#ফুলকৌড়ি
(২০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
সারাদিন তুমুল ঝড়-বর্ষনের পর রাতে গিয়ে নিস্তব্ধ হলো প্রকৃতি।যদি-ও রাত, তবু-ও বাহিরের পরিবেশটা ঘোর আমাবস্যা ন্যায় ঘুটঘুটে আঁধার।শীতল ভাবটা যেনো মাঘের কনকনে ঠান্ডাভাব!সেই ঠান্ডাভাবটা আর-ও বাড়িয়ে দিচ্ছে,মাঝেমধ্যে গ্রীল ভেদ করে আসা মৃদুমন্দ বাতাসে।অতি শীতল ঠান্ডাভাব আবহাওয়ার মধ্যে-ও বেলকনিতে সটান দাঁড়িয়ে আছে নিভান।গায়ে পাতলা টিশার্ট।বলিষ্ঠ দেহটা ক্ষনে ক্ষনে ছুঁয়ে যাচ্ছে শীতল বাতাসে তবু-ও নড়চড় নেই তার।ট্রাউজারের দু-পকটে দু-হাত গুঁজে স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।পলকহীন শান্ত,সুগভীর নজরজোড়া তার ঘুটঘুটে আঁধারে আচ্ছন্ন প্রকৃতিতে।জানোয়ার গুলোকে ইচ্ছেমতো পিটিয়ে এসেছে সে।যদি তৃনয় না ঠেকাতো তবে আজ মৃতলাশে পরিনত করে আসতো সবকটাকে।যদি-ও নিঃশ্বাস নেওয়ার অবস্থায় ছেড়ে আসেনি।যদি কোনোক্রমে বেঁচে যায়,তবে ওদের হাত পা হাড়গোড় ঠিকঠাক হতে কতো মাস সময় লাগবে তারও ঠিক নেই।তবু-ও এতো মেরেও শান্তি মেটেনি নিভানের।মনে হচ্ছিলো,সবগুলোর আত্মা বের করে,মৃত লাশে পরিনত করে তারপর ছেড়ে আসতে।
কৌড়িকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তখন ওই অবস্থায় বের হয়ে,তৃনয়কে ফোন দিয়ে সাথে নিয়েছিলো সে।তারপর ছেলেগুলোর বিষয়ে তথ্য নিয়ে খুঁজে খুজে বের করতে যেটুকু সময় লেগেছে।কলেজের আশেপাশে একটা বদ্ধ ঘরে জুয়া খেলছিলো আর হাসি তামাশা করছিলো জানোয়ারগুলো।বিষয়টা কৌড়িকে নিয়েই ছিল।ওদের মধ্যে একজন লালসিত অঙ্গিভঙ্গি করে বলছিলো যে–ওই সিনজিওয়ালা যদি তখন মাঝখানে এসে সময়টা ওয়েস্ট না করাতো তবে ওমন সুন্দর চিকনাচামেলি ময়না পাখিটা আজ তাদের হাতের মুঠোয় থাকতো।হাতছাড়া হতোনা।আর হাত ছাড়া না হলে এই ওয়েদারে ময়নাটাকে ভোগ করতে কি মজাটাই না পেতো!ইশশ!তন্মধ্যে একটা ছেলের গলায় তখন-ও কৌড়ির ওড়নাটা ঝুলতে দেখে নিজেকে আর কন্ট্রোল রাখতে পারি-নি।ছেলেগুলো কিছু বুঝে উঠার আগেই,সাথে নিয়ে যাওয়া হকিস্টিক দিয়ে এলোপাতাড়ি ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে।তাদের আকুতি-মিনতি,জ্বালা-ব্যথা কোনোপ্রকার বাক্য কানে তোলেনি নিভান।শুধু মনের জ্বালা অনুযায়ী ইচ্ছেমতো ছেলেগুলোর যেখানে খুশি সেখানে মেরেছে।প্রথমে তৃনয় সাথে থাকলেও,যখন দেখলো নিভান, আউট অফ কন্ট্রোলে গিয়ে ছেলেগুলোকে পেটাচ্ছে।আধমরা হয়ে গেছে,নাকমুখ দিয়ে রক্ত ছুটছে তখন-ও ছাড়ছে-না।তখন গিয়ে নিজের হাতের হকিস্টিকটা ফেলে দিয়ে নিভানকে বাঁধা দিতে ব্যস্ত হলো তৃনয়।শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দেহের নিভানকে একা সামলিয়ে উঠতে পারা মুশকিল!পারছিলো না তৃনয়।কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছিলো,তবুও নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে,বিভিন্ন কিছু বলেকয়ে তারপর তাকে ঠান্ডা করতে হয়েছে তাকে।না-হলে ওই জানোয়ার গুলোর দাফন করেই তারপর তবে বাড়ি ফিরতো!নিভানকে এতোটা উদভ্রান্ত হতে আগে কখনো দেখিনি তৃনয়।বিধায় আশ্চর্য হয়ে তখন তাকে থামাতে বলতে বাধ্য হয়েছে—পরের বাড়ির একটা মেয়ের জন্য তুই এভাবে নিজেকে কেনো খুনী প্রমান করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিস?বাড়ির মেয়েকে উত্যক্ত করেছে,অসম্মান করেছে!মারতে এসেছি,ব্যাস!মেরেছি!তারজন্য খুন করে ছাড়বি নাকি?
তৃনয়ের কথার উত্তর সরূপ মুখে কিচ্ছুটি বলতে পারিনি নিভান।শুধু অসহায়,পাগল পাগল নজরে তারদিকে তাকিয়ে ছিলো।সেই নজরে যেটা বুঝে নেওয়ার সেটা বুঝে নিয়েছিলো তৃনয়।বিস্মিতও হয়েছিলো,এটা ভেবে।যে তার সবসময়ে গম্ভীর হয়ে থাকা তীক্ষসম্পূর্ণ, বুদ্ধিমান বন্ধুটা একটা বাচ্চা মেয়েতে মন হারিয়েছে।সেই মেয়েটাকে উত্যক্ত করার জন্য এতোটা উদভ্রান্ত!এতোটা পাগল পাগল ভাব!তৃনয়ের সেই বিস্মিত ভাবটা আরও বাড়িয়ে তখন নিভান শক্তগলায় বলেছিলো।
‘ও শুধু পরের বাড়ির মেয়ে নয়,তৃনয়।ওর দিকে নজর দেওয়া তো অন্যায় ছিলো!আর সেই অন্যায়টা তো ওরা করেছেই!সাথে ওকে ছুঁতে চেয়ে সেই অন্যায়টা পাপে পরিনত করে ফেলেছে।তারজন্য আমার হাতে খুন হওয়া তো ওদের প্রযোজ্য।ওরা নিভানের ঠিক কোথায় ছুঁয়েছে,ওদের জানা নেই।যদি ওরা বেঁচে ফিরে,তবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পাবে।নিভান আওসাফ আহমদের ঠিক কোথায় হাত দিয়েছিলো ওরা।
তারপর আর তৃনয় একটা-ও কথা বাড়াইনি।নিভানের অনুভূতি মেয়েটাকে নিয়ে ঠিক কতোদূর গড়িয়েছে।সেটা নিভানের কথা কাজে বেশ ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ বুঁজে নিলো নিভান।মূহুর্তেই বদ্ধ নজরে ভেসে উঠলো,স্বপ্নে দেখা সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া।যা আজকের ক্রন্দনরত চোখজোড়ার সাথে মিলেমিশে একাকার।সেই স্বপ্নে দেখা ক্রন্দনরত চোখজোড়ার সাথে আজকের চোখজোড়ার নতুন করে মিল পেয়েছে, এমনটা নয়!মিল তো সে সেদিনই পেয়েছিলো যেদিন নাফিমের বাহুভেদ করে ভয়ার্ত চোখজোড়া উঁকি দিয়ে তাকে দেখেছিলো,সেদিনই।তবে সেবিষয়ে অবুঝ শিশুটি হতে চেয়েছিলো সে।পারলো কোথায়!বরং সেসব স্মৃতি তার হৃদয়ে মস্তিষ্কে জোকের মতো জেঁকে ধরে বসে আছে।স্মৃতিকে মধুরতা করতে,শীতল একদল বাতাস তখন সঙ্গী হয়ে ছুয়ে দিলো তাঁকে।নিজের অনুভূতি প্রকাশে বরাবরই সে অক্ষম হলেও,আজ তৃনয়ও খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়েছে,কৌড়িকে নিয়ে তার অনুভব।এখন আর-ও একজন জানবে।যদি-ও তাতে তার সমস্যা নেই।তবে ইভানের ব্যাপারটাতে এখনো সে ক্লিয়ার নয়।তবু-ও নিজের মনকে তো শান্ত করতে হবে তাকে!ওই অসুস্থ মেয়েটাকে না দেখা পর্যন্ত তো ভিতরটাকে শান্ত রাখতে পারছেনা।আর না মিলছে নিজের শান্তি।আর না পারছে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় আরাম দিতে।
চোখ খুললো নিভান।আবার শান্ত নজর ফেললো বাহিরের নিকষ কালো আঁধারে!বাড়িতে আসার পর শুনেছে,কৌড়ির প্রচন্ড জ্বর!কড়া ডোজের ঔষধেও নাকি জ্বর নামেনি।ডাক্তারের কাছে না গেলেও,পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। আপতত আজকের রাতটা দেখে কালকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। মা, এমনটা জানিয়েছেন তাঁকে।সেখান থেকেই নিজের দেহের বাহিরটাকে স্বাভাবিক আর শান্ত রাখতে পারলে-ও, ভেতরটাকে নিয়ে প্রচন্ডভাবে অশান্ত সে।দুদন্ড একজায়গায় বসে,শুয়ে,দাঁড়িয়ে শান্তিতে থাকতে পারছে না সে।না পেরে নিজের মনো-শান্তির জায়গা বেলকনিতে চলে এসেছে।তবু-ও শান্তি মিলছে কৈ!
ক্ষনিকের জন্য নিজেকে শান্ত রাখতে পারলে-ও মন মস্তিষ্কে চলছে তার,কৌড়ি কৌড়ি কৌড়ি!এই মেয়ে তাকে সত্যিই পাগল করে দেবে।
নিজেকে আর কতো দমিয়ে রাখবে!এতোযাবত সকল বিষয়ে নিজের ধারালো ব্যক্তিত্ব আর নিজের সিদ্ধান্তকে কঠিনরূপে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে সে।সেখানে নিজের কাছের মানুষগুলো ছাড়া প্রধান্য পায়নি কেউ।অন্যের ভালোমন্দ মন অতোটাও গুরুত্ব দিয়ে দেখিনি। পায়-নি তার মন মস্তিকে গুরুত্ব। আর আজ,ওই মেয়েটার কাছে সেই কঠিন ব্যক্তিত্ব ঠুনকো হয়ে গেলো!মন মস্তিস্ক হয়ে গলো পরাজিত!সে, ওই মেয়েটার কাছে পরাজিত সৈনিক!দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।নজরজোড়া ফের বন্ধ করে নিয়ে মৃদুস্বরে আওড়ালো।–তবে তার কাছে পরাজিত সৈনিক হতে ক্ষতি কোথায়!নেই ক্ষতি।
নিজের ব্যক্তিত্বের কঠিন্যত্ব বজায় রেখে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে রাখতে পারলে-না নিভান।পা বাড়ালো, নিজের তোলপাড় হয়ে যাওয়া অশান্ত ভিতরটাকে পরম শান্তি দিতে।যাওয়ার সময় রুম থেকে নিজের ফোনটা নিতে ভুললো না।কৌড়ির রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ভাবলো।হয়তো মন দোনো-মোনো করলো..এই এতো রাতে মান্যতার বিস্ময় বাড়িয়ে দিয়ে,মেয়েটার কাছে যাওয়া ঠিক হবে কি-না?এই ঠিক হবে কি-না,শব্দটা মস্তিষ্ক ভাবতেই।ভিতরটা আরও উতলা হলো।বুঝলো,মেয়েটাকে না দেখা পর্যন্ত আজ তার কোনোক্রমে নিস্তার নেই।দরজা বন্ধ।মান্যতাকে ফোন দিলো সে।আজ মান্যতা,কৌড়ির সাথে রয়েছে এটা সে জানে।প্রথমবার কল রিসিভ হলোনা।দ্বিতীয়বার আবারও কল দিলো নিভান।একটানা কল বেজে যাওয়ার পর শেষে গিয়ে রিসিভ হলো।ওপাশ থেকে মান্যতা কিছু বলার আগেই,এপাশ থেকে কিছুটা উদ্বিগ্ন গলায় নিভান বললো।
‘দরজাটা খোল মান্য।
বিস্ময়ের চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলো মান্যতার ভাবনারা।এমনিতেই এতো রাতে দাদাভাই ফোন দেওয়াতে সে বেশ আশ্চর্য।তারউপর দাদাভাই যেটা বললো সেটা কি বাস্তব নাকি সে এখনো ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে চলেছে?নিজ হাতে চিমটি দিলো মান্যতা।ব্যথা পেতেই চোখমুখ কুঁচকে ফেললো।সত্যি জেগে আছে সে!তবে এতোরাতে কৌড়ির রুমে দাদাভাইয়ের কি দরকার?শত ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেলেও,উত্তর নেই।গায়ের কথাটা ফেলে উঠে দাঁড়ালো মান্যতা।দরজা খুলতেই তার দেখে আসা এতোযাবতকালের,উল্টো মানুষটাকে দেখলো সে। এরকম উদভ্রান্ত চেহারা,অসহায় নজর। এরআগে কখনো এই মানুষটার মধ্যে লক্ষ্য করেছে বলে মনে হয় না মান্যতার।অবাক হয়ে শুধু সামনে দাড়ানো মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।সামনে দাড়ানো মানুষটাও বুঝি ছোট বোনটার চাহুনিতে একটু অপ্রস্তুত হলো।তবুও অন্তরের অশান্ততায় মুখ তাকে খুলতেই হলো।
‘আমি ভিতরে যেতে চাই মান্য।
বিস্ময় বাড়লো বৈ কমলোনা মান্যতার।তবে নিভান কথাটা বলতেই ফটাফট পা পিছে নিয়ে সরে দাঁড়ালো সে।ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো নিভান।নিভানকে দরজা লাগাতে দেখেই মান্যতার যেনো হুঁশ ফিরলো।নারীমন চেনা-জানা ভাইটার অচেনা রূপ দেখে বুঝতে চাইলো বা বুঝে নিলো অনেক কিছু।নিভান দরজা লাগিয়ে পিছে মুড়ানোর আগেই,দ্রুত পা চালিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো মান্যতা।দাদাভাইয়ের মনে কৌড়িকে নিয়ে কিছু চলছে,ভাবতেই সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠলো তারও।না চাইতে-ও বেলকনির জানালায় নজর দিলো সে।বিস্ময়ে চোখ স্থির হয়ে গেল তার।এই মানুষটা তার দাদাভাই নিভান!কখনোই হতে পারে না!
★
দরজা লাগিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো।মোটা কম্বল জড়িয়ে,শান্ত বাচ্চাটার মতো ঘুমিয়ে থাকা কৌড়িকে।বুকের স্পন্দন বেড়ে গেলো নিভানের।পৃথিবীর সব সুখ মনেহয় ওই মুখে লেপ্টে আছে,নাহলে তার অশান্ত মনটা মূহুর্তেই শান্ত হয়ে গেলো কি-করে!
নিষ্পলক মুগ্ধ নজরে এগিয়ে গিয়ে কৌড়ির পাশে বেডটায় বসলো।নিঃসংকোচে তার রুক্ষ ডান হাতটা ছুলো কৌড়ির কপাল।প্রচুর জ্বর মেয়েটার।হয়তো একারনেই এরকম বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছে।নিথর দেহে পড়ে আছে।হাত সরিয়ে নিলো নিভান।কৌড়ির জ্বরে মলিন হয়ে থাকা মুখটা দেখে,খুবকরে একটা ইচ্ছে জাগলো মনে।কৌড়ির নিস্পাপ মুখটা যেনো বাধ্য করলো সেই ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় দিতে।মাথা নিচু করে নিজের ওষ্ঠ ছোঁয়ালো কৌড়ির তপ্ত কপালে।জ্বরের ঘোরে-ও কেঁপে উঠলো কৌড়ি।নড়েচড়ে ফের শান্ত বাচ্চাটি হয়ে গেলো।ঠোঁট ছোঁয়ানো অবস্থায় মৃদু হাসলো নিভান।ভিষন আদর-প্রিয় মেয়েটা!না-হলে অজানা অচেনা একজন পুরুষ তাকে ছুলো আর সে শান্ত বাচ্চাটার মতো আদর উপভোগ করলো।পরক্ষণে মনে পড়লো,মেয়েটা তো জ্বরের ঘোরে বেহুশ হয়ে আছে।না হলে কি তার এই ছোঁয়াটা মেনে নিতো?কখনোই নিতো-না।
ঠোঁট সরালো নিভান।এভাবে ছুঁতে চায়নি সে কৌড়কে।কিন্তু নিজের মনকে যে কিছুতেই মানাতে পারছিলো না।ঘুমান্ত কৌড়ির মুখের দিকে নিস্প্রভ নজরে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো।–আজ একজন পুরুষ তার অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য তোমাকে তার ছোঁয়ায় কলঙ্কিনী করে রাখলো।যদি কখনো আমার না হও, তবে তোমার অজানাতে একজন পুরুষের ছোঁয়ায় তুমি কলঙ্কীনি হয়ে থাকলে।
আর সময় ব্যয় করলোনা নিভান।যদি মেয়েটা একান্ত তার হতো,তবে ওই অসুস্থ মেয়েটাকে বেডে ওরকম নিথর দেহে পড়ে থাকতে দিতোনা।কখনোই দিতো না।
কতোকিছু ভুলভাল ভাবনা মনে এলো নিভানের।আর প্রশ্রয় দিতে চাইললনা,যদি কখনো প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ আসে।তবে ওই মেয়েটাকে সবকিছু দিয়ে আগলে রাখবে,নিজের সর্বচ্চ সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসবে।হ্যা নিভান ভালোবাসবে তাঁকে।কাল ইভানের সাথে কথা বলা খুব প্রয়োজন তার।খুব প্রয়োজন।কেননা মেয়েটাকে যে তার হওয়া চাই।
দরজায় গিয়ে ফের দাঁড়িয়ে পড়লো নিভান।মান্যতা এখনো রুমে আসেনি।কৌড়ির দিকে আরও একপলক তাকিয়ে মৃদুস্বরে মান্যতাকে ডাক দিলো সে।তৃনয়ের মতো মান্যতাও আজ বুঝে গিয়েছে তার হাল। মনের বেহাল দশা।সেখানে লুকোচুরি করে লাভ আছে?নেই।আর এমনিতেই লুকোচুরি সে করতেও চায়-না।তার ধারনা মান্যতা তার মনের দশা জানার সাথেসাথে,একটু আগে কৌড়ির সাথে ঘটা নিজের আবেগ-ঘনো ঘটনাটা দেখেছে।মান্যতা রুমে আসতেই নিভান বললো।
‘আমি এসেছিলাম,আর ওকে ছুঁয়েছি।ও যেনো বিষয়টা না যানে।
মান্যতার আশ্চর্যতা হয়তো এখনো কাটেনি।সে সামনের মানুষটাকো এখনো ভুল দেখছে বলে তার মনেহলো।
সেই আশ্চর্যতা বহাল রেখে মাথা উপরনিচ করে সম্মতি জানালো।সেটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিভান চলে গেল।বোনটা যে,তার কর্মকান্ডে ভিষন আশ্চর্যতা হয়েছে এটা মান্যতার চেহারায় প্রকাশ পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে সে।এরা যে কেনো তাকে স্বাভাবিক ভাবে নেয় না বা নিতে পারে,বুঝে আসেনা নিভানের।না-হয় সে সবার সাথে খোলামেলা মিশতে পারে-না, বেশি-বেশি কথা বলতে পারে না।তাই বলে কি সে সবার মতো সাধারণ একজন মানুষ নয়?কথা কম বললে, মানুষের সাথে না মিশলে কেউ আশ্চর্য মানুষ হয়ে যায় কিকরে!এটাও বুঝে আসে না তার।
★
‘কোথায় গিয়েছিলি নিভান?
চেনা কন্ঠ শুনে মনেমনে মৃদুমন্দ হাসলো নিভান।ফের বললো–আমাকে প্রশ্ন করার তুই কে?যেখানে এবাড়ির বড়কর্তাও আমাকে প্রশ্ন করার সাহস করেনা, স্পর্ধা দেখায়না।সেখানে তুই কে?
নিভানের কথাগুলোয় কষ্ট পেলেও,কথাগুলো উপেক্ষা করে দীবা বললো।–কৌড়ির কাছে গিয়েছিলি তাই না?
বিরক্ত হলো নিভান।গম্ভীর গলায় বললো—তাতে তোর সমস্যা কোথায়?তোরতো সমস্যা হওয়ার কথা না?আর ইদানীং আমি কোথায় যাচ্ছি,কি করছি,না করছি।গোয়েন্দাগিরি করছিস?তবে পরমর্শ দিতে বাধ্য হচ্ছি,আমার পিছনে গোয়েন্দা গিরি না করে নিজের বরের পিছনে কর।কাজে দেবে, উপরন্তু সংসারটা টিকে যাবে।
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো নিভান।সামনে এগোলোও ক-কদম।পিছন থেকে দীবা ফের বললো– যদি কৌড়িও আমার মতো অন্যায় করে।তখন কি করবি?
থামকালো নিভান।থমকে গেলো বুকের ভিতরের চলা হৃদস্পন্দন।রাগে চোয়ালদ্বয় কঠিন হয়ে এলো তার।তবে তার নিজের রাগটাও যে অপাত্রে দান করতে চায় না সে। দু’হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো।সময় নিয়ে পিছে ফিরে দীবার দিকে ফের দুকদম পা বাড়ালো।দীবাও একটু ভড়কে গেলো।যেটা তার সুন্দর চোখমুখে প্রকাশ পেলো।সেটা দেখে মৃদু হেসে তাচ্ছিল্যের সুরে নিভান বললো।
‘ও তোর মতো নিচু মানসিকতা বা লোভী প্রকৃতির মেয়ে নয়।আর যদি হয়ে-ও থাকে,তবে কৌড়ি মানে সাতখুন নয় সহস্রখুন মাফ,বুঝেছিস?তাহলে এটাও বুঝে-নে ওর স্থান নিভানের ঠিক কোথায়!কোন জায়গায়!
চলবে…..
#ফুলকৌড়ি
(২১)কপি করা নিষিদ্ধ
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
সেদিন যখন নিভানের অফিসকক্ষের স্পেশাল রুমটার একান্ত বেডটাতে কৌড়িকে খুব সুন্দর করে ঘুমাতে দেখেছিলো।সেদিনই দীবা বুঝে গিয়েছিলো,নিভানের মনের পরবর্তন!হালচাল!অফিসটা তো আজকের নয়।
কতোবার পদানত করেছে সেখানে।অথচ ওই স্পেশাল রুমটাতে বসার বা ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার।অফিসকক্ষ থেকেই ফিরে আসতে হয়েছে।আর এমনিতেই খুব অতি প্রয়োজনীয় ছাড়া বাড়ির কোনো মেয়ের অফিসে অবাধ যাতায়াত,এটা নিভানের পছন্দ নয়।সেই নিয়ম আর তার বাধ্য হুকুম অনুযায়ী সহজে কেউ, প্রয়োজনেও অফিসে ঢুকতে চায়-না।আর সেই নিয়ম ভেঙেই মেয়েটাকে নিভান নিজেই অফিসে নিয়ে গেলো আবার তাকে নিজের একান্ত আরাম-আয়েশের জায়গায় খুবযত্নে স্থান দিলো।শুনেছিলো,মেয়েটা অফিস ঢুকতেই নাকি বমিটমি করে ভাসিয়ে দিয়েছিল।তাতে তো নিভানের মেজাজ চুড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার কথা ছিলো!কৈ,সে বিষয়ে তো উফফ-তাক অব্দি টুঁশব্দ শোনে নি।রাগান্বিত, বিরক্ততা কোনো কিছুই তার চেহারায় বা ব্যবহারে প্রকাশ পায়নি।বরং মেয়েটার যত্ন নেওয়া হয়েছে নতুন পোশাক এনে,তাকে পরিয়ে!সেদিন অন্যরকম নিভানকে দেখে দীবা চরম আশ্চর্য হয়েছিল।কৌড়ির প্রতি নিভানের আচার-ব্যবহার,বাক্যবয়,দৃষ্টি সবকিছু সম্পূর্ণ আলাদা ছিলো।যা অন্য কোনো মেয়ের প্রতি কখনো সেসব হতে দেখেনি দীবা।সবসময় কমকথা বলা গম্ভীর একটা ছেলে।ছোটোবেলা থেকে নিভানকে এরকমটা দেখে এসেছে দীবা।সেই ছেলের
পরিবর্তন টের পাওয়া কি খুব মুশকিলের!মুশকিলের হলেও কৌড়ির প্রতি নিভানের দৃষ্টি সেটা বুঝতে সহজ করে দিয়েছে তাকে।সেদিন যখন কৌড়িকে নিয়ে আসার জন্য অফিস থেকে বের হচ্ছিলো সবাই।নিভানের শান্ত আর নিষ্পলক নজর ছিলো,কৌড়ির সদ্য ঘুমে উঠা ক্লান্ত মুখশ্রীততে।এটা দীবার চতুর নজর খেয়াল করেছিলো।তারপর নিচে এসে সবাই যখন গাড়িতে উঠলো।দীবার মনে হয়েছিল,নিভান অফিসের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।আর তার নজর নির্দিষ্ট সেই মেয়েটার উপর।সত্যিই তাইই দেখেছিলো।উফফ, সেটা দেখে ভিতরটা জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো তার।মেয়েটার প্রতিও চরম হিংসা জেগেছিলো।কিন্তু কাকে কি বলবে সে?মেয়েটা তো নিজেই বেখবর, নিভানের সেই মুগ্ধ আচার ব্যবহার আর অনুভূতির প্রতি।
সেই থেকে নিভানের গিতিবিধির প্রতি লক্ষ্যে রেখেছে দীবা।নজরেও বিঁধেছে,সেই দৃঢ়চিত্তের গম্ভীর নিভানকে তবে কৌড়ির বেলায় সে নিভান আলাদা।তার আচার ব্যবহার দৃষ্টি সবকিছুই আলাদা।এটা মানতে কষ্ট হয় দীবার!কৌড়ির প্রতি সেই ব্যবহারের বিরূপ আচারন করতে গিয়েও বারবার ফিরে আসে সে।নিজের বিবেকে দংশিত হয়, বাঁধা পায়!যেখানে মেয়েটার কোনো দোষ নেই,সেখানে তাকে শাসিয়ে লাভ আছে।উপরন্তু নিভান যদি ক্ষুন্নাক্ষরেও টের পায়,কৌড়ির প্রতি দীবার বিরূপ আচারন।তবে তো সবকিছু নিঃশেষ করে দিতে ছাড়বে না।নিভানকে তার খুব ভালো করে চেনা!ঠান্ডা স্বভাবের হলেও রাগ ক্ষোভ জেদ তার খুব ভয়ংকর!যদি-ও মায়ের মতো স্বভাব দীবার নয়।যাকে-তাকে কারন ছাড়া উল্টো পাল্টা কথা সে বলতে পারেনা।আর না খারাপ আচারন বর্তাতে পারে।বিবেকহীন তো নয় সে!আর না হতে চায়।তবে কষ্ট হয়,যে কারনে সংসার ছাড়তে সংকোচ করিনি।আজ সেই কারনটাই হাতছাড়া। যদিও হাতের নাগালে কখনোই ছিলো-না।তবুও মনের কোণে আশার নিভুনিভু বাতিটা তো জ্বলছিলো।আজ সেই নিভুনিভু বাতিটা দমকা হাওয়ার মতো ফু দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে গেলো নিভান নিজেই।
দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেলো দীবা।ঘুম আসছিলো না তাই হাটাহাটি করছিলো।রুম ছেড়ে সামনের লাগোয়া বারান্দায় আসতেই দেখলো নিভানকে নিচে যেতে।আর নিভান কোথায় যেতে পারে,সেটা আন্দাজ করে নিজেও নিচে এসেছিলো সে।কৌড়ির রুমে ঢুকতে দেখেই সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সে।নিভান বের হতেই
বেহায়া হয়ে প্রশ্নবিদ্ধও করেছে তাঁকে।আর যা সে শুনতেই চাই-নি,সেটাই শুনতে হলো তাকে।নিজের বেডে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে হুহু করে কেঁদে দিলো দীবা।জীবনটা নিজের সিদ্ধান্তহীনতার জন্য আজ এরূপ অবস্থা তার।না পারছে সিয়ামের ভালোমন্দ মেনে নিয়ে তারসাথে মানিয়ে সংসার করতে,আর না পারছে নিভানকে মন থেকে সরাতে।তার কিশোরী বয়সের ভালোলাগা ছিলো নিভান।সময়ের সাথে সাথে সেই ভালোলাগা বাড়তে থাকলে-ও নিভানের থেকে কোনোভাবেও প্রশ্রয় পায়নি কখনো।একই বাড়িতে বছর বছর থাকা সত্ত্বে-ও,নিয়ম করে দেখা সাক্ষাৎ হলেও সেভাবে কথাই হতোনা তারসাথে।শান্তশিষ্ঠ আর গম্ভীর ছেলেটা সবসময় পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।সেই শান্তশিষ্ট ছেলেটার জন্য একটাসময় মামি তাকে পছন্দ করলো।তবে নিভানের গম্ভীর আচারনে আর সবসময়ে নির্লিপ্ত থাকার কারনে তন্মধ্যে সিয়াম তার জীবনে এসে গিয়েছিলো।
সিয়ামকে যে তার ভালোবাসা ছিলো বা সে সিয়ামকে ভালোবাসতো এমনটা-ও নয়।মামার বিজনেস পার্টনারের ছেলে ছিলো সে।একবার এবাড়িতে উনাদের পুরো ফ্যামিলিকে নিমন্ত্রণ করা হয়।সেখানে দীবাকে দেখে পছন্দ করে সিয়াম।নিজেথেকে যোগাযোগ করে নেয় দীবার সাথে।তারপর বিভিন্নভাবে যোগাযোগ, কথাবার্তা আদান-প্রদান।সিয়ামের কথাবার্তা চালচলনে এমনকি হুটহাট তার ভার্সিটির সামনে চলেআসা,কারনে অকারণে ফোন করা।সেসব বুঝিয়ে দিতো সিয়াম তাকে পছন্দ করে।এমনকি একদিন হাটুগেড়ে প্রপোজও করে দিলো যে,সে দীবাকে ভালোবাসে।সেদিন প্রপোজ গ্রহন করা নিয়ে দোনোমোনো করছিলো দীবা।কেননা সে তখন-ও নিভানকে নিয়ে কনফিউশানে ছিলো।তবুও কিভাবে কিকরে যেনো সিয়ামের সাথে জড়িয়ে গেলো।
আর সেই জড়ানোটায় তার মা কোনোভাবে টের পেয়ে এমন ইন্ধন যুগিয়েছিলেন,পিছু ফিরে তাকানোর কোনো যুক্তিতর্ক বাদ রাখেননি।মা হয়তো নিভানকে নিয়ে তার মনোভাবটা জানতেন!যা উনার পছন্দ ছিলো না।এমনিতেই ছোটো থেকে নিভানকে উনার কখনোই বিশেষ পছন্দ ছিলো না সেখানে নিজের মেয়ের ভালোলাগা অনুভূতিটা তাকে ঘিরে।তিনি মানতেই পারছিলেন না।আর যখন সিয়াম এলো মাঝখানে তখন তো তিনি মানার মতো কারনই খুঁজে পেলেন না।ভালোমন্দ কতোকিছু বোঝালেন তাকে।তারমধ্যে যখন হঠাৎই একদিন সিয়াম,বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তার মা বাবা সমেত হাজির হলো।মা যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলন।বড়মামি সেদিন মাকে তাদের আড়ালে প্রস্তাব রাখলেন যে,—–বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকুক।অনত্র দেওয়ার থেকে চোখের সামনে থাকা ভালো।মা সেদিন সরাসরি মামির প্রস্তাব নাকচ না করলে-ও,তাকে দিয়ে মতামত একপ্রকার না করাতে বাধ্য করেছিলেন।ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন।
‘নিভান এবাড়ির ছেলে নয়।বড়ভাই মন থেকে যদি চায় তবে নিভান সম্পত্তির ভাগ পাবে না-হলে নয়।সেখানে নিভানের সাথে সাংসার পেতে তোর লাভ আছে?আর কি আছে ওই ছেলের মধ্যে।যেখানে সিয়াম তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। সেখানে রাজরানি হয়ে থাকবি তুই।দেখতেও কোথায় শ্যামকালো নিভান আর কোথায় রাজপুত্রের মতো দেখতে সিয়াম।নিজহাতে কেনো দূর্ভাগ্যকে কপালে টেনে এনে সৌভাগ্যকে ছেড়ে দিবি।সবকিছুর তফাৎ করার বা ভালো মন্দ বোঝার বয়সটা তো নিশ্চয় হয়েছে।সুতরাং আবেগে না ভেসে বাস্তবতায় ভাসো।কোথায় ভালো থাকতে পারবে,সেই বুঝজ্ঞানতো হয়েছে।
সত্যিই কি বয়স হলেও দেই জ্ঞানবুঝ তার হয়েছিলো?
সেদিন মা শুধু বাহিরের চাকচিক্য দেখেছিলো।ভিতরটা দেখেনি।দেখিনি ছেলের চরিত্র কেমন।সেই চাকচিক্যের মানুষ আর অর্থের মধ্যে উনার মেয়ে ভালো থাকবেন কি-না!দোষতো শুধু মায়ের একার ছিলোনা তার-ও তো ছিলো।নাহলে বুঝদার হওয়া সত্ত্বেও খাঁটি হিরা ছেড়ে কাচ কিকরে বেছে নিয়েছিলো সে?কেউ ইন্ধন দিলো,আর বুঝেশুনে সেই ইন্ধনের আগুনে ঝাপ দেওয়া তো,সম্পূর্ণ সেই ইন্ধন জোগানো মানুষটার দোষ নয়।সেখানে বুঝেশুনে সেই ইন্ধনে প্রশ্রিত হওয়া,নিজেরইতো দোষ।আর কোন বাবা মা কি সত্যিই চায় তার সন্তানের অমঙ্গল বা খারাপ?তবে মা কেনো বুঝেও বুঝলো-না,তার মন।তার ভালোটা।সেদিনও তো বাড়িতে আসার পর মামা কি বললো।তারউপরে এসে চোটপাট করলো, কতো কথা শোনালো।–ছেলেদের নাকি ওরকম একটু আধটু চারিত্রিক দোষ থেকেই থাকে।সেটা মানিয়ে গুছিয়ে নিয়ে সংসার করতে হয়।আরও কতো কথা।অথচ একবারও জানতে চাইলেননা সে কি চায়!সে সেই মানুষটার সাথে ভালো আছে কি-না?আগেও জানতে চাইনি আর এখনো জানতে চায়না,বুঝতে চায়না।মায়ের তারজন্য এ-কেমন ভালো চাওয়া,ঠিক বুঝে আসে-না দীবার।
হাটমুড়ে বসা দীবা,দুহাটুর ফাঁকে মুখ গুজে হুহু করে কেঁদে দিলো।জীবন এমন কেনো এলোমেলো হয়ে গেল তার!যেভাবেই হোক বিয়েটা যখন হয়ে গিয়েছিলো,সে মনের ভালোলাগাটাকে ভুলে সিয়ামের সাথে সংসারে মন দিতে চেয়েছিলো।সত্যি বলতে সে-ও তখন বাহিরের চাকচিক্যেরের মোহে ভুলে গিয়েছিলো তার পিছনের ভালোলাগাটা।তবে বিয়ের পর যখন সিয়ামের কাজিন বা বন্ধুবান্ধব থেকে একটু একটু করে জানতে পারলো, তারসাথে বিয়ে হওয়ার আগে সিয়ামের একাধিক মেয়েদের সাথে সম্পর্কের কথা।চারিত্রিক বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তখন একটু একটু করে মন খারাপ হতে থাকলো।সম্পর্কের সুতোয় চির ধরতে শুরু করলো।তখন তার পুনরায় নিভানের কথা মনে হতে থাকলো।যে নিভান কখনো কোনো মেয়ের দিকে অযাচিত কারনে তাকায়নি,অপরিচিত মেয়েদের সাথে সহজে অহেতুক কথা বলতে দেখিনি।গম্ভীর্যভাব আর কথা কম বললেও, যে ছেলের সবদিক থেকে ছিলো পারফেক্ট।যারজন্য দীবার ভালো লাগাটা তৈরী হয়েছিলো।সেই ছেলেটাকে ভুলে ক্ষনিকের মোহে পড়ে বিয়ের মতো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তাতে জড়িয়েও পড়লো!সিয়ার আর নিভানের মধ্যের সবদিকের গুনাবলির কম্পেয়ার করতে করতে একটা সময় তাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের এতোটা অবনতি হয়,সেই সম্পর্কে থাকাটা তিক্ততার হয়ে যাচ্ছিলো।বিধায় এবাড়িতে চলে এসেছে।আর আসার আরও একটা পাকাপোক্ত কারন ছিলো,পুরানো ভালোলাগার মানুষটাকে পুনরায় ফিরে পাওয়া।তবে আর ফিরে পাওয়া হলো কোথায়!সে মনে যে বাসা বেঁধেছে যে অন্য কেউ।তবে খড়কুটো দিয়ে যেন-তেন বাসা নয়,সে যে লোহার খাঁচার মতো পাকাপোক্ত ভাবে বাসা বেঁধে নিয়েছে সে মনে।যা আজ নিভানের কথায় ঢেড় টের পেয়েছে সে।
কান্নার গতি বাড়লো দীবার।যদি সেদিন আগেপিছে না ভেবে মামির সিদ্ধান্তে রাজি হতো সে।তবে নিভানের সেই একান্ত মনের জায়গাটা তার হতো।ওই পাগলকরা মুগ্ধকর ভালোবাসাটাও শুধুই একান্তে তারই হতো।তবে নিজেই সে-পথ রোধ করে দিয়েছে।সেই-পথে যে তার আর স্থান নেই______হঠাৎ ফোনের আওয়াজে কান্নার তীব্রতা কমে গেলো দীবার।তবে মাথা তুললো না সে।এতোরাতে কে ফোন দিতে পারে,সেটাও বেশ অনুধাবন করতে পারলো।সেদিকে আর মন দিলো-না।তবে ফোনের একের পর এক বেজে যাওয়া রিংটোনে বিরক্ত হলো সে।এটাও তার জানা ছিলো,সে ফোন না ধরা পর্যন্ত ওই অসভ্যটা কল দেওয়া বন্ধ করবেনা।আজ ঝগড়া করার মানসিকতায় নেই তার মন,তাই সে ফোন তুলতে চাচ্ছিলোনা।কিন্তু না তুলে উপায় আছে।বেড থেকে ফোনটা নিয়ে কল রিসিভ করে কানে তুললো দীবা।ওপাশ থেকে সিয়ামকে ত্যাড়াবেঁকা কিছু বলতে না দিয়ে কান্নাভেজা ক্লান্ত গলায় বললো।
‘আমাকে কি একটুও শান্তিতে থাকতে দেবেনা তুমি?কি চাইছো কি তুমি?আমি মরে যাই এটাই চাইছো!আচ্ছা মরে গেলে তুমি শান্তি পাবে! ঠিক আছে,তবে তোমাদের শান্তিরই ব্যবস্থা করি।
ওপাশ থেকে ধমকে উঠলো সিয়াম।–দীবা
সিয়ামের ধমকে এবার গলা ছেড়ে হুহু করে কেঁদে দিল দীবা।কান্নারত গলায় ফের বললো—তবে দাওনা আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে।দয়া করে আর ফোন দিয়ে জ্বালিওনা আমাকে।একটু শান্তিতে থাকতে দাও সিয়াম।প্লিজ থাকতে দাও আমার মতো আমাকে।তোমাদের কাওকে চাই-না আমার।
ওপাশ থেকে আর একটা শব্দও এলো-না।এপাশ থেকে দীবা তখন হুহু করে কেঁদে চলেছে।কিছুসময় পর কল কেটে যেতেই,ফোনটা বেডে ছুঁড়ে দিয়ে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লো সে।সিয়ামের এই রোজ রোজ ফোন দিয়ে বিরক্তিরতার কারনটা হলো,সিয়াম তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। তাকে ছাড়তে চাইছেনা!
.
সময়টা রাত আটটার কাঁটায়।গম্ভীর মুখে সোফায় বসে আছে নাফিম।নানু অসুস্থ থাকায় কাল নানাবাড়ীতে গিয়েছিলো সে।একটু আগে সেখান থেকে ফিরেছে,সেই থেকে মন খারাপ তার।সাথে ফর্সা গোলুমোলু মুখটা অন্ধকারচ্ছন্ন রাতের ন্যায় অন্ধকার করে রেখেছে।কি হয়েছে কাওকে কিছুই বলছেনা।শুধু গুম মেরে বসে আছে।ইভান বাহির থেকে এসে নাফিমকে এমতাবস্থায় দেখে,তারপাশে ধপাৎ করে বসে বললো।
‘কিরে পিচ্চু,ওভাবে মুখ ভার করে বৈজ্ঞানিকদের মতো কি ভেবে চলেছিস?
আঁড়চোখে ইভানকে একপলক দেখে।ফের নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো নাফিম।কিছুই বললোনা।সেটা কিছুসময় কপাল কুঁচকে দেখে ইভান ফের বললো–কি, গার্লফ্রেন্ড ভেগে গেছে নাকি?যে ওমন গুম মেরে বসে শোক পালন করছিস?
‘আমার গার্লফ্রেন্ড নেই।আর এই বয়সে গার্লফ্রেন্ড থাকা ভালো কথা নয়।
নাফিম গম্ভীর গলায় কথাটা বলতেই ইভান সোজা হয়ে বসলো।ফের মিছেমিছি মুখের ভাবে আশ্চর্যতা দেখিয়ে বললো—ওমা এতো সুন্দর নীতিবাক্য তোকে কে শেখালো শুনি?
‘ছোটোমামা বলেছে।
ইভান এবার সত্যি আশ্চর্য হলো।কারন নাফিমের ছোটমামা কিছুটা ইভানের কোয়ালিটির মানুষ।সেখানে তিনি আর নীতিবাক্য।মোটেই যাচে না। ইভান পের কিছু বলার আগেই নাফিম আবারও গম্ভীর গলায় বললো।
‘ছোটো মাাম জিজ্ঞেস করেছিলো ক্লাসে আমার কয়টা গার্লফ্রেন্ড আছে, আমি বলেছিলাম অনেক।কেননা আমার ক্লাসের মেয়েগুলো তো সবই আমার গার্লফ্রেন্ড হয়,তাই না।তখন ছোটো মামা এগুলো বলেছে।
নাফিমকে ক্ষেপানোর জন্য কথাগুলো যে বলেছে,এবার এটা বেশ বুঝলো ইভান।হেসেও ফেললো সে।নাফিমের মন খারাপের কারন যে তার ছোটো মামার উল্টোপাল্টা
কথা এটাও বেশ বুঝলো।হাসি ঠোঁটে বজায় বললো–তা মামা আর কি কি নীতিবাক্য শিখিয়েছে,বলে ফেল তো পিচ্চু।আমিও একটু জানি, শিখি।এবার নাফিমের মুখ কাঁদোকাঁদো হয়ে গেলো।আবেগে অবুঝমন বলে দিলো।–ছোটোমামা বলেছে,আমি নাকি আমার আম্মু আব্বুর ছেলে নই।আমাকে আব্বুআম্মু হসপিটাল থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছিলো নাকি।
‘যাক বাবাহ।তোর ছোট মামাতো মোটেই সুবিধার মানুষ নন।সত্যি কথাটা আমরা এতোদিন চেপে রাখলাম,তুই কষ্ট পাবি বলে।সেটা তোকে বলেই দিলো।মামাকে তো এখন ফোন দিয়ে বকতেই হচ্ছে।
এবার সত্যিই নাফিম কেঁদে দিলো।ফর্সা চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল।ছোট্টো লাল টুকটুকে ঠোঁট দুটো ভেঙে উঠলো ফুপিয়ে।সেটা দেখে ইভান মুখটা মিছেমিছি আহত ভঙ্গিমা করে বললো।—কাঁদছিস কেনো পিচ্চু,কাদিসনা।তুই আমাদের চাচির পেটের ভাই না বলে,আমরা কি তোকে কম আদর করি?কম ভালোবাসি,বল?
‘তুমিও,ছোটোমামার মতো মিথ্যা বলছো?তাইনা ছোটো দাদাভাই?
নাফিম কান্নারত গলায় কথাটা বলতেই,ফের মিছেমিছে মুখটা করুণ করে ইভান বললো।—আমি তোদের একটু ক্ষেপালেও কখনো মিথ্যা বলি।তুই বল?আচ্ছা তুই যদি আমার কথা বিশ্বাস না করিস,তবে তুই নিজে ভেবে দেখ।সাধারনত নামের ক্ষেত্রে ভেবে দেখ,আমার নাম ইভান।বড়াে দাদাভাইয়ের নাম কি?নিভান।দেখেছিস আমাদের দু-ভাইয়ের মধ্যে নামের কতো মিল।মিল আছে কি-না বল?তারপর তোর বড়আপু ছোটোআপুর নামগুলো দেখ?মান্যতা আর মৌনতা।তাদের নামেরও কতো মিল।মিল থাকবেনা কেনো?মিলিয়েই তো রাখা হয়েছে।এখন তুই ভেবে বল আমাদের ভাই বোনদের নামের মিল আছে কি-না?আর সেখানে তোর নাম কি?নাফিম।আমাদের ভাইবোনদের নামের সাথে তোর নামের সেভাবে কোনো মিল আছে?তুই বল,আছে কি না?নেইতো।এই লজিক মানলেও তো…..
ইভানের কথা শেষ করতে দিলোনা নাফিম।গলা ছেড়ে হা হা করে কেঁদে দিলো। আর নাফিমের কান্না দেখে সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়ানো কৌড়ি খিলখিলিয়ে হেসে দিল।সে এতোসময় ধরে দু ভাইয়ের কথপোকথন শুনছিলো সে।দেখতে চাইছিলো,শেষ পর্যন্ত কি হয়!তবে সেটাই হলো।জুনায়েদ জাহিদ ইভান যার পিছু লাগে,ইতুড়ের মতো লাগে!তাকে কাদিয়ে ছেড়ে দেয়!নাফিকের কান্না দেখে খুব মন খারাপ করার বা দুঃখ পাওয়ার কথা থাকলেও,কেনো জানি খিলখিলিয়ে হাসি পেলো কৌড়ির।আর জ্বরে মিইয়ে যাওয়া সেই শুভ্র মুখের মায়াময় হাসির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো, দোতলায় দাঁড়িয়ে থাকা নিভান।আজ চারদিন অসম্ভব সর্দি-জ্বরের পালা চুকিয়ে মেয়েটা মনেহয় কিছুটা সুস্থ। ওই খিলখিলিয়ে উঠা হাসিটা তো সেরকমটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।মনের কোণের স্বস্তির আর শান্তির জায়গাটায় যেনো একটু বিশ্রাম মিললো তার।সুগভীর সুস্থির নজরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো,হাসতে হাসতে নাফিমের দিকে এগিয়ে যাওয়া কৌড়িকে।
কৌড়ির খিলখিলিয়ে হাসি দেখে নাফিমে কান্নার জোর বড়লো বৈ কমলোনা।কাঁদলোও সে।সেই কান্না বসেবসে নিষ্ঠুর মানুষের মতো উপভোগ করছে ইভান।কৌড়ির এগিয়ে আসতে দেখেই ইভান বললো–তুমি বলো ফুলকৌড়ি আমার লজিক ঠিক কি-না।
‘মোটেই ঠিক না।পুরোই ইললজিক্যাল কথাবার্তা।নিভান আর ইভানের ভাই নাফিম।নাম মিলালো না কি-করে?আপনি সেটা বলুন আমাকে?
কথাটা বলতে বলতে নাফিমের পাশে বসলো কৌড়ি।ইভানের থেকে উত্তরের আশা না করে ফের নাফিমকে উদ্দেশ্য করে বললো।–তুমি এই সামন্য কথায় কাঁদছো নাফিম?তুমি কখনো নিজেকে আয়নায় দেখেছো,তুমি পুরো ছোটোমায়ের মতো দেখতে।চোখ কান নাক ঠোঁট, তোমার পুরো অবয়ব ছোটোমায়ের মতো।কে বলেছে তুমি হসপিটাল থেকে চেয়ে নিয়ে আসা ছেলে।পাগল ছেলে!ছোটো দাদাভাইতো এগুলো তোমাকে ক্ষেপানোর জন্য বলছে।আর তুমি কাঁদছো?বোকা!
‘তোমার কথাগুলো সত্যি ফুলকৌড়ি?
কান্না থেমে গিয়ে উৎফুল্ল গলায় কথাটা জিজ্ঞেস করতেই,কৌড়ির আগে ইভান উত্তর দিলো—একশো পার্সেন্ট মিথ্যা। ফুলকৌড়ি তোকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলছে।
এবার কান্না বাদে রেগে গেলো নাফিম।গলা চড়িয়ে নীহারিকা বেগমে উদ্দেশ্য করে বললো–বড়মা,ছোটো দাদাভাই কিন্তু আমাকে আবার-ও..….
কথা শেষ করতে দিলো না তার আগেই নাফিমের মুখ চেপে ধরলো ইভান।ফের বললো–হসপিটাল থেকে চুরি করে নিয়ে আসা ছেলে, চুপ কর।
কথাটা বলতে বলতে প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে নাফিমের হাতে দিয়ে বললো—একদম গলা দিয়ে সাউন্ড বের করবিনা,বড়মায়ের আদরে বাদর হওয়া মিনি।
ফোন পেতেই নাফিমও আর দাড়ালো-না।কান্নাকাটি সবকিছু ভুলে দৌড়ে চলে গেলো।কৌড়ি উঠে দাড়াতেই ইভান তাকে কথার ছলে থামিয়ে দিলো–তখন আমার নাম ধরলে ঠিকআছে,দেবরের নাম ধরাই যায়।তাই বলে বরের নাম ধরলে কেনো?পাপ হবেনা?
কপাল কুঁচকে গেলো কৌড়ির।সে কখন বরের নাম ধরলো।আরেহ ধেৎ,সে বিয়ে করলো কখন যে তার বর হবে!ইভান ভাইয়া নাফিমকে ছেড়ে এবার তার পিছনে লাগার ধান্দা করছে ভেবে বললো।—আমার বরের নাম আমি ধরেছি,তো বেশ করেছি।তাতে আপনার কি?
ইভান নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো।
‘বাহ বাহ,বিয়ে হতে পারলো-না,তারআগেই ভাইকে তার ভাইয়ের জীবন থেকে আউট করে দিয়ে বলছো।আপনি কে?একেই বলে বাড়ির যোগ্য বড় বউ!যাই হোক সেসব বাদ,তোমার বরের নাম নাহয় তুমি ধরতেই পারো, সত্যিতো আমি বলার কে?তবে তোমার বরতো বলার রাইট রাখে তাই-না?পিছনে দোতলায় তাকাও ফুলকৌড়ি?সেখানে তোমার বর অপেক্ষা করছে,উত্তর নেওয়ার জন্য।
বোকাবোকা নজরে সত্যিই পিছনে তাকালো কৌড়ি।দোতলার রেলিঙ ঘেঁষে তাদের দিকে স্থির আর শান্ত নজরে তাকিয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে বুক ধ্বক করে উঠলো তার।চোখ বড়োবড়ো হয়ে গেলো মূহুর্তেই।মনে পড়লো,সত্যিতো একটু আগে নাফিমকে বলার সময় ইভান ভাইয়ার সাথে ওই মানুষটার নাম-ও নিয়েছে সে।সেজন্যই তো নাম নিয়ে ইভান ভাইয়া ওরকমটা বললো।আর সে নাম নিয়েছে খেয়ালে না থাকার দরূন, না বুঝে কিসব বলে দিয়েছে।মানুষটা কি শুনে ফেলেছে তার বলা উল্টো পাল্টা কথাগুলো!মূহুর্তেই নজর ফিরিয়ে নিলো কৌড়ি।এখন তার হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।ইচ্ছে তো মিটাতে পারলোনা,তবে ইভানের উপর ক্ষোভ মিটাতে বললো।
‘আপনি খুব খারাপ, ইভান ভাইয়া।
একগাল হেসে ইভান বললো–সেটা আর নতুন কি বড়ো ভাইয়ের বউ।তা শুনলাম দুজন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর সর্দি বাঁধিয়ে বসে আছো।তবে কি দু’জনের মধ্যে সামথিং সামথিং কিছু হলো?
মূহুর্তেই সেদিনের বৃষ্টিভেজা মূহর্তগুলো মনের গহীনে ভেসে উঠলো কৌড়ির।তাঁকে দেখে ওই মানুষটার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা,মনেহয় শত বছরের তৃষ্ণার্থ পাখি একফোঁটা পানির জোগান পেয়েছে।কাছে এসে কোমল গলায় শুধানো,খুব ভয় পেয়েছো তাইনা?কৈ সেদিন সেই গলায় তো কোথাও একফোঁটা গম্ভীর্যতা ছিলোনা?কতো নির্মল,কোমল ছিলো সে কন্ঠ।তারপর তাকে অভয় দিয়ে বলা,আমি তোমার কাছে এসে গেছিতো, তবে ভয় কিসের!কথাগুলো মনে পড়তেই ভিতরে ভিতরে কাটা দিয়ে উঠলো কৌড়ির।সর্দিতে এখনো ভার হয়ে থাকা নিঃশ্বাসটা আরও ভারী হয়ে উঠলো।ইভানের সাথে আর কথা না বাড়ালো না।
‘কি হলো?তোমার বরের প্রেমে পড়ে গেছো মনে হচ্ছে?
ভাবনা ভঙ্গ হলো কৌড়ির।কি বলবে কোনো কথা না খুঁজে পেয়ে বললো।–আপনি আসলেই খুব খুব খারাপ। আর আমি মোটেই কারও প্রেমে পড়িনি।
‘কিন্তু সে, তোমার প্রেমে পড়ে গেছে।
কথাগুলো বলে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে যখন পা বাড়ালো চলে আসার জন্য।ইভানের কথায় পা থমকে গেলো তার।থমকে গেলো বুকের মধ্যে ধুকপুক করা চলা হৃদস্পন্দন-ও।তবে ইভানের কথায় সে নিজেকে দূর্বল করে চায়না।আর না নিজেকে দূর্বল দেখাতে চায়।আর সে নিশ্চিত ইতুড়ে ছেলেটা তারসাথে ফাজলামো করছে।তাই ঘাড় ফিরিয়ে সে বললো।
‘আপনাকে বলেছে তাই না?
‘বলবে কেনো?তার চোখে চোখ রেখে দেখো তবে নিজেই বুঝতে পারবে।
দাঁড়ালো না কৌড়ি।আরনা আশেপাশে তাকানোর প্রয়োজনবোধ করলো।কেনো জানিনা,তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে,ওই মানুষটা এখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে।আর তার সূচালো আর শান্ত নজর তাদের দিকেই নিবন্ধিত।ইভানের শেষের কথার প্রতিত্তোর সরূপ মৃদুস্বরে আওড়ালো।
‘খেয়ে কাজ আছে!ওই চোখে চোখ রেখে সে নিজের দূর্বল হৃদয়ের মৃত্যু ডেকে আনবে।
★
আজ প্রায় পাঁচদিন পর পুরোপুরি সুস্থ কৌড়ি।কলেজে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হতেই মান্যতা তার সঙ্গ নিলো।দুজনেই গেটের বাহিরে পা রাখতেই মান্যতা বললো।—ফোন নিয়েছো কৌড়ি?
আজ সকাল সকাল কলেজে বের হওয়ার কিছু সময় আগে মান্যতা আপু,তাকে একটা ফোন ধরিয়ে দিয়েছে। ফোনটা যে নতুন এবং দামী,সেটা দেখেই বুঝতে পেরেছে কৌড়ি।এতোদামী ফোন নেবেনা নেবেনা করে-ও,মান্যতার বিভিন্ন যুক্তিতর্কে তাকে বাধ্য হয়ে নিতে হলো।কিন্তু ফোনটা কাছে নিতেই,একটা চেনা পরিচিত সুগন্ধ এসে ঠেকলো তার নাকে।অজানা কারনে বিভিন্ন প্রশ্ন মনে এলেও,মান্যতাকে তা জিজ্ঞেস করতে পারলো না সে।
‘কি হলো নিয়েছো?
‘হুম আপু।
দু’জনে একটা রিকশা ডেকে রিকশায় উঠলো।হঠাৎ ফোনের আওয়াজে বিভ্রান্ত হলো কৌড়ি।কার ফোন বাজছে বুঝে উঠতে পারলোনা,তবে এটা বুঝলো।এই টোন মান্যতা আপুর ফোনের নয়।তবে তার ফোনের।নতুন ফোন সকালে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে মান্যতা আপু।তারমধ্যে কে নাম্বার জানলো আর কেই বা ফোন দিলো?
‘তোমার ফোন বাজছে কৌড়ি।
এতো নির্লিপ্ত কন্ঠে কথাটা বললো মান্যতা,যেনো সে জানতো কেউ ফোন দেবে।আর কে দিয়েছে এটাও মনে হয় মান্যতা আপুর জানা।নাহলে…..
‘ফোনটা ধরো কৌড়ি।
অদ্ভুত তরঙ্গে ভিতরের সকল অনুভূতি উথাল-পাতাল ঢেউয়ে দুলতে থাকলো কৌড়ির।অকারনে কাঁপলো হাত।সেইমৃদু কাঁপা হাতে ফোনটা ব্যাগের মধ্যে থেকে বের করলো সে।কল কেটে গিয়ে নিভে যাওয়া স্কিনটা ফের জ্বলে উঠতেই,স্কিনের উপরে জ্বলজ্বলে গোটাগোটা ইংরেজি অক্ষরে লেখা Nivan নামটা ভেসে উঠতেই সকল ইন্দ্রিয়ের কাজ করা বন্ধ করে দিলো কৌড়ির।চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে একবার মান্যতার দিকে তাকালো সে।মেয়েটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিজের ফোনের মধ্যে ডুবে আছে।যেনো আশেপাশে কোথায় কি ঘটে চলেছে,হয়ে চলেছে তাতে তার কোনো খেয়াল নেই।এমনকি যায়ও আসেনা।আশ্চর্য হলো কৌড়ি।নিজের ফোনের দিকে নজর রেখেই ফের মান্যতা বললো।
‘কলটা রিসিভ করো কৌড়ি।হয়তো দাদাভাই ইম্পর্ট্যান্ট কোনো কথা বলবেন।
তারসাথে ইম্পর্ট্যান্ট কথা।ওই মানুষটার সাথে তার কি ইম্পর্ট্যান্ট কথা থাকতে পারে?আর এরা ভাইবোনেরা শুরু করেছেটা কি?তাকে কি পাগল মেরে ফেলার ধান্ধায় নেমেছে।নাহলে ঠেলেঠুলে কোনো ওই মানুষটার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে।তৃতীয়বার ফোনটা বাজতেই ফোনটা ধরলো কৌড়ি।তবে হ্যালো বলার সাহস পেলো-না।ওপাশের ধৈর্য্যশীল মানুষটা-ও হয়তো এই মেয়েটার বেলায় ধৈয্যহীনা হয়ে পড়লো।ফোন রিসিভ করতেই বললো।
‘ফোনটা তুলতে এতো সময় লাগে?তুমিতো বাধ্য মেয়ে তবে আমার বেলায় কেনো অবাধ্য হতে চাইছো?
প্রানটা যায়যায় অবস্থা কৌড়ির।মুখ ফুটে একটা রা শব্দও উচ্চারণ করলোনা সে।শুধু কঠিন পাথরের মতো নিথর হয়ে বসে রইলো।সেটা হয়তো বুঝতে পারলো ওপাশের মানুষটা।নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে সময় নিয়ে বললো।
‘ভালোমন্দ যে-কোনো কারণেই হোক,প্রয়োজনে আগে আমাকেই ফোন দেবে।সুবিধা হোক বা অসুবিধা আগে আমাকেই জানাবে।সেটা ঝড়-তুফান বর্ষা-বাদল বা রাত-দিন,অ্যাট এ্যানি টাইম।যখন-তখন যেকোনো সময়ে অসময়ে,ভালোমন্দ প্রয়োজনটা আগে আমাকেই জানাবে।ভুলেও ভুল করো না কৌড়ি।তুমি তো বাধ্য মেয়ে,ভুলে-ও আমার কথার অবাধ্য হতে যেও না।আর আমার কথার অবাধ্য হতে গিয়ে যদি নিজের ক্ষতি ডেকে আনো বা তোমার কোনোরূপ ক্ষতি সাধিত হয়।মানা মুশকিল হয়ে যাবে।আর আমার কথা না মানলে কিন্তু মোটেই ভালো হবে-না।একদম ভালো হবে না কৌড়ি।
চলবে…