ফুলকৌড়ি পর্ব-৩৬+৩৭

0
13

#ফুলকৌড়ি
(৩৬)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ছাঁদের উপর শান বাধানো বসার স্থানে দুহাঁটু একসাথে মুড়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে কৌড়ি।সেই নিঃশব্দে কান্নার দমকে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে তার পেলব শরীর।ফর্সা চোখমুখ লালাভ বর্ণায় ছেয়ে গেছে।ঠোঁটে দাঁত চেপে কান্নার ফলে ঠোঁটজোড়াও গোলাপিবর্ন ছেড়ে রক্তিম আভায় ছেয়ে পিষ্টে আছে যন্ত্রণায়।এতো পোড়া কপাল নিয়ে পৃথিবীতে কেনো জন্মছিলো সে!দূর্ভাগ্য বুঝি শুধু তারই প্রাপ্য!কেনো ওই মানুষটা তার ভিতরটা বুঝতে চাইলো না?ইদানিং তার সুখ-অসুখ সব নিজ থেকে বুঝে নিতে পারছে।আর এটুকু বুঝে নিতে পারলো না,কেনো সে মানুষটাকে দেখতে যেতে পারিনি। কৌড়ি কি এতোই,নিষ্ঠুর অমানবিক।মানুষটা এক্সিডেন্ট করেছে শুনে কি অনুভব অনুভূতি হয়েছিলো তার,এটা শুধু সেই জানে।একটা পলক মানুষটাকে দেখার জন্য মনটা কিভাবে ছটফটিয়ে ছিলো,সেটাও শুধু তার ভিতরটা জানে।অথচ সেই মানুষটা তাকে কিছু বলার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে রেগে-মেগে চলেই গেলো!তাকে একটাবার বোঝার চেষ্টা-ও করলো-না!এই বুঝল মানুষটা তাকে?এতো রাগ, এতো ক্ষোভ জন্মেছে তারউপর?কৌড়ির কান্নার গতিবেগ বাড়লো।হঠাৎ সামনে দু’খানা ফর্সা গোটালো পা দেখেই কান্নারা এবার হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো।বসা অবস্থায় মান্যতার কোমড় জড়িয়ে তার পেটে মুখ গুঁজে হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকলো।মান্যতাও পরম যত্নশীলতায় নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তাকে।নিজের রুম থেকে বেরিয়ে নিচে যাচ্ছিলো সে।হঠাৎ দাদাভাইকে হনহনিয়ে ছাঁদ থেকে নামতে থেকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো সে।নিভান কাছে আসতেই তাঁকে দেখেই চলা ধীর করলো।ফের গম্ভীর কন্ঠে তাঁকে আদেশ করলো ছাঁদে আসতে।বলেই চলে গেলো।মান্যতা ভেবে পায়নি দাদাভাইয়ের এমন আদেশর কারন।কেনো সে ছাঁদে যাবে!হঠাৎ কিছু মাথায় খেলতেই দ্রুত ছাঁদে এসে দেখলো,দাদাভাইয়ের রাগের কারন।

‘উনি আমার কথা কিছুতেই শুনলোই না আপু।আমি কেনো যেতে পারিনি,কারনটা উনি জানতেও চাইলেন না,শুনতেও চাইলেন না।বরং তার বিনিময়ে আমাকে ভুল বুঝে কতো উল্টো পাল্টা কথা শুনিয়ে চলে গেলেন।তুমি বিশ্বাস করো, আমি যেতে চেয়েছিলাম।উনি সেকথা কিছুতেই মানতে চাইছেন না।বিশ্বাসও করছেন না।আরও উল্টে আমার সম্পর্কে সবচেয়ে নিচু ধারনা করে বলে গেলেন,আমার প্রার্থনায় উনার দীর্ঘায়িত কামনা না করে মৃতু কামনা করবো!এটা উনি কিকরে বলতে পারলেন?কিকরে মুখে আনলেন উনি?

একাধারে কৌড়ির পিঠে আর মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে থাকলো মান্যতা।কৌড়ির কান্নার দমকে বেঁধে বেঁধে বলা কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো।ফের মুখে মৃদু হাসি টেনে নরম গলাশ শুধালো।–দাদাভাইকে ভালোবেসে ফেলেছিস?

তড়িৎ মাথা নাড়ালো কৌড়ি।অর্থাৎ না।মান্যতা ফের শুধালো—তবে তার কথায় এতো কাঁদছিস কেনো?সে তার অনুভূতির আবেগ থেকে নাহয় শুনিয়েছে কথা।তোর মোটেও কান দেওয়া উচিত হয়নি।আর না এতো কান্নাকাটি করার প্রয়োজন আছে।

সব যেনো কেমন এলোমেলো মনে হলো কৌড়ির।নিজের আবেগ অনুভূতি ওই মানুষটার প্রতি আগ্রহী।তাই বলে কি তারপ্রতি ভালোবাসা জন্মেছে?কি জানি!তবে ওই মানুষটার প্রতি যে নিজের অগাধ মায়া।এটা অনুভব করে কৌড়ি।সেই মায়া থেকেই মান্যতার কথার উত্তর সরূপ বললো –আমি কিচ্ছু জানিনা।তবে উনার খারাপ আমি কখনো চাইনি আর চাইবোও-না কখনো।
সেখানে উনার মৃত্যু কামনা করবো আমি!উনি এটা কিছুতেই বলতে পারেনন না।রাগে হোক বা ক্ষোভে কথাগুলো বলে তিনি দোষ করেছেন। অন্যায় করেছেন।উনি সব দোষ আমার উপরে বর্তায়ে রাগ প্রকাশ করতেই পারেন।তাই বলে উল্টো পাল্টা যেকোনো কথা বলতে পারেন না।

হাসলো মান্যতা।ভালোবাসা জন্মায়নি নাকি!স্বীকার না করলেও কথার আচে ঠিকই বোঝা যাচ্ছে, চৈত্রের খরা নেমে মনে আষাঢ়ে শ্রাবণধারা নেমেছে মেয়েটার তার দাদাভাইয়ের জন্য।কৌড়ির পিঠে ফের হাত বোলাতে বোলাতে কোমল গলায় বললো।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।দাদাভাইয়ের হয়ে মানলাম আমি।ভুল হয়ে গেছে।আর কাঁদিস না।মাইগ্রেনের ব্যথাটা আবার শুরু হয়ে যাবে।দু’দিন বাদ ফাইনাল পরিক্ষা।ব্যথা বাড়লে বুঝতে পারছিস,কি হবে?আর দাদাভাই রাগ করে উল্টো পাল্টা বলেছে,আবার ঠিক হয়ে যাবে।প্রিয় মানুষ বলতে,সে তাদের থেকে পাওয়া কষ্ট, ব্যথা মনে রাখেনা।রাখে-না বলতে ভুল।হয়তো ঠিকই মনে রাখে তবে তাদেরকে বুঝতে দেয় না।তোর সাথে রাগারাগি করেছে।বিশ্বাস কর আমি অখুশি হতে পারছি-না।দাদাভাই প্রিয়জনদের দেওয়া শত কষ্ট, শত ব্যথা সহ্য করতে সদা প্রস্তুত।তাকে এমনটা জেনে এসেছি,দেখেও এসেছি।,তবে বিপরীত মানুষটাকে সেই ব্যথা কষ্ট ফিরিয়ে দিতে কখনো প্রস্তুত হয়না।পছন্দ করে না সে।আমার দেখা,কষ্ট ব্যথা পেতে দেয়নি কখনো।আমার নজরে পড়েনি সেরকম কোনো ঘটনা।তবে তোর কাছে যখন নিজের ব্যথার,কষ্টের অনুভূতির কৈফিয়ত চাইছে।বহিঃপ্রকাশ করছে।তবে বিশ্বাস কর, সে অত্যন্ত তোকে ভালোবাসে।তোকে নিজের ভাবে।সম্পূর্ণ নিজের।যার প্রতি ও হকদার।নাহলে কখনো এরকমটা করতোনা।রাগ করে উল্টো পাল্টা বলেছে তাই কি,সে তোর কাছেই ফিরবে।

একটু থেমে ফের বললো–দাদাভাই রাগ করেছে কেনো সেটা তো বললিনা?

কান্না থেমে গেলেও এখনো বারবার চোখ মুছছে কৌড়ি।তারমানে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে।হাত ডলে আবারও চোখ মুছে নিয়ে রয়েসয়ে বললো–আমি কেনো তাকে দেখতে যায়নি,সেই অভিযোগে অভিযুক্ত করে দুনিয়ায়র আজেবাজে কথা আমাকে শুনিয়ে গেছেন।

এবার শব্দ করে হাসলো মান্যতা।সেই হাসিতে লজ্জা পেলো কৌড়ি।মান্যতা বললো—তা তুই বলিসনি,তুই পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে পারিসনি।এখানে তোর দোষ কোথায়?

‘সময় দিয়েছেন আমাকে বলতে?আর আমার কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেননি উনি।শুধু নিজের মতো নিজেরটা বলে রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন।

শব্দকরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মান্যতা। ফের বললো–যাই হোক খেয়াল তো আমারও ছিলোনা তুইও যে দাদাভাইকে দেখতে যেতে চাস বা তোরও দাদাভাইকে একবার হলেও দেখতে যাওয়া উচিত।এটা মাথায় ছিলো না।দাদাভাইয়ের এক্সিডেন্ট আবার হঠাৎ আমার পরিক্ষার প্রেশার পড়ে গেলো।সবমিলিয়ে কি এলোমেলো হয়ে ছিলাম,দেখলিইতো এইকয়দি।আমিও বা ঠিকঠাক এই চার-পাঁচটা দিনে কয়বার যেতে পেরেছি দাদাভাইকে দেখতে বলতো?প্রথমদিনতো ওই তাড়াহুড়োয় চলে গেলাম।তারপর তো বাড়ি থেকে দাদাভাইকে আর দেখতে যাওয়া হয়নি।পরিক্ষা পড়ে গেলো,পরিক্ষা দিয়ে আসার পথে সময় করে দেখা করে এসেছি,এই যা।বাড়ি থেকে উহ্য করে তো যাওয়া হয়নি।এজন্য তোর কথাও বিশেষ খেয়ালে ছিলো-না।স্যরিরে সোনা।তোর বকার অর্ধেক ভার আমি নিলাম।যদিও বকা তোর শোনা হয়ে গেছে।তবে এবার দাদাভাই উল্টো পাল্টা কিছু বললে বা রাগ দেখালে,আমি বুঝিয়ে বলে দেবো তোকে না বকতে।কেমন?আর কাঁদিস না।

মান্যতার কথার ছলে এবার কৌড়ির কান্না পুরোপুরি থেমে গেলো।হঠাৎই নিচ থেকে জোরে কিছু ভাঙার আওয়াজ আসতেই চমকে উঠলো দু’জনে। মান্যতার কোমর ছেড়ে, তার মুখের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ নজরে তাকালো সে।মান্যতাও কপাল কুঁচকে কৌড়ির মুখের দিক তাকিয়ে রইলো।ফের আবার জোরেশোরে কাচ ভাঙার শব্দ হতেই মান্যতার কোমর ফেরছে খামচে ধরলো কৌড়ি।মান্যতারও হুশ ফিরলো জেনো।মনেমনে কিছু ভাবলো,ফের কৌড়ির হাতটা চেপে ধরে চোখ বড়বড় করে বললো।

‘চল নিচে।আমার কেনো জানি মনেহচ্ছে নিশ্চিত এটা দাদাভাইয়ের কাজ।

আতঙ্কে কৌড়ির হরিনী চোখগুলোও আকার ছাড়ালো।
ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হলো।একটু আগে যা রাগ দেখিয়ে গেলো।আবার?তাকে আর কিছু ভাবার বা বলার সুযোগ না দিয়ে মান্যতা তার হাত খিঁচে টান দিয়ে নিচে দৌড় দিলো।অগ্যতা তাঁকেও দৌড়াতে হলো।

‘এই নিভান কি হয়েছে?

কথাটা জিজ্ঞেস করতেই,নিভানের দরজায় পা আঁটকে গেলো নীহারিকা বেগমেরম।পরিপাটি করে রাখা ঘরের অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হলো চোখমুখ।সহসা ডান হাতটা মুখে চেপে ধরলেন।উনার পিছে আস্তে আস্তে এসে ভীড় করলো বাড়িতে থাকা সমস্ত মানুষ।ঘরের অবস্থা দেখে সবার মুখাবয়বের এক্সপ্রেশন একই রূপ ধারন করলো।সবার আতঙ্কিত মনে প্রশ্ন জাগলো।
ছেলেটা তো কখনো এতো রেগে যায়না?যায় না বললে ভুল,তবে বহিঃপ্রকাশ তো সহজে ঘটায় না।আর এতো বাজেরূপে তো কখনো ঘটায়না।তবে কি এমন হলো যে এতো রেগে গেলো?আর এই অসুস্থ অবস্থায় রেগেমেগে রুমের বেহাল দশা করে ফেলেছে! কি বাজে অবস্থা! একাকার অবস্থা করে ফেলেছে রুমের।দরজার পাশের বিশাল আকারের ফুলদানিতে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ। তার খন্ডিত কোনো রূপ নেই।রুমের ওয়ালসেট আয়নাটারও বিশ্রী অবস্থা।ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।অল্প একটু অবশিষ্ট কোনোমতে লেগে আছে ওয়ালে।সেই ভাঙা আয়নার সম্মুখে দাড়িয়ে আছে নিভান।তার ক্রোধিত মুখ আর বুঁজে থাকা নজর সেখানে দেখা মিলছে।হঠাৎ কি হলো ছেলেটার?আর এতো রেগেই বা গেলো কিসে বা কার উপর?নীহারিকা বেগম ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নিভান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো।—ভিতরে এসো না মা।লেগে যাবে।
আমাকে একটু নিজের মতো থাকতে দাও।যাও।

ছেলের কথা শুনে কপাল কুঁচকে গেলো নীহারিকা বেগমের।তবে নিভানের কথা কর্ণপাত না করে ভিতরে
পা বাড়াতে গিয়েও,কোথায় পা ফেলবেন খুঁজে পেলেন না।থেমে গেলেন।প্রশ্নবিদ্ধ করলো নিভানকে।

‘ভিতরে আসবোনা কেনো?আর এই অসুস্থ অবস্থায় এসব কেনো নিভান?দুনিয়া গোল্লায় যাক,এতো হাইপার হলে নিজের কি অবস্থা হতে পারে জানা নেই তোর!তবুও এসব কি!কেনো?এতো রেগেও বা গিয়েছিস কি জন্য?আর আমাকে একা থাকতে দাও মানে?হয়েছে টা কি?কেনো এই অবস্থায়ও এতো হাইপার হচ্ছিস?

‘আমার যা হয়ে যায় যাক।প্লিজ মা,আপতত আমাকে একা থাকতে দাও।প্লিজ,ট্রায় টু আন্ডারস্ট্যান্ড।

জেদালো ভারী গম্ভীর কন্ঠস্বর আরও ভারী শোনালো।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে নিভানের পানে চেয়ে রইলেন নীহারিকা বেগম।এরকম রাগ জেদ সহজে করেনা ছেলেটা।তবে যখন করে খুবই কঠিন হয়ে যায়।সামলানোও দ্বায় হয়ে পড়ে।কারও কথা শুনতে চায়না।নিজের রাগজেদে অনড় থাকে।কারও ভালোমন্দ কথায় টলতে চায় না।কাজই হয়না।ওর মতো ওকে ছেড়ে দিলে,মাথা যখন ঠান্ডা হয় নিজে থেকেই স্বাভাবিক হয়ে যায়।তবে হঠাৎ এতো রাগলো কি নিয়ে?প্রশ্নটা যেনো মনস্তাত্ত্বিকে ঘুরেফিরে বাড়ি খেতে লাগলো।উনার মতো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকের মনে প্রশ্ন জাগলো।এতো রেগে গেলো ছেলেটা কি নিয়ে?কি হলো হঠাৎ ছেলেটার কেউ বুঝে উঠতে পারলো-না।তবে সদ্য দরজায় এসে দাঁড়ানো কৌড়ি আর মান্যতা ঠিকই বুঝতে পারলো,রুমের এই করুন দশা কিসের জন্য আর কার জন্য!রুমের দৃশ্য দেখেই মূহুর্তেই মুখে হাত চেপে ধরলো কৌড়ি।সেটা আর কেউ খেয়াল না করলেও দীবা খেয়াল করলো।মেয়েটার চোখমুখ লাল।বড়বড় চোখগুলোও ফুলোফুলো।কেঁদেছে কি?কিন্তু কেনো?
কৌড়ি ছাঁদ থেকে নেমে এলোনা?নিভান তো একটু আগে ছাঁদ থেকে নামলো।আর তারপর পরপরই তো এসব কান্ড।ড্রয়িংরুমে বসেছিলো সে।নিভানকে ছাদ থেকে নেমে নিজের রুমে ঢুকতে দেখেছে সে।তবে কি দু’জনের মধ্যে কিছু হয়েছে।ঝগড়াঝাঁটি বা কথা-কাটাকাটি!নাহলে?ভাবনা সেখানেই স্থির রেখে নিভানের পানে চাইলো দীবা।ছেলেটা সেভাবেই অনড় দাঁড়িয়ে আছে।নিভানের সিদ্ধান্ত টলানো এতো সহজ নয়!মনেহলো তার ধারনাই ঠিক।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো দীবা।ফের আস্তে আস্তে পা পিছিয়ে নিয়ে চলে গেলো।খালি জায়গায় উপস্থিত হলো ইভান।বাড়িতে ছিলোনা সে।রুমে ঢুকতে গিয়েই নিভানের রুমের সামনে জটলা দেখে চলে এলো।দরজার সামনে দাঁড়াতেই সবার মতো তার-ও একই অবস্থা হলো।মনে জাগলো একই প্রশ্ন।সন্দেহের দৃষ্টি ফেললো ফুপুমনির দিকে।তবে না তিনিও ঢ়েনো তার মতো অবাক নজরে হা হয়ে নিভানের রুমের পানে তাকিয়ে আছে।তবে ব্যাপারটা কি?দাদাভাই এতো রেগে গেলো কি নিয়ে?
নীহারিকা বেগম ফের ডাকলেন।

‘নিভান

নিভানের এতো সময়ের বুঁজে থাকা ক্ষোভিত মন মায়ের ডাকে শান্ত হলো ঠিকই তবে সহসা চোখ খুললো না সে।বিষাদে টলমলা হরিণী চোখগুলো আবারও দুনয়নে ভেসে উঠছে তার।নিজ স্বার্থে মেয়েটাকে কাঁদিয়েছে সে!
আর তার কারনেই বিষাদে ছেয়ে গেছে ওই মায়ময় দুনয়ন।উফফ,চোখগুলো বারংবার ভেসে উঠছে মানসপটে আর সবকিছু শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। সব জায়গায় এতো এতো ধৈর্য সহ্যর পরিধি ঠিক রাখতে পারলেও,ওই মেয়েটার বেলায় কেনো রাখতে পারলো-না।না গিয়েছে তাকে দেখতে?সে তো বলেছিলো যেতে চেয়েছিলো,হয়তো পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে পারিনি।সেটা বুঝে হোক বা অবুঝে,মন কেনো মেয়েটার বেলায় এতো ধৈর্য্যহীন,অবুঝ হয়ে পড়লো।কেনো?ওই মেয়েটা তারজন্য কেঁদেছে আর কাঁদছে-ও।
উফফ!

‘দাদুভাই।

ফাতেমা বেগম ডাকলেন।এবার চোখ খুলে ফেললো নিভান।সামনের দেয়ালেন ভাঙা আয়নার নজর পড়তেই মায়ের স্পষ্ট মুখ দেখতে পেলো,পাশে আরও একজনকে নজরে পড়লো তার।তবে পুরোপুরি নয়।তার কাঁধের ওড়নার অংশ।বুঝতে অসুবিধা হলো-না, ওটা কৌড়ি।মন আবারও কারণবশত জ্বলে উঠলো।একটু আগের বুঝদার মন আবার অবুঝপনার খেলায় মাতলো।কেনো,কৌড়ি তাকে গ্রাহ্য করবেনা।পরিস্থিতি যেমনই থাকুক,তার কাছে কেনো যাবে-না?যদি সে মরে যেতো তবে ওই মায়াময় মুখটা দেখার তৃষ্ণা তো তার রয়েই যেতো।এটাই অপরাধ ওর।ভাঙা আয়নার পানে দৃষ্টি অনড় রেখে গম্ভীর, ঠান্ডা গলায় বললো।

‘দাদুমা প্লিজ।আমাকে একটু একা থাকতে দিন।প্লিজ দাদুমা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধা।নরম গলায় বললেন–
‘ঘরের এই অবস্থার মধ্যে তুমি চলবে ফিরবে কিকরে?

‘আমি একটু পরে রানীসাহেবা ডেকে গুছিয়ে নেবো।

গম্ভীর কন্ঠস্বর।ছেলের পেট থেকে কিছু বের করতে পারবেন না,বেশ বুঝলেন নীহারিকা বেগম।তবু্ও কেমন থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন।ইভান এসে মায়ের পাশে দাড়ালো।ফের চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো,সে দেখছে।ফের ছোটো চাচিকে ইশারা করলো,মা’কে নিয়ে যেতে।স্বান্তনা রহমান ইশারা মেনে,নীহারিকা বেগমের হাত ধরে নিয়ে চলে গেলেন।উনাার পিছুপিছু চলে গেলেন ফাতেমা বেগম আর ডালিয়া বেগমও।যেতে যেতে অদ্ভুত দৃষ্টিতে কৌড়িকে দেখে যেতে ভুললেন-না।কৌড়িও যেনো দাড়িয়ে থাকার সাহস পেলোনা আর।চঞ্চলা পা সহসা বাড়িয়ে চলে গেলো।চোখ নোনাজল আসাটা যেনো দাঁতে দাত চেপে কোনো রকম রোধ করে রেখেছিলো এতোক্ষণ সে।মান্যতাও পিছু নিলো কৌড়ির।সবার যাওয়াটা স্বাভাবিক ঠিকলেও কৌড়ির যাওয়াটা কেমন অদ্ভুত ঠিকলো ইভানের।চোখমুখের হাবভাবও ভলো দেখালো-না।পায়ের চলনটা-ও কেমন এলোমেলো ছিলো।

পা বাঁচিয়ে বাচিয়ে নিভানের কাছে যেতে যেতে ইভান বললো–কি করেছো কি রুমের অবস্থা!তোমার থেকে এটা আশা করা যায়!আমি হলে, না কেউ প্রশ্ন করতে আসতো আর না বিস্মিত হতো।তুমি আর এসব!মানা যায়?তা কার উপর এতো রেগে রুমের এই বেহাল দশা করলে?

ইভানের মজার ছলে বলা কথাগুলো শুনেও শুনলোনা নিভান।ভিতরে ভিতরে নিজেকে ঠান্ডা করার প্রয়াস চালালো।কৌড়ির চঞ্চল পায়ে চলে যাওয়াটা সে দেখেছে।এবার মনেহলো,রাগটা মাত্রাধিক হয়ে গেছে তার!উফফ!

‘মেয়েটাকে আবার বকেছো নিশ্চয়?আর তার রাগ দেখাচ্ছো নিজের উপর,তাই না?

ইভানের কথার উত্তর দিলোনা নিভান।শুধু পূর্ন দৃষ্টিতে ইভানের মুখপানে তাকিয়ে রইলো।ইভান গিয়ে ধপাৎ করে শুশে পড়লো নিভানের বেডে।হাত ছড়িয়ে বেডে শরীর এলিয়ে দিলেও পা ঝুলছে বেডের নিচে।সেই অবস্থায় হঠাৎ গান ধরলো সে।

‘আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি,আমি তোমার দ্বিধায় পুড়ে যাই।
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে আমি তোমাকে চেয়েছি পুরোটাই।
আমি তোমার স্বপ্নে বাঁচি, আমি তোমার স্বপ্নে পুড়ি যাই।
এমন সাধের পৃথিবীতে আমি তোমাকে চেয়েছি পুরোটাই।

ইভানের হঠাৎ গানের গলায় কপাল কুঁচকে তারদিকে অদ্ভুত দৃষ্টি ফেললো নিভান।তারপর গানের শব্দগুলো কেমন যেনো নিজের সাথে মিলিয়ে দেখলো।মন হলো, নিজের পরিচিতি। সব তার নিজের কথা,ভিতরের কথা।
সহসা কপালের ভাজ মিলিয়ে গেলো।পা বাড়িয়ে নিজে গিয়েও ধপাৎ করে শুয়ে পড়লো ইভানের পাশে।সহসা ইভান বললো।

‘আস্তে।ব্যথা পাবে তো।

ব্যথা পেলো,যন্ত্রণা অনুভব হলো শরীরে। তবে সে ব্যথা ভিতরের জ্বলন স্পর্শ করে মন ছুঁতে পারলো-না।সময় নিয়ে বললো।—আমি কি ওকে চেয়ে অন্যায় করে ফেলেছি ইভান?ওর আমার হতে অসুবিধা কোথায়?

‘কাওকে মন থেকে নিজের করে চাওয়াটা অন্যায় কি করে হয়!আর কৌড়ি।ও তো তোমারই।তুমি ভাবছো,ও তোমার হতে চাইছে না?তোমার প্রতি দূর্বল নয় ও,? দূর্বলতা নেই ওর?আমার লাইফের সবচেয়ে কঠিন অভিজ্ঞতা, মেয়েদের মন যেটা বলে মুখ তার বিপরীত শব্দ আওড়ায়।এটা ওদের চোখের দিকে তাকালে বুঝবে।মানুষের মনের সত্যি মিথ্যা কেনো জানি চোখে প্রকাশ পায়।ওইযে বলে-না মেয়েদের বুক ফেটে যাবে কিন্তু মনের কথা মুখে সহজে প্রকাশ করবেনা তারা।তবে এসব বলছো কেনো?সত্যিই কি তুমি কৌড়ি-কে বকেছো?

উত্তর দিলোনা নিভান।সময় নিয়ে ফের নিজের মতো বললো–আচ্ছা আমি যদি মরে যেতাম।ও কি একবারও দেখতে যেতো না আমাকে?

রাগ অভিমানের শুরু কোথা থেকে এবার বুঝি ইভান ধরতে পারলো।পাশ ফিরে একপলক পাশে শোয়া মানুষটাকে দেখে নিয়ে মৃদু হাসলো।প্রিয় মানুষটার এক্সিডেন্ট।বাড়ি,হসপিটাল।হসপিটালের বিভিন্ন ঝামেলা সামলাতে সামলাতে বিশেষভাবে কৌড়ির কথাটা মাথায় ছিলোনা।হসপিটালের মোটামুটি বাড়ির সবার যাওয়া আসা চললেও,কৌড়ির যে একবারও সেখানে পা পড়েনি।আর সেটা নিয়েই তবে তার দাদাভাই ক্ষেপেছে!রুমের এই ছেলেমানুষী লন্ডভন্ড তছনছ কাহিনী করে চলেছে।এই বুঝি তার আগের সেই দাদাভাই!কাওকে মন থেকে পাওয়ার তীব্রতা বুঝি ব্যাক্তিত্ববান মানুষটাকেও বুঝি ব্যাক্তিত্বহীন করে দেয়?
ছেলেমানুষী বানিয়ে দেয়?আশ্চর্য।এতো শক্তকঠিন ব্যাক্তিত্বপূর্ন দাদাভাইও, সেই চাওয়ার কাছে হার মেনে গেলো।

‘এতো অভিযোগ?এতো অভিমান?তুমি ওকে পেয়ে গেলে কলিজায় লুকিয়ে রাখবে দেখছি!

এবারও উত্তর দিলোনা নিভান।চোখ বুঁজে নিলো।বদ্ধ নয়নে ভেসে উঠলো,মায়া-মায়া সেই টলমলানো হরিনী নজর।গোলগাল ফর্সা লালাভ মুখ।তাকে কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য বলতে যাওয়া কাঁপানো ঠোঁট।ওই বিষাদ নজর,লালাভ মুখ,কাঁপানো ঠোঁট।সব তার কথার ব্যথায় অস্বাভাবিক হয়েছে।কষ্ট দিয়েছে সে মেয়েটাকে!ভিতরের জ্বলনটা আবারও দপদপ করে উঠলো।তবুও নজর খুললো না। ইভান ফের বললো।

‘ও পরিস্থিতির স্বীকার। ওর উপর রাগ দেখিয়ে লাভ আছে?তুমি ওর পরিস্থিতিটা বুঝবেনা?বাড়ির সবাই তো আর আমার মতো জানেনা,ওই মেয়েটাতে তুমি কি অনুভব করো।সে তোমার কি!জানলে নিশ্চয় তোমার কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করতো।জানে-না বলে,ভেবেছে ওর হসপিটালে গিয়ে কাজ কি?আর ও-ও হয়তো কাওকে বলতে পারি-নি নিজের মনের কথা,তোমাকে দেখতে যেতে চায়।ওকে তো তুমি ভালো করেই চেনো এবং জানো।তবুও অভিযোগ কেনো?

কন্ঠ শান্ত অথচ স্বরে অভিমান ভরা।–ওর কাছে ফোন ছিল ইভান।আর সেই ফোনে আমার নাম্বারটাও ছিলো।যেটা আমি নিজ হাতে সেভ করে দিয়েছিলাম।ও আমাকে একটা ফোন দিতে পারতো না?পারতো না?

শান্ত গলায় কথাগুলো বললেও,কথার মধ্যে যেনো হাজার আকুলতা,অভিমানে টইটম্বুর।তবু-ও কৌড়ির হয়ে সাফাই গাইলো ইভান।

‘তুমিতো ওকে খুব ভালো করে এতোদিনে জেনে গেছো দাদাভাই।মেয়েটা কেমন স্বভাবের।আর জেনেবুঝে-ও অভিযোগ করবে?

‘জানিনা ওকে জেনেশুনেও কেনো ওর প্রতি অভিযোগ জন্মালো।ও বলেই হয়তো অভিযোগ।ও হসপিটালে যেতে পারিনি,ঠিক আছে।কিন্তু ,আমাকে তো একটাবার ফোন দিতে পারতো?আমার ভালোমন্দ জানার প্রয়োজন ছিলোনা।শুধু একটা বার ফোন দিতো।আমি ওর উপস্থিতি হোক বা ফোনকলের অপেক্ষায় ছিলাম ইভান।ও কেনো একটু বুঝলো না, আমার দূর্বলতা।আমার একটুখানি ওকে দেখার তীব্রতা!আমি যখন এক্সিডেন্ট করলাম,আমার মনে হচ্ছিলো।আমার বুঝি ওর কাছে আর কখনো ফেরা হবেনা।সেই তৃষ্ণা নিয়েই আমি মরতে মরতে বেঁচে গেলাম।তারপর বেঁচে গিয়েও, ও কি আমাকে একটু একটু করে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে-না?

‘হাম তেরি মোহাব্বতমে ইউ পাগল রেহতি-হে,
‘দিয়াওনাভি আব হামকো দিয়াওনা কেহতা-হে।

মজার ছলে দারুণ কন্ঠে গানের কলিজোড়া গেয়ে উঠলো ইভান।ফের ঠোঁটে চমৎকার হাসি ফুটিয়ে পাশ ফিরে তাকালো নিভানের পানে।নিভান তখনো চোখ বুঁজে। ইভানের গানের শব্দগুলো তাকো উল্লেখ্য করে গাওয়া বুঝতে অসুবিধা হলোনা।প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে।সেভাবেই চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো।অনুভব করার চেষ্টা করলো,নিজের মধ্যে অন্য কারও অস্তিত্বকে।ইভান খেয়ালী নজরে বেশ কিছুক্ষণ নিভানকে পর্যবেক্ষণ করে চঞ্চলা গলায় বললো।

‘দু’দিন পর মেয়েটার পরিক্ষা।এমনিতেই প্রেশারে আছে।সারাদিন তাকে বইয়ের টেবিলে ছাড়া দেখা যায়না।আর আমার অতি ধৈর্য্যশীল,বুঝদার দাদাভাই,তার পাগলামী মেয়েটার উপর প্রয়োগ করে মেয়েটার প্রেশার দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে!মানা যায়?তুমি অবুঝপনা করেছো? সত্যি মানতে পারছিনা!

নিভান এবারও উত্তর দিলোনা। চুপচাপ সেভাবেই রইলো।ইভান-ও আর কথা বাড়ালো-না।সে-ও নিশ্চুপ হয়ে গেলো।সময় চললো।নীরবতায় ছেয়ে গেলো বিশাল বড়ো রুমটায়।চারপাশটা কেমন শুনশান নিস্তব্ধতা।বেশ সময় কেটে যাওয়ার পর ইভান উঠে বসলো।বসে থেকেও কিছুসময় ব্যয় করলো।ফের উঠে দাড়ালো।
কাঁচের টুকরো লক্ষ্য করে পা বাঁচিয়ে যেতেযেতে শিথিল গলায় বললো।

‘প্রানপাখি উড়াল দেওয়ার আগে নিজের অনুভূতির কাছে তাকে আঁটকে দাও।না-হলে আমার মতো ভুগতে হবে,পুড়তে হবে।জ্বলতে হবে!এই ভোগ,এই পোড়া,এই জ্বলন,খুব যন্ত্রণার দাদাভাই।শেষ করে দেবে তোমাকে।

চলে গেলো ইভান।হঠাৎ মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো নিভানের।এক্সিডেন্টে মাথায় আঘাতটা লেগেছে বেশি।তবে সেই ব্যথা জেগেছে,নাকি ইভানের কথায় নতুন ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে?

পূর্ব আকাশে নতুন আরও একটিদিনের সূচনা দিয়ে সূর্য উদিত হোলো।কি অপরূপ তার ঝলমলে রূপ।তেমনই রূপের প্রশংসা পেয়েছে কৌড়িও।অথচ সেই ঝলমলে রূপে যেনো আজ ঘোর আমাবস্যা নেমেছে।ডায়নিং টেবিলে চুপচাপ খাচ্ছে সে।খাচ্ছে কম,হাত দিয়ে খাবার ঘাটছে বেশি।কাল বিকালের ওই ঘটনার পর না ঠিকঠাক মতো গলা দিয়ে খাবার নামাতে পেরেছে আর না বইয়ে মনোযোগ দিতে পেরেছে আর-না দু’চোখে ঘুম নেমেছে তার।ওই চুপচাপ শান্তশিষ্ট মানুষটা শুধু তারজন্য এতো পাগলামি করলো!এতো রেগে গেলো!
কাল যেনো কৌড়ির মনকে ধরেবেধে রোধ করে রাখার সব সীমা ছাড়িয়ে ফেললো।ভাবনায় বিভোর কৌড়ি হঠাৎ সুপরিচিত সুগন্ধে মুখ উচু করে তাকলো।হুম,সেই মানুষটাই।আজ আর কৌড়ির নজর নামলোনা।অনিমেষ চেয়ে রইলো,কপালে সাদা ব্যান্ডেজ জড়ানো শ্যামবর্ণ মুখে।নিভান এসে আশেপাশে না তাকিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।শান্ত গলায় ডাক দিলো রানিকে।

‘রানিসাহেবা,আমাকে কফি দিন।

রানির বদৌলে তড়িৎ রানাঘর থেকে বের হয়ে এলো স্বান্তনা রহমান।ব্যস্ত গলায় বললেন—তুই কেনো অসুস্থ শরীর নিয়ে নিচে নেমে এলি।ভাবী,তোর খাবার রেডি করে রেখেছেন।ভাইয়ের খাবারটা দিয়ে এসেই,তবে তোর খাবারটা নিয়ে উপরে যাবেন।তার আগেই চলে এলি?

‘সমস্যা নেই,শরীর ঠিক আছে আমার ছোটোমা।খাবার দিতে হবে-না।এককাপ কফি বা চা হলেই আপতত চলছে।

কন্ঠে কোমলতা মিশিয়ে স্বান্তনা রহমান বললেন–অসুস্থ শরীরে খাবার না খেয়ে এখন চা, কফি খাবি?খাবারটা এখন খুব প্রয়োজন। খাবারটা খেয়ে তারপর না-হয় চা,কফি খা।

নিভানও খুব স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলো।—খাবার খেতে এখন ইচ্ছে করছেনা ছোটোমা।

‘ঔষধ আছে তো।নরমাল নয় সব হাই-পাওয়ারের।না খেলে চলবে!

‘ খাবারটা পরে না-হয় খাচ্ছি।আপতত আমাকে এককাপ কফি দিন।

স্বান্তনা রহমান আর কিছু বললেন-না।চলে গেলেন।যেতে গিয়ে কিছু একটা খেয়াল করে পিছু মুড়ে কৌড়ির পানে তাকালেন তিনি।অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলেন।কৌড়ি ঘনোঘনো নজর উঠিয়ে নিভানকে দেখছে।অথচ নিভানের নিরেট দৃষ্টি,তার হাতে থাকা ফোনে।অদ্ভুত!বেশ কয়েকদিন এই বিষয়টা নিভানকে খেয়াল করেছেন তিনি।তখন কৌড়িকে দেখেছে উল্টো।আজ দু’জন দুজনের বিপরীত।ব্যাপার টা কি? চলছেটা কি এদের মধ্যে?মনে প্রশ্ন নিয়ে চলে গেলেন।তিনি রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন,রানী কফির জন্য দুধ অলরেডি বসিয়ে দিয়েছে।এরপর তিনি নিজ হাতে কফি বানালেন।কফি বানানো শেষ হতেই,নিভানের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা মগটায় ঢেলে ট্রে-তে গুছিয়ে দিলেন।রানী সেটা হাতে নেওয়ার আগেই কিছু একটা ভেবে তাকে থামিয়ে দিলেন।রানী প্রশ্নবোধক নজরে তাকাতেই তিনি চোখ দিয়ে ইশারা করে বললেন পরে বলছেন।ফের কৌড়িকে গলা চড়িয়ে ডাক দিলেন।

‘এই কৌড়ি,নিভানের কফিটা একটু নিয়ে যা তো।

খাওয়া থেমে গেলো কৌড়ির।নিভানের পানে আবারও আড়চোখে চাইলো সে।আজ ভুলেও মানুষটা তারদিকে একবারও তাকায়নি।অথচওই মানুষটার দ্বিধাহীন নজর তাকে ঘিরে থাকে।অমাবস্যার ঘোর অমানিশি বুঝি এবার মনের চারধারে ছেয়ে গেলো।স্বান্তনা রহমানের ডাকে উঠার জন্য প্রস্তুতি নিতেই,নিভান ভরাট গলায় বললো।

‘ছোটোমা,কফিটা রানিসাহেবাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিন।তাকে খাবার ছেড়ে উঠতে হবেনা।

খুব স্বাভাবিক গলায় কথাটা বললো নিভান।অথচ কৌড়ির কানে সেটা অস্বাভাবিক লাগলো।আর তার চেয়ে অস্বাভাবিক লাগলো, সামনে বসা মানুষটার আচারণ।পলকহীন চোখে নিভানের দিকে চেয়ে রইলো কৌড়ি।অথচ মানুষটার খেয়াল ধ্যান হাতের ফোনেই।ধ্যানতো আর দিকে থাক এটাতো চায়নি কৌড়ি।তবে কেনো মন কাঁদছে।স্বান্তনা রহমান কি বুঝলেন, রানীকে দিয়ে কফি পাঠিয়ে দিলেন।রানী এসে কফি দিয়ে গেলো।সেটা তুলে মুখে নিলো নিভান।অদ্ভুত শান্ত নজরে মাথা নিচুকরে,হাত দিয়ে খাবার ঘেঁটে যাওয়া কৌড়িকে খুব কৌশলে একবার দেখে নিলো।সুক্ষ হাসলো ফের সে হাসি মূহুর্তেই ঠোঁটের ভাঁজে মিলিয়ে নিয়ে মনেমনে আওড়ালো।

‘শাস্তি পাচ্ছো তুমি।একটু সময় দাও আমাকে,অপেক্ষা করো।এই শাস্তির বিনিময়ে নিভান তোমাকে তার নিজের এতো কাছে আনবে,তুমি নিজেই আর দুরত্ব চাইবে-না।তখন এই শাস্তির বদৌলে নিভান তোমাকে এক সমগ্র পৃথিবী সুখ দেবে।অজস্র ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে,নিভানের প্রানপাখি।

চলবে…

#ফুলকৌড়ি
(৩৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

গাঢ় শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর।চারপাশটা ঠান্ডায় যবুথবু অবস্থা।ক্ষনে ক্ষনে যেনো হাত-পা বরফ হয়ে আসছে।সেই হীম-পড়া শীতের ভোরে বাড়ি থেকে রেডি হয়ে বের হচ্ছে কৌড়ি।শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়।আজ থেকে তার ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষা শুরু।এবাাড়ি থেকেই নিজ গ্রামে গিয়েই পরিক্ষা দিতে হবে তাকে।আর যাওয়ার উদ্দেশ্যে এই শীতের হিমশীতল সকালে তাকে রওনা হতে হচ্ছে।অথচ বাড়িতে থাকলে সবকিছু কতো সহজ হতো তার।নিরাপদ জার্নি হতো।সময়-মতো সুন্দর সুস্থ মস্তিষ্কে গুছিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে পরিক্ষা দিতে যেতে পারতো।না টেনশন থাকতো,এতো জার্নি করে ঠিকমতো সময় কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারবে কি-না?আর না মানসিকভাবে তাকে এতোটা এলোমেলো থাকতে হতো!আফসোস নিজের বাড়ি-ঘর সব থাকতেও কতোদূর থেকে জার্নি করে তাকে পরিক্ষা দিতে হচ্ছে।
আবার মাথার মধ্যে চতুর্দিকের ভাবনায় ছড়ানো-ছিটানো।তন্মধ্যে সব ভাবনার মুল হয়ে দাঁড়িয়েছে,সেই মানুষটাকে নিয়ে।

‘খেয়ে গেলিনা!তবে আমি ইভানকে বলে দিয়েছি,একটু বেলা হলেই যেনো তোর খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়।

কথাটা বলে তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন।—আমি খাবার দিয়ে দেবো?নিবি?

নীহারিকা বেগমের কথায় ভাবনা কাটলো কৌড়ির।স্মিথ হাসলো।অমায়িক স্বভাবের অসম্ভব অদ্ভুত ভালো এই নারীটা এই তিনমাসের মধ্যে কতো আপন হয়ে গেছে।আপন হয়ে গেছে কোথায়,তাকে আপন করে নিয়েছে মানুষটা।কেমন নিজ সন্তানের মতো আপন।নীহারিকা বেগমের গলা জড়িয়ে ধরলো কৌড়ি।ফের বিগলিত বিনয়ী গলায় বললো।

‘এতো সকালে খাওয়া যায়,নাকি খেতে ভালো লাগে?আর পরিক্ষার টেনশনে আমার মাথাসহ পেটটাও ভরা।একটুও খেতে ইচ্ছে করছেনা বড়মা।তাই খাবার দিয়ে নষ্ট করো না।আমার ক্ষুধা লাগলে আমি অবশ্যই ইভান ভাইয়াকে বলে কিছু একটা কিনে খেয়ে নেবো।তাই অযথা টেনশন নিওনা তুমি।আর খাবারও দেয়া লাগবে না।তুমি শুধু দোয়া করো,আমার পরিক্ষাটা ভালো হয় যেনো।

‘অযথা টেনশন?তোরা সন্তানেরা যে কবে বুঝবি বাবা মায়েদের এই অযথা টেনশন ঠিক কি?যাই হোক, নিজেরা মা বাবা হ তারপর ঠিকই বুঝবি মা বাবাদের এই অযথা টেনশন ঠিক কি?আর ইভানকে বলে বাহিরে খেয়ে নিবি কতো,সে তো আমি জানি!তোকে চিনিনা বুঝি!তবে বেলা হলে আমি ফোন দিয়ে ইভানকে খাবার কিনে দেওয়ার জন্য বলে দেবো।এবার বের হ,দেরী হয়ে যাবে।রাস্তাঘাটে কতো জ্যাম থাকে।যতো সকাল সকাল বের হবি ততোই ভালো।

ফের নিজের থেকে কৌড়িকে ছাড়িয়ে,মমতার নজরে তারদিকে তাকালেন তিনি।আঙুল ছুয়ে দিলেন কৌড়ির গালে ফের মায়ামায়া আদূরে গলায় বললেন।–আর দোয়া।সে তো আমার পেটের সন্তান,আমার পিঠের সন্তান, আমার আগলে রাখা সন্তান,আমার নিয়ন্ত্রাধীন সকল সন্তানদের জন্য সর্বসময়ে তাদের ভালোটা আমার মনস্তাত্ত্বিকে জপতে থাকে।আমার দোয়ায় সবসময় আমার বাচ্চারা ভালো থাকুকু,ভালো রাখুক ওদের প্রভু,মঙ্গল হোক, এই কামনায় থাকে।আর মায়ের দোয়া প্রভু সহজে বিফলে ফেলেননা,তোর পরিক্ষাও আল্লাহর রহমতে ভালো হবে।একদম টেনশন নিবিনা,কেমন?

বিমোহিত নজরে এতোসময় সামনের নারীটাকে দেখছিল কৌড়ি।এতো ভোরে,এই ঠান্ডায় কেউ এখনো উঠেনি।উঠেনি বলতে ভুল,উঠেছিলো।নামাজী ব্যাক্তিগন উঠে নামাজ পড়ে নিয়ে আবার শুয়েছে।শোয়ারই তো কথা।এতো সকালে এতো ঠান্ডায় কেউ কি আর নিজেদের আরাম বাদ দিয়ে জেগে বসে থাকবে।থাকার কথা নয়!অথচ এই মমতাময়ী নারীটা উঠে তার সবকিছু গুছিয়ে রেডি করে দিলো।খাবার না খেলেও,চা নাস্তা না খাইয়ে ছাড়িনি।কি অদ্ভুত সম্পর্ক।নেই রক্তের টান,নেই আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক।অথচ দূরের একটা সূত্র ধরে কতো মায়াময় এই সম্পর্ক।যেনো রক্ত নয়,আত্মীয়তাী নয় আত্মার সম্পর্ক।আত্মার টান।আর সেই আত্মার টানেই বুঝি বাধতে চেয়েছিলো,ওই মানুষটা তাকে।অথচ!হঠাৎই মন খারাপ হলো কৌড়ির। ড্রয়িংরুমে জ্বলতে থাকা বড় ঝকঝকা লাইটের আলোয় চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে আসলো,আশপাশ দিয়ে উপরনিচ সব জায়গায়।শূন্য!কেথাও কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই।আবারও উপরের দোতলার কাঙ্ক্ষিত রুমটার দিকে নজর দিলো কৌড়ি।নিঃশব্দ রুম।মনটা আরও বেজায় খারাপ হলো কৌড়ির।আজ চারটাদিন!
মানুষটা যে নীরব আচারন করছে তারসাথে,সেটা কি কখনো মানুষটার থেকে আশা করেছিলো সে।নাকি চেয়েছিলো তার মন?এই যে সে পরিক্ষা দেবে,সবাই তাকে কতো সাহস যোগাচ্ছে,কতো ভালোমন্দ কথা বলছে অথচ ওই মানুষটা তার ব্যাপারে কি নির্বিকার।সেই আগের মতো নির্জীব।বাড়িতে আছে।দু’বেলা তারসাথে দেখা হচ্ছে, অথচ না আগের মতো কথা বলার আগ্রহ দেখাচ্ছে!আর না তাকে দেখলে সেই দ্বিধাহীন নজরে তাকিয়ে থাকছে, আর না শুধুই তাকে খেয়াল করে মুগ্ধ নজরে দেখছে!যদিও এসব চায়নি চায়নি কৌড়ি।তবে তারপ্রতি অনাগ্রহী হোক এটাও তো মন চায়নি তার। এই অনাগ্রহতা সহ্য হচ্ছে না তার।মন পুড়ছে। ভালো লাগছে কিছু।সবকিছু যেনো বিষাদময় লাগছে।

‘কি হলো।যেতে হবে তো।থমকে দাঁড়িয়ে রইলি যে?

চমকাল কৌড়ি।মূহুর্তেই আবার নিজেকে সামলিয়ে নিলো।ভিতরে ভিতর দীর্ঘশ্বাস ফেলে জোরপূর্বক মুখে মৃদু হাসি টেনে বললো-কাওকে তো বলে যেতে পারলাম না।খারাপ লাগছে।

‘সবাই তো ঘুমে।এখন তুই নিশ্চয় এটা চাইছিস না,এই ঠান্ডায় সবাইকে ডেকে তুলে বলে যেতে।

কৌড়ি তড়িৎ মাথা নাড়ালো।ফের মুখে বললোো–না। কখনো না।

‘তবে ভেবেচিন্তে লাভ আছে?আর না মন খারাপ করে লাভ আছে?মন খারাপ করিসনা,সবাই ঘুমথেকে উঠলে দেখবি তোরসাথে যোগাযোগ করে নিয়েছে।তখন দোয়া চেয়ে নিস।

ভিতরে ভিতরে আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কৌড়ি।মুখের মৃদু হাসিটা একটু প্রসারিত করে বললো–আচ্ছা। তবে যাই।

তড়িৎ কথা ধরলেন নীহারিকা বেগম।মিষ্টি ধমক দিয়ে বললেন–যাই কি!যাই বলতে নেই।বল আসি।আর খবরদার পরিক্ষা দিতে যাচ্ছো ভালো কথা,ওবাড়িতে থাকার চিন্তাভাবনা করবেনা কিন্তু একদম।দাদীআপা বলেছে,পরিক্ষার কেন্দ্রে এসে দেখা করে যাবেন।সেখান থেকেই দেখা করে কিন্তু চলে আসবে।বাড়িতে গিয়ে থাকার চিন্তা ভাবনা করবেনা একদম!ঠিক আছে?

সহসা কৌড়ি উত্তর দিতে পারলে।আজ কতোদিন বাদে সে নিজের শহরে পা দিচ্ছে!কতো পরিচিত অপরিচিত মানুষের সাথে দেখা হবে।নিজের শহরের রাস্তাঘাটা গাছপালা,আকাশ!আপন বাতাস!উফফ,কতোগুলো দিন পর দেখবে সে।ভাবনা মূহুর্তেই অন্যদিকে চলে গেলো তার।নীহারিকা বেগমকে বিদায় জানিয়ে লন এরিয়াতে গিয়ে দেখলো,শীতের ভারী জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে ইভান গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাতে হাত ঘেঁষে চলেছে।মূহুর্তেই মনটা আবার-ও খারাপ হয়ে গেলো।বিচিত্র মন,অদ্ভুত এক আশা করেছিলো।তা বুঝি আশাতেই রয়ে গেলো।দোষ আর আশার কোথায়!দোষটা তো তার নিজের।পথটা তো সেইই এলোমেলো করে দিয়েছে।তবে আকাঙ্ক্ষিত মন কেনো আবার উল্টো পাল্টা চাইবে?আশা করবে?তবে পাগল মনটা সেটা বুঝলে তো।অবুঝ মনটা তো বলছে ওই মানুষটা তাকে কিছুতেই অবজ্ঞা করতে পারে না!কেনো জানি মানুষটার আচারনে,অদ্ভুত পাগলামোতে এই বিশ্বাসটা দৃঢ়রূপে মনে জন্মে গেছে তার।সেই মনোবলে কিছু একটা ভেবে আবারও পিছে ফিরলো সে।কুয়াশায় ঘিরে থাকা দোতলা বাড়িটা নিস্তব্ধ।দোতলার লন এরিয়ার দিকের বেলকনিগুলোও কেমন শূন্য, নিস্তব্ধ,নীরব।ঘুরেফিরে আরও একবার সেই কাঙ্ক্ষিত খোলা,স্তব্ধ বেলকনির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এগোলো কৌড়ি।মূহুর্তেই বেলকনিতে পা রাখলো নিভান।এলোমেলো চুল।ফুলোফুলো চোখ।ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে চেয়ে রইলো কৌড়ির গমন পথে।মেয়েটার গায়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো সেই শালটা।মুখের হাসিটা যেনো আরও একটু প্রসারিত হলো নিভানের।দু-হাত ট্রাউজারের দুপকেটে গুঁজে বেশ নির্বিকার শান্ত নজরে কৌড়ির গাড়িতে উঠা দেখলো।ফের চমৎকার মৃদু হাসিটা ঠোঁটটা ছেয়ে,মৃদুস্বরে আওড়ালো।

‘বেস্ট অপ লাক,মাই ডিয়ার।

শব্দটা মুখ আওড়ে কিছু সময় নিশ্চুপ থাকলো।নজর স্হির রাখলো এরিয়ার কালো গাড়িটার খোলা জানালায়পানে।সুগভীর নজর খুব সুক্ষ ভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করে ঠোঁট মৃদুস্বরে আওড়ালো।–কষ্ট পাচ্ছো!আমার চেয়েও বেশি কি!ভাবছো, নিভান রাগে জেদে পড়ে তোমাকে আর চাইছে না বা চাইবে না সে?তোমার প্রতি সে আর আগ্রহ পাচ্ছে না?যদি এই ভাবনা মনে পুষে থাকো,তবে খুব ভুল ভাবছো।তুমি জানো-না! তোমাকে পাওয়ার আগ্রহ, ইচ্ছে নিভান ইহকালে-ও ছাড়বে না।ছাড়া সম্ভব নয় নিভানের।বরং তোমাকে পাওয়ার আগ্রটা নিভানের বেড়েছে।দিনকে দিন সেই বেড়ে চলা আগ্রহের তীব্রতা নেশাদ্রব্যের মতো শুধুই হ্রাস পেয়ে চলেছে।আর তোমাকে চাইছেনা বা চাইবে না নিভান!তবে নিভানের আগামী বেঁচে থাকার দিনগুলো চলবে কি করে?তুমি জানো কি!নিভান তোমাকে চাইছে,তার প্রতি নিঃশব্দের নিঃশ্বাসে।শুধু তোমাকেই তার করে পাবার জন্য চেয়ে চলেছে সে।এন্ড ডু ইউ বিলিভ মি, নিভান তোমাকে বিন্দু পরিমান কষ্ট পেতে দিতে চায়নি।

নিভানের শান্ত নজরটা এখনো লন এরিয়ার কালো রঙের গাড়িটার খোলা জানালায়।ফ্রন্ট সিটে চুপচাপ বসে আছে কৌড়ি।ইভান যেনো কিছু গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত।গাড়ির ভিতরে ঢোকেনি এখনো সে।কানে ফোন, সঙ্গে কারও সাথে ফোনালাপ চলছে তার।কিছু একটা মনে পড়তেই নড়েচড়ে দাড়ালো।ঘরে ফিরবে ভেবে ফের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নজর দিলো আবারও।ভুলেও এদিকওদিক তাকাচ্ছে না কৌড়ি।মাথা নিচুকরে হাতের দিকে তাকিয়ে বসে আছে মনেহচ্ছে। মন খুব খারাপ তাহার তবে!কারণটা সে আচ্ করতে পেরে আবার-ও অদ্ভুত হাসিতে ছেয়ে গেলো নিভানের ঠোঁট।স্পষ্ট স্বরে গান না গাইলেও গুনগুনিয়ে সুর তুললো।

Ishq bhi tu hai pyar bhi tu hai
Tu hi meri mohabbat hai
Saans mein teri saans mein le loon
Teri agar ijazat hai

গুনগুনানোর সুরটা বাড়িয়ে পা বাড়ালো রুম।বেডের পাশের ল্যাম্পটেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে ধপ করে আধশোয়া হয়ে পড়লো বেডে।ফের ইভানের হোয়াটসঅ্যাপ আইডিতে ঢুকলো।সেকেন্ডের মধ্যে দক্ষ হাতে টাইপ করলো।

‘সাবধানে নিয়ে যাবি।

সেন্ড করতেই সঙ্গে সঙ্গে দুটো টিকচিহ্নে গোলাকর ঘরটা পূর্ন হয়ে গেলো।তারমানে ইভানের ফোনে কথা বলা শেষ।মূহুর্তেই রিপ্লাই এলো।

‘যথা আজ্ঞা বড়ো সাহেব।তোমার মতো দক্ষ ড্রাইভার নই,তবে আমি জানি, আমি আমার দাদাভাইয়ের জান, কলিজা,প্রানপাখি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি।আর তাকে কিভাবে নিয়ে যেতে হবে,রাখতে হবে।সেটাও খুব ভালো করে জানি।সো,আমার প্রতি বিশ্বাস ভরসা রাখতেই পারো।

ঠোঁটের মৃদু হাসিটা বিস্তৃত হলো নিভানের।মেসেজে লেখা শব্দগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎক্ষন।ফের পুনরায় মেসেজ আসতেই সেদিকে নজর দিলো– আমার জায়গায়,তোমার যেতে ইচ্ছে করছেনা?

সুগভীর শান্ত চোখ দুটো মেসেজের শব্দগুলোয় আঁটকে রইলো।ফের সময় নিয়ে উত্তর দিলো।–অমূল্য কিছু পেতে গেলে কিছু ইচ্ছেদের বিসর্জন দিতে হয়।মনের ছোটো ছোটো চাওয়া পাওয়া ছাড়তে ইচ্ছে না করলেও ছাড়তে হয়।তাতে মঙ্গলজনক কিছু পাওয়ার সম্ভবনা থাকে।

মেসেজ দেখে চমৎকার হাসলো ইভান।ফের মজার ছলে রিপ্লাই দিলো।–‘তোমার মনে হয়না,তুমি রোমিও টাইপ প্রেমিক হয়ে গেছো?

মেসেজ দেখলো নিভান।তবে মেসেজের উত্তর না দিয়ে লিখলো।–দেরী হয়ে যাচ্ছে।গাড়ী ছাড়।আর সাবধান, খুব সতর্কতার সহিত গাড়ি চালাবি।আর কোনো সমস্যা হলে সেকেন্ড সময় অপব্যয় করবিনা,আমাকে জানাবি।

ফোনের সময়ের দিকে তাকালো ইভান।ভাবলো আসলে আর সময় ব্যয় করা উচিত হবেনা।নিভানকে বিদায় জানিয়ে ফোন রেখে উচ্ছল মুখে একবার কৌড়ির দিকে তাকলাো।মেয়েটা চুপচাপ,শান্ত হয়ে বসে আছে।নজর তার ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন বাগানের দিকে।

‘কি মন খারাপ?

একটু চমকে ইভানের পানে তাকালো কৌড়ি। সময় নিয়ে মুখে জোরপূর্বক মৃদু হাসি টেনে সহসা মাথা নাড়ালো।মুখে কিছু বললোনা।মৃদু হাসলো ইভান।ফের বললো—তবে আমার জায়গায় দাদাভাইকে আশা করোনি,বলছো?

ধ্বক করে বুকের ভিতরে ধাক্কা দিয়ে উঠলো।সেই ধাক্কার ঢেউয়ে নোনাজ্বল এসে ভীড় করতে চাইলো চোখে।তবে তা সফল হতে দিলোনা কৌড়ি।কারনে হোক বা অকারনে এরকম ছিচকাদুনি মেয়ে তো সে কখনোই ছিলো-না।তবে ইদানীং কথায় কথায় কেনো মন খারাপ হয়!আর তার রেশ কাটাতেই চোখে নোনাজল ভরে যায়।কেনো?শান্ত নজর এলোমেলো হলো কৌড়ির।নিজেকে যতসম্ভব ঠিক রাখার প্রয়াস চালিয়ে বললো।

‘আপনার যেতে ইচ্ছে না করলে,হাফিজ ভাইকে পৌঁছে দিতে বলতেন।আমার কিন্তু উনার সাথে যেতে কোনো অসুবিধা হতো না।উনিও কিন্তু নিজের বোনের মতো যথেষ্ট খেয়াল রাখেন আমার।

আসলে মেয়েরা অদ্ভুত হয়,মনে এক কথা আর মুখে তাদের আরেক কথা।অথচ অভিমানী চোখ,গলার স্বর বলে দেয় ভিতরের কথা।অন্তরের জপে চলা কথা।কৌড়ির কথার উত্তরসরূপ ভিন্নবাক্য ছুড়লো ইভান।বললো।-‘দাদাভাই কে তুমি একবার বললে সে কিন্তু এই অসুস্থ অবস্থায়ও তোমাকে নিয়ে যেতে দ্বিতীয়বার ভাবতো না।

অভিমানের প্রগাঢ়তায় ছেয়ে গেলো মন।জপে উঠলো সে,’বলতে হবে কেনো।তিনি এতো বুঝদার,আর তার বেলায় এসে অবুঝ হয়ে গেলেন!অবুঝপনা শুধু তার বেলায় কেনো? মনেমনে যে অভিমান জমলো,সেই অভিমান কথার স্বরেও ছড়ালো সে।বাহিরের পানে নজর স্থির রেখে বললো।

‘দেরী হয়ে যাচ্ছে ইভান ভাইয়া।গাড়ী ছাড়ুন।

সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ী ছাড়লো ইভান।মেয়ে মানুষ বলতে তার সৃষ্টির জটিল জীব মনেহয়।তাদের মন বোঝা যে কতো কঠিন, এটা ইভান হাড়হাড়ে টের পেয়েছে।তন্ময়ীকে পেতে তার যা বেগ পোহাতে হয়েছে।
তারচেয়ে সাত রাজার ধন জয় করা সহজ মনে হয়েছে।আর এবার বুঝি দাদাভাইয়ের পালা।

নিজের অফিস কক্ষে বসে আছে নিভান।ফর্মাল ড্রেসআপে থাকলেও মাথায় এখনো সাদা গোলাকার সেই পট্টি জড়ানো।এই অসুস্থ অবস্থায়ও তাকে ইমার্জেন্সি অফিসে আসতে হয়েছে।সেটা নিয়ে মা- কতো হম্বিতম্বি করলেন।অফিস গোল্লায় যায় যাক।তুই এই অবস্থায় কিছুতেই বাড়ি থেকে বের হতে পারবিনা। সম্পূর্ণ সুস্থ হবি তারপর বাড়ির বাহিরে আর অফিস!এরআগে কোনো কিছু নয়।আর অফিস-টফিস তো নয়ই।আরও কতো কি?বাড়ির মোটামুটি সবাই তাতে ইন্ধন জোগালো।বাধ্য হয়ে না পেরে ছোটো চাচ্চু ক্লায়েন্টের সাথে কথা বললেন।যাদের জন্য নিভানকে অফিস যেতে হবে।অনেক বুঝিয়ে কথা বলেও কাজ হলো-না।তারা নিভান ছাড়া ডিল মানতে রাজী নয়।
বিধায় মা’কে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাধ্য হয়ে তারপর তাকে অফিসে আসতে হয়েছে।ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং শুরু হবে একটু পরে।অফিসে এসে নিজকক্ষে বসে নিজের পি-এ মৃদুল এবং শাহেদ সাহেবের সাথে,অফিস বিষয়ক কথা বললো কিছুক্ষণ। তারপর তারা নিজ দায়িত্বে চলে যেতেই মূহুর্তেই মাথায় এলো কৌড়ি।যদিও সারাদিন মেয়েটাই ঘুরেফিরে চলেছে তার মাথায়।বিশেষ চিন্তা মেয়েটা বাড়ি ফিরবে কখন?মেয়েটা পরিক্ষার হলে ঢোকার পর আরও দু’বার খোজ নিয়েছে নিভান।সাড়ে বারোটার পর থেকে আর খোজ নেওয়া হয়নি।এখন কয়টা বাজে?মূহুর্তেই হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালো নিভান।প্রায় চারটা।এতোসময় বাড়িতে আসার অর্ধেক পথ মনেহয় চলে এসেছে।একটা খোঁজ নেওয়া দরকার! তখন বাড়ির ঝামেলা মিটিয়ে অফিসে এসে কথা বলতে বলতে কখন এতো বেজে গেলো খেয়াল হয়নি নিভানের।উফফ!তড়িৎ ফোনটা পকেট থেকে বের করলো।ইভান গাড়ী চালাচ্ছে ভেবে ফোনটা দেবে কি-না দ্বিধাদ্বন্দ্ব করেও ফোনটা দিলো।একবার কলে ফোনটা ধরলো না ইভান।বিষয়টা সাধারণ ভাবে নিলো নিভান।দ্বিতীয়বার ফোন দিতেই রয়েসয়ে ফোন ধরলো ইভান।

‘কোথায় তোরা?বাড়িতে পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে?

কথাগুলো বলতে বলতে নিভানের মনে কেমন খটকা তৈরী হলো।রাস্তায় থাকলে তো,যানবাহনের শব্দ হবে।তবে ইভানের আশেপাশে এতো শুনশান কেনো?এতো নীরব।নিভানের কথায় হঠাৎই উত্তর দিতে পারলো-না ইভান।আমতাআমতা করে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো-না।সেটা বুঝে খটকা আরও দৃঢ় হলো নিভানের।সেই অনুযায়ী সহজ গলায় প্রশ্ন ছুড়লো।

‘কোথায় তুই ইভান?

দাদাভাইয়ের তীক্ষ্ণ ব্রেনের কাছে নিজের চালাকি খুবই নগন্য, তাই চালাকি না করে জড়ানো গলায় আমতা আমতা করে বললো– আমরা কৌড়িদের বাড়িতে দাদাভাই।

যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই করলো ইভান।
মূহুর্তেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নিভান।চকমকানো গলায় মৃদু চেচিয়ে বললো–‘হোয়াট?

‘দাদাভাই আমার কথা না শুনে অশান্ত হবে না!প্লিজ দাদাভাই!

অথচ কথা শুনলোনা নিভান।মূহুর্তেই রাগান্বিত গলায় একের পর এক বাক্য ছুড়লো।—‘ইভান,তোরা ওখানে কি করছিস?আমি কি বলেছিলাম তোকে?আর ওরসাথে হাফিজ ভাইও যেতে পারতাে।সেখানে তোকে পাঠিয়েছি আমি।কেনো জানিস না?ও-তো বুঝতে চায়না আমাকে,তুইতো বুঝিস তবুও এই ব্লান্ডারটা কেনো করলি? কেনো ও-কে নিয়ে ওবাড়িতে গিয়েছিস ইভান?

নিভানকে ঠান্ডা করতো ইভান তড়িঘড়ি উত্তর দিলো–
‘দাদীআপা জোর করেছিলেন আসতে,বৃদ্ধা মানুষটা নাতনীকে দেখার জন্য আমাদের যাবার আগেই কেন্দ্রে গিয়ে বসেছিলেন।কৌড়িকে দেখে কতো কাঁদলেন। কৌড়ির পরিক্ষা শেষ হওয়া অব্দি উনি ওখানেই ছিলেন।কৌড়ি পরিক্ষা দিয়ে বের হতেই,ওকে বাড়িতে নিয়ে যাবার আবদার জুড়লেন।আমার কাছে বারবার তাকে নিয়ে যাওয়ার আকুতি করলেন।কৌড়ি-ও যেতে চাইলো।আমি আর না করতে পারি-নি দাদাভাই।আমি তোমার কথা রাখতে পারিনি, স্যরি দাদাভাই।

কিছুটা শান্ত হলো নিভান।ফের কিছু একটা মাথায় আসতেই তড়িৎ কঠিন গলায় বললো– মিথ্যা বলার বা কথা ঢাকার একদম একটুও ট্রায় করবিনা ইভান।শুধু কি দাদিআপা গিয়েছিলো,কৌড়ির পরিক্ষার কেন্দ্রে? নাকি অন্যকেউও?আর তারই আশ্বাসে তাকে বিশ্বাস করে ওবাড়িতে গিয়েছিস তাই না?

গলা শুকিয়ে এলো ইভানের।এই মানুষটাকে এতো তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন আর এতো চালাক হতে কে বলেছিলো!একটু কম হলে পারতো-না।এখন কি বলবে সে?মিথ্যা বলারও উপায় নেই।আর সত্য বললে যে দাদাভাইয়ের মেজাজ আরও তিনগুণ চড়ে যাবে।তাতে খারাপ ছাড়া ভালো তো মোটেই হবেনা!এটা ইভানের বেশ জানা।উফফ!

‘ইভান।নাহিদ নামের ওই ছেলেটাও গিয়েছিলো তাইনা?

নিভানের ভারী গলায় চমকালো ইভান।হৃদপিণ্ডের ধুকপুক তীব্র হলো।প্রানপাখিটা যেনো উড়ে যাওয়ার অবস্থা তার।কেনো যে সবার কথা মেনে এখানে আসতে গেলো।এখন জবাব পেতেই দাদাভাই ক্ষেপে যাবে।আর
দাদাভাই ক্ষেপে গেলে সে হোক বা কৌড়িকে।কারও রক্ষে থাকবেনা।

‘ইভান,আমাট প্রশ্নের উত্তর দে?

‘দাদাভাই প্লিজ।ওকে নিয়ে সুস্থ সমেত বাড়িতে ফিরলে তো হলো?

‘আমার প্রশ্নের যথাযথ এন্সার দে ইভান!

গলা কাঁপলো তবুও সাহস জুগিয়ে উত্তর দিলো ইভান।
‘ হুম মিঃ নাহিদও গিয়েছিলেন। তবে দাদীআপা আশ্বাস দিয়েছেন,উনাকে দেখেও মনে হয়েছে উনি আর আগের মতো নেই।তারদ্বারা কৌড়ির কোনোরূপ ক্ষতি হবেনা,এটা আমারও মন বলছে।

‘মিঃ নাহিদ মাই ফুট।তারদ্বারা কৌড়ির ভালো হোক বা মন্দ।আমি চাইই-না কৌড়ি ওর আশে-পাশেও থাকুক।
সেখানে ও ভালো হয়ে যাক বা মন্দ থাকুক,আই ডোন্ট কেয়ার!কৌড়ি কোথায় ?

নিভানের দাঁতে দাত চেপে রাগান্বিত গলার কথাগুলো শুনলো ইভান।লোকটাকে তারও বিশেষ পছন্দ নয় তবে কি করবে সে।কৌড়ির উপর হক তার বাড়ির মানুষেরই তো বেশি, আগে।সেখানে কোন অধিকারে গলার জোর দেখিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলবে সে?দু-দিন মেয়েটাকে তাদের বাড়িতে রেখেছিলো বলে! দ্বিতীয়ত সত্যিই ছেলেটা-কে দেখে,তার আগের সেই অদ্ভুত চোখ লাললাল নেশাখোর টাইপ আর একগুঁয়ে ছেলেটা বলে মনে হয়নি।অথচ এই ছেলেটার জন্যই কৌড়ির বাড়িছাড়া।নিজ বাড়িঘর ছেড়ে,নিজের বাবার মতো আপনজনের শোকছায়ার দিনে,অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া।

‘ইভান।কৌড়ি কোথায়?

‘ওর একটা ক্লোজ ফ্রেন্ড এসেছিলো,মেয়েটার নাম বিথী। হয়তো তারসাথে কোথাও গল্প করছে।ওদের বাড়িতে একটা পুকুরঘাট ওদিকেই যেতে দেখেছিলাম বেশ কিছুসময় আগে।

‘আমি হোয়াটসঅ্যাপে কল করছি, আমাকে ইমিডিয়েটলি ও-কে দেখা!

ইভানের মনেহলো তার দাদাভাইয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।একটু নয় পুরোটাই গেছে।কৌড়িকে নিয়ে তার দাদাভাই ভিষণ সিরিয়াস,এটা সে ইতিপূর্বে জেনে গিয়েছে।তাই বলে এতো সিরিয়াস।ভাবা যায়?এই তার সেই দাদাভাই,যার চিন্তাভাবনা ছিলো ব্যবসার উন্নতি। হাজারগন্ডা মেয়ে রিজেক্ট করেছে বিয়ের জন্য।সে আপতত বিয়ে করতপ চায়না।আর সেই বান্দা কৌড়িতেই পাগল হয়ে গেলো!তাও একটুআধটু নয়।একেবারে ছন্নছাড়া পাগল পাগলভাব যারে বলে!অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও ইভানের মুখে হাসি ফুটলো।সেই হাসি মিলিয়ে গেলো,নিভানের হোয়াটসঅ্যাপ ফোনকলে।ফোনকল রিসিভ করার আগে আশেপাশে বিশেষ নজর দিলো ইভান।কোনো হৈচৈর উপস্থিতি নেই বাড়িটায়।পুরো বাড়ি নীরব।কৌড়ির চাচাতো ভাইবোনের সংখ্যা নিতান্তই কম।কৌড়ির বাবা বড় ছিলেন,উনার মধ্যেবয়সের একমাত্র সন্তান কৌড়ি।মেজো চাচার এক ছেলে এক মেয়ে।আর তার পরের চাচার দুই ছেলে।তারা নাকি ভিন্ন শহরে পড়াশোনা করছে।বছরে বাড়িতে মেহমানের মতোই আসা-যাওয়া তাদের।তারপরের জনের দুই মেয়ে এক ছেলে।মেয়ে দুজন বিয়ে দিয়েছেন।আর ছেলেটা কৌড়ির বছর খানেক বড়।সেও পড়াশোনা করছে গ্রাম ছেড়ে ভিন্ন শহরে।আর কৌড়ির ছোটো চাচারও দুই ছেলে।তারাও কৌড়ির বড়।আহসান আঙ্কেলের কোনো বোন নেই।সেটা ইভান জানে।বাবার সাথে সেদিন কৌড়ির দাদিআপার ফোনালাপ শুনেছিলো সে।ভদ্রমহিলা সেদিন কান্নারত গলায় বলেছিলেন-আমার একখান মেয়ে থাকলে,ওই ইয়াতিম অভাগী মেয়েটাকে তোমাদের কাছে কি পাঠানো লাগতো?কি দূর্ভাগ্য আমার,একখান মেয়ে নেই।আর ছেলেগুলো যার যার চিন্তায় ব্যস্ত।পরের ঝামেলা তাদের টানার সময় আছে!তাই তোমার আশ্রয়ে পাঠাতে হলো মেয়েটাকে।

বাচ্চাদের হৈচৈ না থাকায়, আশেপাশে চাচাদেরর বাড়িগুলোও নীরব।শান্ত একটা পরিবেশ।তিনজনের থাকার আবাসস্থল হিসাবে কৌড়িদের একতলা বাড়িটা বেশ মোটামুটি।তবে বাড়ি করা ভিটেমাটির অংশবিশেষ একেবারে ছোটো নয়।বড়সড় একটা পুকুরসহ,বিভিন্ন গাছপালায় ভরা বাড়িটা।বিল্ডিংয়ের পাশে ছোটোখাটো টিন দিয়ে ছাওয়া একটা রান্নাঘর।আর সেই রান্নাঘরে বিশেষ রান্নার আয়োজন করছেন কৌড়ির দাদিআপা।সাথে উনার দুই ছেলের বউ আছেন।তাদেরকে বিশেষভাবে ইভান না চিনলেও, কৌড়ি এবাড়িতে ঢুকতেই সবাই কেমন হামলে এসেছিলো।তখন কৌড়ির আলাপে জেনেছে সে।উনারা কৌড়ির চাচিরা।ঘর থেকে বেরিয়ে কাঁচা উঠনে পা রেখে রান্নাঘরের দিকে বিশেষ সতর্ক নজর ফেলে ইভান পুকুরঘাটের দিকে এগোলো।তারআগে ফোনটা রিসিভ করলো।নিভানের গায়ে ফর্মাল ড্রেস দেখেই তড়িৎ কিছু বলতে যাবে তারআগে নিভান বিবশ গলায় বললো।

‘ফোন রিসিভ করতে এতোসময় লাগে ইভান?

নিভানের কথায় ইভান গুরুত্ব না দিয়ে তখনের প্রশ্নটা করলো।

‘তুমি এই অসুস্থ অবস্থায় অফিসে কেনো?

আবারও চেয়ারে গা এলিয়ে হেলান দিয়ে বসে পড়েছে নিভান।সবকিছু নিয়ে মস্তিষ্ক যেনো তার ক্লান্ত।একটু স্বস্তি, শান্তি তার কোথায় মিলবে?সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অদ্ভুত ক্লান্তিময় গলায় বললো।

‘আমি অসুস্থ এটা কি তোদের মাথায় আছে?থাকলে নিশ্চয় এই অবস্থায় আমাকে টেনশনে রাখতে ইচ্ছাকৃত ঝামেলায় জড়াতিস’না।অন্তত একটু স্বস্তি আর শান্তিতে থাকতে দিতিস আমায়।বাই দ্যা ওয়ে,ও-কে দেখা।

ইভান করলো আরেক গাধামি।সামনে না তাকিয়ে নিভানের কথার ধরন দেখে তড়িঘড়ি ব্যাক ক্যামেরা অন করলো।ফোনটা সরাসরি উঁচু করে পুকুরপাড়ের দিকে তাক করতেই তার চোখও চড়কগাছ।থতমত খেয়ে ফোনের স্কিনের দিকে তাকাতেই নিভানকে শান্ত নজরে নিষ্পলক সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে,আত্মাটা ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করা শুরু করলো।দম আঁটকে এলো।হতভম্ব নজর একবার পুকুরের শান বাধনো ঘাটে বসার জায়গায় তো একবার ফোনের স্কিনে নিভানের মুখের দিকে ঘুরতে ফিরতে লাগলো।আজ তারদ্বারা শুধুই ব্লান্ডার হয়ে যাচ্ছে।
দাদাভাইয়ের অতি শান্ত নজর,কঠিন শিথিল মুখাবয়ব!পাক্কা কালবৈশাখী ঝড়ের আগমনী বার্তার পূর্বাভাস দিচ্ছে।উফফ,কি যে লেখা আছে কপালে কে যানে!
ধড়ফড়ানো মনে শুধু একটাই বাক্য আওড়ালো,আল্লাহ মাবুদ রক্ষে করো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে