#ফিরবে চেনা ঠিকানায়
#লেখনীতে-অনামিকা_ইসলাম_জেরিন
#পর্ব_১০
কাঠফাটা রোদে মানুষের জীবন যায় যায় অবস্থা।গাছের পাতা গুলো যেন পণ নিয়েছে বাতাস না দেওয়ার।বৃষ্টি সম্ভাবনা নেই।এই রোদের মাঝে মেঘলা ছাদের এক কোণে বসে আচার খাচ্ছে।কপালে চিন্তার রেখা ফুঁটে উঠেছে।গভীর চিন্তায় মগ্ন সে।চোখ দুটো ছাদের অপর পাশে নয়ন তারা ফুল গাছের ওপর স্থির।মাথার ভিতর সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।তার মন পড়ার ক্ষমতা থাকলে এত চিন্তা হতো না।নিদ্রাহীন রাত কাটতো না।বিকট শব্দে মেঘলা ধড়ফড়িয়ে উঠলো।কেউ অনেক জোড়ে গাড়ির ব্রেক কষেছে।কিন্তু কে?মেঘলা দৌড়ে বাড়ির সামনের দিকে রেলিং ঘেষে নিচে তাকাল।আকাশ গাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে আগাচ্ছে।মুখ পুরোপুরি দেখা না গেলেও হাঁটার ভাব দেখে বুঝা যাচ্ছে প্রচন্ড রেগে আছে।ফুপিরা যাওয়ার পর মাঝে পুরো একদিন কে’টে গেছে।মেঘলা ভেবেছিল আকাশ সব জানার সাথে সাথে ঝামেলা করবে।কিন্তু তেমন কিছু না করে মেঘলাকে একটা ফোন অবধি করে নি।মেঘলা অবাক হয়েছে সাথে নিরবতাও পালন করেছে।আকাশের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আজ সে মেঘলার হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে।মেঘলা কিছু সময় থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে নিচের দিকে দৌড় দিলো।
আকাশ মেঘলার রুমে যেয়ে ওকে না পেয়ে সায়িদের রুমের দিকে পা বাড়ালো।বাসার ভিতর ঢুকে সে কারোর সাথে কোনো কথা বলে নি।ঝিনুক আর তার শাশুড়ি ভয় পেয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।আকাশের লাল বর্ণ চোখ দেখে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।বড় বড় পা ফেলে সোজা ওপরে চলে গেছে সে।কি হবে এখন সে চিন্তায় শ্বাস নেওয়া বন্ধ হয়ে আসছে।
মেঘলা আকাশকে সায়িদের রুমের দিকে যেতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো।ওদিকে কেন যাচ্ছে?তার কাজ তো মেঘলাকে দিয়ে।নাকি তাকে পাই নি বলে ওদিকে যাচ্ছে?মেঘলা নিচে তাকাল।মা আর ভাবি পাশাপাশি ভয়ার্ত চেহারা দেখে নিজেও কিছুটা ভয় পেলো।সায়িদের রুম থেকে আকাশের হুংকার শুনে মেঘলা কেঁপে উঠলো।দ্রুত সায়িদের রুমে যেয়ে চোখ কপালে।আকাশ হেনরির কলার ধরে রাগে কাঁপছে।চোখ দিয়ে হেনরিকে গিলে খাবে।
—“মেঘুকে বিয়ে করার খুব শখ হয়েছে তাই না?আজ তোর এমন অবস্থা করব আমি যে আর জীবনে কাউকে বিয়েই করতে পারবি না তুই।অনেক সহ্য করছি তোকে আর না।”
আকাশের কঠিন বাক্যগুলো সবাইকে কাঁপিয়ে দিলো।মেঘলা ভাবে নি আকাশ হেনরির সাথে ঝামেলা করবে।সায়িদ পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের কাছে অনুরোধ করছে ছেড়ে দেওয়ার জন্য।আকাশ তার কথা শুনছে না বরং চোখ দিয়ে শাসিয়ে দিলো।জোনিতা ভয়ে করুণ দশা।সে বিছানায় বসে ভীতু চোখে আকাশ আর হেনরিকে দেখছে।এদিকে হেনরি পারে তো দৌড়ে পালায় এখান থেকে।সে বরাবরই শান্ত শিষ্ট ছেলে।মা’রা’মা’রি থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে সব সময়।আকাশকে দেখে বুঝা যাচ্ছে সে তাকে এমনি-এমনি ছেড়ে দেবে না।
হেনরির নিরবতা আকাশের রাগ বাড়ালো।মা’রার জন্য ডান হাত শূণ্যে উঠানোর সাথে সাথে পিছন থেকে মেঘলা দুই হাতে তার ধরে টান দেয়।আকাশ পিছন ঘুরে মেঘলাকে দেখে আর নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগে মেঘলা মুখ খুললো,
—“সমস্যা আমার সাথে তাহলে কথাও আমার সাথে বলবেন।মাঝে হেনরি কেন টানছেন?ওকে ছাড়েন বলছি নয়তো…
মেঘলার কথা থামিয়ে আকাশ বলল,
—“নয়তো কি?কি করবি তুই?”
—“খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
আকাশ হেনরির কলার ছেড়ে মেঘলার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।হাত দুটো পকেটে গুজে শান্ত স্বরে বলল,
—“সাহস বেশি দেখানো হয়ে যাচ্ছে না?”
আকাশের শান্ত স্বর মেঘলাকে নাড়িয়ে দিলো।মাত্র যে চিল্লালো-রাগলো-মারধর অবধি চলে যাচ্ছিল সে এখন ঠান্ডা!কি করে?নিশ্চিত বড়সড় কোনো প্লান আটছে মনে মনে।মেঘলা নিজেকে শান্ত করে বলল,
—“একদম না।আমি সঠিক কথা বলেছি।আপনি হেনরিকে কিছু বলতে পারেন না।আপনার কথা থাকলে আমার সাথে থাকবে হেনরির সাথে নয়।আপনার সমস্যা আমাকে নিয়ে তাহলে সমাধানও আমাতে সীমাবদ্ধ থাকবে।”
—“বেশ।”
আকাশ খপ করে মেঘলার হাত ধরে টান দিয়ে রুম থেকে বের করে নিয়ে গেলো।মেঘলার পিছনে তার মা আর ভাবি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।মেঘলা বারবার জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলো কই নিয়ে যাচ্ছে।কোনো উত্তর পেলো না।আকাশ ছাদে গেয়ে মেঘলাকে ধাক্কা মে’রে রোদে উত্তপ্ত জায়গায় দাঁড় করালো।খালি পায়ে মেঘলা পা পুড়ে যাচ্ছে।ছটফট করছে তারপরও আকাশ মেঘলার হাত ছাড়ছে না।চোখে পানি টলমল করছে।
—“পু’ড়ছে মেঘলা?”
গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল আকাশ।আকাশের মুখে নিজের পুরো নাম শুনে মেঘলা স্থির হয়ে দাঁড়ালো।ছটফট করা বন্ধ হয়ে গেলো চোখের পলকে।অন্য সবাই মাঝে মধ্যে পুরো নাম ধরে ডাকলেও আকাশ কখনো মেঘু ছাড়া কথা বলে না।রাগের পরিমাণ কি খুব বেশি?মেঘলাকে চুপ থাকতে দেখে আকাশ বুকের বা পাশে আঙুল রেখে বলল,
—“আমার এখানেও পু’ড়ছে।নয় বছর ধরে অপেক্ষায় আছি কবে তুই ফিরে আসবি।কবে আমাদের রেষারেষি শেষ হবে।তুই ফিরলি কিন্তু আমাদের মাঝের রাগ-অভিমান-অভিযোগ কমলো না।আমাকে এমন যন্ত্রণা দিলি যা না সয়া না যায় উপচে ফেলা।আমার প্রতি যদি রাগ থাকে তাহলে সেটা ঘৃণায় পরিণত কর তারপর আমাকে মে’রে ফেল।তবুও এমন কষ্ট দিস না মেঘু।”
আকাশের কাতর গলায় বলা কথাগুলো মেঘলার ওপর কোনো প্রভাব ফেললো কিনা তা বুঝা গেলো না।ভাষাহীন চোখ আকাশের পানে স্থির।মুখের ভাব থমথমে।আকাশের রক্ত বর্ণ চোখে স্বচ্ছ পানি দেখা যাচ্ছে।
—“জানেন এক সময় আমিও কষ্ট পেতাম।”
মেঘলার মৃদু স্বর শুনে আকাশ তার দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে চিৎকার করে বলল,
—“তুই তখন ছোট ছিলি।আমার প্রতি তোর পাগলামি অত্যধিক পরিমাণে ছিল।যা সে বয়সে তোর জন্য বিপদ ডেকে আনতো।বুঝার চেষ্টা কর মেঘু।আমি তোকে এভাবে হারাতে চাই নি।”
তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে মেঘলা বলল,
—“আমি শুধু আপনার কাছ থেকে ভালো ব্যবহার আশা করেছিলাম।আপনার কাছে কোনো নোংরা আবদার কি করেছিলাম?সত্যি আপনিও জানেন আমিও জানি।আপনি তখন জানতেন আপনার জন্য একজন ফিক্সড করা আছে।আপনি তাকে গুরুত্ব দেন বা না দেন সে আপনার জন্য নির্ধারিত আছে এবং থাকবে।আর আপনার আশেপাশে যে পঁচা জিনিস ঘুরতো তাদের সাথে টাইম পাস করতেন।আপনি তো আমি ছাড়া আর কারোর মন ভাঙতে পারতে না।তাই আপনার রঙিন দুনিয়া তখন বেশি দামী ছিল।”
আকাশ দু’কদম পিছনে যেয়ে মাথা নিচু করে চুলগুলো খামচে ধরলো।চিৎকার করল চুল টেনে ধরে।মেঘলা বিচলিত হয়ে হাত বাড়িয়ে কিছুটা একটা ভেবে গুটিয়ে নিলো।কাঠকাঠ গলায় বলল,
—“এত হাইপার হচ্ছেন কেন?”
আকাশ মাথা তুলে সামনে তাকাল।মন প্রশ্ন জাগলো এই মেয়েটা সত্যি তার মেঘু তো?তার মেঘু এমন না।তার কষ্ট বুঝতো।তার একটু কিছু হলে কেঁদে দুনিয়া ভাসিয়ে দিতো।অথচ সামনের এই মেয়েটা কি কঠোর-গম্ভীর স্বভাবের!
কোমল গলায় আকাশ বলল,
—“হেনরি অন্য ধর্মের।ওর সাথে তোর বিয়ে সম্ভব না।তুই কি বুঝতেছিস না।”
মেঘলা আলতো হেসে জবাব দিলো,
—“হেনরি কবুল বলার আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করবে।আর এতে কারোর কোনো সমস্যা নেই ওর বাবা-মা এতে কোনো প্রকার আপত্তি করে নি।তারা দুই-তিনদিনের ভিতর বাংলাদেশে চলে আসবে।আর আমি আশা করি আপনি হেনরির কোনো প্রকার ক্ষতি করবেন না।”
আকাশের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো।মেঘলার একদম কাছাকাছি এসে সামান্য দূরত্বটুকুও ঘুচিয়ে নিলো।কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
—“তবে তাই হোক যা তুই চাস,কিন্তু শেষটা আমার ইচ্ছে মতো হবে।”
মেঘলার কানে আকাশের ঠোঁট ছুলো।প্রতিবার মেঘলা কেঁপে উঠলো যা আকাশের চোখ এড়ালো না।তার থেকে সরে দাঁড়িয়ে তার দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে চাইলো।বাঁকা হেসে বলল,
—“আমার কাছে আসায় এত নার্ভাস কেন হোস?ভালোবাসিস তাই নাকি ভয় পাস?”
মেঘলা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেছে।আকাশ কোনো উত্তর না পেয়ে মেঘলার হাতের উল্টো পিঠে চুমু দিয়ে চলে গেলো।
মেঘলা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে হাতটা বুকের কাছে চেপে ধরল।চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল।পায়ের বোধহয় ফোসকা পড়ে গেছে।মেন গেটের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলল,
—“আপনাকে পুড়িয়ে ছাই না করে আমি পিছ পা হচ্ছি না।”
চলবে…