#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫৩
#হুমাইরা_হাসান
– ভাই! ভাই আমার সাঞ্জেটার কিছু হবে না তো? ও ঠিক হয়ে যাবে তাই না? বলো না ভাই, ওর কিছু হবে না! ও বাঁচবে তো?
শেষোক্ত কথাটুকু বলতেই কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলো ব্যাপকভাবে, তার চেয়েও তীব্রতর ভাবে কেঁপে উঠলো অন্তরস্থল। কথাটি বলে তাথই যতটা না শঙ্কা, আতঙ্কে আহাজারি করে উঠলো তার চেয়েও করুন ছিল মেহরাজের চাহনি। স্থবির চোখে একবার তাকালো তাথই এর দিকে অতঃপর ইমারজেন্সী ওয়ার্ডের কেবিনটার দিকে। এক ঘন্টা হতে চলল৷ এখনো কেও কেনো বের হচ্ছে না! আর কতক্ষণ লাগবে! মেহরাজ আর সহ্য করতে পারছেনা কিছুতেই।
ওটির থেকে একটু দূরেই লম্বা বেঞ্চের ন্যায় বসার আসনে বসে আছে আম্বি আর কাকলি। অনবরত কেঁদেই চলেছে দুজন, কাকলি খাতুনকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। আর যাই হোক নিজের মেয়ের ওই বিভৎস অবস্থা নিজে চাক্ষুষ দেখার পর নিজেকে সামলে রাখা বড়ো দায়। কাঁদতে কাঁদতে নিজের অবস্থা নাজেহাল করেও ক্ষান্ত হতে পারছেন না মহিলা, নিজের ছোট মেয়েটাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার তীব্র আশঙ্কা ক্রমেই গ্রাস করছে তাকেসহ উপস্থিত প্রতিটি মানুষকে।
– আর কান্নাকাটি করিও না কাকলি। আমার সাঞ্জের কিচ্ছু হবেনা। এইতো ডাক্তার বের হয়েই ভালো কিছু বলবে।
– আর কখন বেরোবে, কখন বলবে! আমি আর পারছিনা সাঞ্জের বাবা। আমার মেয়েটাকে আমার কাছে এনে দাও। ওর কি হলো। এইটুকু মেয়েটা আমার কি পাপ করেছিল। এতকিছু কিভাবে সহ্য করবে ও!
আরহাম প্রত্যুত্তরের ভাষা পেলেন না। চোখ খিঁচিয়ে নিলো অশ্রুগুলো লুকাতে৷ কাকলির পাশ থেকে উঠে এগিয়ে মেহরাজের পাশে দাঁড়ালো৷ ভীষণ অসহায়, বিবশ গলায় ব্যকুল হয়ে বলল,
– আর কতক্ষণ লাগবে মেহরাজ? আমার মেয়েটা বাঁচবে তো?
আরহামের কথাটা মেহরাজ ইচ্ছে করেও অগ্রাহ্য করে ফেলতে পারলো না। ঘাড় টা বাঁকিয়ে তাকালো ভদ্রলোকের দিকে। যার চোখ দু’টো চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে লাল বাতি জ্বলতে থাকা বদ্ধ ঘরটার দিকে৷ বুকটা মুচড়ে উঠলো মেহরাজের, এই মুহূর্তে আরহামকে শুধুমাত্র একজন বাবা ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারলো না আর। তবে তার প্রশ্নের জবাব ও দেওয়ার সাধ্য ওর হলো না। কিই বা বলবে! এই মুহুর্তে যেখানে ও নিজেই একবুক অনিশ্চয়তার স্ফূলিঙ্গ নিজের ভেতর চেপে রেখেছে সেই মুহূর্তে অন্যকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো বিলাসিতার নামান্তর টুকু আনতে পারলো না মুখে।
এইতো ঘন্টা দুয়েক আগের ঘটনা — প্রায় মাস খানেক পর বোনের মলিন মুখটায় এক চিলতে হাসি দেখে ভীষণ ভালো লেগেছিল মেহরাজের। বোনটা একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠবে মনে মনে সেই প্রার্থনা জপে প্রফুল্ল চিত্তে বাড়ি থেকে বের হলেও অর্ধেক রাস্তা টাও পার হতে পারেনি। ফোনে মোহরের মুখ থেকে শোনা দূর্ঘটনা নামক ভয়ংকর বিপর্যয়ের কথাটা শুনে মাঝ রাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি এসে যে দৃশ্য টা সহ্য করতে হয়েছিল এতটা কুগ্রহ কখনো কল্পনাও করেনি কেও।
বেশ অনেকদিন পর একটু সুস্থতা অনুভূত হলে বিছানা আর একঘেয়ে ঘরটা ছেড়ে বেরিয়েছিল সাঞ্জে। দূর্বল শরীরে একটু একটু করে হেঁটে বাইরে এলেও সিড়ির কাছে যে ওর জীবনের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম অভিষঙ্গ অপেক্ষা করছে তার চেতনা ঘুনাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি। তিনপা সিড়ি মাড়িয়ে চতুর্থ পায়ে কদম টলমলে হয়ে কিভাবে কি হলো তা হয়তো সাঞ্জেটাও উপলব্ধি করতে পারে নি, উপুড় হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে সিড়ির উপরে৷ দীর্ঘ সিড়ি গুলো গড়িয়ে নিচে পরে গগনবিদারী আর্তনাদে ফেটে পড়লে হুড়মুড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে প্রতিটি মানুষ। বিভৎস দৃশ্য দেখে চিৎকার করে ছুটে আসে তাথই। সিড়ি থেকে পরে কপাল ফেটে রক্তের ফিনকি ছুটেছে সারা মুখ গলা বয়ে। মোহর হসপিটালে যাওয়ার জন্যেই বেরোচ্ছিল। কিন্তু সিড়িমুখে এসেই স্তম্ভিত হয়ে যায়। সকলে সাঞ্জের মাথার ক্ষত দেখে আঁতকে অস্থির হয়ে উঠলেও মোহর লক্ষ্য করলো সবচেয়ে কুগ্রহ অনর্থপাত’টা। কপালের রক্ত মুছতে সবাই এতটা ব্যস্ত ছিলো যে দেহের নিম্নাংশ বয়ে গড়িয়ে পরা রক্তের শিথিল স্রোত টা রাকোই চোখে পড়েনি। সিড়ির চোখা অংশের তীব্র চাপ,আঘাতে সবচেয়ে সংবেদনশীল স্থানটায় অভিঘাত হেনেছে। মোহর ত্রাসিত হয়ে ছুটে গিয়ে ওকে ধরে, ঠিক যেইটা ভেবেছিল তাই’ই! আতঙ্কপ্রসুচ কান্নারত অবস্থায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লে ঠিক সেই সময় মেহরাজ ছুটে এলে এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে কোলে তুলে নিয়ে হসপিটালে ছুটে ছোট বোনটার রক্তাক্ত শরীর টা নিয়ে, এসে পৌঁছুনো মাত্র ডাক্তার ইমারজেন্সীতে ওটিতে ঢুকিয়েছে। আর তারপর থেকেই . . .
ওদের ব্যগ্রতা, উৎকণ্ঠার ভিত কে নাড়িয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো কাঙ্ক্ষিত একটা চেহারা যার উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে এতগুলো মানুষ। এক পা দু’পা দ্রুতপদে ফেলেই এগিয়ে আসতে আসতে মুখের মাস্কটা টান দিয়ে খুলে ফেললো মোহর৷ সবুজ রঙের অ্যাপ্রোনের মতো পোশাকটা এখনো গায়ে জড়ানো। ওকে দেখা মাত্রই বসা থেকে উঠে ছুটে এলো কাকলি আর তার পেছবে আম্বি৷
– আমার মেয়ে কেমন আছে মোহর? ও ঠিক আছে? কিচ্ছু হয়নি তো?
কাকলির প্রশ্নবাণ শেষ না হতেই আজহার মুর্তজা ও একইরকম ব্যগ্রতা নিয়ে বললেন,
– সাঞ্জের অবস্থা কেমন? ও এখন বিপদমুক্ত তো? বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যায়নি?
মোহর শান্ত চেহারায় ঢোক গিলে বড়সড় শ্বাস টেনে নিলো। মন্থর গলাটায় মৃদু খাঁকারি দিয়ে বলল,
– পেটে খুব বেশি আঘাত লাগায় মিসক্যারেজ হয়েছে সাঞ্জের। আর শুধু মিসক্যারেজ নয় ওভারিতে আঘাত পেয়েছে। রক্তক্ষরণ এতো বেশি হচ্ছিলো যে থামানো দায় হয়ে পড়েছিল। এখন রক্তপাত বন্ধ হলেও বিপদমুক্ত বলা যাচ্ছে না। প্রি-ম্যাচিউর প্রেগ্ন্যাসিতে যতটা না রিস্ক ছিল তার চেয়েও বেশি রিস্ক ওর মিসক্যারেজে। ওর শরীর মোটেও স্ট্যাবল না এতটা প্রেসার নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমাদের হাতে কোনো রাস্তাও নেই। আপাতত ওকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন সর্বাধিক বাকিটা চিকিৎসা ।
এতগুলো কথা একনাগাড়ে বলে দিয়ে থেমে গেলো মোহর। শঙ্কায় জান শুকিয়ে এলো প্রতিটি মানুষের। কাকলি ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। মোহর তাকে ধরে নিয়ে বলল,
– এইখানে শব্দ করা নিষেধ চাচী। আপনি একটু শান্ত হোন। এভাবে হাইপার হয়ে কান্নাকাটি করলে ডক্টর’স আর থাকতে দেবে না এদিকে৷ প্লিজ শান্ত হোন, সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে সবাই যাতে ওকে আউট অফ ডেঞ্জার জোনে আনা যায়। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, একমাত্র তিনিই সাহায্য করতে পারেন।
আজহার আম্বিকে ইশারা করলে সে জোর করে কাকলিকে সরিয়ে নিয়ে গেলো। তাথই দাঁতে দাঁত চেপে কান্না গুলো আঁটকে রেখে মোহরের বাহু চেপে বলল,
– মোহর তুমি যেভাবে পারো সুস্থ করে দাও। যা লাগে সব করো, ডাক্তারকে বলো যত পারে চেষ্টা করুক। আমার বোনকে সহি সালামত চাই মোহর। আমার অনুরোধ এরপর আসলে আর খারাপ খবরটা এনো না দোহাই তোমাদের।
মোহরের কান্নায় কথাগুলো দলা পাকিয়ে এলো। কিন্তু পরিস্থিতির রিখটার সামাল দিতে হলে ভেঙে পড়লে চলবে না। ও সবাইকে আল্লাহর নামে ভরসা করতে বলে আবারও ছুটে গেলো ওটি রুমের ভেতর।
•••
মোহর যখন দুরূহ পরিস্থিতি সামাল দিতে ত্রস্ত। তখন ওরই প্রাণপ্রিয় বান্ধবী অদ্ভুত একটা শোকে কাতর। এদিকের ঘটনা সম্পর্কে ওর ন্যূনতম ধারণাও নেই। কেননা আজকে ওর অফ ডে। যার দরুন হসপিটালে আসার কোনো কারণ নেই, আর দ্বিতীয়ত মোহরকে ফোন দিলেও পাওয়া যায়নি। যার কারণ টা অবশ্যই স্পষ্টত হলেও শ্রীতমার অজানা।
এক হাতে ফোনটা নিয়ে অন্যহাত খালি রেখেই বেরোলো। উদ্দেশ্য মোহরের সাথে দেখা করা।
হোস্টেল থেকে বেরিয়ে বেশ খানেকটা পথ হাঁটার পর মেইন রোডে এসে উঠলে চেনা পরিচিত একটা গাড়ি দেখে থেমে গেলো। এদিক ওদিক সন্ধানী চোখে খুঁজতে থাকলো। এমনই কাঙ্ক্ষিত যিনিসটা চোখেও বেঁধে গেলো। লাল রঙের টোয়োটা গাড়িটা যেখানে রাস্তার এক পাশে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে সেখানে গাড়ির মালিক টাকে খুঁজে নিতে অসুবিধা হলো না। অভিমন্যুকে এতদিন পর দেখে খুব অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো শ্রীতমার। যার কোনো স্থির সংজ্ঞা ওর বোধগম্য হলো না। তবে অভিমন্যুর সাথে কথা বলার তাগিদে এগিয়ে যেতে নিলো তখনই শো-রুমের দরজাটা খুলে ওর পেছন পেছন একটা মেয়ে বেরিয়ে এলো। দেখতে শ্রীতমার বয়েসী হাত ভর্তি অফ হোয়াইট রঙের শপিং ব্যাগ। হাসতে হাসতে কিছু একটা বলে এগিয়ে এসে অভিমন্যুর একটা হাত চেপে ধরলো। জবাবে অভিমন্যু ও ওর হাত থেকে ব্যাগ গুলো নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো৷ শ্রীতমার পা গুলো যথাস্থানেই আঁটকে রইলো। কারণটা জানা নেই তবে মেয়েটার সাথে অভিকে দেখে ওর কথা বলার ন্যূনতম ইচ্ছে হলো না। মনে মনে ভাবলো
‘ তবে কি অভিমন্যুর বিয়ে ঠিক হয়েছে? এই মেয়েটাই কি ওর ফিয়োন্সে? তাছাড়া আর কে হবে? কোই এতদিন তো কোনো মেয়েকে দেখেই ওর সাথে? আজ যেহেতু এভাবে খোলামেলা হাসিখুশি মুখে দুজন একসাথে ঘুরছে তাহলে অবশ্যই তাই ’
কথা গুলো ভেবে লম্বা দম ছাড়লো। স্মিত হেসে ভাবলো ভালোই হয়েছে। আংকেল, আন্টি এমনিতেও তো ওর বিয়ের জন্যেই ব্যকুল হয়ে ছিল। এখন ভালোই হবে। আসলে মানুষগুলোর সাথে হয়তো খুব অন্যায় করে ফেলেছে ভেবে এতটা দিন ভেতরে ভেতরে মুষড়ে গেলেও তাদের সামনে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার মতো মনোবল একত্র করতে পারেনি। তাই আজ যখন সময় পেয়েছে সাথে সাহসটাও। এই জন্যেই তাদের উদ্দেশ্যেই যাচ্ছিল। সেখানে অভি যখন ভালো মেয়ে খুঁজেই নিয়েছে তাই আংকেল আন্টিও আর আগের ব্যাপার গুলো ধরে বসে থাকবে না আর।
এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো শ্রীতমা। যদিও এখন বাইরে কোনো কাজ নেই তবুও এগোতে থাকলো, হোস্টেলে ফিরতে ইচ্ছে করছে না একদমই। ইদানীং নিজের চিরচেনা আবাসস্থলটাকেও ভীষণ অসহ্য লাগে, অন্যরকম লাগে। ওখানে আর একটুও থাকতে ইচ্ছে করে না। একটা পরিবার, পরিবারের সদস্য গুলোর আদর ভালোবাসা, পিতামাতার স্নেহ পাওয়ার জন্য মনটা ভীষণ উতরোল তোলে। আশ্চর্য! কোই এতদিন তো এমন মনে হয়নি? ও তো এই একাকিত্বের জীবনেই অভ্যস্ত। তাথলে দুদিন একটু আদর পেয়েও এমন লোভী হয়ে গেলো?
হুট করেই মুখটা মলিন হয়ে গেলো। অসহ্য লাগছে সবটা শ্রীতমার। অভিমন্যুর উপর ভীষণ রাগ হলো ভীষণ। ওর জন্যেই এতকিছু। না ও মিথ্যে টা বলতো নাইবা মিথ্যে অভিনয় করতে গিয়ে মায়ায় জড়িয়ে যেত। এখন তো অভিমন্যুর পাশে ওই মেয়েটার কথা ভাবতেও রাগ হচ্ছে। কোই এতদিন তো খুব বলল বিয়ে করতে চাই না চাই না। তাহলে এই ক’দিনেই বিয়ের জন্য নাচন ধরে গেলো?
– আসলেই একটা হনুমান মুখো। ওর মুখটাও দেখতে চাইনা আমি আর।
একা একাই বিড়বিড়িয়ে সামনে হাঁটতে থাকলো শ্রীতমা। গন্তব্য জানা নেই, তবে পেছনেও তাকাতে চাচ্ছেনা আপাতত। পেছন টা ভীষণ একঘেয়ে, মলিন, আনন্দহীন। তার চেয়ে বরং রাস্তা টাই ভালো।
•••
লম্বা সময় ধরে কার্যধারা অব্যাহত রেখে অবশেষে বেরোলো ডাক্তার। তার সাথে মোহর ও। সাঞ্জের চিকিৎসা হচ্ছে মোহরের’ই ইন্টার্নশিপরত হসপিটালে৷ ফায়াজ কিছু কারণবশত শহরের বাইরে, তাই সাঞ্জের চিকিৎসা করেছে ফায়াজেরই বন্ধু। ডক্টর. সোয়েব এহসান। ডক্টর সোয়েবের আলাদা চেম্বার থাকায় উনি হসপিটালে ডিউটি খুব কমই করেন, তবে আজ সৌভাগ্যক্রমে হসপিটালেই ছিলেন যার দরুন চিকিৎসা টা পেতে অসুবিধা হয়নি। ডক্টর আরও অনেকেই আছে, তবে সিনিয়র দের মধ্যে ফায়াজ,সোয়েব সহ আরও কয়েকজন আছেন যারা মানুষের কাছে অধিক গ্রহনযোগ্য ভাবে পছন্দ।
ডাক্তারকে দেখেই আরহাম মুর্তজা অস্থির হয়ে পড়লেন। সোয়েব তাকে শান্ত করে বলল,
– পেসেন্টের অ্যাবোর্সন কমপ্লিট হয়েছে। কপালের ইঞ্জুরি টা নিয়েও এখন চিন্তার ব্যাপার নেই। তবে ওর শরীর টা সুস্থিত না। সিচুয়েশন এখনো স্ট্যাবল হয়নি। কিছু সময় অবজারভেশনে রাখার পর বাকিটা বলা যাবে। আপাতত চিন্তামুক্ত থাকুন। ধন্যবাদ
সৌজন্য সুলভ কথাগুলো সম্পন্ন করে সোয়েব আর নার্সগুলো বেরিয়ে গেলো। আম্বি এগিয়ে এসে ক্ষীণ স্বরে মোহরকে প্রশ্ন করলে মোহর ওদের আশ্বস্ত করে বলে,
– এখন ভালো আছে সাঞ্জে। তবে ওর সাথে দেখা করা যাবে না। ডক্টর যেমনটা বললেন, অবজারভেশনে রাখার পর বাকিটা বলা যাবে।
——
জীবনের অবিচ্ছেদ্য ছন্দ চিরন্তন। ভালো হোক আর মন্দ তা কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না, সময়ের তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলে দেদারসে। তাতে ক্লিষ্ট হয়ে কোনো মানুষ মুষড়ে যায়,কেও বা জিইয়ে রাখে পুলক। ঘটনা গুলো দূর্ঘটনা হতেও যেমন সময় লাগেনা, তেমনি দুঃসহ সময় গুলোও পেরিয়েই যায়…
সেদিনের ঘটনা পার হওয়ার আজ একুশতম দিন।সাঞ্জে এখন প্রায় পুরোপুরি সুস্থ। শারীরিক, মানসিক দিক গুলোকে পরিস্থিতির যাতাকল থেকে টেনে নিয়ে প্রাণপণে আগলে নিচ্ছে স্বাভাবিকতা। ভেতরে ভেতরে পাহাড়সম অক্লান্ত অবিন্যস্ত ছন্দটা হৃদয় কোঠরে কাঠের বাক্সভর্তি করে রাখার মতো খুব যতনে আগলে রাখলেও বাহ্যিক দিকটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওকে দেখেই প্রায়ই অবাক হওয়া যায়।এইতো কিছুদিন আগ পর্যন্ত ও মেয়েটা মরিয়া ছিলো ভালোবাসা নামক এক বিভীষিকার মতন বস্তুটার জন্য, হৃদয়হীন একটা অমনুষ্যত্বের জন্য উদারতা দেখিয়ে। তবে আজ কেমন পালটে গেছে। মেহরাজ ওর কলেজের ট্রান্সফার করিয়ে রাজধানীতে এনেছে, যদিও কাজটা খুব একটা সহজতর ছিল না তবে, ক্ষমতার হাত বহুদূর। কথাটিকে যথাযথ ভাবে ফলিয়ে কার্যকর করেছে খুব সহজেই। শারিরীক দুর্বলতা, অসুস্থতা কাটিয়ে একটু একটু করে নিয়মমাফিক হওয়ার সাথে সাথে পড়াশোনাতেও মনোযোগ আনার চেষ্টা করছে সাঞ্জে। সামনেই বোর্ড এক্সাম নামক একটা গুরুতর অগ্রগমণ। তাই যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছে।
.
বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে মেরুদণ্ডটা দন্ডায়মান ভঙ্গিমায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে মেহরাজ। চোখ দু’টো স্ক্রিনে আর হাতদুটো কী-বোর্ডে স্থির রেখে দক্ষ হাতে নিজের কাজ সামলে যাচ্ছে। মোহর সাঞ্জের ঘর থেকে এসে শুয়েছে অনেকক্ষণ। তবে ঘুম আসছে না। রাত খুব বেশি না হলেও কম না। ইদানীং রাতে একদম ঘুম আসতে চাইনা মোহরের,কি ভীষণ অসহ্যকর একটা ব্যাপার। খানিক এপাশ ওপাশ করে চিত হয়ে শুয়ে রইলো। ঘাড় কাত করে কাঁচের ওপাশের ফুলগুলোর দিকে চেয়ে রইলো। শীতকালীন ফুলগুলোর কড়ি ধরা শুরু হয়েছে। বাতাসে তাদের আগমনের সুগন্ধীময় ছন্দ। নাক টেনে নিঃশ্বাস নিলো মোহর। গাঁদা ফুলের মিঠা মিঠা ঘ্রাণ টা বেশ লাগছে। এর মাঝেই কানে এলো ভরাট কন্ঠের ব্যস্ত স্বর,
– ঘুমাচ্ছেন না কেনো?
মোহর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। অথচ লোকটা এখনো চোখ তোলেনি স্ক্রিন থেকে। বেশ অপ্রসন্ন হলো মোহর, আবারও বাঁয়ে ঘাড় টা ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
– আসছে না।
মোহরের গলার ভারটা মেহরাজ বুঝতে পারলো কি না জানা নেই, তবে প্রত্যুত্তর করলোনা। মোহরের বেশ অভিমান হলো। ইদানীং লোকটা একটু বেশিই ব্যস্ত থাকে। কি নিয়ে এতো ব্যস্ততা যে একটু সময় ধরে ওকে দেওয়া যায়না!
– ঘুমিয়ে পড়ুন।
একে তো মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে আছে তার উপর মেহরাজের এই কথাটা ভীষণ হেয়ালি শোনালো মোহরের কানে। রাগ হলো। ধপ করে উঠে বসে বলল,
– আমি ঘুমাবো কি সারারাত জেগে থাকবো তাতে আপনার কি? আপনার ইচ্ছে হলে ঘুমান না তো বেরিয়ে যান। আমাকে কিচ্ছু বলতে আসবেন না। যেটা করছেন জান,প্রাণ, ধ্যান দিয়ে ওটাই করুন
বেশ উচ্চরবে কথাগুলো বলে খাট থেকে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। খুব রাগ হচ্ছে ওর, তার চেয়েও বেশি খারাপ লাগছে। খারাপ লাগাটা তো আর অস্বাভাবিক নয়। এতগুলো কথা বলে আসলো অথচ মেহরাজ তবুও তাকালো না। কি এমন কাজ করছে যে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে থাকতে হলো? ছলছল চোখে সামনের দিকে এগিয়ে এলো। টাইলসে মোড়ানো মেঝেটা রাতের বাতাবরণে হীম হয়ে আছে, ঠান্ডা শিরশিরানি টা পায়ের নগ্ন তালু বয়ে সারাদেহে ছড়িয়ে গেলো। পাতলা ফিনফিনে শাড়ির আঁচল টা টেনে মুড়িয়ে নিলো সারা শরীরে।
ফুলগুলোর কাছে গিয়ে একটা একটা করে ছুঁয়ে দিতে লাগলো। গোলাপ গাছটার সামনে এসেই মনে পড়ে গেলো মেহরাজের বলা সেই কথাটা হলুদ গোলাপ টা নাকি ওকে কারো কথা মনে করিয়ে দেয়। কার কথা মনে করিয়ে দেয়? তার মানে মেহরাজের জীবনে এর আগেও কেও ছিল? মন খারাপের সময় এইরূপ কথাটি ভেবে আরও মনোক্ষুণ্ণ হলো। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো মোহর। এখন এই ফুলের ঘ্রাণ টাও অসহ্য ঠেকছে ওর। হুট করে পেছনে ঘুরলে শক্তপোক্ত জিনিসের সাথে ধাক্কা লেগে সরে যেতে নিলেও আঁটকে ধরলো দুটো হাত। মোহর ব্যক্তিটার মুখের দিকে না তাকিয়েই ঝামটা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে ঘরের দিকে আসতে চাইলো। তবে পেছন থেকে শাড়ির আঁচলে টান পড়ায় পা দুটো না চাইতেও থামিয়ে নিলো। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জাগায়। মেহরাজ প্রসারিত হেসে এগিয়ে এলো। পেছন থেকে বেরিবাঁধে জড়িয়ে নিলো চিকন লতানো শরীর টা৷ ঠান্ডা আঙুল গুলোর চাপ মেদহীন সরু পেটে পড়তেই কুঁকড়ে উঠলো মোহর। হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলে বন্ধন আরও শক্ত হলো। খোঁচা খোঁচা দাড়ির স্পর্শ ঘাড়ে লেগে কেঁপে উঠলো সমস্ত কায়া। কানের কাছে ভরাট কন্ঠের ফিসফিসিয়ে শুনতে পেলো,
– আমার বিবিজান রাগ করেছে? অপরাধ টা কি ক্ষমার যোগ্য না?
মোহর গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মেহরাজ নিঃশব্দে প্রেয়সীর অভিমান টুকু সযত্নে অন্তরে আগলে নিলো। মোহরকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
– খুব বেশি ব্যস্ততা দেখিয়ে ফেলেছি তাই না? চলুন তবে আজ সব ব্যস্ততা ঘুচিয়ে দেই! আপনার পাওয়া আদর গুলো সুদেআসলে শোধবোধ করে দেবো, এ্যন্ড আই সুয়্যার অভিযোগের কোনো স্কোপ রাখবো না।
বলে আগামবার্তা হীনাই কোলে তুলে নিলো মোহরকে। শীতল পরিবেশের শৈথিল্য বাড়িয়ে বিছানায় লেপ্টে মোহরের সারা শরীরে জুড়িয়ে দিলো শিথিলতা। নিজের কথাটার নড়চড় স্থির রেখে ঘুচিয়ে দিলো সব দূরত্ব, মিটিয়ে দিলো সব অভিযোগ। প্রেমপূর্ণ স্পর্শ, আবেদনময়ী আদরে ভরিয়ে দিলো মোহরের সমস্ত সত্তা। ভালোবাসার উষ্ণতায় শরীর জুড়ে শিউলি ফুটলো। চাপা আর্তনাদ, ভালোবাসার আঙ্গার আর তীব্রতায় মত্ত হলো দুটো প্রাণ। একত্রিত হলো প্রতিটি নিঃশ্বাসের উদ্বেলন। যেনো বাতাসে বাতাসেরা মিলিত হয়ে কানে অপার্থিব সুর ঢেলে দিলো –
“ আমার অঙ্গে অঙ্গে কে.. বাজায় বাঁশি ”
( সংগৃহীত চরণ )
.
.
.
চলমান
#Humu_❤️