#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪৩
#হুমাইরা_হাসান
কপালের কোণ ঘেঁষে ঘামের সরু রেখা তিরতির করে বয়ে পড়লো। মাথাটা মেঝের দিকে ঝুঁকানো। এলোমেলো চুলগুলো লেপ্টে আছে গাল, ঘাড় আর কপালে। ঘিয়ে রঙের জামাটা ঘামে ভিজে পিঠের চামড়ার সাথে মিশে আছে। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলছে নিঃশব্দে। স্থির, অনড় শরীরে মেঝেটে গুটিয়ে বসে আছে মেয়েলী শরীর। বাহিরের চেহারাটা যতটা নিশ্চুপ, শাণিত দেখাচ্ছে ভেতরেই ততই ভয়,আতঙ্ক, চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। উত্তপ্ত ক্রোধ, শঙ্কা মিশ্রিত অনুভূতি টা ক্ষণে ক্ষণে কাঁপিয়ে তুলছে পাতলা শরীরটাকে।
ঠক্ ঠক্ জাতীয় শব্দে চোখ দু’টো কিঞ্চিৎ উপরে তুলে তাকালো মোহর। চোখ দু’টো এখনো চশমার আড়ালে ঢাকা,মুখে বাঁধা রুমালটার ও নড়চড় হয়নি একচুল। হাত দুয়েক দূরেই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে পুরুষালী শরীরের এক কদাকার জন্তুরূপী মানুষটা। হাতের তর্জনী তুলে চেয়ারের হাতলে অনবরত শব্দ করছে। কালো কাঁচে আবৃত থাকা সত্ত্বেও মোহর স্পষ্ট টের পেলো তার আড়ালের ভয়ানক লোভাতুর চাহনি। পিঠে লেপ্টে থাকা জামা, ওড়নার আড়ালের গলা বুক সবদিকেই বিশ্রী চোখ দু’টোর দৃষ্টি।
মোহরের সারা গায়ে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই বলল
– ইশ! ঠিক কতদিন, কতটা দিন আমাকে এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে জানো?
মোহর ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, সেই চাহনিকে অগ্রাহ্য করে ছেলেটি ঝুঁকে এলো, হাঁটুর উপরে দুইহাত রেখে মোহরের দিকে আঙুল তুলে বলল
– তুমি এভাবে আমার সামনে বসে থাকবে, একটা ঘরে শুধু তুমি আমি। আর কেও নাহ। আহহ শান্তি লাগছে মোহর শিকদার তোমাকে আমাক মুঠোয় আনতে পেরে যতটা না শান্তি পাচ্ছি তার চেয়েও দ্বিগুণ আনন্দ লাগছে মেহরাজ আব্রাহামের বউকে তুলে এনেছি এই ভেবে।
শরীর কাঁপিয়ে পৈশাচিক হাসি দিলো ছেলেটি। মোহর দুহাতে পরনের পোশাক খামচে ধরে রেখেছে। চোখ বন্ধ করে প্রতিটা কথা মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় শুনছে। কণ্ঠস্বর টা ঠিন চিনতে পেরেও পারছে নাহ। মনে হচ্ছে এটা আসল কণ্ঠস্বর নাহ। কৃত্রিমতা মেশানো, ইচ্ছে করেই কণ্ঠের পরিবর্তন আনা হয়েছে যাতে চিনতে না পারা যার!
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা, এক পা দুই পা করে এগিয়ে এসে মোহরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো কিঞ্চিৎ দূরত্ব বজায় রেখেই। ফিসফিসানির ন্যায় বলল
– যে যতই তোমাকে মে’রে ফেলার কথা বলুক, আমি কিন্তু তা করিনি! কারণ আমি তো তোমাকে চাই! নিজের কাছে,নিজের করেই চাই। তুমি, তোমার এই সুন্দর শরীর টা আমার চাই মোহর।
গা গুলিয়ে এলো বিশ্রী কথাগুলো শুনে। ঘৃণায় সারা গা তিরতির করে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো নোংরা মেঝেতে।
একতলা পাকা বাড়ি, দেওয়ালের চুন খসে ইট গুলোর জরাজীর্ণ অবস্থা, আশেপাশে কতগুলো বস্তা আর ময়লার স্তুপ জমা চাদরে ঢাকা কতগুলো আসবাবপত্র। ঘরের মাঝে দুটো মানুষ ছাড়া কোনো কাক পক্ষির ও উপস্থিতি নেই। ওই তিনটা ছেলে আদও আশেপাশে আছে কি না মোহরের জানা নেই। তখন মিনিট পাঁচেক আগের সময়টাতে — মোহর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই পেছন থেকে দুটো হাত ওর চোখ কালো কাপড়ে আবৃত করে দেয়, ডান হাতের বাহু সজোরে চেপে ধরে টানতে টানতে ওকে এনেছে এই জায়গা টাতে।
গরম ঢোক গিলে সাবধানী চোখে আশেপাশে চোখ বুলালো মোহর, এর মাঝেই গালের উপর মৃদু চাপ খেলো, বজ্রাহতের মতো চমকে উঠলো। গ্লভসে ঢাকা হাতটা ক্রমেই তার বিশ্রী লোলুপ স্পর্শ টা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত গাল থেকে গলা, হাত আস্তে আস্তে নীচের দিকে নামতে থাকলো। নিরীহ শরীর টা ছুঁয়ে এক ভয়ংকর পৈশাচিক আনদে ঝলমল করে উঠছিলো চোখ জোরা। হাতের বিচরণ টা নিচে আসতে আসতে উরুর উপর আঁটকে গেলো, দ্বিতীয় দফায় চাপ দিতে নিবে তখন হাতটা থেমে গেলো, হাতের উপরে আরেকটা নখর ধারালো থাবা টের পেয়ে কিঞ্চিৎ বিষ্ময় নিয়ে চোখ তুলে তাকাতে নিলেও ধাতস্থ হয়ে ওঠার আগেই কপালে সজোরে একটা আঘাত পড়লো, হাতে মোচড় খেয়ে নাক বরাবর একটা ঘুঁ’ষি খেয়ে ধপ করে পড়লো মেঝেতে, কয়েক লহমার জন্যে চোখে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলো নাহ। সাময়িক সুযোগটার মোক্ষম ব্যবহার করে হাত থেকে ছোট্ট পাথরটা ফেলে উঠে দাঁড়ালো মোহর, ছুটে গিয়ে দরজাতে আঘাত করলো, কিন্তু ভুতুড়ে ভেলকির মতো চোখ দু’টো আঁটকে গেলো ছোট্ট তালাটার দিকে নজর পরতেই। শয়তানটা ভেতর থেকেই তালা দিয়ে রেখেছে! ছুটন্ত গতিতে আবারও এলো আগন্তুকের কাছে। পাথর দিয়ে সজোরে আ’ঘাত দেওয়ায় কপালের ছোট্ট একটা অংশ থেকে রক্ত ছুটছে, তবুও দমে গেলো না পুরুষালী শরীরটা। টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়ালো। মাথার পেছন দিকটায় ফ্লোরে বা’রি লেগে কানের ভেতর ঝিঁঝি পোকার আর্তনাদ শুরু হলেও ব্যথার চেয়ে ক্রোধটা যেনো তিনগুণ বাড়লো। কান থেকে হেডসেটের ন্যায় ছোট দুটো যন্ত্রের একটা খুলে থপ করে পরে গেলো সাথে চোখের চশমা টাও। রুমালটা খোলার আগেই আরও দ্বিগুণ ভাবে আঁটসাঁট করে নিলো।
মোহর বিস্ফারিত নয়নে চেয়ে রইলো। চোখ দু’টো! এই চোখ দু’টো ওর ভীষণ চেনা, কিন্তু কোথায় দেখেছে? কোথায়! অত্যাধিক চাপে মাথা টা ঝিম ধরে আসলো, আশেপাশে তাকিয়ে লাকড়ির মতো একটা কাঠের টুকরো তুলে নিলো। পুরুষাবয়ব টা ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটে এলেই হাত তুলে আ’ঘাত করতে নিলেও এক হাতে লাঠিটা খপ করে চেপে ধরলো লোকটা , আরেকহাতে মোহরের কোমর পেঁচিয়ে নিল। মোহর ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার তীব্র প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেই আরেক হাতের নখ বিঁধিয়ে খা’মচে ধরলো চোখ আর তার আশপাশের উন্মুক্ত অংশ। তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে এক ধাক্কায় মোহরকে ফেলে দিলো মেঝেতে। হুংকার দিয়ে বলল
– শা’লির মা** খুব ত্যাজ নাহ? খুব ত্যাজ? আজকে তোর এই ত্যাজ না ছুটাতে পারলে আমিও
বাকি টুকু সম্পূর্ণ না করেই মোহরের উপরে ঝাপিয়ে পড়তে এলেই দরজার বাইরে একটা পুরুষালী গলা শুনতে পেলো,
– মোহর, মোহর তুমি ভেতরে আছো? মোহর কথা বলো!
পরিচিত কণ্ঠে চোখজোড়া চিকচিক করে উঠলো মোহরের, এক লহমা ব্যয় না করে চেঁচিয়ে বলল
– ভাইয়া! ভাইয়া আমাকে বাঁচান
পরবর্তী কথা টুকু বলার আগেই মোহরের মুখটা চেপে ধরলো দুটো হৃষ্টপুষ্ট হাত। প্রচণ্ড শক্তির সাথে শরীর টা হার মানলেও হার মানেনি ওর চৌকস মস্তিষ্ক, বা হাতটা কৌশলে এগিয়ে হাতড়ে ছেলেটার পকেটে ঢুকিয়ে একটা চাবি বের করে আনলো, মুখ চেপে রাখা হাতটাই শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে কামড়ে দিলে র’ক্ত বেরিয়ে এলো হাত থেকে । প্রচণ্ড ব্যথা সহ্যের বাহিরে গেলে হাত ঢিলে করে দিলো আগন্তুক, মোহর এক ছুটে গিয়ে চাবিটা তালায় লাগিয়ে খুলে ফেললো, ক্রমশ ধাক্কাধাক্কির ফলে তালা খোলার সাথে সাথে দরজা হাট করে খুলে গেলো, পৃথক এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ভেতরে এলেই মোহরের বিধ্বস্ত অবস্থাটা দেখে ওর বুকটা কেঁপে উঠলো।
শরীরের জাগায় জাগায় কাপড় ছিড়ে গেছে, ক্রমাগত হাফাচ্ছে, পৃথক মোহরের দিকে ধ্যান দেওয়ার সুযোগ নিয়ে এক ধাক্কা দিয়ে পালালো আহত ছেলেটা, পৃথক হুমড়ি খেয়ে পড়তে নিলেও দরজার হাতল চেপে সামলে নিলো। পৃথক ওর পেছনে না ছুটে এগিয়ে এলো মোহরের কাছে, টি-শার্টের উপরের হলদেটে শার্টটা খুলে মোহরের গায়ে পড়িয়ে দিলো। মোহর নিষ্পলক চোখে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। পৃথক ওকে এক হাতে আলতো ভাবে আগলে নিয়ে বলল
– তুমি ঠিক আছো? ও তোমার কোন ক্ষতি করেনি তো?
কয়েক লহমা ওভাবেই স্থির রইলো, ও এখনো ঘোরের মধ্যেই আছে যেনো। কি থেকে কি হলো! ও কি আদও ভেবেছিলো আজ এইরকম একটা লোমহর্ষক পরিস্থিতিতে ওকে পরতে হবে! একটু আগে এ কি হলো! ভাবতেই ওর সমস্ত স্নায়ু নির্জীব শূন্যে তলিয়ে যাচ্ছে। চোখ দু’টো ভয়াবহ শান্ত মোহরের, এই শান্ত দৃষ্টির আড়ালের দপদপানিটা পৃথক কতখানি আঁচ করতে পারলো জানা নেই। মোহরকে এক হাতে আগলে বের করে আনলো পোড়োবাড়ির ন্যায় বিভৎস দৃশ্যকে। ছেলেটা পালিয়েছে, হাতের কাছ থেকে পালালেও পৃথকের ভেতর ওকে খোঁজার নূন্যতম স্পৃহা দেখা গেলো নাহ।
গাড়ির সামনে এসে দরজা খুলে মোহরকে বসিয়ে দিলো। নিজে গাড়িতে বসে স্টার্ট দিলে দানবের মতো হুংকার ছেড়ে ইঞ্জিন টা শরীর কাঁপিয়ে ছুটতে শুরু করলো। মোহর তখনো নিশ্চুপ, নিস্তেজ। ওর এই প্রশান্ত অভিব্যক্তির কারণ কি এই আকস্মিক দূর্ঘটনা? আ’ঘাত? নারীমস্তিষ্কের দূর্বলতা? নাকি অন্যকিছু! পৃথক স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে আড়চোখে বার দুয়েক তাকালো মোহরের দিকে। পানির বোতল টা ওর সামনে ধরে বলল
– পানি খাও মোহর। বেটার লাগবে
মোহর নিঃশব্দে পানিও গলাধঃকরণ করে নিলো। পৃথকের কপালে সরু ভাঁজ পড়লো। আপাতত দূর্ঘটনা টার চেয়ে মোহরের অভিব্যক্তিটা ওকে বেশি ভাবাচ্ছে। এইরকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সার্ভাইব করা যেকোনো মেয়ের পক্ষে সম্ভব নাহ, তা হলেও ভীষণ রকম ভাবে প্যানিক অ্যা’টাক আসার কথা। অথচ এই মেয়ে কিনা চুপচাপ পাথরমূর্তির মতো বসে আছে! না আছে মুখে এক ছিটে ভয় না চোখে এক ফোঁটা পানি। পৃথক রয়েসয়ে জিগ্যেস করলো
– মোহর তুমি ঠিক আছো?
মোহর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। পৃথক আবারও প্রশ্ন করলো,
– ওরা কারা ছিলো তুমি কি চিনতে পেরেছো কাওকে?
মোহর মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর দিলে পৃথক থেমে গেলো। এই মুহূর্তে আর কোনো প্রশ্ন করা টা সমীচীন হবে নাহ। অনেক বড়ো একটা ধাক্কা সয়েছে মেয়েটা। আপাতত ওর রেস্ট দরকার। কিন্তু মোহরের যে অবস্থা ওকে এই অবস্থায় বাড়ি নিলে অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, পৃথক ঢোক গিলে আরও কিছু বলবে তার আগেই গম্ভীর গলায় মেয়েলী স্বরটা ভেসে আসলো ওর কানে
– আপনি আমার খোঁজ পেলেন কি করে?
পৃথক আড়চোখে তাকালো। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে আটটা। দেরী খুব বেশি না হলেও পরিস্থিতি টা ভীষণ করুন। পৃথক কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই জবাব দিলো
– মেহরাজ বলেছে
মোহরের কুচকানো ভ্রু টা কোনো প্রশ্নে পরিনত হওয়ার আগেই পৃথক বলল
– তোমার ফোনের লোকেশন টা অনেকক্ষণ ধরে এক জাগায় স্থির দেখাচ্ছিলো। এই সময়ে ওই জাগায় তোমার লোকেশন থাকাটা সন্দেহজনক ছিলো। বেশ কয়েকবার ফোনে ট্রাই করেও তোমাকে না পেলে আমাকে ফোন করে লোকেশন বলল মেহরাজ। তোমার ফোন অব্দি পৌঁছাতে পারলেও ওর বিধ্বস্ত অবস্থায় পরে থাকাটাই যথেষ্ট ছিলো তোমার পরিস্থিতি কেমন হতে পারে বোঝার জন্য। আশেপাশে অনেক খুঁজেছি। সুনসান জায়গা যেখানে মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে সেইরকম তিনটা জায়গার মধ্যে দুটো জায়গা খুঁজেছি। সৌভাগ্যক্রমে লাস্টটাতে তোমাকে পেয়ে গেছি। লাখো শুকরিয়া আল্লাহর কাছে।
মোহর নিশ্চুপ থাকলেও মনের ভেতর হাজারো ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্ন গুলোকে দমিয়েই রাখলো। ক্ষীণ নীরবতা ভেঙে পৃথক বলল
– ইউ আর টু মাচ ব্রেভ মোহর। তোমার জাগায় অন্য মেয়ে থাকলে এভাবে সার্ভাইব করতে খুব কমই পারতো। বলতেই হয়, আমি সত্যিই অবাক তোমার উপস্থিত বুদ্ধি আর মস্তিষ্কের ব্যবহার দেখে।
– আপনি না আসলে আজ অনেক কিছুই হতে পারতো ভাইয়া। যখন আমি মেঝেতে পরে আল্লাহর নাম জপছিলাম তখন আপনার কণ্ঠ শুনে আমার মনে হলো আমার নিজের ভাই এসেছে, আমার আর কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আপনার কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো ভাইয়া
– ভাইয়া বলে আবার কৃতজ্ঞতা? ভাই হয়েছি এতটুকু দ্বায়িত্ব কি আমার নেই? ভাই যখন বলেছো তবে আমি ভাই-ই। আর কখনও এভাবে বলবে নাহ। আর নাইবা একা বের হবে, যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে বলবে আমি নিজে গিয়ে তোমার কাজ করে দেবো।
মোহর মাথা ঝুঁকিয়ে নিলো। গাড়িটা এসে থামলো বিশালাকার বাড়ির সামনে থামলে। মোহর নেমে এলো, ওর পেছন পেছন পৃথক ও আসলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল বাজালেই এক মিনিট খানেকের ব্যবধানে খট করে দরজাটা খুলতেই তাথই এর উদ্বিগ্ন চেহারাটা দৃশ্যমান হলো। মোহরের চেহারা টা দেখেই ও বিচলিত স্বরে বলল
– এতক্ষণে ফিরলে মোহর। চিন্তায় আমার জান যাচ্ছিলো। শ্রীতমা বলল তুমি সন্ধ্যার আগেই বেরিয়েছো অথচ বাড়ি ফিরছিলে না দেখে আমি..
বাকিটুকু বলার আগেই মোহর আর ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পৃথককে দেখে মুখটা থমকে গেলো, বিস্ফারিত নয়নে আগাগোড়া মোহরকে পরখ করে করুন স্বরে বলল
– মোহর! এ কি হয়েছে তোমার?
এইটুকু বলতেই পৃথক তাথইয়ের হাত ধরে ওকে বাইরে টেনে আনলো, ধীর গলায় বলল
– চুপ করো। সব পরে জানা যাবে। আগে বলো বসার ঘরে কেও আছে?
তাথই স্তম্ভিত চোখে মোহরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়েই না বলল। পৃথক আবারও আগের ন্যায় বলল
– তুমি ওকে সাবধানে ঘরে নিয়ে যাও, যাতে কেও না দেখে। আর এখনি ওকে কিছু জিগ্যেস করার দরকার নেই। পরে আমি সব জানাবো
কথাগুলো একপ্রকার ফিসফিসিয়ে বলল তাথইয়ের কানে। তাথই আপাতত কোনো কিছু ভাবার সুযোগ টুকুও পেলো নাহ। চুপচাপ মোহরকে নিয়ে ওর ঘরে গেলো। ওকে বিছানায় বসিয়ে গা থেকে শার্ট খুলতেই চোখ দুটো নিজের অজান্তেই স্তব্ধ হয়ে গেলো, গলার স্বর ভেঙে এলো, আধো আধো শব্দে শুধু এইটুকুই বলল
– মোহর, সব ঠিকাছে? তুমি ঠিক আছো? তোমার কোনো ক্ষতি..
– কিচ্ছু হয়নি আপা। আমি ঠিক আছি
এই মুহুর্তে মোহরের মুখ থেকে নিঃসৃত সান্ত্বনা বাণী টুকু একেবারেই যথেষ্ট ছিলো না তাথই এর জন্য। বুকের ভেতর ধুকপুকানির ঝড় উঠেছে। ভীত ঢোক গিলে নিলো। ভাগ্যিস তখন কেও ঘরের বাইরে ছিলো না, আর কেও যাই হোক তাথই এর নিজের মা-ই মোহরের এই পরিস্থিতি দেখলে জঘন্য কিছু কথা বলতে দুবার ভাবতো নাহ। তাথই আর একটা প্রশ্নের শব্দ ও বের করলো নাহ। মোহরকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো, কাবার্ড থেকে জামা বের করে ওর হাতে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করলো, মিনিট দশেক পর মোহর বেরিয়ে এলো। তাথই তোয়ালে টা নিয়ে নিজে মোহরের ভেজা চুল গুলো মুছিয়ে দিলো। শরীরে লেগে থাকা ধুলোবালি, নোংরা গুলো মুছে গেলেও গলা, হাতের আচড় গুলো স্পষ্ট চোখে বিঁধছে, অজানা আতঙ্কে বুকখানা ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠলো তাথইয়ের। কিন্তু মুখ খুলে একটা প্রশ্ন করার সাহস পেলো নাহ। কি প্রশ্ন করবে ও! কোন মুখে করবে? ও তো নিজেও একজন মেয়ে, মোহরের জাগায় ও থাকলে কোনো উত্তর করতে পারতো আদও!
চুল মোছানো শেষে মোহরকে খাবার কথা বললে ও খুব স্বাভাবিক আর স্পষ্ট গলায় বলল
– আমি কিচ্ছু খেতে চাইনা আপা। আমি একটু ঘুমাতে চাই, খুব ক্লান্ত আমি।
তাথই কেনো যেনো মোহরের কথার পৃষ্ঠে দ্বিরুক্তি বা জবাব করতে পারলো নাহ। কথাগুলো কেমন দলা পাকিয়ে আসছে। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে এলো।
নিজের ঘরে এসে ফোনটা হাতে নিলো, কোনো কিছু না ভেবেই কল করে বসলো নাম্বার টাতে, তিন থেকে চারবার রিং হতেই ফোনটা রিসিভ হলো, তাথই অপরপক্ষের ‘হ্যালো’ টুকু শোনার ও অপেক্ষা করলো নাহ, অস্থির হয়ে বলল
– একটা কোনো বাজে কথা শুনবো নাহ। কি হয়েছে আমাকে এক্ষুনি বলুন। সবটা বলুন আমি এখনই শুনবো
(………….)
______________________________
নিকষ অন্ধকারে মত্ত ভুতুড়ে পরিবেশ। এক বিন্দু শব্দের উৎস নেই কোথাও। ঘরের সমস্ত লাইট নেভানো। বিছানাতে চিত হয়ে শুয়ে একটা নিস্তেজ শরীর। কাঁপা কাঁপা চোখ দুটো বুজে। আদও ঘুমের বিভোর নাকি জাগ্রত না থাকার প্রয়াস তা বোঝা সম্ভব নাহ। বারান্দার স্লাইডির দরজাটা হাট করে খোলা, তার ফাঁক দিয়ে হেমন্তের হীম হীম হাওয়ার অগাধ বিচরণ পুরো ঘর জুড়ে। চাঁদের আলোয় আজ অন্যরকম মায়া। পুরো পরিবেশ টাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে চন্দ্রিমা তার নিগূঢ় মায়াতে। সম্মোহনী হয়ে সমস্ত ধরণী টা যেনো মত্ত চাঁদের রূপালী আলোতে গা ভেজাতে।
নিস্তব্ধতা আর নিকষ আঁধারের হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা ভঙ্গুর হলো দরজা খোলার ক্যাচ জাতীয় শব্দে, খুব সাবধানী হাতে খোলায় শব্দটার উৎপত্তি। আস্তে আস্তে দুটো পদক্ষেপ ধীমি গতিতে এগিয়ে আসতে থাকলো, এক পা দুই পা করে লম্বা পায়ের ছোট ছোট পদক্ষেপ টা এসে থামলো একেবারে মোহরের গা ঘেঁষে। মোহর তখনো চোখ বুজে, শব্দটা কি মোহরের কান অব্দি পৌঁছায়নি? কারো উপস্থিতির কড়া ঘ্রাণ কি ওর নাকে যায়নি? খুব সন্তপর্ণে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো ছায়ামূর্তিটা। এক হাত তুলে মোহরের মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো। চাঁদের আলোতে মায়াবী মুখের ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থাটা বুকের ভেতর জ্বলন ধরিয়ে দিলো। রাগ, ক্রুদ্ধতা, পীড়ন সব মিলিয়ে অনুভূতিরা অসহনীয় হয়ে উঠলো।
ধপ করে উঠে দাঁড়িয়েই মোহরের হাঁটুর নিচে আর ঘাড়ের পেছনে হাত রেখে তুলে নিলো। বুকের কাছাকাছি জড়িয়ে নিলো অচেতন নিষ্প্রতিভ শরীর টাহ। খোলা দরজাটা পার করে, সিড়ি ভেঙে, দরজার চৌকাঠ মাড়িয়ে বেরিয়ে এলো। আস্তে আস্তে বাড়ির চৌহদ্দি টাও পেরিয়ে এলো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাম দিকে মিটার দশেক হেঁটেই থামলো ঘাসে আবৃত একটা স্থানে।
বুকের কাছে লেপ্টে থাকা শরীর টা নড়েচড়ে উঠলো।
এতটা পথ আসার পথেও হাঁটার ঝাকিরে একবার ও কি চোখ খোলেনি মোহর! একটা বার ও কি টের পেলো না কে ওকে রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে তুলে এতদূর নিয়ে এলো! পা দুটো আরও কয়েক কদম এগিয়ে এলো, ঘাসের আবৃত নরম জায়গা টাতে বসলো, কোলের মাঝের শরীর টাকে আরও নিগূঢ় ভাবে জড়িয়ে নিলো। মিনিট পাঁচের অতি নিঃশব্দে অতিবাহিত হলে খলখল পানির শব্দের সাথে আরও একটা শব্দ কানে এলো। খুবই ক্ষীণ, দূর্বল স্বরটা বলল
– আপনি এসেছেন রুদ্ধ?
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। টাইফুনের তাণ্ডবের চেয়েও প্রবল উত্থাল পাথাল ঝড় উঠলো অন্তর মাঝে। ভেতরে ছুটোছুটি করা অস্থিরতম উত্তেজনা, বেদনা টাকে সন্তপর্ণে সামলে ভীষণ নরম আদুরে গলায় জবাব এলো
– এসেছি মোহ, এসেছি
.
.
.
চলমান
©Humu_❤️