#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪৯
#হুমাইরা_হাসান
– তোমার ওর সাথে এমন আচরণ করা উচিত নয় তিয়াসা। ভুল যে করেছে তাকে শাস্তি দাও, খামোখা ওর ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছো কেনো?
নিরুত্তর চেহারা’টা ঘুরিয়ে তাকালো জানালার দিকে। রুক্ষ চোখ মুখটা মলিনতাহীন। ক্ষোভ, হিংসার প্রলেপে ক্রুদ্ধ হয়ে আছে চোখের চাহনি আর মুখাবয়ব। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
– ভুল তো ওই করেছে, সব ভুল ওর। আমার সবচেয়ে পছন্দের জিনিসটাকে ও নিজের করে নিয়েছে, ভুল করেনি বলছো? উঠেপড়ে পেছনে এতদিন তো লাগতে যাই’ই নি। তবে এখন লাগবো। ওর ধ্বংস না ডাকা পর্যন্ত আমি থামবো না।
– তিয়াসা! ভুল করছো তুমি। মোহর পরিস্থিতির শিকার। এসবে ওর কোনো ভূমিকা নেই। মেহরাজ নিজ ইচ্ছেতে ওকে বিয়ে করেছে, আর ও তো চাইলেই ডিভোর্স দিতে পারতোই কিন্তু তা তো করেনি। নিজে পুরো পরিবারের অমতে গিয়ে মোহরকে নিজের করে রেখেছে তাহলে দোষটা কার?
– মেহরাজ যে মোহরকে নিজের কাছে রাখার জন্য যা সব সম্ভব সবই করবে, আর এটা তো জানা কথা। শুধুমাত্র মোহরকে নিজের কাছে রাখার জন্যেই তো ও এতগুলো দিন অপেক্ষা করেছে সুবর্ণ সুযোগের।
ফায়াজের মুখ জুড়ে বিরাজমান উৎকণ্ঠা,দ্বিধা,দুশ্চিন্তা এক পলকে ছোটখাটো বিস্ফোরণ স্বরূপে পরিনত হলো। বিশদ হতবিহ্বলতা আর কৌতূহলে জর্জরিত মুখখানা দেখে তিয়াসা ক্রুর হাসলো। হাসির সুরেই বলল,
– কী অবাক হচ্ছো? জানো নাহ! মোহর পরিস্থিতির নয়, মেহরাজের শিকার।
বলে ফায়াজের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যেতে নিলে ফায়াজ দ্রুতপদে এগিয়ে ওর বাহু চেপে ধরলো। তিয়াসাকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলল,
– কী বললে তুমি? আবার বলো! মেহরাজ,মোহরকে আগে থেকেই জানে? সবটা আগেই থেকেই…
– মেহরাজ তোমার নাকের ডগা থেকে তোমারই জিনিস ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেছে। ভীষণ নীরবে, ভীষণ চৌকশে অথচ তুমি ছিটেফোঁটা টুকুও আঁচ করতে পারো নি।
– কিন্তু তিয়াসা মোহর তো..
– ভুল করেছো ভাইয়া। তুমি যাকে ভালোবাসো সে যে মোহর’ই এটা আমাকে আগে জানানো উচিত ছিল। সেদিন ওকে তোমার কেবিনে না দেখলে তো আমি এইটুকুও জানতে পারতাম না।
ফায়াজ ফোসফাস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো ঘনঘন। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে আবারও অস্থির গলায় বলল,
– তিয়াসা তুমি মোহরকে কবে থেকে চেনো? আর মেহরাজ! ও কবে দেখেছিলো মোহরকে? কীভাবে ও..
তিয়াসা কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে দিলো না। হাতের তালু উঁচিয়ে ওকে থামিয়ে দিলো। ফায়াজের সমস্ত উৎকণ্ঠা, কৌতূহলে বড়সড় একটা দাড়িচিহ্ন বসিয়ে দিয়ে সোজাসাপটা বলল,
– যা হয়ে গেছে তা হয়েই গেছে। এখন তো ওসব জেনে কাজ নেই। তার চেয়ে বরং আমরা একটা চুক্তিতে আসি। তোমারও লাভ,আমারও
ফায়াজের ঘামে ভেজা কপালটাতে পুরু ভাঁজ পড়লো। তিয়াসার শাণিত মুখ আর গলা অন্যকিছুরই আভাস দিচ্ছে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। তিয়াসা কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই বলল,
– স্ট্রেইট কাট বলছি। চুক্তি মানে ডিল। তুমি আমাকে আমার জিনিস দেবে আর আমি তোমাকে তোমারটা। মানে মেহরাজ আমার আর মোহর তোমার।
– মানে? কিন্তু কীভাবে!
– কীভাবে সেটা সামনে যানতে পারবে। তবে তোমাকে আগে চুক্তিতে রাজি হতে হবে। পরে পিছপা হতে পারবে না। আমি যা বলবো তাই করতে হবে বিনিময়ে মোহর তোমার
ফায়াজ অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো, হাতের উল্টো পাশে কপাল মুছে খানিক নিশ্চুপ হয়ে অতঃপর বলল,
– তুমি যা বলছো তার সম্ভব করতে হলে বাঁকা রাস্তা ধরতে হবে। স্পষ্ট ভাষায় যেটা অপরাধ।
– অপরাধ! কীসের অপরাধ ভাইয়া? আর আমাদের সাথে যেটা হলো সেটা অপরাধ না? আমি যে এতগুলো দিন একটা মানুষের জন্য মরিয়া হয়ে আছি সে আমাকে নিষ্ঠুর ভাবে অপমান অগ্রাহ্য করে অন্য একজনকে নিজের করে নিলো এটা অন্যায় না? আর তুমি যাকে পাওয়ার জন্য এতগুলো সময় ধরে অপেক্ষা করছো ভালোবাসছো তাকে কেও হুট করে নিজের করে নিবে এটা অপরাধ না? বলো ভাইয়া তাহলে আমরা করলে কেনো অপরাধ হবে?
ফায়াজ তাকালো না তিয়াসার দিকে। চঞ্চল চোখ দুটি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বলল
– আমি এমন কোনো কাজ করতে চাইনা যাতে আমি মোহরের চোখে ছোট হয়ে যাবো। এসব আমি চাইনা, দরকার নেই কিছুর।
– সত্যি! সত্যিই দরকার নেই? মিথ্যে বোলোনা ভাইয়া। তুমি যে মোহরের জন্য ভেতরে ভেতরেই জ্বলে ছাঁই হচ্ছো এটা দেখলেই বোঝা যায়। থাক তুমি যখন রাজি হবে না তবে যা করার আমিই করবো
– কি করবে তুমি?
– যা করার তাই করবো। আর হ্যাঁ আমাকে আঁটকে লাভ নেই কেননা আমার হাতে হোক আর অন্যহাতে মোহরের ক্ষতি হবেই। ও যে এতদিন ভালো আছে এটাই অনেক।
– মোটেও না! মোহরের কোনো রকম ক্ষতি করবে না তুমি , নাইবা অন্য কেও। ওর কী দোষ ওকে কেনো মা’রবে তোমরা? ওর গায়ে একটা টোকাও পড়বে না, বুঝেছো?
তিয়াসার দুই বাহু চেপে ধরে উচ্চস্বরে বলল ফায়াজ। রাগ্র টলমল চোখটা জুড়ে আছে মোহরের জন্য উৎকণ্ঠা, ভালোবাসা। আর এটারই সুযোগ নিলো তিয়াসা। খুব সন্তপর্ণে ফায়াজের হাত দুটো ধরে বলল,
– ইতিহাস তোমার জানা নেই ভাইয়া। ওর থেকে যত দূরে থাকবে ততই ভালো। তবে একটা কথা আমি বলতে পারি মোহরকে যদি বাঁচাতে চাও তবে আমার কথায় রাজি হও। কারণ আমার কথা শুনলে শেষমেশ আর যাই হোক ও তোমার হবে, আর তা না হলে ও শেষ
কথাটা শেষ হবার সাথে সাথে খট করে একটা শব্দ হলো। দরজাটা ধাক্কে খুলে দাঁড়িয়ে আছে ভদ্রমহিলা। তার চোখদুটো স্থির হলো ফায়াজ আর তিয়াসার দিকে। দুজনের মধ্যবর্তী ব্যবধান কিঞ্চিৎ, দুটো হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তিয়াসার মায়ের দৃষ্টি লক্ষ্য করে ফায়াজ ছিটকে সরে গেলো৷ অপ্রস্তুত হয়ে এগিয়ে এসে বলল,
– আমি আজ আসছি মামী।
বের হতে গেলে ওকে থামিয়ে দিলো ভদ্রমহিলা। স্মিত হেসে বলল,
– সে কি যাবে কেনো? আমি খাবার বেরেছি তোমাদের জন্য,দুজন একসাথে লাঞ্চ করে নাও।
– আজ থাক মামী। আমি আরেকদিন আসবো।
– আসবো তো বলো, আসো আর না। আজ কত মাস পরে এসেছো হিসেব আছে? একই শহরে থাকো অথচ বছরে দুবার তোমার পদধূলি এ বাড়িতে পরে কি না সন্দেহ। তোমার বাবা মা ভাববে আমরা তার ছেলের খোঁজ খবর’ই রাখিনা।
– তেমন কিছু না মামী। ব্যস্ত থাকি মা বাবা জানে। আজ যেতে হবে, ইমারজেন্সিতে একটা পেশেন্ট রেখে এসেছি।
বলে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলো। ফায়াজের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল মহিলা যতদূর দেখা যায়। অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে তিয়াসার দিকে তাকালো, ভ্রু কুঞ্চন করে বলল,
– খাবার রাখা আছে, খেয়ে নাও
বলেই বেরিয়ে যেতে চাইলো। তিয়াসা এগিয়ে এসে মায়ের হাত ধরে বলল,
– মম, তুমি আমার সাথে ঠিকঠাক কথা বলোনা কেনো? আমি যে অসুস্থ তবুও তো খোঁজ নিতে আসো না!
– যে মেয়ে অন্য কারো ক্ষতির চিন্তাভাবনা করে সে মেয়ের খোঁজ খবর রাখার প্রয়োজন আমি মনে করিনা।
বলে ভার মুখটা নিয়ে চলে গেলো নিজের ঘরে। তিয়াসা অসহায়ের মতো তাকিয়ে রয়, ওর মা ইদানীং একদম কথা বলতে চাইনা ওর সাথে। প্রথম প্রথম তিয়াসাকে খুব করে বুঝিয়েছে অন্যের ক্ষতি না করতে৷ কিসমতে যা পেয়েছে তাই মেনে নিতে। মোহরকে কিডন্যাপিং করানোর কথাটা যেদিন থেকে জানতে পেরেছে সেদিন থেকেই ওর সাথে আর কথা বলেনা। এমনকি ওর যে হাতটার চামড়া পুড়ে গেছে তবুও মা হয়ে একটু খোঁজ নিতে আসেনা। এবাড়িটা যেনো দুভাগে বিভক্ত। তিয়াসা আর ওর বাবা একদিকে আর ওর মা একাই একদিকে।
•••
রান্নাঘর থেকে শব্দ ভেসে আসছে, বাড়িতে ঢুকেই হাতের ব্যাগ আর গায়ের অ্যাপ্রোনটা খুলে সোফাতেই রেখে দিলো। ছোট ছোট কদম ফেলে এগিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। দরজার সম্মুখেই পা দুটো থমকে গেলো। অপলক তাকিয়ে রইলো সামনে. . . মাঝামাঝি উচ্চতার উজ্জ্বল শ্যামলা শরীর। পরনে হালকা নীল রঙের সুতির শাড়ি। এলোমেলো চুলগুলোও ভীষণ গুছিয়ে খোপা করা। আস্তেধীরে একা একাই থাল গুলো ধুয়ে মুছে রাখছে। অথচ বাড়িতে দুটো কাজের লোক থাকা সত্তে এসব তার নিজ হাতে করার কোনো প্রয়োজনই পরেনা!
– মা!
ডাকটা শুনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো নিস্তেজ চেহারাটা। প্রতিবারই ‘ মা ’ ডাকটা শুনে বুকটা অমায়িক শীতলতা জুড়ে যায়। এ যেনো এক মধুর বাণী, যা শোনার জন্য মরিয়া হয়ে থাকে প্রতিটি মা-সত্ত্বা।
– আজকে তাড়াতাড়ি এলে যে?
নিজের কাজে ব্যস্ত থেকেই বলল আম্বি খাতুন। মোহর এগিয়ে এলো দু’কদম। আম্বির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বললেন,
– আমাকে দিন আমি করে দেই
– মাত্র বাইরে থেকে এসেছো। হাত মুখ না ধুয়েই থালাবাসনে হাত দিতে কে বলেছে তোমাকে। যাও, নিজের ঘরে যাও!
মোহর নড়লো না একচুল। খানিক চুপ দাঁড়িয়ে থেকে আবার একই কথা বলে আম্বির হাত থেকে বাসন নিতে গেলে উনি ছিনিয়ে নেয়, হুট করে টান দেওয়াতে হাতের উল্টোপাশে গুতা লেগে চাপা আর্তনাদ করে ওঠে আম্বি খাতুন। মোহর ব্যস্ত গলায় বলে
– কোথায় লেগেছে মা? দেখি!
বলে আম্বি খাতুনের হাতটা ধরতে গেলে উনি খপ করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কর্কশ গলায় বললেন,
– তোমাকে না বলেছি একদম আদিক্ষেতা করবে না আমার সাথে। যাও এখান থেকে
বলে হাতটা চেপে নিলো। মোহরের চোখ দু’টো ভরে এলো, না চাইতেও দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে, সেদিকে লক্ষ্য হতেই ভদ্রমহিলা বললেন,
– সামান্য ধমকেই কেঁদে ভাসাচ্ছো, তাহলে আসো কেনো আমার সামনে। বলেছিনা তোমাকে আমি একদম পছন্দ করিনা, সরে যাও আমার সামনে থেকে। এসব নাটক আমার সহ্য হয়না
মোহর জবান না দিয়ে হুট করেই জড়িয়ে ধরলো আম্বি খাতুনকে। দু’হাতে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। হতবিহ্বলিত চোখে দাঁড়িয়ে রইলেন মহিলা, উনি আদও বুঝতে পারলেন না মোহরের এরূপ আচরণের কারণ!
মোহর কান্নামিশ্রিত গলাতেই বলল
– আপনি আর কতো মিথ্যে নাটক করবেন। কেনো নিজেকে সবার সামনে রুক্ষ,নিষ্ঠুর দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণা সহ্য করছেন মা,কেনো? কেনো আপনাকে সবার সামনে নিজেকে খারাপ দেখিয়ে চার দেওয়ালের মাঝেই অত্যাচারিত হতে হচ্ছে, কেনো?
মোহরের কথা গুলো বাজ পড়ান ন্যায় বাজলো আম্বির কানে। বিস্মিত হয়ে পাথরমূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো নিস্তব্ধ রূপে। বুকে জড়িয়ে থাকা মেয়েটার শরীরটা কান্নার দাপটে কেঁপে কেঁপে উঠছে, আলতো ভাবে হাতটা রাখলেন পিঠের ওপর। অস্ফুটে স্বরে বললেন,
– কীসব বলছো মেয়ে! কি যাতা বলছো। পাগল হয়েছো নাকি, দেখি
বলে মোহরকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। মোহর দু’হাতে চোখ মুছে নিলো। মানুষটা ওর সামনে কী অবলীলায় সবটা এড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ রাতের দৃশ্যটা ওর চোখে এখানো চলমান দৃশ্যের মতো ভাসছে। কাটা লাগিয়ে দিচ্ছে সারা শরীরে, মোহর নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
– আমি যাতা বলছি? তাহলে এসব কী?
বলে আম্বি খাতুনের বাঁ হাতটা টেনে এনে শাড়ির আঁচল সরিয়ে দিলো, পাশাপাশি দুটো লম্বা কালচে দাগটা দেখিয়ে বলল,
– এসব কীসের চিহ্ন মা? আমি যদি আবল তাবলই বলি তবে এগুলো কী?
– এখানে ধাক্কা লেগেছিলো দরজার সাথে। তাই এমন হয়ে গেছে
মোহর ভেজা চোখেই হাসলো, দুর্বোধ্য হাসলো। গালের পাশে হাতটা ছুঁয়ে বলল,
– গালের উপর পাঁচটা আঙুলের ছাপ ও কী ধাক্কা লেগেই হয়েছে মা!
মোহরের গলাতে কী একটা ছিলো! আম্বি খাতুন না চাইতেও ভেতরটা নড়বড়ে হয়ে গেলো। নিজেকে শক্ত রাখার প্রচণ্ড প্রচেষ্টা টুকুও বিফলে যাচ্ছে। চোখ ভরে এলো ওনার। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল
– যা কিছু বলছো, জেনেছো তা যেনো এই রান্নাঘরের দেওয়াল গুলোর মাঝেই আবদ্ধ থাকে। ভালো হয় যদি মাথা থেকেই মুছে ফেলো। আমার জীবন, আমার সংসার। আমাকেই ভাবতে দাও।
শীতল কণ্ঠের গভীরতায় আজ কাঠিন্যের চেয়ে যন্ত্রণাটা একটু বেশিই বুঝতে পারলো মোহর। যে লুকিয়ে রাখতে চাই জোর করে আর কতটুকুই বা জানতে পারা যায়! তাই মোহর সে বিষয়ে আর কিচ্ছু বলল না বরং খানিক দম নিয়ে বলল,
– আমি নাহয় কিছুই জানতে পারবো না। কিন্তু এই কাজটুকু অন্তত আমাকে করতে দিন। আপনার ছেলেবউ হিসেবে নাই হোক। একজন ডাক্তার হিসেবে আমার দ্বায়িত্ব টা অন্তত করি
…
– বড়মা! কি হয়েছে তোমার? ব্যান্ডেজ লাগাচ্ছে কেনো মোহর?
সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল তাথই। আম্বি খাতুন এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,
– কিছুই হয়নি। রান্না করতে গিয়ে একটু লেগেছে। একজন তো নিজেকে খুব জ্ঞানী মনে করে, সুযোগ পেয়ে ডাক্তারগীরি দেখাতে এসেছে। ওকে বল তো এসব ঢঙ যেনো আমার সামনে না করে।
কণ্ঠের সাথে একরাশ বিরক্তি প্রকাশ পেলো৷ তাথই স্মিত হেসে বলল,
– ঠিকই করেছে। তুমি ইদানীং বেশ বেখেয়ালি চলাফেরা করো।
কথার মাঝেই তাথই জিগ্যেস করলো
– আচ্ছা মা বাবা কোথায়? উনাদের তো দেখছিনা?
– তোর বাবা মা একসাথেই বেরিয়েছে। কী একটা কাজ আছে বলল।
মোহর মলম,ওষুধ লাগিয়ে ব্যাগটা হাতে তুলে উপরে চলে এলো। আজকে মন, শরীর কোনো টাই ভালো ঠেকছে না। এই জন্য আগে আগেই লিভ নিয়ে এসেছে হসপিটাল থেকে।
ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, সারাটা রাত ঘুমাতে পারেনি। মস্তিষ্ক জুড়ে কাল রাতের দৃশ্যটাই ঘুরপাক খাচ্ছে, কী এমন ব্যাপার যা এড়িয়ে যাচ্ছে আম্বি খাতুন? কেনোই বা সকলের সামনে নিজেকে খারাপ প্রমাণ করতে চাই? আর আজহার মুর্তজা! মোহরের পুরো ধ্যান ধারণাটাই পালটে গেছে কাল। এ বাড়িতে এসে থেকে আজহার মুর্তজাকে সবচেয়ে বিনয়ী স্বভাবের পেয়েছে, অথচ সেই মানুষটা! হাজারো চিন্তা, দুঃশ্চিন্তা মাথায় ভেতর জুড়ে বসলো। এসব ভাবনায় বুদ হয়ে কখন ঘুমে তলিয়ে গেলো তা নিজেও বুঝতে পারেনি।
___________________
মাথায় আলতো স্পর্শে ঘুম হালকা হয়ে এলো মোহরের। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না, তবে তন্দ্রাচ্ছন্নতা এখনো কাটেনি। চোখ বুজেই পড়ে আছে অনড় শরীরে। তবে ঘুমের ঘোরেও প্রিয়-পরিচিত ঘ্রাণটা নাকে লাগায় বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে কপালে গাঢ় করে চুম্বন এঁকে দিলো মেহরাজ। মোহরের ঘুমন্ত শরীরটার পিঠের নিচে হাত গলিয়ে দিয়ে হালকা টান দিয়ে ওর মাথাটা নিজের বুকের উপর রাখলো। ঘুমের ঘোরের চেয়েও তীব্রতর একটা আবেশে মিশে গেলো মোহর, হালকা হয়ে আসা ঘুমটা আবারও ঘন হলো৷ ভারিক্কি চোখের পাতা টেনেও খুলতে পারলো না।
.
এবার যখন ঘুম ছুটলো তখন নিজের স্থানটা আগের মতোই দেখলো৷ ঘাড় তুলে তাকালো মেহরাজের ঘুমন্ত চেহারায়। মানুষটা ওকে বুকে নিয়েই ঘুমিয়েছে। মোহর ঘাড় ঘুরিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। কী আশ্চর্য, এতক্ষণ ঘুমিয়েছে ও! সেই তিনটার পর এসে ঘুমিয়েছে আর এখন রাত নয়টা। এতক্ষণ কীভাবে ঘুমালো ও, একটা বার ডাকলো ও না কেও! মোহর রয়েসয়ে উঠে বসলো, মেহরাজ তখনও চোখ বুজে, আস্তেধীরে ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেমে এলো বিছানা থেকে। পরনের শাড়িটা ঠিক করে ওয়াশরুমে ঢুকলো। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বিছানাতে এসে বসলেও মেহরাজকে আর সেখানে পেলো না। কৌতূহলী চোখ দু’টো এদিক ওদিক ঘোরাতেই সামনে একটা ধোঁয়া ওঠা মগ ধরলো, শীতল কণ্ঠে বলল,
– চলুন বারান্দায় যাই।
মোহর ঘাড় তুলে তাকালো মেহরাজের দিকে। গরম পাত্রটা হাতে নিয়ে বলল,
– কখন উঠেছেন?
– আপনি যখন আমাকে রেখে উঠে গেলেন
মুচকি হেসে বলল মেহরাজ। মোহর স্থৈর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ওর দৃষ্টিচ্যুত করে মেহরাজ ওর হাত এনে বারান্দায় কাউচে বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো। আশপাশ জুড়ে ঠান্ডা ঠান্ডা আবহ, শীতল বাতাসের আমেজ জানান দিচ্ছে খুব শীঘ্রই শীতের আগমন বার্তা। ধোঁয়া ওঠা মগে চুমুক দিয়ে মোহর বলল,
– কাল রাতে আমি বাইরে আসার পর আপনিও উঠেছিলেন তাইনা।
মেহরাজ জবাব দিলো না। কাউচে শরীর ঠেস দিয়ে এক হাত ছড়িয়ে আরেক হাতে ঘনঘন চুমুক দিচ্ছে কফির কাপে। মোহর মুখ সামনের দিকে ফিরিয়ে নিলে মেহরাজ ওর কাছাকাছি ঘেঁষে বসলো। হাতের কাপটা সাইডে রেখে বলল,
– আমাকে বুক থেকে সরিয়ে বিবিজান উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে, অথচ আমি বুঝতে পারবো না?
মোহর চুপ করে রইলো। রাতে ঘরে ফিরে মেহরাজ কে নিজের জাগাতেই দেখেছিল। কেনো মেহরাজ ওর সজাগতা বুঝতে দেয়নি তা হয়তো এখন বুঝছে। মোহর ভীষণ বেচ্যাইন হয়ে বলল,
– এসবের মানে কী রুদ্ধ? কী দেখেছি আমি? আপনার বাবা রীতিমতো আপনার মা’কে অ’ত্যাচার করছে! ফিজিক্যালি, মেন্টালি। অথচ আপনারা কেও কিছু জানেন নাহ! নাকি জেনেও না জানার ভান করেন, ইচ্ছে করে মা’কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন।
– তুমি যখন কাল ঘর থেকে বেরিয়েছিলে তখন ঘড়িতে কয়টা বাজছিলো মনে আছে? আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। রাত একটা বেজে সাতচল্লিশ মিনিট। এবার তুমি বলো মাঝরাতের পরে কার ঘরে, কোন দম্পতির মাঝে, কার ব্যক্তিজীবনে কী ঘটবে তা খুতিয়ে দেখার অধিকার বা সামর্থ কারো আছে? তারা আমার বাবা মা ঠিকাছে, তবে তার আগে তারা স্বামী স্ত্রী। স্বামী স্ত্রীর মাঝে কী ঘটবে দে নিয়ে আমি বা আমাদের কিছু বলার আছে? আচ্ছা তাও ধরে নিলাম বলা উচিত, আজ তো বলেছিলে তুমি তাই না? কী উত্তর পেয়েছো? স্বীকার করেছে সে? অভিযোগ করেছে? করেনি তো! কখনো সামনা-সামনি আমার বাবা মায়ের মাঝে রেষারেষির ছোট্ট আভাস ও পেয়েছো? পাওনি তো! যে বা যারা মুখ বুজে স্বেচ্ছায় সবটা সহ্য করে লুকিয়ে রাখে তাকে কী বলার আছে?
মোহর নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো মেহরাজের দিকে। আজ অব্দি হয়তো এতটা অস্থির কখনও কথা বলেনি মেহরাজ ওর সাথে। কিন্তু মেহরাজের কথার প্রেক্ষিকা জবাব ও টানতে পারলো না ও। মেহরাজ ঘাড়ের পেছনে হাত দিলো। স্পাইনাল কর্ডে হাত বুলিয়ে নিজেকে শান্ত করার ব্যাপক প্রচেষ্টায় দম ছাড়লো বার দুয়েক। মোহরের হাত ধরে নিজের কাছে টেনে বলল
– আমি জানি তুমি যা বলছো তা একটুও ভুল নয়, তবে আমার কথাগুলো কী সবই ভুল? এক দেখায় কোনো কিছুই বিচার করা যায়না। কেও তার ব্যক্তিজীবনকে আড়ালে রাখতে চাইলে জোর করে তাকে ন্যায় দেওয়া ও যায়না। আমার কথাটা শোনো, এতো চিন্তা কোরোনা। আজ সারাটা দিন কিচ্ছু খাওনি শেষে তুমি অসুস্থ হলে!
মোহর চুপ করে রইলো। ও যে গতরাতের দৃশ্যটা ভুলতে পারছেনা। স্বামী স্ত্রীকে আ’ঘাত করাত ঘটনা বহুত শুনেছে, তবে এভাবে কখনো চোখে পড়েনি। কীভাবে পারে কেও এভাবে!
– দেখি তাকাও আমার দিকে। সবার দিকে মনোযোগ দাও অথচ আমাকে দাও না। এই যে আমি আপনি থেকে হুট করেই তুমিতে চলে গেলাম এটা খেয়াল করেছো? করোনি, তা করবানা তো। আমাকে নিয়ে আদও ভাবো? সারাদিনে আমার একবার খোঁজ নাও?
মোহর জবাব দেওয়ার আগেই আরেকটা শব্দের উৎপত্তিতে চুপ করে গেলো। মেহরাজ একহাতে মোহরকে জড়িয়ে রেখেই আরেক হাতে ট্রাউজারের পকেট থেকে ফোন বের করে কানে ধরলো, ওপাশ থেকে বলা কথাটা জবাবে বলল,
– জ্বী আমি মেহরাজ আব্রাহাম বলছি।
তারপর কতক্ষণ পিনপতন নীরবতা। ফোনের ওপাশের কণ্ঠের ঘনঘন কিছু কথা যান্ত্রিক শব্দের মতো কানে এলো মোহরের, মেহরাজ খট করে কলের লাইনচ্যুত করলো, উঠ্র দাঁড়িয়ে অস্থির গলায় বলল,
– আমাকে এক্ষুনি বেরোতে হবে মোহ!
.
.
.
চলমান।