ফানাহ্ পর্ব-৬১

0
1017

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৬১
#হুমাইরা_হাসান
______________

মাথার পেছনের অংশে তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা অনুভূত হলে অচেতন অবস্থায়তেই চোখ কুঁচকে এলো। চোখের পাতা দুটোয় যেনো দানবীয় শক্তি ভর করেছে, খুলে তাকাতেও পারছে না। মস্তিষ্ক জুড়ে বায়ুশূন্য অবস্থার ন্যায় বাতাবরণ ছেয়ে আছে। মিনিট খানেক বাদে মোহর আস্তেধীরে চোখ মেলে তাকালো। ঝাপসা কৃষ্ণাভ চোখ জোড়ার দৃষ্টি
ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে ফকফকে সাদা ছাদের নিম্নাংশের বুকে ঘূর্ণায়মান ফ্যানটা দৃষ্টিগোচর হলো। মোহর ভারিক্কী মাথাটা একহাতে চেপে উঠে বসলো৷ আস্তে আস্তে বিভীষিকাময় রাতটার দৃশ্য স্মৃতির মানসপটে দৃঢ় ভাবে ভেসে উঠলো। তৎক্ষনাৎ পাতলা সিঙ্গেল বেডটা ছেড়ে নিচে নেমে কেবিনে অ্যাডযাস্টের বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে অসংখ্যবার পানির ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে এলো। সকালের আলো ফুটেছে। মোহর মেঝেতে পরে থাকতে থাকতেই কখন চেতনাশূন্য হয়ে জ্ঞান হারিয়েছে তা ওর বহু প্রচেষ্টাতেও মনে করতে পারলো না। অভুক্ত শরীরটা ভীষণ দূর্বল লাগছে, মোহর তবুও সেসব অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে এলো কালকের যেই কক্ষতে মেহরাজকে নেওয়া হয়েছিল সেদিকে ছুটলো৷ হসপিটালের আইসিইউ সেকশন টার সামনে সারিবদ্ধ বসবার স্থানটাতে অনেক গুলো পরিচিত মুখ দেখেও না দেখার ভান করে এগিয়ে গেলো। মোহরকে আসতে দেখেই সাঞ্জে বসা থেকে উঠে ছুটে এলো, মোহরকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বলল,

– ভাবী দাভাই এর কী হলো? এসব কীভাবে হলো! ওরা বলছে দাভাই এর অবস্থা ভালো না, বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে লাইফ সাপোর্টে নিতে হবে৷ তুমি একটু বলো না, ও ভাবী তুমিও তো ডাক্তার, তুমি বলো না। দাভাইকে দেখে বলো না দাভাই সুস্থ হয়ে যাবে!

মোহর স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়েই রইলো৷ যেনো কথা গুলো কানের পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতে পারলো না৷ এক পলকের দৃষ্টিতে দেখলো অদূরেই বসে কতগুলো মুখ। শাহারা বেগমকে একহাতে ঝাপটে ধরে তাথই নীরবে অশ্রু ছেড়ে দিচ্ছে। আম্বি বেগমের চোখ মুখের অবস্থা ভীষণ করুণ। কাকলি বেগম ও বসে৷ মোহর আরও কয়েকটা চেহারা প্রত্যাশা করেছিল। তবে তাদের দেখা না পেলেও ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজবার প্রচেষ্টা করলো না। কোনো জবাবহীনা সাঞ্জে কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে৷ মোহর কাঙ্ক্ষিত কক্ষ অব্দি পৌঁছানোর আগেই ফায়াজের ত্রস্ত চেহারাটা দেখতে পেলো। মাস্কে ঢাকা মুখটার যে অংশগুলো দৃশ্যমান তাতে উপস্থিত বলিরেখার ন্যায় ভাঁজগুলো মোহরের ভেতরটায় শঙ্কার বাসা বুনে দিলো দৃঢ়ভাবে৷ মোহর ফায়াজকে দেখা মাত্র ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটলো যেন কয়েক পা সমান দূরত্ব টাও সহ্য হলো না।

– রুদ্ধ কোথায়! আমার রুদ্ধ কেমন আছে স্যার? ওর জ্ঞান ফিরেছে? ভালো আছে তো! খুব বেশি লেগেছে? ওর কী খুব কষ্ট হচ্ছে?

ফায়াজ অবিচল নেত্রে চেয়ে রইলো মোহরের অতীব শঙ্কিত, দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ, ব্যাকুল চেহারায়। কাল রাত থেকে মোহরের যে চেহারাটা ও দেখছে গত পাঁচ বছরেও হয়তো এমনটার অভিজ্ঞতা হয়নি। মোহরের বাবার মৃতদেহ টা যখন আনা হলো তখন ও তো ফায়াজ ছিলো, মোহরের কান্না আহাজারি গুলো শুনেছে৷ তবে এমন হাহাকার তো শোনেনি! এমন করুণ বিলাপ তো শোনেনি ফায়াজ! বুকের ভেতরে নরম মাংশল অঙ্গটা অত্যন্ত যান্ত্রিক কায়দায় কেঁপে ওঠে ফায়াজের৷ ডাক্তারি জীবনের গোটা কয়েক বছরে অনেক প্রাণ হারিয়েছে ওর হাতের ওপর। অনেক দুঃখ দূর্দশা হজম করেছে চোখ দু’টো। অনেকবারই বলতে হয়েছে ‘ আমরা দুঃখিত,রোগীর হায়াত হয়তো এই পর্যন্তই ছিলো। ’ প্রয়োজনে কত সান্ত্বনা বাণীও দিয়েছে। অথচ আজ! আজ ওরই সামনে দাঁড়িয়ে ওর বহু পরিচিত, ওর নিজের ছাত্রীকে সামান্য একটা হেলথ আপডেট দিতে ওর এতো জড়তা, আড়ষ্টতা, ভয় কেনো লাগছে!

– স্যার চুপ করে থাকবেন না, বলুন!

এ যেন এক ধমক দিলো মোহর৷ ফায়াজ মোহরের রক্তাভ চোখে চেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো। ওর স্বভাবসুলভতা বজায় রেখে বলল,

– তুমি নিজে একজন ডক্টর মোহর। এরূপ আচরণ তোমাকে মানায় না। মেহরাজকে কোন সিচুয়েশনে হসপিটালাইজড করা হয়েছে তুমি সচক্ষে দেখেছ! ওর কন্ডিশন টা কেমন হতে পারে তোমার ও আন্দাজ আছে। তবুও বলছি, সিচুয়েশন আনস্ট্যাবল, মোট কথায় আল্লাহর কাছে দোয়া করো। শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে যা আমরা রক্ত দিয়েও ভরসা পাচ্ছি না। হাত পায়ে ইঞ্জুর্ডও হয়েছে খুব। পালস রেট একেবারেই ক্ষীণ। আইসিইউ তে রাখা হয়েছে, একিউট ইমারেজেন্সীতে রেখে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ওর কার্ডিয়াক ব্যালান্স, পালস রেট, অক্সিজেন লেভেল সবটাই প্রতিনিয়ত মনিটরিং এ রাখা হয়েছে। আপাতত অপেক্ষা করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি শরীরের রেসপন্স আশানুরূপ হয় তাহলে আমরা আশাবাদী।

এইটুকু বলে ক্ষান্ত হলো ফায়াজ। কিন্তু হলো না মোহর, ওর ভেতরে তীব্র দহনে ঘি ঢালার কাজ করলো ফায়াজের সঙ্কটাপূর্ণ কথা গুলো । ও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

– আমি দেখতে চাই। ওকে আমি একবার দেখতে চাই।

ফায়াজ মোহরকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

– এখন না। এখন কোনো ভাবেই ভিজিট এ্যালাও করা সম্ভব না। তুমি বোঝার চেষ্টা করো।

– না আমি বুঝবো না। আমি কোনো কিছু বুঝতে চাইনা৷ আমি শুধু ওকে সুস্থ দেখতে চাই এ্যাট এ্যানি কস্ট!

উচ্চস্বরের তীক্ষ্ণ শব্দে উপস্থিত সকলেই হতভম্ব হয়ে পড়লো। ফায়াজ নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে অতঃপর ক্ষীণ স্বরে বলল,

– আমাকে যদি ভরসা হয় তবে একটু ধৈর্য ধরো। তোমার রুদ্ধকে আমি তোমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।

বলে দাঁড়ালো না আর এক মুহুর্ত ও৷ স্থবির, অচঞ্চল মোহরকে চরম উৎকণ্ঠায় ফেলে ওভাবেই চলে এলো দ্রুতপায়ে। আজ নিজেকে বড্ড দূর্বল মনে হচ্ছে ফায়াজের৷ যাকে তার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো তাকে তো ও নিজেই ভালোবাসে। এতবড় ত্যাগ কী দুনিয়াতে আরও কিছু হতে পারে! এর চেয়ে ভারী বোঝা কী দুটো হয়! পালের তলার জমিন নড়বড়ে হয়ে উঠছে বারংবার। নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্ক টাতে আর কিচ্ছু ভাবতে পারলো না।

– মোহর, একটু আমার কাছে আই মা। আমার পাশে একটু বোস।

ভীষণ ক্ষীণ স্বরটা দূর্বল শোনালো। মোহর টলমল আঁখিজোড়া ঘুরিয়ে তাকালো বৃদ্ধার দিকে। কয়েকটা দিনের ব্যবধানে যেন আরও নুইয়ে পড়েছে একেবারে শীর্ণকায় বৃক্ষলতার মতো৷ মন্থর গতিতে এগিয়ে গেলে তাথই নিজে উঠে দাঁড়ালো। শাহারা বেগমের ইশারায় পাশটায় বসলে বৃদ্ধা কুঁচকানো চামড়াবৃত হাতটা তুলে মোহরের কাঁধে রেখে বললেন,

– তোর কপাল টা বোধহয় খুব মন্দ রে। বাপ মা, সবকিছুর পরে যেই স্বামীকে পেলি তার জীবন টাও টলমলে হয়ে আছে। তোর কপালে কারো ভালোবাসা সয়না কেনো! আমার ভাই, আমার মানিকটার এই অবস্থা কী করে হলো! আমার ভয় করছে, আমার মানিক ওর কোলের মানিক কে দেখে যেতে পারবে তো! বাবা ডাকটা কী ওর কপালে জুটবে না?

কথাটা সম্পূর্ণ করতে করতে অঝোরে চোখের জল ছেড়ে দিলো। মোহর ভাষা পাচ্ছে না, নাইবা পাচ্ছে অভিব্যক্তি। এই মুহূর্তে বসেও ভীষণ শঙ্কিত ভাবে নিজের পেটের ওপর আলতো ভাবে হাতটা রাখলো। ওর বাচ্চা টা ঠিক কতটুকু এখন! নিশ্চয় একেবারেই ছোট! আলট্রাসোনোগ্রাফি তেও হয়তো ছোট একটা বিন্দু হয়ে দেখা যাবে৷ এই বাচ্চাটার হাত,পা, চোখ,মুখ সবটা হবে। নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়ে ভূমিষ্ট হবে। তখন ওকে কোলে নেওয়ার জন্য আল্লাহর ধ্বনি কানে দিয়ে ওর আগমনে শুভেচ্ছা জানাতে ওর বাবা কী থাকবে না!

•••

– রাস্তা টা ব্যাকসাইডে। ওদিকে ছোট্ট ঝুপড়ি গ্রামের মতো পরিবেশ। শর্টকাট বলা চলে। স্বল্প সময়ে দূরত্ব পার করার জন্যই হয়তো স্যার ওই পথ ধরেছিলো। ওদিকে দোকান পাট বা কোনো ইনফরমেশনের সোর্স নেই৷ আমি সকালে ওখানকার প্রত্যেকটা মানুষের থেকে খোঁজ নিয়েছি৷ ওরা যতক্ষণে এসেছে ততক্ষণে জায়গাটা ফাঁকা ছিলো। তবে যে সবার প্রথমে শব্দটা শুনে বেরিয়ে এসেছে তার ভাষ্যমতে ওখানে একটা মালবাহী ট্রাক ছিলো৷ যেটা ওরা কাছে আসার আগেই সরে গিয়েছে। যদিও এমনটা শুধু একজনই বলেছে তবুও এটা হাইলাইটে আনার মতো পয়েন্ট মনে হয়েছে আমার৷

পৃথক ওর পিসির স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকেই বলল,

– ওই এরিয়া টায় ঢোকার পথে কয়েকটা বড় বড় সুপারশপ আর দোকানপাট আছে। ওগুলোতে নিশ্চয় সিসিটিভি ক্যামেরা যুক্ত। রাজীব যতদ্রুত সম্ভব আমাকে ওখানকার ফুটেজ কালেক্ট করে এনে দাও।

রাজীব নামের রোগা পাতলা ছেলেটা তৎপর হয়ে উঠলো। অনুগত ভৃত্যের ন্যায় ঘাড় নাড়িয়ে জবাবে বলল,

– স্যার আমাকে আধ ঘন্টা সময় দিন। আমি এনে দিচ্ছি

বলে অবিলম্বেই বেরিয়ে গেলো৷ রইলো বাকি পৃথক আর অভিমন্যু। পৃথক গায়ের রক্তমাখা শার্টটা পালটে একটা টি-শার্ট পরলেও অভিমন্যু এখনো আগের বেশে৷ চোখ মুখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,

– স্যার আমি সব এয়ারপোর্ট, স্টেশনে নিযুক্ত অফিসারদের ইনফর্ম করে দিয়েছি । নোমান নামের যত গুলো মানুষের নামে দেশের বাহিরে, ভেতরে টিকিট রেজিস্ট্রার করা হবে তক্ষনি ওরা আমাদের জানাবে সব ডাটাসহ।

– দেশের ভেতরে না অভি। ও যদি সত্যিই এই কাজটা করে থাকে তাহলে দেশের ভেতরে ও থাকবে না। আমার যতদূর মনে হচ্ছে ও কাল রাতেই সীমানা পেরিয়েছে৷

অভিমন্যু জবাবে নিশ্চুপ থাকলো। কিয়ৎকাল নির্বিকারচিত্তে ফ্লোরে তাকিয়ে থেকে কেমন একটা গলায় বলল,

– স্যার ও তো হুকুমের গোলাম। যারা মাথা তাদের কেনো ধরছেন না।

পৃথক নরম গদিযুক্ত চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

– কান টানলে মাথা আসে। তাই মাথাকে আনার জন্য কানটা ধরা মাস্ট। নোমান টাকার ভিখারি। ওর পিঠের চামড়ায় দোররা পড়লে গড়গড় করে উগড়ে দিবে সব৷ প্রমাণ ছাড়া কাওকে আমরা অ্যালিগেশন দিতে পারিনা। এদেশের সার্টিফিকেটে মেহরাজ মুর্তজাদেরই ছেলে। তাই নিজ ছেলেকে হ’ত্যার দায়ভার চাপিয়ে দেওয়ার আগে কড়া প্রমাণ পেশ করতে হবে৷

অভিমন্যু নতমস্তকেই অবলম্বে জবাব দিলো,

– ওদের শাস্তি দিলেও কী। আল্লাহ্ না করুক স্যারের কিছু হলে তাকে কী ফেরানো সম্ভব?

কথাটা কান অব্দি পৌঁছালে বুকের ভেতর প্রচণ্ড রিখটারে কেঁপে উঠলো পৃথকের৷ ঝড়ের ঝাপটার মতো একটা দমকা হাওয়া এসে যেনো মেহরাজের চেহারাটা মনে করিয়ে দিলো। মনে করিয়ে দিলো ওদের যুগ সমান বন্ধুত্বের স্মৃতি। সময়ে, অসময়ে, ভালোতে, মন্দতে যাকে নির্দ্বিধায় কোনো প্রশ্নহীনায় পাশে পেয়েছে সে মেহরাজ। ও দৈন্যতাকে অগ্রাহ্য করে ওকে নিঃস্বার্থ ভালোবেসে যে ভাই হয়ে পাশে থেকেছে সেই মেহরাজ। যার সাথে কতশত গল্প,স্মৃতি জুড়ে আছে সেই মেহরাজের গায়ে টোকা টাও ও সহ্য করতে পারে না। আজ যখন সব ওর হাতের মুঠোয়, ক্ষমতা টাকা পরিচিতি সবকিছু নিজের হাতে পেয়েও তার ব্যবহারে বন্ধুকে সুস্থ করতে পারছেনা। এর চেয়ে বড় অসহায়ত্ব আর কী হতে পারে!

ভাবনার মাঝেই ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে না তাকিয়েই ফিঙ্গার সেন্সরে আঙুল ঠেকিয়ে কানে ধরলো ফোনটা,

– কোথায় তুমি? আমার ভাইকে তো এরা দেখতে দিচ্ছে না। ও কতক্ষণে সুস্থ হবে। এখানকার পরিস্থিতি একদম ভালো না,মোহর অসুস্থ হয়ে যাবে। কাল থেকে না খাওয়া এমন চললে কী করে সামলাবো সবটা। আমি পারচায়না!

পৃথক হয়তো সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা টুকুও খুঁজে পাচ্ছে না৷ শুধু দূর্বল গলাটা খাটিয়ে বলল,

– আমি আসছি আশু।

•••

– ভালো বোন আমার একটু কিছু মুখে দে। কাল থেকে দানাপানি মুখে পড়েনি তোর। আর কত কাঁদবি,অসুস্থ হয়ে গেলে মেহরাজকে কে সামলাবে৷ ও তো জ্ঞান ফিরেই ওর মোহ কে দেখতে চাইবে তখন যদি ওর সামনে দাঁড়াতে না পারিস আমরা কী জবাব দেবো ওকে!

মোহরের কান অব্দি কথাগুলো পৌঁছুলো না যেনো। পাগলীনির মতো মেঝেটায় গুটিয়ে বসে থেকে অনিমেষ তাকিয়ে রইলো বড় বড় অক্ষরে ‘ICU’ লেখা ঘরটার দিকে। অস্পষ্ট স্বরে বলল,

– আমাকে খেতে বলিস না তোরা। ওই মানুষ টা বদ্ধ ঘরের ভেতর একা একা মৃত্যুর সাথে লড়ছে আর আমি কী না খাবো! এ খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে? আমি পারবো না।বলিস না আমায়

শ্রীতমা ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিলো৷ ওদের এতসব তোড়জোড় এর মধ্যেও একটা মানুষের চোখ নিষ্পলক তাকিয়ে মোহরের দিকে৷ কতগুলো ঘন্টা এভাবে বসে আছে তা কেও জানে না। শ্রীতমা মোহরের কাছ থেকে সরে এলে মানুষটা বসা থেকে উঠে একটু একটু করে এগিয়ে এলো। একদম সামনাসামনি পা দুটো ভাঁজ করে বসলো। দুই হাঁটু ভাঁজ করে রাখা মোহরের পায়ের কাছে আস্তে আস্তে নিজের হাতটা এগিয়ে নিলো। উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষকে চরম বিস্মিত করে একহাতে মোহরের পা স্পর্শ করে বলল,

– আমায় ক্ষমা করে দে মা। ক্ষমা চাওয়ার মুখ আমার নেই৷ তবুও বেহায়ার মতো করে চাচ্ছি। আজ আমার স্বামীর জন্য তোমার স্বামীকে ভোগ করতে হচ্ছে। নিজের মুখটা তোমার সামনে দেখানোর মতো অবস্থানটাও আমার নেই। অনুতাপ, খেদ, অপরাধবোধের আতশে জ্বলে পুড়ে ম’রছি৷ সেদিন যদি ওকে ওর মাতৃভূমি থেকে টেনে না এনে ওখানেই ফেলে আসতাম তাহলে আর যাই হোক আজ হয়তো ও নিজের জীবন টায় এত দূর্দশা বইতে হতো না। যতটা মমতায় ওকে বুকে করে এনেছিলাম ঠিক ততটাই আজাব ওর ভোগ করতে হচ্ছে। আমার মুখ নেই তোমাদের সামনে দাঁড়ানোর। আমি পারিনি, যাকে নিজের সন্তান করে রেখেছি তাকে আগলে রাখতে পারিনি।

আহ্ কী সেই মর্মান্তিক দৃশ্য! চোখের পানিগুলো ও যেন লেলিহানে পরিণত হচ্ছে। একজন স্ত্রী তার স্বামীর অপরাধের ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে আরেকজন স্ত্রীর পায়ে ধরে পড়ে আছে যে কী না তারই পুত্রবধূ! নিজের ছেলেকে অন্যের স্বামী রূপে সম্বোধন করে চরম পাপের ক্ষমা চাওয়ার চেয়ে নিরুদক যন্ত্রণা, শোচন, মর্মান্তিক আর কী হতে পারে! মা তো মা’ই হয় তাই না! গর্ভে ধারণ করার চেয়ে লালন-পালন করে পরম আদরে আগলে রাখার বোঝা,দায় তো কম না! আম্বি বেগম পারেনা নিজের প্রাণটা সপে দেয় ছেলের জন্য। ওর মেহরাজ ওর চাঁদখানার এই অবস্থাটা ও সহ্য করবে কী করে! যাকে আগলে রাখার জন্য, বাঁচিয়ে রাখার জন্য এতগুলো বছর প্র’হার, আঘাত, যন্ত্রণা সবটা সয়ে এসেছে তবুও একটা ফুলের টোকা পড়তে দেয়নি সেই রত্ন টাকে সে কীভাবে এই অবস্থাতে দেখবে!
মোহর কথা বলতে পারলো না নাইবা পারলো কোনো অভিব্যক্তি বা নড়চড় করতে… নিশ্চুপ তাকিয়ে দেখতে থাকলো এক গর্ভধারণহীনা মায়ের কষ্ট, তার অনুতাপের অশ্রুতে নিজের ভিজে যাওয়া পা খানা।

•••

এক্কেবারে শব্দহীন ঘরটা। যেনো নিঃশ্বাস ছাড়লেও এক একটা ঝংকার তুলবে। বুকে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত কম্পন গুলোয় প্রচণ্ড অবসন্নে মুষড়ে গেছে। বাহিরে ঝড়ো হাওয়ার কম্পন, ভেতরে প্রবল নিস্তব্ধতা। এই শীতের শুরুতেও এই আবহাওয়া! এটা কী শুধু আবহাওয়ারই বৈরী রূপ নাকি অন্তরে পুষে রাখা দাবদাহের একাংশ! তা বোধগম্য হয়তো কোনো জীবের ক্ষেত্রে সম্ভব না।
ঘড়িতে কাটকাট সময় টা হয়তো জানা নেই, তবে আন্দাজের হিসেব টাকে আয়ত্তে নিলে তা দাঁড়াবে রাতের প্রায় শেষ প্রহরের দিকে ‘তিনটা থেকে চারটার’ মাঝামাঝি। মোহর ঘাড় এলিয়ে দিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে একটা চেয়ারে। নাকে মেডিসিনের একটা কড়া গন্ধ নিঃশ্বাসের সাথে সাথে মিশে যাচ্ছে।
মাঝে পেরিয়ে গেছে তিনটে দিন। এই তিনদিনে মেহরাজের মুখখানা দেখবার প্রচণ্ড আকুতি তেও সৌভাগ্য টা জোটেনি। তাই আর অপেক্ষা করতে পারেনি মোহর, সমস্ত ধৈর্য, সংযম, নিয়ম শৃঙ্খলার বাঁধ চুরমার করে নিজের দাপট দেখিয়ে চলেই এসেছে। ওর প্রচণ্ড জিদের কাছে হার মেনে বাধ্য হয়ে ওকে ভিজিটের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে মোহর তাও মানতে নারাজ, সময়ের মাপকাঠিতে আবদ্ধ, বরাদ্দকৃত সময় ও নিতে রাজী নয়। মেহরাজকে ও চোখের সামনে চায়, ওর সমস্ত সেবা শুশ্রূষা ও নিজ হাতে যত্নে করতে চাই। ও একজন স্ত্রীর সাথে সাথে ডাক্তার ও তো! তাই হয়তো নিয়মের বেরিবাঁধ টা ওর ক্ষেত্রে কঠোর হতে পারেনি। অবশেষে বাহাত্তর ঘন্টার ও অধিক সময় পেরিয়ে মোহর পেয়েছে, পেয়েছে সাক্ষাৎ প্রাণাধিক প্রিয় মুখখানার৷ যেই মুখখানা দেখে ওর বুকের ভেতর প্রশান্তির উচ্ছ্বাস মেলতো, ভালোবাসার উদ্বেলনের প্রবাহ চলতো সেই মুখখানা আর প্রাণহীন স্বরূপে ওর সামনে পড়ে আছে। গালের বাঁ পাশটায় নিচের দিকে তিনটে সেলাইয়ের দাগ। ডান হাত আর পায়ে ব্যান্ডেজ। ফায়াজের ভাষ্যমতে গাড়িটা উলটে কাত হয়ে পড়ায় একমুখী সমস্ত চাপটা মেহরাজের ডান পাশে পড়েছে, যার কারণে হাত আর পা দু’টোয় ভীষণ ভাবে জখম হয়েছে। মোহর নির্লিপ্ত চেয়ে দ্যাখে লম্বা চওড়া সৌষ্ঠব শরীরটার বিকল চিত্র। ওর মনে পড়ে যায় সেই মেহরাজকে যে ওকে পায়ের পাতায় দাঁড় করিয়ে সারা ঘর, বারান্দাময় পায়ে পায়ে হাঁটিয়ে বেড়াত। আর বলতো ‘সারাজীবন আপনাকে এভাবেই রাখবো মোহ, আমার পায়ে পা রেখে আপনি হাঁটবেন। আর আপনার পথের সমস্ত কাটা আমি মাড়িয়ে দেবো, আপনি শুধু চোখে চোখ আর বুকে বুকটা রাখবেন ছোট্ট দুনিয়াটা শুধুই আমি আর আপনিময়’ । এক একটা কথা শব্দ ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। মনের ইচ্ছে, বাসনা গুলো ওকে ক্ষণে ক্ষণে জ্বালাচ্ছে। ধৈর্যে কুলাচ্ছে না কখন চোখ দু’টো মেলে তাকাবে মেহরাজ। ওর ধূসরময় দৃষ্টির ভালোবাসায় সিক্ত করবে মোহরের সর্বাঙ্গ, কখন অতি সুন্দর ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে ডাকবে ‘মোহ!’

চোখ দু’টো খিঁচিয়ে বন্ধ করতেই অবিরাম ধারার ন্যায় নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। ভালোবাসা, আর ভালোবাসার মানুষটার অভাব ওকে নিষ্প্রাণ করে দিচ্ছে।

– মোহ্

এক্কেবারে ক্ষীণ একটা স্বর। মোহরের বুকটা প্রচণ্ড মাত্রায় কম্পিত হলো। কী হলো! ও কী ভুল শুনলো! কে ডাকলো! এত গুলো প্রশ্ন, উত্তেজনায় জর্জরিত হলেও চোখটা খুলে তাকালো না মোহর। এটা কী সত্যিই? নাকি স্বপ্ন। যদি স্বপ্ন হয় তবে চলতে থাক চোখ খুলে তা ভেঙে যাওয়ার দৃশ্য ও সইতে পারবে না।

– মোহহ!

অতিশয় দূর্বল গলার ডাকটা এবার আরেকটু স্পষ্টতর শোনা গেলো। সে স্বরে তীব্র আকুতি, কাতরতা,আদর মিশ্রিত আবেশের তীক্ষ্ণতা মোহরকে আর চোখ বুজে থাকতে দিলো না। ধপ করে চোখটা খুলে তাকাতেই মেরুদণ্ড বয়ে হীম শিথিলতার স্রোতের জোয়ার বইল। পায়ের তালু অসম্ভব রকম ঠান্ডা হয়ে গেলো। সত্যি! মোহর কী স্বপ্ন দেখছে? নাকি সত্যিই মেহরাজ তাকিয়ে আছে ওর ধূসর বর্ণের চোখটা মেলে? মোহরের স্তম্ভিত তাকিয়ে থাকা অবস্থায় মেহরাজ ওর শুষ্ক, ক্ষতযুক্ত ঠোঁট দুটো আবারও নাড়িয়ে বলল,

– আমি আসতে পারিনি বলে রাগ করেছেন মোহ? দেখুন এই যে আপনার সামনে আছি! আপনি ডাকলে আমি না গেলে তো মরেও শান্তি পাবো না, তাই হয়তো উপরওয়ালা আমাকে একটুকু সুযোগ দিয়েছে।

মোহর দু’হাতে মুখটা চেপে ধরলো, বুক ভরা চাপা কান্নার আহাজারি গুলো ছুটন্ত বেগে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। দলা পাকানো কান্নাগুলো খোলা বাতাসে ঝংকার তুলতে চাইছে৷ মোহর কাঁদবে না! নিজেকে সামলানোর প্রাণপণ চেষ্টা করবে।

– আপনি একবার ভালোবেসে ছুঁয়ে দিবেন মোহ? তাহলে আমি মরেও শান্তি পাবো। একবার আমার বুকে আসবেন! আমি একটু দম ছাড়তে চাই.. এই রুদ্ধতা আমাকে বাঁচতে দিচ্ছে না।

কথাটুকু বলতেও যেনো সারা শরীরের শক্তি লেগে গেলো মেহরাজের। মোহর নিজের ভ্রম আর বাস্তবের সীমানার হিসেব ভুলে দিকবিদিকশুন্য মস্তিষ্কে হা’মলে পড়লো মেহরাজের বুকে। ভারী চাপে হয়তো প্রচণ্ড কষ্টও হলো মেহরাজের। চোখের কার্নিশ ছাড়িয়ে পানির রেখা বেমালুম গড়িয়ে পড়লো। তবে সেই কান্নাকে ছাপিয়ে দিলো মোহরের কাকুতি। মেহরাজের ক্ষতেপূর্ণ বুকটায় মুখ ডুবিয়ে সশব্দে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, যেই শব্দ হসপিটালের পেটা দেওয়াল গুলোকেও বিদ্ধ করলো, বিদীর্ণ করলো। মেহরাজের পরনের হালকা নীল রঙের পোশাক টা খামচে ধরে হাউমাউ করে কান্নায় ভাসিয়ে দিলো ওর বুকখান। মেহরাজ বহুকষ্টেও একটা হাত তুলে মোহরের পিঠে রাখতে পারলো না। আরেকটা হাতে স্যালাইন যুক্ত থাকায় সেটাও নাড়াতে অক্ষম হলো। কেমন অতিষ্টময় গলায় অসহ্যকর সুরে বলল,

– এইটা আমার হাত থেকে খুলুন মোহ। আমি আপনাকে ধরতে পারছিনা, এই অসহ্য জিনিস টাকে খুলে দিন

মোহর আর্দ্র মুখটা তুলে কেমন শূন্য অভিব্যক্তিতে তাকালো। মেহরাজ আবারও একই কথা বললে মোহর না বোধক জবাব দিয়ে সরে আসতে চাইলেও মেহরাজের ওই ব্যাকুল দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা এতটুকুও হলো না। মেহরাজ আবারও প্রচণ্ড আকুতি মিশিয়ে বলল,

– খুলে দিন মোহ। একটা হাত আমার ভাঙা, চাইলেও নড়াতে পারবো না।এটা অন্তত খুলে দিন! বহুদিন আপনাকে জড়িয়ে ধরিনি, এই তৃষ্ণা বুকে নিয়ে আমাকে মরতে দিবেন না। আমি মাটিতে মিশেও অতৃপ্ততায় ছারখার হবো। খুলুন এটা লাগবে না আমার কিচ্ছু, আমার চিকিৎসা ওষুধ দুটোই আপনি।

মোহরের যেন মতিভ্রম হলো। যেই হাতটায় মেহরাজের স্যালাইনের সূঁচ বিঁধানো। সেই সূঁচটা এক টান দিয়ে বের করতেই মেহরাজ একহাতে যতটুকু সম্ভব, নিজের সমস্ত শক্তিটা দিয়ে জড়িয়ে ধরলো মোহরকে। স্যালাইনের নল টা ছিন্ন হওয়ায় রক্ত বেরিয়ে এলো ছোট ক্ষত ছিদ্র থেকে, তবুও সর্বশক্তি খাটিয়ে দিলো সে হাতে। রক্তের ফিনকি ছুটলো মেহরাজের হাতের উলটো পিঠ দিয়ে, সেই রক্তে মোহরের পিঠময় ভিজে গেলো রক্তাভে । অথচ সেদিক কোনো ধ্যান নেই ওর যেনো বহুবছরের তৃষ্ণাদগ্ধ কেও তার প্রবল তৃষ্ণার সুধা প্রাণভরে শুষে নিচ্ছে। মোহর অবিন্যস্ত ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো মেহরাজের সারা বুকে। ব্যাকুলতা, বুকের ভেতর পুষে রাখা সমস্ত মর্মবেদনার স্পর্শে প্রচণ্ড আদরে ছুঁয়ে দিলো মেহরাজকে। কতগুলো কথা, অভিযোগ গলা অব্দি এসেও বেরোলো না। পাগলের ন্যায় কান্না করতে করতে মেহরাজের খোঁচা খোঁচা দাড়িভরা গালে কপালে নাকে অসংখ্য চুমু দিয়ে বলল,

– পাষাণ, নির্দয় আপনি কোথায় ছিলেন এতগুলো দিন? এই যন্ত্রণা দেওয়ার বদলে আমায় মে’রে ফেললেন না কেনো! কেনো নিজের শরীরে এই আঘাতের চিহ্ন নিয়ে আমায় কলিজায় দহন ধরালেন!

মেহরাজ ওর রক্তমাখা হাতটা টেনে মোহরের গালে রেখে বলল,

– আমি আপনাকে ভালোবাসি মোহ, এরচেয়ে বড় সত্য আর দুটো আমার জানা নেই।
.
.
.
চলমান

#হীডিং : প্রচণ্ড রকম অপেক্ষায় অপেক্ষারত আছেন জানি। তাদের জন্য আমার ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা। অনেক বড় পর্ব দিয়েছি। পড়ুন,আর মন্তব্য করে ফেলুন।

#Humu_❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে