ফুলকৌড়ি পর্ব-১০+১১

0
12

#ফুলকৌড়ি
(১০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কাঁচের দেয়াল বেষ্টিত সৌন্দর্যবর্ধনে সজ্জিত- গচ্ছিত নিজ অফিসকক্ষের চেয়ারে বসে আছে নিভান।রুমটা শুধুই তারজন্য স্পেশাল।জাহিদ সাহেব এবং শাহেদ সাহেব অফিসে আসলে তাদের জন্য-ও স্পেশাল নিজ নিজ অফিসকক্ষ রয়েছে।যে যারমতো করে নিজেদের অফিসকক্ষটা সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে।শীততাপনিয়ন্ত্রণ রুমটার চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সে।ইদানীং চোখ বন্ধ করলে সেই ক্রন্দনরত চোখজাড়ার সাথে সাথে আর-ও একটি দৃশ্য বদ্ধ নজরে ভেসে বেড়ায় তার।সেদিন বিকালের সেই ফিকে পড়া সূর্যের আলোতে কালোপোশাকে আবৃত এক মায়াহরিনীর গোলগাল কোমল লাবন্যময়ী মুখশ্রী ।কি অদ্ভুত!যে কারনে বিহানকে সে ঠান্ডা গলায় শাসালো,সেই একই নজরে সে-ও তাে দেখেছে মেয়েটাকে।তবে তাকে শাসাবে কে?আর মেয়েটা তো তার-ও কেউ নয় তবে কোনোই বা বিহানকে শাসালো সে?বিহানের মতো সেই মায়াহরিনীকে মুগ্ধ চোখে দেখার জন্য,তারও কি শাসন প্রাপ্য নয়?হবেনা কেনো?একই অপরাধে অপরাধী দুজন,তবে কেনো একজন শাসিত হবে।কিন্তু ভিতরটা কেনো বলছে ভিন্ন কথা!বিহানতো খারাপ নজরে মেয়েটাকে দেখেনি,তবে কেনো সেই মুগ্ধ নজরে তাকানোটা ঠিকঠাক লাগেনি তার?শান্ত থাকতে চেয়ে-ও মানতে পারিনি সে।হঠাৎ কি শুরু হলো এগুলো তার সাথে?কি?

‘আসবো?

কোনো সাড়া এলোনা ভিতর থেকে।কপাল কুঞ্চিত হলো তৃনয়ের।এতো কি ভাবনাতে ডুবে আছে ছেলেটা,যে তার ডাকটা অব্দি কান পর্যন্ত পৌঁছালো না।নিভান এত মনোযোগী হয়ে কি ভাবনায় ডুবে আছে।আশ্চর্য!

‘এই নিভান আসবো?

সচকিত হলো নিভান।চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলো চেয়ারে।—তোকে বারবার কেনো উহ্য করে বলতে হয়, আমার কেবিনে আসার জন্য তোর অনুমতি প্রয়োজন নেই।

‘অফিসিয়াল রুলস বলে কথা।সেটাতো আর অগ্রাহ্যতা করা যায়না।রুলস্ তো সবার জন্য সমান।তাই না?

‘সেই অফিসের কোনো স্টাফ নোস তুই।আর না কোনো কোম্পানির কন্ট্রাক্ট ডিলার।আমার কাছের মানুষগুলোর আমার কাছে আসার জন্য কখনো তাদের অনুমতির প্রয়োজন নেই।

‘তা এমন কোন কাছের মানুষের কথা ভাবছিলি,যে আমার ডাকটা পর্যন্ত নিভান আওসাফ আহমেদ এর সেই ভাবনা ভেদ করে তার কর্নদ্বয় অব্দি পৌছালো না?

দুষ্ট হেঁসে কৌতুক গলায় কথাটা বলে চেয়ারে গা এলিয়ে
দিয়ে নিভানের মুখের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো তৃনয়।যদিও অপরপক্ষের ছেলেটার থেকে উত্তর পাবে এই আশাটা রাখে-না সে।তৃনয়ের ভাবানমতো সত্যিই উত্তর দিলো না নিভান।বরং অফিসের পিয়নকে ডেকে কফির অর্ডার করলো।পিয়ন চলে যেতেই তৃনয়কে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘হঠাৎ আমার অফিসে?সহজে তো পা পড়ে-না এখানে?কিজন্য এসেছিস?

তৃনয় জানতো উত্তর পাবেনা। তাই সেদিকে সে-ও আর এগোলা না।তবে নিভানের বলা কথাগুলো কানে যেতেই চেয়ারের হেডে মাথা এলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো— তন্ময়ীর বিয়ে ঠিক হয়েছে।সেটাই বলতে আসলাম তোকে?

‘হঠাৎ?অনার্সটা তো কমপ্লিট করতে দে।তারপর না-হয় ওর বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবিস।

‘জানিসইতো,আম্মা আমাদের দুভাইবোনের অভিভাবক সম্বল।সবকিছু।হয়তো প্রতিটি সন্তানের ক্ষেত্রে মায়ের অবদান অতুলনীয়।তবে বাবা মারা যাওয়ার পর সেই মা,বাবা মায়ের দুজনেরই অবদান রেখেছেন বর্ননাহীন।নিজে চোখে দেখে এসেছি তো,বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের দুই-ভাইবোন-কে আঁকড়ে কিভাবে বেঁচে আছেন আম্মা।আমাদের সবদিকের যথাযথ খেয়াল রেখে প্রয়োজন অপ্রয়োজন সকল আশা আকাঙ্খা মিটিয়ে কি-করে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করেছেন।মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছেন।সেই মায়ের সিদ্ধান্ত কখনো অমান্য করার চেষ্টা করেনি।তন্ময়ী-ও কখনো করিনি।হঠাৎ বিয়ের এই সিদ্ধান্তে ওর একটু মন খারাপ হলে-ও,মায়ের সিদ্ধান্তে অমত পোষন করেনি।তন্ময়ীকে আমি ঠিক কিরূপ ভালোবাসী।সেটা তো তুইও জানিস।আমিও তোর মতো চেয়েছিলাম,আর ভেবেছিলামও,এতো তাড়াতাড়ি ও-কে পর কর দেবো না।তবে মা যখন চাইছেন আমি-ও না করবো কিকরে বল?যদি-ও আমি না করেছিলাম।আম্মাকে বললাম– এতো তাড়াহুড়োর কি দরকার?পড়াশোনাটা আপতত কমপ্লিট করে নিক।তারপর না হয় ওর বিয়ের কথা ভেবে দেখা যাবে।মা আমার কথাতে রাজী হতে চাইছে না।বলছে,ভালো পাত্র,হাতছাড়া করা ঠিক হবে-না।আর এখনকার যুগে খুঁজে খুঁজে যোগ্য পাত্র মেলাও ভার।তা বাদেও মেয়েদের বয়স হয়ে গেলে,সঠিক পাত্র পাওয়াও মুশকিল হয়ে যায়।সঠিক বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া উচিত।এই কতশত কথা।মায়েদের ভাবনা বুঝিসই তো।
আর ছেলের ডিটেইলস সম্পর্কে খোঁজ খবর তো নিলাম।সবদিকে থেকে ভালোই তো মনেহলো।

‘আন্টি যখন ভালো ভেবেছেন,তবে নিশ্চয় চিন্তা ভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।আর তন্ময়ী অ্যাডাল্ট, ও যখন মতামত দিয়েছে।তবে আর না করার কি আছে!যদি-ও খোঁজখবর নিয়েছিস,তবু-ও আর-ও একটু ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে তারপর বিয়ের মতো সিদ্ধান্তে যাবার চিন্তাভাবনা করিস।এটা কিন্তু শুধু একটা মেয়ের ভবিষ্যতের চিন্তা নয়।তোর আমার একেকটা জান কলিজার ভবিষ্যত।সেখানে ওরা ভালো থাকলেই তবে আমাদের শান্তি।

তৃনয় কথা বললো-না।শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।ফের চেয়ারে এলানো মাথাটা আরও শক্তকরে চেয়ারে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো।ওই শান্তশিষ্ট মায়াবী মিষ্টি চেহারার আদরের বোনটাকে তার পর করে দিতে হবে?ভাবতেই ক্ষনে ক্ষনে বুকের ভিতরটা ছলাৎ করে উঠছে তার।বাবা ছিলো না বিধায় ছোটো থেকে ওই বোনটাকে যে খুব যত্নে আগলে মানুষ করেছে সে।

‘এই তৃন?

ছেলেটার মন খারাপ হলেই নিভানের সঙ্গ খোঁজে।আজ হয়তো সেই সঙ্গটাও মন খারাপটাকে বিতাড়িত করতে পারছে-না।সেটা বুঝে তৃনয়কে ডাকতেই চোখ মেলালো সে।তন্ময়ীর জন্য যে ছেলে দেখা হয়েছে তার সম্পর্কে এবং তার ফ্যামিলি সম্পর্কে ডিটেইলসে জানতে কথা বাড়ালো নিভান।কথার মধ্যে থাকলে হয়তো ছেলেটার মন খারাপটা দীর্ঘ হবে-না।সেটা ভেবেই মুলত কথা বাড়ানো নিভানপর।একপর্যায়ে কফি নিয়ে এলো পিয়ন।কফিটা পান করতেকরতে দুই-বন্ধুর কথা আরও জমে উঠলো।

বেডে হেলান দিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে বই পড়ছেন জাহিদ সাহেব।বই পড়ার অভ্যাসটা উনার আগে খুব বেশি একটা ছিলো না।বলতে গেলে,ব্যবসায়ী কাজের জন্য পড়ার সময়ই পেতেন না।অসুস্থ হওয়ার পর থেকে এই পড়ার অভ্যাসটা হয়েছে উনার।এখন সারাদিন নামাজ কালাম তসবিহ তাহলীল ছাড়া সারাদিনের সঙ্গী হলো বই।আসরের নামাজটা পড়ে বিকালের চা নাস্তা নিয়ে স্বামীর খেদমতে হাজির হলেন নীহারিকা বেগম।নীহারিকা বেগমের উপস্থিতি বুঝতে পেরে বইটা হাত থেকে বেডের একপাশে রাখলেন জাহিদ সাহেব।যতো প্রয়োজনীয় কাজ আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোক এই নারাীটাকে তিনি কেনো জানি উপেক্ষা করতে পারেন না।কতো বছরের সংসার উনাদের।অথচ যতোবার স্ত্রী নামক নারীটার পদচারণ এই রুমে পড়ে তিনি সব উপেক্ষা করে নারীটাতেই মন দেন।

‘নিন,আপনার চা।

চায়ের কাপটা হাতে নিলেন জাহিদ সাহেব।চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলেন।

‘আজ এক কাপ চা?তোমারটা কোথায়?

‘দুপুরের খাবারটা আজ অসময়ে খাওয়া হয়েছে।তাই চা টা আর এসময়ে খেতে ইচ্ছে করলোনা।

কথা বাড়ালেন না জাহিদ সাহেব।চায়ের কাপে ছোটো ছোটো চুমুর দিতে থাকলেন।সাথে একটুকরো বিস্কিট ও নিলেন।সেদিকে কিছুসময় নীরবে তাকিয়ে থেকে কথা পাড়লেন। বললেন–মেয়েটার দু’মাস বাদে ফাইনাল পরিক্ষা।কলেজ যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করা উচিত নয় কি?

‘কার কথা বলছো?কৌড়ির?

‘হুমম।

জাহিদ সাহেব ভাবান্বিত হলেন।সময় নিয়ে কিছুসময় ভাবলেনও।ফের বললেন—ব্যবস্থা তো করা উচিত।তবে এই পরীক্ষার দু’মাস আগে কলেজ কতৃপক্ষ কোনো বহিরাগত স্টুডেন্ট এলাও করবে কি-না।এটাও চিন্তার বিষয়।

ফের জাহিদ সাহেব কিছু ভাবলেন।বললেন–তবে আমি দেখছি।রাতে শাহেদ বাড়িতে আসলে আমার সাথে একবার জরুরীভাবে দেখা করতে বোলো তাকে।

‘ঠিক আছে।

সম্মতি জানিয়ে ফের নীহারিকা বেগম বললেন।-আমিও তাই ভাবছিলাম।মৌনতার স্কুল এন্ড কলেজের যে প্রিন্সিপাল,উনার সাথে শাহেদের তো বেশ সখ্যতা আছে।সম্পর্কে মৌনতার নানুবাড়ির দিক থেকে আত্নীয় ও হয়।আপতত পরিক্ষার আগ অব্দি মেয়েটাকে একটু ক্লাস করার ব্যবস্থা করে দিলেই হচ্ছে।মেয়েটা মনেহয় আবার সাইন্সের স্টুডেন্ট।

‘হুম।আহসান বলেছিলো মেয়েকে ডাক্তারী পড়াবে।সেই হিসাবেই এগিয়েছে।আর সেদিন ওর কাগজপত্রগুলো তো দেখলাম।ক্লাস ফাইভ, এইট,এস এস সি।হাই কোয়ালিটি রেজাল্ট।সবগুলোতে গোল্ডেন এ প্লাস।

‘হুমম।

দু’জনে মিলে কৌড়িকে নিয়ে ভালোমন্দ বেশ টুকিটাকি আলোচনা করতে থাকলেন।কীভাবে বাাবা মা মরা মেয়েটাকে নিজের সন্তানদের মতো, তার স্বপ্নের পথের দিকে এগিয়ে দেওয়া যায়।

রাতে শাহেদ সাহেব বাড়িতে এলে কৌড়ির বিষয়ে উনার সাথে আলোচনা করলেন জাহিদ সাহেব।আলোচনার একপর্যায়ে শাহেদ সাহেব বললেন।তিনি মৌনতার স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে কৌড়িকে কলেজে ক্লাস করার জন্য ব্যবস্থা করে দেবেন।নিশ্চিত হলেন জাহিদ সাহেব।সেখান থেকে দু’দিন বাদেই কৌড়িকে নিয়ে কলেজে গিয়ে,ওর বিষয়ে কথা বলে আপতত ক্লাস করার ব্যবস্থাটা করে দিয়ে আসলেন শাহেদ সাহেব।তবে পরিক্ষাটা মেয়েটা এখানে দিতে পারবে-না।
পরিক্ষাটা, তার নিজ কলেজের রেজিষ্ট্রেশন অনুযায়ী সেখানেই দিতে হবে।


নিজের অফিস কক্ষের কাঁচের বেষ্টনীতে ঘেরা ওয়ালের সম্মুখে,দু-পকেটে হাত গুঁজে সটান দাঁড়িয়ে আছে নিভান।নজরটা তার ব্যস্ত শহরের অলিতে-গলিতে স্থির। সাততলা ভবনের উপর থেকে ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত যানযট আর তারচেয়ে ব্যস্ত মানুষের চলাচলের আনাগোনা দেখে চলেছে সে।বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন পোশাকের মানুষের আনাগোনা চলছে,বাকী নেই স্কুল, কলেজ ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের ব্যস্ত চলাচল সেখানে।এমনকি বিভিন্ন পোশাকে ভিন্ন ভিন্ন নারীর পদচারণাও। হঠাৎ নিভানের মনেহলো বাড়ির গাড়িটাও সেই ব্যস্ত চলাচলের রাস্তায় ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।গাড়িতে কে বা কারা?আর এই অসময়ে কোথায় চলেছে?হঠাৎই আবার মনেহলো গাড়ীটা তার অফিসের পার্কিং এরিয়ার দিকে টার্ন নিচ্ছে।ব্যাপার কি?চাচ্চু আর সেতো সেই কখন অফিস চলে এসেছে।তবে অফিসে আবার কে আসলো।ইভান নাকি অন্যকেউ?ইভান তো সহজেই অফিসে পা মাড়ায় না।আর অন্য কেউ।কে?হয়তোবা প্রয়োজনে কেউ এসেছে।তবে অনেক্ক্ষণ যাবত অপেক্ষা করার পরও যখন মনেহলো,অফিসে কেউ আসেনি।ব্যাপার অন্যকিছু। নাহলে এতো সময় বাড়ি থেকে কেউ এসেছে,এটা তার কাছে ইনফর্ম হয়ে যেতো।

নিভান যে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো,সেপাশ থেকে গাড়িটার কিছু অংশ দেখা গেলেও,গাড়ির সামনের অংশ আর গাড়িতে কারা?এটা দেখা যাচ্ছিলো না।দ্রুত পা চালিয়ে নিজের অফিস রুমের সাথে নিজস্ব কেবিনটায় চলে গেলো নিভান।সেখানে মাঝেমধ্যে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থাকার সুব্যবস্থা করা আছে।সুব্যবস্থা করে রেখেছে নিভান।মাঝেমধ্যে এর প্রয়োজনীতা সুফল দেয় খুব।কেবিনের বিশাল বড় কাচের জানালাটার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই নিচের পার্কিং-এরিয়ার দৃশ্যবলী নজরবন্ধিতে স্পষ্ট হতেই কপাল কুঁচকে গেলো তার।গাড়ির দরজা খোলা,সেখান স্পষ্ট একটা মেয়েকে মাথা এলিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে।মেয়টা কে বুঝতে অসুবিধা হলোনা
নিভানের।প্রায় মাসের কাছাকাছি হতে চলেছে,মেয়েটা তাদের বাড়িতে এসেছে।সামনাসামনি দেখাসাক্ষাৎ কম হলেও,মেয়েটা শত দূর থেকে তার নজরে পড়লেও সে চিহ্নিত করতে পারবে মেয়েটা কে?তবে মেয়েটার কি হলো,ওভাবে বসে আছে কেনো?আর এরা এই অসময়ে এখানেই বা কি করছে?মান্যতা আর দীবা গাড়ির বাহিরে দাড়ানো।মান্যতা চিন্তিত মুখে কিছু ভেবে চলেছে আর দীবা তাকে কিছু বলে চলেছে। হাফিজ ভাই তাদের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান্ড দেখছে।কোনো কারনে মন একটু বিচলিত হলো নিভানের।দ্রুত পায়ে অফিসকক্ষে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা এনে পুনরায় জানালার পাশে দাঁড়ালো।কাঙ্ক্ষিত নম্বরটাতে ফোন দিতেই ওপাশের মানুষটা তথাস্তু হয়ে কিছুটা ভয়েভয়ে ফোনটা রিসিভ করলো। সে নিশ্চিত স্যার নিশ্চয় উনাদের দেখেছেন বলেই তাকেই ফোন দিচ্ছেন।
মান্যতাদের কাছ থেকে কিছুটা সরে দাঁড়ালো হাফিজ।ফের ফোন রিসিভ করেই সালাম দিলো।সালামের উত্তর দিয়েই নিভান স্বভাবমত গম্ভীর গলায় শুধালো।

‘এ্যনি প্রবলেম,হাফিজ ভাই।অফিসের নিচে কেনো আপনারা?

কি বলবে হাফিজ খুঁজে পেলোনা।এই মহিলাদের কান্ড-কারখানা তার বুঁজে আসেনা।কি যে করবে এরাই ভেবে পাচ্ছেনা তো সে কি বলবে!

‘হাফিজ ভাই।

গম্ভীর গলার ডাকটা শুনতেই মান্যতাদের দিকে একপলক তাকিয়ে তড়তড়িয়ে উত্তর দিলো।–আসলে হয়েছে কি স্যার।ওই যে নতুন মেয়েটা এসেছে না,উনার জন্য কিছু বই আর কিসব শপিংয়ের জন্য বড়ো ম্যাডাম পাঠিয়েছেন।মান্যতা ম্যাডাম আর মেয়েটা আসছিলেন। দীবা ম্যাডাম বললেন তিনিও শপিংয়ে যাবেন তাই তিনিও তাদের সাথে এসেছেন।আর..

‘আমি সবার ডিটেইলস সম্পর্কে জানতে চাইনি হাফিজ ভাই।অফিসের নিচে এতো সময় দাঁড়িয়ে আছেন কেনো সমস্যাটা কি সেটাই বলুন।

নিভানের থমথমে গলায় আওয়াজ কানে আসতেই থতমত খেয়ে সংক্ষেপে কথা ধরলো হাফিজ।বললো–

‘মেয়েটা মনেহয় আগে থেকে কোনো-কারনে অসুস্থ ছিলো।গাড়িতে উঠার পর,মাঝ রাস্তায় এসে হড়বড়িয়ে কয়েকবার বমি করে দিলো।এখন আবার এখান থেকে বাড়ি ফিরতে তো সময় লাগবে,আমারাও শপিংমলের কাছাকাছি চলে এসেছি।তাই মান্যতা ম্যাডাম চাইছিলেন,সেই কাছাকাছি এসে গেছি যখন মেয়েটাকে আপনার অফিসের শীলা ম্যাডামের কাছে আপতত রেস্টে রেখে,জিনিসগুলো কেনাকাটা করে নিতে।মেয়েটার এই অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে শপিংয়ে তো আর ঘোরাঘোরি করা ঠিক হবেনা।আর গাড়িতে একা রেখে যাওয়াতো রিস্ক হবে, তাই।কিন্তু…

‘কিন্তু কি?

মুখটা ছোটো হয়ে এলো হাফিজের।আমতাআমতা করে বললো–দীবা ম্যাডাম চাইছেন না আপনার অফিসে মেয়েটাকে রেখে যেতে।বলছেন আপনি এসব উল্টো পাল্টা কাজের জন্য রেগে যেতে পারেন।আমাকে বলছেন উনাদের শপিংমলে রেখে মেয়েটাকে বাড়িতে দিয়ে আবার আসতে।সেটাতে তো প্রচুর দেরী হবে।আর বড় ম্যাডাম আবার বারবার করে বলে দিয়েছেন, তাদেরকে একা না ছাড়তে।মেয়েটারও যা অবস্থা!তার আপতত বিশ্রামের প্রয়োজন।খুবই ক্লান্ত মনেহচ্ছে তাকে।

দীবার বিষয়টা আমলে নিলোনা নিভান।সে যে কি কারনে মেয়েটাকে অফিসে রাখতে দিতে চাইছেনা।এটা নিভানের থেকে ভালো কে জানে।তবে মেয়েটার যা পরিস্থিতি শুনছে,মেয়েটার তো আপতত রেস্টের প্রয়োজন।তবে শিলাও তো অফিসে নেই।

‘কিন্তু শীলা তো আজ আসেনি।সে ছুটিতে আছে।

হাফিজের সাথে কথা বললেও নিভানের দৃঢ় নজর স্থির গাড়ির সিটে নির্জীব ভঙ্গিতে মাথা এলিয়ে রাখা মেয়েটার পানে।সেদিকে লক্ষ্য রেখেই গম্ভীর কন্ঠে বললো।

‘আমি নিচে আসছি।

নিচে যেতে সময় নিলোনা নিভান।হাফিজের নজরে পড়তেই সে তথাস্তু হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।স্যার নিচে আসতে চেয়েছে এ খবর সে কাওকে দেয়নি।তাই নিভানকে নজরে পড়তেই মান্যতার মুখ শুকিয়ে গেলো।
উল্টো পাল্টা কাজকর্ম দাদাভাইয়ের সহ্য হয়না,এখন কি না কি বলে বসে?যদিও দাদাভাই পরিস্থিতি বুঝে রাগারাগি করে।তবুও দাদাভাইয়ের এই দৃঢ় চোয়ালের কঠিন মুখাবয়ব নজরে পড়লেই অযথা কারনে বুক কাপে তাঁর।

নিভানকে নিচে দেখে দীবাও অবাক হলো।কিছু বলতে নেবে তার আগেই শক্ত গলায় মান্যতাকে প্রশ্ন করলো।

‘সমস্যা কি?

দৃঢ়চিত্তে এসে সটদন সামনে দাঁড়ালো শক্ত চোয়ালের মানুষটাকে একবার দেখে নিয়ে নমনীয় স্বরে মান্যতা বললো।

‘ওর হালকা মাথা ব্যথা ছিলো।মনে করেছিলাম বাহিরে আসলে ঠিক হয়ে যাবে।তাই ও না আসতে চাওয়া সত্ত্বেও,ও-কে নিয়ে এসেছি।ওর সামনে ফাইনাল পরিক্ষা তাই বইসহ ওর কিছু পোশাকও কেনা লাগতো।ও সাথে থাকলে বই পোশাক,দুটোই কিনতে সুবিধা হতো তাই মুলত নিয়ে আসা।কিন্তু ও এতো অসুস্থ হয়ে পড়বে আমি বুঝতে পারিনি।

‘ও অসুস্থ জেনেও ওকে নিয়ে আসা তোমার ঠিক হয়নি মান্য।

বিস্ময় চোখে নিভানের দিকে তাকিয়ে আছে দীবা।এ- কোন নিভানকে দেখছে সে! কৌড়ির হয়ে কথা বলছে নিভান!সম্ভব!এটা নিভানইতো?সে ভুল কাওকে দেখছে না তো?দীবার বিস্ময় আরও কঠিন রূপে বাড়িয়ে দিয়ে নিভান গমগমে গলায় মান্যতাকে আদেশ দিলো।

‘ও-কে বাহিরে আসতে বলো?

এবার মান্যতাও চোখ বড়বড় করে নিভানের দিকে তাকালো।পরপর চোখ নামিয়ে নিয়ে কৌড়ির কাছেই এগোলো।বিভিন্ন প্রশ্ন জাগলো মনে,তবে ভুলেও করলো না।গাড়ীর সিটে চোখ বুঁজে মাথা এলিয়ে রাখা মেয়েটার ক্লান্ত মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভিষন মায়া হলো।খুব করে মনেহলো,মেয়েটাকে জোর করে আনা তার একদম ঠিক হয়নি।কৌড়িকে ডাক দিতেই চোখ খুললো।একটু আগের কথোপকথোন কথন শুনেছে সে।এমনিতেই মানুষটাতে তার ভয় এবার ভয়ের সাথে সংকোচও কাজ করলো।বাহিরে গিয়ে সে ওই মানুষটার সামনে দাঁড়াবে কি করে?তাই মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে নিচু গলায় বললো।

‘আমি আপতত ঠিক আছি আপু।উনার সামনে যেতে চাইনা,প্লিজ আপু।আমি উনাকে খারাপ ভেবে বলছি-না আপু।

কৌড়ির ভয় সংকোচের কারনটা জানে মান্যতা।সে আগেও খেয়াল করেছে দাদাভাই যেখানে থাকে কৌড়ি সহজে সেখানে যায়না।কারনটা,তাদের মতোই।ওই কঠিন মুখাবয়বের মানুষটার সামনে সহজে তারা ভয়ে কেউ পড়তে চায়না।জানে দাদাভাই ওরকম কঠিন মুখাবয়ব করে থাকলে-ও সহজে বকা রাগদ্বেষ করবে না।তবুও ওই মানুষটাকে দেখলে একটা ভয় কাজ করে।কেনো এটা তারা কেউ জানেনা!হয়তো তার কম বলা আর গম্ভীর স্বভাবের জন্য।কিন্তু এখন উপায় নেই।কথা না শুনলে দু’দিকেই বিপদ।

‘না বলো না।প্লিজ নেমে এসো কৌড়ি।তোমার আপতত বিশ্রামের প্রয়োজন।এই অবস্থায় তোমাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি একদম ঠিক হবেনা।আম্মু জানলেও বকবে।আর দাদাভাই জেনে গিয়েছে যখন,উপায়ও নেই।তাই প্লিজ লক্ষী বোন আমার,না বলো না।এবারের মতো বাচিয়ে দাও আমাকে।

তারজন্য কেনাকাটা করতে আসা।আবার তারজন্যই তারকাছে অনুনয়। একটুও ভালো লাগলোনা কৌড়ির।সবার জন্য কেমন একটা গলায় বিঁধে থাকা কাটার মতো হয়ে গেছে সে।অন্তত নিজেকে তাই মনেহচ্ছে ইদানীং তার।দূর্বল পায়ে গাড়ি থেকে বের হলো সে।বের হতেই সামনে দাঁড়ানো উঁচু লম্বা বলিষ্ঠ দেহের কঠিন মুখাবয়বের মানুষটাকে দেখেই মুখ নিচু করে নিলো সে।

‘হাফিজ ভাই গাড়িতে উঠুন।তাড়াতাড়ি কেনাকাটা শেষ করে ওদের নিয়ে ফেরার চেষ্টা করবেন।

নিভানের গলার আদেশ পেতেই,দ্রুত পায়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো হাফিজ।সেটা লক্ষ্য করেই মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে নিভান ফের বললো।

‘মান্য গাড়িতে উঠে বসো।শপিং শেষ হলে,যাবার সময় ওকে এখান থেকে নিয়ে যেও।যাও।

কৌড়ি তড়িৎ গতিতে মুখ উচু করে মান্যতার দিকে তাকালো।মান্যতা তারদিকেই অসহায় ভঙ্গিতে আগে থেকেই তাকিয়ে ছিলো।তার মুখাবয়ব বলে দিচ্ছে, পড়েছি যমের হাতে,এখন যা বলবে তাই শুনতে হবে।দূর্বল শরীরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত রোমে রোমে কাটা দিয়ে উঠলো কৌড়ির।তাকে এই জলদগম্ভীর ভয়ংকর মানুষটার সাথে আপতত কিছু সময়ের জন্য থাকতে হবে!এরথেকে মান্যতা আপু তাকে, এই অজানা অচেনা শহরের অলিতে-গলিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে যেতো বা নিজে হস্তে কোনো ক্ষুধার্ত বাঘের মুখের আহার বানিয়ে দিতো।তবুও ভালো ছিলো।আল্লাহ।

গাড়ি ছাড়তেই ভাবনা কাটলো কৌড়ির।গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করা মান্যতার মুখটা দেখে ভিষণ কান্না পেলো তার।সত্যিই রেখে যাচ্ছে তাঁকে?গাড়িটা কিছুদূর যেতেই নিভানের কন্ঠে চমকে তার দিকে তাকিয়ে ফের মুখ নিচু করে নিলো।

‘আমি কোনো ভয়ংকর জীব নই,যে আমার সামনে এলে তোমাকে গিলে ফেলবো।চলে এসো।

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(১১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

তখন মান্যতা আপুকে বলা নিচু গলায় কথাগুলো শুনে ফেলেছে লোকটা!শ্রবণশক্তি কি তুখোড়!এবার থেকে এই লোকটা আশে-পাশে থাকলে ভুলেও কথা বলবেনা কৌড়ি।না-হলে এই জলদ-গম্ভীর গলার আওয়াজে তার রূহ,শরীর ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিতে সময় লাগবেনা।যেমনটা এখন অনুভব করছে।ওই অদ্ভুত গলার খোঁচা মারা কথা-গুলো শুনে তার হৃদপিণ্ড নিজ গতির সীমা ছাড়িয়ে চৌগুন হারে লাফালাফি করে চলেছে।লাফালাফির হারের গতিবেগ মাঝেমধ্যে এতো দ্রুত অনুভব হচ্ছে কৌড়ির,এই বুঝি বুকেরপাটা ভেঙে হৃদপিণ্ড নামক যন্ত্রটা জমিনে ছিটকে পড়লো।অবান্তর অনুভূতিতে ক্লান্ত শরীরটা আরও দূর্বল অনুভব হচ্ছে।অহেতুক ভাবনাগুলো মন মস্তিষ্ক-জুড়ে কিলবিলিয়ে বুকের ভিতরের ভয় আর শরীরের কাঁপুনিটা বাড়িয়ে দিতে চাইছে। তবু্-ও লোকটাকে অনুসরণ করেই তার পিছন পিছন যেতে হচ্ছে তাকে।আশেপাশে অনেক মানুষের পদচারণরা চোখে পড়লে-ও মাথা উঁচু করে দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে পোষন করলো না কৌড়ি।শরীর মন আপাতত দুটোই দূর্বল, কিছুই ভালো লাগছে না তার।শরীর চাইছে বিছানা আর মন চাইছে এই সামনে চলা ভয়ংকর মানুষটার সঙ্গ ত্যাগ করতে।তারউপর অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তাভাবনা,ভয়,সংকোচ মিশ্রিত মাথা-ঘোরানো অনুভূতি।সেসবের জন্য আশেপাশে তাকাতেই তার ইচ্ছে করছেনা।তাই বাধ্য হয়ে একমনে ফ্লোরের ঝকঝকা সাদা টাইলসকৃত মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধন করে তার সামনে চলা মানুষটাকে অনুসরণ করে চলেছে সে।তবে তার সামনে চলা মানুষটাকে যে,সেসব পথচারীরা বিনয়ের সাথে সালাম বিনিময় করে চলেছে।সেটা চোখে না দেখলেও কানে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।

হঠাৎ সামনের মানুষটা থেমে যাওয়ায় তাকেও থেমে যেতে হলো।মাথা উচু করে তাকাতেই, সেই দৃঢ় চোয়ালর মানুষটাকে স্থির নজরে তারদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নজর মূহুর্তেই সরিয়ে নিলো কৌড়ি।লিফট!লিফট তার কাছে অপরিচিত কিছু নয়।চড়া হয়েছে।তবে….

‘এসো।

পা চালালো কৌড়ি।লিফটের ভিতরে গিয়েই মোটামুটি দুরত্ব বজায় রেখে শক্ত হয়ে দাঁড়ালো সে।লিফট চলতেই পুনরায় মাথাটা ঘুরে এলো তার।বমি বমি ভাবটা আবার শুরু হলো।এখন কি করবে সে?এই ভয়টাই পাচ্ছিলো! ক্লাস এইট থেকেই মাইগ্রেনের সমস্যা তার।মাথা ব্যথা শুরু হলে,কড়া পেইনকিলারেও কাজ হতে চায় না।আগে মোটামুটি হতো,তবে ইদানীং কড়া পেইনকিলারেও কাজ হয়না।একবার কোনো কারনে মাথা ব্যথা শুরু হলে,একটানা দুই -তিনদিন মাথা ব্যথায় ভুগতে হয়।তারপর গিয়ে সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আস্তেআস্তে ব্যথা স্বাভাবিক হয়ে যায়।কড়া ঘুমের ঔষধ ছাড়া,এই ব্যথা সাধারণ ব্যাথার ঔষধে এখন আর নিষ্পত্তি হয়না।যদি-ও এই ব্যথা সহ্য পেয়ে গেছে তার।তবুও ব্যথার প্রতিক্রিয়াতো আছেই।কাল ভেজা চুল নিয়ে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিলো কৌড়ি।আর তার ফলস্বরূপ এই মাথা ব্যথার উৎপত্তি।মনে করেছিলো রাতে ঘুমের পরে ঠিক হয়ে যাবে।তবে ঠিক না হয়ে বরং সারারাত মাথা ব্যথায় ছটফট করেছে সে।মৃদু ধাক্কা দিয়ে লিফটা থেমে যেতেই আগের থেকে দ্বিগুণ হারে গা গুলিয়ে আসলো কৌড়ির।মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো।এখন যদি আবারও বমি হয়।কি বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে তাঁকে?ভেবেই কান্না পেলো।দাঁতে দাত চেপে যতসম্ভব নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো কৌড়ি।লিফটের থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আগে দু’জনে আগেপিছে হাঁটলেও এবার নিভানের সাথেসাথে সামনে এগোলো সে।বিশাল বড় কাঁচের দরজাটা ভেদ করে সাততলা ভবনের ভিতরে প্রবেশ করতেই মূহুর্তেই মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।আচমকা কতোগুলো নজর তাদের দিকে পড়তেই আড়ষ্টতা সংকোচ আর-ও দ্বিগুণ হারে ঘীরে ধরলো তাকে।সাথে বমিবমি ভাবটা জেনো তীব্র হলো।অথচ পাশের মানুষটা কতো সাবলীল-ভাবে বড়বড় পা ফেলে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।

আর পারলো না কৌড়ি।স্টাফ রুমগুলো পার করতে না করতেই, নিভানের অফিসকক্ষের সামনে এসেই হড়হড় করে বমি করে দিলো।পা থেমে গেলো নিভানের।কপাল কিছুটা কুঞ্চিত হলো অস্বস্তিতে।ফের কৌড়ির খিঁচে নেওয়া চোখ মুখের দিকে তাকাতেই সেই কুঞ্চিত কপাল মূহুর্তেই সহজ হয়ে গেলো তার।যে জিনসটায় তার প্রচুর অস্বস্তি হয়।পারল না সেই জিনাসটা চোখের সামনে দেখে-ও মেয়েটা থেকে দূরে সরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে।দ্রুত বেগে কৌড়ির খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে।দ্বিধা সংকোচ ছাড়াই বাম হাত দিয়ে শালীনতার সাথে তাকে আঁকড়ে ধরে, ডান হাতটা তার কপালে রেখে মাথা চেপে ধরলো।রুক্ষ স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠলো কৌড়ির সর্বাঙ্গ।বমির মধ্যে-ও ভয়ে কেঁদে ফেললো সে।ক্লান্ত অসহায় শঙ্কিত নজরজোড়া নিয়ে তাকালো,মাথা চেপে রাখা মানুষটার পানে।যা কখনো সে আশা করে নি।সেই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতেই পড়তে হলো তাকে।আর এতোগুলা মানুষের সামনে লজ্জিত করলো এই মানুষটাকেও।এখন মানুষটা তাকে বকবে নাকি কঠিন ধমকাবে?সেই শঙ্কা নিয়ে না চাইতেও ভয়েভয়ে তাকালো সে।কৌড়িকে তাকাতে দেখেই চোখের পলক ফেলে আশ্বস্ত করলো নিভান।মেয়েটার শরীরে কাঁপুনি বলে দিচ্ছে,নিজের কর্মকান্ডের জন্য মেয়েটা ভয়ে শঙ্কায় আছে।তাই চোখের ইশারা দ্বারা আশ্বস্ত করলো ভয় নেই, সংকোচ করো-না।যেটা হচ্ছে হতে দাও।

নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় পেলো-না কৌড়ি।পেটের মধ্যে যা ছিলো,তা আর গলা দিয়ে উগরে তুলতে বাকী নেই।শেষ সম্বল হিসাবে সবুজ পিতুনিগুলোও উঠছে।মেয়েটার গলা টানা দেখে কৌড়ি কে ধরে রাখা বাম হাতের বাঁধনটা আর-ও জোরালো হলো নিভানের।পানি প্রয়োজন।পিছনে তাকাতে নজরে পড়লো কয়েকজোড়া বিস্ময়কর,অবাককরা, আশ্চর্যজনক নজর।নজরগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভরাট গলায় হাঁক ছাড়লো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উদ্দেশ্যে।

‘অহিদ সাহেব,কোথায় আপনি।তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আসুন।

অফিসের পিয়ন।তিনি কৌড়িকে বমি করতে দেখেই পানি আনতে ছুটে ছিলেন।নিভান হাক ছাড়তেই দৌড়ে পানি নিয়ে হাজির হলেন।কৌড়ির মাথা থেকে হাত সরিয়ে,হাত পাতলেন অহিদ সাহেবের সামনে।ইশারা করলেন হাতে পানি ঢালতে।ইশারা পেতেই হাতে পানি ঢলালে অহিদ সাহেব।মুঠোভর্তি পানি কৌড়ির হিজাবে এঁটে থাকা মাথায় দিয়ে, ফের আরেকমুঠো পানি নিয়ে কৌড়ির চোখমুখে ছিটিয়ে দিতেই মেয়েটা একটু স্বস্তি পেলো।গলা টানাও কমে এলো।শরীর কঠিন দূর্বলতায় ছেড়ে দিতে শুধু করলো।তবুও নিজেকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রাখার কঠিন প্রয়াস করলো।

‘এখন ঠিক লাগছে?

কথা বলতে পারলোনা।শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো কৌড়ি।সেটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো নিভান।ফের বললো –এটুকু হেঁটে ভিতরে যেতে পারবে?

নিভানের চোখের ইশারায় দু-কদম সামনের রুমটার দিকে তাকালো কৌড়ি।আবার-ও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো,পারবে।কৌড়ি সম্মতি জানাতেই বমিকৃত অপরিচ্ছন্ন জায়গা থেকে কৌড়িকে নিয়ে সরে দাড়ালো নিভান।সামনে এগোনোর আগে,অফিসের পিয়নকে আদেশ করলো। —জায়গাটা পরিস্কার করার ব্যবস্থা করুন, অহিদ সাহেব।

স্বভাবমত গম্ভীর গলায় কথাটা বলে সামনে এগোতে গিয়ে,কৌড়ির দিকে নজর পড়তেই কিছু একটা ভেবে ফের আদেশ ছুড়লো—আর মিস রাইসাকে একবার আমার কেবিনে জলদি আসতে বলুন।

‘জ্বি স্যার।

সম্মতি জানিয়ে সরে দাঁড়ালো অহিদ।নিভানও কৌড়িকে নিয়ে তার নিজস্ব অফিসকক্ষের ভিতরে চলে গেলো।নিভান ভেতরে ঢুকতেই বিভিন্ন বয়সী অফিস স্টাফদের চোখ ঘুরেফিরে এলো সেই,স্পেশাল অফিসকক্ষের বিশাল বড় ঘোটালে থাই গ্লাসের কাঁচের দরজা থেকে।স্যার যখন অতি সুন্দরী একটা মেয়েকে পাশাপাশি নিয়ে অফিসে ঢুকলেন,তখনই সবার নজর কেড়েছে।বেশ আশ্চর্যও হয়েছে সবাই।যে যার চাকরির বয়স অনুযায়ী কখনো দেখেনি তাদের এই দৃঢ় ব্যাক্তিত্বের স্যারের সাথে কোনো মেয়ে সঙ্গ।অফিস অথবা অফিসের বাহিরে কোথাও দেখেনি।এমনকি কানাঘুঁষা-ও কখনো শোনেনি কোনো মেয়ে সম্পর্কিত বিষয়।যেমন স্যারের গার্লফ্রেন্ড বা এই ধরনের ধনী ব্যক্তিদের যেসব বিভিন্ন মেয়ে-ঘটিত বিষয় সম্পর্কিত জানা যায়,শোনা যায়।কখনো শোনেনি কেউ।এজন্য অফিসের যে ক’জন মেয়ে স্টাফ আছে,সবাই এম-ডি স্যার মানেই ফিদা।সেই দৃঢ় ব্যাক্তিত্বের মানুষটার সাথে হঠাৎ কোনো মেয়েসঙ্গ।সবাইকে তো একটু চমকে দিলো বটেই।আর- ও চমকে দিলো,ভরা অফিসে মেয়েটাকে বমি করতে দেখেও একটুও বিরক্ত হলেন না স্যার।বরং শালীনতা সাথে আগলে নিলেন,এবং ধৈর্য্য নিয়ে শান্ত হয়ে মেয়েটার পাশে থাকলেন।নিশ্চয় মেয়েটা, স্যারের স্পেশাল কেউ।নাহলে এতো যত্ন,এতো মায়া।কৈ এরকম মায়া করে,যত্ন করে কথা বলতে তো অফিসের নারী স্টাফদের সাথে কখনো দেখা যায়নি বা যায়না স্যারকে।সবাই তো স্যারের কঠিন ব্যাক্তিত্বে আর জলদগম্ভীর গলার আদেশে তথাস্তু থাকে।

সবার জল্পনা কল্পনা শেষ হলো মিস রাইসাকে,স্যারের রুমের দিকে ছুটে যেতে দেখে।অফিসে যে ক’জন মেয়ে স্টাফ আছে,তাদের বসার জন্য আলাদা জায়গা নির্বাচন করা।অফিসে ঢুকেই সরাসরি পুরুষ স্টাফদের নজরে পড়লেও,নারী স্টাফদের সহজে নজরে পড়বে না।তাদের কেবিনগুলো আলাদা ভাবে,অফিসে ঢুকতেই উত্তর সাইডে একটু ভিতরের পানে।বিধায় এতো সময়ের কান্ড তাদের নজরে পড়েনি।তবে মিস রাইসা যখন স্যারের কেবিনে যাচ্ছেন, মেয়েটা স্যারের কে।ঠিক জানা যাবে।

নিভানের অফিস কক্ষের সামনে আসতেই নাকমুখ কুঁচকে ফেললো রাইসা।একজন ওয়ার্ডবয় অপরিচ্ছন্ন জায়গাটা পরিস্কার করছে।তবে অকাজটা করলো কে? আশেপাশে কাওকে জিজ্ঞেস করারও সময় পেলো-না।স্যার হঠাৎ কেনো ডেকেছেন?অহিদ ভাইকে জিজ্ঞেস করাও সময় পায়নি।সেখানে একসেকেন্ড দেরী হলে ওই গম্ভীর গলার ঠান্ডা হুমকি।

‘যতসম্ভব টাইম মেইনটেইন করে চলার চেষ্টা করবেন।

স্যারের উপরে ফিদা হলে-ও, তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস তার এখনো হয়ে উঠেনি।আর হবে বলেও মন হয়না।ভাবনা স্থির রেখে দরজায় নক দিলো সে।

‘মে আই কা’মিন স্যার।

‘ইয়েস।

ভিতরে ঢুকতেই চোখজোড়া বিস্ময়ে চড়কগাছ।স্যারের রুমে মেয়ে মানুষ।ও আল্লাহ এ-কি দেখছে সে।মাথা চেপে চেয়ারে বসা মেয়েটাকে লক্ষ্য করলো রাইসা।গাঢ় নেভিব্লু কালারের সাথে সাদা মিশ্রনে একটা গোল ফ্রক জাতীয় জামা পরা।সাথে চুড়িদার।নেভিব্লু ওড়নাটা, দুকাধে সেফটিপিন দিয়ে আটকে গায়ে জড়ানো।মাথাটা সাদা হিজাবে মুড়ানো।মাথায় হাত চেপে রাখায় মেয়েটার মুখটা দেখা যাচ্ছে না।তবে হাতের খোলা অংশ বলে দিচ্ছে মেয়েটার গায়ের রঙটা মারাত্মক চকচকে ফর্সা।

‘আশেপাশের কোনো শপিং কর্নার থেকে ওনার একটা রেডিমেট যেকোনো ড্রেসের ব্যবস্থা করুন।

হুঁশে ফিরলো রাইসা।মেয়েটার কাছাকাছি দাড়ানো নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে ফের কৌড়ির দিকে তাকালো সে।মাথায় প্রশ্নেরা ভিড় করেছে,মনে কৌতুহল জমেছে গাদাখানিক।তবে প্রশ্ন করাতো তাকে সাঝেনা।তাই চাইলেও করতে পারলো না।প্রশ্ন,কৌতুহল সব চেপে সম্মতি জানালো সে।মুখে বললো–জ্বি স্যার,আমি ব্যবস্থা করছি।

পা ঘুরিয়ে-ও কৌতুহলী নজরে কৌড়ির পানে একবার চাইলো সে।মুখ ঘুরিয়ে যেতে নিতেই শুনতে পেলো, মেয়েটাকে ঘীরে স্যারের নম্র আচারন।

‘চোখেমুখে পানি দিলে একটু বেটার ফিল করতে।আর এমনতেই তোমার ওয়াশরুমে যাওয়া উচিত,জামা চুড়িদার নষ্ট হয়ে গেছে।

মেয়েটাকে ঘীরে তাদের দেখা দৃঢ় স্বভাবের ব্যাক্তিটার এতে নম্র আচারন।আরও কৌতুহলী করে তুললো রইসাকে।মেয়েটা স্যারের কে খুব জানতে ইচ্ছে করলো।তবে পারলো না।এমডি স্যারের অফিসকক্ষ থেকে বের হতেই অনেকেই কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেসও করে ফেললো।মেয়েটা স্যারের কে?আর তাকে কিজন্য ডাকা হয়েছিলো?তাকে কিজন্য ডাকা হয়েছিলো,এটা বলতে পারলেও, মেয়েটা স্যারের কে?এটা বলতে পারলো না।তবে রাইসার মন বলছে,মেয়েটা স্যারের বিশেষ কেউ।নাহলে এতো মুগ্ধ চাহুনি নিয়ে,তাদের দেখা দৃঢ় স্বভাবের মানুষটা কিকরে একটা মেয়ে মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে!সে মেয়ে মানুষ, পুরুষ মানুষের চাহুনির তফাৎটা বোঝে।স্যার যেভাবে গাঢ় দৃষ্টি ফেলে মেয়েটার দিকে মায়ামায়া নজরে তাকিয়ে ছিলো।নিশ্চিত মেয়েটা স্যারের অতি কাছের কেউ।


মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে কৌড়ির।আশেপাশে
কে আছে,কি হচ্ছে দেখতে, শুনতে,জানতে কিছুই ইচ্ছে করলো না।তবে মেয়েটার সাথে নিভানের কথপোকথন সে শুনেছে।মেয়েটা চলে যেতেই, তাকে উদ্দেশ্যে বলা কথাগুলো শুনতেই এবার অস্বস্তিতে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো তার।কি একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে সে,না পারছে সহ্য করতে আর না পারছে এই অস্বস্তিকর পরিবেশ ছেড়ে পালাতে।নিজের উপর চরম বিরক্তিতে চোখমুখ তেঁতো হয়ে এলো তার।এমনিতেই পাশে দাড়িয়ে থাকা মানুষটা মানেই আতঙ্ক ভয়,তারউপর বদ্ধ একই রুমে দু’জনে।ভয় লজ্জা সংকোচ সবমিলে কি যে দাবানল হচ্ছে তারমধ্য শুধু সেইই জানে।।নিভান হয়তো বুঝলো।

‘এভাবে থাকলে তোমারই অস্বস্তি বাড়বে।তখন আবার-ও বমিভাব পুনরাবৃত্তি হতে পারে।

এমনিতেই প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছে।ওয়াশরুমে যাওয়া খুব প্রয়োজন।তবে ভয়ে লজ্জায় কিছুতেই জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারছেনা কৌড়ি।তবে আর কতো মানুষের জ্বালা আর বিরক্তর কারন হবে সে?সবার কাছে জেনো না চাইতে-ও কাঁধে নেওয়া বাড়তি ঝামেলা আর বিরক্ততা সে।উঠে দাড়ালো কৌড়ি।সে উঠে দাঁড়াতেই ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলো নিভান।মাথা নিচুকরে সেদিকে এগোলো সে।বেশ কিছুসময় সেদিকে নীরব চেয়ে থেকে নিজের দিকে তাকালো নিভান।মেয়েটা মাথা নিচু করে বমি করায় তার প্যান্টের নিচের দিকে-ও কিছুটা ছিটকে লেগেছে।চেঞ্জ না করলে নিজেরই অস্বস্তিতে ভুগতে হবে।অফিসকক্ষ সাথে লাগোয়া কেবিনের দিকে এগোলো নিভান।সেখানে রাখা কেবিনেট থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে, নিজেকে চেঞ্জ করে নিলো।বাহির এসে দেখলো কৌড়ি এখনো বের হয়নি।নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো নিভান।সেখান থেকে কিছুসময় বাদেই ফের দরজায় নক পড়লো।

‘আসুন

রাইসা ভিতরে ঢুকলো।হাতে তার একটা শপিং ব্যাগ।রাইসাকে দেখে নিভান উঠে দাঁড়ালো।রাইসাকে উদ্দেশ্য করে বললো–আমি বাহিরে যাচ্ছি।ও ওয়াশরুমে আছে, ওকে একটু হেল্প করুন।

আদেশ পেতেই সম্মতি জানিয়ে, ওয়াশরুমের দিকে এগোলো রাইসা।মেয়েটাকে দেখার জানার আরেকটা সুযোগ পেয়েছে সে,সুযোগ পেতেই সম্মতি জানালো।এতো আকর্ষণ সে দেখাতোনা,তবে কঠিন ব্যাক্তিত্বের ক্র্যাশিত বসের জন্য মেয়েটাকে জানায়,দেখার আকর্ষণ মনে ভরপুর দোলা খাচ্ছে।ওয়াশরুমের দরজায় নক করতে গিয়ে,মনেহলো কি বলে নক করবে?নিভান বড়বড় পা ফেলে বাহিরে চলে যেতে গিয়েও দরজায় দাঁড়িয়ে পড়লো।পিছে ফিরে তাকাতেই তার ধারনা ঠিক হলো।রাইসা ওয়াশরুমের দরজা নক করতে গিয়েও থেমে দাঁড়িয়ে আছে।

‘ওর নাম কাশফিয়া।

ইচ্ছে করেই কৌড়ি নামটা বললোনা নিভান।চলে গেলো।মনেমনে দু’বার নামটা আওড়িয়ে ওয়াশরুমের দরজার নামধরে নক করলো রাইসা।সময় নিয়ে দরজা খুলতেই নজরে পড়লো কৌড়ির শোভিত সুন্দর মুখখানা।মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইলো কিয়াদক্ষন।নিঃসন্দেহে অতি সুন্দরী মেয়েটা।একনজরে যে কারও নজর মুগ্ধ হতে বাধ্য হবে।রাইসা নিজে-ও কম সুন্দরী নয়।তবে সামনে দাঁড়ানো লাবন্যময়ী নারী চেহারার কাছে সেই সৌন্দর্য কম মনেহলো।অথচ মেয়েটা ক্লান্ত, অসুস্থ দেখা যাচ্ছে।সেই মলিন মুখেও অদ্ভুত মায়ামায়া ভাব।স্যারের কি হতে পারে মেয়টা?গার্লফ্রেন্ড!এতো ছোটো মেয়ে।বয়সে তার তুলনায় বেশ ছোটো বলে মনেহচ্চে।যাই হোক,পরে জেনে নেওয়া যাবে।তবে মেয়েটাকে কি বলে সম্বোধন করবে।স্যারের স্পেশাল কেউ বলেই তো মনেহচ্ছে,তুমি করে বললে আবার কিছু মনে করে কি-না? আবার আপনি বলতেও দ্বিধা হচ্ছে।মেয়েটা তার অনেক ছোটো বলে। অতশত ভেবে যখন উত্তর মিললোনা,ভাবনা সেখানে ক্ষান্ত রেখে রাইসা বললো।

‘বয়সে আমার তুলনায় বেশ ছোটো মনেহচ্ছে।তুমি করে বলি।

ঘনঘন কয়েকবার বমি করায় গলা চিরে গেছে কৌড়ির।কথা বলতে ভিষন কষ্ট হচ্ছে।তবুও নমনীয় গলায় বললো–জ্বি।আপনি আমাকে তুমি করেই বলুন।আমি আপনার বয়সের ছোটোই হবো।

কৌড়ির ব্যবহারে খুশিই হলো রাইসা।শপিং ব্যাগটা কৌড়ির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো–এটাতে ড্রেস আছে তোমার।পারফেক্ট ফিট না হতে পারে।তবুও মানিয়ে নিও।

‘আচ্ছা।

মিষ্টি হাসালো রাইসা।মেয়েটা শান্তশিষ্ট স্বভাবের মনে হলো তার।এখনকার মেয়েদের মতো অতি চঞ্চল আর বাঁচাল নয়।বললো।

‘আমি ভিতরে আসবো?হেল্প লাগবে তোমার?

একটু ইতঃস্তত হয়ে কৌড়ি বললো-আমি পারবো আপু। আপনি শুধু একটু বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে।

মিষ্টি হেসে ফের রাইসা বললো–আচ্ছা ঠিক আছে।

শরীর প্রচন্ড দূর্বল লাগছে।চোখেমুখে ঘনঘন পানি দেওয়ার পর একটু ভালো লাগছে।তবুও ক্লান্ত দেহটা জেনো বিছানা চাইছে।জামাকাপড় পাল্টাতে ইচ্ছে করলো না, সত্যি বলতে হাত চলতে চাইছে-না।তবু-ও নোংরা জামাকাপড় বদলাতে তো হবেই।বদলানোর সুযোগ করে দিয়েছে মানুষটা এটাইতো অনেক।নাহলে তো নিজেকেই অস্বস্তিতে থাকতে হতো আর নিজের জন্য অন্যকেও অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হতো।আর-ও এখানে কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে।দূর্বল হাতে কোনোরকম জামাকাপড় পাল্টে নিলো কৌড়ি।নতুন পরিহিত পোশাকগুলো শরীরে বেশ ঢোলাঢুলাই হয়েছে। তবু-ও চলবে।এখন আর এসব ভালো লাগছেনা তার।তবে নিজের পোশাকগুলো কি করবে এখন?ভেবে কুল না পেয়ে দরজা খুললো।বাহিরেও একজন তারজন্য দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে,সেটা ভেবেই বাহিরে আসতে বাধ্য হলো।কৌড়ি বাহিরে বের হতেই আবারও মিষ্টি হাসলো রাইসা।তখন যে অফিসকক্ষের সামনে মেয়েটা বমি করে ভাসিয়েছে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। বুঝলো রাইসা।বললো।

‘এখন ঠিক লাগছে?

ঠিক তো মোটেই লাগছেনা।তবুও মাথা নাড়িয়ে হ্যা সম্মতি জানিয়ে।মুখে বললো–লাগছে।

‘তুমি কিছু বলবে?

কৌড়ির বারবার ওয়াশরুমের দিকে তাকাতে দেখে কথাটা বললো রাইসা।মেয়েটা বুঝতে পেরেছে দেখেই কৌড়িও বললো।—আমার জামাকাপড়গুলো ভিতরে সেগুলো কি করবো তাই বলছিলাম…

‘ওগুলো অহিদ ভাই নিয়ে গিয়ে লন্ড্রিতে দিয়ে দেবে।তারপর তোমার কাছে পৌঁছে যাবে ভেবো-না।

নিজের পছন্দমতো গাঢ় সবুজরঙা ঢিলাঢালা ড্রেসটাতে মেয়েটার বেশ লাগছে।গাঢ় সবুজের মধ্যে গায়ের ফর্সা রঙটা,রৌদ্দুরে জ্বলজ্বল করা বালির ন্যায় চিকচিক করছে।ওড়নায় মুড়িয়ে রাখা মুখটা কি সুন্দর শোভিত একখানা মুখ।মেয়েটার সৌন্দর্যে রাইসা নিজেই জেনো মুগ্ধ হয়ে গেলো।তবে তাদের স্যার কি এই সৌন্দর্যে…ভাবতে গিয়েই মনেহলো।সে কিসব উল্টাপাল্টা ভেবে চলেছে?তবে স্যারের দুটো বোনকে তো সে দেখেছে,চেনে ।এমন কি স্যারের ফুফুর মেয়ে দীবাকেও চেনে।তবে এই মেয়েটা কে?কৌতুহল আর নিজের মধ্যে দমন রাখতে পারলোনা রাইসা।প্রশ্ন করেই ফেললো।

‘তুমি স্যারের কি সম্পর্কিত হও?

দূর্বল শরীর আরও জেনো দূর্বল অনুভূত হলো এই প্রশ্নটার কারনে।আসলে তো,সে কি সম্পর্কিত হয় ওই মানুষটার?কি বলবে এখন সে?মান্যতা আপুকে সে আপু বলে ডাকে।নীহারিকা আন্টিকে বড়মা আর আঙ্কেলকে আঙ্কেল।ইভানকেও ভাইয়া বলে ডাকে।তবে ওই মানুষটাকে কখনো কিছু বলে ডাকা হয়নি।তবুও ওদের সম্পর্কিত ডাকটার খাতিরে, মানুষটাকে কি তার ভাই বলে ডাকা উচিত?ভাই!কেমন একটা বিশ্রী ভাবনা বলে মনেহলো কৌড়ির।তবে ভাই সম্পর্কিতোই তো হয়।তবে ভাবনা কেনো বিশ্রী বলে মনেহলো তার।মানুষটাকে ভয় পায় বলে তাকে ডাকতে চাইছেনা মন?নাকি….দরজায় নক পড়তেই আর ভাবা হলোনা কৌড়ির।তবে স্বস্তি পেলো সামনে দাঁড়ানো মেয়েটাকে উত্তর দিতে হলো না বলে।রাইসা-ও উত্তর না পাওয়ায় হতাশ হলো।নিভান ঢুকতেই রাইসা বের হয়ে গেলো।রাইসা বের হওয়ার আগমুহূর্তে নিভান ফের আদেশ জারী করলো।

‘অহিদ সাহেব কে আমার কেবিনে একবার আসতে বলুন।

সম্মতি জানিয়ে রাইসা বের হতেই আবার-ও অস্বস্তি ঘিরে ধরলো কৌড়িকে।কি এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়েছে সে!মাবূদ, কখন যে বের হবে এই পরিস্থিতি থেকে।জীবনে শিক্ষা হয়ে গেছে,সামন্য অসুস্থ অবস্থায়ও আর কোথাও কখনো বের হবেনা।হবেই না।

‘ওপাশে একটা রুম আছে, তুমি আপতত ওখানে গিয়ে রেস্ট নিতে পারো।

নিভানের আঙুলের ইশারা পেতেই সেদিকে যাওয়ার জন্য দ্রুত পা চালালো কৌড়ি।মানুষটার সামনে থেকে দূরে থাকতে পারলে স্বস্তি,শান্তি তার।কেবিনের দোরগোড়ায় পর্দার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতেই পিছন থেকে নিজের নামের ডাকটা শুনেই কলিজা কেঁপে উঠলো।হাত পায়ে মৃদু কম্পন ছড়িয়ে গিয়ে কাটা দিয়ে উঠলো সর্বশরীরে।এ কেমন ডাক?

কৌড়ি?

কৌড়ি থমকে যেতেই নিভান বললো।–কিছু খাবে?

তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে ভিতরে ঢুকলো সে।খাবার আগেই অর্ডার করে দিয়েছে নিভান।তবুও জিজ্ঞেস করলো সে।জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলো অন্য কিছু কিন্তু বলতে হলো আরেক কথা।নিজের চেয়ারে বসে পড়লো নিভান।গা এলিয়ে মাথাটা চেয়ারের হেডে রাখতেই চোখ বন্ধ করে নিলো।সেই ক্রন্দনজোড়া নজর হারিয়ে সেখানে দখল করেছে একজোড়া ডগরডগর সচ্চ চোখ,একটা মায়াবী মুখ।কি কারনে?

কেবিনের ফ্লোর কম্ফোর্ট আরামদায়ক বিছানাটায় শুতে প্রথমে কৌড়ির দ্বিধা হলেও,শরীরিক দূর্বলতায় বাধ্য হয়ে শুতে হলো তাকে।সংকোচ হয়েছিলো,তবে শরীরের দূর্বলতা,ক্লান্তি সেই সংকোচ বেশিসময় টিকিয়ে রাখতে পারিনি।আর নরম বিছানাতে,হাত পা গুটিয়ে গা এলাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে।কোথায় ঘুমাচ্ছে, জায়গা যাচাই-বাছাই না করে ঘুমানো উচিত হবে কি-না।এগুলো আর মাথায় কাজ করলোনা তার।অপরিচিত মানুষ অপরিচিত জায়গা,কার উপর ভরসা রেখে ঘুমালো।এটাও চিন্তা করলো না।শুধু ক্লান্ত শরীরটা বিছানাতে দিতেই ঘুমে বিভাোর হয়ে গেলো।

সেই হাত পা গুটিয়ে গায়ে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটাকে,নজর স্থির রেখে দেখে চলেছে নিভান।
দূর থেকে মুখটা আচ্ছন্ন।তবু-ও নিভানের সুক্ষ নজর,সেদিকে স্থির। ক্লান্ত মুখটা কি নিস্পাপ দেখাচ্ছে। এতো মুগ্ধ নজরে এরআগে কাওকে দেখেছে সে?মন বলে উঠলো।না!তবে এই মেয়েটাকে কেনো দেখে চলেছে?কতো ঘেন্না ছিলো বমি জিনিসটাতে তার।অথচ আজ একটু অস্বস্তি লাগলেও,ঘেন্না করেনি।কেনো?তার হৃদয় দখল করতে চাইছে?হৃদয়ের রানী হতে চাইছে মায়াহরিনীটা?

‘মে আই কা’মিন স্যার?

ভাবনা কাটলো।মূহুর্তেই সটান হয়ে বসলো সে।নিজের ব্যাক্তিত্বের নিদর্শন বজায় রেখে গম্ভীর গলায় বললো।

‘ইয়েস,কাম’ইন।

ভিতরে ঢুকতেই মূহুর্তেই চারিদিকে নজর ঘুরিয়ে নিয়ে এলো রাইসা।মেয়েটা কোথাও নেই।তারমানে স্যারের স্পেশাল কেবিনে।নারীমন বুঝে নিলো,মেয়েটা স্যারের বিশেষ কেউ।স্যারের পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট মৃদুল ভাই আপতত ক্লায়েন্টদের নিয়ে ব্যস্ত।বিধায় ফাইল পত্রের সই সাক্ষর নিয়ে তাকেই দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে।যদি-ও এই কাজ তার নয়,।মৃদুল ভাইয়ের।তিনি ব্যস্ত থাকায় তাকেই করতে হচ্ছে।ফাইলগুলো টেবিলের উপর রেখে বললো।

‘স্যার,ফাইলগুলোতে সাক্ষর দরকার।

রাইসার বিশেষ কৌতুহলী নজর খেয়াল করলেও,সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিলো-না নিভান।স্বভাবমতো দৃঢ় গলায় বললো–ঠিক আছে।আমি চেইক করে সাক্ষর করে দেবো।আপনি আসুন।

এরমধ্যে আবারও দরজায় নক পড়লো।নিভানের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট এসেছে।ছেলেটা সকাল থেকেই ব্যস্ত,নতুন ক্লায়েন্টের তদারকিতে।

‘স্যার সবকিছু কমপ্লিট।এবার উনারা আপনার সাথেই মিট করতে চাইছেন।

‘ওকে।উনাদেরকে আমার অফিস-রুমে নিয়ে আসুন।

মৃদুল চলে যেতেই রাইসাও অফিস কক্ষের বাহিরে যাবার জন্য পা বাড়ালো।কৌতুহল বশত পিছে ফিরতেই দেখতে পেলো,স্যার বড়বড় কদম ফেলে কেবিনের দিকে যাচ্ছেন।কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে বিশাল কাঁচের দরজাটা টেনে দিয়েছেন।সাথে ভারী পর্দাগুলোও।আশ্চর্য!এতো পজেসিভ মেয়েটাকে নিয়ে স্যার।এবার নিশ্চয় নয় নিশ্চিত মেয়েটা স্যারের বিশেষই কেউ।নিভান পিছু ফেরার আগেই দ্রুত পায়ে অফিসকক্ষের দরজা খুলে বাহিরে চলে এলো সে।

রাইসা চলে গেছে বুঝতে পেরেই নিজেকে কাচের দেয়ালের সামনে স্থির করলো নিভান। ঘোলাটে কাঁচের দেয়াল ভেদ করে ওপাশের শয়নরত আবাছা নারীমূর্তিটির দিকে অবিচল নজরে চেয়ে রইলো কিছু মূহুর্ত।ফের মৃদুস্বরে আওড়ালো।

‘নারী,তুমি শুধুই ছলনাময়ী নও।যাদুকারিনী-ও বটেই।


রান্নাঘরে সন্ধ্যার চা নাস্তা বানাচ্ছিলেন নীহারিকা বেগম একাই।আপাতত সেখানে কেউ নেই।শ্বাশুড়ি মায়ের পায়ের ব্যথাটা বেড়েছ, তাই আজ্ঞা পেতেই তেল গরম করে নিয়ে রানী গেছে মালিশ করতে।স্বান্তনা আপতত বাড়িতে নেই,মা অসুস্থ তাই ছেলেকে সাথে নিয়ে বাবার বাড়িতে গেছে।বিধায় একাই রান্নাঘরে ব্যস্ত কাজে মত্ত তিনি।সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই মা’কে রান্নাঘরে দেখে সেখানে ঢুকলো ইভান।নীহারিকা বেগম দেখলেন তবে কিছু বললেন না।ইভান আরও একটু এগিয়ে গিয়ে চুলোর পাশাপাশি কেবিনেটটার উপর ঝপাৎ করে উঠে বসলো।বিরক্ততে চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন নীহারিকা বেগম।কিঞ্চিত রাগ দেখিয়ে বললেন।

‘আমি রান্না করছি চোখে দেখিস না।শুধু নামেই বড়ো হয়েছিস।

একগাল হেসে মা’কে ভোলানোর চেষ্টা করলো ইভান।ফের বললো—আমার না তোমার সাথে খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা কথা আছে।

ছোটো ছেলের ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে কি উনার জানা আছে।সারাদিনে মা,চাচি,ভাই বোনের পিছে লেগে থাকা যার গুরুত্বপূর্ন কাজ,তারই আবার গুরুত্বপূর্ণ কথা।তবুও তিনি শুধালেন–কি?

সেই একগাল হাসি বজায় রেখে ইভান বললো।

‘আমার না ফুলকৌড়িকে বেশ ভালোই লাগে।বলতে পারো খুব পছন্দ।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে