ফানাহ্ পর্ব-৫১

1
1360

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫১
#হুমাইরা_হাসান

– উত্তর দিচ্ছিস না কেন তুই? কার সাথে ন’ষ্টামি করে এসেছিস বলছিস না কেন?

ভয়ংকর হুংকারে কেঁপে উঠলো সাঞ্জে। ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইলো বড়ো বোনের পেছনে। তবে আপাতত নিষ্ঠুররূপী মায়ের থাবা থেকে রেহাই পেলো না। সাঞ্জের বাহু চেপে ধরে টেনে এনে বলল

– কি হলো নাম বল? কার সাথে পাপ করেছিস? এই পাপের ভাগিদারের নাম বল! কোন ছেলে তোর এতো বড়ো সর্বনাশ করেছে?

হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সাঞ্জে। ঘরের প্রতিটি কোণে ওর কান্নার আহাজারি বাড়ি খেলো। নিঃস্তব্ধ, নিঃশব্দ মানুষ গুলোর মুখ দিয়ে টু পরিমাণ শব্দ বের হলো না। সাঞ্জে অসহায় চোখে আশপাশে তাকালো। দিদা, বড়মা, আপি, ভাবী সকলে আছে। সকলেই তো ওকে কতো ভালোবাসে, তাহলে আজ কেন ওকে বাঁচাচ্ছে না! মায়ের এরকম ব্যবহারেও কেও কেন ওকে আগলে নিচ্ছে না! ও কতো বড়ো পাপ করে ফেলেছে তাহলে! কি ভাবে হয়ে গেলো এতকিছু!

মোহর শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছে তাকালো সাঞ্জের দিকে। গোলগাল মিষ্টি গড়নের মেয়েটার শরীর শুকিয়ে কি অবস্থা! ওর এই কান্নারত চেহারাটা দেখে কষ্টের হুল বিঁধলো বুকে। দরজার দিকে এক পলক তাকালো। মেহরাজ কোথায়! কেন আসছে না?
মোহরের ভাবনার মাঝেই কাকলি খাতুন সাঞ্জের চুলের মুঠি টে’নে ধরলো সাঞ্জের। কান্নায় চিৎকার করে উঠলে কাকলি, তাথই ছাড়িয়ে নিতে ছুটে গেল। কিন্তু তবুও কাকলির হাত আলগা করতে পারলো না। তাথই কে সরিয়ে দিয়ে বললেন,

– খবরদার আমার রাস্তায় কেও আসবি না। ওর মুখ কি করে খুলতে হয় আমার জানা আছে।

বলে দরজা পর্যন্ত গেলেও আর এগোতে পারলো না। সামনের দিকে তাকিয়ে খানিকটা দমে গেলেও প্রকাশ না করে চড়া গলাতেই বললেন,

– সরে যাও মেহরাজ। আমাকে আঁটকাবে না একদম, ও আমার মেয়ে তাই ওর ব্যাপারটা আমাকেই বুঝতে দাও।

মেহরাজ শান্ত চোখে মোহরের দিকে তাকালো। ইশারাবার্তা টুকুর মর্মার্থ বুঝতে পেরে এগিয়ে এলো ত্রস্ত পায়ে। সাঞ্জে কে কাকলির হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একহাতে আগলে নিলে মেয়েটা দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো সজোরে। মোহরকে জড়িয়ে ধরেই ফুঁপিয়ে উঠলো,

– নাম বল সাঞ্জে

ভীষণ শাণিত গলায় বলা কথাটির ধার উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষের কান অব্দি পৌঁছালো। সাঞ্জে ভয়াতুর চোখে তাকালো চিরচেনা দাভাইয়ের অচেনা মুখটাতে। থরথর করে কেঁপে উঠলো সারা শরীর, দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেলেও চোয়াল শক্ত করে নিলো। আধো আধো কণ্ঠে বললেও স্পষ্ট শুনতে পেলো সকলে একটা নাম

– নো.. নোমান ভাই

••••

টেবিল ভর্তি হরেক রকমের পাকোয়ান। হরেক রকমের খাবারের সুমিষ্ট ঘ্রাণে ম-ম করছে পরিবেশ। শ্রীতমা মন্থর পায়ে একটু একটু করে এগিয়ে ভেতরে ঢুকলো উদ্বেলিত চেহারায়। শেষ বাটি টা টেবিলে রাখতে রাখতে শ্রীতমাকে লক্ষ্য করে গা এলিয়ে হেসে বললেন,

– এতো দেরী হলো আসতে! ইস কত বেলা হয়ে গেছে। সারাদিন না খেয়ে আছো নিশ্চয়! শিগগির হাত মুখ ধুয়ে আসো যাও

– আন্টি আপনি এভাবে হুট করে ডেকে পাঠালেন যে!

– সেসব পরে আগে যাও তো মেয়ে, হাত মুখ ধুয়ে এসে বোসো এখানে।

বলে তাড়া দিয়ে শ্রীতমাকে ওয়াশরুমের দিকে পাঠালো। হাত মুখ ধুয়ে এসে বিব্রত মুখেই দাঁড়ালো ডাইনিং এ। অভিমন্যু ওকে রেখেই নিজের ঘরে ঢুকেছে। ওর বাবাকেও দেখতে পাচ্ছে না। হুট করে এভাবে ডেকে কেনো পাঠালেন ইনি!
শ্রীতমার ভাবনার মাঝেই একটা হাত ওর কপালে বুকে ছোট্ট একটা ফুল ছুঁইয়ে দিয়ে একটা সন্দেশ তুলে দিলো ওর হাতে। শ্রী সসম্মানে সন্দেশ-টা কপাল অব্দি তুলে মুখে পুরে নিলে মাধুর্য ব্যানার্জি বসতে বসতে বললেন,

– আজকে পূজো দিয়েছিলাম তোমার আর আমার অভিটার নামে। ঠাকুরের কাছে কত চেয়ে চেয়ে তোমাদের জুটি মিলেকে কি না! এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে আমার বাড়ির লক্ষ্মী করে আনতে পারলেই আমি খুশি!

শ্রীতমা ফ্যাকাসে মুখে বসলো চেয়ার টেনে। ততক্ষণে বাইরে থেকে অভিমন্যুর বাবা অজয় ব্যানার্জি ও ফিরলেন। সকলে মিলে একসাথে বসলো টেবিলে। ইলিশ, ভেটকি মাছের পাতুরি, রুই মাছের মাথা, মুরগীর কোরমা,পোলাও, চিংড়ি, রাবড়ি সব দিয়ে বড়সড় টেবলটা একবারে পরিপূর্ণ করে ফেলেছে। অভিমন্যুর বাবা শ্রীতমার পাশের চেয়ারে বসে ওর থালে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন,

– তোমার জন্য মধু সকাল থেকে অস্থির হয়ে আছে কী রান্না করবে, তুমি কী খেতে পছন্দ করো! এই অপদার্থ টাকে জিগ্যেস করলো অথচ গাধাটা কিছুই বলতে পারলো না। তাই নিজের মনমতোই এসব রেঁধেছে। কী বলছে জানো?

শ্রীতমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে, ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখেই বললেন,

– বলেছে মেয়েটা হোস্টেলের পানসে খাবার খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। না জানি ঠিক ভাবে খাই কী না। এভাবে চলে নাকি! তাই যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে এ বাড়িতে আনতে চাই, এখান থেকে তো তোমার হসপিটাল টাও কাছে হয়।

শ্রীতমার গলা দিয়ে খাবারের লোকমাটা আর নামলো না। মাঝপথেই আঁটকে গেলো। কেমন ছলছল চোখে তাকালো ওর দুইপাশে বসে থাকা দুটো মানুষের দিকে। অভিমন্যুর সাথে চোখাচোখি হতেই ও চোখ ফিরিয়ে নিয়ে খাওয়াই মনোযোগ দিলো। শ্রীতমার মনে হলো, এই মুহুর্তে ওর চেয়ে নিষ্ঠুর, মিথ্যুক, অপরাধী হয়তো কেও নাহ,কেও নাহ! ও কি না এমন দুজন মানুষকে মিথ্যের জালে ঠকাচ্ছে! যারা কিনা এতটা অমায়িক, নিঃস্বার্থ ভাবে ওকে ভালোবাসছে! এতটা আদর, মমতা তো জন্মের পর কখনও পাইনি। শ্রীতমার একবার মনে হলো এই মিথ্যে টা চলতেই থাকুক, মিথ্যে সম্পর্কের নাম করে যদি এই ভালোবাসা টুকু পাওয়ার সৌভাগ্য হয় তবে তাই হোক না! আবার পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে পাপ করছে ও, মিথ্যে নাটকের মহাপাপ!

– তুমি চুপ করো তোহ! খেতে দাও মেয়েটাকে

বলে একটা ইলিশের টুকরো তুলে দিলো শ্রীতমার পাতে। শ্রীতমার ঠাঁই বসে থাকা দেখে মাধুর্য ব্যানার্জি বললেন,

– খাচ্ছো না কেন? খাবার পছন্দ হয়নি?

– না না আন্টি। খুব ভালো হয়েছে, আসলে আমার ক্ষিধে লাগেনি খুব একটা, তাই।

– লাগেনি বললেই হয়! হসপিটালে তো সেই সকালেই আসতে হয়। সারাটা দিন এভাবে থেকেও বলছো ক্ষিধে নেই? সবটা শেষ করতে হবে কিন্তু।

শ্রীতমার শুকনো হেসে ভাতের লোকমা মুখে পুড়লে অভিমন্যু খেতে খেতে বলল,

– না খেতে পারলে কি জোর করে খাওয়াবে নাকি তোমরা। কি যে হচ্ছ দিন দিন ভগবান জানে

– চুপ কর! নিজেকে দেখ। হাতির মতো শরীর নিয়ে ঘুরিস অথচ বউমা এমন পাতলা হলে লোকে বলবে খেতে দেইনা আমরা।

অভিমন্যু খাওয়া থামিয়ে চোখ কুঁচকে বলল,

– লোকের তো কাজ নেই নিজের খেয়ে তোমার বাড়ির লোকের আলোচনা করবে। আর আমাকে হাতি বলছো? তার মানে আমি বেশি খাই তাই তো!

অভিমন্যু বাবার কথার পৃষ্ঠে ক্ষুব্ধ হয়ে উত্তর দিলে মিসেস মাধুর্য বিরক্তির সুরে বললেন,

– আহ্! কি শুরু করেছ দুজনে! সবসময়ই তোমাদের ঝগড়া করতে হয়!

– তোমার হাসব্যান্ড যে আমাকে খাওয়ার খোটা দিচ্ছে সেবেলায় কিছু না? শোনো আমি ইনকাম করি।

– এ্যাহ্ এসেছেন আমার ইনকাম ধারী। তোকে যে ছোট বেলায় হাজার হাজার টাকা খরচ করে ডাইপার পড়িয়েছি সেসবের বিল শোধ কর আগে।

বাবার এসব লাগামহীনা অপমানে হার হামেশা অভ্যস্ত থাকলেও শ্রীতমার সামনে এহেন কথা শুনে লজ্জা, অপমানবোধে কুণ্ঠিত হলো। শ্রীতমা এতক্ষণ খাওয়াতে মনোযোগ দিলেও অজয় ব্যানার্জির এরূপ কথা শুনে ফিক্ করে হেসে দিলো। অভিমন্যু থমথমে মুখ করে একবার শ্রীতমার দিকে একবার নিজের বাবার দিকে তাকাচ্ছে, ভাবসাব ভালো না দেখে মিসেস মাধুর্য পরিস্থিতি সামাল দিতে বললেন,

– কিসব যাতা বলছ! এখনো কি তোমার ইয়ার্কি করার সময়! খেতে দাও তো আমার ছেলেটাকে। একদম চুপ করে থাকবে।

বলে অভিমন্যুকে বললেন,

– তোর বাবার কথা শুনিস না তো। তুই খা বাবা

অভি মায়ের এরূপ সমর্থনে মনে মনে বেশ তুষ্ট হলেও মুখটা ভার করেই খেতে থাকলো। অথচ ওর বাবা মা দুজনই গাল টিপে হাসছেন নিঃশব্দে। শ্রীতমা আড়চোখে তাকালো ওদের দিকে। এক মুহুর্তের জন্য ওকে একটা লোভ ঘিরে ধরলো। একটু ভালোবাসা, স্নেহ আর পরিবারের লোভ। যেটা ভোগ করার জন্য আজীবন তৃষ্ণার্ত ওর ভেতরটা। এমন হাসিখুশি ভালোবাসাময় পরিবার টা তো ওর সাধের! স্বপ্নের!

.

খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে গল্পগুজব করে বেরোতে বেরোতে প্রায় সন্ধ্যা পার হয়ে গেলো। বাবা মায়ের আদেশে অভিমন্যু শ্রীতমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ওর সাথেই বাড়ির বাইরে আসলো।

– কি হয়েছে?

শ্রীতমা মুখটা ভীষণ ভার করে রেখেছে। যেন কালো মেঘের ছায়ার গুমরে আছে মুখটা। অভিমন্যু খেয়াল করলো এতক্ষণ ঠিকই তো ছিল! হেসে হেসে গল্প করলো। হুট করেই কি এমন হলো?

– কি হলো? মুখটা এমন পেঁচার মতন করে আছেন কেনো!

– আপনি কি মানুষ? হ্যাঁ? আপনার বিবেক বোধ কিচ্ছু নেই? কিভাবে পারছেন এমন সহজ সরল দুটো মানুষকে ঠকাতে? শুধুমাত্র ইয়ার্কি,ফাজলামোর ছলে যেই মিথ্যেটা আপনি বানিয়েছেন তার রেশটুকু কতদূরে এসে পৌঁছেছে ভাবতে পারছেন? তারা এখন রীতিমতো আমাদের বিয়ের প্ল্যানিং করছেন? এতে তাদের তো দোষ নেই, দোষ তো আমাদের। শুধু শুধু মিথ্যে নাটক করছি আমরা। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন আমার দ্বারা আর এসব ছলচাতুরী করা সম্ভব না। আপনি আজই আপনার বাবা-মাকে বলে দিবেন যে আদতে আপনার আমার কোনো সম্পর্কই নেই। এগুলো সব মিথ্যে ছিল। সব মিথ্যে!

বলে গটগট করে হেঁটে বাড়ির ফটক পেরিয়ে বের হয়ে গেলো। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু পড়লো শ্রীতমার। গল্প শেষে যখন বিদায় নিয়ে বের হচ্ছিলো তখন মাধুর্য ব্যানার্জি তার হাত থেকে একটা সোনার বালা খুলে দিয়ে শ্রীতমার হাতে পরিয়ে দিয়েছে, শ্রীতমা নিতে না করলে উনি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

– ফিরিয়ে কেন দিচ্ছ! আমিতো তোমারই মা। আর যা মায়ের তাইতো মেয়ের। একটা তোমার কাছে থাক একটা আমার কাছে, এটা হলো ভালোবাসার ভাগাভাগি। যখন তুমি এ বাড়িতে চলে আসবে তখন এটাও দিয়ে দেব।

বলে শ্রীতমার কপালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে ভালোবেসে দিলেন যখন তীব্র অপরাধবোধে পায়ের তলার জমিনটা যেন কেঁপে উঠলো। এতো বড়ো ঋণের ভার ও কি করে নেবে! এমন নিষ্পাপ মনের মানুষকে ঠকানোর দায়ে কি ওকে ভগবান কক্ষনো ক্ষমা করবেন! আবারও চোখ ছাপিয়ে এলো জলে। হাতের উলটো পিঠে মুছে আরও জোরে হাঁটা শুরু করলো শ্রীতমা।হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল হলো যার জন্য এতকিছু বলে এলো অথচ বালা টাই খুলে ফিরিয়ে দেয়নি ও হাত থেকে। কান্নার দাপটে, আর ফিরেও তাকালো না ওভাবেই চলতে থাকলো পথ ধরে। পেছনে তাকাতে ভয় হচ্ছে, ওই বাড়িটাতে ও এক বুক মায়া আর ভালোবাসা ফেলে এসেছে। আর কিছু না হোক ভালোবাসার লোভটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে যদি ফিরতে ইচ্ছে না হয়! তাই আর ফিরলো না শ্রীতমা, কখনো রাস্তায় দেখা হলে ফিরিয়ে দেবে অভিমন্যুকে।

•••

বিকট শব্দ তুলে গাড়িটা ব্রেক করতে যতটুকু দেরী। ধড়াম করে দরজাটা খুলেই বেরিয়ে এলো। পেছন থেকে বেরিয়ে এলো আরও দুটো মানুষ। ক্রুদ্ধ চোখের ভয়ংকর হিংস্রতায় গর্জে উঠে কলার চেপে ধরলো মেহরাজ। সিংহের থাবার ন্যায় ঝাপটে টেনে হিচড়ে আনলো বাড়ির ভেতরে। সদর দরজাটা পার করেই এক ধাক্কার ছিটকে ফেলে দিলো পুরুষালী শরীর টা। প্রচণ্ড বেগে কাঁচের সেন্টার টেবিলের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লে কাঁচ ভেঙে চুরমার হয়ে বিকট একটা শব্দ তুললো সারা বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে। আর তার চেয়েও বিকট গর্জন তুললো ক্ষুব্ধ গলাটা. . .

– জা’নোয়ারের বাচ্চা! তোর সাহস টা কতো বড়ো! কতো বড়ো কলিজা নিয়ে তুই হাত দিয়েছিস আমার পরিবারে! তোর কলিজা টে’নে ছিড়ে শেয়ালের পাল দিয়ে খাওয়াবো আমি!

পরপর দুটো বিকট গর্জনের শব্দ কানে যেতেই উপরের ঘর থেকে হুড়মুড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সকলে। আজহার মুর্তজার ঘরটা নিচতলাতে, আর সেখানেই উপস্থিত ছিলেন দুই ভাই। তাই সকলের আগে পৌঁছালেন তারাই। আতংকে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো দুজনেরই। মোহর, তাথই, আম্বি নিচে নেমে এলো অতি দ্রুত পায়ে। নাজমা তাথইয়ের মেয়েকে কোলে নিয়ে উপর থেকেই চুপিসারে দাঁড়িয়ে থেকছে লোমহর্ষক তাণ্ডবের দৃশ্য —

কাঁচে বিঁধে ক্ষত হওয়া শরীর থেকে রক্ত ঝরে ফ্লোরে ছোপছোপ দাগ বসে গেলেও সেদিনে তাকালো না পাষাণরূপী পুরুষ টা। কলার চে’পে তুলে পরপর চারবার ঘু’ষি বসিয়ে দিলো নাক বরাবর। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো নোমানের নাক, মুখ দিয়ে। আম্বি খাতুন ছুটে এসে মেহরাজকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে বলল,

– মেহরাজ বাবা ওকে ছেড়ে দে। ইয়া আল্লাহ্ ও মরে যাবে রে…ছেড়ে দে ওকে বাবা দোহাই তোর

মেহরাজ ফোসফাস নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘাড় কাত করে তাকালে পৃথক আম্বি খাতুনকে দুহাতে ধরে সরিয়ে আনলো। মেহরাজ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো নোমানের রক্তাক্ত মুখের দিকে। কি দূর্বিষহ সে দৃশ্য! তবে তাতে গললো একচুল পাথর মনটা। শিকারীর মতো খা’বলে ধরলো অপরাধীর শরীর টা, বাঁ হাতটা তুলে চরম শব্দ করে একটা চড় পড়লো কানের উপর। ভোঁ ভোঁ করে উঠল কানটা নোমানের, বিধ্বস্ত শরীরটাকে সামাল দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই ভারিক্কি হাতের পরপর তিনটা ঘুষি চোয়ালে পরতেই গলগলিয়ে রক্ত বেরুলো মুখি দিয়ে। মোহর দুচোখ সজোরে খিঁচিয়ে নিলো। চোয়ালের দাঁতগুলো আদও আস্তো আছে কি না এতে বড়সড় সন্দেহ হলো ওর। রাগে ক্ষোভে মেহরাজের হুংকার গুলো কায়ে কাটা লাগিয়ে দিচ্ছে মোহরের, প্রথম কয়েকটা মুহুর্ত তো ও পাথরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো, এই দৃশ্যটা হজম করতে অনেক বেশি বেগ পেতে হলো। নির্মম দৃশ্যে টলমল চোখে তাকিয়ে মোহরের মনে হলো. . . কে এটা! এটা কি সেই মেহরাজ যে কি না পারলে মোহরের পায়ের তালুতে হাত রেখে দেয় যাতে একচুল ব্যথা না হয়, যে কি না দুহাতের বাহুডোরে এক পৃথিবী ভালোবাসা পুষে রাখে। এটাই কি মোহরের প্রেমিক স্বামী যে কি না ক্ষণে ক্ষণে লজ্জা, ভালোবাসার আদরে উদ্বেলিত করে প্রাণভোমরা! নাহহ্ ‚ কিছুতেই নাহ। মোহরের মেহরাজের সাথে এই চেহারার মিল খুঁজে পেলো না ও। শুধু মনে হলো ঠিক এই চেহারাটার জন্যেই হয়তো মা ওর নাম রেখেছিল রুদ্ধ!

লোমহর্ষক মুহুর্তেও অদ্ভুত খেয়ালে গুম হওয়া মোহরের শরীর টা কেঁপে উঠলো জোরসে এক ধাক্কায়। সম্বিত ফিরে পেতেই দেখতে পেলো ওর হাত দুটো ঝাপটে ধরে সাঞ্জে হাউমাউ করে কেঁদে বলছে,

– ভাবী! ভাবী দাভাই কে থামাও। দাভাই ওকে মে’রেই ফেলবে ভাবী তুমি ওকে থামাও।

মোহর থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু পারলো না তাথই। এ দৃশ্য চোখে দেখার মতো না। ঝকঝকে, ফকফকে টাইলস রক্তের কুচকুচে দাগে ভরে গেছে। অস্থির, ব্যতিব্যস্ত হয়ে মেহরাজের দিকে এগোতে নিলেও আঁটকা পড়লো শক্ত হাতের শেকলে।

– ওকে আঁটকাতে যাওয়ার ভুলটা কোরো না আশু। যা হচ্ছে হতে দাও, বহুদিন পর বাগে পেয়েছি। পাপের সাত কলস পূর্ণ হয়েছে শালা স্ক্রাউ’ন্ডেলের।

তাথই হতবুদ্ধিকর চোখে তাকালো পৃথকের দিকে। চেনা জানা মানুষ গুলোর এ কোন রূপ দেখছে! এটা কি আদও বাস্তব নাকি দুঃস্বপ্ন? বহুদিন পর মানে কি! নোমানকে ওরা আগে থেকে খুঁজছিল? কিন্তু কেনো? একটা রাতের ব্যবধানে এ কোন ভয়ংকর রূপ নিল আব্রাহাম ম্যানসন!

– কু’ত্তার বাচ্চা কি মনে করেছিলি? কি ভেবেছিলি পার পেয়ে যাবি! তোকে এভাবে ছেড়ে দেবো আমি? কার শরীরে হাত দিয়েছিলি বল? এই হাত! এই হাতে ছুঁয়েছিলি?

বলে জুতার তলে সজোরে পা’রিয়ে ধরলো হাতটা। যেন শরীরের সমস্ত রাগ ওই হাতটার উপরে ঢেলে দিলো। বিভৎস চিৎকারে কেঁপে উঠলো উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষ। সাঞ্জেকে জড়িয়ে ধরে চোখ খিচিয়ে নিলো মোহর। এই নৃশংস মা’রগুলো চোখে দেখার মতো না!
সবচেয়ে বেশি হতবাক, বিহ্বলিত, বিস্মিত হয়ে আছেন কাকলি বেগম। একচুল শব্দ টাও যেনো। করতে পারছেন না।
তবে এতক্ষণ নির্বাক জনতার মতো দাঁড়িয়ে থাকলেও পরিস্থিতি হাতের বাইরে যেতে দেখে তৎপর হয়ে উঠলেন দুজন। আজহার মুর্তজা ছুটে গিয়ে মেহরাজের বাহু চেপে ধরে সরিয়ে আনলেন, অস্থির গলায় বললেন,

– মেহরাজ কি করছো? ও ম’রে গেলে অ্যালিগেশন তোমার উপরেই আসবে। আগে শান্ত হও, শুধু সাঞ্জের মুখ থেকে একটা কথা শুনেই এমন আচরণ কেনো করছো? নোমান কেও বলতে দাও, ও তো তোমার ভাই হয়!

– শাট আপ্! এই কু’লাঙ্গার টাকে আমার ভাই বলার মতো সাহস ভুলেও করবেন নাহ। আমার কোনো ভাই নেই। আমার আম্মার একমাত্র সন্তান আমি, আমি আব্রাহাম রুদ্ধ! বুঝতে পেরেছেন?

কম্পিত পায়ে দু কদম পিছিয়ে গেলেন আজহার মুর্তজা। আম্বিত চোখ মুখে তীব্র আতংকের ছাপ। আরহাম বড়সড় ঢোক গিলে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো নিস্তের পরে থাকা লা’শ সমতূল্য দেহটার দিকে। ফিসফিস করে নিঃশ্বাস এখনো পড়ছে৷ যাক! এখনো মরে’নি বলে শান্ত করলো নিজেকে। কিন্তু ভেতর ভেতর রাগ, আক্রোশে ফেটে পড়লেন। শেষে কি না তার মেয়েকে! এতো বড়ো সর্বনাশ করেছে!
সাঞ্জে এক ধাক্কায় মোহরকে সরিয়ে দিলো, ছুটে গিয়ে আঁটকে নিলো সামনে এগোতে যাওয়া মেহরাজের পা। মেহরাজ পা ছিটকে সরিয়ে নিতে গেলেও নিচে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো।

– দাভাই, ও দাভাই তুমি ওকে ছেড়ে দাও দাভাই। আমি তোমার পায়ে পরি, ওকে ছেড়ে দাও। ওর কোনো দোষ নেই, ও জোর করে আমার কোনো ক্ষতি করেনি। আমি, দোষটা আমার।আমি নিজেই উনার কাছে গেছি।আমি ভালোবাসি নোমান ভাইয়া। তুমি ওকে আর মে’রোনা দাভাই। তার বদলে তুমি আমাকে মা’রো। আমাকে মে’রেই ফেলো তবুও ওকে ছেড়ে দাও। আমি আর জীবনে কিচ্ছু চাইবো না তুমি এইটুকু দয়া রহম করো দাভাই।

বলে ডুকরে উঠলো, ছোট্ট বোনটার চোখের পানিতে ভিজে গেলো মেহরাজের পা, পায়ের নিচের জমিন।বুকটা কেঁপে উঠলো প্রকাণ্ড ভাবে। সাঞ্জের মুখের এক একটা বুলি, ওর চোখ থেকে গড়ানো এক একটা পানি ওর বুকটা ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। তবুও হাত বাড়িয়ে সাঞ্জেকে তুললো না, তার আগেই পেছন থেকে মোহর এগিয়ে এসে টেনে তুললো সাঞ্জে কে। খুব শান্ত চোখ মুখের অভিব্যক্তি। সাঞ্জের মুখটা দু’হাতে ধরে চোখের পানি মুছিয়ে দিলো। ওকে এগিয়ে নিয়ে দাঁড় করালো একদম নোমানের সামনা-সামনি, ফ্লোরে পড়ে থাকা অসাড় দেহটার দিকে আঙুল তুলে বলল,

– এই যে যাকে বাঁচানোর জন্য নিজের ভাইয়ের পায়ে পড়ছো, যাকে ভালোবাসো বলে কেঁদে উজাড় করছো আদও সে কি, তার চরিত্র ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে তোমার?

সাঞ্জের কান্না এক মুহুর্তের জন্য থেমে গেলো। তার সাথে থমকে গেলো উৎসুক মানুষ গুলোর চাহনি। মোহর জলদগম্ভীর স্বরে বলল,

– এই যে যাকে দেখছোনা? ও হলো ভালো মানুষির মুখোশ পরে থাকা একটা জলজ্যান্ত কু’লাঙ্গার, একটা নি’কৃষ্ট প’শুর চেয়েও অধম।
যে কি না নিজের বড়ো ভাইয়ের বউয়ের গায়ে ওর লোলুপ হাত, স্পর্শ করতে একবার ভাবে না। ভাববে কি ও তো মেয়েদের শুধু নিজের ভোগের বস্তুই মনে করে

খুব শান্তভাবে বলা মোহরের কথাগুলো উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষের ভেতর বিস্ময়ের বাজ ফেললো। মোহর নির্দ্বিধায় আবারও বলতে শুরু করলো,

– এ বাড়িতে আসার পর থেকেই ওর বিশ্রী নজর টা আমার উপর ছিলো। সামনা-সামনি আমার সাথে ভালো সম্পর্কের অভিনয় করে রাতের বেলায় ওই চোরের মতো আমার ঘরে এসে আমার শরীরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করতো। এমনকি সেদিন আমাকে লোক ভাড়া করে তু’লে নিয়ে যাওয়ার মূখ্য ভূমিকাতে ওই ছিলো। মুখোশ পরে, যান্ত্রিক কৃত্তিমতা দিয়ে ও আমার চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। আমার দেওয়া নখের খা’মচির দাগ ওর চোখ মুখ থেকে এখনো সরেনি, দেখো!

সাঞ্জে অশ্রুবিদ্ধ চোখে তাকালো নোমানের দিকে। গলা কা’টা মুরগীর ন্যায় ছটফট করেই পরে আছে ফ্লোরে। ওর দিকে তাকি আবার মোহরের দিকে তাকিয়ে বলল,

– মিথ্যা বলছো, মিথ্যা বলছো তোমরা! নোমান মোটেও এমন না। আমি ওকে ভালোবাসি, আর ওউ শুধু আমাকেই ভালোবাসবে বুঝতে পেরেছো। নোমান শুধু আমাকেই ভালোবাসে।

বলে থপ করে নিচে বসে পড়লো। কান্না করতে করতে বলল,

– তোমরা আমাকে আর কষ্ট দিও না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, খুব।

বলতে বলতেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। তাথই দৌড়ে এসে সাঞ্জের মাথাটা তুলে কোলের উপর নিলো। ক্রমাগত গালে চাপ’ড়েও হুঁশ ফিরলো না। পৃথক তাথই এর কোল থেকে সাঞ্জের মাথাটা তুলে নিয়ে কোলে তুলে সিড়ির দিকে যেতে যেতে বলল,

– আশু আমার সাথে আসো।

তাথই ছুটে গেলে শাহারা বেগম ও খোরাতে খোরাতে উঠল সিড়ি বেয়ে। মেহরাজ তীক্ষ্ণ চোখে এখনো তাকিয়ে নোমানের দিকে, তবে আবারও কিছু করার আগেই মোহর এগিয়ে এলো। মন্থর গলাতে বলল,

– ওকে আর মারবেন না রুদ্ধ। অনেক হিসাব বাকি আছে আমার ওর সাথে, অনেক। আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ওকে আমি ম’রতেও দেবো না।

.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে