ফানাহ্ পর্ব-৫২

0
1448

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫২
#হুমাইরা_হাসান

| অংশ ০১ |

পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ পোড়োবাড়িতে পরিনত হলো যেন একটা দিনের ব্যবধানে। এমনিতেও খুব একটা প্রাণোচ্ছল বাড়ি না হলেও প্রাণের সুরটাও যেন নিমেষ হয়ে গেছে। প্রতিটি মানুষের মুখটা কালো মেঘে ছেয়ে আছে। কারো বা দুঃশ্চিতায় কারো বা ক্রোধ, ক্ষোভে। শাহারা বেগম অত্যাধিক মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সাঞ্জের শরীর টা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বিধ্বংসী পরিবেশের আদলে তলিয়ে আছে পুরো আব্রাহাম ম্যানসন’টা।

শাহারা বেগমের ঘর থেকে বেরিয়েই দরজাটা ভিরিয়ে দিলো মোহর। বয়স্কা খুব বেশিই আহত হয়েছেন এহেন পরিবেশে। মোহর সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল পুরো বাড়ির উদয়। এক ঘোরতর কোন্দলের রেশটুকু যেন মুড়ে ফেলেছে শোকে,কাতরে। কদম ফেলে এসে দাঁড়ালো কাঙ্ক্ষিত ঘরটার দরজার সামনে। ভীষণ সাবধানে, সন্তপর্ণে নব মুচড়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখতে পেলো চিন্তা,দুঃখের প্রলেপে ঢাকা উদ্বেগিত মুখটা। নিঃশব্দে চোখে জল মুছছে আর বোনের কপালে হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে। ধীরপায়ে কাছাকাছি এলেই মোহরকে দেখে চোখের জল বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়লো অবলীলায়। কান্নামিশ্রিত চাপা স্বরে বলল,

– এটা কি হলো মোহর আমার বোনটার এ কোন দশা হলো! আমি কখনো কল্পনাতেও ভাবিনি এমন দিন দেখতে হবে। আমার ছোট্ট বোনটা এতো ধকল কি করে সামলাবে? ও যতই মুখে বড়ো বড়ো কথা বলুক, ও তো এখনো বড়ো হয়ে উঠতে পারেনি।

মোহর তাথই এর পাশে বসে ওর হাতটা ধরে বলল,

– কাঁদবে না আপা। কাঁদলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে বলো? তুমি নিজেকে সামলাতে না পারলে সাঞ্জে কে কি করে সামলাবে? ও জেগে থাকলে কতটা হাইপার হয়ে উঠছে দেখেছোই তো।

– ওর সারা গা জ্বরে পু’ড়ে যাচ্ছে মোহর। কয়েকবার জলপট্টি দিয়েছি কপালে, কিছুতেই কমছেনা। মা-বাবা বিকেল থেকে ওর মুখটা দেখতেও আসেনি একবার। বড়মা এসেছিলো সে বলল বাবা মা, বড় আব্বু নাকি নিষেধ করেছে বাইরের কোনো ডাক্তার আনতে। উনারা এই বিষয় টাকে কোনো ভাবেই চার দেওয়ালের বাইরে যেতে দিতে চাননা। তারা তো এই বলেই চলে গেলো, এড়িয়ে গেল, মুখ ফিরিয়ে নিলো। কিন্তু আমি কি করবো, আমি তো নিজের ছোট বোনের এই অবস্থায় মুখ ফেরাতে পারছিনা। আমার জীবনে তো এক ঝড়ে শেষ হয়েই গেছে, আমার বোনটার এমন কেনো হলো মোহর! ও এখন কি নিয়ে বাঁচবে। বাবা মায়ের যা ভাব বুঝছি ওরা খুব তাড়াতাড়ি অ্যাবোর্সন করানোর জন্য উঠেপড়ে লাগবে

– শান্ত হও। আপাতত ওর সুস্থতা টা দরকার। প্রথমত পারফেক্ট ম্যাচিউরিটির আগেই কনসিভ করেছে। দ্বিতীয়ত ওর শরীর টা অনেক বেশিই অ্যাবনোরমাল হয়ে আছে এখন। ওর সুস্থতা টা খুব বেশি প্রয়োজন।

বলে উঠে ওয়াশরুমের দিকে গেলো। ক্ষানিক বাদেই ঠান্ডা পানিভর্তি একটা পাত্র এনে তাতে কাপড় ভিজিয়ে তাথইয়ের হাতে দিয়ে বলল,

– ওর সারা শরীর মুছিয়ে দাও। যতক্ষণ না তাপমাত্রা কমবে বারবার মুছিয়ে দেবে। হাত আর পায়ের তালুতে ঠান্ডা কাপড় চেপে রাখবে। আর হাই পাওয়ারের কোনো মেডিসিন দিচ্ছি না। তুমি ওর শরীর মুছিয়ে দাও আমি নাজমা খালাকে ডেকে কিছু খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।

বলে তাথইকে শান্ত করে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো। নাজমাকে ডেকে সাঞ্জের জন্য গরম স্যুপ করে নিয়ে যেতে বলে ও আবারও উপরে উঠে এলো। তবে এবার আর সাঞ্জের ঘরে না, নিজের ঘরটাতেই ঢুকলো৷ বুকের ভেতরটা কেমন অসহনীয় ঠেকছে। মেহরাজ সন্ধ্যার থেকে একটা বারের জন্যেও বের হয়নি ঘর থেকে। পৃথকের সাথে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করে পৃথক চলে গেলেও মেহরাজ আর কারো সাথে কোনো প্রকার কথা বলেনি।
ঘরের ভেতর টা গুমোট, আলোহীন হয়ে আছে। মোহর দরজা ঠেলে দিয়ে অন্ধকার হাতড়েই বারান্দার দিকে এগিয়ে স্লাইডিং দরজাটা ফাঁক করে দিতেই হুড়মুড়িয়ে শৈথিল্যে ভরা বাতাসে ঘরটা ভরে গেলো। বাইরের লাইটের ছোট ছোট আলোকণাও এসে পড়ছে ঘরটাতে। বারান্দা থেকে আসা মৃদু আলোতে মোহর স্পষ্ট দেখতে পেলো বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা লম্বাটে শরীর টা। বুক চিড়ে ভারী প্রশ্বাস বেরিয়ে এলো। মৃদুমন্দ পায়ে এটি গিয়ে বসলো মেহরাজের পাশে ফাঁকা রাখা জায়গাটার।
বালিশ ছাড়াই উপুড় হয়ে আছে মানুষটা। সুনসান নীরবতায় অক্লিষ্ট ঘরটায় নিঃশ্বাসের অক্রুর ফিসফিসানি ছাড়া আর কোনো শব্দের উপস্থিতি নেই। মোহর নিজের হাতটা এগিয়ে খুব আরামসে রাখলো মেহরাজের প্রসর পিঠে। নিঃশ্বাসের ওঠানামার সাথে তাল মিলিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠলো মোহরের হাতটাও। শাড়িটা একহাতে সামলে পা তুলি এগিয়ে বসলো মোহর। হাতের তালুর বিচরণ সন্তপর্ণে পিঠময় ছাড়িয়ে ঘাড় বয়ে চুলগুলোয় বিলীন হলো। খুব আদরে, আত্ততায়, যত্নে চিকন চিকন আঙুলগুলো ঘন চুলগুলোতে বুলিয়ে দিলো। এভাবেই অতিবাহিত হলো মিনিট দশেক। নিস্তব্ধতার বুক চিরলো মোহরের চিকন রিনিঝিনি গলায় স্বরে,

– সাঞ্জের জন্য খুব খারাপ লাগছে?

মেহরাজ পড়ে রইলো ঠাঁই নিঃশব্দে। যেন ঘুমে তলিয়ে যাওয়া অসাড় শরীর। মেহরাজের প্রতিক্রিয়াহীনতাকে আমলে না নিয়ে মোহর আবারও বলল,

– সাঞ্জের বাবা মায়ের মতো কি আপনিও অ্যাবোর্সন করিয়ে দিতে চান রুদ্ধ?

কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই শরীর টা কেঁপে উঠলো মোহরের। মেহরাজ বিছানা থেকে মুখ তুলে হুড়মুড়িয়ে এসে মোহরের কোলে মাথা রেখেছে। আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই স্বাভাবিক ভাবমূর্তিতে মুখ তুলে জানালার কাঁচ পেরিয়ে রাতের আকাশে তাকালো। তীব্র বিষাদে ভরা ভারিক্কী মন-মস্তিষ্কে ক্লেশ নিয়ে বলল,

– সাঞ্জে কি করে এমন ভুলটা করলো। নিজের জীবন টাকে কোন মোড়ে এনে দাঁড় করালো ও। তাও আবার এমন একজনের জন্য যে কি না . . .

শেষটুকু বলতে গিয়েও বলল না। কণ্ঠ কেঁপে উঠলো। মানুষ টার নামটা না নিতেও ক্রোধ, ঘৃণায় মুদে এলো চোখ মুখ। মেহরাজ দুহাতের করপুট ভীষণভাবে দৃঢ় করে মোহরের কোমর পেঁচিয়ে ধরলো। মেয়েলী শরীরের নরম পেটে মুখ গুঁজে ফোসফাস নিঃশ্বাস ছেড়ে অস্থিরতা নিয়ে বলল,

– সাঞ্জে এটা কীভাবে করলো মোহ। আমি ভাবতে পারছিনা, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা। ও আমাকে একবার বললে যাকে চাইতো আমি তাকেই এনে দিতাম। কিন্তু ও কি করে . . ওর মুখের দিকে আমি তাকাতে পারছিনা মোহ। ছোট ছোট যেই হাত দুটো আমার হাত ধরে দাভাই দাভাই করে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতো সেই দু’হাতটাই যখন আমার পা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদলো তখন আমার কেমন লেগেছে এটা আমি কি করে বোঝাবো মোহ? ওর এই চেহারাটা তো আমি সহ্য করতে পারছিনা

কথার সাথে তীব্র যন্ত্রণা, মনস্তাপে কেঁপে কেঁপে উঠলো গলার স্বর। দুহাতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রইলো মোহরের কোমর। চোখ দু’টো ভরে এলো মোহরের নোনাজলে। ছোট বোন সমতূল্য মেয়েটার এহেন পরিস্থিতি যে ওকে ও কম যন্ত্রণা দিচ্ছে না! তবে নিজের দুঃখ, কষ্টটাকে আড়াল করে দুহাতে মেহরাজের মুখটা ধরে টেনে উঁচিয়ে নিলো। যতটা সম্ভব কাছে টেনে নিলো পুরুষালী শরীর টাকে। দুই গাল,কপালেসহ সারা মুখজুড়ে এক দুই করে অসংখ্য ছোট ছোট ঠোঁটের স্পর্শ মেখে দিয়ে বলল,

– সমস্যা যখন হয়েছে সমাধান ও আছে। আপনি এভাবে বললে তাথই আপা, দিদা তারা কি বলবে। দিদা তো এমনিতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপা নিজেকে ধরে রেখেছে শুধু সাঞ্জের মুখের দিকে চেয়ে। আপনি অন্তত ভেঙে পড়বেন না।

মেহরাজ উত্তর করলো না। প্রিয়তমার বুকে ঠেস দিয়ে পড়ে রইলো চোখ বুজে। অশান্ত মন, দুঃশ্চিন্তা, বিষাদে আপাতত এই জায়গাটা ছাড়া কোনো স্থান নেই মাথা গুজার।

•••

– দুটো দিন ছুটি নিয়েছি। যাই হোক, আজতো আসতেই হবে।

– কিন্তু বাড়ির এই পরিস্থিতিতে তুই ছাড়া ওদের সামলাবে কে। তাথই দিদি একা কীভাবে . .

– দরকার হয় আজ হাফ শিফট নেবো। ফায়াজ স্যারকে বললে উনি অবশ্যই বুঝবেন ব্যাপারটা।

– আচ্ছা তবে তাই কর,যেটা তোর ভালো মনে হয়

মোহর আচ্ছা বলে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে সেন্টার টেবিলে রেখে হ্যাণ্ডব্যাগ টা গুছিয়ে রাখলো। চুলগুলো আঁচড়ে গায়ে ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। সাঞ্জের ঘরে দরজাটা হালকা ফাঁক করে দেখলো তাথই আধশোয়া হয়েই বসে আছে ওর পাশে। তবে মোহর আর ঘরে ঢুকলো না, দরজাটা ভিরিয়ে দিয়েই নেমে এলো। মোহরকে বেরিয়ে যেতে দেখে নাজমা ডেকে বলল,

– আপনি খেয়ে যাবেন না ম্যাডাম?

– আজ না।

বলে দাঁড়ালো না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে আসলেই সাদা রঙের গাড়িটাকে দেখে থেমে গেলো। গাড়ি থেকে বেরিয়ে মোহরকে দেখে শুকনো মুখেই হাসলো পৃথক,

– হসপিটালের জন্য বেরোচ্ছ?

– হ্যাঁ ভাইয়া।

– ভেতরের অবস্থা কেমন?

– আগের মতই।

বলে মোহর বিরতিহীনা আবারও জিগ্যেস করলো,

– মেহরাজ এতো সকালে কোথায় বেরিয়েছে ভাইয়া?

– একটু কাজ আছে। আমার একটু সাঞ্জের সাথে কথা বলা দরকার। ও কি এখনো স্ট্যাবল না?

মোহর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

– কাল সারারাত জ্বরে কাবু ছিল। এই শরীরে এতটা কি করে সামাল দেবে আমি এটা নিয়েই বেশি চিন্তিত।

পৃথক কপালে সরু ভাঁজ ফেলে জিগ্যেস করলো

– ওর বাবা মা কি কোনো ভাবে . .

– হ্যাঁ। তারা গর্ভপাত করানোর কথাটাই ভাবছে। আর তার জন্য খুব শীঘ্রই স্টেপ নিবে সেটাও বুঝতে পারছি।

– কিন্তু তারা স্টেপ নিলেও তো লাভ নেই। এই স্টেজে অ্যাবোর্সন কোনো ভাবেই পসিবল না!

মোহর ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,

– সেটা আপনি বা আমি বুঝলে তো কিছুই হবে না। যাই হোক আমার দেরী হচ্ছে ভাইয়া। আমি এসে কথা বলবো।

বলে পৃথকের থেকে বিদায় নিয়ে এগোলে পৃথক ও বাড়ির দিকে ঢুকতে গেলো। তবে মোহর কি মনে হতে, পেছনে ফিরে বলল,

– ভাইয়া! আপার কাল থেকে ঘুম,খাওয়া কিছুই নেই। সবচেয়ে বেশি আঘাত টা মনে হয় আপাই পেয়েছে। উনাকে একটু সামলে নিবেন

বলে গাড়িতে উঠতেই গাড়িটা তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে গেলো। পৃথক নিরবে সম্মতি দিয়ে এগিয়ে গেলো বাড়ির ভেতর।

•••

– সমস্যাটা আপনাদের। এখানে আমার কিছু করার আছে বলে তো মনে হয় না!

– ভাই যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। যেই ঘটনা পেরিয়ে গেছে সেটার রেশ ধরে এখনো এই মন কষাকষির কোনো মানে হয়!

– মন কষাকষির তো কিছু নেই মুর্তজা সাহেব! আমি আপনাদের সম্মুখেই সমস্ত ল্যাটা চুকিয়ে এসেছি। আপনাদের সাথে এখন আর কোনো লেনদেন আমি করিনা।

বলেই নিজের কথায় ইতি টানলেন ওয়াকিফ চৌধুরী। এতক্ষণ আরহাম বললেও এবার মুখ খুললো আজহার। ভীষণ সাবলীল ভাবেই বললেন,

– লেনদেন করিনা বললেই তো লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়নি ওয়াকিফ। কোম্পানির শেয়ারের মালিকানায় এখনো তোমার নামটা বহাল আছে, ফ্যাক্টরির সকলে এখনো তোমাকে ম্যানেজমেন্টের অথোর হিসেবে জানছে, আর ব্যাংক এখনো এআর গ্রুপ থেকে তোমার অ্যাকাউন্টে মানি ট্রান্সফার করছে। তাহলে বন্ধ টা কি হলো?

ওয়াকিফ চৌধুরী ক্রুর চোখে তাকালো দুই ভাইয়ের দিকে। যারা আজ সকালেই নিমন্ত্রণ হীনায় এসে বসেছে তার তলবে। বেশ ভারী গলাতে বলল,

– কোম্পানিতে আমার শেয়ার,মানি,নাম সবই আছে। তাহলে এসব তো হবেই। আমার হকের জিনিস, এ নিয়ে খোটা দিচ্ছেন আপনারা আমাকে!

– ভুল বুঝছেন আপনি। ভাইজান আপনাকে খোটা দিচ্ছেন না বরং মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমাদের নাম,ঠিকানা, ব্যবসা, আবাস্থল এখনো একই আছে। আমরা এখনো এক সুত্রেই আঁটকে আছি। এসবের মাঝে শুধু শুধু মনোমালিন্যতা ধরে রাখা টা অহেতুক বিলাসিতার মতো অবান্তরতা ছাড়া কিছুই না। আপনি না চাইলেও এখনো আমরা একই আছি, আর চুক্তি শেষ না হওয়া অব্দি থাকতেও হবে।

আরহামের কথাটার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে অসুবিধা হলো না ওয়াকিফের। কথার কোনো অংশে ভুল বলেননি তারা। তবে তার অহমিকাও তো অহেতুক নয়! কিন্তু সেই মনোভাব টা সন্তপর্ণে লুকিয়ে বেশ খানিকটা নিরবতা পালন করে গম্ভীর স্বরে বলল,

– তাহলে কি চাচ্ছেন আপনারা!

– আপনি লয়্যার মোতায়েন করুন। নোমানের যত দ্রুত সম্ভব জামিন হওয়া দরকার

আরহামের কথায় ভীষণ রকম ভাঁজ পড়লো ওয়াকিফের কপালে। ভ্রু কুঁচকে বললেন,

– লয়্যার তো আমার আলাদা নয়। একই, তবে সেই কাজটা তো আপনারাও করতে পারেন

আজহার চ জাতীয় শব্দ করে ব্যতিব্যস্ত হয়ে অস্থির গলায় বললেন,

– কিসব বোকার মতন কথা বলছো ওয়াকিফ। নোমানকে জেলে দিয়ে ওর নামে কেস ঠু’কেছে কে? মেহরাজ, যে আমাদেরই বাড়ির ছেলে। এখন ছেলে কেস ঠু’কেছে আর আমরা বাপ চাচারা লয়্যার অ্যাপোয়েন্ট করবো! জল কতদূরে গড়াবে ভাবতে পারছো?

– ভাইজান ঠিক বলছেন ওয়াকিফ ভাই। আমাদের কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, নোমান যা করেছে ওকে শূ’লে চড়ালেও আমার রাগ হজম হবে না। কিন্তু আপাতত ওই অ’জাত টাকে আমাদের দরকার। যতসব লেনদেন, এক্সপোর্ট, ইমপোর্ট ওর হাত দিয়েই হচ্ছে। ডিলার’রা আমাদের বলতে নোমানের নামটাই জানে। এখন যদি ওকে আমাদের হাতে রাখতে না পারি তাহলে কোটি কোটি টাকা আমাদের পকেট থেকে চুকাতে হবে। তাই আপনি নোমানের হয়ে কেস লড়াবেন। কারণ বিজনেসটায় আপনারও সমান ভাবে শেয়ার আছে, সেক্ষেত্রে নোমান আপনার ও আন্ডারে কাজ করে। তাই নিজের এমপ্লয়িকে জামিন দিতে আপনার লয়্যার মোতায়েন করাটাকে কেও ই সন্দিহান নজরে দেখবে না।

পুরো কথাটা চুপচাপ হজম করলো ওয়াকিফ। হয়তো বুঝতেও পারলো সবটা। কিন্তু তাতে কালো করে রাখা মুখটার পরিবর্তন হলো না। বরং আরও দ্বিগুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,

– সেসব নাহয় করলাম। কিন্তু মেহরাজের হয়ে কে লড়ছে সেটা ভুলে যাচ্ছেন আপনারা! ব্যারিস্টারকে আমার লয়্যার কিছুতেই মোকাবিলা করতে পারবেনা আরহাম। ওর হাত অনেক লম্বা, বরং আমি হাত ঢোকাতে গেলে শেষে কেঁচো খুঁজতে কেওটে না বেরিয়ে আসে!
.
.
.
চলমান।

©Humu_❤️

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫২
#হুমাইরা_হাসান
| অংশ ০২ |

– আশু?

বহুচেনা একটা পুরুষালী কণ্ঠ কানে এলে ডান হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নিলো তাথই। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। বিস্ময়কর ভাবে সামনের দৃশ্যটুকু দেখে বুকের পিঞ্জিরাবদ্ধ যন্ত্রণা টা ভোতা আঘাত করে বসলো। স্তব্ধ নজরের ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পৃথকের বুকে মিশে থাকা ওর ছোট্ট মেয়েটার মুখে। এতসব ঝামেলার মাঝে কাল থেকে নিজের মেয়েটাকে একবারের জন্য কোলেও নেয়নি। এমনকি কাল রাতটাতেও তোয়া নাজমার কাছেই ছিলো।

– নাজমা খালার কাছে ছিলো, খুব কান্নাকাটি করছে, মনে হয় ওর ক্ষুধা লেগেছে। তুমি একটু ওকে খাওয়াও আশু

বলে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো তাথইয়ের পাশে। তাথই নিষ্পলক চেয়ে রইলো পৃথকের বুকে লেপ্টে থাকা ওর মেয়ের দিকে। যার রক্ত নিজের শরীরে বইছে সেই বাবার বুকটাও তো কখনও এতো আদরে কাছ থেকে পাইনি, তাই বোধহয় আর হাতছাড়া করছে না? ছোট্ট মেয়েটা এটাও বুঝে নিলো! কি সহজে,নির্দ্বিধায় ছোট ছোট থাবা বুকটায় মেলে দিয়ে লেপ্টে আছে। তাথই নিজেকে কোনো ভাবেই ধরে রাখতে পারছে না, এইরকম মুহুর্তেও অবাঞ্ছিত একটা অনুভূতিময়ে কোন্দল তুললো মনের ভেতরে। নিজ সন্তানের বাবার শূন্যতাটা যেন আজ ওর বুকে বেশ গাঢ় আঁচড় দিলো।
নিজের যৌক্তিক ভাবনা গুলোকেও নিছক অযৌক্তিকের তকমা লাগিয়ে ধাতস্থ হয়ে হাত বাড়িয়ে তোয়াকে নিতে গেলো। সাত মাসের বাচ্চাটা কি বুঝলো কে যানে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ওভাবেই পৃথকের বুকটাতে লেপ্টে রইলো। তাথইয়ের বিস্মিত চেহারা দেখে পৃথক খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

– আ…ব্ ও নাহয় আরেকটু থাকুক আমার কাছে। মানে তোমার যদি কোনো অসুবিধা না হয়?

তাথই মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে শক্ত গলায় বলল,

– অসুবিধা নেই

তাথইয়ের এমন গম্ভীর মুখটা দেখে বিচলিত হলেও বেশ জড়তা নিয়ে পৃথক বলল,

– না মানে, ও তো ছোট। কার কোলে উঠেছে বুঝছে না। তুমি কি ওর উপরেও রাগ করবে?

তাথই পৃথকের দিকে গরম চোখে তাকালে ওর উৎসুক মুখটা নিমিষেই শুকিয়ে গেলো। তাথইয়ের রাগ হলেও নিজের উপরেই রাগ হলো। অতিষ্ঠময় গলাতে চ্যাঁচিয়ে বলল,

– আমি কি সবসময় রাগই করি? আমার মনে দয়া মায়া নেই? নাকি পাষাণী মনে হয় আমাকে? আপনারা সবসময় আমাকে কি বোঝাতে চান আমি নিষ্ঠুর?

প্রচণ্ড খারাপ ভাবে পৃথকের মুখের উপর এতগুলো কথা বলে খিটখিটে মুখটাই অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। পৃথক চুপ করে রইলো। আস্তেধীরে এগিয়ে এসে তাথইয়ের পাশে বসে একহাতে তোয়াকে ধরে অন্য হাতটা এগিয়ে তাথইয়ের মাথায় রাখতে বাড়িয়ে দিলেও অদ্ভুত একটা জড়তা, আড়ষ্টতার ভয়ে পিছিয়ে নিলো। তাথই আড়চোখে ঠিকই লক্ষ্য করলো পৃথকের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটার পিছিয়ে নেওয়া। ভীষণ রাগ হলো ওর ভীষণ, আবারও আগের মতো রুক্ষ স্বরে বলল,

– হাতটা সরিয়ে নিলেন কেনো? আমাকে ধরলে হাতটা পচে যাবে তাই তো? আমি এতোই খারাপ যে আমাকে স্পর্শও করা যাবে না? তাহলে কেনো এসেছেন, আলগা দরদ দেখাতে এসেছেন?

পৃথক বেশ অবাক হলো তাথইয়ের এরূপ কথাবার্তার ধরনে। ওকে স্পর্শ করলে যদি আবারও রেগে যায় সেই ভয়েই তো পিছিয়ে নিলো! তাথই জোরে জোরে দুবার নিঃশ্বাস টেনে ঘাড় কাত্ করে তাকালো পৃথকের দিকে৷ এতক্ষণ তো ঠিকই ছিল! হুট করে এতো রাগ হচ্ছে কেন? এই মানুষটাকে দেখে এতক্ষণের চাপা উদ্বেগ, ক্ষোভ গুলো উগড়ে আসছে কেনো?
পৃথক তাথইয়ের অস্থিতিশীল দশা দেখে সরে আসতে চাইলো, বসা থেকে উঠতে নিলেও ওর সমস্ত চিত্তকে অভিভূত করে দিয়ে তাথই ঝাপিয়ে পড়লো পৃথকের বুকে, অকস্মাৎ তাল সামলাতে না পেরে নড়েচড়ে গেলো পৃথক। তোয়াকে বুকের একপাশে ধরে আরেকটা হাতের অপ্রকৃতস্থ স্পর্শ টা তাথইয়ের মাথায় রাখলো। পৃথকের সমস্ত জড়তা, বিহ্বলতাকে এক ঝটকায় সরিয়ে বুকের একপাশটায় নিজ অধিকার দখল করে নিলো দেদারসে। চমৎকৃত ভাবে পৃথকের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে সশব্দে কেঁদে উঠলো। কান্নার হিড়কে কম্পিত গলায় বলল,

– আমাকে এতো খারাপ কেনো ভাবেন আপনারা। আমি কি এতোই খারাপ? এতোই রাগী? আমার কি কষ্ট হয়না? হয় . . আমার অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু কেও তো আমারটা বোঝে না! আমি কোথায় যাবো কার কাছে যাবো?

অদ্ভুত অনুভূতির জিরিজিরি কম্পনে বুকটা নাড়া দিয়ে উঠলো। একহাতে তাথইকে আগলে নিলো। আকস্মিক কাণ্ডে তালগোল হারিয়ে অদ্ভুত দুঃসাহসিক কাজটা করে বসলো। এতদিনের সুপ্ত অনুভূতি গুলোই প্রিয়তমাকে আগলে নিতে, সাদরে যত্নে নিতে ঠোঁট দুটোর আলতো পরশ বসিয়ে দিলো তাথইয়ের কপালে। তাথইয়ের চোখের জল বাঁধছাড়া হয়ে ছাপিয়ে পড়লো। ওর যত খারাপ মেজাজ, রাগ, ক্ষুব্ধতার পেছনে যে একবুক ভালোবাসা যত্ন আর কারোর কাছে নিজেকে আগলে রাখার সুপ্তানুভূতির প্রখরতা টুকু লুকিয়ে থাকে সেটা তো কেও বোঝেনি। এতটা খারাপ ব্যবহার করলে তো অন্যেরা দূরে চলে যায়, পৃথকই একমাত্র মানুষটা যে বরং পাশে এসে বসেছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি তাথই, অনুচিত সত্ত্বেও তাই ঝাপটে ধরলো বহুকাঙ্ক্ষিত বুকটাতে।

– আশু?

তাথই নড়াচড়া করলো না। পৃথক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

– তোমাকে কেও খারাপ ভাবে না আশু, নাইবা পাষাণী ভাবে। তুমি যে কতটা মায়াবতী সেটা আমিতো জানি। আমিতো শুধু চেয়েছিলাম তোমাকে স্পেস দিতে, তোমার মন মেজাজ ভালো নেই এই ভেবে।

– লাগবে না আমার স্পেস। কিচ্ছু লাগবে না। বহুত স্পেস পেয়েছি। এতটাই পেয়েছি যে আমার সাথে,আমার পাশে কেও নেই আর।

– কে বলেছে কেও নেই? সবাই আছে আশু

– চুপ করুন। একদম চুপ। লাগবে না আমার কাওকে৷

পৃথক হাসলো। একেবারেই সামান্য, নিঃশব্দে, অল্পবিস্তর। কিন্তু এই এক ফালি হাসিতে যেন ওর একবুক তৃপ্তিটুকু স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেলো। দীর্ঘ বছরগুলো পরে সুখানুভূতি টাকে বুকের মাঝে পেয়ে ওর কতটা আনন্দ লাগছে এটা কি করে বোঝাবে ও!
তাথইয়ের হুট করেই সম্বিত ফিরলো যেন। আবেগের বশে কতবড় কাজটা করে ফেলেছে সেটা বোধগম্যতায় আসলেই ছিটকে সরে এলো। অপ্রস্তুত চেহারায় উঠে দাঁড়ালো। পৃথক আর বাড়ালো না তাথইয়ের অস্বস্তি, বিষয় বদলাতে সাঞ্জের দিকে তাকিয়ে বলল,

– সাঞ্জের অবস্থা কেমন?

তাথই সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। ছোট্ট বোতলটা হাতে নিয়ে ধীমি গলায় বলল,

– আগের মতোই। সারারাত জ্বরে ছিলো। সকালে ছেড়েছে। কিন্তু চোখ খোলেনি।

– স্বাভাবিক। প্রি-ম্যাচিউর প্রেগন্যান্সিতে অনেক বেশিই ক্রিটিকাল হবে ফিজিক্যাল কন্ডিশন।

তাথই উত্তর করলো না। ঘর থেকে বেরিয়ে মিনিট পাঁচেক বাদেই এসে পৃথকের সামনে হাত বাড়িয়ে বলল,

– ওকে খাওয়াতে হবে।

পৃথক বুক থেকে ছোট্ট তোয়াকে তুলে তাথইয়ের হাতে দিলে। তাথই ওকে নিয়ে বসে দুধভর্তি ফিডারটা ওর মুখে ধরলো। পৃথক তাকিয়ে আছে নিষ্পলক সেদিকে, তাথইয়ের অবশ্য বেশ অস্বস্তি হলো এহেন চাহনিতে।

•••

– তুই কি এখনি বেরিয়ে পরবি মহু?

– হ্যাঁ।

শ্রীতমা হাতের ফাইলটা একপাশে রেখে এগিয়ে এলো। মোহরের হাতের বাহুটা জড়িয়ে ধরে মাথা ঠেকিয়ে বলল,

– এতো সমস্যা কি সব তোর জীবনেই আসে। কেনো আসে মহু, আমার আর ভাল্লাগে না এসব।

মোহর স্মিত হাসলো। স্টেথোস্কোপ টা গলা থেকে খুলে শ্রীতমার গালটা টেনে দিয়ে বলল,

– এসব নিয়ে একদম ভাবিস না তো। সব ঠিক হয়ে যাবে। পরিস্থিতি যেমনই হোক, আমাদের উচিত প্রতিটা মুহুর্তে ধৈর্য ধরে সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসী হওয়া। তিনিই পারেন সব সমস্যার সমাধান দিতে। এসব ছাড়,তোর খবর বল তো! হাতের বালাটার কাহিনি কিন্তু এখনো বলিস নি আমাকে?

বালাটার কথা শুনতেই মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো শ্রীতমার। মোহরের হাতটা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। শুকনো গলায় বলল,

– এখন তুই বাড়িতে যা। এমনিতেই অনেক সমস্যা চলছে। এসব নাহয় সময় করে একদিন বলবো।

প্রিয় বান্ধবীর চোখ মুখের ভাষা, আর অভিব্যক্তি বুঝতে একটুও দেরী হলো না মোহরের। ও শ্রীতমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

– ঠিকাছে। আমি জানি আমার শ্রী অনেক বুদ্ধিমতী। যা করবে ভেবেচিন্তেই করবে। তবে মন্দের চেহারা দেখে ভালো টাকেও ঠেলে দেওয়া কিন্তু বুদ্ধিমত্তার পরিচয় না।

ছোট্ট ইঙ্গিত টা হয়তো শ্রীতমাও বুঝতে পারলো। তবে সে বিষয়ে আর না বলে মোহর ওকে ছেড়ে বলল,

– সাবধানে ফিরিস। কেমন?

শ্রী ঘাড় নাড়ালো মৃদু হেসে। মোহর চলে গেলে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়েই নিজের হাতটার দিকে তাকালো। সোনার বালা টা চকচক করছে। ওর ফর্সা হাতটার শোভাটা যেন দ্বিগুণ করে দিয়েছে। বালাটা খুলতে চেয়েও কি ভেবে ওভাবেই পড়ে রেখেছে, যতবার এর দিকে তাকাচ্ছে মাধুর্য নামের মানুষটার মমতা, মাতৃস্নেহটা যেনো কড়া ভাবে অনুভূত হচ্ছে ওর।

.

যেহেতু আজ অন্যদিনের তুলনায় হসপিটাল থেকে আগে আগে বেরিয়েছে তাই গাড়িটা আজ আসেনি, নাইবা মোহর জানিয়েছে আসার জন্য। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় চোখ গেলো অল্প দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটর দিকে। মুচকি হাসলো মোহর। এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে ডেকে বলল,

– আজকে আমাকে এড়িয়ে গেলেন যে?

ফোনে মুখ গুঁজে থেকেও কণ্ঠস্বরটা কানে এলে না চাইতেও তাকালো তিয়াসা। মোহরকে দেখে ইচ্ছে করেই সরে দাঁড়িয়েছিলো। গাড়িটা এলেই এখান থেকে সরে বাঁচে, তবুও মেয়েটা দেখেই ফেললো ওকে। বিরক্তি ভরা মুখাবয়বে বলল,

– তুমি কে যে তোমাকে দেখে সালাম ঠুকে চলতে হবে

– সালাম তো অন্যদিনেও ঠুকেন না। তবুও আমাকে দেখলে দুটো তেতো কথা শোনার জন্য তো মুখিয়ে থাকেন। তবে আজ কেনো সালামের প্রশ্ন আসছে!

তিয়াসা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তাকালো মোহরের মুখের দিকে। খিটমিট করে বলল,

– এই তোমার সমস্যা কি। আমি কি করবো না করবো সেটা তুমি বলার কে? শুনেছি বাড়িতে বিরাট ঝামেলা হয়েছে, সেসবই সামলাও আমি কি করছি সেটা না দেখলেও হবে।

শেষোক্ত কথাটুকু বলতে ক্রুর হাসলো তিয়াসা। মোহরও হাসলো। হাসি হাসি মুখেই বলল,

– হ্যাঁ সেটাই তো, যার জন্য ঝামেলা হয়েছে আপাতত সে গারদের ওপারে। তাই আপনাকে আগাম বার্তা দিতে এলুম। কান টানলে মাথা আসে জানেন তোহ। চা’বুকের ঘা পিঠে পড়লে কেও ই মুখ বুজে থাকবে না, সে যতটা অনুগতই হোক। আর আমি যতদূর জানি পার্টনারশিপে সবাই স্বার্থপর হয় অনুগত নয়।

তিয়াসার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে এলো। মোহর কিসের ইঙ্গিত দিলো। এসব ওকে বলতে আসা মানে ইন্ডাইরেক্টলি ওর দিকেই আঙুল তুলেছে মোহর। শুদ্ধ বাংলায় যাকে হুমকিই বলা যায়।

– এসব আমাকে কেনো বলতে এসেছ? নোমান তোমাদের ফ্যামিলি মেম্বার। ঝামেলা ও করেছে এখানে কান টানলে মাথা আসবে না চুল এসব আমাকে শুনিয়ে লাভ কি? শোনো আমি কোনো দু’টাকার মানুষ নোই যে, যে যা খুশি বলে দেবে। আমি ওয়াকিফ চৌধুরীর মেয়ে। আমার বাবার হাত কত লম্বা তোমার ধারণাও নেই।

মোহর এবার দুগাল এলিয়ে হাসলো। বেশ চমৎকার ভঙ্গিমায় বলল,

– আমি কিন্তু নোমানের নাম বলিনি অথচ আপনি নিজেই ওর দোষটা খুঁজে দিলেন। আর আমি আপনাকেও কিছু বলিনি,তবুও নিজের বাবার ক্ষমতার হাত শুনিয়ে দিলেন। তা শোনালেনই যখন একটা কথা বলে রাখা ভালো, আপনার বাবার হাত যে অনেক লম্বা সে আমি কেন শহরের অধিকাংশ মানুষই জানে, তবুও আপনার হাতটাতে ব্যান্ডেজের কাপড় টা এখনো আছে। গভীর ক্ষত তোহ ব্যান্ডেজ তো থাকবেই!

শেষের কথাটা বেশ আফসোসের ভাব দেখিয়ে বলল মোহর। এরপর তিয়াসা কিছু বলার আগে নিজেই বলল,

– ওইতো একটা রিকশা এসেছে। যাই, ভালো থাকবেন।

বলে রিকশা ডেকে চড়ে বসলো। কিছুক্ষণের মধ্যে চলেও গেলো অথচ তিয়াসা হা করে চেয়ে রইলো ওর যাওয়ার দিকে। কি বলে গেলো মেয়েটা! কিসের ইঙ্গিত দিলো? বেশ খানিকটা সময় ভাবনায় বুদ হয়ে রইলো তিয়াসা, এর মাঝেই ওর গাড়ি এসে পড়লে উঠে বসলো। একটা কথা ওর কানে এখনো বাজছে, মোহর তো ভুল কিছু বলেনি! ওর বাবার এতো ক্ষমতা থেকে কি হবে ওর হাতটা এসিডে ঝ’লসে মেহরাজ দিব্যি নিজের মতো বহাল আছে। অথচ ওর বাবাতো একবারও তাকে কিচ্ছুটি বলেনি। হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো তিয়াসার কোনো এক দুঃশ্চিন্তায়, হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোনটা বের করেই কানে ধরলো

•••

– কাকলি! এই কাকলি? কোথায় ঢুকে বসে আছিস? বেরিয়ে আই।

ভারী কণ্ঠের চিৎকারে কাকলি খাতুন ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন। সাথে ছিল আম্বি আর মালা। বেরিয়ে এসেই কণ্ঠের মালিককে দেখে মুখটা কালচে হয়ে এলো। তবে উত্তর দেওয়ার আগে রুকাইয়া আবারও চ্যাঁচিয়ে বলল,

– আমার ছেলেকে বেধড়ক পি’টিয়ে গারদের ওপারে দিয়ে খুব আরামে এসির হাওয়া খাচ্ছিস তাই না? মুখ কালা কি আমার ছেলে একা করেছিল নাকি তোর মেয়েকে ধ’র্ষণ করেছে? তোর মেয়ের ইচ্ছে ছিলো না? তোর মেয়ের ছোক’ছোকানির জন্যেই তো হয়েছে এসব। কে বলেছিল ওকে আমার ছেলের কাছে যেতে?

তাথই দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো রুকাইয়া বেগমের বাজখাঁই গলার উচ্চস্বরে শুনে । পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধার না দেখে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই ছুটে গেলো, নিচতলার কোণার ঘরটার দিকে।

– কি হলো উত্তর দে? আমার ছেলেকে কি পেয়েছিস তোরা। আজ ওর বাপ নেই বলে যা তা করবি? নিজেদের কাজে গাধার মতো খাটিয়ে আবার মেয়ের দোষ ঢাকতে ওকেই অ’ত্যাচার করেছিস?

– আপা আপনি একটু শান্ত হোন। এভাবে চ্যাঁচামেচি করবেন না।

– আমি চ্যাঁচামেচি করছি? আর তোরা যেটা করেছিস? আমার ছেলেকে আমার ফেরত চাই। তোদের সাহস কি করে হলো আমার ছেলেকে পুলিশে দেওয়ার। দিবিই যখন নিজের মেয়েকেও দে। আজহার ভাই কোথায়? আরহাম কোই? ডাক ওদের আমার ছেলেকে এই মুহুর্তে বাইরে দেখতে চাই আমি

রুকাইয়ার এহেন আচরণে দমে গেলেন আম্বি। কাকলি এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার সেও তেতে উঠে বললেন,

– আপনার ছেলে দোষ করেছে তাই জেলে গেছে। সাঞ্জে ওর বোনের মতো। এটা কি করে করলো ও?

– বোন হয় সেটা তোর মেয়ের মনে ছিলো না যখন ছ্যাচড়ার মতো আমার ছেলের পেছনে পড়েছিল!

– আমার মেয়ের নামে কুৎসা রটার আগে নিজের ছেলেকে দেখুন। ওর চরিত্র কেমন তা কমবেশি সবাই জানে। আর যদি চ্যাঁচ্যাঁতেই হয় তবে মেহরাজের সামনে গিয়ে চ্যাঁচামেচি করুন। কারণ ওকে মা’রধর ও মেহরাজ করেছে আর হাজতেও ওই পাঠিয়েছে

রুকাইয়া বেগম যেনো দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ছেলের অবস্থা দেখে মাথায় খু’ন চড়েছে উনার। কি পেয়েছে টা কি! তার ছেলের একবিন্দু কষ্ট চোখে দেখতে পারেন না। আর সেখানে কি না সারা শরীরে ক্ষত নিয়ে ওই গারদে পড়ে আছে!

– কোই তোর মেয়ে কোই? ওকে ডাক! আমি ওকে এক্ষুনি পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাবো। ও নিজে মুখে বয়ান দেবে যে আমার ছেলে নির্দোষ।

বলে কারো কথার অপেক্ষা না করে ভারী শরীর টা নিয়েই দ্রুতপায়ে ছুটলো উপরে সাঞ্জের ঘরের দিকে। তাথই মাত্রই শাহারা বেগমকে নিয়ে বেরিয়েছিলো। রুকাইয়াকে ওভাবে ছুটতে দেখে ওউ পিছু পিছু ছুটলো।

– আপা আমাদের কথাটা শুনুন, সাঞ্জে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। ওর শরীর খুব খারাপ

পেছন থেকে আম্বির হাঁকডাক কানে না নিয়ে ক্ষিপ্ত পায়ে ছুটলো ঘরের দিকে। সাঞ্জের একটু আগেই চোখ খুলেছে। উঠে আধশোয়া হয়ে হেলান দিয়ে বসেছে আর তক্ষুণি ধড়াম করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো রুকাইয়া। ওকে ধাতস্থ হবার সুযোগ টুকু না দিয়েই হড়বড়িয়ে বললেন,

– এই সাঞ্জে! এই তোর জন্য আমার ছেলেটা হাজতে গেছে। বল কি ক্ষতি করেছিল ও তোর? তুই তো নিজেই ওর পেছন পেছন ঘুরেছিস। কবে করেছিস এসব হ্যাঁ? আর যা করেছিস অবশ্যই তোর সম্মতিতেই তাহলে দোষ একা আমার ছেলের কেন হয়েছে? তুই তো আসল দোষী

বলে সাঞ্জের বাহু ধরে ঝাকাতে লাগলো। তাথই ছুটে এসে রুকাইয়াকে পেছন থেকে ধরে বলল,

– ওকে ছাড়ুর ফুফু। ওর সাথে এমন আচরণ করবেন না!

– ছাড় আমাকে। ওর সাথে এর চেয়েও খারাপ করা উচিত। নির্লজ্জ বেহায়া মা** তোর এতো ছোকছো’কানি বাপ মাকে বিয়ের কথা বলিস নি কেনো? আমার ছেলেটাকে ফাঁ’সিয়ে মা’রতে চাস?

বলে এক হাত তুললেও হুট করে পেছন থেকে শক্তপোক্ত একটা হাতের মুঠোয় আঁটকা পড়লো। তাথই ভেবে আবারও ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে গেলেও পেছন ঘুরে আসল ব্যক্তির চেহারা দেখে চোখ দু’টো যেনো আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। রাগে, রোষে নিজের হাতটা সজোরে ছিনিয়ে নিতে চাইলেও পারলো না। সজোরে চেপে রাখা মোটাসোটা হাতের কব্জিটা মোহরের হাতের শেকলে দৃঢ়ভাবে আঁটকা পড়েছে।

– ওর গায়ে হাত দেওয়ার কথা ভুলেও ভাববেন না

মোহরের শান্ত চেহারায় বলা শান্ত শব্দগুলো শুনে রুকাইয়া রোষানলে উদ্ভুদ্ধ হয়ে ক্ষ্যাপাটে সুরে বলল,

– তোমার সাহস কি করে হলো আমার হাত চেপে ধরার। ছাড়ো বলছি অসভ্য মেয়ে

বলে একটানে হাতটা সরিয়ে আনতে চাইলে এবার আরও ক্ষিপ্তভাবে চেপে ধরলো মোহর। তপ্ত গলায় বলল,

– আপনার আচরণই আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে অসভ্য কে। যার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন তাদের সাথে এরকম দুঃসাহস দেখানোর সাহস কি করে হচ্ছে। নিজের চরিত্রহীন ছেলের হয়ে গলাবাজি করতে লজ্জা করছে না যার সে কি করে অন্যকে নির্লজ্জ বলে!

বলেই এক ঝটকায় হাতটা ছেড়ে দিলো। রুকাইয়া নিজের লাল হয়ে যাওয়া কব্জিখানায় হাত বুলিয়ে তীব্র ক্রোধে গর্জন করে বলল,

– খুব সাহস তাই না? বড়োলোক বাড়ির বউ হয়ে এসে বেশি বাড় বেড়েছে তোমার? সাঞ্জে কে তো দূর তোমাকে আমি আগে দেখে নেবো। তোমার জন্য এই মাস কয়েক আগেই আমার ছেলের হাত ভে’ঙে দিয়েছিল মেহরাজ। সেটা আমি ভুলিনি। শোধ আমি নেবোই। কড়ায় গন্ডায় উসুল করে নেবো

বলে আড়চোখে একবার কাকলির দিকে তাকিয়ে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলো রুকাইয়া বেগম।

.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫২
#হুমাইরা_হাসান
| শেষাংশ |

– সারাদিন কোথায় ছিলেন?

মেহরাজ ক্লান্ত চেহারায় ঘাড়টা কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে তাকায়। ওকে প্রশ্নকারীর চোখ মুখের কৌতূহলী চাহনি দেখে মৃদু হাসে। কি চমৎকার সেই হাসি! মোহরের সমস্ত চিত্তে শিথিলতা ছড়িয়ে দেয়। হাজারো মন খারাপেও যে মানুষ’টা ওর দিকে তাকিয়ে একফালি অকৃত্রিম হাসি দেয় এতে যে একবুক তৃপ্তি সারা বদনে খেলে যায় এটা কি হাসির মালিকটা আদৌ জানে?

– কাজ ছিলো বিবিজান।

বলে ব্লেজার টা খুলে গলার টাই ঢিলে করতে থাকে। মোহর এগিয়ে এসে পানির গ্লাসটা মেহরাজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজেই গলার টাই খুলে নিয়ে পাশে রাখলো। মেহরাজ এক নিঃশ্বাসে গ্লাসভর্তি পানি শেষ করে, গ্লাসটা নামিয়ে রেখে মোহরের হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় আগলে নিয়ে বলল,

– ফুফু এসেছিল আজ?

– হু

মোহর নিজের হাতদুটো ছাড়িয়ে নিয়ে মেহরাজের শার্টের বোতামে রেখে নিছক স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বলল,

– আমার জন্য নাকি তার ছেলের হাত ভে’ঙেছে সেই প্রতিশোধ নিবে বললেন।

মেহরাজ মোহরের নতজানু মুখটা দেখে স্মিত হাসলো। দু’কদম সরে বিছানাতে বসে নিজের উরুর উপরে মোহরে টেনে বসালো। চিকন আঙুল গুলো ধরে আবারও নিজের শার্টের বোতামে রেখে নিজ হাত দুটোকে বাড়িয়ে দিল কোমরের ভাঁজে। নমনীয় গলায় বলল,

– তাই আমার বিবির চিন্তা হাতটা ভা’ঙায় তার দোষটা কোথায়। তাই তো?

– চিন্তা নয়, প্রশ্ন। একটা প্রশ্নই করবো

মেহরাজ চোখের ইশারায় অনুমতি সূচক অভিব্যক্তি দিলে মোহর মন্থর গলায় বলল,

– সেদিন রাতে আপনার বুকে ছুরির আ’ঘাতের জন্য দায়ী কোনো ছিনতাইকারী নয় বরং নোমান,তাই তো?

মেহরাজ অনিমেষ তাকিয়ে রইলো মোহরের নতমস্তক আনন পানে। কতো শান্ত, নম্র, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন’টা করে বসলো। যেখানে ও নিজের মস্তিষ্ক খাটিয়ে ইতোমধ্যে উত্তর টা খুঁজে নিয়েছে।

– আপনি কি আমার স্বীকারোক্তি চাচ্ছেন, নাকি লয়্যালটি?

– যেমনটা ভাববেন।

শার্টের বোতাম গুলো এক এক করে সবগুলো আস্তেধীরে খুলে এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো মোহর। মেহরাজ মোহরের ঘাড়ের পেছনে হাত রেখে ওকে নিজের কাছে টেনে এনে কপালের মাঝ বরাবর চুমু দিলো, বেশ গভীর ভাবে। তারপর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,

– আমাকে ভরসা করেননা মোহ?

– শুধুমাত্র আপনাকেই।

মোহরের ছোট্ট জবাবে প্রসারিত হলো পুরু অধরযুগল, প্রশান্ত বুকটার মাঝে প্রাণপ্রিয়াকে মিশিয়ে রেখেই বলল,

– তবে আর কিছু শোনার দরকার নেই। শুধু জেনে রাখুন যে হাত আপনার দিকে খারাপ উদ্দেশ্যে আগাবে, তাকে আমি আস্ত রাখবো না সে যেই হোক।

মোহর নিঃশব্দে হজম করে নিলো মেহরাজের ভীষণ শাণিত, ধারালো শব্দগুলো। সন্দেহ তো ওর সেদিনই হয়েছিল যেদিন মেহরাজের শরীরে ক্ষতের চেয়েও রক্তের পরিমাণ অনেক বেশিই দেখেছিল। যেখানে এটা স্পষ্টত যে মেহরাজের শরীরে লেগে থাকা রক্ত অন্য কারো। অথচ মেহরাজের ভাষ্যমতে ছিনতাইকারী ওকেই আ’ঘাত করে পালিয়েছে!
তবে এই ব্যাপারটাকে আর গাঢ় করলো না মোহর। মুখ তুলে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলল,

– ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি খাবার দেই।

মেহরাজ মোহরের মুখের দিকে তাকিয়ে হুট করেই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপারে প্রশ্ন করে বসলো,

– আপনার কপালের দাগটা কিসের মোহ?

আচমকা এমন প্রশ্নে বেশ বিব্রত হলেও ভড়কালো না। কপালের একদম মাঝ বরাবর ছোট কালো দাগটা সবারই আগে চোখে পড়ে। মোহর বলল,

– ছোট বেলায় লেগেছিল কিছুতে। সেই থেকেই এমন দাগ পড়ে গেছে।

মেহরাজ কিয়ৎকাল অপলক তাকিয়ে থেকে মুখটা এগিয়ে নিয়ে ঠিক ললাটের দাগটার উপরেই ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরলো। দীর্ঘক্ষণ সেভাবে থেকে সোজা হয়ে বলল,

– হয়তো এইটারই কমতি ছিলো, সৃষ্টিকর্তা পরে পূরণ করে দিয়েছেন।

– মানে?

– মানে এই দাগটা আপনার সৌন্দর্যের বড়ো একটা অংশ। আর আমার আদরের খোরাক। ধরে দিন এই দাগটা আমার ঠোঁটের স্পর্শ পাওয়ার জন্যেই জন্মেছে।

বলে আবারও ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। মোহরকে সরিয়ে উঠে ওয়াশরুমের দিকে ঢুকে পড়লো। মোহর আনমনা হয়ে বেশ কিছু সময় বসে থেকে নিজেই নিজের কপালে হাত রাখলো। যে দাগটা এতদিন ওর একটা খুঁত হিসেবে জেনে এসেছে, তাকেই মেহরাজ নিজের আদরের খোরাক বানিয়ে নিলো, অদ্ভুত না? ভালোবাসা একটু বেশিই অদ্ভুত বোধ হয়!

•••

অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তার একপাশ ধরে হেঁটে চলেছে। শুভ্র, সুশ্রী মুখটা জুড়ে মলিনতা,বিষাদের ভয়াবহ রাজত্ব। এলোমেলো কদমে একপা একপা করে এগোচ্ছে। মনটা একটু বেশিই খারাপ শ্রীতমার। কিন্তু কেনো খারাপ! ও তো এটাই চাচ্ছিল অভিমন্যুর থেকে পিছু ছাড়াতে, ওই লোকটার মুখটাও আর না দেখতে। ঠিক তাই তো হলো, অভি আজ দুটো দিন ওর সামনেও আসেনি। অথচ ওর মনে হচ্ছে কতদিন লোকটা ওকে জ্বালাচ্ছে না। তারচেয়েও বেশি দীর্ঘ মনে হচ্ছে ওই মানুষ দুটোর থেকে দূরত্বের। কয়েকদিনেই আপন হয়ে ওঠা মানুষ দুটোকে ও আর যাই হোক মন থেকে ভালোবেসেছে। সেই মানুষ গুলোর কথা খুব বেশিই মনে পড়ছে। আচ্ছা ও কি খুব অন্যায় করেছে? পিতামাতা তূল্য মানুষ দুটোর মুখের দিকে চেয়ে মিথ্যে নাটক টা করে গেলেই বোধ করি ভালো হতো! নাকি নাটক করতে করতে তাদের ইচ্ছেকে ঠাঁই দিয়ে অভিমন্যুকে নিজের জীবনের জুড়ে নিতে!
বিরক্তিতে মুখ দিয়ে চ জাতীয় শব্দ করলো শ্রীতমা। অস্থির মনটা খুব বেশিই আজগুবি চিন্তাভাবনা জুড়েছে। এমনটা তো হওয়ার না। একবার একজনকে নিজের জীবনে জুড়ে যা কিছু সহ্য করেছে, এরপরে আর কখনও ভালোবাসার ইচ্ছে হবে কিনা জানা নেই ওর৷ সেই বিভৎস, যন্ত্রণাময় দিন গুলো। অশ্রুভেজা নির্ঘুম রাত্রিগুলো কিভাবে পার করেছে তা একমাত্র শ্রীতমা আর ওর ভগবান’ই জানে। আর নাহ, ও সারাটা জীবন নাহয় ভালোবাসার সুখ বাদেই কাটিয়ে দেবে, তবে বেদনার ক্ষত নিয়ে নাহ।
নিজেকে সামলে অযাচিত চিন্তাগুলো সযত্নে এড়িয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটতে লাগলো। এমনিতেই আজ অনেক দেরী করে ফেলেছে। এই সন্ধ্যা হলো বলে।
হাঁটার পথেই রাস্তায় মন্দিরটা পরে, একবার ভাবলো যাবে না, আরেকবার কি একটা ভাবতেই গেটের দিকে এগিয়ে গেলো। সন্ধ্যা আরতি টা নিয়ে আসলে মন্দ হয়না। তবে মন্দিরে ঢোকবার আগে প্রবেশ পথেই পা দুটো থমকে গেলো৷ সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে চোখাচোখি হতেই মেকি হাসলো শ্রীতমা, মনটা যেন হুট করেই ভালো হয়ে গেলো সামনের ব্যক্তির চেহারা দেখে।

– কেমন আছেন আন্টি? আপনি কখন এসেছিলেন।

– এইতো একটু আগেই।

ছোট জবাব দিয়েই ক্ষান্ত হয়ে গেলেন মাধুর্য ব্যানার্জি। শ্রীতমা অবাক হলো বেশ। সাথে বুকের ভেতর একটা ভয় ও হলো, এভাবে তো কখনও কথা বলেনা মাধুর্য! তিনি তো দেখা হলেই প্রাণখোলা হেসে জড়িয়ে ধরেন, তবে আজ!

– আপনার শরীর ঠিক আছে তো আন্টি?

– হ্যাঁ ভালো। এখন বাসায় ফিরতে হবে

শ্রীতমার বেশ খারাপ লাগলো। চেনাজানা মুখটা যে ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে সেটা ব্যবহারেই স্পষ্ট। ওউ ধপ করে নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো চুপ করে গেলো। মাধুর্য শ্রীতমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে শ্রীতমা ব্যস্ত স্বরে বলল,

– আ আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন আন্টি?

– রাগ? কিসের রাগ?

– আপনি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেনো আন্টি?

প্রশ্নটা করতে ওর বুকটা ফেটে গেলো যেন। কি অদ্ভুত! এতো কষ্ট লাগছে কেনো ওর? অপরিচিত মানুষ গুলোর সাথে দুদিনের পরিচয়েই এতটা টান,মায়া লাগছে ওর। মাধুর্য ব্যানার্জি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বললেন,

– এড়িয়ে যাবো কেনো। এইতো কথা বললাম। আর আমি দুদিনের চেনা একজন মানুষ, কথা না বললেও বা কি। রাস্তায় তো কতো মানুষের সাথেই দেখা হয় সবার সাথেই কি দাঁড়িয়ে গল্প করবে তুমি?

শ্রীতমার চোখটা ওর অজান্তেই ভরে এলো। ওর এই ব্যাথাতুর মুখটা দেখে ভদ্রমহিলাও আর শক্ত থাকতে পারলেনা । দ্রুত পায়ে সরে যেতে নিলে শ্রীতমা বলল,

– আপনি আমায় ভুল বুঝছেন আন্টি।

– আমি তোমাকে ভুল বুঝিনি মা। আসলে ভুল তো আমরা করেছি। নিজের ছেলের উপর বিয়ের জন্য একটু বেশিই চাপ দিয়ে ফেলেছিলাম,তাই হয়তো এমন একটা মিথ্যে নাটক দেখতে হলো। আসলে কি জানো আমাদের খুব শখ ছিল একটা কন্যাসন্তানের। কিন্তু ভগবান হয়তো চাননি,তাই পাইনি। কিন্তু বাবা মায়ের মন কি আর তা মানে। নিজের গর্ভে না ধরতে পারলেও ছেলের বউ করে একটা মেয়েসন্তান আনতে চেয়েছিলাম। তাই তো তোমাকে দুদিন দেখেই এতো ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমার ছেলেটা আবার এমনি যতই রাগ দেখাক আসলে খুব বোকা জানো তো। তা না হলে এই দুইদিনেও আমাকে সত্য টা বলতে পারেনি। সে তো ভাগ্যিস আমি সেদিন তোমাকে খাবার টিফিন করে দেবো বলে পিছু পিছুই আসছিলাম। তখনই সবটা শুনে না নিলা তো আজও মিথ্যে আশা নিয়ে ঘর সাজাতাম আমরা বুড়া-বুড়ি।

বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। শ্রীতমার নতমস্তকে তাকিয়ে স্মিত হেসে ওর মাথায় হাত রেখে বললেন,

– তোমাকে নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। সুখে থাকো আশীর্বাদ করি। আর বালাটা আমি তোমায় ছেলের বউ হিসেবে না, নিজের মেয়ে হিসেবে দিয়েছি। ওটা তোমার কাছেই রেখো। আসছি

বলে আর একটা মুহুর্তও দাঁড়ালেন না। শ্রীতমা পাথরমূর্তির মতো স্থির হয়ে রইলো। শুধু রইলো না স্থির চোখজোড়া। দৃষ্টি ঝাপসা করে অশ্রুতে ভিজিয়ে দিলো। নিজেকে আজ ওর খুব বড়ো অপরাধী মনে হচ্ছে, নিষ্পাপ মনের দুটো মানুষকে এভাবে কষ্ট দিলো ও? ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে নাহয় নাটকই করতো। ক্ষতি কি, তাতে যদি বাবা মায়ের ছায়াতল আর প্রাণভরা আশীর্বাদ পাওয়া যায়!

•••

– আমাকে এখান থেকে কবে বের করবেন মামা। এখানে আমি আর একদিন ও থাকতে চাইনা।

– চুপ কর। তোর মুখ টেনে ছি’ড়ে ফেলবো কুলাঙ্গার, জানোয়ার। লজ্জা করছে না আমাকে এই কথা বলতে? আমার মেয়ের সর্বনাশ করে আমাকেই বলছিল বের করাতে! মাঝখানে যদি এই কোটি টাকার হিসেব না থাকতো তাহলে আমি নিজে হাতে তোকে খু’ন করতাম শু**র।

গারদের ভারী দেওয়াল গুলোতে বারি খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো আরহাম মুর্তজার চাপা হুংকার। ছোটখাটো ঝুপড়ি খোপটার আরেক কোণায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে একটা অল্পবয়সী ছেলে। চাপা ধমকানিটা শুনে চাদরের ফাঁক দিয়ে চোখ দু’টো বের করে উঁকি দিয়ে আবারও ঢেকে নিলো। নোমান সেদিকে একবার তাকিয়ে খিটমিট করে তাকালো আরহামের মুখের দিকে। আরহাম আবারও খেঁকিয়ে উঠে বলল,

– মেয়ে মানুষে তোর মন ভরে না? আমি বারবার করে নিষেধ করেছিলাম মেহরাজের বউয়ের দিকে তাকাবি না, তবুও ও বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই তোর কা’মড় লেগে গেলো। ওখান থেকে দূর করেও হলো না তুই রাস্তায় ধরে বসলি। কি পেয়েছিস বল? নেড়ি শেয়ালের মতো পালিয়ে পালিয়েই তো থাকলি। যাকে মোকাবিলা করার মুরোদ নেই তার জিনিসে হাত দিতে যাস কোন কলিজায়! আবার সেসবেও হয়নি তুই আমার মেয়ের সাথে নোংরামি করেছিস খচ্চ’রের জাত!

– মামা মুখ সামলে কথা বলো। না জেনে বুঝেই আমাকে দোষারোপ করবা না বলে দিচ্ছি। হ্যাঁ আমি মানছি মোহরের দিকে শুরু থেকেই আমার নজর ছিলো, বহুবার চেষ্টাও করেছি ওকে পাওয়ার। তাই তিয়াসা যখন প্রস্তাব দিয়ে বসলো আমি নাকচ করতে পারিনি। কিন্তু তা বলে সাঞ্জের ক্ষতি আমি চাইনি।

– ক্ষতি চাসনি তাহলে এসব কি? আমার বাচ্চা মেয়েটার কি হাল করেছিস তুই।

– বাচ্চা বোলো না তো। ও যথেষ্ট বড়ো হয়েছে। আর আমি একা ওর কিছুই করিনি। মা’লপানি খেয়ে টাল হয়ে ছিলাম। সেই অবস্থায় ও নিজেই আমার ঘরে এসেছিলো। আমায় ভালোবাসে সে কথা বলতে, আমি নিষেধ করেছিলাম। বললাম ঘর থেকে চলে যা, তবুও শুনলো না। ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদতে লাগলো। এমনিতেই মাথা ঠিক নেই, মোহরকে বারবার হাতের কাছে পেয়েও ছুঁতে পারিনা।জিদ চড়েছিল, নেশার ঘোরে ওর উপর ঝাপিয়ে পড়েছি, ও নিজেও কোনো বাঁধা দেয়নি। এখানে আমার একার দোষটা কোথায়।

কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ হলো। ভারী হাতের একটা তামাশা গালের উপর পেয়ে চোখ ঘোলা হয়ে এলো নোমানের। টলমল পায়ে থপ করে মেঝেতে বসলে আরহাম দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন,

– আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মেয়ের নামে এসব বলতে বুক কাঁপছে না? শা’লা কু’ত্তার বাচ্চা। এবার পচে ম’র এখানে। এখান থেকে তোকে আদৌ বের করতে পারবো কি না জানি নাহ।

– মামা। একথা বলবা না। আমাকে মা’রো কা’টো যাই করো এখান থেকে বের করো। না তো আমি . .

– ভিজিটিং আওয়ার শেষ। আপনি এক্ষুনি বেরিয়ে আসুন স্যার চলে এলো বলে

কনস্টেবলের আগমনে বাকি কথাটুকু শেষ করতে পারলো না নোমান। আরহাম নোমানের দিকে এক পলক আড়চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে এলো। পকেটে হাত গুঁজে হাজার টাকার নোট বের করে কনস্টেবলের বুকপকেটে গুঁজে দিয়ে বললেন,

– মুখ যত বন্ধ রাখবে পকেট তত গরম হবে।

বলে রোগা পাতলা ছেলেটার পিঠ চা’পড়ে বেরিয়ে গেলেন।

.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে