ফানাহ্ পর্ব-৪৬

0
1419

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪৬ (প্রথমাংশ)
#হুমাইরা_হাসান

ধুকপুকানির শব্দ টা স্পষ্ট চড়াঘাত করছে কানের পর্দায়। ঢিপঢিপ করে জানান দিচ্ছে একবুক স্বপ্ন আর অনুভূতিময় আবেগ গুলো। এতদিনে! এতদিনে ও কি সত্যিই এতদূর আসতে পারলো? এত ঝড় ঝাপটা, প্রাণের উপর আঁছড়ে পরা বিপদ, ঝক্কি গুলো সামলে ও তবে স্বপ্ন সারথি’র মুখোমুখি! হাত দুটোও যেনো প্রবল উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। অনুভূতিটা এতো সংবেদনশীল, সুগ্রাহী শুধু এই জন্য না যে ও স্বপ্নের শেকড়টা আগলে ধরতে চলেছে,বরং ভেতরটা তো খাঁ খাঁ করে উঠছে সেসব চেহারা গুলো মনে করে, যারা একবুক আশা বেঁধেছিলো ওর স্বপ্ন পূরণের সাথী হবে বলে, ওর স্বার্থকতায় অবদান রাখবে বলে।
আজ তারা কোথায়! বুকভরা যন্ত্রণা, আর আহাজারি, অপূর্ণতা নিয়ে মাটিতে মিশে গেছে যে তারা। টুপটাপ এক,দুই করে অজস্র নোনাজল গড়িয়ে পড়লো পরনের অ্যাপ্রোন টার ওপর। পরক্ষণেই কেও অশ্রুভেজা মুখটাকে দুহাতের আঁজলে আগলে নিলো। মোহর চোখ বুজে নিলো কান্নার দাপটে, নিঃশব্দে ভিজিয়ে নিলো নিজের গাল,বুক সহ ধরে রাখা হাতটা। মেহরাজ আরেকটু এগিয়ে এলো, মোহরের অশ্রুভেজা দু গালে পরপর দুবার অধর ছুঁয়ে দিলো গভীর ভাবে, সিক্ত পাপড়িতে ঠোঁট চেপে ধরে বলল

– একদম না মোহ। আপনার আব্বা আম্মা আপনার সাথে না থাকতে পারলেও তাদের দোয়া,ভালোবাসা সর্বদা আপনার সাথে আছে। নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকে পূরণ করে দিবেন তাদের সকল স্বপ্ন। কিন্তু কাঁদবেন নাহ, কি বলেছি মনে নেই? আনন্দ গুলো সব আপনার, কষ্ট আর দুঃখগুলোর ভার নাহয় আমার থাক!

মোহর চোখ তুলে তাকালো মেহরাজের মুখটাতে। স্নিগ্ধ, শান্ত, সুপুরুষের শীতল শব্দ,বাক্য গুলো একটা করে প্রাণসঞ্চার করে দেয় মোহরের বুকের মাঝে। স্নেহ,আদরটুকুতে আরেকটু অভিলাষী হয়ে ঝাপিয়ে পড়লো বুকখানার মাঝে, পিঠের উপর হাত দুটো চেপে বুকের ভেতর মুখ ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে বলল

– আপনি কেনো এলেন আমার জীবনে রুদ্ধ? কেনো! আমার বহুকষ্টে নিজেকে শক্ত করে নেওয়া খোলস টা দুমড়ে মুচড়ে চুরচুর করে দিয়েছেন। আপনি এতটা কেনো আমাকে মিশিয়ে নিলেন রুদ্ধ? আপনাকে ছাড়া একটা কদম ও আমার কাছে এক একটা ক্রোশ সমান মনে হয়। বাবা-মাকে ছাড়া তো টিকে গেলাম, আপনাকে ছাড়া আমি একটুও বাঁচতে পারবো নাহ

মেহরাজ মৃদু হাসলো। মেয়েটা দিন দিন এতটা জড়িয়ে যাচ্ছে ওর সাথে মেহরাজের এখন নিজেকে সামলাতে ভীষণ পীড়ন হয়। এই যে মেয়েটা সময়ে অসময়ে জড়িয়ে ধরে, বুকের ভেতর মুখ গুঁজে দেয়,,এতে মেহরাজের ঠিক কোন জায়গা টায় জ্বলন ধরে ও কি বোঝে! তার মোহ কে নিজের ভেতর শুষে নেওয়ার অদম্য অনুভূতি গুলো যে ওকে ক্ষণে ক্ষণে ক্ষতবিক্ষত করে তা কি বোঝে মোহ? মেহরাজ দুবাহুতে হাত রেখে আলগা করে নিলো মোহরকে, ওর মুখের কাছে ঝুকে এসে বলল

– আপনাকে ছেড়ে আমি যাবো কার কাছে?
মোহ.. আপনি ছাড়া কি আদও আমার কোনো ঠিকানা আছে?

মোহর প্রত্যুত্তরে শুধু নিঃশব্দেই রইলো। মেহরাজ স্টেথোস্কোপটা নিজ হাতে মোহরের গলায় পড়িয়ে দিলো, খানিক ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে থেকে বলল

– উহম,,এবার একটু ডাক্তার ডাক্তার লাগছে বুঝলেন। না তো এভাবে চোখের পানি,নাকের পানি এক করলে শুধুই ছিচকাঁদুনেই লাগে তো

মোহর ভ্রু কুচকে নিলো। দুহাতে চোখ মুছে কপট রাগ দেখিয়ে বলল

– আমি ছিচকাঁদুনে? আমাকে তাই বললেন?

– কই আপনাকে? না তো! আর যাই বলেন আবার ভীষণ বিবিভক্ত। তার নামে এমন দুষ্টু কথা বলতেই পারিনা, ছি ছি

মোহর না চাইতেও হেসে ফেলল।মেহরাজের কথা বলার ধরণ টা অনেকটা ছোটদের মতোই লাগলো। মোহরের হাসি দেখে মেহরাজ বলল

– হ্যাঁ। ঠিক এইভাবে লক্ষী মেয়ের মতো কাজে যান তো, সকাল করে বিবিজানের হাসিমুখ না দেখলে দিন ভালো যায় না বুঝলেন!

মোহর ঠোঁট চেপে হাসলো, আস্তে করে গাড়িটার দরজা একহাতে খুলে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো মেহরাজের দিকে, মেহরাজ চাবি ঘুরিয়ে ঘাড় কাৎ করে তাকালেও পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই থেমে গেলো। হাতের আঙুল দুটো চাবির সাথেই আঁটকে গেলো, ধূসর বর্ণা আখিযুগল ঠিক সেই অবস্থাতেই থমকে রইলো। শুধু কানের পর্দায় বারংবার প্রতিধ্বনিত হলো ছোট্ট শব্দগুলো৷ “শুকরিয়া আব্রাহাম সাহেব” ।
প্রতিমাস্বরুপ চেহারাতে নিজের অজান্তেই হাতটা গালের বাঁ পাশটায় চলে গেলো। ভেজা ভেজা ঠোঁট দুটির নরম স্পর্শটা যেনো এখনো লেগে আছে। মোহর ততক্ষণে দরজা ধাক্কে চলে গেছে অনেকখানি দূরে। এলোমেলো অনুভূতির পিঞ্জরাস্থিতে আবদ্ধ মনটার ইচ্ছেতে সাঁয় দিয়ে মোহর এমন কাজটা করে ফেলবে মেহরাজ ভাবতেও পারেনি, একটা বার ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো না মোহরের যাওয়ার দিকে, যেই ঝড়টা বুকের মাঝে মেয়েটা ঠোঁটের ছোট্ট স্পর্শে তুলে দিয়ে গেছে, তা ওই চেহারাতে তাকালে আর আটকানো সম্ভব হবে নাহ, মেহরাজের গালের উপরে হাতটা রেখেই অস্থির স্বরে বলল

– বড্ড জালাতন করছেন ইদানীং মিসেস আব্রাহাম। আপনার জন্য অতিষ্ট হয়ে বাঁধ ভাংলে সামলাতে পারবেন না তোহ!

বলেই ইঞ্জিনের দাপটে বিকট শব্দে ছুটিয়ে নিলো চার চাকার পিচ ব্ল্যাক গাড়িটা। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে মুহুর্তেই হারিয়ে গেলো দৃষ্টি সীমানার বাইরে।

.

শহরের অন্যতম ব্যায়বহুল হসপিটাল। নামি দামি ডাক্তারসহ, এখানে চিকিৎসার্থে আসা মানুষ গুলোও পয়সার হিসেবে বেশ দাপটধারী। মেডিক্যালে পড়বে আর এইরকম সনামধন্য হসপিটালে কার্যরত হবার স্বপ্ন পুষবে না এমন মানুষ তো নেই। মোহর ও তাদের ই দলে, ও বরাবরই চেয়েছিলো যাতে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ টা এইখানেই পাই। আর ওর দোয়া কবুল হয়ে সেই সুযোগ টাকেই হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলো মোহর।
ভেতরে ঢুকতেই রিসিপশনের কাছে শ্রীতমাকে দেখতে পেলো। মোহরকে দেখেই এগিয়ে এলো ও, উত্তেজিত হয়ে বলল

– এতক্ষণে আসলি, জানিস আমার কতো চিন্তা হচ্ছিলো। আমিতো ভাবলাম আমি আবার স্বপ্ন দেখেই এখানে চলে এলাম নাকি। আমিতো কাল পূজো ও দিয়েছি এর জন্য। তুই এলি, আমার বুকটা এখন হালকা হলো

শ্রীতমার ভেতরের চাপা উত্তেজনা গুলো যেনো আর বাঁধ মানছে না। মোহর আশপাশে তাকিয়ে বলল

– আস্তে আস্তে, এতটা এক্সাইটেড হোস না। এটা হসপিটাল। জোরে কথা বললে প্রথম দিনেই আমরা রেড ফ্ল্যাগ পাবো।

শ্রীতমা ঘনঘন ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। দুজন মিলে এগিয়ে গেলো ওদের কাঙ্ক্ষিত জায়গা টিতে। শুরুতেই যেই চেহারা টা আগে চোখে পড়লো। এই মানুষটাকে, এই চেহারাটাকে মোহর এতদিন খুঁজেছে, কোথায় ছিলো মানুষটা এতদিন! সেদিন গাড়ির ভেতর দেখার পর আর একবার ও চোখে পড়েনি!
মোহর আর শ্রীতমা এগিয়ে যেতেই স্পষ্ট গলার, নিয়মমাফিক কণ্ঠস্বরটা কানে এলো

– গুড মর্নিং, ওয়েলকাম।

মোহর আর শ্রীতমা ভদ্রতা সুলভ জবাব দিলো। ফায়াজ শরুতেই ওদেরকে নিয়ে বাকি ইন্টার্নি শিক্ষার্থীদের সাথে সবটা বুঝিয়ে দিতে দিতে ওয়ার্ড ভিজিট করালো। গ্রুপের ছেলেমেয়েদের একত্রে ওয়ার্ড চেক করিয়ে, আনলো অথরিটির মিটিং রুমে।
বলা বাহুল্য ড.ফায়াজ করিম এই হসপিটালের সিনিয়র ডক্টর, আর মোহর ওর আন্ডারেই অ্যাজ অ্যা অ্যাসিস্ট্যান্ট ডক্টর হিসেবে যোগদান করবে। অথরিটি মিটিংয়ে এমনটাই ঠিক হলো। মিটিং সহ অন্যান্য ফরমালিটিস কমপ্লিট করে বেরোতে বেশ অনেক সময় পার হয়ে গেলো। ডক্টর’সরা ব্রেক এ গেলে, ফায়াজ ওর একজন সহকর্মীর সাথে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছিলো, তখনই পেছন থেকে ডাক পড়লো,

– স্যার!

ফায়াজ হাঁটা থামিয়ে দাঁড়ালো। সাথে দাঁড়ালো পাশের লোকটিও। ফায়াজকে ডাকা মানুষটার চেহারার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে বলল ড. কে এগোনোর কথা বলে নিজে একাই এগিয়ে এলো মোহরের সামনে। মোহর ফায়াজকে বলল

– স্যার আপনাকে ফোনে পাওয়া যায়নি এতদিন

ফায়াজ খানিক নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটার সকল নাড়ি নক্ষত্র ওর ও কম জানা নেই। কতগুলো বছর ধরে দেখে আসছে, ওর যে দরকার ছিলো ফায়াজের সাথে কথা বলার তা স্পষ্টভাবে বলবে নাহ। তাই ফোনের কথাটি বলেছে, ফায়াজ গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই বলল

– হ্যাঁ আমি ইমার্জেন্সিতে দেশের বাইরে গেছিলাম কিছুদিনের জন্য।

মোহর হাসফাস করতে থাকলো। কি দিয়ে কিভাবে বলবে ও? তিয়াসার কথাটা জিগ্যেস করা কি উচিত হবে? তিয়াসা ফায়াজের সাথে কেনো ছিলো, ওরা কিভাবে একে অপরের সাথে পরিচিত এটা জিগ্যেস করা কি উচিত হ? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মোহর লক্ষ্য করলো ফায়াজের চোখ মুখের গাম্ভীর্য। কথা বলার ধরণ। অন্যরকম, অচেনা লাগছে মানুষটাকে, পরক্ষণেই নিজের মত পালটে নিলো, সৌজন্য মুলক হেসে বলল

– কলেজে আপনাকে দেখিনি তাই জিগ্যেস করলাম। তেমন কিছু নয়, আপনাকে দেরী করানোর জন্য দুঃখিত স্যার।

ফায়াজ মৃদু ঘাড় নাড়িয়ে এগিয়ে যেতে নিলেও দু কদম এগিয়ে থেমে যায়। দেহ বাকিয়ে মোহরের দিকে ফিরে বলে

– সকাল ৯ টার মধ্যেই চলে আসবে কাল থেকে। তুমি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডক্টর, ফোকাস শুধুমাত্র আমার দেওয়া কাজগুলোর ওপরেই থাকবে, ওকে?

মোহর বিব্রতবোধ করলেও প্রকাশ করলো নাহ। তবে ফায়াজ আর দাঁড়ালো নাহ। ও সরে যেতেই মোহর ও চলে আসলো অন্যদের জাগায়। সব কাজ শেষে, শ্রীতমার সাথে ফিরতে অনেকটা দেরী হয়ে গেলো।

দুজন মিলে হসপিটাল থেকে যখন বেরিয়েছে, তখন বেলা পেরিয়ে গেছে অনেকটা। শ্রীতমা আর ও একসাথে বেরিয়ে এলে বাইরে আসতেই পরিচিত একটা চেহারা দেখে শ্রীতমার চোখ চিকচিক করে উঠলো। ও মোহরকে রেখেই এগিয়ে গেলো, সউৎসাহে বলল

– এই যে আপনি! পেয়েছি, আপনি আগে বলুন কাল আমাকে ভরা রাস্তায় ওভাবে অপমান করার সাহস হলো কি করে আপনার! হ্যাঁ? কি মনে করেন নিজেকে? কাল অপমান করে হয়নি আজ এখানেও খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছেন আমাকে অপদস্ত করতে হনুমান মুখো কোথাকার!

ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় হুট করেই তীক্ষ্ণ স্বরে চমকে উঠলো অভিমন্যু। চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত চেহারাটা দেখে বিস্মিত হলেও শ্রীতমার মুখ থেকে নিঃসৃত কথা গুলো শুনে বিরক্ত হয়ে গেলো। চশমাটা চোখ থেকে খুলে ধমকে বলল

– এই আপনার সমস্যা টা কোথায় হ্যাঁ? আমি যেখানেই যাই সেখানেই আগে আগে টপকে পরেন কেনো আপনি? আর সবসময় এমন চিল্লাচিল্লি করেন কেনো? মাথায় সমস্যা আছে?

শ্রীতমা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো এরূপ কথায়। ও কিছু বলবে তার আগেই অভিমন্যু আঙুল তুলে বলল

– দেখুন এটা রেপুটেড প্লেস। একদম ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচামেচি করবেন নাহ

শ্রীতমা প্রচণ্ড রাগে, অভিমন্যুর হাতের চশমাটা একটানে ছিনিয়ে নিয়ে দু খণ্ড করে রাস্তার মাঝে ফেলে দিলো। ক্ষিপ্ত স্বরে বলল

– আমাকে যদি আর একবার ষাঁড় বলেছেন, তাহলে এই চশমার মতো আপনাকেও ভেঙে ফেলবো আমি

– আপনা…

– কি হচ্ছে এসব! কি শুরু করেছো দুজন?

তুমুল ঝগড়ার রেশ টা মাঝপথেই আঁটকে গেলো। মোহরের উপস্থিতিতে অভিমন্যু তড়িত বেগে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। নিচু স্বরে কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নেবে তখনই শ্রীতমা বলল

– এই যে। এই চামচা টাইপ লোকটা, কাল আমাকে ভরা রাস্তায় অপমান করেছে। লোকজনের সামনে আমার মুখের সামনে গ্লাস লাগিয়ে গাড়ি নিয়ে পালয়েছে যাযাবর লোক।

মোহর বিহ্বলিত হয়ে অভিমন্যুর দিকে তাকালো, অভি মোহরের এহেন দৃষ্টি দেখে অপ্রস্তুত হয়ে বলল

– ম্যাডাম উনি ভুল বলছেন। উনি একা যাচ্ছিলেন দেখে আমি উনাকে লিফট দিতে চেয়েছিলাম,কিন্তু তার বদলে উনি রাস্তার মাঝে চ্যাঁচামেচি শুরু করেছিল।সবাই আড়চোখে দেখছিল ব্যাপারটা, তাই আমি সরে এসেছি।

– হ্যাঁ তো আপনি কেনো আমার মুখের উপর..

– শ্রী!

মোহরের শান্তস্বরে শ্রীতমা চুপ করে গেলো। আর কিছু বলার সাহস করলো নাহ। যেহেতু এটা ঝগড়া করার পার্ফেক্ট প্লেস না তাই চুপচাপ দমে গেলো। লোকটাকে তো পরে শায়েস্তা করবে।

_________________________

ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজমান ঘরটা জুড়ে পিনপতন নীরবতা। কে বলবে একটু আগেই এই ঘরটা জুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে কেও। উপরটা যতটাই শান্ত চোখ দু’টো নামিয়ে নিচে তাকালেই ফ্লোর ভর্তি ভাঙা কাঁচের টুকরো, কাগজ, সোপিচ সহ ঘরভর্তি জিনিসের বিধ্বস্ত অবস্থাটা চোখ ধাঁধিয়ে দেবে।
ঘরের এক কোণায় বসে ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে তিয়াসা। বা হাতটার তালু আর তার উপরের অংশ জুড়ে ব্যান্ডেজের আস্তর। সফেদ কাপড়ে ঢাকা ব্যান্ডেজের ভেতরের অবস্থাটা কতটা নির্মম,বিভৎস তা নিজ চোখে দেখা মানুষগুলোই শুধু বুঝতে পারবে, চোখ বন্ধ করে ফেলে তিয়াসা, মনে পড়ে যায় সেদিনের কথাটা

তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে যখন গলার স্বর ভেঙে যাওয়ার অবস্থা ঠিক তখনি জ্বলন ধরা জায়গাটাতে ঠান্ডা পানি ঢেলে দেয় মেহরাজ। গলা কা’টা মুরগীর মতো ছটফট করছিলো তিয়াসা বাঁধা অবস্থাতেই। সেই অবস্থা যন্ত্রণা থেকে যেনো প্রাণ ভরা শান্তি পেলো তিয়াসা। মেহরাজ ওর ক্ষত স্থানে সাদা গুড়ো পাউডারের ন্যায় কতখানি নিউট্রিলাইজার পাউডার ছিটিয়ে দিলো। তিয়াসা প্রচন্ড বিধ্বস্ত শরীরে গা এলিয়ে দিলো, মেহরাজ তখন হিসহিসিয়ে বলল

– এবার শুধু হাতটা দিয়েই ছেড়ে দিলাম। এরপর থেকে আমার মোহকে ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে যে মস্তিষ্ক ছক করবে সেই মস্তিষ্কটাকেই আমি অ’কেজো করে দেবো, এ্যন্ড আই মিন ইট্

ধপ করে চোখ খুলে তাকালো তিয়াসা। সেদিনের যন্ত্রণা, কষ্ট, আত্মচিৎকার গুলো যেনো ভেতর ভেতর হুংকার দিয়ে উঠছে একটু পরপরই। খাট থেকে ফোনটা তুলে, উদ্ভ্রান্তের ন্যায় চেপে কানে ধরলো গত দুইদিনের মতো এবারও একই জবাব

‘ the number you’re trying is currently unreachable ‘

চিৎকার করে ফোনটা ছু’ড়ে ফেলল তিয়াসা, দাঁতে দাঁত চেপে বলল

– বা’স্টার্ড, কাওয়ার্ড! একবার তোকে হাতের কাছে পাই। যেই কাজটা দিয়েছিলাম সেটা তো করতে পারেইনি বরং আমাকে ম’রতে দিয়ে পালিয়েছে শুয়ো’রের বাচ্চা
.
.
.
চলমান

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪৬(মধ্যাংশ)
#হুমাইরা_হাসান

– আপনারা এখনও চুপ করে আছেন? নিজের মেয়ের উপর এত বড়ো অন্যায় আমি কিছুতেই মেনে নেবো না মুর্তজা সাহেব

– চুপ থাকা ছাড়া তো আর কোনো রাস্তা দেখছি না

ধপ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ওয়াকিফ চৌধুরী, গায়ে জড়ানো পাঞ্জাবি টায় হাত বুলিয়ে টান করে আঙুল উঁচিয়ে বললেন

– প্রথমেই আপনারা আমার মেয়ের এতদিনের স্বপ্ন চুরমার হতে দেখেও কোনো স্টেপ নেননি, এরপর মেহরাজ দিনের পর দিন আমার মেয়েকে অপমান ও করেছে অনেক ভাবে। সেসব তো ছিলোই ওর সাহস হলো কি করে আমার মেয়ের হাতে এ’সিড ঢেলে দেওয়ার! এতো বড়ো সাহস! তিয়াসা আমার মেয়ে,আমার আদরের রাজকন্যা। ওর উপর কোনো আঘাত আমি ওয়াকিফ একচুল সহ্য করবো না বলে রাখছি

– তাহলে কি করতে চান আপনি?

গলার স্বর শক্ত করেই প্রশ্ন ছুড়লো আরহাম। কপালে তার অসংখ্য বলিরেখার ভাঁজ। এয়ারকন্ডিশনের আওতায় থাকা রুমটাতে বসেও কপালের ভাঁজে তার ঘামের ছোট বিন্দু অজস্র। চেহারায় রাগ,বিরক্তি আর দুশ্চিন্তা মিলিয়ে ত্রৈধ এক ছাপ ফেলেছে, ওয়াকিফ চৌধুরী শাণিত চোখে তাকালো একবার আজহার মুর্তজার দিকে, হয়তো তার থেকে এই প্রশ্নের জবাব টা তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন, তবে আজহারের নীরবতায় আরও তেঁতে উঠলো চড়া মেজাজ টাহ, আরহামের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল

– যা আপনারা করতে ভয় পাচ্ছেন তাই করবো প্রয়োজনে। মনে রাখবেন মেহরাজকে আপনারা সমীহ করে চললেও আমি নম নম করতে পারবো না, এমনিতেও ব্যবসায় আমি কোনো প্রফিট পাচ্ছি নাহ

– ব্যবসাতে কি প্রফিট একা আপনার যাচ্ছে নাকি আমাদের ও? কি বলতে চাচ্ছেন আমরা আপনাকে ঠকিয়ে নিজেদের পকেট ভরছি?

– মেহরাজ আর আপনাদের পকেট তো আলাদা দেখছি না। রিয়েল এস্টেটের যে নতুন টেন্ডার টা ধরলেন, ওটাতে কম হলেও কোটি টাকার লাভ, এগুলো আপনাদের পকেটে যাবে না বলছেন?

আরহাম মুর্তজার ভ্রু যুগল ব্যপক ভাবে কুঞ্চন হলো, চেহারাটায় রাগের লালাভ, কটমট করে বলল

– রিয়েল এস্টেটের সাইড টা মেহরাজের একার, মেহরাজ ওর শেয়ারের প্রোপার্টি থেকে ইনভেস্ট করেছে, আর মি.রায়ান গসলি অনেক আগে থেকেই মেহরাজের শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন তাই ওর আমাদের সাহায্য দূর আমাদের একবার বলার ও প্রয়োজন হয়নি।

ওয়াকিফ চৌধুরীর ক্রুর হাসলেন, তাতে তাচ্ছিল্যের রেশটুকু স্পষ্ট বিদ্যমান। এবার বেশ শান্তভাবে হলেও তীক্ষ্ণ গলায় বললেন

– ওর শেয়ারের! হাসালেন মুর্তজা ব্রাদার্স, সবই তো ওর আপনারা হলেন উড়ে এসে জুড়ে বসা, মেহরাজ একবার মত ঘুরিয়ে নিলে সব ফাঁকা। যাকে বলে কাক হয়ে কোকিলের ডিমে তা

বলেই সশব্দে হেসে উঠলো। মাঝারি গড়নের শরীর টা দুলে উঠলো বিকটভাবে। আরহাম ক্ষিপ্ত হয়ে দু কদম এগিয়ে গিয়ে বলল

– মুখ সামলে কথা বলুন। এই সম্পত্তি,টাকা ব্যবসা শুরু থেকেই আমাদের ছিলো। আমাদেরই থাকবে। মেহরাজ আমাদের সন্তান তাই এসবে ওর ও সমান হক থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

– আপনি কাকে কোনটা বোঝাচ্ছেন আরহাম, আমাকে? সব ইতিহাস আমার জানা আছে, আমার সাথে ভাউতাবাজি একদম না

আরহামের মেজাজ টা উর্ধ্বে চলে গেলো। ওয়াকিফ চৌধুরীর বলা প্রতিটি কথা যেনো শূলের মতো বিঁধছে শরীরে। আবারও চড়া গলা তুলবে তার আগেই ধমকে উঠলেন আজহার৷ এতক্ষণ নিশ্চুপতা দেখিয়ে ওদের বাকবিতন্ডা শুনলেও এবার ক্ষোভে তপ্ত মেজাজে বললেন

– আহ, কি হচ্ছে কি! দুজন মিলে রেষারেষি করছো কেনো। নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করে কোনো সমাধান হবে নাহ

– নিজেদের মধ্যে ঝামেলা তো অনেক আগেই করে ফেলেছেন। আমার মেয়ের সাথে এতো বড়ো কাজটা করার আগে ভাবা উচিত ছিলো

আজহার মুর্তজা বসা থেকে দাঁড়ালেন। হাতের ফোনটা পকেটে পুরে বললেন

– দেখুন তিয়াসার সাথে যা হয়েছে তাতে আমরা দুঃখিত। কিন্তু এর সাথে আমাদের কোনো যোগসূত্র নেই। ওরা নিজেরাই নিজেদের ঝামেলা ডেকেছে। আমি এর আগেও তিয়াসাকে বুঝিয়েছি। আমি বলেছি ধৈর্য্য ধরতে, সাপের লেজে পা দিলে ছোবল খেতে হবে এটা ওর ও জানা ছিলো।

– তাহলে শুধু আমার মেয়ে কেনো? আপনাদের…

– ওকে আমরা নিজেরাই খোঁজ করে পাচ্ছিনা। কুজাত টাকে হাজার বার নিষেধ করেছি, ওর যেনো সহ্য হয়নি আর। এখন গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে, ওর জন্য আমাদের টেন্ডার আঁটকে আছে

– টেন্ডারের কথা ভুলে যান। কারণ অবস্থা যা দেখছি তাতে আপনাদের এই জা’লিয়াতির মেয়াদ খুবই স্বল্প

ক্ষীণ বিরতি নিয়ে আবারও বললেন ওয়াকিফ

– আমার মেয়ের হাতের চামড়া এখনো দগদগ করছে, আমি এর শোধ কড়াই গন্ডায় চুকিয়ে নেব। বেস্ট অফ লাক!

বলেই গটগট করে বেড়িয়ে গেলো। ওয়াকিফ বের হতেই আরহাম পা দিয়ে জোরে শব্দ করলো, তিক্ত মেজাজে চড়াও গলাটায় বেশ ক্ষুব্ধতা সহিত বলল

– এক ঝামেলা নিয়ে কূল পাইনা আবার আরেকজন। আমার আর এতো কিছু সহ্য হচ্ছে না ভাইজান। জলদি কিছু একটা করতে হবে, না তো একূল ওকূল সব হারাবে।

আজহার মুর্তজার চেহারায় প্রচন্ড দুশ্চিন্তার ছাপ। চুলহীন কপাল টার ঘাম রুমালে মুছে বলল

– ওই ইতরের ছা টাকে আগে খোঁজ করো। দুই ইঞ্চির কলিজা নিয়ে মেহরাজের বউয়ের গায়ে হাত দিতে ওর বুক কাঁপেনি? এখন কেনো গা ঢাকা দিয়েছে। ওটাকে যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে আনার চেষ্টা করো।

_________________________

সময়টা বিকেলের ৪ টা, মোহরের শিফট শেষ, ওয়ার্ড গুলো সব ভিজিট করে বের হলো কেবিন থেকে। হসপিটালের আজ দ্বিতীয় দিন, কোনো প্রকার র্ঝঞ্ঝাট ছাড়াই বেশ সুন্দর কেটেছে অভিজ্ঞতার দ্বিতীয় দিনটা, সব রোগীদের ডিটেইলস এর ফাইলটা হাতে করে মোহর হাঁটা ধরলো ফায়াজের কেবিনে। এটা দিয়ে আসতে পারলেই আজকের মতো ওর কাজ শেষ। মৃদুমন্দ পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে কেবিনের সামনে এসে দরজা টায় আলতো আলগা করে মোহর বলল

– আসতে পারি স্যার?

এটুকু বললেও বাকি কথা কণ্ঠনালীতে আঁটকে গেলো, বিস্ফারিত নয়নে চেয়ে রইলো সামনের দুজনের দিকে। অপ্রত্যাশিত,ধারণাতীত দৃশ্য দেখেই পা আঁটকে গেলো। অপ্রকৃতস্থ চেহারাতে তাকিয়েই রইলো, ওর অপ্রতিভ চেহারাটা খুব একটা আমলে নিলো না ফায়াজ, সোজা থেকে গা এলিয়ে দিলো অফিস চেয়ারটাতে। চোখের ইশারায় মোহরকে আসতে বললে, মোহর অপ্রস্তুত চেহারাতেই এগিয়ে গেলো। ওর সামনেই বসে থাকা দ্বিতীয় জন ফোনে ব্যস্ত থাকায় এখনো মোহরের চেহারাটা দেখতে পারেনি। মোহর এগিয়ে যেতেই ফায়াজ হাত বাড়ালো, অপরপক্ষের নিস্ক্রিয়তা দেখে ফায়াজ গলা খাকারি দিয়ে বলল

– এহেম এহেম!

মোহরের ধ্যান ফিরলে ও হাতের ফাইলটা এগিয়ে দিলো। আড়চোখে তাকালো পাশের মানুষটার দিকে।

– বাবা ফোন দিয়েছে ভাইয়া, আমি যাচ্ছি। তুমি সন্ধ্যায় আসবে কিন্তু

বলে পাশে তাকালো, ঠিক কিছুক্ষণ আগে মোহরের চেহারাতে যেরূপ অভিব্যক্তি ছিলো, একদম সেটাই ছড়িয়ে পড়লো তিয়াসার চোখে মুখে। বিজড়িত চোখে একবার মোহরের দিকে তাকিয়ে আবার ফায়াজের দিকে তাকালো, তিয়াসার সকৌতুক দৃষ্টিকে লক্ষ্য করে ফায়াজ বলল

– সী ইজ মোহর, মোহর শিকদার। আমার নতুন অ্যাসিস্ট্যান্ট। তোমার কলেজেরই, জুনিয়র। চেনো নাকি?

তিয়াস অপলক তাকিয়ে রইলো খানিক মোহরের চেহারাতে, আগাগোড়া পরখ করলো ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে। যেই দৃষ্টির ফাঁকে হিংসার রেশটুকু স্পষ্ট বুঝতে পারলো মোহর। ভীষণ দাম্ভিকতার সহিত উঠে দাঁড়ালো, শক্ত গলায় বলল

– আমার কলেজে অনেক গেঁয়ো, বস্তির লোকজন ও পড়তে আসে। প্রয়োজন নেই যে আমি সবাইকে চিনবো

বলে ফায়াজের দিকে না তাকিয়েই ছোট করে ‘আসছি’ বলে বেরিয়ে গেলো খটখট শব্দ করে। মোহর তিয়াসার যাওয়ার পানে তাকালে ওর ব্যন্ডিজে আবৃত হাতটা দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো।

– বোসো মোহর

ফায়াজের কথায় ধ্যান ফিরলে, ও ধাতস্থ হয়ে চুপচাপ ফায়াজের সোজাসুজি রাখা চেয়ারটাতে, মোহর বসলো নতমস্তকে। ফায়াজ ফাইল দেখার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে তাকায় বারংবার মোহরের দিকে৷
ওর পদ্মলোচন আঁখিদ্বয়, পাতলা পাপড়ির ন্যায় ওষ্ঠ, টানা টানা ভ্রুর নিচের কৃষ্ণাভ চোখ দু’টোর চঞ্চলতা সবটা, সবটা যেনো বৈরাগী আবহাওয়ার মতন অন্তরের ভিতটাকে নাড়িয়ে দেয় ফায়াজের। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে, বুকের বাঁ পাশটায় তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাভূত হয়। ঠিক যেমনটা হয়েছিলো বছর চারেক আগে। নিশ্চুপ, শান্তশিষ্ট, গম্ভীর কিশোরীকে দেখে। ওই পাতলা মুখ, নরম গাল, ভরা ভরা চোখ দু’টোর প্রতিচ্ছবি এখনো ফায়াজের মুখে ভাসে। ভেতরটা সুনসান শ্মশানের মতো হীম হয়ে আসে। হুট করেই ভাবনাচ্যুত হয় ফায়াজের. . ফোনের রিংটোনে ধাতস্থ হয়ে ফাইলটা হাত থেকে নামিয়ে রাখে, নরম গলায় বলে

– কাজ কেমন লাগছে মোহর?

– ভালো লাগছে স্যার

মোহরের সদা সর্বদার ন্যায় ছোট ছোট উত্তর। ফায়াজ হাসে মৃদু,ওর ফর্সা চেহারাটায় অদ্ভুত ক্লান্তির ছাপ বিদ্যমান হয়, নিষ্পলক চেয়ে বলে

– এখনই ফিরে যাবে?

মোহর ঘাড় তুলে ভ্রু গুঁটিয়ে বলে

– জ্বী?

– তোমার ডিউটি শেষ হয়েছে। এখন ফিরে যেতে পারো

মোহর হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে, আরও কিছু কথা বার্তা সেরে উঠে আসলো। শ্রীতমাটার শিফট আজ আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন ওর একাই ফেরা লাগবে। হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে একদম গেটের সামনে এলেই দেখতে পেলো কাঙ্ক্ষিত গাড়িটা, আর তার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন চেহারা। অধর যুগল প্রসারিত হলো, মিষ্টি হেসে লাজুক চেহারায় এগিয়ে গেলো।
ও যেতেই মেহরাজ হাত থেকে অ্যাপ্রোন টা নিজের হাতে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিলো, মোহর উঠে বসতেই নিজেও গিয়ে পাশে বসে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল

– কেমন কাটলো আপনার সেকেন্ড ডে বিবিজান।

মোহর হাসলো মৃদু, প্রাণহরার চেহারাটায় চোখ ভরে তাকিয়ে থেকেই বলল

– ভালো, খুব ভালো

দেখতে দেখতে দৃষ্টির সীমানার বাহিরে চলে গেলো গাড়িটি, তার সাথে দুটো মানুষ। আর সেই দৃশ্যে চাতক পাখিত মতো চেয়ে রইলো এক জোড়া চোখ। কত সাধ ছিলো, স্বপ্ন ছিলো। প্রাণহারীনিকে ওর ঘরের রাণী করবে, খুব যত্নে এতগুলো বছর যার জন্যে এক জীবনের সুপ্তাকাঙ্ক্ষা গুলো জিইয়ে রেখেছিল. . অবশেষে সে কি না অন্য কারো! যার হাসির দিকে চেয়ে মাতোয়ারা হয়েছিলো বহু আগেই, হৃদমন্দিরে সুবর্ণখচিত অক্ষরে যার নামের প্রতিমা স্থাপন করেছিল সে কি না আজ অন্য কারো সঙ্গী! তার অংশ! তার,সবটাই অন্যের? ছোট একটা মুক্তোদানার ন্যায় চিকচিকে তরলে চোখের কোণ ভরে উঠলো, পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই, তাহলে সে কেনো কাঁদছে! কার জন্য? যার মনে তার প্রতি নূন্যতম কোনো স্থান নেই?

______________________

– এত কি ভাবছো বনু

তাথই অবিচলিত চোখে তাকালো, বৃদ্ধা পায়ে তেল ঘষে দিতে দিতে বলল

– নাহ, কি আর ভাববো

শাহারা বেগম পা গুটিয়ে নিলেন। আরাম করে হেলান দিয়ে বসে বললেন

– হ্যাঁ ভাবছো তো। বলো আমাকে আমিও শুনি

তাথই তেলের বাটি টা সরিয়ে রাখলো, নড়েচড়ে বসে বেশ আনমনা হয়ে বলল

– স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার পর একটা মেয়ের জীবন ওখানেই থমকে যায়, তাই না দিদা?

তাথইয়ের মলিন মুখটাই দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইলেন শাহারা বেগম। ক্ষীণ হেসে বললেন

– বোকা মেয়ে। জীবন কি আর এত সহজেই শেষ হয় নাকি! যতদিন হায়াত আছে ততদিনই বাঁচতে হয়। সম্পূর্ণ অধিকার, সুখ-শান্তি, ভালোবাসা নিয়েই বাঁচতে হয়। আমরা ছোট্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভেঙে পড়ি,ভাবি জীবন হয়তো এখানেই শেষ। কিন্তু হবে তাই-ই যা সৃষ্টিকর্তা নির্ধারিত করে রেখেছেন। আমাদের জীবনের প্রতিটি ভুল, দূর্ঘটনা এক একটা শিক্ষা। যা আমাদের জীবনকে ওখানেই থামিয়ে দেয়না,বরং সঠিক আর ভুলটা উপলব্ধি করিয়ে সামনের পথে এগিয়ে যাওয়া নূতন একটা রাস্তা তৈরী করে দেয়।

তাথই নীরব রইলো। সবকিছু কেমন এলোমেলো মনে হচ্ছে। কোনো দিশা, কোনো মঞ্জিল খুঁজে পাচ্ছে না। ভেতর টা থেকে থেকে মুষড়ে উঠছে, শাহারা বেগম হয়তো কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারলেন নাতনীর ভেতরের অবস্থাটা, ওর মাথায় হাত দিয়ে বললেন

– চলার পথে ভালো খারাপ দুটোই থাকবে বনু, খারাপ টার জন্য সাময়িক দুঃখ হলেও ওর জন্য ভালোকে হেলাফেলা করে দূরে সরিয়ে দেওয়া টাই সবচেয়ে বড়ো ভুল। অতীত সবারই থাকে, কিন্তু ওটা ভুলিয়ে নিজেকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার অধিকার সবার আছে, সুখে থাকা আমাদের মৌলিক চাহিদার চেয়ে কম না। খাবার,বাসস্থান, চিকিৎসা,শিক্ষার মতো সুখটাও আমাদের মুখ্য খোরাক। বেঁচে থাকতে হলে সুখে থাকাটা ভীষণ দরকার।

তাথই মৃদু হাসলো। দিদার দিকে তাকিয়ে হুট করেই জড়িয়ে ধরলো তাকে, ক্ষীণ গলায় বলল

– আমি তোমাদের সাথে কতই না খারাপ ব্যবহার করেছি তাই না দিদা? তবুও তো তোমরা আমাকে ভালোবাসো। এটাও তো ভালো, খারাপ কে ভুলিয়ে এই তোমাদের মতো ভালোর সাথেই তো আমি সুখে আছি।

শাহারা বেগম জড়িয়ে ধরলেন আদরের নাতনীকে। কপালে স্নেহভরা চুমু দিয়ে পরম মমতাময়ী গলায় বললেন

– আল্লাহ তোমাকে সেই সকল সুখের ভাগীদারী করুক যা তোমারই হওয়ার কথা ছিলো। ভাগ্য তোমায় রামধনুর মতো রাঙিয়ে দিক পবিত্র ভালোবাসায়।

.

গরম কফি কাপে ঢেলে সেটা ট্রে তে তুলে নিলো। সাথে একটা চায়ের কাপ। রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে সোফার উপরে আম্বি খাতুনকে বসা অবস্থায় দেখলে এগিয়ে গিয়ে ট্রে টা সেন্টার টেবিলে রেখে চায়ের কাপটা তুলে বলল

– মা?

মেয়েলী গলায় মা ডাকটা শুনে ছ্যাত্ করে উঠলো ভেতরটা, চোখ খুলে তাকাতেই স্নিগ্ধ একটা মুখ ভেসে উঠলো চোখের সামনে। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো এই মা ডাকটাতে যেনো দুনিয়ায় সমস্ত সুখ,আনন্দ, তৃপ্তি খুঁজে পেলেন আম্বি খাতুন। মখমলি নরম আবেশে ভেতরটা ভরে গেলেও তার স্থায়িত্ব হলো ক্ষীণ সময়ের। পরক্ষণেই মুখ খানা শক্ত,গম্ভীর করে নিলো। সেসবকে অগ্রাহ্য করে, মা বলে ডাকা স্বরটা তার নরম পালকের মতো গলায় আবারও বলল

– আপনার মাথা ব্যথা করছে বলে আমি আদা চা করে এনেছি মা। এটা খেলে ভাল্লাগবে

বলে আম্বি বেগমের হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিলো, ভদ্রমহিলার প্রত্যুত্তর বা অভিব্যক্তির অপেক্ষা না করে, একটা ছোট্ট কৌটার ভেতর থেকে সামান্য মলম আঙুলের ডগায় তুলে খুব সন্তপর্ণে কপালের দুপাশে লাগিয়ে দিয়ে বলল

– চা খেয়ে একটু রেস্ট করুন মা, কমে যাবে।

বলেই ঠিক যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই চলে গেলো। শুধু রেখে গেলো একঝাঁক মিষ্টি আবেশ, মাধুর্য আর প্রাণভরা স্নেহ। আম্বির চোখ দু’টো খুব অজানা কারণেই ভরে এলো, চায়ের কাপটা হাতের কম্পনের সাথে কেঁপে উঠলো। শুধু বিড়বিড়িয়ে এইটুকুই বলল

– আমাকে খোদা দুনিয়ায় সবচেয়ে অসহায়দের একজন বানিয়েছে রে, আমাকে ক্ষমা করে দিও পারলে।

মোহর কফির মগটা এনে রাখলো মেহরাজের পাশে, সরে যেতে গেলেও টান পড়লো হাতের কব্জিতে। সপ্রতিভ হয়েই তাকালো মোহর,মেহরাজ মোহরের হাতটা টেনে ওকে নিজের কাছে আনলো, পাশে বসিয়ে চোখ দু’টো ল্যাপটপে রেখেই বলল

– কি ভাবছেন এত বলুন তো? কি জানতে চান আপনি?

মোহর কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। পাশে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল

– কই কিছুই তো না!

মেহরাজ এবার আঙুল টা থামালো। ঘাড় কাৎ করে মোহরের দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে বলল

– আমার কাছে লুকাচ্ছেন? পারবেন লুকাতে?

মোহর অপ্রতিভ হলো। খানিকটা আড়ষ্ট হলো, এই মানুষটা কি করে বুঝে ফেলে সব? এটা কি কোনো যাদুটোনা নাকি ম্যাজিক! তা ওর বোধগম্যতার বাহিরে।
মোহর স্থৈর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেহরাজকে বলল

– যা জানতে চাই তা কি জানাবেন আপনি?

মেহরাজ কিঞ্চিৎ ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। মোহরকে নিজের কাছে সরিয়ে এনে বলল

– শুধু বায়োলজিই তো পড়লেন এতদিন, ম্যাথ কেমন পারেন?

সম্পূর্ণ অহেতুক একটা ব্যাপার তুলে আনার কারণটা বোধগম্য হলো না মোহরের, কপালে সরু ভাঁজ ফেলে বলল

– ম্যাথ! হঠাৎ?

– পিথাগোরাসের নাম তো শুনেছেন?

মোহরের বিজড়িত, কৌতূহলী চোখে চেয়ে মেহরাজ ল্যাপটপের সাটার নামিয়ে দিতে দিতে বলল

– বিখ্যাত গণিতবিদ পিথাগোরাসের একটা সূত্র আছে জানেন? যদিও অনেক সূত্রই আছে, তার মধ্যে একটা হলো ” তোমার যা বলা উচিত, তাই তুমি বলবে। আর তোমার যা শোনা উচিত না তা তুমি কখনো শুনবে না ” এবার বলুন তো আপনি যা জানতে চান তা কি আদও আপনার শোনা উচিত?

মোহর বেশ কয়েক মুহুর্ত নীরব, স্থবির , অনড় তাকিয়ে রইলো মেহরাজের মুখে। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো ওর সামনে বসে থাকা এই মানুষটা, যে কি না ওর স্বামী যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় একটা মানুষ মনে হচ্ছে এখন ওর। প্রতিটি কথা, কাজ, আর দৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজেও যেনো রহস্য। ধূসর চোখ দু’টিতে আস্ত একটা অজানা রাজ্যের উপস্থিতি। যা প্রতিটি মুহুর্তে, প্রতিটি সময়ে মোহরের জ্ঞান আর চক্ষুর আড়ালে।

মোহরের ভাবনার মাঝেই সশব্দে হেসে উঠলো মেহরাজ। মোহর চমকপ্রদের মতো তাকিয়ে রইলো যেন কোনো আশ্চর্য কিছু দেখে ফেলেছে। ওর আড়ষ্ট মুখে তাকিয়ে মেহরাজ বলল

– আপনি স্বীকার করুন আর নাই করুন, ভীষণ ভীতু আপনি। আপনাকে কনফিউজড করা আমার জন্য সবচেয়ে সহজ কাজ

মোহর ভ্রু কুঁচকে নিলো। মেহরাজের এমন রসিকতা মোটেও উচিত হয়নি ওর সাথে। মুখটা ভার করেই বসে রইলো ওভাবে। মেহরাজ ক্ষীণ স্বরে বলল

– রাগ করলেন বিবিজান?

মোহরের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে ও নিজেই পুনরায় বলল

– এই যে আপনি অদ্ভুত সব টপিক তুলে কথা বলে আমার কফিটা ঠান্ডা করে দিলেন আমি কিন্তু একটুও রাগ করিনি। তাহলে আপনি কেনো করছেন?

মোহর কফিটার দিকে তাকালো, কাপটা হাতে নিয়ে গুরুতর ভঙ্গিমায় বলল

– গরম করে এনে দিচ্ছি

বলে সরে যেতে গেলে মেহরাজ এবারও ওর হাত ধরে বসিয়ে দিলো। কাপটা নিয়ে সাইডে রেখে মোহরকে চেপে নিজের কাছে এনে বলল

– আপাতত আপনাকে দরকার,ঠান্ডা হতে।

কথাটি শোনার পর ঠিক কত সেকেন্ডের ভেতরে মোহর বুঝতে পারলো না, ঠান্ডা শীতল পাঁচটা পাঁচটা করে দশটা আঙুলের চাপ পড়লো ওর মেদহীন কোমরে। শক্ত হাতের আঙুল গুলো দেবে গেলো যেনো ইঞ্চি খানেক।মোহরের গলাটা ভিজিয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা ব্যর্থ করে মেহরাজ আস্তে আস্তে একটা হাতের বিচরণ অগাধে ছড়িয়ে দিলো সারা পিঠময়, আস্তে আস্তে চুলের ভেতর থেকে ঘাড়ে এনে আঙুলের চাপ বসিয়ে দিয়ে নিজের খুব কাছাকাছি জড়িয়ে নিলো মোহরকে। ঘাড় থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে সেখানে মুখ গুঁজে দিলো মাথা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বিদ্যুতের বেগে শিরশিরানি টা ছড়িয়ে গেল, আড়ষ্টতায় দাঁতে দাঁত চেপে নিলো মোহর। মেহরাজ ওর খোঁচা খোঁচা দাড়িময় গালটা মোহরের গলা, ঘাড়ে ঘষে দিলো। চোখ মুখ খিঁচিয়ে এলো মোহরের। মেহরাজ মুখটা মোহরের গালের সাথে লাগিয়ে নরম গলায় অতীব অনুরোধের সুর ঢেলে বলল

– আজকে ওই হলুদ রঙের শাড়িটা একটু পড়বেন মোহ.. শাড়িতে জড়ানো হলদে গোলাপটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে!
.
.
.
চলমান

©Humu_❤️

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪৬ (অন্তিমাংশ)
#হুমাইরা_হাসান

একবার, দুবার, তিনবার শব্দটা হতেই বাজতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন , আকস্মিক ভাবে ঘুম ভাঙায় চমকে উঠলো। শব্দের উৎপত্তি টা লক্ষ্য করে অন্ধকার হাতরেই ফোনটা হাতে নিলো। কলারের নম্বর টা দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো, ফোনের স্ক্রীনে বাঁ পাশটায় উপরে ছোট ছোট শব্দে কাট-কাট জানান দিচ্ছে সময়টা ঠিক বারোটা বেজে ছাপ্পান্ন মিনিট। এই অসময়ে নামহীন নম্বর থেকে ফোন আসার অর্ধ টা বোধগম্য না হলেও কিছু একটা আঁচ করতে পারলো যেনো, ধীরেসুস্থে সবুজ আলো জ্বলা জায়গাটাতে আঙুল ঘুরিয়ে কানের কাছে নিলেন। ছোট্ট করে ‘হু’ বলতেই ওপাশ থেকে গড়গড়িয়ে কতগুলো লাইন উগড়ে দিলো যেনো। মিনিট খানেক নিঃশব্দে কথাগুলো গলাধঃকরণ করলেও পরমুহূর্তেই গর্জে উঠলো, ভয়ংকর গম্ভীর গলায় শাসিয়ে বলল

– শু’য়োরের বাচ্চা! তোকে সামনে পেলে সপাটে চ’ড়াবো আগে শা’লা জোচ্চর। কোথায় পালিয়ে আছিস ইত’র, তোর জন্য কত ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে কোনো আন্দাজ আছে, কোটি টাকার মা’ল সাপ্লাই দিতে পারছি না। আর এখন নিশিতে ফোন দিয়ে তুই আমার কাছে টাকা চাচ্ছিস

বন্ধ ঘরের দেওয়ালে মিটমিটিয়ে বলা কথা গুলো ঝংকার তুললো। মুহুর্তেই ঘুম ছুটে গেলো কাকলির। অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে পাশের স্থান টা ফাঁকা দেখে উঠে বসলেন, তন্মধ্যে আবারও খেঁকিয়ে উঠলো আরহাম মুর্তজা

– এসবের মানে কি, তোকে নিজের রাইট সাইড বানিয়ে খুব বড়ো ভুল করেছি মনে হচ্ছে। নিজে গা ঢাকা দেওয়ার নামে ডুবাতে চাচ্ছিস আমাদের? পালিয়ে বাঁচতে পারবি বলে মনে হয় তোর! মেহরাজ তোকে ইঁদুরের গর্ত থেকে হলেও এক থাবায় বের করে আনবে। তোর মতো চুনোপুঁটি লুকিয়ে বাঁচতে পারবি বলে মনে করিস? গতবার যে হাত দুটো মুঁচড়ে দিয়েছিলো ভুলে গেছিস! লজ্জা করেনি আবারও সেই হাত ওর জিনিসের দিকে বাড়াতে! এতো লোভ যখন পাড়ায় গেলি না ক্যান জা’নোয়ার!!

কাকলি বেগম শুকনো মুখেই আন্দাজ মতো হাত বাড়িয়ে রাখলেন স্বামীর ঘাড়ে, ইশারাবার্তা টুকু সতর্কবাণী হিসেবেই আমলে নিয়ে শান্ত করলো নিজেকে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল

– কালকের মধ্যে আমার সামনে আই, না তো নেকড়ে টাকে আমি নিজে লেলিয়ে দেবো তোর পেছনে

প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই খট করে কল লাইনচ্যুত করলো, তিক্ত মেজাজে ফোনটা ছু’ড়ে ফেলে হাতের তালুতে কপাল টা ভর করে বসে রইলো, কাকলি বেগম স্বামী দুশ্চিন্তা, অশান্তির কারণটা পুরোপুরি না হলেও কিছুটা আঁচ করতে পারলো, ক্ষীণ স্বরে বলল

– এতটা উত্তেজিত হলে প্রেসার টা বাড়বে রাত করে। শান্ত হও

– কিভাবে শান্ত হবো কাকলি, বায়ার’রা ফোন দিয়ে দিয়ে অতিষ্ট করে ফেলেছে। এক তো ব্যবসা ডাউন হওয়ার কারণে সার্ভিস ভালো করে দিতে পারছি না, তার সাথে এই অজাত টা আরেক ঝামেলা বাঁধিয়ে বসে আছে। ওকে কে বলেছিলো মোহরের পেছনে লাগার, কান টানলে মাথা আসবে এ তো বাচ্চাও জানে। মোহরের দিকে হাত বাড়ালে সে হাত যে মেহরাজের মুঠোয় আঁটকাবে সেটা তো ও জানতো। একসাথে কত গুলো সাইড ব্লক হয়ে আছে ভাবতেও পারছো না। কোনো ভাবে ব্যালান্স হারালে সব ডুববে।

এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে দম ছাড়লো আরহাম মুর্তজা। কাকলি বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালালো। সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস টা তুলে আরহামের সামনে ধরলে বিনা বাক্যেই ঢকঢক করে গিলে নিলো পানি টুকু।

– ভাইজান এখনো চুপ করে আছে কেনো? শুনলাম ওয়াকিফ ভাই ও এখন উল্টো পথে ঘুরেছে, তিয়াসার সাথে হওয়া ঘটনার জন্য তোমাকে আর ভাইজানকে দোষারোপ করেছে?

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে গ্লাসটা নামিয়ে রাখলো। অস্থির গলাতেই আবারও বলল

– ভাইজানের ও এখন কিছু করার নেই। এসবের মাঝে একটা চিন্তা এখনো আমার মাথায় শূলের মতো আঁটকে আছে আর তা হলো পেনড্রাইভ টা। কাকলি ওটা কিন্তু আজও আমাদের হাতে আসেনি

– বছর পেরিয়ে গেলো। এখনো ওটা আছে? থাকলে এতদিনে একটা দামামা শুরু তো হতোই!

– নষ্ট হয়ে গেছে এমন খবর ও তো নেই। আসলে কাজটাই ভুল হয়েছে ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে আগে পেনড্রাইভ টা হাতিয়ে তারপর ওর ব্যবস্থা করা উচিত ছিলো। ওটা যদি কোনো ভাবে কারো হাতে পরে যায় কোনো রেহাই নেই। এরকম একটা সেনসিটিভ নিউজ পেলে সাংবাদিক থেকে রাস্তার পাগল সবাই হাত ধুয়ে লেগে পড়বে পেছনে।

চিন্তার বিন্দু বিন্দু ঘামে এক এক করে কপালটা ভরে গেলো কাকলির। আসন্ন বিপদের আতঙ্কে জান শুকিয়ে যাচ্ছে। মনটা ও কেমন কু-গাইছে। সত্যিই কী সব শেষ হয়ে যাবে! সবটা খোলাসা হয়ে যাবে! অন্ধকার রাত্রিতে দুটো মানুষের মন দুর্বোধ্য দুশ্চিন্তায় কেঁপে উঠলো, না জানে আর কার কার মনে বাজছে এই আতঙ্কের বীণ।

.

ঘড়ির কাটা-টা যেনো নড়ছেই নাহ। ইদানীং সময় টাও একটু বেশিই গড়িমসি করেছে। পার-ই হতে চাইনা। দীর্ঘ রাতটা বেশিরভাগই নির্ঘুম কা’টে তাথইয়ের। কোনো অজানা চিন্তায় ডুব দিয়ে আকাশ পাতাল ভাবনায় বুদ হয়ে ভুলে যায় ইহজাগতিক সমস্ত চিন্তা ভাবনা।
এর মাঝেই বার কয়েক ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো অরুণ। শেষবার যখন ফোন করেছিলো তখন ওর মা কথা বলেছিলো। তার বলা কথাটা ঠিক এমন ছিলো
” মানছি আমার ছেলেটা ভুল করেছে, তা তোমরাও তো চুপ করে থাকোনি? কেস করেছো, ডিভোর্স ফাইল ও করেছো এর মাঝে আমার ছেলেটাকে মা’র খাওয়ালে কেনো! ও তো আর তোমাদের জ্বালাতে যায়নি। ছেলেটার আমার হাত,পা কি বিশ্রী ভাবে যখ’ম করেছে। ও তো এখনো তোমার স্বামী-ই আছে। এতগুলো দিন সংসার করে কি এতটুকুও মায়া হয়নি তোমার ”
এটুকু বলেই দমে যায়নি। ভালো মন্দ কত রকম দোষারোপ করেছে মহিলা তাথইয়ের ওপর। অবশ্য ও কোনো রকম অভিব্যক্তি দেখায় নি। অবাক হয় ও মাঝে মধ্যে এই ভেবে যে শুধুমাত্র নিজের আপনজন বলে হয়তো মানুষ খু’নিকে নিয়েও সাফাই গাইবে এখন। অরুণের বাবা বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলো পরিবার সাথে,পারেনি। অগত্যা দমে গেছে।
থমকে গেছে সব৷ তাথইয়ের জীবন, অনুভূতি সব থমকে গেছে। এতসব নিষ্ক্রিয়তার মাঝেও মনের কোনো এক কোণের ছোট্ট জায়গা জুড়ে একটা মানুষের উপস্তিতি’টা কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যেও ভুলতে পারেনা ও।

এসব ভাবতে ভাবতেই হাতের মুঠোয় আগলে রাখার অর্ধমৃত ফুলগুলো নাকে চেপে নিলো। পৃথকের চেহারা ওর কণ্ঠস্বর ওর হাসিটা যেনো বিদ্যুতের ন্যায় ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত দেহে। পৃথক ওর কথা রেখেছে, সেদিনের পর থেকে আর আসেনি তাথইয়ের সামনে, আর নাইবা যোগাযোগ করার ক্ষীণ চেষ্টা অব্দি করেছে। কিন্তু এখন যেনো তাথইয়ের আর সহ্য হয়না। কারণে অকারণে মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে করে, পুরোনো আবেগ অনুভূতি গুলো সুচের মতো বুকটা ঝাঁঝরা করে ফেলে।
ফোনটা হাতে নিলো, বহুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দে বুদ হয়ে অবশেষে সংযোম চুরমার করে কলটা করেই বসলো, কয়েকবার রিং হয়ে কে’টে গেলেও রিসিভড হলো নাহ। তাথইয়ের সংযমচ্যুত সত্তা ওকে যে ধৈর্য ধরতে দিলো না, অবিলম্বেই আবারও কল করলো, এবার তিনবার বাজতেই রিসিভ হলো। খানিকটা আড়ষ্টতা নিয়ে তাথই হ্যালো বলবে তার আগেই ওপাশ থেকে ভীষণ ক্ষীণ, দুর্বল গলায় জবাব আসলো

– রাজীব তোমাকে বলেছিই তো শরীর টা খুব খারাপ। আপাতত কোনো কেসেই হাত দেবো নাহ। কথা বলার শক্তি নেই, বিরক্ত করিও না। পারলে কাল সকালে ডাক্তার নিয়ে এসো

বলে সাথে সাথে কল কাট করে দিলো। তাথই বিচলিত চিত্তে আবারও ফোন লাগালো তবে এবার অপরপক্ষ হতে এলো একটা মেয়ের যান্ত্রিক জবাব
‘ The number you are trying to call is currently unreachable ‘

__________________________

এক বুক দুরুদুরু কম্পনের অতিষ্টতা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মোহর। এ কাকে দেখছে সে! এই চেহারা,এই শরীর, এই মানবী কি আদও ও নিজে! নাহহ, বুকের ভেতরের অবুঝ যন্ত্রটার ধুকপুকানি টা আজ অন্যরকম আস্বাদন দিচ্ছে, একটা মানুষের বাচ্চাদের মতো আবদারের খোরাক মেটাতে এই যে মধ্যরাত্রির ও পরে শাড়ি পড়েছে। সত্যিই হলুদ রঙের শাড়িটা জড়িয়েছে শরীরে, তবে যার আবদার মেটাতে পড়েছিলো তার সামনে যাওয়ার কথা ভাবতেও প্রাণে-প্রাণে, হৃদয়ে-হৃদয়ে চাঞ্চল্যতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

অপরদিকে মেহরাজ দাঁড়িয়ে বারান্দায়, এই নিশিতে আকাশটা অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। ঋতু বদলের পালায় আকাশটা যেনো অভিমানে গুমোট রূপ ধরেছে৷ ক্ষণে ক্ষণে ধরণী কাঁপিয়ে, আলোর ফুলকি তুলে গর্জে উঠে বিদ্যুতের চমকানি। মেঘের গর্জনের ঝংকার তোলা বিকট শব্দেও একটা খুব ক্ষীণ শব্দটা মেহরাজের কানে আসতে ভুল হলো নাহ। শুষ্ক অধরখানা সামান্য চওড়া হলো। সেই ঠোঁটের তৃপ্তির শ্বাস টুকু হয়তো আগত রমণীর চোখে বিঁধলো নাহ, কিন্তু শীতল পরিবেশটার চেয়েও হীম একটা কণ্ঠ ঠিকই ওর কান হতে মস্তিষ্কে পৌঁছালো

– এসেছেন মোহ?

ছোট্ট শব্দের সম্বোধন টা যেনো আজ অন্যরকম দোলা লাগিয়ে দিলো শরীরে। গুটি গুটি পা ফেলে আরেকটু এগিয়ে এলো, পাশাপাশি রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল

– আমিতো একটু শব্দও করিনি, আর করলেও এমন বজ্রপাতের শব্দেও কি করে বুঝলেন আমি এসেছি?

মেহরাজ তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো নাহ। পাশ ফিরে তাকালো স্নিগ্ধ একটা মানবীর দিকে । মায়াময় সে মুখ,মোহভরা সেই রূপ। আবছা আলোতেও যেনো রূপকথার গল্পের মতো রাঙিয়ে উঠলো পরিবেশটা। মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘুচিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো একদম মোহরের কাছাকাছি, পকেটে গুজে রাখা হাতটা বের করলো না,সটান দাঁড়িয়ে রুদ্ধের সেই ভরাট গলাটায় মুগ্ধতা মিশিয়ে বলল

– বজ্রপাতের শব্দ তো বড়জোর শ্রবণযন্ত্র ভেদ করে, আপনার পদধ্বনি তো আমার হৃদয় পর্যন্ত ছুঁয়ে দেয়, এফোড় ওফোড় করে দেয়।

লজ্জাবিষ্ট আবেশে মাথা নুইয়ে নিলো মোহর। আজ যেনো মেহরাজের কথাগুলো একটু বেশিই ভালো লাগছে শুনতে। হীম হাওয়া টা আরও জোরসে বইতে লাগলো, পাতলা ফিনফিনে শাড়িটা বাতাসের দাপটে মিশে যাচ্ছে শরীরের সাথে। মোহর পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্যমনস্ক হয়ে বলল

– এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো!

মেহরাজ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল

– বৃষ্টি হবে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি নামবে।

মোহর ও একইসাথে তাকালো। ঝড়ো হাওয়া আর মেঘের চমকানিতে বৃষ্টির আগমনবার্তা স্পষ্ট। মোহর আবারও জিগ্যেস করলো

– এতো রাতে শাড়ি কেনো পড়তে বললেন আপনি?

কণ্ঠে কৌতূহলের চেয়েও জড়তা বেশি প্রকাশ পেলো। মেহরাজ মুচকে হেসে বলল

– রাত হোক আর দিন। আমিই তো দেখবো। আমার যে এখন আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করেছে তাই

মোহর প্রত্যুত্তর করার জন্য কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে নাহ। মিনিট খানেকের মধ্যেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছুঁয়ে দিতে থাকে চোখ মুখ। নিস্তব্ধতা ভেদ করে বৃষ্টির গাঢ় হওয়ার শব্দ। শীতল আমেজে কা’টা লাগিয়ে দিচ্ছে। মেহরাজ পা দুই পিছিয়ে মোহরের পেছনে এসে দাঁড়ালো। দু’হাতের নিচ দিয়ে কোমর জড়িয়ে ঘাড়ে থুতনি চাপিয়ে দিলো, নরম শরীরটার মিষ্টি ঘ্রাণে নাক ডুবিয়ে নিঃশব্দে অতিবাহিত করলো কতগুলো মুহুর্ত,ক্ষণ। জড়ত্ব ভর করা মোহরের অর্ধভেজা শরীর টা সমস্ত ভার ছেড়ে দিলো, মেহরাজের বুকে পিঠ এলিয়ে দিয়ে হেলান দিলো। মেহরাজ কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল

– মোহ! ভালোবাসেন?

স্তব্ধরূপে ঠাঁই পড়ে রইলো মোহর প্রসস্থ বুকটার মাঝে। চোখে,ঠোঁটে ব্যকুলতা অস্থিরতা ছড়িয়ে গেলো। এর উত্তর কি করে দেবে,কিভাবে দেবে! ‘মোহ ভালোবাসেন’ নামক দুটো শব্দের এই প্রশ্নের উত্তরে কি জবাব দেওয়া যায়! আজ যেনো মন,শরীর আর সামলাতে পারে না।নিজের উষ্ণ,পরিস্ফুটিত মনের উদ্বেলনের সাঁই দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল

– বাসি

দু’হাতের বেরিবাঁধ আরও দৃঢ় হলো, কানের কাছ থেকে মুখের অবস্থান পরিবর্তন করে ঘাড়ের কাছে নিয়ে মেহরাজ ভীষণ রকম শাণিত গলায় আবারও বলল

– ভালোবাসেন মোহ!

– বাসি, ভালোবাসি!

যন্ত্রমানবীর মতো তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো মোহর। কি বলল,কিভাবে বলল তা ওর মস্তিষ্ক ঠাওর করতে পারলো নাহ। এই নিগূঢ় নীরবতায়, বৈরী আবহাওয়ার বর্ষণে শুধু একটা নামই ওর মস্তিষ্কে ঘিরে রইলো আর তা হলো মেহরাজ।
মেহরাজ বিভোর হলো, মাতোয়ারা হলো। স্নিগ্ধ মানবীর মোহনীয়তায় ডুব দিয়ে সিক্ত করলো সমস্ত মন-মস্তিষ্ক। মৃদু হেসে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো। মোহরকে বুক থেকে তুলে নিজের সামনাসামনি ঘুরিয়ে থুতনিতে হাত রাখলো, কোমল দৃষ্টিটা মোহরের সমস্ত আননে ছড়িয়ে মোলায়েম গলায় বলল

– মোহ নামক মায়াতে ডুবে বিভোর হয়েছি। একজনের সুমিষ্ট ঘ্রাণভরা মায়াতে আবিষ্ট হয়ে মাতোয়ারা হয়েছি। নরম ওষ্ঠের ভাঁজ থেকে প্রস্ফুটিত এই শব্দটার জন্য একবুক তৃষ্ণা নিয়ে অপেক্ষা করেছি চাতক পাখির মতো। কতবার আপনাকে স্পর্শ করতে গিয়েও গুটিয়ে নিয়েছি নিজেকে তা শুধু আমিই জানি, কতবার আপনাকে ভালোবাসি বলতে গিয়েও আঁটকে গেছি তাও শুধু আমি আর ওই রব জানে। আমার সবটুকু যত্ন,আদর, মুগ্ধতা উগড়ে দিয়েছি শুধু দেইনি অধিকার মেশানো ভালোবাসা টা ,চাই ও নি। অপেক্ষা করেছি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য যখন আপনি বুঝবেন আমি শুধু আপনার জন্যেই,আর এই আপনিটা শুধু আমার ।

থামলো মেহরাজ, মোহর নিস্তেজ তাকিয়ে রইলো মেহরাজের স্বচ্ছ আঁখিজোড়ায়। মেহরাজ নিজের মুখটা ঝুঁকিয়ে আনলো, মোহরের নাক বরাবর মুখটা রেখে বলল

– এতগুলো দিন যেই উন্মত্ত ভালোবাসার অভিলাষটা বুকে পুষে রেখেছি, তার প্রণয়াকাঙ্ক্ষা আপনার দেহেও মিশিয়ে দিতে চাই!

মেহরাজের অবাধ্য কথাটার মর্মার্থ বুঝতেই মুষড়ে পড়লো, মুখটা আরও নিচু করে নিলো। মেহরাজ নিজের ঘাড়টা আরও ঝুঁকিয়ে মোহরের কানের কাছে মুখ এনে বলল

– আপনার সমস্ত সত্তাকে নিজের মাঝে শুষে নেওয়ার, ভালোবাসার উষ্ণতায় ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার, অনুমতি টুকু আজ দেবেন না মোহ!

মোহর আর পারলো নাহ, ঝড়ো অনুভূতির ওঠাপড়োনে অতিষ্ট হয়ে উঠলো। মেহরাজের বুকে মুখ লুকিয়ে ঝাপটে ধরলো, তীব্রভাবে খামচে ধরলো শুভ্র রঙের শার্টটা হাতের মুঠোয় মুচড়ে ধরলো। পুরুষালী শরীরটার কারাগারে নিজেকে স্বেচ্ছায় সমর্পিত করে, নিঃশব্দে জানান দিলো নীরব সম্মতি। শব্দ,যুক্তিহীনায় নিজের পবিত্র মন,শরীর আর সত্তাটুকু কে ভালোবাসার জোয়ারে প্লাবিত, উচ্ছ্বসিত করতে অর্পণ করলো
মেহরাজের বাহুর ডেরায়।
ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে দুটো শরীর, মধ্যবর্তী দূরত্বের মাপটা অতিমাত্রায় শূন্য। ভয়াবহ রকম শীতলতায় জরাজীর্ণ অবস্থায় নিজেকে একটু উষ্ণতা দিতে,ওমের মাঝে লুকিয়ে নিতে আরও গভীরে জড়িয়ে যেতে অস্থির মনটা আনচান করে উঠছে। ঠিক এই মুহুর্তেই মেহরাজ বুক থেকে তুলে সোজা করলো মোহরকে।
আপাদমস্তক নেশাতুর দৃষ্টি বুলালো, লাইটের হালকা আলো আর ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুতের ঝলকানিতে সদ্য স্নাতা রমণীর অগাধ রূপটা প্রবল তৃষ্ণা ধরিয়ে দিচ্ছে। সিক্ত চেহারা, গায়ে চুইয়ে চুইয়ে অঝোরে পানি ঝরে পড়ছে, হালকা পাতলা হলুদ রঙের শাড়িটা ভিজে চুপসে মিশে আছে শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে। প্রাণভরা আকুলিবিকুলি নিয়েই হাসলো মেহরাজ, দুর্বোধ্য সেই হাসি। প্রসারিত ঠোঁটজোড়া এগিয়ে এনে পরম আদরে চেপে ধরলো মোহরের কপালে।
এক লহমা অপেক্ষা না করে কোলে তুলে নিলো মোহরকে। ভেজা শরীরটাকে নিজের যতটা নিকটে সম্ভব চেপে ধরলো। এক পা দুই পা করে এগিয়ে গেলো ঘরের দিকে।
প্রবল কম্পনে ক্ষণে ক্ষণে নড়েচড়ে উঠলো মোহরের পাতলা শরীর টা।
খাটের উপরে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো মোহরকে ভেজা বস্ত্রেই। মোহরের নিস্তেজ চোখজোড়ার অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়া মেহরাজের দিকে। খট করে ছিটকিনি তুলে দিয়েই ঘুরে দাঁড়ালো। মোহরের চোখে নিষ্পলক চেয়েই আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে থাকলো মেহরাজ। ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা শরীর টা হুট করেই থমকে গেলো। বিচলিত চোখে তাকিয়ে রইলো মোহর তার একান্তই নিজের মানুষটার দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে সাদা শার্টটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে সৌষ্ঠব শরীরটায়। কপালের চুল,কানের লতি, ঘাড় বয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানির ছোট ছোট মুক্তকণা। ব্যকুল তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো মোহরের, নিজেকে প্রাণপণে গুটিয়ে নিলো, দুই হাতের তালুতে ভর করে একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে থাকলো। মোহরের সমস্ত আড়ষ্টতা, জড়তা,কুণ্ঠাকে হরদমে অগ্রাহ্য করে কোমরের কাছে শার্টটা উঁচিয়ে বেল্ট ধরে এক টান মারলো। ভারি জিনিসটা ফ্লোরে ছু’ড়ে ফেলার বিকট শব্দ তুললে মোহর ভয়াতুর চাহনি মেলে তাকালো সেদিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকানোর সাহস টুকু আর জুটলো না শরীরে যেনো, কম্পিত শরীরেই আড়চোখের আরক্তিম নজরে তাকালো মেহরাজের দিকে। মোহরের পায়ের দু’দিকে হাঁটু গেড়ে একটু একটু করে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে এগিয়ে এলো মেহরাজ। আস্তে আস্তে মুখটা একদম মোহরের কাছাকাছি এনে অস্থির স্বরে আদরের সুর ঢেলে বলল

– মোহ. . আমার মোহ!

কপালে উষ্ণ স্পর্শটা গাঢ়ভাবে চেপে ফিসফিসিয়ে বলল ‘ভালোবাসি বিবিজান,এই অধমটা তার সমস্ত জান দিয়ে আপনাকে ভালোবাসে’
কথাটা বলার সাথে সাথেই প্রচণ্ড ভাবে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো মোহর,নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের ঝড় উঠলো মেহরাজের পাগল করা অস্থির স্পর্শে। কপাল থেকে গাল, নাক, চোখ, থুতনি,কান সব খানেই চেপে ধরলো উষ্ণতায় ভরা ওষ্ঠদ্বয়। মেহরাজের শরীর থেকে টুপটাপ করে পানির বিন্দুগুলো পড়ছে মোহরের গলায়, মুখে। ঝিমঝিম করা অনুভূতিতে বজ্রাহতের মতো মুষড়ে পড়লো মোহর। বাজ পরার বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো ধরণী। বৃষ্টিত ফোঁটাগুলো যেমন মিশে যায় শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে তার চেয়েও গহীনে মিশে গেলো মেহরাজ। অস্থিরতম অনুভূতিতে ভাসিয়ে নিলো মোহরের সমস্ত সত্তা। সংযম,ধৈর্য, বাঁধ চুরচুর হলো। বেসামাল আদরের আশ্লেষীপূর্ণ চুম্বনে আবদ্ধ করলো দুইজোড়া ঠোঁট। হাতের উপরে চেপে রাখা পুরুষালী হাতের করপুট দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হলো। হাতের চাপে নরম বিছানার বুকে দেবে গেলো হাতদুটো। বুকের মধ্যিখানে অধরের চাপে নৈসর্গিক আদলে তলিয়ে গেলো মেয়েলী সত্তা আর পুরুষালী অনুভূতি। বৃষ্টি আর বজ্রপাতের গর্জনের মাঝে অসহনীয় হয়ে উঠলো দুটো আত্মার মিলনের আর্তনাদ। রুদ্ধশ্বাস আঁটকে গেলো শিরশিরানির অনুভবে। বাতাবরণটা যেনো হুট করেই অন্য জগতে পদার্পণ করলো, সারা শরীরে মেহরাজময় অস্তিত্বে অবগাহন করে উন্মাদনায় আরক্ত স্বরে মোহর দূর্বল গলায় বলল

– আরেকবার বলুন নাহ

অনতিবিলম্বেই ভূবণ ভোলানো নিবিড়, আকুল স্বরটা উত্তপ্ততা ছড়িয়ে বলল

– ভালোবাসি

শোঁ শোঁ বাতাসে পর্দাগুলো বেয়ারা উড়তে লাগলো। লাইট গুলো যেনো নাটকীয় ভাবেই ধপ করে বুজে গেলো, বৃষ্টি আর মেঘের গর্জন বেড়েই চলল। তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়লো দুটো মানবের অবাধ্য মায়া, কিছু দূর্লভ ইচ্ছে, নিষিদ্ধ আবেগ। স্পৰ্শ গুলো যতটা সম্ভব প্ৰগাঢ় হলো। নিয়ন্ত্রণ হারা হলো সকল সুপ্ত কামনা। অগাধ প্রণয়লীলা মত্ত বেহুশ হৃদয়জোড়ার খায়েশ ।
তপ্ত নিঃশ্বাসের ঝড়ো হাওয়া, একসমুদ্র সুখেপ্রণয় প্রহেলিকা ভূবন্ত শীতল কক্ষ আবেষ্টিত হলো অদ্ভুত বাতাবরণে, মোহরুদ্ধকর আবেশে।
.
.
.
চলমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে