#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪৮
#হুমাইরা_হাসান
| অংশ ১ |
পৃথকের বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় বিকেল গড়িয়ে আসলো। এসেছিল কিছুক্ষণের সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে, অথচ কীভাবে ঘন্টার কাটা একের পর এক পাল্লা দিয়ে পেরিয়ে গেলো বোঝাই গেলো না। সময়টা হয়তোবা তিনটে/সাড়ে তিনটের কাটা পেরিয়ে চারের ঘরে হেলেছে।
মোহর আর তাথই বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসলো। দুপুরের দিকে মেহরাজ ও এসেছিলো, বলা বাহুল্য পৃথকের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে।
এই প্রথম যখন ওরা এসেছে পৃথকের নতুন বাড়িতে তাই একসাথে মধ্যাহ্ন ভোজ করার সুযোগ টা ছাড়তে চাইনি। আর আজ সমস্ত রান্না টাও মোহর নিজেই করেছে সাথে তাথইয়ের সাহায্যে। তাথই অবশ্য রান্নাতে খুব একটা পাঁকা নয়, যেটুকু সম্ভব এগিয়ে দেওয়ার কাজটাই করেছে। এই সময় টুকু যেনো তাথইয়ের কাছে দম বন্ধকর ছিলো, একে তো অস্বস্তি তার সাথে চিন্তা। কোলের মেয়েটাকে রেখে এতটা সময় বাইরে তো থাকেনি। বারবার বাড়িতে ফেরার তাড়া দিচ্ছিলো। সবশেষে মেহরাজ আসলো পৃথকের সাথে গল্প করতে করতে৷
গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দেওয়ার সময় একবার আড়চোখে তাকালো তাথই, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার বেহায়া চোখ জোড়া ওর দিকেই স্থির তাকিয়ে আছে। তাথই আড়চোখে দেখলেও চোখ ফেরালো না অথচ স্পষ্ট বুঝতে পারলো ঠিকই যে একজোড়া চোখ প্রবল আকুতি নিয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে,ওর মুখের দিকে হয়তোবা একটা বার চোখ ফেরাবে স্নিগ্ধ মুখটা ঘুরিয়ে দেখবে ওকে। কিন্তু সেই বুকভরা আশাটুকুকে বেশ নিষ্ঠুরতার সহিত চ্যুত করে তাথই সামনেই তাকিয়ে রইলো। গাড়ি ছাড়ার সাথে সাথে এগিয়ে গেলো সম্মুখে, পেছনে ছেড়ে আসলো একটা জলজ্যান্ত তৃষ্ণাভরা মুখ আর বুক’টাকে। তাকালো না তাথই, বুকের ভেতরের ভোতা যন্ত্রণার তীক্ষ্ণতা মুখ বুজে সয়ে নিয়ে সামনেই তাকিয়ে রইলো। কেনোই বা তাকাবে! কোন অধিকার কোন সাহসে তাকাবে? মায়া যে বড্ড ভয়ংকর জিনিস, দুনিয়াবি নিয়ম বাঁধ-শৃঙ্খলের গণ্ডি চুরচুর করে দিয়ে বেহারা করে তোলে আত্মসত্তা’টাকে, বহু বছর পরেও জাগিয়ে তোলে বিতৃষ্ণার দহন
.
বাড়িতে ঢুকেই তাথই ছুটে গেলো নিজের মেয়ের কাছে। সোফাতেই বসে ছিলো কাকলি, তাথইকে এলে ওর হাতে তোয়াকে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। দেখে মনে হলো ভীষণ তাড়ায় আছে। মোহর একবার সেদিকে তাকিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠে গেলো। ফ্রেশ হয়ে পুনরায় বসার ঘরে এসে দেখে তাথই তখনও বসে তোয়াকে নিয়ে। মোহর আসলো অল্পবিস্তর, তাথইকে দেখে মাঝে মধ্যেই অবাক হয়। কিভাবে সবটা বিসর্জন দিয়ে নিজের ছোট্ট অংশ টাকে আঁকড়ে ধরে প্রতিনিয়ত বেঁচে যাচ্ছে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে তাথইয়ের পাশে বসে বলল
– আপা, তুমি এখনো ফ্রেশ হওনি তো! বাবুকে আমার কাছে দাও তো। গিয়ে চেঞ্জ করে আসো
বলে তোয়াকে নিজের কোলে নিলো। তাথই ও যেনো এটার অপেক্ষাতেই ছিলো। ওউ আর কথার খরচা না করে নিজের ঘরের দিকে গেলো।
মোহর একাই ছিলো বসার ঘরটাতে। আশপাশে তাকিয়ে হঠাৎই দেখলো স্টোর রুম থেকে চোরামুখে মালাকে বেরিতে আসতে। মেয়েটাকে কেমন অদ্ভুত চরিত্রের মনে হয় শুরু থেকেই। নাজমা আর মালা দুজন একই সাথে কাজ করলেও দু’মেরুর দুটো প্রাণীর মতো দূরত্ব বজায় রেখে চলে। বলা বাহুল্য নাজমা হলো শাহারা বেগম এবং আম্বি খাতুনের ছাপোষা। অন্যদিকে মালা মেয়েটা কাকলি খাতুনের ছাপোষা, মেয়েটার মুখেই কেমন কূটনৈতিক ছাপ।
– দাঁড়াও
মোহরের কথা শুনে মালা হতভম্ব হয়ে পা থামালো। ও নিজের ধ্যানে এতটাই বিভোর ছিল যে ড্রয়িং রুমে বসে থাকা মোহর কেও লক্ষ্য করেনি। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়েই এগিয়ে এলে মোহর আগের মতোই বলল
– স্টোররুমে কি করছিলে তুমি?
মালা বেশ অপ্রস্তুত হলো, চোখে মুখে অহেতুক ভীতি নিয়েই জবাব দিলো
– পরিষ্কার করছিলাম
– বিকেল বেলা স্টোররুম পরিষ্কার করার যুক্তি টা একটু বেশিই অসঙ্গত নাহ? মিথ্যে বললে সেটা ভালো করে বলো যাতে বিশ্বাসযোগ্য হয়।
মালা বিস্ফারিত নয়নে তাকালো মোহরের দিকে। বার দুয়েক শুকনো ঢোক গিলে বিনয়ী গলায় বলল
– বিশ্বাস করুন আমি পরিষ্কার করতেই গেছিলাম। আমাকে সকাল বেলায়ই ছোট ম্যাডাম বলেছিলেন পরিষ্কার করার কথা। কাজের মাঝে ভুলে গেছিলাম তাই এখন করলাম।উনি যদি দেখেন কাজ হয়নি খুব বকবে, সেই ভয়ে। আর কিচ্ছু না
মোহর ভীষণ শাণিত চোখে তাকিয়ে রইলো মালার চঞ্চল চোখ, কচলানো হাত আর অস্থির পায়ের অবস্থানে। তবে মস্তিষ্কের ভাবনা টাকে আর খাটালো না। স্বাভাবিক ভাবে বলল
– মাথাটা ধরেছে, আদা চা করে আনো দুটো।
– আপনি তো একা! দুটো চা কি করবেন?
মালার প্রশ্নের পরমুহূর্তেই মোহর চোখ তুলে নির্লিপ্ত ভাবে চাইলো ওর দিকে। মালার বুকটা আচমকাই হুঁ-হুঁ করে উঠলো। কেমন একটা শীতলতার স্রোত বয়ে গেলো। নিজের মুখের অনুচিত ব্যবহারের মার্জনা চাওয়ার আগেই মোহর আলতো হেসে সুমিষ্ট সুরে বলল
– তোমরা যেমন তিনজন মানুষের মজলিশে চারটা কাপ নিয়ে যাও। অনেকটা সেরকমই ভাবতে পারো
চুলের গোড়া বয়ে সরু ঘামের রেখা তিরতির করে ঘাড় বেয়ে নামলো মালার। ওর হালকা পাতলা মুখটা টেনে খানিকটা হাসার প্রয়াস করলেও পুরোপুরি সফল হলো না অপ্রতিভ’তা ঢাকতে। পরপর বার দুয়েক বলল
– আমি এক্ষুণি করে আনছি চা
বলে সঙ্গে সঙ্গেই সেই স্থান ত্যাগ করে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। মালা যেতেই গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে এলো আম্বি খাতুন। ক্লান্ত শরীরে সোফাতে বসে হেলান দিলো। ক্ষীণ গলায় শব্দ তুলে ডাকলো
– নাজমা?
– আমি চা করতে বলেছি মা, এক্ষুণি আনবে।
আম্বি খাতুন চোখ খুলে তাকালেন। মোহর তখনও তাকিয়ে মাঝবয়সীর আনন পানে। চেহারায় অনেক বেশি ক্লান্তি আর দৌর্বল্যের ছাপ। চোখের নিচের কালো দাগের প্রলেপ টা নিঃশব্দে জানান দিচ্ছে রাতভর নির্ঘুমতার। তবে কারণ টা মোহরের অজানা, মানুষটাকে অনেক বেশিই ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত মনে হলো মোহরের। ইদানীং ঘর থেকে খুব কম বের হন। চুপচাপ থাকা, আর কম কথা বলার স্বভাব টা একেবারে নিস্তব্ধ করে রেখেছে মানুষটাকে। মোহর এ বিষয়ে শাহারা বেগমের সাথে কথাও বলেছিলো একবার। তবে জবাবে একমুখ মলিনতা ছাড়া আর কিছুই পাইনি।
– শরীর টা কি খুব খারাপ মা?
আম্বি খাতুন ডায়ে বাঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে না বোধক জবাব দিলো। মোহর দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করলো না। মালা ততক্ষণে চা এনেছে, এক কাপ মোহরের সামনে দিয়ে আরেক কাপ আম্বি খাতুনের হাতে দিতে দিতে আড়চোখে মোহরের দিকে তাকালো। তন্মধ্যে ডাক পড়লো মোহরের, ওপর থেকে মেয়েলী গলাটা খানিকটা উচ্চস্বরে বলল
– তোয়াকে নিয়ে উপরেই আসো তো মোহর। ওকে খাওয়াতে হবে।
মোহর চায়ের কাপটা আর ধরলো না। তোয়াকে বুকে করে উপরে উঠে গেলো তাথইয়ের ঘরের দিকে। নিচে একাকী বসে নিঃশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আম্বি খাতুন। মিনিট দুয়েকের মাঝেই পাশে কারো উপস্থিতি টের পেলো। মোহর এসে একদম পাশটায় বসেছে, ওকে দেখে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখলো আম্বি খাতুন। মোহর নিঃশব্দে আম্বি খাতুনের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে স্ফীত কাফ এবং বাল্বটার ব্যবহারে হাতটা চেপে ধরলো। আম্বি খাতুন কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না বরং চুপচাপ তাকিয়ে রইলো মোহরের মুখের দিকে৷ মিনিট কয়েক পরেই হাতটা ছেড়ে দিলো। কান থেকে স্টেথোস্কোপ টা নামিয়ে তার জাতীয় বস্তুটা পেঁচাতে পেঁচাতে বলল
– সিস্টোলিক চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। এরকম হারে বাড়তে থাকলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে অনেক বড়ো সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। ঠিক মতো ঘুম হচ্ছে নাহ, মাথাব্যথা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। ডাক্তার দেখাচ্ছেন না কেনো? হাই প্রেসার কতটা সাস্থ্যঝুঁকি সম্পন্ন জানেন না? স্ট্রোক আর হার্টের সমস্যার প্রাথমিক মাধ্যম হলো হাই প্রেসার। এটাকে সময়মত নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে অনেক ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন হবে। আপনার এসব ব্যাপারে লক্ষ্য রাখা উচিত।
আম্বি খাতুন বাধ্য রোগীর মতন সবগুলো কথা মনোযোগ সহকারে শুনলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে অতঃপর বলল
– মায়েরা স্বাভাবিক ভাবেই তার সন্তানকে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু আমি মেহরাজকে অনেক বেশিই ভালোবাসি মোহর। আর আমার মেহরাজ তোমাকে ভালোবাসে৷ তাই আমারও উচিত ছিলো তোমাকে ভালোবাসা। কিন্তু আমি তা করিনি। এ বাড়িতে এসে থেকে একটা কথাও ঠিকঠাক ভাবে বলিনি তোমার সাথে। আজ বলছি, বলছি না অনুরোধ করছি। আমার ছেলেটা তোমাকে যতটা ভালোবাসে তার সমান না পারলে অর্ধেকটা হলেও ওকে ভালোবেসো। আমার ছেলেটাকে আমি তোমার জিম্মায় ছেড়ে দিলাম মোহর। মা হয়ে আমি সমস্তটা তোমার হাতে দিলাম। তুমি এ দ্বায়িত্বের অবহেলা কোরো না। যত যাই হয়ে যাক,তুমি ওর সাথে থেকো। পাশে থেকো। ওকে কখনো ছেড়ে যেও না,ভুল বুঝো না। আমার ছেলেটা ভীষণ বিলাসিতায় বড়ো হয়েছে, তাই খুব করে চাওয়ার মতো কিছু ওর ছিলো না কখনো। তবে এখন আছে, খুব এর চেয়েও অনেক বেশি চাওয়া আর বাসনার জিনিস আছে। আর তা হলো তুমি। তোমাকে নিজের ভালো থাকার মাধ্যম করে নিয়েছে ও, ওকে কখনো কষ্ট দিও না। আমার বাবু ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো, আমার দুনিয়াটাই তো ওকে ঘিরে।
বলে আর এক মুহুর্ত ও দাঁড়ালো নাহ। দুরন্ত পায়ে ছুটে গেলো নিজের ঘরে। মোহর এখনো তব্দা খেয়ে বসে আছে। ওর কব্জিতে চেপে ধরা হাতটার স্পর্শ এখনো লেগে আছে যেনো। আম্বি খাতুনের কথায় আর রূঢ়তা ছিলো না, নাইবা ছিলো কাঠিন্য, গাম্ভীর্য। বরং ছিলো তীব্র আকুতি, অনুনয় বিনয়। একজন মায়ের সর্বশেষ অনুরোধ। তার আবদার তার ছেলেকে ভালো রাখার আবদার। একজন মায়ের কাছে তার সন্তানের চেয়ে প্রিয় তো কিছুই হয়না, সেই বুকে জড়ানো মানিকটাকে অন্য একটা মেয়ে যাকে কিনা একচুল ভরসা করেনা বলে তার জিম্মায় তুলে দিলো? কেনো! কেনোই বা মায়ের মুখ ভরা দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক কেনোই বা তার কণ্ঠে অসহায়ত্ব!
মিনিট পাঁচেক ঝিম ধরে ওভাবেই বসে রইলো মোহর। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে আস্তেধীরে উঠে এলো। নিজের ঘরে এসে স্ফিগমোম্যানোমিটার নামক যন্ত্রটা টেবিলের উপরে রেখে খাটে হেলান দিয়ে বসলো, নানবিধ চিন্তা আর ভাবনায় বুদ হয়ে এলো মন-মস্তিষ্ক। বিছানার হেডবোর্ডে ঠেস দিয়ে চোখ বুজে নিলো মোহর। নিষ্প্রভ, স্থবির অবস্থায়’ই বুকের উপর ভারী চাপ অনুভব করলো, তার সাথে শরীর টাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরা দুটি হাত। মোহর চোখ খুলে কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটা দেখে চুপ করে বসে রইলো। হাতটা তুলে চুলের ভাঁজে গলিয়ে দিলে হাত দুটোর বেরিবাঁধ আরও ঝাপটে ধরলো ওকে। মোহর চুলগুলোর ভাঁজে হাতের স্পর্শ চালিয়ে দিতে দিতে বলল
– মায়ের শরীরটা খারাপ বেশ কয়েকদিন ধরে।
মেহরাজের জবাবের আগেই নিজ থেকে আবারও বলল
– প্রায় সপ্তাহ খানেকের বেশি হলো উনি ঘর থেকে খুব একটা বের হন না, প্রায়শই উনার মাথা ব্যথা থাকে। আজকে প্রেসার মেপে দেখলাম স্বাভাবিকের মাত্রা ছাড়িয়েছে, এভাবে চললে তো অনেক বেশি খারাপ হবে অবস্থা।
মেহরাজের পক্ষ হতে কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। মোহর জবাবের অপেক্ষায় কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল
– আপনার মা আপনাকে খুব ভালোবাসে রুদ্ধ। অথচ আপনার আচরণে উনার প্রতি টান দেখতে পাইনা আমি।
মেহরাজ বুক থেকে মাথা তুলে মোহরের দিকে তাকালো। নির্লিপ্ত দৃষ্টি স্থির রেখে বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল
– আপনার এমন মনে হওয়ার কারণ?
– কারণ টা তো স্পষ্ট। আপনি কী সময় করে মায়ের খোঁজ নেন? উনার এতটা অসুস্থতার খবরটাও আপনার অজানা। মানুষটা আপনাকে যতটা ভালোবাসেন বিনিময়ে আপনার প্রতিক্রিয়া ততটাই শান্ত।
মেহরাজ নিজের প্রশান্ত স্বভাব টা বহাল রেখেই জিগ্যেস করলো
– ভালোবাসা তো বিনিময়ের সম্পর্ক নয় যে কেও ভালোবাসলে তা সমান অঙ্কে ফেরত পাবে! ভালোবাসা তো বিনিয়োগের সম্পর্ক, যেখানে লাভ বা লোকসানের ব্যাপক অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও আমরা আমাদের সবচেয়ে দামী সম্পদটা ইনভেস্ট করি।
মোহর বিব্রত মুখে চেয়ে রইলো। স্বাভাবিক একটা প্রশ্নের এহেন জড়ানো উত্তর নিতান্তই অপ্রত্যাশিত ছিলো। মেহরাজ মুচকি হাসলো, থুতনিটা বুক থেকে তুলে এগিয়ে নিয়ে মোহরের ঠোঁটে শব্দ করে একটা চুমু দিলো। উঠে দাঁড়িয়ে ফোনটা সেন্টার টেবিল থেকে পকেটের পুরে মোহরের দিকে তাকিয়ে বলল
– আগেই বলেছি. . ব্যবসায়ীক স্বামীর আপনার। লাভ লোকসানে হিসেবটা একটু বেশিই ভালো বোঝে
.
.
.
চলমান
©Humu_❤️
#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪৮
#হুমাইরা_হাসান
| অংশ ০২ |
– আপনাকে ডক্টর ডেকেছেন
চিকন একটা মেয়েলী গলার ডাকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মোহর। ইঞ্জেকশনের সিরিজে একটা আঙুলের টোকা দিয়ে চোখের ইশারায় হ্যাঁ বোধক ঘাড় নাড়িয়ে দু’কদম এগিয়ে গেলো। সাতাশ নম্বর বেড, একটা ১৪ বছরের ছেলে। পাশেই গালে হাত দিয়ে ওর মা বসা। মোহর শীর্ণকায় হাতটা এক হাতে খুব আলতো করে ধরলো, সিরিজের চোখা সুচ টা যেনো ছেলেটার নাহ,ওর মায়ের শরীরের চামড়া ভেদ করলো। দুঃখে, যন্ত্রণায় চোখ কুচকে নিলো মহিলা। কুচকে নেওয়া চোখের কার্ণিশ বয়ে বিন্দু বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়লো। কী আশ্চর্য! সুচ ফুটলো ছেলেটার শরীরে,অথচ চোখ ভিজলো মায়ের৷ এই বুঝি মা-সন্তানের মধুর টান, মমতা, ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই।
মোহর স্মিত হাসলো। প্রেসক্রিপশনটা মহিলার হাতে ধরিয়ে ওষুধ গুলোর নাম, নিয়ম সব যথাযথ ভাবে বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো। কেবিন থেকে বেরিয়ে দুয়েক কদম হাঁটতেই নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটাকে দেখে না চাইতেও দাঁড়াতে হলো৷
– কোথায় যাচ্ছো?
– ফায়াজ স্যারের কেবিনে।
ছোট্ট উত্তরটুকু দিয়েই পাশ কাটাতে চাইলো মোহর, তবে তিয়াসা তা হতে দিলো না। দু’পা এগিয়ে এসে মোহরের একদম সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে বলল
– খুব তো সুখে আছো তাইনা!
অহেতুক কথাটার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পেরেও ভ্রু কুঁচকে নিলো মোহর। জিজ্ঞাংসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে, তিয়াসা কটাক্ষ করে বলল
– আমার জায়গা,আমার জিনিস ছি’নিয়ে নিয়ে বেশ তো ফূর্তিতে আছো। চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
– না আমি কারো জায়গা ছি’নিয়ে নিয়েছি আর নাইবা কারো জিনিস
– নাওনি? আমার মেহরাজকে ছিনি’য়ে নাওনি বলছো!
মোহর সরু চোখে তাকালো, ঠোঁটের কোণে ছোট হাসির রেখা টেনে বলল
– মেহরাজ তো কোনো জিনিস নয় যে আমি ছিনি’য়ে নেবো!
– অবশ্যই তাই। তুমি, তুমি আমার ভালোবাসা আমার মেহরাজকে আমার সব সুখ স্বপ্নকে কেড়ে নিয়েছো। কি মনে করেছো খুব সুখে থাকবে? হ্যাঁ! কখনও নাহ,এই তিয়াসা চৌধুরী কখনোই তা হতে দেবে না। তোমার থেকে তোমার ঘর,বর সব কেড়ে নেবো আমি, এ্যন্ড আই মিন্ ইট্!
তিয়াসার চাপা স্বরের ক্ষুব্ধতা যেনো হসপিটালের দেওয়ালে দেওয়ালে বাড়ি খেলো। নিঃশব্দ,শৃঙ্খলার আওতাভুক্ত জায়গাটায় ছড়িয়ে গেলো মেয়েলী গলার ক্রুদ্ধতা। মোহর শাণিত চোখে তাকিয়ে রইলো তিয়াসার দিকে। ওর অস্থিরতা, চোখ মুখ জুড়ে উপচে পড়া হিংসে,ক্রোধ সবটা খুন নিপুণভাবে পরখ করে, স্থৈর্য গলায় বলল
– না আমি কারো জিনিস ছিনি’য়েছি আর নাইবা মানুষ। আপনার মেহরাজকে না আমি কখনো দখল করেছিলাম নাইবা করবো। আমি যাকে পেয়েছি সে আমার স্বামী। যে নিজ হতে আমাকে গ্রহণ করেছে, ভালোবেসেছে। সে যদি আপনারই হতো তাহলে কখনো আমার হতো নাহ। তবুও যখন আপনার মনে হয় আমিই আপনার ভালোবাসা ছি’নিয়ে নিয়েছি তবে বেশ, দিয়ে দিলাম মেহরাজকে। যদি নিয়ে নিতে পারেন তবে দে আপনার। খোদার কসম আমি নিজ হাতে আপনাদের বিয়ের ব্যবস্থা করবো। আর যদি নিজের করে নিতে না পারেন,তাহলে মুখে না হোক মনে মনেই স্বীকার করে নিবেন, মেহরাজ কখনোই আপনার ছিলো না।
বলে তিয়াসার অভিব্যক্তি বা প্রত্যুত্তর কোনোটার অপেক্ষা না করে মোহর দ্রুত পায়ে সরে এলো। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলো ফায়াজের কেবিনে। তিয়াসার রাগে, ক্ষোভে চোখ ছাপিয়ে দুটো ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো। এই মেয়েটার,দুইদিনের মেয়েটার এতো দেমাগ! ও কি না তিয়াসাকে! যে সারাটা জীবন ধরে ওই মানুষটাকে পাওয়ার সাধনা করে গেলো তাকে কথা শোনালো? অপমান করলো!
– খুব গৌরব তাই নাহ! নিজের স্বামীর উপর এতো আস্থা! বেশ তবে, মেহরাজ আর এখন আমার ভালোবাসা রইলো না কারণ আমি নিজেও জানি ও কখনোই আমার ছিলো নাহ। তবে ও অন্য কারো ও ছিলো না কখনো। আজ যখন আমার না আমি তোমার ও হতে দেবো না মোহর শিকদার। আমার মনে, শরীরে যে ক্ষত হয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুণ, তিনগুণ আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো।
হাতের উলটো পিঠে চোখের পানি মুছে নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে গেলো তিয়াসা। ওর ভেতরে কীসের ঝড়, কোন ষড়যন্ত্রের নক্সা আঁকছে তা হয়তো উপরওয়ালা ছাড়া এখন কারোই বোধগম্যে নেই।
.
– যদি কিছু মনে না করেন আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই স্যার।
ফাইলের বুকে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে থেকে গেলো আঙ্গুল। মুখোভঙ্গির কোনো পরিবর্তন না করে আবারও টুকটাক কলমটা নাড়াতে নাড়াতে উত্তর দিলো
– খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে সবকিছু পালটে গেছে, জানো তো মোহর।
মোহর ফায়াজের কথার অর্থোদ্ধার করার আগেই ফায়াজ নিজে থেকেই তাকালো ওর দিকে। কলম টা সাইডে রেখে টেবিলের উপরে দুইহাতের কনুই ভর দিয়ে বলল
– বোঝো নি,তাই না? লেট’মি এক্সপ্লেইন।
বলে লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিলো। ভীষণ সহজতর ভঙ্গিমায় বলল
– এই স্থান,কাল,পরিচয়, মানুষ। সবই তো বদলে গেছে। না এমন হওয়ার কথা ছিলো আর নাইবা এমনটা বলার। একবার নিজের দিকে তাকাও তো মোহর। তুমি, তোমার মন-মস্তিষ্ক কোনো টাই কি আগের মতো আছে? তোমার নিজের নামটাও তো বদলে গেছে। এখন আর তুমি মোহর শিকদার নও বরং মিসেস.মেহরাজ আব্রাহাম ওরফে দ্যা গ্রেট ম্যান। তাই তো? আগের মানুষ গুলো সবাই হারিয়ে গেছে তোমার জীবন থেকে, আর যারা আছে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।
শেষের কথাটুকু খুব হালকা স্বরে বললেও ভীষণ ভারী শোনালো। মোহর চোখ তুলে তাকালেও ফায়াজ চোখ মেলালো না। মোহরের ইদানীং বেশ অস্বস্তি হয় ফায়াজের সামনে। ঠিকঠাক অস্বস্তি নাহ,কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করে। এর কারণ ওর জানা নেই তবে ফায়াজ এখন কেমন একটা অন্যরকম চোখে তাকায় ওর দিকে। যে চাহনি হাজারো প্রশ্ন,অভিমান,যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে মোহরের বুকটা। কেনো? কই আগে তো ফায়াজের চোখ দু’টো এমন লাগেনি! ফায়াজ তো কখনও চোখ মেলে ঠিকঠাক তাকাতোও না ওর দিকে। মাঝেমধ্যে মোহর নিজেই বিরক্ত হতো ফায়াজের এতো ভদ্রতায়। কোনো প্রশ্ন করলেও লোকটা অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দিতো। তবে আজ কেনো সেই একই মানুষটার চোখে মুখে অকল্পনীয়, দুর্বোধ্য অনুভূতি, ক্লেশ!
মোহর চোখ সরিয়ে নিলো, আড়ষ্টভাব মিশ্রিত স্বরে বলল
– স্যার,আপনি ভুল বুঝছেন। সবকিছু কোন পরিস্থিতিতে হয়েছে তা আপনারও জানা ছিলো। না এই সম্পর্ক আর না এই বিয়ে কোনো টাই আমার ইচ্ছেতে হয়নি।
– তুমি আমাকে একটা ফোন করতে? একবার জানাতে? আমি যেই দেশেই থাকি না কেনো তক্ষুনি ছুটে আসতাম। এতো বছরে কি আমি এইটুকু ভরসাযোগ্য ও হতে পারিনি তোমার কাছে?
– তেমনটা নয় স্যার। আব্বা যখন বেঁচে ছিলেন তখন থেকে শুরু করে আব্বা চলে যাওয়া পরেও আপনি আমাদের পাশে যেভাবে ছিলেন,যেভাবে প্রতিটা মুহুর্তে আমাদের সাপোর্ট করেছেন এটা কখনোই ভুলে যাওয়ার নয়। আপনাকে আমি নিজের পরিবারেরই একজন মনে করে এসেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সারারাত একটা দুঃস্বপ্নের মতো খারাপ কাটিয়ে সকালে বাড়ি ফিরে মায়ের মরা মুখটা দেখে আমার ভেতর বাহির কোনোটাই আর স্বাভাবিক ছিলো না। তার সাথে লোকসমাগমের ভয়ংকর কুৎসিত কথার তুবড়িতে ঝাঝড়া করে দিচ্ছিলো আমার দুনিয়াটা। আমাকে তো মায়ের মুখটাও মন ভরে দেখতে দেয়নি। এক প্রকার জোর করে একটা অচেনা মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে আমাকে। আপনার অভিযোগ টা আমি অবশ্যই স্বীকার করি, তবে বিশ্বাস করুন কাওকে জানানোর পরিস্থিতি ছিলো নাহ।
পুরোটা কথা মোহর দম ছাড়েনি। একদমে একটা যন্ত্রমানবীর মতো বলে গেলো। ফায়াজ নির্লিপ্ত, নিষ্পলক চেয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। এই মেয়েকে ও কি করে বোঝাবে ও তাকে ভালোবাসে! একটা নয় দুটো নয়, পাঁচটা বছর ধরে বুকের ভেতর ভালোবাসার বীজটুকু যতনে যতনে আগলে রেখেছে। তাকে হুট করেই অন্য কারো হতে কীভাবে মেনে নিবে ও,কীভাবে!
– পুরোনো কথা আর মনে করতে হবে নাহ। আমি দুঃখিত। বলো কী জানতে চাচ্ছিলে তুমি
মোহর বুঝলো যে ফায়াজ ইচ্ছে করেই এড়িয়ে দিলো কথাগুলো। অতঃপর ধাতস্থ হয়ে শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলো
– তিয়াসা চৌধুরীর সাথে আপমার সম্পর্ক কী?
– তিয়াসা আমার কাজিন্। মামাতো বোন ও আমার।
মোহর অবাক হলো বিস্তর। তবে সেটুকু প্রকাশ করলো শুধু ভ্রুদ্বয় কুঁচকে। খানিক বিব্রত ভাবে জিগ্যেস করলো
– মামাতো বোন? কই আগে তো শুনিনি। আপমার কোনো রিলেটিভ যে এদেশে আছে কখনো তো বলেননি!
– বলার মতো প্রয়োজন বা টপিক আসেনি তাই। বাবা মা আমাকে এ দেশে রাখতে চাইনি, শুধু আমার ইচ্ছেতেই থেকে গেছি। তিয়াসার বাবা ওয়াকিফ চৌধুরী আমার মামা। তবে সে বা তার পরিবারের সাথে সম্পর্ক খুব একটা টানের না। একই শহরে থেকেও আমি আলাদা আমার মতো থাকি তবে তিয়াসাকে আমি স্নেহ করি। আমার একমাত্র ছোট বোন ও। আগে দেখা সাক্ষাৎ মেডিক্যালে হতো এখন হসপিটালে। ওউ তো এখানেই ইন্টার্নশিপ করছে, অসুস্থতার জন্য কয়েকদিনের লিভ নিয়েছে। এই আরকি
কথাগুলো বেশ অভাবনীয় হলেও মোহরের মুখাবয়বে তেমন কোনো বিস্ময় প্রকাশ পেলো না। ওর মনে পড়ে গেলো সাঞ্জের বলা কথাগুলো। এই জন্যেই মেয়েটা বলেছিল, ফায়াজকে ওর চেনা চেনা লাগে।
এতসব ভেবে,শুধু ছোট করে বলল
– উনার হাতে কীসের জখম?
– এসিড, এসিড পড়েছে।
মোহর প্রসারিত চোখে তাকালো। ফায়াজ খুব অবলীলায় বলে দিলেও মোহরের নিকট বিস্তর একটা অভিব্যক্তি প্রত্যাশা করেছিলো। সে ভাবনার জল ঢেলে দিলো মোহরের আবারও শাণিত চেহারাটা।
অতঃপর প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে বেড়িয়ে এলো মোহর।
–
শ্রীতমার সাথে রাস্তার কোণ ঘেঁষে হাঁটছে, টুকটাক গল্প হাসি দিয়েই এগোচ্ছে। মাঝখানে হুট করেই শ্রীতমাকে চুপ দেখে মোহর কিঞ্চিৎ রসিকতা করে বলল
– কী ব্যাপার আবার তার কথা ভাবছিস?
শ্রীতমা চোখ ছোট করে তাকালো। ধুপ করে পাঁচটা আঙুল মোহরের বাহুতে বসিয়ে বলল
– খবরদার জোচ্চর টার নাম নিবি না। কতো বড়ো ইতর হলে কেও এমন একটা কাজ করতে পারে ভাবতে পারিস! ওর বাবা মা এখন সত্যিই আমাকে ওর প্রেমিকা ভাবছে। অসভ্য হনুমান মুখো কোথাকার, ও কি না আমার বয়ফ্রেন্ড। হুহ্
মোহর গাল টিপে হাসলো। ওর বেশ ভালো লাগছে শ্রীতমা আর অভিমন্যুর এই ক্যাট ফাইট টা। শুরুতে তো বেশ অবাক হয়েছিলো। শেষে কি না অভিমন্যু ওকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেলো! দেখতে ছেলেটা বেশ শান্তশিষ্ট হলেও দুষ্টু অনেক। তবে এসবের মাঝে শ্রীতমার দিকে তাকালে মোহর এখন বেশ শান্তি পায়। মেয়েটা আবার আগের মতো প্রাণোচ্ছলতা, চঞ্চলতা ফিরে পেয়েছে। মনমরা শ্রীতমাকে একদম ভালো লাগেনা মোহরের।
– হলে কিন্তু খারাপ হয়না। আর এমনিতেও ওর পরিবার তো তোকে বউমা মেনেই নিয়েছে
বলে না চাইতেও মোহর শব্দ করে হেসে ফেললো। শ্রীতমা প্রথমে চোখ মুখ গরম করলেও পরমুহূর্তে মুখটা মলিন করে বলল
– ওই মানুষ দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছু বলতে পারিনি রে মহু। মানুষ দুটো খুব ভালো, সাক্ষাৎ দেবদূত। না তো একটা অচেনা অনাথ মেয়েকে কেও এতো ভালোবাসে। অথচ মানুষ দুটোকে কি না আমি ঠকাচ্ছি। ওখানে অন্য কেও হলে আমি তখনই একটা হেস্তনেস্ত করে দিতাম। কিন্তু বিশ্বাস কর ওই দুজনের শিশুসুলভ ভালোবাসা আর আদর দেখে আমি পারিনি নিষ্ঠুরের মতো সত্যটা বলে দিতে। এ কোন ঝামেলায় ফেললো আমাকে হনুমান টা
শেষোক্ত বাক্য দুটো তীব্র ক্রোধ মিশিয়ে বলল শ্রী।মোহর ওর কাঁধে এক হাত রেখে বলল
– যা হয় তা ভালোর জন্যেই। এতেও হয়তো কোনো না কোনো মঙ্গলকর কিছুই নিহিত আছে।
•••
সারাটাদিন ব্যস্তময় কেটে রাতের বেলা শরীর টা বেশ ক্লান্ত মোহরের। হসপিটাল থেকে ফিরতে আজ অনেকটা দেরী হয়েছে। তাথইয়ের ঠান্ডা জ্বর হয়েছে, বাচ্চাটাকে আজ মোহর ই রেখেছে সারাটা সন্ধ্যা। এসবের মাঝে সাঞ্জে কে খুব মনে পড়ে মোহরের। চঞ্চল হাসিটা ওর চোখে ভাসে। বার দুয়েক কল করেছিলো আজ, তবে সাঞ্জের ফোন সুইচড অফ দেখাচ্ছে। বেশ চিন্তাও হলো, ওর কলেজের হোস্টেল সুপারকে অবশেষে কল দিলে উনি খোঁজ নিয়ে জানান কলেজ থেকে ফিরেই সাঞ্জে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই মোহর আর ডেকে দিতে বলেনি, সামনে বোর্ড এক্সাম। মেয়েটা বেশ চাপের মধ্যে আছে।
বসে থাকতে থাকতেই মিথিলার সাথেও কথা হলো ওর। ঝুমুটা নাকি বেশ কথা বলা শিখেছে, সারাদিন পুতুলমোহ পুতুলমোহ করে। ছোট ছোট শব্দের ভাঙাচুরা কথাগুলো শুনতে খুব ইচ্ছে করলো মোহরের। মনে মনে ভাবলো কাল গিয়ে একবার দেখা করে আসবে, বুবুর বাড়িতে যাওয়ার সময়ই পাইনা ইদানীং।
এসব ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে দুটো হাত জড়িয়ে ধরলো ওকে, বেশ অভিমান মিশ্রিত স্বরে বলল
– সারাদিন তো রোগী নিয়ে আবার বাড়িতে এসেও একে ওকে নিয়েই থাকে। স্বামী বলে যে একটা অধম আছে কারোর তো সেটা মনেই থাকে না।
মোহর হাসলো অল্পবিস্তর। শরীরটা ঘুরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মেহরাজের গলাটা দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলল
– অধমকে আর কি করে ভুলি বলুন তো। সারাক্ষণ তো আমার মনের ভেতরেই থাকে।
মেহরাজ স্থবির চোখে তাকিয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপতা দেখিয়ে মোহরের গালে আলতো হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
– আপনাকে এতো আদর আদর লাগে কেনো মোহ! এতো মোহনীয়তা কোথায় পান। কোথা থেকে এসেছেন আপনি বলুন, কোথা থেকে
মোহর জবাব দিতে পারল না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো পাথরমূর্তির ন্যায়। মেহরাজ মুখটা এগিয়ে এনে বলল
– আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার টা কি জানেন! আমি আপনাকে তখন পেয়েছি যখন আমি আপনাকে খুঁজছিলামই না। আর আপনাকে পাওয়ার পরে বুঝলাম এই আপনিটাকেই আমার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল, খুব বেশি দরকার।
মোহর হারিয়ে যায়, মেহরাজের মিষ্টি সুবাস আর তার চেয়েও মিষ্টি উপমায় তলিয়ে যায়। মোহাবিষ্ট হয়ে ঢলে পড়ে, মন্থর গলায় বলে
– কেনো ভালোবাসেন রুদ্ধ। এতটা ভালো কেনো বাসেন!
মেহরাজ উত্তর দিলো নাহ। মোহর নিয়ে খাটের দিকে এগিয়ে গেলো। নরম বুকটার মাঝে মাথা চাপিয়ে হারিয়ে গেলো ওর শান্তির ভূবনে। ক্লান্ত স্বরে বলল
– এতো বিশাল দুনিয়াটাতে আপনার এই ছোট্ট বুকটা আমার একমাত্র শান্তির আবাসস্থল। সারাদিনের ক্লান্তি,একজীবনের পরিশ্রান্তি ভুলে যায় আমি এখানে মাথা রেখে। আমি মারা যাওয়ার আগে আপনার বুকটা যেনো শেষ ঠাঁই হিসেবে পাই মোহ, এ আমার দ্বিতীয় আবদার।
মোহর জবাব দেয়না। মেহরাজের গণনা করে রাখা আবদার গুলো ওর ভেতরটায় উদ্বেলন তোলে। বুকের মাঝে ভারী মাথাটার চাপ সহ্য করে দম বন্ধ করা অবস্থায় ও যেই শান্তিটা পায় এটা কোথাও নেই। মেহরাজ তো মুখ ফুটে বলে দিলো,কিন্তু মোহর বলল নাহ, স্বরযন্ত্রটা শব্দের ব্যবহারে প্রকাশ করতে পারলো না যে
“ আপনাকে বুকের মাঝে পেয়ে আমি যে শান্তি, যেই আবেশ টুকু পায় এ আমার এক জীবনের প্রাপ্তির খাতার সর্বপ্রথম পঙক্তি । এটাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ, আমার সবটা ধোঁয়াশা ”
…………
কতগুলো প্রহর কেটে গেছে জানা নেই। ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দের মাঝে আরেকটা শব্দ কানে এলো মোহরের। খুব ক্ষীণ সে শব্দ। ওইটুকু মাত্রার শব্দে কারো ঘুম ভাঙা সম্ভব নয়,তবে মোহরের ভেঙে গেলো। হুট করেই ঘুমটা ছুটে গেলো ওর।
আবছা আলোয় মেহরাজের মুখটা খুব নিকটে পেলো নিজের। এখনো বুকের উপরেই মাথা চেপে আছে, শান্তির ঘুমে তলিয়ে আছে নির্দ্বিধায়। মোহরের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করলো না ওকে সরিয়ে দিতে, কিন্তু তবুও সরাতে হলো। খুব ধীরে সন্তপর্ণে মেহরাজের মাথাটা বালিশে রেখে হাতটা আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে নিলো ওর শরীর থেকে। খুব সাবধানে, লম্বা সময় নিয়ে মেহরাজের থেকে নিজেকে পুরোপুরি আলাদা করেই নেমে এলো বিছানা থেকে। আবছা আলোর ঘরটা পেরিয়ে ক্ষীণ পায়ে এগিয়ে এলো বাইরে।
কারো ফুঁপানোর শব্দ ওর কানে বাজছে। মোহর সাবধান হয়, শক্ত হয়। এটাই সেই শব্দ যেটা ও এ বাড়িতে প্রথম দিন শুনেছিল। সেদিন রাতের কথাটা এখনো তরতাজা হয়ে স্পষ্ট গেঁথে আছে মোহরের স্মৃতির মানসপটে। নিগূঢ় অন্ধকারে যখন ও কারো আর্তনাদ শুনে কৌতূহলের তীরে না চাইলেও ছুটে এসেছিলো। ঠিক তখনি পেছন থেকে দুটো হাত চেপে ধরেছিলো ওকে, এখনো এখনো সবটা স্পষ্টভাবে মনে আছে।
খুব সাবধানে পা ফেলে মোহর সিড়ি বেয়ে নেমে আসলো। আস্তেধীরে এসে দাঁড়ালো একটা ঘরের পাশে। ডাইনিং বরাবর একটা জানালা ঘরটার। কান ঠেকিয়ে খুব হালকা ভাবে ভর দিয়ে মোহর শুনতে চাইলো, ভেতর থেকে একটা গলার তীব্র আকুতি-কাকুতি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আর ফরিয়াদ
” একটা বার আমার কথা শুনুন। আপনি যা বলবেন তাই হবে, কিন্তু ওকে ছেড়ে দিন। এমনটা করবেন নাহ। এটা পাপ, মহাপাপ। আর কতো পাপ করবেন! গলা অব্দি পাপে ভরে গেছে আপনাদের শরীর ”
কথাটি শেষ হওয়া মাত্র শোনা গেলো সেই গলাটারই আর্তনাদ। সর্বোচ্চ আ’ঘাতের চোটে গুঙিয়ে কাঁদলো। মোহরের সর্বাঙ্গে কাটা দিয়ে উঠলো সে শব্দে। সারা শরীরে বরফ জমে গেলো। পা দুটো আঠাবিহীন আঁটকে গেলো মেঝেতে। ওর এই অবস্থাটাকে আরও দূরূহ করে দিয়ে ক্ষীণ বাতাসে কাঁচের জানালা টার পর্দা উড়ে ফাঁক হয়ে গেলো। তৎক্ষনাৎ মোহরের চোখের সামনে ভেসে উঠলো চরম নিষ্ঠুরতম, অতর্কিত এক দৃশ্য। চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে এলো মোহরের। সারা শরীর ঝিম ধরে এলো, মস্তিষ্কটা একটা কথায় শুধু ঠাওর করতে পারলো যে, “ ভুল…সব ভুল। এতদিন যা দেখেছে সব ভুল৷ চোখের ধোকা, চোখ মন সবকিছুর ছল ”
.
.
.
চলমান
©Humu_❤️