ফিরে পাওয়া পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
42

#ফিরে_পাওয়া
– মারিয়া আফরিন নুপুর
(শেষ পর্ব)

সেই প্রথম ছিল তার ঠোঁটের আলতো পরশ পাওয়া।
সারা শরীরের রক্ত ছলকে উঠছিল মাতালের মত, তাকে পাওয়ার আবেশে। এর কিছু দিন পরেই শিহাব চলে যায় ঢাকায়। মাঝে মাঝে যোগাযোগ হতো। বেশ কিছুদিন পরে বাসা থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। উপায় অন্ত না পেয়ে তাকে জানিয়ে ছিলাম, আমার বিয়ে ঠিক করেছে বাবা। আসলে বাবার মুখের উপর কথা বলার সাহস কখনও হয় নি আমার। তাই শিহাব কে বলেছিলাম, আমাকে যেন তার কাছে নিয়ে যায়। উত্তর এসেছিল তার পড়াশোনা এখনও কমপ্লিট হয় নাই। নিজেই চলতে পারে না, আমাকে নিয়ে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে। তাই আমি যেন বাবাকে বলে আর কিছু দিন সময় নেই। কিন্তু বাবা আর সময় দেয় নাই আমাকে। বিয়ে দিয়ে দেয় খ্যাতনামা এক ইঞ্জিনিয়ার এর সাথে।
শুরু হয় জীবনের ভয়ংকর অধ্যায়। বাসর রাতেই বুঝেছিলাম আমার মনের না; শরীর নামক জিনিসের বড়ই কদর এই লোকের কাছে।
নিজের যে একটা আত্মসম্মান ছিল সেটা ভুলেই গেছিলাম।
বুকের উপরে, গলার নিচের, বুকের উপরিভাগের দগদগে লাল দাগ গুলোই সাক্ষী দিত অত্যাচারের।
এর মধ্যেই আমার কোল জুড়ে এলো ঝিনুক।
তখন রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটার অযুহাতে রুম আলাদা করে নিল সে। নিজের যখন প্রয়োজন হতো, তখন হিড়হিড় করে রুমে টেনে নিয়ে যেত। প্রয়োজন শেষ তো, ছুঁড়ে ফেলে দিত। রাস্তার পতিতাদের মত লাগত নিজেকে। হঠাৎই একদিন স্ট্রোক করে বসে ঝিনুকের বাবা। তিনদিন যমে মানুষে টানাটানি করার পরে আর বাঁচানো গেল না তাকে…

মুয়াজ্জিন এর আজানের শব্দ কানে আসতেই চোখ খুলে ফেললাম। কখন যে সকাল হয়েছে টেরই পাই নাই।
উঠেই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ঝিনুককে উঠিয়ে নাস্তা করালাম। বুয়াকে ঘর সামলাতে দিয়ে মা মেয়ে চললাম স্কুলে। বাসা থেকে বের হতেই দেখি শিহাব সামনে দাঁড়িয়ে। ক্রিম কালার আর ব্লু কালারের ব্লেন্ড পাঞ্জাবিতে কেমন যে তাকে দেখাচ্ছিল বুঝাতে পারব না।
শুধু এতটুকুই বলতে পারব যে, চোখ ফেরানো দায়।
তাকে দেখে এগিয়ে গেলাম। ঝিনুকের হাত ধরে দাঁড়ালাম শিহাবের সামনে। মেয়েটাকে দেখেই বলল ‘এটা তোমার মেয়ে দেখলেই বোঝা যায়। অবিকল তোমার মত হয়েছে।’
তখনই ঝিনুকের প্রশ্ন,
___ ‘মা মনি উনি কে?’
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই ঝিনুককে শিহাব টেনে নিয়ে বলল,
___’আমি তোমার আম্মুর ফ্রেন্ড আর তোমার আংকেল।’
মেয়েটা আমার সবার সাথে মেশে না, কিন্তু কেন জানি না শিহাবকে জড়িয়ে ধরে বলল, ___’আংকেল আমি শুক্রবার বাসায় থাকি, তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে।’
শিহাব ও সানন্দে রাজি হয়ে গেল।

পরের শুক্রবার সকাল থেকেই রান্না ঘরে ঢুকলাম।
বুয়া আর আমি মিলে রান্না শুরু করলাম। শিহাব পুডিং খুব পছন্দ করে তাই পুডিং, নুডুলস, পাকোড়া আর দুই এক পদের নাস্তা বানালাম। সে কখনোই বেশি ভারি খাবার খেত না। তাই পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানা খাবার রান্না করলাম। ছোট মাছের চচ্চড়ি, বেগুন ভাজি, মুসুড়ের ডাল, সাদা ভাত, গরুর মাংস, চিংড়ি মাছ ভুনা আর লাউ চিংড়ি।
রান্না শেষ করতে করতে প্রায় ১২ টা বেজে গেল।
শিহাব এলো নামাজের পরে। হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল আর দুটো গিফট বক্স। রাগ দেখিয়ে বললাম এত তাড়াতাড়ি আসার কি দরকার ছিল? আর একটু দেরি করে আসলেই তো রাতের খাবার খেতে পারতে। মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘অনেক খুঁজে পেয়েছি আর হারানোর ইচ্ছা নেই।’
ঝিনুককে ডেকে নিয়ে আসলাম। তিনজনে মিলে খেতে বসলাম। এত খাবার দেখে তো শিহাবের মাথায় হাত!
বলল, ‘করেছ কি এত এত খাবার!!!’
পরম তৃপ্তিতে তাকে খেতে দেখে শুধু চোখ না মনটাও জুড়িয়ে গেল আমার।
‘কি ব্যাপার শিমু, তুমি খাচ্ছ না কেন?’
শিহাবের প্রশ্নে যেন ধ্যান ভাঙল আমার।
বললাম পেট ভরে গেছে। খাওয়ার পরই ঝিনুকের ঘুমের অভ্যাস। ওর আংকেলকে বলে ও ঘুমাতে চলে গেল।
আমি শিহাবকে আমার রুমে নিয়ে আসলাম। ঘুরে দেখে বলল,
___ ‘শিমু তোমার রুমটা তো তোমার মতই গুছানো।’
বিছানা দেখিয়ে বললাম একটু রেষ্ট করে নেও।
___’এখন আর বসব না। পরশু পহেলা বৈশাখ তোমাকে আর ঝিনুককে নিয়ে ঘুরতে যাব মেলায়, রেডি থেকো।’
এই বলেই বের হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও ছিল না আমার কাছে যে, আমি রাজি কি না!
র‍্যাপিং পেপার মোড়ানো বক্স গুলো খুলতেই, সোনালি আর কালোর মিশেলে সুন্দর একটা জামদানি শাড়ি পেলাম। ছোট্ট একটা চিরকুটেও ছিল সাথে লেখা
“প্রিয়জনকে, তার হারিয়ে যাওয়া কাছের মানুষ”।
চিরকুটটা পড়ে এক অন্য ভালো লাগায় মনটা ভরে গেল।
আবার কেন জানি না ভয়ও লাগছিল।
মনটা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল, আমি কি ঠিক করছি???

বৈশাখী মেলার দিন দুপুরের পরেই শিহাব আমাদের বাসায় চলে এলো। তাকে একটু বসতে বলে মা মেয়ে রেডি হতে চলে গেলাম। শিহাবের সেই শাড়িটা পরে হালকা একটু সাজলাম। চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিলাম আর কপালে ছোট একটা কালো টিপ দিলাম।
ঠোঁটে হালকা করে লিপবাম লাগিয়ে যখন ড্রয়িংরুমে আসলাম, দেখি শিহাব আর ঝিনুক দুই জনেই হা করে চেয়ে আছে আমার দিকে।
ঝিনুক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, ___’মামনি তোমাকে কত্ত সুন্দর লাগছে তুমি নিজেও জানো না’।
শিহাবের দিকে তাকিয়ে দেখি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে।
বললাম,
___”যাবে না নাকি?? ”
ঘোর লাগা চাউনি নিয়ে বলল,
___ ‘নতুন করে সব শুরু করতে চাই আবার’।
যখন আবার প্রশ্ন করলাম, কিছু না বলে এড়িয়ে ঝিনুককে কোলে নিয়ে আগে আগে চলল।
সামনে যেয়ে আবার পিছনে এগিয়ে এসে সাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা রক্তলাল গোলাপের কুঁড়ি হাতে দিয়ে বলল, ___”খোঁপায় দিও। ফুল ছাড়া খোঁপা খালি দেখাচ্ছে।”
সারা বিকেল মেলায় ঘুরলাম, সন্ধ্যায় ফুসকা-ঝাল মুড়ি খেয়ে বাসায় আসলাম। ঝিনুককে একগাদা খেলনা কিনে দিয়েছে শিহাব। মানা করার পরেও শোনে নাই।
শিহাবকে দেখে ভুলেই গিয়েছিলাম যে, এটা একটা মফস্বল শহর। দুইদিন পরে আম্মু আর ছোট বোন আসলো। দুজনেই আমতা আমতা করতে লাগল। জিজ্ঞেস করলাম,
___” কি হয়েছে? ”
তারপর আস্তে আস্তে শিহাবের কথা জানতে চাইল। আম্মুর কথা ছিল, আমি যেন আমার সংসার শুরু করি। কিন্তু ঝিনুকের কথা ভেবে আম্মুকে মানা করে দিয়েছিলাম।

বেশ কিছুদিন শিহাবের কোন খবর নেই। আমিও আর কোন খোঁজ নেই নি। মিছে মায়া বাড়িয়ে কি লাভ?
স্কুল বন্ধ ছিল, ঝিনুক ওর নানুর বাসায় গিয়েছে।
বুয়াকে পাঠিয়েছি আনতে। বুয়া যেই দরজা চাপিয়ে বের হয়েছে সেই শুরু হল অঝোর বর্ষন। মন জানি কেমন করে উঠলো। সোজা চলে গেলাম ছাদে। বৃষ্টি বরাবরই ভীষন প্রিয় আমার। বাচ্চাদের মতো বৃষ্টি পেলে পাগল হয়ে যাই। বৃষ্টিতে ভিজেছি কতক্ষন খেয়াল নেই। হঠাৎই দেখি ছাদের দরজায় শিহাব। তাকে দেখেই মনটা কেন জানি না অজানা ভালো লাগায় ভরে গেল। হাত দিয়ে ইশারা করে শিহাব ডাকল আমাকে। কাছে যেতেই বলল,
___’বৃষ্টিতে ভিজতেছ জ্বর আসবে তো, এক্ষুনি নিচে নেমে গোসল করে নেও।’
চলে আসলাম নিচে।
গোসল করে বের হলাম, হালকা গোলাপি পাড় কালো শাড়ি আর গোলাপি ব্লাউজ পরে। এসে দেখি তখনও ভিজে শরীর নিয়ে বসে আছে। টাওয়াল এগিয়ে দিয়ে বললাম,
___” মাথা মুছে ফেলছ না কেন?”
শিহাব অভিমানের সুরে বলল
___’মুছিয়ে দিলেই হয়'”
হাতে তোয়ালে নিয়ে মাথা মুছে দিতে দিতে বললাম,
___” একটা বিয়ে করে নেও। ”
হালকা হাতে কোমর ধরে কাছে টেনে নিল সে,
___” ‘অনেক আগেই অন্য কারো হয়ে গেছি, চাইলেও এখন আর অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না।”
এই বলেই বুকে মুখ গুজল আমার। তার উষ্ণ নিশ্বাসে বুকটা পুড়ে যাচ্ছিল।
মন সায় দিচ্ছিল বারবার কিন্তু আমিত্ত্ব সত্ত্বাটা বিদ্রোহ করে উঠল।
হাতের ধাক্কায় সরিয়ে দিলাম তাকে। মানুষটা উঠেই মাথা নিচু করে চলে গেল সেই ঝুম বৃষ্টিতে। বারবার ইচ্ছা হচ্ছিল হাতটা ধরে ফিরিয়ে আনি, কিন্তু হাতটা যে বাঁধা ছিল।

প্রায় তিন চারদিন যাবত খোঁজ নেই শিহাবের।
না ঘুমাতে ঘুমাতে চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। ঝিনুক একদিন সকালে গুঁটি গুঁটি পায়ে আমার রুমে এলো। কোলে মাথা দিলে বলল,
___ ‘মামনি কিছু কথা বলি?’
মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
___” হ্যাঁ মামনি বলো। ”
___’মামনি আমি কিন্তু জানি তুমি আংকেলকে পছন্দ করো, আংকেলও তোমাকে পছন্দ করে। নানুমনি বলেছে আমাকে। তাহলে কেন তুমি আংকেলকে আমাদের বাসায় আসতে মানা করেছ??'”
মেয়ের এই কথা শুনে আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম।
মেয়েটা আবার বলতে লাগল,
___ ‘মামনি তুমি আংকেলকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসো, এক্ষুনি যাবে না হলে আমি আর কথা বলব না তোমার সাথে। সবই ঠিক আছে কিন্তু আংকেলকে আমি বাবাই বলে ডাকব কি করে?’
এই বলে হেসে কুটি কুটি হতে লাগল ঝিনুক।
জড়িয়ে ধরে বললাম,
___”তবে রে পাজি মেয়ে।”

শিহাবের দেওয়া শাড়ি পরে, মাথার খোঁপায় ফুল গুজে আস্তে আস্তে গেলাম শিহাবের বাসায়। কলিংবেল টিপ দিতেই দরজা খুলল মাঝবয়সী এক লোক। শিহাবের কথা জিজ্ঞেস করতেই অন্য একটা রুমে নিয়ে গেল সে।
কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে শিহাব। লোকটা বলল গতকয়েক দিন যাবত জ্বর। কিছুই খায় না চুপ করে পড়ে থাকে। আস্তে করে ডাক দিতেই উঠে বসল শিহাব। শুকিয়ে গেছে অনেক খানি। আমাকে দেখেই চুপ করে মাথা নিচু করে বসল। মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে বললাম,
___” খাও না কেন? ”
অজানা এক অভিমানে আমার দিকে চেয়ে বলল,
___ ‘আমি ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করেছি, এই শহর ছেড়ে তোমাকে ছেড়ে আবার অনেক দূরে চলে যাবো।’
আমি বললাম,
___”ঝিনুক তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে। ”
চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ‘তোমার ফ্যামিলি, ঝিনুক এরা কি বলবে?’
শুধু বললাম,
___” ঝিনুক তোমাকে আংকেল থেকে বাবাই কি করে বলবে তা নিয়ে ভীষন টেনশনে আছে।”
এই বলেই তার বুকে মুখ লুকোলাম।
আর শিহাব দুই হাতের বাধঁনে জড়িয়ে বলল ‘,”হারিয়ে আবার ফিরে পেয়েছি তোমাকে, আর কখনোই হারাতে দেবো না।”

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে