#ফানাহ্ 🖤
#সমাপন_চূড়ান্ত
#হুমাইরা_হাসান
________________
রক্তের ফোঁটা গুলো অবিরাম ধারায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে হাত থেকে। অসহনীয় যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে রেখেও গুঙিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে৷ বি’ষাক্ত যন্ত্রণায় গর্জে ওঠা চাপা গোঙানির শব্দটা মুখে এঁটে বেঁধে রাখা কাপড়ের চাপেই হারিয়ে যাচ্ছে কিছুদূর না পৌঁছাতেই। লোহার পে’রেক দিয়ে কাঠের চেয়ারে বিঁ-ধিয়ে রাখা হাতটায় রক্তের কালচে কুণ্ডলীতে জমে অত্যন্ত বীভৎস দেখাচ্ছে। যন্ত্রনায় না ছাড়াতে পারছে নাইবা সইতে পারছে। অপার্থিব যন্ত্রণায়, ক্লেশে শরীরে রক্ত গুলোই যেন অশ্রু হয়ে চোখের কোন চুঁইয়ে পড়ছে, এতটা কদার্য সেই দৃশ্য। গুঙিয়ে উঠে বারংবার চোখের ইশারায় করুণ আর্জি রাখছে ক্ষমা প্রার্থনার রেহাই পাবার, এই মারণসম য’ন্ত্রণার চেয়ে যেন মৃত্যুও ঢের ভালো। কম্পমান নেত্রপল্লব চোখের পানিতে ভিজে জুবুথুবু। যেই চোখ দিয়ে মানুষের মৃত্যু দেখত, অন্যের করুণতার মজা লুটতো আজ সেই চোখে এক আকাশ অসহায়ত্ব, একটুখানি রেহাই পাবার আকুলি। এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো, হাতের উপর পিঠ দিয়ে ঢুকে তালু ছি-দ্র করে বেরিয়ে আসা, চেয়ারে বি’দ্ধ পেরেকটাই হাতটার তালুর চাপ রেখে ঝুঁকে এলো মুখের কাছে। হাতের ওপরে এরূপ পাশবি’কতায় সহ্যহীনা হয়ে শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে চিৎকার করে উঠলো আরহাম মুর্তজা। কাপড়ে ভরে রাখা মুখটায় সে শব্দে জোর তুলতে না পারলেও চাপা একটা গোঙানির শব্দে মোটা,পেটা দেওয়াল গুলোতেও ঝংকার তুললো। প্রচণ্ড জোর খাটিয়ে চিৎকার করে আধমরা শরীরটা ভার ছেড়ে চেয়ারের পিঠে এলিয়ে পড়লো শরীর। একহাত তুলে মুখে বাঁধা কাপড় টা খুলে দিলো মেহরাজ। আরহাম বিধ্বস্ত অবস্থায় জিহ্ব ঠেলে ক্ষীণ স্বরে বলল,
– ছেড়ে দাও, দয়া করো
– দয়া! তোর মতো শূ-করের জাতকে? তোরা আস্ত মানুষকে খু-বলে খাস টাকা জন্যে। তোদের ক্ষমা!
বন্য জন্তুটার মতো গর্জে উঠল মেহরাজ। চুল থেকে টুপটুপ করে ঘাম পড়লো। সারা মুখ রক্তাভ। যে ক্ষোভের আগুনটা এতদিন বুকের ভেতর ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলো আজ তা অগ্নিয়গিরির লেলিহান দাবালনে পরিণত। ফলস্বরূপ মুর্তজাদের এই পরিস্থিতি। মেঝেতে পড়ে থাকা শরীর টা এবার নড়েচড়ে উঠলো। রক্তে মাখা ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
– আমরা তোমাকে মানুষ করেছি, অন্তত এই উছিলায় আমাদের ছেড়ে দাও
কথা শেষ হতে না হতেই তীব্র চিৎকার দিয়ে উঠলো আজহার মুর্তজা। মুখের চোয়ালটা বোধহয় আর নাড়ানোর যোগ্য নেই। কতগুলো দাঁত যে উপড়ে পড়লো তা দেখবার অবস্থাটাও আর নেই তার। ভারী রডের আ-ঘাতে চোয়ালের মাংস থেঁ’তলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তবুও যেন মেহরাজ ক্ষান্ত হলো না, হিংস্র পশুর মতো শরীরের দানবীয় শক্তিটাকে খাটিয়ে এলোমেলো আ-ঘাত করলো দুটো শরীরে। কণ্ঠনালী কাঁপিয়ে হুংকার দিয়ে বলল,
– আমার ভাইকে মা’রার সময় মনে ছিলো না? ওর কী দোষ ছিলো? জা’নোয়ারের জা’নোয়ার আমার ভাইকে কেনো মা-রলি তোরা। আমাকে দরকার তোদের একবার বলতি আমি রুদ্ধ নিজে এসে হাজির হতাম আমার ভাইকে কেনো মা’রলি?
দেহের ভেতরে জলন্ত অগ্নিশিখা মতন দুঃখ যন্ত্রণাগুলো আজ বেসামাল ক্রোধে ক্রোধান্বিত। অমানবিক শিকারীর মতো দুটো মানুষের সারা শরীর ভয়ংকর ভাবে থেঁ-তলে দিয়ে, ছিন্নভিন্ন করেও শান্তি মেলেনি। আর কত ভাবে! কোন কোন ভাবে যন্ত্র-ণা দেবে? হাতের মত কী পায়েও পে’রেক ঢোকাবে? নাকি কপালে! নাহ..কপালে দিলে একবারেই ম’রে যাবে। ওদের এত সহজ মৃত্যু কিছুতেই দেবে না, কিছুতেই নাহ! মনের ক্ষোভ মিশিয়ে লাগাতার আ-ঘাত করতে করতে হাঁফিয়ে উঠলো মেহরাজ। ঘামে ভিজে লেপ্টে শার্টের হাতায় মুখ মুছে হাত থেকে রডটা ছুড়ে ফেলে দিলো। চেয়ারে বসানো আরহামের বুক বরাবর সজোরে লা-ত্থি দিলে ছিটকে পড়লো কয়েক হাত দূরে৷ রাগে গলার রগ গুলোও কুঁচকে ভীষণ ভাবে দৃশ্যমান হয়ে গেছে, শরীরে ভয়ংকর রাগ আর চোখে বিধ্বংসী যন্ত্রণার অশ্রু নিয়ে পুরো দুইটা দিন বিরতিহীন পা-শবিক নি-র্যাতন করেও ক্ষান্ত হয়নি মন শরীর কোনো টাই। উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে আরহামের পেরেক-বিদ্ধ হাতটায় পা দিয়ে পি-ষে ধরে বলল,
– এই হাত দিয়ে? এটা দিয়ে ছু-ড়ি চালিয়েছিলি তাইনা? আমার ভাইটাকে এটা দিয়ে খু-ন করেছিস নরপশু!
বলে পরপর দুবার পায়ে চেপে ধরে পি-ষে দিলো হাতটা৷ মন-মস্তিষ্ক, শরীরে যে জ্বালা ধরেছে তা ওদের কে-টে টু’করো টু’করো করলেও মিটবে না। উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক করে থপ করে মেঝেতে হাঁটে মুড়ে বসলো মেহরাজ৷ চোখ থেকে ঝড়ে পড়া অনবরত অশ্রু ধারায় সিক্ত মুখ, বুক। আহাজারি করে বলল,
– আমার বাবাকে মা’রলি, সন্তান টাও তোদের জন্যেই গেলো! আবার আমার ভাইটা! যে সারাটা সময় আমার ঢাল হয়ে সামনে থেকেছে ভালোবেসেছে তার মতো মানুষটাকেও শেষ করে দিলি তোরা? কী দোষ করেছিলো ও? আমার এই হাত দুটোয় আমার সন্তান আর ভাইয়ের লাশ ধরবার মতো অ-মানবিক য-ন্ত্রণা দিয়েছিস, তোরা! তোদের শরীরের এক একটা ফোঁটা রক্ত আমি রুদ্ধ পায়ে মা-ড়িয়ে বের করবো।
বলে আবারও উঠে এসে আরহামের মুখে এলোপাথাড়ি ঘু-ষি বসাতে লাগলো। ওর চোখের সামনে অভির প্রাণহীন মুখটা ভাসছে। যে মুখটা ওর রোজকার সাথী ছিলো, বেলা-অবেলায় যেই মুখটার পানে চেয়ে কতশত গোপন কথার ঝুড়ি রেখেছে সেই মুখটা হারিয়ে গেছে। পু-ড়ে ছাই হয়ে গেছে, যাকে বুকের ভেতর ভালোবেসে ভাইয়ের স্থানটা দিয়েছিলো সেই ভাইটা আজ ভস্ম হয়ে গেছে ওকে বাঁচাতে৷এতখানি যন্ত্রণায় দায়ভার, এই কর্জ কী করে চুকাবে মেহরাজ।
– থাম ভাই! ওকে আমার হাতে তুলে দে, আমি কথা দিচ্ছি তোকে দুটোকে ফাঁ-সির দঁড়িতে দুইদিন ঝুলিয়ে রাখবো আমি। একবিন্দু ছাড় পাবে না। থাম তুই, একটু ঠান্ডা হ
– কীসের ঠান্ডা। আমার জীবন থেকে যা কিছু ছিনিয়ে নিয়েছে তা যদি ওদের জ্য’ন্ত শরীরকে নেকড়ে দিয়ে ছি-ড়ে খাওয়াই তাও পরিশোধ হবে না। আমার ভাইটাকে ওরা কী করে মা’রলো পৃথক! ওদের কী হাত কাঁপে নি? বুকটা কাঁপেনি? তাহলে আমারও কাঁপবে না!
বলে উঠে গিয়ে আজহার মুর্তজার মুখ বরাবর লাগাতার লা-থি দিতেই থাকলো। পৃথক সর্বশক্তি দিয়ে পেছন থেকে মেহরাজকে ঝাপটে ধরে সরিয়ে আনলো। আজহার মুর্তজার চোয়ালের দাঁতগুলো ভে’ঙে রক্ত-পুঁজে বীভৎস, বিস্রংসী দেখাচ্ছে। মেহরাজ হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,
– ওদের বল এনে দিতে। অভিকে ফিরিয়ে দিতে৷ পারবে ওরা? আমি শ্রীতমার সামনে কোন মুখে দাঁড়াবো। মেয়েটাকে ফেস করার মতো ন্যূনতম শক্তি বা মুখ আমার নেই। নিঃস্বার্থ ভাবে আমায় ভালোবেসে কী পেলো ওরা? মরণ!
পৃথক জবাব দিলো না।আজও চোখের সামনে ভাসে দুটো রাত আগের ঘটনা। অভিমন্যু ইবনাতকে ফলো করার সময়েই নিজের ফোনের লোকেশন অন করে মেহরাজকে আগেই ইনফর্ম করেছিলো। ও যেই লোকেশন টায় এসে থেমেছে তা শহর থেকে বেশ দূরে। তৎক্ষনাৎ রওনা দিয়েও পৌঁছাতে কম হলেও আধঘন্টা লাগবেই। অভিমন্যুকে কু-প্রস্তাব দিলে সেটা নাকচ করে বেরিয়ে আসতে চাইলেও দেয়নি আজহার, আরহাম। সর্বস্ব হারিয়ে শেষ উপায় হিসেবে অভিকে হাত করার রাস্তাটাও যখন থাকলো না সেই রাগ আর ক্ষোভ উথলে পড়ছিলো। অভির লোকেশন ইনফর্ম করার ব্যাপারটা ধরতে পেরেই যেন খু’বলে উঠেছে ভেতরের প-শুত্ব। ওকে কোনো কথা বা কাজের সুযোগ না দিয়েই আজহার পেছন থেকে চেপে ধরলে এক মুহুর্ত ব্যয় না করে বিছানার তোশক উলটে চকচকে ধারালো জিনিসটায় সজোর লাগিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে অভিমন্যুর পে’টে৷ বিস্মিত, হতবিহ্বলতাকে ছাড়িয়ে আকস্মিক যন্ত্রণায় মুখ উগড়ে রক্ত বেরিয়ে এলেই থপ করে পড়ে অভিমন্যুর শরীরটা। ভাগ্যের এতটাই নিদারুণ নিষ্ঠুরতা মেহরাজ-পৃথক চোখের সামনে দেখে অভিমন্যুর ঢলে পড়া শরীরটা অথচ চোখের সামনে ওর মৃত্যু দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারলো না। ওকে বাঁচিয়ে নিজের গুরুদায়িত্বটা পালন করবার সুযোগ পাইনি মেহরাজ। ওর বুকে ফালের মতো যন্ত্রণা বিদ্ধ করে অভিমন্যু তৎক্ষনাৎ হারিয়েছে, রক্তের টান নেই এমন এক ভাইয়ের জন্য নিজের জীবনটা উৎসর্গ করে হারিয়ে গেছে চিরতরে। মেহরাজ নিজের সন্তানের মৃত্যুতে যতটা কষ্ট পেয়েছিলো তার চেয়েও তীব্রতর যন্ত্রণায় জ্বলছে ভাইয়ের বিচ্ছেদে৷ যেই ভাইটা ওকে বছর বছর ধরে সাহায্য করে আসছে যার উপরে নির্দ্বিধায় নিজের সমস্ত মূল্যবান জিনিসগুলো চোখ বুজে ছেড়ে দেওয়া যায়। তার মৃত্যুর যন্ত্রণা ঠিক কতটা সেটা যে হারিয়েছে সে ছাড়া কে বুঝবে আর।
দুটো ভারী শরীরকে মেহরাজ আর পৃথক টেনে গাড়িতে বসালো, র-ক্তে ভরে গেলো হাত। শরীররের জায়গা জায়গা থেকে মাং-স খসে খসে পড়ছে দুজনের। তবুও প্রাণবাতিটা নিষ্প্রভ হয়ে জ্বলছে। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানিটা এখনো চলমান। ঠিক যেন কৈ মাছের জান!
– আর একবার ভেবে দেখবি?
– ভাবনার চ্যাপ্টার অনেক আগেই ক্লোজ। এই কাজটা যদি আরও আগে করতাম। নিজের মনুষ্যত্ব টাকে আগেই বিসর্জন দিতাম তাহলে আজ আমার অমূল্য সম্পদটা হারাতে হতো না।
বলেই গাড়িতে ফ্রন্ট সীটে ড্রাইভারের আসনে বসে দরজা লাগিয়ে নিলো মেহরাজ। স্পীডের স্বাভাবিক সীমাটা ছাড়িয়ে যতটা দ্রুত সম্ভব ছুটিয়ে নিলো। সামনেই একটা খাদ। বিশাল সে গহ্বর৷ ইট-পাথরের স্তরের ভেতর গাছগাছালিতে ভরা৷ মেহরাজ এতটা দূর এসেছে শুধু ওদের জন্য, ভীষণ পরিকল্পনা করেই প্রতিটি য-ন্ত্রণা উসুল করবছে৷ স্কেলেটরে সজোড়ে পায়ের চাপ বসিয়ে স্টিয়ারিং বেকায়দায় ঘুরিয়ে নিলো। স্পীডটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে এক ধাক্কায় গাড়ির দরজাটা খুলে লাফ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। প্রচণ্ড বেগে ছুটন্ত গাড়ি থেকে পড়ে পায়ে, হাতের চামড়া ছিলে কপালেও লাগলো ভীষণ রকম। তবে সেই যন্ত্রণাটা উপলব্ধি করার আগেই ঝনঝন শব্দের তুমুল ঝংকার উঠলো। মেহরাজ মাটিতে পড়েই ঘাড় উচিয়ে দেখলো দুটো অ-মানুষের বিনাশ। গাড়ির সাথে খাদে গড়িয়ে পড়া দুটো প্রা’ণ। মানুষরূপী কুলাঙ্গার, মানুষ হয়েই মানুষের ভ-ক্ষক, নরপশু, বিষাক্ত সাপের মতো পা-শবিকতার একটা জীবন্ত উদাহরণকে গাড়ির সাথেই পাথরের ধাক্কায় চূর্ণবিচূর্ণ হতে নিজ চোখে দেখলো। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। বুকের ভেতর চাপা পড়া যন্ত্রণা গুলো যেন আবারও শূল বিঁধিয়ে দিলো। এতদিন যেই মানুষ গুলোর ভূমিকায় হাজারো মানুষের জীবনের স-র্বনাশ হয়েছে, কত প্রাণ বেঘোরে হারিয়েছে, কত মানুষের জীবনটা নরক হয়েছে কতশত পা-পের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে তাকে চোখের সামনে ধূলিসাৎ হতে দেখেও যেন শান্তি পেলোনা মেহরাজ। ইচ্ছে করলো লোহার চাপে বিধ্বস্ত, টু’করো হওয়া শরীর গুলোও তুলে এনে আগ্রাসী হয়ে আ-ঘাত করতে, তবে যেন মনের জ্বালা টা একটু হলেও দমে –
– স্যার আসবো?
দরজায় গায়ে বার কয়েক আঙুলের টোকা দিয়েও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অগত্যা এক প্রকার বাধ্য হয়েই মুখ ফুটে ডেকে উঠলো অর্ণব।
– ইয়েস কাম-ইন
অবশেষে এলো কাঙ্ক্ষিত অনুমতি সূচক জবাবটি। অর্ণব সমস্ত বিনয়ীতা, ভদ্রতা বহাল রেখে হাতভর্তি ফাইল নিয়ে এগিয়ে এলো। উত্তরের বিরাট জানালার কাঁচের দিকে একমুখী হয়ে তাকিয়ে লম্বা শরীরটা। অর্ণব নিঃশব্দে এগিয়ে এসে পেছনে দাঁড়ালো। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে অবলোকন করলো কালো প্যান্ট আর শার্টের ফরমাল ড্রেসআপে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটার পানে। অর্ণব একটা প্রশ্নের উত্তর কিছুতেই মেলাতে পারেনা – লোকটা কী সত্যিই বাংলাদেশি! ও অর্ধযুগ সমান অস্ট্রেলিয়া থেকেও এতো ফর্সা নাইবা এতটা অথেনটিক ফরেইন লুক অ্যাবজর্ব করতে পারেনি! আর এই মানুষটা বাংলাদেশি হয়েও এতটা ফরেইন লুক কীভাবে মেইনটেইন করেছে!
– দাও
গুরুগম্ভীর একটা স্বরে ভাবনাচ্যুত হলো অর্ণবের৷ দ্বায়িত্বশীল কর্মীর মতো ফাইল গুলো বসের হাতে তুলে দিয়ে নিজের কাজগুলো দেখিয়ে নিলো। অর্ণবের দেওয়া ফাইল গুলোতে সিগনেচার দিয়ে অর্ণবের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
– মি.গসলিকে বলে দিও আজকের সমস্ত প্রোগ্রাম ক্যান্সেল। আজ আমি অফিসে যাবো না।
– ওকে স্যার
বলে এগোতে নিলে ভরাট গলার ডাকটা আবারও কানে আসলো।
– আর বাকি সাইন গুলো তুমি করে দিলেই হবে অভি।
– ওকে স্যার। স্যরি বাট অর্ণব
শেষ কথাখানা অত্যাধিক ক্ষীণ স্বরে বলল অর্ণব। কিন্তু তা স্পষ্টভাবেই কানে এলো, বুকের ভেতরটা তিরতির করে কেঁপে উঠলো মেহরাজের। অর্ণবের ডাকে তিন বছর আগের স্মৃতিচারণ ভাঙলেও মস্তিষ্ক থেকে নামটা তো সরাতে পারেনি। ওর স্থবির মুখাবয়ব কায়েম থাকা অবস্থাতেই অর্ণব খুব কোমল গলায় বলল,
– স্যার কিছু মনে করবেন না একটা কথা জিগ্যেস করি? প্রায় দেড় বছর ধরে আপনার সাথে কাজ করছি তবুও আমার নামের জাগায় প্রতিবার অভি বলে ফেলেন কেনো? অভি নামের কেও কী আপনার খুব কাছের?
মেহরাজের বুক জুড়ে শৈথিল্য ছড়ালো। পুরোনো যন্ত্রণাটা এখনো নতুন ঘায়ের ন্যায় ব্যথানুভূত করালো। তবুও ক্ষীণ হেসে বলল,
– সাত বছরের অভ্যাসকে দেড় বছরেও পরিবর্তিত করতে পারিনি। অ্যানিওয়েস, ইউ মে লিভ।
অর্ণবের ভীষণ ইচ্ছে হলো সেই অভি নামক ব্যক্তিটার কথা জানতে যে কী না এই গুরুগম্ভীর, অনুদাত্তসভাব সূচক ব্যক্তিটারও এত কাছের। নিশ্চয় খুব স্পেশাল কেও? খুব বিশেষ! তবে সে সাহসটুকু আর অর্ণবের প্রাণাত্মা জুগিয়ে উঠতে পারলো না। বসের আদেশক্রমে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে গেলো৷ অর্ণব বেরিয়ে যেতেই মেহরাজ স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে এলো। ঝকঝকে, অত্যন্ত দৃষ্টিনান্দনিক বাড়িটার আরও দুটো ঘর পেরিয়ে ঢুকলো নিজের একান্তই ব্যক্তিগত ঘরটায়। যেটা প্রিয়জনের স্মৃতিগুলোকে জড়ো করে সাজিয়েছে, যার প্রতিটি কোণে মিশিয়ে রেখেছে ওর জীবনে মিশে থাকা প্রতিটি মানুষের স্মৃতি। বড় একটা সেল্ফ। গ্লাসের পাল্লাটা ভেদ করে স্বচ্ছ কাঁচের আড়ালে সগৌরবে জায়গা করে বসে থাকা ফ্রেমটা খুব আলগোছেই দেখা যায় বাইরে থেকে। মেহরাজ এসে দাঁড়াল সেই ছবিটারই সামনে। গোলগাল গড়নের লম্বা চওড়া ফর্সা সুদর্শন একটা মায়াভরা চেহারা। স্মিত হেসে দাঁড়িয়ে আছে ওর লাল রঙের গাড়িটায় হেলান দিয়ে। মেহরাজ এগিয়ে আসে।অনিমেষ তাকিয়ে থাকে ছবিটার পানে। বুক চিরে আসা অনুভূতি গুলো একত্রিত হয়ে কিছু বাক্যরূপে বেরিয়ে আসে মুখ থেকে
– তুমি হীনা তৃতীয় বছর অভি। তবুও তোমায় এক রত্নিও ভুলতে পারিনি দেখো। সবার মাঝে আমি তোমায় খুঁজি কিন্তু পাইনা। তোমার মতো করে আমায় কেও বুঝে নেয়না, যেভাবে তুমি সবটা বুঝে নিতে আমার কোনো বাক্যহীনাই। আমায় এতটা ভালো কী করে বেসেছিলে তুমি? কখনো তো মুখ ফুটে বলিনি তোমায় যে তুমি আমার ভাই! কখনো বুকে জড়িয়ে বলিনি যে তুমি আমার বুকের খুব বড়,স্নেহের একটা জায়গা জুড়ে থাকো। খুব ভুল করেছিলাম না বলে, তুমি যে এত জলদি আমায় ছেড়ে যাবে তা যে আমি বুঝিনি। তোমাকে খুব করে মনে পড়ে জানো! তোমার বোকা বোকা প্রশ্ন, বিব্রতকর চাহনি, একটা ভুল করার পর অপরাধীর মতো মুখটা আমায় এখনো অনুভব করায় যে তুমি হীনা আমি কতটা অচল। এআর ইন্ডাস্ট্রিজ এখনো টিকে আছে, মাথা তুলে আছে। তবে এখানকার সবচেয়ে যোগ্য মানুষটা নেই৷ আমি কাওকে নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারিনা ‘অভি তুমিই দেখে আসো আমার দেখা লাগবে না’। আমি এতবড় প্রতিষ্ঠানের মালিক হলে কী হবে, আমি যে তোমায় ছাড়া কতটা শূন্য তা তো বোঝাতে পারিনা!
– মে আই কাম’ইন স্যার!
নেত্রকোণে জমে আসা মুক্তবিন্দুর ন্যায় ফোঁটা গুলোকে মুছে নিলো মেহরাজ। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াসে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
– ইয়েস
তৎক্ষনাৎ এক বিশ বছর বয়েসী কিশোরী প্রবেশ করলো৷ পরনে তার হালকা গোলাপি রঙের ফ্রক,লালচে চুল গুলো বেণি করে রাখা। কোলে একটা দুই বছর সমান বয়েসী বাচ্চা। হাস্যজ্বল মুখে কিশোরী এগিয়ে এসে বলল,
– আভি ইজ ক্রায়িং স্যার। হি ডন্ট ওয়ান্ট টু প্লে উইদ মি অ্যানিমোর, হি ওয়ান্ট হিস পাপা।
মেহরাজ তৃপ্তিময় হাসলো। দুহাত বাড়িয়ে সাদরে কোলে তুলে নিলো আদুরে বাচ্চাটাকে। মেহরাজের কোলে উঠতেই কান্নায় লাল হওয়া গালটা প্রসারিত করে হেসে উঠলো ছোট্ট বাচ্চাটা, মেহরাজের বুকটা পূর্তিতে ভরে ওঠে৷ ক্ষীণ স্বরে বলে,
– হোয়্যার ইজ ম্যাডাম?
– ম্যাডাম হ্যাজ যাস্ট রিটার্নড, সি ইজ ইন হার রুম
মেহরাজ ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলে। মিষ্টি হেসে মেয়েটা বেরিয়ে গেলো। রোজ নামক বিদেশীনি মেয়েটা বেরিয়ে গেলেই মেহরাজ কোলের বাচ্চাটাকে নিয়ে এসে দাঁড়ালো আবারও সেই ছবিটার সামনে। দুই গালে স্নেহভরা চুমু এঁকে দিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো ছোট্ট তুলতুলে শরীরটাকে। বাচ্চাটাকে যেন প্রাণের মধ্যে লুকিয়ে নেয় মেহরাজ অকৃত্রিম স্নেহময়ে। মন্থর গলায় বলে,
– তুমি এত বড় একটা দ্বায়িত্ব আমার ওপর দিয়ে গেছো অভি আমার খুব ভয় হয়। আমার ভয় হয় যদি কখনো আমার ভুলেও এ দ্বায়িত্বের অবহেলা হয়ে যায়! যদি ভুলেও এর কোনো ত্রুটি রয়ে যায়! আমিতো নিজেকে আর মানুষ বলে পরিচয় দিতে পারবো না!
বলে খানিক থেমে সুগভীর নয়নে তাকালো নয়নের মণিটার দিকেই, মায়া ভরা স্বরে বলল,
– অভিরাজ একদম তোমার স্বভাব পেয়েছে জানো! একদম শান্তশিষ্ট, আদুরে আর মেহরাজ বলতে পাগল । ঠিক যেমন তুমি আমার সেরা সহচর ছিলে ওকে ও আমি তাই গড়ে তুলবো। আমার বাচ্চা ও, আমার ছেলে হয়েই থাকবে, বাঁচবে। তোমার স্যার বেঁচে থাকা অব্দি তোমার ছেলের কক্ষনো কোনো কষ্ট হবে না অভি। তুমি যেভাবে আমায় ভালোবেসেছিলে আমিও ঠিক সেভাবেই ওকে ও ভালোবাসি। ও আমার মানিক।
বলে আবারও খুব আদরে অভিরাজের কপালে চুমু দিয়ে ওকে নিয়েই বেরিয়ে এলো। কাঙ্ক্ষিত ঘরটির সামনে এসে দুবার আঙুলের টোকা দিয়ে বলল,
– ক্যান উই কাম ইন ম্যাডাম?
– ইয়েস
নারীকণ্ঠের চমৎকার সুমিষ্ট একটা গলার অনুমতি পেয়ে মেহরাজ ওর ছেলেকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই চোখ জুড়ালো তার প্রেয়সীর নরম চেহারায় তাকিয়ে। সাদা রঙের পা ছুঁইছুঁই একটা গাউন পরনে মোহরের মুখটা যেন মোহরের মতোই চকচকে আর আকর্ষণীয় লাগে মেহরাজের কাছে৷ ধীমি পায়ে এগিয়ে মোহরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
– ফ্রী আছেন ম্যাডাম?
– নিজের ছেলেকে নিয়ে একাই ঘুরছেন, আবার বলছেন আমি ফ্রী আছি? আমায় আমার দরকার হয় আপনাদের?
– হুস…এমন ভুল একটা কথা কীভাবে বললেন মোহ! আপনাকে রেখে আমরা কোথাই যাবো?
– থাক। একদম পটাতে আসবেন না আমায়, এত্ত আদর করি অথচ আমার ছেলেটা মাকে রেখে বাবার পেছনেই লেগে থাকে। বাবাকে ছাড়া তার চলেই না
– আর ছেলের বাবার যে আপনাকে ছাড়া চলে না বিবিজান।
মুহুর্তেই থমকে যায় মোহরের কপট অভিমান, দেখানো রাগ। কতগুলো বসন্ত পেরিয়ে গেলো, অথচ এখনো লোকটার এমন কথাগুলো মিইয়ে দেয় ওকে। লজ্জায় কাবু করে দেয়। মোহরের লজ্জার আব্রুতে ঢাকা মুখের কাছে মুখ এগিয়ে মেহরাজ বলে,
– যেদিকেই যাইনা কেনো, আমার পথ ঘুরেফিরে বৃত্তের মতো আপনিতেই এসে থমকে যাবে। রুদ্ধ’র সীমানা তার মোহ অব্দিই।
মোহর হেসে মেহরাজের কোল থেকে অভিরাজকে নিজের কোলে নেয়। দুই গালে চুমু দিয়ে বলে,
– আমার সোনাপাখিটা
খিলখিলিয়ে ওঠে বাচ্চাটা। ওর অমায়িক হাসির দিকে চেয়ে হুট করেই মুখটা মলিন হয়ে আসে মোহরের৷ বুকের কোণে ঢেকে গোপনে রাখা ব্যথাটা চিনচিন করে তার উপস্থিতি জানান দেয়। মেহরাজ যেমন অভিমন্যুকে দেখে ওর বাচ্চার মধ্যে মোহরও ঠিক সেভাবেই প্রাণপ্রিয় বন্ধবীটার রূপটাই খুঁজে পায় ওর বাচ্চার মুখে। মোহর আজও ভুলতে পারে না ওই বীভৎস যন্ত্রণা। সে বছরটা কত না বেদনার, পীড়ার দংশনে প্রাণটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। অভিমন্যুর মৃত্যুর পর শ্রীতমা পাগলপ্রায়। জীবনের একমাত্র সম্বল টা হারিয়ে নিজের মানসিক ভারসাম্যটাও খুইয়ে ফেলেছিলো। কত যত্ন, কত চিকিৎসা কোনো কিছুর ত্রুটি রাখেনি কেও। কিন্তু পারেনি, যেখানে ভাগ্য ওদের হারিয়ে দিয়েছে সেখানে গোটা কয়েক মানুষ গুলোর লড়াইটা জিতাতে পারেনি। অভি গত হওয়ার পর মাস দুয়েকের মাথায় জানা গেলো শ্রীতমা সন্তানসম্ভবা, অন্যদিকে ছেলের মৃত্যুশোকে অভির বাবার শারীরিক অবস্থার ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে, সবদিক সামলাতে ভেঙে, মুষড়ে পড়েন মাধুর্য ব্যানার্জি। শ্রী যেখানে স্বামী হারিয়ে জীবনের ক্ষীণ সুখটারও আত্মাহুতি হয়েছে সেখানে সন্তান আসার ফূর্তি টুকু কাজে দেয়নি শ্রীতমার। বরং অসুস্থ শরীরে একটা সন্তানের ভার যেন খুব বেশিই ওর কাছে। প্রেগন্যান্সির সময় কয়েকবার আত্মহ-ত্যা করার চেষ্টা করেছিলো যার দরুন ওর শরীরের স্ট্যামিনা, প্রতিরোধ ক্ষমতা, স্ট্যাবিলিটি এতটাই লো ছিলো যে প্রসবকালীন বেদনা সইতে না পেরে.. শ্রী যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত মোহরের হাতটা ধরে বলেছিলো,
“ আমার মতো আমার ছেলেটাকেও অনাথ হতে দিস না। আমার তো কেও ছিলো না কিন্তু ওর তুই আছিস। আর তুই আছিস বলেই আজ আমি স্বস্তির মরণ মরবো, শুধু আফসোস এতটুকুই ভগবান আমায় সবার সাথে ভালোবেসে বাঁচতে দিলো না ”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মোহর৷ এতটুকু বুকের মাঝে কতখানি যন্ত্রণা বুনে রেখেছে তার নকশাটা তো দেখানোর মতন না। বাবা-মা পরিবারের পর প্রাণের আপনজন ওর শ্রী। যেই শ্রীয়ের সাথে স্কুল,কলেজ,মেডিক্যাল শিক্ষাজীবন সবটাই শেষ করলো, শুধু পারলো না শেষ অব্দি একসাথে থাকতে। কত স্বপ্ন ছিলো দুজনার..কত কত আশা, শখ। কোনোটাই হলো না, অনাথ হয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে শেষে যখন একটু সুখের দেখা মিললো তাকেও হারানোর শোক টা একেবারেই নিতে পারেনি শ্রী। ও যে বরাবরই বড্ড দূর্বল, মানসিক শারীরিক সব দিকেই। মোহরের মনে পড়ে একসাথে কাটানো বেহিসেবী কত সহস্র স্মৃতি। শ্রীতমার চঞ্চল হাসিমুখ। অথচ আজ সবটাই স্মৃতি হয়েই রয়ে গেলো। শুধু রয়ে গেছে দীর্ঘশ্বাস,জড়ো করা স্মৃতি আর ওর গর্ভের অংশটুকু। যাকে মোহরুদ্ধ নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসে আগলে রাখে। জীবন তো সুখের চাদর আর যন্ত্রণা কাঁটা দুটোর সম্মেলনেই! তাই আমরা যতই চাই এমনটা না হলেও পারতো কিছু নিদারুণ নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটেই যাই আমাদের জীবনে। যাতে আমাদের করার কোনো ভূমিকা থাকে না, হয় মেনে নিতে হয় নয় মানিয়ে নিতে হয়।
….
অস্ট্রেলিয়ার শহরে রাতের পরিবেশ। নরম ফুরফুরে হাওয়ার তালে শীতল বাতাবরণ। রাস্তায় হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছে মোহরুদ্ধ৷ আজ ওদের বিয়ের চার বছর নয় মাস৷ ভাগ্য করটা অদ্ভুত হয় তাইনা! কীভাবে দুটো দু প্রান্তের মানুষ একসাথে জুড়ে যায়। যাকে কখনো কল্পনাতেও দেখেনি তার সাথেই সমস্ত জীবন আর জীবনের আশা জুড়ে যায়। মোহরের মনে হাজার বার প্রশ্ন এসেছে কীভাবে এই মানুষটা ওকে এতটা ভালোবেসে ফেললো! কীভাবে? এভাবেও ভালোবাসা যায় নাকি? কত বার জিগ্যেস করেছে, ‘একবার বলুন না আমায় কবে ভালোবেসেছিলেন’ প্রতিবারই জবাবে মেহরাজ আলতো হেসে ওকে আদর করে বলে, ‘ভালোবাসার আবার দিনক্ষণ হয় নাকি! ও তো হতে হতেই হয়ে যায়’। এর বেশি উত্তর কখনোই পাইনি মেহরাজের থেকে। তখন যেন মেহরাজকে একটা অদ্ভুত রহস্যপূর্ণ মনে হয়, ঠিক যেমনটা প্রথম প্রথম মনে হতো। মনে হয় লোকটার ভালোবাসাও কেমন রহস্যময়। মোহর আর ভাবে না ওসব, ও শুধু এখন একটু ভালো থাকতে চাই তাকে নিয়ে যাকে ঘিরেই বেপরোয়া, অবাধ্য, ভালোবাসা গুলোর উপচে পড়ে। দুজনের একে অপরের নামে হওয়ার আজ কতগুলো শরৎ পেরিয়েছে৷ তুখর গরমে পু’ড়ে, শরতের কত অজস্র কাশফুল পেরিয়ে, শীতের কতসহ প্রখরতা আর বসন্তের হাজারো প্রান্তর সমান ঝরা পাতা পেরিয়ে আজ দুজন এক। দুটো আত্মা, দুটো শরীর, দুটো মন আজও একইভাবে একে অপরের। পথিমধ্যে সয়েছে কতই না নিদারুণ নিষ্ঠুর পরিস্থিতি, ক্লেশ। হারিয়েছে জীবনের অবিচ্ছেদ্য কতগুলো অংশকে৷ জীবন তো সবদিকে পরিপূর্ণ হয়না, কিছুনা কিছু হারাতে হয় খোয়াতে হয়। বুকভরা দোয়া ছাড়া কিছুই থাকে না আমাদের হাতে।
মোহর মেহরাজের মতো পৃথক-তাথই ও আজ পরিপূর্ণ। তোয়ার একটা ছোট্ট বোন ও হয়েছে, সাঞ্জের বিয়ে হয়েছে মাস ছয়েক আগেই। ওর অ্যাবোর্সনের সময় যেই ডাক্তার ওর অপারেশন করেছিল তার সাথেই জুড়েছে ওর জীবন। ড.সোয়েব এহসান নিজ প্রস্তাব দিয়ে সাঞ্জের অতীত ওর ভুলগুলো সহই ওকে নিজের করে নিয়েছে। ফায়াজ আর ফেরেনি দেশে৷ সবকিছু ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করেছে। পরিবারের অনুরোধে তিয়াসাকেই সহধর্মিণীর রূপে গ্রহণ করেছে৷ মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও আজ ওরা সুখী দম্পতি। তবে সব সুখ তো আর সুখ হয় না, কিছু সুখ মানিয়ে নেওয়ার অভ্যেস ও হয়। এই যেমন ফায়াজ.. একজন স্বামী হিসেবে কোনো কিছুতেই ত্রুটি রাখেনা৷ নাইবা অন্তরে কোনো বিদ্বেষ পুষে রাখে। তবুও কখনো একেলা বিকেলে, শান্ত পরিবেশে যখন খোলা আকাশটা দেখে তখন স্মৃতির মানসপটে অকস্মাৎ ই একটা মুখাবয়ব ভেসে ওঠে, সেই মায়াবী, অতি সাধারণ চেহারাটা, সেই নিশ্চুপ মেয়েটা৷ কখনো বা ফোন খুঁজে একটা অবশিষ্ট ছবি বের করে দেখে নেয়, কখনো বা পারিপার্শ্বিক ব্যস্ততার চাপে ধামাচাপা দিয়ে দেয় নিষিদ্ধ অনুভূতির মতন। কিন্তু মন তো একটা অন্ধকার গুপ্ত গুহার মতন, সেখানে একবার কিছু জমে গেলে তার অবশিষ্টাংশ জীবাশ্ম হয়ে হলেও রয়ে যায় কোনো না কোনো খানে।
– আচ্ছা রুদ্ধ। একটা কথা বলুন তো!
মোহরের প্রাণচঞ্চল স্বরের সাবলীল প্রশ্নে মেহরাজ সায় দেয়,
– হুমম!
– আমায় কেনো এত ভালোবাসেন?
থেমে যায় মেহরাজের পদচারণ। স্থবির হয় চোখজোড়া। তা স্থিররূপে আবদ্ধ হয় মোহরের কৌতূহলী চোখে। জবাবে প্রশ্ন ছুড়ে বলে,
– এ কথা প্রতিবার আমাকেই শুনতে হয়। আজ আপনি বলুন তো কেনো ভালোবাসেন আমায়?
মোহর ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ বাঁকা হয়। ছোট্ট একটা প্রশ্বাস ছাড়ে। দুকদম এগিয়ে এসে মেহরাজের বুকে হাত রেখে বলে,
– যার চোখে মায়া দেখেছি, যার স্পর্শে ভরসা পেয়েছি, যার মাঝে চিরতর পেয়েছি। বরফের শিথিলতার কাঠিন্য ভরা দুনিয়ায় যার কাছে উঞ্চতা পেয়েছি তাকে ছেড়ে আর কাকে ভালোবাসবো।
মেহরাজের বুকটায় মৃদু কম্পনের উৎপত্তি হয়। প্রিয়তমার শব্দের সমাদরে পুলকিত হয় ওর দুনিয়াটা। এক টুকরো জান্নাত টাকে বুকে চেপে বলে,
– যেই স্বপ্নকে আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই, চোখ খুললেই তাকে বুকের মাঝে পাই। ভালোবাসার জন্য আর কী কারণ লাগে!
– বাহার আসছে রুদ্ধ
এক টুকরো শব্দে সমস্ত কায়ানাতে যেন সু-আবহ পরিস্ফুটিত হয়। দুজনের আপনিময় ভালোবাসায় ওদের অন্তরাত্মার সাথে পরিবেশটাও অন্যরকম লাগে একদম #মোহরুদ্ধকর 🖤
— সমাপ্ত।
#সারাংশ : সম্পূর্ণ অভাবনীয় ভাবে ঘটে যাওয়া এক বিয়ে, যা কী মায়ের মৃত্যুর দায় নিজের কাঁধে নিয়ে সমাজের চাপে এক অপরিচিতকে কবুল বলা আর তার হাত ধরে পারি দেওয়া অজানা এক রাজ্যে। যেখানে পদে পদে অপেক্ষা করে নূতন ঘটনা, রহস্য আর অভিজ্ঞতা। নিজের অতীতের যাথে সংযুক্ত পরবর্তী জীবনে হাজারো ঝড়ো-ঝাপটা পেরিয়ে এক টিকে থাকার লড়াই হলো ফানাহ্। ফানাহ্ – যার অর্থ ধ্বংস বা বিলীন হওয়া। যে ধ্বংস শুধু বাহ্যিকই নয় সমানভাবে অভ্যন্তরীণ ও। প্রতিটি চরিত্রে কোনো না কোন ভাবে ধ্বংস বা বিলীন হওয়ার গল্প ফানাহ্। কেও বা ভালোবেসে নিজেকে বিলীন করেছে কেও বা ত্যাগ করে। কেও বা নিজেকে বিলীন করেছে মাতৃক্ষুধা মেটাতে কেও বা নিজেকে বিলীন করেছে সম্পর্কে টান-মায়ায় জড়িয়ে। শুধু ভালোবেসে বা আত্মত্যাগেই বিলীন হয়নি সকলে কেও বা বিলীন হয়েছে লোভ, হিংসায়, কু-কর্মের দ্বারা আবার হয়েছে নিজের পাপ, অ’নৈতিকতার মাধ্যমে। ভালোবাসা-ঘৃণা, বন্ধন-শত্রুতা, ত্যাগ-লোভ এ মিলিয়ে প্রত্যেকটা চরিত্রের ধ্বংস বা বিলীন হওয়ার গল্প #ফানাহ্ ।
#পরিশিষ্টাংশ : ফানাহ্ গল্পটা আমার লিখা প্রথম ব্যাতিক্রমধর্মী অর্থাৎ থ্রিলার গল্প। গল্পে আমার অপরিপক্বতা আর অনভিজ্ঞতার কারণে বহু ভুল-ত্রুটির আখ্যান হয়তো মিলেছে, তবুও আমায় ভালোবেসে, প্রতিটা মুহুর্তে সাহস,ভরসা জুগিয়ে পাশে থেকে গেছে কতগুলো অমায়িক ভালোবাসার মানুষ। গল্পটা চলাকালীন বহু শারীরিক, মানসিক, পারিপার্শ্বিক, ব্যস্ততার শিকার হয়েছি। তবুও চেষ্টা করেছি লিখার আর সকলের মনঃপূত করে তোলার। তবুও যদি কোনো ক্ষেত্র আমার অজান্তে ভুল বা ছুটে গিয়ে থাকে তাহলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। এতগুলো দিন আমার পাশে থেকে সমর্থন করে ভালোবেসে যাওয়া মানুষ গুলোকে আমার কৃতজ্ঞতা। কতটুকু যোগ্য করে তুলতে পেরেছি আমি জানি না, তবে চেষ্টা করেছি সব প্রতিকূলতার সত্ত্বেও যথাসাধ্য। জীবন যেমন সবসময় সুখকর হয়না, সব খাতায় যেমন প্রাপ্তির নামটুকু লেখা যায় না ঠিক তেমনই কিছু গল্পে অপূর্ণতায়ই গল্প হয়ে যায়। আশাকরি এতদিনের মতো আজও আমায় সহোযোগিতা,দোয়া উপহার দিবেন। তাই ছোট-বড়, আমায় পছন্দ করা না করা প্রতিটি মানুষের জন্য আমার ভালোবাসা-স্নেহ-শ্রদ্ধা, সালাম। ❤️
#হুমাইরা_হাসান
#১৩ই_অক্টোবর_২০২৩।
গল্পটা সত্যিই একদম ভিন্ন ক্যাটাগরির,,,,,,,,all the best