#ফুলকৌড়ি
(৩২)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
বিয়ে বাড়ি মানেই হৈ-হুল্লোড়ে ছোটাছুটি।তবে বাড়ির অধিকাংশ অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা মেহেন্দি অনুষ্ঠানে যাওয়ায় বাড়িটা আপতত কিছুটা হৈ-হুল্লোড়মুক্ত শব্দহীন, শান্ত।সন্ধ্যা নেমেছে সেই কখন।মান্যতার পড়ার টেবিলে মনোযোগী হয়ে পড়ছে কৌড়ি।যদিও স্থির,মনোযোগী নজর তার বইয়ের পাতায় তবে অমনোযোগী মনটা তার পড়ে আছে অন্যকোথাও।অন্যকোথাওটা ঠিক কোথায়!যে মানুষটার থেকে বারংবার নিজেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলো।তারকাছে?হ্যাঁ তার কাছেই তো!পারছে কোথায় ওই মানুষটাকে নিজের মনস্তাত্ত্বিকে ভাবনা থেকে দূরে রাখতে!যতোই দূরে রাখতে চাইছে,ওই মানুষটা যেনো ততোই টানছে তাকে।তারপ্রতি ভয়াবহ দূর্বল করে তুলছে।দূর্বল তো এমনিতেই হয়ে পড়েছে সে।শুধু উপরে নিজেকে শক্ত রাখার প্রয়াস করে চলে।তবে সেই প্রয়াস,প্রচেষ্টাটাও রাখতে দিচ্ছে কোথায় মানুষটা!বিকেলের বলা গম্ভীর মুগ্ধকন্ঠের অনূভুতিপূর্ন কথাগুলো বারবার মনস্তাত্ত্বিকে হানা দিচ্ছে।শান্তিতে কোনো কিছুতেই তাকে মনোযোগী হতে দিচ্ছে না।না পারছে বইয়ের পাতায় মনোযোগী হতে আর না পারছে বিয়ে বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় করে কাটাতে।যদিও শারিরীক কারনে আপতত হৈ-হুল্লোড় তার ভালো লাগছেনা।আবার পনেরো দিন পর পরিক্ষা। আপতত সেই টেনশনে মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।তারউপর ওই মানুষটা!যাকে না পারছে বিভিন্ন দিকের কথা ভেবে সহজে নিজের জীবনে জায়গা দিতে।আবার আর না পারছে নিজের মনস্তাত্ত্বিক থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে।বরাং বারবার মনেহচ্ছে,ওই মানুষটা শুধু তাকে চায়!উনার সকল মুগ্ধকরা অনুভূতি শুধুই তাকে ঘিরে!উফফ এই ভাবনা গুলো সর্বাঙ্গে যেমন থেমেথেমে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে তেমন মনমস্তিষ্ককে এলোমেলো করে দিচ্ছে।দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো কৌড়ি।কি এক যন্ত্রণা!তাকে নিয়ে মানুষটার অনুভূতিগুলো জানার পর আরও যেনো মন ছটফট করছে।যতোই মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছেনা কেনো,পারছেইনা!হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো।সচকিত হয়ে মাথা উঁচু করে ফোনের দিকে তাকালো।বিথী ফোন করেছে।ফোনটা রিসিভ করে,কানে চাপলো কৌড়ি।প্রতিনিয়ত কথা হয় দু’জনের।সেই হিসাবে ভালো মন্দের বার্তা শুরু হলো।একপর্যায়ে গিয়ে বিথী জিজ্ঞেস করলো।
‘তোর মন খারাপ নাকি?
সচকিত হলো কৌড়ি।তড়িৎ বললো—আরেহ না।
‘তবে কথার স্বর ভালো লাগছে-না কেনো?কথাগুলো যেনো কেমন লাগছে!
‘জানিসতো বাড়িতে বিয়ে।তারউপর পনেরো দিন পর পরিক্ষা টেনশনে মাথায় কাজ করছেনা।এখানে আসার পর পড়ার গ্যাপ গিয়েছিলো প্রায় অনেকদিন।সেই গ্যাপ পড়া চ্যাপ্টারগুলো সেভাবে কভার করা হয়নি।তারউপর যা সিলেবাস।কিভাবে সবটা কমপ্লিট করবো সেটাই ভাবছি।
‘টেনশন নিচ্ছিস কেনো।আরেহ সব ভালো হবে।ইউ আর এ গুড স্টুডেন্ট।এটা তো শুধু আমরা বলিনা,তুই ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করিস।তবে কেনো এতো ভাবছিস?সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে দেখিস।বরাবরের মতো তোর পরিক্ষাও ভালো হবে।
‘হুমম।তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?
যদিও জানাশোনা উত্তর তবুও জিজ্ঞেস করলো কৌড়ি।—আরেহ এতো পড়াশোনা দিয়ে কি হবে ভাই।
তারউপর সেই পড়াশোনা নিয়ে টেনশন!আমি বিথী জানিসইতো পড়াশোনা নিয়ে সবসময় চিল থাকি।পড়াশোনা নিয়ে টেনশন নিয়েছি কখনো।তাতে যাহা আছে কপালে।আপতত তুইও টেনশন নিসনা।
টেনশন নিসনা বললেই কি হয়।মাথায় ভাবনা যে তার কতপ্রকার এসে চেপেছে এটা যদি সে,এই চিলমুডে থাকা মেয়েটাকে বোঝাতে পারতো!বোঝাতে চাইলোওনা কৌড়ি।তাই ওই বিষয়ে আর কথাও বাড়ালোনা।দুই বান্ধবীতে মিলে আরও কিছুসময় কথা বললো।কথা শেষ করে কৌড়ি যখনই ফোন কাটতে যাবে তখনই বিথী পুনরায় তাকে অদ্ভুত গলায় ডেকে উঠলো।
‘এই কৌড়ি।
ডাকটা অদ্ভুত ঠেকলো কৌড়িরও। কপালও কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো।কিছুটা চিন্তিত গলায় বললো—এভাবে ডাকলি কেনো?কিছু হয়নি তো ওদিকে?
‘আরেহ না।তবে তোকে কিছু বলার ছিলো।
‘কি?
কথাগুলো বলবে কি বলবেনা কিছুটা দ্বিধায় ছিলো বিথী।যার কারনে কল করে কথাগুলো বলতে চেয়েও বলেনি।তবে বলেই যখন ফেলেছে আর দ্বিধা রাখলো না।বললো।
‘জানিস নাহিদ ভাইয়া না ভালো হয়ে গেছে।আগের মতো আজেবাজে ছেলেদের সাথে মোড়ের মাথায় বসে থাকে না।এমনকি সময় অসময়েও তাকে আড্ডা দিতে দেখা যায় না।একেবারে খুবই ভদ্রসদ্র ছেলে না হয়ে গেলে-ও,স্বাভাবিক ছেলেদের মতো চলনফিরন করছেন।কথাবার্তা চালচলনে আগের সেই উগ্র আচারন আর নেই।জানিস আব্বু এসেও প্রায় বলে,মাস্টারের ভাইয়ের ছেলেটা বুঝি এবার ভালো পথে ফিরলো।নিশির সাথেও প্রায় দেখা হয়।ও-ও বলেছে,ভাইয়া নাকি আগের মতো ওসব উল্টো পাল্টা সাইপাস আর খায়না।ওর সাথে-ও নাকি আগের মতো বকাবকি চিল্লাপাল্লাও আর করে-না।মাঝে একদিন কলেজে যাওয়ার পথে আমার সাথে দেখা হলো। আমার কাছে-ও তোর খবর জানতে চাইলেন।উনি যেভাবে জিজ্ঞেস করলেন মনে তো হলো আমার সাথে যে তোর যোগাযোগ আছে।এটা উনি সিইওরলি জানেন।সেভাবেই তো প্রশ্ন করলেন বলেও মনেহলো আমার।তাই আমিও আর এড়িয়ে যেতে পারিনি।বলেছিলাম,তুই ভালো আছিস।তারপর ভালো ছেলের মতো চলে গেলেন।উনার আচারন দেখে আমার সত্যি মনেহচ্ছে উনি ভালো পথে ফিরেছেন তবে!আগে তো আমাকে দেখলেই,এই ছেমড়ি ছাড়া শব্দ ব্যবহার করতো না।সেদিন নাম ধরেতো ডাকলেন সাথে তুমি করেও কথা বললেন।
কিছুটা অবাক হলো কৌড়ি।দাদিআপার সাথে রোজ কথা হয়।কৈ,দাদিআপা তো এবিষয়ে তাকে কিছু বলেন নি!আবার বিথীর কথাও অবিশ্বাসযোগ্য নয়।মেয়েটাকে চোখবন্ধ করে বিশ্বাস করে এমনটা নাহলেও অবিশ্বাস সে কখনোই করতে পারবেনা।যাই হোক এসব নিয়ে আর সে ভাবতে চায়-না।যে ছেলেটার জন্য মা-হীন জীবনটা তার আতঙ্কে কেটে গিয়েছে।জীবনে কতোকিছু ত্যাগ করতে হয়েছে।এমনকি নিজের বাড়িতে সাচ্ছন্দ্য বসাবস করার অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত।আজ পরের বাড়িতে আশ্রিতা হতে হলো।বাবার তাকে নিয়ে চিন্তায় ব্লাডপ্রেশার বাড়ানো বা এই অকাল মৃত্যুর জন্য ছেলেটা কোনোভাবে কি দ্বায়ী নয়?আর সেই ছেলেটার ভালোমন্দে চাইলেই কি মন সহানুভূতি দেখায়!দেখায় কি-না কৌড়ির জানা নেই।তবে সে দেখাতে পারলোনা।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিথীকে বললো।
‘যাই হোক,ভালো হলেই ভালো।তবে আমার ফোন নাম্বর চাইলে কখনো দিস-না যেনো।আমি সত্যি, তোকে কিন্তু দাদিআপার থেকেও একফোঁটা কম বিশ্বাস ভরসা করি না।
‘আমি জানি সেটা।আর আমার জ্ঞানত আমি কখনো তোর সেই ভরসা বিশ্বাস ছুটতে দেবনো।এটা তুই আমার উপরে ভরসা রাখতে পারিস।
‘ভরসা রাখি বলেই তো তোকে এক্সট্রা সর্তক করলাম।
‘হুমম।
দু’জনে আরও কিছু সময় ভালোমন্দ কথা বললো।ফের ফোন রাখলো।ফোন কেটে দিয়ে ভাবনায় ব্যস্ত হলো কৌড়ি।হঠাৎ উগ্র স্বভাবের ছেলেটার পরিবর্তনের কারন কি!ছোটো বেলা থেকেই বাজে উগ্র স্বভাবের ছেলেটা হঠাৎই পরিবর্তন হয়ে গেলো!বিষয়টা বিস্ময়কর!
যেখানে ওর মা-ও কখনো আশা রাখেনি ছেলেটার আর ভালো পথে ফিরবে।একপ্রকার আশা ছেড়ে দিয়ে, নিজের ছেলে নেই বলে ঘোষনাও দিয়ে দিয়েছিলো।সেখানে নিজের মায়ের ওমন কথাতেও যে ছেলে ভ্রুক্ষেপ করেনি,সেই ছেলের হঠাৎ পরিবর্তনের কি কারন?তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা!যদি তাই হয় তবে তা কখনোই সফল হতে দেবেনা কৌড়ি।আর যাই হোক ওই ছেলেটাকে জীবনসঙ্গীনি কখনো সে হবেনা। আর না কখনো সে নিজের জীবনসঙ্গিনী করবে তাকে।
‘ফুলকৌড়ি।একা একা রুমে বসে কি করছো তুমি?
নাফিমের ডাকে ভাবনা কাটলো কৌড়ির।সম্বিৎ ফিরে মিষ্টি হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কিছুটা বিস্ময় স্বরে নাফিম ফের বললো—তুমি পড়ছো?তোমার পড়তে এতো ভালো লাগে?যে সবাই এতো আনন্দ মজা করছে,তারমধ্যে তুমি তাদের সাথে আনন্দ মজা, সাজগোজ না করে বই পড়ছো!আমার তো একটুও লাগেনা পড়তে।আরও বাড়িতে কোনো আনন্দ মজা হলে-তো মোটেই ভালো লাগেনা।
কথা বলতে বলতে কৌড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো নাফিম।চেয়ার ঘুরিয়ে নাফিমের সম্মুখীন হলো নিজেও।আদূরে স্পর্শে নাফিমের গাল দুটো টেনে দিয়ে বললো—পাকা বুড়ো।আমার যে কয়দিন পর পরিক্ষা, না পড়লে হবে!না পড়লে তো আমি পরিক্ষায় গোলগোল ডিম পাবো।তখন এবাড়িতে আমার জায়গা হবে।ফেল করার অপরাধে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।কে খাওয়াবে তখন আমাকে?হুমম?
মজার ছলে কথাগুলো বলতেই নাফিম তড়িৎ উত্তর দিলো।–দাদাভাই খাওয়াবে।দাদাভাই তো অনেক টাকা উপার্জন করে,তুমি জানোনা?আর জানো দাদাভাই খুব ভালো।দুষ্টমী না করলে,সে কাওকেই বকেনা।এমনকি আমি পরিক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করলেও আমাকে-ও বকেনা।শুধু দাদাভাই কেমন গলায় শান্ত হয়ে অল্প কথা বলে তাতেই ভয় পাই আমরা।নাহলে দাদাভাই খুব ভালো।আমি যা চাই তাই এনে দেয়।মা বকলেও কি! এনে দেয় দাদাভাই।আর আমার খারাপ রেজাল্টে সবাই বকলেও দাদাভাই আর বড়আম্মু কখনো বকেনা।তুমি পরিক্ষা খারাপ করলে তোমাকেও কিছু বলবেনা,দেখো।
দাদাভাই খাওয়াবো”কথাটা বুকের ভিতর কেমন একটা শিরশিরি অনুভূতি জাগালো।তবে ভিতরেটা ভিতরে হজম করে বাহিরের প্রকাশভঙ্গীতে মৃদু হাসলো কৌড়ি।প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো–আচ্ছা যাই হোক।তুমি মেহেন্দি অনুষ্ঠানে যাওনি?
মূহুর্তেই মুখ ভার করে মন খারাপ করে নিলো নাফিম।ফের বললো–আমার গায়ে জ্বরতো এজন্য আম্মু যেতে দেয়নি।তুমি-ও আমার মতো অসুস্থ নাকি?তুমি যাওনি কেনো?
নাফিমের কপালে হাত দিয়ে জ্বরের তাপমাত্রা দেখলো কৌড়ি।বললো–জ্বর আসলো কখন?আর আমি-তো এমনিতেই যায়নি।
‘আমাকে রেখে যাওনি ভালো হয়েছে।এখন আমি তোমাকে মেহেদী মাখিয়ে দেবো।চলো
কথাটা কৌড়ির হাত ধরে বললো।কৌড়িও সচকিত দৃষ্টি ফেললো নাফিমের হাতে।ছেলেটার হাতে একটা মেহেদী টিউব।এতক্ষণে খেয়াল করলো সে।নাফিম এটা পেলো কোথায়?তবে কিি মেহেন্দি অনুষ্ঠান সেরে আপুরা এসেছে?প্রশ্ন করলো কৌড়ি।
‘ওবাড়ি থেকে মেহেন্দি অনুষ্ঠান সেরে আপুরা চলে এসেছে নাফিম?
‘না-তো।কেনো?
‘তবে তুমি মেহেদী পেলে কোথায়?উনারাতো ডালা সাজিয়ে সব নিয়ে গেছেন।তাহলে এটা পেলে কোথায় তুমি?
নাফিম সহজ সাবলীল স্বীকারোক্তি জানালো—দাদাভাইয়ের হাতে তো আরেক ডালা মেহেদী দেখলাম।তোমার রুমের দিকে আসছিলাম,সেটা শুনে আমার হাতে একটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,তোমাকে দিতে।আমিও ভাবলাম তোমাকে লাগিয়ে দেই।
স্তব্ধ হয়ে নাফিমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।
এটাও মানুষটার স্মরণে থাকতে হলো।মনে মুগ্ধতা ছেয়ে গেলো।মন দূর্বল হয়ে পড়লো আরেকধাপ।তবে মূহুর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে একগাল হেসে নাফিমকে বললো—তুমি লাগাতে পারবে?আমি কিন্তু আবার লাগাতে পারিনা।
‘আমিও তো,ওইযে হাতে ড্রয়িং করেনা!ওরকম পারিনা।তবে এমনি অনেককিছু ড্রয়িং করতে পারি।আমি সেরকম একে দেবো।আমার ড্রয়িং খাতা দেখো,আমি একটুও বাজে আকাই না।আমার অন্যন্য সাবজেক্ট বাজে হলেও আমার ড্রয়িং বাজে নয়।টিচার্সরা আমার আকা খুবই ভালো বলে।
বাচ্চা ছেলেটা এমনভাবে কৈফিয়ৎ দিচ্ছে,কৌড়ির মায়া হলো।যদিও তার ফর্সা হাতদুটো নাফিমের ড্রয়িং খাতা নয়।যে আঁকলাম ভালো হলোনা আবার মুছে আঁকলাম।হাতের অবস্থা খারাপ হতে পারে বুঝেও নাফিমের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সে।বললো–তবে আঁকাও।
নাফিম হাত ধরে বেডে এনে বসালো কৌড়িকে।খুশি মনে কৌড়ির ডান হাতটা ধরলো মেহেদি লাগানোর জন্য।তবে হাতের সীমিত তালুর দিকে তাকিয়ে আকা ভুলে গেলো সে।বুঝতে পারলো এটা সত্যিই তার ড্রয়িং খাতা নয়।এখানে যেমন খুশি ঘরবাড়ি নদীনালা বা প্রাকৃতিক যেকোনো দৃশ্য আকা সম্ভব নয়।তবে কি আঁকাবে সে?কৌড়ির উৎসাহিত ঝকঝকা মুখের দিকে তাকালো।মুখটা নীরসত করে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে বললো।
‘এতো ছোটো জায়গায় আঁকাবো কি?
কৌড়ি দুকাধ ঝাঁকিয়ে ঠোঁট উল্টে বোঝালো-সে কি জানে।সেটা দেখে নাফিম আরও হতাশ হলো।তন্মধ্যে সেখানে প্রবেশ করলেন নিভানের নানুমা।রসিকতা করে বললেন– ব্যাপার কি?দু’জনে চুপিচুপি কি করছো?
কৌড়ি কিছু বলার আগে নাফিম নীরস ভঙ্গিতে বললো-ফুলকৌড়িকে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছি।তবে আমি আঁকতে পারছিনা নানুমা।এটুকু জায়গায় কি আঁকানো যায়?
ভদ্রমহিলা এসে বসলেন দু’জনের পাশে ফের নাফিমের কথায় তাল মিলিয়ে বললেন-আসলেইতো এতো ছোট্টো হাতে আকা যায়!যাই হোক,আমার কাছে মেহেদী টিউবটা দাও দেখি।দেখি আমি পারি কিনা লাগিয়ে দিতে?
নাফিম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো–তুমি আকাতে পারো নানুমা?
‘দেখি পারি কি-না।
দু’জনের কথার মাঝে কোনো কথা বললো না কৌড়ি।নাফিম টিউবটা দিতেই ভদ্রমহিলা কৌড়ির পানে তাকিয়ে বললেন–কিরে আমার হাতে মেহেদি লাগাতে কোনো সমস্যা নেই তো?
কৌড়ি মৃদু হাসলো।জানেনা নানুমা মেহেদী লাগাতে পারেন কি-না।তবে তিনি ভালোবেসে যখন লাগাতে চাইছেন,সে যেমনই হোক না কেনো না বলার কোনো প্রশ্নই আসেনা।তাই মাথা নাড়িয়ে মুখে বললো—আপনি লাগিয়ে দিন।আমার সমস্যা নেই।
ভদ্রমহিলা হাসলেন।নাতী উনার নাতবৌ নির্বাচন করতে মোটেই ভুল করেনি।আজ দুদিন মেয়েটার সাথে থাকছেন।সত্যি বলতে মেয়েটাকে উনার সর্বদিক থেকে মনে ধরেছে।কৌড়ির হাত ধরে কোনো আঁকাআকি নয়, শুধু ফর্সা চিকনচাকন আঙুলের গোলাকৃতি করে নখ বাদে চামড়ার উপর প্রলেপ লাগিয়ে দিলেন।সঙ্গে সঙ্গে নাফিম মৃদু চিৎকার দিয়ে বললো।–কি করছো নানুমা। না আঁকিয়ে এরকম লেপ্টে দিচ্ছো কেনো?
‘আমিও তো ভাই আঁকতে পারিনা।তাই আমদের সময় আমরা যেভাবে শুধু আঙুলে মেহেদী মাখতাম সেভাবেই মাখিয়ে দিচ্ছি।
নাফিম কৌড়ির মুখের দিকে তাকালো।দেখলো কৌড়ির স্বাভাবিক মুখাবয়ব।তারমানে নানুমা ভুলভাল লাগাচ্ছে না।তাই সেও চুপচাপ হয়ে গেলো।দুহাতে নখের অংশটুকু ছাড়া একটা নির্দিষ্ট পরিমাপ করে গাড় কালো খয়েরী মেহেদী রঙটা ফর্সা হাতজোড়ায় বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে।বামহাতের তলায় আবার গোলাকৃতি করে মেহেদীর প্রলেপ আঁকিয়ে দিয়েছেন।ফর্সা হাতটা সত্যিই নজরের মাধুর্য ছড়িয়েছে।
‘নাও,আমি যেটুকু পারি সেটুকু করে দিলাম।
টিউব দিয়ে নয়।টিউবের মাথায় মেহেদী এনে,নানুমা উনার তর্জনী আঙুলের মাথায় করে মেহেন্দিটা এতো সুন্দর পরিমাপ করে লাগিয়ে দিয়েছেন।সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।প্রশংসা করলোও কৌড়ি।খোশমেজাজে বললো।
‘খুব সুন্দর হয়েছে নানুমা।আমি এভাবে মেহেদী লাগাতে গেলে তো শুধু লেপ্টে যায়,এঁকেবেঁকে যায়।
নাফিমও কৌড়ির মতো নানুমাকে প্রশংসা করলো।ফের কিছু একটা ভাবলো।তড়িৎ বললো–ফুলকৌড়ি তোমার ডানহাতটা দাও।
কৌড়ি,কেনো?প্রশ্ন করার আগেই তার হাতটা সর্তকতা অবলম্বন করে নিজের কাছে নিলো নাফিম।ফের নানুমার হাত থেকে টিউবটা নিয়ে কৌড়ির হাতের তালুতে ইংরেজিতে ওর নামের ওয়ার্ড গুলো ক্যাপিটাল লেটারে লিখে দিলো।সেটা দেখে কৌড়ি কপাল কুঁচকে বললো।–এটা লিখছো কেনো?
‘আমার নামটা তোমার হাতে লিখে দিলাম।
স্বাভাবিক হলো কৌড়ির কপালের ভাজগুলো।ফের বললো—কেনো?
নাফিমের মুখ কাচুমাচু হয়ে গেলো।নানুমাও কৌতুহলী নজরে তারদিকে তাকিয়ে আছেন,কি উত্তর দেয় ছেলেটা।নাফিম একবার নানুমা তো একবার কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে সংকোচ নিয়ে বললো।
‘আমি দীবা আপুকে দেখেছি সিয়াম ভাইয়ার নাম তার হাতে লিখতে।
‘উনিতো আপুর হাজবেন্ড তাই লিখেন।তুমি কেনো লিখলে?
‘ বড় হয়ে আমি তোমাকেই বিয়ে করবো।তাই আগে থেকে তোমার হাতে আমার নাম লিখে দিলাম
‘ওমা তাই।তুমি তবে বউ হিসাবে ফুলকৌড়িকে ঠিক করে রেখেছো।
নিভানের নানুমা হেসে কথাটা বললেন।কৌড়ি কিছুটা অবাক হলো।ফের হেসে মজার ছলে বললো–তুমি জানো, তুমি যখন বড় হবে।আমার তখন নানুমার মতো বয়স হয়ে যাবে।তখন তোমার পাশে আমাকে মানাবে?খারাপ দেখাবেনা।লোকে বলবে,ওরে বাবাহ নাফিমের বউতো দেখি বুড়ি।
মন খারাপ হলো নাফিমের।তবে প্রশ্ন করতে ভুললো না।
‘কেনো?তখন তুমি অসুন্দর হয়ে যাবে?
‘তা তো অবশ্যই।
‘তবে আমি তোমার মতো দেখতে সুন্দর আরেকটা মেয়েকে নাহয় আবার বিয়ে করে নেবো।
‘আমাকে ছেড়ে তুমি আরেকটা বিয়ে করবে?
মিছেমিছি বিস্ময় দেখিয়ে কথাটা বললো কৌড়ি।এই নিয়ে নানুমা আর কৌড়ি নাফিমের সাথে বেশ মজার ছলে তর্কবিতর্ক করতে থাকলো।একপর্যায়ে গিয়ে নাফিম বললো,হাতে লেখাটা থাক।তবে সে কৌড়িকে নয়,কৌড়ির মতো দেখতে সুন্দর একটা মেয়েকে না-হয় বিয়ে করবে।
★
দ্বিতীয় আর কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়াই তন্ময়ীর আর ইভানের বিয়েটা হয়ে গেলো।তৃনয়ের সেই বন্ধুর বাংলোবাড়িতেই বিয়েটা অনুষ্ঠিত হয়েছে।বিয়ে বাড়িতে মানুষের উপচে পড়া ভিড়।বিয়েটা পড়ানো হয়ে গেলেও বিয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম এখনো বাকি।সেগুলো কাজী সাহেব নিপুণ হাতে করে চলেছেন।আপতত বিয়ে বাড়ির সকলের উপস্থিতি সেখানেই।কৌড়িও সবার সাথে সেখানে ছিলো।তবে নাফিমের জন্য বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়াতে পারলো।ছেলেটার জ্বর বেড়েছে।জ্বর অবস্থায় কিছুতেই স্বান্তনা রহমান আসতে দিতে চাননি।তবে ইভান মানেনি।ছোটো ভাইটা তার বিয়েতে উপস্থিত থাকবে না!এটা কিকরে হয়ে!অসুস্থ ছেলেটা বিয়ে বাড়িতে এসে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।জ্বরটাও প্রচন্ড বেড়েছে।এতো সময় মান্যতার কাছে থাকলেও,বিয়ে পড়ানোর আগে নিরিবিলি কৌড়ির কাছে রেখে গিয়েছে সে।হাত ধরে পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার কপালে হাত রাখতেই হাতটা যেনো জ্বলে গেলো কৌড়ির।ফর্সা গোলগাল মুখটা কেমন টকটকে টমেটোর মতো লাল দেখাচ্ছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মানুষের ভিড় থেকে ওকে নিয়ে সরে দাঁড়ালো কৌড়ি।নেতিয়ে আসা নাফিমকে কাছে টেনে জড়িয়ে নিলো।নাফিমও দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো কৌড়ির কোমর।শীতের মধ্যেও আগুনের মতো তপ্ততা অনুভব করলো কৌড়ি।নাফিমের অবস্থা মোটেই ভালো না।আপতত বিশ্রাম খুবই জরুরি।চঞ্চল নজরে এদিক ওদিক তাকালো কৌড়ি।অধিকাংশ পরিচিত মুখ।তবে কাকে ডাকবে সে?
‘কি হয়েছে?ওর জ্বরটা বেড়েছে নাকি?
নিভানের কন্ঠ পেয়ে পাশে তাকালো কৌড়ি।মূহর্তেই নজর ঘুরিয়ে নিজের ডানহাতের দিকে নজর পড়লো তার।হাতের তালুটা দেখতে গিয়েও দেখলো-না।রাতে নানুমা মেহেদী মাখিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পর হাত ধুয়ে যখন হাতদুটো দেখলো।ফর্সা হাতদুটো গাঢ় খয়েরি রঙে চকচক করছিলো।সাথে নাফিমের নামটাও।অথচ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর হাত ধুতে গিয়ে হাতের দিকে নজর পড়তেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো সে।নাফিমের নামের এন অক্ষরটা সুস্থ সাবলীল,আস্ত থাকলেও পরের অক্ষরগুলো মেহেদী দিয়ে লেপ্টে মুছে দেওয়া।একটু নয় খুব আশ্চর্য হয়েছিলো কৌড়ি।সেই থেকে এই পর্যন্ত যতবার হাতে নজরে পড়ছে,মনে প্রশ্ন জেগেছে।কে করেছে এই অকাজ?তবে এই মানুষটাকে সেখান থেকে যতবার নজরে পড়েছে,কৌড়ির মনের সন্দেহের তীরটা কেনো জানেনা কারন ছাড়াই মানুষটার উপর গিয়েই বর্তাচ্ছে।কৌড়ির ভাবনার মধ্যে নাফিমের কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরীক্ষা করলো নিভান।নাফিম একটু মুখ উচু করে দেখলো তাকে।দেখেই বললো।
‘দাদাভাই বাড়িতে যাবো।
নিভান কিছুটা চিন্তিত গলায় বললো।–ওরতো প্রচুর জ্বর!বাড়িতে যাওয়া প্রয়োজন!কি করি এখন!
সম্বিৎ ফিরলো কৌড়ির।তন্মধ্যে ফোন বের করে তৃনয়কে কল করলো নিভান।নাফিম সম্পর্কে জানিয়ে বাড়ি যাওয়ার মনস্থির করলো।
‘নাফিমকে আমার কাছে দাও।
দ্বিধান্বিত গলার স্বর।–আমি-ও যাবো।
আশ্চর্য হলো নিভান।মেয়েটা তারসাথে যেতে চাইছে!কৌড়িকে যেটুকু চিনেছে,তার অনুভূতি জানার পর মেয়েটা একা কখনোই তার সঙ্গ পছন্দ করবেনা।সেই মেয়েটা তারসাথে যেতে চাইছে।শরীর খারাপ নয়-তো মেয়েটার! যদিও কাল মেয়েটার চোখমুখের প্রকাশভঙ্গি বলছিলো,মেয়েটা কোনো কারনে অসুস্থ।তবে কি সত্যিই অসুস্থ মেয়েটা!বললো–তুমি কেনো যাবে?শরীর খারাপ লাগছে?নাকি এখানেই থাকতে ভালো লাগছে না।
দুটোই।তবে কৌড়ি কারন হিসাবে প্রথমটা বেছে নিয়ে বললো–শরীর ভালো লাগছেনা।
কিছুটা বিচলিত হলো নিভান।বললো–ডক্টরের কাছে যাওয়া কি প্রয়োজন?
‘না।ডক্টরের প্রয়োজন নেই।বাড়িতে নিয়ে গেলেই হবে
অস্বস্তি হলো কৌড়ির।এই কারনেই বলতে চাইছিলোনা। তবে সত্যিই শরীর ভালো লাগছেনা তার।পিরিয়ড জনিত সমস্যা তো আছেই।অনিয়মিত পরিয়ড।তাতে তো বিভিন্ন কমপ্লিকেশন্স রয়েছে।সকাল থেকে আবার মাথাটাও কেমন ধরে আছে।সব অনুষ্ঠান অসুস্থতা বলে কাটিয়ে দিলেও,বিয়েতে আসবেনা।এটা কেমন দেখায়!তাই শরীর খারাপ নিয়েও বাধ্য হয়ে বিয়েতে আসতে হলো তাকে।এখন আবার যেতে চেয়ে এই মানুষটার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।এজন্য বলতে চাইছিলো না।তবে নাফিম যখন যাচ্ছে সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছিলোনা।তারমধ্যে নিভান বললো।
‘এখনো তো খাওনি।বিয়ে বাড়িতে না খেয়ে চলে যাবে?
‘নাফিম না খেয়ে চলে যাচ্ছে আমি না খেয়ে গেলে সমস্যা কোথায়?আর এমনিতেই আমার খেতেও ভালো লাগছেনা।বাড়ি যেতে মন চাইছে।
কৌড়ির মুখের পানে শান্ত নজর ফেললো নিভান।সাধারণ একটা মুখাবয়ব।বিয়ে বাড়ির এক্সট্রা সাজগোজের লেশ সেই চোখেমুখে নেই।সাজ বলতে গাঢ় নেভিব্লু কালোরের একটা দামী চুড়িদার পরা।সাথে নেভিব্লু রঙেরই হিজাব জড়ানো মাথায়।ব্যাস এটুকুই। তাতেই এই বিয়ে বাড়ির সকল রমনীর মধ্যে নিভানের নজর কাড়ছে এই মেয়েটা।কৌড়ির এলোমেলো নজর নাফিমের দিকে,সেটা খেয়াল করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।বললো–চলো।
স্বস্তি পেলো কৌড়ি।নাফিমকে কোলে তুলে নিল নিভান।গাড়িতে গিয়ে বসে মান্যতাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো নাফিম আর কৌড়িকে নিয়ে এসেছে সে।কারন জানতে চাইলোনা মান্যতা। দাদাভাই নিয়ে গেছে মানেই কারন আছে।আর নাফিমের তো জ্বর ছিলোই।পিছনের সিটে নাফিমকে জড়িয়ে বসা কৌড়ির পানে একপলক তাকিয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো নিভান।কিছুদূর আসতেই সামনের আয়নায় দেখতে পেলো কৌড়ি ফের তার হাতটা দেখছে।মনেমনে হাসলো নিভান।ফের সাবলীল গলায় কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো।
‘তোমার সন্দেহ ঠিক।কাজটা আমিই করেছি।
চমকে সামনে তাকালো কৌড়ি।তবে তার ধারণা ঠিক। ফের নাফিমের দিকে তাকালো।এতোটুকু একটা বাচ্চা ছেলেকে কেউ হিংসা করে,আশ্চর্য!নিভান বুঝি কৌড়ির মনোভাব কিছুটা বুঝলো।ফের বললো।
‘তবে ভুলে-ও ভেবো-না,আমি নাফিমকে জেলাস ফিল করে কাজটা করেছি।যদি জেলাসি হয়ে থাকে তবে পাত্র স্থান ভেদে নামটায় হয়েছে।তোমার হাতে অন্য কারও নামের সিলমোহর।মানা যায়!কৌড়ির হাত হোক বা সর্বাঙ্গে,অন্য কারও অধিপত্যে।মানবে বলছো নিভান!উহুম।মানবে না নিভান!
ছিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে নিয়েছে সেই কখন।শরীটা কেমন অসাড় অসাড় লাগছে তার।মাথাটার ঝিমঝিমানিটা কেমন একটু একটু বাড়ছে।এই মানুষটাকে আর উপেক্ষা করবে কিকরে সে?সবাই বলে মানুষটা অনুভূতিহীন। তার দেখাও তেমনটাই।সবার সামনে মানুষটা কেমন অদ্ভুত গম্ভীর্যপূর্ন,শান্ত,চুপচাপ। অথচ তার কাছে কতো সহজ সাবলীল।রাখঢাক নেই।সেই মানুষটার অনুভূতি গুলো কিভাবে আর উপেক্ষা করে চলবে!তবে দাদীআপাকে কি কৈফিয়ত দেবে সে?মৃত বাবা মাকে কোনোপ্রকার অসম্মানিত করা হবে নাতো!মানুষটার প্রতি দূর্বলতা বাবা মাকে ছোটো করে দেবে না-তো!মনের মধ্যে আবারও দোটানা শুরু হলো।
বুঁজে থাকা চোখের কোণ ঘেঁষে গড়ালো নোনাজল।সেটা লক্ষ্য করেই গাড়ি থামিয়ে পিছে ফিরলো নিভান।বিচলিত গলায় বললো।
‘এই কৌড়ি,শরীর বেশি খারাপ লাগছে?আমাকে বলো কি হচ্ছে?
কান্নারা যেনো ভিতর থেকে এবার উপচে বেরিয়ে আসতে চাইলো।তবে দাঁতে দাত চেপে সেই কান্না আটকালো কৌড়ি।কার উপর অভিমান হলো জানা নেই।তবে অভিযোগের স্বরে বললো–আমাকে কেনো একটু শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না?
মুখাবয়ব পাল্টে গেলো নিভানের।কৌড়ির বুঁজে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়।মেয়েটার চোখের নোনাজল বলছে,তারপ্রতি দূর্বলতা।তবে কেনো এতো আপত্তি?এবার অভিযোগ সেও হানলো।রুক্ষ গলায় বললো—-এই তুমি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছো,বলছো?দিচ্ছো কোথায়!
তড়িৎ উত্তর দিলো কৌড়ি।—তবে কি চাইছেন,এবাড়ি থেকে আমি চলে যাই?আপনার শান্তি হোক?
‘তুমি যদি আমার শান্তি প্রশান্তিটা কিসে সেটা বুঝতে! তবে তো হয়েই যেতো।
কঠিন হয়ে এলো নিভানের চোয়ালদ্বয়।আর একটা শব্দও উচ্চারণ করলো-না সে।আর না কৌড়ির উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় রইলো।হাতের তালু দ্বারাা স্ট্রারিংয়ে আঘাত করে,গাড়ি চলমান করলো।সেই আঘাতে কেঁপে উঠে ঘুমন্ত নাফিমকে আরও শক্তকরে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তবুও চোখ খুললোনা।
★
বাড়িতে ঢুকতেই ছেলের অবস্থা দেখে স্বান্তনা রহমান অস্থির হলেন।নাফিম ঘুমিয়েছে।নিরিবিলি জায়গা হিসাবে মান্যতার রুমে শুইয়ে দিলো ওকে।ওকে শুইয়ে দিয়েই চলে গেলো নিভান।স্বান্তনা রহমান ছেলেকে ভালোভাবে শুইয়ে,গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিয়ে কৌড়িকে ওর খেয়াল রাখতে বলে চলে গেলেন।হাতে অনেক কাজ।বিয়ে বাড়ির কাজ বলে কথা।তা বাদেও একটু পরে বউ নিয়ে আসবে তার বিশেষ আয়োজন।বাড়িতে বরযাত্রী যাওয়া ছাড়াও অঢেল মেহমান।তাদের খেদমত খাদিম তো লেগেই আছে।স্বান্তনা রহমান চলে যেতেই কৌড়ি ওয়াশরুম ঢুকলো। জামাকাপড় চেঞ্জ করে শুয়ে পড়লো নাফিমের পাশে।সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা তার পাশ ঘেঁষে তাঁকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে তলিয়ে গেলো।সেটা দেখে নাফিমের মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে কপালে ছোটো করে একটা চুমু দিলো কৌড়ি।গায়ের পাতলা কম্বলটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে সে-ও চোখ বুজলো।খানিকক্ষণ পর অনুধাবন করলো রুমে কেউ ঢুকেছো।অকারনেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো তার।তবে ভুলেও চোখ খুললোনা।তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে,সেই মানুষটা এসেছে।যতোই তার পায়ের গতিবেগ বেড়ে কৌড়ির কাছাকাছি হতে থাকলো।রুমে ঢোকা মানুষটার গায়ের সুগন্ধে অনুধাবন সত্যি হতে লাগলো কৌড়ির।বেডের পাশে এসে সেই পদধ্বনি স্থির হয়ে যেতেই,নিজেও বরফ জমার মতো জমে চুপ হয়ে রইলো।হঠাৎ সমস্ত রুমে পদচারণেট শব্দ শুনে চোখ অল্প খুললো সে।কি খুঁজছে মানুষটা!নিভানকে আবার তাদের দিকে ফিরতে দেখেই চোখ বন্ধ করে নিলো সে।আবার বাহিরের পানে পদচারণ শুনে চোখ খুলে দেখলো,মানুষটা চলে যাচ্ছে। স্বস্তি পেলো কৌড়ি।উঠে দারজা লাগিয়ে ঘুমাবে কি-না ভাবতেই আবার সেই পদচারণ।দ্রুত ফের চোখ বন্ধ করে নিলো।সেই একই ব্যাক্তির পদচারণ এসে থামলো বেডের পাশে।মূহুর্তেই ভারী কিছু একটা গায়ের উপর পড়তেই বুঝতে পারলো,ভারী কম্বল জাতীয় কিছু একটা তাদের গায়ের পাতলা কম্বলটার উপর ঝাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।আসলেই প্রয়োজন ছিলো।আর সেটা থেকে সেই একই কড়া সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।দম বন্ধ হয়ে এলো কৌড়ির।চেয়েও চোখ খুলতে পারলোনা।হঠাৎ নিজের নাকেমুখে শক্ত চুলের আবরণ অনুভব হতেই মিটিমিটি চোখ খুললো সে।দেখলো,মানুষটা নাফিমের কপালে চুমু দিচ্ছে।শিহরে উঠলো কৌড়ির সমস্ত শরীর।একটু আগেই সে ওই একই জায়গায় নাফিমকে চুমু দিয়েছে।নিভানকে সরে যেতেই দেখেই আবারও চোখ বন্ধ করে নিলো।সেটা আরও প্রগাঢ় হলো,কারও শক্ত হাতের ছোঁয়া নিজের মাথায় পেতেই।নড়চড় করলোনা,শুধু নির্জীব হয় পড়ে রইলো।সেই বুঁজে রাখা চোখের দিকে, মুখের দিকে নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ নিচু করে কৌড়ির কাছাকাছি হলো।ফের ধীর,শিথিল গলায় বললাে।
‘তুমি যদি জানতে তুমি নিভানের ঠিক কোথায় নিজের জায়গাটা করে নিয়ে বসেছো?তুমি নিভানের ঠিক কি?তবে আর শান্তিতে থাকতে চাইতে না,নিভানকেই চাইতে।আমাকে চাইতে কৌড়ি।আমি জানি তুমি জেগে আছো।তবে এবার তুমি না চাইলে নিভানের শেষ চাওয়াটুকুসহ সে-ও নিঃশেষ হয়ে যাবে।তবে তোমার শান্তি ভঙ্গ করতে,তোমার দুয়ারে আর আসবে-না।তবুও চলে যাওয়ার কথা আর কখনো মুখে এনো না কৌড়ি!কখনোই বোলো-না কৌড়ি!কখনো না!
চলবে….
#ফুলকৌড়ি
(৩৩)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
নিস্তব্ধ রজনী।শীতের শীতল রাত।হয়তো চারপাশটা সেকারনে আরও শান্ত,নীরব।নিজহাতে কড়াকরে কফি বানিয়ে ছাঁদে এলো নিভান।মূহুর্তেই শীতল ঠান্ডাভাবটা যেনো,ফুলসিল্ভ টিশার্ট পরা শক্তপোক্ত পেটানো শরীর ভেদ করে কলিজা ছুঁয়ে দিলো।তবুও পা পিছে নিয়ে রুমে যাওয়ার চিন্তা করলোনা সে।সামনে এগিয়ে গেল।
ছাদের চারপাশের বড়বড় বাল্বের লাইটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।ঝাপসা কুয়াশার মধ্যেও সেই লাইটের আলোতে
সবকিছু ঝকঝক করছে।চারপাশের গাছগুলোও বেশ মনোমুগ্ধকর লাগছে।আশেপাশে খেয়ালি নজর ফেলে সামনে এগোলো নিভান।নির্দিষ্ট স্থানে যাবার আগেই পা ধীমে কপাল কুঁচকে গেলো তার।ইভানে এখন এখানে!
ছাঁদের রেলিঙের ওয়াল ঘেঁষে বাহিরের পানে স্থির নজরে তাকিয়ে আছে ছেলেটা।গায়ের রক্ত হিম হয়ে জমে যাওয়ার মতো ঠান্ডাভাব পড়েছে।তারমধ্য ছেলেটা একটা টিশার্ট গায়ে এরকম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে!তা বাদেও ছেলেটার জীবনে আজ একটা বিশেষ রাত।সেখানে নিজের রুম বাদে এতোরাতে ছাঁদে কি করছে সে?ফের কিছু ভাবলো তারপর ধীমে পা বাড়ালো।পাশে গিয়ে দাঁড়ালো ইভানের।বললো।
‘তুই এখন এখানে?
কারও আগমনের পদধ্বনির টের আগেই পেয়েছিলো ইভান।পিছে ফিরে না দেখলেও বুঝতে পেয়েছিলো কে এসেছে।কেননা,এতো রাতে দাদাভাই ছাড়া ছাঁদে সহজে কেউ পা মাড়ায় না।তাই কাছে আসার অপেক্ষা করছিলো।প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে এটাও জানতো।নিভান প্রশ্ন করতেই মৃদু হাসলো সে।সে হাসিতে যেনো মলিনতা আর ক্লান্তি ঝরে পড়লো।বললো।
‘এমনিতেই।তোমার হাতে কফি নাকি?এতোরাতে তোমাকে কফি বানিয়ে দিলো কে?আমারও প্রয়োজন।দাওতো ওটা আমাকে।
বলেই নিভানের হাত থেকে কফির মগটা নিলো ইভান।তখনো ইভানের মলিন মুখের দিকে স্থির নজরে তাকিয়ে নিভান।ইভান কফির মগটা নিতেই গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো–ওটা আমার এঁটো হয়ে গেছে।ওটা রাখ,আমি আর একটা এনে দিচ্ছি।
‘লাগবেনা।এটাই চলবে।
বলেই কফিতে চুমুক দিলো ইভান।মূহুর্তেই তিতেভাটাতে নাকমুখ কুঁচকে ফেললো সে।সে-ও কফি খায় তবে এতো কড়া নয়।মুখের মধ্যে থাকা তরল পদার্থ ফেলে না দিয়ে কোনোমতে গিলে বললো।-এতো কড়াভাবটা তুমি গলা দিয়ে নামাও কি করে?এতো উটকো তিতেভাব!নামে গলা দিয়ে তোমার!
‘এরথেকেও তিতে কথার রেশ ইদানীং তাকে হজম করতে হচ্ছে।সেখানে সামন্য কফির এই তিতেভাবটা আর এতো কি!এটাতো তারকাছে নরমাল,ফিকে।
হাসলো ইভান।কফিতে আর চুমুক না দিয়ে,নিভানের হাতে দিয়ে দিলো।হঠাৎই হাতে ভর দিয়ে ধপাৎ করেই ওয়ালের উপর বসে পড়লো।সেটা দেখেই নিভান কিছুটা আতঙ্কিত গলায় বললো–পড়ে যাবি তো ইভান!
‘আমি পড়ে যাবো আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে?আর এটাও আমি বিশ্বাস করবো!আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে তুমি আমাকে কখনো পড়ে যেতে দেবেনা,সেটা জানি আমি।আচ্ছা বাদ দাও।একটু আগে আমার বাচ্চা বউমনিটা সম্পর্কে কি অভিযোগ জানালে?
এবার সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।ইভানের কথার উত্তর দিলোনা।ইভানও উত্তর পাওয়ার আশা করলো না।ফের বললো–তা আমার ওমন সুন্দর শান্তশিষ্ট বউমনিটা তোমাকে কি এমন শোনালো শুনি?যে তাকে নিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছো।তাও আবার তুমি নিভান?
যে সহজে কাওকে অভিযোগ জানায় না।তবে যাই হোক,নিজের মানুষের ওরকম দু’একটা কথা শোনাই যায়।আর শুনতেও হয়।তাতে না দোষের কিছু হয়,আর না দোষ নিতে হয়।মহাপাপ হয় বলে-ও তো আমার মনেহয় না।
‘দোষের কিছু যদি নাহয়ে থাকে আর মহাপাপ যদি না হয়।তবে তুই এখানো কি করছিস?এতো রাত হয়ে গেছে,তবুও ওই মেয়েটাকে একা রুমে ফেলে তুই কেনো এখানে?
ইভান চুপ হয়ে গেলো।নির্বিঘ্নে তাদের বিয়েটা হয়ে গেলেও,তন্ময়ী যে এখনো তারসাথে স্বাভাবিক নয়।এটা সে জানে,এবং মেয়েটার আচারনে বুঝতে পারছে।বিদায়ের সময় মেয়েটা প্রচুর কেঁদেছে,মেয়েটার ওই কান্নায় তাকে অসম্মানিত করার অপরাধ বোধটা যেনো মনেমনে তীব্র হয়েছে।তারপর থেকে যেনো কিছুই ভালো লাগছেনা।গাড়িতে বসেও মেয়েটা নিঃশব্দে সারা পথ কেঁদেছে।একটাও কথা বলেনি,শুধু চুপচাপ কেঁদেছে।সে না পেরেছে সান্ত্বনা দিতে আর না পেরেছে নিজের একান্ত ব্যক্তি হিসাবে মেয়েটাকে কাছে টেনে ভালোমন্দ কথা আওড়াতে।বরং তন্ময়ীর কান্নার নোনাজলগুলো তার অপরাধবোধকে ভিতরে ভিতরে প্রবল করে তার থেকে সরিয়ে রেখেছে।সেই থেকে মেয়েরটার সম্মুখে যেতে ইচ্ছে করছে না।অথচ মন চাইছে,আজকে রাতটা বিশেষই হোক।শারিরীক চাহিদার জন্য নয় মানসিক চাহিদার জন্যই বিশেষ হোক।তাদের জন্য বিশেষ হোক।মেয়েটাকে চেয়েছিলো মনেপ্রাণে, সেই মেয়েটাকে নিজের করে পেয়েছে এই আনন্দে রাতটা বিশেষ হোক।তবে চাইলেই কি সবকিছু হয়!
‘পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বেড়ালেই কি সবকিছুর সমাধান মিলে যায়?যায়-না।মিলবেও না।তবে চেষ্টার অসাধ্য তো কিছু নেই,চেষ্টা করতে হয়।বরং সাহস নিয়ে সেই পরিস্থিতি অনূকূলে হোক বা প্রতিকূলে সম্মুখীন হতে হয়।তাতে নিজের ভালো হোক বা মন্দ,জয় হোক বা পরাজয়।সেই পরিস্থিতির একটা সমাধান মিলে যায়।রুমে যা।পরিস্থিতি থেকে কখনো পালিয়ে বেড়াতে নেই।
নিজেকেই ঠিক করে নিতে হবে সবকিছু,এমনটা সাহস রাখ।মেয়েটা যেমনই ব্যবহার করুক,ওর সঙ্গ ছাড়িস না।একটা সময় দেখবি ও তোকে ভালোবাসুক আর নাই বাসুক,তোর সঙ্গটা ছাড়তে পারবেনা।পরিস্থিতি সম্মুখীন করতে শেখ।পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বেড়ালে বা পিছু হাঁটলে কখনো সবকিছু ঠিকঠাক হবে না।যা রুমে যা।
মন দিয়ে নিভানের কথাগুলো শুনলো ইভান।নীতিবাক্যের ন্যায় কথাগুলো মন থেকে মেনে মাথা নাড়ালো।সামনে কি আছে কপালে সে জানেনা।তবে সত্যি বলতে পরিস্থিতি থেকে পালালে তো তাকে চলবে না।আর পিছু হাঁটলে চলবে।যদিও সে পিছু হাঁটতে চায়না।সম্মুখীন হতে চায়।তবে মেয়েটার ওই মায়ামায়া ক্রন্দনরত মুখটার দিকে তাকালেই কেমন বুকটায় ব্যথার জ্বলন হচ্ছে বলে রুমে যাচ্ছে-না।চাইছে মেয়েটা ঘুমিয়ে যাক তারপর নাহয় যাবে।তবে নিভান কথাগুলো শোনাতেই,মৃদু হেসে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গন্তব্যের পানে অগ্রসর হলো সে।ইভানের যাবার পানে একপলক তাকিয়ে, তারাবিহীন আকাশের দিকে তাকালো নিভান।ফের চোখবুঁজে শ্বাস ফেললো।সবাইকে নীতিবাক্য শোনানো কতোই না সহজ।অথচ নিজের জীবনে সেই নীতিবাক্যের কর্ম ফলানো কতোই না কঠিন।বিকালে ওই মেয়েটাকে যে বলে আসলো,সে না চাইলে নিভান আর কখনো তারকাছে যাবেনা।পারবে কি নিভান মেয়েটাকে ছাড়া দূরে দূরে থাকতে?আচ্ছা কৌড়ি যদি কখনো তার না হতে চায়?তবে কি করবে নিভান?উফফ!
★
ধবধবে সাদা রজনী গন্ধা আর গাঢ় লাল গোলাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে ইভানের ঘরটা।দরজায় দাঁড়িয়ে ক্ষীন বাতির নীল আলোতে সেটা খেয়াল করে দেখলো ইভান।যদিও বিয়ের কাজ সেরে ওবাড়ি থেকে আসার পর,ঘরে ঘুকতেই সাজানো ঘরটা নজরে পড়ছিলো তার।তবে তখন অতোটা মনযোগ দিয়ে দেখা হয়নি।সত্যি বলতে তন্ময়ীর কান্নারত মুখটাই তখন মনে ভেসে বেড়াচ্ছিলো।যার কারনে কেমন যেনো ইচ্ছে কাজ করে নি।ঘরের আলাদা সৌন্দর্যও নজরে কাড়েনি।তবে তখন ঘরের সৌন্দর্য নজর না কাড়লেও এখন কেমন যেনো নজরে কাড়ছে।আলাদা অদ্ভুত অনুভূতিতে বারবার হৃদয় কেঁপে উঠছে।ঘরের ভিতরের আরও দুকদম পা বাড়তেই আপনাআপনি বেডের দিকে নজর পড়লো তার।তন্ময়ী ঘুমিয়ে আছে।তার অধিকার নিয়ে শুয়েছে মেয়েটা।আজ থেকে এই রুমটা তারও।মনেপ্রাণে শীতল একটা দোলা বয়ে গেলো ইভানের।কতোদিনের ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা আজ পূর্ণ হয়েছে।স্ত্রী হিসেবে এই রুমে তন্ময়ীর পদচারণ থাকবে।ঘরের সমস্ত কিছুতেই ছোঁয়া থাকবে শুধু ওই নারীর।তারউপরে একান্তভাবে সকল আদর শাসনের হক থাকবে শুধু ওই রমণীটার।চাওয়াটা তো এখনো সেই একই আছে।পূর্ণও হয়েছে।তবে পাওয়াটা হবে কিনা ইভানের জানা নেই।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে।যদিও পুরুষ মনটা তার টানছিলো তার বেডে শয়নরত রমনীরপানে।সেখান থেকে এসে এশারের নামাজ আদায় করে নিল।আদায় করলো আরও দু’রাকাআত শুকরিয়ার নাামাজ।
নামাজে তার বড়োই অবহেলা, যেটা দেখে নানুমা মা প্রায়ই তাকে প্রচুর বকাবকি করেন।তবুও শয়তান যেনো পিছু ছাড়েনা।আজ কোনো কারনে তার মন খারাপ দেখে নানুমা ফের উপদেশ দিলেন।—নানুভাই,প্রভুর ইবাদতে গাফেল হতে নেই। নামাজ জীবনে সকল বালা মুসিবত,হতাশা দূর করে দেয়।মনের যতো দুঃখদুর্দশা অশান্তি কাটিয়ে দেয়।জীবনে যতোই বিপদ আসুক না কেনো,নামাজ আঁকড়ে ধরে থাকলে সব দূরীভূত হয়ে যায়।তাই নামাজ ছাড়বে না।যখন মুসিবত আসবে, হতাশায় ভুগবে তখন আরও দৃঢ়ভাবে নামাজকে আঁকড়ে ধরবে।দেখবে আল্লাহ তোমার সকল বিপদ মুসিবত থেকে দূরে রেখেছেন।হতাশা গ্লানি দূর করে দিয়েছেন।তাই ভুলেও নামাজে কখনো অবহেলা করবে না।আর এমনিতেই একজন মুসলমান হিসাবে তোমার দ্বায় তোমার সৃষ্টিকর্তা “আল্লাহর” ইবাদাত করা।
নামজ পড়লে শত দুশ্চিন্তা আর মুসিবতেও মনে প্রশান্তি অনুভব হয় এটা ইভান যানে,তবুও কেনো জানে-না শয়তানকে প্রশ্রয় দিয়ে নামাজে অবহেলা করে ফেলে।তবে নানুমার বুঝদার কথাগুলো মনে পড়তেই,গ্লানিভরা মনে প্রশান্তি আনতে নামাজ পড়তে খুব ইচ্ছে হলো তার।নামাজ পড়লো।আজ থেকে স্বামী স্ত্রীর নতুন জীবনে পদার্পণ করারা জন্য, দু’জনের শুকরিয়া আদায় করার জন্য যে নফল নামাজের প্রয়োজন ছিলো।স্ত্রী বিহীন সেটাও আদায় করে নিলো।শুকরিয়া আদায় করলো আল্লাহর।সত্যি বলতে মন হালকা হলো।সারাদিনে যে বিচলিতা অনুভব হচ্ছিলো সেটা কেটে গেলো মূহুর্তেই।নামাজ শেষে জায়নামাজ গুছিয়ে,বেডে শয়নরত নারীরপানে এগোলো।যে এখন তারজন্য হালাল।ভারী কম্বলে মেয়েটার গলা অব্দি ঢাকা।মায়াময় মুখটা শুধু উন্মুক্ত।সারাদিনে ক্লান্তিতে মেয়েটা হয়তো ঘুমে বিভোর।মায়াময় মুখটা দেখেই পুরুষ মনে ইচ্ছে জাগলো ইভানের।সেই আকাঙ্ক্ষাটা নিয়ন্ত্রণে রাখার ইচ্ছে পোষন করলো না।মুখ নিচু করে তন্ময়ীর কপালে গাঢ় চুমু বসালো।কেঁপে উঠলো নারী কোমল শরীর।সে ঘুমায়নি।এই ঘরে আসার পর থেকে হঠাৎই কেমন একটা অনুভব হচ্ছিলো তার।এখনো হচ্ছে।এতো বিলাসবহুল জীবন তার কখনো ছিলোনা,না ছিলো নিজের রুমের এতো বিলাসিতা।সেখানে পুরোই অচেনা সবকিছু।চেনা পরিচিত ঘর বেড সবকিছু রেখে হঠাৎই কি অন্যকোনো বেডে ঘুম আসে?সবার আসে কি না তন্ময়ীর জনা নেই। তবে তন্ময়ীর আসে-না।তাই ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না তার।ঘুমায়নি সে।নারীমন আরও একটা বিষয় নিয়ে খুদমুদ করছিলো।যতোই তাকে অসম্মানিত করা সেই পুরুষটার প্রতি মন অসন্তুষ্ট হোক বা রাগান্বিত।তাকে যেনো আজকের এই বিশেষ রাতে নিজের কাছাকাছি নাহলেও রুমে চাইছিলো মন।এসব ভাবতে ভাবতে ইভানকে রুমে আসতে দেখেই চোখ বুঁজে নিয়েছিলো সে।ইভানকে নামাজ আদায় করতেও দেখেছে সে।এশারের নামাজ সে,দাদিশ্বাশুড়ি নানিশ্বাশুড়ীর সাথে পড়ে নিয়েছে।উনারাই বলেছিলেন,দম্পত্ত্য জীবন শুরু হওয়ায় শুকরিয়া সরূপ নামাজটা দুজনের একসাথে আদায় করে নিতে।অথচ বান্দা একাই পড়ে নিলো তাকে ডাকলো না!ক্ষীন শান্ত হওয়া রাগ ক্ষোভটা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার।ইভান তখনো ঠোঁট ছুঁইয়ে তন্ময়ীর কপালে।হালাল সুখ তৃপ্ততা বুঝি একেই বলে।চম্বুকের মতো টানছে মেয়েটা,ঠোঁট যেনো সরাতেই ইচ্ছে করছেনা।চোখ খুললো তন্ময়ী।ক্ষোভিত গলায় বললো।
‘আপনি আমাকে ছুঁলেন কেনো?
হাসলো ইভান।ঠোঁট সরিয়ে তন্ময়ীর চোখে চোখ রেখে বললো।—অধিকার আছে তাই।
সুগভীর নজরে নজর পড়তেই ভিতরে ভিতরে বিচলিত হলো তন্ময়ী।তবে উপরে নিজেকে কঠিন রাখার প্রয়াস চালিয়ে শক্ত কন্ঠে বললো।—অধিকার তো এখন শরীরের উপরেও আছে।তবে বলে চাইছেন কি বৈধ ধর্ষ…
তন্ময়ীর ঠোঁটে শক্ত করে নিজের পুরুষালী মোটাসোটা বৃদ্ধা আঙুলদ্বারা চেপে ধরলো ইভান।কথা শেষ করতে দিলোনা।ভিতরে ভিতরে ক্রোধে ফেটে পড়লো,তবে প্রিয় নারীটাকে সেই ক্রোধ দেখাতে চাইলো না।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে সময় নিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো।—যদি শুধু শরীরের দরকার হতো।তবে ইভানের মেয়ের অভাব ছিলোনা,আর না ইভান তোমার পিছু পড়ে থাকতো।আমার জীবনে একটা তন্ময়ীর দরকার ছিলো।চেয়েছিলাম আমি তোমার মতো একটা মেয়েকে আমার জীবনে।শুধু সেটারই অভাব ছিলো।আলহামদুলিল্লাহ, সেটা যেভাবেই হোক পেয়ে গেছি।হয়তো তোমার সাথে কোনোভাবে অন্যায় করে ফেলেছি, তাই বলে অমানুষ ভেবোনা।যে,প্রিয় নারীটা হালাল হয়েছে বলেই অনুমতিবিহীন ঝাপিয়ে পড়বো।আমাকে এতোটাও ছোটো করে দেখোনা তন্ময়ী।প্লিজ ট্রায় ট্যু আন্ডারস্ট্যান্ড।
শেষের কথাটা এতোটা করুন শোনালো খারাপ লাগলো তন্ময়ীর।এমনকি চোখ ফেটে নোনাজল টলমল করলো তবে মনের চাপা রাগে সেটা গড়াতে দিলো না।ইভান সরে দাঁড়ালো।রুমের বাহিরের পানে অগ্রসর হতে হতে বললো—নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো।একটা মশাও তোমাকে ছুঁয়ে দেখবেনা।
কথাটা মন মানতে চাইলোনা তন্ময়ীর।নারীমন যা চাইছে তা না পারছে রাগে ক্ষোভে মুখে প্রকাশ করতে।আবার না পারছে নিজেকে শান্ত রাখতে।এতোসময়ের টলমটল নোনাজল এবার চোখ বেয়ে গড়ালো।কম্বলের কিছু অংশ শক্ত হাতে ধরে চুপচাপ সেভাবেই পড়ে রইলো।দরজার কাছে গিয়ে ইভানের কি হলো,পিছে ফিরে তাকালো সে।মূহুর্তেই চোখ বন্ধ করে নিলো তন্ময়ী। সেটা দেখে ফের এলোমেলো হাসলো ইভান।কিছু একটা ভেবে দরজা লাগিয়ে,বেডে এসে ধপাৎ করে তন্ময়ীর পাশে শুয়ে পড়লো।তন্ময়ীর ইচ্ছে বুঝেও তাকে আর ঘাটালোনা।
অপরিচিত রুম,অপরিচিত বিছানা,পরিচিত হলেও অপরিচিত পুরুষ শরীর তারপাশে শুয়েছে উপলব্ধি করতেই শরীর জমে গেলো তন্ময়ীর।হৃদস্পন্দনের গতিবেগ বেড়ে গেলো।কম্বলটা আর-ও শক্তহাতে আঁকড়ে ধরলো সে।তবে ইভানের শোয়া নিয়ে অভিযোগ জানালোনা।সেটার ফায়দা লুটাতেই ইভান নিজের ফর্মে চলে এলো। দুষ্টমী করে বললো।
‘তোমার কম্বলটা শেয়ার করা যাবে?যদিও আমি অপছন্দনীয় ব্যক্তি তোমার, তবে কথা দিচ্ছি ফায়দা লুটবোনা।
উত্তর এলোনা।উত্তর আসবে আশাও করেনি ইভান।নিজ গরজে ঢুকে পড়লো কম্বলের ভিতর।অদ্ভুত অনুভূতিতে শরীর ছেয়ে গেলো।মুখে যতোই নীতিবাক্য আওড়াক,স্ত্রী রূপে প্রিয় নারীর সান্নিধ্যে ছুঁতে চাইলেই হাতের মুঠোয়।তাহলে কি আর নিজেকে ঠিক রাখা যায়।তবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার আলাদা গুণ আছে ইভানের।তাই চুপচাপ থাকলো। সময় গড়ালো।তবে ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও দু’জনের কারও চোখে ঘুম নামলো না।তন্ময়ী শান্ত হয়ে শুয়ে থাকলেও, ইভান শান্ত হয়ে শুয়ে থাকতে পারলো না।শুধু নড়াচড়া করতে থাকলো।আসলে ঘুম আসছেনা তার।কি করবে সে?বেশ কিছুসময় পার হওয়ার পর,বিরক্ত নিয়ে তন্ময়ী মুখ খুললো।বললো।
‘এতো নড়াচড়া করছেন কেনো?পাশে একজন শুয়েছে, সে খেয়াল নেই?নিজে না ঘুমালেও তাকে অন্তত ঘুমাতে দিন।
তন্ময়ীর নীরব পড়ে থাকা দেখে ইভান মনে করেছিলো তন্ময়ী ঘুমিয়ে গেছে।মেয়েটা ঘুমাইনি!তারমানে সে তারমতো ছটফট না করলেও, ঘুমাতে পারছে-না।দুষ্ট হাসলো ইভান। মজার ছলে বললো—এতো সুন্দর করে নিজের রুমটা সাজানো।রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুলের কম্বিনেশনে ঘরটা সুবাসিত হয়ে আলাদা সুগন্ধে ঘরময় ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে।এরপর ফুলসজ্জার রাত বলে কথা।তারউপর বউরূপে প্রিয় নারীটা কাছাকাছি শুয়ে আছে।ঘুম আসে?নাকি ঘুমানো যায়?তুমি বলো?
রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভূতিরা শিরশিরালো তন্ময়ীর।দম আঁটকে আসার মতো বাক্যগুলো।তবুও কথার ছল ছাড়লো না সে।ঘাড় ঘুরিয়ে শক্ত গলায় পরিহাসের স্বরে বললো।
‘এই যে একটু আগে ডায়গল ছাড়লেন,শরীর চাই-না আপনার।তবে ডায়লগ শুধু মুখেমুখে।বলা আর কাজে করে দেখানো কি এতোই সহজ!
তন্ময়ীর চোখে চোখ রাখলো ইভান।সুগভীর শান্ত নিরেট নজর।তারচেয়েও শান্ত গলায় বললো।–‘আমি কখন বললাম আমার শরীর চাই।তবে আমার তোমাকে চাই।শুধু কাছে চাই।
‘এতো সহজে আমাকে পাবেন বলছেন?
‘দুর্লভ্য হলেও একটা সময় গিয়ে যে তোমাকে পাবো।এটা জেনেও কেনো সময়টা এগিয়ে আনতে চাইছোনা?প্লিজ তন্ময়ী একটু সহজ হওনা।
ইভানের অসহায় কন্ঠের বার্তাগুলো নাড়িয়ে দিলো কোমল সত্তা।তবুও বহিঃপ্রকাশে টললো না তন্ময়ী।আর না।উত্তর দিলো।কিভাবে উত্তর দেবে,গলা কাঁপছে তার।উত্তর দিতে গেলেই যে দুর্বলতা প্রকাশ পাবে তার।ধরা পড়ে যাবে সে।তাই চুপ হয়ে রইলো।পদক্ষেপ বাড়লো ইভান।আরও একটু কাছ ঘেঁষে তন্ময়ীর পাশাপাশি গিয়ে শুলো।তন্ময়ী টের পেলো তবে কিছু বললো-না। শুধু নিঃশ্বাস আঁটকে চুপচাপ রইলো।কাত হলো ইভান।দুঃসাহসিকতার সহিত মুখটা নিয়ে রাখলো,তন্ময়ীর মাথার পিছনে কাঁধের কাছে।ফের বিনয়ী কন্ঠে বললো — স্যরি তনু।প্লিজ এতোটা কঠিন হয়েও না আমি প্রতি, একটু সহজ হও।
স্যরি কথাটা শুনতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো তন্ময়ীর।তবে সহজে রাগজেদ ছাড়তে পারলো না।তড়িৎ উঠে বসে,ইভানের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললো।—আজকের দিনটা স্বাভাবিক অন্য দশ পাঁচটা দম্পতির মতোই হতো।যদি সেদিন আপনি ওরকম অবুঝপনার মতো কান্ডটা না ঘটাতেন।
‘এরজন্য কি দ্বায়ী তুমি একটুও নও?ছিলেনা দ্বায়ী।তুমি অন্য কারও হয়ে যাচ্ছো,আমি সেটা মেনে নিয়ে চুপচাপ তোমাকে অন্যকারও হতে দেখবো,বলছো?
নিভে গেলো তন্ময়ী।শুয়ে থাকা সুদর্শন সুপুরুষটার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে হঠাৎই আড়ষ্টতা অনুভব করলো।এলোমেলো হয়ে এলো নজর।বধুর সাজসজ্জা ছেড়ে সাধারণ লালরঙা শাড়ী পরা মেয়েটাকে আবাছা আলোয় বেশ মোহনীয় সুন্দর দেখাচ্ছে।নজর অতিশয় মুগ্ধ হলো ইভানের।নিজের পদক্ষেপ আরও একধাপ বাড়ালো,মনেমনে ভাবলো তাতে যা আছে কপালে।তন্ময়ীর হাত ধরে কাছে টেনে নিলো।হঠাৎ কাজে হতভম্ব হলো তন্ময়ী,ফের ছটফটিয়ে উঠলো ছাড়া পাওয়ার জন্য। তবে ইভান ছাড়লোনা।শক্ত হাতদ্বারা নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো মেয়েটাকে।
ফের তন্ময়ীর ছোট্টো কপালটায় বসালো নিজের ঠোঁট।তন্ময়ী যতোই ছটফট করলো,চুম্বনের গভীরতা ততোই বাড়লো।শক্তকরে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে রাখলো তন্ময়ীর কপালে।যখন ছটফটানিতে দূর্বল হয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকলো মেয়েটা,তখন নিজেও ঠোঁট সরিয়ে নিলো ইভান।আদূরে গলায় বললো।
‘শান্ত হও প্লিজ।তুমি কাছে থাকা ছাড়া আমি দ্বিতীয়ত কোনোভাবে তোমাকে ছুঁয়ে দেখবোনা।আর না কোনোরূপ স্বামীত্ব ফলাবো।রাগ জেদ যেটাই করো,কাছে থেকে করো।ভালোবাসতে হবেনা,তবে আমার মৃত্যু আগ পর্যন্ত এভাবে শুধু আমার কাছে থেকো।প্লিজ তন্ময়ী,দূরে সরে যেওনা।প্লিজজ…
কিসের টানে হঠাৎ যেনো কথাগুলো শুনতেই শান্ত হয়ে গেলো তন্ময়ী। অচেনা বুকে শান্তি মিললো।অস্বস্তি হওয়ার কথা থাকলেও বিন্দমাত্র অস্বস্তি হলোনা।তবে কোনো কারনো কান্না পেলো ভিষন।কেঁদে ফেললো সে।শব্দ হলো-না তবে চোখ বেয়ে নোনাজল গড়লো অবিরাম।ইভান অনুভব করলো তবুও ছাড়লোনা মেয়েটাকে।বরং আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো নিজের শক্তপোক্ত বুকে।তারসাথে ভালোভাবে নিজেদের গায়ে জড়িয়ে নিলো কম্বলটা।ফের হাত দিয়ে তন্ময়ীর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো।
‘তোমাকে অসম্মানিত করার জন্য আমি বিয়ের আগের দিন রাতে আন্টির সাথে কথা বলেছিলাম।তোমার বিয়ে ভাঙার দোষটা আমি অকপটে স্বীকার করেছিলাম।সত্যি বলতে দাদাভাই সাহস না জোগালে,তোমাকে না পাওয়ার ভয়ে কখনোই আমি নিজের দোষটা স্বীকার করতাম না।আন্টি আমার এহেন কাজে আমার প্রতি মনোক্ষুণ্ণ, অসন্তুষ্ট হলেও ক্ষমা করে দিয়েছেন। যদিও তোমার মা-তো একটু বকাবকি করেছিলেন।মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে না দেওয়ার জেদও ধরেছিলেন।তবে আমার চাওয়ার কাছে সেই রাগজেদ টিকিয়ে রাখতে পারেন নি।ব্যর্থ হয়েছেন।আমি জানি না,আমার উপরের রাগ জেদের ক্ষোভটা কখনো তোমার মিটবে কিনা। তবে দুজনে যখন একসুতোই বাঁধা পড়েছি,যাই হোকনা কেনো দূরে সরে থাকার কথা প্লিজ ভেবোনা।যেই শাস্তি দাওনা কেনো,ইভান মাথা পেতে নেবে।শুধু দূরে থাকার শাস্তিটা বাদে।প্লিজ তনু,তোমাকে ভালোবাসতে হবেনা আমাকে, শুধু কাছে থেকো।এভাবে আমার লক্ষীসোনা বউটা হয়ে আমার কাছে থেকো।আই প্রমিজড্,তুমি না চাইলে এই কাছে থাকার থেকে একটুও এগোবো-না আমি।
মায়ের কাছে দোষ স্বীকার করেছে ইভান!তাতেই যেনো বিগলিত হলো তন্ময়ী।এরপর ইভান এতোএতো কথা বললো,তবে একটা শব্দও উচ্চারণ করলোনা।আর না নড়নচড়ন করলো।ইভানের শক্তপোক্ত আলিঙ্গনে শুধু চুপচাপ রইলো।যদিও পুরুষালি শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ বুকে নিজের শরীরকে কেমন অদ্ভুত অনূভুতি অনুভব করাচ্ছে। দম বন্ধবন্ধ লাগছে।তবু্ও শান্ত হয়ে পড়ে থাকার চেষ্টা করলো।ইভানও আর কথা বাড়ালো না।সারাদিনে শারীরিক মানসিকভাবে বেশ ক্লান্তি গিয়েছে।তন্ময়ী তার কথা মেনেছে,শান্তিতে চোখ বুজলো সে।বুকে শয়নরত রমনীকে বাম হাত দিয়ে আরও শক্তপোক্তভাবে আগলে নিলো।ফের ডান হাতটা রাখল নিজের মাথার নিচে।এরপর থেকে প্রতিটা রাত যদি মেয়েটাকে এভাবে বুক জড়িয়ে নিয়ে ঘুমানো যায়,তবে তার রাতসহ দিনগুলোও মন্দ কাটবেনা।
★
ক্ষুধার চোটে ঘুম ভেঙে গেলো কৌড়ির।নড়তে গিয়ে বুঝলো পাশে জায়গা কম।মুখ উঁচু করে দেখলো,পাশে নাফিম নেই।মান্যতা আপু শুয়ে আছে অন্যপাশে নানুমা।কৌড়ি নড়েচড়ে আবার শুয়ে পড়লো।কিন্তু অতিরিক্ত ক্ষুধায় ঘুম আসলো তার।আর সেই বিকাল থেকে এই পর্যন্ত ঘুমে।এখন ক’টা বাজে কে জানে।শুয়ে থাকতেও ভালো লাগছেনা।উফফ।কি এক জ্বালা!
‘ক্ষুধা লেগেছে বুঝি?
মান্যতার প্রশ্নে সচকিত হয়ে বললো-তুমি এখনো ঘুমাও নি আপু?
‘শুয়েছি তো একটু আগে।শুয়ে পড়তেই আমার ঘুম আসে না।শুধু ঠান্ডায় চুপচাপ আছি।
বলেই উঠে বসলো মান্যতা।সেটা দেখেই কৌড়ি বললো- ‘আবার উঠছো যে?
‘ভাইয়ের বউটা দুপুরে না খাওয়া।রাতেও না খেয়ে ঘুমিয়ে আছে।আমার আজ্ঞা আছে, সে যখনই উঠবে তাকে যেনো অবশ্যই খাওয়ানো হয়।
কপাল কুঁচকে ফেললো কৌড়ি।তবে মান্যতার কথা বুঝে উঠতেই কপাল শিথিল হয়ে গেলো তার।আজ্ঞা দেওয়া মানুষটা কে বুঝেই মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।কেনো মানুষটা তার মায়াজালে এমনভাবে জড়িয়ে নিচ্ছে তাকে।যদিও পেটে প্রচুর খিদে তবুও বললো।
‘এখন খাবো-না আপু।ঠান্ডায় উঠতে ইচ্ছে করছে না।তুমিও শুয়ে পড়ো।
হাত ধরে টেনে তুললো কৌড়িকে।এবার নজর পড়লো গায়ের মোটা কম্বলে।সেই একই সুপরিচিত কড়া সুগন্ধ।হয়তো মানুষটার ব্যবহৃত কম্বল।বিধায় তার গায়ের সুগন্ধটা ছড়াচ্ছে।কৌড়ির ভাবনার মাঝেই হাত টেনে বেড থেকে নামালো তাকে।ফের বললো।
‘চলো।শুধু তুমি একা খাবেনা আমিও খাবো।বিয়ে বাড়ি থেকে খেয়ে আাসার পর রাতে খেতে ইচ্ছে করেনি।কিন্তু একন মনেহচ্ছে আমারও ক্ষুধা লেগেছে।
এবার আর দ্বিমত করতে পারলোনা কৌড়ি।প্রথমে ওয়াশরুমে গেলো সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে দু’জনে নিচে গেলো।কিচেনের ফকফকা লাইটটা জ্বলছে।দুজনেই কথা বলতে বলতে সেদিকে এগোলো।সেখানে গিয়ে ঈশিতাকে চুলায় কিছু করতে দেখে মান্যতা বললো।
‘তুমি এখনো ঘুমাইনি আপু।
হঠাৎ কথায় একটু চমকে গেলেও,মান্যতা আর কৌড়কে দেখে শ্বাস ফেলে বললো।–মাথাটা ধরেছে প্রচুর।আদা চা খাওয়াটা প্রচুর দরকার।তাই কিচেনে এসেছি।
‘কাওকে ডাকতে।
‘সবাই ক্লান্ত। তাতে আবার শীতের রাত।কাকে বিরক্ত করবো।তাই নিজে চলে এলাম।তা এতো রাতে তোরা এখানে?
ফ্রিজের দিকে এগোলো মান্যতা। খাবার বের করতে করতে বললো—ক্ষুধা লেগেছে,তাই খেতে এলাম।আর রাতে কৌড়িও খায়নি।তাই ওকেও সাথে নিয়ে এলাম।
‘খাবার আমার এখানে নিয়ে আয়।আমি গরম করে দিচ্ছি।
মান্যতা হাতের কাজ সারতে সারতে বিনয়ী কন্ঠে বললো।–লাগবেনা।আমি করে নিতে পারবো।তোমার মাথা ব্যথা করছে,আপতত চা খেয়ে রেস্ট নাও।
চায়ের পানি এখনো ফুটেনি।সেটা দেখে ঈশিতা ফের বললো–তোরা কেউ চা খাবি?পানি আরও একটু দেবো তাহলে।
মান্যতা ফের বললো –আমি-তো খাবোনা।কৌড়িকে জিজ্ঞেস করো।
জিজ্ঞেস করার আগেই কৌড়িও না জানিয়ে দিলো।ঈশিতার নজর পড়লো কৌড়ির দিকে।ফর্সা গোলগাল মুখ,ফুলে আরও গোলুমোলু দেখাচ্ছে। মেয়েটার শরীর খারাপ নাকি?বিয়ে বাড়ি থেকেও তখন চলে এলো।তারপর বাড়িতে এসে বউ নিয়ে কতো হৈচৈ হলো তখনও তো মেয়েটাকে কোথায় দেখেনি।কিছুটা চিন্তিত গলায় শুধালো সে।
‘তোমার চোখমুখ এতো ফুলোফুলো দেখাচ্ছে কেনো?তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
বিনয়ী হাসলো কৌড়ি।ফের বললো —শরীর ঠিক আছে আপু।অনেক্ক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলামতো এজন্য এরকমটা দেখাচ্ছে।
চায়ের পানি ফুটে গিয়েছে।আদা,এলাচ,দারচিনি লবঙ্গ এর কম্বিনেশনে পানিটা ঘনো করে জ্বালিয়ে নিয়ে তাতে চা পাতা ঢেলে,মশল্লা চা বানিয়ে নিলো।মাথাটা পুরোপুরি না ছাড়লেও,আল্লাহর রহমতে অতিরিক্ত ব্যথা থেকে নিস্ক্রিয় পাবে।চা-টা ঢেলে নিয়ে মান্যতাদের বলে ড্রয়িরুমে চলে গেলো সে।ঈশিতা চলে যেতেই দুজনে মিলে খাবার গরম করে ডায়নিং টেবিলে নিলো।ফের খেতে বসে টুকটাক কথা বলতে থাকলো।
★
দীর্ঘ সময় ছাঁদে পার করে নিজের রুমের দিকে যেতেই ড্রয়িংরুমে নজর পড়লো নিভানের।রুমের দিকে আর পা না বাড়িয়ে সিঁড়িপথ ধরে নিচে নামলো সে।শেষ সিঁড়ি রেখে ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই,মনোযোগী হয়ে চা পান করা ঈশিতাকে শুধালো।
‘তুমি এখনো ঘুমাওনি?
‘আরেহ তুই।তুইও জেগে আছিস?আমার মাথাটা কেমন ধরেছে তাই চা খেতে এলাম।
‘ঔষধ লাগবে?
‘তোর ভাইয়ার মতো কথায় কথায় ঔষধ আমি খাইনা।এটা তুই জানিস না।
কথার উত্তর না দিয়ে স্মিথ হেসে ঈশিতার পাশে গিয়ে বসলো নিভান। ঈশিতা বললো।
‘তুই চা খাবি?
না বলতে গিয়েই ড্রয়িংরুমের সরাসরি ডাইনিংয়ের দিকে নজর পড়লো তার।মুলত টুংটাং মৃদুশব্দে নজর ওদিকে গেছে।তবে এই উঠেছেন ম্যাডাম।
‘কি হলো খাবি?
‘এক্সট্রা থাকলে খাওয়ায় যায়।আর যদি নতুন করে বানাতে চাও তবে থাক।
‘এক্সট্রা আছে।দেরী কর দিচ্ছি।
ঈশিতা উঠতে যাচ্ছিলো।সেটা দেখে নিভান বললো।—তুমি বসো।আমি দেখছি।
নিভান উঠলো।ড্রয়িংরুম পেরিয়ে ডায়নিং স্পেসে পা রাখতেই কৌড়ির নজর আপনাআপনি চলে গেলো নিভানের পানে।সুগভীর নজরজোড়া তারপানে স্থির রেখে সামনে এগোচ্ছে মানুষটা।খাওয়া রুদ্ধ হয়ে গেলো কৌড়ির। মাথা নিচু করে নিলো সে।মান্যতাও খেয়াল করলো নিভানকে।তড়িৎ জিজ্ঞেস করলো।
‘কিছু লাগবে দাদাভাই?
‘তোরা খেয়ে নে।আমি নিচ্ছি।
কিচেনে গিয়ে চায়ের পাত্র থেকে কাপে চা নামিয়ে ড্রয়িংয়ে যাওয়ার আগেই দেখলো ডাইনিংয়ে এসে বসেছে ঈশিতা।নিভানকে দেখতেই বললো—এখানে বোস।কথা বলি।
নির্দ্বিধায় কৌড়ির পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো নিভান।বসেই পরপর চায়ের কাপে দু’বার চুমুক দিলো।
কৌড়ি আরও সংকোচিত হলো।সেটা খেয়াল করে মিটিমিটি হাসলো মান্যতা।ঈশিতা কথা তুললো।
‘বড়ো ভাইয়ের আগে ছোটো ভাই বিয়ে করে ফেলেছে বিষয়টা কেমন না?
নিভানের নির্লিপ্ত উত্তর।–‘কেমন আবার?
‘তোর কাছে কেমন-সেমন না মনে হলেও আমাদের কাছে কেমন সেমন যেনো মনে হচ্ছে।যাই হোক ইভান বিয়ে করে নিয়েছে,এটা ভেবে অন্তত এবার নিজের বিয়ে কথাটা ভাব।বয়সতো থেমে থাকছেনা।আর তা বাদেও সবার তোকে নিয়ে কতো ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা।আর কতোদিন সময় নিবি ভাই?
সংকোচ ছাড়াই পাশের মেয়েটার দিকে তাকালো নিভান।মনেমনে দুর্বোধ্য হেসে বললো–তবে মেয়ে দেখো বিয়ে করে ফেলি।
‘সত্যি বলছিস!কতোগুলো মেয়ে রিজেক্ট করছিস মনে আছে! তোরজন্য মেয়ে পছন্দ করবো ভাবতেই তো ভয় হয়।এই না আবার না করে দিস।মান ইজ্জত সব যায়!
তবে আমার ননদের মেয়ে আছে না,রুশা।তুই এবার বিয়েতে রাজি হলে,ও পাত্রী হিসাবে মন্দ নয়।দেখতে শুনতে বেশ ভালোই মেয়েটা।
নিভানের ঈশিতার কথায় কোনো কান-মন নেই।সে নির্লিপ্ত নজরে তাকিয়ে আছে কৌড়ির পানে।সে চাইছে উত্তর কৌড়ির দিক থেকে আসুক।বাক্যদ্বারা না আসলেও ভঙ্গিমাদ্বারা আসুক।আসলোও তাই।নিভান কথাটা বলতেই ফট করে নিভানের মুখের দিকে তাকালো কৌড়ি। নিভানকে নির্লিপ্ত নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখেই মূহুর্তেি চোখ সরিয়ে নিলো সে।এবার শব্দকরে হাসলো নিভান।চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে, গা-ছাড়া ভাব দিয়ে বললো।
‘ওসব বাদ দাও তো।ওসব মেয়ে নিভানের চলবে না।
‘দেখেছিস,এই কারনেই মেয়ে পছন্দ হলেও তাদের কাছে প্রস্তাব রাখতে পারিনা।তুই পৃথিবীর সব বিষয়ে সিরিয়াস হলেও,বিয়ে বিষয় আসলেই এমন গা-ছাড়া ভাব দেখাস। কেনো করিস এমন?দুদিন পর ইভান বাচ্চার বাবা হয়ে যাবে।আর তুই বিজনেস নিয়েই পড়ে থাকিস।
‘আপু।
মান্যতা এতোসময় চুপচাপ খাবার খেতে খেতে দুপক্ষের কথা শুনলেও এবার কেমন হাসফাস করে উঠলো।ঘনোঘনো পানি খেতে থাকলো।বড়ো ভাইয়ের সামনে এহেন কথাবার্তায় কখনো সামিল হয়নি এমনকি সামনে ও থাকিনি সে।তাই কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। সেটা খেয়াল করেই ঈশিতাকে ডাকলো নিভান।ঈশিতা সেটা বুঝেই বললো।
‘ওরা তো কি হয়েছে।ওরাও বড় হচ্ছে,সবকিছু বুঝতে শিখছে।আর ইভান বাচ্চারা বাবা হয়ে যাবে এটাতে খারাপ কি বলা হলো।বাচ্চা হওয়াটা বুঝি খারাপ কথা!
মা নানুমা আর এই মানুষটা তাকে বিয়ে দেওয়া নিয়ে যেনো মাঝেমাঝে প্রসঙ্গ উঠলেই পাগল হয়ে যায়।তাই ঈশিতাকে ঠান্ডা করতে বললো—আবার আমার বিয়ে নিয়ে হাইপার যাচ্ছো!উফফ, তোমাদেরকে বুঝিয়ে আর পারা যায়না।তবে বললেই কি যে কাওকে নিজের জীবনে জায়গা করে দেওয়া যায়।নাকি নিজের বলে ভাবা যায়।আমি পারিনা ভাবতে।সে হবে আমার পুরো জীবনের সঙ্গীনি।তাকে তো বুঝেশুনে নিজের জীবনে জড়াতে হবে তাইনা?বিয়ে করবো ভাবলাম,আর যে কাওকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিলাম।হলো এটা?যাকে আমি আমার আমিটা দিয়ে দেবো,তাকে পরোখ করে নেবোনা।তাকে আমার আমিটা দেওয়া যায় কি-না। তবে…
কথা শেষ করতে দিলোনা ঈশিতা।বললো–কেমন মেয়ে চাই তোর?সেটা তো বললেই হয়।তা না,যার কথাই বলি সে রিজেক্ট।পৃথিবীর সব মেয়ে তোর অযোগ্য তাই না।
রহস্যময় হাসলো নিভান।শান্ত গলায় বললো–তা বলতে পারো।শুধু একজন বাদে আর পৃথিবীর সব মেয়ে নিভানের অযোগ্য।
ঈশিতা সন্দিহান নজরে নিভানের দিকে তাকালো।ফের সন্দিহান গলায় বললো।—তোর কাওকে পছন্দ আছে বলে মনে হচ্ছে।
আর বসে থাকতে পারলোনা কৌড়ি।এভাবে বসে থাকা যায়না।দরকার নেই তার পেট-মহাজনকে শান্ত করার।না খেয়ে কেউ মরেনা।বরং হৃদযন্ত্রায় সে যখনতখন মরে যেতে পারে।আর এখানে বসে থাকা মানে নিজের মৃতুকে চুপিসাড়ে আহ্বান জানানো।উঠে দাঁড়াতেই মনে হলো গরম চুলার উপরের ঝলছে যাওয়া আগুন থেকে কেউ তাকে বাঁচিয়েছে।তড়িৎ কিচেনের দিকে অগ্রসর হলো সে।তাকে দেখে মান্যতাও চলে গেলো।সেদিকে গভীর নজরে তাকিয়ে রইলো নিভান।ঈশিতার সন্দেহতা বাড়লো।হঠাৎ মাথায় যা খেললো মুখে বলে বসলো সে।
‘আমার অভিজ্ঞ নজর এবং মন বলছে তুই কৌড়িকে পছন্দ করিস।
হাসি চওড়া হলো নিভানের।নজর ঘুরিয়ে নিস্পাপ নজরে ঈশিতার পানে তাকালো সে।সেই হাসিহাসি শ্যামবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে নিলো ঈশিতা।কিছুটা বিম্ময় নিয়ে বললো–ও-তো বাচ্চা মেয়ে ভাই!
মূহুর্তেই নজর অসহায় দেখালো নিভানের।সেটা বুঝে দমে গেলো ঈশিতা।ভাইয়ের অসহায় নজরে পড়ে নিতে অসুবিধা হলোনা।সেখানে স্পষ্ট অক্ষরে খোদাই করে যেনো লেখা-ওই বাচ্চা মেয়েতে তোমার ভাই মন হারিয়ে বডে আছে, এখন তোমার ভাইয়ের উপায় নেই।
দুঃখী হলো ঈশিতা।তবে মেয়েটা কৌড়ি ভেবেই মনেমনে খুশিও হলো।রূপেগুনে একেবারে পরিপূর্ণা।নিভানের জন্য উপযুক্ত মেয়ে।তবে?
কন্ঠ ধীর করে ঈশিতা শুধালো—তবে ‘বাড়িতে বিয়ের কথা কেনো বলছিসনা?ফুপা-ফুপুকেও জানা।অবশ্যই তুই সিদ্ধান্ত নিলেই তো সবকিছু ওকে।
রান্নাঘর থেকে এখনো পানির আর থালাবাসনের টুংটাং শব্দ হচ্ছে। চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুঁজে নিলো নিভান।বললো—ওকে বোঝাও তবে।
‘কৌড়ি জানে তোর ফিলিংস সম্পর্কে?
চোখ বুঁজে রেখেই মৃদু হাসলো নিভান।ধীর গলায় বললো—‘জানে।
বিস্ময় নিয়ে ফের শুধালো ঈশিতা–ও রাজি নয়?
এবার হাসি চওড়া হলো নিভানের।ঈশিতার বিস্ময় বাড়িয়ে দিয়ে বললো–‘না
‘বলিস কি?তুই কে আর অন্যন্য মেয়েদের নজরে কি!
আর কারা তোকে মেয়ে দেওয়ার জন্য ওতপেতে বসে আছে।এটা ও জানে!নাহলে তোকে না বলে!
হাসিটা আরও একটু চওড়া হলো নিভানের।বললো–‘এবার বোঝো কেনো তোমার ভাই মেয়েটাতে মন হারিয়েছে।এতোদিনের শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্ব চূর্ণ করে দিয়ে একটা বাচ্চা মেয়েতে পাগল হয়েছে।
এগো খোলামেলা অনুভূতি প্রকাশ।সত্যিই সামনে নিভান বসে আছে,এটা যেনো ক্ষনিকের জন্য অবিশ্বাস্য মনে হলো ঈশিতার।ভাইটা যে তার বেকায়দায় ফেসে গেছে বেশ বুঝলো।কৌড়ি রাজি নয়।মনেমনে ভাইটার জন্য দুঃখও অনুভব হলো।নরম কন্ঠে বললো
‘আমি বোঝাই ওকে।
বোনের নিজের প্রতি স্নেহময় কথায় হাসলো নিভান।চোখ খুলে একপলক ঈশিতার দিকে তাকিয়ে ফের বন্ধ করে নিলো।বললো।
‘আপতত না।পনেরো দিন পর ওর পরিক্ষা।আপতত সেদিকেই ধ্যানজ্ঞান থাকুক।তারপর এডমিশনের পড়া পরিক্ষাটাও ঠিকঠাক দিয়ে নিক।এরপরেরটা আমিই বুঝে নেবো।
‘এখনো তো পাঁচ-ছয় মাসের ব্যাপার?
এবার মৃদু শব্দ করে হাসলো নিভান।সেই চমৎকার হাসিটা স্নেহভরা নজরে দেখলো ঈশিতা।নিভান বললো।
‘ভাই বিয়েতে ঘোর আপত্তি ছিলো।এখন এটুকু সময় অন্তত সবুর করো।আর আপতত কাওকে কিছু জানিও না।মা’কেও না।ঝামেলাটা ওর হবে।
‘হুমম।
দুভাইবোনের মধ্যে আর বিশেষ কথা হলোনা।ঈশিতা উঠে দাড়ালো।কিচেনের দিকে একপলক তাকিয়ে ফের নিভানের বুঁজে থাকা চোকমুখের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো।ঈশিতা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মান্যতা আর কৌড়িও নিভানকে পাশ কেটে চলে যাওয়ার আগেই মান্যতাকে ডেকে উঠলো নিভান।
‘মান্য।
দাঁড়িয়ে পড়লো দুজনেই।চোখ খুললো নিভান।নজর ফেললো মান্যতার মুখে,তারমধ্যে একপলক কৌড়িকেও দেখে নিলো।কেনো যানি মেয়েটার ফ্যাকাসে চোখমুখ বলছে,মেয়েটা কোনো অসুখে ভুগছে কিন্তু নিজের স্বভাবজাত অনুযায়ী কাওকে কিছু বলছে না।বা বলতে পারছেনা।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।স্বাভাবিক গলায় অকপটে মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে বললো।—কাল ইভানের রিসিপশন,কাল যাওয়া হবে কিনা জানা নেই।হয়তো যাওয়া হবেনা।তবে পৌরসু দিন অবশ্যই ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে।তুমি তো ডক্টর মৌমিতাকে চেনো।
মাথা নাড়ালো মান্যতা।ফের মুখে বললো।–চিনবো না কেনো।উনার কাছেই তো যাওয়া হয় বেশিরভাগ আমাদের।
‘উনাকে বলে রাখবো আমি।তোমারা শুধু গিয়ে দেখিয়ে আসবে।অসুস্থতা কি জনাবে।
আশ্চর্য হয়ে কৌড়ি নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।ফের বললো—কিন্তু আমি-তো কোনো অসুখে ভুগছিনা।তবে আমি উনার কাছে কেনো যাবো?
আমি যেতে বলেছি তাই যাবে।অসুস্থ না থাকলেও সাধারণ চেকাপ করেই চলে আসবে।
নিভানের জেদপূর্ন কথায় রুক্ষ গলায় কৌড়ি বললো।
‘এটার কোনো প্রয়োজন তো দেখছি না আমি।
‘কিন্তু আমি দেখছি।
‘তবে আপনি অযথা জোরাবাদী করতে চাইছেন আমার সাথ।
রাগ হলো নিভানের।রাগে চোখমুখ শক্ত হয়ে কৌড়ির মুখের পনে তাকিয়ে মান্যতাকে বললো।—মান্য রুমে যাও।ও একটু পরে যাচ্ছে।
আশ্চর্য হয়ে কৌড়ি আর নিভানের ঝগড়া দেখছিলো মান্যতা।শান্ত ভিতু মেয়েটা তার ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করছে!নিভান ডাক দিতেই ধরপড়িয়ে উঠলো বুক।কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো,সে-ও আতঙ্কে আছে।তার নজর বলছে,আমাকে একা রেখে যাবেনা আপু।সেই হিসাবে নিভানকে ডাকলো সে।
‘দাদাভাই।
মান্যতার ডাকের স্বর শুনে এবার কিছুটা জোর গলায় বললো নিভান।—-মান্যতা তুমি রুমে যাও।আমি বলছি তো ও একটু পরে যাচ্ছে।
“মান্যতা” ডাকটা ঠিক হজম হলো-না মান্যতার।এই ডাকটা দাদাভাইয়ের ভালো মেজাজের ডাক নয়,বুঝে কৌড়ির পানে দূর্বল নজর ফেলে চলে গেলো সে।কৌড়িও পা বাড়াতে চাইলো কিন্তু কিছুতেই যেনো তার পা উঠলোনা।আর এটাও বুজে আসলো না,সে যে অসুস্থ এই মানুষটা বুঝলো কিকরে?
‘রাগ জেদ যতো পারো দেখা-ও।গোটা তুমি হাজারটা সহ্য করার ক্ষমতা নিভানের আছে।তবে রাগ জেদ এমন জায়গায় অযথা প্রয়োগ করোনা,যেখানে বাধ্য করা লাগে তোমাকে।আমি কোনোরূপ চাইনা তোমাকে বাধ্য করতে।আমি চাই,নরমালি তুমি কথা শোনো আমার।অযৌক্তিক বা অযথা হলে শোনার দরকার নেই।কিন্তু তুমিতো শুনতেই চাইছোনা।তবে নিজের রাগ জেদ বহাল রাখার জন্য ডাক্তার দেখাতে চাইছোনা ভালো কথা।একটু নয় বেশ ভালো কথা।তবে অসুস্থতায় ভুগে যদি কোনো কঠিন অসুখ বাধিয়েছো।বিশ্বাস করো কৌড়ি, সেদিন তোমাকে আমি নিভান আস্ত রাখবো-না।
সেদিন রাগ জেদ কাকে বলে,নিভানকে দেখবে।
একটু থামলো নিভান।কৌড়িকে দেওয়া বিকালের কথাটা রাখতে পারলো-না সে,আর আদৌও রাখা সম্ভব নয়।তার কথার নড়চড় কখনো হয়না অথচ এই মেয়েটার বেলায়।সব কেমন এলোমেলো।চোখ খিঁচে বুঁজে থাকা কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।রুক্ষ গলার স্বর ছেড়ে শান্ত গলায় বললো।–মোটেও ভবিষ্যৎ নিভানকে দেখার চিন্তা ভাবনা করেনা কৌড়ি।যদি মনেমনে ভেবে থাকো,আমি শুধু মুখেমুখে বলছি।তোমাকে কিছু বলবোনা।তবে খুব ভুল ভাবছো।ভবিষ্যত রাগে জেদেপূর্ন নিভানকে যদি দেখতে চাও,তোমাকে ডিস্টার্ব করা ছেলেগুলোর থেকে জেনে নিও।নিভানের রাগ জেদ ঠিক কতোটা বাজে।
এতো দূরে যাওয়ার দরকার নেই।তোমার বড়মার কাছে জিজ্ঞেস করবে, সেই রাগান্বিত জেদালো নিভান কেমন?নাহলে তোমার মান্যতা আপুর কাছে জিজ্ঞেস করো।দরকার পড়লে তোমার ইভান ভাইয়াকেও জিজ্ঞেস করতে পারো।সবার কাছ থেকে আমার সম্পর্কে জেনে তারপর যেটা খুশি সেটা করো।এরপর তোমার ইচ্ছে তুমি ডাক্তার দেখাবে কি দেখাবে না।
আমার থেকে নিজেকে দূরে রাখবে রাখো কিন্তু রাগে জেদে হারিয়ে ফেলার চিন্তা ভাবনা ভুলেও করো-না।
থামলো নিভান।সময় পার হলো চোখ খুললো কৌড়ি।হরিণী বড়বড় চোখে তখন নোনাজলে টইটম্বুর।নিভান তখনও চেয়ে কৌড়ির মুখপানে।মনেমনে নিভানের প্রতি ক্ষোভ জন্মালো কৌড়ির।সেই ক্ষোভ থেকে সংকোচ ছাড়াই বললো।
‘আপনি প্রচন্ড খারাপ!
চলবে….