ফানাহ্ পর্ব-৪৪

0
1362

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪৪
#হুমাইরা_হাসান

নিগূঢ় নীরবতার আঁজলে মৃদু বাতাসের গুণগুণ ছন্দ। রূপালী আলোয় পানিগুলো চিকচিক করে উঠেছে, দেখতে যেনো কোনো উজ্জ্বল বস্তুর মতোই লোভনীয় লাগছে। থালার মতো বৃহৎ গোলাকার চাঁদটার স্পষ্ট প্রতিফলন পড়েছে বিলের পানিটার উপর। প্রকৃতির এই বৈরাগী রূপের অগাধ বিচরণের মাঝে দুটো মানব-মানবী স্থবির, নিশ্চুপ নৈঃশব্দ্যতার পাল্লা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে চলেছে। মেহরাজের বুকেই গা এলিয়ে দিয়ে মোহর নিজের মৌনতা কায়েম রেখেছে দীর্ঘক্ষণ। আর নাইবা মেহরাজ নিজে কিছু বলেছে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মন ও শরীরেও বরফের ন্যায় শীতল আব্রু হয়ে শুষে নিচ্ছে প্রিয়তমার অশ্রুধারা। চুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙুলের আদুরে স্পর্শটা বহমান রেখে নিস্তব্ধতা ভাংলো মেহরাজের নরম গলার আওয়াজে

– মোহ! একবার আমার দিকে তাকাবেন না?

মোহর জবাব দিলো না। একদৃষ্টে চেয়ে আছে পানিতে ভরা গভীরতম জায়গাটা তে। এটাই তো সেই বিল যেটাকে মেহরাজের বারান্দা থেকে দেখা যেতো। দূর থেকে বিল মনে হলেও এটা আদও বিল নাকি পুকুর বোঝা গেলো নাহ। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ছোট ছোট ঢেউ গুলো এসে আছড়ে পড়ছে কিনারায়, তা থেকে কিঞ্চিৎ দূরেই মেহরাজ ওকে নিয়ে বসেছে। আর হাত দুয়েক এগোলেই পানি গুলো হয়তো ছোঁয়া যাবে।
মোহরের এই ভাবনার মাঝেই মেহরাজ ওর ঘাড়ের নিচে এক হাত রেখে আরেক হাতে থুতনিতে চাপ দিয়ে নিজের দিকে মুখটা ফেরালো। মোহর চুপচাপ বুকে হেলান দিয়েই তাকিয়ে রইলো। ঝকমকে আলোতে মোহরের নিষ্প্রভ মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলো মেহরাজ, ওর কপালে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ মেখে দিয়ে বলল

– শুধু চাঁদ, পুকুর আর ঘাস দেখবেন! আমায় দেখবেন নাহ?

মোহর হাসলো আলতো, খরখরে শুকনো ঠোঁট আর মলিন মুখে সে হাসিটা বেমানান ঠেকালেও মেহরাজ যেনো এটুকেও অগাধ মুগ্ধতা খুঁজে পেলো। ওর নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোহর ভীষণ দূর্বল গলায় বলল

– আপনি ভীষণ সুদর্শন রুদ্ধ। প্রকৃতির ওই সুন্দর চাঁদ আর আপনার ভেতরে আমি পার্থক্য করতে পারিনা। তবে আপনার ও একটা অসুন্দর দিক আছে, সেটা কি জানেন?

মেহরাজের কৌতুহলী চাহনিতে চোখ রেখে মোহর উঠে বসলো, সরে যেতে নিলেও মেহরাজের কাছ থেকে নিজেকে পুরোপুরি আলাদা করতে পারেনি, খানিক সরে বসে পুনরায় বলতে আরম্ভ করলো

– আমি। আপনার পাশে যে জিনিসটা বড্ড বেমানান সেটা আমি নিজে। আপনার নিখুঁত চেহারা, যোগ্যতা আর রাজকীয় মহলের ভেতর আমিই সবচেয়ে কুৎসিত। চেহারা, যোগ্যতা সব দিকেই। শরীর টাও তো পবিত্র রাখতে পারলাম নাহ, কেও একজন সুযোগ বুঝে ঠিকই খা’বলে ধরলো। সম্পূর্ণ না পারুক আমার শরীরে অপবিত্র আ’চড়ের কলঙ্ক তো ঠিকই রেখেছে

বাকিটুকু মেহরাজ শুনতে চাইলো নাহ, আর নাইবা শুনলো। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতেই মুখ এগিয়ে আনলো। মোহরের ঘাড়ের পেছনে চাপ দিয়ে চোখদুটো বুজে তীব্র আশ্লেষীপূর্ণ স্পর্শে ছুঁয়ে দিলো। পরোয়া করলো না কিছুই। কানে নিলো না মোহরের কথা, ঘাড়ের পেছনের হাতটার আঙুল সজোরে চেপে আরেক হাতের বেরিবাঁধে আবদ্ধ করলো কোমর। মোহরের ঠোঁট ছুঁয়ে গভীরতম উষ্ণতা মেখে চেপে ধরলো দু ঠোঁটের মধ্যিখানে। নিজের অধরযুগলের ডোরে বন্দিনী মোহরকে ক্ষণে ক্ষণে কাঁপিয়ে আরও মিশিয়ে নিলো নিজের মাঝে।
বিহ্বলিত মোহর থমকে রইলো, কেঁপে উঠলো ওর পাতলা শরীরটা । দুই বাহুর তলে চাপা পড়া হাত দুটো সন্তপর্ণে টেনে বের করলো, ভাবাবিষ্ট কম্পিত হাতের বুকের কাছে হাতের থাবায় ধাক্কিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো৷ ফলশ্রুতিতে আরও দৃঢ় হলো মাতাল করা স্পর্শ। পুরুষালী স্পর্শানুভূতিত কারাগারে বন্দিনী রূপে আঁটকে গেলো। আরেক হাতে মেহরাজের প্রশস্থ পিঠময় হাতের মৃদু স্পর্শ ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘাড় বয়ে চুলের মাঝে গলিয়ে দিলো আঙুলগুলো। সজোরে খামচে ধরলো নরম চুলের আস্তর , কিন্তু পরক্ষণে ঠোঁটে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হতেই ঢিলে হয়ে গেলো হাতটা, আদুরের স্পর্শে জড়িয়েও ধরলো মেহরাজের ঘাড়। সেই আত্মগড়িমা, নিজেকে তুচ্ছ করার একচেটিয়া মনোভাব গুলো তলিয়ে গেলো মেহরাজের দেওয়া সুখদুখমাখা আদরে। ওষ্ঠভাঁজে ক্রমাগত দংশন টা বিরতিহীন চলতে রইলো। ঠিক কত মিনিট, কত সেকেন্ড তা সময়ের দাঁড়িপাল্লায় পরিমাপ করা অসম্ভব হলো দুটো মানবের। অবশেষে ঠোঁট জোড়া আলগা করলেও ছাড়লো না মোহরকে নাকে নাক, ঠোঁটে ঠোঁট চেপেই রইলো দীর্ঘ একটা সময়, ওই সময়ের শেকলটাতে মোহর যেনো মেহরাজ নামক অনুভূতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতে হারিয়ে গেলো, নিষ্প্রাণ শরীরটাতে মেহরাজের উষ্ণ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের উচ্ছ্বাস শিরা উপশিরাময় বাহিত হলো। মেহরাজ ওর ঘাড়টা ছেড়ে দিয়ে গালের হাত রেখে বলল

– যেই বুকটা একটা গহীন কারাগার , যেখানে একবার বন্দিনী হলে, আমৃত্যু মুক্তি নেই। ঠিক সেইখানেই আপনার বসবাস মোহমায়া। আপনার মোহ আর মায়া কোনোটাই কাটানো সম্ভব না, আর নাইবা কখনো কমবে। চক্রবৃদ্ধির ন্যায় বেড়েই যাচ্ছে প্রতিটি মুহুর্তে, প্রতিটি ক্ষণে।

থামলো খানিক। অস্থির করা স্পর্শে তীব্র আদর মিশিয়ে মোহরের কপালে ডায়ে বাঁয়ে নাকে থুতনিতে অজস্র চুমুর আদর মাখিয়ে আবারও বুকের মাঝে চেপে ধরলো মেহরাজ। অসহ্য করা অনুভূতির মেঘ ঠেলে, ঠোঁট চেপে বলল

– আপনার বলা প্রতিটি শব্দ, হরফ যে আমার মনের ভেতরে আঁ’চড় কাটে তা কি আপনি বোঝেন না! তবুও কেনো পাষাণীর মতো কথা বলে ক্ষতবিক্ষত করে দেন আমার ভেতরটা!

মোহর যেনো স্তম্ভিত, আড়ষ্টিত। ঝিরিঝিরি অনুভূতির কম্পনে অতিষ্ঠ দেহ-মন টা নির্বাক করে দিয়েছে স্বরযন্ত্রকে। থেমে থেমে ঠোঁট ভিজিয়ে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করার প্রচেষ্টায় নিজেই নিজের উপর বিরক্তবোধ করছে। মেহরাজের আদর,স্পর্শ, ওর প্রতিটি বাক্য এক অন্য ভূবনে তলিয়ে দিচ্ছে ওকে। দূর্বল অনুভূতিয়ময় মনটাকে আরও নিস্তেজ করে দিচ্ছে। ভালোবাসাময় অনুভূতির অসহ্য হুঁল ফুটছে বুকের ভেতর। চোখ ভরে এলো অজানা কষ্টে, যন্ত্রণায়, অপরাধবোধে।
মেহরাজ যেনো নির্দ্বিধায় পড়ে নিলো মোহরকে ওর ভেতরের ঝড়কে। রয়েসয়ে ওকে সোজা করে গালে দুহাত রাখলো, চোখে চোখ মেলে পূর্ণদৃষ্টি রেখে বলল,

– আপনার এই জীবনটা শুধুই আপনার মোহ, শুধু আপনার জীবনের সমাপ্তিটা আমার। সমস্ত প্রশান্তি শুধুই আপনার, আর যন্ত্রণা গুলো আমার। সুখগুলো শুধুই আপনার, আর দুঃখগুলো আমার।সবকিছুই আপনার মোহ, আর এই আপনিটা শুধুই আমার। আমার অদ্বিতীয়া, আপনার প্রাণসঞ্চারক হয়ে আজীবন নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখতে চাই,আর রাখবো।

মোহর প্রত্যুত্তরে শুধুই নিশ্চুপ রইলো। কি-ই বা বলবে। এই মানুষটার কথার পৃষ্ঠে আদও কি কিছু বলা যায়! যার শব্দ, বাক্যবাণ ওর ভেতরে টাইফুনের প্রলয় তোলে আবার বরফের ন্যায় শীতল ও করে। যে ওর আপাদমস্তকটা চোখ বুজে পড়ে ফেলে তাকে কি আদও শব্দে জবাব দিতে হয়! নাহ মোটেও নাহ। লোকটা দিনকে দিন মোহরের অন্তরের অন্তস্থলে মিশে যাচ্ছে। অবিচ্ছেদ্য সত্তা হিসেবে তলিয়ে যাচ্ছে মন গহীনে।

________________________

প্রাণবন্ত সকাল! পাখির কলধ্বনি আর সূর্যের মিষ্টি আবেশে পরিপূর্ণ পরিবেশ। কিন্তু আসলেই কি সকালটা প্রাণবন্ত? উঁহু, পরিবেশ তার চাঞ্চল্যে বজায় রাখলেও গুমোট, গম্ভীর আব্রাহাম ম্যানসনের ভেতরটা। সকাল করেই পৃথক এসেছে, মেহরাজ পৃথক আরহাম এবং আজহার সবাই বসে। অরুণ আর তাথই এর ডিভোর্স ফাইল করার জন্য স্টেইটমেন্ট আর সাইন নিতে।

– তোমার কি কোনো মতামত আছে তাথই? তুমি কি সত্যিই ডিভোর্স ফাইল করতে চাও?

বাবার প্রশ্নের উত্তর টুকু দেওয়ার মতো ইচ্ছে কাজ করলো না তাথইয়ের ভেতর। বারবার এই টপিক কেনো তোলা হয় ও বোঝে না! এতো কিছুর পরেও কি কোনো প্রয়োজন ছিলো এসব জিজ্ঞেস করার? তাথইয়ের বিরক্তি ভরা মুখটা দেখে মেহরাজ নিজেই বলল

– ওর আর এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই। পৃথক, যত দ্রুত সম্ভব এটা শেষ কর। এই হেডএইক টা আর কোনো ভাবেই টলারেট করতে চাই না আমরা।

– আমার কাজ শেষ, শুধু তোর ফেরার অপেক্ষা ছিলো। আমি আজই এটা প্রেজেন্ট করবো। ওদের হয়তো মাস খানেক সময় দিতে পারে বোঝাপড়া করার জন্য

– আবার কিসের বোঝাপড়া দাদুভাই। এ নিয়ে কি আর কিছু বাদ আছে?

শাহারা বেগমের কথায় একরাশ বিরক্তি। যেনো এটার ইতি টানতে পারলে হাফ ছেড়ে বাঁচে। পৃথক মৃদু হেসে বলল

– এটাই নিয়ম দিদা। হাসব্যান্ড ওয়াইফ ডিভোর্স ফাইল করলে আইন থেকে মাস খানেক সময় দেওয়া হয় নিজেদের মাঝে বোঝাপড়ার জন্যে, তার পরেও যদি সমস্যা রয়েই যায় তখন স্টেপ নেওয়া হয় আবার। তাই নিয়ম রক্ষার্থে হলেও মাস খানেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবুও আমি চেষ্টা করবো ডিউরেশন কমানোর।

বলে বাকিদের সাথে বাকি কথা সই সহ অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করে উঠে এলো পৃথক। মেহরাজ হাঁটতে হাঁটতে ওর সাথে দরজা পেরিয়ে এলো

– মোহর কেমন আছে এখন?

– আগের চেয়ে বেটার। ঘুমিয়ে আছে।

– একবার চেকাপ করিয়ে নিস, হাতে পায়ে ইঞ্জুরিড হয়েছে অনেকে

মেহরাজ চুপ রইলো, মাথা তুলে পৃথকের দিকে চেয়ে রোমন্থন গলায় বলল

– ওরা এসিডে ঝল’ছে দিতে চেয়েছিলো পৃথক, আমার মোহরের হাতে এখনো ফোটা ফোটা কালচে পোড়ার দাগ।

পৃথক পকেট থেকে হাত দুটো বের করলো। কপাল চুলকে বলল

– মোহর একমাত্র সাহস আর কৌশলের জোরে বেঁচেছে মেহরাজ। ওকে প্রথমে তিনটা ছেলে ধাওয়া করেছিলো, আর এসিড ওদের হাতেই ছিলো। ওদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসলেও ওই স্ক্রা’উন্ডেল টার হাতে আঁটকে যায়। ঠিক কতক্ষণ ধরে যে মোহর লড়াই করে গেছে আল্লাহ ভালো জানেন, আমি তো শেষ মুহুর্তে পৌঁছেছি।

– আমার দোষ। আমার ওকে একা ছাড়া উচিত হয়নি কোনো ভাবে। আর মাঝখানে কনফারেন্সের জন্য আমি লোকেশন টাতেও চোখ রাখতে পারিনি।

মেহরাজের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলো। তাতে মিশ্রিত তীব্র ক্ষোভ আর ক্রুদ্ধতা। পৃথক কিছু একটা ভেবে বলল

– দোস্ত! মোহর মনে হয় ওকে চিনতে পেরেছে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি এই ব্যাপারে,কিন্তু আমার মনে হলো। তবে একটা জিনিস আমি খুব ভালো ভাবে রিয়ালাইজ করেছি মোহর প্রচন্ড কাম ক্যারেক্টরের হলেও অনেক চালাক। উপস্থিত বুদ্ধিটা একদম প্রশিক্ষিতের মতো। ও যেই পরিস্থিতিতে মোকাবেলা করেছে সেখানে হাফ ভিক্টিম রা প্যানিকড হয়েই বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে।

মেহরাজ মোটেও অবাক হলো নাহ। বরং মুখে সরু হাসির রেখা টেনে বলল

– এ কথা আজ বলছিস? ও আমার বাঘিনি,কোনো পরিস্থিতিকেই ও ভয় পায় না। চার, পাঁচটা কুকুরকে একা কেলিয়ে মাথা ফাটি’য়েছিলো ও। একটা মেয়ে হিসেবে যতদূর সম্ভব তার চেয়েও বেশি মোকাবেলা করতে জানে ও। শ্বশুর মশাই নিজের মতোই বানিয়েছে মেয়েকে।

বলে আড়চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে আবারও বলল

– ভয় পাই শুধু সম্পর্ককে,আদর-ভালোবাসাকে।তাই তো গুটিয়ে রাখে নিজেকে, খোলসে আবৃত করে রাখে।

– মেহরাজ, কি করবি তুই?

পৃথকের কথায় অন্যরকম টান,সুর। যা যেকোনো মানুষের ই বোধগম্য হবে নাহ, চঞ্চলিত কৌতুহলী চোখ জোড়া মেহরাজের জবাবের অপেক্ষায় তীর্থেরকাক হয়ে রইলো, তাতে একরাশ সন্ধিৎসা ঢেলে মেহরাজ অথর কোণে সরু হাসির রেখা টেনে বলল

– দেখা যাক। বীজ যখন বুনেছে ফসল তো ভোগ করতেই হবে।

.

– তুই আর কতো ঘুমাবি রে সাঞ্জে, বেলা দশটা পার হয়েছে, এখনো পরে পরে ঘুমাচ্ছিস।

– আরেকটু পরই উঠছি আপি, চুপ কর না

সাঞ্জের ঘুমু ঘুমু গলার উত্তরে তাথই বেশ বিরক্ত হলো। বোনের হেয়ালি দেখে ও দিনকে দিন অবাক হচ্ছে। পড়াশোনার প টাও মুখে আনে না এই মেয়ে। আগে তো যাও ছিলো দুদিন ফুফুর বাড়িতে ঘুরে এসে আরও খামখেয়ালী বেড়েছে। হয় ঘুমাবে না তো ফোন নিয়ে পরে থাকবে, এখন তো ঘর থেকেও বের হতে চাইনা, নাইবা মানুষের সাথে মেশে আগের মতো।

– সাঞ্জে তুই যদি এক মিনিটের মধ্যে না উঠিস তাহলে আমি কিন্তু মা কে ডেকে আনবো। পিঠের উপর চেলাকাঠ ভাঙলে সব ঘুম ছুটে যাবে।

প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সাঞ্জে। তাথই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল

– তোর কি শরীর খারাপ?

সাঞ্জে মাথা নাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকলো। তাথইয়ের কেমন যেনো অন্যরকম লাগলো বোনকে, মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখের নিচে কালিও পড়েছে। ও কি ঘুমাই না রাতে? ভাবনার মাঝেই টুং করে একটা শব্দে নড়েচড়ে উঠলো তাথই। ফোনটা হাতে নিয়ে চোখ পড়লো মাত্রই আসা ম্যাসেজে

” need to talk with you, it’s very urgent. some personal discussion about divorce. please come at 5 in the park beside the town hall market ”

ম্যাসেজ টার প্রেরকের নাম্বার সেভ না থাকলেও চিনতে অসুবিধা হলো না তাথইয়ের। কিন্তু ডিভোর্স বিষয়ক কি এমন কথা থাকতে পারে যা আলাদা ভাবে বলতে হবে! এই তো গতো রাতেই কথা হলো লোকটার সাথে। রাতের কথা মনে পড়তেই তাথইয়ের মনে হলো মোহরের সাথে দেখা করা দরকার সকাল থেকে মেয়েটার সাথে কথা হয়নি। মোহরের কথাটা মাথায় আসতেই নিছক ভুলে গেলো ম্যাসেজটার ব্যাপারে, উঠে মোহরের ঘরের দিকে এগোলো।

মোহর ঘরে বসে একটা ম্যাগাজিন মতো কিছু একটার পৃষ্ঠা ওলটাচ্ছে, তাথই এলে ওকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল

– আপা, বোসো

তাথই ওর কাছাকাছি বসে বলল,

– এখন কেমন আছো মোহর

– ভালো আছি আপা, সুস্থ আছি।

কিন্তু তাথইয়ের চোখে মুখে বিরাট কৌতূহল, দুশ্চিন্তার ছাপ, ললাটের তিনটা ভাঁজ রেখেই বলল

– সত্যিই কি ঠিক আছো? আমি ভাবতেও পারছিনা কালকের ব্যাপারটা। এমন জঘন্য, কুৎসিত কাজটা কে করলো

মোহর হাতের ম্যাগাজিন টা ভাঁজ করে পাশে রাখলো। আলতো হেসে সবিনয়ে বলল

– জরুরি তো না এ প্রত্যেকটা মানুষের চেহারাই সুন্দর হবে একজন গায়ের গড়নে,আকৃতিতে,মানানে ভীষণ কুৎসিত ঠিক সেভাবেই অন্যজন সবদিক থেকে অনিন্দ্য সুন্দর হতে পারে। ঠিক তেমনই মানুষের মন,মানসিকতার ব্যাপারটাও সেরকম। আমাদের আশেপাশে এমন হাজারো নিকৃষ্ট মানুষ আছে যারা বা যাদের ভেতরের নিকৃষ্টতা এতোটাই জঘন্য যে তারা মানুষের চরম সর্বনাশ করতেও দুবার ভাবে না। তেমনই ভালো মানুষ ও আছে যারা কোনো সম্পর্ক বা লাভ ছাড়াই মানুষের জন্য ভাবে, করে। তাই খারাপ টাকে দূরে সরিয়ে ভালো টাকে গ্রহণ করে নিতে হয়।

তাথই মলিন মুখেই বলল

– তা তো বুঝলাম। কিন্তু আমারতো চিন্তা বাড়ছে, আজ এমন করেছে কাল আবার করবে না তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই।

মোহর রহস্যময়ী হেসে বলল

– তুমি কি আদও বুঝেছো আপা?

তাথই ভ্রু কুচকে মোহরের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই ললাট প্রসারিত হলো, কুঞ্চিত স্বরে বলল

– আমি কি বলছি আর তুমি কি বোঝাচ্ছো আমাকে! খুব বুঝদার হয়ে পড়েছো এক এক জন তাই না

মোহর হেসে দিলো ফিক করে। অসুস্থ চেহারাটাতেও মোহরের হাসিটা নির্মল, অমায়িক লাগলো। কই কাল অব্দিও তো হেসেছিলো তখন তো এমন লাগেনি! আজ কেনো এইরকম খারাপ পরিস্থিতি পার করেও মুখের হাসিটা এতো নির্ভেজাল, পরমুহূর্তেই মনে হলো মোহরের হাসির কারণ টা তো কাল ছিলো নাহ, আজ আছে। তাই হয়তো। মোহর আর তাথইয়ের কথার মাঝেই ফোন বেজে উঠলো, মোহরের ফোনটা কাল পৃথক দিয়ে গেছে এতো কিছু সহ্য করেও ফোনটা এখনো ভালো আছে বলতে হয়

– হ্যালো মোহর! তুই কেমন আছিস? কাল সন্ধ্যা থেকে ফোন দিচ্ছি তোকে ধরিস না কেনো।বুবুকে মনে পড়ে না! আমাকে ভুলেই গেছিস এখন

– বুবু আমাকেও বলতে দে একটু! কাল ফোন আমার কাছে ছিলো না। আর সাইলেন্ট থাকাই আমি খেয়াল ও করিনি, স্যরি। আর কাল সকালেও কথা বলেছি তোর সাথে ভুললাম কি করে!

অবিলম্বেই ওপাশ থেকে মেয়েলি মিষ্টি গলাটা বলে উঠলো

– সন্ধ্যায় শ্রী ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো তুই আমার বাসায় এসেছিস কি না, তোকে ফোনে পাচ্ছিলো না। তুই নাকি বাড়ি পৌঁছাসনি তোর ননদ ওকে ফোন করেছিলো। আমি যখন ফোন দিয়ে তোকে পেলাম না কতো চিন্তা হচ্ছিলো জানিস! সারাটা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। এতো বেখেয়ালি কেনো তুই, চাপকে সোজা করা উচিত বেয়াদব মেয়ে

মোহর একটা উত্তর করার ও সুযোগ পেলো নাহ। এই হলো ওর বোনের স্বভাব। একটু কিছুতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে, ধৈর্যহারা হয়ে যায়। তার উপর আরেকজন হলো শ্রীতমা। ওইটুকু সময়ে মিথিলাকেও ফোন করে ফেলেছে। মোহর বুবুকে শান্ত করে দুই মিনিট কথা বললে মিথিলা হড়বড় করে বলল

– আচ্ছা ঠিকাছে রাখছি। ইফাজ অফিসে যাবে ওর খাবার না দিয়ে আমি গল্প করছি। রাখছি, সাবধানে থাকিস

বলে খট করে কল লাইনচ্যুত করলো। মিথিলার এমন হটকারিতা আর চঞ্চলতা দেখে তাথই শব্দ করেই হেসে উঠলো, হাসতে হাসতে বলল

– তোমার বুবু মনে হয় পুরোটা তোমার বিপরীত। তুমি যতটা শান্ত ও ততটাই অস্থির স্বভাবের।

মোহর ক হেসে ফেললো। খুব আদর ভরা গলায় বলল

– হ্যাঁ। ও এতো কথা বলতো আর ছটফট করতো বলেই আব্বা ওকে তোতাপাখি আর আমাকে পুতুল বলতো। আম্মাতো অতিষ্ঠ হয়ে যেতো ওর ননস্টপ বকবক শুনে, ইফাজ ভাই যে কি করে ওকে সহ্য করে

হাসির মাঝেও যেনো চোখের কোণা চিকচিক করে উঠলো মোহরের, বাবা মায়ের কথা,স্মৃতি গুলো যে ওর ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে যায়। যাদের অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে দুনিয়াতে এসেছে, তাদের কি ভোলা সম্ভব, কিন্তু তবুও তো বাঁচতে হয়। সকল দুঃখ যাতনা উপেক্ষা করেই বাচতে হয়

_________________________

একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরটার মাঝে বসে, আশেপাশে জরাজীর্ণ অবস্থা, ফ্লোরে এক জাগায় ছোপ ছোপ রক্ত ও লেগে আছে। গা গুলিয়ে এলো তিয়াসার, কিন্তু ওর কিছুই করার নেই। ক্রমাগত হাত পা আছড়াচ্ছে, হাত দুটো চেয়ারের পেছনে বাঁধা, মুখের টেপ লাগানো। পা দুটো দড়ির ঘষাতে চামড়া ছিলে গেছে, এখন কিঞ্চিৎ নড়াতে গেলেও জ্বালাপোড়ায় অসহ্য হয়ে উঠছে। চিৎকার করতে গিয়েও পারছে না, চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। এ কোন জাগায় আনলো ওকে! কারা আনলো। মাথা দু ধারে ঝাঁকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে আর্তনাদ করলো তিয়াসা। হুট করেই জুতার,খটখট শব্দে নিশ্চুপ হয়ে গেলো কেও এদিকেই আসছে!
কৌতূহলী চোখে চেয়ে রইলো দরজার দিকে, এক মিনিট দুই মিনিট, অবশেষে ওর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দরজা টা খট করে খুলে গেলো, প্রবেশ করলো একটা পুরুষালী অবয়ব, ঠিক যেই ভয়টা পাচ্ছিলো তিয়াসা। এক মুহুর্তের জন্য ঘাম গুলো শুকিয়ে গেলো, পিঠ বয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো ওর।

তিয়াসার ভয়াতুর চোখে চেয়ে এগিয়ে এলো, এক টান দিয়ে মুখের টেপ খুলে দিতেই বড়ো বড়ো দম ছাড়লো, হাফাতে হাফাতে বলল

– র্ রাজ…রাজ আমাকে বাঁচাও। আমাকে কেও লোক ভাড়া করে তুলে এনেছে এখানে। এই জায়গাটা খুব হরিবল, জঘন্য। আমি আর এক মুহূর্ত থাকতে পারছি না।প্লিজ বাঁচাও আমাকে

মেহরাজ একটা চেয়ার টেনে মুখ বরাবর বসলো আয়েশী ভঙ্গিতে। গা এলিয়ে দিয়ে নিষ্পলক চেয়্ব রইলো খানিক, তিয়াসার বিভ্রান্ত চাহনি আর নিস্তব্ধতা ভেদ করে বলে উঠলো

– ও কোথায়?

তিয়াসা ভ্রু কুচকে বলল

– কে? কার কথা বলছো?

মেহরাজ ঝুকে এলো, বা হাতটা সামনে আনতেই গলা শুকিয়ে এলো তিয়াসার, মেহরাজ ভীষণ শাণিত গলায় আবারও বলল

– ও কোথায় লুকিয়েছে?

তিয়াসা চোখ দু’টো ধারালো চকচকে জিনিসটায় রেখেই তুতলিয়ে বলল

– ক্..কার কথা বলছো তুমি

মেহরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো, ছু’ড়িটা উঁচিয়ে বেঁধে রাখা তিয়াসার হাতের কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত এক টান দিলো। মুহুর্তেই টকটকে তরলে ভিজে গেলো তিয়াসার ফর্সা হাত, চিৎকার করে উঠলো ও। কান্নারত কণ্ঠে বলল

– কি করছো রাজ, আমার কষ্ট হচ্ছে। আমাকে ছাড়ো, ছেড়ে দাও প্লিজ

মেহরাজের মুখাবয়বের পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো নাহ। বরং তীক্ষ্ণ গলায় বলল

– কষ্ট হচ্ছে! এইটুকুতেই? তাহলে আমার মোহ কি করে ছিলো এখানে সেটা মনে হয়নি? আগে কেনো ভাবলে না আমার জিনিসে হাত দিলে আমি জাহান্নাম দেখিয়ে ছাড়বো

শেষের কথাটা হুংকার ছেড়ে বলে উঠে দাঁড়ালো মেহরাজ। এক লা’ত্থি দিয়ে চেয়ারটা তিন হাত দূরে ছুড়ে দিলো। তিয়াসার দিকে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল

– আমি নিষেধ করেছিলাম না? সাবধান করেছিলাম তো!

– আমার ভুল হয়ে গেছে মেহরাজ আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ, আর আমিতো কিছুই করিনি যা করার ও ক করে..

পুরোটা শোনার আগেই সরে গেলো মেহরাজ, কোত্থেকে সেটা তিয়াসা দেখতে পেলো নাহ মাঝারি আকৃতির একটা কাঁচের শিশি নিয়ে আসলো ওর সামনে। স্বচ্ছ কাঁচের ভেতরের তরল টা দেখে আঁৎকে উঠছে তিয়াসা, আকুতি কাকুতি করে বলল

– মেহরাজ, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি পায়ে পড়ি তোমার। আমি কিচ্ছু করিনি সব তো

– কোথায় পালিয়েছে জানোয়ার টা?

– আমি সত্যিই জানি না। কাল রাত থেকে আমি ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি

ব্যস..এটাই শেষ প্রশ্ন ছিলো মেহরাজের। এবার শুধু প্রচন্ড ক্ষুব্ধ গলায় বলল

– মোহরের হাতের ছোট ছোট ক্ষত গুলো দেখে আমার ভেতরে কিরূপ জ্বল’ন ধরেছে,ঠিক কোন জাগায় হাত দেওয়ার সাহস করেছো বুঝিয়ে দেই

বলার পর এক মুহূর্ত সুযোগ না দিয়ে তিয়াসার ডান হাতে তরল জাতীয় মা’রাত্মক জিনিসটা আস্তে করে ঢেলে দিলো । পুনরায় মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিলো মেহরাজ। অস্ফুটে স্বরে, বেঁধে থাকা অবস্থায় গুমরে গুমরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলো তিয়াসা, হাতের উল্টো পাশের চামড়াতে একটা জায়গা জুড়ে চামড়া জ্বলছে, প্রচন্ড রকম যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলো
.
.
.
চলমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে