ফানাহ্ পর্ব-৫৫

1
1546

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫৫
#হুমাইরা_হাসান

– কেনো করলেন এমনটা?

স্তব্ধতায় আবিষ্ট ঘরটায় মোহরের ক্লিষ্ট কণ্ঠের করুণ কথাটাতে ভীষণ রকম অসহায়ত্ব আর বিভৎস যন্ত্রণাটা স্পষ্ট। মেহরাজ একদম নিশ্চল,শানিত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে,পকেট থেকে হাতটা বের করে দু’কদম এগিয়ে আসলেই মোহর এক হাত তুলে থামিয়ে বলল,

– দাঁড়ান। আমার কাছে আসবেন না, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।

মেহরাজ দাঁড়িয়ে পড়লে মোহর ব্যস্ত হাতে চোখের পানি মুছে নিলো। ঢোক গিলে বলল,

– আমার আব্বার ব্যাপার টা আপনি আগে থেকেই জানতেন?

– জানতাম।

– আপনারই বাপ চাচারা মিলে যে ষড়যন্ত্র করে আমার বাবাকে খু’ন করিয়েছে এটাও আপনি জানতেন?

– জানতাম।

– আমার উপর যে কয়বার হাম’লা করা হয়েছে এসবেও আপনি আগে থেকেই অবগত ছিলেন?

– ছিলাম।

বুকের মাঝে ছোটাছুটি করা জলন্ত অগ্নিশিখা গুলো যেনো তীব্র দাবদাহে পুড়ি’য়ে দিলো ভেতরটা। দগ্ধ হৃদয় নিংড়ে এক একটা হরফ উচ্চারণ করতেও সারাটা শরীরে বিষাদ সিন্ধুর ঢেউ গুলো গলা অব্দি ডুবিয়ে নিচ্ছে। মেহরাজের এক একটা সহজ, সাবলীল ভাবে দেওয়া স্বীকারোক্তি গুলো অন্তঃস্থলের দহনে পীড়িত করছে মোহরের সমস্ত দুনিয়া খানি। বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নিলো, বহু কষ্টে কণ্ঠনালী চিরে একটা বাক্য বেরিয়ে এলো ওর মুখ থেকে,

– আমার বাবার হ’ত্যার সাথে আপনার নামটাও জড়িত রুদ্ধ?

– জড়িত।

প্রশান্ত সাগরের ন্যায় যেন অকাট্য,অবিচল,শীতল এক একটা জবাব। মুখ থেকে নিঃসৃত হতে নাইবা কোনো ভনিতা নাইবা জড়তা ছিল। মোহরের চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে এলো, বড়ো বড়ো শ্বাস ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করার প্রচণ্ড চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। দম বন্ধ হয়ে শরীরের প্রতিটা স্থানে স্থানে জ্বলন ধরেছে, এই জ্বলনের কারণ কোনো বাহ্যিক উৎস বা বস্তু নয়! এই জ্বলন তো ভেতরের। পুড়ে ছারখার হওয়া অন্তরের দহন যা ক্রমেই গ্রাস করছে মোহরকে। আশ্চর্য! শরীর টা এতো খারাপ করলো কেনো? কোথাও একবার জেনেছিল মানুষের মানসিক অবস্থার সাথে শারীরিক অবস্থা টাও নাকি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানসিকতা যখন প্রবল ধাক্কায় বিধ্বস্ত হয়ে সমস্ত নার্ভ গুলো সাময়িক অচল হয়ে যায় তখন শরীর ও তার সাথে সাঁই দিয়ে মুষড়ে পড়ে। মোহরের ও কী তাই হলো? কিন্তু চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া সত্তা টা যেনো দমলো না বুক চিরে চিৎকার বেরিয়ে এলো,

– ধোঁকা! বিশ্বাসঘাতক.. এতো বড় প্রতারণা করতে আপনার বুকটা কাঁপলো না? আমার বাবাকেই হ’ত্যা করে আমাকে বাঁচানোর নাটক করে ফাঁসিয়েছেন! ভালোবাসা নামক শব্দটার জঘন্য ব্যবহার করে আমার সমস্তটাকে গ্রাস করে নিয়েছেন! ঠক আপনি মেহরাজ আব্রাহাম। আমাকে অন্ধকারে রেখে নিজের সাজানো নাটক দেখিয়ে গেছেন এতদিন আর আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি

সশব্দে কেঁদে উঠলো মোহর। নিজের ভরটা সামলাতেও ব্যর্থ হলো। ধপ করে ফ্লোরে বসে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। মেহরাজ পাথরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, চোখ দু’টোয় অনড়, স্থির ভাবে তাকিয়ে আছে মোহরের দিকে। যেনো একটা জীবন্ত যন্ত্রমানব।কোনো প্রকার অভিব্যক্তি প্রকাশের অবকাশ দূর কোনো কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। এটা কি হচ্ছে! ওর সামনে বসে কে কাঁদছে! মোহ? ওর মোহমায়া? কী আশ্চর্য! যার একটুখানি মলিন মুখ ওর মনে অশান্তির ঘোরতর কোন্দল তোলে সেই মোহ ওর সামনে বসে ছটফট করছে যন্ত্রণায় অথচ ও দাঁড়িয়ে দেখছে? হুট করেই যেনো সম্বিত ফিরল মেহরাজের। ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো মোহরের সামনে। দুহাতে ওর বাহুদ্বয়ে গাঢ় চাপ বসিয়ে তোলার প্রয়াস করে বলল,

– মোহ! আমার মোহ। কাঁদছেন কেনো আপনি? কি হয়েছে? কাঁদবেন না প্লিজ, আপনাকে কাঁদতে দেখলে আমার কষ্ট হয়, কাঁদবেন না মোহ!

মোহর মেহরাজের ব্যস্ত, অস্থির চেহারাটায় চেয়ে রইলো কেমন বোকা বোকা মুখ করে। অতঃপর ও উঁচু হয়ে মেহরাজের দুগালে হাত রেখে বলল,

– আপনি মিথ্যে বলছেন তাই না? তাই না রুদ্ধ? বলুন না আপনি যা যা স্বীকার করলেন সব মিথ্যে। এসব জাল ব্যা’বসা, দূর্নীতি, অ’সৎপথ এসবের সাথে আপনার কোনো যোগাযোগ নেই। বলুন না, আমার বাবার হ’ত্যার সাথে আপনার কোনো সংযোগ নেই। আপনি নির্দোষ। আপনি রুদ্ধ, শুধুমাত্র আমার স্বামী আমার ভালোবাসা আমার একমাত্র আশ্রয়ের ঠিকানা আর বাকিসব মিথ্যে। বলুন রুদ্ধ বলুন..

মেহরাজের কলার প্রচণ্ড শক্ত ভাবে চেপে ধরে এক প্রকার চ্যাঁচিয়েই বলল কথাগুলো মোহর। ওর কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না। কি হলো এটা! ওই পেনড্রাইভের ভিডিও আর ডকুমেন্টস যাসব স্পষ্ট আঙুল তুলে দেখাচ্ছে তা ওই ফাইলকেই ইঙ্গিত করছে। যেই তথ্য,ঠিকানা যোগাড় করতে ওর বাবা প্রাণটা হারালো সেটারই নীল নকশা জলন্ত আমলনামা ওই ফাইল যেখানে এক্কেবারে প্রথম পৃষ্ঠাতেই জ্বলজ্বল করছে ‘Abraham’ নামটা। অর্থাৎ যেই শরীর খোঁজার জন্য মরিয়া হলো ওর বাবা তারই মাথা মেহরাজ নিজে! যাকে বলে দ্যা মাস্টারমাইন্ড! মোহরের এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, মনে হচ্ছে একটা দুঃস্বপ্ন। ওর রুদ্ধ কখনোই খু’নী হতে পারেনা। তবে মোহরের এই নিভুনিভু আশার প্রদীপ টাকে স্বয়ং মেহরাজ নিভিয়ে দিয়ে বলল,

– সত্য মোহ, আপনি যা দেখেছেন আর যা জেনেছেন সবটাই সত্য।

তড়িৎ গতিতে হাতটা আলগা হয়ে এলো মোহরের। অশ্রুপূর্ণ নয়নের প্রসারিত দৃষ্টিতে তাকালো ধূসর বর্ণা চোখের দিকে। মেহরাজের ধূসর চোখ দু’টো আজ ওর বিষাক্ত মনে হচ্ছে যা ক্রমেই ছড়িয়ে দিচ্ছে বিষব্যথা । যে চোখে ও এক জীবনের ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিল সেই চোখটাই ধূসর বিষন্নতা ছড়িয়ে অসহ্য করে তুললো ওর সমস্তটা। তীব্র এক ধাক্কা মেহরাজের বুকে দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,

– খবরদার, ওই নোংরা হাতে আমাকে স্পর্শ করবেন না। অভিশপ্ত আপনি, আমার জীবনটাকে জলজ্যান্ত অভিশাপের কূপের মতো কূলহীন করে দিয়েছেন। ঘৃণা হচ্ছে আমার, প্রচণ্ড ঘৃণা. ইয়া মাবুদ! এ তুমি কার হাতে আমাকে তুলে দিলে যে কী না আমারই জীবনটা ধ্বংসের জন্য দায়ী!

আহ্ . . কী নিদান করুণ সে আর্জি। মোহরের কম্পিত স্বরের চাপা আর্তনাদে ঘরের দেওয়াল গুলোর ও ভিত নড়ে গেলো যেনো। তীব্র বিষন্ন যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে দু’হাতে নিজের মুখটা চেপে ধরে বলল,

– আমার কষ্ট হচ্ছে, খুব খুব। ন্ নাহ এসব সত্য না । আমি স্বপ্ন দেখছি স্বপ্ন, এগুলো মারাত্মক রকমের দুঃস্বপ্ন এ সত্য হতে পারেনা।

ফিসফিস করে আবল তাবল বলতে বলতে ছুটে ঘরের বাহিরে যাওয়ার চেষ্টা করলে মেহরাজ উঠে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,

– শান্ত হন মোহ। এমন অস্থির হবেন না অসুস্থ হয়ে যাবেন। আমার কথাটা শুনুন আমি..

মোহর ধাক্কা দিয়ে মেহরাজকে সরিয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু মেহরাজের হাতের বন্ধন আলগা করতে না পেরে রীতিমতো ধস্তাধস্তি শুরু করলো। মেহরাজ ওকে শান্ত করার হাজারো প্রচেষ্টা করলেও একটা কিচ্ছু কান অব্দি পৌঁছালো না ওর, এক সময়ে ব্যাপক ভাবে মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে ক্লান্ত হয়ে জ্ঞান হারালো। মেহরাজ এক টান দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরলো মোহরের নিস্তেজ শরীরটা। ওর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,

– পৃথিবীতে শুধু একটা সত্যই আমি মানি। আর তা হলো আমি আপনাকে ভালোবাসি মোহ। ভীষণ রকম ভালোবাসি, আপনি যা দেখেছেন তা দেখা আপনার একেবারেই উচিত হয়নি, কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি!

….

ঠিক কতটা সময় পেরিয়েছে হিসেব জানা নেই। নিস্তেজ শরীরে বিছানাতে পড়ে থাকা শরীর টা মৃদু নড়েচড়ে উঠলো। দু চোখ কুঁচকে আস্তেধীরে প্রসারিত হলো দৃষ্টি। ভার হয়ে থাকা মাথাটা টেনে তুলে উঠে বসতেই হতবাক চোখে ঘরের চারপাশ টা দেখলো। সকাল হয়েছে! ঘড়িতে সাতটা। মোহরের কাল রাতের ঘটনা টা মনে পড়তেই এক ছুটে বেরিয়ে এলো, অন্ধকার কুঠুরির মতো সেই ঘরটাতে ঢুকলে ঠিক আগের মতোই ফ্লোরে কালো রঙের ডিভাইসটা পড়ে থাকতে দেখে ধপ করে নিভে গেলো সব আশার প্রদীপ, শরীরের রক্ত গুলো অস্বাভাবিক রকমের সঞ্চারিত হলো। রাতের ঘটনাটাকে দুঃস্বপ্ন ভেবে ছুড়ে দেওয়ার যেই আশাটুকু নিয়ে ছুটে এসেছিল তাতে বাজ পড়ার মতো সব চুরমার হয়ে গেলো। রাগ,ঘৃণা,কষ্টে বুক চৌচির হলো। পেনড্রাইভটা হাতের মুঠোয় নিয়ে দ্রুতপায়ে ঘরে ফিরলো। চোখে মুখে কয়েকবার পানির ঝাপটা দিয়ে এসে আলমারি থেকে ফটোফ্রেমটা বের করে হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে নিলে দরজার সামনেই মেহরাজকে দেখে পা দুটো থেমে গেলো।

– কোথায় যাচ্ছেন মোহ?

– যেখানে ইচ্ছে তবে এই জাহান্নামে নয়।

মেহরাজ বিচলিত না হয়ে শান্ত ভঙ্গিমাতে বলল,

– এটা আপনার বাড়ি,আপনার ঘর। ছেড়ে কোথায় যাবেন আপনি?

– আমার নাহ,কিচ্ছু আমার না। এগুলো বাড়িঘর নয়, এক একটা পাপের ফসল৷ প্রতিটি ইট গুলো কা’লো টাকার এক একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ। এসব আমার নয়

বলে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলে মেহরাজ ওর হাতটা চেপে ধরে বলল,

– যাবেন না মোহ! আমায় ছেড়ে যাবেন না। আমাকে বিশ্বাস করবেন না?

– বিশ্বাস তো করেছিলাম, কি পেলাম তার পরিবর্তে? প্রতারণা!

ঝামটা দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পূনরায় বলল,

– আমি ভুলে গেলাম কখনো কাওকে ভালোবেসেছিলাম। আজ থেকে আপনি আমার চোখে একজন খু’নী ছাড়া কিচ্ছু নন।

এক মুহুর্ত আর দাঁড়ালো না। দেখলো না ওর যাওয়ার পানে তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকা চোখজোড়া,কথার খঞ্জরে ক্ষ’তবিক্ষত হওয়া বুকখানা। দেখলো না শান্ত চোখটায় আজ কতটা যন্ত্রণা, দহন।

পানের বাটা নিয়ে দু পা ছড়িয়ে বসেছিলেন পৌঢ়া, তবে হাতের বস্তুটা মুখে পুড়ার আগেই দরজার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো। কোনো প্রশ্ন বা উৎসাহ ছাড়াই এগিয়ে এসে শাহারা বেগমকে সালাম করে মোহর বলল,

– এ বাড়িতে আসার পর সর্বপ্রথম স্নেহ আর ভালোবাসাটা আপনার থেকেই পেয়েছিলাম। তাই সেই দায়ে অন্তত আপনাকে বিদায় দিতে এলাম, ভালো থাকবেন

বলে বেরিয়ে যাবে কিন্তু দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে হুট করেই পেছন ঘুরলো, শাহারা বেগমের চোখে চোখ রেখে বলল,

– আপনাকে খুব বিশ্বাস করতাম আমি। অথচ আপনি কি না আমারই বাবার খু’নীর মা। আর সবটা জেনেও আমাকে অন্ধকারে রাখতে সহায়তা করে গেছেন!

বলে তাচ্ছিল্য হাসলো মোহর। যে হাসিতে রাগ,ঘৃণার স্পষ্ট প্রতিফলন দেখতে পেলেন বৃদ্ধা। বুকটা ছ্যাত্ করে উঠলো। এই মেয়ে কি বলল! তবে কী? শাহারা বেগম তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে নেমে আসতে চাইলেন। তবে দূর্বল শরীরটা খুব একটা সাঁই দিলো না। যতক্ষণে দরজা অব্দি এসেছে ততক্ষণে মোহর নাগালের বাহিরে। মোহরের এই বিধ্বস্ত চেহারাটা আরও এক জনের চোখে পড়লো। কিছু একটা ভেবে হাতের বাসন টা রেখে ছুটে এলো মোহরের পিছু পিছু

– দাঁড়াও!

বলে এক প্রকার দৌড়ে মোহরের সামনে এসে ওর হাতটা চেপে বললেন,

– কোথায় চললে তুমি এভাবে। এই অবস্থায় বেরোচ্ছ কেনো?

মোহর আম্বি খাতুনের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

– আমাকে দেওয়া গুরুদায়িত্বটা ফিরিয়ে নিন মিসেস মুর্তজা। কারণ একজন খু’নীর সাথে সংসার করার মতো উদার আমি নই। আপনি সহ্য করে যাচ্ছেন। আমি করবো না, আমার দ্বায়িত্ব পালনের জন্য যা যা দরকার আমি করবো। জানিয়ে দিবেন ক্ষমতাধর মানুষ গুলোকে, মাহবুব শিকদার নেই, তবে তার মেয়ে এখানো জীবিত আছে।

বলে খালি পায়েই হাঁটা দিলো। পরনে কুঁচকে যাওয়া সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ। ওড়নাটা গলার দুপাশে পেঁচিয়ে ঝুলানো। এক হাতের মুঠোয় পেনড্রাইভে আরেকটায় ফটোফ্রেম। বুকের ভেতর তীব্র জ্বালা নিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। গেইট পার হতে রূপালী বর্ণের নেমপ্লেটটা চোখে বাঁধতেই মনে পড়ে গেলো প্রথম দিনের কথা, সেদিনও ঠিক একইরকম বিধ্বংসী, চূর্ণবিচূর্ণ অবস্থায় মাড়িয়েছিল আব্রাহাম ম্যানসনের চৌকাঠ। আজও তাই, শুধু পার্থক্য একটাই, সেদিন পাশে মেহরাজ ছিলো আজ নেই!

•••

– সকাল বেলা সকালে এভাবে হোস্টেলের বাইরে এসে সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেনো কী সমস্যা?

অভিমন্যু হাতের ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে ভ্রুকুটি করে বলল,

– প্রায় এক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। নিচে নামতে এতো সময় লাগে?

শ্রীতমা বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলো অভিমন্যুর পানে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে লোকটা। পরনে সাদা কালো টি-শার্ট আর ট্রাউজার। গোলগাল মুখের চোখ দু’টো ফোলা ফোলা, সকালের মৃদু কুয়াশায় চশমার গ্লাসটা ঝাপসা হয়ে আছে। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে খুব জলদি হাতে চশমাটা মুছে আবারও চোখে পড়ে বলল,

– এমনিতেই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি আপনার জন্য এখন চলুন আমার সাথে

– কোথায় যাবো আমি? আর আপনিই বা সাত সকালে লেডিস হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন কেনো৷ জানেন কতগুলো মেয়ে জানালা দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলো? একজন তো বলেই দিয়েছে আমার বয়ফ্রেন্ড নাকি। আপনি কী এবার আমাকে বদনাম করে ছাড়বেন?

– আজব, একটা মানুষ কী দেখাও করতে আসতে পারেনা? আর লোকে কী ভাবলো তাতে আপনার কী? লোকে কী আপনাকে খাওয়াচ্ছে নাকি পড়াচ্ছে?

– কোনোটাই না

শ্রীতমা বিব্রত মুখে চেয়ে বলল। অভিমন্যুকে আজ একেবারেই অন্যরকম লাগছে।চিরচেনা বোকা বোকা ভাবটা আর মুখে নেই। কেমন গম্ভীর একটা ভাবসাব এঁটে রয়েছে। লোকটার মাথায় আদৌ কী চলছে তার ন্যূনতম ধারণা করতে পারলো না শ্রীতমা। তবে ওর ভাবনার মাঝেই অভিমন্যু তাড়া দিয়ে বলল,

– এখন আমার সাথে চলুন

বলে নিজে নিজেই এগোতে নিলে শ্রীতমা পেছন থেকে বলল,

– আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না। একটু পরেই আমাকে হসপিটালে যেতে হবে, আর তাছাড়াও আপনার সাথে কোথাও যাওয়ার কোনো কারণ বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই।

– ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হবেই।

অভিমন্যুর কথায় কেমন গুরুতর ভঙ্গিমা। চোখ মুখে কেমন আম্ভরিকতার ছাপ। শ্রীতমা অনেকটা ঘাবড়ালো। তবুও সাহস করে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

– বললাম তো যাবো না, মানে যাবোই না। আপনি কী এখন আমাকে জোর করে নিয়ে যাবেন?

– শুধু জোর করে নিয়েই যাবো না আরও অনেক কিছু করবোও।

বলে শ্রীতমার ডাম হাতের কব্জিটা সজোরে চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে এগিয়ে নিলো। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটার দরজা খুলে ওকে বসিয়ে দিয়ে ধড়াম শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। শ্রীতমা চমকে কেঁপে উঠলো। লোকটা ভীষণ রেগে আছে, কিন্তু কেনো? দুইদিন সময় তো দিয়েছিলো তার মধ্যে একদিনও পার হয়নি। তবে এমন হম্বিতম্বি করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে?
অভিমন্যু গাড়িতে বসে সীটবেল্ট বেঁধেই গাড়িটা স্টার্ট দিলো। শ্রীতমা চ্যাঁচিয়ে বলল,

– এই আপনি আমাকে তুলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? এবার কিন্তু বারাবাড়ি রকম হয়ে যাচ্ছে। কী সমস্যা আপনার আমাকে নিয়ে। কাল যা বলেছিলেন তার দুইদিন তো পারও হয়নি। তবুও কীসের…

– মুখটা বন্ধ করে সীটবেল্ট লাগাও। নাতো এক ধাক্কা লাগলে কাঁচ ভেঙে উড়ে যাবে । কাজের কাজ তো কিছুই হবে না শুধু আমার গাড়ির গ্লাসটা যাবে।

শ্রীতমা হতবিহ্বলিত হয়ে তাকায়। অভিমন্যু আজ এভাবে কেনো কথা বলছে! কী করবে ও? কোথায় ই বা নিয়ে যাচ্ছে। আদৌ কী হতে চলল? অযাচিত ভয় জেঁকে ধরলো শ্রীতমাকে। অভিমন্যুর মুখাবয়ব দেখে আর একটা শব্দ করার সাহস টাও ওর হলো না। কিন্তু কেনো? হুট করে এই মানুষটা পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে গেলো কি করে? আর ওই বা ভয় কেনো পাচ্ছে!

•••

ওড়নার আঁচলে হাতটা মুছে কোল থেকে মেয়েটাকে ইফাজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দরজার দিকে এগোলো মিথিলা। এতো সকাল করে কে এলো বুঝতে পারলো না। আত্মীয়হীন শহরটাতে এই সাত সকালে তলব করার মতো মানুষ টার নাম আন্দাজ করা গেলো না। তবে দরজা খুলতেই একটা চেহারা দেখে যতটা না খুশি হলো তার চেয়েও অধিক হতবাক হলো। বিস্ময়ের সহিত বলল,

– কী রে! তুই এতো সকালে? হুট করেই চলে এলি যে? আমাকে একটা ফোন তো দিতিস।

– ভেতরে আসবো না?

এই হলো মিথিলার স্বভাব। সবসময়ই আগে আগে নিজের কথাগুলো বলে ক্ষান্ত হয়। অপরপাশের জবাবের প্রতীক্ষা টাও যেনো ওর দ্বারা হয়না।

– ওহ হ্যাঁ। আই আই।

বলে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালে মোহর ভেতরে এলে দরজাটা লাগিয়ে ওর পিছুপিছু এসে বলল,

– কী হয়েছে মোহর? এই অবস্থা কেনো তোর? পায়ে এতো নোংরা,পোশাক আশাকও এলোমেলো। এইরকম অবস্থায় সাত সকালে কেনো এসেছিস? কী হয়েছে তোর?

মিথিলার কণ্ঠে স্পষ্ট কৌতূহল, উৎকণ্ঠা। ইফাজ মোহরকে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল,

– মোহর যে! অনেক দিন পর এলে। বোসো তুমি।

মোহর হাসতে চাইলো সৌজন্যে। তবে হাসিটা যেনো চেষ্টা করেও আনতে পারলো না। মিথিলা এগিয়ে এসে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,

– এই! তোর কী হয়েছে? সত্যি করে বল? এমন দেখাচ্ছে কেনো তোকে?

স্বরযন্ত্র ভেদ করে উগড়ে আসা কান্না গুলো দাঁতে দাঁত চেপে আঁটকে নিলো মোহর। যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখা চেষ্টা করে বলল,

– বলবো, সব বলবো। আগে বল আমাকে তোদের কাছে থাকার জায়গা দিবি? শুধু একটা ঘর দে যেখানে আমি থাকতে পারবো!

মিথিলার সন্দেহ এবার দৃঢ়বিশ্বাসে পরিণত হলো। মোহরের চোখ মুখ মোটেও স্বাভাবিক নয়। ও প্রবল দুঃশ্চিন্তা সামলে বলল,

– এড়িয়ে যাস না মোহর। আমাকে বল কী হয়েছে? মেহরাজ কোথায়? তুই এভাবে কোত্থেকে এলি? আর থাকার কথায় বা কেনো বলছিস?

– প্রশ্ন করিস না বুবু! আমি নিজেই বলবো সব। আপাতত আমাকে একটু জায়গা দে, আমি একটু একা থাকতে চাই।

মোহরের উচ্চস্বরে দমে গেলো মিথিলা। মনের ভেতর ঝড় তোলা প্রশ্ন আর ব্যাকুলতাকে থামিয়ে মোহরকে গেস্টরুমটা দেখিয়ে দিতেই ও ভেতরে ঢুকে ধপ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। আপাতত একটু একা থাকতে চাই মোহর, একদম একা। যেই ঝড়টা শুরু হয়েছে এর তাণ্ডব কতদূর পৌঁছবে যানা নেই তবে সবটা যে এফোড় ওফোড় করে দিবে তা সুনিশ্চিত।

.
.
.
চলমান

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে