ফুলকৌড়ি পর্ব-৩৪+৩৫

0
17

#ফুলকৌড়ি
(৩৪)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কম্বলের নিচে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে কৌড়ি।সেটা বুঝে তাকে বুকে জড়িয়ে নিলো মান্যতা। স্নেহের হাত মাথায় বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে থাকলো।তবে মুখে কোনো শব্দ প্রয়োগ করলোনা।কি বলবে আসলে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা।কৌড়ি কি তাহলে সত্যিই দাদাভাইকে পছন্দ করেনা!আর দাদাভাইকে পছন্দ করে-না বলে কি তার যত্নগুলো নিতে চাইছেনা।নাহলে এমন যত্নবান, দায়িত্বশীল পুরুষ কোন মেয়ে না তার জীবনে চায়?আর সেই দায়িত্ববান যত্নবান,খেয়ালী দাদাভাইকেই কৌড়ি চাইছেনা!কিন্ত কেনো?এরকম খেয়ালী ছেলেদের প্রতি তো মেয়েদের মন গলতে সময় লাগেনা।তবে?মান্যতার ভাবনার মাঝেই কৌড়ির ফুপিয়ে বলে উঠলো।

‘উনি আমার সাথে জোরাবাদী করছেন আপু।উনি এমনটা করতে পারেন না!

দীর্ঘশ্বাস ফেললো মান্যতা।ফের নমনীয় কন্ঠে বললো।

‘তুই শুধু দাদাভাইয়ের জোরাবাদিটা দেখলি?তোর প্রতি তার যত্ন খেয়ালটা নজরে পড়লোনা?অনুভব করলি না, তুই নামক মেয়েটাতে সে কতোটা খেয়ালী,দায়িত্ববান
যত্নশীল?তুই মেয়েটাতে সে কি অনুভব করে?না-হলে এতোটা জোর আর অন্য কারও সাথে তাকে কখনো করতে দেখেছিস?এই ধর দীবা আপু।সে অসুস্থ হলো,পড়লো,মরলো কি বাচলো।তাঁর বিষয়ে কখনো দাদাভাইকে কোনো কথা বলতে শুনেছিস,মাথা ঘামাতে দেখেছিস?নাকি এমনটা করতে দেখেছিস?তবে কেনো একটু বুঝতে চাইছিস না,তুই নামক রমনীতে দাদাভাই ঠিক কি অনুভব করে?তুই দাদাভাইয়ের কাছে ঠিক কি?কেনো বুঝতে চাইছিস-না?ওই মানুষটাও যে আপন বলতে খুবই দূর্বল!তাদের সামান্য অসুস্থতায়,কষ্টে যে সে চুপচাপ থাকতে পারেনা।

‘দাদিআপা বারবার বলে দিয়েছেন। রোজ ফোন করলে একবার নয় হাজরবার করে সতর্ক করেন,আমি যেনো এমন কাজ না করি যাতে আমার মৃত বাবা মাকে অসম্মান করা হয়!তাদেরকে অসম্মানিত হতে না দেই।

‘এখানে উনাদেরকে অসম্মানিত করার কি হলো?

‘উনার কথাগুলো মানা মানেই তো উনাকে প্রশ্রয় দেওয়া।আর প্রশয় দেওয়া মানেই তো..

‘মানেই তো মানে কি?কিচ্ছু না।তোর মনেহয় দাদাভাই তেমন ছেলে?উনি কখনো তোরসাথে প্রেমময় সম্পর্কে জড়াবেন না।আর জড়াতে চাইবেনও না।আমার বিশ্বাস, তোর প্রতি যে ধ্যান খেয়াল উনার।উনি স্ত্রী রূপে ছাড়া আর অন্য কোনো রূপে তোকে চাইবেনা।

কৌড়ি মাথায় চুমু খেলো মান্যতা।নিজের সাথে আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে বললো–তুই দাদাভাইয়ের।এটা ওই ব্যক্তিটা যখন পাকাপোক্তভাবে মন থেকে মেনে নিয়েছে,তোকে*ও মানিয়েই ছাড়বে।সে কোনোরূপই।
ছাড় পাবি-না তুই।আর দাদাভাই যখন বলেছে তোকে ডাক্তার দেখাতেই হবে,তো তুই মরে গেলেও ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়াই লাগবে।এবং তাকে নিজের অসুস্থতা খুলে বলাই লাগবে।সুতরাং এতো ভেবেচিন্তে রাতের ঘুম হারাম না করে শান্ত হয়ে ঘুমা।ওদিকে যে আরেকজনের ঘুম হারাম করে দিয়ে এসেছিস,সেটাতো বেশ বুঝতে পারছি।

নিভানের জেদালোপূর্ন কথাগুলো পুনরায় মনে করতেই কৌড়িও যেনো মান্যতার কথাগুলো মনেমনে মেনেই নিলো।কান্না থেমে গেছে তার অনেক আগেই।ঠান্ডায় মান্যতা জড়িয়ে ধরায় যেনো উষ্ণতায় আর-ও আরাম পেলো।ঘুম না আসলেও চুপচাপ পড়ে রইলো মান্যতার বুকে।এই মানুষগুলো তাকে এতোটা আপন করে নেবে,ভালোবাসবে এটা কখনোই সে আশা করেনি।আর মান্যতা বলে এই অমায়িক স্বভাবের মেয়েটার সে এতো প্রিয় হয়ে উঠবে,এটাও কল্পনায় ছিলো না।সর্বোপরি ওই মানুষটা তাকে চাইবে,দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করার স্পর্ধা করেনি কৌড়ি।আর সেই মানুষটা তাকে এমনভাবে চাইছে,উফফ।

‘এই কৌড়ি।

হঠাৎ ডাকে একটু চমকালো সে।ছোটো করে বললো–হুমম।

‘এই-যে আমি তোমাকে মাঝেমাঝে তুই করে বলি।মন খারাপ হয়?রাগ করোনা তো?

‘একটু-ও না।বরং ভালো লাগে।আপন আপন মনে হয়।তুমি আমাকে তুই করে ডাকতেই পারো।ডাকতেই পারো কি, ডাকবে।

‘এখন নাহয় ডাকলাম।পরে তো আবার সেই তুমি করে সম্বোধন করতে হবে।

‘কেনো?

‘দাদাভাই আমার কতোবড় জানো!সেই বড় ভাইয়ের বউ তুমি হবে বলে কথা।

‘আপুু।

শব্দ করে হেসে দিলো মান্যতা।বললোা–ওরকম কেনো
করিস?আমার দাদাভাই খুব ভালো।যে মানুষটা তার নিজের আপনজনকে মনপ্রাণ দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে,আগলে রাখতে পারে।না জানি সে তার বউটাকে কতো ভালোবাসবে!কিভাবে আগলে রাখবে!বউ হ তারপর বুঝবি।একটা সময় গিয়ে দেখবি, ওই মানুষটাকেই ছাড়া তোর চলছে-না।

গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো কৌড়ি।সে কি আর ইচ্ছে করে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে!ওই মানুষটাকে অনাগ্রহ বা উপেক্ষিত করার যোগ্যতা তার আছে কি!শুধু দায়বদ্ধতার খাতিরে নিজের মনটাকে ধরেবেঁধে অনুভূতিগুলো চেপে রাখতে হচ্ছে।নিজেকে ছোটো হতে দেখলেও,নিজের মৃত বাবা মা’কে কিকরে সে ছোটো হতে দেখে!যারা তার অসময়ে আশ্রয় দিয়েছে, তাদেরকেও বা কিকরে ঠকায়?এইযে দুবেলা ফুপুমনি অবহেলিত,বাকা,ছোটো নজরে তাকে দেখে।মাঝেমধ্যে কথার ছলে কটু বাক্য শুনাতেও পিছুপা হোন না।
এমন কুইঙ্গিতপূর্ন কথা বলেন,যেনো নিজের রূপলাবণ্যে দিয়ে এবাড়ির ছেলেগুলোকে সে পটাতে এসেছে।এমনকি লোভীও সে।এগুলো নিজের জন্য মানা গেলেও,মৃত বাবা মায়ের নামে সহ্য করবে কি করে কৌড়ি! আপনজন বলতে এক ওই দাদাআপাই আছে।যিনি মায়ের মমতা দিয়ে স্নেহ আদরে তাকে মানুষ করেছেন।উনার আদেশ উপদেশগুলোও উপেক্ষ কি-করে করবে?কোনো একটা কান্ড ঘটলে উনাকে-ও কি কথা কম শুনতে হবে।তবে পা কোনদিকে বাড়াবে সে?সারাদিনে অনেক ঘুমিয়েছে,তাই আপতত চোখে ঘুম ধরা দিলো-না।তবে মাথায় চিন্তারা ঘুরপাক খেলো বৈচিত্র্যময়।তন্মধ্যে যে মানুষটাকে একটু আগে প্রচন্ড খারাপ বলে আখ্যায়িত করে এলো,সেই মানুষটাকে নিয়েই মন মস্তিষ্কের ভিতর চকরির মতো ঘুরপাক খেতে থাকলো।ওই মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে বসলে সবথেকে একটা কথা তাকে বিশেষভাবে ভাবায়,ওই মানুষটা তাকে পছন্দ করে,শুধু তাকেই চায়!কি অদ্ভুত অনুভূতিতে ছেয়ে যায় তখন শরীর-মন।মানুষটার চাওয়ার তীব্রতা দেখে,আবেগি মন খুব সাড়া দিতে চায়।তবে পরবর্তীতে দাদিআপার,বিথীর কথাগুলো বিবেক দিয়ে ভাবলে,মন মস্তিষ্ক দিশাহারা হয়ে পড়ে।যেমনটা এখন দিশাহারা অবস্থা।

দেখতে দেখতে আরও কয়েকটা দিন চলে গেলো।ইভানের রিসেশনের পর বাড়িতে আস্তে আস্তে মেহমান ও কমতে শুরু করলো।বললে চলে আপতত বাড়িতে কোনো মেহমান নেই।এরমধ্যে ইভানও তন্ময়ীকে নিয়ে ওবাড়ি থেকে ঘুরে এলো।তাহমিনা বেগম ইভানের প্রতি মনেমনে মনোক্ষুণ্ণ থাকলেও জামাই আদরে সামান্য পরিমান-ও অনাগ্রহ দেখালেন না।আর না কোনো ত্রুটি রাখলেন।বরং নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী ইভানকে জামাই হিসাবে যথেষ্ঠ পরিমাণ আদর যত্ন করলেন।মেয়েকেও উপদেশ দিলেন,সবকিছু মানিয়ে গুছিয়ে নিতে।ইভানের রিসেশনের দু’দিন পর কৌড়ির ডাক্তার দেখানোর কথা থাকলেও ডাক্তার দেখানোর মতো সুযোগই হয়নি।হঠাৎ পরিক্ষার ডেট পড়ায় মান্যতাও ব্যস্ত হয়ে গেলো।তবে কৌড়ি চাইছে, ডাক্তার দেখানোর বিষয়টা কোনোভাবে চাপা পড়ে যাক।কেননা,অসুস্থ বলতে নিজের এই লজ্জাজনক শারীরিক বিষয়টা যদি এবাড়ির সকালেসহ ওই মানুষটা জানে,লজ্জার কি আর শেষ থাকবে!যদিও মান্যতা বলেছে,কাল অবশ্যই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।সেই টেনশনে আছে আপতত সে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলোমেলো মনে ফের পড়ায় মনোযোগ দিলো।

আর একসপ্তাহ পর পরিক্ষা।আপতত কলেজ বন্ধ।রুমে বসে পড়ছে কৌড়ি।পড়ছে তো না।ইদানীং একজন মানুষকে নিয়ে ভাবনাটা বেড়ে গিয়েছে তার।তিনি সময়ে অসময়ে মনস্তাত্ত্বিকে এখন অবাধ চলেফিরে বেড়ান।কি এক জ্বালা!চেয়েও তাকে মনস্তাত্ত্বিক থেকে সরানো যায়-না।পড়ার ফাঁকে আবারও সেই মানুষটার বিচারণ!উফফ!শব্দটা প্রয়োগ করে চোখজোড়া বুঁজে কিছুসময় সেভাবে থেকে ফের চোখ খুলে বইয়ের পাতা মনোযোগী হবার চেষ্টা করলো।তবে সেই মানুষটা হয়তো কৌড়ির এই অবজ্ঞা মেনে নিতে চাইলোনা,তাই বাস্তবে ধরা দিলো।হঠাৎই কৌড়ির ফোন বেজে উঠলো। এখন আবার কে ফোন দিয়েছে?এই অসময়ে তো কখনো ফোন দেয়না কেউ?কথাগুলো ভাবতে ভাবতে,ফোন হাতে নিয়ে চোখের সামনে আনতেই নজর স্থির হয়ে গেলো তার।হৃদস্পন্দন ধকধক ধ্বনিতে আওয়াজ করে উঠলো।’নিভান’ নামটা স্কিনে পরিচ্ছন্নভাবে জ্বলজ্বল করছে।বয়সে তারথেকে-ও কতোবড় মানুষটা অথচ তারই নামটা কি অবলীলায় লেখা।সেই থেকে এই পর্যন্ত নামটা চেঞ্জ করার কথা মাথায় এলেও,পুনরায় কি নাম লিখে সেভ করবে সেটা ভেবে নামটা আর কাটা হয়নি।যদিও মানুষটা অতি প্রয়োজন ছাড়া কখনো তাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করেনা।এখন আবার কি জন্য দিল?হৃদ স্পন্দনে গতিবেগ হ্রাস পেলো।মন চাইছে কলটা ধরতে,মস্তিষ্ক বলছে না।মন মস্তিষ্কের দ্বিধাদন্ডে মনকে আজ প্রশ্রয় দিলো কৌড়ি।যদিও হৃদ যন্ত্র তার লাফিয়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম।তবুও কলটা রিসিভ করে চোখ বুঁজে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো সে।ফোনটা রিসিভ হয়েছে!ওপাশের মানুষটার ঠোঁটের কোণেও যেনো এক টুকরো হাসি ফুটলো।সে-ও, তার নিজস্ব অফিসকক্ষে বসা আরামদায়ক চেয়েরটায় শরীর এলিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে ডাকলো।

‘কৌড়ি।

এবার হৃদস্পন্দন থেমে গেলো কৌড়ির।এ কেমন ডাক!তাকে অস্বাভাবিক করে তোলে।গায়ের নুইয়ে থাকা লোমগুলােও কেমন কাঁটার মতো তথাস্তু হয়ে দাঁড়িয়ে সমস্ত শরীরে ডাকের জানান দিয়ে শিরশিরানি বয়ে যায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আজ যেনো কিসের টানে ডাক অবজ্ঞা করতে পারলোনা কৌড়ি।খুবই নিন্মস্বরে ছোটো করে উত্তর দিলো।–হুমম।

ওপাশের মানুষটার হাসিটা যেনো আর-ও একটু বিস্তৃত হলো।সময় নিয়ে বললো–তুমি পড়ছো, তাই-না?বিলিভ মি কৌড়ি,আমি তোমাকে একটুও ডিস্টার্ব করতে চাই নি।কিন্তু তোমার কথা খুব মনে হচ্ছিলো।কেনো জানিনা কথা বলতেও খুব ইচ্ছে করছিলো।তাই ডিস্টার্ব করলাম।আমি জানি আমার ফোনকলে তুমি বিরক্ত হয়েছো,তবুও অল্পক্ষণের জন্য এই অপছন্দ মানুষটাকে একটু সয়ে নাও।একটু ডিস্টার্ব হও।

উত্তর দিলোনা কৌড়ি।শুধু চোখ বুঁজে কথাগুলো শুনে গেলো।বুকের ভিতর যে উথালপাতাল ঝড় চলছে তার।গলা দিয়ে কথা বের করবে কিকরে সে?আর বলবেও বা কি সে?তাই নীরবে সেই ভরাট গলার কথাগুলো শুনে গেলো।উত্তর পাওয়ার আশাও করলোনা নিভান।ফের সুন্দর সাবলীল গলায় বললো।

‘আমি কখনো নিজেকে অন্যের কাছে ছোটো করে দেখাতে পছন্দ করিনা।করিনিও কখনো।আমার নেই কিচ্ছু,তো নেই।তাই বলে আমাকে কেউ ছোটো করে দেখবে,এমনটা কখনো কারও সামনে প্রেজেন্ট করেনি আমি।বারবার কারও কাছে নিজের ভালোমন্দ অনুভূতি প্রকাশ করে নির্লজ্জতার বহিঃপ্রকাশও ঘটায়নি কখনো।ইউ নো,তুমিই একমাত্র ব্যক্তি।যেখানে আমি নিজেকে ছোটো করতে প্রস্তুত হয়েছি।নিজের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েও বারবার নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়েছি।নির্লজ্জও বানিয়েছি নিজেকে।আর যতক্ষণ তুমি আমার না হতে চাইবে ততক্ষণ পর্যন্ত হয়তো এই নির্লজ্জতার দফা বহাল থাকবে।নির্লজ্জ হতে রাজিও আমি,তোমাকে তোমার কাছে বারবার চেয়ে নিজেকে ছোটো করতেও রাজি আমি।তবে যে নিভান আমি ছিলাম, সেই নিভান হারিয়ে।নিজের সেই দৃঢ়পণ,ব্যক্তিত্ব,সবকিছু খুইয়েও তোমাকে পেতে চাইছে মন।কেনো কৌড়ি?আমি কেনো পারছিনা,আমার মন আমার মস্তিষ্ক থেকে তোমাকে দূরে সরাতে?আমার এতো এতো কাজের প্রেশারের মধ্যেও কেনো পারছিনা, তুমি নামক কৌড়িকে সেই কাজের প্রেশারের মধ্যে চাপা ফেলতে।এই কৌড়ি বলো-না?আমিতো এতোটা দূর্বল কারও প্রতি কখনোই ছিলাম না।তবে কিকরে হোলাম তোমার প্রতি?

চোখ বেঁয়ে নোনাজল গড়ালো কৌড়ির।এভাবে কিকরে একটা মানুষ কাতরভাবে তাকে চাইতে পারে!কিকরে!আবার সেই মানুষটা।যার কাছ থেকে এসব কথা-কাজ অবিশ্বাস্য।কখনোই আশা করেনি।অথচ সেই মানুষটা তার কাছে পুরো খোলামেলা পুস্তক।অথচ অন্য পাঁচ দশটা মানুষের সামনে,মানুষটা কি গম্ভীর। অনুভূতিহীন।শক্তপোক্ত দৃঢ়মনের মানুষ।সেই মানুষটা শুধুই তার খোলামেলা হতে চাইছে।মানেটা কি?বুঝতে কি পারছে না কৌড়ি।পারছে।খুব ভালোভাবে পারছে।এরকম মানুষকে নিজের করে পাওয়ার সৌভাগ্য কজনের হয়?
কৌড়ির হয়েছে।অথচ সেই সৌভাগ্য নিজ ইচ্ছেতে বরন করার ক্ষমতা তার নেই।তবে নিজের মনকে আর বাঁধ সেধে রাখবেনা কৌড়ি।নিজ ইচ্ছেতে সেই সৌভাগ্য বরণ করার ক্ষমতা তার না থাকলেও ওই মানুষটার তো আছেই।পারলে ওই মানুষটা তাকে নিজের করে নিক।যেভাবে পারে তাকে সেভাবেই নিজের করে নিক।সে কখনো অমত পোষন করবে-না।তবে মুখে স্বীকারোক্তি জানানো হয়তো কখনো তারদ্বারা হবেনা।

‘এই কৌড়ি।শুনছো তুমি?

দৃঢ়কণ্ঠের ডাক ফের পড়তেই ভাবনা কেটে গেলো। না চাইতেও ফের জবাব দিয়ে ফেললো কৌড়ি।’হুমম।

‘একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করেনা আমার সাথে তাই না?

উত্তর দিলোনা কৌড়ি।কারন মন যা বলছে মুখে তার বিপরীত উত্তর দিতে হবে।মিথ্যাও মুখ দিয়ে সহজে বের হবেনা।তাই বরাবরের মতো নিশ্চুপ রইলো।নিভান ফের বললো।

‘আচ্ছা কৌড়ি,আমার যদি হঠাৎ কিছু হয় যায়।ধরো হঠাৎই আমি বরাবরের মতো দূরে চলে গেলাম।তোমার থেকে খুব দূরে।যেখানে গেলে কেউ আর কখনো ফেরে না।আচ্ছা কৌড়ি,আমার অবর্তমানে তুমি কি একটুও কষ্ট পাবে আমার জন্য?আমি নেই, কখনো মন খারাপ হবে তোমার?

বুজে থাকা চোখজোড়া টেনে আরও গভীরভাবে টেনে বুঁজে নিলো কৌড়ি।ফের মৃদুস্বরে আওড়ালো–এগুলো কি বলছেন আপনি।

কথাটা শোনা হলোনা নিভানের।তার আগেই তার পি-এ নক করলো দরজায়।মনোযোগ ছিন্ন হলো নিভানের।মনে পড়ল,একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংয়ের জন্য একটু পরে বের হতে হবে তাকে।সেজন্য ডাকতে এসেছে মৃদুল।মৃদুলকে ফাইলপত্র নিয়ে বের হয়ে গাড়িতে বসতে বলে,পাঠিয়ে দিল।ফের ফোনটা কানে তুললো সে।তার আগে দেখে নিলো সংযোগ আছে কি-না। আছে।দেখেই মৃদু হেসে ফোনটা কানে নিলো।ফের অমায়িক কন্ঠে বললো।

‘তোমাকে খুব বেশি ডিস্টার্ব করলাম।সেই ডিস্টার্বের বিনময়ে যে স্বস্তি শান্তিটুকু দিলে আমাকে,তারজন্য নিভানের ভালোবাসা গুচ্ছিত রইলো তোমার জন্য।যদি সুস্থ থাকি,তবে সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে।আল্লাহ হাফেজ।

মনেমনে, আপনি সর্বদা সুস্থ থাকেন শব্দগুলো বললেও মুখে চুপ থাকলো কৌড়ি।আল্লাহ হাফেজ বলে মনেমনে বিদায় জানালো হবে।আজকে নিভান যেনো নাছোড়বান্দা।মায়াময় কন্ঠে বললো।—এই কৌড়ি, আল্লাহ হাফেজ বলবে-না।

ঘনো নিঃশ্বাস ফেললো কৌড়ি।নিঃশ্বাসের শব্দ ওপাশ থেকে নিভানও শুনলো।নিভানের মায়াময় কন্ঠের বশিভূত হলো কৌড়ি।কৌড়ি মৃদুস্বরে বললো।—আল্লাহ হাফেজ।

নিজেই ফোন কেটে দিলো সে।ওপাশ থেকে মৃদুহেসে ফোনের দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে ফোন প্যান্টের পকেটে ঢুকালো নিভান।ফের দ্রুত কেবিন ত্যাগ করে নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালো।

সময়টা মধ্যহ্ণ!গায়ের পরিহিত সাদা শার্টটার দিকে আবারও তাকালো ইভান।রক্তের ছোপছোপ দাগে ছেয়ে আছে শার্টটা।এই অবস্থায় কিভাবে সে বাড়ির ভিতরে যাবে বুঝে উঠতে পারলোনা!বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই তো মা চাচিদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে।আর প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে তো এই দুপুরবেলা একটা হুলুস্থুল কান্ড ঘটবে।তবুও তো যেতে হবে।তবে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে,উনার প্রশ্নের সম্মুখীন হবে কিকরে সে?কি করে বলবে তার আদরের ছেলেটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট করে হসপিটালের বেডে পড়ে আছে।শুধু যে হসপিটালের বেড পড়ে আছে এমনটা তো নয়।গুরুতরভাবে এক্সিডেন্ট হয়ে আইসিইউতে নির্জীব শুয়ে আছে।গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো ইভান।মূহুর্তেই ভেসে উঠলো সেই বিভৎস এক্সিডেন্টে দুমড়ে মুচড়ে গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে থাকা গাড়িটা।মূহুর্তেই পথচারীরা হৈহৈ করে উঠলো।

‘ওই বুঝি অসচেতন রাস্তা পারাপর করতে গিয়ে মা-সহ বাচ্চাটাকে বাঁচাতে,গাড়ির লোকটা বুঝি মরলো।

ব্যস্ত শহুরে রাস্তার পথচারীর মধ্যে সে-ও একজন ছিলো।তবে কল্পনাতেও আনেনি মারাত্মক এক্সিডেন্টে মরতে বসা মানুষটা তার আপনজন হবে।সকল পথচারীর মতো সে-ও এক্সিডেন্টের কথা শুনে এগিয়ে গিয়ে গাড়িটা নজরে পড়তেই বুকটা ঝড়ের মতো কেঁপে উঠেছিলো তার।নজর যেনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছিলোনা,গাড়িটা তার আপনজনের।আর ভিতরের আহত মানুষটা আর আত্মার একাংশ।মানুষটা আঘাত পেলে তার-ও ব্যথা লাগে,কষ্ট অনুভব হয়।মূহুর্তেই পথরে বনে যাওয়া হাতগুলো কিভাবে যে টেনেহিঁচড়ে গাড়ির সিটে রক্তাক্তে এলিয়ে থাকা মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো,সেটা শুধু ইভান যানে।তারপর সর্বসাহায্যে হসপিটালে পৌঁছে কাকে কিভাবে জানাবে ভেবে উঠতে পারছিলো।নিভান শুধু একটা নাম নয়।ওই নামের মানুষটা,নিজের আপনজনদের মধ্যে আবেগ ভালোবাসা আর অনেকের দূর্বলতার স্থান।ওই মানুষটা এক্সিডেন্ট করেছে!অসুস্থ হয়ে হসপিটালের বিছানায় শুয়ে!সবাই মূর্ছা পড়বে।তার অসুস্থতার কথা শুনে তারপ্রতি যত্নশীল মানুষগুলোও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে,এটাও ধারণা আছে ইভানের।বিশেষকরে বাবা,মা,নানুমা।তাই দুপুর এগোটার দিকের ঘটনা এখন দুপুর তিনটে, এখনো কাওকে জানাতে সাহস পায়নি ইভান।শুধু ছোটো চাচ্চুকে জানিয়েছিলো।আপতত তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে,তিনিই এখন হসপিটালে অবস্থান করছেন।সহজ সরল মানুষটাও আপনজনের এমতাবস্থায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন।দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইভান।

পরিস্থিতির সম্মুখীন তো হতেই হবে।ছোটো চাচ্চুর গাড়ীটা নিয়ে এসেছে সে।গাড়ী থেকে বের হলো ইভান।আজকের দুপুরের চারপাশটা কেমন নিস্তব্ধ।আশেপাশে তাকিয়ে মেইন দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাতেও সময় নিলো সে।কেমন যেনো সাহসে কুলচ্ছে না।এলোমেলো শ্বাস ফেলে কলিংবেলের চাপতেই, মুহূর্তেই দরজা খোলার শব্দ পেলো ইভান।কিছুটা আশ্চর্যও হলো।সময় না নিলেও মিনিট সময় পার হয়ে অন্য সময় দরজা খুলতে। আর আজ সময় নিলো-না!মনেহলো দরজার পাশে কেউ ওত পেতে বসে ছিলো,দরজা খোলার জন্য।তবে কি দাদাভাইয়ের এক্সিডেন্টের কথা জেনে গিয়েছে বাড়ির সবাই?

‘ও আল্লাহ।ও ইভান বাবা তোমার গায়ে রক্ত মাখামাখি কেনো?কি হইছে তোমার?

রানির চিল্লানোতে মূহুর্তেই যেনো,দুতলা বাড়িটা গমগম করে উঠলো।নীহারিকা বেগম টেবিলে খাবার গোছাচ্ছিলেন,রানিকে এমন হাহাকার করতে শুনেই সব ফেলে দৌড় এলেন।সাথে স্বান্তনা রহমানও পিছু নিলেন।ততক্ষণে ইভান ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়েছে।ইভানকে দেখেই আঁতকে উঠলেন নীহারিকা বেগম।দ্রুত কাছে এসে গায়ে হাত দিয়ে ইভানকে পরখ করতে করতে আতঙ্কিত কন্ঠে বললেন।

‘কি হয়েছে তোর?এতো রক্তে মাখামাখি কেনো তুই?

ফের ইভানের ঘাড় কাধ মাথার চুলগুলো উল্ট পাল্টে দেখতে দেখতে স্বান্তনা রহমানকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকলেন—দেখেছিস ছোটো,তোকে সকাল থেকে বলছিলাম না।আমার বুকটা কেমন করছে,কি যেনো খারাপ হতে চলেছে।আমার কথা মিললো তো!মায়ের মন কখনো মিথ্যা বলে না।আর না ভুল জানান দেয়।তারউপর সেই দুপুর থেকে ছেলে দুটোকে ফোন দিয়ে পাচ্ছিনা।আমার মনটা আরও খুদমুদ করছিলো, জ্বলছিলো।তুই তো বিশ্বাস করছিলি-না আমার কথা।দেখেছিস,একটা বিপত্তি বাধিয়ে তারপর বাড়িতে এলো।আমার মন তবে ভুল বলছিনা।

ইভান দূর্বল অনড় নজরে মায়ের বিচলতা দেখে গেলো।একেই বলে বুঝি মা।যার অন্তর, সন্তানের সুখ অসুখে ভালোমন্দে বিপদআপদে আগেই টের পেয়ে যায়।উফ!সেই মা’কে কিকরে জানাবে তার আদরের সন্তানের ভয়ঙ্কর বিপদের কথা!

‘কই,তোর তো কোথাও কাটাছেঁড়া নেই।তবে সমস্ত শরীরে এতো রক্ত মাখামাখি কেনো?কার কি হয়েছে ইভান?ও ইভান কথা বল?এমন রক্তে মাখামাখি কেনো তুই?

ততক্ষণে ড্রয়িংরুমে সবাই হাজির।সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত নজরে ইভানকে দেখছে তন্ময়ী।পা এগোবে সে সাহস হচ্ছে না তার।এ কয়েকদিনে ইভানের সাথে কাছাকাছি ঘুমানো ছাড়া বিশেষ সম্পর্ক এগোইনি তাদের। তবে হালাল সম্পর্কের টান হোক বা ছেলেটার বারবার অনুতপ্ততা।তাকে মায়ায় জড়াতে বাধ্য করেছে।একটা অদ্ভুত টান তৈরী হয়েছে।এখন ভুলেও তন্ময়ী চায়না ওই ছেলেটা কোনো প্রকার বিপদআপদে পড়ুক।সেই ছেলেটার এতো রক্তে মাখামাখি,কেমন যেনো ভিতর থেকে অসড় অসড় অনুভব হলো।বিধায় চেয়েও সামনে এগোতে পারলোনা।ইতিমধ্যে ফাতেমা বেগম এবং ডলািয়া বেগমও সেখানে হাজির।রানির গলা শুনে মান্যতা মৌনতা কেউ বাদ রইলোনা।কৌড়ি মান্যতার রুমে ছিলো।মান্যতা আগে এসে নিচে নেমে গেলে-ও,ইভানকে এমন অবস্থায় দেখেই ধীর হয়ে গেলো তার পা।তবে সিঁড়ির মাঝ বরাবর এসে নীহারিকা বেগমের অবিচলিত করা প্রশ্নে, ইভানের বলা নির্দয় বাক্যগুলোয় নিঃশব্দে থেমে গেলো তার পা।নিঃশ্বাস আঁটকে
ধব্ক করে উঠল বুক।

‘আমার কিচ্ছু হয়নি মা।তবে…

‘তবে কি বল?ও ইভান আমার নিভানের কিচ্ছু হয়নি তো?

প্রশ্ন করতেই নীহারিকা বেগমকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো নিজের শক্তপোক্ত বুকে।ফের বললো-শান্ত হও।দাদাভাই ঠিক হয়ে যাবে।একদম পাগলামো করবেনা,তবে সুস্থ হয়ে দাদাভাই কিন্তু আমাকে বকবে।

‘আমার নিভানের কি হয়েছে ইভান?

নীহারিকা বেগমকে আরও শক্তপোক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইভান।ফের চোখ বুঁজে নিঃশ্বাস ফেলে একনাগাড়ে বললো।–‘দাদাভাই এক্সিডেন্ট করেছে মা।

‘আমার নিভান ঠিক নেই তাইনা?

উত্তর দিতে পারলো-না ইভান।গলা রোধ হয়ে এলো তার।তবে মা’কে ভুলেও কাছছাড়া করলো-না।নিভানের এক্সিডেন্ট!আতঙ্কে হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো সবার।আবেগে কেঁদে ফেললো মান্যতা মৌনতা।মুখে হাত চেপে ধরলেন ডালিয়া বেগমও।কি সর্বনাশ,কিভাবে কি হলো? বলে মুখেও আওড়ালেন!বিচলিত হলেও বৃদ্ধা আমেনা বেগমও।স্বান্তনা রহমান তো হাত পা নাড়ানোর শক্তিই পেলেন না।সকালবেলা সুস্থ সাবলীল ছেলেটাকে উনিই খাবার বেড়ে খাওয়ালেন।এখন বলছে সেই ছেলেটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছে!হঠাৎই কথাটা যেনো বিশ্বাস হলোনা।ভুল শুনেছেন বলে মনে হলো।তারপর নীহারিকা বেগমের পাগলামি করা দেখে হুঁশ ফিরলো যেনো উনার।

‘ও ইভান,আমার বাচ্চাটা ঠিক নেই বল?আমার বাচ্চাটা আমার আগে ছেড়ে চলে যাবে না-তো,ওর বাবার কাছে?

‘বড়ো বউমা এগুলো কি বলতে শুরু করলে তুমি?

ধমকে উঠলেন ফাতেমা বেগম।তাতে এবার কেঁদে ফেললেন নীহারিকা বেগম।ইভানকে জড়িয়ে হাওমাও করে উঠলেন।ফের শ্বাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে
বললেন–ওর আমার উপর অনেক অভিযোগ, খুব অভিমান মা।আপনি জানেন না।আমার বাচ্চাটা প্রকাশ করতে চায়না বলে!কিন্তু আমি মা,আমি ওর মনের কথা জানি।ওর আমার উপর খুব অভিমান।খুব অভিযোগ।
ও ওর বাবাকে খুব ভালোবাসতো।আমি জানি, ও আমার উপর অভিমান করে ওর বাবার কাছে গিয়ে শান্তিতে থাকতে চায়।একটু স্বস্তি আর শান্তিতে থাকতে চায়।

গলা ছেড়ে কাঁদতে কাদতে কথাগুলো বলে ফের বললেন।–ও আল্লাহ আমার প্রানটা নিয়ে, তুমি আমার বাচ্চাটাকে সুস্থ করে দাও।আমার আয়ু কেটে তাকে যুগ যুগ বাচিয়ে রাখো।

ফের ইভানকে উদ্দেশ্য করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন–এই ইভান আমাকে নিয়ে চল-না,আমার বাচ্চাটার কাছে।

সেই যে পা থেমে গেছে কৌড়ির।তা আর সচল অনুভব হলো না তার।নিস্পলক স্তব্ধ নজরে শুধু ড্রয়িংরুমে চলা ঘটনাগুলো দেখে চলেছে সে।কানে শুনছে সব।তবে কি শুনছে সব যেনো তালগোল পাকিয়ে মস্তিষ্কে বিচরন করছে।বাজে অদ্ভুত একটা ধকধক অনুভূতিতে তোলপাড় করছে হৃদস্পন্দন। বাবা মারা গিয়েছিলো যেদিন,ঠিক একই অনুভূতিতে কেঁপেছিলো বুকের ভিতর বাহির।কি এসব ভাবছে সে?মানুষটা মরতে যাবে কেনো?তবে হয়তো তার এটা খেয়ালে নেই।মানুষ মরণশীল।সে পিঁড়ি অনুযায়ী এসেছে বলে পিঁড়ি অনুযায়ী চলে যাবে।এমনটা নিয়ম সৃষ্টিকর্তা করেন নি।যার যখন সৃষ্টিকর্তার থেকে ডাক আসবে তখনই তাকে চলে যেতে হবে!এটা অতি বাস্তবিক সত্যি কথা।

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(৩৫)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

গভীর রাতের প্রহরের ন্যায় এই মধ্যে দুপুরেও বাড়িটা শুনশান বিরাজ করছে।নিস্তব্ধ, নীরব!মানুষের অভাবে খা-খা করছে-ও বৈকি।এতোবড় বাড়িটার কোথাও কেউ নেই যেনো।অথচ বাড়িতে কম মানুষও নয়।অসুস্থ
জাহিদ সাহেব নিয়মানুযায়ী দুপুরের খাবার খেয়ে একটা ভাতঘুম দেন।আজও তার অন্যথা হয়নি।দুপুরে খেয়েই ঘুমিয়েছ।যারকারনে বাড়িতে এতোবড় একটা দূর্ঘটনার ঘটনায় সবাই যে মূর্ছা পড়েছে।এটা তিনি জানেনও না।নাফিমও ঘুমে।জ্বরে অসুস্থ দীবাও গভীর ঘুমে পড়ে আছে বিছানায়।বাড়িতে আপতত তিনজন মানুষের আনাগোনা চলছে।তবুও সেই মানুষগুলোর আনাগোনা ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোর থেকেও খুব একটা পার্থক্য নেই।সেই রক্তে মাখামাখি অবস্থায় আবারও বাড়ির সদস্যগুলো নিয়ে হসপিটালে ছুটতে হলো ইভানকে।বাদ গেলেন না বৃদ্ধা ফাতেমা বেগমও।স্বান্তনা রহমানও যাবার প্রস্তুতি নিতেই,বাড়ির অসুস্থ মানুষগুলোর কথা ভেবে ফের রয়ে গেলেন।নাহলে নিভানকে যে তিনি নাফিমের থেকে কোনো অংশেও আলাদা নজরে দেখেন না।আপন সন্তানের মতোই মনে করেন।সেই ছেলেটা অসুস্থ!তিনি না গিয়ে বাড়িতে থাকতে পারেন!তবে বাড়ির মানুষগুলোর কথা না ভাবলেও যে নয়।তাই বাধ্য হয়ে শ্বাশুড়ি মায়ের কথায় তিনি রয়ে গেলেন।তবে মন ছটফটিয়ে চলেছে,ওই মারাত্মক অসুস্থ ছেলেটাকে একপলক দেখার জন্য।সোফার একপাশে দু’হাতে মাথা চেপে মনেমনে শত প্রার্থনা করে চলেছেন তিনি।যেনো ছেলেটার মহাবিপদ কেটে যায়,দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসে।

স্বান্তনা রহমানের অপর পাশের সোফায় বসে আছে তন্ময়ী আর কৌড়ি।দুজনেই চুপচাপ।তন্ময়ী ক্ষনে ক্ষনে চোখ মুছলেও,তার কান্নার শব্দ নেই।কৌড়িও নীরব।স্বান্তনা রহমানের মতো মাথায় দুহাত চেপে বসে আছে।
নিজের ভিতরে কি চলছে,সেটা শুধু সেইই জানে।সকালের ফোন কলের কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে, আর বুকব্যথাটা জ্বলনে রুপান্তরিত হচ্ছে।সেই জ্বলনের বহিঃপ্রকাশ না কান্নার জ্বলে নিভিয়ে ফেলতে পারছে,না ভিতরটাকে কোনোপ্রকার স্বস্তি দিতে পারছে।তবে মনেমনে প্রার্থনা করে চলেছে।–মানুষটা সুস্থ সমেত তারকাছে ফিরে আসুক।হ্যাঁ তারকাছে ফিরে আসুক।

‘জানো কৌড়ি,পৃথিবীতে মানুষের বাঁচার অনেক শখ।আমারও বাঁচার অনেক ইচ্ছে,শখ।তবে এই মূহুর্তে আমি আমার নিঃশ্বাসের বিনিময় হলেও,ওই মানুষটা সুস্থ হয়ে ফিরে আসার প্রার্থনা করছি।আমার এই দোয়ার কারন শুনবে না তুমি?

দু’হাতে চেপে রাখা মাথাটা একটুখানি তুললো কৌড়ি।হরিণী বড়োবড়ো কালোমনির শান্ত চোখজোড়া মূহুর্তেই জ্বলজ্বল করে উঠলো।চোখের কালোমনির পাশের সাদা অংশটুকুও মৃদু লালচেবর্ণে ছেয়ে আছে।সেদিকে বিশেষ খেয়াল করলোনা তন্ময়ী।ফের বলতে শুনতে করলো।

‘নিভান ভাইয়া আমার জীবনের এমন একটা সম্মান শ্রদ্ধার স্থান।আমি উনাকে ভাইয়ের বন্ধু কম,উনার আচার আচারণে নিজের ভাইয়ের মতো জেনেছি বেশি। পাশে পেয়েছিও সবসময় তেমনটা রূপে।উনি আমার জীবনে মা ভাইয়ার পরপরই এমন একটা শ্রদ্ধীয় মানুষ।
যেখানে উনার অবদান একটা একটা বলে শেষ করার নয়।নিজের বোনের মতো দায়িত্ব পালন করেছে।যেভাবে একটা ভাই পালন করে,উনি আমার প্রতি করেছেন।দাদাভাই বিদেশ থাকাকালীন আমাদের সমস্ত দায়দায়িত্ব নিজগুণে নিপুনভাবে সামলিয়েছেন।তখন ভাবতাম,দূরসম্পর্কের জন্য কেউ কিভাবে এতেটা করে!সেখান থেকেই শ্রদ্ধাটা আরও বেড়ে গেলো।যদিও দাদাভাইয়ের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকে,আমার আর দাদাভাইয়ের জীবনে অর্থাৎ আমাদের জীবনে উনার অনেক অবদান।শুধু অর্থ দিয়ে নয়,আমাকে নিজের বোনের মতো স্নেহ করা,আমার দাদাভাইকে বন্ধু কম নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসা,মা’কে মায়ের মতো সম্মান শ্রদ্ধা করা।খেয়াল রাখা।আমাদের মধ্যে যে দূরসম্পর্ক।সেই সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল হওয়া।কে করে এই জামানায়? সত্যিই আমি উনার মতো,ছেলে, বন্ধু, ভাই,খুব কমই দেখেছি।আর ওরকম মানুষের বেচে থাকা,সুস্থ থাকা পৃথিবীতে খুব দরকার।আমার চেয়েও বেঁচে থাকা দরকার।

চেনা পরিচিত মানুষগুলো মানুষটাকে কতোটা সম্মান কতোটা শ্রদ্ধা করে।ভালোবাসে।অথচ তারকাছেই সেই মানুষটা ভালোবাসার কাঙাল।আর সেই মানুষটার হতে পারছেনা সে।উফফ! নিজের আলাদা ভাবনায় মশগুল হলো কৌড়ি।স্বান্তনা রহমান এতোসময় মাথা হাত চেপে বসে থাকলে-ও তন্ময়ী কথা শুরু করতেই,ওর মুখের তাকিয়ে নীরবে কথাগুলো শুনে গেলেন।তন্ময়ী কথা শেষ করতেই উঠে দু-জনের মধ্যর ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসলেন তিনি।দু’জনেই উনার দিকে তাকালো।সেটা দেখে দূর্বল হেসে তন্ময়ীর মাথায় হাত রেখে বললেন।

‘মন খারাপ করো না।সব ঠিক হয়ে যাবে।দেখবে নিভান এই সুস্থ হয়ে ফিরলো বলে কথা।এতো মানুষের প্রার্থনা বিফলে যেতে পারে!পারে না।

মাথা নাড়ালো তন্ময়ী।স্বান্তনা রহমানের হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে বললো–এই প্রার্থনাই তো করে চলেছি বারংবার।ভাইয়া সুস্থ হয়ে দ্রুত ফিরুক।

তন্ময়ী ভরসার কাঁধ খুঁজে নিয়ে সেখানে মাথা রাখলো।কৌড়িও যেনো ভরসার কোল খুঁজে পেলো।দ্বিধাহীন নীরবে মাথাটা এলিয়ে দিলো স্বান্তনা রহমানের কোলে।তড়িৎ কৌড়ির মুখের দিকে তাকালেন তিনি।তার আগেই কৌড়ি মুখ লুকিয়ে নিয়েছে স্বান্তনা রহমানের পেটের শাড়ির ভাঁজে।চিবুকের একপাশ আর মাথার চুলের অংশ ছাড়া নজরের আড়ালে চলে গেলো সব।তবুও সেদিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে কৌড়ির মাথায় স্নেহের হাত রাখলেন তিনি। ইদানীং একটা বিষয় তিনি খুবই সুক্ষ ভাবে লক্ষ্য করেছেন,যা সহজে সবার নজরে পড়ার কথা নয়।কৌড়ির প্রতি নিভানের মায়াময় শান্ত নরম চাহুনি।একদিন খেয়াল করার পরে গুরুত্ব দেননি তিনি।তবে বিয়ে বাড়ির এতো মেয়েদের উজ্জ্বল সাজগোজ ছাড়িয়ে,সাধারণভাবে ঘুরতে থাকা কৌড়ির পানে সেই একই মায়াময় মুগ্ধ নজর আবদ্ধিত হওয়া।বিষয়টা সাধারণ বলে মনে হয়নি উনার।নিভান যে চরিত্রের ছেলে,তারসাথে মিলিয়ে তিনি যে উত্তর পেলেন।সেটাও অবিশ্বাস্য লেগেছে।বিষয়টা নিয়ে তিনি নীহারিকা বেগমের সাথে আলাপ করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু বিয়ের হাজার তাল-ঝামেলায় আর হয়ে উঠে-নি।

কৌড়ির চুলের ভাঁজে আঙুল বিচরণ করলেন তিনি।মুগ্ধ হয়ে ফর্সা কান,গলা এগুলো পর্যবেক্ষণ করলেন।মেয়েটার সৌন্দর্যের কমতি নেই।যে কার-ও নজরের মুগ্ধতা ছড়াবে।তবে নিভান শুধু সৌন্দর্যের পাগল নয়।ও ছেলে আলাদা ধাতুর।যা দীবার বিষয়েসহ,আরও অনেক সৌন্দর্যময়ী মেয়ের বিষয়ে তিনিসহ পরিবারের সবাই ঢেড় টের পেয়েছেন।তবে কৌড়ি!বিষয়টা ভাবিয়েছে উনাকে।যদিও ছেলেমেয়ে দু’টোই চাপা স্বভাবের।একজন পড়াশোনা নিয়ে যেমন ব্যস্ত।অন্যজন বিজনেস নিয়ে তার দ্বিগুণ ব্যস্ত। দু’জনের কাউকে সেভাবে ফোনেও দেখা যায় না।আর না কখনো কথা বলতে শুনেছেন।বিধায় কৌড়ির দিক থেকে কিছু না থাকলেও,নিভানের দিক থেকে কিছু একটা চলছে।তবে তাই যদি হয়,বউমা হিসাবে কৌড়ি মোটেও মন্দ হবেনা।শুধু ছেলেটা সুস্থ হয়ে ফিরলেই শুকরিয়া।

আজ হসপিটালে নিভানের অসুস্থতার চারদিন চলছে।মারাত্মক এক্সিডেন্টে বেঁচে ফিরার কথা নয়।তবুও বেঁচে ফিরেছে সে।হয়তো জীবন এখানেই শেষ নয় তার।জীবনের এগিয়ে যাওয়ার পাতা এখনো বাকি।তাই হয়তো ফিরে এসেছে।রহম করেছেন আল্লাহ।হসপিটালের স্পেশাল কেবিনের রুগী বেডটায় হেলান দিয়ে পা মেলিয়ে বসে আছে নিভান।গায়ের হালকা শীততাপনিয়ন্ত্রক বস্ত্রটা কোমর পর্যন্ত দেওয়া।চোখ বুঁজে আপনমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে।এক্সিডেন্ট হওয়ার প্রায় চব্বিশ ঘন্টা পরে তার নাকি জ্ঞান ফিরেছে।জ্ঞান ফেরার পর অনেককেই দেখেছে হসপিটালে।মাকে হাওমাও করে কাঁদতে দেখেছে,বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে তারজন্য মলিন রূপে দেখেছে সে।যে ফুপুর সাথে তার কখনো আদর আহ্লাদিত সম্পর্ক গড়ে উঠেনি,সেই ফুপু তাই মায়ামায়া করে কথা বললো।দাদুমা।তিনি তো কেঁদেই দিয়ে কতো আদূরী কন্ঠে এটা ওটা বললেন।এই চারদিনে নিজের আপনজন, আত্মীয় স্বজন বলতে কেউ বাকি নেই,তাকে দেখতে আসতে।অথচ যাকে দেখে মন শান্ত হতে চাইছে। নজর খুঁজেছে। আজ চারদিনেও তার দেখা মেলেনি।কি-করে মেয়েটা এতো নিষ্ঠুর হতে পারে!তার কি একটুও মায়া হয়নি তার প্রতি।আর মারাত্মক এক্সিডেন্টের কথা শুনেও কি একটুও কষ্ট, খারাপ লাগিনি মেয়েটার!অদ্ভুত হাসলো নিভান।সে হাসি যেনো বর্ণনা দিলো নিজের প্রতি তাচ্ছিল্যতা।

‘আসবো দাদুভাই?

পুরানো বৃদ্ধা কাঁপা কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই মৃদু কেঁপে উঠলেন নীহারিকা বেগম।কতোগুলো দিনপর দেখা।কতোগুলো দিন কোথায়,প্রায় দুই যুগেরও বেশি।এরমধ্যে নিভানের সাথে টুকিটাকি সম্পর্কের আদান-প্রদান থাকলেও, উনার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি ওবাড়ির ছাড়ার পর আর।হয়তো নাতীর অসুস্থতার কথা শুনে এসেছেন।ভদ্রমহিলা অনুমতি চাইলেও অনুমতি পাওয়ার আশা করলেন না।ভিতরে ঢুকেই নিভানের কাছাকাছি গিয়ে বসলেন।নিভানকে এই অবস্থায় দেখে কেদেও ফেললেন।ফের নিভানের মাথায় হাতে জড়ানো ব্যান্ডেজে হাত ছুঁইয়ে আদূরে গলায় বললেন।

‘এখন কেমন আছো দাদুভাই?আমি তোমার এক্সিডেন্টের কথা কাল সন্ধ্যায় শুনেছি,নাহলে আসতে কি আমার দেরি হয়!

শ্যামবর্ণের জৌলুশ একটা বৃদ্ধা আবায়ব।জিনগতভাবে হয়তো এই একই বর্নের একোই মুখাবয়ব পেয়েছিলেন বাবা আওসাফ আহমেদ।আর সেই একোই জিনগতভাবে বাবার কাঠামো বর্ন পেয়েছে সে।বিধায় এই মুখটার দিকে তাকিয়ে শক্তপোক্তভাবে কোনো কথা বলতে পারে-না নিভান।পারেনা বলতে ভুল।ওবাড়ি ছাড়ার পর,প্রায় বারো বছর পর এই দাদুমার অসুস্থতার কথা শুনে উনাকে দেখতে গিয়েছিলো নিভান।তখন কম কথা শুনিয়ে আসিনি।যদিও সে যেতে চায়নি ওবাড়ি।তবে মরণাপন্ন একজন মানুষ তাকে দেখতে চেয়েছে, তাই মায়ের কথা মেনে ওবাড়িতে যেতে বাধ্য হয়েছিলো সে।হয়তো ওবাড়ি ছাড়ার ক্ষেত্রে দাদুমার কোনো দোষ ছিলো-না।তবে তিনি যে ধরনের শক্তপোক্ত মহিলা,তিনি চাইলেই ছেলেদের মুখের উপর কথা বলে নিজের জোর দেখাতে পারতেন।এবং তাদেরকে ওবাড়িতে রাখার সুব্যবস্থা-ও করতে পারতেন।তবে তিনি সেটা করেননি।নীরব ছিলেন।মায়ের ভাস্যনুযায়ী হয়তো এটা-ও ঠিক।ভাগ্য চেয়েছিলো অন্যরকম,তাই আজ তারা এখানে।ভাগ্য ভিন্ন।ভাবনা ছেড়ে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো মায়ের দিকে একপলক চেয়ে মৃদুস্বরে বললো।

‘কান্নাকাটি করবেন না।আমি এখন ঠিক আছি।আপনি কেমন আছেন?শরীর ঠিক আছে আপনার?

‘কান্নাকাটি করবো না বলছো?ওই একইভাবে তো তোমার বাবাও চলে গেলেন।আমার প্রথম সন্তান ছিলো আওসাফ।সেই সন্তান আমার আগে চলে গেলো!আমার অবস্থা বুঝতে পারছো?সেই ঘরপোড়া গোয়ালিনী আমি।আমার নিজের কারও এক্সিডেন্টের কথা শুনলে যে আমার পরাণ যায়!আর তুমি আমার সেই সন্তানের সন্তান।তোমাকে সেই আদর আহ্লাদে এই দুহাতে মানুষ করতে পারিনি হয়তো।কাছেও রাখতে পারিনি বলে মনে করো,আমি তোমার মন্দে ব্যথিত হইনা?আমার আফসোস তুমি বুঝবেনা দাদু।তবে তোমার মন্দেও একইভাবে ছটফটায় আমি।কষ্ট পাই,ব্যাথা পাই।যেমনটা আমার আওসাফের মন্দে ব্যথা কষ্ট অনুভব করতাম।আমার বংশের প্রথম নাতী তুমি আমার।অথচ তোমাকে না নিজের কাছে রাখতে পারলাম আর না,নিজের বড় সন্তানের আদরের সন্তান হিসাবে যোগ্য সম্মান দিয়ে আদর আহ্লাদে নিজ হাতে বড় করে পারলাম।না-হলে কি তোমাকে অন্যের দারস্থ হয়ে থাকতে হয়,আর না তোমার এই মহাবিপদের তিনদিনের মাথায় এসে আমাকে দেখতে হয় তোমাকে!

ভদ্রমহিলা কাঁদলেন।বেড থেকে কিছুটা দূর দাড়িয়ে সেই নীরবে কান্না নীহারিকা বেগম-ও দেখলেন,এবং নিজেও উপলব্ধি করলেন।ভদ্রমহিলার প্রতি এতোদিনের অভিযোগ বুঝি তরতর করে কমে যেতে থাকলো উনার।আজ নিজেও সেই একই পরিস্থিতির মোকাবেলা করছেন।উনার সন্তান করুনাময়ের অশেষ রহমতে এখনো বেঁচে আছে।কিন্তু ওই বৃদ্ধা মহিলার সন্তানের লাশতো উনার দুচোখের সামনে দিয়ে কবরে নিয়ে শায়িত করা হয়েছিলো।তবে কি পরিস্থিতি হয়েছিলো উনার!কিভাবে সামলিয়ে ছিলো নিজেকে!আজ তা বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারলেন।সেদিন নীহারিকা বেগমের উপরে দেখানো রাগ ক্ষোভে বলা কথাগুলো হয়তো যথার্থ না থাকলেও,একেবারে অনর্থ ছিলোনা।আর স্বামীর বাড়িছাড়া সেটাতো নিতান্তই ভাগ্যে ছিলো।নয়তো ওই অল্প বয়সে একটা বাচ্চা নিয়ে ওই সংসারে টিকে থাকা দীর্ঘস্থায়ী কখনো সম্ভব হতোনা।যেখানে নিজের দেবরের নজর পড়েছিলো উনার উপর।যার ঘরসংসারও ছিলো।সেই ঘর ভাঙতে চায়নি বলেই নিজ থেকে ওই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি।ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন,স্বামীর সম্পদ নিয়ে নয়।

বাবার নামটা বারবার আসতেই চোখ বুঁজে নিলো নিভান।ববা নামক মানুষটাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসতো, এমনকি ওই মানুষাটও তাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো।নিভানের যেটুকু স্মৃতিতে স্মরণ আছে,বাবা সবসময় তার সাথে আদুরে গলায় কথা বলতো।মানুষটা তাকে এতো ভালোবাসতো,সেই ছোট্টো সময়ের ভালোবাসা স্মৃতিতে স্মরণে না থাকার কথা থাকলেও,স্পষ্ট স্মরণে আছে নিভানের।তাই তো সেই একই আদর পিতৃস্নেহ পাওয়া সত্ত্বেও,জাহিদ সাহেবকে কখনো বাবা ডাকটা ডাকা হয়নি।চোখ বুঁজে থাকা নিভানের মুখের দিকে অনড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রমহিলা।একদম ছেলের কপি।নিভান ছোটো থাকতে ততোটা অনুরূপ না মনে হলেও এখন পুরো অনুরূপ মনে হয়।সেই চোখ, ঠোঁট, গড়ন। এমনকি উঁচু লম্বা,গায়ের বর্ন।ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন। নিভানের কপালে ব্যান্ডেজ জড়ানো সাদা পট্রির উপর প্রগাঢ় চুমু একে দিলেন।মনহলো নিজের ছেলেকেই আদর করছেন।এই উপলব্ধি উনার এখান থেকে অনেকগুলো বছর আগে নিভান যখন দেখা করতে গিয়েছিলো উনার সাথে তখনই অনুভব করেছিলেন।তরপর প্রতিটা রাত উনার আফসোস আর দীর্ঘ নিঃশ্বাসে কেটেছে,নিজের ছেলের অংশকে কাছে ধরে রাখতে না পারার।নিজের আদূরের বড় সন্তানের অস্তিত্ব, রক্ত অন্যের দারস্থ হয়ে মানুষ হওয়ার।উফফ সেই আফসোস কি কখনো মিটবে!মিটবে না।প্রগাঢ় চুমু একে সরে আসলেন ভদ্রমহিলা। ফের আবার নিভানের কপালের ব্যান্ডেজ ছুয়ে আদুরে গলায় অপরাধী মুখ করে বললেন।

‘দাদুমাকে ক্ষমা করো দাদুভাই।তার আদর ভালোবাসা থেকে তোমাকে বঞ্চিত রাখার জন্য ক্ষমা করো।তোমার সাথে হওয়া সকল অবিচার অন্যায়ের জন্য ক্ষমা করো তোমার এই হতভাগা দাদুমাকে।

নিজ রক্ত যতোই দূরে থসক।আর নিজের প্রতি যতোই অন্যায় অবিচার করুক,এই বংশীয় রক্তের টান মায়া যেনো অন্যরকম।দাদুমার আদর ছোঁয়া,বাবার ছোঁয়ার মতো যেনো উপলব্ধি করলো নিভান।সেই প্রেক্ষিতেই মুখে আওড়ালো।

‘এমনভাবে বলবেন না দাদুমা,বাবা কষ্ট পাবেন।উনার মা উনার সন্তানের কাছে এভাবে ছোটো হয়ে কথা বলছে!উনি বেঁচে থাকলে হয়তো এই দৃশ্যটা কখনো মানতেন না।আর আমিও চাইনা,আমার মৃত্যু বাবার মা অসম্মতি হোক।

দাদির ভালোবাসা পেয়েও চোখ মেললো-না নিভান।সেভাবে চোখ বুঁজে রেখে বললো কতগুলো।

‘আর আমার আওসাফের আমানত।তার কলিজার টুকরো যে আমি আগলে রাখতে পারিনি,তারজন্য ও কি আমার উপর মনোক্ষুণ্ণ হবেনা!কষ্ট পাবেনা!

এতোদিন পর এই কথাগুলো মনেহলো!মনে কথাগুলো আসলেও,কথা বাড়ালোনা নিভান।চুপ রইলো।নিভানের থেকে সরতেই ভদ্রমহিলার নজর পড়লো পাশে।নীহারিকা বেগম-কে দেখেই পরাণ কেঁদে উঠলো।নীরবে কিছু সময় তাকিয়ে কাঁপা স্বরে আওড়ালেন।

‘কেমন আছো নীহারিকা?

গলা কাঁপলো নীহারিকা বেগমের।গত হওয়া স্বামী না থাকলেও উনাকে তিনি ভুলে যাননি।আর না তার পরিবারকে।আর না কয়েক বছরের সংসারকে।যখন একাকি সময় পার করেন,মনে পড়ে ফেলে আসা দিনগুলো। সবকিছু।আবার দীর্ঘশ্বাসের সাথে মিলিয়ে যায় মনে পড়া অতিত।ভদ্রমহিলা প্রশ্ন জবতেই, সময় নিয়ে নীহারিকা বেগম উত্তর দিলেন।—ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন মা?

‘এইতো আছি ভালো।তবে মা না-হয় সন্তানের ভালোর জন্য তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো,তুমি সেটা বুঝেও অবুঝ রইলে কিকরে?এই মা-টা কেমন আছে একটু খোঁজখবর নিলে না?জানতে চাইলেনা?আমার অসুস্থতা মৃত্যুশয্যা পর্যন্ত গড়িয়েছিলো।শুধু নাতিকে দেখতে চায়নি আমি,তোমাকেও চেয়েছিলাম।কৈ মা’কে তো একবার দেখতে গেলেনা?মা’কে বুঝি এখনো ক্ষমা করতে পারোনি?

খোঁজ নিয়েছিলো নীহারিকা বেগম।ওই বাড়ির একটা সদস্যর সাথে এখনো যোগাযোগ আছে উনার।তার কাছেই খোঁজ নিয়েছিলো।তবে ভদ্রমহিলা হয়তো জানেন না।জানাতে চাইলোওনা নীহারিকা বেগম। ধীর পায়ে এগিয়ে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে গিয়ে বসলেন।আলতো স্পর্শে উনার হাতটা ধরে বললেন—আপনি তো জানেন সবকিছু। পরিস্থিতি যেটা দাড়িয়েছিলো,ওই বাড়িতে পা রাখার ইচ্ছে আর কখনো হয়নি মা।তবে আপনাদের আমি ভুলিনি মা।আর আপনি এমন কোনো অন্যায় আমার সাথে করেননি যে আপনাকে আমার ক্ষমার নজরে দেখতে হবে।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রমহিলা।ফের রয়েসয়ে বললেন–তুমি যারজন্য ওবাড়িতে পা মাড়াতে চাওনা,সে এখন আর ওই বাসভবনে থাকেনা।সবকিছু বেঁচেকিনে মা-ভাইদের ফেলে পর শহরকে আপন করে নিয়েছে।স্ত্রী সন্তান নিয়ে বিদেশে স্থায়িত্ব হয়েছে।এক সন্তানকে চোখের সামনে দিয়ে কবরে শায়িত করা হলো।অন্য সন্তানকে পরের বাড়ির মেয়ের জন্য কাছছাড়া করতে চায়নি আমি।তাই সেদিন আমার আওসাফের কাছে জবাবদিহিতা করা লাগবে জেনেও আমি তোমাদের প্রতি অবিচার করলাম।সেদিন নীরব থেকে বাড়িছাড়া হতে বাধ্য করলাম।অথচ সেই তাই হলো।সেই সন্তান নিজের ভালোর জন্য,নিজের সুখের জন্য আমার কাছছাড়া হয়েই গেলো।অথচ আমি তোমাদের কাছে আমার মৃত সন্তানের কাছে কতোবড় দ্বায়ী হয়ে রইলাম।আমাকে ক্ষমা করে দিও নীহারিকা!ক্ষমা করে দিও!

মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রমহিলাকে স্বান্তনা দিতে থাকলেন নীহারিকা বেগম।সেখান থেকে কিছুক্ষণ পর নিভানের আরও ছোটো চাচা ঢুকলো কেবিনে।যিনি নিভানের দাদুমাকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন।তবে নিভানের জন্য ফলমূল নিয়ে আসতে, মাকে এগিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন।ভদ্রমহিলা অসুস্থ নাতীকে দেখার জন্য উনাকে পথে কোথাও দাঁড়াতে দেয়নি।বিধায় উনাকে হসপিটালে পৌঁছে দিয়ে উনি পুনরায় ফলমূল আনতে গিয়েছিলেন।নীহারিকা বেগম যখন বাড়ি ছেড়েছিলেন ছেলেটা ছোটো ছিলো।কেবল ইন্টারমিডিয়েট পড়ে।সেই ছেলের এখন ভরা সংসার।ভালোমন্দ আলাপন সেরে,সাংসারিক ভালোমন্দ কথায় মত্ত হলো তিনজনে।সেখানে নিভান শুধু নীরব দর্শক।
সবার কথা শুনে যাচ্ছে।যদিও ছোটো চাচার সাথে তার মোটামুটি সম্পর্ক।যোগাযোগ ও আছে।চলতো মাঝেমধ্যে।তবে ওবাড়িতে আসা যাওয়া ছিলো-না।সেই সম্পর্কে উনি নিভানের সাথেও মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা সারছেন।তবে নিভানের মন অন্য কোথাও।নজর আবদ্ধ কেবিনের দরজায়।এই বুঝি সেই কাঙ্ক্ষিত মুখটা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো।কিন্তু নসহ!সময় অপেক্ষার গড়াচ্ছে।অপেক্ষা করতে করতে আজ চারটা দিন।অথচ সেই মুখটার দেখা নেই।মাথা সোজা করে চোখ বুঁজে নিলো নিভান।শক্তমনে হঠাৎই অভিমানেরা জায়গা করে নিলো,যেখানে যুক্ত হলো অভিযোগেরাও।সে মনেমনে আওড়ালো।

‘তুমি এতো নিষ্ঠুর নির্দয়া কি-করে হতে পারো কৌড়ি?
কি করে?তবে কি আমি তোমাকে কোমল ফুলটা ভেবে মারাত্মক ভুল করে ফেললাম?

শীতের দক্ষিণা হিমেল হাওয়া বইছে এলোমেলো ভাবে।প্রচুর ঠান্ডাভাব।সেই ঠান্ডাভাব ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিভানের হালকা ফুলসিল্ভ সাদা টিশার্টটা ভেদ করে।তবুও অনড় ছেলেটা।যেনো শীতল বাতাসটা তার শরীর ছুঁয়ে গেলেও ভিতরটা ছুঁয়ে দিতে পারছেনা।যে ঠান্ডা ভাবটায় শরীর হিম হয়ে আসছে,তা কিছুতেই ভিতরের জ্বলন’টা নিভাতে পারছেনা।বাড়িতে এসেছে কাল বিকালে তবুও মেয়েটার দেখা নেই।দুর প্রান্তে স্থির হয়ে থাকা বাদামিবর্ন নজরজোড়া এবার আপনমনে বুঁজে নিলো নিভান।হঠাৎ সেই শান্ত পায়ের কদমধ্বনি। হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো নিভানের।কৌড়ি এসেছে।মেয়েটার পায়ের নিঃশব্দতাও তার চেনা।সে শতভাগ সিওর কৌড়ি এসেছে।ভিতরের জ্বলনটা কমার বদৌলে বেড়ে গেলো দ্বিগুণ।তবে ভুলেও পিছু ফিরলো না নিভান।প্রগাঢ় এক অভিমানে সেভাবেই চোখবুঁজে অনড় দাঁড়িয়ে রইলো।মনেমনে অভিমানী মন প্রশ্ন যাপলো, সত্যিই কি মেয়েটা তারজন্য এসেছে?মরে যাচ্ছিলো তাই মেয়েটা দেখতে যায়নি,আর এখন তো সে সুস্থ।
দুরুদুরু বুকে নিভানের কয়েক কদম পিছে এসে দাড়ালো কৌড়ি।সেদিনের পর এই মানুষটাকে একটাবার দেখার জন্য কতোটা উতলা হয়ে ছিলো তার মন।সেটা শুধু সেই জানে। হসপিটালে যাওয়ার জন্যও মুখিয়ে ছিলো।অথচ সবার হসপিটালে অবাধ যাওয়া আসা চললেও, তাকে যেনো সেখানে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।এমনটা ভেবে বসেছিলো সবাই।দ্বিধায়,লজ্জায় সেও আর বলতে পারিনি, মানুষটাকে একটু দেখতে সেও হসপিটালে যেতে চায়।কাল বিকালে যখন মানুষটাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো।কৌড়ি সামনাসামনি না যেতে পারলেও,দরজার আড়াল থেকে অসুস্থ মানুষটাকে খুব খেয়াল করে দেখেছিলো।শ্যামবর্ণ মুখটা সেই গম্ভীর্য।কপালে মোটা করে ব্যান্ডেজ জড়ানো।হাতেও সেই একই অবস্থা।ইশ,ওই অবস্থায় মানুষটাকে দেখে পরানটা কিভাবে ছলকে উঠেছিলো!আজ সকাল থেকেও সুযোগ পায়নি মানুষটাকে দেখার, আর কাছে যাওয়া তো অপ্রকাশ্যভাবে বারণ।এই নিষেধ বারণ কেউ না করলেও,কুন্ঠায় এই নিষেধ যেনো সম্পর্কের অধিকারের।তবে বারবার খেয়াল রেখেছে,মানুষটা ড্রয়িংরুমে আসলো কি-না?রুম থেকে বের হলো কি-না? কিন্তু না আজ সারাদিনে মানুষটা সকাল থেকে রুম থেকে বের হয়নি।তার সকল প্রয়োজন অপ্রয়োজন রুমে মেটানো হয়েছে।সেখানেও বাড়ির সবার অবাধ যাতায়াত থাকলেও,সম্পর্কের খাতিরে তার যাওয়া প্রশ্নেবিদ্ধের!

‘কিজন্য এসেছো?

ভারী গলায় চমকে উঠলো কৌড়ি।মুখ উঁচু থাকলেও,খেয়ালি নজর ভাবনায় ডুবে ছিলো।গম্ভীর স্বরের বার্তা কানে আসতেই নজট খেয়ালি হয়ে উঠলো।
উচুলম্বা মানুষটার পিছন দেখা গেলেও,সামনে দেখার উপায় নেই।তবে মানুষটার গম্ভীর গলাটা আজ আরও দৃঢ়।কিন্তু তারসাথে তো কখনো এতো কঠিন গলায় কথা বলেনা।তবে কি?ভাবনা না এগিয়ে কিছু বলতে গিয়েও দ্বিধায় পড়লো কৌড়ি।কি বলবে?কি জিজ্ঞেস করবে সে?কখনো নিজ ইচ্ছেতে মানুষটার সাথে কথা হয়নি তার!তবে কি জানতে চাইবে?আর জানতে চাওয়াতে আসছে যাচ্ছেই বা কি?কৌড়ির নীরবতা আরও জ্বালিয়ে দিলো নিভানকে।মূহুর্তেই ঘুরে কৌড়ির মুখোমুখি দাঁড়ালো সে।ক্ষোভিত গলা শুধালো।

‘বাড়িতে কুকুর বিড়াল পুষলেও মানুষের তারপ্রতি একটু মায়া জন্মায়।টান হয়।সেখানে আমিতো মানুষ।আমার দূর্বলতা তুমি।জেনেও তোমার কি একটুও আমার জন্য মায়া হয়নি কৌড়ি?আমি মরে যেতে পারতাম,সেটা জেনেও কি আমাকে একটু দেখতে ইচ্ছে হয়নি তোমার?

তীব্র অভিযোগে বুক কেঁপে উঠলো। হৃদপিণ্ডে বিধলো যেনো সূচালো তীর।সেই যন্ত্রণায় চোখে ভিড় করলো নোনাজল।তবে সেই নোনাজল দাঁতে দাঁত চেপে রোধ করলো কার্নিশ বেয়ে গড়ানো থেকে।গলা কাঁপলো কথা বলতে গিয়ে।তবুও বললো।

‘আমি যেতে চেয়েছিলাম।

‘আমি অপেক্ষাতে ছিলাম।কিন্তু তুমি যাওনি।কেনো?

এই কেনোর জবাবদিহিতা দিতে গিয়েও দিতে পারলোনা কৌড়ি।শুধু অনিমেষ চেয়ে রইলো নিভানের ক্ষোভিত শ্যামবর্ণ মুখে।কৌড়িকে চুপ থাকতে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো নিভান।যেনো সেই হাসি নিজের উপর তাচ্ছিল্য করা।মুখে বললোও সেরকম তাচ্ছিল্যময় কথা।আগের সেই ক্ষোভ নেই গলায়।গলার স্বর এবার শীতল হলো।সেই শীতল গলার শিথিল বাক্যে কৌড়ির স্পন্দন থমকে গেলো।

‘বিগত চারদিন আমি হসপিটালে শুয়েবসে এটা রিয়েলাইজড্ করলাম,আমি সত্যিই তোমার উপর জোরাবাদী করছি।তুমি ঠিকই বলেছো।আমার,তোমার উপর অনুভূতি জন্মাতেই পারে,সেটা আমার অনুভূতি আর মনের ব্যাপার।তাই বলে তোমার তো বাধ্যবাধকতা নেই,যে সেই একই অনুভূতি তুমি আমাতেও অনুভব করবে।সেই ক্ষেত্রে আমি সত্যিই তোমার উপর জোরাবাদী করছি।দুঃখিত।খুব খুব দুঃখিত।

চোখ বুঁজে ফেললো কৌড়ি। মূহুর্তেই চোখের কার্নিশ বেয়ে অর্নগল নোনাজল গড়ালো। সেটা দেখে ভিতরটা আরও জ্বলে উঠলো নিভানের।তীব্র আক্রোশ নিয়ে কৌড়ির মুখের কাছাকাছি গিয়ে দাড়ালো সে।ফের নিজের ভিতরে জমা সকল অভিমান অভিযোগ মিশিয়ে রাগমিশ্রিত কন্ঠে বললো।

‘তুমি প্রার্থনা করতে আমার ফিরে না আসার।তোমাকে জোরাবাদী করার মানুষটা একেবারে মিলিয়ে যেতো তোমার জীবন থেকে,সেই সুখে তুমি মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে বেড়াতে।প্রার্থনা করতে তুমি আমি না ফিরে আসতাম,তোমার কাছে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে