ফিরবে চিনা ঠিকানায় পর্ব-০৬

0
1184

#ফিরবে চিনা ঠিকানায়
#লেখনীতে_অনামিকা_ইসলাম_জেরিন
#পর্ব_৬

রাতে ছাদে বসে মেঘলা,জোনিতা আর হেনরি গল্প করছে।হেনরি বিশ্বাসই করতে পারছে জোনিতা ওর সামনে বসে কথা বলছে।তিনদিন জোনিতার সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না।তার ওপর মেঘলার কথা শুনে সে বিশ্বাস করে নিয়েছিল জোনিতা আসবে না।কিন্তু বিকালে জোনিতাকে দেখে অবাক না হয়ে পারি নি সে।যখন জোনিতা সবার সাথে কথা বললো তখন তার পুরোপুরি বিশ্বাস হলো জোনিতা এসেছে।

জোনিতা হাসতে হাসতে বলল,

—“কেমন লাগলো হেনরি সারপ্রাইজ?”

হেনরি রাগান্বিত সুরে বলল,

—“এটা কোনো সারপ্রাইজ হয়?আমার এমন সারপ্রাইজ লাগবে না জোনিতা।তুমি জানো তুমি আসবে না শুনে আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম।আর মেঘু তুমিও আমাকে বললে না জোনিতা আসবে উল্টা মিথ্যা বলেছো।তোমার কাছে আমার ফিলিংসের কোনো মূল্য নেই জোনিতা।তারপরও আমি এক্সপেকটেশন নিয়ে বসে থাকি।”

জোনিতা আর মেঘলা দু’জন একে ওপরের দিকে তাকিয়ে জোড়ে হেসে দেয়।হেনরির রাগে বাড়লো।মেঘলা হাসি থামিয়ে হেনরিকে বলল,

—“হেনরি তুমি মেয়েদের মতো অভিমান করছো!”

হেনরি জোনিতার কিছু কাজের ওপর চরম বিরক্ত হয়।তার ফিলিংসের কোনো মূল্যই দেয় না।সবার সাথে এমন করে তা নয়,শুধু হেনরির সাথে এমন করে।যার কারণে হেনরি কষ্ট পায় তবুও জোনিতার পিছনে ছুটে।আবার কোনো মেয়ের সাথে সামান্য পরিমাণ কথা বললে জোনিতা তার সাথে রাগারাগি করে।সে কোনোভাবে জোনিতাকে বুঝতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো হেনরি।ভালো লাগছে না বলে নিচে চলে গেলো।

—“ও চলে গেলো কেন?”

জোনিতার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না মেঘলা।মেঘলার রাগ হলো জোনিতার ওপর।জোনিতা কি জানে না অতিরিক্ত কোনো কিছু ভালো না?আর সেটা যদি হয় অবহেলা তাহলে তো কথাই নেই।কেউ তার সবটুকু দিতে ভালোবাসলে তাকে আগলে রাখতে হয়।ভীষণ যত্নে রাখতে হয়।নাহলে সে ভালোবাসা বেশি দিন টেকে না।এই যে হেনরির অমূল পরিবর্তন তার একটা-ই কারণ সে জোনিতার পছন্দ মতো নিজেকে তৈরি করছে।এমনও তো হতে পারে জোনিতার অবহেলার জন্য সে খারাপ পথে ধাবিত হলো।তখন কি জোনিতা?

ছাদে নিরবতা ছেয়ে গেলো।জোনিতার মনে হচ্ছে সে একটু বেশি করে ফেলেছে।জোনিতা নিচে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো।মেঘলা এখন যাবে না তাই সে একাই নেমে গেলো।মেঘলা চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো।বাগান থেকে হালকা আলো আসছে।ছাদের লাইট বন্ধ করা।আকাশ চাঁদ নেই তবে অসংখ্য তারা আছে।হঠাৎ মেঘলার কোনো কিছু ভালো লাগছে না।নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না।ছাদে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না।আকষ্মিক মন খারাপের কোনো কারণ খুঁজে পেলো না সে।ঘাড় কাধ করে তারা গুণার বৃথা চেষ্টা চালালো।নিবর ছাদে ভ’য়ংকর শব্দ তুলে মেঘলার মোবাইল বাঁজতে লাগলো।মেঘলা ভয় পেয়ে কেঁপে উঠলো।নিজেকে ধাতস্থ করে মোবাইলের দিকে তাকালো।স্ক্রিনে ভাবি লেখা ভাসছে।কল রিসিভ করলো।দেশে আসার পর ঝিনুকের সাথে একবার দেখা হয়েছে আর ফোনে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে।নিসন্দেহে বলা যায় মেয়েটা প্রচুর মিশুক।ভাবি হিসাবে ঝিনকুকে দারুণ লেগেছে মেঘলার।মিষ্টি চেহারার মতো স্বভাবেও মিষ্টতা ভরা।মেঘলা ছাদে পায়চারি করছে আর হেসে হেসে ঝিনুকের সাথে কথা বলছে।সিঁড়ি কাছ থেকে হাসির শব্দ শুনে আকাশ ছাদের দিকে এগোলো।মেঘলাকে এভাবে হেসে কথা বলতে দেখে গাঁ জ্ব’লে গেলো তার।নিশ্চয়ই কোনো ছেলের সাথে কথা বলছে।তার জন্য এত হেসে কথা বলা হচ্ছে।বড় বড় পা ফেলে মেঘলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।এভাবে আকাশ সামনে এসে দাঁড়ানোয় মেঘলা ভড়কে গেলো।কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে সামনে ভালো করে তাকালো।আকাশকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলো।’পরে কথা বলছি’ বলে লাইন কে’টে দিয়ে কপাট রাগ নিয়ে বলল,

—“সমস্যা কি?এভাবে কেউ সামনে এসে দাঁড়ায়?”

আকাশ দ্বিগুণ রাগ নিয়ে মেঘলার একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।মেঘলার দুই বাহু চেপে ধরে চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,

—“কার সাথে কথা বলছিলির?কয়টা বয়ফ্রেন্ড পালিস তুই?এই হেনরির সাথে তোর এত কিসের কথা?অপমান করছিস,ইগনোর করছিস,যা বলছিস সব মুখ বুজে সহ্য করছি তার মানে এই নয় তোকে ছেড়ে দিছি আমি।সময় আছে এসব ছেড়ে দে নাহলে আমি ছাড়ালে খুব খারাপ হয়ে যাবে মেঘু।”

মেঘলা ব্যথায় কুকরে যাচ্ছে।চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি পড়লো।শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলো।তাল সমলাতে না পেড়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো আকাশ।মেঘলা চিৎকার করে উঠলো,

—“সবাইকে নিজের মতো ভাবেন কেন আপনি?আপনি যেমন চরিত্রহীন সবাই তেমন ভাবেন কেন?আপনার তো আমার প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না।তাহলে এখন এসব কেন?আমি তো আপনার যোগ্য না।আপনার ভাষ্য মতে আপনাকে ভালোও বাসি না আমি।আমার অনুভূতি গুলো পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতেন।কথায় কথায় অপমান করতেন।আর আজ আমি অন্য কারোর সাথে একটু হেসে কথা বলায় আপনার জ্ব’লে যায়।তাহলে আমার ছোট্ট কিশোরী মনে কি প্রভাব পড়তো তা কখনো ভেবে দেখেছেন?যেখানে সবাই মিলে আমার মন মস্তিষ্কে শুধু আপনার কথা ঢুকাতো সেখানে আপনি সারাক্ষণ অন্য মেয়ের সাথে ঘেষা-ঘেষি করে বেড়াতেন।আমি কিছু বললেই ঠাস করে একটা চ’ড় নাহয় অপমান উপহার পেতাম।কেন করতেন আমার সাথে এমন করতেন?আমি তো ভুলেও কোনো ছেলের সাথে কথা বলতাম না।আপনি কেন মেয়েদের সাথে এত কথা বলতেন?মানলাম তারা আপনার বান্ধবী ছিল কিন্তু আমার সে সময় এসব বোঝার ক্ষমতা ছিল না।মানতে বা মানিয়ে নিতে পারতাম না।আমি পারতাম না সহ্য করতে।কষ্ট হতো আমার কিন্তু আপনি তাতে এক বিন্দু মলম লাগাতেন না।উল্টো কা’টা ঘা’য়ে লবণের ছিড়া দিতেন।”

মেঘলা থাকলো।জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে।দু’চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে।গুছিয়ে রাখা কথা গুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।বুকের মাঝে পুরাতোন ক্ষ’ত জেগে উঠেছে।সামনে থাকা মানুষটা তাকে এত অবহেলা না করলে কি পারতো না?তার সাথে রাগারাগি না করে কি তাকে বোঝানো যেতো না?বলা যেতো না,’আমি তোরই আছি।তোরই থাকব।এখন তোর পড়াশোনা করার সময় অন্য কিছুর না।’এই মানুষটার আদুরে গলায় সব কথা যে সে মাথা পেতে নিতো তা কি তার অজানা ছিল?হাতের উল্টো পিট দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল,

—“একদিন স্কুলের এক ছেলে আমাকে প্রোপোজ করলো আর সেটা আপনি দেখে আমাকে সবার সামনে মা’র’লে।বাসায় যেয়ে সবার সামনে আমাকে বা’জে ভাবর প্রেজেন্ট করলে।কিন্তু কেন?ওই ছেলের সাথে রিলেশনে গেলে আপনার তাতে কি সমস্যা ছিল?পারছিলাম না আমি আর আপনাকে সহ্য করতে তাই নিজেকে ঘর বন্দী করে নি।আপনার থেকে দূরে থাকতে না পেরে দেশ ছাড়ার সিন্ধান্ত নিলাম এবং সবাইকে রাজি করলাম।যাওয়ার কিছু দিন আগে আপনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।মনে হয়েছিল আপনি আমাকে মিস করবেন সবকিছুর জন্য সরি বলবেন।কিন্তু কিছুই করেন নি বরং বলেছিলেন ‘ভালোই হয়েছে মেঘু তুই আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করে দিয়েছিস।এখন আমি শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারি।’আপনি আমার অভিমান বোঝেন নি।আমার অভিমান ভাঙ্গতে আসেন নি।এজন্য দিয়েছি আপনাকে শান্তি।চলে গেছি আপনার থেকে দূরে।এতসবের পরও আশা করেন আমি আপনার জন্য পাগল থাকব?আপনাকে ভালোবাসব?কিভাবে আশা করেন?আমি কি এতটাই তুচ্ছ?”

আকাশ বাক্যশূণ্য হয়ে পড়লো।বলার মতো কিছু খুঁজে পেলো না।মেঘলা নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।নিষ্পলক নয়নে আবছা ছায়াকে অন্ধকারের সাথে মিলিয়ে যেতে দেখলো আকাশ।নিষ্প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ক্ষণকাল।নিজের অজান্তে করা ভুল গুলো আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখে নিলো।দূরে নিকষ আধারে চেয়ে বলল,

—“তার ভালো করতে যেয়ে তাকে সীমাহীন কষ্ট দিয়ে দিয়েছি।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে