#ফুলকৌড়ি
(২৬)কপি করা নিষিদ্ধ।
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
ঘন্টাখানেক আগের মুখরিত হলুদের অনুষ্ঠানটা হঠাৎই যেনো নীরব বিস্বাদ থমথমে পরিবেশে ছেয়ে গেলো।মন ভালো নেই কারও।দূর্বল বিষন্ন মানসিকতায় আকস্মিক ইভানের প্রস্তাব পেতেই,মনেমনে বিস্মিত হলেন তাহমিনা বেগম।তবে ভগ্নহৃদয়ের দূর্বলতায় চোখমুখের এক্সপ্রেশনে সেটা প্রকাশ করতে পারলেন-না।নীরবে চেয়ে রইলেন ইভানের সুদর্শন আশাবাদী মুখের দিকে।কি বলবেন হঠাৎই জেনো ভেবে পেলেন না।সবদিক থেকে নিভানকে উনার খুব পছন্দ ছিলো।ছেলেটার আচার ব্যবহার কথাবার্তা চালচলন,সর্বোপরি ছেলেটার দৃঢ় ব্যক্তিত্বে বরাবরই মুগ্ধ হতেন।সব মায়েরাই তো চায় নিজের কন্যার জন্য এমন উপযুক্ত ছেলে।সেখানে নিভানের গায়ের রঙটা উহ্য করে দেখেন-নি কখনো।
সেই হিসাবে একসময় তিনি মনেমনে তন্ময়ীর জন্য নিভানকে,খুব পছন্দ করতেন।এটাও চাইতেন,মেয়ের জামাই হিসাবে নিভান হোক।এরকম উপযুক্ত ছেলে সহজে মেলে না।মনের কথা একসময় গিয়ে ছেলেকে-ও জানিয়েছিলেন তিনি।সেদিন তৃনয় বিভিন্ন কারন দেখিয়ে সাফ না করে দিয়েছিলো।তন্মধ্যে তন্ময়ীকে নিজের বোনের নজরে দেখে নিভান।নিজেদের কথার মধ্যে যদি কখনো তন্ময়ীর প্রসঙ্গ আসে কথাবার্তা-ও সেরূপ বলে নিভান।সেখানে তন্ময়ীর জন্য তার-কাছে প্রস্তাব রাখা বিব্রতকর।আশা করাটাও আরও লজ্জাজনক।ভাবাটা-ও উচিত নয়।তৃনয় একথা বলার পর তিনি মনের মধ্যে গড়া ইচ্ছে,আশা, সব ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।আর সেই নিভানদের বাড়িতে,তন্ময়ী ইভানের বউ হয়ে গেলে কখনোই অসুখী হবে!ভালো থাকবে-না।এটা তিনি ভাবতেই পারেন না কখনো।তবু-ও তন্ময়ীর হয়ে ইভানের প্রস্তাবটা তিনি যেনো কখনোই আশা করেননি।নিজের মেয়ের সবদিক থেকে ইভান অনেক উঁচুতে।সেখানে কি আশা রাখা,আকাশ কুসুম ভাবার মতো।আরও সেই মেয়ের আজ হলুদের অনুষ্ঠানে বিয়ে ভেঙে গেছে।সেখানে আরও আশা রাখা তো উচ্চাকাঙ্খা।উনাদের মতো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির জন্য উচ্চবিলাসিতা।
‘আন্টি,কিছু বলুন?
ঝাপ্সানো চোখে কয়েকবার দুর্বলচিত্তে পলক ঝাপটালেন তিনি।আরও কিছুসময় বিচক্ষণতার সহিত ভাবলেন।ফের চোখ বুঁজে মৃদু-ভাবে মাথা উপর নিচ কয়েক-বার ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলেন।তবে মুখ দিয়ে কোনো টুশব্দ-ও উচ্চারণ করলেন না।চাইলেন না যেনো কথাই বলতে।সম্মতি পেতেই ইভানের বুকে এতোসময়ে জমে থাকা শক্তপোক্ত ভয়াবহ পাথরটা যেনো মূহুর্তেই সরে গেলো।মাথা নিচু করে জোরেশোরে নিঃশ্বাস ফেললো সে।সেই নিঃশ্বাস ফেলার দৃশ্যটুকু জহুরি নজরে পর্যবেক্ষণ করলেন,তাহমিনা বেগমের পাশে বসা নীহারিকা বেগম। তখনো ছেলের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন তিনি।উনার ইভান,প্রস্তাব রেখেছে মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্য।এটা যেনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না উনি।উনার পাশে দাঁড়ানো স্বান্তনা রহমান, মান্যতা,মৌনতারও একই অবস্থা।অবিশ্বাস্য নজর।অথচ কৌড়ির মন গাইছে অন্য কিছু।তন্ময়ী আপু কি সেই মেয়ে,যাকে নিয়ে ইভান ভাইয়া বরাংবার তারসাথে এটাওটা বলে গেছে?না হাওয়া বউ হিসাবে দাবী করেছে।তবে কি আজ তন্ময়ী আপুর বিয়ে ভাঙার পিছনে ইভান ভাইয়া দ্বায়ী!তাই যদি হয় তবে কাজটা মোটেও ঠিক করেননি ইভান ভাইয়া।অসন্তুষ্টচিত্তে ইভানের মুখের দিকে তাকিয়ে, মূহুর্তেই মুখ ফিরিয়ে নিলো সে।
পাশে দাড়নো ডালিয়া বেগমও যেনো বিগতসময় ধরে নাটক দেখছিলেন,উনার মুখাবয়বে সেটা এতোসময় প্রকাশ পাচ্ছিলো।তবে ইভান বিয়ের প্রস্তাব রাখতেই তিনি আশ্চর্যিত হলেন,কপাল কুঁচকে ফেললেন বিরক্তিতে।এরকম একটা কান্ড ইভানের থেকে কখনোই তিনি আশা করেন নি।ছেলেযে বাপের মতো দয়ালু স্বভাব পেয়েছে বেশ বুঝলেন।তবে কি দেখে এই ছেলে, সদ্য বিয়ে ভেঙে যাওয়া ওই মেয়েকে নিজের সঙ্গীনি করতে চাইছে বুঝে আসলোনা উনার।একে মেয়ের গায়ের রঙ শ্যামলা।ইভানের ফর্সা রঙের পাশে কখনোই মানাবেনা।সেখানে মেয়ের বাপ তো নেই,আরও না আছে বাপের রেখে যাওয়া কোনো প্রতিপত্তি।এরকম একটা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়েকে ইভান বিয়ে করবে!
জোয়ার্দার বাড়ির বউ বানাবে!জাহিদ হাসান জোয়ার্দারের ছেলের বউ!এতো রুচিহীন হয়ে গিয়েছে ছেলেটা।তাহমিনা বেগমের কাছে ইভানের রাখা প্রস্তাবে কেউ কিছু না বললেও,তিনি যেনো আর চুপ থাকতে পারলেন না।মুখ খুলবেন এমন ভাবনাটা মাথায় এনে, মুখে কিছু বলতে যেতেই হাতে টান পড়লো উনার।পাশে তাকাতেই দেখলেন,দীবা শক্তকরে হাত টেনে চেপে ধরেছে।চোখ বড়বড় করে,মাথা এদিকে ওদিকে নাড়িয়ে ইশারা করছে কিছু না বলতে।তিনি তবুও মানতে চাইলেননা।কিছু বলবে বলে উদ্যোক্ত হতেই,দীবা আরও শক্তকরে হাত চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো।
‘প্লিজ আম্মু,এখানে কোনোরূপ সিনক্রিয়েট করো-না।ওর লাইফ ওকে বুঝতে দাও।ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ঠ বড় হয়েছে।ওর ভালোমন্দ কিসে ও সেটা খুব ভালোভাবে বোঝে।তাই ও কিসে ভালো থাকবে সেটা ওকে বুঝে নিতে দাও।অন্তত ওর বেলায় নিজেদের সিদ্ধান্ত ওর উপরে না ঝাপিয়ে,ওকে ওর মতো করে ভালো থাকতে দাও।তোমার মতোকরে বুঝতে যেয়ে ওর জীবনটা এলোমেলো করে দেওয়ার চেষ্টা করোনা।প্লিজ আম্মু!
মেয়ের কথার দেওয়া সুক্ষ খোঁচাটা বেশ উপলব্ধি করলেন ডালিয়া বেগম।কোন কারনে মেয়েটা এমন খোঁচা দিয়ে কথা বললো,এটাও বেশ বুঝলেন।বিরক্তও হলেন বৈকি।এতো ভালো ঘরবর দেওয়ার পর-ও মেয়ে সুখে নেই।নাকি সে ইচ্ছে করে সুখে থাকতে চাইছে না এটা তিনি কি বুঝতে পারছেন না!অবশ্যই পারছেন!তবে নিজের পেটের মেয়েযে জোর গলায়-ও তো কিছু বলতে পারেন না।আর বললে-ও,আগে শুনলে-ও এখন আর শুনতে চায়না মেয়েটা।বিরক্তিতে খেঁকিয়ে উঠে তিনি কিছু বলতে যাবেন তার আগেই দীবা আবার-ও হাত চেপে ধরে বললো।
‘এখানে বড়মামাও উপস্থিত আছেন,এটা মাথায় রেখো।
মেয়ে তাকে হুমকি দিচ্ছে, অসন্তুষ্ট নজরে মেয়ের পানে তাকিয়ে পিছনে ফিরলেন তিনি।বড়ভাই উনার কয়েক কদম পিছনে হুইলচেয়ার বসা।ছোটো বেলা থেকেই এই বড়ভাই নামক মানুষটাকে তিনি যেমন সমীহ করে চলেছেন,তেমন ভয় পেয়ে চলেছেন।উনার মুখেমুখে বা উনার সামনাসামনি কথা বলার,তর্ক করার স্পর্ধা করেননি এমনকি সাহস দেখেননি কখনো।মেয়ের হুমকিতে সত্যিই তিনি দমে গেলেন,আর মুখ খুললেন না।তবে মেয়ের প্রতি বেজায় অসন্তুষ্ট হলেন।
★
সম্মতি পেতেই তাহমিনা বেগমের পাশে বসা মায়ের পানে দূর্বল একটা চাহুনি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ইভান।মনেমনে আশা রাখলো,মা নিশ্চয় তাকে বুঝবে।আর সে বোঝালে,অবশ্যই বুঝবে।তাহমিনা বেগমের সম্মতির খবর পুরো হলুদ অনুষ্ঠানের সর্বজনের কাছে ছড়িয়ে পড়লো।অনুষ্ঠানের আমেজ,পুরোপুরি ভাবে না ফিরলেও থমথমে পরিবেশ কিছুটা কাটলো।তন্ময়ীর পাশে গিয়ে তার বান্ধবী আর কাজিনেরা বিভিন্নভাবে তাকে বোঝাতে লাগলো।নিভান-ও এতোসময়ে তৃনয়ের সাথে কথা সেরে নিয়েছে।তৃনয় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো ইভান নিভান দুজনের প্রতি।সেটা শুনে মনেমনে ইভানের প্রতি আরও অসন্তুষ্টতা বাড়লো নিভানের।ইভানের থেকে কোনো অংশে সে তৃনয়কে মনে করেনা।
বন্ধু কম নিজের ভাইয়ের নজরে দেখে সে।সেই বন্ধুর এরকম একটা অসম্মানিত,অসহায় পর্যায়ে দেখা সত্যি কি মন থেকে মেনে নেওয়া যায়!এতোসময় অন্য কেউ হলে তাকে কি যে করতো নিভান।সে তো তন্ময়ীর বিয়ে ভেঙে যাওয়ার খবর শুনতেই,বরপক্ষের বিরুদ্ধে একশান নেওয়ার ব্যবস্থা করছিলো।কিন্তু দোষ তো সেই নিজের ঘাড়েই চেপে বসেছে।এখন তাকেই সুস্থ সুন্দরভাবে দু’দিকেই সমাধান করতে হবে।না-হলে অন্যায় করা হবে।অন্যায় তো তার ভাইদ্বারা এমনিতেই হয়ে গেছে।সেখানে ভান আর তৃনয় দু’জনেই তার নিজের মানুষ।কাছের প্রিয় মানুষ।আর সেই প্রিয় দু’জন মানুষের মধ্যে একজনের দোষ ঢাকতে গিয়ে আরেকজনের উপর অবিচার করতে হচ্ছে তাকে।এটাই সে মন থেকে মানতে পারছে না।তবে এই ছাড়া উপায়ও নেই যে তার।
তাহমিনা বেগমের সম্মতি জাহিদ সাহেবকে জানাতেই তিনি নিজের স্ত্রী, ভাই এমনকি বাড়ির সবাই ডেকে পরামর্শ করলেন।সেখানে উনার সম্মতিই প্রাধান্য দিলো সবাই।তবে মনেমনে নীহারিকা বেগম একটু অসন্তুষ্ট হলেন,ছেলের এহেন কান্ডে।বড় ছেলেকে না বিয়ে দিয়ে ছোটো ছেলের বিয়ের সিদ্ধান্ত,উনার মনটাকে একটু অসন্তুষ্ট করে দিলো।তবুও সেটা তিনি বহিঃপ্রকাশ আনলেন না।ডালিয়া বেগমও একটু খুচখুচ করলেন, তবে মন খুলে নিজের মনের দ্বিমত প্রকাশ করতে পারলেন না।অতঃপর জাহিদ সাহেব তন্ময়ীর মায়ের সাথে এবং তার বাড়ির মুরুব্বিদের সাথে কথা বললেন।একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হলো,বিয়ের ডেট যেদিনই সেদিনই বিয়ে হবে।আর আজ হলুদের অনুষ্ঠানও বহালই থাকবে।এই সিদ্ধান্তে সবাই সন্তুষ্ট হলেও,তন্ময়ী সন্তুষ্ট হতে পারলো না।সবার সম্মুখ দিয়ে ছুটে চলে গেলো সে ক্ষনিকের পরিচিত রাংলোবাড়ির ঘরটায়।ইভান নিস্পৃহ নজরে দেখলো,তন্ময়ীকে ছুটে যেতে।মন ছটফটিয়ে উঠলো তার।তবে অসাড় ভঙ্গিতে নিশ্চুপ দাড়িয়ে রইলো সে।কেনো জানি মন মস্তিষ্কে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।অনুতপ্ততায় হাত পা যেনো অচল অনুভব হলো তার।একটা ফাঁকা টেবিলের চেয়ারে বসে পড়লো সে।ইভানের সেই নিস্প্রভ দৃশ্যটা নিভান দূর থেকে লক্ষ্য করলো নিভান।ভাইয়ের নিস্পৃহতায় বুকের ভিতরটা তারও পুড়লো।ব্যথিত হলো। তবে মেয়েটার পরিস্থিতির কথা ভাবলেই ইভানের প্রতি ভিষণ রাগও হলো তার।ইভানের দিলে এগোলো নিভান।গিয়ে বসলো ইভানের সামনাসামনি চেয়ারে।তীক্ষ্ণ নজরে ইভানের মাথা নিচু করে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রুক্ষ গলায় বললো।
‘তুমি এরকম একটা ব্লান্ডার করবে এটা কখনোই আমি ভাবিনি ইভান!তুমি যেমনটা ছিলে না কেনো,তোমার কাছ থেকে এতোটাও হীনমন্যতা আশা করে-নি আমি। কখনো না।আমার ভাই এমনটা করবে!হাও ইজ দিস পসিবল?
নিভান এসেছে টের পেয়েও মাথা উচু করেনি ইভান।
দাদাভাই যে তার উপর ভিষন রেগে আছে,এটা বেশ অনুভব করতে পারলো সে।আজ তার জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকতো তবে এতোসময় বাজে অবস্থা হয়ে যেতো তার।সেসব ভেবেই মুখ উচু করে সামনে তাকানোর সাহস করিনি সে।তবে নিভানের রুক্ষ গলার কথাগুলো শুনতেই অসহায় মুখ করে তাঁরদিকে চাইলো।কন্ঠে খাদ নামিয়ে বললো।
‘দাদাভাই প্লিজ।
‘এই দাদাভাই প্লিজ কিসের!এই তুই যেটা চেয়েছিস,না কখনো বলা হয়েছে।এই বল, না বলেছি আমি কখনো?
বাবা না বললেও,আমি কখনো না বলেছি?তুই মুখ ফুটে না চাইলে-ও,আমি বুঝতে পারলেই সেটা নিজ থেকে দেওয়ার ট্রায় করেছি তোকে।তবে কেনো এরকম একটা হীন কাজটা করলি ইভান?আমাকে একটাবার জানাতিস।তৃনয়ের কাছে আমার সম্মানের কথাটা একবার-ও ভাবলি না?তোর যখন তন্ময়ীকে এতোটাই পছন্দ তবে আমাকে কেনো সেটা বললিনা?কেনো এমনটা করে মেয়েটাকেসহ ওর পরিবারকে অসম্মানিত করলি?আমার ভাইয়ের প্রতি আমার অটুট বিশ্বাসটা কেনো এভাবে নষ্ট হতে দিলি?
দাদাভাই ভিষন রেগে আছে এটা তার তুইতোকারি কথায় স্পষ্ট বুঝলো ইভান। এখন যদি কথা না বলে চুপ থাকে।তবে তন্ময়ীকে পাওয়ার আশাও ক্ষীন হয়ে দাড়াবে।তাই না চাইতেও মুখ খুললো ইভান।
‘ও সামন্য একটা বিষয় নিয়ে ভুল বুঝে এরকম একটা সিচুয়েশন তৈরী করেছে।যার ফলস্বরূপ এরকম একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হয়েছে।আর এই পরিস্থিতির জন্য যদি আমি দ্বায়ী হয়ে থাকি,তবে তার কিছু অংশীদ্বারও ও।আর তুমিও শুধু ওর পরিস্থিতিটা বিবেচনা করে কিছুতেই ভুল বুঝতে পারো-না আমাকে। ওকে আমি বলেছিলাম,বাড়ি থেকে যদি কোনো বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তবে আমাকে জানাতে।ও সামান্য একটা ভুল বোঝাবোঝির কারনে, নিজমনে ক্ষোভ পুষে রেখে ইচ্ছেকৃতভাবে জানায়নি আমাকে।আর সামন্য একটা ভুল বোঝাবোঝির কারনে,ও এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার থেকে দূরে সরে যেতে পারে-না।ও চাইলে-ও আমি সেটা হতে দিতে পারিনা।আর সেটা আটকাতে আমার এই পদক্ষেপটা নিতে হয়েছে।যার ফলস্বরূপ এই পরিস্থিতি।
ওকে বা ওর পরিবারকে অপমান অপদস্ত করার কোনোরূপ ইচ্ছে আমার ছিলো না।
রাগে টনটন হয়ে যাওয়া কপাল মূহুর্তেই কুঁচকে গেলো নিভানের।বললো—তোদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো?
‘না।
‘তবে?এসব কথা হওয়ার কারন ?
নিজেদের মধ্যে ঠিকঠাক হওয়া না হওয়ার সম্পর্কটা ছোটো পরিসরে বিবরণ দিল ইভান।আর সেই সম্পর্কের থেকে এই পরিস্থিতি কিকরে গড়ালো এটাও বললো।সেটা শুনে নিভান শক্তগলায় বললো।
‘তন্ময়ীর বোঝাবোঝিটা একদম ভুল নয় আর না সেই ভাবনামতো বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভুল।বরং তোমার ওই মেয়েটার সাথে মাখামাখিটাই মাত্রাধিক ছিলো।আর যে কেউ ওসব দৃশ্য দেখলে,তন্ময়ী যেটা ভেবেছে, বুঝেছে।সেটাই বুঝবে,সেটাই ভাববে।নিশ্চয় আমার নজরও ভুল কিছু দেখেনি!আমার ব্রেইন ও ভুল কিছু ভাবেনি!
‘তুমি আমার চরিত্র নিয়ে অবিশ্বাস করতে পারো না দাদাভাই!তন্ময়ীর মতো তোমার দেখায় ভুল না থাকতে পারলেও,ভাবনায় বিস্তার ভুল ছিলো।
‘কিন্তু কার্যকলাপ তো তুমি তেমনটাই করেছো ইভান।সেখানে আমাদের নজর যেমনটা দেখবে,আগে সেরূপ ভাবনাই তো ভাববে।তাই না?
‘না তাই না!আমাদের দেখাও কিছু কিছু সময় ভাবনাতে গিয়ে ভুল হয়। ওই মেয়েটা আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলো-না দাদাভাই।আমার ক্লাসমেট ছিলো,তবে ওরসাথে আগে সেভাবে পরিচিত ছিলাম না আমি।ওর বয়ফ্রেন্ডও আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলো,ওরসাথে রিলেশনের পর মেয়েটাকে চিনেছি আমি।ওদের রিলেশনশিপের পরে বিভিন্ন সূত্রে আমি জেনেছি মেয়েটার একাধিক বয়ফ্রেন্ড ছিলো।এমনকি আমি নিজ চোখেও দেখেছি,শহরের বিভিন্ন নামীদামী কফিশপে রেস্টুরেন্টে মেয়েটার যাতায়াত।বন্ধুকে জানিয়েছিলাম,বিশ্বাস করে নি।ও ঢাকার বাহির থেকে পড়তে এসেছে, বিধায় শহর ঘোরাঘুরি ততোটাও হয়না ওর।বিধায় ওর নজরে মেয়েটার কার্যকলাপগুলো সেভাবে পড়েনি।যার ফলসরূপ ও আমার কথা বিশ্বাস করেনি।কিন্তু মেয়েটা দেখতে হ্যান্ডসাম আর বড়লোক বাপের ছেলে পেলেই পিছনের বয়ফ্রেন্ডটাকে,জীবনে চেনেনি দেখেনি এমনভাবেই ছুড়ে ফেলে দেয়।আমি সেই সুযোগটা নিয়ে আমার ফ্রেন্ডকে প্রুফ করতে চেয়েছিলাম মেয়েটা ভালো নয়।নেহাল ভিষন ভালো ছেলে দাদাভাই।আর ও ওরকম একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক এগোবে।মেয়েটাও দিনের পর দিন তাকে ঠকিয়ে যাবে।এটা আমি মানতে পারিনি, চাইনি কখনোই।যারজন্য মেয়েটার সাথে, তোমার আর তন্ময়ীর ভাষায় একটু মাখামাখি করতে হয়েছিলো আমাকে।এখানে দোষ আমার নেই,এটা আমি বলছিনা।তবে আমার কাছে বিষয়টা না জেনে এমন বাড়াবাড়ি তন্ময়ী করবে এটা আমি ভাবিনি।
‘বাড়াবাড়ি নয়।ওর জায়গা থেকে ও সম্পূর্ণ ঠিক।ভুলটা তুই করেছিস!সম্পর্কে না জড়ালে-ও,মেয়েটার দূর্বলতা নীরব সম্মতিতো তোরসাথে ছিলো।সেখানে অন্য একটা মেয়ের সাথে তোকে ওভাবে দেখলে তো ভুল বুঝবেই।
‘তুমিও তন্ময়ীর মতো কিছুতেই আমাকে বুঝতে চাইছো-না দাদাভাই।আচ্ছা ভাবো,এখন যদি কৌড়ি জানতে পারে।তুমি দীবাআপুকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে।এখন বিয়ে কেনো করতে চেয়েছিলে,কৌড়ি কারন তো আর জানেনা।দীবাআপুকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে, এটাই তার মুখ্য বিষয়।তুমি তার ভুল ভাঙানোর আগে সে যদি এটাও জানতে পারে,দীবাআপু তার স্বামী সংসার ছেড়ে এবাড়িতে পড়ে আছে শুধু তোমাকে পাওয়ার আশায়।এবার পরিস্থিতি যদি আমার মতো হয়।মনে করো কৌড়ি রাগে অভিমানে তোমাকে ছেড়ে অন্যত্র জায়গায় বিয়ের সম্মতি জানালো।তুমি কি করবে?
সবসময়ে শান্ত থাকা নিভানের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো।কপাল অস্বাভাবিক কুঁচকে রাগতস্বরে বললো–‘মানেটা কি,এখানে এসব কথা আসছে কোথা থেকে?
মনেমনে ক্রুর হাসলো ইভান।যে যেই বিষয়ে ভুক্তভোগী তাকে সেই বিষয়ে বুঝিয়ে দূর্বল করতে হয়।নাহলে কি আর সে বোঝে অন্যের ব্যথা,দরদ।ইভান চটজলদি উত্তর দিলো।—তুমি আমাকে বুঝতে চাইছো না তাই আসছে।প্লিজ দাদাভাই এসব বাদে এখন তন্ময়ীকে একটু মানাও না।আমি নিশ্চিত ও তোমার কথা ফেলবে না।
কথা কানে গেলেও,ভাবনা কৌড়িতে চলে গেলো নিভানের।মেয়েটা কি তার পরিস্থিতিটা না বুঝে তাকেও ভুল বুঝে দূরে সরে যাবে?ভাবতেই বুকে চিনচিনে ব্যথার অনুভব সৃষ্টি হলো।হাসফাস হয়ে উঠলো নিঃশ্বাস।নজর এলোমেলো হয়ে কৌড়িকে খুঁজলো।খুঁজে পেলেও।ওই-তো তার থেকে সামন্য দূরত্বে মায়ের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।মান্যতা আর মৌনতাও দাঁড়িয়ে আছে পাশে।অপলক কিছুসময় সেদিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাড়ালো নিভান।সেটা দেখে ইভানের মুখে-ও মৃদু হাসি ফুটলো।দাদাভাই মেনে গিয়েছে মানে তন্ময়ীকেও মানাতে আর সময় লাগবে-না।বিয়েটা একবার ভালোই ভালো হয়ে যাক,তারপর সে বুঝে নেবে।
★
ঘরের দরজা এঁটে বসে আছে তন্ময়ী।সে কিছুতেই ইভানকে বিয়ে করবে-না।মা কি-করে তার মতামত না নিয়ে,ইভানের প্রস্তাব সসম্মানে গ্রহণ করলো!তন্ময়ীকে তার হাতে তুলে দেওয়ার সম্মতি কি করে জানালো। ওই অসভ্য ছেলেটার জন্য আজ তার জীবনে এমন পরিনতি।কতোশত মানুষের সামনে নিজের চরিত্র নিয়ে কথা উঠলো।আপমান অপদস্ত হতে হলো।আর সেই ছেলেটাকেই সারাজীবনের সঙ্গীনি হিসাবে তাকে গ্রহন করতে হবে!কিছুতেই না।ইভানের সঙ্গীনি সে কখনোই হতে চায়না।কখনোই না।দু-হাটু মুড়ে জড়োসড়ো হয়ে ফ্লোরে বসা তন্ময়ী,এবার দু-হাটুর মধ্যে মুখ গুঁজে হু-হু করে কেঁদে দিলো।মাথায় চললো এলোমেলো সব ভাবনা।
‘তনু,দরজাটা খোল।কিচ্ছু হয়নি সোনা। ভাই সব ঠিক করে দেবে।তবু-ও উল্টো পাল্টা কিচ্ছু মনে আনার চেষ্টা করিস না পাখি।এই তনু,দরজাটা খোল’না পাখি।কথা শোন না বোন আমার।
দরজার ওপাশে দাঁড়ানো প্রিয় মানুষগুলোর ভয়ার্ত গলার কথাগুলো,ডাকগুলো সবটাই কানে এলো তন্ময়ীর।তবে একটা টুশব্দও উচ্চারণ করলো না সে।শুধু কেঁদেই চললো।নাজুক মনে হঠাৎই প্রশ্ন বাসা বাঁধল,সবাই তার ভাবনায় চিন্তিত,আতঙ্কিত!অথচ তার মা একবারও এলেন না।তাকে ডাকলেনও না!তবে কি মা বিশ্বাস করে নিয়েছেন,উনারা যেটা বলেছেন সেটাই সত্য।ভাবনা যতোই দৃঢ় হলো তন্ময়ীর কান্নার দৃঢ়তার তোড়জোড়ও ততোই বড়লো।একসময় তৃনয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো নিভান।তখনো লাগাতার তৃনয় এটা-ওটা বলে দরজা ধাক্কিয়ে চলেছে।নিভান চোখ দিয়ে ইশারা করে তাকে থামতে বললো।ফের নিজে মৃদুশব্দে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো।
‘তন্ময়ী,দরজা খোলো।আমি কথা বলতে চাই তোমার সাথে।
নিভানের ভারিক্কি গলার স্বর পেতেই কান্না হালকা হয়ে এলো তন্ময়ীর।তবে নড়লোনা সে।উঠবেওনা আর দরজাও কিছুতেই খুলবেনা সে।নিশ্চয় ওই বেয়াদবটা নিভান ভাইয়া কে তার হয়ে সাফাই গাইতে পাঠিয়েছে।সে মরে যাবে তবুও কিছুতেই ওই বেয়াদবটাকে বিয়ে করবে-না।খুট করে দরজা খুলে যাওয়ার শব্দে মুখ তুলে সেদিকে চাইলো তন্ময়ী।নিভানকে দেখেই মাথা নিচু করে ফেললো সে।নিভান, মেয়েটার এলোমেলো অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে তন্ময়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।ফের নরম গলায় বললো।
‘আমি কখনো মৌনতা আর মান্যতা থেকে আলাদা করে দেখিনি তোমাকে।এতো বছরের সম্পর্কে হয়তো আমার আচারনে তুমি বুঝতে পেরেছো।জানিনা আমার সম্পর্কে তোমার ধারনা নিজের ভাইয়ের মতো কি-না।
মাথা উঁচু করে তাকালো তন্ময়ী। মায়াবী টলমলে কাজলকালো চোখ দু’টো বলে দিচ্ছে সে নিজের ভাইয়ের মতো বিশ্বাস,ভরসা করে নিভান কে।সেদিকে তাকিয়ে নিভান বললো।
‘তবে আজ সেই ভাই বোনের সম্পর্কের বিশ্বাস, ভরসা ভঙ্গ করতে চলেছি কি-না আমি জানি-না।তবে আমার দ্বারা তোমার অমঙ্গল কোনো হতে পারে এটা কখনোই আমি ভাবতে পারিনা।
একটু থামলো নিভান।সত্যিই স্বার্থপরের মতো এককভাবে চেয়ে ফেলছে সে।তবুও বললো—তোমার মতো ইভানও কষ্ট পাচ্ছে তন্ময়ী।আমি জানি, ও তোমাকে অসম্মান করেছে।তবে পরিস্থিতিতে পড়ে যে করেছে এটা তুমিও জানো।ইভানকে তুমি কতোটা চেনো,জানো আমি জানিনা।তবে আমার ভাইকে আমি জানি,ও কখনো একটা মেয়েকে অকারণে অসম্মান করার মতো ছেলে নয়।আর কাওকে কথা দিয়ে তাকে ঠকানো,আমি অন্তত এই অবিশ্বাসটুকু আমার ভাইয়ের প্রতি কখনো করতে চাইনা।হয়তো চেয়েও অবিশ্বাস করতে পারবো-না।যদিও স্বার্থপরের মতো বলা হয়ে যাচ্ছে।তোমার পরিস্থিতিতে থাকলে একথা-গুলো মুখ দিয়ে বের করতে পারতাম কি-না জানিনা।তবে সত্যি বলতে আমরা সবাই আমাদের প্রিয় মানুষদের ক্ষেত্রে দূর্বল স্বার্থপর।তাই,আমার ভাইয়ের জন্য তোমার কাছে তোমাকে চাইতেই হচ্ছে।
তন্ময়ীর অবাককরা দূর্বল চাহুনীর দিকে তাকিয়ে দুর্বোধ্য হাসলো নিভান।বললো–আমাকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে তোমার,তাই না?আমি জানি তোমার দিকটা না ভেবে আমি স্বার্থপরের মতো কথা বলছি।তবুও বলবো,ওকে ফিরিয়ে দিওনা তুমি।আমার বোন হয়ে আজীবন আমাদের সাথে থেকে যাও।
শ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে নিল তন্ময়ী।সেটা দেখে ফের নিভান বললো–এবার তুমি ভেবে দেখো,তুমি কি করতে চাও।তোমার সিদ্ধান্ত যদি এরপর না হয়।তবে তুমি ভেবো-না,ইভান তোমাকে কোনোপ্রকার ডিস্টার্ব করবে না।
নিভান তপ্তশ্বাস ফেলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগে আবার বললো—তুমি ভেবেচিন্তে তারপর সিদ্ধান্ত নাও।আমরা বাহিরে সবাই তোমার অপেক্ষায় আছি।
★
ইভান দীবাকে নিয়ে যুক্তি দেখাতেই কৌড়ির নিয়ে এলোমেলো ভাবনা মস্তিষ্কে চলতেই থাকলো নিভানের।কৌড়িকে নিয়ে নিভানের এতোদিনের কঠিন মন,এমন দূর্বল হয়ে পড়েছে।মেয়েটা তার হবেনা ভাবলেই, হৃদপিণ্ড সেকেন্ডে সেকেন্ডে ছটফটিয়ে উঠছে তার।বিচলিত হলো সে।আপতত মেয়েটার সাথে কথা বলা প্রয়োজন।তন্ময়ীর সাথে কথা বলে বাহিরে বের হয়ে কৌড়িকে কোথাও দেখতে পেলোনা সে।আশেপাশে খুঁজলো তবুও পেলোনা।বাধ্য হয়ে ফোন দিলো।একবার নয় কয়েকবার দিলো।পরপর কয়েকবার ফোন দেওয়ার পর রিসিভ হলো ওপাশ থেকে।ফোন রিসিভ হতেই এপাশ থেকে বিচলিত গলায় নিভান বললো।
‘এতোবার ফোন দিচ্ছি,ধরছো না কেনো?কোথায় তুমি? আমার তোমার সাথে কথা আছে,প্লিজ দুমিনিট হলেও আমার সাথে কথা বলে যাও,কৌড়ি।
চলবে…
★
#ফুলকৌড়ি
(২৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
দীর্ঘ সময় ধরে জমা আকাশের ঘনোকালো মেঘ সরে গিয়ে সেখানে যেনো ঝলমলে রোদ্দুরের দেখা মিলেছে।তন্ময়ীর সম্মতি এমনই প্রভাব ফেললো ইভানের মনে।সাথে বাড়ির বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর মনেও।মান্যতা আর মৌনতা-তো ভিষন খুশি।তন্ময়ীকে তাদের ভিষন পছন্দ।ছোটো বউমনি হিসাবে মোটেই মন্দ হবে-না মেয়েটা।একেবারে তাদের মনমতোন,খুব মিষ্টি।পুনরায় আবার আংটিবদল হলো।আগের পাত্রপক্ষের আংটি খুলে ফেলে,যত্রতত্র নীহারিকা বেগমের হাতের আঙটি দিয়ে আপতত আংটিবদল সারা হলো।ইভান যখন আঙটি পরাতে গেলো তন্ময়ীর হাতে।সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে নিলো তন্ময়ী।ইভানের হাত থেকে আঙটি কেড়ে নিয়ে নিজেই নিজের আঙুলে পরে নিল।
পাশেবসা ইভানকে দাঁতে দাঁত চেপে মৃদুস্বরে বললো।
‘বিয়েতে সম্মতি দিয়েছি মানে,আমাকে ছোঁয়ার অধিকার দেইনি।সো ভুলেও অধিকার তো দেখাবেনই না।দ্বিতীয়ত যখন তখন ছোঁয়ার বাহানা-ও খুঁজবেন না।
দূর্বল চোখে,তন্ময়ীর কঠিন করে রাখা মুখাবয়বের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো ইভান।ফের আশেপাশে নজর ফেলে আর কথা বাড়ালোনা।চুপচাপ উঠে চলে গেলো।পূর্বে যে উৎফুল্লতা সবার মনে বিরাজ করছিলো সেই উৎফুল্লের সহিত হলুদ অনুষ্ঠান নাহলেও,মোটামুটি ভাবেই সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠান শেষ করা হলো।বিয়ের মতো একটা সেনসেটিভ ইস্যু ঘোলাটে হয়েও,পুনরায় যেভাবে হোক মিটে যাওয়ায় সবার মনেমনে সাচ্ছন্দ্যতা অনুভব করলেও,তৃনয়ের মনটা ছোটো হয়ে গেলো।তন্ময়ীর বিয়ের পর সে চেয়েছিলো,সাহস করে হলে-ও একবার নিভানের সামনে প্রস্তাব রাখবে মান্যতার জন্য।তাতে যদি নিভান অসম্মতি জানায় বা তাদের বন্ধত্ব একটু নড়চড় হয়।তবু-ও রাখবে।আগে মনে হতো,চোখের ভালো লাগা একটু একটু করে মনে বাসা বেঁধেছে।বন্ধুত্বের কারনে সেটা একটু কষ্ট করে হলেও, চোখের আড়ালে থাকলে ভুলে যেতে পারবে।কিন্তু না।যখন পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশ চলে গেলো,মেয়েটা জেনো সেই মনে বাঁধা বাসাটা আর-ও শক্তপোক্তভাবে বাঁধলো।তারপর সেই বাসা ভেঙে দেওয়ার কথা ভাবলেই বুকে পাহাড়সম ব্যথার অনুভব সৃষ্টি হয় তার।মনে এমন অনুভূতি জাগে,বাসা বাঁধা জায়গা থেকে মেয়েটাকে একটু নড়চড় করলেই নিজেকেই শেষ হয়ে যেতে হবে।অথচ মেয়েটাকে বলার ক্ষমতা নেই।নেই বললে ভুল হবে।তবে মান্যতার সামনে নিজের অনুভূতি কখনো প্রেমিক রূপে প্রকাশ করতে চায়নি সে।চেয়েছে,সবার সম্মতিতে তাকে নিজের স্ত্রী রূপে আপন করে নিতে।তাকে চেয়েছে প্রনয় নয় পরিনয় রূপে।তবে এখন বোনের জন্য এখন সম্পর্ক তৈরী হতে যাচ্ছে, সেই পরিনয় রূপে চাওয়া সম্পর্ক কি গড়া সহজ হবে!সম্পর্ক হওয়া ঘরে কি আর দ্বিতীয়বার সম্পর্ক তৈরীর প্রস্তাব রাখা যাবে!সেটা কি সবাই ঠিকঠাক চোখে দেখবে?যদিও তন্ময়ী ভালো থাকলে, সুখে থাকলে সেই ভালো।তৃনয়ের পরম শান্তির। তবুও কোথাও যেনো তার কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে, এমনটা অনুভব হচ্ছে।সব কেমন হঠাৎই গড়মিল হয়ে গেলো কেনো!ভাগ্য বরাবরই সে যা চেয়েছে তার বিপরীত দিয়ে এসেছে। এবার চাওয়াটা যদি সেরকমই হয়।তবে তাকে নিঃশেষ হয়ে যেতে হবে।আজ মেয়েটাকে দেখার পর যেমন তাকে পাওয়ার প্রবলতা দ্বিগুনভাবে অনুভাবিত হয়েছে,সেখানে এই ঘটনার পর তাকে না পাওয়ার আকাঙ্খা, ভয়, দ্বিধা, শতগুণরূপে ব্যাথার অনুভূতি রূপে বাসা বেঁধেছে।
★
যদি-ও হঠাৎ করে বিয়ে।তবুও আত্মীয় স্বজন কাওকে বলতে বাদ রাখলেন না নীহারিকা বেগম আর জাহিদ সাহেব।বড় ছেলে বাদে যদিও ছোটোছেলের বিয়ে,তবুও দ্বিধাদন্ড রাখলেন না কাওকে নিমন্ত্রণ করতে।এবাড়ির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে প্রথম বিয়ে।তাও আবার হঠাৎই করেই। তবুও আয়োজন ধুমধামভাবে করার চেষ্টা করলেন।কোথাও কমতি রাখতে চাইলেন না।বিশেষ করে নিভান।ভাইবোনদের মধ্যে ইভানের জায়গাটা তার জীবনে অন্যরকম একটা দূর্বলতার স্থান।মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পরে এই পরিবারের প্রথম আপন বলে কেউ নিজের জীবনে স্থান করে নিতে পেরেছিলো।তার ছোট্ট নিঃসঙ্গ জীবনের একাকিত্ব দূর করে কথা বলার সঙ্গী হয়েছিলো।ভাগ্যের পরিহাসে বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর যে হাসিখুশি জীবটা বিসর্জন দিতে হয়েছিলো সেটাও যেনো কিছুটা হলেও তার জীবনে ফিরে এসেছিলো ইভানের পৃথিবীতে আসার আগমনে।তার মুখে এক টুকরো হাসি ফোঁটাতো বাচ্চার ছেলেটার সুদর্শন মুখ,নরম স্পর্শ।একটু বড় হলে তার কাছে থাকার আবদার।আদূরে কন্ঠ দাদাভাই ডাকটা।তাকে ছাড়া একটা সময় ওই ছেলেটা কিচ্ছু বুঝতে চাইতো না।এরকম একটু একটু করে একটা সময় এমন দূর্বলতা তৈরী হলো ছেলেটার প্রতি।তার অন্যায় আবদারও পর্যন্ত নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে নিভান।যদিও একটা সময় গিয়ে কিছু কারনে সম্পর্কে দূরত্ব এসেছে।তবুও ছেলেটার প্রতি সেই স্নেহ ভালোবাসাময় দুর্বলতা একতিল পরিমানও কমেনি।বরং বেড়েছে।যা হয়তো ইভানও জানে।আবার হয়তো বা জানে না।
নিমন্ত্রণ পেতেই নিকট আত্নীয়দের ভীড় লেগে গেলো বাড়িতে।বাড়ির ভিতরের দিকটা নীহারিকা বেগম আর স্বান্তনা রহমান নিপুণহাতে সামলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।এরমধ্যে বড়ছেলের আগে ছোটোছেলে কেনো বিয়ে করছে?এবিষয়েও কথা উঠলো।কথা উঠলো কি,কথাটা সবার মুখেমুখে।সেসব কথার উত্তরও তিনি অমায়িক হেসে সুন্দরভাবে বলে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।যদিও ছেলের এমন হুটকরে বিয়ের সিদ্ধান্তে মনে- মনে তিনি-ও একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন।তবে নিভান বুঝিয়ে বলায় সেই অসন্তুষ্টটা কিছুটা হলেও গলে বরফ হয়েছে।তবু্ও কাল থেকে ইভানের সাথে এবিষয়ে ভুলেও তিনি কথা বলেন-নি।কথাই বলেননি রাগে।তবে তন্ময়ী মেয়েটাকে উনার বেশ পছন্দ।মায়াবী চেহারার একটা মিষ্টি মেয়ে।হাসলে মেয়েটাকে কি সুন্দর দেখায়।আর সেই মেয়েটা উনার বাদর ছেলের বউ হবে।উনার ছোটো ছেলের বউ!একারনেই ছেলের প্রতি নারাজি তিনি উগ্রভাবে দেখাতে পারছেন না।রান্বাঘরে ব্যস্ত হাতে কাজ করছিলেন,আর মনেমনে ভাবছিলেন তিনি।হঠাৎ গলায় একজোড়া হাত পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরতেই বুঝতে পারলেন হাতজোড়া কার।তবু-ও বিশেষ পাত্তা দিলেন-না।দৃঢ়চিত্তে কাজেই মনোযোগ দিলেন।পাশ থেকে স্বান্তনা বেগম দেখলেন।মৃদু হেসে তিনিও নিজের কাজে মনোবেশিত হলেন।
‘ও আম্মু।খুব রাগ হয়েছো আমার উপর?
রাগ মনে না থাকলেও,গলায় কঠোরতা বজায় রেখে নীহারিকা বেগম বললেন।—ইভান আমার প্রচুর কাজ।এখান থেকে যা।তোর উল্টো পাল্টা বকবক শোনার সময় আপতত আমার নেই।যা…
টুপ করে মায়ের গালে একটা চুমু বসিয়ে দিলো ইভান।নীহারিকা বেগম বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ইভানকে পিছন দিক থেকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন।ফের পরিহাসের স্বরে বললেন—আমার নাবালক ছেলে হঠাৎ সাবালক হয়ে গেলো কবে?এটাই তো বুঝতে পারছি না!আর সেই ছেলে আমার সাবালক ছেলের আগে বিয়ের প্রস্তাব রাখছে,ব্যাপারটা একটু ধাক্কা খাওয়ার না?
নিজের কথার ফাঁদে নিজে আঁটকে যাওয়া!ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক।মনেমনে নিজেকে বেশ প্রবোধন করলো ইভান।ফের মা’কে ভুলাতে বললো–তোমার নাবালক ছেলে নাবলকই আছে।শুধু বিয়ে করতে চাইছে।আর বিয়ে করতে গেলে ছেলে আবার নাবালক সাবালক হতে হবে কোথায় লেখা আছে?দাদুমা গল্প করেন শোনোনা,আগের মানুষের নাকি একদম ছোট্রো বেলায় বিয়ে হয়ে যেতো।এমনকি পেটে পেটেও নাকি বিয়ে হয়ে যেতো।তাদের কি কিছুতে আঁটকে আছে নাকি?নাকি….
নীহারিকা বেগম ইভানের কথা শেষ করতে দিলেন না।এই ছেলের মুখের কোনো লাগাম নেই।কোথায় কি বলে বসে,তার ঠিক নেই।তিনি চোখ রাঙিয়ে দাঁতে দাত চেপে বললেন।—আমি তোর মা,বান্ধবী নই।কথা হিসাব করে বল,বেয়াদব।আর এখান থেকে যা নাহলে কিন্তু মোটেই ভালো হবেনা ইভান।
মুখ বেজার করার অভিনয় করলো ইভান।ফের স্বান্তনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে অভিযোগের স্বরে বললো–দেখেছো ছোটোমা,এবার বলো মা কাকে বেশি ভালোবাসে। দাদাভাই নাকি আমাকে।দাদাভাই হলে তো ঠিকই তার কথা শুনতো।তাও আবার আদরে আহ্লাদে মনোযোগ দিয়ে শুনতো।শুধু আমার বেলায় তার যতো জ্বালা।আমার কথাই শুনতে ভালো লাগেনা উনার।
‘ইভান।
এই ছেলে নাকি বিয়ে করবে!ছেলের ইতুড়েপনায় তন্ময়ী এসে দুদিনও টিকবে কিনা উনার ঘোর সন্দেহ আছে। মায়ের চড়া গলার ডাক পড়তেই দমে গেলো
ইভান।বুঝলো উল্টো পাল্টা যাই বলুক না কেনো কাজই হবেনা।মা সত্যিি বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন তার উপর।পাশে দাড়ানো ছোটো চাচির দিকে একবার অসহায় নজরে তাকালো।সেটা দেখে স্বান্তনা রহমান চোখের পলক ফেলে আস্বস্ত করলেন।বুঝালেন সব ঠিক হয়ে যাবে।হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করে নিলো ইভান।রান্নাঘর থেকে যেতে গিয়েও,কিছু ভেবে ফের মায়ের কাছে এসে দাড়ালো সে।জানে,তার কান্ডে মা বকবে।তবুও আবারও দুহাত দিয়ে মা’কে পিছন থেকে জাপ্টে ধরলো।নীহারিকা বেগম রাগান্বিত হয়ে কিছু বলার আগেই অতি স্বাভাবিক গলায় ইভান বললো।
‘আই এ্যাম রিয়্যালি ভেরি স্যরি মা।আমি আমার কথা কর্মদ্বারা কখনো কাওকে কষ্ট দিতে চাইনি আর চাইনা কখনো।তবুও বারবার সবাই আমার কথা কর্মদ্বারা কষ্ট পায়। আর পাচ্ছেও।তবে বিশ্বাস করো আম্মু,আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমার সেই কাছের মানুষগুলোকে মনোক্ষুণ্ণ হতে হবে,আমার কর্মদ্বারা সেসব মানুষগুলো কষ্ট পাবে।এটা আমি আরও চাইনি।তবুও সেই মানুষগুলোই কষ্ট পেয়েছে।হয়তো আমার ভাগ্য ভালো না,আমি চেয়েও কাওকে ভালো রাখতে পারিনা, এজন্য।বাট আমি নিরুপায় হয়ে এমন একটা ডিসিশন নিতে বাধ্য হয়েছি।আমি চাইনি তন্ময়ীর অন্য কোথাও বিয়ে হোক।আর সেই মেয়েটা আমার জন্য অসম্মানিত হয়েছে,এটা জেনেবুঝেও তাকে কিকরে আরও অসম্মানিত হতে দেই!যারজন্য না চাইতেও সেই সবাইকে কষ্ট দিতে হলো আমাকে।
ছেলের আগাগোড়া কথা কিছুই বুঝলেন না নীহারিকা বেগম।তবে এটা বেশ বুঝলেন তন্ময়ীর বিয়ে ভাঙার সাথে কিছু একটা সম্পর্ক আছে ইভানের।বিস্ময় নিয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎই উনার গালে ছেলের ফের স্নেহময় আদর পড়লো।বিগলিত হলেন তিনি।এমনিতেই মন শান্ত হয়ে গিয়েছে উনার।ইভানের প্রতি যে অসন্তুষ্টটা মনেমনে ছিলো,সেটা কেটে গিয়েছে সেই কখন।তবে ছেলেকে সেটা দেখাতে চাইছেন না বলে মুখেমুখে এতো চোটপাট। তবে ইভানের এবারের কথাগুলো মাতৃত্ব মনে কেমন জেনো দাগ টেনে দিলো।ছেলের ভাগ্য খারাপ মানে!ইভানের কখনো কথায় কেউ কখনো তো কিছু মনে করেনা।তবে কেনো ছেলেটা এমন বলছে?হঠাৎ ইভানের ফের কথায় ভাবনার ঘের কাটলো উনার।
‘তবে সত্যিই তুমি দাদাভাইকে বেশি ভালোবাসো মা।
আর দাঁড়ালো না ইভান।চলে গেলো সে।সেদিকে শূন্য নজরে তাকিয়ে রইলেন তিনি।আজ ইভানের কথায় কোনোরূপ মশকরা ছিলোনা।অতি স্বাভাবিক গলায় ছেলেটা কথাটা বলেছে। তবে কি সত্যিই তিনি ইভানের থেকে নিভানকে বেশি ভালোবাসেন।হয়তো একটু বেশি।মাতৃত্ব মন সেটা বুঝলেও মুখে স্বীকার করলেন না।স্বান্তনা বেগমের দিকে চেয়ে দূর্বল গলায় বললেন।
‘এই ও কেনো বোঝেনা ছোটো।ওরা সবাই আমারই পেটের সন্তান।ওদের সবাইকে আমি একই পেটে ধরেছি।একইভাবে লালনপালন করেছি।ওদেরকে আমি সমান ভালোবাসি।তবে নিভান আমাকে প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি অনুভব করিয়েছে।ওর মধ্যে আমি আমার মাতৃত্বের প্রথম স্বাদ অনুভব করেেছি।ওর মুখে আমি প্রথম মা ডাক শুনেছি।তাই ওর প্রতি একটু দূর্বলতা বেশি আমার।কিন্তু বিশ্বাস কর ছোটো,আমি ওদের সবাইকে সমান ভালোবাসি।আচ্ছা তুই বল,নাফির আর মৌনতাকে তুই সমান না আলাদা আলাদা কম বেশি ভালোবাসিস?
‘নিজের পেটেধরা সন্তানদের কেউ আবার আলাদা আলাদা ভালোবাসতে পারে?নাকি আলাদা নজরে দেখা যায়?তুমি আবার ওর কথা শুনে এগুলো কি বলা শুরু করলে আপা?দেখোনা নাফিম আর মৌনতা সারাদিন কি নিয়ে ঝগড়ায় লেগে থাকে।ওদের ও তো একই কথা,একই অভিযোগ!মা আমাকে নয় তোকে বেশি ভালোবাসে।আমার প্রতিও কি ওদের অভিযোগ কম চলে!তবে সেসব কথায় আমরা অবুঝ হলে চলবে?নাকি চলে?তুমিই আমাকে এসব বোঝাও আবার এখন তুমিই আবার অবুঝ হচ্ছো?
‘ওরা ছোটো,ইভানতো আর ছোটো নয়।ও কেনো বোঝেনা।ও কেনো এমন অবুঝপনা কথা বলে বারবার।কেনো বলে?আমার সব সহ্য হলে-ও, এসব কথা সহ্য হয়না।ও বোঝেনা।
‘আমরা বড়রাই তাই মাঝে মাঝে কঠিন অবুঝ হয়ে যাই সেখানে ওর কথা বাদ দাওতো।ওসব নিয়ে মন খারাপ কোরো-না।বিয়ে করছে তো। বাচ্চার বাবা হোক তারপর সবই ঠিকই বুঝবে।আর ওসব কথা কি আর আজ,ও নতুন বলছে ।ও তো তোমাকে রাগানোর জন্য সবসময় ওসব বলে থাকে।
‘কিন্তু আজ ওর কথা রাগানোর জন্য ছিলো-না।কথাটা মনেমনে আওড়ালেন তিনি তবে মুখে আর সান্ত্বনা বেগমকে জানালেননা।কথা সেখানেই ক্ষান্ত রাখলেন তিনি।নিজ কাজে মনোযোগ দিলেও ইভানের বলা শেষ কথাটা বারংবার মনমস্তিস্কে চলতে থাকলো।
★
বিয়ে উপলক্ষে নীহারিকা বেগমের বাবার বাড়ির আত্মীয়-স্বজন এসেছেন।সাথে নিভানের বৃদ্ধা নানুমা-ও এসেছেন।নিভানের সাথে ভদ্রমহিলার বেশ অমায়িক সম্পর্ক।সকাল সকাল এবাড়িতই উনার আসার কথা শুনতেই, নিভান উনার সাথে দেখা করতে এলো।মান্যতার রুমে আরামদায়ক বিছানায় পা মেলিয়ে বসে আছেন তিনি।নিভানকে দেখেই মিষ্টি হেসে কাছে ডাকলেন।ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন।দুজনের ভালোমন্দ সাক্ষাৎ শেষে নিভানের শ্যামবর্ণ নিটোল কপালে বৃদ্ধা ঠোঁটের আদর দিতেও ভুললেন না।আদর পেতেই,ফিরতে আদর দিতেও ভুললোনা নিভান।নানুমার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে,দ্বিধাহীন উনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।নিভানের চুলের মাঝে নিজের দূর্বল আঙুলগুলো চাপিয়ে নড়াচড়া করতে করতে বেশ রসিকতার সহিত বললেন।
‘কি ব্যাপার বলোতো নানুভাই?তুমি ইদানীং আমার সাথে দেখা করতেই যাচ্ছো-না।যেখানে সপ্তাহে রোজ তোমাকে দেখা যেতো সেখানে সপ্তাহে একদিনও তোমার দেখা নেই।আজ প্রায় দুমাস হতে চললো,অথচ নানুমার কথা মনে নেই।ব্যাপারটা কি?নানুমার নাতবউয়ের দেখা মিললো নাকি?যে নানুমাকে ভুলতে বসেছো?
অপ্রিয় হলপও কথাটা সত্য।তবে সেটা মুখে প্রকাশ করলো না নিভান।মৃদু হেসে নানুমার কথার উত্তর দিল।
–অফিসের প্রচুর ঝামেলা ছিলো।তারমধ্যেও আমি একদিন না জানিয়ে তোমার ওখানে গিয়ে দেখি,তুমি বাসায় নেই।বড়মামাদের ওখানে চলে গিয়েছো।তারপর তো আমি ফোনে তোমার সাথে কথা বলে নিয়েছি,তবুও এই অভিযোগ কেনো আমার নানুর রাঙা বউয়ের?
হাসলেন ভদ্রমহিলা।নিভানের কথার প্রসঙ্গ গেলেননা।প্রসঙ্গ এড়িয়ে নিভানের মাথায় স্নেহপূর্ন হাত বোলাতে বোলাতে বললেন—আমার ছোটো নাতী বিয়ে করছে অথচ বড়নাতী এখনো একটা নাতবউ খুঁজে নিতে পারলোনা।বিষয়টা কিন্তু আমি কিছুতেই মানতে পারছিনা নানুভাই।তাড়াতাড়ি নাতবউ খুঁজে ফেলো?
আমি যে আমার নানুভাইয়ের সুন্দরী বউটা দেখেই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে চাই।
নিভান মৃদু হাসলো।বৃদ্ধার চোখ সেটা এড়ালো-না।তিনি বললে—ব্যাপার কি আমার নানুভাইয়ের মুখে হাসি কেনো?সত্যিই কি নাবৌ খুঁজে পেয়েছো তবে?
নিভান মুখে কিছু বললোনা।তবে নানুমার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা ঘনঘন উপর নিচ নাড়িয়ে হ্যা জানালো।বৃদ্ধা যেনো আসমানের চাঁদ হাতে পেলেন,এমনটাই খুশি হলেন।বললেন–সত্যি বলছো নানুভাই।কোথায় পেয়েছো তাঁকে!আর কে সে?দেখাও দেখি আমাকে।
‘সিক্রেট,নানুমা।তার কথা তো এখন কাওকে বলা যাবে না।
‘নানুমার কাছেও তাকে গোপন রাখতে চাও?নানুমা কাওকে বলবে-না। দেখাও দেখি,সেই সৌভাগ্যবতীকে।যে আমার নানুভাইয়ের শক্তপোক্ত মনটা দূর্বল করে সেখানে জায়গা করে নিতে পেরেছে…
কথা শেষ করতে পারলেন না তারমধ্য সেখানে উপস্থিত হলো নিভানের এক মামতো বোন।নাম ঈশিতা।মেয়েটা বিবাহিত।দুই বাচ্চার মা। নিভানের সাথে মেয়েটার একটা আবেগময় সম্পর্ক আছে।বাবা হারিয়ে যখন নানুবাড়িতে নিভানদের জায়গা হলো।সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকতো ছোট্টো নিভান।মায়ের মানসিক টানাপড়েনে একটা সময় এই বোনটায় তাকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে।যে একটা বছর মামাবাড়িতে ছিলো,তাকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করেছে।আদর ভালোবাসা দিয়েছে।ছোট্ট নিভানকে নিয়মমাফিক খাইয়ে দেওয়া,গোসল করিয়ে দেওয়া, ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া,ঘুরতে নিয়ে যাওয়া।রুটিন ছিলো যেনো মেয়েটার।সেই সময় থেকে মেয়েটার প্রতি কঠিন একটা দূর্বলতা রয়েছে নিভানের।আর তার থেকে দূর্বলতা বোন নামক ঈশিতা মেয়েটার তারপ্রতি।মেয়েটাকে রুমে ঢুকতে দেখেই কিছুটা আনন্দিত গলায় নিভান বললো।
‘ঈশু আপু।তুমি কখন এলে?
মেয়েটা মৃদহেসে সামনে এগোতে এগোতে বললো–এই তো কেবলই আসলাম।কেমন আছিস তুই?আমার ব্যস্ত ভাইটা বুঝি এখন আরও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে!ইদানীং যে তাকে আর বোনের বাড়িতে দেখা যায়না।
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?আর তুমি তো জানো,খুব ব্যস্ত না থাকলে কোনো না কোনো এক ফাঁকে আমি তোমার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।
দুই ভাইবোনের ভালোমন্দ কথা চলতেই থাকলো।তার মধ্যে প্রসঙ্গ পাল্টে নানুমাও যোগ দিলেন।কথার একপর্যায়ে খোলা দরজায় কড়া নড়লো।রুমের সকলের নজর চলে গেলো সেদিকপানে।তবে কড়া নাড়া মানুষটা খেয়াল করলো-না,ভিতরে দু’জন নারী বাদেও একজন পুরুষ পরম আহ্লাদে তার নানুমায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।অথচ পুরুষটা ঠিকই প্রিয় নারীটাকে খেয়াল করলো।অনুমতি পেতেই চায়ের ট্রে হাতে ভিতরে ঢুকলো কৌড়ি।যতো সামনে এগোলো ততো সাদৃশ্য হলো,একজন নারীর পিছনে আরেকজন নারীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকা পুরুষটাকে।অপ্রস্তুত হলো সর্বাঙ্গ।মূহুর্তেই ভিতরে ভিতরে শিহরে উঠলো তার পেলব শরীর।অকারণেই বুক ঢিপঢিপ করতে লাগলো।পায়ের গতি কমে গেলো।তবে থামলো না।মনেমনে আশ্চর্যও হলো।এতোটা আবেগময় হতে এই মানুষটাকে কখনো দেখিনি।সবসময় গম্ভীর্যরূপে ফর্মাল ড্রেসে শুধু বাড়ির বাহির যেতে আর ঢুকতে দেখেছে সে।এবাড়ির কখনো কারও সাথে হাসিমজা বা এরকম কোনো আবেগঘনো দৃশ্যমান হতে দেখিনি।
মাথা নিচু করে বেডের পাশে এসে চায়ের ট্রেটা বেডের পাশে টেবিলেটায় রাখার আগেই পুরুষালী কন্ঠে হাত কেঁপে উঠলো তার।
‘ট্রে একদম টেবিলের উপর রাখবে-না।ট্রে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তুমি।
আশ্চর্য হলো উপস্থিত তিন নারীর মধ্যে দু’জন নারী।
আড়ষ্টতায় সামনে দাঁড়ানো সুন্দরী মায়ময় মেয়েটার পানে তো এক একবার নিভানের পানে তাাকালো তারা।
নিভান তো এমন ছেলে নয় তবে এমন কথা কেনো বলছে?আর মেয়েটাই বা কে?খুব সুন্দর মেয়েটা এবাড়িতে আগে কখনো দেখেননি উনারা।তবে কে?যার সাথে এমন আচারন করছে নিভান?আর নিভানতো এমনিতেই মেয়ে দেখলে,নিজের আগ্রহ টোটাল সেখানে খরচ করেনা।সেখানে মেয়েটার সাথে অকারণে এমন ব্যবহার।নিভানের নানুমা খেয়াল করে কৌড়িকে দেখতে থাকলেও,ঈশিতা চুপ থাকলো না।কপাল ক্ষীন কুঁচকে নিভানকে উদ্দেশ্য করে বললো।
‘ও অকারণে কেনো দাঁড়িয়ে থাকবে?আশ্চর্য, তুই ওরসাথে এমন করে কথা বলছিস কেনো?
গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো নিভান।–‘দোষ করেছে তাই।
‘মানেটা কি?ও দোষ করলো কখন?ও হয়তো কার-ও আদেশে চা দিতে এসেছে।এখানে দোষের কোথায়?
নিভান কথা বললো না।শান্ত নজরে শুধু কৌড়ির অপ্রস্তুত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।কাল কতো করে বললো,অল্প সময়ের জন্য হলেও তারসাথে যেনো দেখা করে।অবশ্যই দেখা করে।কিন্তু ফাজিল মেয়েটা,এরপর আর টোটাল দেখাই দিলো-না তাঁকে।
নিভান নিজেকে কিভাবে শান্ত রেখেছিলো, সেটা শুধু সেই জানে।নানুমা খুব খেয়াল করে নিভানকে দেখলেন।বয়োবৃদ্ধ নজরে যেনো বুঝে নিতে পারলেন নাতীর মনের কথা।ফের কৌড়ির সুশ্রী মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন।মজার ছলে বললেন।
‘নিশ্চয় দোষ করছে মেয়েটা।না-হলে আমার নানুভাই অকারনে কাওকে শাস্তি দেওয়ার মতো ছেলে তো নয়।
অপ্রস্তুত হলো আরও কৌড়ি।মানুষটা এখানে আছে জানলে জীবনেও এই রুমের আশেপাশেও আসতোনা।এখন বের হতে পারলেই বাচে।কোনোমতে প্রসঙ্গ এড়াতে স্বভাবমতো নরম কন্ঠে বললো–বড়মা,নানুমার জন্য চা পাঠিয়েছেন।তাই আমি দিতে এসেছি।
ঈশিতা তড়িৎ করে বললো –এখানে দোষের কি করলো ও,যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।আর দাদুমা তুমি ওর হয়ে কথা বলছো!এই তোমার নাম কি?
‘কৌড়ি।
‘আচ্ছা কৌড়ি,তুমি চা রেখে যাও।
সময় নিলো না কৌড়ি।নাম জানা গোলুমোলু দেখতে সুন্দর মেয়েটাকে মনেমনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে চায়ের ট্রেটা রেখে চলে গেলো সে।সেদিকপানে তাকিয়ে নানুমা নিভানের কানের কাছে মুখ নিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন—ওই সুন্দর দেখতে ফুলকৌড়িটাই আমার নাতবৌ তাহলে?
মৃদু হেসে নিভানও ফিসফিসিয়ে বললো–কোনো,পছন্দ হয়নি?
‘ভিষন পছন্দ হয়েছে।আমার নাতীর একবারে যোগ্য নাতবৌ।
নানুমার কথার উত্তর সরূপ অমায়িক হেসে দিলো নিভান।তবে মনেমনে আওড়ালো-সে যোগ্য কি অযোগ্য জানিনা আর জানতে চাইওনা আমি।তবে ওই মায়াহরিনী ফুলকৌড়িটাকেই তোমার নাতীর চাই।
চলবে…