#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০
ফিরে আসবেনা
Tabassum Riana
ডায়েরির প্রথম পাতা উল্টাতেই তুলির চোখে পড়ে শুকিয়ে কালো হয়ে যাওয়া গোলাপ ফুলটি।আর সাথে একটি হলুদ খাম।তুলি হাসি মুখে খামটি হাতে নিয়ে সেটায় চুমু খায়।তারপর খামটি থেকে একটা চিঠি বের করে আনে।চিঠির ওপর লেখা”আমার প্রেমবিলাসিনী”
চিঠির ভাজ খুলে সেটাকে পড়তে শুরু করে।
প্রিয় প্রেমবিলাসিনী,
আমার ভালবাসা নিও।অনেকদিন তোমায় দেখিনা।জানো খুব দেখতে ইচ্ছে হয় তোমায়।তোমার চুলের মিষ্টি ঘ্রান নিজের নিশ্বাসের সাথে মিশিয়ে নিতে ইচ্ছে হয়।সেদিন বাড়ি থেকে ফিরার সময় খুব খারাপ ব্যাবহার করেছিলাম।জানি খুব কষ্ট পেয়েছিলে,তোমার অশ্রুমাখা চোখজোড়ায় তাকানোর সাহস ছিলো না আমার তাই পিছে ফিরে তাকাইনি জানতাম নিজেকে আটকাতে পারবোনা।সেদিন মেলা তোমায় নীল শাড়ীতে চমৎকার লাগছিলো কিন্তু আমি বলেছিলাম জঘন্য লাগছিলো তাই তোমার মুখে আলকাতরা মাখিয়ে বলেছিলাম এই যে এখন পার্ফেক্ট কাক লাগছে।কারন তোমার সৌন্দর্য অন্য কেউ দেখবে সেটা মেনে নিতে পারবোনা বলেই এমন করেছিলাম।
তুলি তোমায় খুব ভালোবাসি তোমায় ছাড়া থাকতে পারবোনা।তোমার হাত ধরে সারাটাজীবন তোমার পাশাপাশি হাঁটতে চাই।তাই শহরে চলে এলাম।বড় জনবহুল এই শহর।এই ব্যাস্ত শহরে সবাই যে যার কাজেই ব্যাস্ত।এখানে না অনেক ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় আছে তুলি।একদিন তোমার যোগ্য হয়ে ফিরে এসে তোমার সাথে স্বপ্নের সংসার সাজাবো।
অপেক্ষা করো আমার,,,,
ইতি অমিত
কিন্তু ব্যাস্ত শহরে অমিত হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য।কখনোই ফিরে আসবেনা তুলির সাথে স্বপ্নের সংসার সাজাতে।
অমিত ঢাকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।খুব ভালো সাবজেক্ট ও পেয়ে যায়।
মন দিয়ে পড়াশুনার যুদ্ধে নেমে পড়ে অমিত।
সেবার ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি ছুঁটে যায়।দাদি এসে জাপটে ধরে অমিতকে।কাঁদছিলেন ওনি,কি নাতি আর কতোদিন এই বুড়িদাদিরে ছাইড়া থাকবা?আমারে কি দেখতো মন চায়না তোমার?কোনদিন মইরা যাই।কবর দিবার ও তো পারবিনা।
জবাবে অমিত বলেছিলো কি কও দাদী এসব?তোমারে ওপরওয়ালার থেইক্কা ছিনাইয়া আনুম।নাতির কথায় বৃদ্ধা দাদী কেঁদে দিয়েছিলেন।
পাশের বাড়ির সকিনার কথায় তুলি জানতে পারে অমিত বাড়িতে এসেছে।ওর তো খুশির সীমানা নেই।কলেজ ব্যাগ ফেলে দৌড়ে ছুঁটে যায় অমিতদের বাড়ির পানে।
কিছু বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে ছিলো অমিত।হুন্ডার ওপর শুয়ে সিগারেট ফুঁকার মাঝেই প্রেয়সীকে দেখতে পায় অমিত।
তুলি কাছে আসতেই অমিত উঠে বসে।তুলি অমিতের কাছে আসতে পারেনা ওর বন্ধুদের জন্য।
-ঐ কি করিস তুলি?বাড়ি না গিয়ে বনে বাঁদরে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।যা বাড়ি যা।এতো বড় ডাগর মেয়ে হয়েও রাস্তায় দৌড়া দৌড়ি করা।
তুলি অমিতের দিকে তাকিয়ে আছে পলক হীন চোখে।সেই চোখে ভালবাসা মাখা অশ্রু।খুব ইচ্ছে হচ্ছে অমিতকে জড়িয়ে বলতে আর যাসনে অমিত।বড় ভালোবাসি যে তোকে।
কিন্তু সেদিন ফিরে আসে তুলি।মাস খানেক বাড়িতে থাকার পর শহরে চলে আসে অমিত।শহরে যাওয়ার আগের দিন পুকুরের পাড়ের নারিকেল গাছের নিচে তুলিকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো অমিত।বলছিলো ভালবাসি প্রেমবিলাসিনী। তুলি কাঁদছিলো।অমিত তুলির কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলো খুব জলদি তোর যোগ্য হয়ে ফিরে আসবো।আর তোকে নিয়ে সংসার সাজাবো ভালবাসার সংসার।
অমিত চলে যায়।যাওয়ার সময় তুলি নিজের হাতের বানানো আমের আচার নিয়ে যায়।কিন্তু বড্ড
দেরি হয়ে গিয়েছিলো।তুলির পৌছানো আগেই অমিত চলে যায়।
অশ্রুসজল চোখে বাড়ি ফিরে আসে তুলি।সেদিন জমানো টাকা দিয়ে নোকিয়ার বাটন ফোন কিনে তুলি তারপর সুমন ভাইয়ার কাছ থেকে অমিতের নম্বর যোগাড় করে তুলি।
পরদিন দুরুদুরু বুকে অমিতকে কল দিয়ে দেয় তুলি।প্রথমে না চিনলে ও পরে তুলির নিশ্বাসের শব্দ ঠিকই চিনে নেয় অমিত।শুরু হয় প্রেমালাপ।
অমিতদের হোস্টেলের এডমিনিস্ট্রেশনে আছেন কামাল খান।জঘন্য প্রকৃতির মানুষ ওনি।ছাত্রীদের উত্যক্ত করতেন ওনি।গায়ের উড়না খুলে নিতেন কখনো জড়িয়ে ধরে নিষিদ্ধ জায়গায় হাত লাগাতেন।আর জঘন্য নোংরা ভাষায় গালি দিতে তার জুড়ি মেলা ভার।সেদিন অমিত বলেছিলো
..স্যার আপনি এসব বন্ধ করতে পারেননা।
..কামাল খান বলেন কি?
..ছাত্রীরা আপনার মেয়ের সমান হয়।তাদের সাথে এমন আচরন কাম্য নয়।
..বিশ্রী করে হেসে উঠেন কামাল খান।তারপর বলেন নারীরা তো ভোগের জন্যই।
..আপনার স্ত্রী আপনার কন্যা আপনার বোন তাদের ও ভোগের বস্তুই মনে করেন স্যার?
কামাল সেদিন ওকে যা তা বলে অপমান করে।সেদিনের পর থেকে অমিত আর ওর পাঁচ বন্ধু
আওয়াজ তুলে কামাল খানের বিরুদ্ধে।
ছাত্রদের ডাকা হলো।এর সত্যতা জানার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ হলো।তবে কেউই মুখ খোলেনি।অমিত এগিয়ে এসেছিলো বলেছিলো এটা সত্যি আমি একাই করেছি।কেউ ছিলোনা আমার সাথে।সবই ছিলো বন্ধুদের বাঁচানোর উপায়।এই একটা সত্য প্রান কেড়ে নিলো অমিতের।
কুকুরের মতো পেটায় ওকে কয়েকজন টিচার আর কামাল খানের লেলিয়ে দেয়া কিছু কুকুর।কেঁটে নেয়া হয় ওর পুরুষাঙ্গ,চোখ উপড়ে ফেলা হয়।তারপর কোমড়ে দড়ি বেঁধে হুন্ডা দিয়ে পুরো শহরে ঘুরানো হয়।রাস্তায় ঘষা খেতে থাকা অমিতের সুন্দর শরীর রক্তবর্ন হয়ে যায়।ওকে ফেলে দেয়া হয় নর্দমার পানিতে।
অমিতের খবর তড়িৎগতিতে সারা দেশে পৌছে যায়।বাদ যায়নি ওর বাড়ি।বৃদ্ধা দাদি কিছুই বলতে পারেননি।ওনার কুঁচকে যাওয়া গাল বেয়ে পড়া অশ্রু গুলো বলে দিয়েছিলোই অনেক কিছুই।তুলি গলায় ফাঁস দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনি বাবার জন্য।অমিতের মৃত্যুর আজ ছয় বছর।তুলি ডায়েরীটাকে বন্ধ করে দেয়।আজ ও সে অবিবাহিতা।পালিয়ে এসেছিলো গ্রাম থেকে।শহরেরই আবাসিক এলাকায় থাকে তুলি।চিঠিটা আজ ও ওর হৃদয় কে নাড়া দেয়।ঠিক থাকতে পারেনা তুলি।তবে অমিতের নামে আজ ও গর্বভরে বলতে পারে ভালোবেসেছি আমি এক বীরকে।তুলি জানে তার অমিত কখনোই ফিরে আসবেনা।তাদের স্বপ্নের সংসার স্বপ্নই থেকে যাবে।স্বপ্নটাকে যে গুড়িয়ে দিয়েছে নরপশুরা।
সমাপ্তি
