ফানাহ্ পর্ব-৬৬

0
1091

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৬৬
#হুমাইরা_হাসান
__________________

– আমার বাচ্চা টা কোথায় বুবু?

ব্যাগের চেইনে রাখা হাতটা ওমনিই থেমে গেলো। যেন একটা তীক্ষ্ণ হূল এসে বিঁধলো বুকে। টলমল চোখে ঘাড়টা ঘোরাতে গিয়েও পারলো না৷ কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,

– তোর সকালের মেডিসিন গুলো কী নার্স দিয়েছে রে মোহর? আমি তো বুঝছিনা কিছুই

মোহর কনুই এ ভর দিয়ে উঠতে চাইলো। কিন্তু পেটের যন্ত্রণায় খিল ধরে এলো চোখ মুখ৷ মিথিলা নিজেই এগিয়ে এসে ওকে ধরে কোনো মতে ঠেস দিয়ে বসালো। নম্রমুখে বলল,

– কিছু লাগবে তোর?

মোহর ঘাড় নাড়িয়ে না বোধক উত্তর করলো। লম্বা দম ছেড়ে ক্ষীণ গলায় বলল,

– উনি কোথায়? কেও নেই কেনো? সাঞ্জে, তাথই আপা…মা কোথায়?

মিথিলা স্যুপের বক্স টা আনপ্যাক করে ঢালতে ঢালতে বলল,

– আন্টির শরীর টা হুট করেই খারাপ করেছিল। তাই উনাকে নিয়ে সাঞ্জে বাড়িতে গেছে৷ তাথই সারারাত ঘুমাইনি,সকালেই ফিরেছে ফ্রেশ হয়ে আসবে এখনি। আমি রাতে বাড়ি চলে গেছিলাম ইফাজ মাত্রই রেখে গেলো আমায়। ঝুমুটার শরীর ভালো না তো ওই দেখে রাখছে ওকে। আর শ্রীতমা এখানেই ছিলো তো! তোর কয়েকটা মেডিসিন আনতে গেছে পাশেই

– রুদ্ধ কোথায় বুবু?

মিথিলা স্যুপের বাটিতে চামচ নাড়তে নাড়তে হুট করেই থেমে গেলো। কেমন শুকনো মুখে মোহরের সামনে বসে বলল,

– চলে আসবে।

– চলে আসবে মানে! কোথায় ও? আর আমার বাচ্চাটাই বা কোথায়? ওকে দেখছিনা কেনো? এই সিজনে বেশিরভাগ বাচ্চাদের নিউমোনিয়া হয়, ওকে সাবধানে রাখতে হবে৷ আমার কাছে দে ওকে ওর মুখটা একটা বারের জন্যেও দেখলাম না এখনো।

মোহরের কথা শেষ হতে হতেই শ্রীতমা ঢুকলো। পেছনে পৃথক আর তাথই ও আসলো। ওদের দেখে মিথিলা খানিক হাসার চেষ্টা করে বলল,

– আরে তাথই! একসাথেই এলে যে

– আমি ওষুধ নিয়েই ঢুকছিলাম তখনই পৃথক ভাইয়া এলো আপাকে নিয়ে। তাই একসাথেই এলাম

ওদের কথার আবহে বেশ স্বাভাবিকত্বে থাকলেও মোহর ক্ষান্ত হলো না। পৃথক এগিয়ে এসে ওর পাশে বসে মাথায় হাতটা ছুঁয়ে বলল,

– এইতো সুস্থ হয়েই গেছো অনেকটা। আল্লাহর কাছে লাখো শুকরান তুমি এখন সুস্থ। এখন শুধু তোমায় বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার পালা।

– আমার বাচ্চাটা কোথায় ভাইয়া? আপনারা আমার প্রশ্ন টাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেনো?

মোহরের মাথায় রাখা পৃথকের হাতটা যেন স্থানেই থমকে গেলো। টন সমান ভারে নড়চড় করার সামর্থ্য হলো না। পৃথক ব্যাথাতুর মনে হাতটা নামিয়ে নিয়ে কেমন জড়তা ভরা গলায় বলল,

– মোহর.. দেখো তুমি তো সবই বোঝো। ভাগ্যের উপর তো আমাদের হাত নেই আ..

– এতকিছু কেনো বলছেন? এসব তো শুনতে চাইনি! আমার বাচ্চাটা কোথায় সেটা বলুন

তবুও ওদের নিরুত্তর মুখটা দেখে মোহর আঁতকে উঠলো। শানিত ভঙ্গিমায় বলল,

– কী হয়েছে? আর ওই লোকটা কোথায়? কোথায় আছে সে, ডাকুন। রুদ্ধকে আমার কাছে ডাকুন লোকটা কোথায় গেছে?

চিৎকার করে উঠলো মোহর। শ্রীতমা এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরে বলল,

– মোহর শান্ত হ। এমন অস্থির হোস না। তোর শরীর এতটা প্রেসার নিতে পারবে না।

– আমার বাচ্চাটা মরে গেছে?

যেন ঠান্ডা শীতল গলায় একটা আস্ত স্ফূলিঙ্গ নিঃসৃত হলো। মোহর যতটা স্থবিরতা নিয়ে কথাটা বলল, ততটাই উন্মত্ততা নিয়ে চোখ দু’টো ভিজে এলো। মিথিলা, তাথই নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। নাইবা প্রত্যুত্তরের ভাষা জুটলো পৃথকের৷ মোহর আবারও মন্থর গলায় বলল,

– আমার বাচ্চাটা বাঁচতে পারেনি তাই না? মরেই গেলো! বিষের বিষক্রিয়া আমার বাচ্চাটাকে বাঁচতে দিলোই না?

কথাখানি শুনতে যতটা সাবলীল শোনালো আদৌ তার ভার কতখানি তা কী ব্যক্ত করা সম্ভব! সন্তানহারা মায়ের নিজ মুখে স্বীকারোক্তি কতটা দূর্বিষহ হতে পারে!

– একটা বার আমায় দেখালে না? একটা বার আমার বাচ্চাটার মুখ দেখতে পারলাম না আমি? কেনো ডাকোনি কেনো দেখাওনি তোমরা!

চিৎকারে বুক ফাটলো মোহরের। পাজরের হাড় গুলো যেন চূর্ণবিচূর্ণ হলো। তাথই এগিয়ে এসে মোহরকে দুহাতে জড়িয়ে বলল,

– শান্ত হ মোহর। আর কাঁদিস না। জন্ম, মৃত্যু যার হাতে তার সাথে কে লড়বে বল? চেষ্টা তো সবাই করেছিলো।

যেই বিধ্বংসী ঝড়টায় ও মুখ থুবড়ে পড়েছে তার সামনে এই ছোট্ট সান্ত্বনা টুকু নিষ্ফলা। মোহরের চিৎকার, কান্নার সরবে কয়েকজন স্টাফ, নার্স এসে দরজার কাছে জড়ো হলেও আচানক পেছনের কিছু একটা লক্ষ্য করে সব সরে সরে দাঁড়ালো। আড়ষ্টিত মুখাবয়বে আবারও যে যার কাজে ফিরে গেলে শূন্য দুয়ারের চৌকাঠ মাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো একটা শরীর। স্থবির, নিস্ক্রিয়, প্রাণহীন। আস্তেধীরে বিড়াল পায়ে এগিয়ে এসে মোহরের সামনে দাঁড়ালো। যেন কুখ্যাত আসামী দাঁড়িয়ে কাঠগড়ায়। মোহর বিবশ মুখে কান্না থামিয়ে ভীষণ নিরাধার কণ্ঠে বলল,

– আমায় নিয়ে চলুন। যেখানে আমার বাচ্চাটাকে মাটির নিয়ে চা-পা দিয়ে এসেছেন সেখানটাই একবার নিয়ে চলুন আমায়!

– তুই এই অবস্থায় সেখানে কী করে যাবি? তোর হাঁটাচলা করা আপাতত নিষেধ

শ্রীতমার কথা কানে পৌঁছুলো না। মেহরাজ ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালে একটা নার্স এগিয়ে এলো হুইলচেয়ার ঠেলে। যেন আগেই সবটা আদেশকৃত ছিলো। মেহরাজ মোহরের হাঁটু আর ঘাড়ের পেছনে হাত গলিয়ে কোলে তুলে হুইলচেয়ারে বসিয়ে এগিয়ে গেলো। কারো প্রশ্নের উত্তরহীনায় এগিয়ে গেলো নিজ গন্তব্যে। হুইলচেয়ারে বসা রোগে আড়ষ্ট শরীরটা কেঁপে কেঁপে ওঠে কান্নার তোড়ে। যাদের বুকে ছিলো উচ্ছলতা, বাবা-মা হওয়ার স্বর্গীয় খুশি, বুকভর্তি প্রাণোচ্ছল আশা আজ তা মাটির নিচে। ধীমপায়ে এগিয়ে গেলো মেহরাজ। গাড়ির সামনে এসে আবারও কোলে তুলে মোহরকে গাড়ির সীটে বসিয়ে দিয়ে পাশটায় বসে ইঞ্জিন হাঁকিয়ে নিলো। নীরবে, সরবহীনায় সারাটা রাস্তা পার করে এসে দাঁড়ালো জনমানবহীন একটা স্থানে। বসতি হতে খানিকটা দূরে ইটের প্রাচীরে ঘেরা আবদ্ধ বিশাল এক উন্মুক্ত প্রান্তরের ন্যায়। যেখানে শুয়ে আছে হাজারো মানুষের কলিজার ধন, আদরের সন্তান, ভালোবাসার বাবা, মমতার মা৷ কতশত ভালোবাসা, অমূল্য স্নেহের টুকরো গুলো শায়িত আছে নিশ্চল ঘুমে। মাটিতে মিশে যাওয়া সেই হাজারো শরীরের ভিড়ে এক টুকরো জায়গাটা দখল করে আছে ওদের হৃদয়ের টুকরোটা৷ মেহরাজ মোহরকে নিয়ে এগিয়ে গেলো, পায়ের গতি অবিচল, এলোমেলো, অবিন্যস্ত হলো। মনের ভেতর একটা অপার্থিব কণ্ঠ বলে উঠলো ‘গোরস্থানে মেয়েদের যাওয়া নিষেধ? যদি যায় তবে খুব কী পাপ হবে? সন্তানের মুখোদর্শন হীনায় বিচ্ছেদে যেই মায়ের বুকটা অজস্র আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলো তাকে এইখানটায় এনে যদি একটু শান্তি দেওয়া যায় তবে খুব কী পাপ হবে? ধীমি পায়ে এগিয়ে গিয়ে মোহরকে নামিয়ে দিলো মেহরাজ। মানুষ হেঁটে যাওয়ার রাস্তার কোণঘেঁষেই ছোট্ট বেড়ায় ঘেরা কবরটা৷ চলার পথেই যেটা অবলীলায় ছুঁয়ে দেওয়া যায়, যার দরুন ভেতরে প্রবেশ করার প্রয়োজন হলো না ওদের নাইবা নিয়ম শৃঙ্খলা ভাঙার ৷ রাস্তার ধারে মাটিতে বসে কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে বাঁশের বেড়ার ফাঁকে হাত গলিয়ে দিলো। নড়বড়ে হাতের স্পর্শে জমি হতে খানিক উঁচু মাটির স্তূপটা ছুঁয়ে দিলো তৃষ্ণার্ত হাতে। বুকের মাঝের পাঁজরের ভেতরে যেই স্থানটা থাকে! যন্ত্রণা গুলো ঠিক সেইখান থেকে ছড়িয়ে সারাদেহে ছড়িয়ে পড়লো৷ নিস্তব্ধতায় অবরুদ্ধ গোরস্তানের দেওয়ালে দেওয়ালে বারি খেলো একটা চাপা আর্তনাদ। কোলশূন্য মায়ের মাতৃত্বের বিসর্জনের আর্তনাদে কেঁপে উঠলো যেন সমস্ত প্রকৃতিটাও৷ অদ্ভুত, অঘোর, মর্মান্তিক আর্তচিৎকারে ফেটে পড়লো মোহর। বাঁশের তীক্ষ্ণ ফালের খোঁচাতে হাত দুটোর চামড়া ছিড়ে গেলেও ক্ষান্ত হলো না! অতৃপ্তের ন্যায় হাত দুটো বুলিয়ে দিলো নিজ সন্তানের কবরটায়। মায়ের বুকভাঙা আহাজারি, কাকুতিমিশ্রিত অশ্রুতে ভিজে গেলো কবরের নরম মাটি গুলোও৷ অকস্মাৎ পিছু ঘুরে পা দুটো চেপে ধরলো নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা মেহরাজের। কান্নার তোড়ে ককম্পমান গলায় বলল,

– আমার বাচ্চাটাকে এনে দিন রুদ্ধ। ওকে ফিরিয়ে দিন। আমার কোলের রত্ন টাকে এভাবে মাটিতে মিশতে দেবেন না! ও আমার মানিক, ওকে কেড়ে নিলে আমার থাকলো কী! আমার নিষ্পাপ বাচ্চাটার তো কোনো দোষ নেই ওকে কেনো এতো বড় শাস্তি দিলো!

মেহরাজ দুবাহু ধরে দাঁড় করালো মোহরকে। ওর এই কান্না,এই আহাজারি মেহরাজের বুকটা এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে। মোহরকে সরিয়ে এনে বলল,

– কাঁদবেন না মোহ। আর কাঁদবেন না, আমাদের সন্তান হারাইনি। ও চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে আমাদের মাঝে। আমার আপনার ভালোবাসার মাঝে৷ জান্নাতের একটা ফুল দিয়েছিলো খোদা তায়ালা, তাকে সেখানেই ফিরিয়ে নিয়েছে, আমরা কী করতে পারি বলুন। আর কাঁদবেন না দোহাই আপনার।

মোহরের বুক হতে যে যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়েছে তা ওর সমস্ত শরীর নিঃসাড়কালের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। শরীরের ভার ছেড়ে বুকে লুটিয়ে পড়লো মেহরাজের।

•••

নিস্তব্ধতায় ঘেরা ঘরটায় থেকে থেকে গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। নিঃসাড় দেহে ধূলোময়লার স্তূপের মতোই পড়ে আছে দুটো মেয়েলী শরীর। খট করে দরজা টা খোলার শব্দে ভেজা চোখ দু’টো চিকচিক করে ওঠে। দরজার ফাঁক দিয়ে আসা তীক্ষ্ণ আলোর রেখা চোখে পড়তেই খিঁচিয়ে নিলো চোখ জোড়া। ঠিক কতদিন পর আলোর রেখা দেখছে আদৌ? মনে আছে! নাহ তো.. অন্ধকারে দুটো শরীর কুকুরের মতো হাত পা গুটিয়ে বসলো মানুষের পদধ্বনি শুনে। চোখ ভর্তি ভয়কাতুরে দৃষ্টি, ছোক ছোক জাতীয় শব্দ করছে মুখ দিয়ে। ক্ষীণ পায়ে লম্বা অবয়ব টা এগিয়ে এলে মাটি ছ্যাঁচড়িয়ে এগিয়ে এলো একটা শরীর। কালো কুচকুচে জুতায় জিহ্ব ঠেকিয়ে বলল,

– পা..পা্ পানি

শ্বাপদের ন্যায় হিংস্রাত্মক চাহনিটার একচুল নড়চড় হলো না এমন চোখ খিঁচিয়ে নেওয়া দৃশ্যেও। নিজের পা এক টান দিয়ে সরিয়ে আনলো। কয়েক কদম এগিয়ে বস্তার একটা স্তূপের পেছনে হাত গলিয়ে খট করে একটা শব্দ করতেই টিমটিমে একটা হলুদ আলো জ্বলে উঠলো। সেই আলোতে চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিলো দুজনেই। মাটিতে মুখ থবড়ে গুঙিয়ে উঠলো। স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে ছোপছোপ রক্তের দাগ। দুজনের হাতেও রক্ত, পুঁজের জমাটবদ্ধতা লক্ষ্য হলো৷ ভয়ানক ক্ষুধায় অতিষ্ট শরীরে নিজেরাই যে নিজেদের হাতের মাংস খু’বলেছে তা ওদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এইরকম বিভৎস একটা দৃশ্যেও চোখ মুখের এতটুকু পরিবর্তন হলো না, খ্যাচখ্যাচ শব্দ করে চেয়ার টেনে বসলো৷ ওর হিংস্রাত্মক রূপ,ভয়ংকর চাহনি দেখে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো রুকাইয়া। এগিয়ে এসে ওর পা ছুঁয়ে বলল,

– ক্ষমা করে দাও আমাকে। এভাবে যন্ত্রণা আর দিও না পায়ে পড়ি!

পাশে রাখা ব্যাগটা থেকে ছোট্ট একটা শিশি বের করলো খুব সাবধানে। রুকাইয়ার প্রবল আতঙ্কপ্রসূচ চেহারাটায় চেয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বলল,

– আমার নিষ্পাপ বাচ্চাটা কী করেছিল তবে! ওকে কেনো মারলে?

– র্ রাগ! হিংসে। আমার ছেলেকে অ’ত্যাচার করে মে’রে তোমরা সুখে সংসার করবে এটা স্ সহ্য হয়নি.. আ – আমার ভুল হয়েছে, ক্ষ্ ক্ষমা

পুরোটা সসম্পূর্ণ করার আগেই মেহরাজ একটা কাঁচের ছোট্ট শিশি ওর সামনে ধরে সামনের দিকে ইশারা করে বলল,

– ওকে দিয়ে বিষ মিশিয়েছিলে না? একই বিষ ওকে নিজ হাতে খাইয়ে দাও..তাহল…

মেহরাজ কথাটার শেষ অব্দি পৌঁছানোর আগেই রুকাইয়া এক হাত দিয়ে খপ করে ছিনিয়ে নিলো ওষুধ টা। উদ্দাম হয়ে ছুটে গেলো উগ্র শেয়ালের মতো। মেঝেয় পড়ে থাকা মালার চুল ধরে মুখ তুলে ঢেলে দিলো শিশিতে থাকা সমস্ত তরল। নিস্তেজ দেহটা প্রবল ঝক্কি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে রুকাইয়া হামাগুড়ি দিয়ে এসে উদ্ভ্রান্তের মতো বলল,

– পানি.. পা্ পানি

মেহরাজ পাশ থেকে একটা পানির বোতল হাতে তুলে নিতেই রুকাইয়া কোনো দিক না ভেবে মেহরাজের হাত থেকে বোতলটা ছিনিয়ে নিয়ে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে সাবাড় করতে লাগলো কিন্তু অর্ধেকটা শেষ করার আগেই হাত থেকে থপ করে বোতল টা পড়ে গেলো৷ কালচে বোতলের ভেতরের রঙিন তরল টা মেঝেতে পড়ে তিতকে বাদামের ন্যায় গন্ধ ছড়ালো। রুকাইয়া কেমন শ্বাসরুদ্ধকর রক্তচক্ষুতে মেহরাজের দিকে তাকালে মেহরাজ স্মিত হেসে বলল,

– পাপ বাপকেও ছাড়ে না। যার কথায় খাবারে বিষ মেশালে সে নিজেই তোমার মুখে বিষ ঢেলে দিলো,আর যেইভাবে অন্যকে মা’রতে বিষ মিশিয়েছিলে সেইভাবেই নিজ হাতে বিষ করিলে পান। এখানে আমার ভূমিকা টা প্রায় শূন্যের কোঠায়।

রুকাইয়া নীলাভ মুখে তাকিয়েই রইলো সুস্থির সুদর্শন এক বিদেশি চেহারার যুবকের পানে। আধমরা শরীর টা খুব সন্তপর্ণে পরিপূর্ণ ভাবে নিস্তেজ হয়ে গেলো। মেহরাজ অনিমেষ তাকিয়ে রইলো গলা কা’টা মুরগীর মতো ছটফটানো দেহ দুটোর দিকে। নিজের হাত দুটো সামনে এনে ধরলো, ভীষণ অসহায় নির্বিকারচিত্তে তাকিয়েই মনে পড়লো এই হাত দুটো দিয়েই নিজ সন্তানকে মাটিতে শুইয়েছে, ওর শরীর মাটিতে সমাধি করেছে। একজন বাবার কাছে তার সন্তানের লাশের ভার কতখানি তা শুধু সেই বুঝবে যে তার ভার বয়েছে।

……..

সময়ের তালে তাল মিলিয়ে হারিয়ে যায় অজস্র সময় মুহূর্ত আর তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। শুধু রয়ে যায় তার যন্ত্রণার রেশটুকু। মানুষ খুব যতনে তা বুকে পুষে রাখে। আজ অষ্টমদিন মোহরের হসপিটাল থেকে ফেরার। মালাকে ও বাড়ি থেকে তাথই নিজে এনে ফেলেছে মেহরাজের সামনে। রুকাইয়াকে তুলে আনতেও খুব অসুবিধে হয়নি। পরপর তিনটে দিন অন্ধকার ঘরের স্যাঁতসেঁতে জাগায় বন্দী রেখে চতুর্থ দিনেই মুক্ত করেছে ওদের মেহরাজ, দুনিয়া থেকে মৃতসম যন্ত্রণা থেকে। যার জন্য নিজের সন্তানের লাশ বইতে হয়েছিলো আজ তাদের লাশ দেখে ভেতরের যন্ত্রণারা আত্মহুতি দিতে বাধ্য হয়েছে। মেহরাজ কখনোই চাইনি এতটা নিষ্ঠুর হতে কিন্তু মানুষের পৈশাচিক আচরণ আর পাপ বাধ্য করেছে ওকে।

— দরজাটা সটান করে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো মেহরাজ। গুটি গুটি পদক্ষেপ মাড়িয়ে এগিয়ে খাটের কাছঘেঁষে বসলো হাঁটুগেড়ে। বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে মোহর ঘুমে তলিয়ে। খুব সসন্তপর্ণে ঘুমন্ত মোহরের পা দুটো স্পর্শ করে মেহরাজ, প্রেয়সীর পায়ের পাতায় গাল ঠেকিয়ে আদ্র স্বরে চিত্ত চিরে কণ্ঠনালী হতে নিঃসৃত হলো কতগুলো শব্দগুচ্ছ,

– আমায় ক্ষমা করতে পারবেন মোহ? যেই আমি আপনাকে সুখের চাদরে মুড়িয়ে রাখবো বলে নিজের কাছে এনেছিলাম সেই আমার জন্য হাজারো যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত আজ আপনি। আমায় কী ক্ষমা করতে পারবেন আদৌ! বিশ্বাস করুন আমি খুব চেষ্টা করেছি, নিজের জানপ্রাণ দিয়ে চেয়েছি আপনাকে ভালো রাখতে সুখে রাখতে কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমার প্রথম মনে হচ্ছে আমি ব্যর্থ। খুব ভীষণ ভাবে ব্যর্থ আপনার জন্য। আপনার যোগ্য আমি না মোহ। আমায় ক্ষমা করে দিন!

কান্নার তোড়ে কেঁপে উঠছে প্রসস্থ পিঠ। প্রসারিত হয়ে আবারও আগের ন্যায় হচ্ছে বারংবার। শ্রেয়সীর পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিলো নিজ অশ্রু সমর্পণে। আজ প্রথম মেহরাজ কাঁদছে মোহরের সামনে। এতগুলো দিন একটা বার মোহরের সামনে টু শব্দ করেনি প্রয়োজন ছাড়া। আজ যেন দুঃখগুলোর জোয়ারে হামাল তুলেছে ওর। অটল,নিগূঢ় বাঁধগুলো আজ সংযমহারা।

– রুদ্ধ!

মেয়েলী স্বরের অবসাদাবিষ্ট ক্ষীণকায় শব্দে ঝংকার উঠলো মেহরাজের বুকে।মেহরাজ মুখটা তুলে দেখলো এক জোড়া ছলছল চোখ। হাতের তালুতে ভর করে উঠে বসেছে মোহর। মেহরাজের অশ্রুস্নাত চোখে চোখ মিলিয়ে নিঃশব্দে যেন ব্যক্ত করলো কতগুলো শব্দ-বাক্য। ধ্বনির উৎপত্তি ছাড়াই যার প্রতিধ্বনি বারংবার বাজলো মেহরাজের কানে। চিকন লতানো হাতটা এগিয়ে মেহরাজকে ইশারায় ডাকতেই এক লহমার ব্যবধানেই মেহরাজ পা থেকে উঠে ঝাপটে ধরলো মোহরকে, অকস্মাৎ তাল সামলাতে না পেরে ধপ করে বালিশের কোলে ঢলে পড়লো মোহর। বুকের মাঝে মেহরাজকে সযত্নে,সাদরে,সজোরে চেপে ধরলো। কালো রঙের শার্টে আবৃত পিঠময় নিজের শীর্ণকায় হাতটা বুলিয়ে দিলো আদরভরা স্পর্শে। হৃদয় জুড়ে থাকা ভালোবাসাকে সহস্তে আগলে কানে,ঘাড়ে, কাঁধে ঠোঁটের ভারী, শ্লেষাত্মক চুম্বনে ভরিয়ে দিলো। যন্ত্রণাপ্রবণ, আবেদনময়ী গলায় বলল,

– আমার সমস্ত দুনিয়াটাই আপনায় ঘিরে রুদ্ধ, তাতে রুদ্ধ হয়ে আমি শতবার দম বন্ধ হয়ে মরতে রাজি। যন্ত্রণা ভরা এই দুনিয়াতে আপনার ভালোবাসা টাকে আমি খুব বেশি ভালোবাসি।

মেহরাজ মোহরের গলায় মুখ গুঁজে শান্ত, প্রশান্ত হয়ে পড়ে রইলো। চোখের জলে ভিজলো মোহরের গলা বুক, তবুও একচুল নড়চড় হলো না একে অপরের বন্ধনের। মেহরাজ বহুদিন পর যেন এক টুকরো শান্তি পেলো কোমল বুকে মাথা রেখে। চোখ বুজে আঁকড়ে রইলো মোহরকে। মনে মনে একটা কথাই আওড়ালো,

– আমার সন্তানের হ-ত্যাকারীকে যেমন নির্মম মৃত্যু দিয়েছি। ঠিক এভাবেই সব পাপ,অশুভ গুলোকেও পি-ষে ধূলিসাৎ করে দেবো৷

রুকাইয়া আর মালার অধ্যায় মাটির তলে চাপা পড়েছে খুব সংগোপনে৷ নোমানকে পুলিশি আওতায় এনে সকল জিজ্ঞাসাবাদ শেষেও ওর স্বীকারোক্তি আর প্রমাণ সাপেক্ষে যথার্থ তথ্য না মেলায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। কোর্টে কেস উঠেছে মুর্তজাদের নামে। খবরের চ্যানেল, সংবাদ মাধ্যম, পত্রিকা আজ হন্য এই উত্তপ্ত খবরের তোলপাড়ে। খুব দ্রুতই সবটা শান্ত হবে দমে যাবে সকল পাপের সৃষ্টি গুলোও৷

.
.
.
চলমান

#হীডিং : জীবনে অনেক কিছুই এমন ঘটে যায় যেটা ‘না হলেও পারতো’ এমনটা আখ্যা দিয়ে শতবার আফসোস করি। কিন্তু জীবন বহমান, চলমান। এর মাঝে সুখের চাদর যেমন থাকবে কষ্টের কাঁটাও থাকবে। কিসমতের বেশি কেও পাইনা। গল্পের ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনই। তবুও যারা কষ্ট পেয়েছেন বা পাচ্ছেন তাদের জন্য সান্ত্বনাবাণী টুকু আমার ভাণ্ডারে নেই। কারণ যাদেরকে রোজ নিয়ম করে আঙুলের স্পর্শে গড়ে তুলছি,ফুটিয়ে তুলছি তাদের তো আমিও ভালোবাসি!
অনুপ্রেরণা দেওয়া কিংবা না দেওয়া — ভালোবাসা সকলের জন্য ❤️

#Humu_❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে