#ফিরবে চিনা ঠিকানায়
#লেখনীতে-অনামিকা_ইসলাম_জেরিন
#পর্ব_৪
চারিপাশে দাপুটে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।গাছগুলোর মাথা এদিক-ওদিক হেলে পড়ছে।দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো মূহুর্তে ভেঙ্গে যাবে।আকাশে কালো মেঘের ভেলা ভেসে যাচ্ছে।স্থির হয়ে গেলেই বুঝি ঝপঝপ করে বৃষ্টি ঝরে পড়বে পৃথিবীর বুকে।শীতল হাওয়া কোথাও বৃষ্টি হওয়ার জানান দিচ্ছে।উত্তর আকাশে মেঘের পরিমাণ একটু বেশি হয়েছে।বিকাল হলেও চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।মেঘলা ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে।পরণে সবুজ থ্রি-পিস।জর্জেটের ওড়না বা’কাধের ওপর মেলে দেওয়া।বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে ওড়না আর চুল উড়েছে।মন প্রাণ স্নিগ্ধতায় ভরে উঠছে।আশেপাশে সব কিছু শান্ত।কোনো ব্যস্ততা নেই।
—“কেমন আছিস মেঘু।”
ছাদে বিরাজমান নিরবতা ভেঙে গেলো পিছন থেকে আসা পুরুষালি কন্ঠে। মেঘলা মাথা ঘুড়িয়ে তাকাল।প্যান্টের পকেটে হাত গুজে মেঘলার দিকে তাকিয়ে আছে আকাশ।চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।ঠোঁট কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠেছে।ফর্মাল লুক দেখে বোঝা যাচ্ছে অফিস থেকে এসেছে।মেঘলার থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আবারও প্রশ্ন ছুড়ল আকাশ,
—“কি রে কথা বলবি না আমার সাথে?”
মেঘলা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।সামনের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বলল,
—“ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?”
মেঘলার কথা বলার ভাব দেখে বুঝা যাচ্ছে সে আকাশের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না।ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেঘলার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
—“এই তো আছি কোনো রকম।”
একটু থেমে কোনো প্রকার ভনিতা না করে স্পষ্ট কন্ঠ জানতে চাইল,
—“আমার সাথে কথা বলছিস না কেন?”
—“কথা বলছি তো। আমি কি বোবা যে কথা বলব না?”
—“না,তবে আমার বেলায় বোবা হয়ে যাচ্ছিস।সবার সাথে কত কথা বলছিস মজা করছিস হাসির রোল পড়ে যাচ্ছে।শুধু আমার সাথেই কথা বলিস না।কারণ কি?”
—“সময় পাই নি।”
আকাশ মেঘলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিন্তু তাতে মেঘলার ভ্রুঁক্ষেপ নেই।মেঘলার উত্তর আকাশের মন পুত হয় নি।সে এসেছে আজ পাঁচ দিন হতে চলল।এর মাঝে একবারও তার সময় হয় নি আকাশের সাথে দুটো বাক্য ব্যয় করার?আকাশ করুন সুরে শুধালো,
—“এখনও আমার ওপর রেগে আছিস মেঘু?”
—“আপনার ওপর রাগব কেন?আপনার সাথে রেগে থাকার মতো কোনো সম্পর্ক কি আমাদের মাঝে আছে ভাইয়া?আমি ব্যস্ত এজন্য আপনার সাথে কথা বলা হয়ে ওঠে নি।আপনি অহেতুক এসব ভাবছেন ভাইয়া।”
মেঘলার মুখে ‘ভাইয়া’ ডাক শুনে আকাশের মন ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো।এত জেদ কেন মেয়েটার?রাগ করলে সেটা ধরে রেখে সারাজীবন পার করে দেওয়ার কোনো মানে হয়?এত ভাব নিয়ে তার কেন কথা বলতে হবে?মন চায় ঠাটিয়ে একটা চড় মে’রে সোজা করে দিতে।আকাশ মনের ইচ্ছা মনের ভেতর চাপিয়ে রাখলো।রেগে গেলে কিছু ঠিক হবে না বরং বিগড়ে যাবে সব।মৃদু হেসে আকাশ বলল,
—“এখনও আগের মতো রাগিস।সমস্যা নেই রাগ ভেঙ্গে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।কিন্তু আমাকে ভাইয়া ডাকছিস কেন?জীবনে কম চেষ্টা করি নি তোর মুখ থেকে আমার জন্য ভাইয়া ডাক বের করানোর।তখন তো ভাইয়া ডাকতি না তাহলে এখন কেন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করছিস?”
মেঘলা আকাশের চোখে চোখ রেখে কড়া গলায় বলল,
—“আগে ছোট ছিলাম বুঝতে পারতাম না কাকে কি বলতে হবে। এখন বড় হয়েছি সব কিছু বুঝি।সম্পর্কে আপনি আমার ফুফাতো ভাই।আমি আপনার মামাতো বোন।সো ভাই-বোনের সম্পর্ক আমাদের।আপনার কাছ থেকে মার,বকা খাওয়ার বয়সটাও এখন নেই।”
আকাশ আশেপাশে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
—“ভাই-বোন মাই ফুট।সময় আসলে দেখবানি কে কার কি?”
মেঘলার চোখে মুখে অদৃশ্য হাসি খেলা করছে।আকাশ রেগে যাচ্ছে বুঝতে পারছে।তবুও চুপ করে আছে।আকাশের রাগে তার কিছু যায় আসে না।আকাশ ভারী গলায় বলল,
—“বদলে গেছিস।ছোট থাকতে ভালো ছিলি।”
—“নয় বছর অনেক সময় ভাইয়া। বদলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।বরং বদলে না যাওয়া অস্বাভাবিক।মানুষ মিনিটে মিনিটে বদলায়।সেখানে নয় বছর!কত সময় হিসাব করেছেন?”
—“আগের থেকে দেখতে সুন্দর হয়েছিস অনেক।এজন্য কি আমার সাথে ভাব নিচ্ছিস?”
—“আমি জন্মগত ভাবেই সুন্দর।আপনার চোখে আগে কখনো ধরা পড়ে নি আমার সৌন্দর্য এজন্য তখন সুন্দর মনে হয় নি।”
—“আমি কি বলেছি তুই আগে সুন্দর ছিলি…
আকাশের কথার মাঝে হেনরি দৌড়ে এসে মেঘলাকে ইংরেজিতে বলল,
—“মেঘু তুমি কই থাকো?তোমাকে খুঁজছি কখন থেকে জানো তুমি?”
মেঘলা হেনরির দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁ উপর নিচে করে জিজ্ঞেস করল,
—“কেন?”
হেনরি মেঘলার ডান হাত ধরে বলল,
—“দরকার।আমার সাথে চল প্লিজ।”
—“ওকে।”
আকাশ মেঘলার ডান হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।মেঘলা হেনরির সাথে চলে গেলো।কিছু সময় চুপ করে ছাদে দাঁড়িয়ে থেকে নিচে চলে যায় সেও।
___________________
হেনরি মেঘলাকে তার রুমে নিয়ে আসে।হেনরি বিছানায় বসে ব্যস্ত গলায় বলল,
—“মেঘু জোনিতা কবে আসবে?ওর আসার কথা ছিল আরো আগে কিন্তু এখনো আসছে না।”
মেঘলা হেনরির পাশে এসে বসে উদাসীন ভাবে বলল,
—“জোনিতা আসবে না।”
হেনরি অবাক হয়ে বলল,
—“হোয়াট!কেন?ও বলছিল আসবে।”
—“বলছিল কিন্তু এখন আসবে না আমাকে বলে দিয়েছে।”
—“আমি ফোন করলে ফোন ধরছে না কেন?”
—“বিজি আছে।”
হেনরি মন খারাপ করে বলে,
—“কত কিছু ভেবেছিলাম আমি।তিনজনে মিলে ঘুরবো মজা করবো।তোমার ভাইয়ার বিয়ে দেখবো জোনিতার সাথে।বাংলা ভাষাও ঠিক করে শিখেছি।আর এখন বলছো জোনিতা আসবে না।যার জন্য এত কিছু সেই যদি না থাকে তাহলে এসব করে লাভ কি?”
—তিনজন মিলে ঘুরবে নাকি দুইজন?
মেঘলা হেসে জিজ্ঞেস করল হেনরিকে।হেনরি হকচকিয়ে গেলো কিন্তু কোনো কথা বলল না
—“কষ্ট পেও না হেনরি।জোনিতা না আসলে তো কিছু করার নেই তাই না?”
হেনরি চুপ করে বসে আছে আর মেঘলা ওর পাশে বসে হেডফোনে গান শুনছে।বেশ কিছু সময় পর হেনরি ফ্লোরের দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,
—“চারদিন পর তোমার ভাইয়ার বিয়ে তাই না?”
—“হুম।”
—“আমি চলে যাব মেঘু।”
—“কোথায়?”
—“লন্ডন।”
—“কবে?”
—“কাল।”
মেঘলা কান থেকে হেডফোন খুলে হেনরির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,
—“কেন?”
হেনরি মেঘলার সামনে এসে ফ্লোরে বসে পড়ে।মেঘলার এক হাত ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
—“মেঘু জোনিতা আমাকে বুঝে না কেন?ও কি জানে না আমি ওকে কতটা ভালোবাসি?ভেবেছিলাম বাংলাদেশে এসে ওকে প্রোপোজ করে।আর ও রাজি যাবে।কিন্তু দেখো কিছু হবে না।কিছু না।”
মেঘলা হেনরির এমন স্বভাব দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে।একে এখন না আটকালে সোজা লন্ডনের মাটিতে যেয়ে টপকাবে।প্রেমে পড়ে হেনরির মাথার স্ক্রুগুলো ঢিলা হয়ে গেছে তা বেশ বুঝতে পারছে।এতদিন শুধু বাংলা শেখার প্রয়াশ চালিয়েছে এখন ম্যান্টাল হসপিটালের যাওয়ার ব্যবস্থা করতেছে।
মেঘলা হেনরির হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
—“আমি আছি তো হেনরি আমি তোমাকে হেল্প করব।আমাকে বিলিভ কর।”
হেনরি ছোট করে জবাব দিল,
—“হুম।”
আকাশ হেনরির রুমের দরজার সামনে গিয়ে দেখে মেঘলার হাত ধরে হেনরি বসে আছে।আকাশের গা জ্বলে যাচ্ছে ওদের এই ভাবে বসে থাকতে দেখে।এই হেনরিকে তার শুরু থেকে সহ্য হচ্ছে না।এসব দেখার পর তো আর সহ্য করার প্রশ্নই আসে না।আকাশ চোখ মুখ শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—“রোমান্স শেষ হলে খেতে আসেন মামি ডেকেছে।”
মেঘলা হেনরি কেউ খেয়াল করে নি আকাশকে।আকাশের কথা শুনে মেঘলা দরজার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল,
—“কি বলছেন ভাইয়া?”
আকাশ কিছু না বলে ওইখান থেকে চলে যায়।হেনরি আকাশের কথার অর্থ বুঝতে পেরে মেঘলার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চাইল।মেঘলা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে।বাসা থেকে বের হতে যাবে এমন সময় মেঘলার মা বললেন,
—“কোথায় যাচ্ছিস আকাশ?”
—“বাসায়।”
মেঘলার মা বললেন,
—“সে কি কথা?এত রাতে বাসায় যাবি কেন?আজ রাত থেকে যা।”
—“একটু কাজ আছে মামি আমার যেতে হবে।”
—“ওই এত রাতে কিসের কাজ?চারদিন পর আমার বিয়ে আর তুই এইভাবে কাজ কাজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।”
সিয়ামের কথায় আকাশ হালকা হেসে বলল,
—“এখন কাজ না করলে তোমার বিয়ের দিন অফিসে গিয়ে কাজ করতে হবে আমার।”
—“তাহলে খেয়ে যা।”
মেঘলাকে হেনরির সাথে নিচে আসতে দেখে আকাশ ওর মামির দিকে তাকিয়ে বলল,
—“আমার খিদে নেই মামি।”
—“আরে শোন তো খিদে নেই মানে?”
আকাশ কিছু শুনেছে কিনা সন্দেহ আছে।গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে গেল।বাসায় গিয়ে নিজের রুমের সব কিছু ভেঙ্গে চুড়ে একাকার করে ফেলেছে।বারবার চোখের সামনে হেনরির আর মেঘলার হাত ধরে রাখার দৃশ্য ভেসে আসছে।জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশ ভাবছে মেঘু কত বদলে গেছে।মেঘু এখন আর আকাশকে ভালোবাসে না।তার জন্য কোনো পাগলী করে না।সে এখন অন্যকারোর হয়ে গেছে।এত সহজে অন্য কারোর হয়ে গেলো!মেঘু কি আর কখনো ফিরবে না আকাশের কাছে?তার ছোট্ট ভুলের এত বড় শাস্তি পেতে হবে?কি করে থাকবে মেঘুকে ছাড়া?এতদিন বুকের কোণে একটা আশা ছিল মেঘু ফিরবে।মেঘু ফিরেছে তবে একা নয়।তাদের রাগ-অভিমান-অভিযোগের খেলা কি শেষ হবে না?এইসব ভাবতে ভাবতে শেষ রাতে আকাশ ঘুমিয়ে যায়।
চলবে…