ফিরবে চিনা ঠিকানায় পর্ব-১১

0
1078

#ফিরবে চিনা ঠিকানায়
#লেখনীতে_অনামিকা_ইসলাম_জেরিন
#পর্ব_১১

বাসায় এত আয়োজন দেখে আকাশ অবাক না হয়ে পারছে না।তার মা-বাবার হৈচৈ দেখে মনে হচ্ছে তাদের বাসায় বিয়ে হবে।আর এসব তার অসহ্য লাগছে।আতিফের সাথে কথা বলে জেনেছে মেঘুর বিয়ে পরিবারের একমাত্র মেয়ে এত আয়োজন তার সামনে কিছুই না।আর কারোর সাথে তার কথা হই নি।মূলত সে সবাইকে এড়িয়ে চলছে।মায়ের সাথে তুমুল আকারে ঝগড়া হয়েছে এই বিয়ে নিয়ে।কিন্তু আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় নি।মায়ের এক কথা মেঘু যা তাই হবে।সে যাকে চায় তার সাথে বিয়ে হবে।আকাশের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে।মেঘলাকে মাথায় তুলে এক আছাড় মা’রতে মন চাচ্ছে।আর হেনরির কথা নাহয় বাদই থাক।

মেঘলার কথা মনে পড়লে রাগ নিয়ন্ত্রণহীন পড়ছে আকাশের।কাল বিকালে মেঘলার সাথে শেষ কথা হয়েছে।শেষবাবের মতো চেষ্টা করেছে তাকে বুঝানোর।আকাশ রাগারাগি বা জোর করে কোনো কিছু করতে চাচ্ছে না।শান্তভাবে সব মিটিয়ে নিতে চাচ্ছে।কিন্তু মেঘলা সম্পূর্ণ তার বিপরীতে হাঁটছে।

কাল যখন মেঘলাকে ফোন করে আকুতি ভরা গলায় বলল,

—“মেঘু কেন করছিস এসব?এতে কেউ সুখী হবে না।সবার জীবন এলোমেলো হয়ে যাবে।এখনো সময় আছে প্লিজ সব বন্ধ করে দে।এসব আমার সহ্য হচ্ছে না।কেন বুঝতে পারছিস না আসি তোকে ভালোবাসি।বড্ড বেশি ভালোবাসি।”

মেঘলা যেন আকাশের কথা শুনলোই না।তাড়া দিয়ে বলল,

—“হয়ে গেছে?আর কিছু বলার বাকি থাকলে তাড়াতাড়ি বলেন ভাইয়া।আমার অনেক কাজ।”

আকাশ বিস্মিত হয়ে কান থেকে ফোন সরিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাল।সে ঠিক নাম্বারে কল করেছে তো?সে কি বলল,আর মেঘলা কি জবাব দিল!মেজাজ খারাপ হলো তবুও শান্ত স্বরে বলল,

—“পাখিকে কখনো দেখেছিস তার বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও রাত কাটাতে?সে কিন্তু অন্ধকার নামার আগে ঠিকই তার নীড়ে ফিরে যায়।”

মেঘলা ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,

—“তো?”

—“মেঘ ছাড়া আকাশের তেমন বিশেষ কোনো সৌন্দর্য নেই।মেঘ ছাড়া নীল আকাশ থাকবে কিন্তু কেউ বারবার বিমোহিত হবে না।প্রেমে পড়বে না।মুগ্ধ হয়ে আকাশের বুকে মেঘের রং বদল দেখবে না।আকাশ ছাড়া মেঘের ভেলা কোথায় ভাসাবি মেঘু?আকাশ ছাড়া মেঘ অস্তিত্বহীন।”

মেঘলা চুপ রইল।শুধু নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো।আকাশ ভেবে নিলো মেঘলা তার কথা বুঝেছে।কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মেঘলা বলল,

—“কালকের দিন পর আমার গাঁয়ে হলুদ।আশা করি পিছরের সব কথা ভুলে আপনি আসবেন।”

আকাশ এবার ক্ষেপলো।জানালার সবুজ পর্দা মুঠো করে টান দিলো।রাগের চোটে হুংকার দিলো।ওপর পাশে মেঘলা ভয়ে কেঁপে উঠলো।পাশ থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে গলা ভিজিয়ে নিলো।আকাশ ভ’য়ানক ভাবে রেগে গেছে তাতে কোনো স’ন্দেহ নেই মেঘলার।কাঁপা-কাঁপা গলায় কিছু বলবে তার আগে আকাশের ক্রোধ মিশ্রিত আওয়াজ ভেসে এলো,

—“তোকে পাওয়ার জন্য আমি সব করতে পারব,সব।এর জন্য আমাকে যা করতে হবে আমি তাই করব।কাউকে মা’রতে হলে তাও করব।অনেক সময় দিয়েছি,অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি।আর না।নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারছি না আমি।সামনে যা হবে তার জন্য তুই দায়ী থাকবি।শুধুমাত্র তুই।”

মেঘলা ভয়ে চুপসে গেলো।আকাশ রাগের মাথায় কোনো অঘটন না ঘটিয়ে ফেলে তা ভেবে মাথায় হাত দিলো।আকাশ রাগে ফুঁসছে।মেঘলা সামনে থাকলে বোধহয় সব রাগ তারপর ঢালতো।শুকনো ঢোক গিলে মেঘলা বলল,

—“ভাইয়া আপনি…

লাইন কে’টে দেছে আকাশ।মেঘলা ড্যাবড্যাব করে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো।মিনিট কয়েক পর আকাশের নাম্বার থেকে মেসেজ আসলো।

‘শুভ বিবাহ’

এরপর মেঘলা কয়েকবার কল করেছে কিন্তু আকাশ ধরে নি।নিশ্চিত বিয়ে নিয়ে কথা বলবে।বিয়েতে কোনো ঝামেলা করবেন না ব্লা ব্লা।যা শুনার ইচ্ছে আকাশের নেই।

—“কি রে ভাই!সকাল সকাল কি এমন জরুরি তলব পড়ল যে রাত-বিরাতে মানুষের ঘুম নষ্ট করিস?”

আকাশের ভাবনায় ছেদ পড়ল পিছন থেকে ভেসে আসা কথায়।জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল।বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পিছনে তাকাল।তার সব থেকে কাছের বন্ধু রবিন।এক গাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার সাথে আতিফ আর সায়িদ দাঁড়িয়ে আছে।তিনজনকে রাত ফোন করে বলেছিল সকালে দেখা করতে এখন দুপুর হতে চলছে।মেজাজ বিগড়ে গেলো।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—“কেন আসতে বলেছি জানিস না?সকালে আসতে বলেছি আসলি দুপুরে।এখন কি তোদের মুখ দর্শন দিতে এসেছিস?”

রবিন আকাশের কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে হেলেদুলে রুমের ভিতরে ঢুকে ধপাস করে বিছানার ওপর পড়ল।আতিফ যেয়ে বিছানার এক কোণে বসলো আর সায়িদ সোফার ওপর শুয়ে পড়ল।

—“এই বিদেশি মালটা আসলো কই থেকে তোদের মাঝে?”

রবিনের কথায় আকাশ ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

—“কার কথা বলছিস?”

—“আরে ভাবির যার সাথে বিয়ে হচ্ছে?”

—“লন্ডন থেকে।”

রবিন ছোট করে ‘ওহ’ বলল।তারপর সবার মাঝে কিছু সময় নিরবতা চলল।সবাই গভীর ভাবনায় মগ্ন।সবার মুখে সিরিয়াস ভাব।

—“এই সাদা মুলার সাথে প্রেম কেম্নে হলো?”

রবিন চিন্তিত কন্ঠে জানতে চাইল।আকাশ কিছু বলতে যাবে তার আগে আতিফ ব্যস্ত হয়ে বলল,

—“কখনো মনেই তো হই নি ওরা রিলেশনে আছে।আমি আরও ভাবছি এই হেনরি জোনিতারে পছন্দ করে।হাবভাব দেখে মনে হইছে জোনিতার জন্য পাগল।কিন্তু শেষে এসে কি হলো!”

সায়িদও তার সাথে তাল মিলিয়ে বলল,

—“আমি শিওর এ পোলা পাক্কা ক্যারেক্টারলেস।আমি মেঘুরে বলছিও কিন্তু সে কোনো কথা কানে তুলছে না।উল্টো আমাকে বলে আমি বেশি বুঝতেছি।আর আমাদের পরিবারের লোকজনই বা কি?হঠাৎ করে বলে মেঘুর আর হেনরির বিয়ে ঠিক করে ফেললো!আমাদের মতামতের কোনো দাম নেই।খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে তারা।হেনরির বাবা-মাকে তো মাথায় তুলে রাখতেছে।রাগেতে কোনো কাজে সাহায্যই করি নি আমি।”

আকাশ চুপ করে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনলো।নিচের দিকে তাকিয়ে ডান পা দিয়ে ফ্লোরে আঁকিবুঁকি করছে।রবিন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবুক হয়ে বলল,

—“তাহলে এখন আমাদের কাজ এই বিয়ে ভাঙ্গা,তাই তো?”

আকাশ না তাকিয়ে বুঝলো প্রশ্ন তাকে করা হয়েছে।কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ রইল।রবিন উত্তরের আশা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে রইল।

—“হেনরিকে উপরে পাঠায় দিলে কেমন হয়?”

আকাশের অতি শান্ত গলায় করা প্রশ্ন তিনজনের কানে বজ্রপাতের ন্যায় আ’ঘা’ত হানলো।রবিন ধপ করে উঠে বসলো।সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।তার দৃষ্টি এখনো ফ্লোরে।আকাশের ঠান্ডা স্বভাব তার রাগী স্বভাব থেকে বেশি খারাপ।রাগ হলে তা কোনো জিনিস ভে’ঙে বা কারোর ওপর রাগ ঝেড়ে ঠান্ডা হয়ে যায়।কিন্তু এই ঠান্ডা স্বভাব মানে মাথার ভিতর মা’রা’ত্ম’ক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে।

রবিন জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

—“দোস্ত তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?সমস্যার সমাধান অন্য ভাবে আমরা বের করব।এমন চিন্তা মাথা থেকে বের কর।”

—“কি সমাধান করবি?মেঘু আমরা কোনো শুনতে রাজি না।সে এই বিয়ে করবেই।আসল সমস্যা হলো হেনরি।আর ও না থাকলে সব ঠিক।”

রবিন চুপ করে কিছু ভাবলো।বাকি দুইজনের বিস্ময় নিয়ে এখনও আকাশকে পর্যবেক্ষণ করছে।মেঘলার বিয়েতে যে বড়সড় ধামাকা হবে তা বেশ বুঝতে পারতেছে।এই বিয়েতে তাদের মত নেই।তারা চায় এই বিয়ে না হোক।তাই বলে তারা চায় না আকাশ এমন উল্টোপাল্টা কিছু করুক।

—“ভাবিকে কিডনাপ করে নিলে কেমন হয়?”

রবিনের কথা শুনা মাত্র সায়িদ এক চিৎকার দিল,

—“মানে?”

আকাশের চোখে মুখ খুশিতে চকচক করছে।যেন এত সময় পর সে একদম সঠিক রাস্তা খুঁজে পেয়েছে।ডান পা এবার স্থির হলো।আতিফ বোবা হয়ে বসে আছে।বিয়ে ঠেকাতে এখন নিজের বাড়ির মেয়েকে তুলে নেবে?আর কিছু পাচ্ছে না এরা?

রবিন বিরক্তি গলায় সায়িদকে বলল,

—“কিডনাপ মানে অপহরণ।তোর বোনকে তুলে আনব বিয়ের দিন।”

—“তারপর কি করবা?বাসায় ফোন করে বলবা টাকা না দিলে তোমাদের মেয়েকে আর পাবা না।সো চিপ আইডিয়া ভাই।সবাই জানতে পারলে কি হবে বুঝতে পারছো?”

আতিফের বুদ্ধি দেখে রবিন থ হয়ে গেলো।তারা টাকার জন্য মেঘলাকে অপহরণ করবে?এক ধমক দিয়ে বলল,

—“সিরিয়াসলি!টাকার জন্য আমরা এসব করব?মেঘলাকে এনে সোজা যাব কাজী অফিসে যাব,সেখানে ওদের দুইজনকে বিয়ে দিব।এরপর কারোর কিছু করার থাকবে না।বুঝলি?”

—“অসম্ভব।নিজের বোনের সাথে আমি এমন করতে পারব না।তোমরা অন্য কোনো প্লান করো।ছিঃ মানুষ কি বলবে?আর মেঘু?ও তো আমাকে জুতা পিটা করবে কনফার্ম।”

সায়িদের নীতি রবিন,আকাশ কারোর ভালো লাগলো না।আকাশ তার অবজ্ঞা করে পকেটে হাত গুজে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল,

—“সব ঠিক আছে।কিন্তু কখন,কিভাবে করব?”

রবিন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শার্টের কলার ঝাড়া দিয়ে ভাব নিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

—“ওসব আমার ওপর ছেড়ে দে।কাল তোর গায়ে হলুদ সে ইনজয় কর।”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে