ফুলকৌড়ি পর্ব-১৮+১৯

0
7

#ফুলকৌড়ি
পর্ব (১৮) গল্প কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ
#লেখনীাতে_শারমীন_ইসলাম

কান্না থেমে গেল কৌড়ির।দরজার দৌড়গোড়ায় দাড়নো ছেলেটার উচ্ছ্বসিত কন্ঠের নির্বিকার কথায় কান্নাভেজা নজরজোড়া হয়ে উঠলো অসহায়।এই ছেলে তার মানসম্মান আর কিছুই রাখলো-না।সারাদিনে একদণ্ডও শান্তিতে থাকতে দেয়না।যখন তখন যেখানে সেখানে যারতার সামনে ওই লোকটাকে আর তাকে ঘিরে উল্টো পাল্টা কথা বলা শুরু হয়ে যায়।তার নরমাল প্রেশার বাড়িয়ে দেয়।এখন এমন একটা অবস্থা হয়েছে তার,এই ইতুড়ে ছেলেটা যেখানে থাকে ভুলেও সেখানের ছায়া মাড়ায় না কৌড়ি।কখন কার সামনে উল্টো পাল্টা কিছু বলে বসে,আর তার না অকালে আক্কা পাওয়ার টাইম চলে আসে।এই ছেলের জন্য না শান্তিতে কোথাও থাকা বসা যায়,আর না মনের দুঃখে শান্তি মতো কাঁদা যায়।এখন যদি ইভান ভাইয়ার কথার বর্ননা অনুযায়ী তার না হওয়া শ্বশুরবাড়ির,আর বরের ডিটেইলস সম্পর্কে জানতে চায় মান্যতা আপু।তবে কি’হবে?জানতে পারলে কি ভাববে মেয়েটা?আর তার কি লজ্জার শেষ থাকবে?
তারপর ওই ভয়ঙ্কর লোকটাকে আর তাকে ঘিরে এসব কথা যদি বাড়ির সবার কনে যায়,কেমন বিব্রতকর আর অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে

‘কৌড়ি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যেতে চায়-না মানেটা কি?আর ওর বরটা আবার কে?

গলায় আশ্চর্যতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো মান্যতা।ইভান দরজার সামনে থেকে এগোতে এগোতে বললো।

‘তোকে বলবো কেনো?এটা ফুলকৌড়ির আর আমার সিক্রেট ব্যাপার স্যাপার।তোর মতো পেট পাতলা মেয়েকে বলে,আমার না হওয়া বউমনির আমি সর্বনাশ ডেকে আনি।অসম্ভব!যে-কোনো মূল্যে যুদ্ধ বিদ্রোহ করে হলে-ও তাকে আমার বউমনি বলে চাই।

ইভানের সতেরো প্যাচানো কথা শুনে মান্যতার কপাল কুঁচকে গেলো।নিজের নামের অপমানটাও গায়ে মাখানোর সময় পেলো না।কৌড়ির দিকে তাকালো সে।মান্যতা তাকাতেই কৌড়ির অসহায় মুখটা আর-ও ছোটো হয়ে গেলো।সন্দেহভাজন গলায় জিজ্ঞেস করল।

‘ছোটো দাদাভাই এসব কি বলছে কৌড়ি?তোমার আর ওরমধ্যে কি সিক্রেট চলছে?তোমার আবার হঠাৎ বর, শ্বশুরবাড়ি,এসব আসলো কোথা থেকে?

উত্তর দিতে পারলো না কৌড়ি।মুখটা আরও ছোটো করে ফেললো।ইভানের দিকে অদ্ভুত নজরে তাকাতেই চমৎকার হেসে দিলো সে।সেটাও অদ্ভুত নজরে দেখলো মান্যতা।ইভানের বলা কথাগুলো না ভেবেচিন্তে হুটকরে বলে বসলো।

‘তুই কি কোনোভাবে কৌড়িকে এ-বাড়ির ছোটো বউ বানানোর ইঙ্গিত দিচ্ছিস?

‘আস্তাগফিরুল্ল্যাহ,এসব কি কথাবার্তা!এই গর্দভ আমি একটু আগে কি বললাম।ফুলকৌড়িকে আমি আমার না হওয়া বউমনি বললাম না।আর তুই না ভেবেচিন্তে কি আস্তাগফিরুল্ল্যাহ মার্কা কথাবার্তা বলে দিলি!বুঝেছিস তবে কেনো আমি তোকে মাথামোটা বলি।ওমনি ওমনি তো আর বলিনা।কথাবার্তা কাজকর্ম যেমন নামও তার তেমন হওয়া উচিত?তাই নয়কি ফুলকৌড়ি?ওহ স্যরি স্যরি আমার বউমনি?

কৌড়িতো কথা বলতেই ভুলে গেলো।এই ছেলের কথার পাল্টা কথা বলা মানে।এক পুকুর ভরাডুবি জলের মধ্যে একটুকরো ঢিক ফেলা।মান্যতা আশ্চর্য হয়ে বললো।–তারমানে?

‘ইয়েস, ফুলকৌড়িকে আমি দাদাভাইয়ের বউ বানাবো বলে কনফার্ম করে ফেলেছি?কনফার্ম মানে বিয়ে হোক আর না হোক,আমার দাদাভাইয়ের বউ হবে ফুলকৌড়ি।
অন্য কাওকে আমি মানিনা,মানবোও না।

মান্যতা বিমূঢ় হয়ে ইভানের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো–দাদাভাই আর কৌড়ি!একজন পানির মতো সহজ তো অন্যজন পাহাড়ের মতো দৃঢ় কঠিন।কিভাবে সম্ভব?নাকি তুই সম্ভব বানিয়ে নিয়েছিস?

‘সম্ভব নয় কেনো?আমাদের সবার ফুলকৌড়িকে পছন্দ এমনকি দাদাভাইয়ের বউ হিসাবেও পছন্দ।সো দাদাভাই না মানলে,আমরা হরতালে নামবো।আমাদের একটাই দাবী হবে,ফুলকৌড়িকে আমাদের বউমনি হিসাবে চাই।দাদাভাই আমাদের দাবী না মানা পর্যন্ত এ-দাবী চলতে থাকবে।দাদাভাই মানতে বাধ্য!আর এমনিতে-ও দাদাভাই মানতে বাধ্য।শুধু দাদাভাইয়ের বউটার সুমতি আর সম্মতি হলেই হয়।

ওহ তারমানে ছোটোদাদাভাইয়ের এটা নিজস্ব ভাবনা, বড় দাদাভাই জানে না কিছু।তবে ভাবনাটা মন্দ নয়।কিন্তু তাদের ওই গুরুগম্ভীর দাদাভাই জীবনে এই দাবী মানবে বলে মন হয়না তার।

‘ইভান ভাইয়া থামুন’না প্লিজ।আমার মাথা কেমন কেমন করছে?আপনার এ্সব ভয়াবহ উল্টো পাল্টা কথার জ্বলায় ক’দিন পর দেখবেন,আমি রাস্তা রাস্তায় ঘুরছি।

‘ঘুরবে রাস্তায়,সমস্যাটা কোথায়?দাদাভাই আছেনা।বউ রাস্তায় ঘুরবে,আর সে বসেবডে দেখবে নাকি।ধরে নিয়ে আসবে।তবুও আমার দাবী মানতেই হবে তোমাকে।

কৌড়ি অযথা আর কথা বাড়ালোনা।প্রবাদে আছে না,বিচার মানতে পারি তবে তালগাছটা আমার।মায়ামায়া মুখটা ছোটো করেই মান্যতার দিকে তাকিয়ে রইলো।মান্যতা সেটা দেখে বললো–ওর মাথার নাটবোল্টু আগে থেকেই ঢিলা আছে,এটাতো তুমি-ও জানো।দেখোনা,সারাদিন এরওর পিছে লেগে থাকা ওর কাজ।আপতত পড়াশোনাতো নেই,এজন্য মাথার কলকব্জা গুলো আর-ও নড়বড়ে কাজ করছে।এবার তাই তোমাকে নিয়ে পড়েছে,তোমার পিছু লেগেছে।ওর কথা কানে নিওনা।এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দাও।

‘এই তুই ওকে কি পরামর্শ দিচ্ছিস?নিশ্চয় উল্টোপাল্টা কিছু!যদি-ও ননদীনিদের কাজ হচ্ছে কূটনামি করে বেড়ানো।দৃষ্টান্ত আমাদের ফুফুমনি…..

‘ওই কি বললি তুই?

বাজখাঁই গলার আওয়াজ শুনে তথাস্তু হলো সবাই।মূহুর্তেই সবার গোলগোল নজর,দরজায় দাঁড়ানো নারীর পানে পড়লো।মান্যতা মিটিমিটি হাসলেও, কৌড়ি চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো।এই মহিলাকে দেখলে কেনো জানেনা অকারণে তার কলিজায় কম্পন ধরে যায়।পরিস্থিতিতে না বুঝে কখন ছোটো বড় কথা শুনিয়ে দেয়!বেকুবের ন্যায় আগলা হাসলো ইভান
ফের টেনেটেনে বললো।

‘ওহ ফুফুমনি আপনি!আপনি তো কতো ভালো।আপনি কি আমার মা চাচিদেরকে জ্বালিয়েছেন নাকি?জ্বালান নি তো!আর না কখনো উনাদের সাথে কুটনামো করছেন!আমি তো মান্যতা-কে বলছিলাম,ও তো আর আপনার মতো নয়।আর বলতে গিয়ে কিভাবে জেনো আপনার নামটা মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো।ইশশ,এই মুখটা-ও না,ইদানীং টোটালি কন্ট্রোলে থাকতে চায়না।এতো কন্ট্রোল করার ট্রায় করি কন্ট্রোলই হয়না।আপনি তো মানুষ হোক বা তার মনমস্তিস্ক বেশ ভালোই কন্ট্রোল করতে পারেন।আমার মুখটা কিভাবে কন্ট্রোল করা যায় বলুন তো ফুপমনি?

জ্বলন্ত নজরে ইভানের দিকে তাকালেন ডালিয়া বেগম।কিভাবে ঘুরিয়ে পেচিয়ে বাহিরের একটা মেয়ের সামনে উনাকে চরম অপমানিত করলো ছেলেটা।একটা সময় ইভানের উপর কৃতিত্ব চলতো উনার।ছেলেটা উনার কথা সহজ সরল মনে বিশ্বাস করতো,মানতো।আর তারই প্রতিফলন অক্ষরে অক্ষরে ঘটাতো।সেই ছেলের হঠাৎই কি হলো!উনাকে তো মান্যই করে-না।কথায় কথায় ছোটোবড় কথা শুনিয়ে উনাকে উচিত জবাব দিতেও ছাড়েনা।বাপের মতো স্বভাব পেয়েছে কি-না! সারাজীবন রাস্তার লোক কুড়িয়ে কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে এসে আশ্রয় দেবে।আবার তাদের নিয়ে যত্তসব মাতামাতি।পিরিত দেখানো।এখন এখানে দাঁড়িয়ে ইভানের সাথে তর্কবিতর্ক করলে আর-ও ছোটোবড়ো বেফাঁস কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়বেনা ছেলেটা।বিধায় রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন তিনি।যাওয়ার আগে অদৃশ্য কারনে কৌড়ির পানে বিরক্তিময় দৃষ্টি ফেলে তাকে ছোটোকরে কটু কথা শুনিয়ে যেতেও ভুললেন না।

‘পরের মেয়ে।চাচা ভাইরা নিতে এসেছে,দিয়ে দেবে।তা-না,আহ্লাদ করছেন।বাড়তি ঝামেলা বাড়িতে ফ্রীতে পুষে রাখতে খুব ভালো লাগে।যত্তসব আদিখ্যেতাপনা !

ইভান, মান্যতা জানতো ফুফুমনির হঠাৎ এখানে পদচারণের কারণ কৌড়িকে ছোটোবড় কথা শোনানো।
তিনি শুনেছেন এবং দেখেছেন,কৌড়িকে নিজের বাড়ি থেকে তার চাচা নিতে এসেছেন।আর তিনি এটাও বুঝতে পেরেছেন,এবাড়ির কেউ কৌড়িকে সহজে যেতে দেবে না।তিনি এসব বিষয় নিয়ে রান্নাঘরে বসে গজগজ করছিলেন মায়ের সাথে,শুনে এসেছে ইভান।সুযোগ পেলে কৌড়িকেও যে দু’কথা শোনাতে পিছুপা হবেন-না, এটাও জানা ছিল ইভানের।ফুফুমনিকে এখানে আসতে দেখে সেই সুযোগ দিতে চাইছিলো না ইভান।সেটা রোধ করার জন্য ফুফুমনিকে উল্টো পাল্টা কথার জালে ফাসিয়ে নিজের দিকে মনোযোগী করতে চাইছিলো।
তবুও নিজের স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ তিনি ঘটিয়েই গেলেন।যার যা স্বভাব!মেজাজ খারাপ হলো ইভানের।মাথা নিচু করে থাকা কৌড়ির পানে একপলক তাকিয়ে শব্দকরে পা ফেলে চলে গেলো সে।পায়ের শব্দে কান ধরে গেলো মান্যতার।সেদিকে খেয়াল না দিয়ে কৌড়ির দিকে ফিরে বললো।

‘মন খারাপ করো-না।ফুফুমনির কাজই হচ্ছে সবাইকে খোঁচা দিয়ে কথা বলা।আম্মু ছোটোমা বা কাওকেই বাদ রাখেন না কথা শুনাতে।তাই উনার কথা কানে নি-ও না।আমরা কেউ নেইনা।

মাথা নিচু রাখা অবস্থায় মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো কৌড়ি।সেটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মান্যতা।বুঝলো, মেয়েটার মন খারাপ তো ছিলো।আরও মন খারাপ হয়ে গেছে।ফুফুমনি যে কেনো এরকম স্বভাবের,বুঝে আসে না মান্যতার।


‘বাহ,বিয়ের কনে দেখি নিজেই এসেছে বিয়ের আমন্ত্রণ জানাতে।বিষয়টা মন্দ না।এখনকার যুগ,এখন তো আর ছেলেরা বিয়ে করতে যায়না, উল্টে মেয়েরা আসে বিয়ে করতে।সেই হিসাবে তোমার নিমন্ত্রণের বিষয়টা কোনো ব্যাপারই না।তা কেমন আছো তন্ময়ী?

মা তাহমিনা বেগমের সাথে এ-বাড়িতে নিজের বিয়ের আমন্ত্রিত কার্ডটা দিতে এসেছে তন্ময়ী।ভাই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য আসতে পারিনি।আর সে-ও আসতে চাইনি।তবে মা জোর করে নিয়ে এসেছেন।জোর করার কারন ছিলো,কিছু কেনাকাটা বাকি আছে।যাবার রাস্তায় তা সম্পূর্ণ করা।আর এ-বাড়ির সাথে ভাইয়ের দারুন একটা সুসম্পর্ক থাাকায় আসতেও হলো তাকে।তবে এবাড়িতে তার না আসার মহা কারণটা হলো,সামনে দাড়ানো অসভ্য ফাজিল মানুষটা।মা,সবার সাথে ভিতরে কথা বললে-ও,এই লোকটাকে এড়াতে তন্ময়ী মান্যতার সাথে ছাঁদে এসেছে।মান্যতার ফোনে জরুরি কোনো কল আসায়,সে কথা বলছে ছাঁদের অন্যত্র দাঁড়িয়ে।আর তন্ময়ী, ছাঁদে লাগানো বিভিন্ন নাম জানা অজানা মনোমুগ্ধকর ফুলের ফলের গাছগুলো দেখছিলো।মনেমনে কিছু কারনবশত আতঙ্কিতগ্রস্থও ছিলো।আর স্বয়ং সেই আতঙ্ক হাজির।তবে ইভানের মজার ছলে বলা কথাগুলোর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা।বিধায় চুপ রইলো।

‘কি হলো বলছো না যে, কেমন আছো?তবে তোমার চোখমুখের এক্সপ্রেশন তো বলছে খুবই ভালো আছো।বিয়েতে-ও খুব খুশি?বর বুঝি দারুণ হ্যান্ডসাম?

শেষের প্রশ্নটা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে।ইভানের কথার মাঝে নিজের জন্য অবজ্ঞতা টের পেলো তন্ময়ী।ভিতরে ভিতরে জ্বললো।তবে বাহিরে তা প্রকাশ করলো না।ঠান্ডা গলায় বললো।

‘হ্যা খুব খুশি।বুঝতেই যখন পারছেন জিজ্ঞেস করছেন কেনো?

বিকালের গোধূলি লগ্নে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মেয়েটার মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো ইভান।শ্যামবর্ণের নারীরা সত্যিই মায়াবিনী হয়।না-হলে সেই মায়ার রূপে কোনো পুরুষের বুকে উতালপাতাল তরঙ্গ বয়ে যায় কি করে!চারপাশে এতো সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি থাকতে সেই শ্যামবর্ণ সৌন্দর্যে নজর মুগ্ধ হয় কিকরে!আর মেয়েটার ওই গোলগোল চোখ..উফফ!সেই চোখে নিজেকে অপরাধী হিসাবে বিবেচিত হতে দেখতেই শান্ত কন্ঠে বললো।

‘তুমি অকারণে আমাকে ভুল বুঝে,ভুল স্টেপ নিয়েছো
তন্ময়ী।

তন্ময়ীর কালোমনির গোলগোল সচ্চ চোখদুটো মূহুর্তেই জ্বলে উঠলো।গোল ফ্রেমের চশমার আড়ালে সেটাও লক্ষ্য করলো ইভান।তবে ইভানকে পাত্তা না দিয়ে শক্ত গলায় তন্ময়ী বললো।

‘আমি কখনো বুঝতেই চাই-না আপনার মতো বড়লোকদের ছেলেদের।সেখানে আপনাকে ভুল বোঝা তো অনেক দূরের কারন।

ট্রাউজারের দুপকেটে দু-হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ইভান।তন্ময়ী কথাগুলো বলতেই রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো তার।তবে সামনে রমনীকে সেটা বুঝতে দিলোনা।তন্ময়ীকে ভেদ করে সামনে নজর দিলো।মান্যতা সামনের অদূরে মনোযোগ দিয়ে ফোনে কথা বলছে।এবার তন্ময়ীতে মনোযোগী হলো ইভান।মৃদু ঝুকলো তারপানে।ফের বললো।

‘তুমি যেটা করলে,ভুল নয় অন্যায় করলে।একদম ঠিক করলে না।ইভানকে তো চেনো না।তোমার জিনিস যখন,এবার চিনবে।চার চোখ দিয়ে একটু বেশিই দেখে ফেলেছো কি-না!

সেকেন্ড দেরী করলো-না ইভান।বড়োবড়ো পা ফেলে চলে গেল নিচে।রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেল তন্ময়ীর।নিজে মেয়েদের সাথে ফূর্তি করে বেড়াবে আর তাকে কথা রাখতে হবে।আর না রাখলে, তুমি কাজটা ঠিক করলেনা।নিজের বেলার সব ঠিক।বিয়ে তো সে করেই ছাড়বে।সব ঠিকঠাক।এবার করবে কি?

রাগ ক্রোধ ছাড়িয়ে মনেমনে ইভানকে ভেঙালো সে।ফের মনেমনে বললো—আমি ইভান!দেখি এবার সেই ইভানে কি করতে পারে!

ড্রয়িংরুমে বসে আছেন তাহমিনা বেগম।অনেক্ক্ষণ যাবত একটা মেয়েকে দেখছেন।আর আগেও এবাড়িতে আসা হয়েছে উনার। কিন্তু মেয়েটাকে তিনি দেখেছেন বলে মনে হয়না।এখনকার যুগ হিসাবে মেয়েটা বেশ সুশৃঙ্খল।শালিন শান্ত চলাফেরা।কথাবার্তাও নিন্মগামী।আর সৌন্দর্য তো নজরে পড়ার মতোন।কে মেয়েটা?ছেলের বিয়ে দেবেন বলে মেয়ে খুঁজছেন। তবে যেরকম মেয়ে তিনি খুঁজছেন বা চাইছেন, সেরকমটা মিলছেইনা।
তবে মেয়েটা কে,জিজ্ঞেস করবেন না-কি?মেয়েটাকে এতো মনে ধরেছে কৌতুহল চেপে রাখতে পারলেন না।সামনে বসা নিহারীকা বেগমে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন।

‘আপা,ওই মেয়েটা কে?আগে তো এ-বাড়িতে কখনো দেখিনি তাকে।আপনাদের আত্নীয় বুঝি?

মৌনতার সাথে অদূরে দাঁড়ানো কৌড়িকে দেখিয়ে তাহমিনা বেগম কথাগুলো বলতেই,নীহারিকা বেগম সেদিকে লক্ষ্য করলেন।ফের মৃদু হেসে কিছু বলতে যাবেন তারআগে পাশে বসদ ডালিয়া বেগম চোখমুখ কুঁচকে বললেন।—আরেহ না আপা আমাদের আত্মীয় টাত্নীয় কিছু নয়।ওই ভাইজানের কোনো এক বন্ধুর মেয়ে।বাপ মা মরে গেছে,তাই ভাইজান বাড়িতে এনে বাড়তি ঝামেলা পুষছে।

ডালিয়া বেগমের বলা কটুবাক্যগুলো তাহমিনা বেগমের মোটেই ভালো লাগলো না।আর নীহারিকা বেগমের তো ভালোই লাগলো-না।অন্তত বাহিরের মানুষের সামনে নিজের খোলাসা থেকে না বের হলেই কি হতো না!মনে মনে ননদকে প্রবোধন করে, তাহমিনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘আসলে ব্যাপারটা তা নয়,আপা।মেয়েটা আমাদের রক্তের সম্পর্কিত কিছু না হলেও,এক-প্রকার আত্মার আত্মীয়।রক্তের সম্পর্ক না থেকে-ও কতো বন্ধন তো তৈরী হচ্ছে।আর সেসব সম্পর্ক আজীবন নিষ্ঠার সাথে চলে আসছে।এই দেখুন আপনাকে আমাকে,রক্তের সম্পর্ক ছেড়ে পড়ে আছি কোথায়।যেখানে রক্তের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।অথচ সম্পর্কগুলো কতো কাছের, কতো আপন।ওই মেয়েটার সাথে আমাদের সম্পর্কও তেমনটাই।রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় নাহলে-ও আত্মার আত্মীয়,আপনজন।আপনার ভাই সাহেবের খুব ভালো একজন বন্ধুর মেয়ে।মেয়েটার মা মারা গিয়েছে জন্মের সময়,আর বাবা মারা গিয়েছেন এই কিছুদিন আগেই।
আপতত দাদিআপা ছাড়া কেউ নেই।নেই বলতে চাচা চাচিরা আছেন।তবে এখনকার যুগে নিজেরটা বাদে পরেরটা কে দেখে।তাই বলে মেয়েটা সম্বলহীন অসহায় নয়।তবে অর্থ সম্পদ, ঘরবাড়ি তো সবকিছু নয়।মাথার উপর একটা ছায়া সবার খুব প্রয়োজন। সেখানে মেয়ে মানুষের তো আরও প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজনটুকু শুধু আমরা করছি।অযথা না মেয়েটা এবাড়িতে থাকছে আর না আমরা পুষছি।

নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে ভাবিকে কথা বলতে দেখেই ডালিয়া বেগম অসন্তুষ্ট হলেন। ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ হয়ে
বিরক্ত প্রকাশ করলেন, যত্তসব আদিখ্যেতা!প্রবোধন করে উঠে দাড়ালেন।মুখপ বিজবিজ করে চলে গেলেন।নীহারিকা বেগম দেখলেন,বুঝতে পারলেন। তবে কিছুই বললেন না।তাহমিনা বেগম সুশিক্ষিত নারী।নীহারিকা বেগমের বলা কথাগুলো বেশ বুঝলেন।আর মেয়ে মানুষের ছায়া হয়ে,তাদের পিতা ভাই স্বামীকে যে কি প্রয়োজন! সেটা তিনি খুব ভালো করে জানেন।তাদের লড়াইটা কেমন হয় এটাও উনার শিরায় শিরায় উপলব্ধি আছে।একটু আগের ভাবনাটা ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো উনার।বাবা,মা নেই তো কি হয়েছে।মেয়েটা ভালো হলেই হলো।মনেমনে নিজের ভাবনা নিয়ে কিছুসময় তেনোমনো করলেন।সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বেশ বিচক্ষণতার সহিত তাহমিনা বেগমকে লক্ষ্য করলো ইভান।বারবার কৌড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর কিছু একটা ভাবছে।উনার মুগ্ধ নজর,আর ভাবান্নিত মুখাবয়ব।মোটেই সুবিধার ঠেকলোনা ইভানের কাছে।তার না হওয়া সংসারটা ভেঙে এবার তার ভাইয়ের না হওয়া সংসারটা ভাঙতে চাইছেন না তো উনি।উনার দৃষ্টিতো তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তার বউটা ছিনিয়ে নিয়ে এবার ভাইয়ের বউয়ের পানে কুদৃষ্টি! ছিনিয়ে নেওয়ার প্লান।নো ওয়ে।বড়বড় পা ফেলে তাহমিনা বেগমের পাশে এসে বসলো ইভানে।ফের মা’কে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘আন্টির জন্য এখনো নাস্তাপানির ব্যবস্থা করো-নি আম্মু?টেবিল খালি কেনো?

ছেলের ব্যবহারে অপ্রস্তুত হলেন,নীহারিকা বেগম।আশ্চর্য ছেলে উনার।মেহমানের সামনে এভাবে বলতে আছে।তাতে নিজেদের ও লজ্জা পেতে হয়,সাথে মেহমানকেও।এই ছেলের সুবুদ্ধি হবে কবে থেকে কে জানে!তবুও মেহমানের সামনে অপ্রস্তুত যখন করেছে উত্তর তো দিতেই হবে।মৃদু হেঁসে তিনি বললেন।

‘রানি চা বানাচ্ছে, তাই হয়তো দেরী হচ্ছে।চা টা হয়ে গেলেই দিচ্ছি।

‘এসবের দরকার ছিলোনা কিন্তু আপা।আমিতো এখনই
উঠবো।

‘দরকার ছিলো না মানে কি?অবশ্যই দরকার আছে।আপনি দাদাভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ডের মা বলে কথা।আর এই জোয়ার্দার বাড়িতে আপনার আপ্যায়ন হবে-না,তা কিকরে হয়!কতোদিকের আত্মীয় আপনি।আপনি তো নিজেও জানেন না।

কপাল কুঁচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন নীহারিকা বেগম। এই ছেলে বলছেটা কি?তবে বাহিরের একটা মানুষের সামনে ছেলেকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারলেন না।শুধু বললেন —দেখি,ওদিকে রানির কতোদূর হলো।

সেসবে খেয়াল নেই তাহমিনা বেগমের।তিনি নিজের ভাবনায় ডুবে আছেন।আর কিছুক্ষণ পরপর কৌড়ির মায়াময় মুখটার দিকে তাকাচ্ছেন।সেটা দেখে এবার নিশ্চিত হলো ইভান।ভদ্রমহিলা মনেমনে কি আশা পোষন করছেন।তবে তা হতে দেওয়ার নয়।ইভান তো কখনোই হতে দেবেনা সেটা।কন্ঠে উচ্ছলতা প্রকাশ করে ইভান,উনাকে উদ্দেশ্য বললো।

‘মেয়েটা সম্পর্কে শুনছেন নিশ্চয়।

বেখেয়ালিতে উত্তর দিলেন তাহমিনা বেগম।ছোটো করে উত্তর দিলেন– হুমম!

‘মেয়েটাকে দাদাভাইয়ের বউ বানাতে চাইছেন আম্মু আব্বু।কেমন হবে বলুনতো?দাদাভাইয়ের পাশে দারুণ মানাবে না?

চমকে ইভানের মুখের দিকে তাকালেন ভদ্রমহিলা।তিনি কি ভাবলেন,আর এই ছেলে কি শোনালো।ভ্যাগিস বলবে বলবে করেও মুখে বললেন না নিজের ভাবনার কথা।নাহলে লজ্জার শেষ থাকতোনা।তবে মনেমনে মন খারাপও হলো উনার।যদিও এরকম মেয়ে কে হাতছাড়া করতে চায়।ইভান হাসি মুখে ফের বললো।

‘মেয়েটাকে আমাদের ও দারুন পছন্দ। পছন্দ হওয়ার মতো মেয়ে।আমরাও চাই,দাদাভাইয়ের বউ হিসাবে তাকে এবাড়িতে আজীবন আমাদের বউমনি হিসাবে রেখে দেওয়া হোক।আন্টি..বললেন নাতো,কেমন হবে দাদাভাইয়ের বউ হিসাবে মেয়েটা?

‘খুবই ভালো।

সন্তুষ্ট হলো ইভান।ভদ্রমহিলা এবার নিরেট নজরে কৌড়ির পানে তাকিয়ে রইলেন।সেটা-ও লক্ষ্য করলো ইভান।বুঝলো,একদেখায় কৌড়িকে উনার বেশ মনে ধরেছে।মনে ধরলে কি হবে,কৌড়ি শুধু দাদাভাইয়ের।আর কার-ও সে হতে দেবেনা কৌড়িকে।মহিলার পাশ থেকে উঠলো না ইভান।সে চলে যাওয়ার পর,ভদ্রমহিলা যদি মা’কে জিজ্ঞেস করে বডেন।আর তার মিথ্যা ধরা পড়ে যায়।তখন আরেক বিপত্তি।সেটা না হতে দেওয়ায়, বসে থাকলো সে।ওই বিষয়ে প্রশ্ন করলে বা প্রসঙ্গ উঠলে,এলেবেলে কথা দিয়ে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিতে পারে যেনো বিধায় বসে থাকা।নাস্তা আসলো।খাওয়া দাওয়া হলো তবে তার কথার বিষয়ে কথা উঠলোনা।একপর্যায়ে উনারা সবাইকে নিমন্ত্রণ দিয়ে চলে গেলেন।সেই চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে ইভান নিজের জীবনের চক্রটা-ও সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার চিন্তা ভাবনা মশগুল হলো।


সময়টা শরতের শেষ বিদায়ের দিন।আকাশের সাদা মেঘের তুলোরাশি গুলো হঠাৎ কালো মেঘপুঞ্জে ছেয়ে গেছে।কালবৈশাখীর ন্যায় উতালপাতাল ঝড়ো হওয়ার ন্যায় বৈরী বাতাস শুরু হলো।সময়ের ব্যবধানে হঠাৎই দুপুর বেলার চারপাশটা মধ্যরাতের ন্যায় অন্ধকারাচ্ছন্নে ছেয়ে গেলো।কাল থেকেই শরতের মিঠে-মিঠে রোদের আবহাওয়াটা অল্পঅল্প করে খারাপের দিকে এগোচ্ছিলো।আজ সকালের দিকেও আকাশটা সেই অল্পঅল্প খারাপেই সীমাবদ্ধ ছিল।হঠাৎ বেলা গড়াতেই আবহাওয়ার চরম অবনতি পর্যায়ে চলে গেলো।কালবৈশাখীর ন্যায় ঝড় হাওয়া শুরু হলো,সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।সেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা এখন ঝুমঝমে কুলকুলে বন্যায় পরিনত হয়েছে।মান্যতা আজ ভার্সিটিতে যায়নি।মৌনতার স্কুলে বারোটায় ছুটি হয়।ছুটি হওয়ার সাথে সাথেই চলে এসেছে সে।ইভান বাড়িতে নেই,বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেছে নাকি।ফোনটা-ও আপতত বন্ধ তার।এই ছেলেটাকে কখনো কাজের সময় পাওয়া যায় না,সবসময় অকাজের সময় তিনি পিছপিছে।দুপুর দুটো বাজতে গেলো কৌড়িটা এখনো বাড়িতে ফেরিনি।এই পরিস্থিতিতে ফেরারও কথা নয়।সেটা নিয়েই চিন্তিত নীহারিকা বেগম।এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারছেন না তিনি।মেয়েটার কলেজ ছুটি হয় একটায়।এখন বাজতে চললো দুটো,
অথচ মেয়েটা এখনো বাড়িতে ফিরলোনা।ঝড়বৃষ্টি নিয়ে তো এমনিতেই টেনশনে আছেন,মেয়েটা ফিরবে কি করে?আর তার থেকে-ও টেনশন হচ্ছে,উনার মমতাময়ী মন আজ অবিরত উল্টো পাল্টা গেয়ে চলছে।মেয়েটা কলেজের মধ্যে আছে নাকি এই পরিস্থিতিতে-ও বাহিরে বের হয়েছে!মেয়েটা ঠিকঠাক আছে তো,নাকি কোনো বিপদে পড়েছে!ঝড়বৃষ্টি থামার সাথে সাথে মেয়েটা ঠিকঠাক বাড়িতে ফিরতে পারবে তো!এরকম কতশত আবোলতাবোল গাইছে মন।কৌড়ি যে এখনো বাড়িতে ফেরেনি, এটা জাহিদ সাহেবকেও জানাননি তিনি এখনো।নাহলে মানুষটাও দুশ্চিন্তা করবেন।সাথে রাগ করবেন,আবহাওয়ার এমন অবনতি দেখেও মেয়েটাকে নিয়ে আসতে বাড়ির গাড়িটা কেনো পাঠানো হয়নি।বিষয়টা খেয়ালেই ছিলো-না উনার।এখন কি করবেন!হাফিজি তো আপতত বাড়িতে নেই।

ইভানের নাম্বারে আবারও ট্রায় করলেন। বারবার ট্রায় করতে থাকলেন।পেলেন না।মেজাজ চড়ে গেলো উনাার।মনেমনে হাজার বকাঝকা দিলেন ছেলেটাকে।সময় যতো ঘনাতে লাগলো, উনার অস্থিরতা ততোই বাড়তে থাকলো।একপর্যায়ে গিয়ে বাধ্য হয়ে নিভানকে ফোন দিলেন।নিভান ফোন উঠাতেই আতঙ্কিত গলায় ছেলেকে ডাকলেন।

‘ও নিভান।

চমকে উঠলো নিভান।মা তো কখনো এভাবে ডাকেনা তাকে।তবে আজ কি হলো?বাড়িতে কারও কিছু হয়নি তো।কিঞ্চিত বিচলিত হলো সে।বললো

‘কি হয়েছে মা?তোমার কন্ঠ এমন শোনাচ্ছ কেনো?বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো?

সময় নিলেন না নীহারিকা বেগম।বিচলিত গলায় বললেন—বাড়িতে সবাই ঠিক আছে।কার-ও কিচ্ছু হয় নি।তবে?

স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো নিভান।ফের বললো—তবে কি হয়েছে?

‘কৌড়িটা এখনো বাড়িতে ফেরেনি।বাহিরে কি অবস্থা দেখেছিস,মেয়েটাকে নিয়েতো আমার খুব টেনশন হচ্ছে বাবু।পরের বাড়ির মেয়ে কিছু হয়ে গেলে কি জবাব দেব।ইভান-ও বাড়িতে নেই,ফোনে-ও পাচ্ছি না ও-কে।বাড়ির গাড়িটা পাঠাবো,হাফিজও বাড়িতে নেই।ও বাবু তুই একটু ওর কলেজে গিয়ে দেখ না।আমি যে স্থির হতে পারছি-না।মনটা শুধু কু- গাইছে।

চলবে…..

#ফুলকৌড়ি
(১৯)কপি করা নিষিদ্ধ
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

শরতের কালবৈশাখীর ন্যায় বৈরী-হাওয়াটা প্রকৃতিতে আর তান্ডব চালালো কোথায়!তার থেকে দ্বিগুণ বৈরী হাওয়া শুরু হলো নিভানের মনে।বাহিরের ঝড়ো হওয়ার থেকেও দ্বিগুন তন্ডব লীলা চলতে থাকালো বুকের ভিতরের যন্ত্রণটায়।ছটফটিয়ে উঠলো মন।মা এসব বলছেটা কি?বাহিরের এই বৈরী ঘোর আমাবস্যার ন্যায় অন্ধকারচ্ছন্ন অবস্থা,ঝুম বৃষ্টি!তারমধ্যে মেয়েটা এখনো বাড়িতে ফেরে-নি।আর সেই কথাটা মা এখন তাকে বলছে!আশ্চর্য!ওপাশ থেকে অনবরত অপরাধী গলায় এটাওটা বলতেই থাকলেন নীহারিকা বেগম।সেসব যেনো কানের ভিতরে গেলেও,মন স্পর্শ করলোনা।ফোন কেটে দিলো নিভান।সেকেন্ড দেরী করলোনা।দ্রুত পায়ে অফিসকক্ষ থেকে বের হলো সে।আশেপাশে কোথায় কে আছে,খেয়াল করলো-না।বড়বড় পা ফেলে কিছুটা হন্তদন্ত হয়ে ব্যতিব্যস্ত পায়ে সামনে এগোলো।পথিমধ্যে দেখা হলো মৃদুলের সাথে।মিটিং রুমে ক্লায়েন্টের বসিয়ে সে আসছিলো নিভানের সাথে দেখা করতে।আজ একটা বিশেষ কনফারেন্স আছে।বড়ো একটা ডিল-ও সাবমিট করতে হবে।সেসব সব তদারকি করে,স্যারকে জানাতে আসছিলো।পথিমধ্যে নিভানকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বের হতে দেখে নিজেই দাঁড়িয়ে পড়লো।নিভানের গম্ভীর মুখাবয়বের প্রকাশভঙ্গি অদ্ভুত ঠেকলেও,দু’জনে সামনাসামনি হতেই মৃদুল বললো।

‘স্যার,কনফারেন্স রুমে আপতত সব কমপ্লিট।ক্লায়েন্টরা-ও এসে গেছে। আপনি গেলেই কনফারেন্স শুরু হবে।

তবুও থামলো না নিভান।আজ ডিলটা বিদেশি ব্যবসায়ীদের সাথে।নিজেদের কোম্পানির বিভিন্নরকম প্রডাক্ট শেয়ারে নিয়ে বিদেশিরা তাদের নিজেদের দেশে ব্যবসা করতে চান।জে এইস জে এর বিভিন্ন প্রডাক্ট, দেশে ছাড়া-ও বাহিরের দেশে নামডাক রয়েছে,চলে-ও প্রচুর।যার কারন ভিত্তিক বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীদের সাথে যুক্ত আছে তারা।আজ সেরকমই আর-ও একটা বিদেশি ব্যবসায়ীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কথা।ডিলটা ইম্পর্ট্যান্ট।এই বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে-ও,উনারা হাজির।তবে সেসব এখন আর তার মাথায় ঘুরছেনা।কৌড়ির থেকে সেই ইম্পর্ট্যান্ট ডিলটাকে কিছুতেই গুরুত্ব দিতে পারছেনা।মুলত দিতে চাইছেনা না নিভান।তাতে যা হয় হোক।সামনে এগোতে এগোতে সে বললো।

‘আজ ছোটো চাচ্চুকে সামলিয়ে নিতে বলুন।না পারলে আপনি সামলিয়ে নিন।

বিস্মিত হলো কথাকাজে অনড় থাকা স্যারের অদ্ভুত কথাগুলো শুনে।এমন তো কখনোই হয়নি।আজ হঠাৎ কি হলো স্যারের?ভাবনার সাথে সাথে নিভানের পিছু নিলো সে।বললো।

‘আজকের কনফারেন্সটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ,সেটাতো আপনি জানেনই।আর সেখানে আপনার ভুমিকা-ও যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ন।থাকাটা খুবই জরুরি।এটা-ও তো আপনার জানা।আপনি ছাড়া যে ডিলটা ক্যান্সেল হয়ে যেতে পারে।সেটাও তো আপনি জানেন!

‘তবে ক্যান্সেল করে দিন।এই ডিলটার থেকে-ও,সে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

নিভানের মুখের কথাগুলো আশ্চর্যের থেকেও আশ্চর্য লাগলো মৃদুলের কাছে।ডিলের থেকে-ও সে ইম্পর্ট্যান্ট।মানেটা কি?কে সে?থমকালো মৃদুল।তবে স্যারের মুখের উপরে জিজ্ঞেস তো করা সাঝে না।তাই বললো।

‘স্যার, এ্যানি প্রবলেম?

‘নো।

এই পর্যায়ে এসে আর কথা বাড়ানো উচিত নয়।নিজের সীমা জানে মৃদুল।তবুও মন কৌতুহলী হয়ে উঠলো।তার দেখা এতোদিনের মানুষটার সাথে আজকের মানুষটার এতো অমিল!মন মানলো না।কৌতুহলী করে তুললো তাকে।নিভানের পিছু হাঁটতে হাঁটতে বললো।

‘বাহিরের এই খারাপ পরিস্থিতি।এই পরিস্থিতিতে বাহিরে বের হওয়াটা ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না,স্যার।যতোই ইম্পর্ট্যান্ট বিষয় হোক না কেনো,আপনার এখন বের হওয়াটা উচিত হবেন….

লিফটের দোরগোড়ায় এসে থামলো নিভান।মৃদুলের দিকে শীতল দৃষ্টিতে চাইল।এই ছেলে যদি জানতো,তার ভিতরের পরিস্থিতিটা সম্পর্কে।কৌড়ি কোথায় আছে,কিভাবে আছে?সর্বোপরি ঠিক আছে কিনা!এসব ভেবে তার ভিতরে কি অবস্থা হচ্ছে!তবে হয়তো এগুলো বলার সাহস দেখাতো না।এমনিতেই মৃদুলকে এতো কথা বলতে দেখে,নিজেই বিরক্ত হলো।এতো কথা তো বলেনা ছেলেটা।নিজের সীমার মধ্যে থেকে যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই বলে।তবে আজ এতো কথা বলছে কেনো!বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করলোনা নিভান।শুধু গম্ভীর গলায় বললো।

‘আমাকে নিয়ে আপতত না ভাবলে-ও চলবে।পারলে
আপনি ওদিকটা দেখুন,কিভাবে সবকিছু হ্যান্ডেল করা যায়,সেদিকে গুরুত্ব দিন।তবে আমার না থাকাটা যদি ডিলটা ক্যান্সেল হয়, সমস্যা নেই।

‘পাগল হলেন আপনি।

মৃদু শব্দে আওড়ানো কথাটাও নিভানের কান এড়ালো না।তবে সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে লিফটে ঢুকে গ্রান্ডফ্লোর বাটুন প্রেস করে চোখ বুঁজে নিলো।সঙ্গে সঙ্গে কৌড়ির মায়াময় সুন্দর মুখখানা ভেসে উঠলো বদ্ধ নজরে।তখন মৃদলের কথার প্রতিত্তোর সরূপ মৃদুস্বরে আওড়ালো।

‘পাগল হতে আর বাকি রেখেছে কোথায়,ওই মেয়েটা!পাগল তো বানিয়েছে সাথে স্বস্তির যে নিঃশ্বাসটা তার চলছিলো সেটা-ও যেনো মৃতু্প্রায় করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।

ভারী শ্বাস ফেললো নিভান।চোখ খুলে ফের বুঁজে ফেললো।মন অতিমাত্রায় ছটফট করছে তার।মনেহচ্ছে চোখের পলকে,মেয়েটার সামনে হাজির হতে পারলে মন শান্তি পেতো।তাকে সুস্থ অবস্থায় দেখতে পেলে,সব দুশ্চিন্তার অবসান ঘটাতো।নিজের নজর,মন,মস্তিষ্ক, পরাণ সব সুখ সুখ অনুভূত হতো।মনেমনে আবারও বিড়বিড়িয়ে বললো।

‘প্লিজ কৌড়ি,আমি তোমার কাছে আসা পর্যন্ত নিজেকে যেকোনো পরিস্থিতি থেকে যেভাবেই হোক আগলিয়ে রেখো।প্লিজ প্লিজ কৌড়ি।

ফের ঘনোঘনো শ্বাস ফেলে মনেমনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানালো–ও প্রভু,সবদিক দিয়ে ঠিক রেখো ও-কে।

বাহিরের বৈরী হাওয়াটা কিছুটা কম হলে-ও,ঝুম বৃষ্টিতে চারপাশটা কুয়াশাচ্ছন্নের মতো ঢেকে আছে।শুনশান রাস্তা।বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজ ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই।অনেক সময় পরপর দুই একটা করে সিএনজি আসছে যাচ্ছে। তাছাড়া কোনো যানবাহনের চিহ্নটুকো নেই।যদি-ও এই রাস্তায় ছোটো-খাটো যানবাহন ছাড়া, বড়োসড় কোনো যানবাহন চলেনা।রাস্তার ধারের বিভিন্ন দোকানপাটগুলো হয়তো বৈরী এই আবহাওয়ার কারনে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।অসময়ে বন্ধ দোকানের কপাটগুলো সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ছোটো খাটো শপিংমলগুলোও নিস্তব্ধ।মানুষের আনাগোনো নেই বললেই চলে।অথচ এই সময়টাতে প্রচুর লোকজনদের ভিড় থাকে সেখানে। পিচঢালা রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশ যতোদূর নজর যাচ্ছে,শুনশান রাস্তা আর ঝুম বৃষ্টির বড়োবড়ো ফোঁটাগুলা ছাড়া সেভাবে কিছুই নজরে পড়ছে না।তবে মেয়েটা গেলো কোথায়?

কৌড়ির কলেজের সামনে এসে গাড়িটা থামিয়েছে প্রায় পনেরো মিনিটের মতো হবে।এখন বাজতে চলেছে প্রায় তিনটে।দুপুরে তিনটে হলেও,রাত তিনটের মতো দেখাচ্ছে চারপাশটা।ভয়ে ধ্বকধ্বক করে উঠলো বুকের ভিতরটা।মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো বিভিন্ন আজেবাজে চিম্তায়।ইতিমধ্যে,কৌড়ির কলেজে খোঁজ নিয়ে জেনেছে নিভান।সেখানে আপাতত কোনো স্টুডেন্ট অবশিষ্ট নেই।আবহাওয়া খারাপের দিকে যাওয়ার মতিগতি দেখতেই স্কুল এন্ড কলেজের সব স্টুডেন্টের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।বৈরী হাওয়ায় আর বৃষ্টির তোপে দারোয়ান দুজন-ও আজ গেটের পাহারাদারে নেই।কি করবে নিভান এখন?কোথায় খুঁজবে মেয়েটাকে!কি পরিস্থিতিতে আর কোথায় আছে মেয়েটা!উফ, নিঃশ্বাস নিতেই যেনো অসহ্য লাগছে তার!অনর্গল বইতে থাকা ঝুপঝাপ বৃষ্টির মধ্যে-ও আকাশের দিকে তাকালো নিভান।মনেমনে ওই সাত আসমানের উপরে বসাবসরত মালিকের কাছে হাজারও সাহায্য প্রার্থনা করলো।

‘ও মাবুদ, তাকে একবার শুধু পাইয়ে দাও।শুধু একবার।

শুনশান রাস্তার একপাশে গাড়িটা রেখে আশেপাশে দৃষ্টি বোলাতে ব্যস্ত নজর।বৃষ্টিতে ভিজে জুবুথুবু অবস্থা! সেদিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালো-না নিভান।তার শুধু একটাই ভাবনা,খেয়াল।কৌড়িকে সুস্থ সমেত পাওয়া।আর নিজের রয়েসয়ে ধীমেধীমে চলা নিঃশ্বাসটাকে একটু স্বস্তি দেওয়া,শান্তি দেওয়া।বৃষ্টির এই উগ্র তোপের মধ্যে-ও ব্যস্ত পায়ে প্রায় আশপাশের বিভিন্ন গলিপথ, দোকাপাটের আনাচকানাচ,বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিলো নিভান।তবে নিরাস হতে হলো তাকে।খুজতে খুঁজতে প্রায় মেইন সড়ক ছাড়িয়ে,কৌড়িদের কলেজের রাস্তার পিছনের সড়কে চলে এলো।যদি-ও এদিকের রাস্তায় আসার সম্ভবনা নেই মেয়েটার।কেননা এটা তাদের বাড়ির রাস্তাতো নয়,বরং আবাসিক লোকালয়ও নয়।দূর পাল্লার রাস্তা।যেখানের রাস্তার দু’পাশে শুধুই সারিবদ্ধ গাছ।কিছুদূর পরপর ঝোপঝাড় আছে।আর বিশাল চওড়া কালো পিচঢালা রাস্তাটায় ক্ষনে ক্ষনে ছয়চাকা আটচাকার বড়োবড়ো যানবাহনগুলো চোখের পলকে শোঁ-শোঁ করে ছুটে চলেছে।বৈরী অন্ধকারাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আর বৃষ্টির তোপে,আজ সেসব যানবাহনের চলাচলও কম দেখাচ্ছে।শুধু নজর-ভর দেখাচ্ছে পিচঢালা ফাঁকা রাস্তা আর কুয়াশাচ্ছন্ন টুপটুপ বৃষ্টি।আশপাশে খেয়ালি নজর দিলো নিভান।কিছুই পড়লো না নজরে।তবে মেয়েটা কোথায়?কোথায় আর কি অবস্থায় আছে সে।ছটফটানি চঞ্চলা মন এবার উতলা,উদভ্রান্ত হয়ে উঠলো।সবসময়ের শান্ত নজরোজড়ো হয়ে উঠলো বিচলিত।ফাঁকা রাস্তায় দিশাহীন হয়ে বেশ কিছুসময় এদিকওদিক খুঁজলো,দেখলো, তবে দূর্ভাগ্যবশত কিছুই নজরে পড়ল না।আবেগি মন মনেমনে গেয় উঠলো,যদি আচমকা একটা ম্যাজিক হয়ে যেতো আর মূহুর্তেই কৌড়িকে সে পেয়ে যেতো।কতো সুখকর হতো তারজন্য বিষয়টা।সেটা শুধু সেই অনুভব করতে পারছে।

আশাহত নিভান,কলেজের পিছনের রাস্তাটা পার করে পুনরায় কলেজে মেইন সড়কে আসার জন্য উদ্বেগী হতেই,হঠাৎই পা থামকালো নিভানের।সিনেমাটিকভাবে থেমেথেমে কোনোমতে চলা হৃদস্পন্দনটা দ্বিগুনহারে বেড়ে গেলো তার।যেমনটা কৌড়ি আশে-পাশে থাকলে হয়।তাঁকে দেখলে অনুভব করে মন।ক্লান্ত হৃদয় তাকে দেখলে প্রশান্ত হয়।খারাপ মন,তাকে অনুভব করলে ম্যাজিকের মতো মন খারাপের মেঘগুলো কেটে যায়।
তবে কি মেয়েটা আশেপাশে কোথায় আছে?তড়িৎ গতিতে আশেপাশে তীক্ষ্ণ নজর ফেললো নিভান,নজরে কিছুই না পড়লেও মূহুর্তেই ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পেলো সে।কৌড়ির গলার স্বর।ওই মেয়েটা আর তারমধ্যে কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই।যেটুকু নিজের মন থেকে তৈরী হয়েছে সেই সম্পর্কের দূরত্বও অনেক!একই বাড়িতে থেকেও মাইল কি মালই সেই দূরত্বের গভীরতা!তবে ওই মেয়েটাকে অজানা কারনে নিভানের খুবচেনা।মেয়েটার নিজের মধ্যে থাকা চুপিচুপি চাওয়া পাওয়াগুলো চেনা।তাকে দেখে মেয়েটার লুকোচুরি খেলা দূরের স্পর্শগুলো চেনা।মেয়েটার নিঃশব্দে পায়ের চলাচল গুলো চেনা।মেয়েটার নীরবে হোক বা ফুপিয়ে কান্নার শব্দগুলোও তার চেনা।হঠাৎ কি কারনে,দূরে থেকেও মেয়েটা নিজের এতো কাছের চেনা মানুষ হয়ে উঠলো কিকরে?নিভানের জানা নেই।হয়তো নিজেই চেয়েছিলো,মেয়েটাকে চিনতে জানতে।সেকারনেই।তবে
এতো সময় তো আশেপাশে ছিলো সে,কৈ কোনো কান্নার শব্দ তো সে পায় নি।তবে কি কৌড়ি তাঁকে দেখেছে, আর দেখেই পাগল মেয়েটা কান্না শুরু করে দিয়েছে।

ক্ষীন হাসলো নিভান।দুহাটুতে দুহাত ভর দিয়ে মাথা নিচু করে এতোসময়ের বাধোবাধো হয়ে চলা নিঃশ্বাসটা স্বস্তিতে ত্যাগ করলো নিভান।পাথর ভর করে থাকা বুকের ভিতরটা হালকা হতে থাকলো।নিজের জানপাখিটা বুঝি জানের জায়গায় ধীরেধীরে অবস্থান করতে থাকলো।মাথার চুল বেয়ে চুইয়েচুইয়ে পড়তে থাকলো বৃষ্টির ঝমঝমে পানিগুলো,এমনকি সমস্ত শরীর বৃষ্টির পানিতে একাকার।ফুপিয়ে কান্নার রেশটা বেড়েছে।ওই অবস্থায় কিছুটা জোর গলায় কৌড়িকে ডাক দিলো নিভান।

‘কৌড়ি।

রাস্তার পাশের একটা পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা দোকানের আড়ালে হাঁটু মুড়ে চুপচাপ বসে আছে কৌড়ি।এতোসময় নীরবে কাদলেও,এই ফাঁকা রাস্তায় পানির ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ কাওকে হাঁটতে দেখে পিছে ভয়ার্ত নজরে পিছে ফিরেছিলো সে। ক্ষনিকের জন্য মনে হয়েছিলো, ওই বুঝি সেই হায়েনারা আবার পিছু নিলো তার।খাবলেখুবলে খেতে এলো তাকে।কিন্তু না, পরিচিত মুখটাকে দেখে,ভরসা পেয়ে জোরেসোরে কেঁদে ফেলল সে।ফের নিভানের নরম কন্ঠের ডাকটা কর্ণগোচর হতেই আর-ও জোরে কেঁদে দিলো।সেই কান্না অনুসরণ করে পা বাড়ালো নিভান।বড়বড় কদম ফেলে ভিজে জুবুথুবু হয়ে হাটুমুড়ে বসে থাকা কৌড়ির সামনে গিয়ে নিজেও হাঁটু মুড়ে বসলো।বার কয়েকে জোরেজোরে ঘনোঘনো শ্বাস ছেড়ে,এলোমেলো হাসলো।কৌড়িকে এই অবস্থায় এখানে বসে থাকতে দেখে চতুর দৃষ্টি বুঝে নিলো অনেককিছু।তবে মেয়েটাকে পেয়েছে,এটাই শান্তি দিলো তাকে।শ্বাস ফেলে কোমল কন্ঠে সামনে বসা মেয়েটাকে শুধালো।

‘খুব ভয় পেয়েছো তাই-না?

ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যেও যেনো কৌড়ির ডগরডগর চোখের টলমলে নোনাজলগুলো দৃশ্যমান।সেদিকে শান্ত আর অটল নজরে তাকিয়ে রইলো নিভান।এভাবে কেউ কাঁদে!তাহলে কি নিজেকে স্থির রাখা যায়! আর না ওই ক্রন্দরত মায়ময় চোখজোড়া দিয়ে ওভাবে তাকিয়ে থাকলে নিজেকে সামলিয়ে রাখা যায়!বর্ষায় ভিজে জুবুথুবু ওই ছোট্টো দেহটা যে খুব করে নিজের দু’হাতের বাহুবন্ধনীতে শক্তকরে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে।সাথে ওই কেঁদেকেটে লাল বানিয়ে ফেলা মুখশ্রীর আনাচে-কানাচেতে ভালোবাসার ছোঁয়ায় রাঙিয়ে তুলতে ইচ্ছে করছে।প্রবৃত্তি-গুলো মনে জাগতেই অদৃশ্যভঙ্গিতে মাথা ঝাড়া দিলো নিভান।নিজের আবেগ কন্ট্রোল করলো।অপেক্ষা করলো কৌড়ির উত্তরের।প্রশ্নবিদ্ধ হতেই আজ যেনো কৌড়ি কোনো দ্বিধা সংকোচ করলো না,তবে কান্নার তোপে কথাও বলতে পারলো-না।শুধু মাথা ঘনো-ঘনো উপর নিচ নাড়িয়ে হ্যা জনালো।তার মাথা নাড়ানোর ঘনত্ব দেখে,নিভান বুঝে নিলো।একটু নয় মেয়েটা অনেকটাই ভয় পেয়েছে।কৌড়ির উত্তর পেতেই মোলায়েম কন্ঠে

‘আমি এসে গেছি-তো তোমার কাছে।আর ভয় কিসের!উঠে এসো।চলো।

নিঃসংকোচে কৌড়ির বরফঠান্ডা হাতটা ধরলো নিভান।কেঁপে উঠলো কৌড়ি,সেটাও অনুভব করলো।কতক্ষণ ধরে এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটা ভিজে চলেছে কে জানে!হাতটা ধরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বাঁধা পেলো নিভান।মেয়েটা কঠিন পাথরের মতো অটল বসে আছে।মনের মধ্যে যে ধারণাগুলো একটু আগে ধরা দিলো,তা মূহুর্তেই মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো নিভানের।চোখ বুঁজে ফেললো সে।ফের কৌড়ির বলা শব্দগুলো কর্ণগোচর হতেই,বৃষ্টির ঠান্ডা ঠান্ডা পানির মধ্যেও কানমাথা গরম হয়ে এলো তার।ক্রোধিত হয়ে পড়লো মন মস্তিক।

‘আমার গায়ে ওড়না নেই।ওরা আমার মাথার হিজাব টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে।সাথে ওড়ানাটা-ও কেঁড়ে নিয়েছে।

কম্পনরত ফুঁপানো গলায় বাধোবাধো স্বরে কথাগুলো বললো কৌড়ি।রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো নিভানের।মুঠোর তোপে পড়ে,ফুলেফেঁপে উঠলো হাতের শিরা-উপশিরাগুলো।টনটন হয়ে উঠলো শরীরের সমস্ত পেশী।সে কৌড়িকে এরকম একটা পরিত্যক্ত জায়গায় জুবুথুবু হয়ে বসে থাকতে দেখে আগেই বুঝে নিয়েছিলো,কিছু একটা তো হয়েছে!আর কি হয়েছে সেটাও কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছিলো।আর সেটাই শুনতে হলো!আবারও জোরেজোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার চেষ্টা করলো নিভান।এখন মেয়েটাকে সামলানো দরকার।তারপর সে দেখছে?কার-ও আত্মা ধরে টানাটানি করার ফলটা ঠিক কিরূপ হয়!আর এসব শোনার পরে তাদের আত্মাগুলো কিভাবে টেনে শরীর থেকে বের করতে হয় জানা আছে নিভানের।

কৌড়ির হাত ছেড়ে দিলো নিভান।গায়ে ভিজে চুপসে যাওয়া ব্লেজারটা খুলে ফের কৌড়ির সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো।যে অবস্থায় মেয়েটা কলেজ আসে,সেই অবস্থায় নেই।সাদা ইউনিফর্ম হিজাব বোরকাটার,শুধু বোরকাটা পরা থাকলেও হিজাব নেই গায়ে মাথায়।কৌড়িকে বরাবরই দেখেছে,মাথায় ওড়না বা স্কাফ হিজাবের সাথেও আলাদা করে ওড়না পরতে।হয়তো সেই ওড়নাটার কথা বলছে।কৌড়ির হাত ধরে টেনে ব্লেজারটা গায়ে পরিয়ে দিলো নিভান।কৌড়ি সংকোচিত হলেও কিছু বললোনা,শুধু সামনে থাকা মাবুষটার থমথমে মুখের দিলে চেয়ে রইলো।বৃষ্টির তোপে চেয়ে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। তবু্ও চেয়ে থাকার চেষ্টা করলো সে।তার মনে হচ্ছে,একটু আগের স্বাভাবিক চোখমুখের মানুষটার সাথে এখনকার চোখমুখের মানুষটার মিল নেই।হঠাৎ শ্যামবর্ণ মুখটা থমথমে ভাব, চোয়ালদ্বয় লৌহকঠিন মূর্তি।একটু আগের শান্ত বাদামি বর্ন চোখজোড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে রক্তিম আভা!

‘এখনো ভয় করছে?

খুব আদূরে গলায় জিজ্ঞেস করলো নিভান।প্রতিত্তোরে
কথা বললো-না কৌড়ি।শুধু মাথা নাড়িয়ে না জানালো।
সেটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।কৌড়ির কোমল ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ফের বললো।

‘তবে কোনো কারনে আমাকে ভয় পাচ্ছো না তুমি?

ফের মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে না সম্মতি জানালো কৌড়ি।অশান্ত মনে শান্ত চোখে সেটা দেখলো নিভান।মেয়েটাকে তারদিকে অটল নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনেহলো,মেয়েটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো!কোনোকারনে আবার তাকে ভয় পাচ্ছে না তো!বিধায় কথাটা জিজ্ঞেস করলো নিভান।উঠে দাঁড়ালো সে।কৌড়িকে বললো।

‘উঠো।চলো।

দাঁড়িয়ে পড়লো কৌড়ি।ঠান্ডায় পা হাত পা সব অচল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।উঠতে গিয়ে শরীরটা কেমন অচল অনুভব হলো।হেলে পড়ে যেতে নিলেই,নিভান তাকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো।ফের নিজেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো কৌড়ি।পাশে ফেলে থাকা ব্যাগটা নিতে গেলেই বাঁধা দিলো নিভান।অন্য হাতে সেটা তুলে নিল।আবারও কৌড়ির ডান হাতটা নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে বড়বড় পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।মেয়েটার শরীর কম্পনরত।হয়তো অতিরিক্ত ভেজার ফলে আর মনের শঙ্কায় এই অবস্থা।ভিজে অবস্থায় দুজনে গাড়িতে গিয়ে বসলো।গাড়িটা বাড়ির পথ ধরতেই স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো।

‘তুমি,ছেলেগুলোকে এ-র আগে কখনো তোমাদের কলেজের আশেপাশে দেখেছো?

অতিরিক্ত বৃষ্টির পানিতে ভেজার কারনে ফর্সা মুখটা এমনিতেই ফ্যাকাসে বর্ন ধারণ করেছে।নিভানের মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনতেই মুখটা আর-ও ফ্যাকাসে বর্ন হয়ে গেলো।মনে পড়ে গেলো সেই বিভৎস সময়ের কথা।আবহাওয়া খারাপের কারণে যখন কলেজ টাইম পার করার আগেই ছুটি ঘোষনা করা হলো,তখন সে কিছু নোটস নিজের খাতায় কালেক্ট করতে ব্যস্ত ছিলো।তারা কিছু মেয়েরা বাদে অধিকাংশ মেয়েরা তখন কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিলো।অল্প সময়ের মধ্যে সংক্ষেপে নোটসগুলো কোনোমতে কালেক্ট করে, কলেজের বাহিরে বের হতেই ঝড়ের আনাগোনা শুরু।কৌড়ি মনে করেছিলো, সিএনজি পেলে আর তো কোনো সমস্যা নেই।তবে খালি সি এনজি পাওয়ায় মুশকিল হয়ে যাচ্ছিলো।পরিচিত দু-একজন বান্ধবী যারা তারসাথে দাঁড়িয়ে ছিলো,তাদের বাড়ি উল্টো পথে আর আশেপাশে হওয়ায়।তারা দ্রুত হেঁটে চলে গিয়েছিলো।ঝড়ের সাথেসাথে বৃষ্টির আনাগোনা যখন শুরু হলো, বিপদের শঙ্কায় কৌড়ি-ও কলেজের সড়ক রেখে,সামনের সড়কের দিকে হাঁটা দিল।যদি ওখান থেকে দ্রুত খালি সিএনজি বা রিকশা পায়।তবে সে পর্যন্ত যাওয়ার আগেই আকাশ ভেঙে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামতে দেখেই একটা টঙ দোকানের ভিতরে আশ্রয় নিতে হলো তাকে।অতিমাত্রায় বৃষ্টির তোপে দোকনদারও তখন দোকানের ঝাঁপি লাগিয়ে দিয়েছে।তখনও ছাওনির নিচে একা দাঁড়িয়ে সিএনজির অপেক্ষা করছিলো কৌড়ি।কিছুসময় বাদে হঠাৎ দেখলো,তিনটে ছেলে তারপাশে ছাওনির নিচে এসে দাঁড়িয়েছে।গায়ে মাথায় বৃষ্টির পানি লাগায় সেগুলো ঝাড়ছে মুছছে।ছেলেগুলোকে এরআগে দেখেছে কৌড়ি।কলেজ থেকে মেয়েরা বের হলেই উল্টো পাল্টা গান ধরা,অভদ্রের মতো শিষ বাজানো।কলেজের এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেখানে সেখানে আড্ডাবাজি করা।প্রতিনিয়ত এসবই কাজ এদের।তাদের চেহারায় প্রকাশ পায়,এরা অভদ্র বখাটে আর নেশাখোর!

রাস্তা তখন শুনশান।বাতাসের প্রকোপ আর ঝুম বৃষ্টির আনাগোনা। ভয়ে শঙ্কায় কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা!ইতিমধ্যে ছেলেগুলোও তাকে ইঙ্গিত করে উল্টো প্লাটা বাক্য ছোঁড়া শুরু করে দিয়েছে।সাথে সিগারেটের বাজে দুর্গন্ধ তো আছেই।দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিলো, প্রান যায়যায় অবস্থা কৌড়ির!নিজের সাথে যখন তখন বাজে কিছু ঘটতে পারে ভেবেই সেই ঘনো বৃষ্টির মধ্যেও রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলো কৌড়ি।আর তখনই ঘটলো বিপত্তি।একটা ছেলে তার গায়ের ওড়নাটা পিছন থেকে টেনে ধরলো।বোরকার সাথে ওড়নাটা পিনআপ না করে থাকায়,মূহুর্তেই সেটা ওদের হাতের মুঠোয় চলে গেলো।ভয়ে শঙ্কায় থরথরিয়ে কেঁপে চলছিলো কৌড়ি।কি করবে ভেবে উঠতে পারছিলো না।রাস্তা শুশশান, আশে পাশের দোকানপাট গুলো বন্ধ।চিৎকারে চেচামেচি আর ছেলেগুলোর অসভ্যতামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও তো কোনো লাভ হবেনা।বিধায় ভয় শঙ্কা নিয়ে আবারও সামনে এগোতে গেলে,তার মাথায় মুড়ানো হিজাবটাতে টান অনুভব করলো।ভয়ে কেঁদে ফেলেছিলো কৌড়ি।তবে ভয়ের সাথে সাথে এবার রাগ ক্ষোভও হয়েছিলো প্রচুর।পরিস্থিতিতে বুঝেও রাগ ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে পিছনে ফিরে জোর গলায় প্রতিবাদও করেছিলো।

‘আপনারা কেনো আমার সাথে অসভ্যতামো করছেন? রাস্তায় মেয়েদের বিরক্ত করার আগে ঘরে মা বোনদের কথা মনে পড়েনা?

এমনিতেই কৌড়ি ভিতু টাইপের।তার উপর শঙ্কিত গলায় কথাগুলো বলতেই ছেলেগুলো বিশ্রীভাবে হাসতে শুরু করলো।ফের লালসিত গলায় বললো–মনে পড়ে তো মা বোনদের কথা।কিন্তু রাস্তার সব মেয়েকে যদি মা আর বোন ভাবি।তবে বউ পাবো কোথায়,সন্দুরী? আর তোমার মতো সুন্দরী মেয়েকে থোড়াই না মা বোন ভাবা যায়।তোমার মতো মেয়েকে নজরে পড়লে শুধু বউ বউ রকমের আসে।

আরও শত বিশ্রীরকমের কথা বলতে লাগলো একের পর এক।বাহিরে চোখমুখ শক্ত রাখলেও, ভিতরে ভিতরে ভয়ে শঙ্কায় নুইয়ে পড়েছিলো কৌড়ি।এই অসভ্য জানোয়ার গুলোর সাথে কথা বাড়ানো মানেই বিপদ!বুঝেই দ্রুত সামনে এগোতে গিয়েই আবারও বাঁধা পেলো। তবে দাঁড়ানোর মনোভাব দেখালোই না।হিজাবে টান পড়া সত্ত্বেও সামনের দিকে হাঁটা দিল সে।তবুও ছাড়িনি ওই অমানুষ গুলো।বরং আরও জোরে হিজাবের কোনাটা টেনে ধরতেই,চুল ছিড়েখুঁড়ে হিজাবটা নিয়ে নিলো তাদের হাতের মুঠোয়।সঙ্গে সঙ্গে চিতকার করে কেঁদে দিয়ে সামনের দিকে দৌড় দিয়েছিলো কৌড়ি।রাস্তায় তখন একটা মানুষ-ও নেই।
ঝড় আর বৃষ্টির প্রকোপ দ্বিগুণ তখন।চারপাশটা কেমন অন্ধকার!পিছন থেকে ছেলেগুলোও ছুটে আসছে দেখেই,দিশাহারার মতো যেদিকে নজর গেছে সেদিকে ছুটে গিয়েছে কৌড়ি।বেশ কিছুক্ষণ দিশাহীন ছুটে চলার পর হঠাৎই মনে হলো ছেলেগুলো তার পিছনে নেই।কারনটা কি জানা নেই কৌড়ির।কেনো ছেলেগুলো তার পিছু নেওয়া ছেড়েছিলো।তবে নিজের নিরাপদ রাখতে, ওই পরিত্যক্ত জায়গায়টার পিছনে গিয়ে লুকেছিলো সে।ঘন্টা পেরেয়ি যাওয়ার পর-ও সাহসে কুলায়নি সেখান থেকে বেরিয়ে আসার।তবে মনেমনে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছিলো।

‘কৌড়ি।

হুঁশে ফিরলো কৌড়ি।ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটার দিকে উদভ্রান্তের ন্যায় ফিরলো সে।মানুষটার দৃঢ় নজর তখনও সামনের দিকে।তবে মনোযোগ তার দিকে এটা বেশ অনুভব করতে পারলো কৌড়ি।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে,মুখে মৃদুশব্দে বললো।

‘মুখ চেনা।ওদেরকে প্রতিনিয়ত কলেজের আশেপাশেই দেখা যায়।

আর কথা বাড়ালোনা নিভান।বাড়ির কাছাকাছি গাড়িটা পৌঁছানোর আগেই,কাওকে ফোন দিলো সে।ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হতেই গম্ভীর গলায় বললো।

‘মান্য..একটা ওড়না নিয়ে বাড়ির বাহিরে আয়।

ওপাশ থেকে মুখে হাত চেপে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মান্যতা।কৌড়ি বাড়িতে না আসাতে সে-ও ছটফট করছে।বাড়ির অধিকাংশ লোকই এখনো জানে না, কৌড়ি বাড়িতে ফেরেনি।বিশেষভাবে মা আর সে ছাড়া।একটু আগে মায়ের কাছ থেকে জেনেছে,কৌড়ি বাড়িতে না আসায় দাদাভাইকে জানিয়েছেন তিনি।একটু নিশ্চিত হলেও টেনশন কমেনি।এখন দাদাভাই ওড়না নিয়ে বাহিরের যাওয়ার কথা বলছে কেনো? মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু ঘটেনি তো!ও আল্লাহ।দ্রুত
ওয়ারড্রব থেকে একটা ওড়না বের করে নিয়ে দৌড় দিলো মান্যতা।বাড়িটা আপতত শুনশান।বৃষ্টির ঠান্ডার প্রকোপে যে যার রুমে অবস্থার করছে।হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছে।কোনোরকম মেইন দরজা খুলে বৃষ্টির মধ্যেও লন এরিয়ায় পা রাখতে গিয়েও দেখলো,দাদাভাইয়ের গাড়িটা এদিকে আসছে।দাঁড়িয়ে পড়লো মান্যতা। গাড়ি এসে থামতেই দ্রুতবেগে গাড়ীর জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালো সে।ততক্ষণে জানালার কাচ নামিয়ে দিয়েছে নিভান।বিধ্বস্ত কৌড়িকে দেখেই,পরাণ কেঁপে উঠলো তার।তারমধ্যে মান্যতাকে দেখেই কেঁদে ফেললো কৌড়ি।মূহুর্তেই গাড়ির দরজা খুলে, নিচু হয়ে কৌড়িকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো মান্যতা।ভিজে গেলো নিজে, তবুও সরলোনা।কৌড়ির মাথায় বরাংবার হাত বুলিয়ে, কপালে চুমু দিয়ে বললো

‘তুই ঠিক আছিসতো পাখি?আর কখনো তোকে এভাবে একা ছাড়বোনা।কাঁদিস না পাখি, চুপ কর।

অনর্গল এটাওটা বলে গেলো মান্যতা।মান্যতা আদূরে কথাগুলোয় কান্না যেনো বাড়লো কৌড়ির।সেটা বুঝে মান্যতা ফের বললো।–কিচ্ছু হয়নি।একদম কিচ্ছু হয় নি।

ছেড়ে দিলো কৌড়িকে।ভাইয়ের ব্লেজারটা কৌড়ির গায়ে দেখতেই আঁতকে উঠলো বুকের ভিতর।তবে মুখে তা প্রকাশ করলোনা।নিয়ে আসা ওড়না মেলে তারউপর গায়ে দিয়ে বললো।–তাড়াতাড়ি বাহিরে আয়।কতক্ষণ থেকে ভিজছিস তার ঠিক নেই।সর্দি-জ্বর বাঁধলো বলে!

কৌড়িকে ধরে বাহিরে নিয়ে আসলো মান্যতা।বাড়ির দিকে পা রাখবে এমন সময় মান্যতাকে ডাকলো নিভান।ফের বললো—ওকে এই অবস্থায় যেনো বাড়ির কেউ না দেখে!বিশেষ করে ফুপিমণি!আর ও ভয় পেয়েছে প্রচন্ড,ওকে আপতত একা ছাড়িস-না।খাবার শেষে জ্বরের একটা ঔষধ খাইয়ে দিস।

গাড়ি স্টার্ট দিলো নিভান।হঠাৎ কৌড়ির মন ছটফটিয়ে উঠলো।মানুষটাও তো তারমতো কাকভেজা।তবে জামাকাপড় চেন্জ না করে আবার-ও যাচ্ছে কোথায়? কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলোনা কৌড়ি।শুধু শা-শা বেগে গাড়ীর চলে যাওয়াটা দেখলো।মনেমনে আওড়ালো।

‘আজ কেনো ওই মানুষটার দিকে মনটা টানছে তার।ওই মানুষটার শক্তচোয়াল আর রক্তিম চক্ষুোদ্বয় তাকে যে ইঙ্গিত দিলো,তবে কি এই কাকভেজা অবস্থায় সেদিকে ছুটলো মানুষটা!কিন্তু কেনো?তারজন্য!এসব কি ভাবছে সে!নিজের সীমা-তো যানে কৌড়ি।সেই সীমা কখনো অতিক্রম করতে চায়-না সে।উচিত-ও নয় অতিক্রম করা।আর সেই অনুচিত কাজের ভাবানাটা-ও সীমার মধ্যে পড়ে।তাই সেটা নিয়ে ভাবনাও অনুচিত।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে