#ফুলকৌড়ি
(২৪)কপি করা নিষিদ্ধ।
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
অফিস বের হচ্ছিলো নিভান।হঠাৎ জাহিদ সাহেবের ডাক পড়ায় চলে গেলো উনার রুমে।দরজার নক করতেই ভিতরে ঢুকতে বললেন তিনি।অসুস্থ শরীর নিয়ে সবসময়ের নিয়মানুবর্তিতা অনুযায়ী বেডে হেলান দিয়ে বসে আছেন।হাতে একটা ইসলামিক বই।নিভানকে আসতে দেখেই বইটা বুকমার্ক করে রেখে দিয়ে নিভানকে উনার পাশে বসতে বললেন।বাধ্য ছেলের মতো বসলো নিভান।নিভান বসতেই রয়েসয়ে তিনি বললেন।
‘কালরাতে নওশাদ সাহেব ফোন দিয়েছিলেন?
‘উনার সাথে তো অফিসিয়াল সকল কথাবার্তা কমপ্লিট হয়ে গেছে।এরপর সমস্ত অফিসিয়ালি সুবিধা অসুবিধা তো আমার সাথেই মিটানোর কথা।আপনাকে কিজন্য ফোন দিলো?
‘অফিসিয়াল কোনো কথাবার্তা বলার জন্য উনি ফোন দেননি।ব্যাক্তিগত কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলেন।
ভিতরে ভিতরে একটু চমকালো নিভান।সেদিন নওশাদ সাহেবের ছেলে বিহানের বিহেভিয়ার সম্পর্কে স্মরণ হতেই মনটা আরও উচাটন করে উঠলো।কোনোভাবে কি কৌড়ির বিষয়ে বলেছেন উনারা।মন মস্তিষ্কে মধ্যে বিভিন্ন ভাবনা চললে-ও নিজের বহিঃপ্রকাশ স্বভাবিক রাখলো।বললো– ব্যাক্তিগত!কি বলতে চাইছেন উনি?
‘উনার একমাত্র ছেলে বিহানের জন্য মান্যতার হাত মেনেছেন।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নিভান।ফের নিজের জায়গায় তৃনয়কে ভাবতেই বললো–আপনি কি বলেছেন?
‘আমি উনাদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কোানো সিদ্ধান্ত জানাইনি।তুমি তো ভালো করেই জানো,আমার সকল সিদ্ধান্ত তোমার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে।তুমি হ্যা বললে তবেই আমি সেটাতে মতামত প্রকাশ করি,না বললে নয়।উনারা প্রস্তাব রেখেছেন,আমি শুনেছি।আর আমার সিদ্ধান্ত সরূপ বলেছি,আমি আমার পরিবারের সিদ্ধান্ত ছাড়া তাদেরকে হ্যা বা না কোনো মতামত দিতে পারবো-না।এমনকি আমার মেয়ের মতামতটা-ও জরুরি।আর তার থেকেও তোমার মতামতটা বিশেষ।আমার মনেহয় তুমি মান্যতার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিবে,মান্য তা কখনোই অমত পোষন করবে বলে মনে হয়না।এখন তুমি বলো আমার সিদ্ধান্ত কি নেওয়া উচিত।উনাদের ফ্যামিলি ব্যাকগাউন্ড বা ছেলে সবদিক দিয়েই তো বেশ ভালো।খোঁজখবরও না-হয় নেওয়া যাবে।তোমার কি মতামত?
‘আপনি না বলে দিন।
জাহিদ সাহেবের কথাগুলো শুনতে শুনতে মূহুর্তেই সেদিনের বিহানের নজরভঙ্গির দৃশ্যটা মনে পড়ে গেলো নিভানের।সেই দৃষ্টিতে লালসা বা কোনো কুরুচিপূর্ণ দৃষ্টিভাব ছিলোনা।তবে মুগ্ধতা ছিলো সীমাহীন।আর সেই মুগ্ধ হওয়া দৃষ্টির মালিকের মনে,সেই সৌন্দর্যমীয়কে নিয়ে ঠিক কি কি ভাবনা গড়াতে পারে, তা নিয়েই সেদিন অযথা ক্ষিপ্ত হয়েছিলো নিভান।আর সেই পুরুষটা হবে তার বোনের পুরো জীবনের জীবনসঙ্গী।কখনো না।আর তারথেকে মুল বিষয় হচ্ছে, তৃনয়।বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখার জন্য,বন্ধুর বোনকে পছন্দ করা সত্ত্বেও কখনো তা প্রকাশ করেনি।মান্যতার সাথে সম্পর্ক গড়ার থেকে,বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখাটা তারকাছে বিশেষ মনে হয়েছে।বিধায় সেই অনুযায়ী, নিজের অনুভূতি ভিতরে চাপা দিয়ে এতোটা বছর চলে এসেছে।অথচ মান্যতাকে পাওয়ার কতো আকুলতা কতো প্রয়াস ছেলেটার।যা ক্ষনে ক্ষনে টের পেয়েছে নিভান।মান্যতাকে দেখলেই তৃনয়ের হাসফাস।নজর এড়িয়ে ঘুরেফিরে সেই মান্যতার মুখটাতেই মুগ্ধ চাহুনীতে তাকানো।মান্যতার কোনো বিষয়ে কখনো কথা হলে খেয়ালী হয়ে তার কথা শোনা।নিজের ব্রাইড লাইফ ছেড়ে দেশে চলে আসা।যা সবকিছু বুঝেছে তৃনয়ের এলোমেলো কথাকাজে আর আচারনে। তখন সেসব বুঝলে-ও বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি নিভান।তবে এখন গুরুত্ব দিতে হচ্ছে।কারন,নিজেরও যে একই দশা।
পছন্দের নারীকে ক্ষনে ক্ষনে দেখার তীব্রতা,নিজের করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা,সর্বাবস্থায় তাকে কাছে রাখার ইচ্ছেটুকু কিভাবে ভিতরে কুঁড়ে কুঁড়ে জ্বালায়।আর তাকে না পাওয়ার ভাবনা।উফফ…সেই ভাবনাটা আর ভাবতে চায়না নিভান।যদিও তৃনয় আর মান্যতার বিষয়টা আলাদাভাবে ভেবে রেখেছিলো সে।তৃনয় চাকরী পেলেই,জাহিদ সাহেবের কাছে মান্যতাকে নিয়ে তৃনয়ের বিষয়টা তুলে ধরবে।তবে তার আগেই যখন কথা উঠলো,তখন বিষয়টা নিয়ে কথা বলাই সমীচীন।
‘আচ্ছা ঠিক আছে,আমি তাদের না বলে দেবো।তবে না বলার কারনটা কি আমি জানতে পারি নিভান?
‘আপনার তৃনয়কে কেমন লাগে?
হঠাৎ তৃনয়ের বিষয় উঠায় বিশেষভাবে বুঝতে পারলেন না জাহিদ সাহেব,নিভান ঠিক কি বলতে চাইছে।তবুও তিনি বললেন–ছেলেটাকে তো সেই কবে থেকেই দেখে আসছি।সবদিক থেকে তো বেশ ভালোই।পড়াশোনায়ও তো বেশ ভালো ছিলো।বাহিরের দেশ থেকে এমবিএ ও করে এসেছে।যদি-ও বাহিরের দেশে তার ব্রাইড লাইফ ছিলো,তবে দেশে এসে ব্যবসায় নেমেছে।এটাও তো বেশ ভালো।তা হঠাৎ তাঁকে নিয়ে জিজ্ঞেস করছো যে?
‘মান্যর জন্য কোনোভাবে তৃনয়কে কি আপনার অযোগ্য বলে মনেহয়?
একটু আশ্চর্য হলেন জাহিদ সাহেব।নিভানের কথার হাবভাব দেখেই যেনো কিছুটা আচ্ করতে পারছিলেন তিনি।মনের মধ্যে তৃনয়কে নিয়ে দোনোমোনো করছিল।আর সেটাই বললো নিভান।তবে সবদিক ভেবে বললো কি নিভান?নাকি বিষয়টা অন্যকিছু?মান্যতা বা তৃনয়ের মধ্যে কোনোপ্রকার সম্পর্ক তৈরী হয়নি তো?না তেমন আচার ব্যবহার তো মেয়েটার মধ্যে লক্ষ্য করেছেন বলে মনে হয়না উনার আর না ছেলেটার আচারনে।আর সেরকম আচারবিধি যদি বাড়ির মেয়ের মধ্যে লক্ষ্য করলে,বাড়ির আর কেউ গলা চড়িয়ে না বললেও,উনার বোন মুখে কুলুপ এঁটে থাকার মতো মেয়ে নন।তবে কি কারনে নিভান কেনো এমন প্রস্তাব রাখলো?নাকি নিজে থেকেই তৃনয়কে মান্যতার জন্য চয়েজ করছে তাই বলছে?তিনি বললেন—অযোগ্য বলে মনে হবে কেনো!
অপছন্দ হওয়ার মতো ছেলেতো সে নয়।তবে তুমি যখন তার হয়ে প্রস্তাব রাখছো,তখন নিশ্চয় তোমার বোনের ভবিষ্যৎ ভেবেচিন্তে।কিন্তু তৃনয়ের তো একটা পছন্দ অপছন্দতা আছে।তুমি-যে তাকে তোমার বোনের জন্য পছন্দ করে রেখেছো, এটা কি সে জানে?আমরা মেয়ে পক্ষের গার্ডিয়ান হয়ে তো আর নিজের মেয়েকে তাদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব রাখতে পারিনা।আগ্রহটা তো তাদের দেখাতে হবে।
জাহিদ সাহেব খোলাখুলি প্রশ্ন না করলেও উনার কথা দ্বারা মুলত কি বোঝাতে চাইছেন সেটা বেশ বুঝলো নিভান।উনি মুলত তৃনয়ের মনোভাবটা বুঝতে জানতে চাইছেন।তৃনয় উনার মেয়ের প্রতি আগ্রহী কি-না?বা উনার কথায় এটাও স্পষ্ট, তৃনয় যদি মান্যতাতে আগ্রহী হয়ে না থাকে তবে নিভান কেনো আগ্রহী হয়ে তার হয়ে প্রস্তাব রাখছে?আর বিহান বা তৃনয়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মনেমনে তিনি হয়তো যোগ্য পাত্র হিসাবে বিহানকেই এগিয়ে দেখছেন।ছেলেমেয়ে বিয়ে দিতে গেলে হয়তোবা বাবা মায়ের নজরভঙ্গি অন্য রকম হয়ে যায়।যেখানে উনাদের ছেলেমেয়ে খুব ভালো থাকবে,খুব সুখে থাকবে।সেই জায়গাটাকেই যোগ্য মনে করেন।হয়তো জাহিদ সাহেবের কাছে সেটাই মনেহচ্ছে,সবদিক থেকে বিহান যোগ্য পাত্র।তবে কেনো তাকে রিজেক্ট করে তৃনয়কে পছন্দ করতে চাইছে নিভান।যেখানে তৃনয়ের মধ্যে সেরকম হাবভাব তিনি টের পাননি।বস্তুত,সেই ছেলে কখনো উনার মেয়ের হয়ে প্রস্তাব রাখেনি।নিভানও সময় নিয়ে বললো।
‘আমার জানা চেনামতে তৃনয় বিশ্বাস এবং ভরসাযোগ্য ছেলে।যেটা আমি-ও জানি,আপনি-ও হয়তো জানেন।নওশাদ চৌধুরীর বা এতোদিন যারা মান্যতার বিয়ের জন্য প্রপোজাল দিয়ে এসেছে,তাদের মতো হয়তো বিত্তশালী পরিবার বা নাম-ডাক তার নেই।তবে যেটুকু আছে আমার বোনকে যথেষ্ঠ সুখে এবং ভালো রাখার যোগ্যতা।আমার বিশ্বাস রাখতে পারবে সে।আর আমার এটাও বিশ্বাস,মান্যতাকে সেভাবে গুছিয়ে রাখার প্রয়াসও সে করবে।একটা দুটো বছর নয়,বিগত আট নয়টা বছর মতো তারসাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক আমার।তার সবদিক বিবেচনা করেই তারপর আপনার কাছে তার হয়ে প্রস্তাব রেখেছি আমি।আর নিজে-ও সিদ্ধান্ত নিয়েছি,মান্যতার জীবনসঙ্গিনী হিসাবে তৃনয়কে।দ্বিতীয়ত আপনি যেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছেন,সেটা বলতে আমার দ্বিধা নেই।তৃনয় মান্যতাকে পছন্দ করে।সেটা আমাদের বন্ধুত্বের কারনে হোক বা নিজের সীমার গন্ডি বজায় রাখার জন্য,কখনো তা প্রকাশ করিনি।তবে আমি তার প্রতিটা পদক্ষেপ লক্ষ্য করে এটুকু বুঝেছি।
মান্যতা তৃনয়ের কাছে ভালো থাকবে।ভালো রাখবে সে আমার বোনকে।সেখানে চারিত্রিক বিষয় বা অন্যন্য সবদিক থেকেই তাকে মান্যতার যোগ্য বলে মনে হয়েছে আমার।তবে এখানে আপনার বা মান্যতার মতামত-ও গুরুত্বপূর্ণ।আপনি আমার সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছেন আমি খোলামেলা জানিয়ে দিয়েছি।এবার আপনি সিদ্ধান্ত নিন,আপনি মেয়ের বাবা হিসাবে ঠিক কি সিদ্ধান্তে এগোবেন।আমার মনেহয় তৃনয় এতোদিন নিজের ভালোলাগাটা মনের মধ্যে চেপে চুপচাপ থাকলে-ও তন্ময়ীর বিয়ের পর,সে একবার হলে-ও নিজের পছন্দের কথা ভেবে আমাদের কাছে প্রস্তাব রাখবে।আপতত ততোসময় পর্যন্ত আমি চুপ থাকছি বা থাকতে চাইছি।আমি নিজেও চাইছি সে নিজ থেকে প্রস্তাব রাখুক আমাদের কাছে।এখন আপনি সবদিকে ভেবে দেখুন তাকে মেয়ে দেওয়া যায় কি-না।
‘এখানে ভাবাভাবির কিছু নেই।যেখানে তুমি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছো।সেখানে আমার না করার প্রশ্নই আসে না।আমি বরাবরই তোমার সিদ্ধান্তে বিশ্বাস রাখি,ভরসা করি।সেখানে তোমার সিদ্ধান্ত দ্বারা মান্যতার ভবিষ্যত খারাপ হতে পারে,এটা কখনোই আমি ভাবতে পারি-না।তবে একটাই আশা রাখছি,তৃনয় নিজে প্রস্তাব রাখবে।না হলে আমি এটাও আশা রাখছি তোমার সিদ্ধান্তও না হবে।
‘হুমম।আমি-ও সেটার অপেক্ষায় আছি।
আরও কিছুসময় কথা বলে উঠে দাঁড়ালো নিভান।জাহিদ সাহেব-ও নিজের কাজে মনোবেশিত করলেন।
★
চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে নিভান।চোখ বন্ধ রেখে গভীরভাবে কিছু ভেবে চলেছে সে।ভাবনার বিষয়বস্তু কৌড়ি।মেয়েটাকে যতোটা সহজ সরল ভেবেছিলো,মেয়েটা ততোটা সহজ নয়।হ্যাঁ,শান্তশিষ্টতা ঠিক আছে।তবে একেবারেই নরম মনের নয়।ওই কাজলকালো চোখে চোখ রেখে সেটা বুঝতে পেরেছে নিভান।মেয়েটা তার চালচলনেও কিছুটা বুঝিয়ে দিয়েছে তা।শান্তশিষ্ট, নম্রতা তার বাহিরের রূপ, ভিতরে সে শক্তপোক্ত এক কঠিন মনের মানবী।যাকে নিজের প্রতি দূর্বল হওয়াটা সহজ হবে বলে মনে করছেনা সে। আর ওই মানবীকে নিজের প্রতি দূর্বল করা যতোটা সহজ ভেবেছিলো ততোটাও সহজ হবে-না।আত্নকেন্দ্রীক ওই মানবী,বাধ্য হয়ে এ-বাড়িতে থাকলেও,নিজের সীমাবদ্ধতা বজায় রেখে চলছে।এটা সে অল্পস্বল্প মায়ের মুখ থেকে শুনেছে,জেনেছে।চাওয়া পাওয়া, ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা,চলনবলনে,সবকিছুতেই নাকি মেপে মেপে চলা তার।ছোট্টো একটা মেয়ে অথচ নিজের সীমাবদ্ধতা বজায় রেখে মেপে মেপে তার প্রিয় ব্যক্তিদের দেওয়া ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী চলেছে, মানা যায়!এতোটা বাধ্য হয়ে এখানকার যুগের মেয়েরা চলে!নাকি চলতে চায়?মৃদু হাসলো নিভান।মনেমনে আওড়ালো-তোমার শান্তশিষ্টতার পরপরই বাধ্যতা আর নিজকে সংবরণ করে রাখা,আমাকে তোমার প্রতি আরও আকৃষ্ট করেছে,আমার মায়াহরিণী যাদুময়ী।আর সেই আকৃষ্টতার অনুভূতি জানান দেয়,তুমি শুধু আমারই হবে কাশফিয়া আহসান কৌড়ি।শুধুই নিভানের।যেখানে নিভানের হৃদয়ে চাপা দেওয়া কঠিন পথরটা তুমি চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে নিজে ঘাঁটি পেতে শক্তপোক্তভাবে জায়গা করে নিয়ে বসেছো,সেখানে তো তুমি বাধ্য নিভানের হতে।এখন সে তুমি যতোই কঠিন মনের হওয়া কেনো,আর নিজেকে যতোই পরপর ভেবে সংবরণ করে নিজের সীমাবদ্ধের মধ্যে আঁটকে রাখো না কেনো!তুমি তো নিভানেরই।
দরজায় কড়া পড়তেই,চোখ মেলে সোজা হয়ে বসলো নিভান।সামনে তাকিয়ে দেখলো তৃনয় এসেছে।ফের গা এলিয়ে দিলো চেয়ারে।ভিতরে ঢুকলো তৃনয়।মৃদু হেসে গান ধরলো।
‘পৃথিবীতে সুখে বলে যদি কিছু থেকে থাকে তার নাম ভালোবাসা,তারই নাম প্রেম।
চেয়ারে শরীর এলোনো ভঙ্গিতেই কপাল কুঁচকে তৃনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিভান বললো।–তোর আবার ইভানের রোগে পেলো কবে থেকে?
চমৎকার হাসলো তৃনয়।চেয়ারে বসতে বসতে মজার গলায় বললো—যেদিন থেকে ইভানের ভাইয়ের মতো আমার বন্ধুটাও প্রেমে পড়েছে সেদিন থেকেই আমার বন্ধুটাকে দেখলেই সময় অসময়ে বসন্ত ঋতুটা ভর করছে আমার কন্ঠে।তা আমার বন্ধুটার প্রাণপাখিটার খবর কি?
শান্ত চোখে তৃনয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো নিভান।তৃনয়ের কথার উত্তর দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজনবোধ করলো-না।সময় নিয়ে বললো—সন্ধ্যায় তন্ময়ীর গায়ে হলুদ তুই এখন এখানে কি করছিস?
‘ওদিকে আপতত আজকের অনুষ্ঠানের সবকিছু কমপ্লিট।আর কিছু কাজে শপিংয়ে এসেছিলাম,সেটাও আপতত শেষ।বাড়িতে যা মানুষের মেলা,মাইন্ড ঠান্ডা রাখার জন্য মনে করলাম তোর এখান থেকে একটু ঘুরে যাই।তাই চলে এলাম।কেনো,ডিস্টার্ব করলাম নাকি?
‘তোর মনেহচ্ছে আমি ডিস্টার্ব হয়েছি?
‘তুই ডিস্টার্ব হোস-নি।তবে তোর মন মস্তিকের অলিগলিতে যে চলছিলো তাকে তো ডিস্টার্ব করে দিলাম।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।তৃনয়ের মজার ছলে বলা কথাটার ফিরতি উত্তর দিলো না।দেওয়াটা সে মোটেই প্রয়োজন অনুভব করলো না।যেদিন থেকে কৌড়ির প্রতি তার দূর্বলতা টের পেয়েছে তৃনয়।সেদিন থেকেই ইভানের মতো সে-ও কৌড়িকে নিয়ে পিছু লেগে আছে।
পাত্তা দিলে অসভ্যগুলো আরও পিছু লেগে থাকবে। তাই আপতত পাত্তা দিতে চাইছেনা সে।নিভানকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ফের মজা করে তৃনয় বললো।
‘বল,সে অলটাইম তোর মাথার মধ্যে ঘুরছে কি-না?
‘মাথার মধ্যে ঘুরুক আর নাই ঘুরুক।সে এমনিতেই আমার।আর যে আমার,সে তো আমার মনমস্তিকের সর্বক্ষণের সঙ্গী।তাকে আবার আলাদাভাবে ভাবার বা মাথার মধ্যে ঘোরার কি আছে!
দুষ্ট হাসলো তৃনয়।বললো-ক্যা বাত হে,আমাদের নিভান সাহেব তো পুরোদস্তুর প্রেমে পিছিল গায়া।দেরী করছিস কেনো? বিয়ে করে নে।
চেয়ারে হেলান দেওয়া অবস্থায় চোখ বন্ধ করে নিলো নিভান।ফের নির্বিকার কন্ঠে বললো–দুনিয়াটা দেখা’র একটু সুযোগ করে দেই।দেখুক দুনিয়া,চারপাশটা নজর খুলে দেখুক,বুঝুক।বুঝুক আমাকেও।তার কখনো যেনো না মনে হয়,সে আমার থেকে-ও বেটার কাওকে পেতো।যদিও পাওয়ার মতো মেয়ে সে,তবুও যেনো মনে নাহয় ।অন্তত আমাকে বোঝার জন্য তাকে অবাধ চলাফেরার সুযোগটা তাকে আমি দিতে চাই।
‘তুই কি তাকে দীবার মতো ভাবছিস নিভান?কৌড়িকে কিন্তু আমার তেমনটা কখনোই মনে হয়-নি বা হয়ও না।
চোখ বুঁজে থাকা অবস্থায় নির্বিকার গলায় ফের বললো নিভান।
‘কখনো না।দীবা আর সে,দু’জনেই সবদিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।আমি কখনোই তাকে দীবার সাথে তুলনা করে ছোটো করে দেখতে চাইনা।আর ও সেরকমও নয়।যদি ও সেরকম হতো,তবে কখনোই নিভান তারপ্রতি দূর্বল হয়ে পড়তো না।ও আমাকে তারপ্রতি দূর্বল করেছে!তুই ভাবতে পারছিস?নিভানকে ওর প্রতি দূর্বল করে ফেলেছে।আর তাকে দীবার সাথে তুলনা করলে নিজেকেই যে ছোটো করা হয়ে যায়!তুচ্ছ দেখানো হয়!সেই নিজেকে এতোটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেখি কি করে!যাই হোক,ওর সম্পর্কে ধারণা আমার নিজের মতো,অন্যরকম।আর সবচেয়ে বড়কথা দীবা ম্যাচুউর ছিলো।তবুও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে।সেই তুলনায় বয়সটা ওর নিতান্তই কম।এরকম বয়সে ছেলেমেয়েরা আবেগে ভাসে-ডোবে।সেই আবেগের সিদ্ধান্তটা যেনো আমি না হই ওর।আমাকে চাইতে হবে ওর মনেপ্রাণে।আর কিচ্ছু চাইনা,শুধু এটুকু চাই ওর থেকে আমি।শুধু ওটুকুই চাই, ও আমাকে মনেপ্রাণে চাক।আমার মতো করে আমাকে ছাড়া ও আর দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে না বুঝুক, না ভাবুক আর না চাক।
‘তবে কি তুই ওর সিদ্ধান্তকে নিজের অনুভূতির থেকেও প্রায়োরিটি দিতে চাইছিস?
‘দেওয়াটা উচিত নয় কি?নিভানের জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের প্রতি দূর্বল অনুভব করেছে সে।তার প্রতি কি একটু ভরসা বিশ্বাস রেখে দেখা উচিত নয়কি?সেই সময়টা পর্যন্ত না-হয় আমি আমার মতো করে ওকে আগলে রাখার চেষ্টা করলাম।অমূল্য কিছু পেতে গেলে তো ধৈর্য্য ধরতেই হবে।সেই জিনিসটার প্রতি অটুট বিশ্বাস ভরসা রাখতে হবে।আর ওর প্রতি কেনো জানি না,সেই ভরসা বিশ্বাসটা আমার আপন ইচ্ছেতেই জন্মে গেছে।কেনো জানি মনেহয়,ও আমার ভরসা বিশ্বাস কখনোই ভঙ্গ করবেনা।ও আমারই হবে।আর যদি না হয় তবে,সেই সময়টা পর্যন্ত না-হয় আমি আমার মতো করেই ওকে আগলে রাখলাম।তবে কেনো জানি মন বলে,ও আমারই হবে।শুধু নিভানের।
তৃনয় অবাক হয়ে দেখলো, চেয়ারে গা এলিয়ে রাখা শ্যামবরণ পুরুষটাকে।গায়ের রঙটা শ্যামবরন হলে কি হবে তাকে সুদর্শন সুপুরুষই বলা যায়।লম্বা চওড়া গড়নের গম্ভীর ব্যাক্তিত্বপূর্ন ছেলেটা,কলেজ ভার্সিটি লেবেলে কখনো কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক তো দূর, কথা অব্ধি সেভাবে মেয়েদের সাথে বলতোনা।অথচ এই পুরুষটাতেই মেয়েরা ফিদা ছিলো।তবে সে বিষয়ে কখনো গুরুত্ব দেয় নি নিভান।যাকে রিজেক্ট করে দীবা-ও এখন পস্তাচ্ছে।সেই কাটাকাট আদলের ব্যক্তিত্বপূর্ন পুরুষটা ফেঁসে গিয়েছে এক বাচ্চা মেয়েতে।তার গলার স্বর বলে দিচ্ছে,সে কোন লেভেলের দূর্বলতা অনুভব করে মেয়েটাতে।নিজে চোখে দেখেছে-ও তৃনয়।সেদিন ছেলেগুলোকে যেভাবে মারলো।উফফ, জান নিয়ে টানাটানি অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো।ছেলেগুলো হয়তো এখনো হাসপাতালে।অথচ এতো বাড়াবাড়ি করতে কখনো দেখিনি নিভানকে। না নিজের অনুভূতিগুলো এতো খোলামেলা ভাবে ব্যক্ত করতে শুনেছে।সেই ছেলে ওই মেয়েটাতে এতোটা দূর্বল অনুভাবিত হয়েছে,যে নিজের অনুরক্তিগুলো মনের মধ্যে আর চাপিয়ে রাখতে পারলোনা।কাওকে মন থেকে নিজের করে চাওয়ার অনুভূতির তীব্রতা হয়তো এমনই।তবে সে কেনো পারছে না ব্যক্ত করতে।তবে কি তার চাওয়ায় খামতি আছে?হয়তোবা!তৃনয়ের ভাবনার মাঝে,চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলো নিভান।তৃনয়কে গভীর ভাবতে দেখে সময় নিয়ে বললো
‘ নওশাদ চৌধুরী,মান্যতাকে উনার ছেলের বউ করার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।এতোদিন অনেক প্রস্তাব এসেছে,নাকচ করে দিয়েছেন।এবারেরটা আর ফিরিয়ে দিতে চাইছেন-না।আমার কাছে মতামত চেয়েছেন উনি।কি করা যায় বলতো?
ছলাৎ করে উঠলো তৃনয়ের ভিতরটা।তোলপাড় শুরু হলো হৃদপিণ্ডে।এই চুপিচুপি ভালোবাসার যন্ত্রণা এতো দিন তাকে কষ্ট দিলেও, এতোটা ব্যথা অনুভব করায়নি।কি বলছে নিভান!মান্যতার বিয়ে!মেয়েটা অন্য কারও হয়ে যাবে?তা কি-করে সম্ভব!সহ্য করবে কি-করে সে?বুকে ব্যথা নিয়ে ধীরকন্ঠে জিজ্ঞেস করলো সে।
‘এতো তাড়াতাড়ি কেনো?
তৃনয়ের মুখের দিকে দৃঢ় নজর ফেলে নিভান বললো–
‘এতো তাড়াতাড়ি কোথায়?তন্ময়ী আর মান্যতাতো সেম ইয়ার।তন্ময়ীর এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যেতে পারলে, মান্যতার কেনো হতে পারবে-না।
‘হুম।তা তো ঠিক।তবুও ওর পড়াশোনা কমপ্লিট হওয়ার পর তো বিয়ের ভাবনাটা ভাবতে পারতিস?
‘এখন তো আর সেই যুগ নেই।যে পড়াশোনা অবস্থায় মেয়েকে বিয়ে দিলে,ওখানেই সেই মেয়ের পড়াশোনাটা শেষ হয়ে যাবে।শ্বশুর-বাড়ী থেকে আর পড়াশোনা করতে দেওয়া হবে-না।সুতারাং ভালো প্রস্তাব হাতছাড়া করে লাভ আছে কি!
কথার বাহানা দেওয়ার জন্য আর কোনো শব্দ খুঁজে পেলো-না তৃনয়।ভিতরে ভিতরে হাস-ফাস করে উঠলো বক্ষস্থল।বলবে কি নিভানকে যে,তোর বোনটা আমাকে দিয়ে দে।আমি তাকে,তোর বাবা আর তোদের চেয়ে-ও খুব যত্নে আমার কাছে গুচ্ছিত রাখবো।খুব ভালোবেসে আগলে রেখে দেবো আমার কাছে।পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা কুড়িয়ে এনে হাজির করবো তার পায়ের কাছে।তাকে দিয়ে দে না নিভান আমাকে।আমার বুকটা খালি হতে দিসনা নিভান।বুকের বা পাশটায় তোর বোনটা না থাকলে যে আমি আর আমি থাকবো না নিভান।আমি তৃনয় অর্থহীন হয়ে যাবো।
তৃনয়ের ভিতরের ছটফটানিটা জেনো মুখাবয়বে হালকা হলেও অনুভব করতে পারলো নিভান।নিজেও যে সেই একই জ্বালায় ভুক্তভোগী।তবে কেনো বুঝবেনা অন্যের ভিতরের জ্বালা।বেদনা!আর তৃনয়কে যে সাহস নিয়ে বলতেই হবে। না হলে তাকে যে হারাতে নিজের একান্ত চাওয়া পাওয়াটা।হারাতেই হবে।
★
ধরণীতে সন্ধ্যা নামনাম ভাব।সূর্যটা কমলা রঙের আভা ধারন করে প্রায় ডুবুডুবু অঙ্গসাজ।সেই সময়টাতে নিভানের গাড়ীটা বাড়ির পার্কিং এরিয়ায় এসে থামলো। এই সময়টাতে কখনো বাড়িতে আসেনা নিভান।আজ আসার কারন,তন্ময়ীর গায়ে হলুদ।সেখানে যেতে হবে তাই।যদিও অফিস থেকেই যতো পারতো সে।তবে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে সে জানতে পেরেছে,তাহার যাদুময়ী মায়াহরিনীটা সেখানে যায়নি।ম্যাডামের নাকি কোনো কারনে প্রচন্ড শরীর খারাপ।বিধায় বাড়ির সবাই তন্ময়ীর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেও,তিনি যাননি।কি কারনে শরীর খারাপ তথ্যটা ঠিকঠাক পায়নি নিভান।তবে এটুকু তথ্য পেয়েছে,মেয়েটার প্রচন্ড পেটব্যথা এবং হাতপায়ের যন্ত্রণায় কাতর সে।তাই যেতে চায়নি নিজেই।কিন্তু মেয়েটা ছাড়া ওখানে নিজে কি-করে কাটাবে।আর দ্বিতীয়ত অসুস্থ মেয়েটাকে দেখার তীব্র বাসনা জেগেছে মনে।তাই সরাসরি অনুষ্ঠানে না গিয়ে বাড়িতে এসেছে সে।গাড়ী থেকে নেমে ডোরবেল বাজাতেই রানী দরজা খুলে দিলো।ভিতরে প্রবেশ করতেই স্বাভাবিক গলায় নিভান শুধালো।
”কৌড়ি কোথায়,রানিসাহেবা?
কৌড়ির খোঁজ নেওয়াতে একটু আশ্চর্য হলো রানী।তবে সেটা প্রকাশ না করে,সে-ও স্বাভাবিক গলায় বললো–নিজের রুমে শুয়ে আছে।
“ও-কে বলুন রেডি হয়ে নিতে।আর আপনিও রেডি হয়ে নিন।আমারা এখন তন্ময়ীর হলুদ অনুষ্ঠানে যাবো।
‘মেয়েটার তো শরীর খারাপ বাবা!ও যাবে কি-করে?
‘শরীর কি বেশী খারাপ লাগছে?তাহলে তো ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন।হয়েছে কি ওর?আর মা জেনেশুনে ওভাবে ও-কে একা রেখে গেলেন কেনো?
নিভানের উদ্বিগ্নতা নজরে পড়তেই দ্বিধায় পড়ে গেলো রানী।কি বলবে সে?মেয়েটার পিরিয়ডের ব্যথা চলছে।আর সেকারণেই অসুস্থ সে।যারকারনে এই অসুস্থ শরীরটা নিয়ে কোনোনতে সে তন্ময়ীর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যেতে রাজি হয়নি।মান্যতা মৌনতা তাকে কত জোর করলো, তবুও মেয়েটা রাজী হয়নি।এমনকি তারা নিজেরাও যেতে চাইছিলোনা।শেষমেশ তার অসুবিধার কথা জানিয়ে তাদেরকে পাঠানো হয়েছে।আর নীহারিকা বেগম,তিনিও তো মেয়েটাকে এই অবস্থায় রেখে যেতে চাননি।তবে তিনি না গেলেই নন।তাই সবকিছু বিবেচনা করে,রানীকে-সহ কৌড়িকে রেখে যেতে রাজী হয়েছেন।আর এটাও বলে গিয়েছেন—মেয়েটা একটু সুস্থতাবোধ করলে তাকে জেনো জানানো হয়।হাফিজকে পাঠিয়ে দেবেন,হাফিজ এসে নিয়ে যাবে তাদেরকে।মেয়েটা এখন কিছুটা সুস্থতাবোধ করছে তবে কিছুতেই সেখানে যেতে রাজি নয়।
‘রানীসাহেবা।
সহসা নিভানের ডাকে চমকে গেলেন তিনি।বললেন–সকাল থেকেই মেয়েটার শরীর খারাপ লাগছিলো।তবে এখন ভালো আছে।আর তার তেমন কিছু হয়নি,এই এমনিতেই একটু পেটব্যথা করছে।
‘ব্যথার কোনো ঔষধ খায়নি?
নিভানের এতো খুঁজিনামা দেখে ভিতরে ভিতরে আশ্চর্য হলো রানী।তবে সহসা উত্তর দিলেন–খেয়েছে তো।এখন আপতত ঠিক আছে।
রানীর সংকোচময় উত্তর দেওয়া দেখে মনেমনে কেমন একটা অনুভব হলো নিভানের।সাধারনত কোনো অসুস্থতা হলে তাকে তো খোলামেলা বলার কথা যে, মেয়েটার এই কারনে এই অসুস্থতা বোধ করছে বা অসুবিধা হচ্ছে।তবে কৌড়িকে নিয়ে রানীর কথাগুলো কেমন এড়ানো এড়ানো ভাব।সেটা বুঝতে পেরে সেই বিষয়ে আর ঘাটাঘাটি না করে তাকে আর-ও সংকোচে ফেলতে চাইলোনা নিভান। বললো—যদি শরীর বেশি খারাপ না লাগে তবে ওকে রেডি হয়ে নিতে বলুন।আমরা বের হবো।আর বাহিরে বের হলে শরীর মন দুটোই ভালো লাগবে।
নিভানের তাড়ায় রানীও একপ্রকার হার মেনে কৌড়ির রুমে চলে গেলো।না-হলে আবারও যদি মেয়েটার অসুস্থতা নিয়ে এটা-ওটা নিয়ে প্রশ্ন করে নিভান,তবে সে কি উত্তর দেবে।বিধায় বাধ্য হয়ে কৌড়িকে গিয়ে নিভানের কথাগুলো বলতেই,সে নাকচ করে দিলো।সে যাবে-না।আর ওই মানুষটার সাথে তো কখনোই নয়।কথাগুলো নরমস্বরে বললেও বাহিরে দাড়ানো নিভানর কানে এসে ঠিকই বিঁধলো।হয়তো ওই কন্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায় ছিলো সে।তাই আর আলাদাভাবে কৌড়ির কথাগুলো এসে বলা লাগলো না তাকে।সহসা পা বাড়ালো সে।কৌড়ির রুমের দজার সামনে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দাঁড়াতেই ঘুরে দাঁড়ালো কৌড়ি।বুকের ভিতরের যন্ত্রণাটা মূহুর্তেই বেড়ে গিয়ে ঘনোঘনো উঠানামা শুরু হলো তার।সকাল বেলা কিসব কথাবার্তা বলে গেলো মানুষটা।তারপর কি আর অবিচল হয়ে তার সামনে অটল দাঁড়িয়ে থাকা যায়।এমনিতেই মানুষটাকে দেখলে পরাণ যায়যায় অবস্থা হয় তার।আর সেই মানুষটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাবলেই শরীরের তপ্ততা নেমে গিয়ে শীতলতা ভর করে সেখানে।আর ইদানীং মানুষটা তাকে নিয়ে যা বলা শুরু করেছে।কি করবে কি বলবে ভেবে পায়না সে।
‘রানীসাহেবা আপনি গিয়ে রেডি হয়ে নিন।ও যাবে।
নিভানের দিকে পিছে ফিরে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কৌড়িকে একপলক দেখে নিয়ে রুমের বাহিরের দিকে পা বাড়ালো রানী।সহসা কৌড়ি বললো–উনাকে বলে দিন রানীসাহেবা,আমি যাবো-না।আমার ভালো লাগছে না।
‘আপনি গিয়ে রেডি হয়ে নিন।ও যাবে।
কৌড়ি আর দ্বিতীয় কথা বলার সাহস পেলোনা।রানীও আর দাঁড়ালো না।তবে দরজার সম্মুখীন গিয়ে পিছে ফিরে তাকালো সে।নিভানের কথা-কাজ যেনো উনার সুবিধার ঠেকলো না।এতোবছর ছেলেটাকে দেখে আসছে।কখনো কারও উপর জোর খাটাতে দেখেনি,সেই ছেলে কৌড়ির উপর জোর খাটাচ্ছে।আর কৌড়ির প্রতি নিভানের দৃষ্টি,গলার স্বর।একটুও ঠিক লাগলোনা।কোনোকারনে দুই মানব মানবীকে যে-যার জায়গায় অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু হেসে চলে গেলেন তিনি।রানী চলে যেতেই নিভান মুখ খুললো।
‘কৌড়ি।
ছলকে উঠলো জেনো শরীরের সমস্ত রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাহিত রক্তকণিকা।হৃদপিণ্ড আরও দ্বিগুণ মাত্রায় ছটফটিয়ে উঠলো।ডাকের উত্তর দেওয়ার সাহসটা আর হয়ে উঠলো না।নিজের পরিহিত জামাটা দু-পাশের আস্তিন দু’হাতের মুঠোয় শক্ত করে খামচে ধরে পাথর কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।বিপরীত মানুষটা থেকে উত্তর পাওয়ার আশাটা করলোও না নিভান।বললো।
‘শরীর খারাপ লাগছে যেতে চাইছোনা,ঠিক আছে।তবে আমার সাথে কেনো যাবেনা বলছো?আমাতে তোমার সমস্যা কোথায়?
আপনি মানেই তো ভয়ঙ্কর সমস্যা!কথাটা চেয়েও দিতে পারলোনা কৌড়ি।ওই গম্ভীর স্বরের মালিকের মুখে মুখে তর্ক করাটা কি এতোটাই সহজ বিষয়।কৌড়িরতো মোটেও সহজ বলে মনে হয়না।কেনো জানি পারেনা সে তর্ক করতে।কৌড়ি উত্তর দেবেনা বুঝে নিভান ফের বললো।
‘তোমার জন্য রানীসাহেবা-ও যেতো পারছে-না।নিজের আনন্দ অনুভূতি চেপে রেখে তোমাকে সঙ্গ দিচ্ছে এটা কি তোমার ভালো লাগছে?
এবার খারাপ লাগলো কৌড়ির।সত্যিই তো।মুখ খুললো সে।আলতোস্বরে বললো—তবে আপনি উনাকে নিয়ে যান।আমার সমস্যা হবেনা,আমি থাকতে পারবো।
এতোটা জেদী এতো কঠিন হৃদয়,ওই মানবীর সচ্ছ মুখের আদলে তো সেটা বোঝা যায়না।মায়ামায়া মুখটার দিকে তাকালে মনেহয়,ভেতরটা তার মোম গলানো তরল।অথচ তার গলার স্বরটা বলে দিচ্ছে,তিনি কঠিন হৃদয়ের মানবী।তার মন গলানো সহজ কথা নয়।
তবে কি শুধু তার বেলায় কঠিন হতে চাইছে মেয়েটা?কিন্তু কেনো?এই মূহুর্তেই কৌড়ির মুখটা নিজের বাদামীবর্ন চোখজোড়া দিয়ে পরখ করতে ইচ্ছে করল নিভানের।ওই ডগরডগর চোখের ভাষা পড়তে ইচ্ছে করলো।ওই মায়ামায়া মুখাবয়বের এক্সপ্রেশন জানতে ইচ্ছে করলো।আর বলতে ইচ্ছে করলো,কেনো তুমি আমার বেলায় এতো কঠিন হতে চাইছো কৌড়ি?আর কেনোই বা চাইছোনা আমাকে।নিভান তার দূর্বলতা তোমার প্রতি প্রকাশ করে ফেলেছে তাই!মনেমনে নিজের প্রতি নিজেই তাচ্ছিল্যের মৃদু হাসি হাসলো নিভান।নিজের ব্যাক্তিত্বের বাহিরে গিয়ে কখনো নিজেকে মেলে ধরেনি সে।নিজেকে ছোটো করে দেখবে এমন দূর্বলতা দেখায়নি কাওকে।সবসময় নিজের চরিত্রের ভিতর বাহিরটা কঠিন রূপে রূপায়ণ রেখেছে। অথচ এই মানবীর কাছে,এতো বছরের শক্ত খোলসের সেই ভিতরে বাহিরের কঠিন নিভানটা কেমন মূহুর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে তার খোলাসাটা আলগা করে দিলো!
ক্ষনিকের জন্য চোখ বুঁজে দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে ফের চোখ মেলে নিলো নিভান।নজর স্থির করলো,নিজের হৃদ হরন করে নেওয়া সেই মানবীর পানে।হৃদয় এতোটা দূর্বল হয়ে পড়লো কিকরে এই নারীরপানে!যেখানে নিজেকে দূর্বল দেখাতে-ও মন দ্বিধা করছে-না।আর নিজেকে খোসালা রূপে জানাতে তো মোটেই নয়।কিছু সময় দু’দিকের দুই মানব-মানবী নীরবতায় ছেয়ে থাকলো।একজন তার ভাবনায়,অন্যজন মনের হাসফাসে।হাসফাস করা মানবীটি জানে তার পিছনের মানুষটা এখনো তার পিছে অটল দাড়ানো।যায়নি।ভাবনার অতল গভীর থেকে ডুব দিয়ে এসে মুখ খুললো নিভান।ধীরকন্ঠে গুছিয়ে গুছিয়ে খুব সুন্দর করে কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো।
‘শরীর বেশি খারাপ না লাগলে রেডি হয়ে নাও।তোমাকে বাড়িতে একা রেখে ওখানে আমি আমাকে স্থির রাখতে পারবো না কৌড়ি।আর-ও তুমি অসুস্থ,এটা জেনে একটু না!যদি-ও আমাকে ভালো রাখার দ্বায় তোমার নয়,তবে নিজেকে ভালো রাখার দ্বায়টাতো আমার।তুমি ভাবতেই পারো আমি স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি।যেখানে তুমি অসুস্থ জেনে-ও,আমি আমাকে ভালো রাখার জন্য তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাবার জোরবাদী করছি।আজ আমাকে ভালো রাখার জন্য না-হয় দ্বায়টা একটু কষ্ট করে হলে-ও তুমি বহন করো।আমি না-হয় স্বার্থান্বেষী মানুষ, তুমিও একটু না-হয় দয়ামায়াময়ী হলে।
চলবে….
#ফুলকৌড়ি
(২৫)কপি করা নিষিদ্ধ।
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
গোধুলি বিকেল।মাথার উপরে বিস্তৃত আকাশটা কাঁচের ন্যায় সচ্ছ পরিচ্ছন্ন নীল সাদায় মুড়ে আছে।চারপাশের প্রকৃতিভাব নির্মলতায় ছেয়ে।ঝলমলে সুন্দর একটা দিন।একমাত্র বোনের বিয়ে উপলক্ষে কাছের এক বন্ধুর বাংলোবাড়ি ভাড়া করেছে তৃনয়।অবশ্যই বিয়ে উপলক্ষে ভাড়া করতে চেয়েছিলো কিন্তু বন্ধুর বোনের বিয়ে!তাই তৃনয়ের সেই বন্ধুটা ভাড়া হিসাবে না দিয়ে এমনিতেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দিয়েছে।বিয়ে উপলক্ষে বাংলোবাড়িটা সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।গোধুলি লগ্নে মরিচবাতি দিয়ে সাজানো বাংলোবাড়িটা ঝকমকে আলো দিয়ে ঝলমল না করলেও,ফুলের সাজানো গেইট এবং লন এরিয়াতে করা স্টেজ,বেশ নজর কাড়ছে।আপতত সেখানে নিমন্ত্রিত মানুষের সমাগমে ভরপুর।নিভানের গাড়িটা সেই ফুল সাজানো গেইট দিয়ে পার করতেই,লন এরিয়ার মোটামুটি সবার আকর্ষণীয় নজর চলে গেলো সেখানে।গাড়ি নির্দিষ্ট পার্কিং এরিয়ায় এসে থামতেই অনেকের,কৌতূহলী নজর কে এসেছে দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিল।তবে কিছু কৌতুহলী নজর এখনো সেদিকে তাকিয়ে।
গাড়ি থামতেই রানী আগেই নেমে গেলো।ড্রাইভিং সিটে বসা নিভান ততক্ষণাত পাশে বসা রমণীর দিকে তাকালো।যার সুন্দর শুভ্র শোভিত মুখখানা একটা সাদা হিজাবে মুড়ানো।গোলগাল শুভ্র মুখাবয়ব আর হিজাবের রঙটা মিলেমিশে একাকার।মুখের কোনো অংশে নেই কোনো সামন্য প্রসাধনীর প্রলেপন ছোঁয়া।নিভান শান্ত নজরে খেয়াল করে দেখলো,মুখাবয়ব, চোখ,ঠোঁট কোথা-ও কোনো অপ্রাকৃতিক কিছুরই লেশ ছোঁয়ানো নেই।অতিশয় সাধারণ ন্যাচারাল একটা মুখ।তবু-ও কি সুন্দর দেখাচ্ছে সেই বাঁধানো মুখশ্রী।শরতীয় সদ্য পুষ্পিত কাশফুলের ন্যায় স্নিগ্ধ সে রূপ দেখলে নজর তৃপ্তিময় উঠে।ঘনপল্লবিত ডাগরডাগর আখিযুগল যখন পরপর পলক ঝাপটায়, ইশশ কি-যে কম্পন ধরে বুকে।যদি মেয়েটা সেটা জানতো, বুঝতো!তবে নিজেকে কচ্ছপের ন্যায় খোলাসার মধ্যে লুকিয়ে রাখতো।ভিতরে ভিতরে চঞ্চলা হয়ে উঠলো নিভানের মন।ততক্ষণাৎ তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো সে।বাড়ি থেকে এখানে আসা পর্যন্ত মেয়েটা কাঠের পুতুলের মতো নিশ্চল হয়ে বসে আছে।নজর তার সামনে অবিচল।নাহলে বাঁপাশে খোলা জানালার বাহিরে।তারদিকে তো ভুলেও ফেরেনি।তবে তার কথা রেখে তারসাথে অসুস্থ শরীর উপেক্ষা করেও এসেছে,এটাইতো পরম সৌভাগ্য। ঠোঁটের কোণ মৃদু প্রসারিত হলো নিভানের।সেটা বজায় রেখেই কিছুটা ঠাট্টার স্বরে বললো।
“মায়াহরিনীদের এতো রাগ,এতো জেদ,এতোটা কঠিন রূপ হয় এটা-তো আমার জানা ছিলো-না।তাও আবার শান্তশিষ্ট মায়াহরিনীর!আমার জানা-মতে তাদের ভিতর বাহির সবটা মায়াময় হয়।কিন্তু আমার মায়াহরিণীটির দেখছি ভিন্ন রূপ।নাকি আমি বলে তাই?কারনটা কি যে সে আমার প্রতি সুহৃদয়বান হতে চাইছে না!তার মায়া, শান্তশিষ্টতা,শুধু আমার জন্য নয়!আমার জন্য বরাদ্দ শুধু তার রাগ জেদ আর কঠিন্য রূপ!কেনো?তাকে তার অনুমতি ছাড়া চেয়ে ফেলেছি তাই?নাকি…
কথা শেষ করলোনা নিভান।খিঁচে চোখ বন্ধ করে নেওয়া কৌড়ির পানে শিথিল নজরে তাকিয়ে রইলো।
আমার মায়াহরিণী,বাক্যদ্বয়ে বক্ষস্থলে হৃদকম্পন তুলে দিলো কৌড়ির।তবুও চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস চালালো।বুকের কম্পন যদি-ও শস্য পরিমাণ কমলোনা।বরং দ্বিগুণ তিগুণ বাড়লো।তবুও অস্ফুটস্বরে বললো।
‘গাড়ীর লক খুলে দিন।আমি বাহিরে যেতে চাই।
মুখের মৃদু হাসিটা চওড়া হলো নিভানের।মেয়েটার স্বভাব যেনো না চাইতেও মুখস্থ হয়ে গিয়েছে তার।তাই গাড়ীতে উঠার সাথে সাথে কৌড়ির পাশের দরজা লক করে দিয়েছিল।যেনো গাড়ী থামার সাথে সাথে মেয়েটা না নামতে পারে।একটু জ্বালানো আরকি!আর তার দূর্বলতা যখন মেয়েটা জানতে পেরেছে,তবে আর-ও না হয় একটু জানুক।খোলা বই হয়ে যাক কৌড়ির জীবনে সে।অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে থাকা কৌড়ির মুখের দিকে কিছুসময় তাকিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে দরজার লক খুলে দিলো নিভান।ততক্ষণাত নেমে পড়লো কৌড়ি।নামলো নিভান-ও।দুজনকে একসাথে বের হতে দেখে, দুর থেকে কিছু মানুষের মুখে হাসি ফুটলো।তৃনয়-ও তারমধ্যে একজন।বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলো সে।
তাদের নজরও ছিলো পার্কিং এরিয়ায় নিভানের গাড়ির পানে।ওদের দুজনকে একসাথে বের হতে দেখে উৎসাহী কন্ঠে একজন বললো।
‘নিভানের সাথে মেয়েটা কে?সারাজীবন মেয়েসঙ্গ তো সন্ন্যাসী পুরুষদের ন্যায় এড়িয়ে এসেছে,নিজের মা বোনদের ছাড়া।সেখানে মেয়েটাকে ওর বোন বলে-ও তো মনে হচ্ছে-না।তবে কে?জুড়ি তো একবারে পারফেক্ট মিলেছে।
তৃনয়ের মুখের হাসিটা আরও একটু চওড়া হলো।সমানতালে এগিয়ে আসা কৌড়ির আর নিভানের পানে তার স্থির নজর।আজ হলুদের অনুষ্ঠানে সবাই হলুদ পোশাক পরিহিত।অথচ নিভানের ফুলকৌড়ি আগাগোড়া সাদা ড্রেসআপে।সাথে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি,তারউপরে হালকা হলুদ কোটি পরা নিভানকে। সত্যিই একে অপরের জন্য পারফেক্ট জুড়ি লাগছে।
কিছুটা হেয়ালিপনায়,পাশের বন্ধুটিকে উদ্দেশ্য করেই বললো।—পারফেক্ট জুড়িই তো।নিভানের নজর বলে কথা।
‘মানে কি!নিভান বিয়ে করেছে? করলো কবে?
‘বিয়ে করেনি তো।করলেতো তোরাও জানতে পারতিস।তবে বন্ধু আমাদের ফুলকৌড়িতে মেতেছে।পারফেক্ট না হয়ে যাবে কোথায়!
‘ফুলকৌড়ি মানে?মেয়েটার নাম?
‘হুমম।মেয়েটার নাম।এতোদিনের সন্ন্যাসী নেওয়া নিভান আওসাফ মেয়েটাতে ফেঁসেছে ভালোই।
‘রিয়্যালি
‘আসছে জিজ্ঞেস করে নিস।অবশ্যই জিজ্ঞেস করার দরকার নেই।শুধু বলবি তোর পাশে মেয়েটা কে ছিলো নিভান?মেয়েটাকে আমার দারুন লেগেছে। ব্যাস বুঝে যাবি,মেয়েটা তোর বন্ধুর ঠিক কি!কেমন?
কথাটা একসাথে এগিয়ে আসা মানব মানবীর দিকে তাকিয়ে কিছুটা ঠাট্টার স্বরে বললো তৃনয়।আর তৃনয়ের বলার ভঙ্গি,গলার স্বর একটুও সুবিধার ঠেকলো না ছেলেটার।সেদিকে তাকিয়ে ছেলেটা বোকা হাসার ট্রায় করে পরপর আচমকা কয়েকটা ঢোক গিললো।ভার্সিটিতে পড়াকালীন নিভানের বোন মান্যতাকে একবার প্রপোজ করেছিলো একটা ছেলে।মান্যতা ছেলেটাকে নিষেধ করা সত্ত্বেও ছেলেটা,মান্যতার পিছে ইতুড়ের মতো লেগে ছিলো।মান্যতা না মানায় হুমকিধামকিও দিয়েছিলো।সেসব হুমকিধামকি,বোন এসে ভাইয়ের কাছে অভিযোগ জানাতেই,ছেলেটার যা হাল করেছিলো নিভান।সাথে তারাও ছিল।বিধায় ব্যাপারটা নিজ চোখে দেখা।সুদর্শন পুরুষ হিসাবে খ্যাতিনামা ছেলেটার,সেদিনের ওই ছেলেটার মারের কথা মনে পড়তেই রূহ কেপে উঠলো।নিভান শান্তশিষ্ট তবে যাচিত কারনে রেগে গেলে সে মারাত্মক ভয়ংকর।আর সেই নিভানের পছন্দের মেয়েটার দিকে ভুল নজর পড়া-তো আর-ও আতঙ্কের বিষয়।আর তৃনয় কি না,তাকে হাসপাতালের আইসিইউয়ের দুয়ারে ঠেলে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। যদি-ও সুদর্শন যুবক হিসাবে পরিচিত সে,তবু-ও জীবনে মেয়ে না জুটলেও ওই রমণীর পানে ভুল নজরে তাকানো আর নিজের আত্মা নিয়ে টানাটানি সমপর্যায়ের কথা।
মনেমনে অতশত ভাবলেও নিভান কাছে আসতেই মজা নিতে ছাড়লো না ছেলেটা। সাথে তৃনয়ও।নিভান সেই মজাতে যোগ না দিলে-ও,বিপক্ষে কিছু বললো-ও-না।তবে মনেমনে এক তৃপ্তি অনুভব করলো।কৌড়িকে ঘিরে তাকে কেউ কিছু বললে, আলাদা অন্যরকম এক অনুভূতি হয়।সেই অনুভূতি জানান দেয়,ওই পুতুলের মতো মায়াময়ী মেয়েটা শুধুই তার।
★
গাঁদাফুলের সমাহারে সাজানো গায়ে হলুদের স্টেজে বসে আছে তন্ময়ী।উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ে কাঁচা রঙের হলুদ জামদানীটা আটপৌড়ে জড়ানো।লতানো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে,হলুদ-লালরঙা কৃত্রিম ফুলের গহনায় জড়িয়ে আছে।উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখাবয়বে লেগে আছে হালকা মেকাপের প্রলেপ।চিকন ঠোঁটজোড়ায় লেপ্টে আছে গাঢ় লালরঙা লিপস্টিক।গোলগাল চোখজোড়ার ঘন-পল্লবে ছেয়ে আছে মোটাকরে দেওয়া কাজলরেখা।
কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।আস্ত একটা মায়াপরী।মেকাপ-বিহীন উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখটা আর-ও মোহনীয় দেখায়।এই শ্যামবর্ণ মোহনীয় রূপের প্রেমে পড়েছিলো সেদিন ইভান।যেদিন প্রথম মেয়েটাকে তাদের বাড়িতে দেখেছিলো।দাদাভাই অসুস্থ ছিলো।তৃনয় ভাইয়ার সাথে দাদাভায়েট দারুন বন্ধুত্ব হওয়ায়,অসুস্থ দাদাভাইকে দেখতে এসেছিলেন তৃনয় ভাইয়া,উনার মা আর এই মায়াপরীটা।মেয়েটা মনেহয় তখন সদ্য ইন্টার ভর্তি হয়েছে।গোল কুচিফ্রক পরিহিত চুড়িদার।মাথায় হিজাবে মুড়ানো।চোখে গোল ফ্রেমের চশমা।সোফায় বসে মৃদু হেসে মান্যতার সাথে কথা বলছিলো।কি মিষ্টি লাগছিলো মেয়েটাকে।ভার্সিটি থেকে সবে বাড়িতে ফিরেছিলো ইভান।ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই তীক্ষ্ণ শূলের মতো নজরে বিঁধেছিল,সোফায় বসা হাস্যজ্বল মেয়েটা।মনে বিঁধেছিল,মারাত্মক ব্যাধির ন্যায়।সেই ব্যাধি দিনকে দিন মনমস্তিস্কে ছড়িয়েছে শুধু,সারেনি বৈ।অথচ মেয়েটাকে তা বোঝানোর পর-ও বোঝেনি।হয়তো বা বুঝেছিলো।তার কারনেই সেই নীরবে বুঝপনাটা, আবারও অবুঝপনায় গড়িয়েছে।মনেমনে আওড়ালো।
‘তুমি আমার জীবনের প্রথমা প্রেয়সী।আর সমাপ্তিটা-ও আমি তোমাতেই টানতে চাই।সেখানে তুমি রাগে জেদে অন্য কারও হতে চাইলে,ইভানের চলবে কি করে!
মানুষের আনাগোনা ঠেলে ধীরপায়ে স্টেজের দিকে এগোলো ইভান।তন্ময়ীর পাশে তার বান্ধবী আর কানিজ রিলেটেড কিছু মেয়ে বসা।হলুদ সাজে তাদের রূপের বহরের শেষ নেই।ইভানকে চেনেনা সেভাবে কেউ।তবে হালকা রঙের কাঁচা হলুদ পাঞ্জাবি পরা ইভানের সুদর্শনতায় মুগ্ধ হলো তারা।কিছু মেয়ে গলেও পড়লো।সেটা তাদেরও মুগ্ধ দৃষ্টি আর আচারনেই বোঝা গেলো।তবে সেসব লে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে ইভান মুখে অমায়িক হাসি টেনে বললো।
‘এক্সকিউজ মি ম্যাডামেরা।আমি কি আপনাদের কনের পাশে বসতে পারি একটু?
একজন নয় বেশ কয়েকজন একসাথে আহ্লাদী গলায় বলে উঠলো–ইয়েস,কেনো নয়।শিওর,শিওর।
মুখে বললেও মেয়েগুলোকে সরতে না দেখে ইভান ফের বললো–আমি মুলত আপনাদের কনের পাশেই বসতে চাইছি।সমস্যা হবে নাকি?
ছেলেটা এমনভাবে বলছে যেনো তন্ময়ীকে বিশেষভাবে চেনে।তন্ময়ীর শান্ত চাহুনি আর নীরবতাও সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে যেনো।তাই পাশে বসা মেয়েগুলো সরে বসলো।কিছু মেয়ে উঠে দাঁড়িয়েও পড়লো।তন্ময়ীর নীরব চাহুনীতে স্বাভাবিক দৃষ্টি ফেলে মিষ্টি হেসে তারপাশে গিয়ে বসলো ইভান।এখনো হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয় নি।কনে পক্ষের থেকে সব আয়োজন কমপ্লিট থাকলেও,বরপক্ষের থেকে হলুদের বারাত আসবে তারপর কনের হলুদ মাখানো শুরু হবে।সেটাই এখনো আসেনি।তাই যে যার মতো বিভিন্ন গল্পে মেতে আছে।সেই সুযোগটা ব্যবহার করছে ইভান।যদিও সুযোগ না থাকলেও, কি যায় আসতো বা যেতো!তার কাজ সে কমপ্লিটলি করে ফেলেছে।হলুদের বারাত আর আসবে বলেও মনে হয়না!
তন্ময়ীর সামনে রাখা ছোটোখাটো টেবিলটায় বিভিন্ন পদের মিষ্টি, পিঠা পায়েসের আয়োজন করে রাখা।সেখান থেকে সনন্দে একটা মিষ্টির পাত্রটা উঠিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সেখান থেকে একটা মিষ্টি কাটা চামচ দিয়ে মনোযোগ সহকারে কেটেকুটে খেতে থাকল ইভান।কনের জন্য রাখা মিষ্টি সে এমন নির্বিকার ভাবে খাচ্ছে, যেনো মিষ্টিগুলো তারজন্য রাখা হয়েছে।আর আশেপাশে কে আছে,কে দেখছে,খাওয়া উচিত কি-না! এসবের যেনো বিন্দু পরিমাণ কোনো পরোয়া নেই।কি নির্বিকার আচারন।তন্ময়ীর বিশ্বাস,এই ছেলে নিশ্চিত কিছু অঘটন ঘটিয়ে তারপর এতো শান্ত,এতোটা চুপচাপ।না-হলে এতো নির্বিকার থাকার কথাতো নয়।তেমন ছেলেও যে ইভান নয়।এটা সে বেশ জানে।মনোযোগ দিয়ে মিষ্টি খেতে খেতে শীতলগলায় ইভান বললো।
‘তোমাকে ভারী মিষ্টি আর খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তন্ময়ী।তোমার শ্যামবর্ণ শরীরে হলুদের এই সাজ,উফ!তোমাকে দেখার প্রথম দিনের মতো বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছে।আর সেই হলুদের মোহনীয় সাজটা তুমি অন্য কার-ও জন্য সেজেছো?তোমার জন্য তোলপাড় করা জায়গায়,নিজ হাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছো?কথা-তো এমন ছিলো না।
বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হলো তন্ময়ীর।তবে যতসম্ভব নিজেকে শান্ত আর স্বাভাবিক রেখে শক্তকন্ঠে বললো।
‘তবে কথা কেমন ছিলো?আপনি আমাকে নিজের ভেবে পা দিয়ে চেপে রেখে,অন্য মেয়েদের সাথে ফূর্তি করে বেড়াবেন।আর আমিও সেটা মেনে নিয়ে আপনার হতে রাজি হয়ে যাবো?তেমনটা?এটা আশা করা উচিত আপনার?
শান্ত চাহুনিতে তন্ময়ীর মুখের দিকে তাকালো ইভান।পূর্বের ন্যায় শীতল গলায় বললো।–তুমি ভুল বুঝেছো আমাকে।তোমাকে প্রথম দেখায় ভালো লেগেছিলো আমার।আমি ফালতু ছেলেদের মতো তোমার পিছু লেগে থাকিনি।আর না কখনো ডিস্টার্ব করেছি।আমি শুধু সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি জানিয়ে ছিলাম,তোমাকে আমার ভালো লেগেছে।আমার জীবনের একান্ত নারী হিসাবে তোমাকে চাই।এটাতে কোনোরূপ মিথ্যা ছিলো না,আর না ছিলো সেই সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তিতে ছলনা।ছলনা থাকলে নিশ্চয় তোমার মতো করে স্বাধীনভাবে তোমাকে চলতে দিতাম না।সোজাসাপ্টা একটা প্রেমের সম্পর্কে জড়াতাম।সেখানে আমার ভালোমন্দ চাহিদাও থাকতো।ছিলো কি চাহিদা?পারতাম না আমি সেই সম্পর্কে ছলনা করে নিজের খারাপ মনস্কামনা পূর্ণ করতে?কখনো তেমন কোনো কথাবার্তা হয়েছে আমাদের। নাকি তেমন ব্যবহার পেয়েছো আমার থেকে?তুমি ও তো চাওনি সেরকম প্রেমময় সম্পর্ক হোক আমাদের মধ্যে,সেজন্য তো সময়মতো করে তোমাকে পাওয়ার অনুরোধটা রেখেছিলাম শুধু !
নিস্প্রভ চাহুনীতে মাথা কাত করে তন্ময়ীর কঠিনকরে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো নিভান।উত্তর এলোনা অপরপক্ষ থেকে।আশা করলোওনা ইভান।আবারও বলতে শুরু করলো।—যাই হোক,কিন্তু সেদিন তোমার পক্ষথেকে তুমি আমার মতো করে সোজাসাপ্টা সম্মতি মেলে ধরোনি। দাওনি উত্তর ।তবে তোমার নীরবতাকেই আমি সম্মতি ভেবে নিয়েছিলাম।অন্য সম্পর্কের ন্যায় তোমাকে আমি নিজে কি চাই,সেই গন্ডির মধ্য আঁটকে রাখতে চায়নি কখনো।কেননা তুমি মেয়েটা কেমন?ডিটেইলসে আমার তখন জানাশোনা এমনকি বোঝা-ও হয়ে গিয়েছিলো।তাই চেয়েছিলাম তোমার লাইফ তুমি তোমার মতো করে,যেভাবে আগে চলে এসেছো, সেভাবেই চলো।শুধু সময় যখন আসবে,আমি তোমার মা ভাইয়ের কাছ থেকে চেয়ে নেবো তোমাকে।আর যখন চাইবো তখন যেনো শুধু তোমার সম্মতিটা পাই।আমি তোমাকে চেয়েছি আমার জীবনের একান্ত নারী হিসাবে,কোনো প্রেমিকা হিসাবে নয়।যার কারনে আমার আচারনটা আমি সেরকমই রেখেছিলাম।
থামলো ইভান।বলতে বলতে গলা কঠিন হয়ে এলো তার।ফের বললো –আর একটাই অনুরোধ করেছিলাম তোমাকে।বলেছিলাম, আমার চাওয়ার আগে যদি তোমাকে কেউ তোমার মা ভাইয়ের কাছে চেয়ে বসে, প্লিজ তন্ময়ী আমাকে জানিও।আমার অনুরোধটা তুমি রাখলেই না?এতোটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে!অথচ আমি তোমার নীরবতাকেই সম্মতি ভেবে ভরসা করেছিলাম, বিশ্বাস রেখেছিলাম তোমার উপর।সেই বিশ্বাস, ভরসা তুমি,তোমার নীরব সম্মতির মতোই নীরবেই ভেঙে দিলে!তোমার মোটেও উচিত হয়নি,আমাকে এভাবে অতল সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার।
‘বিশ্বাস ভরসা আপনি রেখেছেন?তবে আপনি কিকরে আমার উপরে সেই আস্থাটা ভরসা করেন?
‘সেই কারণে তুমি আমাকে ভুল বুঝে এরকম একটা পদক্ষেপ নিতে পারো-না তনু!তোমার বিশ্বাস ভরসার জায়গাটা যদি আমার প্রতি নড়বড়ে হয়ে গিয়ে থাকে।
তুমি বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চাইতে আমার কাছে।আমাকে জানাবোঝার,এমনকি যেকোনো বিষয়ে প্রশ্ন করার অধিকারবোধটা কিন্তু আমি আগেই দিয়ে দিয়েছি তোমাকে।সেখানে তুমি আমাকে প্রশ্ন না করে,রাগে জেদে পড়ে বিয়ের মত একটা সারাজীবনের সেনসেটিভ ইস্যুতে নির্দ্বিধায় সম্মতি জানাতে পারো না!
তোমার কি মনেহয় ইভানের জীবনে মেয়ের অভাব পড়েছে,যে তাকে ফিরে আসতে হলো তোমার কাছেই! ইভানের দূর্বলতা ঠিক কোথায়,সেটা অনুভব হলো না তোমার! তুমি একটা মেয়ের সাথে আমাকে ঘুরতে ফিরতে দেখলে আর তোমার মতো করে বিশ্বাস করে নিলে।আর আমাকে ফেললে ফাঁসির দণ্ডনীয় আসামির কাঠগড়ায়।অথচ একনায়কতন্ত্র ভাবে বিচার করলে।সেখানে আসামির ভালোমন্দ স্বীকারোক্তি শোনা জানার প্রয়োজন মনে করলে-না!আর না সেই ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছে জানার প্রয়োজনবোধ করলে!তবে সেদিন কেনো সরাসরি বলে দাওনি,ইভান আপনাকে আমার পছন্দ নয়।আমি আপনার প্রপোজাল একসেপ্ট করতে পারছি না।তবে আমি তোমাকে আমার ভাবার দুঃস্বপ্নটা বুকে লালন করতাম না।
বুকের ভিতর ব্যথার অনুভব সৃষ্টি হলো তন্ময়ীর।কঠিন করে রাখা হৃদয় ভিতরে ভিতরে ভেঙেচুরে চুরমার হলো।সেদিন যখন ইভান সোজাসাপ্টা নিজের অনুভূতি সুন্দরভাবে জানিয়ে দিয়েছিলো।সবদিক ভেবেচিন্তে হ্যা না কিছু না বললেও,মনেমনে ঠিকই ইভানের প্রতি অনুভূতিতে দূর্বল হয়ছিলো সে।মুগ্ধ হয়েছিলো,ইভানের তরফ থেকে তার ব্যবহার কথাবার্তা সিদ্ধান্ত আচারনের।অন্য কোনো গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডের মতো সম্পর্ক না গড়িয়ে, সময়মতো তাকে চেয়ে নেওয়ায় চিন্তাভাবনা।সে-ও যেনো নীরবে সম্মতি দিয়েছিলো সেই চাওয়ার।বরাদ্দকৃত সম্পর্ক দু’জনের মধ্যে না থাকলেও হুটহাট একটুআধটু কথা হতো দু’জনের।তবে সেসব কথা না ছিলো প্রেমময়,আর না ছলনাময়। বরাবরই ঠাট্টা মশকরা করে তাকে রাগিয়ে দেওয়া, উল্টো পাল্টা বলে ক্ষেপানো।এগুলোই কাজ ছিলো ছেলেটার।তন্ময়ী সেসব কার্যকলাপে রেগে, যেতো ক্ষেপে যেতো।আবার মনের কোণে ভালো লাগাও সৃষ্টি হতো। আর সেই ভালো লাগা সেদিন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো,যেদিন একটা কফিশপে ইভানকে আর নাম না জানা সেই মেয়েটাকে হাসিহাসি মজা করে কথা বলতে দেখলো।একবার নয় মেয়েটার সাথে ইভানকে বারংবার দেখেছে সে।ইভানের সাথে বাইকে ঘুরতে।কফিশপে কফি খেতে।ইভানের ভার্সিটি এরিয়াতে।মেয়েটার পোশাক আশাক চালচলন হাবভাবে,মোটেও ঠিক লাগিনি তন্ময়ীর।সেখানে ইভান তাকে ভালোলাগার কথা জানিয়ে,সেই মেয়ের সাথে ফূর্তি করে বেড়াচ্ছে!তন্ময়ীর ভালোলাগার অনুভূতিগুলাে যেনো সেখান থেকেই আস্তে আস্তে একটু একটু করে ফিকে হতে শুরু করলো।তবে হৃদয়,একান্ত মানুষ হিসাবে যার প্রতি একবার দূর্বল অনুভূত হয়।সহজে কি তাকে মনমস্তিস্ক থেকে বের করে দেওয়া যায়!নাকি চাইলেই ভুলে যাওয়া যায়?তবে মন কঠিন রেখে চেষ্টা করে গিয়েছে তন্ময়ী নিজেকে ঠিক রাখার।যেমনটা সে আগে ছিলো তেমনভাবে চলার।না ইভানের কাছে মেয়েটা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আর না আগ্রহ দেখিয়েছে জানার।শুধু মনকে এটা বলে ইভানকে এড়িয়ে গেছে,বড়োলোকের ছেলে কখন কাকে ভালো লেগে যায়া।ভালোলাগা শেষ হয়ে গেলে কখন কাকে আবার ছুড়ে ফেলে দেয়।বলা তো যায়-না।তাই নিজের দূর্বলতাকে কাবু করে,নিজেকেই শক্ত করে নিয়েছে সে।মনেমনে ভেবে রেখেছে,বাবাহারা সে।মা আর ভাই যেমনটা চাইবে তেমনভাবেই চলবে সে।এবং যাকে তার জীবনসঙ্গী হিসাবে নির্বচন করবে তাকেই বিয়ে করবে তন্ময়ী।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো তন্ময়ী।আজ তবে কেনো ইভানের কথাগুলো ভিতরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে তাকে।কেনো মনেহচ্ছে,একবার মেয়েটা সম্পর্কে তার জানা উচিত ছিলো।চোখের দেখাও তো ভুল হতে পারে।ইভানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত ছিলো,কেনো আমাকে কথা দিয়ে অন্য মেয়েকে নিয়ে এতো মাতামাতি!মাতামাতি!হ্যা মাতামাতিই তো ছিলো।রাগ জেদে ক্ষনিকের দূর্বল হওয়া মনটা আবারও কঠিন রূপায়িত হলো।তার, এই ইভানকে না জানিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত একেবারেই ভুল নয়।কোন মেয়ে নিজের পছন্দের মানুষের সাথে অন্য একটা মেয়েকে সহ্য করবে?কে মেনে নেবে?সে যে কারনেই হোক না কেনো!আর কেনোই বা একটা মেয়েকে নিজের মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রেখে,অন্য একটা মেয়ের সাথে মজাফূর্তিতে ডুবে থাকবে।তার কি একটুও মনে ছিলোনা,তন্ময়ী বলে কাওকে সে নিজের করবে বলে কথা দিয়ে রেখেছে।অভিমানে কালোমনির চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো তন্ময়ীর।সেই মুখাবয়বের দিকে খুবই খেয়ালী নজরে তাকিয়ে রইলো ইভান।তার চাহুনী যেনো বলে দিচ্ছে, তন্ময়ীকে ভাবার সময়টা দিয়েছে সে।অনেক সময় পর দৃঢ়কণ্ঠে বললো ইভান।
‘বিয়েটা একটা ছেলে মেয়ের স্বামী স্ত্রী রূপে একসঙ্গে কাটানো সারাজীবনের একটা কঠিন সিদ্ধান্তের ব্যাপার।সেই মানুষটার সাথে তুমি সারাজীবন জড়িয়ে যাবে,এটা ভেবেও তুমি সেই সিদ্ধান্তে অনায়াসে সম্মতি জানালে কি করে তন্ময়ী?এটাই মানতে পারছিনা আমি।
‘আমিও মানতে পারিনি,আমাকে মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রেখে আপনি অন্য মেয়ে নিয়ে হাসিমজা করে শহরময় ঘুরে বেড়াবেন!আমার জায়গায় আপনি হলে মানতেন কি?
অবহেলায় হাসলো ইভান। ভুল তারও ছিলো।তন্ময়ীর কথা না ভেবে, আরেকজনের কথা ভাবতে গিয়ে নিজের জীবনকে হারিয়ে ফেলতে বসেছিলো সে।এখন সেটা খোলামেলা বলার সময় নয়।তবুও বললো-মানতাম না।তবে তোমার মতো না ভেবেচিন্তে বিয়ের মতো একটা ডিসিশনও নিতাম না।তুমি ভুল ডিসিশন নিয়েছো।আর আমাকে না জানিয়ে সেই ভুলকে অন্যায় রূপ দিয়েছো?
‘একদম না।
‘সেটাতো একটু পরে বুঝতে পারবে।তুমি তো ইভানেরই।
আর তোমাকে ইভান ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষ ছোঁবে এটা ইভান মানবে কিকরে?আর মেনে নেবে এটাও ভাবা তোমার ভুল।দ্বিতীয়ত তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারীকে আমি একান্তভাবে আমার ভাবতেই পারি-না, ছোঁয়াতো দূর।তৃতীয়ত আমার বলা কথা তোমার কাছে মিথ্যা বলে মনে হতে পারে।কিন্তু সেই কঠিন সত্যটা মিথ্যা মনে করে ভুল বুঝে রাগে-জেদে বিয়ের মতো একটা কঠিন সিদ্ধান্তে জড়িয়ে পরবর্তীতে তুমি পস্তাতে চাইলেও,আমি তো তোমাকে পস্তাতে দিতে পারিনা।সেই কঠিন সত্যটা মিথ্যা মনে করলেও আমার হতে হবে তোমাকে।তোমার সম্মতি ছাড়াও যদি আমার হতে হয়।তবুও ইভানের হতে হবে তোমাকে।বাধ্য হয়ে হলে-ও।
রাগ জেদ ভুলে গিয়ে বিস্ময় ভর করলো তন্ময়ীর মুখাবয়বে।আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো ইভানের মুখের দিকে।যেটারই ভয় পাচ্ছিলো,সেটাই কি করে বসেছে ছেলেটা।সে তো ভেবেছিল,বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হয়ে গেলে,ইভান আর কোনো কিছু করার সাহস দেখাবে না।
নিভান ভাইয়ার কথা ভেবে হলেও সাহস করবে না কোনো কিছু করার।তবে,ছেলেটা ইভান।এটাও তার মাথায় গেঁথে রাখা উচিত ছিলো।যার দুঃসাহসের কোনো কমতি নেই।বিস্ময়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো তার।
‘আপনি নিশ্চয় বিয়ে ভাঙার মতো উল্টো পাল্টা কিছু করেন নি?
বিস্তৃত হাসলো ইভান।ফের রহস্যময় গলায় বললো-তুমি মুখে যেটা বলছো সেটা নয়।মনে যেটা ভাবছো সেটাই করেছি আমি।
তন্ময়ী কিছু বলতে যাবে তার আগেই চারপাশে কেমন চাপা শোরগোল পড়ে গেল।হৈচৈ শুরু হলো।আনন্দঘন হলুদের অনুষ্ঠানে গুঞ্জন সৃষ্টি হলো বিয়ে ভাঙার।ছেলেপক্ষ হলুদের বারাত নিয়ে আসছে-না।তারা হঠাৎ বিয়ে ভেঙে দিয়েছে।কারন হিসাবে তাহমিনা বেগমকে বলেছে,–আমরা খোজখবর নিয়ে জেনেছি আপনার মেয়ের অন্যত্র সম্পর্ক আছে।কথাগুলো শোনা থেকেই মনমরা হয়ে বসে আছেন তাহমিনা বেগম।মেয়েটার অন্যত্র সম্পর্ক থাকলে হাবভাবে তো তিনি সেটা বুঝতে পারতেন।আর দ্বিতীয়ত উনার এককথায় মেয়েটাও রাজী হতোনা বিয়েতে।তবে কি ছেলের মা তন্ময়ীর গায়ের শ্যামবরন রঙ নিয়ে একটু তনুমনু করছিলেন।সেটারই দোষারোপ উল্টো ভাবে গাইছে।নাকি উনারা যা বলছেন সেটাই সত্য।তাই যদি সত্য না হবে,তবে আজ হলুদের দিন এসে উনারাই বা কেনো বিয়ে ভেঙে দেবেন?সম্মান তো উনাদেরও জড়িয়ে।মাথায় টলটলে ব্যথার উপসর্গ নিয়ে উঠে মেয়ের কাছে গেলেন তিনি।তন্ময়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলেন টলমলে চোখে মেয়েটা উনার দিকে তাকিয়ে আছে।আশপাশে আয়োজিত মানুষের ভিড়।সেই চোখ বলছে–উনারা যেটা বলেছেন সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা আম্মু ।মেয়ের প্রতি ভিতরে ভিতরে রাগে জ্বলে উঠা মাতৃত্ব সত্তা জেনো, মেয়ের চোখের নোনাজল দেখেই ভিতরেই নিভে গেলো।তিনি প্রশ্ন করার আগেই তন্ময়ী রোধ হওয়া গলায় বললো।
‘বিশ্বাস করো আম্মু,উনারা যে অভিযোগটা করছেন সেরকম কোনো সম্পর্ক আমার নেই।উনারা মিথ্যা তথ্য পেয়েছেন।
রাগ-ক্ষোভে আগেই ফেটে পড়েছে তৃনয়।শুধু নিভান শান্ত করে রেখেছে তাঁকে।বোনের কান্নারত গলার কথা গুলো শুনতেই মেজাজ আরও চড়ে গেলো তার।উল্টো পাল্টা কথা বলতেই থাকলো।হলুদের আনন্দঘনো মূহুর্তটা মূহুর্তেই বিগড়ে গেলো।ননান মানুষের মুখে নানান কথা উঠলো।তাহমিনা বেগম চেয়েও মেয়েকে আর প্রশ্ন করতে পারলেন না।যেখানে মেয়ে নিজেই স্বীকারোক্তি জানাচ্ছে।সেখানে তিনি আর কি জানবেন শুনবেন।বকে ধমকে মেরে কি আর স্বীকারোক্তি নেবেন!নাকি সেই সত্য মিথ্যা স্বীকারোক্তিতে হারনো সম্মান ফিরে পাবেন।হঠাৎই উনার প্রেশার বেড়ে গেলো।
মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলেই পাশে দাড়ানো নীহারিকা বেগম সামলে নিলেন উনাকে।এটা-ওটা বুঝ দিতে থাকলেন।কিন্তু তাতে কি আর কাজ হয়!হলুদের দিনে মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়া কি সমাজের চোখে ভালো কথা!নাকি নীরবে মেনে নেবে সেকথা সমাজের মানুষ!
উনাকে ধরে ফাঁকা জায়গায় একটা চেয়ারে বসিয়ে দিশয়ে নানান বুঝদার কথা বলতে থাকলেন নীহারিকা বেগম।পাশে দাড়ানো পরিচিত অপরিচিত অনেকে তখন নীরব দর্শক।এখনো তন্ময়ীর পাশে মাথা নিচুকরে বসে আছে ইভান।ক্রন্দনরত চোখে সেটা দেখে ভারাক্রান্ত গলায় বললো তন্ময়ী।
‘খুশী হয়েছেন আমাকে অসম্মানিত অপদস্ত করে?সুখ পেয়েছেন,শান্তি হয়েছে আপনার?
মাথা নিচু করেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো ইভান।সে এটা কখনোই করতে চাইনি।তবে না করেও উপায় ছিল না তার।আর বিয়েটা ভাঙার ব্যবস্থা সে অনুষ্ঠানের আগেই করতে চেয়েছিলো, কিন্তু সেটাও হয়ে উঠেনি।মাথা কাত করে তন্ময়রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো ইভান।–আমি খুশি হয়েছি কি-না,এটা আমার থেকেও তোমার অন্তর ভালোভাবে জানে।তবে এই সিচুয়েশনের জন্য দ্বায়ী একমাত্র তুমি!
তন্ময়ীর ক্রন্দনরত মুখ তীক্ষ্ণ শূলের ন্যায় বিঁধে এফোড় ওফোড় করতে থাকলো ইভানের বুক।দোষী সে-ও কম নয়,তবে পরিস্থিতি যে তাকে ঠিক করতেই হবে।অনেক সময় ধৈর্য্য নিয়ে বসে থাকলেও এবার আর বসে থাকতে পারলো না সে।উঠে আগে বাবা আর ভাইকে খুঁজলো।নিভানকে দেখলো তৃনয়ের সাথে কথা বলতে সেদিকে না এগিয়ে,মহিলা মানুষের আনাগোনা থেকে কিছুটা দুর নিজের হুইলচেয়ার বসে আছেন জাহিদ সাহেব।পাশে গোলটেবিলের চেয়ারে বসা উনারই বয়সি কিছু মানুষ।সবাই বিষয়টাতে বেশ চিন্তিত।তপ্ত শ্বাস ফেলে সেদিকে এগোলো ইভান।জাহিদ সাহেবের কাছে গিয়ে উনাকে হুইলচেয়ারসহ সেখান থেকে সরিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় নিয়ে দাঁড় করালো।তারপর নিজে মাটিতে হাটু উনার সামনে বসলো।চমকে ছেলের উষ্কখুষ্ক মুখের পানে চাইলেন তিনি।দূর থেকে সেটা নিভান দেখে এগিয়ে এলো।জাহিদ সাহেব বিচলিত কন্ঠে বললেন —কি হয়েছে ইভান?
ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে ধাতস্থ করলো ইভান।বাবার পানে শান্ত নজর রেখে,সদ্য এসে পাশে দাঁড়ানো নিভানের সুক্ষ ধারালো দৃষ্টিপানে চাইলো।ফের বললো।
‘বাবা,আমি তন্ময়ীকে বিয়ে করতে চাই।তার বিয়ে ভেঙে গেছে, তাকে উদ্ধারিত হতে পাত্রস্থিত হয়ে বিয়ে করতে চাইছি এমনটা নয়।আমি তাকেই বিয়ে করতে চাইছি।
“আমি তাকেই বিয়ে করতে চাইছি”।কথাটা নিভানের চতুর ব্রেইন,ইভানকে পর্যবেক্ষণ করা বুদ্ধিদিপ্ত নজর সহজে নিলো-না।মাথার মধ্যে বিষয়টা নিয়ে যেনো ঘুরপাক খেতে লাগলো।কোথাও দুইয়ে দুইয়ে এক কি করে হয় মিলাতে থাকলো।জাহিদ সাহেব,ছেলের আচারনে অবাক,বিস্মিত!কি বলবেন ভেবে পেলেন না।বড় ছেলে এখনো বিয়ে করেনি,ছোটোছেলে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখছে!মুখ উঁচু করে পাশে দাড়ানো নিভানের মুখের দিকে তাকালেন তিনি।নিভান তখনো তীক্ষ্ণ চোখে ইভানের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় মশগুল।তন্ময়ীর বিয়ের খবর পাওয়ার পর থেকে ইভানের ছন্নছাড়া আচরন।বাড়ির বাহিরের অধিকসময় কাটানো।সেদিন কৌড়ির সাথে বলা,ফাজলামো কথাগুলো কিছুটা শুনেছিলো নিভান।তবে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি।আজ তন্ময়ীর পাশে ঘুরঘুর করা।বিষয়টা কেমন ঘোলাটে লাগলো নিভানের।জহরি নজরে ইভানকে খেয়াল করতে থাকলো।মাথানিচু করে রাখার মতো ছেলেতো নয় ইভান।নিজের কোনো জিনিস পছন্দ হলে বা চাওয়ার হলে চোখে চোখ রেখে কোনো আড়ষ্টতায় চেয়ে নেয় সে।তবে কোন অপরাধে আড়ষ্টতায় মাথা নিচু করে বসে আছে সে।তবে কি?উফফ…আর ভাবতে চাইলোনা নিভান।যেটা সে ভাবছে তেমন ছেলে নয় ইভান।এমন অন্যায়টা সে কখনোই করতে পারেনা।তন্ময়ীকে পাওয়ার হলে সে আর কারও কাছে না বলতে পারলেও,নির্দ্বিধায় তারকাছে বলতো।দু’ভাইয়ের সম্পর্ক তেমন না হলেও,এসব বিষয়ে ইভান কখনো নিজেকে তারকাছ থেকে চাপিয়ে রাখেনা। সেই ছেলে এটা কিকরে করতে পারে?
‘নিভান।
জাহিদ সাহেবের ডাকে মৃদু চমকে উনার দিকে তাকলো।উনার মুখ বলছে উনি ইভানের প্রস্তাবে ঠিক কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেননা।যেনো সম্মতিটা তাকেই দিতে বলছেন।নিভানও হঠাৎ কি বলবে খুঁজে পেলোনা।ইভান কাতরস্বরে ফের বলে উঠলো।
‘প্লিজ দাদাভাই সম্মতি দাও।আমি চাইছিনা ওই মেয়েটা আমার জন্য আর কাঁদুক।
“আমার জন্য কাঁদুক”মানে!জাহিদ সাহেব কথার অর্থটা না বুঝলেও নিভান চমকে উঠল।ইভানের কথায় যেনো নিভানের ভাবনা সব হিসাব কড়ায়গণ্ডায় মিলে যাচ্ছে। মূহুর্তেই রাগে মাথাটা দপদপ করে উঠলো তার।চোয়াল হয়ে উঠলো দৃঢ়-কঠিন।তবে মোটেই তা প্রকাশ করার ভুল করলো না।শক্তকন্ঠে শুধু জাহিদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো।
‘আন্টির কাছে গিয়ে প্রস্তাব রাখতে বলুন ও-কে।দেখুন উনি কি মতামত প্রকাশ করেন।তবে এখানে তন্ময়ীর মতামতটাও বিশেষ জরুরী।সে মত না দিলে কিন্তু কিছুই হবেনা।
মূহুর্তেই অসহায় নজরে নিভানের দিকে তাকালো ইভান।দাদাভাই যে বুঝে গিয়েছে সব।আর তারপ্রতিও অসন্তুষ্ট হয়েছে ভিষন,বুঝতে বাকি রইলো-না ইভানের।
চোখ বুঁজে শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো ইভান।গুটিগুটি পায়ে তন্ময়ীর মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
ভদ্রমহিলা চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন।চোখের কোণে উনারও নোনাজলের আনাগোনা।ইভানের অপরাধবোধ যেনো ভিতরে ভিতরে পাহাড়সম হলো।সবকিছু যেনো ছিন্নভিন্ন করে দিতে ইচ্ছে করলো।সময়টা টেনে নিয়ে তন্ময়ীর প্রথম দেখা সেই দিনটায় নিয়ে যেতে মন চাইলো।শুরুটা আবার সেখান থেকে যদি করতে পারতো,কতোই ভালোই না হতো।তবে তা এখন আর কোনোমতেও সম্ভব নয়। এখন আর সিচুয়েশন মোটেই বিগড়ে যেতে দিলে হবে-না।হাঁটু গেড়ে বসলো উনার সমানে ইভান।চোখ খুললেন উনি।উৎসুক প্রশ্নবিদ্ধ নজর।উনাকে ঘিরে তখন,উনার আত্মীয় স্বজনেরা দাড়ানো।সবাই ভিন্ন ভিন্ন ভালোমন্দ কথা বলেই চলেছে।সেসব উপেক্ষা করে ইভান সোজাসাপ্টা বললো।
‘আন্টি,আমি একজন বেকার ছেলে।নিজের আপতত পরিচয় বলতে,আমি জুনায়েদ জাহিদ ইভান।বাবা বা ভাইয়ের সাফল্যে আমি পরিচিত হতে চায়নি কখনো নিজেই বরাবর সাফল্য অর্জন করতে চেয়েছি।সেই সাফল্য অর্জন করার আগেই,আমি আপনার মেয়েকে চাইছি।জানিনা একটা বেকার ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দেওয়া যায় কি-না,বা ঠিক কি-না!তবে আমি আপনার কাছে আপনার মেয়েকে চাইছি।একটা বেকার ছেলের হাতে কি আপনার মেয়েকে তুলে দেওয়া যায়?আমি কথা দিচ্ছি,এই বেকার ছেলে কখনো সুযোগ দেবে-না আপনার মেয়েকে অভিযোগ করার।
চলবে…