#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪৫
#হুমাইরা_হাসান
– এই যে? আপনি চাইলে আমার গাড়িতে উঠতে পারেন
– আমি পারতে চাইনা
অভিমন্যু বিব্রত হলো বেশ,, পারতে চাইনা আবার কেমন কথা হলো! এই মেয়েটা এতো অদ্ভুত কেনো, সবসময়ই এমন রণচণ্ডী হয়ে থাকার কারণ মাথায় আসে নাহ। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে আরেকটু এগিয়ে শ্রীতমার পাশাপাশি দাঁড় করালো গাড়িটা, হর্ন চেপে আবারও বলল
– এই যে মিস না মিসেস, আমি আপনাকে লিফট দিতে চাচ্ছি এড়িয়ে যাচ্ছেন কেনো?
– তো দেখছেন যখন এড়িয়ে যাচ্ছি তাহলে বারবার ডাকছেন কেনো আজব, নাকি আবারও ধাক্কা দিতে ইচ্ছে করছে?
অভিমন্যু হকচকিয়ে তাকালো, আপাদমস্তক স্থূলদৃষ্টি দিয়ে বলল
– নাহ, আপনি মনে হয় মন্দিরে যাচ্ছেন আমিও ওদিকেই যাচ্ছিলাম। ড্রপ করে দিতাম
শ্রীতমা ফোঁস করে লম্বা একটা প্রশ্বাস ছাড়লো। রয়েসয়ে এগিয়ে এলো গাড়ির দরজার সামনে। ঠান্ডা মেজাজে কিছুক্ষণ অভিমন্যুর দিকে তাকিয়ে থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত স্বরে বাজখাঁই গলায় চ্যাঁচিয়ে বলল
– আমি কি আপনার বন্ধু? বান্ধবী? প্রতিবেশী? ক্লাসমেট? ব্যাচমেট? গার্লফ্রেন্ড? বউ? প্রাক্তন? কোনোটা???
অভিমন্যু হতবুদ্ধির মতো ডায়ে বাঁয়ে ঘাড় নাড়ালো প্রতিটি কথার সাথে সাথে। শ্রীতমা আঙুল তুলে বলল
– এই খবরদার এতোবার ঘাড় ঘুরাবেন নাহ, আপনাকে দেখে আমারই মাথা ঘুরাচ্ছে
অভিমন্যু স্থবির হয়ে বলল
– ওকে
শ্রীতমা আবারও শুরু করলো,
– হ্যাঁ তাহলে বলুন। না আপনার সাথে আমার কোনো প্রকার সম্পর্ক বা যোগাযোগ আছে, আর নাইবা আমার সাথে আপনার। তাহলে আপনি কেনো মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি টাইপ বিহেভিয়ার করছেন বলুন?
অভিমন্যু রয়েসয়ে ঢোক গিললো। আকস্মিকতা কাটিয়ে ধাতস্থ হয়ে বলল
– আমি তো শুধু লিফট দিতে চেয়েছিলাম। আপনি তো জাত, বংশ সবকিছুর কুন্ডলি তুলে আনলেন। এই জন্য মানুষের ভালো করতে হয় না
– আপনাকে কেও বলেছে মানুষের ভালো করতে? আগ বাড়ায়ে উস্তাদি করতে এসেছেন কেনো হনুমান মুখো লোক কোথাকার
শ্রীতমার চ্যাঁচানি শুনে লোক দুয়েক যাওয়ার পথেই আড়চোখে তাকালো, অভিমন্যু এবার বেশ ক্ষুব্ধ হলো। ক্ষ্যাপাটে গলায় বলল
– দেখুন একদম গলাবাজি করবেন নাহ। শান্তশিষ্ট ভাবে কথা বলতে পারেন না আপনি? সবসময়ই এভাবে ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচামেচি করেন কেনো হ্যাঁ? আপনাকে সাহায্য করতে চাওয়া টাই আমার ভুল হয়েছে। এই জন্য মানুষের ভালো করতে হয় না
– তো আমি কি আপনাকে বলেছিলাম আসুন মানুষের ভালো করুন আপনিই তো…
পুরোটা শেষ করার আগেই অভি ধপ করে গ্লাসটা তুলে দিলো, শ্রীতমার মেজাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একটানে গাড়ি ছুটিয়ে মুহুর্তেই চক্ষুর অগোচরে হারিয়ে গেলো। শ্রীতমা অথব্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলো মূর্তির মতো, ওর স্থবিরতা কাটলো পাশ থেকে আসা একটা কণ্ঠে
‘ আজকাল কার ছেলেরাই এমন, প্রেম করার সময় হুস থাকে না। দুদিন বাদেই মন ভরে গেলে রাস্তায় মেয়েদের ফে’লে যায়। আর মেয়েগুলোও বলিহারি, এতো প্রেম করার ছোঁকছোঁক কেনো যানেই তো ছেলে গুলো এমন বদমাশ। এখন থাকো দাঁড়িয়ে ‘
শ্রীতমা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো পেট মোটা বেটেসেটে করে একটা মহিলা। শরীরের তুলনায় মুখটা একেবারেই ছোট। ওর ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই মনে হলো ‘যত বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা’ একেই বলে, এই মহিলাই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মেজাজ টা তিনশো পঁয়ষট্টিটি ডিগ্রি ঘুরে গেছে ওর, ওই তথাকথিত হনুমান মুখো টাকে শায়েস্তা না করতে পারলে শান্তি নেই। পাশের মহিলাটি তখনো চোখ ফেড়ে ফেড়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, শ্রীতমা মুখ বাঁকিয়ে ধুপধাপ করে হাঁটা দিলো সামনের দিকে মনে মনে অভিমন্যুকে হাজার বার ভর্ৎসনা করতে করতে।
.
পরন্ত বিকেলের লাল আভার চাদরে মুখ ডুবিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে নিচ্ছে পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে পুরো পরিবেশ টাই। আশেপাশে ছোট বাচ্চাদের হাসির-কান্নার কলকলানির সাথে মৃদুমন্দ শীতল হাওয়া টা শরীরে ঝিম ধরানো আবেশ তৈরী করছে। সুতির মোটা ওড়না টা ভালো করে মুড়িয়ে নিলো গায়ে, বুকের ভেতর চেপে ধরলো তোয়াকে, বাচ্চাটা বেড়াল ছানার মতো ওর বুকের মধ্যেই মুখ লুকিয়ে রেখেছে, মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে বাইরের পরিবেশ এতো ছোট ছোট বাচ্চা, লোকজন আর যানবাহন দেখতে বিস্ফারিত নয়নে। হয়তো মনে মনে ভাবছে ‘ মা আমাকে কোথায় আনলো! এই জায়গা টা তো ভীষণ অন্যরকম,এতো মানুষ একসাথে আগে তো দেখিনি? এরা এতো চ্যাঁচামেচি করছে কেনো?’
মনে মনেই নিজের এসব ভাবনা গুলো মেয়ের ভাবনা হিসেবেই চাপিয়ে দিলো মুচকি হেসে উঠলো তাথই। পরক্ষণেই আশপাশে তাকিয়ে অস্থিরতায় নিশপিশ করে উঠলো, পাঁচটা তো বেজেই গেছে লোকটা এখনো এলো না কেনো? বাড়িতে কাওকেই জানিয়ে আসেনি ও, বলেছে তোয়াকে নিয়ে একটু হাঁটতে বেরিয়েছে, ও কেনো এক কথায় এখানে চলে এলো ও নিজেও জানে নাহ, লোকটাকে তো ও ঘৃণা করে, ভীষণ ভাবে এড়িয়ে চলতে চাই, তাহলে এক ডাকেই কেনো চলে এলো?
– অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে ফেলেছি?
পরিচিত প্রত্যাশিত কণ্ঠস্বরে ধ্যান ভাংলো তাথইয়ের, সকৌতুকে তাকালেই হাস্যজ্বল চেহারাটার মালিক এগিয়ে এলো, প্রশস্থ বেঞ্চ টার অপর প্রান্তে বসে বলল
– স্যরি অনেকটাই দেরী করে ফেলেছি হয়তো, আসলে আসার সময়…
– কি গুরুত্বপূর্ণ কথা সেটা বলুন। এতো কথা শোনার সময় আমার নেই
তাথইয়ের কাঠকাঠ গলার শব্দবাক্যে পৃথকের প্রাণবন্ত মুখটা যেনো চুপসে গেলো অনেকটা, হয়তো কষ্ট ও পেলো। কিন্তু সেসব সাদরে আগলে বাহ্যিক স্বাভাবিকতা বজায় রেখেই বলল
– আ..তোমার সাথে আমার একান্তই ব্যক্তিগত কিছু কথা আছে আশু, একটু ধৈর্য ধরে শুনবে প্লিজ
মুহুর্তেই পৃথকের গলার স্বরটা পালটে গেলো। তাথই যেনো এরূপ স্বরের অভিব্যক্তিটা ঠাওর করতে পারলো খুব সহজেই, ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে বলল
– আমার ডিভোর্সের ব্যাপারটা তো আপনার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার হতে পারে নাহ। এটা তো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার?
– আমি তোমার ডিভোর্সের টপিকে কথা বলতে আসিনি আশু
তাথই বার দুয়েক পলক ফেললো। তার মাঝের খুব সন্তপর্ণে ফেলা উষ্ণ শ্বাস টুকু হয়তো পৃথক অব্দি পৌঁছালো না। অভ্যন্তরীণ কোন্দল টুকু দাম্ভিকতার সহিত সামলে তাথই আগের ন্যায় বলল
– তাহলে কি নিয়ে কথা বলতে এভাবে ডেকেছেন আমায়?
– আমাদের ব্যাপার আশু। আমার আর তোমার ব্যাপার, আমাদের সম্পর্ক টাকে কি একটা সুযোগ দে…
– কি যা তা বলছেন আপনি! এ ধরনের আজগুবী কথাবার্তা বলার জন্যে এখানে ডেকেছেন আমায় তাও মিথ্যে বলে? কিসের আমাদের, আপনার আর আমার কিসের সম্পর্ক!
পৃথক বিহ্বলিত হলো না।আর নাইবা কোনো প্রকার অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো। ও জানতো তাথই এর থেকে এরূপ ব্যবহারই পাবে, ভীষণ শান্ত গলায় বলল
– আমাকে একটু বলতে দাও আশু প্লিজ! আমি হাত জোর করছি তোমার কাছে। এসে থেকে আমি চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছি একটা সুযোগের। আমি শুধু কিছু কথা বলার সুযোগ চাইছি আশু, বেশি কিছু তো না! এটুকু ও কি আমি পেতে পারি না? এতোটাই অপরাধী আমি? ফাঁসির আসামী কেও তার শেষ ইচ্ছেটা বলার সুযোগ দেওয়া হয়, আমাকে কেনো দেওয়া যায়না বলো, আর আমি যে তোমাকে ডিভোর্সের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে এখানে ডাকিনি তা কিন্তু তুমি নিজেও ভালো মতোই জানো, তাহলে কেনো আমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছো না?
তাথই চুপ রইলো, একেবারেই নিশ্চুপ। কিছু বলার মতো ভাষা বা শক্তি কোনো টাই কুলাচ্ছে না ওর। নিজের উপর রাগ হচ্ছে, প্রচন্ড ধিক্কার আসছে কেনো আসতে গেলো ও,কেনো! চোখ ফুরে নোনাজল গুলো উগড়ে আসতে চাইলো, যে কষ্ট, যন্ত্রণাকে ও এতোদিন সংগোপনে আগলে, এড়িয়ে রেখেছিলো সেসব অনুভূতিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এখানে থাকলে হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবে না আর। তোয়াকে বুকের মাঝে চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালো, টলমলে পায়ে সামনের দিকে এক পা এগোলে পেছন থেকে পৃথকের যান্ত্রিক গলাটা ভেসে এলো
– আড়াই বছর আগে যখন একবুক আশা ভরসা আর স্বপ্ন বেঁধে বিদেশের মাটিতে পা রেখেছিলাম তখন নিজের ভবিষ্যত আর ভালোবাসার প্রণয়ের কথাটা ভাবলেই মনটা অস্থির হয়ে উঠতো, ভালোবাসাময় স্মৃতি আর আশাতে অস্থির মন দুদিন পার না হতেই দিন গোনা শুরু করেছিলো কবে দেশে ফিরবো কবে ফিরবো, কিন্তু ভাগ্য হয়তো তা চাইনি জানো তো আশু। আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমিই ছিলাম তখন, বাবা আর ছোট বোন রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর থেকেই মায়ের স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছিলো। ধীরে ধীরে তা আরও বড়ো রকম অসুখে পরিনত হয়, জার্মানিতে যাওয়ার চার মাসের মাথায় বাড়ি থেকে ফোন আসে, মায়ের অবস্থা গুরুতর। উনাকে ভালো চিকিৎসা না দিলে বাঁচানো সম্ভব হবে নাহ। ইমার্জেন্সি রিজন দেখিয়ে ভার্সিটি থেকে ছুটি গ্রান্টেড করে বাড়িতে এসে মাকেও আমার সাথে আনার ব্যবস্থা করলাম। ভিসা টাকা সব গুছিয়ে মা কে নিয়ে পাড়ি দিতে আমার আরও মাস খানেক লেগে গেলো। এর মাঝে মায়ের স্বাস্থ্যের অবনতি যেনো ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছিলো। অবশেষে সব ঝামেলা ঝক্কি সামলে বিদেশে গেলেও চিকিৎসার সময় টুকু আর বেশি পাইনি। হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষটা যে ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ হয়ে গেছে তা একচুল বুঝতে দেয়নি কাওকে। যতদিনে বুঝেছি অনেক দেরী হয়ে গেছে। মা’কে পুরো একটা মাস হসপিটালাইজড রেখে সর্বাত্মক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি, আমার আর আমার জীবনের সাথে চরম নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে মা চলে গেছে। মা’কে হারিয়ে জীবনের সবচেয়ে বিধ্বস্ত সময়টা যখন আমি একা গুমরে গুমরে কা’টাচ্ছিলাম তখন বাংলাদেশ থেকে ফোন এলো, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটা আমায় জানালো যেই মানুষটাকে পাওয়ার জন্য, নিজেকে গড়ে তুলতে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলাম সেই মানুষটাকে অন্য কারো নামে লিখে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। তখন আমি কি বলতাম বলো তো! না আছে পড়াশোনার কোনো ঠিকানা, না আছে আমার ক্যারিয়ার, কোন মুখে তখন বলতাম মুর্তজা পরিবারের বড়ো রাজকন্যা টাকে আমার হাতে সপে দিতে! বলার মুখ ছিলো আমার? তাই আমি সরে এসেছি নিজের ভালোবাসা, সুখ-শান্তিকে নিঃশব্দে বিসর্জন দিয়ে সরে এসেছি। মেহরাজকেও নিষেধ করেছিলাম এ ব্যাপারে যেনো বাড়িতে না জানায়। আমি তো ভেবেছিলাম আমার ভালোবাসা টাকে অন্য কেও খুব যত্নে ভালোবেসে আগলে রেখেছে, ফুলের কড়ির মতোন মুড়িয়ে রেখেছে আদরে। তাই তো আসিনি আমি, মিথ্যে আশা দেখাতে কোনো যোগাযোগ রাখিনি। কিন্তু তার বদলে কি হলো, আমার কি নিজেকে প্রমাণ করার একটা সুযোগ ও পাওয়া মিললো না? আমি কি এতোই নিষ্ঠুর! এতটা অ’মানুষ? নাকি প্র’তারক! আমার জাগায় তুমি থাকলে কি করতে আশু? আমি কি খুব ভুল ছিলাম?
বড়ো একটা দম ছেড়ে চুপ করে গেলো পৃথক। ওইটুকু দীর্ঘশ্বাসই যেনো ওর সমস্ত, বেদনা, গ্লাণি, যন্ত্রণা টুকু বুঝিয়ে দিল। তাথই পাথরমূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে উলটো দিকে ফিরে, না একচুল নড়েছে নাইবা একটা শব্দ করেছে।
– তোমার তো বেলী ফুলের মালা খুব পছন্দের, আসার সময় দেখলাম বলে তুমি নেবে না জেনেও এনেছি। এখানে রেখে গেলাম, নিবে না জানি। ছু’ড়ে ফেলে দিও। শুধু তোমার হাতটা দিয়েই ফেলো, আমি নাহয় দূরেই রইলাম আমার আনা ফুলটাকে অন্তত ছুঁয়ে দিও। আসছি, এতটা সময় নেওয়ার জন্য দুঃখিত। তোমাকে জানানো টা প্রয়োজন ছিলো, তাই বেহায়ার মতো এতদিন পিছনে ঘুরছিলাম। আজ থেকে আর আসবো না সামনে
ব্যস…এরপর আর কোনো শব্দ, বাক্য বা অনুরোধ কোনোটাই আসেনি সেই কণ্ঠস্বর হতে। মিনিট দুয়েক পরে তাথই ঘুরে তাকালো, হাতের উলটো পিঠে অশ্রুভেজা জবজবে মুখটা মুছে নিলো, ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকালো বেঞ্চের উপরে পরে থাকা শুভ্র ফুলের মালাটির দিকে, বহুদিন আগের একটা কথা এখনো নথি’র মতো কানে বাজলো। কোনো এক ভর দুপুরে চুপি চুপি একটা ছেলে এসে ওর হাত ধরে বাড়ির পেছনে নিয়ে মাথায় একটা সুগন্ধিযুক্ত মালা পেঁচিয়ে দিয়ে বলেছিলো
” বেলি দেখলেই আমার নিজস্ব বেলিটার কথা মনে পড়ে যায়, মনে হয় শ্যামারাণীর চুলগুলো ছাড়া এই মালাগুলো আর কোত্থাও মানায় নাহ, কোত্থাও নাহ ”
________________________
– তোরা দুই বোন মিলে আমাকে আর কতো জ্বালাবি বল তো! কি চাস টা কি তোরা? একজন তো একটা হিল্লে করলোই এখন তুই কি চাস
ভীষণ অতিষ্ট আর বিরক্তি ভরা কণ্ঠস্বর কাকলি বেগমের। মেয়েদের আচার আচরণে উনি আর কুলাতে পারছেন নাহ, সাঞ্জের একগুঁয়েমি দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাড়িতে সবাইকে বলে বলে হোস্টেলে তো ফিরলোই না, বেশ ক’দিন ধরেই ঘরবন্দী হয়ে থাকে। এখন আবার কোত্থেকে এসে বলে আবারও নাকি হোস্টেলে ফিরে যাবে। মেয়েগুলো কি শুরু করলো! একজন ও তার মন মতো হলো নাহ!
– কি হয়েছে বুড়ি?
মেহরাজের আদুরে গলাটা কানে আসতেই দরজার দিকে চোখ গেলো। বসা থেকে উঠে গিয়ে মেহরাজকে জড়িয়ে ধরলো, কান্নারত কণ্ঠে বলল
– ও দাভাই তুমি একটু মা’কে বলোনা। আমি হোস্টেলে ফিরে যেতে চাই, আমি মানছি আমিই থাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু ফ্রেন্ডস দের ছাড়া বাড়িতে এখন আর আমার ভাল্লাগছে না। তুমি একটু আমাকে দিয়ে আসো না গো, আমি আর জ্বালাবো নাহ, ও দাভাই
বোনের চোখের পানি যেনো মেহরাজের কাছে সবচেয়ে ভারী বস্তু। এটার ভার একেবারেই নিতে পারে না ও। বোন দুটো ওর চোখের মনি। সাঞ্জের গাল দুটো দুহাতের আঁজলে নিয়ে বলল
– এইটুকুর জন্য কেও কাঁদে? তুই না আমার লক্ষী বুড়ি! তুই চাইবি আর দাভাই দিবে না এমন হয়েছে কখনও? আমি কালই তোকে রেখে আসবো।
– সত্যি দাভাই? আই লাভ ইউ সো মাচচ!
সাঞ্জের আপ্লুত কণ্ঠে মেহরাজ হেসে বলল
– তবে একটাই শর্ত। লেখাপড়ায় কোনো প্রকার হেয়ালি করা যাবে নাহ।
– করবো না সত্যি
– ওকে ডান
সাঞ্জে খুশি হয়ে আবারও জড়িয়ে ধরলো মেহরাজকে। কাকলি বেগম চুপই রইলেন। এ বাড়িতে যেনো এখন আর একটাও কথা চলে না তার, মেয়েগুলো তো বাপ মা কম ভাই বলে পাগল। অতিষ্ঠ লাগছে উনার এখন সবকিছু। কোনো কিছুই মন মতো চলছে না। না পরিবার, নাইবা ব্যবসা। সবকিছু এভাবে চললে ধ্বংসের আর দেরী নেই, এসব ভাবতেই মন টা কু গেয়ে উঠে উনার। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কোনো একটা ব্যাপার মাথায় আসে। তাই মেয়েকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরে।
.
– অনেক হয়েছে মোহর, আর পারছিনা আমি। আমার যেটুকু দ্বায়িত্ব ছিলো আমি পূরণ করে এসেছি। আমি কারো বিরক্তি বা অশান্তির কারণ হতে চাইনা। আমি শুধু চাই ও খুশি থাকুক, ভালো থাকুক। তাতে আমার যদি এ দেশ ছেড়ে আবারও যেতে হয় আমি যাবো
– আর আপনার মনে হয় আপা আপনাকে ছাড়া ভালো থাকবে?
মোহরের প্রশ্নে অপরপক্ষের নিঃশ্বাস ছাড়া আর কোনো প্রত্যুত্তর আসে না,,জবাব দেওয়ার আদও কোনো হরফ তো তার কাছে নেই। মোহর তীব্র অধিকার খাটিয়ে বলে
– যেই মানুষটা আপনাকে ছাড়া এতোগুলো বছর ভালো থাকতে পারেনি সে এখন কি করে পারবে? আপনার দিক থেকেও যেমন আপনি সঠিক আপার দিক থেকেও কিন্তু সে ভুল নয় ভাইয়া। এতদিন যখন পেরেছেন আর ক’দিন ও পারতে হবে। আপনি আর আপাকে একসাথে দেখতে চাই ভাইয়া, বোনের এইটুকু আবদার রাখবেন না?
পৃথক নিশ্চুপ থাকে। ওর আশু যে ওত কতটা জুড়ে, কতখানি জুড়ে তা কি করে বোঝাবে ও? যাকে বোঝানোর কথা তাকেই তো বোঝাতে পারলো নাহ। নিজেকে ভীষণ অপদার্থ, অভাগা মনে হচ্ছে ওর, শেষমেশ কেও ই ওর রইবে নাহ? ভালোবাসাকে ফিরে পাওয়ার যে ক্ষীণ আশার সঞ্চার হয়েছিলো বুকে সেটুকুও কি অপূর্ণই থেকে যাবে!
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ঘরের কোত্থাও মোহরকে পেলো নাহ মেহরাজ। প্রশস্ত ললাটের ক্ষীণ ভাঁজের নিচের চোখ দু’টো উঁকি দিলো দরজার বাইরে, তোয়ালে টা হাত থেকে ফেলে এগিয়ে গেলো ব্যালকনি নামক প্রায় ছাদতূল্য জায়গা টিতে। মোহর ফোনটা রেখে দাঁড়িয়েছে রেলিঙ ঘেঁষে, মৃদু বাতাসের ঠান্ডা আমেজে অন্যরকম একটা বাতাবরণের সৃষ্টি হয়েছে।
ক্ষীণ শীতলতাকে কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে পেছন থেকে দুটি হাত ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরলো, অপ্রকৃস্থ ভাবে চমকে উঠলেও খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শে ঘাড়ে চাপ পড়তেই মুষড়ে পড়লো, মেহরাজ গভীর স্পর্শটাকে গাঢ়তর করে কানের কাছে মুখ এনে বলল
– আমি ঘরে এলেই যেনো বিবিজানের চাঁদ মুখখানা দেখতে পাই। এটা কি খুব জটিল আবদার করে ফেলেছি মোহ?
মোহর তপ্ত শ্বাস ফেললো ঘনঘন। জবাবের অপেক্ষায় অপেক্ষারত মানুষটা ভীষণ অধৈর্য্যের পরিচয় দিকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরলো পাতলা দেহখানা একটা দুইটা করে পরপর চারবার ওর পুরু অধর জোড়া চেপে চেপে ধরলো মোহরের ঘাড়ে, কানের পেছনে। পরক্ষণেই আগলা করে দিলো শক্ত বন্ধন, সরে গিয়ে রেলিঙ ছুঁয়ে দাঁড়ালো, অন্ধকারের মাঝেও সুদর্শন চেহারাটার ব্যাপক গম্ভীরতা টা আঁচ করতে পারলো মোহর, মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই নিস্তব্ধ স্থানটার শব্দহীনতাকে ভেঙে দৃঢ় কণ্ঠে বলল মেহরাজ
– আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ বা এক্সপেকটেশন রাখাটাই ভুল মোহ, যেখানে আমি নিজেও জানি আপনার কাছ থেকে কোনো রেসপন্স আমি পাবো না। আসলে দোষটা আমারই হয়তো আমার ব্যবহার বা কার্যকলাপ গুলোই এখনো এ্যাজ অ্যা হাসব্যান্ড বিশ্বাস বা ভালোবাসা যোগ্য হয়ে ওঠেনি। আমি শুধু শুধুই সম্পর্ক টাকে আগাতে চাচ্ছি। আর আপনি শুধু অসহায়ত্ব আর নিশ্চুপতা দেখিয়ে মেনে নিচ্ছেন আমাকে। আর আপনার এই নিশ্চুপতাই আমাকে ভাবাচ্ছে মোহ। নিজেকে আর পাঁচটা স্বামী অধিকার খাটানো হাসব্যান্ডদের মতোই ভাবতে বাধ্য করছে।
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে চুপ করে রইলো মেহরাজ। দৃষ্টি ওর সামনের দিকে। চেহারাতে রাগ, ক্ষুব্ধতা আর নাইবা কোনো ভাবাবেগ পরিলক্ষিত হলো। মোহরের উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবারও বলল
– ঘরে যান। রাত হয়েছে
কথাগুলো যেনো ভেতরের প্রখরতা সমেত আফসোস টুকু সামলে নিয়েই বলল মেহরাজ। এতো গুলো কথা শুনে অনেকটা স্থবিরতার সাথেই মূর্ছাতুর হলো মোহর। নিজের অজান্তেই চোখ ভরে এলো, জবাবের শক্তিটুকুও যেনো শুষে নিয়েছে মেহরাজ হতে আসা নিষ্ঠুর কতগুলো শব্দবাণ। দিনকে দিন বেহায়া হয়ে ওঠা মানুষটার মুখ থেকে এহেন অভিমান মিশ্রিত অভিযোগ গুলো যেনো কখনোই প্রত্যাশিত ছিলো নাহ। গত দিন ও যেই মানুষটা ওর সমস্ত অযৌক্তিক কথাগুলোকে ঠেলে ভালোবাসার স্পর্শে ভরিয়ে দিলো, ওর গ্লাণি গুলোকে প্রাণভরে শুষে নিলো সেই মানুষটাই আজ এ কথা গুলো বলল! তবে কি মোহর সত্যিই অনেক বেশি দূরত্ব বজায় রেখেছে? মোহরের ব্যবহারে মেহরাজের নিজেকেই বেশি বেশি মনে হচ্ছে!
শুকনো ঢোক গিলেই ঠান্ডা হাত পা নাড়িয়ে এগিয়ে গেলো মোহর, মেহরাজের একদম পেছন ঘেঁষে দাঁড়ালো, প্রচণ্ড ঘুমে আড়ষ্ট দুটি চোখের পাতা যেভাবে সুযোগ পেলেই মিলেমিশে একাকার হয়ে নেতিয়ে পড়ে একে অপরের সাথে, অনেকটা সেভাবেই আস্তে আস্তে জড়িয়ে নিলো মোহর নিজেকে মেহরাজের সাথে। অর্ধপূর্ণ কিছু অনুভূতি অর্ধেকেই আঁটকে গেলো মাঝপথে, মেহরাজের শক্ত প্রশস্ত বুকটার উপরে চিকন চিকন দশটা আঙুলের চাপ পড়তেই হু-হু করে ওঠে বুকের ভেতর। পেছন থেকে একটা আদুরে স্পর্শ ওকে নিজের সাথেই খুব ধীরে, সন্তপর্ণে মিশিয়ে নিলো। উষ্ণ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের বর্ষণে সারা পিঠময় এক অদ্ভুত দীপ্তি ছড়িয়ে গেলো। দীর্ঘাটে পিঠটাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে দুই হাতের মাঝ দিয়ে বুকটা প্রাণপণে খামচে ধরলো মোহর, নখর ধারালো স্পর্শের খোঁচায় চোখ খিঁচিয়ে নিলো কিঞ্চিৎ , কিন্তু সেই ব্যথাযুক্ত পীড়াটাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করার আগেই পিঠের মাঝে নিজের মুখটা নির্বিঘ্নে আশ্লেষের সাথে ডুবিয়ে দিলো, তৎক্ষনাৎ চোখ বন্ধ করে নিলো মেহরাজ, হাতদুটো ট্রাউজারের পকেটের মধ্যেই জমে গেলো।
মাথা ঝুকিয়ে তাকালো দুহাতে বুকটা খামচে ধরা হাতের দিকে, পাতলা ওষ্ঠদ্বর নাড়িয়ে মেহরাজের পিঠে নরম স্পর্শ মেখে অস্ফুটে নরম সুরটা কেঁপে কেঁপে বলল
– বাবা মাকে হারিয়ে বহু আগেই নির্বাক প্রাণী হয়ে গেছি আমি। নিজের কথা,অনুভূতি, মতামত টুকু কারো সামনে তুলে ধরার মতো তীক্ষ্ণতা এখন আর আসেনা। বোকাসোকা, নির্জীব মানুষের মতো সবটা সহ্য করে নেই, মেনে নেই। তা বলে কিন্তু এমন না যে আমি পাথরমূর্তি। আমারও দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ সবই হয়। কারো অনুপস্থিতি আমাকেও বিরহের বেদনায় ছা’রখার করে, কারো একটুখানি স্পর্শ আমাকেও সুখের উল্লাসে ভরিয়ে তোলে৷ কেও একজনের নামে আমার মনেও তীব্র প্রলয় চলে। শুধু আমি মুখ ফুটে বলতে পারিনা, স্বেচ্ছায় ছুঁয়ে দিতে পারিনা, প্রতিদান স্বরূপ আমিও মেখে দিতে পারিনা অনুভূতি। কি করবো বলুন! আপনি তো জানেন আপনার মোহ আপনার কাছে সর্বদাই নিস্তাব্ধ,নিঃস,অসহায় একটা পোষা প্রাণী। তা বলে কি দূরে সরিয়ে দেবেন? ভুল বুঝবেন? আমার সব কিছুই তো না বলতেই পরে ফেলেন, এইটুকু বোঝেন না আব্রাহাম সাহেব?
মলাটবদ্ধ কতগুলো ভয়ংকর অনুভূতি সাগ্রহেই বলে ফেললো মোহর, মেহরাজের পিঠে ঠোঁট ডুবিয়ে নিজস্ব উদ্দীপনা টুকু বুঝিয়ে দেওয়ার মতো দুঃসাহসিক কাজটা করে নিজেও যেনো হতবাক হয়ে রইলো। ক্লান্ত, শিথিল হাতদুটো ছাড়িয়ে নিলেও আঁটকে গেলো, শক্তপোক্ত একটা বন্ধন চেপে ধরলো হাতদুটো। এক ঝটকায় পেছন ঘুরে নিজের পেটের দুপাশে হাতদুটো জড়িয়ে নিয়ে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নিলো মেয়েলি শরীর টা।
আসল ব্যাপারটা বুঝতে বেশ কয়েক লহমা লেগে গেলো মোহরের, নিজের অবস্থানটুকু উপলব্ধি করে ভয়াতুর চাহনিতে ঘাড় উঁচু করে তাকালো, আবছা আবছা আলোয় মেহরাজের অধরকোণের দুষ্টু হাসির মর্মার্থ বোঝার আগেই মেহরাজ কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল
– মাঝে মধ্যে বউয়ের অ্যাটেনশন পেতে একটু টেকনিক্যালি হতে হয় বুঝলেন
মোহর জ্বলজ্বলে চোখেও কেমন বিস্মিত হয়ে তাকালো, মেহরাজ দুই কাঁধ উঁচিয়ে দায়সারা ভঙ্গিমায় বলল
– বউ নিজ থেকে একটু আদর টাদর দিলে তো আর এসব নাটক করা লাগে না ,এতে আমার দোষটা কোথায় আমি পাচ্ছি না
মোহর হতবিহ্বলিত হয়ে বোকা বোকা মুখ করে তাকিয়ে রইলো। লোকটা ইচ্ছে করে এমন করলো তাহলে! ওকে নিজ থেকে কাছে নেওয়ার ষড়যন্ত্র! চোখ দু’টো ক্রমেই বড়ো হয়ে এলো, মুখ খুলে কড়া কিছু বলতে যাওয়ার প্রস্তুতিতে জল ঢেলে মেহরাজ ওর কোমর ধরে উঁচিয়ে নিজের পায়ের তালুতে দাঁড় করালো, ভীষণ শীতল গলায় বলল
– আমার মতো লম্বা হওয়ার পদ্ধতিটা জানতে চেয়েছিলেন নাহ? চলুন আমার সমান সমান করিয়ে দেই
বলে কোমর টা চেপে একদম নিজের কাছাকাছি ধরলো। পায়ের উপর রাখা পা দুটোকে এক পা এক পা করে তুলে, মোহরকে সাথে নিয়েই পায়ে পায়ে হাঁটতে থাকলো, আর পুরুষালী গলায় গুনগুনিয়ে গাইতে থাকলো
” তুমি সুখ যদি নাহি পাও…
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও,
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় মাঝে
আরও কিছু নাহি চাই গো….
আমারও পরান যাহা চাই ”
(সংগৃহীত চরন: রবীন্দ্রসংগীত)
.
.
.
চলমান
©Humu_❤️