ফানাহ্ পর্ব-৬৭

0
1051

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৬৭
#সমাপনের_অবতরণিকা
#হুমাইরা_হাসান
_______________________

– তোকে আমি বড্ড ভালোবেসে এনেছিলাম নিজের কাছে। নিজের বুকে করে বড় করেছি নাম দিয়েছি পরিবার দিয়েছি৷ কিন্তু তোকে একটা সুস্থ জীবন দিতে পারিনি। আফসোস হয়, নিজের উপর ভীষণ ঘৃণা হয় আমার। নাহয় থাকতাম আমি সারাজীবন বন্ধা হয়েই, তবুও তোকে কেনো আনতে গেলাম।যেই অভিশপ্ত জীবনের পাঠ চুকাতে তোর পরিবার টা হারালো আবারও সেই অভিশাপকেই তোর পরিবার করতে চেয়েছি আমি! কিন্তু বিশ্বাস কর বাবা, তুই আমার সাত রাজার হিরা। গোটা দুনিয়াটা আমার তোর জন্য। আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি তোর মা হয়ে উঠতে। বরং তোর জীবনটাকেই একটা জঘন্য খেলার গুটি বানিয়ে দিয়েছি

কথাগুলো বলতে বলতেই নতশির হয় মায়ের মুখ। অশ্রুজলে ভিজে যায় কপোল, কোল। মুখভর্তি কান্না আর চোখভর্তি অসহায়ত্ব, আফসোসের ক্লেশ। সকলের নীরবতাকে চ্যুত করে আবারও বলে,

– আজ যদি আমি তোকে এ দেশে না আনতাম তাহলে এত দুঃখ যন্ত্রণার ভার বইতে হতো না তোর। তোর বাচ্চাটাও তো আমার আনা খাবার খেয়েই…

আঁচলে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে উঠলো আম্বি খাতুন। বুকের ভেতর যে আত্মগ্লানির জলন্ত উনুন টা চলছে তার উত্তাপে ছারখার হচ্ছে বুক। মোহরের হসপিটাল থেকে ফেরার দিন পনেরো পার হতে চলল তবুও সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি আম্বি খাতুন৷ বিবেক, খেদোক্তির দংশন তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে। মোহর হাতটা তুলে আম্বি খাতুন কোলের ওপর রাখে। মোলায়েম সুরে বলে,

– জন্ম,মৃত্যু, বিয়ে, রিজিক সবটাই তো আল্লাহ্ তায়ালা হতে নির্ধারিত। আমরা মানুষেরা তুচ্ছ মাধ্যম মাত্র। আল্লাহ্ রুদ্ধ’র কপালে আপনার মতো মায়ের ভালোবাসা যেমন রেখেছিলো তেমনই হয়তো এই দুঃখ গুলোও রেখেছিলো। আমি সন্তান হারিয়েছি তার কষ্ট টা আমি বুঝি আপনি তো গর্ভে ধারণ করতে পারেননি আপনার যন্ত্রণাটা কে বুঝবে? একজন পাপ করলে কেও না কাওকে তো তা ভোগ করতেই হতো। তা বলে নিজেকে কেনো দোষারোপ করবেন মা! আমি বিশ্বাস করি, একদিন সবটা ঠিক হবে। দুনিয়াতে খারাপ থাকলে ভালোও আছে। আপনি শুধু দোয়া করবেন মা, যেই ছেলেকে নিজের সন্তান করে এনেছেন আপনার হয়ে সবার হয়ে প্রতিবাদ করে সে যেনো আপনার ভালোবাসা, স্নেহের দাম রাখতে পারে।

মোহরের আশ্বস্তপূর্ণ কথা গুলো শুনে একটু হলেও যেন শান্ত হলো আম্বি খাতুন। কিন্তু মনের ভেতর আকুলিবিকুলির ব্যগ্রতা মেহরাজ মুখ ফুটে কিছু বলবে। ছেলেটা যে আজীবন ই শান্ত, অমত্তই রয়ে গেলো। আম্বি খাতুন এক পলক তাকালেন ফিট্ খানেক দূরে বসে থাকা ছেলের পানে। যতবার চেয়ে দেখেন ততবারই মুগ্ধ হন আম্বি খাতুন। অত্যন্ত উজ্জ্বল গায়ের রঙ, পাতলা ঠোঁট, সরু নাক, কালো-বাদামী মিশ্রণের চুল,চকচকে ধূসর চোখটা যেন মুক্তাসম লাগে। ছোট বেলায় আম্বি যে কতবার ফোটা দিয়েছে কাজলের যেনো কারো নজর না লাগে। ওর চাঁদের মতো চেহারাটার জন্যেই তো আম্বি বড় সাধ করে নাম রেখেছিলো মেহরাজ অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ, চাঁদের রাজ্য। যেনো সত্যিই একটা চাঁদ। আম্বি কতবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেছে আর ভেবেছে সত্যিই কী এই চাঁদখানা ওর কোল জুড়তে এসেছে নাকি স্বপ্ন! আস্তে আস্তে মেহরাজ বড় হলো, দূরত্ব সহ গাম্ভীর্য আরও বাড়লো, সাথে তাল দিয়ে বাড়লো আম্বির সন্তানপ্রীতিও। যেন চোখে হারায়। এক পলক মেহরাজের মুখটা দেখে মাতৃক্ষুধা মেটায়।
সেই মেহরাজের চোখটা আজও স্থির,অটল, নিগূঢ়। কিন্তু আম্বির বুকে আজ যেন আকাশসম তৃষ্ণা, ব্যকুলতা। ছেলে তার একটা বার মুখ ফুটে কিছু বলবে। আম্বির প্রবল বাসনাকে ত্বরান্বিত করে মেহরাজ শীতল কণ্ঠে বলল,

– মা যেহেতু মা ’ই হয় তাই ছোট থেকে আপনাকে মা বলে যখন ডেকেছি আপনি মা’ই। শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ করবেন না। আমি হয়তো বলি কম, তবে অনুভব ও যে কম করি তা নয়। কিসমতের বেশি কেও পায়না। তাই যা হয়ে গেছে আমরা মেনে নিয়েছি। শুধু মেনে নেবো না অন্যায় গুলো। মুর্তজাদের দিন শেষ মা। আমাকে এ বিষয়ে কোনো অনুরোধ করবেন না, আমি রাখতে পারবো না।

– না না… কিসের অনুরোধ! ও পাপ আমি করবো না। এত বছর মুখ বুজে সব অত্যাচার সহ্য করে যে পাপ করেছি সেই হিসেব চুকাতেই আমার জীবন পেরিয়ে যাবে। তুই শাস্তি দে! ওদের শাস্তি দে। খুব নিষ্ঠুর রকম শাস্তি দে। ওরা শুধু তোর জীবনটা অতিষ্টই করেনি তোর বাবাকে হ’ত্যা করার মতো জঘন্য কাজটাও ওরাই করেছে

বিদ্যুতের ন্যায় ঝলকে উঠলো মেহরাজের চোখ। যেন বড়সড় তকমা লেগেছে। কপালের ভাঁজ গাঢ় করে ভারী গলায় বলল,

– মানে!

– হ্যাঁ তাই। সেদিন তোর বাবাকে শুধু বোঝাতেই নয় শেষ ব্যবস্থা টাও করেই গেছিলো দুই ভাই। মাজহাব ভাইকে যখন হাজার ভাবে বুঝিয়ে, হুমকিয়েও মতের পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি তখন চায়ের কাপে ওরা তার চোখের আড়ালে ড্রা-গ মিশিয়ে দিয়েছিলো যেটা খাওয়ার পরপরই তোর বাবার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া অস্বাভাবিক হয়ে যায়। ওটা এমনই ধরনের ড্রা-গ যেটা মানব শরীরে প্রবেশ করার পরই হৃদপিণ্ডে আক্রমণ ঘটায়। যার প্রবল ঝক্কি, যন্ত্রণায় দম বন্ধ হয়ে মানুষ মারা গেলেও মেডিক্যাল রিপোর্টে নরমাল হার্ট অ্যাটাক দেখায়। যেহেতু মাজহাব ভাইয়ের এর আগেও দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো তাই কেও নজরেই দেয়নি ব্যাপার টা আর ওদের রাস্তাও খুব আরামসে সাফ হয়ে গেছে।

এ যেনো চরম নিষ্ঠুর খুব অজানা সত্য ছিলো। মেহরাজ সবটা জানলেও এটা তো জানতো না! প্রবল উত্তেজনায় কণ্ঠনালী কেঁপে ওঠে। ঘৃণা, রাগে চোখ দু’টো যেন ঝলসে যায়। হাতের করপুট মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। মোহর আলতো নজরে লক্ষ্য করলো মেহরাজের নিথর ক্রোধ যা খুব আনায়াসেই লেলিহান হতে সময় নেবে না। ত্রস্ত গলায় বলল,

– এই কথাটা তো দিদা বলেনি?

– কারণ মা জানতো না। এই ঘটনা কেও জানতো না। আমি যে তার সহধর্মিণী আমাকেই কখনও জানতে দেইনি। মাজহাব ভাইয়ের মৃত্যুর পরে ওদেরই গোপন আলোচনায় আমার পদক্ষেপ পরে। সেদিন থেকে সবটা,সবকিছু খোলাসা হয় আমার সামনে। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিলো না, অসহায় ভাবে না মেরে বাঁচিয়ে রেখেছে আমায়। আমি যতবার প্রতিবাদ করতে গেছি ততবারই প্র’হার অ’ত্যাচারে তিক্ত হয়েছি।

ঘৃণা, রাগ, অসহায়ত্বের চুপকথায় সংমিশ্রিত অনুভূতিটা ঠিক কেমন হয় তা হয়তো বোঝানো সম্ভব নয়। ঠিক সেইরকম একটা প্রতিছাপই দৃশ্যমান হলো আম্বির মুখে। কেমন ব্যগ্র,অস্থির গলায় বলল,

– আমি! আমি দেবো সাক্ষী কোর্টে। তুই যা করার কর মেহরাজ। ওই অমানুষ গুলোকে শাস্তি দে। এতবছর মুখ বুজে থেকে যেই পাপ টা আমি করেছি আজ মুখ খুলে তার প্রায়শ্চিত্ত করবো তার জন্য জেলের ঘানি টানতেও আপত্তি নেই আমার।

মেহরাজ মুখ তুলে এক পলক চাইলো আম্বির পানে। শেষ মুহূর্তে এসে এই জবানবন্দি টুকু যেন সালফিউরিক এসিডের মতো ঝলসে দিলো সমস্ত ধৈর্য। এবার শুধু মহাকার্যটা সম্পন্ন করবার পালা।

•••

– আশু আমায় ভরসা করো?

বালিশটা হাত থেকে বিছানায় নামিয়ে রাখতে রাখতে থেমে গেলো হাত দুটো। তড়িৎ পেছনে ঘুরে পৃথকের অবিন্যস্ত রূপটার দর্শন যেন একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিলো তাথইয়ের নিকট। ভ্রুদ্বয়ে ব্যাপক কুঞ্চন ঘটিয়ে সকৌতুকে তাথই বলল,

– মানে?

– মানে আমায় ভালোবাসো না? ভরসা করো না?

পৃথকের সদা সর্বদার সাধারণ চেহারা আর এই চেহারাটায় যেন বিস্তর ফারাক।তাথইয়ের বিভ্রান্ত চেহারাটা পৃথকের অস্থিরতা টা যেন কয়েক কাঠি বাড়িয়ে দিলো। ত্রস্ত গলায় বলল,

– উত্তর দাও আশু

– বাসি।

যান্ত্রিকভাবে উত্তর দিলেও কেমন ব্যগ্রতা ঘিরে ধরলো। এগিয়ে এসে পৃথককে প্রশ্ন করার আগেই ওর বাহু দুটোয় চাপ পড়লো সৌষ্ঠব একটা হাতের৷ পুরুষালী গলাটা খানিক ধমকের তোড়েই বলল,

– আমায় ভরসা করো?

– করি

– তাহলে সাইন করো।

বলেই সাদা কাগজের বুকে টাইপ করা গোটা গোটা অক্ষরের ছাপযুক্ত একটা কাগজ তুলে দিলো তাথইয়ের হাতে৷ তাথই হাতের কাগজটায় একবার চোখ বুলিয়ে তাকালো পৃথকের দিকে। অস্ফুটে বলল,

– রেজিস্ট্রার পেপার!

– আমি আর এক মুহুর্ত তোমায় এ বাড়ি রাখবো না আশু। আর কোনো সম্পর্কের নাম ছাড়া তুমি যাবেও না। তাই আমরা বিয়ে করবো, আজ এখনই।

বলে পকেট থেকে একটা কলম বের করে ঘচঘচ করে সই করে দিলো কাগজের ওপর। এবার কলমটা তাথইয়ের সামনে ধরে বলল,

– এই শেষ বার বলছি আশু। আমায় যদি ভালোবসে থাকো তবে সাইনটা করে দাও নাতো এ জীবনে দ্বিতীয় বার এই কথা আমি পৃথক ইয়াসির মুখ দিয়ে বলবো না।

তাথইয়ের বুকটা কেঁপে ওঠে ভীষণ রকম। এ কী শুরু করলো লোকটা! এভাবে হুট করে এসে বিয়ের কথা বললেই কী করা যায়? দ্বিধাদ্বন্দে জর্জরিত মনটা পৃথকের এমন নিষ্ঠুর আচরণকেও মেনে নিতে পারছেনা। আড়ষ্টতভরা কণ্ঠে বলল,

– কিন্তু এভাবে হ..

– করবে কী না!

নাছোড়বান্দার মতো জেঁকে বসেছে জেদ। যা তাথই হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। কোনোরূপ অভিব্যক্তি ছাড়াই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলে পৃথক এক সময় পেপারটা হাতের মুঠোয় নিয়ে উল্টো পথে পা বাড়ালেই তাথই তটস্থ হয়ে পৃথককে থামিয়ে ওর হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে সই করে দিলো৷ অবিলম্বেই পৃথকের মুখ জুড়ে ভেসে উঠলো বাঁকা হাসির রেখা। একটা জয়ের উল্লাস। সেদিকে চেয়ে ছলছল চোখে তাথই কিছু বলবার আগেই পৃথক সগৌরবে এগিয়ে এসে তাথইকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে চুমু দিয়ে বলল,

– চলো যাই

– কোথায়?

পৃথক ভ্রু জড়ো করলো। যেন খুব বোকা একটা প্রশ্ন করে ফেলেছে তাথই। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

– বিয়ে করেছো স্বামীর ঘরে যাবে না? ওটাই তো এখন তোমার বাড়ি

বলে আর কোনো প্রশ্ন বা কৌতূহলের সুযোগ না দিয়ে বিছানা থেকে তোয়াকে কোলে তুলে নিয়ে আরেক হাতে তাথইয়ের এহ হাতের কবজি চেপে নিলো। ওকে নিয়েই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ডাইনিং রুম, বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে বাইরে এসে গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে তা সজোরে ছুটিয়ে নিলো তাথই এখনো স্তম্ভিত, বিস্মিত। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আদৌ কী হলো!

– এটা কী হলো?

– বিয়ে

সানন্দে জবাব পৃথকের। এতক্ষণে চেহারায় এঁটে রাখা কাঠিন্য, গাম্ভীর্যের ছাপ এক মুহুর্তেই উবে গেছে। মুখ জুড়ে কেমন বাঁকা হাসির রেখা। যেন রাজ্য সমান প্রাপ্তিটা নিজের খাতায় লিখিয়ে নিয়েছে। তাথই বিষন্নমুখে বলল,

– এটা কেনো করলেন আপনি? বাড়িতে একটা মানুষকে না জানিয়ে না বলে বিয়ে করে নিলাম! আবার এখন সাথে করে নিয়েও যাচ্ছেন? ভাই, মোহর, সাঞ্জে, দিদা ওদের কী জবাব দেবো আমি?

পৃথক স্টিয়ারিং এ এক হাত রেখে আরেকহাতে খুব সাবধানে তাথইকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,

– আমার বউকে আমি বিয়ে করেছি। কে কী বলবে!

বলে ঘাড়টা ঝুঁকিয়ে এনে তাথইয়ের কোলে ঘুমন্ত তোয়ার কপালে সাদরে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,

– এখন থেকে আমার বউ, মেয়ে দুজন আমার সাথেই থাকবে

– এটা কী করলেন পৃথক। কেনো করলেন? ঠিকাছে বিয়ে নাহয় করবেন, কিন্তু এভাবে?

তাথইয়ের মলিন মুখটা গাড়ি চালানোরত অবস্থাতেই একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো পৃথক৷ রুষ্টভাষী মেয়েটার মনে যে সবার জন্য কত দরদ সেটা মুখে প্রকাশ না করলেও ওর মায়া, সকলের প্রতি টান ঠিকই বুঝিয়ে দেয়। আলতো হেসে পৃথক বলে,

– সাঞ্জে, দিদা আর আন্টি তো ওদের ফ্ল্যাটেই। ওখানেই যাচ্ছি আমরা। মোহর মেহরাজ দুজনই জানে বিয়ের ব্যাপারে। ওখানে গিয়ে কবুল টাও পড়িয়ে নিবো লক্ষীটি আর ভাবতে হবে না এতকিছু ।

তাথই এর মলিন মুখটা কায়েম রইতে দেখে পৃথক এবার বলার ভঙ্গিমাটাতে খুব গুরুতর ভাব এনে ভারিক্কী স্বরে বলল,

– ও বাড়িতে থাকার দরকার নেই তা তুমি জানো। তবুও ছিলে শুধুমাত্র দিদার কথা ভেবে। মেহরাজ দিদাকে নিজের কাছেই রাখবে। মোহরই দেখাশোনা করবে। তোমাকে ও বাড়িতে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না, যে বাড়ির ভিত ঠিক নেই সেখানে থাকারও দরকার নেই। ও বাড়িতে এখন কী হবে তা বাড়িতে থাকা লোক গুলোও জানেনা।

তাথই শব্দ-বাক্য হীনায় রইলো খানিক৷ অতঃপর বেশ কাঠিন্যতা নিয়ে বলল,

– তাহলে এ কথাটা আমায় তখন বললে না কেনো? আর দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা বলবেন না মানে কী? আমি না করে দিলে কী ফিরে যেতেন? আর বলতেন না!

– কে বলেছে ফিরে যেতাম!

– তাহলে মিথ্যে ঢং করার কী দরকার ছিলো?

– মিথ্যে কোথায় বললাম? আমি বলেছি দ্বিতীয় বার বলতাম না। তা বলে কী করতাম না?

– কী করতেন?

– বিয়ে। দরকারে আঙুলের ছাপ নিতাম। তাও সুযোগ হাতছাড়া করার মানুষ নোই আমি।

তাথই বিনিময়ে আর একটা কথাও বাড়ালো না। বাকিটা পথ নিঃশব্দে পার করলো।

— সংবাদ মাধ্যম, পত্রিকা, নিউজ চ্যানেল সবটা জুড়ে এখন একই খবরের অট্টরোল। চারিদিকে স্ফীতি পরিবেশের হুল্লোড়। যেই সত্যটা বহু বছর ধরে সততার ভাবমূর্তির চেহারায় ধামাচাপা রেখেছিলো আজ তার রেশ ধরে জনমাধ্যমে সরব উঠেছে। পাপীদের পরিপূর্ণ খোলাসা না হলেও তাদের কু-কর্মের ছাপ-দাগ এখন লোকচক্ষুর সামনে। সকলে জবাবদিহি চাই, উত্তর চাই। যে মানুষ গুলোকে এতদিন ন্যায়-নিষ্ঠার রূপ হিসেবে ধরেছে, বিশ্বস্ত ভেবেছে তাদের এহেন রূপে অগাধ হৈচৈ তুলেছে। অস্ত্র-ব্যবসা, জা-ল ওষুধ এমনকি নে’শাদ্রব্য চালানের মতোই নিকৃষ্ট কাজের নজির এসেছে৷ এমনকি দেশের বিভিন্ন স্থানে মেয়ে, ছোট বাচ্চাদের অ-পহরণসহ বিভিন্ন যুবক ছেলেদের প্রলভন দেখিয়ে নিজেদের দলে টেনে নিয়ে পা’চার করেছে দেশের বাহিরে। দেশে ব্যবসার শীর্ষস্থানীয় বড় বড় মুখ এসব নৈরাজ্যে শামিল হয়েছে জনগণের নেপথ্যে। এখনো যেন সবটা ধোয়াশায়, অস্পষ্ট। হুট করেই একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণের মতো আম-জনতায় ঝড় তুলেছে এরূপ খবর। সুস্পষ্ট প্রমানের জরিপ এখনো আইনি মাধ্যমে খোলাশা করে যথাযথ প্রমাণ দর্শানো হয়নি বলে বিক্ষোভের অনুভূমিক্ত্বটা অনেক বেশিই। যাদের বিরুদ্ধে এই অপবাদ উঠেছে, সোচ্চার উঠেছে তার নিতান্তই শীর্ষস্থানীয় মুখ। যাদের সঙ্গে ওঠাবসা বড় বড় নেতা, রাজনৈতিক লীগের। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক মুর্তজা ব্রাদার্স এর নামটা শীর্ষে। যারা এতদিন সনামধন্য ট্রাস্ট, ফান্ড এবং নয়া-উদ্যোগ সহ বিভিন্ন মানবকল্যাণ অভিযান চালিয়েছে। বন্যা, দূর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির আওতায় দেশের সকল অঞ্চলে নিজেদের সেবা ত্রাণ পাঠিয়েছে তাদের নামটা দেখে জনগণের মুখ থুবড়েছে। মুর্তজা ব্রাদার্স নামে একটা কোম্পানি ছিলো যেখানে গরীব অল্পবয়সী, স্বল্পবিদ্যান ছেলেদের চাকুরির ব্যবস্থা করা হতো খুব সাবলীলায় সেখানে আটা-ময়দার নামে নে-শাদ্রব্যের চালান আছে বলে দাবী উঠেছে। কোর্টে এসবের প্রতিবেদন পেশ করেছেন স্বয়ং নব-ব্যারিস্টার পৃথক ইয়াসির সহ আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের সাহায্যকারীদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ও হাত আছে বলে জানা যায়…… উত্তপ্ত খবরে আজ দেশে হট্টগোল। চ্যানেলে চ্যানেলে শিরোনাম। নিজের ব্যক্তিগত কাজে বিদেশ থেকে ফিরে দেশে পা রেখেই গ্রেফতার হয়েছে ওয়াকিফ চৌধুরী এবং তার সাথে আরও দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মুর্তজাদের ধরতে পারেনি, সংবাদ মাধ্যমে নিজেদের কুকীর্তির খোলাসা দেখেই গা ঢাকা দিতে পলাতক হয়েছে। কোর্টে তাদের যতদ্রুত সম্ভব পেশ করার আপিল করেছে। কেও বা তাদের পক্ষে কেও বা বিপক্ষে সব মিলিয়ে তুমুল বাকবিতন্ডা। এসবের মাঝে কেও বা মেহরাজের নামটাও তুলেছে কারণ সেও মুর্তজা পরিবারেরই অংশ। এই বিষয়েও গুরুত্ব জারি করে কোর্টে মেহরাজের সমস্ত প্রোপার্টি, বিজনেস,ইনসাইডার সকল ব্যাপারে তদন্ত-ভ্যারিফাই করার আদেশ করেছে। কিন্তু বাপ-চাচাদের থেকে ওর ব্যবসা আলাদা থাকায় কোনো যুক্তি বা প্রমাণ দাঁড় করাতে পারেনি,কিন্তু সবটা এখনো জারি আছে।

~

– অভি, বাসায় ফেরার পথে আমার বাড়ি হয়ে যেও। শ্রীতমা এসেছে একটু আগেই।

– আচ্ছা স্যার

– আর কতক্ষণ লাগবে?

– হয়ে গ্যাছে স্যার। সমস্ত ফাইল ভ্যারিফাই করা শেষ। কোর্টের আদেশ অনুযায়ী পুলিশ এসেছিলো। সমস্ত ডিটেইলস তাদের হস্তান্তর করতেই বেশি সময় লেগেছে। এই তো শেষ কাজ।

মেহরাজ ‘আচ্ছা’ বলেই লাইনচ্যুত করলে। অভিমন্যু আবারও পিসির স্ক্রিনে মনোনিবেশ করে। থেকে থেকে আড়চোখে তাকায় অভি। বাইরে থেকে আসা লাইটের আলোতে মেঝেতে একটা ছায়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই অভি লক্ষ্য করছে একজন তাকে ফলো করছে, ওর ওপর নজরদারি রাখছে। ওকে ফোকাস পয়েন্টে রেখে বেশ অনেকক্ষণ ধরেই সমস্তটা নজরে রাখছে। অভি আড়চোখেই দেখতে পেলো ছায়ামূর্তি টা এক হাতে ফোন কানে চেপে রেখেছে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সরে গেলে অভিমন্যু নিজের কাজটা শেষ করেই বেরিয়ে এলো। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে নিলেও কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে না গিয়ে মোড় ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। সামনেই একটা মারুতি সুজুকির খয়েরী রঙের গাড়ি। তাকে অনুসরণ করেই একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলছে অভিমন্যু। ওরই অফিসের স্টাফ ইবনাত হক কে। বেশ কিছুদিন ধরেই অর চাল-চলন অন্যরকম লাগে। আবার আজ সারাদিন অভিমন্যুর ওপর ওর নজরদারি রাখার কাজটাও মোটেও সুবিধার নয়। বেশ আধঘন্টা একটা কাচা রাস্তা ধরে চলার পর দুইটা গ্রাম পেরিয়ে একটা পুরাতন স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ালো গাড়িটা। অভিমন্যু বেশ অনেকটা দূরে থাকায় নেমে হেঁটে এগিয়ে আসতে আসতে ইবনাত কোথায় যে হারিয়ে গেলো আর চোখে পেলো না অভিমন্যু। একা একাই পথ ধরে এগিয়ে সামনে দাঁড়ালে হুট করেই পেছন থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠে শুনতে পেলো,

– অভিমন্যু এলে! যাক, তোমার অপেক্ষায় করছিলাম।

অভিমন্যু পিছু ঘুরে তাকালে চোখ দুটি আপনা আপনিই প্রসারিত হলো। মনে মনে ভাবলেও এতবড় তকমা টা ওর জন্য অপেক্ষা করছে তার ন্যূনতম ধারণাটুকুও ওর মস্তিষ্কে আসেনি। সাদা রঙের পাঞ্জাবি পড়া মোটাসোটা শরীরের লোকটার মুখ জুড়ে ক্রুর হাসি। সে হাসি বিস্তর করে দু’কদম এগিয়ে এসে অভিমন্যুর কাঁধে হাত রেখে বলল,

– এসেই যখন পড়েছো তবে বোসো। এক কাপ চা খাও। দুটো কথা বলি।

বলে এভাবে সামনের দিকে অগ্রসর হলেন যেন অভিমন্যু তার পেছনে অনুসরণ করবে সে বিষয়ে সুনিশ্চিত। অভিমন্যু করলোও ঠিক তাই। হাঁটতে হাঁটতে স্কুলের পেছনে আধভাঙা একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকলে অভিমন্যুকে সস্নেহে বসতে বলল আজহার মুর্তজা। অবিন্যস্ত নজরে এদিক ওদিক তাকালো অভিমন্যু। দুই ভাই এমন একটা জনমানবশূন্য জাগায় এসে ঘাটি গেড়েছে যে খুঁজে বের করা টা খুব বেশিই দুষ্কর

– তা কী খবর অভিমন্যু ব্যানার্জি? কেমন চলে সব? ভালোই চলছে অবশ্যই, এআর ইন্ডাস্ট্রির সবটাই তো এখন তোমার কথায় চলে মেহরাজ তো শুধু ফাঁপা কলসির ন্যায়।

কথার মাঝেই আরহাম মুর্তজা এসে বসলো অভির পাশটায়৷ খুব ভদ্র সাবলীল একটা হাসি হেসে বলল,

– সবই যখন তুমি চালাচ্ছ তাহলে নামটাও তোমার করে নাও। কী বলো ভালো হবে না?

অভিমন্যুর কপালে ভাঁজ পড়ে। ক্রোধ, বিরক্তির চেয়ে অবজ্ঞাবোধ বেশি আসে। কড়া গলায় বলে,

– কী বলতে চাচ্ছেন?

– খুব সহজ। তুমি চাইলেই ব্যবসা টা পুরোটাই নিজের নামে করে নিতে পারো। আমরা নিজেরাই তোমাকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করবো।

অভিমন্যু হাসলো। তাচ্ছিল্য ভরা সেই হাসি৷ যার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে একটুও অসুবিধা হলো না বাকি দুজনের৷ হাসির মতোই তাচ্ছিল্যের স্বরে অভিমন্যু বলল,

– যাদের নিজেদেরই কোনো গ্যারান্টি নেই তারা কী না করবে আমায় আশ্বস্ত? হাসালেন স্যার।

বলে উঠে দাঁড়ালো। খুব দাম্ভিকতা নিয়েই বলল,

– আমার যা আছে তা নিয়েই আমি খুশি। আমাকে নিয়ে না ভেবে নিজেদের নিয়ে ভাবুন

বলে বেরিয়ে আসতে নিলে আরহাম উঠে দাঁড়ালো। ওকে পেছন থেকে ডেকে বলল,

– লক্ষীকে পায়ে ঠেলে দিতে নেই। জানো না? কত কোটি তোমার নামে হবে কোনো আইডিয়া আছে?

– আছে। আর না থাকলেও দরকার নেই।

– আছে। ওপর ওপরে এতো আনুগত্য পুষলেও মনে মনে সবাই টাকার কাঙ্গাল। আর তুমিও তার ব্যাতিক্রম নও। ছোট্ট একটা সিদ্ধান্ত আর সবটা তোমার পায়ের কাছে!
.
.
.
চলমান

#হীডিং : ‘চলমান’ শব্দটা হয়তোবা আর এগোবে না। খুব সম্ভবত এক কিংবা দুই পর্বের মধ্যেই শেষ হতে চলেছে ফানাহ্।

#Humu_❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে