#ফুলকৌড়ি
(৩০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
অপমানে থমথমে হয়ে উঠলো দীবার ফর্সা সুন্দর মুখাবয়ব।যতোটা রূঢ়ভাষায় তার কথার উত্তর নিভান দিলো, ততোটা রূঢ়ভাবে প্রশ্ন সে কৌড়িকে করেনি।তবে নিভানের উত্তরের ভাষা বলে দিচ্ছে কৌড়ির প্রতি নিভানের অনুভূতিরর জোর।প্রথম দেখায় নিভানের পাশাপাশি কৌড়িকে দেখায় যে শঙ্কা মনে সৃষ্টি হয়েছিলো দীবার। তা একটু একটু করে বাস্তবিত রূপ নিচ্ছে।আর নিভান সেই বাস্তবতায় কৌড়ির মাঝে ডুবে যাচ্ছে।আর তাকে দীর্ঘনিশ্বাসের সহিত সরল চোখে তা দেখে যেতে হচ্ছে।এটা যে কতোটা যন্ত্রণাদায়ক যদি বিয়ের আগে একটাবার অনুভব করতে পারতো।তবে কখনো নিভানকে ছাড়ার কথা ভাবতোনা।ভুলে-ও ভাবতো না।এখন একজনের স্ত্রী হয়ে নিছকই এই ভাবনা অবৈধ,হারাম।তবুও মন কেনো মানে না!কেনো মানতে চায় না!নিভানকে যে আর তারদিকে ফেরানো আর কখনো সম্ভব নয়।এটাও বেশ বুঝতে পারছে দীবা।আরও নিভান যে ধরনের ছেলে,দীবা যতোই ছলাকলা করুক আর যতোই তন্ত্রমন্ত্র পড়াক।নিভানকে সে তারদিকে কখনোই ফেরাতে পারবেনা।তবে কৌড়ির পাশাপাশি নিভানকে দেখলেই তার কি যেনো হয়ে যায়।যতোই নিজের মন আর যবানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেনা কেনো, তারা নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে যায়।চায়না সে, নিজের বয়স আর স্বভাবের বাহিরে গিয়ে অস্বাভাবিক আচারন করতে তবু্ও করে ফেলে।দীবার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে কৌড়ির মন খারাপ হলো।তারজন্য দীবাকে কথা শুনতে হলো!বিষয়টা মোটেই ভালো লাগলোনা তার।যদি-ও তাকে নিয়ে দীবার ইঙ্গিতসরূপ কথাগুলো তার মোটেও ভালো লাগেনি।তাই বলে তারজন্য কাউকে ছোটোবড় কথা শুনতে হবে!লজ্জিত হতে হবে!এটা কখনোই চায়না সে। শুধু দীবার জন্য নয়,কারও জন্য চায়না সে।মনেমনে ভাবলো নিভানকে কিছু বলবে।ভাবনা মতোই নিভানের দিকে তাকাতেই দেখলো,চোখমুখ শক্ত করে তারদিকে তাকিয়ে আছে মানুষটা।মানুষটার চোখমুখের এক্সপ্রেশন বলে দিচ্ছে–এখানে আমার কথার উপরে একটা শব্দ-ও তুমি উচ্চারণ করে দেখো।তোমার খবর আছে।
যে কথাগুলো বলবে বলে মনেমনে সাজিয়েছিলো।ঠোঁট কেনো গলা অব্দি আসার আগেই কথাগুলো যেখান থেকেই গুছিয়ে নিয়ে আসছিলো সেখানেই মাটি চাপা দিয়ে ফেললো সে।সামনের মানুষটা মানেই আতঙ্ক,ভয়!সেই আতঙ্ক,ভয়,মানুষটার আচারনে কিছুটা কাটলে-ও পুরোটা কাটেনি।অদ্ভুত মানুষটার সাথে দুঃসাহসিক আচারন করার সাধ্যি তার কখনো হবে কি-না,সে জানে না।তবে যেটুকু কথার তর্ক সে মানুষটার কথার পরিবর্তে করে,তা মনে সাংঘাতিক ভয় রেখে।
‘এই তোরা এভাবে থমকে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?চল।ইভানদের ফোন দিয়েছি,আসছে ওরা।আরেহ নিভান তুই কখন এলি?কৌড়ি, তুমি-ও এসেছো?
অমায়িক হেসে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই,কৌড়ি দীবার দিকে একপলক তাকিয়ে উত্তর দিলো–ইভান ভাইয়া, জোর করে নিয়ে এসেছেন আমাকে।আমার মানা তিনি একটুও শোনেন নি।
‘ঠিক করেছে।বিয়ে বাড়ির আনন্দ বলে কথা।ভালো লাগবে-না আবার কেনো?যতোই শরীর খারাপ থাক,বিয়ের আনন্দ কেউ মিস করে?ইভান একদম ঠিক করেছে।আমার পক্ষ থেকে বিয়েতে ওর একটা এক্সট্রা গিফট পাওনা রইলো।
এবাড়িতে আসা একদিনের মধ্যে আমায়িক ব্যবহারের ঈশিতা বেশ ভাব পাতিয়ে নিয়েছে কৌড়ির সাথে।বিশেষ করে নিভানের সেই আচারনে পর থেকে, ফুফুর কাছ থেকে মেয়েটা সম্পর্কে জেনে আরও নিজ থেকে ভাবটা জমিয়েছে।যদিও কৌড়ি এখনো সেভাবে মিশে উঠতে পারিনি।দুজনের কথায় মূহুর্তেই পরিবেশ আগের ন্যায় হলো।ঈশিতা ভিড় থেকে একটু দূরে গিয়েছিলো, ইভানদের আসতে বলার জন্য।বিধায় বিষয়টা সম্পর্কে সে আবগত নয়।কিন্তু অন্যন্য কাজিনেরা,কৌড়িকে নিয়ে নিভানের ব্যবহারে একটু আশ্চর্য হলো!বাহিরের মেয়েটাকে নিয়ে,দীবার সাথে রূঢ় আচরন!মনেমনে প্রশ্ন তৈরী করলো।তবে যাকে নিয়ে মনে প্রশ্ন তৈরী হলো,তাকে প্রশ্ন করার স্পর্ধা কারও নেই।বিধায় কেউ আর কিছু বললো না।তবে কৌড়ির পানে বাঁকা নজরে তাকাতেও ভুললো না তারা।কৌড়ি খেয়াল করলো বিষয়টা তবে কি করার আছে তার।নিভান-ও খেয়াল করলো,তবে বিশেষ গুরুত্ব দিলো-না।ইভানরা আসতেই,ঈশিতা গহনা আর শাড়ী কেনার জন্য তাড়া দিলো।সবাই গহনার দোকানের দিকে এগোলেও, ঈশিতাকে বলে নিভান অফিসে চলে গেলো।যদিও ঈশিতাসহ ইভান চেপে ধরেছে,কিছুতেই যেতে দেবেনা তাকে।তবে কাজ হলো না। গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তার।তবে যাবার আগে সবার চোখের আড়ালে কৌড়িকে হুমকিমূলক বার্তা ছুঁড়ে দিয়ে যেতে ভুললো না।মান্যতার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে মিহিকন্ঠে বার্তা ছুঁড়ে দিয়ে গেলো।
‘ভালোমানুষি অপাত্রে দান কখনোই করবে-না।তুমি চাইলে-ও নিভানের,আর না চাইলেও নিভানের।যদি বলো,তোমার হ্যাঁ স্বীকারোক্তি না পাওয়া সত্ত্বেও তোমার সাথে জোর করছি।হ্যা জোর করছি আমি!তুমি হ্যাঁ না যাই বলো না কেনো, তুমি নিভানের।আর নিভান ভালোমানুষি কখনো অপাত্রে দান করা পছন্দ করে না।সো,বি এক্সট্রা কেয়ারফুল।নিজেকে সাবধানে রেখো,ভালো রাখার চেষ্টা করো।অসম্মানিত হওয়ার থেকে রক্ষা করো।না-হলে নিভানের কাছে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া লাগবে তোমাকে।তোমার ভালোর কৈফিয়ত না দেওয়া লাগলেও,অবশ্যই মন্দের কৈফিয়তটা দেওয়া লাগবেই।আর আমার উপরে দেখানো রাগে জেদে ভরা যে শরীরের মধ্যে ভালোমানুষি মনটা নিয়ে ঘুরছো।সে সবকিছু তোমার হলেও,আস্ত তুমিটা তোমার নও।তুমিটা আমার।আর নিভানের জিনিস নিভান কখনো হেলায়ফেলায় নষ্ট করে-না।কষ্ট পেতে দেয় না।অসম্মানিত হতে দেয়ন।সো মাথায় রেখো,কৌড়ি।আস্ত শরীরটা তোমার হলেও,তুমি তোমার নয়।
নিভান শান্ত পায়ে চলে গেলো।সেদিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকে নিজের আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে দেখলো কৌড়ি।নিজের ব্যথা লাগলে,কষ্ট পেলে,সেটাও কাউকে কৈফিয়ত দেওয়া লাগবে!আশ্চর্য!নিজের সবকিছু অথচ সে নিজের নয়!সেটাই বলে গেলো মানুষটা!ঘোর কাটালো তার।নিভানের কথাগুলো একে একে ফের মন পড়তেই,মনের অদ্ভুত সুক্ষ এক ভালোলাগা সৃষ্টি হলো।পরোমূহর্তে কিছু একটা ভেবে মিলিয়ে গেলো সেই ভালোলাগা।নিভানের যাবার পানে তাকলো সে।জেদ নিয়ে মনেমনে আওড়ালো–কৌড়ি যা ইচ্ছে তাই করবে।আর কৈফিয়ত!বসে আছে সে,আপনাকে দেওয়ার জন্য।
দূরত্ব কদমে কদমে বাড়লেও, যেনো কৌড়ির মনে কথা ঠিকই,শুনতে পেলো, বুঝতে পারলো,এমনভাবে পিছে তাকালো নিভান।সঙ্গে সঙ্গে নজর ফিরিয়ে নিলো কৌড়ি।সেটা দেখে মৃদু হেসে নিজের গন্তব্যে এগোলো নিভান।মান্যতা দু’জনের বিষয়টা লক্ষ্য করলো।নিভান চোখের আড়াল হতেই মান্যতা মজার ছলে মিহিকন্ঠে বললো।
‘দাদাভাই চুপিচুপি তোমায় কি বলে গেলো?
হঠাৎ কথায় পরাণ চমকিয়ে উঠলো কৌড়ির।পাশে ফিরে মান্যতার দুষ্ট হাসির মিষ্টি মুখটা দেখতেই নজর অসহায় করে ফেললো সে।অর্থাৎ এসব কথা তোমায় বলি কিকরে আপু?কৌড়ির মুখের এক্সপ্রেশন দেখে হেসে ফেললো মান্যতা।ফের মজার বললো।
‘আচ্ছা ঠিক আছে, বড়ভাই আর বড়ভাবীর গোপনীয় কথা আমি শুনছি-না।তবুও মুখটা ওরকম করে রেখো-না।আমার দাদাভাই আবার কিন্তু প্রিয়জনদের বেচারা মুখ সহ্য করতে পারেনা।আরও তুমি তার.…
‘আপু।
এবার খিলখিলিয়ে হেসে দিলো মান্যতা। সেই হাসিতে কৌড়ির হৃদস্পন্দন দুরুদুরু হলো।সতর্ক নজর আশেপাশে ফেলতেই দেখলো,সবাই সামনে এগিয়ে গেছে।শুধু তারা দু’জনে পিছনে।হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো,এমনভাবে শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো কৌড়ি।কৌড়ির হাল বুঝে হাসি থামিয়ে ফেললো মান্যতা।হাত বাড়িয়ে নিজের হাতের মুঠোয় কৌড়ির হাতটা নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো।—জানো কৌড়ি,আমার গোটা লাইফে দাদাভাইকে আমি গম্ভীর স্বভাবের জেনে এসেছি।অবশ্যই দেখে এসেছিও তেমন।আমাদের সব ভাইবোন থেকে ভিন্ন,একদম আলাদা।তাকে হাসতে কম দেখেছি,সবার সাথে প্রাণখোলা মিশতে খুব কম দেখেছি।যেকোনো সম্পর্কে অনুভূতি খোলাখুলি প্রকাশ করতেও খুবই ক্ষীন দেখেছি।অথচ সবটাই কিন্তু দাদাভাইয়ের মধ্যে ভরপুর।কিন্তু সে দেখাতে পছন্দ করে-না আর দেখায়ও-না।তবে তোমার বেলায়,সেই দাদাভাইটা কেমন ভিন্ন।হয়তো এতোদিনে জেনে গিয়েছো এমনকি বুঝে গিয়েছো,দাদাভাই তোমাকে পছন্দ করে।তবে একটু আধটু পছন্দ নয়,একবারে নিজের বলে পছন্দ করে।আমিও বুঝেছি এবং দেখেছিও, তোমার প্রতি তার অনুভূতির প্রকাশভঙ্গী।খুবই কঠিন!দৃঢ় মনোবল স্বভাবের মানুষ হয়েও,যা সেও ভিতরে চেপে রাখতে পারেনা।দাদাভাইকে যেমনভাবে ছোটো থেকে এই-অব্দি দেখে এসেছি,বিশ্বাস করো কৌড়ি। আমার কাছেও এই দাদাভাইকে কেমন অবিশ্বাস্য এলোমেলো লেগেছে।কিছুতেই আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না,এ-কি আমার সেই দাদাভাই!গম্ভীর, কথা কম বলা,হাসতে কম পরা,মিশতে না পারা,অনুভূতি প্রকাশে অক্ষম দাদাভাই!কতোখানি তীব্র সেই অনুভূতি বুঝতে পারছো।তোমাকে ভেঙে বলতে পারছি না হয়তো সেকারণেই আমার মতো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছো না।তবে তোমার কাছে আমার একটাই চাওয়া।প্লিজ কৌড়ি,ওই মানুষটাকে কখনো বিমুখ করো-না।তোমাকে যদি সে নিজের একান্ত স্ত্রী রূপে চায়,তুমি তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ভুল করো-না।তুমি চোখবুঁজে ওই মানুষটাকে বিশ্বাস করতে পারো,ভরসা করতে পারো।তুমি কখনোই ঠকবে-না।আমার ভাই বলে বলছি না,তুমি ওই মানুষটাকে জানো না।জানলে,তুমিও ওই মানুষটাকে কখনোই তুমি ফিরিয়ে দিতে পারবে-ও না।
থামলো মান্যতা।কৌড়ির হতবিহ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো–তোমার সাথে আরও অনেক কথা আছে।বাড়িতে অনেক মানুষ।রাতে শোয়ার প্রবলেম হতে পারে।তুমি আমার কাছে ঘুমাবে।রাতে আমরা অনেক গল্প করবো।শুনবে না?
ঘোর কাটলো কৌড়ির।কিছু বলার আগেই, দূর থেকে মৌনতার কন্ঠ ভেসে এলো–এই আপু,তোরা আবার দাঁড়িয়ে পড়লি কেনো।দেরী হয়ে যাচ্ছে তো, আয়।
কথা সেখানেই ক্ষান্ত রেখে মান্যতাও এবার তাড়া লাগিয়ে বললো–এই চলো,চলো।আমাদের রেখে ওরা না আবার শপিং সেরে ফেলে।
★
শপিংমল থেকে বের হয়ে গাড়িতেই বসতেই,কিছু একটা ভেবে ফোন হাতে নিলো নিভান।ফোন ওপেন করে ডায়ালে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত নম্বরটাতে ফোন লাগালো।ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই নিভান শুধালো–তুই কোথায়?শপিংয়ে আসলি না যে?তন্ময়ীর সাথে তো তোরও আসার কথা ছিলো,তবে আসলি না কেনো?
‘আরেহ মেয়েদের শপিংয়ে আমি গিয়ে কি করবো।তাই যায়নি।আর এদিকে একটু কাজ ছিলো,বিধায় যেতে পারিনি।
তৃনয়ের স্বাভাবিক গলার কথাগুলো,কিছুতেই স্বাভাবিক লাগলোনা নিভানের।সে জানে তৃনয় কেনো আসিনি শপিংয়ে।নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নিভান।প্রসঙ্গ পাল্টে ফের শুধালো–আন্টির খবর কি?শরীর এখন কেমন? ভালো আছে কি?
‘শরীর তো ভালো আছে।তবে তনুর প্রতি মনেহয় একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন।আম্মু বলতে চাইছেন,কিছু না ঘটলে কিছু রটে না।নিশ্চয় তন্ময়ী কিছু করেছে না-হলে হঠাৎ এরকম কথা পাত্রপক্ষরা পেলো কোথায়?অনকে বুঝিয়েছি তবুও মুখ থমথমে ভাব উনার।কথাও সেভাবে বলছেন না।এই আর কি।
নিভান কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো-না।ইভানের প্রতি রাগ উঠতে গিয়েই মন দূর্বল হয়ে পড়লো।ভেবে দেখলো,আজ যদি ইভানের সিচুয়েশনে সে পড়তো।তবে কি করতো?আরেকমন বললো,যাই করতো না কেনো,অন্তত ইভানের মতো বোকামি সে কিছুতেই করতো-না।ভাবনা ছেড়ে নিভান ফের শুধালো।
‘আন্টি কি ওই ছেলের জায়গায় ইভানকে মানতে পারছেন না?
আরেহ মা মানবে কি, সে নিজেই তো মানতে পারছেনা।কথাটা ঠোঁটের চৌধারে এনেও বলতে পারলোনা তৃনয়।ইভানের জন্য মান্যতাকে পাওয়া তার আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। সে ভেবে রেখেছিলো,তন্ময়ীর বিয়ের পর একটা চান্স নেবে।তাতে যা হয়ে যায় হবে।তবে বিষয়টা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।বোনের ননদকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টা কি কেউ ভালো চোখে দেখবে?নাকি ভালো মনে মেনে নেবে?ওবাড়ির কেউ মানবে?নিভান মানবে?বোনটার কি তার এহেন প্রস্তাবে শ্বশুরবাড়িতে অসম্মানিত হতে হবে না?এসব ভেবে ভেবে সে দিন পার করছে।এগুলো সে নিভানকে কি করে বোঝায়!কিকরে বলে।তবে নিভানের কথার উত্তর সরূপ বললো।
‘আরেহ না।মা কেনো মানতে পারবেন না।ইভান সবদিক থেকে পারফেক্ট ছেলে।আর তাকে মেয়ের জামাই হিসাবে চাইবেনা,এটা কিকরে হয়!এমনিতেই তন্ময়ীর উপর একটু মনখারাপ আছে বলে ওরকমটা করছে।
নিভান কিছু ভাবলো।ফের বললো–আমি অফিস শেষে তোর বাসায় আসছি।আন্টির সাথে আমার কথা আছে।রাখছি।
ফোন কাটতে গিয়েও তৃনয়ের প্রশ্ন থেমে গেলো নিভান–
‘আম্মুর সাথে তোর আবার কি কথা?
‘তোর মতো গাধাকে বলবো কেনো?যে নিজের কাজটা সাহস নিয়ে ঠিকঠাক করে উঠতে পারেনা।তাকে বলে সময় নষ্ট করে লাভ আছে?
‘তুমি আমাকে গাধা বলতে পারিস-না।এই আমি কি ঠিকঠাক করতে পারিনি?আমি পড়াশোনা থেকে শুরু করে যে কাজটায় উদ্যোগ নিয়েছি,সেটা পুরোপুরি সাহসের সহিত সাকসেসফুল করে এসেছি। তুই আমাকে নতুন চিনছিস?নাকি নতুন করে আমাকে চিনাতে হচ্ছে?
বোনকে সেধে অন্যের ঘাড়ে তো কখনো চাপাতে চায় না নিভান।তবে বন্ধুর মনের দোনোমোনোতাও বুঝতে অসুবিধা হলোনা।মনেমনে ভুগছে ছেলেটা, সেটাও বেশ আন্দাজ করতে পারলো।তাই বললো।
‘নতুন করে চেনাতে,জানাতে হবেনা।তোকে চিনি, জানি বলেই বলছি।তবে ভেবে দেখ।সব ঠিকঠাক থাকলেও, জীবনে যে জিনসটা আঁকড়ে মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত বাঁচতে হবে।সেই জিনিসটা তুই সাহসের সহিত নিজের করে নিতে পেরেছিস কি-না?আমার সন্দেহতা আছে, সত্যিই তুই সেটা চাস কি-না?মনেপ্রানে চাইলে কি কেউ নিজের হৃদয়ে বসানো মানুষটা থেকে দূরে থাকতে পারে নাকি নিজেকে তার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে পারে?আমি পারছি কৈ?আমার যে কৌড়িকে চাই।
শব্দ করেই শ্বাস ফেললো নিভান।সেটা হতবাক হয়ে থাকা ওপাশের ছেলেটা-ও শুনতে পেলো।নিভান ফের বললো–রাখছি।রাতে দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ।
উত্তর এলোনা।কল কেটে দিলো নিভান।অথচ ওপাশের ছেলেটা তখনো স্তব্ধ।নিভান তার কথাদ্বারা কি বোঝাতে চাইলো,নিজেও বুঝতে চাইলো?বিশেষ করে কৌড়িকে দিয়ে উদাহরণ দেওয়া শেষের কথাটা!তবে কি নিভান জানতে পেরেছে তার মনের কথা?কবে, কিভাবে, কখন?সে তো তার আচারন দ্বার কখনো বুঝতে দেয়নি তাকে।শুধু তাদের খুব ভালো বন্ধত্বটা নষ্ট হয়ে যাবে বলে।তবে কিভাবে জানলো?মান্যতাকে দেখা মূহুর্তেই চোখমুখের এক্সপ্রেশন বদলে যায় তার।সেখানে ভীড় করে বিশেষ মুগ্ধতা।ভিতরে ভিতরে সে দূর্বল হয়ে পড়ে।সেসব আচারনই কি তবে বুঝে নিয়েছে তার বুদ্ধিমান চতুর বন্ধুটি!
★
কুয়াশাচ্ছন্ন সুন্দর একটা সকাল।হেমন্তঋতু গিয়ে শীতের ঘনঘটায় প্রকৃতি আচ্ছন্ন হয়েছে গোটা কয়েকদিন হলো।সামনে কৌড়ির পরিক্ষা।অথচ বিয়ের হইহট্টগোলের আমেজে পড়াশোনা হচ্ছে না।কৌড়ি মুখে কিছু না বললেও নীহারিকা বেগম বেশ বুঝতে পারলেন তার অসুবিধার।তাই বিয়ের কয়েকদিন মান্যতার রুমে থাকতে বলেছেন তিনি, কৌড়িকে।যেখানে বিশেষভাবে থাকতে দেওয়া হয়েছে নীহারিকা বেগমের আম্মাকে।বয়সের খাতিরে বিভিন্ন ব্যথা-বেদনায় আক্রান্ত মানুষটাকে একটু স্বত্বি শান্তিতে থাকতে দেওয়ার জন্য মান্যতার রুমটা আলাদা করে উনাকে স্পেস দেওয়ার জন্য বাছাই করে থাকতে দেওয়া হয়েছে।আপতত কৌড়িরও একটু পড়াশোনার জন্য স্পেস দরকার।তাই ভেবেচিন্তে সেখানে কৌড়িকেও জায়গা করে দিলেন।বৃদ্ধা মানুষটা তা নিয়ে দ্বিরুক্তি করলেন না।বরং খুশিই হলেন।বিয়ে বাড়িতে রাতের বেলায় রুমটায় অনেক মানুষের থাকার জায়গা হলেও,দিনের বেলায় রুমটায় শুধু কৌড়ি আর বৃদ্ধ মানুষটার আনাগোনা।তবে মান্যতা মৌনতার আশা যাওয়া রুমটাতে অঢেল চলছেই।
সকাল হতেই পুনরায় বিয়ে বাড়ির হৈচৈ শুরু হলো।যে যার দায়িত্ব অনুযায়ী কাজেকর্মে লিপ্ত হলো।গল্পগুজব, রান্নাবান্না,আলাপ আলোচনা,যে যার কর্ম অনুযায়ী লিপ্ত।সকাল হওয়ার পর কৌড়ি এখানো বাহিরে বের হয়নি।গভীর মনোযোগ বইয়ের পাতায় তার।একটু আগে এসে রানীসাহেবা তাকে আর নানুমাকে চা নাস্তা দিয়ে গেছে।আপতত ওই খাবারেই চলে যাবে তার দুপুর অব্দি।তবে বড়মা কি তা হতে দেবে?তবুও বাহিরে হৈচৈ নিজেকে সামিল করার নিয়ত তার নেই।রুমের বাহিরেই কেনো জানি যেতে ইচ্ছে করছেনা।এতো মানুষের ভিড়ে নিজেকেই কেমন পরপর মনেহচ্ছে।অদ্ভুত সব চিন্তাভাবনা।তবুও সেই চিন্তাভাবনা থেকে কিছুতেই নিজেকে সহজ করতে পারছেনা।বিধায় গভীর মনোযোগটা পড়াশোনায় দিয়েছে।এমনিতেই এতো অচেনা মানুষের মধ্যে নিজেকে কেমন মনেহচ্ছে, তার উপর পড়াশোনায় ভিষন চাপ।অথচ সেই চাপ অনুযায়ী পড়তেও পারছে-না সে।আপতত পড়ায় মনোবেশিত করেছে।নানুমাও তাকে ডিসটার্ব করছেন-না।চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বেলকনিতে গিয়ে বসেছেন।সকালের মিষ্টি মিষ্টি রোদ্দুর এসে পড়েছে সেখানে।সেই সোনালী রোদ্দুরে তিনি গা ভাসাচ্ছেন আর চা খাচ্ছেন।পড়ার একফাঁকে নজর যেতেই কৌড়িরও ইচ্ছে হলো উনাকে সঙ্গ দেওয়ার।দ্বিধাদন্ড ছাড়াই চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সে-ও উঠে উনার কাছে চলে গেলো।বৃদ্ধা মানুষটার সাথে দিলখোলা সম্পর্ক তৈরী নাহলেও একটুআধটু মিশুকে সম্পর্ক তৈরী হয়েছে।একদম বড়মায়ের কপি মনে হয়েছে।বৃদ্ধ মানুষটার মুচকি হেসে মিষ্টি মিষ্টি কথা মনে ধরেছে কৌড়ির।প্রায় দু-মাসের অধিক সময় বাদে মনে হয়েছে,দাদিআপার সঙ্গ পেয়েছে সে।কৌড়িকে বেলকনিতে দেখতেই বৃদ্ধা মৃদু হেসে বললেন।
‘পড়াশোনা ছেড়ে এসেছিস তবে?
বিনিময়ে কৌড়ি মৃদু হেসে উনার পাশে গিয়ে দাঁড়লো।বৃদ্ধা আবার শুধালেন।–তোর সাথে তুই করে কথা বলছি।কিছু মনে নিচ্ছিস না-তো?
কৌড়ি চঞ্চল গলায় উত্তর দিলো–একদম না।আপনি আমার সাথে তুই করে বলতেই পারেন।
বিনিময়ে ফের মৃদু হাসলেন বৃদ্ধা।বয়সের ভারে কুঁচকে আসা মুখাবয়বে সেই হাসিটা দারুন মুগ্ধতা ছাড়লো। কৌড়িও সেটা মুগ্ধ নজরে দেখলো।অথচ বৃদ্ধার নজর বেলকেনির গ্রীল ভেদ করে লন এরিয়ায় চেয়ার পেতে গোল টেবিলের মধ্যমনি হয়ে বসা যুবকের পানে অটল।কিছুসময় বাদে সেটা বুঝে,নানুমার নজর লক্ষ্য করে কৌড়িও সেদিকপানে তাকালো।নজর স্থির হয়ে গেলো তারও।জাহিদ আঙ্কেল শাহেদ আঙ্কেল দিয়ে ইভান ভাইয়ার মামারাসহ বেশ কিছু মুরুব্বি মানুষের মধ্যমনি হয়ে বসে আছে, তাকে সবসময় হুমকির মুখে রাখা মানুষটা।হালকা শীতের প্রতাপে গায়ে জড়ানো তার কালোরঙা হুডি।হুডিটা মাথায় জড়ানো নেই।পরিপাটি করে রাখা ঘনোকালো চুলগুলো সোনালী রোদ্দুরে চকচক করছে।শ্যামবর্ণ মুখের আদল আরও উজ্জ্বল উজ্জীবিত দেখাচ্ছে।গায়ের লম্বা হাতার হুডিটার কনুই পর্যন্ত সরিয়ে গুটিয়ে রাখা।ডানহাতে চায়ের কাপ।সময় নিয়ে নিয়ে তাতে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে।সবার মধ্যেমনি হয়ে বসে থাকা মানুষটাকে বেশ আকর্ষণীয় আর হ্যান্ডসাম লাগছে।ওই শ্যামসৌন্দর্য পুরুষ যেকোনো নারীর স্বপ্নের কাম্য পুরুষ।আর ওই মানুষটা তাকে পছন্দ করে!মনে উঠতেই,অদ্ভুত শিহরনে তোলপাড় বয়ে চললো ছোট্টো বুকের ভিতরটায়।মনটা কোনো কারনে সুখ অনুভূত অনুভব হতে গিয়ে-ও নিরাসিত হলো।এ কেমন দোটানায় মধ্যে পড়ে গিয়েছে তার মন মস্তিষ্ক?কোনপথে যাবে সে?এ কেমন জ্বালা!মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে দেখলো নানুমা এখনো নিষ্পলক ওই মানুষটার পানে তাকিয়ে রয়েছে। মনে প্রশ্ন জাগলো কৌড়ির।নাতীকে নানুমা এতো স্নেহময় মুগ্ধ নজরে কি দেখছে?তবে চেয়েও প্রশ্ন করতে পারলোনা।দ্বিধাদ্বন্দ্বের জালে ফেলে দিলো মন।পাশে দাঁড়ানো বয়োবৃদ্ধ মানুষটা সেটা বুঝতে পারলো কি-না জানা নেই কৌড়ির।তবে নিজের মতো করে বলে উঠলো।
‘জানিস নানুমা!ওই ছেলেটার গায়ের রঙ শ্যামকালো হলে কি হবে,আমার নজরে দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ।আমার সকল নাতিনাতনিদের মধ্যে সবচেয়ে স্নেহময় আর নিস্পাপ আদূরে একখানা মুখ।আমার এতিম বাচ্চাটা,আমার নিভান।ছোটো বেলা থেকে কতোকিছু সহ্য করে এসেছে আমার বাচ্চাটা।অথচ কখনো উফ-তাক শব্দ ওর মুখ দিয়ে বের হয়নি।প্রিয় বাবাকে হারালো,মায়ের অবহেলা পেলো।অথচ ছেলেটা চুপচাপ।জানিস,আমি ওর ওই ছোট্টো নিস্পাপ আদূরে মুখখানা দেখতাম আর ওকে জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কাঁদতাম।ভাবতাম,আমার এই এতিম বাচ্চাটার কি হবে।একসময় চিন্তায় চিন্তায় নিজের অসুখ বাঁধিয়ে ফেললাম।আমার ছেলে, ছেলে বউরা সান্ত্বনা দিলো।ওরা থাকতে নিভানকে কখনো কষ্ট পেতে দেবেনা।নিজেদের সন্তানের মতোই মানুষ করবে।ঈশিতা।আমার নাতনী।ও পর্যন্ত কি বলতো জানিস?বলতো,ওমন আদূরে মায়ামায়া একটা মুখ।দাদুমা তুমি কিকরে দুশ্চিন্তা বাড়াও,আমরা ওকে অযত্নে অবহেলায় বড় হতে দেবো!ছেলেটা, সবার প্রিয় জানিস!প্রিয় হয়ে উঠেছে তার স্বভাবে,তার ব্যবহারে।
থামলেন বৃদ্ধা।জেনো জিরিয়ে নিলেন।ফের বলতে শুরু করলেন–নীহিরিকার যখন জাহিদের সাথে দ্বিতীয় বিয়ে হলো।আমি ওকে দিতে চায়নি।আমার এমিত বাচ্চাটা পরের বাড়ি কষ্ট পাবে!আমি চায়নি।আমার ছেলেরাও দিতে চায়নি।তবে জাহিদ সেটা মানেনি।নিজ সন্তানের দাবী করে এবাড়িতে নিয়ে আসলো ওকে।
সত্যি বলতে,ও নিভানকে মেনে নিয়েছিলো সেভাবেই।একদম নিজ সন্তানের মতোন।অথচ আমার এতিম বাচ্চাটাকে এবাড়ির কেউ ভালো চোখে দেখলো-না।তবুও আমার বাচ্চাটা কখনো কাওকে অভিযোগ জানাইনি।ছোট্ট বাচ্চাটা কি বুঝতো জানিনা।তবে কখনো কারও নামে ভালোমন্দ বিচার দেওয়া,দোষারোপ করা এসব গুণ ও কখনো আয়ত্ত করেনি।ওর প্রতি আলাদা একটা মায়ামমতা আমার।অদ্ভুত টান।যা অন্য নাতিনাতনীদের প্রতি অনুভব করিনা আমি।সেই আলাদা টানটা আসে না আমার ওদের প্রতি, যা একমাত্র ওরপ্রতি কাজ করে।এবাড়ি থেকে আমার কাছে বেড়াতে গেলে,আমি যখন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এটাওটা জিজ্ঞেস করতাম ওকে।ওর বাচ্চা কন্ঠে একটাই উত্তর ছিলো, আমি মায়ের কাছে ভালো আছি নানুমা।অথচ ওর আর ওর মায়ের মুখ দেখলেতো আমি বুঝতে পারতাম।ও কতোটা ভালো আছে।মাঝেমধ্যে অনেকদিন করে রেখে দিতাম আমার কাছে। জাহিদ আবার সেটা বেশিদিন দীর্ঘ হতে দিতোনা।নিয়ে আসতো ওকে।সত্যি বলতে জাহিদ কখনো ওকে পরের ছেলের নজরে দেখিনি।তবে ওর বাড়ির লোক কেউ নিভানকে পছন্দ করতোনা।জাহিদের চাপে পড়ে সবাই নিভানকে মেনে নিলেও,মন থেকে কেউ মেনে নেয়নি।এরপর ইভান নানুভাই জন্মালো।আমার যেমন ওর উপরে অদ্ভুত এক স্নেহ মায়া।ওর-ও ইভান নানুভাইয়ের উপরে অদ্ভুত এক স্নেহ মায়া।ইভান নানুভাই জন্মানোর পর আর ওকে আমার কাছে রাখতে পারিনি।ইভানকে ছাড়া ওবাড়িতে যেতোনা ও।আর কোনোসময় গেলেও থাকতোও-না।এরপর সকল প্রতিকূল অনুকূলের মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে বেড়ে উঠলো।যে ইভানের প্রতি ওর আদর,যত্ন ভালোবাসা ছিলো মা আর সন্তানের মতো,সেই ইভানের সাথে ওর দূরত্ব তৈরী হলো,এবাড়ির কিছু মানুষের কুমন্ত্রণায়।যদিও সেটা সামসময়িকতার জন্য ছিলো।তবু-ও দু ভাইয়ের মধ্যে আগের যে অটুট বন্ধনটা ছিলো, সেটা এখন আর দেখা যায়-না।তারপর এবাড়ির মানুষগুলো পরিস্থিতির প্রতিকূলে পড়ে এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়ালো।আপন ভাইরা স্বার্থপরের মতো দূরে সরে গেলো।সেখানে সেই পর হয়ে, ওকেই নিজের সপ্নটা বিসর্জন দিতে হলো।দিলেও।তখন আর আমি চুপ থাকতে পারলাম না।পারলাম না বলতে চাইলাম না চুপ থাকতে।ওকে স্বার্থপরের মতো বারবার বললাম–কেনো নিজের ইচ্ছে, স্বপ্ন বিসর্জন দিবি তুই নানুভাই?ওই মানুষগুলো তোর এই বিসর্জন,ত্যাগটা বুঝবেনা।তোকে বুঝবেনা!
ও সেদিন উত্তর দিয়েছিলো—আমি নিজেকে মহান বোঝানোর জন্য বা কারও জন্য কিছু করছিনা নানুমা।আমি আমার বিবেকবোধ থেকে নিজের স্বপ্নটা ত্যাগ করতে চাইছি।যেখানে যে ব্যাক্তিটা আমাকে নিজ সন্তানের মতো আগলে রাখার চেষ্টা করেছে।বাবার বঞ্চিত আদর ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছে।তাকে এই অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে আমি আমার স্বপ্নের পথে উড়াল দেই কিকরে?এতোটা স্বার্থপর হতে তো শেখাওনি তোমারা,আমাকে।তবে শুধু নিজেরটা ভাবি কিকরে?আর আমার মা।তিনি যেখানে ভালো থাকবেন না সেটা জেনেও সেখানে আমি আমার স্বপ্নের পথে পা বাড়াবো কিকরে?আমার ইচ্ছেগুলোর ডানা মেলে দেই কিকরে? আমার মা ভালো থাকার কাছে,আমার স্বপ্ন যে নিতান্তই নগন্য।
‘স্কলারশিপ পেয়েও ছেলেটা বাহিরে পড়ার স্বপ্নটা ছেড়ে দিল।জাহিদের ধসে পড়া ব্যবসার হাল ধরলো।তারপর একটু একটু করে নিজের ভালো থাকাটাও ছেড়ে দিলো।ভুলে গেলো, ও নিজের ভালো থাকা।নিজে কিসে ভালো থাকবে,কিসে মন্দ থাকবে,সেটা না ভেবে নিজের ভাইবোন,আপনজনদের নিয়ে ভাবনা বাড়লো।ভাবতে থাকলো।আজ ও সফল।তবে নিজের ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা, ভালোলাগা, মন্দলাগা সবটা ত্যাগের বিনময়ে সে সফল।অথচ ওকে দেখ,কি নির্জীব।মনেহয় ও ওর ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা,ভালোলাগা মন্দলাগা নয়,নিজেকেই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে?
কথা বলতে বলতে বৃদ্ধ মানুষটার দূর্বল গলা কেঁপে কেঁপে উঠলো।সেই কম্পনে কৌড়ি অনুভব করতে পারলো,ওই মানুষটার প্রতি এই বৃদ্ধার আলাদা স্নেহ ভালোবাসা।বিমূঢ়, স্তব্দ কৌড়ি।সে ভুলেও আশা করেনি।ওই মানুষটার অতীত এমন হতে পারে।সেজন্য কি সেদিন মানুষটা বলেছিলো,সে এবাড়ির কেউ নয়।ভাবনা কেমন অস্থির এলোমেলো হয়ে উঠলো কৌড়ির।অদ্ভুত কারনে ব্যথার তোলপাড় শুরু হলো বুকের ভিতর।চঞ্চল নজর গিয়ে পড়লো,লন এরিয়ার সেই নির্দিষ্ট স্থানে।নজর গিয়ে থামলো,সেই শ্যামবর্ণ মুখাবয়বে।হঠাৎই নানুনার মতো তারও মনে হলো,পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুদর্শন যুবকটা বুঝি সবার মধ্যমনি হয়ে ওই বসে আছে।আর তার শ্যাম সৌন্দর্যের কাছে যেনো পৃথিবীর অন্যন্য সুদর্শন সুপুরুষেরা সব ফিকে।কৌড়ির এলোমেলো অনুভূতি অনুভবের মধ্যে, পাশে বৃদ্ধা দাড়ানো নারীটা শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।ফের বললেন
–ওর জন্য আমার সবসময়ের প্রার্থনা।ও একটু অভিযোগী হোক,একটু অভমানী হোক।মনের মধ্যে চেপে রাখা বিয়োগ ব্যথার ক্লেশগুলো সেই অভিমানে অভিযোগে মুক্ত হয়ে যাক।তারপর নিজের ইচ্ছেমতো ভালো থাকুক।পৃথিবীর সবসুখ প্রভু তার রহমতের হাতদ্বারা ওর উপর ঢেলে দিক।ও এমন একজন জীবনসঙ্গিনী পাক।সে যেনো ওর সমস্ত অপূর্ণতা, পূর্নতায় ছেয়ে দেয়।ওর সকল অপূর্ণতার পুর্নাঙ্গীনি হয়।
চলবে….
#ফুলকৌড়ি
(৩১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
আজ তন্ময়ীর মেহেন্দি অনুষ্ঠান।ইভানদের বাড়ি থেকে যখন অনুষ্ঠানের সকল আয়োজন নিয়ে ওবাড়ির পথে রওনা হবে সবাই।তখনই ইভানকে ফোন করে জানিয়ে দিলো,সে মেহেন্দি অনুষ্ঠান করতে চায়না।এমনকি হাতে মেহেদি লাগাতেও সে ইচ্ছুক-নয়।ইভান অসন্তুষ্ট হলো!মেয়েটাকে এতোকরে বোঝালো অথচ মেয়েটা তাকে বোঝার চেষ্টাই করলোনা। বুঝলোই না তাকে!দগ্ধ হলো মন।কি করবে হঠাৎ বুঝে উঠলো না।মেয়েটাকে ছেড়ে দেওয়া তাঁরপক্ষে কখনো সম্ভব নয়।আর এখন এই পরিস্থিতিতে এসে মেয়েটাকে মাঝ দরিয়ায় দাঁড় করিয়ে তো আরও কখনো নয়!দু-জনের মধ্যে তর্কবিতর্ক হলো।ইভান পুনরায় তন্ময়ীকে বোঝানোর চেষ্টা করলো।
তবুও কাজ হলোনা।তন্ময়ীর একটাই কথা,মেহেন্দি অনুষ্ঠানে জন্য কেউ যেনো ওবাড়ি থেকে তাকে মেহেদী পরাতে এবাড়িতে না আসে।অসহায়বোধ করলো ইভান।কি করবে সে এখন?কিভাবে তন্ময়ীর এসব জেদালোপূর্ন অযৌক্তিক কথাটা বাড়িতে জানাবে?কথা শেষ করে কল কেটে দিয়েছে তন্ময়ী।হাতে থাকা ফোনটার দিকে দূর্বল নজরে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঘনোঘনো।ক্লান্ত শরীরের ন্যায় বসে পড়লো নিজের বেডে।মাথার চুলগুলো দু’হাতে খামচে ধরে বেশ কিছুসময় ভাবলো।সামনের চলা দিনগুলোতে কি আছে ভাগ্যে,এটা তার জানা নেই।তবুও তন্ময়ীকে কোনোমূল্যে ছাড়তে চাওয়া বা ছাড়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।জোরেশোরে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।গমন পথ বাড়িয়ে দিলো মায়ের কাছে যাওয়ার পানে।
নীহারিকা বেগম তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত হাতে কর্মে লিপ্ত।মায়ের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো ইভান।ভরাট গলায় ডেকে উঠলো
‘আম্মু।
কন্ঠ যেনো কেমন শোনালো।উদ্বিগ্ন হয়ে কপাল কুঁচকে ফেললেন নীহারিকা বেগম। তড়িৎ কাজের হাত থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘কি হয়েছে?কিছু বলবি?
ভিতরে ভিতরে ইভান ইতস্ততবোধ করলো।তবুও বলতে তো হবেই।তাই মনের দ্বিধা কাটিয়ে বললো–এবাড়ি থেকে মেহেন্দির ডালা নিয়ে, ওবাড়িতে না পাঠালে হয় না?
‘এ কেমন কথা ইভান!যদিও এই আচার অনুষ্ঠান কড়াকড়ি নয় তবুও মেহেন্দি অনুষ্ঠানটা বিয়েতে মানা হয়।আর যেখানে সবাই যখন মনস্থির করেছে ওবাড়িতে যাবার জন্য সেখানে হঠাৎ না মানাটা কেমন দেখায়?আর ওরাও অপেক্ষা করছে,সেখানে না যাওয়াটা কতোটা যৌক্তিক!সবকাজে ছেলেমানুষী করলে হয়-না ইভান।আর মেহেন্দির ডালা নিয়ে ওরা যাবে,তোর সমস্যা হচ্ছে কোথায়?
সমস্যা আমার নয় সমস্যা তোমার ছোটো বউয়ের। কথাটা মনেমনে কঠিন গলায় আওড়ালেও, তন্ময়ীকে দোষী করতে চাইলো না।তাই ইনিয়েবিনিয়ে বললো—আমার সমস্যা নেই।তন্ময়ীর কথা ভেবে বলছিলাম, মেয়েটার মানসিক অবস্থা আগের ন্যায় নেই।ও বলছিলো,এতো উহ্য করে মেহেন্দি অনুষ্ঠান করার দরকার নেই।বিয়ে যখন হচ্ছে মেহেদী এমনিতেই পরে নেবে।
মন মিথ্যা বলতে চাইলোনা।তবে বাধ্য হয়ে বলতে হলো তাকে।কিছুটা অবাক হয়ে নীহারিকা বেগম বললেন-
—তন্ময়ী নিজেই চাইছেনা মেহেন্দির অনুষ্ঠান করতে?
মুখে কিছু না বলে এবার মাথা উপর নিচ মৃদু ঝাঁকিয়ে ইভান জানালো।সেটা দেখে সহসা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন নীহারিকা বেগম।মেয়েটার বিয়ে ভেঙে গিয়ে আবার নতুন করে অন্যত্র বিয়ে হচ্ছে। মানসিকভাবে হয়তো প্রস্তুত নয়।একজনকে নিয়ে এক রকম ভেবে রেখেছিলো।এখন আবার হঠাৎ আরেকজনকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে ।তাই হয়তো এসব আচারনিষ্ঠা বিশেষভাবে ভালো লাগছে-না।নীহারিকা বেগম,উনার মতো বুঝে আপতত সবাইকে তন্ময়ীদের বাড়িতে যাওয়া থেকে আটকে রাখলেন।তিনি কথা বলবেন তন্ময়ীর সাথে।যেভাবেই হোক বিয়ে যখন হচ্ছে আচার অনুষ্ঠানতো করতে হবে।এসবে বাড়ির সম্মানও জড়িয়ে আছে।বুঝিয়ে শুনিয়ে ব্যবস্থা তো একটা করতেই হবে।না-হলে এবাড়ির সম্মানের ব্যাপার তো পরে,মেয়েটাকেই কটুবাক্য শুনতে হবে।নিন্দিত হতে হবে।তিনি হাতের কাজ ফেলে ছুটলেন নিভানের কাছে।যদি মেহেন্দি অনুষ্ঠান হয় তবে ছেলেটা ঠিক তন্ময়ীর দিকটা সামলে নিতে পারবে।যেখানে ওবাড়ির সাথে আগে থেকে নিভানের একটা দারুণ সম্পর্ক আছে।আর যদি মেহেন্দি অনুষ্ঠানটা না-হয় তবুও ছেলেটা,সমাজের নাকউঁচু মানুষের উল্টো পাল্টা বলা বা ভাবা থেকে দমিয়ে রাখতে পারবে।এ-বাড়ির ও-বাড়ির দু-য়োবাড়ির সম্মান,নিজের যোগ্যতা বলে অটুট রাখতে পারবে।
★
নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছে তন্ময়ী।ঘোলাটে নজরজােড়া তার ফোনের পানে নিশ্চল।ইভান কতশত বার ফোন দিয়েছে অথচ সে ধরেনি।নিজেকে কেমন অনুভূতিহীন জড়বস্তু মনেহচ্ছে।একটু আগে কতোকরে ভাইয়া তাকে বুঝিয়ে গেলো,অথচ মন কিছুতেই গলতে চাইছেনা।এইযে মা,হলুদের অনুষ্ঠানের পর এখনো তার সাথে সেভাবে কথা বলেনি।দায়ী কে?ইভানের সবকিছু মাফ করা গেলেও,মায়ের সাথে তার যে অস্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছে।এটার জন্য ইভানকে ক্ষমা করবেনা সে।কিছু সময় মনেহচ্ছে বিয়েটা ভেঙে দিতে।আবার মন বলছে,এবার বিয়ে ভেঙে গেলে মা আর ভাইয়ের সম্মান তো নষ্ট হবেই।সাথে মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়!
কিন্তু মায়ের এই ব্যবহার তাকে কষ্ট দিচ্ছে। আর সেই কষ্ট ইভানের প্রতি রাগ জেদ অভিমান আরও বাড়াচ্ছে।
অথচ বিপরীত লিঙ্গ বলতে,ইভানের প্রতিই তো তার প্রথম অনুভূতি জন্মেছিলো।তবে বাবাহীন,মায়ের একার এই শ্রমের সংসারে গা ভাসিয়ে চলতে চায়নি সে।তেমন মন মানসিকতা নিয়ে-ও বেড়ে উঠেনি।মা এবং ভাইয়ের আদর্শমতো চলার চেষ্টা করেছে।সেখানে ইভানের রাখা প্রস্তাব, তার করা পাগলামির প্রতি অনূভুতি জন্মালেও তা প্রকাশ করেনি তন্ময়ী।বরাবর অনুভূতি চেপে রেখে নিজেকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে সে।সেই দমিয়ে রাখা মৌন সম্মতিও যেনো ইভানের প্রতি অগাধ আগ্রহী আর দূর্বল ছিলো।থাকবেনা কেনো,ছেলেটা তাকে বুঝে কি নিখুঁতভাবে তার মনের মতো করে প্রস্তাব রেখেছিলো।যা কখনো সে কোনো পুরুষ মানুষের কাছে আশা রাখেনি।প্রেমের সম্পর্কে না জড়িয়ে সময় মতো তাকে চেয়ে নেওয়া।ইভানের এহেন প্রস্তাবে মনেমনে বিগলিত হয়েছিলো তন্ময়ী।তবে হ্যা সূচক সম্মতি না দিলেও,নাকচ সে করেনি।দেখা না হলেও,ফোনালাপে তার সকল ইতরামি কথাগুলো সহ্য করে তাকে আশকারা দেওয়ার হকতো সেই তৈরী করে দিয়েছিলো।একদিন দু’দিন তিনদিন করে যখন সময় পার হয়ে সপ্তাহে গিয়ে ঠিকতো,তখন একটা মানুষের কলের অপেক্ষা তো সে করতো!সম্পর্কের নাম ছিলোনা।অথচ সেই সম্পর্কে মায়া,টান ছিলো অদ্ভুত।সেই মায়া টান নিস্ক্রিয় হয়ে পড়লো,ইভানের একটা কার্যে।অথচ ইভান,সেই কার্যে নিজের পক্ষে কি নিপুনভাবে সাফাই গেয়েছে।সেই সাফাই সত্য কি মিথ্যা জানা নেই তার।তবে ইভানের হয়ে নিভান ভাইয়া কখনো মিথ্যা বলতে পারে!এটাও সে বিশ্বাস করেনা।নিজের ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ,ভরসা করে নিভানকে তন্ময়ী।অথচ ইভানের হয়ে সেই সবার কথা ভেবেচিন্তেও নিজের মনকে মানাতে পারছে-না তন্ময়ী!
না নিজের মায়া টান থেকে ইভানকে ক্ষমা করতে পারছে!না ইভানের সাফাই তার মনকে গলাতে পারছে।আর না নিভানের যৌক্তিক কথায় নিজের মনকে ইভানের প্রতি মানাতে পারছে!কি এক যন্ত্রণায় আছে।উফফ!তবে এই পরিস্থিতির জন্য নিজেকেও কম দ্বায়ী করছেনা তন্ময়ী!ইভানের এ-কথাতো সত্য। ইভানকে নিজের জীবনে প্রশ্রয় দেওয়ার হক যখন নীরবে দিয়েছিলো।তখন নিজের চোখে দেখা দৃশ্যাবলী নিয়ে একবার তো তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেতো!ভালো হতো বা মন্দ তবে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন তো তাকে হতে হতোনা।ইতুরে ইভানকে তো সে আগে থেকেই চিনতো জানতো।বিয়ে ভাঙার মতো কান্ড,ছেলেটার দ্বারা অসম্ভব কিছু নয়।তবুও কেনো এরকম ভুলটা করলো!এখন কোনদিকে যাবে?
‘তুমি ওবাড়ি থেকে মেহেন্দি দিতে আসতে নিষেধ করেছো কেনো?
চমকে মায়ের মুখের দিকে তাকালো তন্ময়ী।এখনো গম্ভীর সেই ফর্সা গোলগাল মুখখানা।মায়ের প্রশ্ন এড়িয়ে ধরা গলায় বললো।–বিশ্বাস করোো আম্মু, উনারা যে অভিযোগ জানিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছেন।আমি তেমন কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে নেই।
‘আমি জানি।
‘তবুও তুমি আমার সাথে কথা বলছোনা?অভিমান করে আছো?তুমি ছাড়া কে আছে আমাদের?তুমি ওরকম আচারন করলে,আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসে।মনে হয়, আমার বলে এই পৃথিবীতে কিচ্ছু নেই।
দুচোখ বেয়ে নোনাঅশ্রু গড়ালো তন্ময়ীর।দ্রুতপানে পা বাড়িয়ে মেয়ের কাছে গেলেন।মা’কে সামনে পেতেই জড়িয়ে ধরলো তন্ময়ী।ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।পিঠে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিলেন তাহমিনা বেগম।মুখে কিচ্ছুটি বলেননা,শুধু দীর্ঘশ্বাস আওড়ালেন।তন্ময়ীর বিয়ে ভাঙার পর ক্ষনিকের জন্য উনারও মনে হয়েছিলো,কিছু না ঘটলে এরকম কথা পাত্রপক্ষরা পেল কোথায়?নিজ মনে সেসব কথা ভেবে তন্ময়ীর উপরে অভিমান জন্মে ছিলো উনার।সেই অভিমান গলেছে কাল রাত্রে নিভানের সাথে কথা বলার পর।কালরাতে ছেলেটা দেখা করতে এসেছিলো উনার সাথে।ভালোমন্দ কথার পর,ভণিতা ছাড়াই ইভানের করা ভুলের দোষ স্বীকার করেছে সে।সাথে মিনতি-ও করেছে,বিয়েটা না ভাঙার।ছেলেটা নাকি তন্ময়ীকে ভিষন পছন্দ করে।যেখানে তন্ময়ীর কোনো সম্মতি বা হাত ছিলোনা।আর যখন শুনলো,তন্ময়ীর বিয়ে।সেই বিয়ে ঠেকাতে কিভাবে কি করবে বিবেচনা না করে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে।এসব শুনে তাহমিনা বেগমও চড়াও হয়েছিলেন।এমনকি ইভানের সাথে মেয়েকে বিয়ে দেবেননা,এটাও জানিয়ে ছিলেন।তবে নিভানের অমায়িক যুক্তিতর্ক আর নরম ব্যবহারের কাছে নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছেন।আর দ্বিতীয়বার মেয়ের বিয়ে ভাঙার খবর পাড়াপ্রতিবেশি বা আত্মীয় স্বজন জানলে, মেয়েটার বাঁচা মুশকিল হয়ে যাবে।সব বিবেচনা করে তিনিও আর কথা বাড়ালেন না।তবে নিভান যাওয়ার আগে ভাইয়ের পক্ষ থেকে বারবার ক্ষমা চেয়ে গিয়েছে।যদিও মেয়ের সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা করার জন্য, ইভানের প্রতি তিনি মনোক্ষুণ্ণ হয়ে রয়েছেন তবে তা আর চেয়েও প্রকাশ করতে চাইলেন না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন।
‘মা হও তারপর বুঝবে মায়েদের কতো জ্বালা।আর যদি হয় মেয়ে সন্তান তখন যেনো,চিন্তা-ভাবনা,বিবেচনাবোধ বিবেকবোধর জ্বালা শতগুণ!যাই হোক,সত্যি বলতে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে মা তোমাকে অবিশ্বাস করেছিলো। তোমার প্রতি মনোক্ষুণ্ণও হয়েছিলো।মা’কে ক্ষমা করে দিও।
‘এসব কি বলছো আম্মু!আমার জন্য তোমাকে অসম্মানিত হতে হয়েছে,আমিই স্যরি।খুব খুব স্যরি আম্মু।
তাহমিনা বেগম এবার শব্দকরেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
প্রসঙ্গ এড়িয়ে মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বললেন–মেহেন্দির অনুষ্ঠান হবে।ওবাড়ি থেকে মেহমান আসার আগে রেডি হয়ে নাও।আর তোমার বান্ধবীরাও তোমার অপেক্ষা করছে,ওরা তোমার জন্য রেডি হয়নি।চুপচাপ ড্রয়িংরুমে বসে আছে।আমি ওদেরকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেবে।
তন্ময়ী মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।তাতেই তাহমিনা বেগমের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।মেয়েকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।তন্ময়ীর কপালে চুমু দিয়ে ফের রেডি হয়ে নিতে বলে চলে গেলেন।মা যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তন্ময়ী।মনে প্রশ্ন জাগলো বিভিন্ন। তার বিরুদ্ধে মায়ের এই মান ভাঙলো কিকরে মন জানতে চাইলো।তবে আপতত জানার যখন উপায় নেই।মা’কে প্রশ্ন করার সাহসও করতে পারলোনা।তখন আর মনে প্রশ্ন রেখে লাভ আছে!তবে যে এই সাধনটা করেছে,তাকে মন থেকে ধন্যবাদ।
★
তন্ময়ী বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চায়না,এটা নিভান ছাড়া দ্বিতীয় কান হতে দিতে চাইলেন না নীহারিকা বেগম।
বাড়ির একটা পিঁপড়া পক্ষীকেও জানতে দিলেনও না।
তবুও কথাটা কিভাবে কি করে যেনো ইভানের ফুপু ডালিয়া বেগমের কান অব্দি পৌঁছে গেলো।আর তিনিও যেনো এমন একটা মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় মূখিয়ে ছিলেন,নিজের পেটের কথাগুলো উগরে দেওয়ার জন্য। যা তিনি নিজের বড়োভাইয়ের জন্য পারছিলেন না।এখন যখন সুযোগ পেয়েছেন তবে কথার খেই কেনো ছাড়বেন?ছাড়বেন না তিনি।এমনিতেই ইভান ওরকম একটা মেয়কে বিয়ে করতে চাইছে, এটা যেনো তিনি সেদিন থেকেই মানতে পারছিলেননা।তবে বাধ্য হয়ে চুপ থাকতে হয়েছে উনাকে।এবার কথার খেই যখন পেয়েছেন চুপ থাকার প্রশ্নই উঠেনা।কন্ঠে উপহাস মিশিয়ে,ড্রয়িংরুমের ভরা মজলিসে বেশ কটাক্ষ করে তিনি নিজের মা’কে অর্থাৎ ইভানের দাদুমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
‘এমনিতেই মেয়েটার গায়ে রঙ ময়লা,চাপা!তারউপরে বংশের কোনো বিশেষ নামগন্ধ নেই।তাতে আবার,মেয়েটার বিশেষ ছেলেবন্ধু আছে বলে নাকি বিয়ে ভেঙেছে।সেই মেয়েকে কোন হিসাবে ইভান বিয়ে করতে চাইলো আমার বুঁজে আসছে না।তোমারা-ও আবার তাতে ইন্ধন জুগিয়ে,বিয়েতে মতামত দিলে।ছেলেটার না-হয় মহান হওয়ার সাধ জেগেছে তাই বলে তোমারাও কিকরে, ছেলেটার ভবিষ্যতের দিকে না তাকিয়ে ওর সম্মতিতে সহমত পোষণ করলে?ওর নাহয় বুদ্ধুিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে,তোমরা কিকরে বুদ্ধিতে খাটো হলে!নাও,এখন রঙঢঙ সহ্য করো। জাত-বংশ না দেখে, ঘরে বউ আনতে চাইলে যা হয়!যত্তসব রংঢং!
হঠাৎ এতো আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কথাগুলো এমন কটাক্ষের স্বরে বলায় ইভানের দাদুমা কিছুটা থতমত খেলেন।বিব্রতবোধ-ও করলেন।মধ্যবয়স্ক মেয়ে উনার।উপযুক্ত এক মেয়ের মা অথচ কোন কথা কোথায় কিভাবে বলতে হয়,মেয়েটা যেনো উনার শেখেইনি।শেখেনি বলতে ভুল,সারাজীবনতো নিজের মতো করে বুঝিয়ে শিখিয়েই তো এসেছেন।তবে মেয়েটা নিজগুণে আয়ত্ত করলে তো!নিজের একমাত্র মেয়ে বলে ছোটো করে কথাও বলতে পারেন না বলে।তাই বলে নিজের বাড়ির সন্মান নিয়ে ছোটো করে কথা বলা।তিনি মানতে চাইলেন না।কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললেন।
‘তুমি এভাবে কথা বলতে পারোনা ডালিয়া।মেয়েটা দেখতে শুনতে,যথেষ্ঠ মার্জিত।নাহলে নিভান বা তোমার বড়োভাই কখনো এ-বিয়েতে সম্মতি প্রকাশ করতো না।আর মেয়েটাকে আমারও বিশেষভাবে পছন্দ।সেখানে ইভান দাদুভাই কোনো ভুল করেছে বলে আমার মনে হয়না।
রাগ লাগলো ডালিয়া বেগমের।মা-ও ওই মেয়েটার হয়ে কথা বলছেন।তাও আবার এতোগুলা মানুষের সামনে,ওই সামন্য মেয়েটার জন্য উনাকে ছোটো করে কথা বলছেন!তিনি পুনরায় কটাক্ষের স্বরে বললেন।
‘এবাড়ির বউ হিসাবে কোনদিক থেকে উপযুক্ত বলে মনে হলো ওই মেয়েটাকে তোমার?যেমন গায়ের রঙ,ইভানের পাশে মানায় মেয়েটাকে?ওর থেকে বাড়িতে যে মেয়েটার পিছনে ঘুরঘুর করতো সেটাই তো ভালো ছিলো।অন্তত দেখতে তো শ্রী।জাতপাতেও চলার মতো।
ভদ্রমহিলা আবারও মেয়ের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য মুখ খুলতে যাবেন।তার আগেই রাগান্বিত গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বরের বার্তা এলো–সংসার করবো আমি।
মেয়েটা বউ হবে আমার।তার গায়ের রঙ ময়লা হোক বা কয়লা,তা নিয়ে আপনার এতো মাথাব্যথা বা চিন্তা কিসের ফুপিমণি?সংসার তো আপনি করবেন না আর না তাকে এবাড়িতে এনে আপনার কাঁধের উপর ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে!তবে এতো সমস্যা কিসের আপনার?আপনি এবাড়ির আউটসাইডার, আপনি তাকে পছন্দ করে চাইলে ভালোবাসতে পারেন,না চাইলে নয়।তাই বলে আমার বউয়ের যোগ্যতা অযোগ্যতা মাপার বিচারক আপনি কে?আপনাকে তো মানা হয়নি বিচারক!না আপনার সিদ্ধান্ত জানা হয়েছে।তবে তাকে নিয়ে ছোটো বড়ো কথার দুঃসাহস দেখান কিকরে আপনি?
‘উনি তোমার ফুপুমনি হয় ইভান।উনার সম্মান বজায় রেখে কথা বলার চেষ্টা করো।
দাদুমার থমথমে গলার আজ্ঞা পেতেই ঠোঁটের কোণে হাসি এনে দাঁড় করালো ইভান।সে হাসিতে ফুটে উঠলো তাচ্ছিল্যতা।কিছুটা দ্বায়ী হলেও আজ দাদুমায়ের জন্য ফুপুমনির এই অধঃপতন।তবে সে বিষয়ে ভাবনা না এগিয়ে গম্ভীর গলায় বললো —উনি বড়ো হয়ে নিজের ব্যবহার আর যবান দ্বারা আগে নিজের সম্মান আর শ্রদ্ধার স্থানটা ধরে রাখার চেষ্টা করুক।আমি অবশ্যই উনার সাথে সম্মান শ্রদ্ধার সহিত কথা বলবো।
অপমানে থমথমে হয়ে থাকা ডালিয়া বেগম আবারও মুখ খুললেন।বললেন-আমি তোমার ভালোর কথা ভেবে কথাগুলো বলছিলাম আর তুমি আমাকে এমন কথা শোনালে?আমি এবাড়ির বহিরাগত!
‘ভালোর জন্য।আমার ভালো আপনাকে ভাবতে হবেনা।কে বলেছে আমার ভালো জন্য আপনাকে ভাবতে?আমার ভালো ভাবতে গিয়ে পিছনে কি কি করে এসেছেন,জানা নেই আমার।নাকি মনে নেই আপনার?সেসব বলে নিজের অপরাধকেও ছোটো করে দেখতে চাই না আমি।তবে আমার ভালো আর আপনাকে না ভাবলেও চলবে।এবাড়িতে আমার ভালো ভাবার জন্য অনেক মানুষ আছে।আপতত তারাই যথেষ্ট।আর আপনার ভালো ভাবার,সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো আপনার মেয়ে।তাই নিজের মেয়ের জন্য যে ভালোটা করে রেখেছেন,আমার ভালোটাও সেখানেই ব্যয় করুন।হয়তো তার এলোমেলো জীবনটা পুরোপুরি নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে যেতে পারে।
‘ইভান।
ডালিয়া বেগমের চড়াও গলার ডাকে ইভান হাসলো।ফের বললো —ভুল কিছু বললাম নাকি আমি?ভুল বলে থাকলে,আদরের ভাইপো হিসাবে ক্ষমা করে দেবেন।তবে আমি ইভান।নিভানের মতো অত ধৈর্য্য, সহ্যশক্তি আমার নেই।যে যা বলছে,যা করছে আপনজন মনে করে চুপচাপ শুনবো।আর না আমি জাহিদ হাসান,শাহেদ হাসান।যে তাদের আদরের ছোটোবোন, নিজের স্ত্রীকে লোকসমাগমে নিচু করে কটুবাক্য শোনাচ্ছে,তা নীরবে হজম কর নেবো।
ড্রয়িংরুমে মানুষ বলতে ইভানের মামিরাই ছিলো।ডালিয়া বেগমের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে উনারা অবগত তাই আর বিশেষ কথা কেউ বাড়ালেন না।চুপচাপ দুপক্ষের ছুড়াছুঁড়ি কথা শুনে গেলেন।একপর্যায়ে যখন ডালিয়া বেগম নীরব হয়ে গেলেন,উনারা ইভানকে থামার জন্য বললেন।ডালিয়া বেগমের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে থামলো ইভান।সে চায়নি এতো মানুষের সামনে ফুপিমণিকে ছোটো বড় এতো কথা শোনাতে।তবে কথা না বলার উপায় কি রেখেছেন ফুপুমনি?আর তন্ময়ীকে ওভাবে বলায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি সে।মেয়েটার ওই মায়াবী গায়ের রঙ তাকে যে বিশেষ আকর্ষণ করে।আর সেই গায়ের রঙ নিয়ে কটাক্ষ করে কথা।মোটেই ভালো লাগিনি ইভানের।এরমধ্যে নীহারিকা বেগম এসে তাড়া দিলেন,মেহেদীর ডালা নিয়ে ওবাড়িতে যাওয়ার।কথাটা শুনতেই স্বস্তির শ্বাস ফেললো ইভান।মেয়েটা জেদ ছেড়েছে তবে!যাক তবেই শান্তি।বিয়ে বাড়ির পরিস্থিতি ফের মুখরিত হলো।চাপা পড়ে গেলো ডালিয়া বেগমের থমথমে মুখ।
★
গোধুলি বিকাল।সন্ধ্যা নাম নাম ভাব।বাড়িতে এখন লোক সমাগম কম।মেহেন্দি অনুষ্ঠানে গিয়েছে সবাই।নিভানের যাওয়ার কথা থাকলেও নিভান যেতে পারিনি।
নানু-মায়ের ঘরে ঢুকলো নিভান।ঘরটা ফাঁকা।নানুমা ঘরে নেই?তাহলে কোথায়?নিচে কোথাও তো দেখলো-না।পিছে মুড়ে বের হতে গিয়েই অনুভব করলো বেলকনির দরজায় কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।নানুমা বেলকনিতে ছিলো!শব্দ পেয়ে পিছে মুড়ে তাকাতেই দেখলো কেউ নেই।মানেটা কি!সে স্পষ্ট কারও নরম পায়ের শব্দ শুনলো।মান্যতারা তো বাড়িতে কেউ নেই তবে ওখানে কে?আর নানুমা তার সাথে নিশ্চয় লুকোচুরি খেলবেনা।ধূর্ত মস্তিস্কে কিছু একটা ভাবতেই কৌতুহল বশত বেলকনির দিকে এগোলো।বেলকনির দরজায় গিয়ে, বেলকনিতে কৌড়িকে দেখেই কপাল কুঁচকে গেলো তার।তবে আন্দাজ ঠিক ছিলো।কিছুটা কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করলো।
‘তুমি এখানে।মান্যতাদের সাথে যাওনি?
রক্ষা হলো-না।নানুমা মনে করে সে দেখতে গিয়েছিলো রুমে কে এসেছে।মানুষটাকে দেখেই নিঃশব্দে পা চালিয়ে ফের চলে এসেছে তবুও বুঝে ফেলেছে মানুষটা।উফফ। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।কথার উত্তর দিতে চাইলো।কারন,সকালে নানুমায়ের কথাগুলো শুনে আর মানুষটাকে নিখুঁত নজরে দেখে মনে কিছু-মিছু একটা অনুভূতির জন্ম নিয়েছে।সেই অনুভূতি আজ সারাদিন তাঁকে জ্বালিয়ে মেরেছে। এখন কথা বাড়িয়ে সেই অনুভূতিকে আর প্রশ্রয় দিতে চায়না।হোক একটু বেয়াদব!তবুও ওই গম্ভীর স্বরের মানুষটার কথার উত্তর সে দিতে চায়না।সামনে মানুষটা কি বুঝলো কি বুঝলো না।ওয়ালে কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়ালো।ফের দুষ্ট হেসে বললো।
‘গ্লাস আঁটকে দেই?কি বলো?
বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে। উত্তর না দিলে ছাড়া পাবেনা সেটা বেশ আন্দাজ করতে পারলো কৌড়ি।স্বভাবজাত
নমনীয় অথচ অসন্তুষ্ট গলায় বললো–আমার ভালো লাগছিলো না।তাই যায়নি।
কৌড়ির অসন্তুষ্ট গলার স্বরে মৃদু হাসলো নিভান।বললো—মান্য আর মৌনতা তোমাকে না নিয়ে যেতে চাইলো?
‘আপু অনেক জোরাজোরি করেছিলো।এমনকি রাগ করেছে।আমিই যায়নি?
কৌতুহলী গলা নিভানের–‘কেনো?
‘এমনিতেই।
এমনিতেই যায়নি এমনটা নয়।পিরিয়ড চলছে তার।আর পিরিয়ডে পেটব্যথা সহ বিভিন্ন সমস্যা চলে তার।তার উপর আরও একটা সমস্যা আছে।আর সেসব সমস্যা জনিত কারনে কোথাও গিয়ে মনোশান্তিতে থাকতে পারেনা সে।বিধায় মান্যতাকে বুঝিয়ে না করে দিয়েছে।না-হলে মান্যতা আপু বাদ অমায়িক ব্যবহারের ঈশিতা আপুর কথা সে ফেলতে পারতোনা।কৌড়ির কথা শুনে সংগোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিভান।মেয়েটার মলিন মুখ বলছে অন্য কথা।গোধূলি লগ্নের মিষ্টি আলো এসে পড়েছে মেয়েটার মসৃন মুখে।সেই আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা কোনো কারনে অসুস্থ।চোখমুখ শুখিয়ে আছে।তবে অসুস্থতার কথা বলতে পারছেনা কাওকে।বা ইচ্ছাকৃত কাওকে বলছেনা।দীর্ঘশ্বাস চেপে নিভান ফের শান্ত গলায় শুধালো।
‘কোনো কারনে শরীর খারাপ তোমার?
চমকে নিভানের মুখের পানে তাকালো কৌড়ি।সুগভীর শান্ত নজরের নিভানকে তারদিকে নিটোল নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখেই মূহুর্তেই মুখটা আবার ফিরিয়ে নিলো।মানুষটা বুঝলো কি করে সে অসুস্থ?তবে কি বুঝে গিয়েছে তার কি কারনে শরীর খারাপ? উফফ! ভিতরে ভিতরে অস্বস্তিতে গাঁট হলো মনস্তাত্ত্বিক।লজ্জায় হাসফাস করে উঠলো সর্বাঙ্গ।তড়িৎ বললো—আমার তো শরীর খারাপ নয়।
নীরব, অথচ গভীর নজর।কৌড়ির মুখের পানে স্থির রেখে বললো –তবে চোখমুখ ওরকম দেখাচ্ছে কেনো?
মনেমনে বিচলিত হলো কৌড়ি।কেমন দেখাচ্ছে?খুব বাজে?উফফ! কি এক জ্বালা!এতো খেয়াল করতে বলেছে কে মানুষটাকে!উত্তর দিতে চাইলো না।তবুও বাধ্য হয়ে উত্তর দিতে হলো।বেকায়দায় আছে সে।এই মানুষে ভরা বিয়ে বাড়িতে যদি মানুষটাকে আর তাকে আঁটকে থাকা বেলকনিতে কেউ দেখে ফেলে তবে কি হতে পারে ভাবতে পারছে সে!তাই ফের তড়িৎ গলায় বললো—আর পনেরো দিন পর পরিক্ষা।পড়াশোনার চাপ যাচ্ছে তো এজন্য।
”পনেরো দিন পর পরিক্ষা। এবিষয়ে তো খেয়াল রাখা হয়নি।এখন আর মেয়েটা শুধু এবাড়ির দায়িত্ব নয়।মেয়েটার ভালোমন্দের সুব্যবস্থার দ্বায় তো এখন তাকেই রাখতে হবে।খেয়াল ছিলোনা তবে খেয়াল তো এবার রাখতে হবে।বললো — পড়াশোনা কেমন চলছে?
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
‘পড়াশোনাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?
‘না।
কথা যেনো বাড়াতেই ইচ্ছে করলো।কি অসুস্থতায় মেয়েটার এই মলিন মুখ।সেটাও জানতে ইচ্ছে করলো।তবে মেয়েটার আড়ষ্টতায় পথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে দমিয়ে নিলো নিভান।শ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাড়ালো সে।চলে যাবে বলে মনস্থির করেও দাঁড়িয়ে রইলো।ফের কি মনে করে কৌড়ির পাশাপাশি গিয়ে গ্রিল ধরে দাঁড়ালো।উঁচু লম্বা মানুষটাকে কাছাকাছি অনুভব হতেই নিঃশ্বাস আঁটকে এলো কৌড়ির।সেটা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো,পাশে দাঁড়ানো মানুষটার গায়ের কড়া পারফিউমের সুগন্ধে।তবে নড়চড় বন্ধ করে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কৌড়ি।শক্ত হাতো চেপে ধরে রইলো গ্রীলের লৌহ। পলকহীন নজর তার বাহিরের পানে।সেই মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে নিভানও নজর ফেললো গোধূলি লগ্নের ধীমে আসা সূর্যের পানে।শান্ত আর খুব সাবলীল গলায় বললো।
,জানো কৌড়ি,ভালোলাগা ভালোবাসাটা ঠিক কি।এর বিশেষ সজ্ঞায়িত আমার জানা ছিলো না।ছিলোনা বলতে,আমার লাইফে আমি ভালোলাগা ভালোবাসার বিভিন্ন বিভিন্ন ডেফিনেশন্স শুনে এসেছি।দেখেছি তেমনটাও।বিভিন্ন বইতে পড়েছিও তেমনটা।তবে নিজে জানার উপলব্ধিটা হয়নি কখনো।অনুভব করিনি কখনো আমি।এই উনত্রিশের কাছাকাছি বয়সে আমার পছন্দনীয়,মোহনীয়,নজর আকর্ষণ করার মতো অনেক কিছুই নজরে পড়েছে।এমনকি বিভিন্ন রূপবতী মেয়েও।নজরে দেখেছে তাদের তবে কখনো তাদের প্রতি বিশেষ অনুভূতি অনুভব করাইনি।নজর দেখেছে,ওখানেই ক্ষান্ত। দ্বিতীয়বার আর নজর সেদিকে ফিরে তাকায়নি।অথচ হঠাৎ একদিন একজোড়া ক্রন্দনরত চোখ আমার স্বপ্নে মিললো।জানো,আমাকে ঘুমাতে দিলোনা কতোদিন।আমার একটাই দোষ ছিলো,আমার খুব কাছে বসে সেই চোখজোড়া ক্রন্দন করেই চলছিলো।অথচ আমি ফিরে তাকাইনি।তাই বাধ্য হয়ে চোখজোড়া আমার স্বপ্নে হানা দিলো।শাস্তিসরূপ কতোগুলো দিন আমাকে ঘুমাতে দিলোনা।আমি জীবনের প্রথম মায়া,টান অনুভব করলাম সেই ক্রন্দনজোড়া নজরে।যখন তাকে বুঝলাম সে স্বপ্ন আসা বন্ধ করে আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিলো।অথচ সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া পরিনত হলো সচ্চ একজোড়া মায়ামায়া ডাগরডাগর হরিনী চোখে।সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া আমাকে রাতে আরামে ঘুমাতে দিলেও সেই সচ্চ ডাগরডোগর চোখজোড়া কেঁড়ে নিলো আমার দিনগুলো।এরপর এক বিকালের গোধূলি লগ্নে একটা গোলগাল মায়াবীনি মুখ,আমার বুকের বা পাশটায় জায়গা করে নিলো।বিশ্বাস করো আমি মোটেও হিংসুটে ছেলে নই।অথচ আমি হিংসে করলাম এক যুবককে।কারন তার নজরও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো সেই গোলগাল মায়াবিনী মুখশ্রীতে।আমার কেনো জানি সহ্য হলোনা।সেই একই অপরাধের অপরাধী হয়ে আমার অপরাধ মুক্ত পাখির মতো ছেড়ে দিয়ে তার অপরাধে অভিযুক্ত করে নিষেধাজ্ঞা দিলাম।তারপর এক বৃষ্টি ভেজা দিনে সেই মায়াবিনীর অসহায় মুখ আমার বুকে ঝড় তুলে দিলো।আমি তাকে পুরোপুরি জায়গা করে দিলাম আমার সত্তায়।
‘আচ্ছা কৌড়ি,ওই টান ওই মায়া,ওইযে বুকে ঝড়তোলা অনুভূতি ওগুলোকে ঠিক কি অনুভূতি বলে?ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা?আমার মতে তো,এই দুই অনুভূতির উর্ধ্বে গিয়ে,তাকে পেয়ে যাওয়া মানে আমাকে পৃথিবীতে এক টুকরো জান্নাতের সুখ অনুভব করানো।স্বর্গসুখ লাভ করা।
চলবে…