ফানাহ্ পর্ব-৬৪

0
1074

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৬৪
#হুমাইরা_হাসান
_________________

বহুতল ভবনটার সামনে এসেই গাড়িটার দুরন্ত গতি মন্থর হলো। আস্তে আস্তে চাকাটা থামলে পাশ থেকে নেমে তাথই এপাশে এসে গাড়ির দরজাটা খুলে দিলো। স্তিমিত চোখজোড়া খুব সংগোপনে মুছে নিলেন ভদ্রমহিলা। নিজে বের হয়ে পাশে বসে থাকা মাতৃতূল্য বৃদ্ধাকেও বের করলো সাবধানে। আস্তেধীরে এগিয়ে এলো কাঙ্ক্ষিত স্থানটির দিকে। বন্ধ দরজার সামনাসামনি এলেই তাথই পাশ থেকে সুইচ টিপে দিলে অনতিবিলম্বেই কাঠের দুয়ার দুটো খুলে সহজাত হাস্যজ্বল মুখে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলো সাঞ্জে। মোহরকে ছাড়া ওর একটুও চলে না, পরশু সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরার পর রাতটুকুই শুধু পার করেছে, পরদিন সকালেই মোহরের কাছে এসে পড়েছে। কাল থেকে এখানেই পড়ে আছে মোহরের সাথে। আম্বি শাহারা বেগমকে এক হাতে ধরে পা দুটো চালিয়ে অগ্রসর হলেন ঘরের ভেতরে। দুজন মানুষ হিসেবে খুব বেশিই বড় ফ্ল্যাট’টা যার প্রতিটি কোণেই শৌখিনতার ছোঁয়ায় পরিপূর্ণ। পরিপাট্যের সংস্পর্শে প্রতিটি জিনিসই দর্শনদারী। ছেলের সংসারে প্রথম পদার্পণ আম্বি খাতুনের। চোখ,বুক সবটাই জুড়িয়ে যাচ্ছে। তাথই শাহারা বেগমকে ধরে সোফাতে বসিয়ে দিলেও আম্বি বসলেন না, কেমন একটা জড়ত্ব ঘিরে ধরেছে। আম্বি খাতুনের এহেন আড়ষ্টতা হুট করেই উবে গেলো পরিচিত একটা মেয়েলী গলার সালামে৷ উৎকণ্ঠিত মুখটা ফিরিয়ে সালামের জবাব দিলে মোহর এগিয়ে এসে প্রজ্জ্বলিত হাসলো। খুবই সহজাত ভঙ্গিমায় বলল,

– কেমন আছেন মা?

আম্বি খাতুন চেয়ে রইলেন স্তম্ভিত চেহারায়। চোখভর্তি কেমন তৃপ্তির ঢেঁকুরটুকুর উচ্ছ্বাস উতলে উঠেছে যেন। বুকটা অদ্ভুত সুখানুভূতিতে ভারিক্কী হয়ে এলো৷ চার মাসের ও অধিক সময় পর দেখলো মোহরকে। মায়াটাও কী অদ্ভুত একটা জিনিস তাই না! যেই মেয়েটাকে দেখলে গা পিত্তি জ্বলে উঠতো একসময়, যাকে দেখলে ক্রোধের আগুনে ঝলকাতো সেই মেয়েটাকেই একবার চোখের দেখা দেখতে আজ কত তোড়জোড়। যাকে সামনে রেখে কত কটুকথা অবলীলায় ছুড়ে দিতো আজ তার সামনে দাঁড়িয়েও কেমন জড়তা জেঁকে বসেছে। হলুদ রঙের একটা পা সমান লম্বা গোল জামা আর সাদা সুতির ওড়না জড়িয়ে যেন একটা ফুটন্ত গোলাপ দাঁড়িয়ে আছে আম্বির চোখের সামনে। কতই না স্নিগ্ধ লাগছে মুখখানা। কতটা প্রাণবন্ত, আদুরে লাগছে। আম্বি খাতুনের খুব ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে আদর করে দিতে, প্রাণভরে দোয়ার আর্জি রাখতে৷
মোহর যেন নিঃশব্দে বুঝে নিলো অস্থির মাতৃ হৃদয়ের ব্যাকুলতা। আম্বি খাতুনের ভেতরের ইচ্ছেটাকে খুব সাদরে আগলে নিয়ে নিজেই এসে জড়িয়ে ধরলো আম্বিকে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,

– এতদিনে আমায় দেখতে আসলেন। আমি নাহয় পরের মেয়েই রইলাম নিজের ছেলেটাকে তো দেখতে আসা যায় নাকি!

আম্বি খাতুন চিকচিক করা চোখেও স্মিত হাসলেন। মুখটা যেন অদৃশ্য তালা লেগে বন্ধ হয়ে আছে, আজ শুধু মুগ্ধ হবার পালা। মোহরের মুখটা ধরে ওর কপালে স্নেহময়ী স্পর্শ মেখে দিয়ে বললেন,

– আমার ছেলেকে তো তোমার জিম্মায় তুলে দিয়েছি বহু আগেই। আমি নেই তো কী, তুমি তো আছ। আল্লাহ্ তোমাদের শতবছর বাঁচিয়ে রাখুন, আমৃত্যু একসাথেই রাখুন।

মোহর আম্বির সাথে সাক্ষাৎ সেরে এসে বসলো শাহারা বেগমের পাশে৷ বৃদ্ধার কুঁচকে যাওয়া মুখটাতেও যেন খুশির ঝলকানি ঝিকমিক করছে। শব্দহীনা শুধু বারংবার আদুরে স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন মোহরের গালে,হাতে।

– ইশ শ্রী আপাই জানলে খুব আফসোস করবে। আমরা সবাই এখানে এসেছি অথচ বেচারি নেই।

সাঞ্জের কথায় তাল মিলিয়ে তাথই ও সম্মতি দিলো,

– হ্যাঁ এটা অবশ্য ঠিক। আমি অবশ্য ফোন করেছিলাম ওকে, বেচারি আজ ডিউটিতে আছে। আর ঝুমুটার নাকি সেদিন থেকেই শরীরটা খারাপ তাই মিথিলাকেও আমি আর ফোন দিয়ে বিরক্ত করিনি।

আরও টুকটাক কথা চলতে থাকলো। তবে আম্বি খাতুনের অস্থির চোখদুটো যেন কেও একজন কে খুঁজে চলেছিলো। তার অশান্ত চোখ জোড়ার দৃষ্টি অবিন্যস্ত ভাবে ঘুরছে ঘরময়।

– মা! আপনার ছেলেকে খুঁজছেন?

কুণ্ঠিত মুখেও কেমন অপ্রস্তুত হাসলেন মহিলা। ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধীর ন্যায় ঘাড় নাড়ালো। মোহর স্মিত হেসে বলল,

– পৃথক ভাইয়ার সাথে গ্যাছে। একটু পরেই চলে আসবে৷

•••

নিউমার্কেটের ভিড়ে আজ যেন লোক সমাগম টা একটু বেশিই। মানুষের ভিড়টা পিপড়াদের দলের মতোই গিজগিজ করছে। সেই ফাঁক গলিয়ে এগিয়ে চলেছে বেশ লম্বা চওড়া একটা দুগলা-পাতলা শরীরের অবয়ব। টি-শার্টের উপরে একটা ছাঁইরঙা জ্যাকেট পরনে। ক্যাপে ঢাকা চুলগুলোর নিচে মুখটাও মাস্কের আড়ালে ঢাকা। কালো চশমায় ঢাকা চোখে পরিবেশটা কালচে ঠেকলেও তাতে চলাচলের ব্যাঘাত ঘটলো না একচুল ও। কাঁচের স্লাইডিং দরজাটা ঠেলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে দ্রুতগামী গতিটা আরও বাড়িয়ে দিলো। গত দুইদিনে তিনবার লোকেশন চেঞ্জ করেছে। ভিন্ন জায়গার দুটো গেস্ট হাউজে পরপর দুটো রাত কাটিয়ে আজ আরেকটা হোটেলে নিজের অস্থায়ী আস্তানা গেড়েছে। বেশ-ভূষার পরিবর্তনটা খুব সূক্ষ্ম ভাবে সাজানো। যেন খুব পরিচিত মানুষেরও বেশ কায়দায় পড়তে হবে চিনতে হলে। কৃত্রিম লেন্সে ঢাকা চোখের মণি, যান্ত্রিক ডিভাইসের ব্যবহারে পরিবর্তিত গলার স্বর, চুল-দাড়ির ভিন্ন স্টাইল কাট সহ ভিন্নরূপী পোশাক। সবটাই এক অচেনা অজানা খুব স্বাভাবিক মানুষেরই আবহ দিচ্ছে। তাকে দেখে বোঝাই সম্ভব না যে কতটা নিকৃষ্ট একটা খুনী মনকে অন্তরে সগৌরবে পুষে রেখেছে লোকটা৷

রাস্তাটা পেরিয়ে হোটেলে ঢুকেই যেন দম ছাড়লো। তবে মাস্কটা আর খুললো না। কথায় আছে না – সাবধানের মার নেই! ঠিক সেই ব্যাপারটাকে মস্তিষ্কে কড়াকড়ি ভাবে খাটিয়ে এগিয়ে চলল লিফটের দিকে৷ বাইরে থেকে জনশূন্য লিফটটা দেখে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে ভেতরে ঢুকে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তবে সেই স্বস্তি টুকু ওই খনিকের জন্যেই। এরপর কী অপেক্ষা করছিলো সেটা ওর কল্পনাতীত! লিফটের একদম সেন্টারে দাঁড়িয়ে ঠেস দেওয়া পিঠটা সোজা করার আগেই চোখ হাত দুটো স্থির হয়ে গেলো। ঠিক ওর সামনা সামনি.. দূরত্বের সীমানাটুকু দু’হাত সমান ও হবেনা। ওর মতোই মুখে মাস্ক এঁটে, খুব দায়সারা আয়েশী ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে লিফটের একটা কোণঘেঁষে৷ যেখানটাই দাঁড়ালে বাইরে থেকে তার উপস্থিতি বুঝতে পারাটা দুষ্করই বটে। নোমানের বিহ্বলিত মুখের চোয়ালটা খুব স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আলগা হয়ে এলো। অনাকাঙ্ক্ষিত চেহারাটা দেখে ওষ্ঠদ্বয়ের ভাঁজ আপনা আপনিই বড় হলো।
সামনে দাঁড়ানো ওর চেয়েও অত্যাধিক উচ্চতার মানুষটা মাস্কের আড়ালের মুখটাতেই হাসলো, দুর্বোধ্য সেই হাসি। যার রেশটুকু কতদূর গড়াবে তার আঁচ করতে অসুবিধে হলো না নোমানের।

– শুনেছি তোর কলিজাটা নাকি তেরো হাত! আজ সেটাই মাপবো চল।

বলেই একটা হাত এগিয়ে লিফটের বাটন প্রেস করতেই যন্ত্রচালিত দুয়ারদুটি স্বয়ংক্রিয়তায় সাঁই দিয়ে বন্ধ হয়ে গেলো। কনকনে ঠান্ডায় হাড় হীম করা মৌসুমেও কপার গড়িয়ে পড়লো সূক্ষ্ম ঘামের রেখা। ঢোক গিলার সাথে কণ্ঠনালীর ওঠানামাটাও স্পষ্ট। তা দেখে একচুল গললো না পাষাণ মন৷ হিংস্র শ্বাপদের মতই চেয়ে রইলো ধূসর চোখ দুটি, যেন চোখের সামনে আস্ত একটা শিকার যাকে ধরতে পারলেই পেশি থেকে হাড় গুলো আলাদা করতে সময় নেবে না এক লহমা।
লিফট্ টা খুব নাটকীয় ভাবেই একবার সুউচ্চে উঠে আবারও নেমে এলো। দরজাটা পূণরায় একই স্থানে এসে থামতেই প্রসারিত হলো দ্বারদুটি। মেহরাজ খুব অবলীলায় একটা হাতে চেপে ধরলো নোমানকে। নোমান অস্থিরমুখে আশপাশ লক্ষ্য করলো। কী আশ্চর্য! এইতো লোকজনের আনাগোনা দেখে গেলো অথচ এক মিনিটের মধ্যেই সব হাওয়া হয়ে গেলো? রিসিপশনিস্ট, ম্যানেজার, স্টাফ’স কেও নেই! আস্ত একটা হোটেল দাঁড়িয়ে আছে অথচ লোকজন গুলো এক মিনিটের মধ্যেই হারিয়ে গেলো! হাজারো প্রশ্নে জবজবে মনটা ব্যাপক অস্থিরতায় জড়সড় হয়ে সামনে তাকাতেই যেন সবগুলো প্রশ্নের সমাধা মিলে গেলো। একজন ব্যারিস্টারের নিশ্চয় এইটুকু ক্ষমতা আছে যে একটা জায়গা কে মিনিটের মধ্যেই লোকশূণ্য করে দিতে পারবে! তবে একটা ব্যারিস্টারের তো কাওকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতেও খুব খাটনি হবে না! পরের টুকু আর ভাবতে পারলো না উপস্থিত লঘুমস্তিষ্কে। নোমান আসন্ন অবস্থার ভয়ে মনের ভেতরেই যেন শতবার দোয়া ইউনুস পড়ে ফেললো।

মেহরাজ এগিয়ে আসতেই পৃথক গাড়ির দরজাটা খুলে দিলে নোমানকে এক ধাক্কায় গাড়ির সীটে বসিয়ে নিজেও পাশে উঠে বসলো। মেহরাজ,পৃথক দুজনের চেহারাটাই মাস্কে ঢাকা অথচ নোমানের চিনতে একচুল দেরি হলো না। ঠিক যেমনটা মৃত্যুর সময় মানুষ তার আজরাইল কে চিনে ফেলে। নোমানের ও ঠিক তেমনটাই হবে! এত এত টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি যাসব হাসিল করার জন্য কতগুলো প্রাণকে পিষে ফেলতেও দুবার ভাবেনি, সেসব কী ভোগের সাধ্য হবেনা! তার আগেই কী যমদূত ওর দুয়ারে কড়া নাড়তে এসে পড়লো!

……..

ক্লান্ত শরীরে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো মেহরাজ। জানুয়ারীর জবরদস্ত বার্ধক্যেও শার্টটা ঘামে ভিজে লেপ্টে গেছে শরীরে। হাতের জিনিসটা সজোরে আছড়ে ফেললে ধাতব শব্দে টনটন করে উঠলো বদ্ধ কামড়ার দেওয়াল গুলো । ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াসটুকুও ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে যেনো। হিংস্রাত্মক চাহনিটা স্থির করে রেখেছে সামনেই আধমরা রক্তাক্ত শরীরটার দিকে৷ মেহরাজ পারেনা মা’রতে মার’তে মে’রেই ফেলতে৷ ওই পাপিষ্ঠ দেহটাকে টুকরো টুকরো না করা অব্দি হয়তো শান্তি নামক বস্তুটার সাক্ষাৎ মিলবে না! অমানুষটার জন্য ঠিক কতগুলো প্রাণ বেঘোরে হারিয়েছে? ওর নিজের বোনটার জীবনের দূর্বিষহ একটা অতীত রয়ে গেছে, আর মোহর! মোহরের বাবাকে গাড়িশুদ্ধ নদীতে ফেলে দেওয়ার মতো নৃশংস কাজটাও নিজ হাতেই করেছে জানোয়ার টা, আর হাত! ওই দুটো হাত দিয়েই তো মোহরের শরীরটায় লোলুপ স্পর্শ বুলিয়েছিলো! ওকে ভোগ করা, সম্ভ্রম নষ্ট করার চেষ্টা অগণিত বার করেছিলো। এটুকু মাথায় আসতেই মনটা যেন আবারও পাশবিক হয়ে উঠলো, ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটে গিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তাক্ত হাতটা পা দিয়ে পি’ষে দেওয়ার চেষ্টা করলো। তৎক্ষনাৎ পেছনে থেকে দুটো হাত ওকে পেঁচিয়ে ধরে বলল,

– থাম মেহরাজ। ওকে মারিস না। মরার সময় এখনো হয়নি। আগে কেউটে গুলোকে বের করে আনি। সবগুলোর হিল্লে একসাথে করবো।

মেহরাজ না চাইতেও থামিয়ে নিলো নিজেকে। ওকে শেষ করে শুভ কাজটায় বাগড়া দিতে চাইনা। পাপের রথটাকে যে হাতে টানছিলো এতদিন সে হাতেই টেনে বের করবে রথটাকে লোকচক্ষুর সম্মুখে। কয়েক কদম পিছিয়ে সরে এলে পকেটের মাঝে বন্দী ফোনটা হুট করেই কেঁপে উঠলো ব্যাপকভাবে। মেহরাজ লম্বা লম্বা শ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করেই ফোনটা কানে ধরলো। ঘটনাটা এত দ্রুতভাবে ঘটে গেলো যে পুরোটা ঠাওর করে উঠতেও যেন মিনিট খানেক পেরিয়ে গেলো মেহরাজের৷ হ্যালো বলার ফুরসত টুকু যেনো নিজের পক্ষে জুটলো না তার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে একটা কান্নারত কণ্ঠে উন্মাদনায় বলল,

– ভাই! ভাই কোথায় তুমি? জলদি বাড়ি আসো ভাই, মোহরটা কেমন করছে ওকে এক্ষুনি হসপিটাল নিতে হবে।বড়সড় কিছু একটা ঘটে যাবে ভাই এই মুহুর্তেই তুমি ফেরো

এরপর প্রত্যক্ষ কোনো শব্দ বা বার্তা ওর কান অব্দি এলো না। শুধু হাত থেকে ছিটকে পড়েও জ্যান্ত ফোনটার স্পিকারে কতগুলো মানুষের তীব্র শোরগোল ভেসে এলো একটা মেয়েলী গলায় অস্থিরতম ভাবে বলল, “ওর সারা মুখ নীলচে কেনো লাগছে তাথই, এক্ষুনি অ্যাম্বুলেন্স ডাক তুই”।

– মেহরাজ! কী হয়েছে! এমন কেনো লাগছে তোকে?

পৃথকের প্রশ্নগুলোর জবাবে প্রত্যুত্তর করবার ভাষা খুঁজে পেলো না মেহরাজ৷ ফোনটা হাতের মুঠোয় পুড়েই ছুট লাগালো গাড়ির দিকে৷ ড্রাইভিং সীটে বসে এস্কেলেটরে চাপ দিতেই পৃথক গাড়ির দরজাটা খুলে বসতে বসতে বলল,

– কী হয়েছে মেহরাজ। বল ভাই, চুপ করে থাকিস না।

– আমার মোহ পৃথক। আমার মোহ..

বাকিটুকু বলতে গেলেও কণ্ঠনালী হতে নিঃসৃত হলো না কোনো শব্দ। এমন বিভৎস কিছু শব্দ উৎপন্ন করতেও ব্যর্থ হলো স্বরযন্ত্রীয় অঙ্গগুলো। ক্ষিপ্ত গতিতে – যতটা সম্ভব দ্রুত বেগে ছুটিয়ে নিলো গাড়িটা। স্পীডের পাল্লাটা তরতর করে বেড়েই চলল। দুজন মানুষ পাশাপাশি নিঃশব্দে শুধু আল্লাহর নামই জপ করতে থাকলো।

•••

– সব তো ঠিকই ছিলো! তাহলে হুট করেই এমনটা কেনো হলো! মোহর…মোহর চোখ খোলো! কথা বলো!

এতগুলো অস্থিরতা, ভীতসন্ত্রস্ততাপূর্ণ কোলাহলের একচুল যেন কান অব্দি পৌঁছালো না মোহরের। হাত পা খিঁচিয়ে পড়ে আছে। ভয়ে, সংশয়ে জান প্রাণ যায় যায় অবস্থা তাথইয়ের। কী করবে, কোথায় যাবে বুঝে পায় না ও! কী থেকে কী হলো! এইতো সুস্থ চেহারার মানুষটা বসে কথা বলছিলো।

– তাথই ম্যাডাম!

এই মুহুর্তে অভিমন্যুর গলাটা যেনো একটা বড়সড় আস্থা দিলো তাথইকে। মোহরকে ছেড়ে ছুটে গিয়ে অভিমন্যুর হারটা ধরে টেনে এনে বলল,

– ওকে এক্ষুণি হসপিটালে নিতে হবে অভি। একটুও সময় নেই৷ শিগগির করো

কথাটুকু বলামাত্র দেরি করলো না আর অভি। ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে থাকা মোহরের নিস্তেজ দেহটা দেখেই আঁতকে উঠেছে। তাথই, অভিমন্যু দুজন ধরাধরি করে গাড়ি অব্দি আনলো। সাঞ্জে যতটা সম্ভব ওদের সাহায্য করার চেষ্টায় সাথে সাথে এলো। মোহরকে নিয়ে পেছনের সীটে তাথই বসতেই অভিকে তাড়া দিলো এগোনোর জন্য। মেহরাজ পৃথক দুজনকেই বার দুয়েক কল করেও যখন পেলো না তখনই অভিমন্যুকে কল করেছিল৷ ভাগ্যিস করেছিল! তা নাহলে এখন কীভাবে কী করতো ও।
বাকি রইল শাহারা বেগম আর আম্বি, সাঞ্জে নিচ থেকে আবারও ছুটলো ফ্ল্যাটের দিকে। সাঞ্জেকে দেখে শাহারা বেগম কোনো সুযোগ না দিয়ে নিজেই বললেন,

– দেরি করিস না সাঞ্জে। আমাদের ও নিয়ে চল। হসপিটালে নিয়ে চল মোহরের কাছে।

— গাড়ির পেছন সীটে পড়ে থাকা মোহরের ভারী শরীরটা ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। প্রচণ্ড ব্যাথায় নীলাভ হওয়া মুখ হতে থেকে থেকে যন্ত্রণা ভরা চিৎকার বেরিয়ে আসছে, তা যতটা যন্ত্রণাভূত করছে মোহরের দেহটাকে, ততটাই আতঙ্কিত করে তুলছে তাথই আর অভিমন্যুকে। পেটের ভেতর অসহনীয় যন্ত্রণা টায় মনে হচ্ছে নাড়িভুড়ি ছিড়ে বাইরে চলে আসবে। দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে রেখেও নিদারুণ শারীরিক যন্ত্রণাটার রিখটার সামাল দিতে না পেরেই তীব্র আর্তচিৎকার দিচ্ছে। বিভৎস পরিস্থিতির যাতাকলে অবরুদ্ধ তাথইয়ের মন মস্তিষ্ক সবটাই অসাড় হয়ে আসছে, প্রায় হন্য হয়ে গেছে এরূপ অবস্থায়। এমতাবস্থায় হুট করেই অভিমন্যুর গলার একটা চাপা ডাক শোনা গেলো,

– স্যার!

তাথই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে মোহরকে একহাতে আগলে অভিনন্যুর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো জ্যামের লাইনে আঁটকা পড়া স্থির গাড়িটার দিকে৷ তাথইয়ের একটা বারের জন্যে মনে হলো চিৎকার করে ডাক দিতে। ওদের সোজাসুজি ঠিক অপর পাশটায় মেহরাজের গাড়ি। জ্যামের মাঝ দিয়ে ওরা আসার প্রতীক্ষায় তো এরা যাওয়ার। বার কয়েক চিৎকার করে ডাকলো তাথই কিন্তু কোলাহলপূর্ণ রাস্তাটা পার করে ওর চিৎকার অপর পাশ অব্দি গেলো না। তাড়াহুড়ায় ফোনটাও বাড়িতে রেখে এসেছে, খুব অস্থিরতায় আতঙ্কিত মনটায় অভিমন্যু ও নিজের ফোনের কথা টা ভুলে গেলো। তন্মধ্যেই জ্যামটা ছুটে রাস্তা ফাঁকা হয়ে সরু পথটা তৈরী হতেই অভিমন্যু প্রচণ্ড গতিটা আয়ত্তে চেপে ইঞ্জিন হাঁকিয়ে ছুটানোর প্রস্তুতি নিয়েছে তৎক্ষনাৎ একটা ডাক ওর কানে আসতেই হাতটা থেমে গেলো, জানালা দিয়ে ঘাড়টা বের করে পেছনে তাকিয়ে স্পষ্ট দৃশ্যটা উপলব্ধি করার আগেই একটা দমকা হাওয়ার মতো ছুটন্ত গতিটা মন্থর হয়ে সজোরে গাড়ির দরজাটা খুলে মোহরের ডান পাশটা দখল করে বসলো। এই জ্যামের ভিড়ে মেহরাজের চোখটা এই খানটাই কী করে এলো বা কয়েকটা মুহুর্তেই দীর্ঘ রাস্তাটা পারি দিয়ে কী করে মেহরাজ অশরীরির মতো হাজির হয়ে গেলো সে রহস্য উদঘাটনের প্রচেষ্টা বাদ রেখেই নিজের সর্বোচ্চ কায়দাটা কায়েম রেখে গাড়ি ছুটিয়ে নেওয়ার কাজটাই মনোযোগ যোগালো অভিমন্যু।
বজ্রাহতের ন্যায় চমকে ওঠে মেহরাজ। মোহরের শরীরের ব্যথায় দগ্ধ হওয়া নীলচে মুখটা ওর ভেতরটাকে বিদ্যুৎপৃষ্ঠের ন্যায় কাঁপিয়ে তুলছে। এক হাতে মোহরকে ঝাপটে ধরে বলে,

– মোহ! মোহ তাকান আমার দিকে। কী হয়েছে। আমার মোহ’র কী হয়েছে

শেষোক্ত কথাটুকু এতটাই জলদগম্ভীর আর তীব্র সোচ্চার পূর্ণ ছিলো যে তাথই রীতিমতো কেঁপে উঠলো। মেহরাজের চেহারাটা ওর ভেতর আতঙ্কের, ভয়ের লাভা সৃষ্টি করছে। আঁটকে আসা গলার কাঁপা কাঁপা শব্দে কিছু বলবে তার আগেই মেহরাজ প্রচণ্ড ধমকে উঠলো,

– স্পীড ফাস্ট করো অভি। দুই মিনিটের মধ্যেই আমি মোহকে হসপিটালের বেডে চাই।

মিনিট দুয়েকের মাথায় কাছাকাছি একটা বড় হসপিটালে আনা হলো মোহরকে। রিসিপশন পর্যন্ত আনতেই ইমারজেন্সীতে ডক্টরকে ইনফর্ম করে আনা হলো, মোহরকে স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে গেলো কাঙ্ক্ষিত ঘরটায়। শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহরাজ। ঠিক কয়েকটা মাস আগেই এই একই স্থানে,পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ছিলো মোহর আজ সেখানে মেহরাজ। বদ্ধ ঘরের ছুড়ি-কাঁচির কাছে পাঠাতে সেবার যেমন মোহরের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠেছিলো ঠিক তেমনটাই আজ মেহরাজেরও হচ্ছে। শ্বাস আঁটকে আসছে ওর, শেষ মুহূর্তে মোহর কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু যন্ত্রণার আগুনে দগ্ধরত মুখটা হতে কোনো শব্দই তুলতে পারেনি। পুঞ্জীভূত কতগুলো কথা-বাক্য অপ্রকাশিত রেখেই চলে গেলো ঘরটার ভেতর। নিজেকে ভীষণ নিষ্প্রাণ আবেগশূন্য মনে হচ্ছে, অস্ফুটস্বরে ওষ্ঠদ্বয় হতে কতগুলো শব্দ বলল,

– এমনও পাপ কী করেছিলাম আমি যার জন্য আজ এই দিনটা দেখতে হলো!

……

বিপদের সময় এক একটা মিনিট ও ঘন্টা সমান,এই কথাটার কাটকাট প্রমাণটা যেন আজ সবাই পেলো। ডক্টর ওটিতে ঢোকার আধ ঘন্টা পার হয়নি অথচ মনে হচ্ছে কতগুলো ঘন্টা যেনো পেরিয়েছে তা বেহিসেবী। উন্মনা হয়ে ঠিক কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে সময়টার ঠিক-ঠিকানা নেই। ততক্ষণে আম্বি আর শাহারাকে নিয়ে সাঞ্জেও হাজির হয়েছে। এক একজনের নির্জীবতা যেন তাদেরকে করে তুলেছে হতপ্রায় জীব। ব্যস্ত, ত্রস্ত অবস্থাটা এতটাই উন্মত্ত ছিলো যে অন্য কাওকে খবর দেওয়ার সুযোগ টা অব্দি পাইনি কেও। এখনও মেহরাজ যানে না কী থেকে কী হয়েছে, ওর মন মস্তিষ্কে শুধু মোহরের যন্ত্রণাদগ্ধ ব্যাথাতুর চেহারাটাই ভেসে আছে। নিজ স্ত্রী আর সন্তানের জন্য প্রবল উদ্বিগ্ন মন ক্ষণে ক্ষণে হৃদয়খানা কাঁপিয়ে তুলছে। অভ্যন্তরে থিতিয়ে থাকা ব্যাথা গুলো সরব তুলে ওকে দূর্বল করে দিচ্ছে ক্রমশ।
ওদের প্রবল দুঃশ্চিতা, ভয়ের বোঝা টাকে প্রসারিত করে ডক্টর বেরিয়ে এলেন ভার মুখে। মেহরাজ বিড়ালপায়ে এগোলো সামনের দিকে। কতগুলো উৎসুক মুখকে ফ্যাকাসে করে দিয়ে ডক্টর বলল,

– একজন প্রেগন্যান্ট মেয়ের খাবার দিকে সচেতন থাকতে হয় সেটা জানেন না, পয়েজন কী করে তার পেটে পড়ে!

.
.
.
চলমান

#Humu_❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে