#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৬৩
#হুমাইরা_হাসান
______________
মাস চারেক আগে যেই খেলা টা খুব নাটকীয় আপোষের মতো থমকে গেছিলো সেই খেলাটা আবারও শুরু হয়েছে। যেই খেলার খেলোয়াড় গুলো ঘুমন্ত পশুর ন্যায় স্থবিরতা ধারণ করেছিলো তাদের রগে রগে আজ উন্মত্ততা, উন্মাদনার তেজ ঝলকাচ্ছে। মোক্ষম সুযোগ, পরিস্থিতির বেড়া কলে আঁটকে যাওয়া যম গুলো ছুটতে শুরু করেছে। অনৈতিক কারবার, দূর্নীতি গুলোর যে রথ ওরা তৈরী করেছে তা টেনে নেওয়ার দড়িটায় দৃশ্যমান হাতটাই নোমান। মেহরাজ এতগুলো দিন অপেক্ষায় ছিলো নিজেকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলার, নোমানের দেশে ফেরার। সেদিন গাড়ি উল্টে পড়লেও সামনের ট্রাকে নোমানের চেহারাটা স্পষ্ট দেখেছিল মেহরাজ৷ কিন্তু ওকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে এতটুকু বয়ান কাফি নয়। কিছুদিন আগেই মেহরাজ গারদে ফেলেছিল নোমানকে যেখান থেকে ও সুকৌশলে পালিয়েছে তাই নিজের অ্যাক্সিডেন্টের দায়ভার নোমানের উপর চাপিয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশটাই মেটাতে চাই– এমন একটা মন্তব্য কোর্ট অথবা উকিল ওর দিকে অবলীলায় ছুড়ে দিতে পারে। নড়বড়ে ভিতটাকে মাধ্যম করে মেহরাজ নিজেকে হাইলাইট করতে চাইনি। ও জানতো নোমান ফিরবে, আর সে অপেক্ষাতেই দিন গুনছিল এতগুলো মানুষ।
– ওকে বুঝতে দিও না তোমরা ফলো করছ, নরমালি চলাফেরা করো। শুধু ওর লোকেশন টা মিস করা যাবে না
ওপাশ থেকে ‘ওকে স্যার’ বললে পৃথক কান থেকে ফোনটা নামিয়ে রাখলো। হাঁটুতে হাতের ভর রেখে ঝুঁকে এসে বলল,
– কী করতে চাচ্ছিস?
মেহরাজের শান্ত চোখগুলো শাবকের মতো উচ্ছ্বসিত হলো না। বরং নির্মল দিঘির মতো প্রশান্ত রইলো। খুব আস্তেধীরে জবাব করলো,
– এসেছে, আসুক। থাকুক, বিশ্রাম নিক। সময় হউক।
– কীসের সময়ের কথা বলছেন আপনি?
রিনিঝিনি কণ্ঠের তেজস্বী স্বরে পৃথক, অভিমন্যু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেও মেহরাজ তাকালো না। মোহর ভারী পেটটা নিয়ে খুব সাবধানে এগিয়ে এসে মেহরাজের সামনাসামনি বসে বলল,
– আরো কীসের অপেক্ষা করতে চাইছেন!
মেহরাজ সুপ্রসারিত নয়নে তাকালো ললাটে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে সকৌতুকে তাকিয়ে থাকা মোহরের দিকে। খুব নরম সুরে বলল,
– সঠিক সময়ের।
– স্যার। যদি ওরা আবারও আপনার কোনো ক্ষতি করে
অভিমন্যুর গলার স্বরটা বেশ ক্ষীণ শোনালেও কান অব্দি তা সকলেরই স্পষ্ট ছিলো। মেহরাজ জবাবে নড়চড়হীনায় বলল,
– করবেনা। একই ভুল আবার করবে না আপাতত। ওদের ইচ্ছে ছিলো আমাকে সরিয়ে মোহরের কাছ থেকে প্রমাণ হাতিয়ে নিজেদের রাস্তা সাফ করা। কারণ আমরা তখন আলাদা ছিলাম, এখন এই রিস্ক টা নেবে না।
– আপনি কেনো তবে এতগুলো বছর চুপ ছিলেন রুদ্ধ! কেনো এতদিন এগুলো থামাতে চাননি?
মোহরের কণ্ঠে সুস্পষ্ট কৌতূহল,অভিযোগ। তাতে তীব্র বিক্ষোভ যেন মেহরাজের নিশ্চুপতার প্রতি । মেহরাজ খানিক নীরব থেকে রয়েসয়ে বলতে শুরু করলো,
– ছোট থেকেই অনেক ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম আমি, আম্মা বাদে দাদা-দাদীর সাথেও খুব কম মিশতাম। বাবাকে তো কাছে পেয়েছি এমন সময় গুনলে হাতের এক আঙুল ও পার হবে না। তবুও সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো, আমার স্পষ্টভাবে কিছুই মনে নেই। শুধু হালকা ঝাপসা মনে পড়ে আম্মার সাথে খুব ঝগড়া হতো বাবার কোনো এক বিষয় নিয়ে। একদিন সকালে আমায় স্কুলে পাঠিয়ে আম্মু দাদা আর দাদীকে নিয়ে বেড়িয়েছিল কোনো এক কাজে তারপরে আর তারা ফেরেনি। আম্মা যাওয়ার পর একা হয়ে গেলেও বাবা তখন আমার খুব যত্ন নিতো৷ প্রতিটা সময় আমার সাথে কাটাতো। আস্তে আস্তে মায়ের জায়গাটা বাবাকে দিয়ে আমি তাকে নিয়েই বাঁচতে শুরু করলাম যখন, তখন বাবাও চলে গেলো। সেদিনের কথা খুব বেশি মনে করতে পারিনা, ঘরে বসে মায়ের দেওয়া গিটার টা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম, আমার শরীরের তুলনায় অনেক ভারী আর বড় হওয়ায় সেটা ধরতে পারতাম না। হুট করে বাবার কেমন একটা আর্তচিৎকার শুনে বাইরে গিয়ে দেখি বাবা ফ্লোরে পড়ে আছে আমি গিয়ে বাবাকে ধরে অনেক ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া পাইনি। কয়টা মাসের ব্যবধানে আম্মা বাবা দুজনকেই হারিয়ে অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীনের মতো হয়ে গেছিলাম। সেই অবস্থাটা থেকে ফিরতে আমার অনেক সময় লেগেছে, আস্তেধীরে স্বাভাবিকতার আতত্তে এলেও আমি কাওকে আপন করে নিতে পারিনি। আমাকে যারা সাথে করে এনেছে তাদের দেখলে আমার সংকোচ হতো, ভয় হতো। মা আমাকে অনেক ভালোবাসলেও আমি তার মাঝে নিজের মা’কে পাইনি। সবসময় এদেরকে ভিলেন মনে হতো। অন্যান্য বাচ্চাদের মতো বড় হয়েছি এদেশেই পড়াশোনা শিখেছি। আস্তে আস্তে সবটা যখন বুঝেছি, আমার পরিচয় অতীত যখন বুঝতে শিখেছি ততদিনে অনেক দেরি। ওই দেশে যেসব কাজ শুরু করেছিল তা যে এদেশেও এসে বহমান রেখেছে এই ব্যাপার টা খুব গোপন ছিলো। এমনকি আমিও জানতাম না। প্রায় আড়াই বছর আগের কথা, মি.আজহার আর আরহাম মুর্তজার খুব গোপন আলোচনা ভুল করে আমার কানে এসে যায়। আজহার, আরহাম মুর্তজা আর নোমানের আলোচনা শুনে আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি ওরা কী করছে কী চালাচ্ছে। সবটার খোঁজ আর খবর আমার কানে এসেছে যেনে ওরা ঘাবড়ে গেলেও ভয় পাইনি। কারণ ওদের অগাধ আত্মবিশ্বাস। ওরা নিজেরাই সবটা স্বীকার করেছিল আমার সামনে। আমার মূলও এই কাজের সাথেই জড়িত এরূপ যুক্তি খাটিয়ে আমাকে তাদের কাজের বৃহৎ একটা অংশের ভাগীদার করার প্রস্তাব তুলেছিল। আমি তা নাকচ করে দিকেই একা যে ওদের কাজে কোনো বাগড়া দিতে পারবো না। আর সবচেয়ে খারাপ জিনিসটা এই ছিলো যে ওদের জঘন্য ব্যবসাতে শীর্ষ নামটা ছিলো আমার বাবার। আমি যদি ওদেরকে আইনের আওতায় আনতে চাই তবে সবার আগে আসবে আমার বাবার নাম। যেই মানুষটা বাইশ বছর আগেই মাটির নিচে মিশে গিয়েছে তার নামের কুৎসা, কেচ্ছা গুলো আমারও জাগ্রত হবে। খোলাসা হবে জানা-অজানা হাজারো তথ্য যা একটুও প্রশংসনীয় নয়। একবার ওদের মুখ থেকেই মাহবুব শিকদারের নামটা আমার কানে এলো। তখন ওদের ব্যবসাতে তোলপাড় তুলেছিল একটা সামান্য ইন্সপেক্টর। যার জন্য ওদের নাভিশ্বাস ওঠার যোগাড়। আক্রমণ, হ’ত্যা কোনো পরিকল্পনা বাদ রাখেনি। একবার মাহবুব শিকদারকে ওরা ডেকে পাঠায় আপোষের উছিলায় কিন্তু অফিসার সেটা দাম্ভিকতার সাথেই প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে বরং নিজেই ওদেরকে সাবধান করে যায় যেন এই কাজগুলো বন্ধ করে দেয়। ফলস্বরূপ..
আধো আধো কথাগুলো সুসম্পন্ন না করেই থেমে যায় মেহরাজ। কথাগুলো বলার সময় ওর ভেতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ মোটেও ছিলো না হয়তো। অভিমন্যু, শ্রীতমা চোখ তুলে তাকালোও না মেহরাজের দিকে। যেন প্রবল আড়ষ্টতা জেঁকে বসেছে। পৃথকের অভিব্যক্তি খুব স্বাভাবিক ভাবেই নির্লিপ্ত। বাকি রইলো মোহর– ওর মাঝেও খুব নড়চড় লক্ষ্য হলো না। স্থিরচিত্তেই চেয়ে রইলো মেহরাজের মুখের দিকে। কয়েক মুহুর্তে নীরবতায় কাটলে মেহরাজ আবারও আরম্ভ করলো,
– যদি জানতে চাও এসব পাপে আমার ভূমিকাটা কোথায়, আমি বলবো আছে। তা হলো, আমি দীর্ঘদিন যাবত এসব জেনেও চুপ ছিলাম। হয়তো আমার কিছু করার ছিলো না তবে নির্লিপ্ততাও একেবারে কম ছিলো না। আমি শুধু চাইনি নিজের মৃত বাবাকে আবারও দুর্নাম করতে। তিনি কোনো ভাবেই নির্দোষ না তা আমি মানি,তবে সে তো ভালো হতে চেয়েছিলেন! সুযোগ টা হয়তো পাননি।নিজের পাপ গুলো মওকুফ করানোর সুযোগ টা তার কপালে ছিলো না।
তবে মাহবুব শিকদারকে বাঁচানোর চেষ্টা আমি করেছিলাম। অফিসারকে আমি নিজে ব্যক্তিগত ভাবেই বলেছিলাম গোটা কয়েকটা এ্যাভিডেন্স আর শুধুমাত্র নিজের বলে ওদের মাত দেওয়া অসম্ভব। কারণ ওরা একা নয় নাইবা এটা কোনো ছোটখাটো ব্যবসা। এর প্রসারণ এতটাই বিস্তৃত যে আসলে কে কে যুক্ত আছে এসবে তা আমাদের ধারণার বাহিরে। দুঃখজনক ভাবে দ্বিতীয় বার তাকে বোঝানোর সুযোগ টা আর পাইনি। তার আগেই..
আবারও কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। মেহরাজের মুখপানে চেয়ে কতগুলো কৌতূহলী মুখ। মেহরাজ শেষ কথাটা যেন আরেকটু ক্ষীণ স্বরেই বলল,
– মোহকে যখন দেখেছিলাম তখন জানতাম না আসলে ওই সে যার বাবার লাশটা দেখতে হয়তো আর খুব বেশি দেরি নেই। যতক্ষণে জেনেছিলাম ততদিনে দেরি হয়েছে.. অনেক দেরি। আমি চেয়েও পারিনি বাঁচাতে।
খুব অগোছালো, এলোমেলো ভাবে বলল কথাগুলো মেহরাজ। মোহরের সামনে কখনো ওর পরিবার সম্পর্কে ছোট্ট শব্দটাও তোলেনি ওর কষ্ট হবে বলে৷ কিন্তু সেই দূর্বিষহ অতীত টা নিজ মুখে ওকে শোনানোর মতন কাজটা ওর নিকট নিষ্ঠুরতমতার চেয়ে কম মনে হলো না তো!
•••
– তোকে দেশে ফিরতে কে বলেছে? নিজের মরার টিকিট টা কনফার্ম করার জন্য?
– একদিন না একদিন তো ফিরতেই হতো। আমার কাছে যাসব টাকা ছিলো সব শেষ। ওইদেশে থেকে কী আমি ঘাস কাটব?
– প্রয়োজনে তাই কাটবি। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ তোর জন্য যদি আমাদের নাকে দড়ি বাঁধে তোকে…
– আরে থামো! সব জাগায় আমার নামটাই তো সিলমোহর করে দিয়েছ, নিজেরা খুব আয়েশে ভদ্রলোক সেজে ঘুরছ। আবার আমার সাথেই গলাবাজি করে বেড়াও৷ টাকা যতটা দেওয়ার কথা ছিলো তার চেয়েও কম দিয়েছ। আমি তোমাদের কাছে আসছি আমার টাকা লাগবে
বলে খট করে কলটা লাইনচ্যুত করে দিলো। আরহাম খিটখিটে মেজাজে ধপ করে চেয়ারে বসলো। এই নোমানটা এই মুহূর্তে দেশে ফিরে কত্ত বড় ব্লান্ডার টা করলো তা কী আঁচ করতে পারছে না! কপালটা চিন্তার ভাঁজ আর ঘামে জবজবে হলো। ওয়াকিফ টাও শহরে নেই। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এলো অফিস থেকে যেটা ওদের আলাদা সেকশন হিসেবে ছিলো। মেহরাজ নিজে একটা অফিস নিজের আন্ডারে চালায় আরেকটা ওরা দুইভাই। গাড়িতে উঠে কপাল মুছে বাড়ির দিকে চলতে শুরু করলো। নোমানের ওপর একদম ভরসা পাচ্ছে না৷ নোমানকে ওদের দরকার ছিলো একটা কাজে তবে যেই কাজটা ও ঘটিয়ে গেছে সেই ভয়ে ওকে দেশে ফেরানোর কথাটা ভাবতেও পারেনি অথচ!…গাড়ি থেকে নেমে প্রচণ্ড বেগে পা চালিয়ে বাড়িতে ঢুকেই আজহার মুর্তজার ঘরের দিকে ছুটলো। আম্বি খাতুন কেবলই ঘর থেকে বেরোচ্ছিলেন। আরহাম কে হন্তদন্ত অবস্থায় ঢুকতে দেখে কপালের ভাঁজ গাঢ় হলেও দাঁড়ালেন না।
– ভাইজান। নোমানডায় তো দেশে ফিরেছে। ইতরের জাতটা একটা বার জানানোর প্রয়োজন ও মনে করেনি। আগে জানলে ওকে কখনও এখানে ফিরতে দিতাম না।
– কোথায় উঠেছে ও?
– শহরের কাছাকাছিই। একটা গেস্টহাউজ রেন্টে নিয়েছে।
আজহার মুর্তজা চেয়ারে বসা অবস্থাতেই মেরুদণ্ড সোজা করলো। খুব তীর্যক একটা চাহনি দিয়ে আরহামের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ওকে ফিরে যেতে বলো আরহাম। ও এবার সত্যিই আমাদের ফাঁসাবে। গতবার গারদ থেকে বের করিয়েছি বলে এবার কিন্তু তা সম্ভব না।
আরহাম ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এসে আজহারের সামনে বসে কেমন ভয়াতুর গলায় বলল,
– ওদের এতদিন চুপ থাকা আজ নোমানের ফিরে আসা কোনোটাই সুবিধার ঠেকছে না আমার ভাইজান। পেনড্রাইভটা, মোহর-মেহরাজ, পৃথক সব একদিকে। আইন প্রমাণের গোলাম আর আমরা আইনের৷ ওদের হাতে যা আছে তা ফাঁস হলে আমাদের টেনে আনতে খুব একটা অসুবিধা হবে না।
– শান্ত হও আরহাম।ঘাবড়ে গেলে শুধু চিন্তায় হবে, সমাধান না। আপাতত নোমানকে সরাতে হবে। তারপর পেনড্রাইভটা..
– উফ! ভাইজান পেনড্রাইভটার টিকিটাও ছুঁতে পারবো না আমরা । কম তো চেষ্টা করিনি, পৃথক সবটা সময় ওদের সিকিউরিটি অ্যাশিওর করে রেখেছে। গত কয়েক মাসে কম তো চেষ্টা করিনি। সারাটা সময় ও নিজের স্পেশ্যাল টিমকে ওদের সিকিউরিটি তে মোতায়েন করে রেখেছে। মোহরের তো এখন হসপিটাল ডিউটিও অফ, মেহরাজ ও খুব প্রয়োজন ছাড়া বের হয় না। এতদিন পৃথক সামলাচ্ছিল এখন মেহরাজ ও উঠে দাঁড়িয়েছে। সহজ হবে না ভাই!
আতঙ্ক, দুঃশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতায় কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো দুই ভাইয়ের ই। কেও মুখে প্রকাশ করলো তো অপরজন নিশ্চুপতায়। আশঙ্কা তো একই জিনিসকে নিয়ে।
•••
– নোমানকে রাজীব ফলো করছে। বেশি কিছু নয় শুধু ওর লোকেশন, স্টেপ বাই স্টেপ আমাকে ইনফর্ম করবে। কাস্টম অফিসারদের কেও ও ওকে কোনো রকম বিরক্ত বা জেরা করেনি। আমি শুধু ওর আসার খবর টা চেয়েছি ওরা দিয়েছে এখন বাকিটা আমাদের হাতে৷
– যরদূর মনে হয় নোমান মনে হয় বেশিদিন থাকার ইচ্ছেতে দেশে ফেরেনি। কারণ যাসব আমরা ভাবছি একই লক্ষ্যে ওরাও ভাবছে
পৃথকের প্রাসঙ্গিক কথায় অভিমন্যুর উত্তর টা ভুল নয়। মেহরাজ শানিত কণ্ঠে বলল,
– রাত হয়েছে অভি। শ্রীতমাকে নিয়ে বাড়িতে ফেরা উচিত তোমার। এতটা প্রেসার নেওয়ার দরকার নেই। অফিসের সবটা সামলে যাচ্ছ, বাড়িতেও সময় দেওয়া উচিত!
মেহরাজের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত দ্বায়িত্ববোধের চেতনাটা স্পষ্ট। অভিমন্যু সম্মতি স্বরূপ ঘাড় নাড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়ালো। শ্রীতমা মোহরকে বিদায় দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেও মনটা এক দণ্ড স্থির করতে পারছেনা। এতগুলো দিন পেরিয়ে এসে শেষ মুহুর্তেই এই বিপদ টা হতে হলো! মোহর আর ওর বাচ্চাটাকে নিয়ে প্রবল দুঃশ্চিতায় ভার হয়ে আসছে মনটা। কিন্তু প্রকাশ করার যথাযথ জায়গা টা পাচ্ছে না।
বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে অভিমন্যুর সাথে গাড়িতে উঠে বসলে সেটা চলতে শুরু করলো। অভিমন্যুর হাতটা জড়িয়ে ঠেস দিয়ে ভীষণ মলিন সুরে বলল,
– আমার খুব চিন্তা হচ্ছে অভি। মনটা কেমন কু-গাইছে। যদি আমার মোহুর কিছু হয়ে যায়!
প্রিয় মানুষটার প্রতি ভয়াতুর ভাবনায় গলার স্বর বেঁধে আসে শ্রীতমার। অভি শানিত ভাবটা বজায় রাখলেও ওর ভেতরেও যে একই অভিশঙ্কার সুর বেজে চলেছে। তবুও শ্রীতমাকে তার ন্যূনতম আঁচটুকুর আভাস পেতে দিলো না। এক হাত ওর ঘাড়ে রেখে মাথাটা নিজের বুকের কাছে নিয়ে বলল,
– কিচ্ছু হবে না দেখিও। একদম চিন্তা করবে না। এমনিতেই একদম যত্নশীল না তুমি নিজের প্রতি। পরে অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমরা সবাই আছি তো! স্যার, ম্যাডাম কারো কিচ্ছু হবেনা।
শ্রীতমা স্মিত হেসে মুখটা এগিয়ে নিয়ে অভিমন্যুর গালে দীর্ঘ একটা চুম্বন মেখে দিলো। অভি কেমন ভরাট গলাতে গভীরত্ব মিশিয়ে বলল,
– ইদানীং একটু বেশিই আদর পাই তোমার দেখি!
– পাবেই তো। এমন গুলুমুলু হনুমান মুখো হলে পাবেই বা না কেনো!
শ্রীতমার আদুরে গলায় বলা কথাটায় অভিমন্যুর কপাল জড়ো হয়ে এলো। ভ্রু কুঁচকে ভার গলাতে বলল,
– একটা উড়নচণ্ডীর সাথে প্রতিনিয়ত সংসার করলে হনুমান মুখো হওয়া টা অস্বাভাবিক নয়।
শ্রীতমার দুষ্টু হাসি ছড়ানো মুখটা নিমিষেই আধার রূপে ছেয়ে গেলো। ধুপ করে একটা কিল বসিয়ে সরে গেলে অভিমন্যু সশব্দে হেসে উঠে বলল,
– নিজের বেলায় আঁটিসুটি,পরের বেলায় চিমটি কাটি!
– এই খবরদার আমার ডায়লগ দিবেন না। বাড়ি চলুন আগে বাবাকে দিয়ে যদি কান মলা না খাইয়েছি আমি হনুমান মুখোটার বউ নোই।
– ঠিকাছে। কানের শোধটা যদি অন্যকিছু দিয়ে না তুলি আমিও উড়নচণ্ডীর বর নোই
•••
নরম ফোম জাতীয় বস্তুটার বুকে পিঠ এলিয়ে দিয়ে শূণ্যদৃষ্টিতে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। দুর্ভাবনাগ্রস্ততায় ছেয়ে আছে বুকভর্তি অনুভূতি গুলো। ফোঁসফোঁস দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনো কিছুই মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ ধারণ করতে পারছেনা।
দুটো পায়ের পদক্ষেপ ভীষণ ক্ষীণ শব্দে এগিয়ে এলো। মোহরের পাশের জায়গাটা অসংকোচে দখল করে বসলো,দখলে নিলো আঙুলের ভাঁজের ফাঁকা জায়গা গুলোয় নিজের আঙুল গুলো সে ফাঁকে গলিয়ে দিয়ে। জলদগম্ভীর গলার স্বরটায় খানিক নম্রতা মিশিয়ে বলল,
– বলুন কী জানতে চান। আপনার সব প্রশ্নের জবাব দেবো আমি।
– আমার জবাব চাইনা রুদ্ধ! আমার ভরসা চাই, আস্থা চাই। একটা সুরক্ষিত, খুব সাধারণ জীবন চাই। এই লড়াই, হিংস্রতা প্রতিটা ক্ষণে ভয় নিয়ে বাঁচতে আর চাইনা।
মেহরাজ সহস্তে আগলে নিলো প্রেয়সীকে। প্রেয়সীর নরম দেহটার সাথে যেন আগলে নিলো তার সমস্ত অস্থিরতা, দুঃশ্চিতার খেই গুলো, নিলো তার বুকের মাঝে জমে থাকা কালচে মেঘের কুণ্ডলী গুলো। সুগভীর গলায় বলল,
– আমার এ জীবনে কোনো চাওয়া পাওয়া ছিলো না। না ছিলো বাঁচার জন্য এক বুক স্বপ্ন। হুট করেই দক্ষিণা হাওয়ার স্নিগ্ধতার মতো আপনি এলেন আমার জীবনে। তারপর থেকে আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে, স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। আর সবচেয়ে নান্দনিক ব্যাপার টা কী জানেন? আমি যতবার স্বপ্ন দেখবার জন্যে চোখ বুজেছি ততবার শুধু আপনার চেহারাটাই দেখেছি
.
.
.
চলমান
#হীডিং : আগেই জানিয়েছিলাম আমি শহরের বাহিরে আছি। এই ব্যস্তময় অবস্থাতে দীর্ঘ একটা সময় নিয়ে টাইপ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা অনেক বেশিই দুরূহ হয়ে পড়েছে। তবুও নিজের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার তাগিদে আর অপেক্ষারত মানুষগুলোর জন্যই টাইপ করছি। ভুল ত্রুটি পেলে তা নিজ গুনে মার্জনা করবেন। সকলের তৃপ্তির স্থানটুকু পরিপূর্ণ করতে না পারলেও শূণ্যতা না রাখার চেষ্টা করছি।
#Humu_❤️