ফানাহ্ পর্ব-৫৪

2
1460

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫৪
#হুমাইরা_হাসান

– আমাকে বিয়ে করবেন?

বিমূঢ়, হতবিহ্বলিত হয়ে চেয়ে রইলো শ্রীতমা। হুট করেই বলা কথাটা স্পষ্ট শুনতে পারলেও একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল যার কারণে থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইলো।

– আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই শ্রী।এবং তা খুব শীঘ্রই।

অবান্তর কথাবার্তা শুনে বেশ বিরক্তির সাথে সম্বিত ফিরল শ্রীতমার। কপালে চওড়া ভাঁজ ফেলে বলল,

– আপনার মাথা ঠিক আছে? আচমকা কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে বলছেন ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই আর তা খুব শীঘ্রই’ সার্কাস চলছে নাকি? আপনার যখন যা মনে হয় তখন না বলে দিয়ে বসে থাকবেন!

– আমার মাথা একদম ঠিক আছে। আর আমি যা বলছি সম্পূর্ণ সিরিয়াস ভাবেই বলছি সার্কাস, ইয়ারকি কোনো টাই না।

– ওমনি বলে দিলেন আর হয়ে গেলো? নিজেকে কি মনে করেন হ্যাঁ? সেদিন আপনার ওই বানোয়াট নাটক টার জন্যে আমি তাদের দুজনের চোখে কতটা নিচে নেমে গেছি জানা আছে? যেই মানুষ টা কোনো পরিচয় ছাড়াই আমাকে এতো স্নেহ করত সেই মানুষ টাই রাস্তায় আমাকে দেখলে এড়িয়ে যায়। এই মিথ্যেটার জন্য দুটো মানুষের মন ভেঙে কি লাভটা হলো! তবুও আপনার মন ক্ষান্ত হয়নি? আপনি আবারও এসেছেন আরেক নাটকের স্ক্রিপ্ট নিয়ে?

রাগের চোটে কণ্ঠনালী কেঁপে উঠলো শ্রীতমার। অভিমন্যুর এসব হেয়ালিতে রীতিমতো বিরক্ত হচ্ছে ও। যখন যা মনে হয় বলে দিচ্ছে ছেলেটা, মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি!
অভিমন্যু এতগুলো উত্তেজনা পূর্ণ কথা শুনেও হেলদোল করলো না। আগের মতোই স্থবির চেহারায় তাকিয়েই বলল,

– আমি না কোনো ইয়ারকি করছি নাইবা কোনো মিথ্যে নাটক সাজাতে এসেছি। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই আর এবং তা সত্য। হ্যাঁ আমি মানছি নিছক ফাজলামোর সুত্র ধরে যেটা আমি শুরু করেছিলাম সেটা মোটেও ঠিক হয়নি। আর তার ফল আমি এখনো ভোগ করছি। বিশ্বাস করুন আমার বাবা মা রেগে নেই আপনার উপর আর না আপনি তার চোখে নিচু হয়েছেন। বরং তারা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, মা বাবার এরকম ধারণা হয়েছে যে আমার উপর প্রেসারাইজ করার কারণে আমি এটা করতে বাধ্য হয়েছি তাই তারা এখন আর আমাকে প্রয়োজন ব্যতীত একটা কিচ্ছু বলে না। আর এটা আমাকে কষ্ট দেয়,ভীষণ রকম। আমার বাবা মা আর আগের মতো আমার সাথে হাসি মজা, খুনসুটি করে না। নিজেদের যত্নও নিতে চায় না। অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হয়ে এসব আমি সহ্য করতে পারছিনা আবার কাজের জন্য খুব একটা সময় ও দিতে পারছিনা।এটা আমাকে ক্রমশ অপরাধী বানাচ্ছে। আমি চাই তাদের সাথে থাকার জন্য, যত্ন করার জন্যে হলেও একজন দরকার সে জন্যেই আমি বলতে এসেছি।

শ্রীতমা ক্ষান্ত হলো খানিক। উগড়ে পড়া রাগটা সামাল দিয়ে ধাতস্থ হলো। তবে আক্রোশ কমলো না। কটাক্ষ করে বলল,

– আপনার কয়টা লাগে বলুন তো! সেদিন ও দেখলাম একটা মেয়ে নিয়ে হাত ধরাধরি করে ঘুরছেন,খাচ্ছেন, শপিং করে বেড়াচ্ছেন। তাহলে বিয়েটা ওকে করলেই তো পারেন।

– আপনি যার কথা বলছেন সে আমার বান্ধবী। অন্য শহরে থাকে। এদিকে ঘুরতে এসেছিল তাই। আর গাড়ির ভেতর ওর হাসব্যান্ড ও বসে ছিল যেটা না দেখেই আমার হাত ধরেছে বলে গার্লফ্রেন্ড ভেবে বসে আছেন।

শ্রীতমা খানিক নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো প্রতিক্রিয়াহীনা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে, রয়েসয়ে বলল,

– বিয়ে যখন করবেন তখন বাড়িতে বলুন। আমাকে কেনো বলছেন! আর কোনো মেয়ে নেই নাকি?

– এ বিষয়ে আমার আপনার ছাড়া আর কারো নামটা মাথায় আসছে না। আমি আপনাকে ভেবে দেখার সময় দিতে পারি তবে সর্বোচ্চ দুইদিন৷ আমি বিয়ে করতে চাই তাও আপনাকে, আর এই সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই।

শ্রীতমা কি বলবে ভেবে পায়না। এভাবে অকস্মাৎ সামনে এসে বিয়ের কথা বলে দিলেই হয়? যার সাথে না আছে বন্ধুত্ব না সহবত পূর্ণ সম্পর্ক। তিনটে কথা বললে দুটোই হয় তর্ক। আর সেসব বাদেও শ্রীতমার নিজস্ব মতামত তো আছে! ও নিজের জীবনে আর কাওকেই জুড়তে চাইনা। মানুষকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় খুব। কিন্তু সেসব তো অভিমন্যু শুনতে নারাজ। এক কথায় গাঁট হয়ে আছে যে বিয়ে করবে! শ্রীতমা নিজের মেজাজ,মস্তিষ্ক ঠান্ডা করে ধাতস্থ হয়ে অভিমন্যুকে বুঝিয়ে বলার আগেই অভি আবারও বলল,

– আমি কিছু শুনতে চাচ্ছি না শ্রী। আমার বাবা মা তাদের ছেলেবউ হিসেবে আপনাকেই চাই। আর আমি আমার বাবা মায়ের খুশিতেই খুশি। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে পজিটিভ জবাব দিলে ভালো আর তা না হলে এবার মিথ্যে নাটককে সত্য করতে আমার বাঁধবে না।

কথাটা বলে শ্রীতমার দিকে তাকালেও শ্রীতমার নজর অন্যদিকে। অভিমন্যুর ঘাড়ের পাশ দিয়ে ওর পেছনে দৃষ্টি দেখে অভিও সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে বড়সড় একটা ঝটকা খেলো। এইখানটায় এই মানুষ টাকে একেবারেই প্রত্যাশা করেনি ও। মোহরের নিশ্চল অভিব্যক্তি আর শানিত চেহারা দেখে অনেকটা ঘাবড়ে গেলো অভি। শুকনো হাসি দিয়ে সালাম দিয়েই হনহন করে চলে গেলো। একটু দূরেই দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়িটায় টান দিয়ে মুহুর্তেই হাওয়া হয়ে গেলো।
মোহর ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে এগিয়ে এলো। কথাগুলো সবটাই শুনেছে ও, শ্রীতমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে পাশের দোকানটাতে পানির বোতল কিনতে গেছিলো অভিমন্যু যখন এসেছিল ওউ একই সময়ে এসেছে তবে ওকে দেখলে অভিমন্যু অপ্রস্তুত বোধ করে, তাই আর সামনে আসেনি।

– তুই হাসছিস? আমার রীতিমতো নিজেকেই পাগল মনে হচ্ছে। ছেলেটা আদৌ কি! যখন যা খুশি বলে দিল? বিয়ে কী এতই সোজা! যে বললেই করা হয়ে গেলো। আবার কি বলল এ বিষয়ে আপনার ছাড়া অন্য কারো নাম মাথায় আসেনি।আসবে কি করে পেয়েছেই তো আমাকে জ্বালিয়ে ম’রার জন্য হনুমান টা। আমার কোন কপালের দোষ ছিলো যে এর সাথে আমার দেখা হয়েছে।

শ্রীতমার অস্থির অবস্থা দেখে না চাইতেও হাসিটা থামালো মোহর। এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

– ছেলেটা তোকে ইন্ডাইরেক্টলি কনফেস করে গেলো, এটাও বুঝলি না গাঁধি। বিয়ের ব্যাপারে তুই ছাড়া আর কারো নাম মাথায় আসেনি মানে কি! অভিমন্যু সহজ সরল হলেও বোকা নয়। একটা ছেলে এভাবে হুট করেই বিয়ের কথা বলে না। হয়তো ওর কথায় লজিক আছে তবে রিজন ও আছে। সরাসরি ভালোবাসি বলতে না পারার প্রক্সি দিলো ও।

শ্রীতমা হতবাক হয়ে বলল

– যাহ বাবা। ভালোবাসা তাও আবার ওই হনুমান মুখো টার! সর, এসব আমার বিশ্বাস হয়না।

– হবে। বিশ্বাস ও হবে আর ভরসাও। ভেবে দেখ। আটচল্লিশ ঘন্টা আছে তো।

বলে স্মিত হাসলো মোহর। তবে এবার আর শ্রীতমা সেদিকে মনোযোগ দিলো না, বরং গভীর ভাবনায় বুদ হয়ে পড়লো। অনেক হিসেব নিকেশ, সমীকরণ মেলানো যাচ্ছে না। আসলেই কী মোহরের কথা সত্য!

….

– আমায় ভুলে গেলে নাকি ডার্লিং?

পুরুষালী কণ্ঠস্বরে এহেন বাক্য কানে আসতে তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়াল মোহর। কুঞ্চিত ভ্রু যুগলের নিচের মারবেল আকৃতি চোখ দু’টো চারপাশে ঘুরিয়ে খুঁতহীনা পরখ করলো। এইতোহ কানের কাছে বলে গেলো কথাটা, মুহুর্তেই হাওয়া হয়ে গেলো! নিজ গতিতে আবারও চলতে শুরু করলো। এইতোহ আর পাঁচ মিনিটের পথ বাড়ি পৌঁছুতে। বিকেলের শেষ ভাগ পেরিয়ে সন্ধ্যার আগমন অতি নিকটে। আকাশের বুকে পশ্চিমের গাঢ় কমলা রঙের আঁচড় তার স্পষ্ট আগামবার্তা দিচ্ছে। মাঝে মধ্যেই এমন এক্সট্রা ডিউটি পড়ে যায়৷ যার দরুন ফিরতে বেশ বেলা পড়েই যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে আজ পায়ে হেঁটে আসার কারণ শ্রীতমা। ইচ্ছে টা ওরই ছিল। হোস্টেল পার করে এসে মোহর নিজেও আর অটোরিকশায় ওঠেনি নেহাৎ দূরত্ব খুব বেশি না বলে।
বিকেলের আবহে বেশ শীতল মৌশুম হওয়া সত্ত্বেও মোহরের চুলের ভেতর থেকে তিরতির করে সরু ঘামের স্রোত কানের পেছন দিয়ে গড়ালো। অদ্ভুত রকম একটা ভয়,আতঙ্ক কাজ করছে। কেন যেনো মনটা বড্ড কু-গাইতে থাকে ইদানীং। শরীর, মন কিছুতেই শান্তি পায়না। কিন্তু হঠাৎ এভাবে এইধরনের কথা গুলো কে বলল? আদৌ কী কেও বলেছে নাকি মনের ভুল? আজকাল রাতেও কীসব উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখে মোহর। শরীর টা খারাপ করে প্রায়ই। দিনের বেলাতেও কি তাই ই হলো? নিছক মনের ভুল ভেবে যেটাকে কাটিয়ে দিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট মনে এগিয়ে যেতে লাগলো ঠিক তখনই সতর্কবার্তা হীনা আছড়ে পরা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই পাশাপাশি তাল মেলালো একটা মানুষ। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখ দু’টো আপনা আপনিই প্রসারিত হয়ে যায়। মাস্কে ঢাকা থাকলেও চোখ আর কপালে অসংখ্য নখের আঁচড়ের স্পষ্ট দাগগুলো নিঃশব্দে আগন্তুকের পরিচয়টা নিশ্চিত করে দিলো মোহরকে। ঢোক গিলে অসহিষ্ণু ভাবে বলল,

– আপনি?

– হ্যাঁ আমি। কেনো এক্সপেক্ট করোনি? অবশ্য করার কথাও না, তোমার চিন্তা অনুযায়ী আমার তো এখনও সেখানেই থাকার কথা।

বলে খুব নির্দ্বিধায় পকেটে হাত গুঁজে হাঁটতে লাগলো পাশাপাশি। মোহর এখন পরিস্থিতিটা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারলো না৷। এসব কী হচ্ছে! এই লোকটা এখানে এলো কি করে! মোহর অপ্রতিভতা সামলে কোনো প্রশ্ন ছোড়ার আগেই নোমান নিজ থেকেই বলল,

– তোমার কোনো প্রশ্ন বা কথার উত্তর দিতে আমি আসিনি। বরং তোমাকে একটা সাহায্য করতে এসেছি।

– সাহায্য?

অস্ফুটস্বরে বললেও নোমানের কান অব্দি ঠিকই পোঁছালো। নোমান কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই বলল,

– হ্যাঁ সাহায্য। ওই যে ওদিন তুমি যেমন করেছিলে সাহায্য। ঠিক সেভাবেই আজ আমিও করবো।।

ধক্ করে উঠলো মোহরের ভেতরটা। কি করবে এই নোমান? বেশ কড়া গলায় বলল,

– কিসব বলছেন আপনি? কিসের সাহায্য, আপনার কোনো সাহায্যের দরকার আমার…

– নেই। জানি, তবুও করবো। আর তুমিও অবলীলায় মেনে নেবে তা আমিও জানি।

সেকেন্ড খানেক দম নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো নোমান। মোহরের পা দুটোও থেমে গেলো খুব অজ্ঞাত কারণে। নোমান পকেট থেকে এক হাত বের করে কপাল চুলকে বলল,

– সেদিন যেমন তুমি সাঞ্জে কে চোখে আঙুল তুলে আমার আসল রূপ টা দেখিয়েছিলে, আজ আমিও দেখাবো। তোমার প্রাণপ্রিয়, তোমার বিশ্বাস ভরসা তথাকথিত তোমার স্বামী। আজ তার আসল রূপের বর্ণনা টা আমার থেকে শুনে যাও।

– কি যা তা বলছেন। আমার স্বামীকে নিয়ে কোনো মন্তব্য আমি অন্তত আপনার থেকে শুনবো না।

মোহরের তীক্ষ্ণ স্বরে স্পষ্ট ক্রোধ, ক্ষিপ্ততা। ভীষণ অনিহা সামনের মানুষটার প্রতি।

– তোমার এমন ব্যবহার করা টাই স্বাভাবিক। এক্সপেক্টেড। তবে অতসব না বলে মোদ্দা কথায় আসি। তোমাকে আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে ভাবতাম অথচ তোমার মাথায় খুব সহজ কিছু প্রশ্ন আসা উচিত ছিল যা তুমি বোকামী করে এড়িয়ে গেছ। প্রথমত, সুনসান রাস্তায় রাতে মেহরাজ একা আহত অবস্থায় পড়ে ছিল, কখনো প্রশ্ন করেছ মেহরাজ ওখানে কেন গিয়েছিল? দ্বিতীয়ত তার দুই দিন পরেই যখন তুমি ছুটে পালাচ্ছিলে তখন মেহরাজের গাড়ির সামনেই এসে পড়েছ এটা মাথায় আসেনি ওইরকম একটা অফসাইডে দিয়ে মেহরাজ আসছিল? আবার সমাজের চাপে পড়ে এক কথায় তিন কবুল পড়ে তোমাকে বিয়ে করে নিলো যেখানে মেহরাজ চাইলেই ওরকম তিনটে সমাজকে চোখ ঘুরিয়ে এড়িয়ে দিয়ে রাখতে পারে! সেসব নাহয় বাদই দিলাম আব্রাহাম ম্যানসনে আসার পর থেকে তোমার মনে অনেক প্রশ্ন কৌতূহল থাকার কথা ছিলো, সেসবের উদ্ধার করতে চেয়েছ কখনো? আর মেহরাজ নিজে! ওকে কখনো জানার ইচ্ছে হয়নি? চোখের সামনে যা দেখাচ্ছে দেখে নিচ্ছ নিজের চোখটা খোলার ইচ্ছে করেনি?

মোহর স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, প্রশ্ন গুলোর উত্তরে কি বলা উচিত? এই প্রশ্ন গুলো তো মোহরের মনে আসা উচিত, নোমান কিভাবে মোহরের হয়ে বলে দিলো? আর ও কেনোই বা বলছে এসবের কথা। আর মেহরাজ! মেহরাজ কে নিয়ে কি? কিসের উদ্ধারের কথা বলল ও!

– তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে। তবে আমি বললে সেটা তুমি বিশ্বাস করবে না। দোতালায় একদম ডান পাশের ঘরটা, যেটা সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। সেখানে গিয়ে একটু খোঁজ করলেই পেয়ে যাবে। শুধু প্রশ্নের উত্তরই না আরও অনেক কিছুই পাবে যা তোমার আরও আগেই পাওয়া উচিত ছিলো। তখন হয়তো বুঝতে পারবে এতসব নিয়তির খেল, নাকি মানুষের।

বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না। রাস্তার মোড় ঘুরে চোখের পলকে উধাও হয়ে গেলো। মোহর স্তম্ভিত চেহারায় দাঁড়িয়ে রইলো। শিরদাঁড়া বয়ে রক্তস্রোতের তীব্র জোয়ার যেনো বুঝতে পারলো। পায়ের তালু ক্রমশই ঠান্ডা হয়ে এলো। কেনো জানে না তবে নোমানের মতো অপরাধীর কথাটা ও চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারলো না। কি করবে ও? কিসের খোঁজ করবে! খোঁজ তো কম ও করেনি তবে কোনো সুত্র বা উৎস তো কখনোই পায়না। তাহলে! জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলো। পা দুটোয় যেন টন খানেক ওজন ভর করেছে নড়ানোই যাচ্ছে না!

•••

গভীর রাত আর তাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন পুরো বাতাবরণ। শীত শীত আমেজে ঝিঁঝি পোকারাও যেনো অবসর নিয়েছে। আর তাদের অনুপস্থিতি টা আরও নিখুঁত করে তুলছে নিরবতার ছন্দ। তবে তার মাঝে অতিসূক্ষ্ণ একটা শব্দ কানে বাজছে। আর তা হলো মেহরাজের নিঃশ্বাস, প্রশ্বাস। নির্দ্বিধায়, নিরুদ্বেগ ঘুমে মগ্ন মোহরের শরীরে লেপ্টে। দু’হাতে পেছন থেকে আঁটসাঁট করে জড়িয়ে বরাবরের মতোই মুখটা মোহরের ঘাড়ে গুঁজে রেখে নির্ঝঞ্ঝাট ঘুম তার। তবে মোহর দুচোখের পাতা এক লহমার জন্যেও এক করতে পারলো না। মস্তিষ্ক জুড়ে অভাবনীয় ভাবনার রাজত্ব বেড়েই চলেছে।
এইতো সকালের কথা, মোহর যখন বেরোচ্ছিল তখন পৃথক বাড়িতে ঢুকছিল। চেহারায় চিরচেনা হাসি,স্বচ্ছতা কোনো টাই ছিলো না তার পরিবর্তে ছিল একরাশ গাম্ভীর্যের সাথে দুঃশ্চিতার ছাপ। মোহর সে বিষয়ে জানতে চাইলে খুব চৌকসতার সহিত এড়িয়ে গেছে ব্যাপার টা। তবে সেই দুঃশ্চিতার কারণ কী নোমানের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যাওয়া! কিন্তু কিভাবে ছাড়া পেলো ও! ওকে তো কাস্টাডিতে রাখা হয়েছিল! বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে নড়েচড়ে উঠলো মোহর, আলতো হাতের ভীষণ সাবধানী স্পর্শে মেহরাজের হাতটা সরিয়ে দিলো। গায়ের উপর থেকে চাদর সরিয়ে নেমে এলো। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় সবটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মোহর ওর ব্যাগ হাতড়ে একটা ছোট্ট জিনিস বের করলো। আশেপাশে তাকিয়ে মেহরাজের ল্যাপটপ টায় চোখ আঁটকে গেলো। দুদিন আগের ঘটনা, আলমারি থেকে প্রয়োজনীয় কাপড় বের করে গিয়ে টান লেগে ফটোফ্রেম টা ফ্লোরে পড়ে কাঁচ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। বাবা মায়ের সাথের একমাত্র স্মৃতি। ভেঙে যাওয়ার ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল মোহর। তবে সেই কষ্ট ভাঙা কাঁচ সরিয়ে ছবিটা ফ্রেম থেকে বের করে আনা অব্দিই ছিলো। এরপর যেটা দেখেছে সেটা ভীষণ মাত্রায় অপ্রত্যাশিত ছিলো ওর। মোটা ফ্রেমটায় ছবির পেছনের বোর্ডের ভেতর ছোট কিছু দেখতে পেয়ে পুরো ফ্রেমটা খুলে আলগা করতেই নজরে বিঁধে যায় একটা পেনড্রাইভ। মোহরের তৎক্ষনাৎ মনে পড়ে আব্বা বলেছিল ওর জন্মদিনে এই ফটোফ্রেম টা দিলে তার সাথে একটা অন্য জিনিস ও থাকবে। তবে সেটা ও তখনই দেখতে পারবে যখন সে নিজে আর উপস্থিত থাকবে না। মোহর তখন কথাটার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেনি, তবে এইটুকু বুঝেছিল ওর আব্বা বাড়ির সকলের অজান্তেই কোনো কাজে জড়িয়েছে যা তার প্রাণ কে’ড়ে নেওয়ার মতোই হুম’কিস্বরূপ। তবে পরিপূর্ণ কোনো তথ্য ব্যাখ্যা জানতে পারেনি মোহর। আব্বা যাওয়ার পর অনেক খুঁজেছিল ছবিটা তবে সেটা যে ওর বুবু মিথিলার কাছে রেখে গিয়েছিল ওর বাবা। ওর বুবু যখন ছবিটা ওর হাতে তুলে দিয়েছে তখনও অনেক খুঁজেছিল মোহর জিনিসটা। তবে সেই জিনিসটা কি এ বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা না থাকায় তদন্ত ওখানেই স্থগিত হয়েছে। এখন যখন কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা হাতে পেয়েছে তখন এর মধ্যে কি আছে তা জানার জন্য প্রবল উৎকণ্ঠা তৈরি হলেও সেটা প্রকাশ করতে পারেনি।

এক হাতে ল্যাপটপ টা তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। কয়েক কদম এগিয়েই দাঁড়াল বদ্ধ দরজাটার সামনে। শাড়ির আঁচল সরিয়ে কোমরে খুব গোপনে গুঁজে রাখা চাবিটা বের করে নিলো যেটা খুব খোঁজাখুঁজির পরে উদঘাটন করতে পেরেছিল আজ। দরজাটা নিঃশব্দে খুলতেই কেমন ঠান্ডা হয়ে এলো শরীর। প্রবল উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা, দুঃশ্চিন্তা সবটা গলাধঃকরণ করে এগিয়ে গিয়ে লাইট জ্বেলে বসলো। পেনড্রাইভটার ভেতরের ফাইল গুলো দেখার জন্য প্রয়োজন ছিল একটা ল্যাপটপ তবে তা মেহরাজকে জানানোতে মন সাঁই দেয়নি বলেই দুটো দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। যথারীতিতে পাসওয়ার্ড এন্ট্রি করে খুব সহজেই পেনড্রাইভটা কানেক্টেড করে নিলো।

অন্ধকার একটা ঘর, স্ক্রীনের আলোতে হালকা পাতলা চাপ দাড়িতে ঢাকা মুখটার বিচলিত, দুঃশ্চিতাপূর্ণ আতঙ্কিত চেহারা স্পষ্ট। ইউনিফর্ম পরিহিত মধ্যবয়স্ক লোকটা বলে উঠলো

“ আমি মাহবুব শিকদার। খিলক্ষেত থানায় দ্বায়িত্বরত ইন্সপেক্টর মাহবুব শিকদার। গত অর্ধযুগ যাবত দেশে খুব গোপনে, সূক্ষ্মতার সাথে যে কালো ব্য’বসা চলে আসছে। অস্ত্রব্যা’বসা, নক’ল ওষুধ তৈরিসহ, হসপিটালে চিকিৎসা নামে বিভিন্ন গরীব অসহায় মানুষের অর্গান পা’চার করার মতো আরও সব জঘন্য,কুকা’জের কা’লো টাকার ব্যাবসা চলে আসছে বহু বছর ধরে। সরকার থেকে স্টেপ নেওয়া হলেও প্রতিবারই তা নাটকীয় ভাবে স্থগিত হয়ে যায় নয়তো কোনো ফলাফল ই আসেনা। দেশের স্থানে স্থানে এখনো জা’ল দ্রব্যাদি তৈরীর ফ্যাক্টরি চালু রয়েছে যাতে করে আন্ডা’রওয়ার্ল্ড গ্রুপের রাঘব বোয়ালরা কোটি কোটি টাকার কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। চলমান দুই বছর যাবত আমি সবকিছুর তদন্ত করে যাচ্ছি, কোনো স্পেশাল পারমিশন বা অর্ডার ছাড়াই আমি খুব গোপনে অভিযান চালিয়েছি। এর মাধ্যমে আমি যেই নামগুলো উদ্ধার করতে পেরেছি তাতে শীর্ষে আছে আজহার মুর্তজা, আরহাম মুর্তজা, উমেদ ইকবাল সহ আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। যাদের নামগুলো আমি এখনো পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারিনি৷ তবে কতদূর পারবো জানা নেই, ইতোমধ্যে আমার সবরকম হু’মকি সহ আ’ক্রমণ
করা হয়েছে। আমাকে লোভ দেখিয়ে কোনো কাজ না হওয়ায় ঘু’ষ খাওয়ার মতো মিথ্যে অ্যালিগেশন দিয়ে পদচ্যুত করার চেষ্টাও করা হয়েছে। আর এ চেষ্টা এখনো চলমান, কতদিন টিকে যেতে পারবো জানি না। এই পেনড্রাইভে আমার জোগাড় করা সব রকম ইনফরমেশন, প্রমাণ সহ কয়েকটি ডকুমেন্টস আছে।

বলে মিনিট খানেক স্তব্ধ হয়ে চুপ করে বসে রইলো ভদ্রলোক। অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

আমার পুতুল, মা আমার। তুই যখন এই ভিডিও টা দেখছিস ততক্ষণে হয়তো তোর আব্বা বেঁচে নেই। কারণ বেঁচে থাকলে তোর হাতে পেনড্রাইভটা যেত না। আমি জানি আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত, আর তা যেকোনো সময়ে। তুই তো আমার সাহসী বাচ্চা, আমার বাঘিনী। জানি তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস,পাচ্ছিস তবে একটা কথা মনে রাখবি। তোর বাবা সত্যের পথে লড়ে গেছে, কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করেনি। পেনড্রাইভটা সঠিক হাতে স্থানান্তর করে তোর বাবার অসম্পূর্ণ কাজটা তুই করবি এমনটা ভাবিস না মা। আমি পারিনি হয়তো ওদের সাথে লড়ে যেতে, ওদের হাত বহুদূর। তুই যেমন আছিস সাবধানে থাক, ভালো থাক,পরিবারের খেয়াল রাখ। তোর উপর আমার অগাধ আস্হা। আমি চাইনা তুই ন্যায়ের লড়াই লড়তে গিয়ে আমার মতো প্রাণটা হারিয়ে ফেল। তোর আব্বা তোকে ভালোবাসে, অ্যাপ্রোন পরিহিত ডাক্তার মেয়েটাকে দেখতে পারিনি তো কি হয়েছে আমার দোয়া,ভালোবাসা সবসময় আমার মেয়েটার জন্য ”

শেষ কথাটুকু সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ভিডিও টা শেষ। পাঁচ মিনিট ছাব্বিশ সেকেন্ডের ভিডিও টা মোহর স্তব্ধ হয়ে দেখলো। চোখ ছাপিয়ে গড়িয়ে পরা অনবরত পানিগুলো ছাড়া কোনো রকম প্রতিক্রিয়া ওর আসলো না। নিস্তব্ধ, স্থবির হয়েই বসে রইলো। ওর আব্বাকে খু’ন করা হয়েছে। মে’রে ফেলেছে! ছি’নিয়ে নিয়েছে ওর আব্বাকে। প্রাণভরা হাসি আর ভালোবাসা টা কেড়ে নিয়েছে ওরা। বুকে’র ভেতর খঞ্জর চালিয়ে দিলো যেনো কেও। যন্ত্রণা, হাহাকার, রাগ ক্ষোভে ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে এলো। তবুও আর ভেঙে পড়লো না মোহর। পেনড্রাইভটা বের করে নিয়ে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ঘরটার চারিদিকে তাকালো। চোখ বিঁধে গেলো একটা দুই পাল্লাযুক্ত মাঝারি আকৃতির আলমারির দিকে। বেশ পুরোনো, ধুলো জমে আছে খানিক। মোহর ল্যাপটপের সাটার নামিয়ে উঠে গিয়ে চাবির গোছা থেকে সবচেয়ে আলাদা রকম চাবিটা ঢুকিয়ে ঘোরাতেই খট করে খুলে গেলো পাল্লা। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো মোহর, ভেতরে আরও একটা ড্রয়ার। টান দিয়ে খুলতে মোটা মোটা তিনটে ফাইল চোখে পড়লো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বহু পুরোনো এই কাগজ। একটা ফাইল আব্রাহাম ম্যানসন, আর জমিজমা সংক্রান্ত। একটা ব্যাবসা। শেষের ফাইলটা বেশি মোটা। ওটা তুলতেই নিচে দুটো ছবি দেখতে পেলো। ভীষণ আগ্রহী চোখে ছবিটা তুলে হাতে নিতেও কেঁপে উঠলো হাতের করপুট। একটাতে ওর আব্বা মাহবুব শিকদারের ছবি, আরেকটায়…সেটাতে একটা মেয়েলী চেহারা। কাঁধে ব্যাগ চেপে রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে এমতাবস্থায় ক্যামেরাবন্দী করা দৃশ্য। নিজের ছবিটা থেকে মুখ তুলে ফাইলটা তড়িঘড়ি করে খুললো। সেখানে প্রথম পৃষ্ঠা উলটাতেই ” Abraham’s Industries ” নামক একটা লাইন দেখেই পায়ের তলার জমিন কেঁপে উঠলো মোহরের। কাঁপা কাঁপা হাতে পরের পৃষ্ঠা গুলো উলটাতেই সামনে এলো সেই দৃশ্য যা বহু প্রত্যাশিত হলেও কখনো কাঙ্ক্ষিত ছিলো না। চোখ দু’টোর সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসছে যেনো, যন্ত্রণার আর্তচিৎকারে অন্ধ বিশ্বাসের ভিত নড়ে গেলো। সারা শরীরে কম্পন দিয়ে উঠতেই হাত থেকে ফাইলটা পড়ে গেলো। ঠিক তখনই প্রশান্ত একটা কন্ঠস্বর কানে এলো,

– এখানে কেনো এলেন মোহমায়া! . .

টলমল পায়ে ঘুরে দাঁড়ালো মোহর, ঝাপসা চোখে দেখতে পেলো বহুচেনা মানুষটার অস্পষ্ট চেহারা। বুকের পাজরের হাড় গুলো যেনো গুড়িয়ে চুরমার হয়ে গেলো। মোহরের গলা আঁটকে এলো, একটা তুচ্ছ শব্দ বের করতেও যেনো সর্বশক্তি লেগে গেলো। তবুও অস্ফুটস্বরে বলল,

– কবে থেকে চেনেন আমাকে?

– দুই বছর এক মাস উনত্রিশ দিন।

.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

2 মন্তব্য

  1. Klk theke golpota pore Ei prjnto aslam,,,,,,, amr khub psndr golpo gulir moddhe Ei golpota o jog holo,,,,,, kisu kisu golpo eto Eto eto poriman valo lage j,,,,,, valo laga prokash korar moto vasa khuje pai na,,,,,,,, lekhika apu, Maya doya Kore jodi baki purata golpo eksathe die diten,,,, tahole mne hoy shanti petam,,,,,,,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে