#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৬০
#হুমাইরা_হাসান
_______________
প্রচণ্ড তুফানের তর্জন গর্জন শেষে প্রকৃতিটা যেমন নিঃশব্দ, নিথর, বিশ্রদ্ধ হয়ে যায়। ঠিক সেইরকম একটা অবস্থা বিরাজমান। ধ্বংসাত্মক অবস্থাটা কাটিয়ে শ্রান্ত বাতাবরণ টা গায়ে শূল বিঁধিয়ে দেওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বিশালদেহী ট্রাকটার জানালার ছোট্ট ফাঁক দিয়ে ঘাড় টা বের করে তাকালো। শান্ত চোখ দু’টোয় পৈশাচিক আনন্দের ফুলকি ছুটেছে। বাঁ কানে ফোনটা ঠেকিয়ে গাল বাঁকিয়ে বলল,
– খেল খতম মামু। পি’ষে দিয়েছি এক্কেবারে। টাকার ব্যাগ টা রেডি রাখো। এক একটা নোট আমি গুনে গুনে নেবো।
ওপাশ থেকে আসা জবাব টা শোনা গেলো না। তবে জবাব টা হয়তো এতটাই সুখকর ছিলো যে চোখ মুখ ঝকমকিয়ে উঠলো। আর কিছু না বলেই খট করে লাইনচ্যুত করলো সুপরিচিত নম্বর টা। চোখ দু’টো তখনও বিদ্ধ ধ্বংসাস্তূপের ন্যায় চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া গাড়িটার দিকে। রাস্তায় গড়ানো রক্তের শিথিল স্রোতটা দেখে প্রশান্তির হাসি হেসে বলল,
– খুব দাপট খাটিয়েছিস। আজ তোর নাম নিশান মুছে দিলাম আব্রাহাম রুদ্ধ! পিঠে, বুকে,পায়ে মা’রের দাগ গুলো এখনো তাজা। এই মা’রের দাগ শুকানোর আগেই আমি তোর র’ক্তের বন্যা বইয়ে দেবো বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আজ তা কমপ্লিটেড। আব তেরা ঘার ভি মেরা, ঘারওয়ালি ভি মেরা
নিজের মনেই কথাগুলো তবে গা দুলিয়ে হেসে উঠলো নোমান। যেই হাসির কোনো শব্দ নেই, আছে শুধু প্রাণান্তকর হিংসা, ক্ষোভ। যেই জ্বালা মেটাতে একটা প্রাণ কে পি’ষে ফেলতে দুবার ভাবলো না। তন্মধ্যে অদূর থেকে জন কয়েকের হৈ হৈ শুনতে পেয়ে ঘাড় টা অনেকখানি বের করে তাকালো নোমান। কয়েক মিটার দূর থেকেই কতগুলো মানুষ ছুটে আসছে এদিকে, ব্যাপারটা স্পষ্টতর হতেই গাড়িটা ব্যাকে নিলো নোমান। ঠিক যতটা গতিতে এসেছিলো সেরকম ভাবেই উলটো পথ ধরলো। দুর্দম্য গতিতে হওয়া অ্যাক্সিডেন্টটা যেইরকম গর্জন তুলে গাড়িটা ছিটকে পড়েছে তাতে আশেপাশের জনবসতির কান অব্দি পৌঁছানো খুব অস্বাভাবিক না।
…
– হ্যালো ভাইসাব? কি হয়েছে সামনের রাস্তায় এতো শোরগোল কীসের?
– অ্যাক্সিডেন্ট হইছে সাহেব। গাড়িডা পুরা উল্টাই গ্যাছে। ভিত্রের মানুষ টা বাঁইচা আছে কী না অহনেও কওন যাইতো না। তয় যেইভাবে উল্টাইছে গাড়িডা খোদার কসম একটা কাঁচ ও আস্ত নাইকা। পুরাডা রাস্তায় রক্তের নদী বইয়া গ্যাছে।
কথাটা শোনা মাত্র সীটবেল্ট টা খুলে ক্ষিপ্ত গতিতে বেরিয়ে এলো পৃথক। মাঝ বয়েসী ছিপছিপে গড়নের লোকটা নড়েচড়ে দাঁড়ালো। পৃথকের গাড়ির সামনে নেমপ্লেটের উপর লাল কালিতে বড়বড় অক্ষরে কিছু একটা লিখা। অজ্ঞ মানুষটা সেটা পড়তে না পারলেও আগত ছেলেটা যে বড় মাপের একটা মানুষ এইটা বেশ কড়াভাবেই বুঝতে পারলো। এইতো ইলেকশনের কয়েকদিন আগে এম্পি এসেছিল ওদের এলাকায়, তখনও তার গাড়ির সামনেও ঠিক এইরকমই একটা নেমপ্লেট লাগানো ছিলো। এই গাড়িতেও যখন সেইরকম ই একটা লাগানো, তো লোকটা নিশ্চয় বড়সড় মাপের কেও হবে!
– কোথায় হয়েছে অ্যাক্সিডেন্ট চলো তো!
পৃথক মুখে একটা মাস্ক এঁটে বলা মাত্রই সম্মুখে দাঁড়িয়ে লোকটা বেশ তৎপর হয়ে বলল,
– স্যার লোকটা অবস্থা দেখার মতো না। কয়েকটা লোক মিলে চেষ্টা করছিলো গাড়িত্তে বাইর করার হ্যার যা অবস্থা ডাক্তারের লোক আনতে হইবো৷
বলে সামনের দিকে এগিয়ে পথ চিনিয়ে পৃথককে নিয়ে গেলো। আজকে কাজ সেরে ওর অফিস থেকে বের হতে অনেকটা সময় লেগে গেছে। পার্শ্ববর্তী থানার অফিসার এসেছিলো ওর সাথে একটা কেস রিলেটেড আলোচনার জন্যে। বাড়িতে ফেরার সময় ভাবলো মেহরাজের সাথে একবার দেখা করবে, ওর ফোনে বার দুয়েক ফোন দিলেও প্রত্যেকটা বারই আনরিচ্যাবল দেখাচ্ছিল।
– দেহি সইরা যা তোরা, স্যারের দ্যাখতে দে
বলে সামনে থেকে কিছু লোক সরিয়ে দিয়ে জায়গা করে দিলো পৃথককে। রাতের অন্ধকারেও রাস্তার সোডিয়াম আলো আর কয়েকজনের হাতের টর্চের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলো পিচ ব্ল্যাক রঙের মার্সিডিজ টার বিধ্বংসী অবস্থা টা। ওই মর্মান্তিক দৃশ্যটা দেখবার চিন্তা হয়তো কল্পনাতেও করেনি পৃথক। চিৎকার করে উঠলো ‘মেহরাজ’ বলে। ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটে গেলো উল্টে থাকা গাড়িটার দিকে। ফ্রন্টের গ্লাস ভেঙে সারা শরীরে জড়িয়ে আছে মেহরাজের। পাশের সীট আর স্টিয়ারিং টা ভেঙে গায়ের উপর চেপে আছে। পৃথক আশেপাশের লোক গুলোর সাহায্যে বহুকষ্টে গাড়িটা সোজা করে সীটবেল্ট টা খুলে ধরাধরি করে মেহরাজকেনিজের গাড়িতে এনে বসালো, পেছনে একটা লোক ও বসেছে মেহরাজকে ধরে। পৃথক এক মুহুর্ত দেরী না করে গাড়িটা স্টার্ট করে তীব্র বেগে ছুটিয়ে নিলো। এক হাত দিয়ে স্টিয়ারিংটা খুব দক্ষভাবে সামলে আরেক হাতে ফোনটা তুলে কল করলো। খুব সৌভাগ্যবশত অনতিবিলম্বেই ফোনটা রিসিভড হলেই পৃথক ওপাশ থেকে কোনো প্রশ্ন বা জবাবের তোয়াক্কা না করে অস্থির স্বরে বলল,
– কোনো রকম প্রশ্ন বাদেই সিটি হসপিটালে চলে এসো অভিমন্যু, কুইক!
বলে ফোনটা ছেড়ে দিলো। কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই স্পীডের সীমা ছাড়িয়ে যত দ্রুত সম্ভব ছুটিয়ে নিলো। থেকে থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায় মেহরাজের দিকে। সাড়া শব্দ দূর একচুল নড়চড় নেই বিশাল শরীর টার৷ পরনের সাদা শার্টটা রক্তে ভিজে টকটকে, জবজবে হয়ে গেছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো পৃথকের৷ এই মুহূর্তে নিজেকে সবচেয়ে বেশি অসহায়, ভীতু মনে হচ্ছে। শঙ্কা, আশঙ্কায় শরীরটাও থরথর করে কেঁপে উঠছে। মেহরাজের কোনো জ্ঞান নেই, যেই পরিমাণ ব্লিডিং হয়েছে পৃথকের আত্মা শুকিয়ে আসছে আসন্ন ভয়ে।
…..
ঘরের ভেতর অনবরত পায়চারি করেই যাচ্ছে মোহর। ভেতরটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। কু গাইছে রীতিমতো। লোকটা বলল তো আসছে তাহলে এখনো এলো না কেনো। চিন্তায়, অস্থিরতায় মোহর আরও দুবার ফোন লাগিয়ে বসলো। মেহরাজের ফোনটা আনরিচ্যাবল বলতেই অন্তর আত্মা শুকিয়ে এলো মোহরের, হাত পায়ের তালু ঠান্ডা হয়ে তিরতির করে কেঁপে উঠলো ঠোঁট দুটো।
– ফোনটা বন্ধ কেনো? এখনো এলো না কেন রুদ্ধ? কী হলো! আমার এমন অশান্ত লাগছে কেনো সব। কেনো কু গাইছে মনটা। আল্লাহ্, রহম করুন। আমার ভয় হচ্ছে, খুব ভয় হচ্ছে।
মনটা সব কিছুর অজান্তেই হাজার বার বিপদ সংকেত দিতে থাকলো মোহরকে। ওর চরমসীমার দুঃশ্চিন্তাকে থমকে দিয়ে ফোনটা বেজে উঠলো। মোহর যতটা উৎসুকতা নিয়ে ফোনটা ধরেছিলো ততটাই শিথিলতার স্রোত বয়ে গেলো শরীরে। কাঁপা কাঁপা হাতে আননোউন নাম্বারের কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে অস্থির গলায় বলল,
– মিথিলাদি স্যারের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। অবস্থা ভালো না আপনি মোহর ম্যাডামকে এখনই কিছু বলবেন না। যদি পারেন কাল সকালে ওনাকে নিয়ে আসবেন।
অভিমন্যু যতটা অস্থিরতা নিয়ে কথাগুলো বলল ততটাই দ্রুততার সহিত লাইনচ্যুত করলো। মোহর চাপা আর্তচিৎকারে কাঁপুনি দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। চোখ মুখ প্রচণ্ড ধাক্কায় থম মেরে গেছে। মাথার মধ্যে বায়ুশূন্য অবস্থা বিরাজমানে মূর্তির মতো চেয়ে রইলো৷ কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে কল লাগালো।
একবার দুইবার করে পরপর তিনবার ফোন বেজে কেটে গেলো। পৃথক এখনো গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে যাচ্ছে, রাস্তাটা মনে হয় ফুরোতেই চাচ্ছে না৷ আরও একবার ফোনটা বেজে উঠতেই কী মনে হতে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে দুর্বোধ্য পরিষ্কার একটা কণ্ঠে বলল,
– ওই লোকটার আমার সাথে দেখা করার কথা ছিলো। লোকটাকে আমার চাই, তাকে যেভাবেই হোক বাঁচান ভাইয়া। মানুষটাকে আমি জীবিত চাই। আমার চোখের সামনে চাই
বলে খট করে ফোনটা কেটে দিয়ে ঘর থেকে বের হতেই মিথিলাও নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। মোহরের আর্তনাদ শুনেই ওর সবেমাত্র লেগে আসা ঘুমটা ছুটে গেছে। পেছন পেছন ইফাজ ও বেরিয়ে এলো। সুস্থির, পেরেশান হওয়া গলাতে বলল,
– কী হয়েছে মোহর?
মোহর ইফাজের প্রশ্নকে অবজ্ঞা করে মিথিলার হাতটা ধরে বলল,
– বুবু, আমাকে এক্ষুনি বের হতে হবে। ওই লোকটা অ্যাক্সিডেন্ট… আমার যেতে হবে!
বলে দ্রুতপায়ে এগিয়ে দরজা খুলেই বেরিয়ে গেলো। মিথিলা স্তম্ভিত রূপে তাকিয়ে থেকে ওকে পেছন থেকে ডেকে বলল,
– একা কোথায় যাচ্ছিস। কে বলল তোকে? দাঁড়া!…
কিন্তু সেই কথাগুলোর একটাও কানে যাইনি মোহরের। সিড়ি বেয়ে নেমে ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটতে শুরু করলো৷ এক ছুটে রাস্তার সামনে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনো যানবাহনের চিহ্নমাত্র পেলো না। কিন্তু উচ্ছেদিত মন এক মুহুর্ত স্থির হতে দিলো না। চওড়া সড়ক ধরে পা ছুটিয়ে দৌড় শুরু করলো মোহর। শরীরের সকল দূর্বলতা, ক্লান্তি সব যেনো উবে গেছে, তার বদলে ভর করেছে দানবীয় শক্তি আর বিদ্যুতের গতি। শরীরের সর্বোচ্চ শক্তিটুকু খাটিয়ে ছুটলো মোহর৷ পাথরযুক্ত রাস্তায় ওর নগ্ন পায়ের খাল উঠে যাচ্ছে হয়তো দৌড়ের গতিতে, তবুও থামলো না। এইতো আরেকটু পথ….আরেকটু! বলে প্রায় দশ মিনিট পায়ে দৌড়ে এসে দাঁড়ালো অভিমন্যুর বলা হসপিটালের সামনে। ওর নিজের ইন্টার্নশিপরত হসপিটালটা। কিন্তু এখন তো অনেক রাত ডক্টর কী আদৌ আছে! নানাবিধ চিন্তায় অস্থির মনটায় আবারও ছুটে উপরে এলো মোহর। শরীরের প্রত্যেকটা শিরা উপশিরা গুলো যেন গগনবিহারী হুঙ্কার দিচ্ছে, যন্ত্রণার দাবানল গুলো অ’মানবিক জু’লুম করছে৷ বক্ষস্থলের পাঁজরের ভেতরের ছোট্ট যন্ত্রটা প্রচণ্ড ভাবে উন্মাদনা তুলেছে।
হসপিটালের ইমারজেন্সী ওয়ার্ডের দিকে ছুটে যেতেই দণ্ডায়মান মানুষটাকে দেখে থমকে গেলো। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো তার কাছটায়, পৃথক এক কানে ফোন ধরে অনবরত কাওকে কল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, একহাত কানে আরেকটা হাত মাজায় রেখে মোহরের মুখটা দেখেই থমকে গেলো। ওষ্ঠদ্বয় আপনা আপনিই ফাঁক হয়ে এলো৷ ওর বিস্মিতদৃষ্টিকে পুরোপুরি এড়িয়ে মোহরের চোখ গেলো পরনের শার্টের দিকে। ইন করা আইভরি রঙের শার্টটার অর্ধেকাংশ জুড়ে টাটকা রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। মোহর ঠোঁট দুটি কিঞ্চিৎ নাড়ালো,কিন্তু তা হতে নির্গত কোনো শব্দের মাত্রা টা এতটাই ক্ষীণ ছিলো যা সন্নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা পৃথকের কানেও এলো না
– মোহর!
পেছন থেকে মেয়েলী ডাকটা এলেও ফিরে তাকালো না মোহর। মিথিলা আর ইফাজ এসেছে। মোহরকে ওভাবে ছুটতে দিয়ে ওরা বাড়িতে বসে থাকতে পারেনি, কোলের মেয়েটাকে পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার ঘুম ভাঙিয়ে তার কাছে রেখেই ছুটেছে দুজন। তবে এসবে একটু মাথা ঘামালো না মোহর৷ পৃথককে ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলো শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে দাঁড়িয়ে থাকা অভিমন্যু ব্যানার্জি। আর তার পাশেই দাঁড় করিয়ে রাখা একটা স্ট্রেচার।
মোহর মন্থর গতিতে এগিয়ে যেতে যেতেই পেছন থেকে পৃথকের প্রচণ্ড ধমকানি শোনা গেলো,
– এভাবে ওকে অপেক্ষা করিয়ে ম’রতে দেবো আমি? ডক্টর কই আপনাদের? রাতের বারোটা বাজতেই সব ঘরের কোণে ঢুকেছে! রাতে কী কোনো ইমার্জেন্সী কেস আসতে পারে না? এসব দ্বায়িত্ববোধ কী নেই আপনাদের?
– মি.পৃথক ইয়াসির। প্লিজ ডন্ট বি সো লাউড। এখানে আরও অনেক পেশেন্ট আছে
পৃথক এক মুহুর্তের জন্য থমকালো। অ্যাপ্রোন পরিহিত ডাক্তারটা এগিয়ে এসে বলল,
– এখানকার ডাক্তার রা দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন নয়। মাত্র একটা সার্জারী শেষ হলো। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার কথা ছিলো কিন্তু মোহরের ফোন পেয়ে আমি আবারও ফিরে এসেছি। মাইসেল্ফ ফায়াজ করিম।
মোহর যে নিজের মস্তিষ্কের হেরফের না করে খুব চৌকসতা খাটিয়ে হসপিটালে ঢুকেই রিসিপশন থেকে ফায়াজের সাথে কন্ট্যাক্ট করেছিলো এটুকু পৃথক বুঝতে পারলো না। তবে আপাতত সেসব নিয়ে ভাববার সময়টাও নেই৷ ফায়াজের সাথে এগিয়ে এলো।
কিছুক্ষণ আগেও যেই মানুষটা অস্থিরতম স্ফূর্তিতে বলল ‘আমি আসছি মোহ.. আমি আসছি’। যার পথ পানে চেয়ে চাতকের মতো চেয়ে রইলো সেই মানুষটাকে এই অবস্থায় দেখবার কথা কী কখনো ভেবেছিলো? এই যে স্তব্ধ,শ্রান্ত চেহারায় পাথরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, তার অন্তরালে যে ভয়ংকর হাহাকার আহাজারি চলছে তা কেও জানে! মোহর কাঁপা কাঁপা হাত দুটোর আঁজলায় নরম স্পর্শে ধরলো মেহরাজে র’ক্তাক্ত মুখখানা । গালের একপাশে একটা কাঁচ এখনো বিঁধে আছে, নিজের ভীষণ দূর্বল আঙুল খাটিয়ে কাঁচটায় টান দিতেই গলগল করে রক্ত ফিনকি দিয়ে ছুটলো সেই স্থান থেকে। মোহর পাগলের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো,পেছন থেকে ওর নাম ধরে যে কতগুলো ডাক এলো তার ছিটাফোঁটাও ওর কান অব্দি পৌঁছালো না। ওর ফিসফিসিয়ে বলল,
– এ্যাই! চোখ খুলুন, এখানে পড়ে আছেন কেনো? উঠুন! উঠুন রুদ্ধ।
অতঃপর কিয়ৎকাল নির্বিকারচিত্তে তাকিয়ে থেকে হা’মলে পড়লো মেহরাজের উপর। ওর দুগাল ধরে প্রবল আর্তচিৎকারে ফেটে পড়ে বলল,
– কেনো এমন করলেন! কেনো এমন হলো? আমাকে তো বললেন আপনি আসছেন আমার কাছে আসছেন! আমার কাছে না এসে হসপিটালে কেনো আসতে হলো! আমার সাথে এতবড় বেইমানি, নাফরমানী টা কীভাবে করলেন রুদ্ধ! এই দৃশ্য দেখার আগে আমাকে মে’রে ফেললেন না কেনো! আমি আর কত সইবো। এইটা আমি কী করে সইবো আল্লাহ্! উঠুন না, উঠে তাকান, আমাকে ডাকুন! আমি এসেছি। আর যাবো না,কোথাও যাবো না। যত বড় পাপ যত বড় অ’ন্যায় ই করুন আমি আর ছেড়ে যাবো না তবুও দোহাই আপনার আমাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিন৷ আপনার এই চেহারাটা আমায় কেনো দেখতে হলো রুদ্ধ! কেনো?
চিৎকার, কান্না, আহাজারিতে হসপিটালের পেটা দেওয়াল গুলো ও হয়তো কেঁপে কেঁপে উঠলো। মোহরের করুণ আকুতি ভরা কান্নায় কেঁপে উঠলো উপস্থিত মানুষ গুলোর স্থিতিশীলতার ভিত্তিও। অভিমন্যু নিঃশব্দে চোখের জল ছেড়ে দিলো। মোহর এক মুহূর্তে থেমে বড় ঢোক গিয়ে মেহরাজের শরীরের উপর উবু হয়ে ক্ষত স্থান গুলোয় উদ্ভান্ত্রের ন্যায় হাত বুলিয়ে দিলো, হাহাকারের সুরে বলল,
– উঠুন না। একবার উঠুন। আপনাকে ওই বদ্ধ ঘরের ছুড়ি, কাঁচির কাছে পাঠাতে আমার অন্তর আত্মাও কেঁপে উঠছে, ওই ঘরকে আমি আর ভরসা করিনা। আপনাকে আমি ওইখানে কি করে পাঠাবো!
বলে মুখ ঝুঁকিয়ে উন্মাদের মতো ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো মেহরাজের নাকে, মুখে,কপালে, ঠোঁটে। নিজের ফ্যাকাসে মুখখানাও স্বামীর রক্তে রক্তাভ করে ফেললো। উপস্থিত জ্ঞান,বুদ্ধি, বিবেক সব হারিয়ে মেহরাজের রক্তাক্ত মুখে অসংখ্য চুমু লেপ্টে দিয়ে বলল,
– আমাকে ছেড়ে যাবেন না রুদ্ধ । আপনি ছাড়া আমার কেও নেই কেও না! আমি শুধু আপনাকেই চাই৷ আমি সব সহ্য করে নেবো আপনার এই মুখটা না দেখে একটা মুহূর্ত সহ্য করতে পারবো না৷ এত বড় জু’লুম আমার ওপর করবেন না। আপনার এই চেহারাটা দেখবার শক্তি আমার নেই। আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবেন গো আমায় নিজের সাথে নিয়ে চলুন। কথা বলছেন না কেনো! উঠুন, উঠুন না
মেহরাজের শরীরের রক্ত মোহরের সারা হাতে,গায়ে,মুখে লেগে গেছে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পাগলেই মতো ও সৌষ্ঠব পুরুষালী শরীর টার অবচেতন নিথর দেহটাকে ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে। ফায়াজ এই দৃশ্য বেশিক্ষণ হজম করতে পারলো না। মোহরকে ও ভালোবাসে, সব কিছুর নির্বিশেষে ওকে ও ভালো দেখতে চেয়েছে। সেখানে ওর এই আহাজারি বুকের নরম মাংসটাকে কাঁপিয়ে তুলছে!..
– ও নিজের সেন্সে নেই মিথিলা। সরিয়ে আনো ওকে৷ শান্ত করো না তো এবার ওর সাথে বড়সড় অ্যাক্সিডেন্ট ঘটবে৷
মিথিলা ফোঁপাতে ফোপাঁতে এগিয়ে গেলো৷ মোহরকে পেছন থেকে সজোরে ঝাপটে ধরে সরিয়ে আনতে গেলে মোহর চিৎকার করে বলল,
– আমাকে থাকতে দে না বুবু। এই পাষাণ লোকটার কাছে আমায় থাকতে দে। ওকে বল না আমি ম’রে যাবো ওকে ছাড়া। এটা কেনো হলো বুবু আল্লাহ্ আর কতো নিষ্ঠুর হবে আমার উপর। ওই ক্ষত গুলো ওকে যতটা কষ্ট দিচ্ছে ততটাই আমাকেও দিচ্ছে। সারাটা শরীর ওর রক্তে ভেজা, এতটা যন্ত্রণা ও কী করে সইবে। এতো বড় অ’মানবিকতা কী করে আল্লাহ্ হতে দিলো৷ আমার রুদ্ধ কে আমার কাছে ফিরিয়ে দে তোরা বুবু, আমার মানুষ টাকে আমার বুকে ফিরিয়ে দে।আমি আর কোনো অভিযোগ করবো না।এসব দুনিয়াবি কিচ্ছু চাইবো না কিচ্ছু জানার দরকার নেই বুবু। আমি মানুষটাকে নিয়েই বাঁচতে চাই, ও কী জানে না আমি ওকে কতটা ভালোবাসি ওকে উঠতে বল না!
ফ্লোরে বসে মিথিলার পা চেপে ধরলো মোহর। মিথিলার সমস্ত দুনিয়াটা যেনো অন্ধকার হয়ে উঠলো। দিকবিদিকশুন্য হয়ে গেলো। কী করবে ও! মোহরের এই কথাগুলোর জবাবে ও কী বলবে। নিজেকে দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি অসহায়, অযোগ্য মনে হলো। চোখের সামনে নিজের ছোট বোনটার এইরকম হাহাকার দেখেও মুখ বুজে গিলতে হচ্ছে সবটা।
আর একটুও বিলম্ব না করে ফায়াজের সাথে আরও একজন ডক্টর কতগুলো নার্স ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ঢুকলো ঘরটায়। মোহর ঝাপসা চোখে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলো বাঁচা-মরার মাঝামাঝি পর্যায়ে লড়াইয়ের ঘরটার দিকে। এক একটা মুহুর্ত ওর বুকে অনিশ্চয়তার পাথর চাপিয়ে দিলো। ওর ভয়, আকুতি, আহাজারি তো অযথা ছিলো না! মেহরাজের অবস্থা টা যে আদৌ কতটুকু ভরসাজনক অন্তত এইটুকু বোঝার বিদ্যে ওর আছে। তবুও চোখের পানি ঝরিয়ে প্রতিটা বিন্দুর সাথে সাথে দয়া ভিক্ষা চাইলো রবের কাছে। চার চাকার যেই জিনিসটায় শুইয়ে নিয়ে গেলো লোকটাকে, যেই নিষ্প্রাণ দেহটাকে হাজারো ডেকেও সাড়া পেলো না সেই মুখটা আবারও চঞ্চল দেখবার আকুল আর্জি,মিনতি, আকুলিবিকুলি সবটা প্রাণভরে সপে দিলো সৃষ্টিকর্তার কাছে। হসপিটালের ঝকঝকে মেঝেতে ঠাঁই পড়ে রইলো নির্জীব চিত্তে, একবুক সমান কাকুতি নিয়ে তাকিয়ে রইলো কক্ষটার দিকে
.
.
.
চলমান
#Humu_❤️