ফুটপাতের মন্দবাসা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

1
3261

ফুটপাতের মন্দবাসা- ২য় ও শেষ পর্ব

রকি আবার দোকান চালু করে। তেলে ভাজতে থাকে নাস্তা। বেচাকেনা চলে হরদম। চুমকি ভাত রান্না করে অপেক্ষা করে রকির জন্য। কখন ফিরবে রকি। রকি ফিরলে যেন প্রাণ ফিরে পায় সে।

রাতে রকি ভাত খেতে খেতে বলে, ‘ ছেলে তো হইলো না। তুমি মন খারাপ করলা নাকি?’

‘কি যে কও না তুমি? আমার রুমঝুম আইতাছে। মন খারাপ করমু কেমনে? আমগো ভালোবাসার প্রথম ফুল ফুটতাছে। এর চাইতে খুশির আর কিছু হইতে পারে না।’

‘আইচ্ছা, খুশি হইছো তাইলে? নাও, হা করো। আমার পেট ভইরা গেছে। এগুলা তুমি খাও এহন। আমি খাওয়ায় দিতাছি।’ বলে রকি চুমকিকে জোর করে ভাত খাওয়াতে থাকে। নিজের ভাগের মাছের টুকরাটা খাইয়ে দেয় চুমকিকে।

রকি ভাবে, চুমকি কিছু বুঝে না। কিন্তু চুমকি সব বুঝে। চুমকি জানে রকির পেট ভরে নাই। রকি ইচ্ছে করেই রোজ অযুহাতে ওর খাবার খাইয়ে দিচ্ছে চুমকিকে।

‘আইজকা আবার আপেল আনছেন কেন হুনি? কালকের আপেলই তো পইরা আছে এহনো!’ শুতে যাবার আগে বলে চুমকি।

‘পইরা আছে মানে? তুমি খাও নাই আপেল?’

‘খাইছি তো। অতো কি খাইতে পারি? নাও তুমি খাও তো এবার।, বলে রকির হাতে আপেল তুলে দেয় চুমকি।’

‘আচ্ছা, এখন ঘুমাই। আমার সকালেই দোকান যাইতে হইব। তুমি ঘুমায় যাও।’ বলে শুয়ে পড়ে রকি।

চুমকিও শুয়ে পড়ে। চুমকি শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু, রকি আসলে ঘুমায় না। ও চুমকির হাত জড়িয়ে ধরে বুকে। বারবার মনে পড়তে থাকে ডাক্তারের সেই কথাটা, ‘একটু এদিক ওদিক হলেই হয়তো কেউ একজনকে হারিয়ে ফেলবেন। খুব যত্নে রাখতে হবে এখন, খুব যত্নে।’

ডাক্তারের কথা মনে হতেই রকি শক্ত করে চুমকির হাত ধরে। ওর ভয় হয়, প্রচণ্ড ভয় হয়।

_________

সেদিন রাতে, একসেট নীল চুড়ি কিনে আনে রকি। সে চুড়িতে কি যেন দেয়া, আলো গায়ে পড়লেই ঝিকিমিকি করে ওঠে। রকির ধারণা, এই ঝিকিমিকি চুড়ি দেখে চুমকি খুশি হবে, ওর চোখেও আলো ভরে উঠবে।

হাতমুখ ধুতে ধুতে রকি বলে, “ও রুমঝুমের মা। আমার জানু পাখিটা, ভালা আছো?”

চুমকি ভীষণ মন খারাপ ছিলো। তবুও, রকির প্রশ্ন শুনে হেসে দেয় সে। তারপর ন্যাকা সুরে বলে, ” ও মা! রুমঝুমের বাপের মনে দেখি ভালোবাসা জাগছে। তা কোনদিকে চাঁদ উঠছে হুনি?”

“কি কইবার চাইতেছো? তোমারে আমি ভালোবাসি না?” রকির মনে আঘাত পায় যেন, অভিমান ঝড়ে পড়ে কণ্ঠে।

“না, ভালোবাসো না। আমার তো এহন পেট উঁচা। বিশ্রী দেখায়। তাই আমারে আর ভালোবাসো না।” রকির চাইতেও বেশি অভিমান দেখায় চুমকি। রকির ততক্ষণে হাত মুখ মোছা হয়। চুমকির অভিমান সে বুঝতে পারে।

পুরুষ মানুষ নারীর মনের অভিমান বুঝবে না, তা কি হয়? রকি বুঝে চুমকির অভিমানের কারণ। বেশ কিছুদিন থেকেই রকি রাতে ফিরেই ঘুমিয়ে যাচ্ছে, সকালে উঠেই বেরিয়ে পড়ছে। চুমকির সাথে কথা বলা হচ্ছে না বেশি একটা। সেকারণেই চুমকির অভিমান।

রকির এভাবে ব্যস্ত হবার অবশ্য কারণ আছে। রকির এখন অনেক টাকার দরকার। রকি জানে, যখন তখন চুমকিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে অনেক টাকার দরকার হবে। একটু হেলাফেলা হলেই ডাক্তার এসে বলবেন, “দুঃখিত, একজনকে বাঁচাতে পারিনি আমি।”

এই দুঃসময় আসার আগেই প্রচুর টাকা জমাতে হবে। রকি একটুও হেলাফেলা করতে চায় না চুমকির। একটুও না।

“আমার জানু পাখিটা রাগ করে না। এদিকে আসো দেখি।” বলে চুমকির হাত ধরে বিছানায় বসায় রকি। তারপর চোখ বন্ধ করতে বলে চুমকিকে।

নিমিষেই চুমকির অভিমান কেটে যায়। রকি তার জন্য কিছু একটা এনেছে! চুমকি চোখ বন্ধ করে ঠিকই, কিন্তু সে চোখে সুখ উপচে পড়ে। চুমকি চোখ খুলে যদি দেখে ১ টা ৫ টাকা দামের চকলেট এনেছে রকি, তবুও সে প্রচণ্ড খুশি হবে।

চোখ খুলতেই দেখে নীল চুড়ি! নীল রং চুমকির প্রিয় রং। তাই বুঝি রকি নীল রঙের চুড়ি কিনেছে। চুমকি চুড়িগুলো নিয়ে বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে যায়। সাথে সাথেই হাতে পরে ফেলে চুড়িগুলো। হাত নাড়িয়ে চুড়ি বাজাতে শুরু করে।

চুমকির এই বাচ্চামি দেখতে রকির ভালো লাগে। রকির নিজেকে প্রচণ্ড সুখী মানুষ মনে হয়। চুড়ির শব্দরা এতো সুখ বিলাতে পারে আগে ভাবেনি সে।

খাওয়া শেষে শুতে যাবার আগে চুমকি হঠাৎ বায়না ধরে, “আমারে একটা গান শুনাইবা? তুমি গান গাইবা, আমি নাচমু।”

রকি ভীমড়ি খায়! “কি বলো এসব, তুমি নাচবা কেমনে?”

“আরে, সত্যি সত্যি নাচুম না তো। শুধু হাত নাড়ায়া চুড়ি বাজায়া নাচুম। একটা গান গাও না! ”

রকির গান গাওয়ার অভ্যাস নেই যদিও, তবু কিছু গানের কলি সে জানতো। চুমকি ভেবেছিল রকি গান গাইবে না এতো রাতে। এ ঘর, ও ঘরের সবাই শুনে হাসাহাসি করবে। কেউ কেউ রাগ ও করবে। কিন্তু, চুমকিকে অবাক করে দিয়ে গান শুরু করে রকি।

♪♪ওহে, কি করিলে বলো,
পাইবো তোমারে।
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।

ওহে, এতো প্রেম আমি
কোথা পাবো না,
এতো প্রেম আমি
কোথা পাবো না।♪♪

রকি থামে। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, “কেমন গাইলাম জানু পাখি?”

চুমকি হাসে না। চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কার দুঃখে এই দুঃখের গান গাইলা হুনি? তার মানে তুমি আমারে পাইয়া খুশি না? তুমি অন্য কাউরে চাইছিলা? কে সেটা? কারে তুমি চোখে রাখতে চাও হুনি?”

রকি ভাষা হারিয়ে ফেলে যেন। চোখেমুখে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। শুধু বলে, “কি মুসিবত। মাইয়া মানুষ এমন কেন যে! গান গাইয়া দেখি বিপদে পইড়া গেলাম।”

রকির অসহায় মুখ দেখে চুমকি খিলখিল করে হেসে ওঠে। সে হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে পাশের ঘরগুলোতেও। কিন্তু তাতে রকি চুমকির কিছুই যায় আসে না। কিছুই না।

_________

৭ বছর পরের কথা। রকি ভাজাপোড়ার দোকানটায় ব্যস্ত। এখনো সে দোকান রেলগেটের পাশেই। সিঙ্গারা, পেঁয়াজু, পুরি, বেগুনি, আলুরচপ মচমচে ভাজে রকি। কাজের আরেকটা ছোটছেলে রেখেছে সে। লাবু নামে ডাকে তাকে। সেই ছেলে যথেষ্ট পটু। কিছু বুঝিয়ে দিতে হয় না। নিজ থেকেই কাজ করে যায়।

ঐ তো, বেণি দুলিয়ে স্কুল থেকে ফিরছে রুমঝুম। সাদা ধবধবে স্কুল ড্রেস আর সাদা জুতো পায় নেচে-গেয়ে আসছে সে। ওর গায়ের রং একদম চুমকির মতো, শ্যামলা, সুন্দর। চোখগুলোও চুমকির মতো, টানাটানা। চুমকির মতো চোখ নাচিয়া কথা বলে সে। চুমকির মতো অল্পতেই রেগে যায়, অভিমান করে।

” আব্বু, স্কুল ছুটি দিয়েছে। আজ সব পড়াই ঠিকঠাক দিয়েছি আমি। মিস আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন” রকির কাছে এসে স্পষ্ট শুদ্ধ ভাষায় বলে রুমঝুম।

” গুড মেয়ে আমার। রোজ পড়া দিতে হবে মা। তাহলে রোজ মিস আদর করবেন।” বলে রুমঝুমকে নিয়ে দোকানের একটু পাশে চলে আসে রকি। গরমে ঘেমে গেছে মেয়েটা। স্কুল ড্রেসটা খুলে দেয় রকি। স্কুল ড্রেসের নিচে একটা গেঞ্জি পরা ছিলো, সেটা পরে থাকে রুমঝুম।

ওদিকে দোকানে কাস্টমারের ভীড় জমে। লাবু কাজ করতে করতে হাপসে যায়। তবু রকিকে ডাকে না। লাবু জানে, রকি এখনি আসবে না দোকানে। সে এখন রুমঝুমের বেণি খুলে দিয়ে চুল আছড়িয়ে দিবে। তারপর নিজহাতে ভাত তুলে খাওয়াবে। তারপর ফিরবে দোকানে।

পাশ দিয়ে চুড়িওয়ালা যাচ্ছিল। তা দেখে রুমঝুম বলে ওঠে, ” আব্বু, আমি চুড়ি নিব।”

“চুড়ি নিবে? দাঁড়াও।” বলেই চুড়িওয়ালাকে ডাকে রকি। চুড়িওয়ালা সঙ্গে সঙ্গেই কাছে এসে দাঁড়ায়। “একসেট লাল চুড়ি দাও দেখি।” চুড়িওয়ালাকে বলে রকি।

চুড়ি হাতে নিয়ে রুমঝুম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তারপর বলে ওঠে, “এই চৃড়ি আমি নিব না আব্বু।”

“এগুলো নিবে না মা?”

“না আব্বু, আমি ওগুলো নিবো।” বলে আরেকসেট চুড়ি দেখিয়ে দেয় রুমঝুম। নীল রঙের চুড়ি।

এরকম নীল রঙের একসেট চুড়িই নিয়েছিল সে চুমকির জন্য। সেই চৃড়ি পেয়ে চুমকি ছোট বাচ্চার মতো খুশি হয়েছিল। হাত নাড়িয়ে শুনিয়েছিল চুড়ির নৃত্যের শব্দ।

রুমঝুম চুড়ি হাতে শব্দ করতে থাকে, ঠিক যেভাবে হাত নাড়িয়ে শব্দ করতো চুমকি, ঠিক সেভাবে। রুমঝুমের হাসিটা, ঠিক চুমকির হাসির মতোন যেন। রুমঝুমের মুখটা যেন চুমকিরই।

আজ ৭ বছর হয়ে গেছে চুমকি পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছে। ওর চিকন শরীর সইতে পারেনি রুমঝুমের আগমন। রুমঝুমের মুখটাও দেখে যেতে পারেনি সে।

অপারেশন রুমে ঢোকার আগমুহূর্তে রকির হাত ধরে চুমকি বলেছিল, ” আমি হয়তো আর ফিরুম না। আমি হয়তো রুমঝুমরে দেখতু পারুম না দুচোক্ষে। আমার হয়া তুমি রুমঝুমরে দেইখা রাইখো।”

চুমকির চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। রকি সেই চোখের পানি মুছে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, “দূর বোকা, তোমার কিছৃই হইব না। কিছুক্ষণ পরেই তুমি আমি রুমঝুমরে কোলে নিয়া বইসা গল্প করুম। তুমি রুমঝুম দুইজনেই ঠিক থাকবা।” বলে চুমকির কপালে চুমু এঁকে দিয়েছিল রকি।

“আমার খুব শখ আছিল রুমঝুমরে মানুষের মতোন মানুষ করুম। শুদ্ধ ভাষায় কথা শিখামু। তুমি ওরে কিন্তু ভালা স্কুলে দিবা। শুদ্ধ কইরা কথা কওয়া শিখাবা।” চুমকি বলতে থাকে নিজের মতো। চোখ দিয়ে টপাটপ পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে।

রকি চুমকির হাত শক্ত করে ধরে। “তোমার কিচ্ছু হইব না কইলাম। তুমি ভয় পাইয়ো না। তুমি এহনি ফিরা আইবা। তোমার কিচ্ছু হইব না।” বলতে বলতে চোখ ভিজে আমে রকির।

চুমকি মুচকি হেসেছিল শুধু। ভেজা চোখে চুমকির হাসি অদ্ভুত লাগছিল। রকি তখনো বুঝতে পারেনি, ঐ মুচকি হাসিটাই চুমকির শেষ হাসি হবে।

রুমঝুম হঠাৎ কথা বলে ওঠে, “তোমার চোখে পানি কেনো আব্বু? তুমি কি কাঁদছো?”

চোখের পানি মুছে নেয় রকি। মুখে হাসি এনে বলে, ” না মা, কাঁদছি না। আমি একটুও কাঁদছি না।”

” না আব্বু, আমি বুঝে গিয়েছি তুমি কাঁদছো। বড় মানুষদের কাঁদতে নেই, বুঝেছ?”

“আচ্ছা মা, আর কাঁদব না, একদম কাঁদব না আর।” বলে রুমঝুমকে বুকে জড়িয়ে ধরে রকি।

রুমঝুম হেসে ওঠে। স্নিগ্ধ হাসিতে হেসে ওঠে।

রুমঝুম জানে না, ওকে জড়িয়ে ধরে চোখের অশ্রুধারা লুকাচ্ছে তার বাবা। চোখ যে বাঁধ মানে না।

আচ্ছা, চুমকি কি ওদের হাসিকান্না দেখে? সে কি ঐ আকাশ থেকে ওদের হাসিকান্না দেখে উদ্বেলিত হয়?

কে জানে? হয়তো দেখে। হয়তো দেখে না।

(সমাপ্ত)

ফুটপাতের মন্দবাসা-2

Mahmud Hasan

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে