাল ঝড় বইছে তালে চলছে।মানেটা কি?এতোটা অস্বাভাবিক আচারন কৌড়ির জন্য!নজর যেনো পিছনের সব বিস্ময়, আশ্চর্যতা ছাড়িয়ে গেলো।ছেলের বুঁজে থাকা মুখের দিকে কেমন আশ্চর্যজনক নজর নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।মনেহলো,উনি উনার গর্ভে ধারণ করা লালিতপালিত এতোদিনের চেনা সুপরিচিত শক্তপোক্ত, কঠিন ব্যাক্তিত্বের ছেলেটাকে নয়,সম্পূর্ণ অজনা অচেনা কাওকে দেখছেন।আর তার অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডগুলো বেজায় অবাক চোখে উপলব্ধি করছেন।নিভান!
হঠাৎই অনেক আগের পুরানো কিছু স্মৃতি মনে পড়লো।সেই মানুষটারই তো ছেলে।ছেলের কর্মকাণ্ড তো বাবার মতোই হবে!হওয়ার কথা!মানুষটার গায়ের রঙটা ছিলো শ্যামকালো।কিন্তু ভিতরের মনটা ছিল অমায়িক। ঝকঝকা পরিচ্ছন্ন,মায়াময়।নিজের মানুষ বলতে তার ভালোবাসা যত্নগুলো ছিলো নজরে লাগার মতো।যেমন ধৈর্যশীল শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন তেমন সহনশীল।আর নীহারিকা বলতে মানুষটা ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছিলেন। একটা সময় কটাক্ষ করে কতো আত্মীয় স্বজন কত কথা বলতো–রঙেচাপা ছেলেদের বউ সুন্দর হলে,সেসব ছেলেরা নাকি বউ যত্নে রাখে।খুব ভালোবাসে।তাই আওসাফ-ও তার বউ বলতে পাগল।আরও কতো কথা।লজ্জা পেতেন।সেই লজ্জায় যেনো দ্বিতীয়বার না পড়তে হয়,তাই মানুষটাকে আড়ালে বকতেন।কথা শুনাতেন।অথচ কে শোনে কার কথা।তার যত্নশীলতা চলতো তার নিয়মে।আর তারইতো ছেলে নিভান!
★
ঠিক কতোটা সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছে কৌড়ির জানা নেই।তবে ঘুমের ঔষধের প্রভাব কাটতেই গভীর ঘুমটা কেটে গিয়ে সকল ইন্দ্রিয় যেনো সচল সজাগ অনুভব হলো।ঘুমের প্রভাব পুরোপুরি না কাটায় আর শারীরিক দূর্বলতায় চোখ যেনো ডুবে রইলো।কিছুতেই মেলাতে ইচ্ছে করলো না।তবে ঘুমের রেশটা কেটে সকল ইন্দ্রিয় যখন সচল হলো সুপরিচিত তীব্র একটা সুগন্ধ নাকে এসে বাড়ি খেয়ে মস্তিষ্কে হানা দিলো।অনুভবে নাকি সত্যি?আচ্ছা মানুষটার তো আসার কথা ছিলো।তবে কখন আসার কথা ছিলো?আজ না গতকাল!ঘুমের ঔষধের ঘোরে খেয়াল করতে পারলো-না।গভীরভেবেও
সময়টা দিন চলছে নাকি রাত, সেটা-ও আন্দাজে করতে পারলোনা।তবে কি মানুষটা নিজের কথা রাখতে সত্যিই চলে এসেছে?হঠাৎ ডাক্টারের বলা নিজের অসুস্থতা কারনগুলো কানে বেজে উঠলো।মূহুর্তেই মনটা তিতকুটে অনুভূতিতে ডুব দিলো।কেনো এসেছে মানুষটা?তার জীবনটা অভিশপ্ত!আর সেই জীবনে যাকে জড়াবে সেও তো অভিশপ্ত হবে।নিশ্চয় মানুষটা শুনেছে,সে অসুস্থ।কারনটাও এতোসময় জেনে নিয়েছে।তবে এখনো কেনো এখানে মানুষটা!কৌড়ি শিওর,মানুষটা এসেছে।এবং তিনি তার অতি সন্নিকটে বসা।এতোসময় যে সুগন্ধটা মৃদুমৃদু নাক লাগছিলো এখন সেটা তীব্র,গাঢ় রূপ নিয়েছে।চোখ মেলতে চেয়েও মেললোনা কৌড়ি।পেশেন্ট বেডের পাশে,স্টিলের টুলে বসা মানুষটা তখনও তীক্ষ্ণ নজরে কৌড়ির ঘুমন্ত মুখের পানে চেয়ে।গভীর নজরে কৌড়ির ঘুমন্ত মুখের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সে।পুরো ঘন্টাখানেকের অপেক্ষার প্রহর বুঝি শেষ হলো এবার।তবে সজাগ হয়েও কৌড়ি যখন চোখ মেললো না,কারনটা বুঝি অনুধাবন করতে পারলো।সময় নিয়ে
ঝুকলো নিভান।কৌড়ির মুখের সন্নিকটে মুখটা নিয়ে খুব শান্তকন্ঠে বললো।
‘ডক্টর কি বলেছে জানো?বলেছে,বিয়ের আগে বাচ্চা হওয়ার প্রসেসিংটা কমপ্লিট করে নিতে।তুমি কি বলো?ডক্টরের পরামর্শটা কিন্তু আমার বেশ মনে ধরেছে।
সর্বাঙ্গের কম্পিত শিরশিরানিটা জানান দিলো সামনের মানুষটার শীতল গলার কথার ওজন, ভার।ফাজলামো করে বলা কথাটার গলার স্বর মোটেও সুবিধার ঠিকলো না কৌড়ির কাছে।তারউপর রেগে গেছে মানুষটা!গলার স্বরটা তেমনই জানান দিলো।ভিষণ কান্না পেলো কৌড়ির।ভুলেও চোখ মেললোনা।আর চোখ না মেলেও আন্দাজ করতে পারলো,সামনে বসা মানুষটার কঠিন করে রাখা মুখাবয়ব।শান্ত অথচ রাগান্বিত দুটো চোখ।
নিভান,কৌড়ির গতিবিধি খেয়ালি নজরে দেখলো।আরও ঝুকলো সে।ফের রাগ সামলাতে না পেরে বলেই বসলো।
‘তোমাকে কি বলে ছিলাম!বলো?বলেছিলাম না,কঠিন অসুখ বাঁধালে তোমাকে কিন্তু নিভান ছেড়ে কথা বলবে না।আস্ত রাখ…
‘মেরে ফেলুন-না আমাকে!এরকম অভিশপ্ত জীবন আমার চাইনা।যার সদ্য জীবন বাঁচাতে মা চলে গেলেন, যার চিন্তায় বাবাও গত হলেন।এখন আপনি!মেরে ফেলুন!সত্যিই এই অভিশপ্ত জীবন আমার চাই-না।
নিভান চোখবুঁজে দাঁতে দাঁত চেপে কৌড়ির বকে চলা প্রলাপ শুনলো।কৌড়িকে প্রেশার দিয়ে এমন কথাগুলাে সে বলতে চায়নি।কিন্তু মেয়েটাকে এরকম হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখে নিজেকেও ঠিক রাখতে পারিনি, পারছে না।পাতলা শরীরটা কিভাবে বেডের সাথে লেপ্টে আছে!একটু আগে রক্তের একটা সেলাইন শেষ হয়েছে।নিজ হাতে সেলাইনের লাইনের সুচটা টেনে খুলেছে সে।ফর্সা হাতটা ফুলে জায়গাটা লাল হয়ে আছে।কি অবস্থায় নিয়ে গেছে নিজেকে!ডক্টর বলেছে, সমস্যাটা শুরু হওয়ার কিছুমাস বা বছরের মধ্যে ডাক্তারের শরাণাপন্ন হওয়া উচিত ছিলো আপনাদের।অথচ বোকা মেয়েটা মাত্রাধিক পর্যায়ে যাওয়ার পর ব্যাপার সবাইকে জানিয়েছে।জানিয়েছেতো না জেনেছে সবাই।রাগ কি তবে সহজে কন্ট্রোলে রাখা যায়!সেই অসুস্থ মেয়েটাকে,না পারছে কাছে টানতে আর না পারছে তারউপর জমা রাগ ক্ষোভের কথাগুলো ভিতরে চেপে রাখতে।কৌড়ি কথা শেষ করতেই অনিমেষ গলায় বললো।
‘কিন্তু আমার যে এই অভিশপ্ত নারীটাকেই চাই।চাই মানে চাই।তুমি অভিশপ্ত হও বা কলঙ্কিনী তবুও তোমাকে চাই আমার।
দৃঢ়কণ্ঠের বার্তায় এবার চোখ মেললো কৌড়ি।মূহুর্তেই দুপাশের কার্নিশ বেয়ে হড়হড় করে নামল নোনাজলের স্রোত।ভাসমান নোনাজলের ঝাপসা চোখে নজরে পড়লো,ক্লান্ত শুষ্ক একটা কঠিন মুখাবয়ব ।শ্যামবর্ণ রঙটা আজ আরও চাপা দেখাচ্ছে। সবসময় পরিপাটি রূপটা নেই।কেমন উদভ্রান্ত!অথচ মায়াময়।গায়ের সাদা শার্টটার এলোমেলো অবস্থান!এরকম উদভ্রান্ত অগোছালো কখনো দেখেছে মানুষটাকে?কখনো দেখেনি কৌড়ি!সবসময় তার পরিপাটি রূপ দেখেছে।অথচ আজ এই রূপ।ফের চোখ বুঁজে নিলো কৌড়ি।কারজন্য এমন উদভ্রান্ত,পাগল পাগল অবস্থা মানুষটা?তারজন্য!কঠিন চোখে কৌড়ির কান্না দেখে গেলো নিভান।কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে চলা নোনাজলের দিকে কিছু সময় চেয়ে ধপ করে উঠে দাঁড়ালো সে।গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললো।
‘আজ মঙ্গলবার, এখান থেকে তিনদিন পর শুক্রবার।আর সেদিনই আমাদের বিয়ে।এখন সন্ধ্যা, একটু পরেই তোমাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরছি।
কৌড়ির বিস্মিত মুখের দিকে না চেয়ে বাহিরের পানে পা বাড়ালো নিভান।সেটা লক্ষ্য করেই আশ্চর্য গলায় কৌড়ি বলে উঠলো।
‘এটা হতে পারেনা।
থেমে গেলো নিভান।পিছে মুড়ে বললো–কি হতে পারে না?তুমি ওবাড়িতে যেতে চাইছো না নাকি বিয়েটা করতে চাইছো না?
‘বিয়েটা!
‘কেনো হতে পারেনা?
কেনোর উত্তর দিতে গিয়েই থমকে গেলো কৌড়ি।সেদিকে কেমন অদ্ভুত নজরে চেয়ে রইলো নিভান।সেই নজরে বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে পারলোনা কৌড়ি।নজর ফিরিয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকিয়ে কেমন করুণ গলায় বললো–কেনো বুঝছেন না আপনি!
আবারও কৌড়ির দিকে এগোলো নিভান।বেডের পাশে দাড়িয়ে শান্ত নির্বিকার গলায় শুধালো—কি বুঝবো?কি বোঝাতে চাইছো তুমি?
নিভানের দিকে ফিরলো কৌড়ি।শান্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ দুটোতে চোখ রাখলো।কথাটা বলতে গলায় বিঁধলেও,ঢোক গিলে কথাটা কাটাছেঁড়ার মতো ভেদ করে মুখে আনলো।–যদি আমি কখনো মা না হতে পারি!
দাঁড়িয়ে থেকেই নিভান ঝুকলো কৌড়ির পানে।শার্টের বোতাম খোলা থাকায় উঁকিঝুঁকি দিলো লোশমের আস্তরণে আকর্ষণীয় বলিষ্ঠ বুক।পলকে নজর সরিয়ে নিভানের চোখ চোখ রাখলো কৌড়ি।সেই নজরে নজর স্থির রেখে দৃঢ়কণ্ঠে বললো নিভান।
‘যদিও ডাক্তার তেমন কিছু বলেননি।তবে তুমি যদি কখনো মা না হতে পারো।আমিও কখনো বাবা হতে চাই না কৌড়ি।
থামলো নিভান।কৌড়ির নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা চোখের দিকে বেশ কিছুসময় তাকিয়ে থেকে এবার কন্ঠ কোমল করে বললো–সেদিন ঝড়বর্ষার দিনে যখন তোমাকে ওই অবস্থায় দেখলাম।আমার কলিজার মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করেছিলো তোমাকে।আজও সেই ইচ্ছেটার তীব্র তেষ্টা পেয়েছে।তৃষ্ণায় পাগল পাগল অনুভব হচ্ছে ভিতরটা।কিন্তু আমি পারছি না তোমাকে কাছে টানতে।আর আমি চাইছিওনা সম্পর্কের বহির্ভূত তোমাকে ছুঁতে।প্লিজ কৌড়ি,এই তৃষ্ণাটুকু মেটাতে সাহায্য করো আমাকে।ঠুনকো অসুস্থতা বা অযৌক্তিক কোনো বাঁধা আমাদের দুরত্বের কারণ হতে পারেনা।তাই এসব কারণ উল্লেখ করে আমার তৃষ্ণাটা দমবন্ধ করা অনুভূতিতে পরিণত হতে দিওনা।প্লিজ।
এমন মানুষকে স্বামীরূপে পাওয়া ভাগ্য। শুধু ভাগ্য নয় সৌভাগ্যতো বটেই।অথচ সেই মানুষটাকে নিজের দূর্ভাগ্যের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বঞ্চিত করবে কত পাওয়া থেকে!যা মানুষটার প্রাপ্য।কিন্তু মানুষটা তো বুঝতেই চাইছেন না।আর বুঝবে এ আশা করেনা কৌড়ি।তবুও মানুষটার ভালো তো সে চায়।কৌড়ির ভাবনার মাঝেই নিভান সরে দাঁড়ালো।ওই ভারাক্রান্ত অবুঝ চোখ, কান্নায় রক্তিম আভা ছড়ানো লাল নাক,শুষ্ক ঠোঁট। মলিন মুখ তাঁকে টানছে।একটু নয় গভীরভাবে টানছে।যখন তখন কিছু একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে।এজন্য হয়তো হারাম নারী থেকে দূরে থাকার নিষেধাজ্ঞা,জরুরি। নিভান আর দাঁড়ালোনা।আর না কৌড়ির উত্তরের আশা করলো।সহসা পা বাড়িয়ে কেবিনের বাহিরের দিকে অগ্রসর হলো।সেটা লক্ষ্য করেই কৌড়ি দূর্বল গলায় কয়েকবার ডাকলো তাকে।তবুও পিছু ফিরলো নিভান।এই ডাকের অর্থ তার জানা আছে।খুব ভালো করে জানা আছে।এবার শেষ দূর্বল অস্ত্র ব্যবহার করলো কৌড়ি।মৃদু চঞ্চল গলায় ডাক দিলো।
‘নিভান।
থামকালো পা।সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ফের পা বাড়ালো সামনের দিকে।এই ডাক উপেক্ষা করার নয়!তবুও উপেক্ষা করতে হবে তাকে।ভিতর থেকে দূর্বল
করে দেওয়া এই ডাকের অর্থ কৌড়ি জানে।তাই দূর্বল করতে এই ডাক।তবে কৌড়ির চাওয়া আবদার পূরণ করা তারজন্য কখনো সম্ভব নয়।আবদার তো নয় অনর্থকর অনাবদার।যা নিভানের দ্বারা পূর্ণ করা আদৌ সম্ভব্য নয়।
নিভানের চলে যাওয়ার পানে কেমন করুন চোখে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।নজরের আড়াল হতেই চোখ বুঁজে নিলো সে।আশা করেছিলো,এই ডাকেও কাজ হবেনা।তবে শেষ চেষ্টা করতে আপত্তি কোথায়, মানুষটাকে থামাতে।তাই ভিতরের বিড়ম্বনা অস্বস্তি ঠেলে দিয়ে তার বয়সের কতোবড় মানুষটাকে নাম ধরে ডেকেছে!অথচ ফলাফল শূন্য।ফলাফল শূন্যইতো আশা করেছিলো সে।তবুও চেষ্টা বিফলতা আনতেই মনটা হতাশ হলো।ভিতরটা হুহু করে উঠলো তীব্র যাতনায়।
গতকাল বিকাল থেকে অতিমাত্রায় পেটব্যথা আর স্বাভাবিকের চেয়ে প্রচন্ড রক্তক্ষরণে পাগলপ্রায় অবস্থা ছিলো তার।শরীরের এই অবনতির কথা বাড়ির মানুষ জানতে পারলো রাতে।তখন ডক্টরের শরণাপন্ন হওয়ার মতো অবস্থা ছিলো-না।সময়টা ছিলো গভীর রাত।তাই সারাটা রাত প্রচন্ড ব্যথায় কাটাতে হয়েছে তাকে।সকাল হতেই শারিরীক অবনতির কারণে আর দেরী করা হয়নি।হসপিটালে আনতেই ইমার্জেন্সিতে ডক্টর দেখানো হয়েছে।সবটা করেছে নাহিদ আর কৌড়ির ছোটো চাচা।তারপর ডক্টর রোগীর বক্তব্য অনুযায়ী বিভিন্ন টেস্টসহ নিজেও পরিক্ষানিরিক্ষা করলেন। রিপোর্ট দেখার আগে যেটা ধারনা করলেন,অবলীলায় রোগীর সামনে সেটা উপস্থাপন করলেন।তবে রিপোর্ট অনুযায়ী ঔষধ দেওয়ার আগে,কৌড়ির অতিমাত্রায় পেটব্যথা আর বিল্ডিং বন্ধের ঔষধসহ ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছিলেন।যার রেশ কেটে গিয়ে ভর করেছে এখন অনেক চিন্তা।নিজের অসুস্থতার ভাবনা বাদ দিয়ে ভর হয়েছে ওই মানুষটার চিন্তা।
‘সত্যিই কি মানুষটা বিয়ের চিন্তা ভাবনা করে ফেলেছে!
ভাবনাটা আর এগোতো পারলোনা।তন্মধ্যে কেবিনে ঢুকে পড়লো প্রিয় কিছু মুখ।নীহারিকা বেগমকে দেখেই কেমন যেনো মন আবেগপ্রবণ হলো।সহসা কেদে ও ফেললো।তা দেখে তড়িঘড়ি করে কৌড়ির কাছে গিয়ে বসলেন তিনি।স্নেহময় হাতে কৌড়িকে বেড থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদুরে বুঝদারী কতো কথা বলতে থাকলেন।মাথায় ঘনোঘনো মাতৃত্ব স্পর্শে আদর ছোয়াতেও ভুললেন না।একপর্যায়ে গিয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললেন।
‘আমার নিভানের বউ হবি কৌড়ি?চল-না তোকে একেবার নিয়ে রেখে দেই আমার কাছে।এই কৌড়ি জানিস,তোরজন্য আমার ছেলেটা ভালো নেই।আমার নিভান সমগ্র পৃথিবীর মেয়ে রেখে এই ফুলকৌড়িতে এতো পাগল হলো!কিকরে রে?বিশ্বাস কর,তোরজন্য ছটফট করতে দেখে আমারই বিশ্বাস হচ্ছিলোনা,ও আমার সেই নিভান।যার নিজের ইচ্ছে,আকাঙ্ক্ষা,শখ, চাওয়া পাওয়া বলতে মুখ ফোটেনি কখনো।অথচ আজ আমার কাছে কি নির্দ্বিধায় সে চেয়ে বসলো তোকে!চল-না কৌড়ি, আমার বাচ্চাটাকে ভালো রাখতে।
চলবে…
#ফুলকৌড়ি
(৪৩)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
দুপুরের ব্যস্ত যানযটপূর্ন রাস্তায় নিভানের গাড়ীটা চলছে খুব স্বাভাবিক গতিতে।স্ট্রায়িংয়ে হাত রেখে দক্ষ এবং মনোযোগ সহকারে গাড়ী চালাচ্ছে সে।সুগভীর শান্ত নজর তার পিচঢালা ব্যস্ত রাস্তায় হলে-ও বিশেষ মনোযোগ পাশে বসা নারীটিতে।রক্তশূন্যতায় গোলগাল ফর্সা মুখখানা আরও ফ্যাকাশে রঙ ধারণ করে দুধ-সাদা রঙের ন্যায় উজ্জ্বল,উজ্জীবিত দেখাচ্ছে।তাতে গায়ে জড়িয়ে কালো রঙ!সেই কালো রঙটার মধ্যে ফ্যাকাশে ফর্সা মুখটা আরও ঝকঝক করছে।পূর্নিমা চাঁদের ন্যায় ঝলমলে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।হরিনী চোখজোড়া ফুলোফুলো, প্রানহীন।যে চঞ্চল চোখজোড়া বারবার তাকে টেনেছে,মেয়েটার প্রতি চরম আগ্রহী করে তুলেছে।আজ তা নিঃস্পৃহ। অথচ সেই নিঃস্পৃহ চোখজোড়ার প্রতি আজ আরও মায়া,টান অনুভব করছে নিভান।শান্তশিষ্ট চুপচাপ থাকা মেয়েটা আজ আরও নীরব,শান্ত।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।গতকাল পরিচিত অপরিচিত সকল মুখগুলো উপেক্ষা করে কৌড়ির দাদিআপার কাছে সহজ সরল ভঙ্গিমায় প্রস্তাব রেখেছিলো সে।
‘আমি আপনার নাতনীকে বিয়ে করতে চাই।আমি তার সকল ভালো মন্দের গার্ডিয়ান হতে চাই।আর আমি এটাও আশা রাখছি আমার রাখা প্রস্তাবে আপনি দ্বিমত পোষণ না করুন।
ভদ্রমহিলা হয়তো আশা করেননি ওরকম সিচুয়েশনে বিয়ের প্রস্তাব।আশ্চর্য তো হয়েছিলেন সাথে বিচলিত।
বিচলিত হওয়ার কারণ,হয়তো উনার মনোবাসনা ভিন্ন রকম ছিলো।যা উনার চেহারায় চাহুনির ভঙ্গিমার প্রকাশ পেয়েছে।এবং তা নিভানের বুদ্ধিদীপ্ত নজরে-ও সুক্ষভাবে টের পেয়েছে।তাদের বাক্যলাপের মাঝে ঘনোঘনো নাহিদের দিকে তাকানো,সেটা আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিলো।তবে দ্বিমত পোষণ করার স্কোপ পাননি ভদ্রমহিলা।নিভানের প্রস্তাব রাখার সাথে সাথে নীহারিকা বেগমও আমায়িক ব্যবহারে সহমত জানিয়ে,ছেলের বউ হিসাবে কৌড়িকে পাওয়ার আবেদন জানালেন।আবদার করলেন।সাথে মান্যতা ইভান, মৌনতা তো ছিলোই।সবাই যেনো ভদ্রমহিলাকে দ্বিমত পোষণ করার করার সুযোগই দিলো-না।একমাসের মতো সময় পার করে এসেছেন,যে বাড়িতে।কাছ থেকে দেখেছেন প্রতিটি ব্যক্তিকে।সেখানে হয়তো অমত পোষণ করার কারণও তিনি খুঁজে পান-নি।তবে বুদ্ধিমতি নারীটি মূখ্য চাল হিসাবে,নাতনির সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রেক্ষিতে আশ্বাস জানালেন।–যে কৌড়ি রাজি হলে,উনার অমত পোষণ করার প্রশ্নই উঠে-না।
দক্ষ হাতে রাস্তার বাক ঘুরাতে গিয়ে সুক্ষ হাসলো।ভদ্রমহিলা ভেবছিলেন,হয়তো কৌড়ি রাজি হবেনা।তবে
নিভানের মা,নীহারিকা বেগমও যেনো ভদ্রমহিলার বুদ্ধির আরও এক কাঠি উপরের চাল দিলেন।ছেলের সুখশান্তি ভালোথাকা বলে কথা!ফাঁকফোকর থাকবে কেনো সেখানে!ভদ্রমহিলা কথাটা বলতেই তিনি বললেন –আমি আপনার আগে কৌড়ির কাছে প্রস্তাব রেখেছি,ও সম্মতি না জানালেও অসম্মতি প্রকাশ করেনি।নীরব ছিলো।আর নীরব থাকাতো সম্মতিরই লক্ষন,তাইনা?বিধায় আপনি আর অমত পোষন করবেন–না চাচিমা।আপনার নাতনিকে আমি মেয়ের মতো আদর যত্ন গুছিয়ে রাখবো।আর আমার ছেলে!আপনি যেভাবে খুশি নাতী জামাই হিসাবে তাকে পরখ করে নিতে পারেন।যেভাবে ইচ্ছে খোঁজখবর করে যাচাই করে নিতে পারেন।আল্লাহর রহমতে ত্রুটি পাবেন না।
ভদ্রমহিলা দ্বিমত করার যেনো আর কোনো ফাঁকফোকড় পেলেন না।দ্বিতীয়ত আর কোনো শব্দও উচ্চারণ করলেন না।তবে উনার বেজার মুখের অপ্রকাশিত কথা মুখের অসন্তুষ্টতার ভঙ্গিমায় প্রকাশ পেয়েছিলো,যা নিভানের সুক্ষ নজর পদেপদে ঢেড় টের পাচ্ছিলো।উনি যে মনেমনে অবশ্যই অন্য আশা পোষন করেছিলেন,এটা বুঝেও নিভান তা ভ্রূক্ষেপ করেনি।তবে প্রস্তাব যখন পারিবারিকভাবে রাখা হয়েছে। এবং সেখানে সরাসরি সম্মতি না থাকলেও নীরব সম্মতি রপ্ত করা গেছে।দ্বিতীয়ত তা বিগড়ে যাক নিভান আর তা চাইনি।কৌড়িকে নিয়ে কোনো রকম পার্সেন্টটিস রিক্স! সে নিতে চায়না।তাই যতদ্রুত সম্ভব কৌড়ির রিপোর্টসহ সকল ডাক্তারী ফর্মালিটি কমপ্লিট করে,সেই সন্ধ্যায় সবাইকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরেছে।সাথে কৌড়ির দাদিআপাকে নিয়ে এসেছে।কৌড়ির চাচারা, এই অসুস্থ অবস্থায় মেয়েটাকে এভাবে নিয়ে আসতে দিতে চান-নি।তবে নিভানের কাওকে তোয়াক্কাহীন কৌড়ির প্রতি অধিকারবোধের কাছে হার মেনেছে।মানতে বাধ্য হয়েছে জাহিদ সাহেবের একটা ফোন কলের কাছে।তাতে তারা অসন্তুষ্ট হলেও আর দ্বিমত পোষন করেন নি।নিভানও সেই অসন্তুষ্টতা তোয়াক্কা করেনি।এমনকি নাহিদের অনুনয়ও না।
হসপিটালের সামনে গাড়িটা এসে থামতেই ভাবনার ছেদ ঘটলো নিভানের।কাল ওখানের ডাক্তার দেখিয়ে তার মনপুত হয়নি।যদিও প্রাইভেট ক্লিনিক ছিলো।ডক্টরও অভিজ্ঞতায় খারাপ ছিলেন না।তবে নিজের পছন্দনীয় সুপরিচিত ডক্টরের কাছে পুনরায় আরও একবার দেখিয়ে, সুপরামর্শ নিতে চাইছে।বিধায় সকাল সকাল কৌড়িকে নিয়ে হসপিটাল মুখি হওয়া।যদিও মেয়েটা আসতে চায়নি।তবে নিভান কি শুনবার পাত্র।এমন অসুস্থতা নিয়ে কেউ হেলাফেলা করে!অথচ বোকা মেয়েটা রোগটা বাড়িয়ে কোথায় নিয়ে গেলো!
গাড়ী থামতেই কৌড়িও নড়েচড়ে বসলো।সিটবেল খুলে নিভানকে গাড়ি দরজা খুলতে দেখে মৃদুস্বরে চঞ্চল গলায় বললো।
‘আমি বললাম তো কাল ঔষধ খাওয়ার পর থেকে মোটামুটি ঠিক আছি।ভালো হতে তো সময় লাগবে!আবার ডাক্তার দেখানোর কোনো প্রয়োজন ছিলো-না।নেই প্রয়োজন! কেনো সবকিছুতে অবুঝপনা করছেন?
বিষয়টা নিয়ে কথা নলতে ভিতরে ভিতরে লজ্জায় গাট হলো।যে বিষয়টা নিয়ে বিয়ের দশবছর পরও স্বামীর জানার কথা ছিলোনা।তা আজ কতো খোলামেলায় প্রকাশ পেলো।অথচ মানুষটার এমন আচারণ এযেনো স্বাভাবিক অসুখের ন্যায় একটা রোগ।
‘অবুঝপনা!আমি করছি!না তুমি করেছো!সেদিন কি বলেছিলে,তুমি কোনো অসুখে ভুগছো-না।জোর গলায় বললে,ডাক্তার দেখানোরও কোনো প্রয়োজন নেই।তোমার এই দেখাদেখি অপ্রয়োজনীতার মধ্যে কি দেখতে হলো আমাকে!তুমি নিথর হয়ে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছো!তোমার আন্দাজ আছ আমি যখন শুনলাম তোমাকে হসপিটলাইজড্ করা হয়েছে,আমার কি….
কথা শেষ করলো না নিভান।চোখ বুঁজে নিজেকে ধাতস্থ করলো।ফের গাড়ির দরজা খুলে বের হতে হতে বললো–তখন আমার কথা শোনার প্রয়োজন মনে করোনি।সো এখন আমি যেটা বলবো,করবো শুনতে বাধ্য তুমি।আর এই অসুস্থতার বিষয়ে বাধ্য নয়,আমি যেটা বলবো সেটাই হবে।এখানে কোনো অজুহাত বাহানা,দ্বিমত আমি শুনবোনা।সুতরাং অযথা বাহানা করো-না কৌড়ি।
সে অসুস্থ!অথচ কাল থেকে মানুষটা কেমন তারসাথে কড়া গলায়,রুক্ষ ভাষায় কথা বলছে!কারণটা হয়তো তার জানা।তবুও মানতে কেনো যেনো কষ্ট হচ্ছে।নিভানের কথায় মনেমনে অসন্তুষ্ট হলো।সেটা মুখের বহিঃপ্রকাশেও ঘটলো।নিভান স্পষ্ট খেয়াল করল।তবে দাঁতে দাত চেপে নিজেকে শক্ত রাখলো।এ মেয়ে নিজের ভালো বোঝেনা।তাকেসহ নিজেকে ভালো রাখতে গেলে
এই মেয়ের বাহানাকানো তােলা যাবেনা।তার অসন্তুষ্টতা মোটেই গ্রাহ্য করা যাবেনা।নিজে বের হয়ে কৌড়ির পাশের দরজা খুলে দিলো।কৌড়ি বের হলো ধীরেসুস্থে।বের হতেই নিভান শুধালো।
‘হাঁটতে অসুবিধা হবে?
‘না।
অসন্তুষ্ট স্বর!বুঝেও অবুঝ হয়ে রইলো নিভান।গাড়ীর দরজা লক করে পাশাপাশি হাটলো দু’জন।হসপিটালে ঢোকার আগে অতিরঞ্জিত দশতলা ভবনটা একবার মাথা উঁচু করে দেখে নিল কৌড়ি।সাথে বিভিন্ন ডক্টরের বিভিন্ন বিষয়ের উপর নামীদামী সার্টিফিকেট ধরা সাইনবোর্ড।তারমধ্যে ডক্টর মৌমিতা নাহার নামের সাইনবোর্ডটা জ্বলজ্বল করছে।নামটা আগেই শুনেছে সে।আর তার কাছেই যে নিয়ে এসেছে এটা বেশ বুঝেছে কৌড়ি।ভিতরে ঢুকে রিসিপশন এরিয়া পার করে নিভানের অনুসরণ অনুযায়ী লিফটে ঢুকলো।সামন্য সময়ের ব্যবধানে ছয়তলায় গিয়ে থামলো লিফট।লিফট থেকে পার হয়েই ছয়তলার রিসিপশন ডেস্ক।সামনে এগোতেই ডক্টর মৌমিতার চেম্বার নজরে পড়লো।সেখানে নেমই প্লেটে জ্বলজ্বল অক্ষরে লেখা।
ডক্টর মৌমিতা নাহার।
এমবিবিএস এন্ড এফসিপিএস (গাইনি এন্ড অবস)
কনসালট্যান্ট রিপ্রোডাক্টিভ এন্ড এন্ডোক্রাইনোলজি ও ইনফার্টিলিটি।
বিএসএমএমইউ (—-)
গাইনিও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন।
★
বয়সটা ঠিক কোন গানিতিক সংখ্যায় গিয়ে ঠিকেছে,গাঢ় গোলাপি শাড়ি পড়া অতি সুন্দরী নারীটার অনুধাবন করতে পারলোনা কৌড়ি।শালিন মার্জিতরূপে পরা গোলাপি শাড়ীর সাথে ম্যাচিং করে মাথায় হিজাব বাঁধা অসম্ভব সুন্দর নারীটা তারা ঢুকতেই মিষ্টি হেসে স্বাগত জানালেন।যেনো কতোদিনের চেনাপরিচিত।যদিও তারসাথে আসা মানুষটার সাথে যে বেশ চেনাপরিচয় এটা উনার ভালোমন্দ আলাপে বুঝতে পারলো কৌড়ি।তবে অসম্ভব অমায়িক ব্যবহার।এখন তিনি,কৌড়ির গতকালকের রিপোর্ট দেখছেন।সময় নিয়ে বেশ মনোযোগ সহকারে রিপোর্ট দেখার পর মুখ খুলেলেন তিনি।
‘আল্ট্রা রিপোর্ট এন্ড অন্যন্য টেস্ট রিপোর্ট তো আমার কাছে ঠিকই মনে হচ্ছে।তবে,আপনি যখন পুনরায় রোগীর সমস্যা বিবরণ করে আলট্রা রিপোর্ট করতে চাইছেন।তাহলে তো আমাকেও পুনরায় রোগীর সমস্যা শুনতে হবে।
‘অবশ্যই।রোগী তো সাথেই,আপনি সমস্যা জেনে নিন।
মানে কি?তাকে আবারও রোগের বিবরণ দিতে হবে।তাও আবার এই মানুষটার সামনে!কখনো না!রোগ জেনেছে ঠিক আছে।তাই বলে তার বিবরণ দিতে হবে মানুষটার সামনাসামনি!লাজলজ্জা সব কি বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে নাকি!না!বড়মা কতো করে বোঝালো বলে সে এসেছে।আর এখন!
‘কৌড়ি,উনাকে সমস্যাগুলো বলো।
কৌড়ি কেমন যেনো অসহায়,অদ্ভুত নজরে তাকালো।নিভান পলকেই তা বুঝে নিলো।মূহুর্তেই উঠে দাঁড়ালো সে। মুখে সৌজন্যে হাসি ফুটিয়ে,ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বললো—আপনি ওর থেকে সমস্যাগুলো জেনে নিন।আমি একটু আসছি।
দুজনকে সুক্ষ নজরে খেয়াল করলেন ডক্টর মৌমিতা।
নিভানের সাথে সাথে মূহুর্তেই কৌড়ির দ্বিধা, অস্বস্তিটা তিনিও টের পেলেন।বাচ্চা মেয়ে।যদিও ফোনে মেয়েটার সম্পর্কে নিভানের কাছে ডিটেইলসে আগেই জেনেছেন। তবুও নিভানকে উদ্দেশ্য করে বললেন–আপনি না ফোনে জানালেন,সি ইজ ইয়োর উডবি ওয়াইফ।তাহলে সমস্যা কোথায়?
সৌজন্যেমূলক ঠোঁটে ঝুলানো হাসিটা নিভানের আরও একটু প্রসারিত হলো।মাথা নিচু করে থাকা কৌড়ির পানে একপলক তাকিয়ে ফের ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বললো।
‘উডবি!এখনো পুরোপুরি আমার নয়।হয়তো এজন্য সমস্যা।
হাসলেন ডক্টর মৌমিতা।এখনকার যুগে এসে এখনো এতোটা রাখঢাক গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডের মধ্যে আছে!যেভাবে অবাধ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়াচ্ছে এন্ড মেলামেশা করে চলেছে ছেলেমেয়েরা।কতো ওয়েল ফ্যামিলির মেয়েরা আসেন উনার কাছে।সাথে নির্দ্বিধায় তাদের বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসে।বিবাহ হয়নি।লিভেন সম্পর্কে আছেন।অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন।আর সেসব অপরিপক্ক ফুলকে নষ্ট করতে। যদিও উনার হাতদ্বারা এখনো এতোটা অমানবিক পাপ কাজ হয়নি!মনেমনে তপ্ত শ্বাস ফেললেন।সাথে নিভানের এই সুন্দর মানসিকতার পরিচয়কে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ জানালেন।যদিও জে এইচ জে ব্রান্ড গ্রুপ এন্ড লিমিটেডের অল্প বয়স্ক তুখোড় এই ব্যাবসায়ীর চারিত্রিক এন্ড ব্যাবসায়ী নীতির সুনাম দেশজু্ড়ে।ছেলেটাসহ উনার ফ্যামিলি কে তিনি ঈশিতার মধ্যেমেই চিনেন।ঈশিতা উনার ফ্রেন্ড।
সেই হিসাবে নিভানের কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিলো বলে উনার জানা ছিলো-না।তবে কালরাতে ফোনে মেয়েটা সম্পর্কে ডিটেইলস জানার পর আর আজ সরাসরি দেখার পর একটু আশ্চর্য হয়েছেন।এতো বড় একজন সনামধন্য ব্যাবসায়ীর বাচ্চা একটা গার্লফ্রেন্ড।যদিও গার্লফ্রেন্ড বলে মিঃ নিভান সম্বোধন করেননি।বয়সের তারতম্যটাও বেশ।যদি-ও দুজনকে একসাথে দেখামাত্র নজরে পড়বেনা সেই বয়সের তারতম্য।তবে পরিচয় মিললে অবাক তো সবাই হবেই।
‘আপনি কিন্তু ভুলপও তাকে আমার গার্লফ্রেন্ড ভেবে ভুল করবেন না।এখান থেকে দু’দিন পর আপনিও কিন্তু বিয়ের নিমন্ত্রণ পাচ্ছেন।সো সি ইজ মাই ওয়াইফ, একপ্রকার ধরেই নিন।তাই আমি আশা রাখছি,তাকে ট্রিটটা আপনি তেমনই করবেন।
দৃঢ়কণ্ঠ অথচ কোমল বার্তা।আশ্বাস দিলেন ডক্টর মৌমিতা।আমায়িক হাসিটা ঠোঁটে কোণে অক্ষত রেখেই বললেন—অবশ্যই।আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।এন্ড কংগ্রাচুলেশনস।বিয়ে করছেন তবে?
ডক্টর মৌমিতার শেষের কথার প্রেক্ষিতে চমৎকার হাসলো নিভান।উত্তর যেনো তাতেই মিললো।–‘হয়তো তারই আশার অপেক্ষা ছিলো।এসে গেছে যখন বিয়ে করতে আপত্তি কিসের!
কথাগুলো মনেমনে আওড়ালেও মুখে বললো-থ্যাঙ্কিউ ডক্টর।আমি বাহিরে অপেক্ষায় আছি,প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই আমাকে ডাকতে ভুলবেন না।
এতোসময় দুজনের বাক্যালাপে কৌড়ি চুপ থাকলেও নিভানের কথাগুলো তাকে,মানুষটার জীবনে কেমন যেনো গুরুত্বপূর্ণ আলাদা স্পেশালি একজন একান্ত মানুষের অনুভব করালো।আচমকা চেয়ে পড়লো সে নিভানের পানে।তখনও মানুষটার বাক্যালাপ চলছে সামনের নারীটির সাথে।অথচ কৌড়ির ভিতরের চঞ্চল অনুভূতিগুলো আঁটকে আছে।যখন নিভান বললো,সি ইজ মাই ওয়াইফ।কথার দৃঢ়তায় কৌড়ির মনেহলো,তার সমস্ত অধিকার শুধু এই মানুষটার।সে সমগ্রটাই শুধুটাই যেনো এই মানুষটার।কোথাও যেনো ভিতরের অসন্তুষ্টতা মন খারাপ,খারাপ চিন্তাগুলো ধূলিকণার মতো উড়ে গেলো।
‘কৌড়ি,আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।আর সমস্যাগুলো উনাকে সুন্দরভাবে বিবরণ দেবে।হুমম?
ভাবনায় আচমকা কথা পড়তেই তড়িৎ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।নিভান বাহিরে পা বাড়ালো।কৌড়ি সেদিকে একপলক তাকিয়ে ডক্টরের দিকে ফিরলো।ফিরতেই কেমন অস্বস্তিতে পড়ে গেলো।ডক্টর মৌমতা কেমন হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তারপানে তাকিয়ে আছেন।ফের কন্ঠে মাধুর্যতা ঢেলে চলে যাওয়া মানুষটার প্রশংসায় ডুব দিলেন।
‘ছেলেটাকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি।আজ পুনরায় নতুনত্বভাবে আরেকধাপ চিনলাম।সেই হিসাবে কিন্তু তুমি সৌভাগ্যবতী নারী।
কৌড়ির বলার কিছু পেলোনা।তবে লজ্জা পেলো ভিষণ।লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়ে হাসফাস করলো।হাত কচলে লাল করে ফেললো।সেটা লক্ষ্য করেই ডক্টর মৌমিতা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন।
‘এবার ডিটেইলসে জানা যাক, সমস্যা কি?যদিও আমি আগের রিপোর্টগুলো দেখে রোগ নির্নয় করতে পারছি।বাট রোগীর মুখ থেকে সমস্যা গুলো জানলে,রিপোর্ট করতে আমার আরও সুবিধা হবে।
কৌড়ি মাথা নাড়ালো।ভিতরে ভিতর অস্বস্তি অনুভব করলেও ডক্টরের প্রশ্ন অনুযায়ী নিজের সমস্যাগুলো বলতে থাকলো।কোমল স্বরে যেমন একের পর এক ডক্টরের প্রশ্ন বাড়লো,উনার ব্যবহারে কৌড়ির উত্তর দেওয়ার স্পৃহা দ্বিগুণ হলো।
★
অনিয়মিত ঋতুস্রাব সাধারণত যৌবনের প্রারম্ভে এবং যৌবন শেষে হতে পারে। যৌবনের প্রারম্ভে সাধারণত ১২ থেকে ২০ বছর বয়সে কারো শরীরের ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন যদি অপরিপক্ব (প্রিমেচিউর) থাকে তবে অনিয়মিত ঋতুস্রাব হয়। আবার নারী শরীরে মেনোপজ শুরু হওয়ার আগে এ ধরনের সমস্যা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতার কারণেও এই সমস্যা হতে পারে।
অনিয়মিত পিরিয়ড কেন হয়?
নারীদের নিয়মিত ও সময়মতো পিরিয়ড (মাসিক) হওয়াটাই স্বাভাবিক।অনিয়মিত পিরিয়ড নারী স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো নয়। অনিয়মিত পিরিয়ড বা একেবারেই পিরিয়ড বন্ধ হওয়া মূলত পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের (POS) জন্য হয়ে থাকে।তবে আরও অনেক কারণ আছে,যার জন্য পিরিয়ড নিয়মিত হয় না। এই সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।তন্মধ্যে জটিল সমস্যা হলো,TSH &FSH (Thyroid stimulating Hormone & Follicle Stimulating Hormone!
অনিয়মিত পিরিয়ড কী?
প্রতি চন্দ্রমাস পর পর হরমোনের প্রভাবে পরিণত মেয়েদের জরায়ু চক্রাকারে যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় এবং রক্ত ও জরায়ু নিঃসৃত অংশ যোনিপথে বের হয়ে আসে তাকেই ঋতুচক্র বলে।মাসিক চলাকালীন পেটব্যথা, পিঠব্যথা, বমি বমি ভাব হতে পারে। আর যাদের এই মাসিক ঋতুচক্র প্রতি মাসে হয় না অথবা দুই মাস আবার কখনও চার মাস পর পর হয়, তখন তাকে অনিয়মিত পিরিয়ড বলে।অনিয়মিত পিরিয়ডে নারীদের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।পিরিয়ড অনিয়মিত (তথা একাধারে অনেকদিন বন্ধ থাকার কারনে জরায়ুর রাস্তা পুরো হয়ে রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভবা থাকে।ওভারিয়ন সিস্ট দেখা দিতে পারে,সন্তান জন্মদানে বন্ধ্যত্ব প্রকাশ পেতে পারে।আবার অনিয়মিত(তথা মাসের মধ্যে পিরিয়ড কয়েকবার এবং বেশিদিন স্থায়ী থাকার ফলে জরায়ুর রাস্তা ফুলে বিভিন্ন সমস্যা তৈরী হয়।সমস্যা গুরুতর হলে জরায়ু ক্যান্সারের মতো ভয়ংকর রোগে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।এবং সন্তান ধারণ ক্ষমতাতেও জটিলতা দেখা দেয়।
মাসিক অনিয়মিত কেন হয়?
অনিয়মিত পিরিয়ড বা একেবারেই পিরিয়ড বন্ধ হওয়া পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের (POS) জন্য হয়ে থাকে।তবে আরও অনেক কারণ আছে,যার জন্য পিরিয়ড নিয়মিত হয় না।যেমন অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা, ক্যাফেইন জাতীয় খাবার গ্রহণ যেমন অতিরিক্ত কফি পান করা,স্ট্রেস নেওয়া,অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করা, অপরিচ্ছন্ন থাকা,মদ্যপান বা ধূমপান করা ইত্যাদি।
টিনেজার ও মধ্যবয়সী নারীদের মধ্যে অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর পেছনের কারণটি হলো হরমোন। আর লম্বা সময় স্ট্রেসে থাকলে অনেকেরই মাসিক দেরিতে হতে পারে।এ ছাড়া একজন নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু তা জানতেন না। এর পর নিজে থেকেই তার মিসক্যারিজ বা গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে।এ ঘটনায় সাধারণ পিরিয়ডের তুলনায় কিছু দিন পর বেশি রক্তপাত হতে পারে,যাকে অনেকেই দেরিতে মাসিক হওয়া বলে ধরে নেন।ওজন কম হলে সময়মতো পিরিয়ড নাও হতে পারে। এমনকি কিছু দিন বন্ধও থাকতে পারে। জরায়ুতে টিউমার ধরনের এক ধরনের বৃদ্ধি হলো ফাইব্রয়েডস।এগুলো পিরিয়ডের স্বাভাবিক চক্রকে বাধা দিতে পারে।জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করা।যেমন-পিল,প্যাঁচ, ইনজেকশন,আইইউডি। এগুলো ব্যবহার করলে পিরিয়ড দেরিতে হওয়া বা পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক।মনোনিউক্লিওসিস, ঠাণ্ডা, সর্দি, গলার ইনফেকশন- এ ধরনের সমস্যায় পিরিয়ড দেরিতে হতে পারে।তবে বড় কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন থাইরয়েডের সমস্যা বা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের কারণেও পিরিয়ড দেরিতে হতে দেখা যায়।
নিয়মিত মাসিক হলে শরীরের হরমোনাল ব্যালেন্স ঠিক থাকে।তবে অনিয়মিত পিরিয়ড বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করতে পারে।তাই এ বিষয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।এবং অনিয়মিত পিরিয়ড জনিত যে সমস্যাগুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হলো,সেসব লক্ষ্মণ দেখা দেওয়ার সল্প সময়ের মধ্যে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।নাহলে জরায়ু টিউমার,জরায়ু ক্যান্সার এবং বন্ধ্যাত্বের মতো জটিল রোগের সম্মুখীন হতে পারে।
‘আপনার রোগি তথা কাশফিয়া আহসান,( Follicle Stimulating Hormone)সমস্যা ভুগছেন।আরও কিছু সমস্যা রয়েছে তবে জটিল নয়আমাদের দেশের অধিকাংশ নারীরা হরমোন সমস্যায় ভুগছেন।বিভিন্ন জটিলতার কারণে তারা মারাত্মক কিছু না ঘটলে সহজে ডাক্তারের শরাণপন্ন হতে চান,না।তবে সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হন তাহলে রুগী এবং রোগের সেবা প্রদানে সহজ হয়।রুগীর রোগ নিরাময়ে জটিলতা দেখা দেয় না।কমপ্লিকেশন কম হয়।
নিভান মনোযোগ দিয়ে ডক্টরের কথাগুলো শুনলো।কিছু কিছু কথায় শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো তবে মুখে কিছু বললোনা।ডক্টর ফের বললেন—তবে আমি আশা রাখছি আমার দেওয়া আলট্রা রিপোর্টসহ অনন্য টেস্টগুলোও একই রোগ নির্ণয় করবে।যদি উনার দেওয়া বিবরণ আগের ডাক্তারের কাছে যথাযথ পেশ করে থাকে।আর যদি রিপোর্ট সেইম আসে তবে উনাকে কিছু মাস পর্যন্ত ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী থাকতে হবে।এবং নিয়মিত ঔষধ সেবন করে যেতে হবে।এবং স্বাস্থ্য সচেনতা হতে হবে।নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে।
তন্মধ্যে,নিজের ওজনের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।মানসিকভাবে বেশি স্ট্রেস নেওয়া যাবে না।খাদ্যাভ্যাসে অনিয়ম করলে চলবেনা। বাহিরের খোলামেলা খাবার বর্জন করতে হবে।আরও বিভিন্ন করণীয়।যেগুলো রিপোর্টের একটা চার্টে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য থাকবে।
‘নিয়মিত ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী থাকলে আপতত জটিল কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না,এটা আশা রাখা যাচ্ছে তবে?
‘আল্লাহর রহমতে ইনশাআল্লাহ।আমি আশা রাখছি ঔষধ নিয়মিত চললে এবং নিজের স্বাস্থ্য এবং খাদ্যাভ্যাস সচেতন থাকলে,বাচ্চা কনসিভসহ পরবর্তী কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে-না।বাকিটা আল্লাহ যেটা চাইবেন সেটাই হবে।
দরজা খোলার শব্দে পিছনে ফিরলো নিভান।একজন নার্সের পাশাপাশি কৌড়ি আসছে।আলট্র,রক্ত টেস্টসহ বিভিন্ন টেস্টের জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।নিভান সাথে যেতে চেয়েছিলো তবে কৌড়ি ফের অসম্মতি প্রকাশ করায় একজন নার্স দিয়ে পাঠানো হয়েছিলো তাকে।সেই ফাঁকে কৌড়ির বিবরণ অনুযায়ী ডক্টরের শরণাপন্ন হয়ে বিস্তারিত জেনে পরামর্শ নিয়েছে নিভান।ওই মেয়ে যা!ডক্টর কি বলেছে,কি পরামর্শ দিয়েছে সেটা নিয়ে কখনো মুখ খুলবেনা।তাই ম্যাডামের অলক্ষ্যে পরামর্শ নিতে হলো তাঁকে।কৌড়ি এসে নিভানের পাশের চেয়ারে বসে পড়লো।মেয়টাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে!চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে সেটা।নিভান কিছু বলতে নিয়ে-ও বলতে পারলো না।এরমধ্যে নার্স, কৌড়ি আর নিভানকে একপলক লক্ষ্য করে ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বললো।
‘রিপোর্ট আধাঘন্টা পরে পাবেন ম্যাম।
যদিও নিভান কথাগুলো শুনলো তবুও ডক্টর তাকে আলাদাভাবে বলে দিলেন।নার্সের কথা অনুযায়ী নিভান বুঝলো,রিপোর্ট পেতে সময় লাগবে।যদিও স্পেশালি ইমার্জেন্সিতে ডাক্তার দেখোনো হয়েছে,কোথাও সেকেন্ড দেরী হওয়ার কথা না।তবে রিপোর্ট তৈরী হতে তো সময় লাগবেই।এটুকু সময় তো ব্যায় হবে।দুপুরের খাবারটা খাওয়া হয়নি কৌড়ির।পাশে অফিস। অফিস যাবে নাকি কোনো রেস্টুরেন্টে?বাহিরের খাবার এখন কোনোমতে কৌড়ির খাওয়া যাবেনা!আবার মেয়েটা ক্লান্ত!যদিও খেতে চাইবে-না নিভান যানে।তবুও খেতে তো হবেই।
‘এক্সকিউজ মি ডক্টর।আমরা তাহলে ঘন্টাখানেক পরে আসছি।
‘লাঞ্চ করা হয়নি মনেহচ্ছে। না হওয়ারই কথা, সময়টা তো আমার এখানেই পার হয়ো গেলো।তবে লাঞ্চটা কিন্তু আমার এখানেই সেরে নেওয়া যেতো।
ফের সৌজন্যেতা দেখিয়ে হাসলো নিভান।বিনয়ের সাথে অফারটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো।–থ্যাঙ্কিউ ডক্টর।তবে অনেক্ক্ষণ তো হসপিটালে,আমার মনেহচ্ছে ওর আপতত এখন একটু খোলামেলা পরিবেশ দরকার।
ডক্টর মৌমিতাও সৌজন্যে হেসে বললেন–‘অবশ্যই।
নিভান আর কৌড়ি বের হতেই ডক্টর নিজের কাজে ব্যস্ত হলেন।নার্সকে উদ্দেশ্য করে বললেন–লাঞ্চের আগে আপতত আর কোনো রুগী পাঠিও না।
নার্স সেকথা কানে তুললো কি-না বোঝা গেলোনা।সে এখনো তাকিয়ে আছে নিভান আর কৌড়ির যাবার পানে।তাদের প্রতি ডক্টরের এতো আগ্রহ,আহ্লাদ।যদিও এই হসপিটালে সব ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দেখা যায়।
আর তাদের ফ্যামিলি। তবে চলে যাওয়া মানুষটার মেয়েটার প্রতি অতিরিক্ত খেয়াল ধ্যান তাকে যেনো মুগ্ধ করলো।মানুষটাকে সে চেনে,সেই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন শুধালো।
‘ম্যাম,একটু আগের রুগীর সাথে যিনি ছিলেন,উনাকে আমার চেনা চেনা লাগছে।
‘আমাদের হসপিটালের সামনাসামনি এগোরোতলার যে ভবনাটা…
হঠাৎই মনে পড়ায় ডক্টর মৌমিতার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বেশ মুগ্ধ উচ্ছ্বসিত গলায় নার্সটা বললেন–উনি জে এজ জে গ্রুপ এন্ড লিমিটেডের (C,O),নিভান আওসাফ আহমেদ। আজ ফর্মাল ড্রেসআপ ছাড়া ছিলেন বলে হঠাৎই চিনতেই পারিনি।তবে গার্লফ্রেন্ডের প্রতি উনি বেশ খেয়ালি,যত্নশীল।
‘গার্লফ্রেন্ড নয় উডবি ওয়াইফ।দুদিন বাদেই বিয়ে..
নিভান নামের লম্বা চওড়া হ্যান্ডসাম লোকটাকে মাঝেমধ্যে দেখে নিপা।তবে দূর থেকে।গায়ের শ্যামবর্ণ মায়াময় রঙটার সাথে ফর্মাল ড্রেসেআপে মাঝেমধ্যে লোকটাকে যখন দেখে,মনটা পুলকিত হয়।নজর আকর্ষিত হয়।তবে ওর বাহিরে ভাবা পাপের সাথে সাথে ঔদ্ধত্যও।তাই ভাবনা ওই পর্যন্তই।তাদের হসপিটালের অনেক নার্স এমনকি সদ্য হওয়া ডাক্তারানীগন ,উনার ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধ।রঙে চাপা হলেও সেই সৌন্দর্যের কথা সবার মুখেমুখে।লোকটা বিয়ে করছে?মেয়েটাকে একটুখানি মনেহলো না!
★
ডক্টর দেখিয়ে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে গেলো কৌড়িদের।বাড়ি ফিরতে এতো দেরী হতো-না, কিন্তু মানুষটা দুপুরের খাবারটা খেতে কোথায় নিয়ে গেলো তাকে! একগ্রহ থেকে আরেকগ্রহে।এরচেয়ে বরং বাড়ি এসে খেয়েদেয়ে রিলাক্সে যেতে পারতো তারা।
কোথায় ডক্টরের চেম্বার আর কোথায় তৃনয় ভাইয়ার রেস্টুরেন্ট।পাক্কা পয়তাল্লিশ মিনিট লেগেছে যেতে!তার বেশি ছাড়া কম নয়!তাদেরকে দেখে তো তৃনয় ভাইয়া খুশিতে গদগদ।এর আগেও দেখাসাক্ষাৎ সহ টুকটাক কথা হয়েছে কৌড়ির সাথে তার।মানুষটা তন্ময়ী আপুর মতো আমায়িক মানসিকতার।দেখা হলে বিনয়ের সাথে একদম নিজের বোনের মতো ট্রিট করে।আজও তার ব্যতিক্রম হলো-না।সে অসুস্থ জেনে নিজ হাতে স্বাস্থ্যসম্মত রান্না করে খাওয়ালেন।হয়তো এজন্য উনার ওখানে নিয়ে যাওয়া।শেফ হিসাবে দারুন তিনি।উচ্চশিক্ষিত একজন মানুষ। যার বাহিরের ডিগ্রী আছে।ভালো উচ্চপদস্থ কোনো চাকরিবাকরিতে যোগ দিতে পারেন।অথচ তা না করে,কি নির্দ্বিধায় নিজের প্যাশনের মধ্যে ডুবে আছেন।যেনো এই শেফ নামটাতেই মহা সুখি তিনি।খাওয়া শেষে দুই বন্ধুর মধ্যে বেশ রমরমা আড্ডা চললো।যদিও কথা তৃনয় ভাইয়াই বলেছেন।উত্তর সরূপ সামনের মানুষটা শুধু পাল্টা উত্তর দিয়ে গেছেন।কিছু নিয়ে হয়তো তৃনয় ভাইয়ার উপর অসন্তুষ্ট।নাহলে, তৃনয় ভাইয়ার উপস্থিতিতে তাকে এতোটা চুপচাপ কৌড়ি কখনো দেখিনি।দুই বন্ধুর বেশ দৃঢ় বন্ধন দেখেছে।
রেস্টুরেন্টের রিসিপশন এরিয়ার পাশাপাশি আলাদা একটা গার্ডেন আছে।সেখানে বিভিন্ন ইনডোর গাছসহ মাছের বিশাল বিশাল ভিন্ন একুরিয়াম রাখা আছে।দুই বন্ধুর কথোপকথনে মধ্যে না থেকে সেখানে গিয়েছিলো কৌড়ি।ঘুরেফিরে যখন তাদের মধ্যে ফিরে এলো, দেখলো দুজনের মুখ থমথমে,ভার।সামন্য সময়ের মধ্যে কি কথা হলো বুঝলোনা কৌড়ি।তবে কিছু একটা তো হয়েছে।এটা বেশ বুঝেছিলো।তবে তার সামনে আর পর্যালোচনা না করার কিছু বুঝে উঠতে পারিনি।তার উপস্থিতি থমথমে পরিস্থিতি কাটিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বিদায় নিয়ে চলে এলো তারা।অবশ্যই চলে আসার তৃনয় ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে মানুষটা কেমন শান্তস্বরে কিছু কথা বলে এসেছিলো।যা কৌড়ির সম্পূর্ণ বোধগাময় হয়নি।অদ্ভুত গলায় শুধু বলেছিলেন–
‘ট্রাস মি তৃনয়,আমি আমার সকল না পাওয়া ইচ্ছেগুলো ভুলে গিয়েছে শুধু ওকে পেয়ে।যা আমি আমার এতোদিনের হাজার সফলতার মধ্যেও, নিজের বিসর্জন দেওয়া ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষার ব্যথা ভুলতে পারিনি।না পাওয়ার মন খারাপগুলো এক নিমেষেই কেমন করে যেনো ভুলে যেতে বাধ্য হয়েছি।তোকে বর্ণনা দেওয়া সত্যিই সম্ভব নয়।জানি,জীবন মানে সবার কাছে একই রকম ডেফিনেশন নয়।আলাদা আলাদা যুক্তিতর্ক,আদালা আলাদা রুচিবোধ,আলাদা আলাদা শখ,সপ্ন,আলাদা আলাদা ইচ্ছেরা।হয়তো জীবন মানে সফলতার চূড়ায় পৌঁছানো।আমি সফলতা একটু হলেও ছুঁয়েছি তো,এজন্য জীবন মানে আমার কাছে ভিন্ন ডেফিনেশন মনে হচ্ছে।তবে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে সেটাই বলেছি তোকে।হয়তো হারিয়ে যাওয়ার পর,হারিয়ে যাওয়া জিনিসের মর্ম বোঝা যায়।তবে উচিত নয় কি, হারিয়ে যাওয়ার আগে নিজের জীবনের সাথে তাকে জড়িয়ে নেওয়া?তাকে নিজের জীবনে মূল্যবান জায়গাটস করে দেওয়া?আমার মনেহয় মনের মতো উত্তম সঙ্গীনি হলে পৃথিবীতে আর কিছু চাইনা।ক্ষনিকের জন্য নাকি দীর্ঘস্থায়ী ভাবনা,জানিনা।তবে তেমনটা মনে হচ্ছে আমার।মা’কে দেখেছিতো।আমি চেয়েছিলাম আমার জীবন সঙ্গীনিও তেমনটা হোক।তাই ভাবনাটা আমার উত্তম সঙ্গীনিতেই আঁটকে গেছে,সফলতায় নয়।সফলতাতো পরিশ্রমের অর্জিত ফল।পুরুষ মানুষ যখন,পরিশ্রম করলে সৃষ্টিকর্তা বাধ্য হন সফলতা দিতে।তাই উত্তম সঙ্গীনি আগে।যাই হোক,আমি বাড়িতে ফেরার আগে তোকে যেন বাড়িতে গিয়ে পাই।আসছি।
সেখান থেকে ডক্টরের কাছে গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে,পুনরায় ডক্টর দেখিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে,বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যা।তৃনয় ভাইয়ার সাথে ওরকম অদ্ভুত কথাবার্তা হওয়ার পর থেকে মানুষটা কেমন চুপচাপ হয়ে রয়েছে।কৌড়ির মনে কৌতুহল জাগলেও,প্রশ্ন করা হয়ে উঠেনি তার।সন্ধ্যায় মাগরিবের আযানের পর গাড়িটা যখন বাড়ির গেটে ভিড়লো,বাড়ির ভিতর বাহিরের চিত্র দেখে কৌড়ির চোখ কপালে উঠলো।বিস্মিত হওয়ার কয়োকধাপ পেরিয়ে একবার নিভানের মুখের দিকে তো একবার বাড়ির ভিতরসহ আশপাশটায় নজর দিলো।কয়েকঘন্টা বাড়িতে নেই,তারমধ্যে পুরো বাড়ির সাজসজ্জা পাল্টে গেলো।সত্যিই কি তবে?
চলবে…